নবম পরিচ্ছেদ— অন্তিম সমাধান
(এই অংশটিতে ব্রিটিশ সরকারের গোপন সেবা বিভাগের তরফ থেকে যে গোপন নথি প্রস্তুত করা হয়েছিল তার প্রয়োজনীয় অংশ প্রায় অবিকল প্রকাশ করা হল। মূল নথিটি ইংরাজিতে লেখা। যদিও এখানে তার ভাষান্তর করা হয়েছে। সম্পূর্ণ নথিটির উৎস বিশেষ কারণে গোপন রাখা হচ্ছে। পাঠকরা মার্জনা করবেন)
This Document is the property of Her
Britannic Majesty’s Government
Printed on November, 1895
CONFIDENTIAL
(On Her Majesty’s Secret Service)
THE PAST AND PRESENT
OF FREEMASONS IN
BRITISH EMPIRE
Memorandum prepared by Mr. M. Holmes
বিষয়— ফ্রিম্যাসন
সদস্যরা মানুন বা নাই মানুন ফ্রিম্যাসন অবশ্যই এক গুপ্ত সমিতি, যার কিছুটা এঁরা প্রকাশ করেন আর অনেকটাই একান্ত গোপনীয়। এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডে প্রায় ১০০০০-এর কাছাকাছি ফ্রিম্যাসন আছেন, যাঁদের মধ্যে বড়োজোর ১০০০ জন নিজেদের ফ্রিম্যাসন বলে স্বীকার করেন। এই অদ্ভুত গুপ্তসমিতির সব সদস্যই আদলে গড়ে উঠলেও ধীরে ধীরে আবশ্যিকভাবে পুরুষ। এতে নৈতিকতা, আদর্শ, ভ্রাতৃত্ববোধের ম্যাসনিক লজগুলো নানা গোপন কাজকর্মের আস্তানা হয়ে উঠেছে। যদিও এঁরা দাবি করেন পৃথিবীর শুরুতে আদমের সময় থেকে এই ম্যাসনদের উৎপত্তি, কিন্তু আধুনিক ম্যাসনদের শুরু স্কটল্যান্ডে। এর আগে প্রাচীন রোম ও মিশরেও নাকি এঁরা ছিলেন। এঁদের শুরু হয়েছিল…….
(এখানে এরপর চার পাতা জুড়ে ফ্রিম্যাসনদের উৎপত্তি, ইতিহাস ও ব্যাপ্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মূল কাহিনিতে অপ্রয়োজনীয়বোধে তা বর্জিত হল)
১৮৭৭ সালে আমাদের বিভাগ অদ্ভুত এক তথ্য আবিষ্কার করে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রায় প্রতিটি স্তরের কর্মচারীর কেউ না কেউ (কখনও একাধিক কর্মচারী) সরাসরি বা গোপনে ফ্রিম্যাসনদের সঙ্গে যুক্ত। শুধু তাই নয়, তারা ফ্রিম্যাসনদের থেকে নানা উৎকোচ গ্রহণ করে যে- কোনোরকম পাপকাজ করতেও পিছপা হয় না। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে এই ধরনের দুর্নীতির শুরু করেন ইন্সপেকটর জন মেকলিজন নামে এক পুলিশ অফিসার। তিনি নিজে ম্যাসনিক লজের সদস্যই ছিলেন না, তখনকার বেশ কিছু বিখ্যাত ও কুখ্যাত মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। বিখ্যাতদের মধ্যে প্রধান ছিলেন লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসন, বেডলামের চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিক এলি হেনকি (জুনিয়র), অভিনেতা হেনরি আরভিং প্রভৃতি। মেকলিজনের আমলে ইয়ার্ডের সেরা সব গোয়েন্দা– জর্জ ক্লার্ক, উইলিয়াম পামার, নাথানিয়েল ডুস্কভিচ— সবাই গোপনে ফ্রিম্যাসন ছিলেন বা তাঁদের সাহায্য করতেন। মেকলিজন, ক্লার্ক আর পামার মিলে বড়ো কিছু এক ষড়যন্ত্রের চক্রান্ত করেন। তার আভাস পেয়েই সরকার তাঁদের বরখাস্ত করেছিলেন। এলি হেনকিকে বেডলামের ডিন পদ থেকে বরখাস্ত করে সাধারণ চিকিৎসকের পদে আসীন করা হয়। তিনি ফ্রিম্যাসনদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে বেডলামেই ছাত্র পড়ানোতে মন দেন। স্টিভেনসন ও আরভিং-এর ওপরেও নজর রেখে দেখা হয়েছে। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। গতবছর স্টিভেনসনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। গত বছর ৩ ডিসেম্বর বিকেলে তাঁর বাড়িতে এক অপরিচিত অতিথি দেখা করতে আসেন। রাতে ডিনারের সময় ওয়াইনের বোতল খুলতে গিয়ে তিনি তাঁর স্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, “এই বোতলে কী আছে?” এক ঢোঁক খেয়েই চিৎকার করে ওঠেন, “আমায় কি অন্যরকম লাগছে?” আর তারপরেই চেয়ারে ঢলে পড়েন। এই মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটিত হয়নি, কারণ মদ পরীক্ষা করে ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা কিছুই পাননি। শুধু তাঁরাই নন, একজন বেসরকারি গোয়েন্দা (নাম উহ্য রাখা হল) সেই মদ পরীক্ষা করে জানিয়েছেন কোনও চেনা রাসায়নিকের অস্তিত্ব নেই তাতে।
উইলিয়াম পামার আমাদের গোপন সেবা বিভাগের চোখ এড়িয়ে ভারতবর্ষে পালিয়ে যান অনেক আগেই ওলন্দাজরা তাদের এবং হুগলীতে আশ্রয় নেন। ব্রিটিশরা ভারতে বাণিজ্য স্থাপনের ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ওই দেশে বাণিজ্য করত। তারা হুগলী জেলার চুঁচুড়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে। ডাচদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ফ্রিম্যাসনদের সদস্য। বিশেষ করে তাদের গভর্নর জি ভার্নেৎ হুগলীর ওলন্দাজ ও চন্দননগরের ফরাসিদের নিয়ে বৃহত্তর ফ্রিম্যাসন সংঘ গঠন করেন। ১৭৬৩ সালে তিনিই ওলন্দাজদের গির্জাটি সম্পূর্ণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই সংঘ ছিল একেবারেই অহিংস ও ভ্রাতৃত্বভাবাপন্ন ধীরে ধীরে বেশ কিছু ইংরেজ ব্যক্তিও ওলন্দাজদের সংস্পর্শে এসে এই সংঘের সদস্য হন। তাঁদের মধ্যে ইংরেজ আইনজ্ঞ উইলিয়াম হিকিও ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল চুঁচুড়ায় অবস্থান করেছিলেন। আর যেসব ইংরেজ অভিজাতরা…
(এখানে একটি লম্বা তালিকা আছে। কোন কোন ইংরেজ রাজপুরুষ চুঁচুড়ার ওলন্দাজ ফ্রিম্যাসনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তাঁদের নাম ও বর্ণনা সহ)
উপবিষয়— জাবুলন
১৮৮৬ সালের অক্টোবর মাসে আমাদের বিভাগে একটি গোপন সূত্রে খবর আসে যে ইংল্যান্ডের ফ্রিম্যাসনদের মধ্যে নতুন একটি শাখা মাথা চাড়া দিয়েছে। শাখাটি এতই সতর্ক যে ফ্রিম্যাসনদের বেশিরভাগই এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নন। জাবুলন শব্দটির অর্থ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য জানা গেছে। কারও মতে ইনিই প্রথম সলোমনের মন্দির থেকে তাঁদের উপাস্য দেবতা জিহোবার বাণী উদ্ধার করেন। কারও মতে ইনি স্বয়ং জিহোবা। তবে এরা অন্য ফ্রিম্যাসনদের মতো নিরীহ বা শুধু জ্ঞানচর্চা কিংবা সৌভ্রাতৃত্বে আগ্রহী নয়। এদের লক্ষ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। মতের দিক থেকেও বাকি ফ্রিম্যাসনদের ঔদার্য এদের মধ্যে নেই। উদ্দেশ্য একটাই। সারা বিশ্বে জাবুলনদের আধিপত্য স্থাপন করা।
