নবপত্রিকা

নবপত্রিকা

নামটা শুনলেই মেয়ের নাম দিতে ইচ্ছে করে ‘নবপত্রিকা’। নবপত্র মানে নয়টি পাতা, নয়টি গাছ। সেখান থেকে একটা স্ত্রীলিঙ্গ রূপ করলে দাঁড়ায় নবপত্রা অথবা নবপত্রী। যে ‘শব্দার্থ-নির্মাণ-নিপুণ’ কবি এই শব্দ তৈরি করেছিলেন তাঁর মধ্যে অদ্ভুত এক মায়া-স্নেহ কাজ করেছে। ফলে শব্দটাকে নবপত্রী বলেও শান্তি হল না তাঁর। তাই বললেন নবপত্রিকা। সংস্কৃতে ‘ক’-প্রত্যয় ক্ষুদ্র বা অল্প অর্থে ব্যবহৃত হয়—যেমন, ‘মানব’ মানে মানুষ কিন্তু ‘মানবক’ মানে বাচ্চা। তেমনি নবপত্র যখন নবপত্রিকা হয়ে দাঁড়ায় তখন তার অর্থ দাঁড়ায় নয়টি গাছ-পাতা। কিন্তু এই শব্দটাই আবার বাঙালির দুর্গাপূজার কালে একটা রূঢ় অর্থ ধারণ করে, দুর্গাসপ্তমীর দিন নদী-পুষ্করিণীতে নবপত্রিকাকে স্নান করালে তবেই দেবীকে জাগ্রত করা বা ষষ্ঠী-বোধনের অবশেষ রচনা করা হয়।

যদি সপ্তমী থেকে ধরা হয়, তবে বলতে হবে দুর্গাপূজার মহারম্ভ কিন্তু এই প্রকৃতিজাত বৃক্ষ-লতার সঙ্গে দুর্গার একাত্মতা দিয়েই। ন’টি পত্রশোভিত বৃক্ষকে একত্রিত করে দুর্গাসপ্তমীর প্রাতে যে শস্যবধূর দৈবরূপ তৈরি হয়, তখনই বিদেশি গবেষকদের মহতী জল্পনা শুরু হয়, তাঁরা সঘোষে বলতে থাকেন—দুর্গা প্রথমত এক ‘ভেজিটেশন ডেইটি’, তা না হলে এক যুদ্ধমত্তা রমণীকে নয়টি দেশজ সাধারণ বৃক্ষের পূজার্চনায় আবদ্ধ করা যেত না। আর এমনই অলঙ্ঘ্য আচার দুর্গাপূজার আরম্ভই হয় এই নবপত্রিকার পুজো দিয়ে। তার মানে—অন্তত ওঁরা এই যুক্তিতেই বলেন যে, তার মানেই হল ‘ভেজিটেশন ডেইটি’ হিসেবেই মা দুর্গার ‘প্রায়রিটি’।

আমাদের এখানে বক্তব্য হল—এই ধরনের প্যাটার্ন, রিচুয়ালিস্টিক প্যাটার্ন তৈরি করে ভারতবর্ষের দেব-দেবীর বিচার করা যাবে না—এতটাই তাঁরা জটিল। তা ছাড়া ওঁদের এটা বুঝতে হবে যে, আমাদের দেব-দেবীর পূজা-আরাধনা থেকে আরম্ভ করে যে কোনো সাধারণ গার্হস্থ উৎসবের ক্ষেত্রেও আমরা খুব ক্ষুদ্র বস্তুকে বৃহৎ করে নিতে ভালোবাসি। খেয়াল করে দেখুন—আমরা যদি শুধু একবার পুজো করতে বসি তাহলে পূজায় বসার আসনখানিকে পর্যন্ত দেবপূজার যোগ্য করে তোলার জন্য সেটাকে এক বিশ্বজনীন আধার শক্তি হিসেবে কল্পনা করি। এখানে মন্ত্র-কল্পনায় সামান্য পূজার আসনটুকুও হয়ে ওঠে এই পৃথিবী। পৃথিবী যেহেতু আমাদের ধারণ করে তাই বৃহদভাবনায় ধরিত্রীই হয়ে ওঠেন আসন—পৃথ্বি ত্বয়া ধৃতা লোকাঃ।

