ধূর্জটিবাবুর প্ল্যানচেট
পলাশ বলল, ‘কিরে নিলু, পর পর চারটে ট্রেন চলে গেল৷ অনির্বাণ তো এখনও এল না? এদিকে তোর ধূর্জটিবাবুরও কোনো পাত্তা নেই! তিনি আবার বাঘমুণ্ডি পাহাড়ে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসতে চলে গেলেন না তো?’
নিলু বলল, ‘দেখ পলাশ, সিদ্ধপুরুষদের নিয়ে মজা করবি না৷ বাঘমুণ্ডি নয়, উনি অমাবস্যা রাতে তারাপীঠের মহাশ্মশানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে শবসাধনা করেছিলেন৷ উনি যখন কথা দিয়েছেন, তখন নিশ্চয়ই আমাদের নিতে আসবেন৷ তুই মোবাইলে আর এক বার ট্রাই কর অনিবার্ণকে৷ ও আবার ঘাবড়ে গেল না তো? শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ে বসে প্ল্যানচেট-ভূত-প্রেত নিয়ে মজা করা, আর এখানে এসে সত্যিকারের প্রেতসিদ্ধ জ্যোতিষীর মুখোমুখি প্ল্যানচেটে বসা, এ দুইয়ের মধ্যে অনেক তফাত!’
নিলুর খোঁচাটা বুঝতে অসুবিধে হল না পলাশের৷ ও বলল, ‘ঝড়বৃষ্টির মধ্যে হয়তো কোথাও আটকে গিয়েছে৷ ওর কথার দাম আছে৷ আর ও যে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসি ছেলে, তা তো তুই জানিস৷’ এই বলে সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য প্ল্যাটফর্মের শেডের আর একটু ভিতরে এসে দাঁড়াল৷ অনির্বাণকে রিং করার চেষ্টা করে কানে দিয়ে কয়েক মুহূর্ত পর সেটা আবার কান থেকে নামিয়ে নিল পলাশ৷
নিলু প্রশ্ন করল, ‘কী হল?’
পলাশ জবাব দিল, ‘নেটওয়ার্ক ফেলিওর এখনও৷ যা ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে কখন নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে কে জানে?’
তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই কড়াৎ কড়াৎ শব্দে কাছেই কোথাও যেন বাজ পড়ল৷ সারা প্ল্যাটফর্ম কেঁপে উঠল সেই শব্দে৷ আর কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যে নামবে৷ বৃষ্টিরও বিরাম নেই৷ ঝাপসা হয়ে যাওয়া বাইরের দিকে তাকিয়ে পলাশ বলল, ‘ধূর্জটিবাবুর বাড়ি এখান থেকে কত দূর?’
নিলু জবাব দিল, ‘গাড়িতে আধ ঘণ্টার পথ৷ উনি গাড়ি নিয়ে আসবেন বলেছেন৷’ এরপর সে বলল, ‘অনির্বাণ না এলে প্রেস্টিজ পাংচর হয়ে যাবে আমার৷ আসলে উত্তেজনার বশে তোদের কথাটা ওঁকে বলা আমার উচিত হয়নি৷ ব্যাপারটা উনিও সিরিয়াসলি নিয়েছেন৷ এখন তো আমাদের ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই৷ ওঁর বাড়িতে রাতে খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন উনি৷ এখানে এসে ফিরে যাওয়া মানে ওঁকে অসম্মান করা৷ তা ছাড়া উনি বড়োমামার বন্ধুমানুষ৷ বড়োমামা শুনলেও রাগ করবেন৷’
পলাশ তার কথার জবাবে কিছু বলল না৷ একটু দূরে প্ল্যাটফর্মের মধ্যে একটা চায়ের দোকান দেখিয়ে বলল, ‘চল, ওখানে একটু চা খাই৷ বেশ ঠান্ডা লাগছে৷’
ওরা দু-জন এর পর গিয়ে হাজির হল চায়ের দোকানের সামনে৷ দোকানদারকে চা দিতে বলে পলাশ বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, অনির্বাণ এল না কেন? কলকাতা থেকে বৃষ্টির দিনে তাদের এই নবাবগঞ্জে আসা বলতে গেলে তো তার জন্যই!