ফ্রিম্যাসনদের এই শাখাটি দলের অভ্যন্তরে ১৮৮০ নাগাদ প্রথম মাথা চাড়া দেয়। কিন্তু তাদের বিশেষ সমর্থক ছিল না। ১৮৮৫ সালে এমন কিছু একটা ঘটে যার ফলে জাবুলন গোষ্ঠী পালে হাওয়া পায়। দলের মধ্যে, এমনকি দলের বাইরের অনেকেই তাদের এই চরমপন্থী আদর্শ সমর্থন করতে থাকেন। এঁদের মধ্যে লন্ডন শহরের বিখ্যাত মানুষরাও ছিলেন। কিন্তু এই গোষ্ঠীর গোপনীয়তা এতই বেশি যে যখনই আমাদের বিভাগের থেকে জাবুলন বিষয়ে কোনও খোঁজ করার চেষ্টা হয়েছে, প্রতি ক্ষেত্রে তদন্তের ফলস্বরূপ কেউ না কেউ খুন হয়েছেন। জাবুলনদের খুনের পদ্ধতি মধ্যযুগীয়। তারা যাকে অপরাধী মনে করে তার সারা শরীর ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফালাফালা করে কেটে দেয়। পুরুষ হলে তাঁর যৌনাঙ্গটি ছেদ করে দেয়া, আর মহিলাদের ক্ষেত্রে তাঁর গর্ভাশয়টি দেহের আর বাইরে এনে কেটে পাশে রেখে দেয়। আদিম ম্যাসনিক আচরণে সর্বোচ্চ শাস্তির প্রতিবিধান এমনই। কিন্তু আজ অবধি কোনও আধুনিক ম্যাসন এই পদ্ধতি অনুসরণ না করলেও জাবুলন গোষ্ঠী আবার এই জঘন্য আচরণকে ফিরিয়ে আনতে চলেছে।
.
উপ-উপবিষয়— জাবুলনদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকারের পদক্ষেপ পোলক ছদ্মনামধারী এক ব্যক্তির থেকে পাওয়া চিঠিতে প্রথম জানা যায় লন্ডনে এই জাবুলনদের নানারকম শয়তানি পরামর্শ দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর এক অধ্যক্ষ। নাম প্রফেসর জেমস মরিয়ার্টি। ১৮৮৮ সালের শরতে হোয়াইটচ্যাপেলের পাঁচজন মহিলা দেহোপজীবিনীর কাছে এক গোপন তথ্য আসে। আমাদের বিশ্বাস সেই তথ্যে সরাসরি ইংরেজ সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের বিভাগ থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের আগেই নৃশংসভাবে তাঁদের খুন করে এই গোষ্ঠী। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা ১৮৮৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর লন্ডনের সেন্ট্রাল এজেন্সিতে খুনের দায় নিয়ে একটা চিঠিও পাঠিয়েছিল। তলায় সই ছিল— জ্যাক দ্য রিপার। কিন্তু আমাদের স্থির বিশ্বাস, এই রিপার কোনও ব্যক্তি নয়, দল। খুনের মোডাস অপারেন্ডি অনেকটা এক হলেও একেবারে এক নয়। একাধিক মানুষের দ্বারা খুনগুলো হয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমরা লন্ডনের সেরা কনসালটিং ডিটেকটিভের পরামর্শ নিয়েছি। তিনি এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইনস্পেকটর লেস্ট্রেড ও টোবিয়াস গ্রেগসন একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এই সবকিছুর পিছনে মাথা যে প্রফেসর, তাঁকে আইনি পথে ধরাছোঁয়া যাচ্ছিল না। আইনি পথে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না দেখে আমরা এক বেসরকারি গোয়েন্দার সাহায্য নিই। তিনি মরিয়ার্টিকে ভুয়ো চিঠি লিখে রাইখেনবার্গ জলপ্রপাতের ধারে নিয়ে যান।