একইভাবে একটা ঘটস্থাপনই কি খুব সহজ কাজ! একটি ঘট স্থাপন করতে গেলে তার তলায় মাটি দিতে হবে পৃথিবীর অনুকারে, সেই মাটির ওপর যব, তিল, ধান, মাষ ইত্যাদি পঞ্চশস্য দিতে হবে ‘ভেজিটেশন’-এর কথা মনে রেখে, ঘটকে অলংকৃত করতে হবে সিন্দুরের রক্তিম শোভা দিয়ে, তার ওপর আবার একটা আমগাছের পঞ্চপল্লব—মানে আবার ‘ভেজিটেশন’। তারপর সেই ঘট মন্ত্রের উচ্চারণে দেব-দেবীর সমার্থক হয়ে উঠবে। আমরা তাই বলতে চাই, ভেজিটেশন দেবতার একটা অঙ্গমাত্র, দেবতা পুরোটাই ‘ভেজিটেশন ডেইটি’ নন।

অন্যান্য সাধারণ একটি পূজাতেই যেখানে এত আড়ম্বর সেখানে দুর্গাপূজার মতো এক বিরাট উৎসব যেটা চারদিন ধরে চলে, সেই সাড়ম্বর পূজায় আমাদের কৃষিজ সম্পত্তি এবং পরিবেশের একটা ঐকতান তৈরি হবে না? বস্তুত সেই ঐকতানের সুরই নবপত্রিকা। মনে রাখতে হবে যে, মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় ভগবতী দুর্গার বোধন, অধিবাস এবং মায়ের আমন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে নবপত্রিকারও অধিবাস, আবাহন করতে হয় এবং সেই মুহূর্তেই ভগবতী দুর্গার সঙ্গে নবপত্রিকাও একাকার একাত্মক হয়ে যায়। গন্ধ, পুষ্প এবং মাল্যের উপচারে মন্ত্রটা শুনলেই বুঝবেন—ভগবতী দুর্গা এখানে বিশেষ্য-বিশেষণভাবে একাত্মক হয়ে আছেন—অনেন গন্ধেন ভগবদ্দুর্গায়াঃ নবপত্রিকায়াশ্চ শুভাধিবাসনমস্তু।

দুর্গাপূজার সপ্তমী-বিহিত কর্মে সকালবেলায় উঠেই প্রথম এবং প্রধান কাজটি হল নবপত্রিকার প্রতিষ্ঠা। আমাদের লৌকিক ভাষায় কলা-বউ স্নান করিয়ে আনা এবং মণ্ডপে নবপত্রিকার প্রতিষ্ঠা। নবপত্রিকা কথাটার সাধারণ অর্থ হল নয়টি পাতার সমাহার। কিন্তু এক-একটা শব্দ মাঝে মাঝে একটা লক্ষণ তৈরি করে—যেমন সামান্য দূরস্থ ফুচকাওয়ালাকে আমরা ‘ফুচকা’ বলেই ডাকি, এবং ‘ফুচকা’ সম্বোধনে যেমন সেখানে ফুচকাওয়ালাকেই বোঝায়, এখানেও তেমনি নবপত্রিকা বলতে অর্থাৎ নয়টি পাতা মানে আসলে নয়টি গাছ, নয়টি উদ্ভিদ। এই নদী-পুষ্করিণীর বাংলায় যে উদ্ভিদগুলি ভগবতী দুর্গার প্রথম অবয়ব তৈরি করে, তার মধ্যে অনেকগুলি বাংলার অতিসাধারণ মানুষের খাদ্য।

নবপত্রিকার প্রধান উদ্ভিদ হল কলাগাছ—’ফার্টিলিটি’ আর ‘ভেজিটেশনে’র চূড়ান্ত প্রতীক। মা দুর্গার সঙ্গে একাত্মতায় একটি কদলী বৃক্ষ প্রধান উদ্ভিদ হিসেবে বঙ্গদেশের শত-কোটি সন্তানের জননী-প্রতীক হয়ে ওঠে। এই চরম উর্বরীর সঙ্গে আর আটটি উদ্ভিদ হল কচু—আমাদের ধারণা—এটা মুখী কচু; কেননা ভাদ্রের শেষে আশ্বিনের প্রথমে এই কচুর বহুল ফলন গরীব গার্হস্থ জীবনে অন্নের আস্বাদন তৈরি করে। একই বর্গের আর এক খাদ্য হল মানকচু—বর্ষার পরে শরতের রোদ্দুর পেলে এটাও বড়ো সুস্বাদু। ফলের জায়গায় আছে বেল এবং দাড়িম্ব। এখানে বিল্বফল নিয়ে কোনো কথার প্রয়োজনই নেই। বেলগাছ এবং বেলপাতা যেহেতু শিব এবং পার্বতীর প্রিয়তম, অভীষ্ট পুজোপচার, তাই এটি তো দুর্গাপূজার যে কোনো অঙ্গেই প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।