পলাশদের নবাবগঞ্জে আসার কারণটা একটু খুলে বলা যাক৷ পলাশ, নীলকান্ত অর্থাৎ নিলু, অনির্বাণ, এরা সকলেই শ্যামবাজারের বাসিন্দা এবং কাছেই গণেন্দ্র মিত্র লেনের ‘যুগের পথিক’ ক্লাবের সদস্য৷ প্রত্যেকেই ওরা কলেজ ছাত্র অথবা সদ্য পাশ করে বেরিয়েছে কলেজ থেকে৷ শরীরচর্চা, খেলাধুলো, লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত তাদের আড্ডার আসর বসে গণেন্দ্র মিত্র লেনের ঘুপচি ক্লাবঘরে৷ দিন দশেক আগে এমনই এক বর্ষার সন্ধেয় ক্লাবঘরে বসে গল্প করছিল তারা৷ শুধু তিন জন নয়, ঋজু, অসীম, তপন, ভোলা, আরও অনেকে সেদিন হাজির ছিল সেখানে৷ এসব আড্ডা যেমন হয়, এক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হতে হতে অন্য প্রসঙ্গ চলে আসে, ঠিক তেমনই কী একটা কথা আলোচনা করতে করতে হঠাৎ কে যেন তুলে বসল আত্মা নিয়ে কথা৷ শুরু হল আত্মা-প্রেতাত্মা আছে কি না তাই নিয়ে সনাতনী তর্ক৷
নিলুর আত্মা-টাত্মার ব্যাপারে প্রচণ্ড বিশ্বাস৷ সে হঠাৎ বলল, ‘আমার বড়োমামার বন্ধু জ্যোতিষী ধূর্জটি চক্রবর্তী, যাঁর কাছে আমি হাত দেখাই, তিনি প্ল্যানচেটে আত্মা নামাতে পারেন৷ আমার বড়োমামা এ ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন৷’
অনির্বাণ প্রেসিডেন্সির ফিজিক্সের ছাত্র, ঘোর যুক্তিবাদী৷ নিলুর কথাটা শোনার সঙ্গেসঙ্গেই সে চেপে ধরল তাকে৷ বলল, ‘যখন সুনীতা উইলিয়াম মহাশূন্যে পায়চারি করে এলেন, সে সময় দাঁড়িয়ে কেউ আত্মা নামাচ্ছেন, এ কথা বিশ্বাস করতে হবে? আসলে এসব ব্যাপার হল ধান্দাবাজ লোকদের লোক ঠকিয়ে পয়সা কামানোর কৌশল৷’
ব্যস, শুরু হয়ে গেল জোর তর্ক৷ যারা হাজির ছিল, তারা ভাগ হয়ে গেল প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আত্মা নামানো যায় কি না এই নিয়ে৷ পলাশেরও আত্মা-টাত্মায় বিশ্বাস নেই৷ স্বাভাবিক ভাবে সেও সেদিন অনির্বাণের পক্ষ নিয়েছিল৷ অনেক যুক্তি, পালটা যুক্তির পরও যখন সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গেল না, তখন ভোলা একটা প্রস্তাব দিল৷ সে বলল, ‘নিলু গিয়ে ধূর্জটিবাবুকে রাজি করাক প্ল্যানচেটে আত্মা নামিয়ে দেখানোর জন্য৷ তিনি যদি সত্যিই তা পারেন, তাহলে সকলেই ব্যাপারটা মেনে নেব৷ তবে এর মধ্যে একটা কন্ডিশন আছে৷ প্ল্যানচেটে মিডিয়াম অর্থাৎ যার মাধ্যমে আত্মা নামানো হয়, সেই মিডিয়াম করতে হবে অনির্বাণকে৷ তাহলেই প্রমাণ হয়ে যাবে আত্মা নামানোর ব্যাপারটা সাজানো কি না!’
সেদিনের এই আলোচনা অন্য দিনের মতো শুধু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি৷ অনির্বাণ আর নিলু দু-জনেই সিরিয়াসলি নিয়েছিল বিষয়টা৷ পরদিনই নিলু তার বড়োমামাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিল ধূর্জটিবাবুর বউবাজারের চেম্বারে৷ সব কথা শোনার পর প্ল্যানচেটের ব্যাপারে রাজি হয়ে গেলেন ধূর্জটিবাবু৷ তবে তিনি বললেন, নিলু, অনির্বাণ ও আর-একজন অর্থাৎ মোট তিন জনকে আজ এই আষাঢ় মাসের অমাবস্যার দিন তাঁর নবাবগঞ্জের বাড়িতে আসতে হবে৷ তাঁর বাড়িতে অন্য কেউ থাকে না৷ ফলে উভয় পক্ষের কোনো অসুবিধে হবে না৷ সেখানে রাত্রিবাস করে পরদিন কলকাতা ফিরতে পারবে নিলুরা৷ তাঁর আমন্ত্রণেই পলাশ আর নিলু বিকেলের ট্রেনে নবাবগঞ্জ প্ল্যাটফর্মে এসে নামল৷ কিন্তু কলকাতায় একটা কাজ সেরে অন্য ট্রেনে অনির্বাণের এখানে আসার কথা থাকলেও তার দেখা নেই৷ বৃষ্টির মধ্যে প্ল্যাটফর্মে অনির্বাণের জন্য এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে পলাশরা৷ ধূর্জটিবাবুও তাদের এখনও নিতে আসেননি৷
চা খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর পলাশ এক বার তার রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছ-টা তো বাজল৷ আর আধ ঘণ্টার মধ্যে যদি দু-জনের কেউ না আসেন, তাহলে ডাউন ট্রেন ধরে ব্যাক করব৷ আমরা দু-জন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি৷ আমাদের কেউ দোষ দিতে পারবে না৷’
পলাশের কথা শুনে একটু চিন্তা করে নিলু বলল, ‘ঠিক আছে, তাহলে তাই হবে!’