মরিয়ার্টি সমস্যা সমাধান হলে আমরা ভেবেছিলাম জাবুলনরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তখনই পোর্লকের থেকে আবার খবর আসে বেডলাম হাসপাতালের কিছু ডাক্তার তলায় তলায় জাবুলনদের সদস্য হয়েছেন। চিকিৎসক, বিশেষ করে শল্যচিকিৎসকরা যে এই দলে থাকতে পারে সে সন্দেহ আমাদের হোয়াইটচ্যাপেল খুনের সময় থেকেই ছিল। এত নিপুনভাবে মানবদেহ অন্য কেউ কাটাছেঁড়া করতে পারে না। এই বেডলামের চিকিৎসক প্রাক্তন ফ্রিম্যাসন এলি হেনকি (জুনিয়র)-এর ছাত্র রিচার্ড হ্যালিডে ভারতে পালিয়ে আসা বৃদ্ধ উইলিয়াম পামারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ১৮৯২ সালে হ্যালিডে আর তার সৎভাই ম্যাজিশিয়ান হ্যারি জনসন ভারতে যাত্রা করলে আমরা এক বিশ্বস্ত গোয়েন্দাকে ভারতে পাঠাই ও মহারানির কর্মচারীদের সাহায্য নিয়ে হ্যালিডেকে নিরস্ত করি।
হ্যালিডে ও জনসনের মৃত্যুর পরে প্রায় তিন বছর জাবুলনদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা ভেবেছিলাম এই গোষ্ঠী অন্য গোপন সমিতির মতো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ইদানীং ভারতে আমাদের গুপ্তচর বিভাগ জানিয়েছে জাবুলনরা নাকি ভয়ানক কোনও এক পরিকল্পনা করছে। এদের মাথা কে, কারাই বা এর মদত দিচ্ছে, এই বিষয়ে সঠিক কিছুই জানা যাচ্ছে না। তবে একটা শব্দ বাতাসে ঘুরছে, ‘অন্তিম সমাধান’, ‘ফাইনাল সলিউশান’ সেটার প্রকৃতি কী, বা কেমন করে সেটা করা যাবে, সে বিষয়েও আমাদের বিভাগ সম্পূর্ণ অন্ধকারে। ইদানীং ভারতবর্ষে কিছু নেটিভ বিপ্লবী গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়েছে। তারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন চালাচ্ছে। জাবুলনদের সঙ্গে এদের যোগাযোগের সম্ভাবনাকেও আমরা খতিয়ে দেখছি।
ইদানীং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আচমকা, অযাচিত দাঙ্গার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এবার জাবুলনের লক্ষ্য আরও বড়ো। আরও নৃশংস। আমাদের বিভাগের বিশ্বাস এবারের লক্ষ্য “গণহত্যা, মাস মার্ডার।” সেটাই এরা কীভাবে করতে চলেছে, শেষ সমাধানের সঠিক মানেই বা কী, ইত্যাদি সরেজমিন তদন্ত সরকারি স্তরে করায় বিভিন্ন অসুবিধা হতে পারে। আমি তাই স্বয়ং মহারানিকে অনুরোধ করছি গতবার আপনার একান্ত অনুগত ভৃত্য বেসরকারি গোয়েন্দাটিকে পাঠানো হয়েছিল, তাঁকেই আবার ভারতে পাঠানো হোক। প্রয়োজনে নিজের আইন তুলে নেবার ক্ষমতাও যেন তাঁকে প্রদান করা হয়।
এই রিপোর্ট এখানেই শেষ হল।
আপনার একান্ত অনুগত ভৃত্য
মাইক্রফট হোমস,
সেক্রেটারি, ডায়োজেনিস ক্লাব।