দ্বিতীয় ফলটি হল দাড়িম্ব, আমাদের লৌকিক ভাষায় ডালিম। আশ্বিন মাস থেকে অঘ্রান মাস পর্যন্ত এই ফলন হয়। রোগের পর এই ফল শক্তিবর্ধক এবং রক্তবর্ধক। বাংলায় এই ফল বহু জন্মায় বলেই এই ফলের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে নবপত্রিকার মধ্যে। পুষ্পবৃক্ষের মধ্যে আছে জয়ন্তী এবং অশোক। এই দুটি বৃক্ষই আয়ুর্বেদের মহৌষধ। অশোকারিষ্টের কথা ছেড়েই দিলাম, জয়ন্তী বৃক্ষ দুর্গাদেবীর নামাঙ্কিত একটি দেববৃক্ষ। জয়ন্তী দুর্গার একটি নাম, দুর্গার অষ্টনায়িকার একজন। তাঁর নামাঙ্কিত এই বৃক্ষটির বীজ আয়ুর্বেদের বহু ঔষধের উপাদান। শক্তি এবং উত্তেজনা জয়ন্তী-বীজের সাধারণ গুণ, স্ত্রীরোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও জয়ন্তীর উপাদেয়তা আছে আয়ুর্বেদে। এরও ফলন আশ্বিনের শেষে।

শেষটি হল কন্দ জাতীয় বৃক্ষ—হরিদ্রা বা হলুদ। কাঁচা হলুদ থেকে পাকা হলুদ—এর সবটাই এমন আদি-মধ্যান্ত মাঙ্গলিক—পেটের পক্ষে এবং রান্নায়, বৈবাহিকতায় এবং পূজার্চনায় যে, হরিদ্রা নবপত্রিকার প্রয়োজনীয়তম অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

লক্ষণীয়, সময়োচিত ফলিনী বৃক্ষ, আয়ুর্বেদিক বৃক্ষ, দেবতার অভীষ্ট বৃক্ষ এবং সবার ওপরে reproduction and sustenance-এর প্রতীক সেই কদলী বৃক্ষ—নয়ের সমাহারে নবপত্রিকা ভগবতী দুর্গার আবাসিক শস্যবধূ, বাঙালির দেবতা হয়ে ওঠেন। এখানে জানানো দরকার যে, নবপত্রিকার প্রত্যেকটি উদ্ভিদ, ফল এবং ফুলের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরা এইদিন সকলেই দুর্গার এক-একটি রূপ এবং সমাহারে তাদের নবদুর্গা বলা হয়। পুজোর সময় বলতে হয়—নবপত্রিকার আবাসিনী নবদুর্গাকে আমার প্রণাম—নবপত্রিকা-বাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ।

এবার বলি—বেশ ভালোই লাগে আমার! এক দল মানুষ যখন ঢাক-ঢোল বাজিয়ে একজন বলিষ্ঠ পুরুষের হাতে নবপত্রী শস্যবধূকে ভগবতী দুর্গার গরিমায় তুলে দেন, তখন পথিমধ্যে সেই পুরুষের নিষ্ঠা, ভক্তি দেখে আমার মোহিত হতে ভালো লাগে। নবপত্রিকাকে ভগবতীর রূপে সাজিয়ে তোলাটা বাঙালির শিল্পবোধের চরম পরিচয়। একটা গোটা কলাগাছের সঙ্গে আরও আটটা গাছ বা গাছের ডালকে বেঁধে নিয়ে সেটাকে যদি লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে দেওয়া যায় এবং তদুপরি কলাগাছের ওপর থেকে নেমে-আসা সর্বোচ্চ পাতাটির ওপর লালপেড়ে কাপড়টি দিয়ে ঘোমটা টেনে দেওয়া যায়, আবার সেই পাতাটির ওপরেও যদি তেল-সিঁদুর মাখিয়ে এয়োতির চিহ্ন প্রকট করে তোলা যায়—তাহলে সেই নবপত্রী শস্যবধূর নবদুর্গা হয়ে উঠতে সময় লাগে না। সপ্তমীতে বাঙালির শিল্পিত হস্তাঙ্গুলি-চালনায় নবপত্রিকার এই মানবায়িত কায়-ন্যাসই শেষপর্যন্ত সেটিকে গণেশের কলা-বউতে পরিণত করেছে।