কথাটা বলল বটে, কিন্তু ঠিক সেই সময় একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডর গাড়ি এসে প্ল্যাটফর্মের বাইরে রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে দাঁড়াল৷
গাড়িটা দেখেই নিলু বলে উঠল, ‘ওই যে, ধূর্জটিবাবু এসে গিয়েছেন৷ ওটা ওঁর গাড়ি, আমি চিনি৷’
গাড়ি থেকে বৃষ্টির মধ্যে বাইরে নেমে ছাতা খুললেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা এক লম্বা-চওড়া ভদ্রলোক৷ তিনি উঠে এলেন প্ল্যাটফর্মে৷ তাঁকে দেখে প্রথমে নিলু আর তার পিছন পিছন পলাশ এগিয়ে গেল তাঁর দিকে৷ ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন শেডের নীচে৷ নিলুরাও এসে দাঁড়াল তাঁর সামনে৷
ভদ্রলোকের বয়স মনে হয় ষাটের কাছাকাছি হবে৷ ফরসা রং, টিকোলো নাক, দু-হাতে অনেক আংটি৷ পলাশ আর নিলুকে এক বার ভালো করে দেখে নিয়ে তিনি নিলুর উদ্দেশে বললেন, ‘আমি কলকাতা থেকে ফিরছি, তাই আসতে দেরি হয়ে গেল৷ তা তোমরা দু-জন কেন? আমি তো তিন জনকে আসতে বলেছিলাম৷ আর এই কি সেই ছেলে, যে মিডিয়াম হতে চায়?’ গম্ভীর স্বরে এই কথাগুলো বলে ধূর্জটিবাবু তাকালেন পলাশের দিকে৷
নিলু বলল, ‘না না, এ সে নয়৷ এর নাম পলাশ৷ আমরা দু-জন একসঙ্গে এসেছি৷ অন্য ট্রেনে এসে এখানে আমাদের সঙ্গে মিট করার কথা অনির্বাণের৷ কিন্তু এক ঘণ্টা ধরে ওর জন্য আমরা অপেক্ষা করছি৷ ও এখনও এল না৷ মোবাইল কানেকশনও কাজ করছে না৷’
তার কথা শুনে ভদ্রলোক কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ‘তোমরা দু-জনই বরং আমার সঙ্গে চলো৷ আমি হিউম্যান সাইকোলজি বুঝি৷ সম্ভবত সে ভয় পেয়েছে৷ সে আসবে না৷ মেঘ যত গর্জায় তত বর্ষায় না৷ সন্ধ্যে নেমে আসছে৷ জল-কাদায় বেশ কিছুটা পথ যেতে হবে আমাদের৷ তার উপর আমার গাড়ির একটা হেডলাইট আবার ভেঙে গিয়েছে আজ৷’ এই বলে তিনি তাকিয়ে রইলেন নিলুদের দিকে৷
নিলু বলতে যাচ্ছিল, ‘কিন্তু অনির্বাণ যদি পরের ট্রেনে এখানে এসে পৌঁছোয় তখন কী হবে?’ কিন্তু তার আগেই প্ল্যাটফর্মের মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, ‘বিশেষ ঘোষণা! ঝড়বৃষ্টিতে কুতুবপুর স্টেশনে গাছ পড়ে ওভারহেড তার ছিঁড়ে যাওয়ায় আপ লাইনে রাত দশটা পর্যন্ত কোনো ট্রেন চলবে না৷ যাত্রী সাধারণের সুবিধার্থে এই সংবাদ জানানো হচ্ছে৷’
ঘোষণাটা শুনে ধূর্জটিবাবু বললেন, ‘এর পর তার আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই৷ আর যদি সে কোনোভাবে এখানে এসে হাজির হয়, আর যদি তার আমার বাড়ি যাওয়ার সত্যি ইচ্ছে হয়, তাহলে যেকোনো ভ্যানরিকশাকে বললেই সে আমার বাড়ি নিয়ে যাবে৷’ এ কথাগুলো বলে তিনি পলাশদের উত্তরের অপেক্ষা না করে, ‘এসো’, বলে হাঁটতে শুরু করলেন তাঁর গাড়িতে যাওয়ার জন্য৷
পলাশ আর নিলু একবার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে অগত্যা ধূর্জটিবাবুকে অনুসরণ করল৷ গাড়িতে উঠে ধূর্জটিবাবু চালকের আসনে বসলেন৷ পলাশরা বসল তাঁর পিছনের আসনে৷ গাড়িতে ওঠার সময় প্রায় ভিজে গেল পলাশরা৷ গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই যেন ঝুপ করে অন্ধকার নামল বাইরে৷ একটা হেডলাইটের আলোয় খানাখন্দে ভরা মেঠোপথ দিয়ে বর্ষার অন্ধকারে ধূর্জটিবাবুর গাড়ি ছুটল তাঁর বাড়ির দিকে৷
মিনিট কুড়ি পর ধূর্জটিবাবুর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছোল পলাশরা৷ একটা মাঠের ঠিক মাঝখানে একলা ভূতের মতো দাড়িয়ে আছে পুরোনো ধাঁচের দোতলা বাড়িটা৷ কোনো আলো আসছে না বাড়ির ভিতর থেকে৷ গাড়িতে একটিও কথা বলেননি ধূর্জটিবাবু৷ পলাশের মনে হল, হয় তিনি গভীরভাবে কিছু ভাবছেন, নয় স্বভাবজাতভাবেই তিনি গম্ভীর মানুষ৷ গাড়ি থেকে নামার সময় তিনি শুধু বললেন, ‘এখানে এখনও ইলেকট্রিসিটি নেই৷ তবে একটা রাত, তোমাদের আশা করি তেমন অসুবিধে হবে না৷’
পলাশরা গাড়ি থেকে নামতেই ঘাসজমিতে জমে থাকা জলে তাদের পায়ের পাতা ডুবে গেল৷ বৃষ্টি একটু ধরেছে ঠিকই, তবে বাতাস এখনও বইছে৷ মাঠের চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক৷ জলের মধ্যে ছপ ছপ শব্দে পা ফেলে পলাশরা তাঁর পিছন পিছন উঠে এল বাড়ির বারান্দায়৷ পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ছোটো টর্চ বের করে সেটা জ্বালিয়ে চাবি দিয়ে একটা ঘরের দরজা খুললেন তিনি৷ তারপর ঘরের ভিতর ঢুকে একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে তাদের দু-জনকে সে ঘরে বসতে বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ ঘরটা পুরোনো হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ একটা পুরোনো আমলের পালঙ্ক আছে ঘরটায়৷ বিছানার উপর বসে নিলু বলল, ‘সম্ভবত এই ঘরেই আমাদের আজ রাত কাটাতে হবে৷’
পলাশ কোনো জবাব দিল না৷ সে ভাবতে লাগল, অনির্বাণ এল না কেন? সত্যি কি সে ভয় পেয়ে গেল?
মিনিট তিনেকের মধ্যেই একটা পাথরের থালায় মিষ্টি আর জল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ধূর্জটিবাবু৷ থালা আর জলের গ্লাস পালঙ্কের পাশে একটা টেবিলের উপর রাখলেন৷ ‘তোমরা এগুলো খেয়ে নাও৷ আমি ততক্ষণ সান্ধ্য-আহ্নিক সেরে আসি৷’ এই বলে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷
পাথরের থালায় বেশ বড়ো বড়ো অনেক মিষ্টি৷ সেই দুপুর বেলা খেয়ে বেরিয়েছে পলাশরা৷ মিষ্টিগুলো দেখে তাদের খিদে পেয়ে গেল৷ তারা খেতে শুরু করল৷
সান্ধ্য-আহ্নিক সেরে যখন ধূর্জটিবাবু আবার পলাশদের ঘরে এলেন, তখন তাদের খাওয়া শেষ৷ তিনি পলাশদের বললেন, ‘চলো, এবার অন্য ঘরে গিয়ে বসে কথা বলি৷’
সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সবাই গিয়ে হাজির হল বাড়ির এক প্রান্তে, একটা ঘরে৷ সেই ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা কাঠের তেপায়া টেবিলের উপর একটা ছোটো মোমবাতি জ্বলছে৷ আর সেই টেবিলের চারদিকে সাজানো আছে চারটে কাঠের চেয়ার৷ এ ছাড়া অন্য কোনো আসবাব নেই সেই ঘরে৷ ঘরটায় আরও একটা দরজা আছে৷ ঘরে ঢুকে সেই দরজাটাও খুলে দিলেন ধূর্জটিবাবু৷ বাড়ির পিছন দিকের মাঠ থেকে একঝলক ভেজা বাতাস এসে ঢুকল ঘরের ভিতর৷ টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে বসলেন ধূর্জটিবাবু৷ তাঁর কথামতো সেখানে অন্য দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসল পলাশ আর নিলু৷ চেয়ারে বসার পর এক বার তাদের দিকে ভালো করে দেখলেন ধূর্জটিবাবু৷ পলাশের মনে হল তিনি যেন তাদের জরিপ করে নিলেন৷ ফাঁকা চেয়ারটা দেখিয়ে গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, ‘একটা চেয়ার তোমাদের সেই বন্ধুর জন্য নির্দিষ্ট ছিল৷ কিন্তু সে তো এলই না৷ চার জন না হলে প্ল্যানচেটে বসা যাবে না৷ আমি ভেবেছিলাম তোমাদের কথার দাম আছে৷ তাই তোমাদের এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম৷ এখন বুঝলাম . . .৷’
তাঁকে কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রসঙ্গটা এড়াবার জন্য নিলু বলল, ‘প্ল্যানচেটে বসা না গেলেও আপনার মতো সিদ্ধপুরুষের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু জানার আছে৷ আচ্ছা, পঞ্চমুণ্ডির আসনে কীভাবে শবসাধনা করা হয় তা একটু শোনাবেন? আমার খুব জানার ইচ্ছে৷’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর গম্ভীর কন্ঠে ধূর্জটিবাবু বললেন, ‘তাহলে এসব কথাই বলি শোনো৷ তোমরা যে সাধনার কথা শুনতে চাইলে, তা অতি কঠিন সাধনা৷ লাখে একজন তন্ত্রসাধকের এই সাহস হয়৷ অনেকের মৃত্যুও হয়েছে এই সাধনা করতে গিয়ে৷ প্রথমে সংগ্রহ করে আনতে হয় কোনো লাশ৷ মহাশ্মশানে অমাবস্যার রাতে সেই লাশের উপর পঞ্চমুণ্ডির আসন পেতে বসতে হয়৷ সঙ্গে রাখতে হয় মাটির ভাঁড়ে চালভাজা আর নরকরোটিতে সুরা৷ মন্ত্রোচ্চারণে প্রেতাত্মা এসে প্রবেশ করে সেই শরীরে৷ জীবন্ত হয়ে ওঠে লাশ৷ বীভৎস চিৎকার করে মাঝে মাঝে সে বলে ওঠে, ‘দে, দে, আমার বড়ো খিদে পেয়েছে৷’ তখন একমুঠো চালভাজা আর সুরা তার মুখে ঢেলে দিয়ে শান্ত করতে হয় তাকে৷ এ সময় কেউ ভয় পেয়ে গেলে তার নির্ঘাত মৃত্যু! লাশের উপর পাতা আসনে শক্ত হয়ে বসে চামুণ্ডা মন্ত্র জপ করতে হয়৷ সে মন্ত্রও অত্যন্ত কঠিন৷ মন্ত্রের জোরে বশে থাকে প্রেতাত্মা৷ মন্ত্রে সামান্য ভুলচুক হলে যে বুকের উপর বসে আছে, তাকে ছিটকে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াবে সেই লাশ৷ তারপর . . .৷’ এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ চুপ করে গেলেন ধূর্জটিবাবু৷
পলাশরা ডুবে গিয়েছিল তাঁর গল্পের মধ্যে৷ তিনি থামতেই নিলু উত্তেজনা চাপতে না পেরে বলে উঠল, ‘তারপর? তারপর?’
তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে পিছন দিকের খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাইরে থেকে একটা শব্দ আসছে না?’
তাঁর কথা শুনে কান খাড়া করল পলাশরা৷ হ্যাঁ, একটা শব্দ৷ দরজা দিয়ে বাইরে অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ কিন্তু মনে হচ্ছে, কে যেন মাঠের জমা জলে ছপ ছপ শব্দে পা ফেলে বাড়িটার দিকে এগিয়ে আসছে৷ ক্রমশই শব্দটা এগিয়ে আসতে লাগল৷ বলতে গেলে সে যেন আসছে পলাশরা যে ঘরে বসে আছে সেই ঘর লক্ষ করেই৷ সকলেই তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে৷ দরজার একদম কাছে এসে থেমে গেল শব্দটা৷ কয়েক মুহূর্ত কোনো সাড়াশব্দ নেই৷ তার পরই দরজার বাইরে অন্ধকার থেকে ফুটে উঠল একটা মানুষের অবয়ব৷ ঘরের ভিতর উঁকি মারল একটা মাথা৷ তা দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধূর্জটিবাবু বলে উঠলেন, ‘কে! কে তুমি?’
আর তার পরেই আগন্তুককে চিনতে পেরে নিলু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে উল্লাসে ধূর্জটিবাবুর উদ্দেশে বলল, ‘ও হল আমাদের সেই বন্ধু, যার আসার কথা ছিল!’
ধূর্জটিবাবু যেন একটু অবাক হয়ে গেলেন৷ অবশ্য পলাশ আর নিলুও অবাক হয়ে গিয়েছে৷ সে যে এভাবে এখন হাজির হবে, তারা কেউ আশা করেনি৷ ধূর্জটিবাবু বললেন, ‘এসো, ভিতরে এসো৷’
ঘরের ভিতর পা রাখল অনির্বাণ৷ সে একদম কাকভেজা৷ জল চুঁইয়ে পড়ছে মাথা থেকে৷ ঘরে ঢুকে একটু হেসে সে বলল, ‘আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল৷ অনেক কষ্ট করে আসতে হল তো!’
পলাশ বলল, ‘আমরা তো ভেবেছিলাম তুই আর এলিই না৷ অনেকক্ষণ আমরা প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করেছি তোর জন্য৷’
অনির্বাণ পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে মাথা মুছতে মুছতে বলল, ‘আমি যখন আসব বলেছি, তখন আসবই৷ তাই তো এত কষ্ট
করেও . . .৷’
ধূর্জটিবাবু এবার বললেন, ‘দাঁড়িয়ে কেন? চেয়ারে বোসো!’
মাথা মুছে অনির্বাণ এসে বসল পলাশের পাশের চেয়ারটায়৷ এত ভিজেছে যে, মোমের আলোয় তার মুখ যেন রক্তশূন্য বলে মনে হচ্ছে৷ সে বসার পর ধূর্জটিবাবু তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমিই কি মিডিয়াম হতে চেয়েছিলে? তোমার নাম কী?’
অনির্বাণ প্রথমে ঘাড় নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ৷’ তারপর বলল, ‘আমার নাম তাতাই৷’
অনির্বাণ হঠাৎ তার ডাকনামটা বলল কেন, তা বুঝতে পারল না পলাশ৷ তার নাম শোনার পর ধূর্জটিবাবু বললেন, ‘তুমি কি জানো, যে মিডিয়াম হয়, অনেক সময় কোনো শয়তান আত্মা মিডিয়ামকে ছেড়ে যাওয়ার সময় তার ক্ষতি করে দিয়ে যায়?’
অনির্বাণ তাঁর কথার উত্তরে বলল, ‘ক্ষতি করে মানুষেরা, আত্মা নয়৷ কোনো আত্মা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না৷’
ধূর্জটিবাবুর দিকে তাকিয়ে একটু যেন রুক্ষ স্বরেই কথাগুলো বলল অনির্বাণ৷
তার কথা শুনে ধূর্জটিবাবু কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘বাঃ, তোমার সাহস আছে দেখছি! তবে বেশি সাহস ভালো নয়!’
অনির্বাণ তাঁর কথার কোনো জবাব দিল না৷
ধূর্জটিবাবু এর পর নিলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাদের বন্ধু যখন এসেই পড়েছে, তখন আর পঞ্চমুণ্ডির আসনের গল্প বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই৷ তোমাদের অবিশ্বাসী বন্ধু নিশ্চয়ই ভিতরে ভিতরে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে প্ল্যানচেটে বসার জন্য৷ বৃষ্টির মধ্যে এতটা পথ ভিজে এসেছে মিডিয়াম হবে বলে!’ এই বলে তিনি যেন মৃদু কটাক্ষ করলেন অনির্বাণকে৷
অনির্বাণ তাঁর কথা শুনে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন৷ সময় নষ্ট করে লাভ নেই৷ আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে৷’
এ কথা শুনে পলাশ বলল, ‘সে কী রে? তুই আবার এই বৃষ্টিতে ফিরে যাবি?’
অনির্বাণ একটু বিষণ্ণভাবে পলাশকে বলল, ‘না রে, আমার এখানে রাতে থাকা হবে না! অনেক লোকজন এসেছে বাড়িতে৷ আমাকে ফিরতেই হবে!’
ধূর্জটিবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে বরং শুরু করা যাক৷ দরজা দুটো বন্ধ করে দিতে হবে এবার! তবে প্ল্যানচেটে বসার আগে একটা কথা তোমাদের বলে দিই৷ কারও হার্ট দুর্বল থাকলে কিন্তু প্ল্যানচেটে না বসাই ভালো৷ দুর্ঘটনা ঘটলে আমাকে কিন্তু কেউ দোষ দিয়ো না!’
তাঁর কথা শেষ হতেই অনির্বাণ একটা বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘আমাদের সকলেই হার্ট ঠিক আছে৷ আপনার হার্ট ঠিক আছে তো? আপনি নিজে ভয় পাচ্ছেন না তো?’
তার কথা শোনামাত্রই হঠাৎ যেন দপ করে জ্বলে উঠল ধূর্জটিবাবুর চোখ দুটো৷ তিনি কী যেন বলতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করে নিলেন৷ মৃদু হেসে শুধু তিনি বললেন, ‘যে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে শবসাধনা করে, সে কোনো প্রেতাত্মাকে ভয় পায় না৷’
নিলু উঠে গিয়ে দরজা দুটো বন্ধ করে এল৷ টেবিলের একদম কাছে চেয়ারগুলো আরও এগিয়ে নিয়ে বসল সকলেই৷ মোমটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে৷ তার মৃদু আলোয় চেয়ারে বসে থাকা পলাশদের ছায়াগুলো কাঁপছে৷ চারপাশে কোনো শব্দ নেই৷ সকলে ঠিকভাবে বসার পর কয়েক মুহূর্ত অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে ধূর্জটিবাবু বললেন, ‘তোমরা আমার মতো এইভাবে দু-হাতের আঙুলগুলোকে টেবিলের উপর আলতো করে ছুঁইয়ে রাখো৷ আমি আলো নেভাবার পর কেউ কোনো কথা বলবে না৷ শুধু একমনে চিন্তা করবে পরিচিত কোনো মৃত ব্যক্তির কথা৷’
পলাশরা তাঁর দেখাদেখি টেবিলের উপর আঙুল রাখল৷ আঙুল রাখতে গিয়ে পলাশের আঙুল মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে গেল তার পাশে বসা অনির্বাণের হাতের পাতা৷ পলাশের মনে হল, বৃষ্টিতে ভিজে অনির্বাণের হাত যেন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে!
ধূর্জটিবাবু সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে এক ফুঁয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলেন৷ সারা ঘরে নেমে এল জমাটবাঁধা অন্ধকার৷ সকলেই এক মনে চিন্তা করতে লাগল পরিচিত কোনো মৃত মানুষের কথা৷
নিস্তব্ধ অন্ধকার ঘর৷ মিনিট পাঁচেক পর পলাশের মনে হল, টেবিলটা যেন থরথর করে একবার কেঁপে উঠল৷ আর তারপরই শোনা গেল ধূর্জটিবাবুর গম্ভীর অথচ চাপা কন্ঠস্বর, ‘আপনি কি এসেছেন? এসে থাকলে টেবিলে একবার শব্দ করুন৷’
টেবিলটা আরও একবার কেঁপে উঠল৷ তারপর একটা পায়ায় শব্দ শোনা গেল, ঠক!
পলাশের একটু ভয় করল এবার৷ ধূর্জটিবাবুর গলা শোনা গেল, ‘তাহলে আপনি এসেছেন! আপনার নাম কী?’
পলাশের পাশে বসে থাকা অনির্বাণের গলায় প্রথমে একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হল, তারপর একটা অস্পষ্ট স্বর শোনা গেল, ‘আমার . . . নাম . . . অ . . .৷’
নামটা স্পষ্ট শোনা গেল না শেষ পর্যন্ত৷ ‘আপনার ঠিকানা কী?’ এর পর প্রশ্ন করলেন ধূর্জটিবাবু৷
আবার সেই ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল অনির্বাণের গলা থেকে৷ তারপর একটা ভাঙা ভাঙা স্বরে সে ধীরে ধীরে বলল, ‘সাতাত্তর, গণেন্দ্র মিত্র লেন, শ্যামবাজার, কলকাতা . . .৷’
ঠিকানাটা শুনেই প্রথমে একটু চমকে উঠল পলাশ৷ আরে, এ তো তাদের দুটো বাড়ি পরেই অনির্বাণের বাড়ির ঠিকানা! ‘অ’ তা হলে অনির্বাণ৷ অনির্বাণ তা হলে কায়দা করেই তার ডাকনাম বলেছে ধূর্জটিবাবুকে৷ আসলে সে প্ল্যানচেটে বসে নাটক করে ঠকাতে চাইছে ধূর্জটিবাবুকে৷ ব্যাপারটা ভেবে ভয় কেটে গিয়ে হাসি পেয়ে গেল তার৷ হাসি চেপে রেখে সে ধূর্জটিবাবু আর অনির্বাণের কথাবার্তা শুনতে লাগল৷
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, খুব কষ্ট . . . খুব কষ্ট . . .৷ কোমরটা একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে!’ অনির্বাণের গলার স্বর যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে৷
অনির্বাণ পারে বটে অভিনয় করতে৷ মনে মনে ভাবল পলাশ৷
ধূর্জটিবাবু বললেন, ‘ও, তার মানে অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে আপনার? কীভাবে?’
‘একটা গাড়ি . . . একটা গাড়ি চাপা দিল আমাকে . . . সব শেষ . . .৷’ জবাব দিল অনির্বাণ৷
‘কী গাড়ি ছিল সেটা? বাস না লরি?’
‘না, না, বাস নয়, একটা . . . একটা . . . অ্যাম্বাসাডর . . .৷ আজ দুপুরে . . . পার্ক সার্কাসের মোড়ে . . .৷’
এর পর সে কী বলল ঠিক বুঝতে পারল না পলাশ৷
ধূর্জটিবাবু তার কথা শুনে বলে উঠলেন, ‘তার নম্বর কত ছিল?’
পলাশের মনে হল, প্রশ্নটা করার সময় তাঁর গলাটা যেন কেঁপে উঠল৷ কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ তারপরই অনির্বাণের স্পষ্ট উত্তর শোনা গেল, ‘ডব্লু বি কিউ ৫৫৫৫৷’
তার কথা শোনার সঙ্গেসঙ্গেই অন্ধকারের মধ্যে প্রচণ্ড জোরে আর্তনাদ করে উঠলেন ধূর্জটিবাবু৷ তারপর দুম করে একটা শব্দ হল৷ পলাশের মনে হল ধূর্জটিবাবু যেন চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন৷ পরক্ষণেই প্রচণ্ড জোরে হাসতে শুরু করল অনির্বাণ৷
ব্যাপারটা কী হল ঠিক বুঝতে পারল না পলাশ বা নিলু৷ হাসতে হাসতে অনির্বাণ বলল, ‘দেখ, দেখ, তোদের পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসা সিদ্ধপুরুষ নিজেই কেমন ভয় পেয়ে গেলেন৷’ তারপর সে হাসি থামিয়ে বলল, ‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হয় তোর বিশ্বাসই ঠিক নিলু!’
তার কথা শেষ হওয়ার পর আবার ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল৷ হঠাৎ কীভাবে যেন ঘরের একটা দরজা শব্দ করে খুলে গেল৷ একঝলক ঠান্ডা বাতাস ঢুকল ঘরের ভিতর৷
পলাশ বলল, ‘ধূর্জটিবাবু, ও ধূর্জটিবাবু! আপনার কী হল? অনির্বাণ, অ্যাই অনির্বাণ?’
কিন্তু কারও কোনো শব্দ পাওয়া গেল না৷ নিলুও তাদের নাম ধরে ডাকল৷ তারপর পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে জ্বালল৷ মৃদু আলোয় তারা দেখতে পেল মাটিতে পড়ে আছেন ধূর্জটিবাবু৷ তাঁর মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে৷
কিন্তু অনির্বাণ ঘরের মধ্যে নেই৷ তার চেয়ার খালি৷ নিলু লাইটার দিয়ে মোমের টুকরোটা জ্বালিয়ে দিল৷ ধূর্জটিবাবুর পাঞ্জাবির পকেট থেকে টর্চটা ছিটকে পড়েছিল মেঝের উপর৷
পলাশ সেটা চট করে কুড়িয়ে নিয়ে নিলুকে বলল, ‘তুই ধূর্জটিবাবুকে দেখ৷ আমি দেখি অনির্বাণ কোথায় গেল? সে এভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কেন?’
ঘর ছেড়ে খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল পলাশ৷ টর্চ জ্বালিয়ে সে দেখতে পেল, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে ধূর্জটিবাবুর গাড়িটা৷ টর্চের আলো মাঠের বেশি দূরে যাচ্ছে না৷ আর কিছু দেখা যাচ্ছে না মাঠে৷ বারান্দাতেও সে নেই৷
বারান্দা থেকে মাঠে নেমে কয়েক পা এগিয়ে টর্চের আলো চারপাশে ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করে বলে উঠল পলাশ, ‘অনির্বাণ, অ্যাই অনির্বাণ, তুই কোথায় গেলি?’
ঠিক সেই সময় পলাশের পকেটে বেজে উঠল মোবাইলটা৷ কানে দিতেই ওপাশ থেকে মোবাইলে ভেসে এল পলাশদের বন্ধু অসীমের গলা, ‘কে পলাশ? আমি অসীম বলছি৷ তোরা যেখানে আছিস সেখান থেকে এখনই কলকাতায় ফিরে আয়৷ খুব জরুরি৷ অনেকক্ষণ ট্রাই করার পর তোদের ধরতে পারলাম!’
পলাশ বলল, ‘কেন, কী হয়েছে?’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অসীম বলল, ‘অনির্বাণ আর নেই৷ আজ দুপুরে পার্ক সার্কাসের মোড়ে একটা অ্যাম্বাসাডর তাকে . . .৷’
আর বলতে পারল না অসীম৷ কান্নায় ভেঙে পড়ল৷
পলাশ তাকে চিৎকার করে বলল, ‘কী বলছিস তুই? অনির্বাণ তো এক্ষুনি . . .৷’
কথাটা শেষ করতে পারল না পলাশ৷ উত্তেজিতভাবে তার টর্চ ধরা হাতটা নাড়াতে গিয়ে টর্চের আলোটা যেন হঠাৎ আটকে গেল কিছু দূরে দাঁড়ানো ধূর্জটিবাবুর অ্যাম্বাসাডরের নম্বর প্লেটের উপর৷ পলাশ দেখতে পেল, সেখানে জ্বলজ্বল করছে গাড়ির নম্বরটা ‘ডব্লিউ বি কিউ ৫৫৫৫’!
টর্চটা খসে পড়ল তার হাত থেকে!