সত্যি কথা বলতে কী, নবপত্রিকা দুর্গারই প্রতীক, তিনি দুর্গারই স্বরূপ, নবপত্রিকার সঙ্গে গণেশের খুব একটা সম্পর্ক থাকার কথা নয়। সম্পর্ক নেইও, কিন্তু বাঙালির মন হল মহাকবির উদার হৃদয়ের মতো ‘অপূর্ব-নির্মাণ-নিপুণ’। যা আগে হয়নি, তেমনই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে বাঙালি। এটা তো সত্যি কথা—বড়ো ছেলে গণেশের তো বহু বয়স পর্যন্ত বিয়েই দিতে পারেননি পার্বতী। ওইসব ঋদ্ধি-সিদ্ধির মতো ‘অ্যালিগোরিক্যাল’ স্ত্রী দিয়ে এক মানবায়িত দেবতার নিজেরই কোনো শুভলাভ হয়নি বলে বাঙালি ভগবতী দুর্গার বড়ো ছেলের জন্য পাত্রী পছন্দ করে রেখেছে—কলা-বউ। হস্তী-মুণ্ড গণেশ তাঁর গজ-ভাবে কলাগাছ খেতে কতটা পছন্দ করেন, সেটা যে কোনো হাতির সামনে কদলী-খণ্ড রেখে পরীক্ষা করতে পারেন। আর স্ত্রী-পুরুষের যৌনসম্পর্কের মধ্যে খুব স্থূলদৃষ্টিতে যদি একটা খাদ্য-খাদক সম্পর্ক কল্পনা করা যায়, তাহলে বাঙালির শিল্পচেতনায় ঋদ্ধির প্রতীক শস্যসম্পদ হিসেবে কদলীবৃক্ষের প্রাধান্য আরও আটটি ঋদ্ধি-পুষ্টির বৃক্ষালঙ্করণ গণেশের স্ত্রী হিসেবে মন্দ কী?

নদীতে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে এনে তাঁকে স্থাপন করার কথা ভগবতী দুর্গার দক্ষিণ পাশে। প্রাচীন বাঙালিরা নিয়মাচার মেনে দুর্গার দক্ষিণ ভাগে নবপত্রিকা রাখার চেষ্টা করতেই নবনির্মিত দুর্গার অপূর্ব মূর্তির পাশে লজ্জায় ভেঙে-নুয়ে-পড়া কদলী বৃক্ষটিকে স্থাপন করাটা বাস্তব-সম্মতভাবেই কঠিন হয়ে পড়ল। বাঙালি মনে করে—এই অবস্থায় গণেশের গজ-নিমিলিত চক্ষেও শস্যবধূর এই লজ্জানম্রা রূপটি ধরা পড়ে যায়। তাতে গণেশ ভাবলেন—স্নেহময়ী জননী তাঁরই জন্যে যেন কনে খুঁজে এনেছেন। আর মায়ের দক্ষিণে যাঁর থাকার কথা, তিনিই তো গণেশের বামাবতী, তাঁর বাম দিকেই তো তাঁর স্ত্রীর অবস্থান হওয়ার কথা। অতএব আবেগপ্রবণ বাঙালি-হৃদয়ের ঠেলায় নবপত্রী কলা-বউ গিয়ে পৌঁছোলেন গণেশের বাম পাশে, তাতে গণেশের বউই হয়ে গেলেন তিনি। লোক প্রচলিত ভাবনায় সপ্তমী-প্রাতের স্নানার্দ্রকেশিনী নবপত্রিকা এতটাই কলাবউ হয়ে উঠলেন যে, কদলী-বধূর বস্ত্রভেদী কলার মোচাটি দেখে বাঙালি-ঘরের শ্বশুর-প্রতিম শঙ্কর-মহাদেব নাতি-পুতির মুখ দেখার আশায় পার্বতী-ঘরনিকে বলছেন—

 ও গণেশের মা!
 কলাবউকে দাগা দিয়ো না।
 ওর একটি মোচা ফললে পরে
 কত হবে ছানাপোনা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *