দ্রৌলমার খড়্গ

দ্রৌলমার খড়্গ

আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগের কথা৷ বীরভূম জেলার একটি ছোট গ্রাম চণ্ডীপুর৷ এক গ্রীষ্মের সকালে গ্রামের জমিদার বাড়ির কুলপুরোহিত পণ্ডিত রামনারায়ণ মিশ্র মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছিলেন কাছারির দিকে৷ জমিদারবাড়িতে দেবী কিরীটেশ্বরীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে৷ রামনারায়ণই তার নিত্যপূজা করে থাকেন৷

যখনকার কথা বলছি তখন ভারতবর্ষে আকবর বাদশার রাজত্বকাল চলছে৷ সুবে বাংলা’র শাসনকর্তা হয়ে এসেছেন খান ই জাহান মুনিম খান৷ তখন দেশগাঁয়ে অনেক ছোটবড় জমিদার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাজত্ব করতেন৷ বিনিময়ে তাঁরা সরকারবাহাদুরকে খাজনা দিতেন৷ এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ভীষণ অত্যাচারী৷ আবার ভালো জমিদারও কম ছিলেন না৷ তাঁরা প্রজাদের সন্তানস্নেহে লালনপালন করতেন, বিপদে আপদে সবার পাশে থাকতেন৷ প্রজারাও এমন জমিদারকে নিজের অভিভাবক হিসেবে মানত, প্রয়োজনে তাদের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াত৷

চণ্ডীপুরের জমিদার প্রতাপনারায়ণ রায়চৌধুরী ছিলেন এমনই এক জমিদার৷ জনশ্রুতি ছিল প্রতাপনারায়ণের পূর্বপুরুষরা নাকি ডাকাতি করে সেই সব লুটের টাকায় এই জমিদারি কেনেন৷ প্রতাপনারায়ণের বাবা আর ঠাকুর্দা দুজনেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুরুষ ছিলেন, তাঁদের ভয়ে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত৷ প্রতাপনারায়ণ আবার তার উলটো৷ সুদর্শন মানুষটি সংস্কৃত আর ফার্সি, দুই ভাষাতেই সুপণ্ডিত৷ গুণীর আদর করতে জানেন৷ অন্তত দুটি পাঠশালার ব্যয় নির্বাহ করেন৷ পুকুর কাটানো, মন্দির প্রতিষ্ঠা, গরিবকে অন্নদান, নিয়মিত দান ধ্যান, এসবে তাঁর জুড়ি নেই৷ লোকে বলে বহুপুণ্যফলে রায়চৌধুরী পরিবারে এমন মহাপুরুষ জন্মেছেন৷

এই রায়চৌধুরীদেরই ইষ্টদেবী হলেন মা কিরীটেশ্বরী৷ জনশ্রুতি আছে যে এককালে এই এলাকার রাজা খড়্গেশ্বরের রাজপ্রাসাদে দেবী কিরীটেশ্বরী পূজিতা হতেন৷ তারপর যবন আক্রমণে রাজা খড়্গেশ্বরের রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, মূর্তিটি রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে৷

এর বহু বছর পর ওই অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা হলে সেই প্রলয়ঙ্করী বন্যায় মূর্তিটি ভেসে এসে আটকা পড়ে বারূনী নদীর ঘাটে৷ রামনারায়ণ মিশ্র’র কোনও এক পূর্বপুরুষ নদীতে স্নান করতে গিয়ে মূর্তিটির সন্ধান পান৷ তিনি দেবী কিরীটেশ্বরীকে উদ্ধার করে গ্রামের জমিদার রায়চৌধুরীর হাতে সমর্পণ করেন৷ জমিদার মশাই দেবীকে কুলদেবীরূপে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে থাকেন৷ আর সেই থেকে মিশ্ররা এই মূর্তির বংশানুক্রমিক পূজারি৷

পথ চলতে চলতে একবার আকাশের দিকে চাইলেন পণ্ডিতমশাই৷ আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছে৷ সূর্য প্রায় মাথার ওপরে৷ ওদিকে ব্রাহ্মণীর শরীর ভালো না৷ সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে আসতে তাই একটু দেরি হয়ে গেল৷ ফিরতেও হবে তাড়াতাড়ি৷ যদিও চিন্তা নেই, মেয়ে সর্বমঙ্গলা মায়ের দেখভাল করছে৷

সর্বমঙ্গলার কথা মনে পড়তেই নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল পণ্ডিতমশাইয়ের বুক চিরে৷ দেখতে দেখতে মেয়ের এগারো বছর বয়েস হয়ে গেল, অথচ এখনও মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারলেন না তিনি৷ এ নিয়ে যে দেশগাঁয়ের প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবার মধ্যে কানাকানি শুরু হয়েছে সে তিনি ভালো করেই জানেন, সবই তাঁর কানে আসে৷ ব্রাহ্মণীও নিত্য গঞ্জনা দিচ্ছেন মেয়ের বিয়ে নিয়ে৷ সোমত্থ মেয়ে, তাও ব্রাহ্মণ ঘরের, এত ধেড়ে বয়েস অবধি কেউ ঘরে রাখে?

আর মেয়েও হয়েছে তেমনি৷ রূপ যেন একেবারে ফেটে পড়ছে৷ একমাথা কোঁকড়া চুল, পদ্মের পাপড়ির মতো চোখ, আর গায়ের রংটি যেন পাকা সোনা৷ তাকে দেখে দেখে পণ্ডিতের আর আশা মেটে না৷ মেয়ে তাঁর সাত রাজার ধন এক মাণিক, চোখের তারা, বুকের পাঁজর৷ সে পরের বাড়ি যাবে ভাবলেই তাঁর বুক হু হু করে ওঠে৷ কিন্তু কিছু করার নেই৷ মেয়ে হল গচ্ছিত ধন৷ তাকে আজ না হয় কাল বিয়ে দিতেই হবে৷

পাত্র যে পণ্ডিতমশাই একেবারে পাচ্ছেন না তা নয়৷ তবে তারা যৌতুক হিসেবে যা চাইছে সে দেওয়া তাঁর সাধ্যের বাইরে৷ তিনি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, জমিদারমশাইয়ের দয়ায় আর ছাত্র পড়িয়ে গ্রাসাচ্ছদনটুকু চলে যায়৷ মেয়ের বিয়ের অত পণ দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই৷ তাই দিনে দিনে তাঁর চিন্তা ক্রমে বেড়েই চলেছে৷

কয়েকদিন আগে গাঁয়েরই নাপিত হারু একটা ভালো সম্বন্ধ এনেছে৷ চণ্ডীপুরের দশ ক্রোশ উত্তরে তালকোঠরি গ্রাম৷ সেখানকার হরিসাধন বন্দ্যঘটী তাঁর ছোট ছেলের জন্য একটি পাত্রী খুঁজছেন৷ হরিসাধন সম্পন্ন গৃহস্থ৷ জমিজমাও কম নেই৷ তাছাড়া একটি চতুষ্পাঠী চালান৷ তাতে ছাত্র প্রচুর৷ ছেলেটি নিজেও বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত৷ হরিসাধন চতুষ্পাঠীর ভার ছোট ছেলের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন৷ তার ওপর পালটি ঘর৷ এমন সম্বন্ধ লাখে একটা মেলে৷ কিন্তু হারু নাপিত পণের যা ফিরিস্তি দিয়েছে, দেখে রামনারায়ণের বুক ভরা আশা ধুক করে নিভে গেছে৷

চলতে চলতে ফের একবার মাথার ওপর সূর্যটাকে দেখে নিলেন পণ্ডিতমশাই৷ এবার একটু তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে৷ নইলে ফেরার সময় দেরি হলে মেয়েটা চিন্তায় থাকবে৷

চিন্তার অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে৷

দিগন্তবিস্তৃত এই মাঠের নাম হচ্ছে বাঘার মাঠ৷ বাঘা ডাকাত এককালে এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ ডাকাত ছিল৷ তার নামে বুক কাঁপত না এমন লোক এদিগরে একটিও ছিল না৷ সে নাকি এক কোপে দু’জন লোকের মাথা কাটতে পারত, এমনই ছিল তার গায়ের জোর৷ মাঠের পাশে এক বিশাল ঘন জঙ্গল৷ তার নামও বাঘা ডাকাতের নামেই, বাঘার জঙ্গল৷

জঙ্গলের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি ছিল৷ বাঘা ডাকাত সে লোকজন ধরে সেই মূর্তির সামনে নরবলি দিয়ে ডাকাতি করতে যেত৷

এখন বাঘার জঙ্গলে দিনমানেই লোক যায় না, সন্ধের পর তো কথাই নেই৷ জন্তুজানোয়ার সাপখোপ তো আছেই৷ তাছাড়াও বাঘার জঙ্গলের অন্য একটাও দুর্নাম আছে৷

এই এলাকার সব্বাই জানে বাঘা ডাকাত যাদের নরবলি দিত তাদের আত্মা নাকি এখনও জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়৷ তাই এই জঙ্গলে ঢোকা মানা৷ অনেক দিন আগে নাকি কয়েকজন কাঠুরে মোড়লের মানা না শুনে কাঠ কাটতে বাঘার জঙ্গলে ঢুকেছিল৷ তাদের কেউ ফেরেনি৷ তারপরেও অবশ্য লোকে জঙ্গলের কাছাকাছি যেত, কাঠকুটো কুড়োতে৷ কিন্তু বেশি ভেতরে ঢোকার সাহস কারও হয়নি কোনওদিনও৷

তবে তাও বন্ধ হয়ে গেছে মাসখানেক আগের একটা ঘটনায়৷ ইদানীং নাকি জঙ্গলের মধ্যে এক কাপালিক এসে বসবাস করছে৷ দুএকজন দূর থেকে দেখেছে সেই কাপালিককে৷ কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করার আগেই সে জঙ্গলে মধ্যে মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গেছে৷

সেই শুনে গ্রামেরই একটি ডানপিটে ছেলে, নাম জগাই, বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে ঢুকেছিল বাঘার জঙ্গলে৷ অনেকক্ষণ পর সে ফিরে আসছে না দেখে কয়েকজন সাহসী লোক জঙ্গলের কাছে গিয়ে দেখে জগাইয়ের অচৈতন্য দেহটা জঙ্গলের বাইরে একটা বড় বটগাছের নীচে পড়ে আছে৷ তার মুখ থেকে তখন গ্যাঁজলা উঠছে৷ তুলে আনার পরেও স্বাভাবিক হয়নি সে৷ দিন দুয়েক ওভাবেই পড়ে থাকার পর এক রাতে হঠাৎ করে বিছানায় ছটফটিয়ে ওঠে জগাই৷ তখন তার দু’চোখে ভয়, গলার স্বরে আতঙ্ক৷ যেদিকে জঙ্গল সেদিকে আঙুল তুলে একটাই কথা বলে যাচ্ছে সে, ‘দানো এসেছে, ওই দেখো দানো এসেছে৷ খেয়ে ফেললে রে, আমাকে খেয়ে ফেললে রে..’৷ আর প্রতিটা বাক্যের সঙ্গে তার শরীর মুচড়ে উঠছিল আগুনে দেওয়া সাপের মতো৷

অশেষ কষ্ট পেয়ে মারা যায় জগাই৷ সেই মরণান্তিক আর্তনাদ এখনও গ্রামের লোকেদের কানে বাজে৷

গা’টা শিউরে উঠল পণ্ডিতমশাইয়ের৷ দ্রুত হাঁটতে থাকলেন তিনি৷

* * *

রামনারায়ণ মিশ্র জমিদারবাড়িতে ঢুকে দেখলেন সেরেস্তায় একেবারে এলাহি ব্যাপার৷ নায়েব, খাজাঞ্চি থেকে শুরু করে বাকি পাত্রমিত্ররা তো আছেনই, পাইক লেঠেলদের সর্দার কালু ডোমও এসেছে৷ গ্রামের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত৷ পণ্ডিতমশাই বুঝলেন কোনও উত্তেজিত আলোচনা চলছে৷ একটু অবাকই হলেন তিনি৷ এমন কী হল যে এত লোক জড়ো হয়েছে এখানে?

পণ্ডিতমশাই মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন৷ তার আগেই জমিদারবাবুর আহ্বান ভেসে এলো, ‘পণ্ডিতমশাই, পুজো করে একটু এদিকে আসুন৷ কথা আছে৷’

আজকের পুজোটা বেশ একটু চিন্তিতভাবেই সম্পন্ন করলেন রামনারায়ণ৷ এতদিন হয়ে গেল এই বাড়িতে যাওয়া আসা আছে তাঁর, কই, এত লোকের জমায়েত তো কোনওদিন দেখেননি তিনি৷

পুজো শেষ করে প্রসাদ বিলিবণ্টনের ব্যবস্থা করে ফের সেরেস্তায় এলেন রামনারায়ণ৷ দেখলেন ভিড় তো কমেইনি, বরং আরও বেড়েছে সবার মুখ গম্ভীর, আবহাওয়া যথেষ্ট থমথমে৷

রামনারায়ণ এসে দাঁড়াতে একজন তাঁর জন্য নির্দিষ্ট কুশাসনটি এগিয়ে দিল৷ রামনারায়ণ তাতে বসে প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার বাবা প্রতাপ, এত লোকজন কী জন্য? খুব গুরুতর কিছু ঘটেছে?’

প্রতাপনারায়ণ চিন্তিতমুখে বললেন, ‘হ্যাঁ ঠাকুরমশাই৷ ব্যাপার গুরুতরই বটে৷ কয়েকদিন ধরেই খবর আসছিল যে আশপাশের কয়েকটা জমিদারি মিলিয়ে ছোটখাটো চুরিচামারির সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷ তবে সে যে এত বড় আকার ধারণ করবে সে ভাবিনি৷’

‘কীরকম?’

উত্তর দিলেন নায়েবমশাই রজনীকান্ত সরকার৷ প্রবীণ মানুষটি প্রতাপনারায়ণের বাবার আমল থেকেই চণ্ডীপুর জমিদারবাড়ির নায়েবের দায়িত্বপালন করছেন৷ তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘যেগুলোকে আমরা ছোটখাটো চুরিচামারি বা ছিনতাই ভাবছিলাম, সেগুলো ছিল আসলে সলতে পাকানো৷ এখন বোঝা গেছে যে একটা বেশ বড় ডাকাতের দলের আবির্ভাব হয়েছে এই অঞ্চলে৷ পাশের গ্রামের ভুবন সরখেলকে তো চেনেন?’

চেনেন বইকি রামনারায়ণ৷ ভুবন সরখেল হেঁজিপেঁজি লোক নয়৷ গঞ্জে বাজারে তার তিনখানি চালের আড়ত আছে৷ পাট আর তুলোর ব্যবসা থেকেও তার উপার্জন কম নয়৷ এছাড়াও তেজারতি কারবার করে সে বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে৷ গৃহে প্রতিষ্ঠিত রাধামাধব আছেন, নিত্যই ধুমধাম সহ তাঁর পূজার্চনা চলে৷

‘গত সপ্তাহে ভুবন সরখেল মুর্শিদাবাদে এগারো নৌকো বালাম চাল আর আট নৌকো ফুটি কাপাসের তুলো পাঠায়৷ আপনারা তো জানেন, মসলিন তৈরিতে একমাত্র ফুটি কাপাসের তুলোই লাগে৷ সেই সূত্রে তার প্রচুর ধনলাভ হয়৷ কিন্তু সংবাদ এসেছে যে দুদিন আগে তার বাড়িতে ডাকাত পড়ে সমস্ত সোনার গহনা আর মোহর অপহরণ করে নিয়ে গেছে৷ তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে ডাকাতরা কখন কীভাবে ঢুকল, কীভাবে সব লুট করে নিয়ে গেল কেউ বুঝতে পারছে না৷’

বুদ্ধিমান এবং ঠান্ডা মাথার মানুষ বলে অনাথবন্ধু মুখুটির নাম আছে৷ তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘শুধু কি তাই? আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি গত মাস খানেক ধরে আলাইপুর, তেলেনিপাড়া, মোষডোবা, বাহিরগাছি, চক গঙ্গাপুর এসব অঞ্চলে ছিনতাই, ছোটখাটো ডাকাতি এসব প্রচুর বেড়ে গেছে৷ চোর ছিনতাইবাজরা আসছে একেবারে নিঃসাড়ে, আর সর্বস্ব লুটে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ সন্ধের পর লোকে পথে যাতায়াত করতে ভয় পাচ্ছে৷’

‘তবে একটা কথা কি জানেন মুখুটি মশাই, ‘চিন্তিতস্বরে বলেন রজনীকান্ত সরকার,’ শুনেছি এরা নাকি শুধু সোনাদানা লুট করে৷ আর কিছু না৷ ভুবন সরখেলের বাড়ি থেকেও শুধু সোনার মোহর আর গহনা নিয়ে গেছে৷ আর কিছুতে হাত দেয়নি৷ এদের শুধু সোনার ওপরেই যত লোভ৷’

প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘সে কী? সোনা ছাড়া রুপো বা অন্য কোনও বহুমূল্য রত্ন, মণি কিছুতেই এদের আগ্রহ নেই?’

‘না বাবা প্রতাপ৷ শুধু সোনা৷’

‘চাল ডাল শস্য আনাজ মশলা এসব কিছু?’

‘নাহ, আজ অবধি এদের এসবও কিছু লুট করতে দেখা যায়নি৷’

উঠে বসলেন প্রতাপনারায়ণ, ‘তাহলে নিশ্চয়ই গঞ্জ বা হাট থেকে কিনে নিয়ে যায়৷ কোনও না কোনও আড়কাঠি তো আছেই যে ওদের হয়ে এসব শস্য সংগ্রহ করার জন্য৷ তার খোঁজ করলেই তো হয়৷’

অনাথবন্ধু মাথা নাড়লেন, ‘সে কথা আমরাও ভেবেছি জমিদারমশাই৷ গঞ্জের সমস্ত পাইকার, দোকানদার সবাইকে বলা আছে, হঠাৎ করে কেউ যদি অনেক চাল ডাল আনাজ কেনা শুরু করে তবে আমাদের সংবাদ দিতে৷ কিন্তু সেরকম কারও সন্ধানও পাইনি৷’

রামনারায়ণ প্রশ্ন করলেন, ‘নবাবের পাইক বরকন্দাজরা কিছু করছে না?’

সরকারমশাই মাথা নেড়ে বললেন, ‘তারা চেষ্টা করছে কম না৷ এমনকি পাশের গ্রামের জমিদারমশাই রতন সিঙ্গিও লোক লাগিয়েছেন এদের ধরবার জন্য৷ কিন্তু হলে কী হবে, এদের কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না৷’

‘কেন? ধরা যাচ্ছে না কেন?’

‘তার কারণ এরা কে, এদের আস্তানা কোথায়, কেউ জানে না৷ আর আগেই বলেছি, এরা ডাকাত হলে কী হবে, একদম শোরগোল করে না৷ হা রে রে বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না৷ যেন বাতাস থেকে উদয় হয়, আর লুট করে ফের বাতাসে মিশে যায়৷ আর এত নিঃশব্দে ডাকাতি করে যে গলায় ফাঁস এঁটে বসার আগের মুহূর্ত অবধি শিকার বুঝতে পারে না যে তার শিয়রে সর্বনাশ৷ এমনকি আজ অবধি এদের কাউকে কেউ দেখতেও পায়নি৷’

সবাই চুপ করে গেলেন৷ একটু পর অনাথবন্ধু যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে উপায়?’

প্রতাপনারায়ণ হুঁকোর নল মুখ থেকে নামিয়ে চিন্তিতমুখে বললেন, ‘উপায় তো আমার মাথাতেও কিছু আসছে না মুখুটি মশাই৷ আমি ঘরে ঘরে লোক পাঠিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলছি৷ শুধু তাই নয়, সরকারমশাইকে বলেছি গাঁয়ে গাঁয়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে বলে দিতে কারও কাছে যদি দামি গয়নাগাঁটি বা সোনার মোহর কিছু থাকে, তারা চাইলে আমার কাছারিতে এসে রেখে যেতে পারে৷’

রামনারায়ণ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘কিন্তু বাবা প্রতাপ, সেক্ষেত্রে ওরাও তো জেনে যাবে যে তোমার জমিদারির সব অলঙ্কার, মোহর এই কাছারিতে জমা আছে৷ সেক্ষেত্রে ওরা দলবল জুটিয়ে কাছারি আক্রমণ করলে?’

প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘সে সম্ভাবনা যে নেই তা নয়৷ তবে কাছারিতে পাইক বরকন্দাজ কম নেই৷ আমি আরও লেঠেল আনাচ্ছি কাছারিবাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য৷ আর কালু ডোম তো আছেই৷’

কালু ডোম তার পর্বতপ্রমাণ শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠাকুরমশাই, যতক্ষণ কালু ডোমের দেহে প্রাণ আর হাতে লাঠি আছে, ততক্ষণ কাছারিবাড়ি লুটে নিয়ে যাবে এমন সাধ্য কোনও ডাকাতের বাবার নেই৷’

কালু ডোমের বীরত্বের কথা সবাই জানেন৷ তার হাতে লাঠি থাকলে সে স্বয়ং যমরাজকেও ডরায় না৷ কথাটা শুনে রামনারায়ণ একটু স্বস্তি পেলেন৷

প্রতাপনারায়ণ উঠে বসে বললেন, ‘তাহলে ওই কথাই রইল৷ আমি ঢেঁড়া পিটিয়ে দিচ্ছি৷ আর সবাইকে বলছি একটু সাবধানে থাকবেন৷’

* * *

দুধপুকুরের কাকচক্ষু জল তিরি তিরি করে কাঁপছিল৷ তার পাড়ে বসে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়েছিল সর্বমঙ্গলা৷

সে জানে তাকে নিয়ে তার বাবা-মায়ের চিন্তার অন্ত নেই৷ তার সমস্ত সইদের বিয়ে হয়ে গেছে৷ মণিমালা, লক্ষ্মী, আমোদী, সববার৷ শুধু সেই একা বসে আছে আইবুড়ি হয়ে৷ মায়ের কাছে গাঁয়ের মাসিপিসিরা আসে, নিত্য গঞ্জনা দেয়৷ বলে বামুনের বাড়িতে এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে আইবুড়ো বসে থাকা নাকি ভালো লক্ষণ না, ওতে গাঁয়ের অমঙ্গল হয়৷

সর্বমঙ্গলা সবই বোঝে৷ সে আর কচি খুকিটি নয়৷ এই অঞ্চলে পাঠান পাইকদের খুব উৎপাত৷ তারা সুন্দরী মেয়ে দেখলেই অপহরণ করে৷ কখনও নিজের মালিককে নজরানা দেয়, কখনও নিজেরাই ভোগ করে৷ তাই তো বাপ-মায়েরা চায় যত তাড়াতাড়ি করে সম্ভব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতে৷ তাহলে আর মেয়েকে রক্ষার ভার তাদের নিতে হয় না৷

বুকের ভেতর থেকে হিলহিলে সাপের মতো কান্না উঠে আসছিল সর্বমঙ্গলার৷ তার মোটেও বাড়ি ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না৷ এই গ্রাম, গ্রামের বুড়ো অশ্বত্থ গাছটা, মিষ্টি তেঁতুলের গাছ, দুধপুকুর, আমগাছ, ইতুপুজো, মাঘমণ্ডল ব্রত, পুন্যিপুকুর ব্রত, এসব ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই তার কান্না পায়৷ আর বাবা মা’কে ছেড়ে যেতে হবে ভাবলে তো তার বুকই ফেটে যায় কষ্টে৷

তার বাবাঠাকুর খুব গরিব৷ আর সে জানে বাবাঠাকুর গরিব বলেই তার বিয়ে হচ্ছে না৷ মা ঠারেঠোরে বাবাকে অনেক করে বলেছে জমিদার মশাইকে জানাতে৷ সে এও জানে যে জমিদারমশাইকে বললে তিনি হয়তো কিছু অর্থসাহায্য করবেনও৷ কিন্তু তার বাবার আত্মসম্মানবোধ প্রচণ্ড৷ তিনি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য কারও কাছে এক পয়সা হাত পাতবেন না৷

একবার ফের দুধপুকুরের স্থির জলের দিকে তাকায় সর্বমঙ্গলা৷ সেখানে একটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের ছবি ভেসে উঠল৷ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে একটু কেঁদেও নিল সে৷ তারপর চোখের জল মুছে বাড়ির রাস্তা ধরল৷

* * *

রাতে স্বামীকে ভাত বেড়ে দিয়ে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করছিলেন গিরিসুন্দরী দেবী৷ রাতের এই সময়টায় স্বামী-স্ত্রী’র কিছু সাংসারিক কথা হয়৷ তাছাড়া গিরিসুন্দরী জানেন তিনি নিজের হাতে ভাত বেড়ে না দিলে স্বামী তৃপ্তি করে খান না৷

আজ গিরিসুন্দরী লক্ষ্য করলেন তাঁর স্বামী যেন খুব অন্যমনস্ক৷ খেতে খেতে কী যেন ভাবছেন৷ একবারের বেশি দুবার ভাত চাইলেন না৷ খাওয়া শেষ করে শেষপাতের দুধটুকু রেখেই উঠে গেলেন৷

হাত ধুয়ে এসে দাওয়ায় একটু বসলেন ঠাকুরমশাই৷ সন্ধের পর নদীর দিক থেকে একটা ঝিরিঝিরি হাওয়া আসে৷ আকাশে এখন বৃশ্চিকরাশিতে অনুরাধা নক্ষত্র দৃশ্যমান৷ ওদিকে ধনুরাশিতে উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্র৷ আরও কয়েকটি নক্ষত্রকে দেখা মাত্র চিনলেন রামনারায়ণ, চিত্রা, জ্যেষ্ঠা, শ্রবণা৷

গিরিসুন্দরী রাতের খাওয়া শেষ করে স্বামীর পাশে এসে বসলেন৷ ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজকে আপনাকে বড় অস্থির দেখছি৷ জমিদারবাড়িতে কিছু হয়েছে?’

রামনারায়ণ সব কথাই গিন্নিকে জানালেন৷ তারপর চিন্তিতমুখে বললেন, ‘এ তো বড় চিন্তার ব্যাপার হল গিন্নি৷ এমন দুর্দান্ত ডাকাতদল, যাকে জমিদার মশাই অবধি সমঝে চলছেন, সে যদি আমাদের বাড়িতে চড়াও হয়…’

গিরিসুন্দরী বুঝলেন তাঁর স্বামীর উদ্বেগের কারণ৷ তাঁদের বাড়িতে ধনসম্পদ কিছু নেই বটে কিন্তু পরমাসুন্দরী কন্যা আছে৷ ডাকাতদল যদি তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তাহলে রামনারায়ণ আর গিরিসুন্দরীর আত্মহত্যা করা ছাড়া পথ থাকবে না৷

রামনারায়ণ জমিদারমশাইয়ের প্রস্তাবটা জানালেন৷ তারপর গিন্নিকে বললেন, ‘আমাদের তেমন কিছুই তো নেই জমিদারবাড়িতে রেখে আসার মতো৷ ভাবছি একটা সড়কি চেয়ে নিই, কী বলো?’

হেসে ফেললেন গিরিসুন্দরী৷ বললেন, ‘বাড়িতে ডাকাত পড়লে আপনি সড়কি চালাতে পারবেন তো?’

মৃদু হাসলেন রামনারায়ণ৷ তিনি শাস্ত্রজীবী ব্রাহ্মণ৷ জীবনে কখনও শস্ত্রধারণ করেননি৷ বাড়িতে ডাকাত পড়লে তিনি সড়কি চালিয়ে ডাকাত তাড়াবেন এ বড় কষ্টকর দূরকল্পনা৷ বললেন, ‘তাও, হাতে থাকলে একটু মনে বল আসে, এই আর কী৷’

গিরিসুন্দরী একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘তালকোঠরির বন্দ্যঘটীদের ছোট ছেলের ব্যাপারে কথা কিছু এগোল?’

হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রামনারায়ণ, ‘না গিন্নি৷ হরিসাধনমশাই যা পণ হেঁকে বসেছেন তা দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে৷ ও আশা তুমি ছাড়ো৷ হরু নাপিত তো আছেই, আমি দেবানন্দ ঘটককেও কাজে লাগিয়েছি৷ দেখি আমার মায়ের ভাগ্যে কেমন পাত্র জোটে৷’

গিরিসুন্দরী ম্লানমুখে বসে রইলেন৷ সেই দেখে কষ্ট পেলেন রামনারায়ণ৷ স্ত্রীর পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘চিন্তা কোরো না৷ মা আমাদের সর্বগুণসম্পন্না, অতি সুলক্ষণা৷ মা কিরীটেশ্বরী নিশ্চয়ই কোনও সুপাত্র জুটিয়ে দেবেন৷’

গিরিসুন্দরী বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই আশাতেই বসে থাকুন৷ পাত্র তো পুকুরপাড়ের হাঁস কী না, যে মেয়ে মাঠঘাট থেকে নিজেই ধরে আনবে৷’

সশব্দে হেসে উঠলেন রামনারায়ণ৷ সর্বমঙ্গলা তখন ঘুমোচ্ছিল৷ একবার চটকা ভেঙে উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে ফের ঘুমিয়ে পড়ল৷

তারপর একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করল সে৷ দেখল সে যেন গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে এক অন্ধকার পিণ্ডের মধ্যে৷ যেভাবে মায়ের পেটে বাচ্চারা থাকে, ঠিক সেভাবে৷ আর তাকে ঘিরে যতদূর চোখ যায়, দাউ দাউ করে জ্বলছে মস্ত বড় সব চিতার আগুন৷

* * *

বেহারাদের হুম হুম না হুম হুম না ডাকে অল্প দুলতে দুলতে পালকিটা যাচ্ছিল তালকোঠরি থেকে চণ্ডীপুর৷ ছয়জন বেহারা পালকি বইছে আর তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জনা আষ্টেক মুশকো চেহারার লাঠিয়াল৷

দুপুরের সূর্য এখন পশ্চিমমুখী৷ পাহারাদারদের সর্দার রঘু একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সবাই তাড়াতাড়ি পা চালা রে৷ ঈশান কোণে মেঘ জমেছে৷ লক্ষণ ভালো বুঝছি না৷ অন্ধকার হওয়ার আগেই বাঘার জঙ্গল আর মাঠ পেরোতে হবে৷ আর যদি কালবৈশাখী আসে তো কথাই নেই৷’

রঘু সর্দার যা বলছে তা মিথ্যে নয়৷ জ্যৈষ্ঠের প্রথম দিকে প্রায়ই ভয়ানক কালবৈশাখী ঝড় ওঠে৷ আর বাঘার জঙ্গলের ঘটনা শোনেনি এমন লোকজন এই অঞ্চলে নেই বললেই চলে৷ সবাই মিলে একটু জোরে দৌড়তে লাগল৷

একটু পর পালকির দরজায় একটি তরুণের মাথা উঁকি দিল৷ এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে হ্যাঁক দিল, ‘রঘু৷’

রঘু দৌড়ে এল, ‘বলুন ছোটকত্তা৷’

‘চণ্ডীপুর আর কতক্ষণ?’

‘আর প্রায় আড়াই ক্রোশ মতো ছোটকত্তা৷ বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছে যাওয়া উচিত৷ কেন, কিছু চাই?’

‘পালকি থামাও৷ আমার জল তেষ্টা পেয়েছে৷ সঙ্গে আনা জল শেষ৷’

রঘু প্রমাদ গনল৷ এই গ্রীষ্মের দুপুরে বার বার তেষ্টা পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক৷ কিন্তু ছোটকত্তা হলেন তালকোঠরি গ্রামের বন্দ্যঘটী বংশের কুলপ্রদীপ৷ ঘোর কুলীন ব্রাহ্মণ৷ তাঁর খাওয়াদাওয়া ছোঁয়াছুঁয়ির অনেক বাছবিচার মেনে চলতে হয়৷ এহেন ছোটকত্তার জলের ব্যবস্থা সে এখন করবে কোথা থেকে?

পালকি থামল৷ সেখান থেকে এক অনিন্দ্যসুন্দর তরুণ পা রাখল মাটিতে৷ বয়েস খুব বেশি হলে সতেরো-আঠেরো হবে৷ দোহারা ফর্সা চেহারা, একমাথা কোঁকড়ানো চুল৷ ফতুয়া ধুতি পরিহিত তরুণকে কন্দর্পকান্তি বললেও কম বলা হয়৷ তবে তার উপস্থিতির সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন অংশ হচ্ছে তার চোখদুটি৷ এমন টানাটানা উজ্জ্বল চোখ কমই দেখা যায়৷

সে মাটিতে পা রেখেই একবার কোমর বেঁকিয়ে, লাফালাফি করে শরীরের জড়তা দূর করে নিল৷ তারপর বলল, ‘তা আমরা কতদূর এলাম রঘু?’

রঘু ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘বাঘার জঙ্গল এল বলে ছোটকত্তা৷ বেলাবেলি এই মাঠ পেরিয়ে যেতে পারলেই সন্ধে নামার মুখে আমরা চণ্ডীপুর পৌঁছে যাব৷’

‘আর যদি বেলাবেলি না পেরোতে পারি?’

রঘু আঁতকে উঠল, ‘ভুলেও ও কথা উচ্চারণ করবেন না ছোটকত্তা৷ এই মাঠ আর ওই জঙ্গল বড় অলুক্ষুণে৷ আমাদের উচিত হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই মাঠ পেরিয়ে যাওয়া৷ আপনি দয়া কয়ে পালকিতে চড়ে বসুন ছোটকত্তা৷ বেহারাদের পালকি ছোটাতে বলি৷’

রঘুর এত সতর্কবাণী সত্ত্বেও কিন্তু দেখা গেল যে ছোটকত্তার তেমন হেলদোল নেই৷ সে খানিক এদিক ওদিক বেড়াল৷ আড়মোড়া ভাঙল৷ তারপর রঘুর কাছে ফিরে এসে বলল, ‘জল দাও৷’

রঘু আমতা আমতা করে বলল, ‘কাছেপিঠে তো পুকুর বা দিঘি নাই ছোটকত্তা৷ একটু অপেক্ষা করে যান৷ চণ্ডীপুর ঢুকেই আপনাকে জল খাওয়াব৷ মিঠে জল, ক্যাওড়া আর কর্পূর দেওয়া৷’

তরুণ হেসে বলল, ‘অতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না বাপু৷ তোমার ভিস্তিতে তো জল আছে? তাই দাও৷’

রঘু শুনে শিউরে উঠল৷ জিভ কেটে বলল, ‘অমন কথা বলবেন না কত্তা, শুনলেও পাপ হয়৷ আপনারা কুলীন ব্রাহ্মণ, আর আমরা হলাম গিয়ে নীচু জাত৷ আপনাকে জল খাইয়ে শেষে নরকবাসী হব নাকি?’

তরুণ সামান্য চোখ টিপে বলল, ‘আর যদি জল না পেয়ে আমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে? বলি ব্রাহ্মণহত্যার জন্য রৌরবে কত বছর থাকতে হয় সেটা জানা আছে?’

রঘু ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেহারাদের বলল, ‘ওরে তোল তোল, পালকি তোল৷ ইশ, অনেক দেরি হয়ে গেল৷ সন্ধে নামার আগেই চণ্ডীপুর পৌঁছতে হবে৷’

ততক্ষণে তরুণটি রঘুর ভিস্তি কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে বলল, ‘আহ, শান্তি৷ প্রাণটা জুড়োল৷’

রঘু একেবারে হায় হায় করে উঠল, ‘এ কী করলেন কত্তা? শেষে আমাকে নরকবাসী করলেন? বড়কত্তা জানলে আমাকে খড়মপেটা করবেন যে৷’

তরুণ ভিস্তি ফেরত দিয়ে বলল, ‘আরে জানলে তো করবেন৷ এই যে তোমরা, আমাকে কেউ রঘুর ভিস্তি থেকে আমাকে জল খেতে দেখেছ?’

বেহারা আর বাকি লাঠিয়ালরা সবাই ইতিউতি তাকাতে লাগল৷ কেউ আকাশের দিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে কাক গুনতে লাগল৷ কেউ বা খুব মন দিয়ে মাটি ঘাঁটতে লাগল৷ একজন তো বেশ জোরে বলে উঠল, ‘ছোটকত্তাকে দেখছি না যে? কত্তামশাই গেলেন কোথায়?’

তরুণটি মুচকি হেসে পালকিতে উঠে বলল, ‘জলের আবার জাতধর্ম হয় নাকি রঘু? চলো চলো, পালকি ওঠাতে বলো৷ অনেক দূর যেতে হবে৷’

পালকিবেহারারা আবার সেই হুম হুম না করতে করতে পালকি কাঁধে দৌড়তে লাগল৷ রঘু একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল ঈশান কোণের সেই মেঘ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে৷ সে মনে মনে একবার ঠাকুরকে স্মরণ করে দৌড়তে লাগল৷

কিন্তু ঠাকুর বোধহয় তখন অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন৷ রঘুর প্রার্থনা তাঁর কানে পৌঁছল না৷ কিছুদূর এগোতে না এগোতেই সেই মেঘের দল দ্রুত আকাশ ছেয়ে ফেলল৷ দিঁমি দিঁমি বজ্রহুঙ্কারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাঠের মাঝখানের জেগে উঠল ধুলোর ঘূর্ণিস্রোত৷ হু হু করে ধেয়ে এল ঠান্ডা হাওয়ার দল৷ মাঠের ধারে বাঘার জঙ্গল৷ সেখানে গাছেদের দল মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল পাগলের মতো৷ রঘু চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওরে তোরা পালকি জঙ্গলের দিকে নিয়ে চল৷ এই ফাঁকা মাঠে বাজ পড়লে আর রক্ষা নেই৷’

* * *

প্রতাপনারায়ণের কাছারিবাড়িতে লোকে লোকারণ্য৷ সবাই এসেছে তাদের সোনার গয়না আর সঞ্চিত মোহর কাছারিবাড়িতে জমা রাখতে৷ একদিকে নায়েব রজনীকান্ত সরকার বসে সবকিছুর তদারকি করছেন৷ সঙ্গে খাজাঞ্চি রতনলাল ঘোষ৷ হরিহর সাহা হল গিয়ে আশপাশের চারটে গাঁ মিলিয়ে সবচেয়ে বড় সোনার কারবারি৷ সে নিজে এসেছে কষ্টিপাথর আর নিক্তি নিয়ে৷ গয়নাগাঁটি সব পরখ করে গুনে গেঁথে সে খাজাঞ্চি মশাইয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে৷ আর নায়েবমশাই একটি তুলোট কাগজে সেসব গয়নার বিবরণ, ওজন, পরিমাণ, সব লিখে জমিদারমশাইয়ের মোহর মেরে কাগজটি তুলে দিচ্ছেন গয়নার মালিকের হাতে৷

দিগম্বর মুখুটি এসেছিলেন ছোট ছেলের হাত ধরে৷ তিনি গজেন হালুইকে দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী ব্যাপার গজেন৷ তুমি তো সর্বত্র বলে বেড়াও তোমার নাকি একেবারে হাঁড়ির হাল, বাড়িতে একবেলার বেশি রান্না হচ্ছে না? তাহলে আজ কী জমা দিতে এলে? হাঁড়িকড়াই নাকি হাতাখুন্তি?’

গজেন হালুই টুক করে সরে পড়লেন৷

ওদিকে গৌরীচরণ বাচষ্পতি ভারী খাপ্পা হয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছেন হরিহরের সঙ্গে, ‘ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় সময় বেয়াইমশাই গীতায় হাত রেখে বললেন পাকা সোনার মান্তাসা আর চন্দ্রমুখী হার দিয়েছেন, আর এখন তুমি বলছ সোনায় খাদ আছে? বললেই হল?’

হরিহর ঠান্ডা মাথায় বলল, ‘পাকা সোনায় গহনা হয় না কত্তা, ওতে শুধু মোহর বানানো যায়৷ গহনা বানাতে গেলে পাকা সোনায় অন্তত এক আনা খাদ দিতেই হয়৷ আমি আপনার বেয়াইমশাইয়ের অসম্মান করছি না৷ তবে তিনি খুব একটা ভুল বোধহয় বলেননি৷ এক আনা খাদের গয়নার সোনাকে পাকা সোনা বললেও চলে৷’

ওদিকে কালিপদ ভট্টাচার্য আর ভবানীপ্রসাদ সান্যালের মধ্যে ভারী গোল বেঁধে উঠেছে৷ দুইজনেই চণ্ডীপুরের স্বনামধন্য তার্কিক৷ আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচল, অমাবস্যা-দ্বাদশীতে কুষ্মাণ্ডভক্ষণ, একাদশীতে বালবিধবার অবশ্যকরণীয় কর্তব্য, সতীদাহের পুণ্য, এসব বিষয়ে দুজনেই মস্ত জ্ঞান রাখেন৷ কালিপদ এনেছেন তাঁর মৃতা মাতৃদেবীর হাতের হাতের সোনার কাঁকন, ভবানীপ্রসাদ এনেছেন তাঁর স্বর্গতা জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃবধূর সাতনরী হার৷ এই দুই ভদ্রমহোদয়াই তাঁদের স্বামীদের দেহাবসানের পর সহমৃতা হয়েছিলেন৷ আপাতত নবাবের অন্নে প্রতিপালিত দুই ব্রাহ্মণ ব্যস্ত কালী বড় না কৃষ্ণ বড়, এই কুতর্কে৷

কাজ শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে এল৷ একে একে অতিথি অভ্যাগতরা বিদেয় হলেন৷ নায়েব আর খাজাঞ্চিমশাই সমস্ত গহনা মোহর ইত্যাদি অন্দরমহলে নিয়ে গেলেন৷ ওখানে একটি বিশেষভাবে সুরক্ষিত গুপ্তকক্ষ প্রস্তুত করা হয়েছে এসব ধনসম্পদ গচ্ছিত রাখার জন্য৷

একে একে প্রায় পঞ্চাশ জন ঢাল তলোয়ারধারী মল্লবীর এসে প্রতাপনারায়ণকে প্রণাম করে দাঁড়াল৷ এরা পশ্চিমদেশের জঙ্গলের যুদ্ধব্যবসায়ী অধিবাসী৷ এরা যেমন শূরবীর, তেমনই নৃশংস৷ একমাত্র প্রভুর আদেশ ছাড়া কারও কথা শোনে না৷ প্রতাপনারায়ণ বহু অর্থব্যয়ে এদের নিয়োগ করেছেন৷

কালু ডোম বলল, ‘কত্তা, আদেশ দিন৷ এদের কাছারিবাড়ি পাহারার কাজে লাগাই?’

প্রতাপনারায়ণ মুখ থেকে হুঁকো নামিয়ে বললেন, ‘লাগিয়ে দে৷ বাড়ির সব দরজা, সিংহদুয়ার, পাছদুয়ার, খিড়কি সব জায়গায় এদের মোতায়েন কর৷ আর বাড়িতে যারা যাতায়াত করেন, নায়েবমশাই, খাজাঞ্চিমশাই, ঠাকুরমশাই, সববার সঙ্গে মুখচেনা করিয়ে দে, যাতে এঁদের কাছারিতে ঢুকতে কোনও অসুবিধা না হয়৷ ও, হ্যাঁ, তালকোঠরি থেকে হরিসাধন বন্দ্যঘটীর ছোট ছেলে শশিশেখর আসছে৷ দুদিন থাকবে আমার কাছে৷ তার অভ্যর্থনার যেন কোনও ত্রুটি না হয়, দেখিস৷’

‘যে আজ্ঞা কত্তামশাই,’ প্রণাম করে কালু বিদায় নিল৷

কাছারিবাড়ির একটু দূরে বটগাছের নীচে উড়নি দিয়ে মুখ ঢেকে একটা লোক বসেছিল৷ সবাই চলে যাওয়ার পর সে একটু দ্রুত পা চালাল৷ আকাশে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি নামল বলে৷

* * *

ক্কড়কড়াৎ শব্দে পৃথিবী কাঁপিয়ে বাজ পড়ল একটা৷ পালকির মধ্যে বসে থাকা শশিশেখর কেঁপে উঠল সেই প্রলয়ঙ্করী শব্দে৷ এদিকে তখন মুষলধারে শিলাবৃষ্টি নেমেছে৷ আর সেই সঙ্গে তুমুল ঝোড়ো হাওয়া৷ মনে হচ্ছে স্বয়ং ভোলা মহেশ্বর যেন ত্রিশূল হাতে এই পৃথিবী সংহারে উদ্যত হয়েছেন৷

পালকি বেহারা আর লাঠিয়ালের দল জলে ভিজে একেবারে জবুথবু৷ চারিদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার৷ এরই মধ্যে কোনওমতে জঙ্গলের ঠিক বাইরে একটা বিশাল বড় বটগাছের নীচে পালকি নামিয়েছে তারা, আর এই ঠান্ডা ধারাস্রোতে ঠকঠক করে কাঁপছে৷ আর প্রার্থনা করছে, ‘হেই মহাদেব, হেই শিবশম্ভু, এই শিল যেন আমাদের মাথায় না পড়ে৷’ এক-একটা শিল প্রায় ছোটখাটো পাথরের সমান৷ বটগাছের ঘন ডালপালায় আটকে তারা এদের মাথায় পৌঁছতে পারছে না বটে৷ তবে ভয়ে একেবারে কাবু করে দিয়েছে৷ এর ওপর তাদের সঙ্গে আনা মশালও ভিজে একসা, জ্বালানোর উপায়ই নেই৷

একটু পর রঘু পালকির দরজার কাছে মুখ নামিয়ে বলল, ‘ছোটকত্তা, একটা কথা আছে৷’

শশিশেখর পালকির মধ্যেই প্রায় আধভেজা ভিজে গেছিল৷ এই শীতল ঝোড়ো বাতাস তার অঙ্গে ঘোর কাঁপন ধরাচ্ছিল৷ সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল ‘কী হয়েছে রঘু?’

‘জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মশালের আলো দেখা যাচ্ছে৷ কারা যেন এদিকেই আসছে৷’

শশিশেখর কথাটা শুনল বটে, কিন্তু বুঝল না৷ এই প্রবল বৃষ্টিতে মশাল জ্বলার কথাই নয়৷ আর এত বৃষ্টি মাথায় করে আসছে কারা?

বেশিক্ষণ ভাবতে হল না৷ একটু পরে একদল ডাকাত মশালহাতে ঘিরে দাঁড়াল ছোট্ট দলটিকে৷ প্রত্যেকের হাতে ধারালো খড়্গ৷ তাদের পাথুরে লাল চোখ, শীতল দৃষ্টি, আর ঝাঁকড়া চুল দেখে ভয়ে বুক উড়ে গেল রঘুর সে বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে তোমরা? কী চাও?’

ডাকাতদের দলপতি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘পালকি তোল৷ আমাদের সঙ্গে যেতে হবে৷ সর্দার ডেকেছেন৷’

* * *

ডাকাতের দল ঘন জঙ্গলের মধ্যে যেখানে পৌঁছল সেটি একটি ফাঁকা জায়গা৷ বোঝা যায় যে অনেক পরিশ্রমে জায়গাটি মানুষের বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে৷ পুরো স্থানটির ওপর গাছের ঝাঁকড়া মাথারা মিলে চাঁদোয়ার মতো করে রেখেছে৷ তার নীচে ইতস্তত ছড়ানো কয়েকটি কুটির৷ একটি কুটির অপেক্ষাকৃত বড়৷ তার পেছনে একটি বিশাল বটগাছ৷

কুটিরের সামনে একজন দীর্ঘদেহী মানুষ রক্তাম্বর পরে নরকপাল থেকে অল্প অল্প করে কারণবারি পান করছিল৷

পালকি এসে সেই মানুষটির সামনে থামতেই শশিশেখর বেরিয়ে এল৷ আর চারিদিকে চেয়ে বুঝল অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়৷ তাদের কপালে বিস্তর দুঃখ আছে৷

পুরো জায়গাটি বড় বড় মশালের আলোয় আলোকিত৷ বৃষ্টির জল মশালের আলোর ওপর পড়ে ছ্যাঁকছোঁক আওয়াজ করছে৷ কিন্তু মশালগুলি নিভে যাচ্ছে না৷ দলে আরও অনেক ডাকাত আছে, তারা বিভিন্ন কাজে কাজে ব্যস্ত৷ কেউ খড়্গে শান দিচ্ছে৷ কেউ রান্নার আয়োজন করছে৷ কেউ বল্লমের ধার পরীক্ষা করছে৷

লোকটি কারণবারির পাত্রটা নামিয়ে বলল, ‘আসতে আজ্ঞা হোক৷ বসতে আজ্ঞা হোক৷ ওরে কে আছিস, ছোট কত্তাকে পাদ্যঅর্ঘ্যটা একটু এগিয়ে দে৷’

ডাকাতের দল যন্ত্রের মতো হেসে উঠল এই কথা শুনে৷ শশিশেখর কিন্তু ঘাবড়ালও না, উত্তেজিতও হল না৷ ঠান্ডা মাথায় বলল, ‘কে আপনারা? এখানে আমাদের ধরে এনেছেন কেন?’

সর্দার হো হো করে হেসে উঠল, ‘কেন ধরে এনেছি? ওরে তোরা কথা শোন৷ ছোটকত্তা জিজ্ঞেস করছেন ওঁকে আমি কেন ধরে এনেছি৷’

ডাকাতের দল আবার হেসে উঠল৷ কেন জানি না শশিশেখরের কানে হাসির রোল খট করে বাজল৷ মনে হল হাসিটা ঠিক স্বাভাবিক নয়৷

‘বলি তোমার পিতাঠাকুর তো কম অর্থসম্পত্তি জমাননি৷ সবই যদি তিনি ভোগ করবেন, তাহলে আমাদের মতো গরিবরা যায় কোথায় বলো দেখি ছোটকত্তা?’

শশিশেখের কিছু বলল না৷

‘আপাতত আমাদের এখানে থাকো কয়েকদিন৷ তোমার পিতাঠাকুরকে সংবাদ দিই৷ দেখি তিনি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের জন্য কতটা ব্যয় করতে সম্মত হন৷’

শশিশেখর বলল, ‘আপনি আমাকে, আমার পিতাঠাকুরকে চেনেন? আমি আজকে এখন এই পথ দিয়ে যাব জানলেন কী করে? আর আপনাকে কে বলল যে আপনি চাইলেই পিতাঠাকুর আপনাকে অর্থ দেবেন?’

‘হা হা হা৷ আমি কী করে জানলাম সে প্রশ্ন থাক৷ আর তুমি কী ভাব, তোমার পিতাঠাকুর যে তোমাকে বাঁচাবার জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করতে পারেন, সে আমি জানি না?’

‘তাই? কী করে জানলেন শুনি? গুপ্তচর লাগিয়েছেন?’

‘সে গুপ্তচর আমার আছে বটে৷ তবে গুপ্তচরের থেকেও ভালো কাজ কীসে হয় দেখবে? এই দেখো৷’

এই বলে সর্দার একটি বড় কাঁসার থালা সামনে রেখে সেটি কারণবারিতে কানায় কানায় পূর্ণ করল৷ তারপর ডান হাতের তর্জনী আর কনিষ্ঠা তাতে ডুবিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল৷

কয়েক মুহূর্ত পর শশিশেখর বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল ধীরে ধীরে সেই জলের ওপর ছবি ফুটছে৷ ওই তো, ওই তো তার পিতা, দাওয়ায় বসে কার সঙ্গে যেন আলোচনা করছেন৷ একটু পরে মা’কে দেখা গেল, তিনি মুংলী গাইকে জাবনা দিতে গোহালে ঢুকলেন৷ ধীরে ধীরে সে ছবি অস্পষ্ট হয়ে গেল৷ এবার অন্য ছবি৷ তাদের গ্রামের পথঘাট, আমবাগান, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীর্ণকায় নদীটি৷ নদীর ওপরে মেঘ জমেছে৷ ঝড় এল বলে৷

শশিশেখরের গরম লাগতে লাগল৷ কাঁপা কাঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করল, ‘এ কী? এখানে আমার বাড়ি ঘরের চিত্র ফুটে উঠছে কী করে?’

পাশ থেকে একটি ডাকাত কর্কশ গলায় বলে উঠল, ‘আমাদের প্রভু মহাসিদ্ধ ভৈরবসাধক, জানেন না হেন বিদ্যে নেই৷ মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হতে পারেন, শরীর পাহাড়ের মতো ভারী আবার পালকের মতো হাল্কা করে ফেলতে পারেন, জলের নীচে বেঁচে থাকতে পারেন, ইচ্ছেমতো ঝড়বৃষ্টি আনতে পারেন৷ এসব তো ওঁর বাঁ হাতের খেলা৷’

শশিশেখর লক্ষ্য করল ডাকাতটির স্বর কেমন যেন যান্ত্রিক ধরনের৷ চোখের মণিগুলোও নিষ্প্রাণ, পুতুলের যেমন হয়৷ কিন্তু কথাবার্তায়, বলার ভঙ্গিতে একটা উগ্র হিংস্র ক্ষুধার ভাব ফুটে বেরোচ্ছে৷ যেন এতগুলো মানুষকে দেখে তার হাত নিশপিশ করছে ছিঁড়ে ফেলার জন্য৷

এবার সে বাকিদের দিকে তাকাল৷ সবারই মুখচোখের একই রকমের ভাব৷ চোখ নিষ্প্রাণ, বসার ভঙ্গিমা যান্ত্রিক৷ কিন্তু সারা দেহে খেলে বেড়াচ্ছে বন্য উন্মাদনা৷ যেন কোনও অদৃশ্য বন্ধন তাদের সবলে বেঁধে রেখেছে, সেই বাঁধন সরে গেলেই হিংস্র তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে শিকারের ওপর৷

মাথা ঠান্ডা করল শশিশেখর, এখন তার ভয় পেলে চলবে না৷ সে জিজ্ঞেস করল, ‘আর আমার পিতা যদি অর্থ দিয়ে দেন, তাহলে আমাদের ছেড়ে দেবেন তো?’

হা হা করে হেসে উঠল সর্দার আর তার দলবল৷ উদ্দাম কালবৈশাখী ঝড়ের শোঁ শোঁ আওয়াজ পেরিয়ে সেই হাসির শব্দ শুনে শিউরে উঠল বাঘার বন৷ যেন কোনও এক ভয়ের করালগ্রাস নেমে আসতে লাগল এই চত্বরটি জুড়ে৷

হাসি থামলে উঠে দাঁড়াল সর্দার৷ তারপর বলল, ‘ছেড়ে তো দেবই৷ তোরা তো মুক্তি চাস, সেই মুক্তির ব্যবস্থাই করে দেব তোদের৷’

কথাটা শুনে রঘু আর তার ছোট কত্তা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল৷ রঘু করজোড়ে বলল, ‘কোন মুক্তির কথা বলছেন সর্দার?’

সর্দার একটা মশাল তুলে লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গেল বটগাছের অন্ধকার গোড়ার দিকে৷ জায়গাটি আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল৷ শশিশেখর আর বাকিরা দেখল সেখানে বেদির ওপর একটি তিন হাত উচ্চতার প্রস্তরনির্মিত দেবমূর্তি৷ দেবমূর্তির আকৃতি কোনও কুমার বা বালকের৷ দেবমূর্তি সম্পূর্ণ উলঙ্গ, সর্পাবরণে ভূষিত এবং মুখমণ্ডল মহাক্রোধে উদ্ভাসিত৷ ডানহাতে একটি নরকপাল, দেবমূর্তির চোখ সেই কপালে নিবদ্ধ৷ বামহাতে একটি মূষিক গোত্রের প্রাণী৷ দেবমূর্তির পায়ের কাছে একটি হাড়িকাঠ৷ আর তার পাশেই রাখা আছে একটি ভয়ঙ্করদর্শন বিশালাকৃতির খড়্গ৷

শশিশেখর ভয়ার্তস্বরে বলল, ‘আপনি আমাদের বলি দেবেন? আপনি কি কাপালিক?’

সর্দার ব্যঙ্গের স্বরে বলল, ‘এই তো ঠিকঠাক ধরতে পেরেছ দেখছি৷ আপাতত তোমরা আমার অতিথি৷ বিশ্রাম করো৷ খাও দাও৷ আর কয়েকদিন পর কৌশিকী অমাবস্যা৷ সেদিন তোমাদের চিরমুক্তির ব্যবস্থা করছি৷’

চলে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়াল সর্দার, ‘আর হ্যাঁ, ভুলেও কিন্তু পালাবার চেষ্টা কোরো না৷ ওই ওদের দিকে তাকিয়ে দেখ৷ ওরা কিন্তু না বললেও সব বুঝতে পারে, অন্ধকারেও সব দেখতে পায়, আর ওদের হাতের মশাল কিছুতেই নেভে না৷ আমার আদেশ ভিন্ন এই জঙ্গল থেকে বেরোবার কারও ক্ষমতা নেই৷ আর তোমরা যদি সেই আদেশ অমান্য করো, তাহলে কিন্তু ওরা তোমাদের জ্যান্ত ছিঁড়ে খাবে৷ মনে থাকে যেন৷’

রঘু চারিদিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা কারা সর্দার?’

‘আজ অবধি আমি যাদের বলি দিয়েছি, ওরা তারাই৷’

* * *

রাতের দিকে প্রতাপনারায়ণ খেয়ে দেয়ে শুতে যাওয়ার উদ্যোগ করছেন, এমন সময় গৃহভৃত্য কানাই এসে সংবাদ দিল, ‘কত্তামশাই, আপনার সঙ্গে কারা যেন দেখা করতে এয়েছে৷’

প্রতাপনারায়ণ ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, ‘কে? শশিশেখর? সে এসে পৌঁছতে পেরেছে তাহলে? আমি তো ভাবলাম এই ঝড়জল দেখে রাত্রে কোথাও আশ্রয় নিয়েছে বোধহয়৷’

কানাই বলল, ‘আজ্ঞে না কত্তামশাই, একজন সাধু আর একজন ব্রাহ্মণ এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান৷’

প্রতাপনারায়ণ বিস্মিত হলেন৷ সাধু আর ব্রাহ্মণ? এত রাতে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কালু জানে?’

‘আজ্ঞে জানে বই কি৷ সেই তো সদর দেউড়িতে আটকাল৷ এখন তো পাহারাদারেদের চোখ এড়িয়ে মাছিটি গলবার উপায় নেই কী না৷ কালুই বলল আপনাকে খবর দিতে৷’

প্রতাপনারায়ণ পালঙ্ক থেকে নেমে এলেন৷ গায়ে ফতুয়া গলিয়ে হরিণের চামড়ার চটি পায়ে দিয়ে বাইরে এসে দেখলেন দুইজন্য মধ্যবয়সী অতিথি দাঁড়িয়ে আছেন৷ তাঁদের মধ্যে সন্ন্যাসীটির গায়ে গৈরিকবাস, খালি পা, সারা মুখভরতি দাড়ি গোঁফ আর মাথায় একটি মস্ত জটা কুণ্ডলী করে রাখা৷ অন্যজন গলায় পৈতে ঝোলানো সাধারণ ব্রাহ্মণ৷ তাঁর মাথায় মস্ত শিখি, পরনে উড়নি আর ধুতি, ক্ষৌরি করা মুখ আর চোখ দু’খানি ভারী জ্বলজ্বলে৷

অতিথি দুজন নমস্কার করলেন৷ প্রতাপনারায়ণ প্রতিনমস্কার করে বললেন, ‘বলুন, অতিথিদেব, আপনাদের কী সেবা করতে পারি৷’

ব্রাহ্মণটি শান্তস্বরে বললেন, ‘গৃহস্থের কল্যাণ হোক৷ আমরা দুই বন্ধু এই ঝড়ের রাতে পথ ভুল করে এই গ্রামে এসে পড়েছি৷ এক রাতের জন্য আশ্রয় পাওয়া যাবে?’

প্রতাপনারায়ণ শশব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘সে তো বটেই, সে তো বটেই৷ ব্রাহ্মণ আর সন্ন্যাসী আমার দরজায় এসেছেন সে তো আমার সৌভাগ্য৷ ওরে কানাই, নিতাই, তোরা দৌড়ে আয়৷ এঁদের কুয়োতলায় নিয়ে যা, গামছা, আর নতুন কাপড় বার করে দে৷ আপনারা হাত পা ধুয়ে আসুন, আপনাদের নৈশাহারের আয়োজন করছি৷’

একটু পর নতুন অতিথিরা দাওয়াতে এসে বসলেন৷ সন্ন্যাসীর অঙ্গে তাঁর গৈরিক বসন, তিনি এ ছাড়া অন্য পোশাক অঙ্গে ধারণ করেন না৷ তবে অন্যজন প্রতাপনারায়ণের দেওয়া নতুন ধুতি, নতুন ফতুয়া পরেছেন৷

প্রতাপনারায়ণ হাত জোড় করে বললেন, ‘আপনাদের পরিচয়…’

ব্রাহ্মণ বললেন, ‘আমাদের নিবাস নবদ্বীপে৷ আমার নাম কৃষ্ণানন্দ মৈত্র৷ অধ্যাপনা আর পৌরোহিত্য করে গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করি৷ আর দিন কাটে মা জগদম্বিকার নাম করে৷ আর ইনি হলেন আমার বিশিষ্ট মিত্র, শ্রী জটাধারী পরমহংস৷ লোকমুখে অবশ্য ইনি অন্য নামে প্রসিদ্ধ, জাটিয়া জাদু৷ আমরা এদিকে এক জায়গায় মাতৃআরাধনায় যোগ দিতে এসেছিলাম৷ ফিরে যাওয়ার সময় দেখি এই তুমুল বিপর্যয়৷ তাই এখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি৷’

প্রতাপনারায়ণ ভারী প্রীত হলেন৷ বললেন, ‘আহা, আপনাদের পদরজে আমার ভবন ধন্য হল৷ জানি না আপনারা জানেন কি না, আমাদের বাড়িতে মা কিরীটেশ্বরী গৃহদেবী রূপে পূজিতা হন৷ আজ বিশ্রাম করুন, কাল মায়ের দর্শন আর ভোগপ্রসাদের ব্যবস্থা করব৷’

কৃষ্ণানন্দ দু’হাত মাথায় ঠেকালেন, ‘জয় মা কিরীটেশ্বরী৷ সবার মঙ্গল করো মা৷’

প্রতাপনারায়ণ দুটি হুঁকোর নল অতিথিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সেবা করতে ইচ্ছে হোক৷ এই গড়গড়া দুটি ব্রাহ্মণদের জন্যই নির্দিষ্ট, অন্য জাতের লোক মুখ দেয় না৷’

সন্ন্যাসীটি গড়গড়ার নল মুখে নিয়ে বললেন, ‘দিলেই বা কী? আমি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী৷ আমার অত ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক নেই৷’

ব্রাহ্মণ সহাস্যে বললেন, ‘মিছে কথা বোলো না জাটিয়া৷ ওই সন্ন্যাসীর বেশ তোমার ভেক৷ নইলে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর আবার হুঁকোর অভ্যেস হল কী করে?’

সন্ন্যাসী হুঁকোয় একটা টান দিয়ে বললেন, ‘দেখো আমার কাছে সবই সমান৷ বিষ্ঠাও যা অমৃতও তাই, ব্রাহ্মণ-শূদ্রে ভেদ নাই৷ তাই মা যখন যা জুটিয়ে দেন, তাকেই প্রসাদ বলে মনে করি৷’

কৃষ্ণানন্দ গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে বললেন, ‘তা ভালো৷ তা জমিদারমশাইয়ের অনেক নাম শুনেছি৷ মশাইয়ের নাকি দেবদ্বিজে, শাস্ত্রালোচনায়, পঠন-অধ্যাপনায় ভারী উৎসাহ৷ শুনে ভারী ভালো লাগল৷’

প্রতাপনারায়ণ সামান্য লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘ও তেমন কিছু নয়৷ মানুষের অর্জিত সম্পদ মানুষের যতটা কাজে লাগানো যায় আর কী৷’

‘তা বেশ৷ তবে আপনার জমিদারবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ কিন্তু বড়ই কড়া৷ যেসব প্রহরীদের রেখেছেন তারা ভারী সতর্ক৷’

‘তার কারণ আছে মৈত্রমশাই৷ এমনি এমনি এত পাহারা চৌকি বসাতে হয়নি৷’

কৃষ্ণানন্দ কৌতূহলী হলেন, ‘বটে? কীরকম শুনি?’

প্রতাপনারায়ণ সব কথা খুলে বললেন৷ শুনে দুজনেই অনেকক্ষণ ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ‘কাজটা ঠিক করলেন না ভুল সেটা বুঝতে পারছি না৷ যাই হোক৷ আশা করি এই উপদ্রব বেশিদিন আপনাদের বিব্রত করবে না৷’

বলতে বলতেই দেউড়ির বাইরে থেকে একটা শোরগোল শোনা গেল৷ ধর ধর বলতে বলতে কারা যেন খিড়কির দিকে ছুটে গেল৷ প্রতাপনারায়ণ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন৷ আমি একবার দেখে আসি৷’

প্রতাপনারায়ণ বারান্দা থেকে নামার উদ্যোগ করতেই কালু ডোম ছুটে এল৷ প্রতাপনারায়ণ প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার রে কালু?’

কালু উত্তেজিতভাবে বলল, ‘কে যেন দরজার সামনে ঘোরাঘুরি করছিল৷ দরওয়ান ধাওয়া করতেই খিড়কি দরজার দিকে পালিয়ে গেল৷’

প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘বটে? চল তো দেখি এত বড় সাহস হয়েছে৷’

কৃষ্ণানন্দ দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘দাঁড়ান জমিদারমশাই৷ যাবেন না৷’

প্রতাপনারায়ণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কেন?’

কৃষ্ণানন্দ কিছু না বলে আকাশের দিকে তর্জনীনির্দেশ করলেন৷

ঝড়জলের পর আকাশ তখন পরিষ্কার হয়ে এসেছে৷ একটি দুটি করে তারা ফুটছে আকাশে৷ তারই মধ্যে প্রতাপনারায়ণ সবিস্ময়ে দেখলেন একটা বিশাল ছায়া তাঁর বাড়ির খিড়কি দুয়ারের ওপর ঝুলে আছে৷ শুধু ঝুলে আছে তা নয়, সেই ছায়া শুধু ছটফট করছে আর তার মুহুর্মুহু তার আকার বদলে বদলে যাচ্ছে৷ সেই ছটফটানি দেখে মনে হচ্ছে যেন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেই ছায়াশরীর, কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য বাঁধন তাকে মুক্তি দিচ্ছে না৷

প্রতাপনারায়ণ সভয়ে বললেন, ‘কী ওটা?’

কৃষ্ণানন্দ আড়চোখে দেখলেন জাটিয়া জাদু ধ্যানস্থ৷ তাঁর ডানহাতে হুঁকোর গড়গড়া যেমন ছিল তেমন আছে৷ বসার ভঙ্গিতেও কোনও পরিবর্তন হয়নি৷ শুধু তাঁর চোখদুটি বন্ধ৷

একটু পর সেই ছায়াশরীর কোনওক্রমে বাঁধন ছিঁড়ে পালাতে সক্ষম হল৷ আর সেই সঙ্গে একটা অশরীরী আর্তনাদের শব্দ ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বচরাচরে৷

জাটিয়া জাদু ধ্যান ভেঙে বললেন, ‘আমি আর কৃষ্ণানন্দ একবার আপনার বাড়ির চৌহদ্দি পরীক্ষা করতে চাই জমিদারমশাই৷ ব্যবস্থা করুন৷’

একটু পর কালু ডোম আর জনা ছয়েক পাইক মশাল আর সড়কিহাতে উপস্থিত হল৷ তাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতাপনারায়ণ, কৃষ্ণানন্দ আর জাটিয়া জাদু জমিদারবাড়ির চৌহদ্দি প্রদক্ষিণ করতে করতে খিড়কির কাছে এসে স্থির হলেন৷ জাটিয়া মাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, ‘কী ওটা?’

সবাই দেখলেন মাটিতে চারটি পায়ের ছাপ৷ দেখে মনে হয় যেন কোনও পাখি বা ইঁদুরের পা৷ কিন্তু সে ছাপ এতই বড়, এতই অতিকায় যে উপস্থিত সকলে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন৷ একটু পর প্রতাপনারায়ণ কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব কী হচ্ছে মৈত্রমশাই? এ কার পায়ের ছাপ? আকাশে ও কার ছায়া?’

মৈত্রমশাই গম্ভীরমুখে বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না জমিদারমশাই৷ আপনি এক কাজ করুন, বাড়িতে গঙ্গাজল আছে? তাহলে এক ঘটি গঙ্গাজল আর মায়ের পায়ের বেলপাতা আমাকে দিয়ে যান৷’

একজন পাইক দৌড়ে গিয়ে গঙ্গাজলের ঘটি নিয়ে এল৷ অত রাতে কিরীটেশ্বরীর মন্দির খুলে মায়ের পায়ের বেলপাতা নিয়ে এলেন প্রতাপনারায়ণ স্বয়ং৷ কৃষ্ণানন্দ আর জাটিয়া জাদু বেলপাতা দিয়ে সেই জল মন্ত্র পড়ে বাড়ির চারিদিকে ছিটিয়ে দিলেন৷

সব কাজ শেষ করে সবাই যখন দাওয়ায় এসে বসলেন, তখন প্রায় মধ্যরাত৷ প্রতাপনারায়ণ হাত জোড় করে বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে মৈত্রমশাই৷ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷’

কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘আপনার বাড়ির ওপর কোনও অতিজাগতিক অশরীরী ছায়া পড়েছে জমিদার মশাই৷ খুব সাবধানে থাকতে হবে৷ আজ রাতের চিন্তা নেই, একটা বাঁধন কেটে দিয়েছি৷ কিন্তু মনে হচ্ছে একটা দুদৈব আসন্ন৷ সাবধানে থাকবেন৷’

প্রতাপনারায়ণ হাত জোড় করে বললেন, ‘কী যে করব কিছু মাথায় আসছে না৷ অনুরোধ করি কয়েকটা দিন আমার এখানে আতিথ্য গ্রহণ করুন৷ এই সঙ্কট কেটে গেলে…’

জাটিয়া জাদু মাথা নেড়ে বললেন, ‘সে হওয়ার উপায় নেই জমিদারমশাই৷ আমি গৃহত্যাগী৷ পরপর দু’রাত গৃহস্থের ছাদের তলায় কাটানোয় গুরুর নিষেধ আছে৷’

কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘ঠিক আছে৷ তুমি না হয় মায়ের মন্দিরের চাতালে রাত কাটিও জাটিয়া৷ চাতালের ওপর ছাউনি আছে৷ রাতে শুতে অসুবিধা হবে না৷ মায়ের মন্দিরে রাত কাটাতে তো আর তোমার গুরুর নিষেধ নেই৷’

জাটিয়া জাদু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘তোমার যে বড় থাকবার শখ দেখছি৷’

কৃষ্ণানন্দ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘এ বাড়ির ওপর একটা ঝড় আসতে চলেছে জাটিয়া, এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি৷ আজ যে অশরীরী ছায়া দেখলে, সে সামান্য কোনও জিনিস না৷ অষ্টসিদ্ধির সবক’টি সিদ্ধি আয়ত্তে না এলে কারও পক্ষে ও জিনিস প্রক্ষেপ করা সম্ভব নয়৷ অত্যন্ত সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটার আশঙ্কা করছি আমি৷ আর যিনি আমাদের রাতের আশ্রয় দিয়েছেন, এই দুর্দিনে তাঁকে বিপদের মুখে ফেলে চলে যাওয়ার শিক্ষা আমার গুরু আমাকে দেননি৷’

জাটিয়া জাদু বললেন, ‘অগত্যা আর কী৷ আমার শোয়ার ব্যবস্থা তাহলে মন্দির চাতালেই করুন জমিদার মশাই৷’

* * *

জঙ্গলের নির্জন রাত৷ মশালগুলি প্রায় নিভু নিভু হয়ে এসেছে৷ পরিষ্কার আকাশে দ্বাদশীর বাঁকা চাঁদ, আর তাকে ঘিরে তারাদের দল৷

আরাধ্য ইষ্টদেবতার পদতলে বসেছিল সর্দার৷ তার মুখখানি যন্ত্রণায় বেঁকে আছে৷ চেহারা পোশাক অবিন্যস্ত৷ মনে হচ্ছে যেন একটা বড় লড়াই থেকে কোনওমতে উদ্ধার পেয়ে ফিরে এসেছে সে৷

কী হয়ে গেল মাথায় ঢুকছিল না তার৷ এতদিনের সাধনা, অর্জিত ক্ষমতা, এক লহমায় ব্যর্থ হয়ে গেল? কী করেনি সে এই সিদ্ধিলাভের জন্য? সংসারত্যাগ করেছে, গুরুর পায়ের কাছে বসে অঘোরী সাধনা করেছে৷ শবচালনা শিখেছে, আয়ত্ত করেছে দুরূহতম সাধনসিদ্ধি, সুসম্পন্ন করেছে যাবতীয় ভূতাদিযজ্ঞ৷ নরবলির রক্তে তুষ্ট করেছে ইষ্টদেবকে৷ তৈরি করেছে মৃতদের পিশাচ সেনানী৷ তার তুল্য শক্তিশালী তন্ত্রবিদ কে আছে আর এই সংসারে?

তাও আজ তার ছায়াশরীর জড়িয়ে ধরল কে? তার থেকেও বড় সাধক আছে তাহলে? কে সে? সে এমন অমিত শক্তির অধিকারী হল কী করে?

চারিদিকের কুটিরগুলি বন্ধ৷ সর্দার জানে আজ যাদের ধরে আনা হয়েছে তারা ঘুমিয়ে আছে অঘোরে৷ তাদের খাবারে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে একধরনের বিশেষ ভেষজ বিষ৷ বিষের মাত্রা নির্দিষ্ট, কাল ভোর অবধি টানা ঘুমোবে তারা৷

আর তার দলের সদস্যরা? তারা বিছানায় শুয়ে আছে মৃতদের মতো৷ একটিমাত্র, তার একটিমাত্র মন্ত্রোচ্চারণে জেগে উঠবে সেই অশরীরী পিশাচের দল, আর তার পায়ের কাছে নতজানু হয়ে যান্ত্রিকস্বরে বলবে, ‘বলুন সর্দার, কী আদেশ৷’

ফের যন্ত্রণা ছটফটিয়ে উঠল সর্দার৷ এই নশ্বর শরীরের ব্যথা বেদনা তো সে জয় করেছিল আগেই৷ আজ তাহলে তার শরীরে এই বিষব্যথা এল কেমন করে?

একটু পরে দুটি হাত বিশেষ মুদ্রায় সংহত করল সে৷ গুরু শিখিয়েছিলেন এই বিশেষ বিষমুদ্রা৷ এতে শরীরের ব্যথা বেদনার উপশম হয়৷

খানিকপর একটি পিতলের থালা নিয়ে সামনে বসল সে৷ কারণবারিতে সে থালা কানায় কানায় পূর্ণ করল৷ এই মায়াদর্পণে ইচ্ছেমতো কোনও জায়গার দৃশ্য দেখা যায় বটে, কিন্তু তার একটি সীমাবদ্ধতা আছে৷ যেখানে মানুষজন, জীবজন্তু, বা প্রাণের সাড়া আছে এমন দৃশ্যগুলিই দেখা যায়৷ গোপন, নির্জন, জনহীন স্থানের ছবি ফুটে ওঠে না৷ কিন্তু এই অঞ্চলের যাবতীয় সোনা এখন নির্জন গুপ্তকুঠুরিতে বদ্ধ৷ সেখানে তার মায়াদর্পণের দৃষ্টি পৌঁছবে না৷৷

তাই তাকে নিজে যেতে হয়েছিল জমিদারবাড়িতে, ছায়াশরীর নিয়ে৷

খবরটা এনেছিল ভীম৷ চণ্ডীপুরের জমিদার যে ঢেঁড়া পিটিয়ে এলাকার সব অলঙ্কার নিজের কাছারিবাড়িতে জমা রাখতে বলেছে সে খবরটা তার কানে আগেই এসেছিল৷ মনে মনে হেসেছিল সে৷ মূর্খ, নেহাত মূর্খ না হলে কেউ এই কাজ করে না৷ আসলে জমিদারমশাই বোধহয় ভেবেছেন এসব সাধারণ চোর ডাকাত বা ঠগীদের কাজ৷ আসল কারণটা যদি তিনি জানতেন, তাহলে এই দুঃসাহস করতেন না৷ তবে জমিদারমশাই নিজের অজান্তেই সর্দারের কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছেন৷ তাকে আর তার পিশাচদলকে সোনাদানার খোঁজে এদিকওদিক ঘুরে বেড়াতে হবে না৷

সামান্য ঘুরে নিজের ইষ্টদেবের দিকে তাকাল সর্দার৷ আর কয়েক তোলা৷ আর মাত্র কয়েক তোলা সোনা পেলেই নিজের ইষ্টদেবের সোনার মূর্তি গড়তে পারবে সে৷ আর তারপর?

হাসি ফুটে উঠল সর্দারের মুখে৷ ইষ্টদেব সন্তুষ্ট হলে এই ধরাতলের সমস্ত ধনসম্পদ তার হাতের মুঠোয়৷ বাদশাহ আকবর স্বয়ং তার পাদবন্দনা করবেন৷ ক্ষমতা, অর্থ, প্রতাপ, সুখ, সমস্তকিছুই অনায়াসে তার করায়ত্ত হবে৷ এই সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি হবে সে৷

আর সেই জন্যই তো মহাচীন থেকে এই দুরূহবিদ্যার পাঠ নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে সে৷

আস্তে আস্তে সেই কারণবারিতে তর্জনী আর কনিষ্ঠা ডোবাল সে৷ অস্ফুটে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল৷ ক্রমে সেই অদ্ভুত মন্ত্রের শব্দ মিশে যেতে লাগল রাত্রির গাঢ় অমানিশার সঙ্গে৷ একটু পর স্থির কারণবারিতে ফুটে উঠতে লাগল ছবি৷ বিভিন্ন সব ছবি৷

কিন্তু এ কী! ছবিগুলো স্থির হচ্ছে না কেন? কেন কাঁপতে কাঁপতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কেন? তার হাত কাঁপছে নাকি? নিজের হাতের দিকে তাকাল সর্দার৷ কই, না তো৷ তার তার আঙুল তো স্থিরই আছে৷ তাহলে ছবিগুলো ফুটতে ফুটতে আবার নিস্তরঙ্গ কারণবারিতে মিশে যাচ্ছে কেন?

অনেকবার চেষ্টা করল সর্দার৷ কিন্তু কিছুতেই তার প্রয়োগবিদ্যা স্থির হল না৷ শতেক চেষ্টাতেও সে চণ্ডীপুরের জমিদারবাড়ির আশপাশের চিত্র ফুটিয়ে উঠতে পারল না৷

থালা থেকে মন্ত্রপূত কারণবারিটা এক চুমুকে খেয়ে নিল সর্দার৷ একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি, কণ্ঠার হাড়, বুক পেরিয়ে নামতে লাগল সেই তরল৷ হাত কাঁপছে সর্দারের, এইবার তার হাত কাঁপছে৷ কী হল? তার অধীত বিদ্যা আজ বিফল হয়ে যাচ্ছে কেন? তাহলে কি ইষ্টদেব বিমুখ হলেন?

একটু পর মাথা ঠান্ডা হলে ব্যাপারটা আবার প্রথম থেকে ভাবতে বসল সর্দার৷ খুব সম্ভবত জমিদারমশাই লেঠেল পাহারায় বসিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি৷ তাই কোনও শক্তিশালী কাপালিক বা অঘোরীর সাহায্য নিয়েছে৷ নইলে এমন অনর্থ হতে পারে না৷ ঠিক আছে, সেও মস্ত গুরুর শিষ্য, সেও দেখে নেবে কার কত ক্ষমতা৷

একটুপর আবার ঘটি থেকে কারণবারি নিয়ে থালাটি কানায় কানায় পূর্ণ করল সে৷ ভীম কী যেন বলেছিল? কারা কারা যেন কাজ করে জমিদারবাড়ির কাছারিতে?

এইবার, এইবার তার প্রয়োগ সফল হল৷ একের পর এক ছবি ফুটে উঠতে লাগল নায়েব, খাজাঞ্চি, পুরোহিত, কালু ডোম, সবার বাড়িঘরদোরের৷ ছবির পর ছবির ফুটে উঠে মিলিয়ে যেতে লাগল৷ সর্দার তন্ময় হয়ে দেখতে লাগল সেসব৷

একটা ছবিতে এসে তার আঙুল স্থির হয়ে গেল৷ কে এই অপরূপা সুন্দরী মেয়েটি? আহা, কী রূপ, কী লাবণ্য, যেন স্বর্গের দেবী নেমে এসেছেন এই ধরাধামে৷ এমন মনোহারিণী রূপ আগে কখনও দেখেনি সর্দার৷ আর দেহলক্ষণ? এমন দেহলক্ষণ তো কোটিকে গুটিক মেলে৷ এই তাহলে পুরোহিতমশাইয়ের মেয়ে?

চোখ চকচক করে উঠল সর্দারের৷ এই তো, লোহার বাসরঘরে ঢোকার ছিদ্র খুঁজে পেয়েছে সে৷ এবার এক ঢিলে দুই পাখি৷

ভোর হয়ে আসছে৷ আনন্দে হাতে হাত ঘষল সর্দার৷ যা করার আজই৷

* * *

সেই রাতে অদ্ভুত স্বপ্নটা আবার দেখল সর্বমঙ্গলা৷ দেখল সে যেন গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে এক অন্ধকার পিণ্ডের মধ্যে৷ যেভাবে মায়ের পেটে বাচ্চারা থাকে, ঠিক সেভাবে৷ যতদূর চোখ যায়, চারিদিকে দাউ দাউ করে জ্বলছে বড় বড় সব চিতা৷ তাদের আকাশ ছুঁই ছুঁই লেলিহান শিখা দেখলে মনে হয় যেন স্বর্গ মর্ত্য পাতাল সব গ্রাস করতে উদ্যত সেই আগুন৷ আর চারিদিকে কেউ নেই৷ কিছু নেই৷ আকাশ নেই, ভূমি নেই, মানুষ, পশু, প্রাণী, জল স্থল অন্তরীক্ষ, কিচ্ছু নেই৷ শুধু আছে ওই চিতার কাঠপোড়ার শব্দ আর দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের নিঃশ্বাস৷

ধীরে ধীরে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল সর্বমঙ্গলা৷ নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সে৷ তার পরনে শাড়ি কই? এই বাঘছাল তাকে কে পরিয়ে দিল? তার দুই বাজুতে দুটি সাপ জড়িয়ে আছে কেন?.দুই পায়ের গোছে দুটি সাপ এল কোথা থেকে? একটি কালনাগিনী তার মাথার ওপর ফণা উঁচিয়ে আছে কেন?

তার ঠিক সামনে একটি বিশাল চিতা জ্বলছে৷ সেই চিতার আগুন যেন তাকে ডাকতে লাগল, আয়, আয় আয়৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়াল সে৷ ধীরে ধীরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল সেইদিকে৷ এইবার সেই মহাকালান্তক হুতাশন তার একদম সামনে৷ অথচ ভয় পাচ্ছে না সে৷ মনে হচ্ছে এই শ্মশান, এই চিতার সমারোহ, এই আগুনের আনন্দ যেন তার বহুকালের চেনা৷

জ্বলন্ত কাঠের ওপর পা ফেলে ফেলে চিতার ওপরে উঠতে থাকল সে৷ অথচ সেই আগুন তাকে স্পর্শ করছে না৷ তাকে ঘিরে তাথৈ তাথৈ নাচছে সর্পিল শিখার দল৷ আহা, কী আনন্দ, কী আনন্দ তার শরীর জুড়ে৷ তার এক পায়ে জন্মের উল্লাস, আরেক পায়ে মৃত্যুর হাহাকার৷

আস্তে আস্তে সেই শ্মশানের মধ্যে একটা আর্তি জেগে উঠল৷ আগুনের শিখায় শিখায় উন্মাদের মাতম জেগে উঠল৷ মনে হল সমস্ত বিশ্বচরাচর, জগৎব্রহ্মাণ্ড যেন প্রসবযন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপছে৷ একটা, চিৎকার, কান্না, বেদনার কলরোল ঘুরে ঘুরে কেঁদে চলেছে তাকে ঘিরে৷ তবুও তার চলা থামল না৷ ক্রমশ সে সেই চিতার ওপরে উঠছে৷ তার পায়ে লেগে খসে পড়ছে জ্বলন্ত কাঠ৷ ক্রমে তার কোমর অবধি ডুবে গেল আগুনের ঢেউয়ে৷

আর তখনই সে দেখল চিতার ওপর কে যেন শুয়ে আছে৷ কে শুয়ে আছে ও?

হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসল সর্বমঙ্গলা৷ সমস্ত গা ঘামে ভিজে গেছে তার৷ দ্রুত উঠে মুখে চোখে জল দিল একটু৷ তারপর পুবের দিকে তাকিয়ে দেখল ভোর হতে চলেছে৷

* * *

প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘আপনার সঙ্গে এঁদের আলাপ করিয়ে দিই ঠাকুরমশাই৷ ইনি কৃষ্ণানন্দ মৈত্র, অধ্যাপনা করেন৷ ইনি জটাধারী পরমহংস, লোকে বলে জাটিয়া জাদু, মায়ের সেবক৷ আর ইনি হলেন রামনারায়ণ মিশ্র, পুরুষানুক্রমে আমাদের বংশের কুলপুরোহিত৷’

রামনারায়ণ মিশ্র হাত জোড় করে বললেন, ‘আহা, কী সৌভাগ্য আপনাদের দর্শন পেলাম৷’

কৃষ্ণানন্দও হাত জোড় করে বললেন, ‘মা কিরীটেশ্বরীর সেবককে প্রণাম৷ আসুন ঠাকুরমশাই, মাতৃমূর্তি দর্শন করান৷’

রামনারায়ণ মন্দিরের চাতালে উঠে দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ‘আসুন মৈত্রমশাই, আসুন জাটিয়াবাবা৷’

কৃষ্ণানন্দ আর জাটিয়া জাদু হাত জোড় করে নিষ্পলক চোখে মাতৃমূর্তির দিকে চেয়ে রইলেন৷ সমগ্র মূর্তিটি কষ্টিপাথরে তৈরি, উচ্চতায় প্রায় চার হাত৷ দেবী চতুর্মূখী, অষ্টভুজা, ও পদ্মাসনা৷ বেদির পাদপীঠে দুটি সিংহ মুখোমুখি খোদিত৷ চারটি দক্ষিণ ভুজে বজ্র, পাশ, শঙ্খ ও শর ধারণ করে আছেন৷ তিনটি বাম ভুজে অঙ্কুশ, পদ্ম, ধনু এবং নীচের হাতটির তর্জনী বেদি স্পর্শ করে আছে৷ দেবীর মাথায় একটি কিরীট৷ সেখানে একটি ক্ষুদ্র শিবমূর্তি৷ মাতৃকাবিগ্রহটি কঠোরে কোমলে অতি অপূর্ব৷

মৈত্রমশাই দুহাত জোড় করে উচ্চারণ করলেন, ‘ওঁ তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা৷’

জাটিয়া জাদু কোনও মন্ত্রোচ্চারণ করলেন না৷ সটান মাটিতে শুয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলেন৷

একটু পরে দুইজনে বেরিয়ে এলেন৷ প্রতাপনারায়ণ চাতালের নীচে দাঁড়িয়েছিলেন৷ তিনি প্রণাম করে বললেন, ‘মায়ের দর্শন হল?’

কৃষ্ণানন্দ হৃষ্টস্বরে বললেন, ‘কাল রাতের ঝড়ে পথ ভুল করিনি জমিদারমশাই, বরং পথ খুঁজে পেয়েছি৷ মা নিজেই পথ দেখিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন৷ জয় তারা, ওঁ তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা৷’

‘ওটা কী মন্ত্র বললেন মৈত্রমশাই?’ প্রশ্ন করলেন রামনারায়ণ, ‘হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রে তো এমন কোনও মন্ত্র…’

‘পাবেন না পুরোহিতমশাই,’ শান্তস্বরে বললেন কৃষ্ণানন্দ, ‘কারণ ইনি কোনও হিন্দু দেবীই নন৷’

প্রতাপনারায়ণ আর পুরোহিতমশাই দুজনেরই মুখটা হাঁ হয়ে গেল৷ একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘কী বলছেন কী মৈত্রমশাই?’

‘আমি ঠিকই বলছি৷ আপনারা হয়তো মূর্তিশাস্ত্রে তেমন অভিজ্ঞ নন৷ তবে আমি এ বিষয়ে প্রভূত অধ্যয়ন করেছি৷ দেবী কিরীটেশ্বরী বলে এতদিন যাঁর পূজা করছেন, তিনি একজন অতি প্রাচীন বৌদ্ধদেবী, দেবী বজ্রতারা৷’

জাটিয়া জাদু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘বটে? তুমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত এ ব্যাপারে?’

‘হ্যাঁ জাটিয়া এই দেখো, দেবীর বসার ভঙ্গি দেখ৷ আমরা যাকে পদ্মাসন বলি, বৌদ্ধরা তাকে বলেন বজ্রপর্যাঙ্কাসন৷ দেবীর কিরীটে যাঁকে দেখছ উনি দেবাদিদেব নন, ধ্যানীবুদ্ধ রত্নসম্ভব৷ পাদপীঠে একটি দুটি সিংহ খোদিত আছে দেখতে পাচ্ছ? দেব রত্নসম্ভবের বাহন হল দুটি সিংহ৷’

প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘আরও যদি একটু বুঝিয়ে বলেন পণ্ডিতমশাই৷’

কৃষ্ণানন্দ মন্দিরের দাওয়ায় বসলেন৷ তারপর বলতে শুরু করলেন৷

‘বৌদ্ধদের দেবদেবীদের ভাগ হিন্দুদের মতো অবিন্যস্ত নয়৷ তার একটি সুসংবদ্ধ রীতি আছে৷ হিন্দুদের এই জগৎজীবন যেমন পঞ্চভূত দ্বারা গঠিত, বৌদ্ধরা তাকেই বলেন পঞ্চস্কন্ধ৷ এই পাঁচটি স্কন্ধ হচ্ছে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার এবং বিজ্ঞান৷ বৌদ্ধদের মতে এই পাঁচটি স্কন্ধের অধিপতি পাঁচজন ধ্যানীবুদ্ধ, এঁরা আদিবুদ্ধ হতে উদ্ভূত৷ পাঁচজন ধ্যানীবুদ্ধ হলেন অক্ষোভ্য, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি, বৈরোচন এবং রত্নসম্ভব৷ এই পাঁচ ধ্যানীবুদ্ধের আবার পাঁচজন শক্তি আছেন৷ অক্ষোভ্য’র শক্তি মামকী, অমিতাভ’র শক্তি পাণ্ডরা, অমোঘসিদ্ধির শক্তি তারা, বৈরোচনের শক্তি লোচনা এবং রত্নসম্ভবের শক্তি বজ্রধাতীশ্বরী৷

এই পাঁচ ধ্যানীবুদ্ধের কুল পৃথক এবং সেই কুল হতে উৎপন্ন বোধিসত্ত্বরাও পৃথক৷ প্রতিটি কুলে উৎপন্ন দেবদেবীরা সেই কুলের চিহ্ন ধারণ করে থাকেন৷

রত্নসম্ভবের স্কন্ধ হল বেদনাস্কন্ধ, মন্ত্রপদ হল রত্নধৃক৷ দেব রত্নসম্ভবের বাহন হল দুটি সিংহ, এবং প্রতীকচিহ্ন রত্ন৷ ইনি সমগ্রদক্ষিণদেশাধিপতি৷ ইনি বসন্তঋতু, লবণরস এবং বর্ণমালার ত বর্গের ওপর আধিপত্য করেন৷

এই রত্নসম্ভব কুলের অন্যতম দেবী হচ্ছেন বজ্রতারা৷ যিনি তারণ করেন তিনিই তারা৷ দেবীর মূর্তি আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন৷ এঁর ধনুর্বাণ রিপুনাশে উদ্যত; আবার প্রস্ফুটিত পদ্মে ও বরদমুদ্রায় মহাকরুণা ও জ্ঞান ধারণ করে আছেন৷ মা তারাই গৌরী, মঙ্গলা, গায়ত্রী৷ তিনি স্বয়ং ব্রহ্মস্বরূপিণী আদ্যাশক্তি, কৈবল্যদায়িনী৷ জয় মা তারা, জয় মা শ্যামা৷’

জাটিয়া জাদু এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিলেন৷ এতটা শুনে চুক চুক শব্দে আক্ষেপ করে বললেন, ‘গুরুদেব এই জন্য বলতেন শিক্ষালাভে মন দিতে৷ এই পিঠে তিনি কম করে একশোখানি বেত ভেঙেছেন, তাও কিছু শিখে উঠতে পারলাম না৷ অথচ এই দেখো তুমি কত জানো৷ আর আমি?’

কৃষ্ণানন্দ হেসে উঠে বললেন, ‘শিক্ষার অন্তিম উদ্দেশ্য তো অন্তর্নিহিত দেবত্বকে, শিবত্বকে ছোঁয়া৷ সে শিক্ষায় তুমি আমার থেকে অনেক এগিয়ে গেছো জাটিয়া৷ আমি জ্ঞানমার্গে যে পাহাড়ের পাদদেশ অবধি পৌঁছেছি, তুমি ভক্তিমার্গে ইতিমধ্যেই সেই পাহাড়ের শীর্ষদেশে আরোহণ করে বসে আছ৷’

প্রতাপনারায়ণ সামান্য অধৈর্য হয়ে বললেন, ‘ক্ষমা করবেন পণ্ডিতমশাই, আমি, আমার পিতৃপুরুষেরা কি তাহলে বিধর্মী কোনও দেবীকে পূজা করে এসেছি এতদিন?’

‘বিধর্মী দেবী?’ রুষ্ট হলেন কৃষ্ণানন্দ, ‘ওই পাপ শব্দ আপনার মুখে উচ্চারিত হল কী করে জমিদারমশাই? ভগবান বুদ্ধ বিধর্মী ছিলেন? বিধর্ম কাকে বলে? মনে রাখবেন এই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি ধর্ম এই দেশের ধর্ম৷ আর সেই ধর্মের যাবতীয় দেবদেবীরা আমাদের নিজস্ব, কেউ বিধর্মী নয়৷ ভগবান বুদ্ধ শুধু এই ভারতভূমির নয়, এই পৃথিবীর সর্বোত্তম পুরুষ ছিলেন৷ তিনি ভারতপদ্মের মণি, এই দেশের জাগ্রত চৈতন্যের মূলীভূত স্বরূপ৷ তাঁর ধর্মসম্ভূত দেবদেবীদের বিধর্মী বলে অসম্মান করার স্পর্ধা হল কী করে আপনার?’

প্রতাপনারায়ণ যেন সঙ্কোচে এতটুকু হয়ে গেলেন৷ মিনমিন করে বললেন, ‘না না,আমি তা বলতে চাইনি৷ আসলে অনেকে বৌদ্ধ নাঢ়ানাঢ়ীদের নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে কী না…’

কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘কে কী বলে সে কথা বাদ দিন জমিদারমশাই৷ শুনেছি আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে নাকি বৌদ্ধ আর হিন্দুদের মধ্যে ধর্ম-দর্শন-মূর্তি-স্মৃতি এসব নিয়ে কূট ও জটিল বাদ-বিসম্বাদ ছিল৷ এখন এই বিধর্মী যবনের আক্রমণে সেসব সূক্ষ্মতর্ক কবেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে৷ আর ওই নাঢ়ানাঢ়ীদের কথা বলছেন? ওরা তো চেয়েছিল হিন্দুধর্মের মূলস্রোতে ফিরে আসতে৷ এই আমরাই, হিন্দুধর্মের হোতারাই আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে তা হতে দিইনি৷ তাই নাঢ়ানাঢ়ীদের প্রায় সবাই ওই বিধর্মীদের ধ্বজতলে আশ্রয় নিচ্ছে৷ সে কি তাদের দোষ? আমাদের দোষ নেই? এখনও আমরা বৌদ্ধদের বিধর্মী বলে ত্যাগ করব? তাঁদের ধর্মসংস্থাপনাকে দূরে সরিয়ে রাখব?’

প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘তাহলে আমার কী করা উচিত প্রভু?’

কৃষ্ণানন্দ দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘মা নিজে আপনাদের গৃহে আতিথ্য স্বীকার করেছেন জমিদারমশাই, আপনি মহাপুণ্যবান৷ আপনার উচিত দেবী বজ্রতারাকে আরও নিবিড়ভাবে আত্মীকৃত করা৷ তাঁকে হিন্দুধর্মের মধ্যে উচ্চস্থান দেওয়া, মা জগদম্বিকার সঙ্গে একাত্ম করে নেওয়া, তারামন্ত্রকে এই বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়া৷ ইনি কিন্তু মা দুর্গারই অন্য রূপ জমিদারমশাই৷ আমি ভবিষ্যদ্বাণী করলাম, দেবী তারা আপনার সমস্ত ক্লেশ নাশ করবেন, আপনার ঘরে সমৃদ্ধি আনবেন৷’

রামনারায়ণ অভিভূত হয়ে কৃষ্ণানন্দকে প্রণাম করতে কৃষ্ণানন্দ স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করলেন৷ তারপর তিনি জাটিয়া জাদুকে প্রণাম করতেই জাটিয়া একেবারে কেঁপে উঠেই খপ করে রামনারায়ণের হাত ধরে ফেললেন৷ রামনারায়ণ একটু বিব্রত হলেন৷ বললেন, ‘কী হল জাটিয়াবাবা?’

জাটিয়া জাদু ভয় পাওয়া স্বরে বললেন, ‘তোমার মাথার পেছনে ও কার ছায়া ঘুরছে রামনারায়ণ? তোমার বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?’

* * *

সর্বমঙ্গলা পুকুর থেকে বাসনপত্র ধুয়ে ঘরে ফিরছিল৷ সঙ্গে পুকুরপাড় থেকে তোলা কিছু কলমি আর হেলেঞ্চাশাক৷ বাপঠাকুর কলমি শাকভাজা খেতে ভারী ভালোবাসেন৷

দুধপুকুরের হাঁসগুলো সর্বমঙ্গলার ভারী ন্যাওটা৷ তারা প্যাঁকপ্যাঁক করতে করতে হেলেদুলে সর্বমঙ্গলার পিছে পিছে আসছিল৷ সর্বমঙ্গলা জানে এরা তার পাছু পাছু বাড়ি অবধি পৌঁছবে৷ সর্বমঙ্গলা উঠোনে তাদের ক’টি ভাতের দানা ছড়িয়ে দেবে, আর এরা ভারী আনন্দ করে সেই ভাত খেয়ে ডানা তুলে নৃত্য করতে করতে বিদায় নেবে৷ এ তার নিত্যকারের খেলা৷ গিরিসুন্দরী এজন্য মাঝে মাঝে ছদ্মকোপে মেয়েকে ভর্ৎসনা করেন বটে৷ তবে সে তার মনের কথা নয়৷ হাঁসেদের সঙ্গে মেয়ের এই খেলাটুকু তিনিও কম উপভোগ করেন না৷

পুকুরপাড় থেকে কয়েকপা এগোলেই গ্রামের পথ৷ মোড়ের মাথায় একটু আগে একটা বড় তালগাছ আছে৷ তার নীচে অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল ঝোপজঙ্গল৷ সর্বমঙ্গলা সেই তালগাছের কাছে পৌঁছেছে, এমন সময় হঠাৎ দেখল একটি নেউল দ্রুত পথের এপার থেকে ওই ঝোপজঙ্গলের মধ্যে দৌড়ে ঢুকে গেল৷ আর তার গায়ের রং যেন সোনার মতো৷

 থমকে গেল সর্বমঙ্গলা৷ নেউল আবার সোনার হয় নাকি? নাকি চোখে ভুল দেখল সে?

পিছনে ফিরে সর্বমঙ্গলা দেখল হাঁসগুলো নেই৷ কোথায় গেল ওরা?

একটু ইতস্তত করে ঝোপজঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল সর্বমঙ্গলা৷ এমন সুন্দর নেউল কখনও দেখেনি সে৷ পুষবে ওটাকে৷

* * *

অস্থিরপায়ে ঘরবার করছিলেন গিরিসুন্দরী৷ অনেকক্ষণ হয়ে গেল, মেয়ে বাড়ি ফিরল না কেন? এত দেরি তো হয় না সচরাচর৷ কখন রান্না হয়ে গেছে৷ মেয়ে এলে তাকে খেতে দিয়ে তিনি নাইতে যাবেন৷ তারপর ইষ্টদেবতার পায়ে দুটি ফুল সমর্পণ করে নিজে খেতে বসবেন৷ সংসারের কত কাজ বাকি৷ হতচ্ছাড়ি গেল কোথায়?

একটু পর রাগটা কমে এলে ভয় ভয় করতে লাগল গিরিসুন্দরীর৷ পথে-ঘাটে কোনও বিপদ হল না তো? একে বাড়ন্ত বয়সের মেয়ে, তার ওপর দিনকাল ভালো নয়৷ বিশেষ করে সেদিন স্বামীর কাছে এই ভূতুড়ে ডাকাতদলের কথা শোনার পর থেকেই মনটা কু গাইছে গিরিসুন্দরীর৷

একটু পর দরজায় কার যেন পদশব্দ৷ আশান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন গিরিসুন্দরী৷ মেয়ে ফিরল নাকি? কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েই হতবাক হয়ে গেলেন তিনি৷ এ কী! তাঁর স্বামী? এখন? কী হয়েছে ওঁর? মুখচোখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

রামনারায়ণ হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করলেন, ‘মঙ্গলা কোথায়?’

বিস্ময়টুকু চেপে রেখে গিরিসুন্দরী বললেন, ‘দুধপুকুরে স্নান করতে গেছিল, এখনও ফেরেনি৷ কিন্তু তুমি… ’

বাকিটা আর বলার সময় পেলেন না গিরিসুন্দরী৷ রামনারায়ণ দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে৷ গিরিসুন্দরী স্বামীর পিছনে পিছনে গিয়ে দেখলেন উঠোনে এক সন্ন্যাসী আর একজন ব্রাহ্মণ দাঁড়িয়ে৷ তিনি ঘোমটাটা থুতনি অবধি টেনে নিলেন৷ এবার সত্যি তাঁর ভয় করতে লাগল৷ এরা কারা? স্বামী এমন অসময়ে বাড়িতে দৌড়ে এলেন কেন? মেয়ে এখনও এল না কেন?

গিরিসুন্দরী দেবী দেখলেন তিনজনের মধ্যে শুধু চোখাচোখি হল, কোনও কথা হল না৷ তারপর রামনারায়ণ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন৷ বাকি দুজনও অনুসরণ করলেন তাঁকে৷

* * *

তিনজনে রাস্তার বাঁক পেরিয়ে দুধপুকুরে যাওয়ার পথ ধরলেন৷ লোকের পায়েচলায় ফুটে উঠেছে একটি ঘাসে ছাওয়া সরু সুঁড়িপথ৷ সেই পথ দিয়ে সামান্য এগোলেই পুকুরঘাট৷ সর্বমঙ্গলা এখানেই আসে স্নান করতে৷

আজ পুকুরঘাট একেবারে নির্জন৷ কেউ নেই, কিছু নেই৷ পাখিদের ডাক নেই, জলের তিরিতিরি কাঁপন নেই, ঝিরিঝিরি মিঠে হাওয়াটিও নেই, গাছেদের মৃদুমন্দ মাথা নাড়ানো নেই৷ শুধু একটা বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিপাশে৷ মনে হচ্ছে যেন নিঃশ্বাস নেওয়াও এখানে নিষিদ্ধ৷

কৃষ্ণানন্দ নাক টানলেন এক দু’বার৷ তারপর ভুরু কুঁচকে চারিদিকে চাইলেন৷ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে অস্ফূটে বললেন, ‘জাটিয়া…’

জাটিয়া জাদু চাপা গলায় বললেন, ‘অতি জটিল ভূবন্ধন৷ কিন্তু এ তো অতি প্রাচীন তন্ত্র, শুনেছিলাম লোপ পেয়ে গেছে৷’

‘লোপ যে পায়নি সে তো দেখতেই পাচ্ছি৷ কিন্তু প্রয়োগ করল কে?’

রামনারায়ণ এসব শুনছিলেন না৷ উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন৷ প্রতি মুহূর্তে আশা করছিলেন এই বুঝি তাঁদের চমকে দিয়ে কোন জাদুমন্ত্রে উদয় হবে তাঁর মেয়ে৷

কৃষ্ণানন্দ সতর্ক চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে পুকুরপাড়ে পৌঁছলেন৷ সেখানে নীচু হয়ে কী যেন দেখলেন খুব মন দিয়ে৷ তারপর পুকুরপাড় থেকে উঠে আসার পথটি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন৷ তাঁকে দেখে মনে হল কীসের যেন একটা চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন৷ তারপর ধীরে ধীরে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগোতে থাকলেন৷ তাঁর পেছন পেছন জাটিয়া আর রামনারায়ণ৷

একটু এগোলেই বড় ঝোপটা৷ ঠিক তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কৃষ্ণানন্দ৷ তারপর বললেন, ‘এর মধ্যে ঢুকতে হবে৷’

রামনারায়ণ আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দেখলেন ঠাকুরমশাই?’

‘পথে কিছু সোনার ধুলো ছড়ানো আছে৷ এত সূক্ষ্ম যে খুব খুঁটিয়ে না দেখলে ধরা যাবে না৷ আর সেই ধারা এসে শেষ হয়েছে এখানে, এই ঝোপের সামনে৷ এরকম অস্বাভাবিক ঘটনা জীবনে দুটি দেখিনি৷ এই নির্জন পুকুরপাড়ে সোনার ধুলো ছড়িয়ে গেল কে?’

জাটিয়া জাদু কম কথার মানুষ৷ তিনি সবলে ঝোপজঙ্গল ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেলেন৷ একটু পরেই তাঁর আর্তচিৎকার ভেসে এল, ‘এ কী!’

কৃষ্ণানন্দ আর অপেক্ষা করলেন না৷ দ্রুত জাটিয়ার পদানুসরণ করলেন৷ পেছন পেছন রামনারায়ণও৷

* * *

গিরিসুন্দরী উদ্বিগ্নমুখে দাওয়ায় বসেছিলেন৷ তাঁর স্নান-খাওয়া কিছুই সাড়া হয়নি৷ মনের মধ্যে উথালপাথাল চলছে৷ থেকে থেকে আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ কী হল তাঁর মেয়ের? স্বামীই বা অমন ঝড়ের মতো এসে আবার কোথায় চলে গেলেন? সঙ্গে ওই দুজন কারা? চিন্তায় চিন্তায় মনে হচ্ছিল পাগল হয়ে যাবেন তিনি৷

একটু পর সদর দরজার কাছ থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘মা, দুটি ভিক্ষা পাই যেন৷’

গিরিসুন্দরী উঠে দাঁড়ালেন৷ যতই অশান্তিতে থাকুন না তিনি, এই অবেলায় ভিক্ষুক ফিরিয়ে দেওয়ার মতো অলুক্ষুণে কাজ তিনি কিছুতেই করবেন না৷

একটা মাটির সরায় কিছু চাল আর দুটি কড়ি নিয়ে বাইরে এলেন গিরিসুন্দরী৷ কিন্তু যাকে দেখলেন তাকে দেখে ঠিক ভিক্ষুক বলে মনে হয় না৷ রোগা পাকানো চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল আর সারা মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল৷ কাঁধে একটি ঝোলা৷ ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গে একটি কালো কাপড় শাড়ির মতো ঘের করে পরা৷ আর চোখ দু’খানি তীব্র, এত তীব্র যে তাকালে ভয় করে৷

লোকটাকে দেখে গিরিসুন্দরীর অস্বস্তি হতে লাগল৷ তবুও তিনি মনের ভাব গোপন করে বললেন, ‘তোমার ওই ঝোলাটা এদিকে আনো বাবা, চালটা ঢেলে দিই৷’

লোকটি কিছু বলল না৷ শান্ত হেসে বলল, ‘মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করছেন মা? করবেন না৷ আপনার মেয়ে ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’

গিরিসুন্দরী বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন৷ বললেন, ‘আমার মেয়ের ব্যাপারে তুমি কী করে জানলে বাবা?’

লোকটি ঝুলি থেকে কী যেন একটা বার করে গিরিসুন্দরীর সামনে মেলে ধরল৷ আর গিরিসুন্দরী সেটা দেখামাত্র আমূল থরথর কেঁপে উঠলেন৷ শাড়ি! সর্বমঙ্গলার শাড়ি!! এই শাড়ি পরেই তো স্নানে গেছিল মেয়েটা! সে শাড়ি এর হাতে এল কী করে? তিনি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলে সেই লোকটার দিকে৷

লোকটা শাড়িটা তার ঝোলায় পুরে চতুর হেসে বলল, ‘চিন্তা করবেন না মা৷ আপনার মেয়ে ভালো আছে৷ তার কোনও ক্ষতি হয়নি৷ আমার কথা যদি মেনে চলেন তাহলে সে সুস্থ দেহে ফিরে আসবে৷ কেউ জানতেও পারবে না৷ আর যদি না মেনে চলেন, তাহলে কিন্তু আপনার মেয়ের মৃতদেহ এই আপনার বাড়ির দরজায় ফেলে যাব৷’

গিরিসুন্দরীর মুখে কথা ফুটল না৷ তাঁর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে৷ মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন৷

লোকটির ঝোলা থেকে একটি ছোট মাথা উঁকি দিল৷ তারপর একটি নেউল বেরিয়ে এসে লোকটির ঘাড়ে মাথায় খেলা করতে লাগল৷ গিরিসুন্দরী দেখলেন নেউলটি সম্পূর্ণ সোনার বরণের৷ তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে লোকটি বলল,‘বাঘার জঙ্গলে ঢোকার মুখে যে বড় বটগাছটা আছে, আপনার স্বামীকে বলবেন তিনি যেন আজ মধ্যরাতে সেখানে উপস্থিত থাকেন৷ সঙ্গে যেন কোনও অস্ত্র বা লোকজন না থাকে৷ আমি আপনার স্বামীকে কিছু কাজ করতে দেব৷ তিনি সেই কাজ সুসম্পন্ন করলেই আপনার মেয়ে সুস্থ দেহে ফিরে আসবে৷ মনে থাকে যেন, নিরস্ত্র এবং একাকী৷’

বলেই লোকটি পিছন ফিরে দ্রুত পায়ে হাঁটা দিল৷ গিরিসুন্দরীর জ্ঞানহীন দেহটা পড়ে রইল সদর দরজার গোড়ায়৷

* * *

রামনারায়ণ আর কৃষ্ণানন্দ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে গেলেন জাটিয়া জাদুর কাছে৷ দেখলেন জাটিয়া মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন৷ তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে মাটির দিকে তাকাতেই একটা নারকীয় দৃশ্য দেখতে পেলেন দুজনে৷

চারিদিকে কয়েকটি হাঁসের মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ বা কারা যেন অসহায় হাঁসগুলোর মাথা দেহ থেকে সজোরে ছিঁড়ে নিয়েছে৷ চারিদিকে চাপ চাপ রক্ত৷ তারমধ্যে কিছু কিছু হাঁসের দেহ আবার আধখাওয়া৷

দৃশ্যটা এতটাই বীভৎস যে তিনজনেই একটু থমকে গেলেন৷ কৃষ্ণানন্দ নীচু হয়ে একটি হাঁসের মৃতদেহ ডানা ধরে তুলে কী যেন দেখে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন৷

জাটিয়া জাদু জোরে নিঃশ্বাস নিলেন বার দুয়েক৷ তারপর সামান্য ভয়ের স্বরে বললেন, ‘আমি কিন্তু অবস্থা ভালো বুঝছি না কৃষ্ণানন্দ৷ আমার ইন্দ্রিয়, আমার অনুভূতি বলছে এখানে কোনও এক অত্যন্ত প্রাচীন এবং শক্তিশালী তন্ত্রবিদ্যার আবির্ভাব ঘটেছিল৷ মনে হচ্ছে শীঘ্রই একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে৷ আমাদের সাবধান হওয়া দরকার৷’

জাটিয়া জাদুর কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা আর্তচিৎকার ভেসে এল রামনারায়ণের মুখ থেকে৷ বাকি দুজন সচকিত হয়ে চেয়ে দেখলেন রামনারায়ণ ঝোপের একদিকে চেয়ে আছেন৷ সেখানে কাঁটাগাছের গায়ে একটুকরো কাপড় লেগে আছে৷

জাটিয়া জাদু গিয়ে অতি সন্তর্পণে কাপড়ের টুকরোটি তুলে আনলেন৷ একটি শাড়ির টুকরো৷ কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘এ কি আপনার মেয়ের শাড়ির অংশ?’

রামনারায়ণ কোনওক্রমে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ৷’

কৃষ্ণানন্দ কাপড়ের টুকরোটি নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখলেন৷ তারপর নীচু হয়ে প্রায় চতুষ্পদ প্রাণীর মতো সমগ্র ক্ষেত্রটিকে মন দিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন৷

একটু পর তিনি যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন তাঁর কপালে ঘনঘোর ভ্রুকুটি৷ চোখদুটি খর হয়ে উঠেছে৷ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে গভীরভাবে চিন্তান্বিত তিনি৷

জাটিয়া জাদু উদ্বিগ্নস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী দেখলে কৃষ্ণানন্দ?’

‘এখানকার মাটিতেও সেই অত্যন্ত মিহি সোনার ধুলো ছড়িয়ে আছে৷ তবে কোনও নির্দিষ্ট রেখা ধরে নয়৷ মনে হচ্ছে সেই স্বর্ণধুলার ধারা যেন দুধপুকুরের পথ হতে এখানে এসে এক জায়গায় স্থির হয়েছিল কিছুক্ষণ৷ তারপর আর তার চিহ্ন নেই৷’

কথা বলতে বলতে কৃষ্ণানন্দ অত্যন্ত মন দিয়ে আশপাশের ঝোপঝাড় আর মাটি লক্ষ্য করছিলেন৷ কয়েকটি ভাঙা ডাল, কয়েকটি খসে পড়া পাতা তুলে তুলে দেখলেন৷ তারপর উত্তরের দিকে একটু এগিয়ে গেলেন৷ সেখানে পথের ধুলো, ঝোপজঙ্গল খুব মন দিয়ে দেখলেন৷ যখন ফিরে এলেন তখন তাঁর মুখ আরও চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছিল৷ বিড়বিড় করে বললেন, ‘তারপর? তারপর কী হল?’

জাটিয়া জাদু বললেন, ‘কী বলছ কি কৃষ্ণানন্দ? কীসের কী হল?’

‘এখানে কেউ একজন ছিল৷ মা মঙ্গলা তো বটেই, সঙ্গে আরও একজন৷ একটা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে৷ কিন্তু না তার আসার চিহ্ন আছে, না তার যাওয়ার লক্ষণ৷ যেন সে হঠাৎ করে এসে আবার হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে৷’

রামনারায়ণ যখন মুখ খুললেন তখন বোঝা গেল যে ভয়, উদ্বেগ, আশঙ্কা সব মিলিয়ে বোধহয় উন্মাদ হওয়ার সীমায় পৌঁছে গেছেন তিনি৷ কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে সংঘর্ষ? ওর শাড়ির ছেঁড়া অংশ? কী বলছেন ঠাকুরমশাই? তাহলে কি আমার মেয়ের সম্মান…’

কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘বুদ্ধিভ্রষ্ট হবেন না ঠাকুরমশাই৷ আমার মন বলছে আপনার মেয়েকে শুধু অপহরণই করা হয়েছে, তার বেশি কোনও অপকর্মের চিহ্ন এখানে নেই৷ শাড়ির ওই অংশটুকু ছিঁড়েছে কাঁটাঝোপে লেগে৷ আপনি স্থির হোন৷ এখন বুদ্ধিভ্রংশ হওয়া মানে মস্ত বড় বিপদ৷ আমরা জমিদারমশাইকে গিয়ে বলছি….৷’

কাটা কলাগাছের মতো দুজনের পায়ে পড়ে গেলেন রামনারায়ণ, ‘দয়া করে আমার এত বড় সর্বনাশটা করবেন না মৈত্রমশাই, আপনাদের হাতে পায়ে ধরছি৷ এই ঘটনা যেন কিছুতেই জমিদারমশাইয়ের কানে না যায়৷ আমি হিন্দু ব্রাহ্মণ৷ ঘরের মেয়ে অপহৃতা হয়েছে শুনলে সমাজে আমাদের সবাই একঘরে করবে, এড়িয়ে চলবে, বেঁচে থাকাই দুঃসহ হবে৷ যা করার আমি করব৷ আমিই আমার চেষ্টা করব আমার মেয়েকে উদ্ধার করে আনার৷ কিন্তু আপনাদের দোহাই, এই কথা কোনওমতে যেন প্রতাপনারায়ণের কানে না যায়৷’

দুজনেই দুপা পিছিয়ে এলেন৷ জাটিয়া জাদু তীব্রস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘স্বার্থপর ব্রাহ্মণ, মেয়েকে উদ্ধার করার পরিবর্তে শুধু নিজের পরিবারের সম্মানটাই তোর কাছে বড় হল? তোর লজ্জা করে না বাপ হয়ে এমন কথা বলতে?’

হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন রামনারায়ণ, ‘করে ঠাকুর, খুব করে৷ আমার ওই একটি মাত্র সন্তান ঠাকুর, আমার সাগরসেঁচা ধন৷ আপনি জানেন না ঠাকুর কীভাবে আমার বুকটা এখন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে৷ ওকে না দেখলে যে আমার মুখে একগ্রাস ভাতও ওঠে না ঠাকুর, রাতে ঘুম আসে না৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে ঈশ্বরের নাম নেওয়ার আগে একবার ওর নাম ধরে ডাকি৷ ওর মুখ দেখে ঘুমোতে যাই৷ আর আজ সেই মেয়ে আজ আমার চোখের সামনে নেই ঠাকুর৷ উপায় থাকলে আজ এখনই নিজের বুকে সড়কি ফেঁড়ে মরে যেতাম৷ কিন্তু ওকে না দেখে মরলে যে আমার মরণেও শান্তি হবে না গো সন্ন্যাসী ঠাকুর৷ কিন্তু এখন যদি গাঁয়ে সংবাদ রটে যায় যে আমার সোনার পুতলিকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে, তাহলে এই সমাজ আমাদের একঘরে করবে, ত্যাগ করবে, গঞ্জনা দেবে৷ আপনিই বলুন সন্ন্যাসী ঠাকুর, তখন আমাদের স্বামী-স্ত্রী’র জন্য গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে?’

কৃষ্ণানন্দ তাঁর কোমল হাতখানি জাটিয়া জাদুর পিঠে রাখলেন, ‘রাগ কোরো না জাটিয়া৷ তুমি সমাজত্যাগী সন্ন্যাসী, তোমার পক্ষে এসব কূটসমাজস্থিতি বোঝা সম্ভব নয়৷ আপাতত ওঁর কথাই মেনে নেওয়া যাক৷ চলো, আমরা জমিদারবাড়িতে যাই৷ আর ঠাকুরমশাই, আপনিও বাড়ি যান৷ মাথা ঠান্ডা করে ভাবুন আপনি কী করবেন৷ যদি সিদ্ধান্ত বদলান তো আমাদের জানাবেন৷’

* * *

সর্বমঙ্গলা গুটিসুটি মেরে কুঁড়েঘরের এক কোণে বসেছিল৷ এই কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতায় সে যেন অনেক বুড়িয়ে গেছে৷ কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল এখনও তার মাথায় ঢুকছে না৷

সোনার নেউলের পিছনে পিছনে সে ঝোপজঙ্গলের মধ্যে অনেকটা ঢুকে পড়েছিল৷ একদিকে তার মন বলছিল সে যা করছে ঠিক করছে না, নেউল কখনও সোনার হয় না৷ অন্যদিকে ওটাকে ধরার তার তীব্র ইচ্ছা হচ্ছিল৷ আহা, পুষতে পারলে কী দারুণই না হবে৷

সর্বমঙ্গলা ক্রমে বুঝতে পারছিল তার হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছে৷ কানে শব্দ পৌঁছচ্ছে না, চোখের দৃষ্টিও যেন ঝাপসা হয়ে আসছে৷

খানিকটা গিয়ে একটু ফাঁকা জায়গা৷ সেখানে গিয়ে একটু হাঁফ ছাড়ল মঙ্গলা৷ নেউলটা গেল কোথায়?

ঠিক তখনই যেন ভোজবাজির মতো তার সামনে একটা লোক এসে দাঁড়াল৷ সর্বমঙ্গলা এত চমকে গেছিল যে বলার কথা নয়৷ লোকটা কোন রাস্তা দিয়ে এল? আর কী বিশ্রী দেখতে৷ রোগা পাকানো চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল আর সারা মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল৷ খালি গা, একটা কালো ধুতি শাড়ির মতো করে পেঁচিয়ে পরে আছে৷ আর চোখ দুটোতে লোভ, সীমাহীন লোভ৷ সর্বমঙ্গলা আর খুকিটি নেই, ওই লোভের চিহ্ন সে স্পষ্ট পড়তে পারে৷

সে ভয়ার্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি? এখানে কী করে এলে?’

লোকটা বিশ্রী হেসে বলল, ‘আমি একজন সাধক গো৷ পথে ঘাটে ভিক্ষা করে বেড়াই আর ইষ্টদেবতার নাম করি৷ আমার অনেকদিনের সাধ ছিল তোমার মতো একজন সাধনসঙ্গিনী পাওয়ার৷ আজ এই দেখো, ঠাকুর পাইয়ে দিলেন৷ যাবে আমার সঙ্গে?’

সর্বমঙ্গলা দৃঢ়ভাবে বলল, ‘না, যাব না৷ পথ ছাড়৷ নইলে কিন্তু আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব৷’

লোকটা খিকখিক করে বলল, ‘এখানে লোক কোথায় যে তোমার চিৎকার শুনবে? ভালো কথা বলছি শোনো মেয়ে, আমার সঙ্গে চলো৷ তোমাকে রাজরানি করে রাখব৷ কোনও দুঃখকষ্ট থাকবে না৷ যা চাইবে তাই পাবে৷’

সর্বমঙ্গলা এবার ভয় পেল৷ আসার সময় দেখেছে পথঘাট ফাঁকা, সত্যিই তার চেঁচামেচি শুনে কেউ আসবে কি না জানা নেই৷ সে অনুনয়ের সুরে বলল, ‘আমাকে যেতে দাও৷ আমার মা-বাবা অপেক্ষা করে আছেন৷’

লোকটা চুকচুক করে বলল, ‘তোমার মা-বাবা’র আক্কেলটা কী বল দেখি৷ অমন সুন্দরী মেয়ে, সোনার মতো গায়ের বরণ, পদ্মের পাপড়ির মতো চোখ, কাজলকালো চুল, এখনও বিয়ে না দিয়ে ঘরে রাখে কেউ? তোমার দেহলক্ষণ ভারী পয়মন্ত গো মেয়ে, আমার সাধনসঙ্গিনী হওয়ার একদম উপযুক্ত৷ চলো মেয়ে, ইষ্টদেব নিজে তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন৷ এই-ই বোধহয় তাঁর ইচ্ছে৷’

সর্বমঙ্গলা বুদ্ধি হারাল না৷ সে বলল, ‘কিন্তু তুমি এখানে এলে কী করে?’

লোকটা বলল, ‘দেখবে? এই দেখো৷’

সর্বমঙ্গলার চোখের সামনের একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটা শুরু হল৷ সে দেখল হঠাৎ করে লোকটার শরীর ছোট হতে শুরু করেছে৷ একটু পর তার সামনে একটা মানুষের বদলে একটা নেউল দাঁড়িয়ে রইল, আর তার সমস্ত গা উজ্জ্বল সোনালি রোঁয়াতে চকচক করছে৷ আবার একটু পরেই সেই নেউল থেকে বড় হতে হতে লোকটা আগের রূপে ফিরে এল৷

সর্বমঙ্গলার হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছিল৷ মনে হচ্ছিল তার গায়ে আর জোর নেই৷ এক্ষুনি পড়ে যাবে সে৷ লোকটা এবার তার শিরা ওঠা হাতটা বাড়িয়ে সর্বমঙ্গলার ডান হাত ধরে বলল, আমার ক্ষমতা দেখলে তো? এবার চলো৷’

বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা কাণ্ড ঘটল৷ যে হাঁসগুলো সবসময় সর্বমঙ্গলার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে, তাদেরই একটা উড়ে এসে ঝাপটা মারল লোকটার মুখে৷ সঙ্গে সঙ্গে বাকি হাঁসগুলোও৷ তাদের ডানা ঝাপটানি আর ক্রুদ্ধ ডাকে জায়গাটা যেন একটা ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হল৷ সর্বমঙ্গলা এক পা এক পা করে পিছোতে লাগল যেদিক দিয়ে সে এসেছিল সেদিকে৷ একবার দৌড়ে সে রাস্তায় গিয়ে পড়ুক, তারপর দেখবে লোকটা তাকে ধরে কী করে৷

কিন্তু তারপর যেটা সে দেখল সেটা তার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না৷ তার পা দুটো যেন পাথর হয়ে গেল৷

লোকটা প্রথমে এই আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে গেছিল৷ তবে নিজেকে দ্রুতই সামলে নিল সে৷ প্রথমে সে বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরল সবচেয়ে বড় হাঁসটার শরীর৷ তারপর ডান হাত দিয়ে এক অমানুষিক টানে হাঁসটার মুন্ডুখানা ছিঁড়ে নিল সে৷ এক ঝলক রক্ত ছিটকে পড়ল তার চোখেমুখে৷ তারপর অন্য একটা হাঁসকে ধরল সে৷ তারও এক গতি হল৷ তারপর প্রতিটা হাঁসের মুন্ডু ছিঁড়ে চারিদিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল লোকটা৷

এই অকল্পনীয় নিষ্ঠুর এবং বীভৎস দৃশ্যের অভিঘাত সর্বমঙ্গলার মস্তিষ্ক আর নিতে পারল না৷ শেষ হাসটি নির্মমভাবে নিহত হওয়ার আগেই সর্বমঙ্গলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে৷

তারপর যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে এখানে৷ কোনওমতে মেঝে থেকে উঠে দেখল একটা কুঁড়েঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে সে৷ না, হাত-পা বাঁধা নেই৷ গায়ে হাত পায়ে ব্যথাও নেই তেমন৷ শুধু মাথাটা খুব টিপটিপ করছে৷

কুঁড়েঘরের মেঝেটাও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ সে যেখানে শুয়েছিল তার উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা দরজা, আর ঘরের দুদিকের দেওয়ালে দুটো জানলা৷ সর্বমঙ্গলা উঠে পড়ল৷ জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল চারিদিকে ঘন জঙ্গল৷ জায়গাটা কোথায় বুঝতে পারল না সে৷

প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছিল সর্বমঙ্গলার৷ এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল ঘরের কোণে একটা কুঁজো রয়েছে, মুখ বন্ধ করা সরার ওপর একটা ঘটিও৷ ঢকঢক করে অনেকটা জল খেলো সে৷ তারপর দরজাটা টানতেই খুলে গেল৷

পা টিপে টিপে বাইরে এল মঙ্গলা৷ জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা জায়গা পরিষ্কার করে এই জায়গাটা বানানো হয়েছে৷ কয়েকটা কুঁড়েঘর এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ সবচেয়ে বড় কুঁড়েঘরটা একটা মস্ত বড় বটগাছের তলায়৷ তার পাশে একটা বেদি৷ বেদির ওপর কোনও একটা ঠাকুরের মূর্তি৷ সামনে হাড়িকাঠ৷ ঠাকুরের মাথায় ছাউনি দেওয়া৷

আশপাশে কোনও লোক দেখতে পেল না সর্বমঙ্গলা৷ সে পা টিপে টিপে আরও একটু এগোল৷ নাহ, কোথাও কেউ নেই৷

এই অঞ্চলে এত বড় জঙ্গল বলতে এক বাঘার জঙ্গল৷ তাহলে কি ওই লোকটা ওকে বাঘার জঙ্গলে এনেছে? কিন্তু বাঘার জঙ্গলে তো দানো আছে৷ লোকটা এল কী করে?

সে যেভাবেই আনুক৷ এখন ওকে পালাতে হবে৷

বিকেল হয়ে সন্ধে হব হব করছে৷ সূর্য পশ্চিমপাটে৷ দিক ঠিক করে নিল মঙ্গলা৷ উত্তরদিকের জঙ্গল ভেঙেই তাকে এগোতে হবে৷ ওই দিকেই তার গ্রাম৷ জঙ্গল পেরোলেই বারূণী নদী, এই গ্রীষ্মে তার বুক একেবারে শুকনো খটখটে৷ পেরিয়ে গেলে আর কেউ তাকে ধরতে পারবে না৷

কিন্তু ওদিকে দুপা হাঁটতেই কে যেন বলে উঠল, ‘ওদিকে গিয়ে লাভ নেই, যে তোমাকে এনেছে তার অনুমতি ছাড়া জঙ্গল থেকে কেউ বেরোতে পারবে না৷’

মঙ্গলা ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল একজন তরুণ, বয়েসে তার থেকে খানিকটা বড়ই হবে, অন্য একটা কুঁড়েঘরের দরজা থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ কথাটা সেই বলেছে৷

ছেলেটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ মঙ্গলার চোখের সামনের তার স্বপ্নের দৃশ্যটা যেন হঠাৎ করেই ভেসে উঠল৷ চিতার চূড়ায় উঠে পড়েছে সে৷ একটু দূরে কার যেন একটা শবদেহ শোয়ানো৷ তবে সে মুহূর্তের জন্য৷ দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল৷

মঙ্গলা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’

তরুণ বিষণ্ণমুখে বলল, ‘নাম শশিশেখর, নিবাস তালকোঠরি৷ পিতার নাম হরিসাধন বন্দ্যঘটী৷’

মঙ্গলা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখানে এলে কী করে?’

শশিশেখর তার পুরো কাহিনী বলল৷ তারপর পালটা জিজ্ঞেস করল, ‘আর তুমি কে?’

‘আমি চণ্ডীপুর গাঁয়ের পণ্ডিত রামনারায়ণ মিশ্র’র মেয়ে৷ আমার নাম সর্বমঙ্গলা৷’

শশিশেখরের কেন জানি না মনে হল রামনারায়ণ মিশ্র নামটা কোথায় যেন শুনেছে সে৷ কিন্তু মনে পড়ল না কোথায়৷ সে প্রশ্ন করল, ‘তুমি এখানে এলে কী করে?’

মঙ্গলা বলল, ‘একটা বিশ্রী লোক আমাকে গ্রামের পথ থেকে চুরি করে এনেছে৷’

‘সর্দার তোমাকে চুরি করে এনেছে? সে কী, কেন?’

‘বলেছে আমাকে সাধনসঙ্গিনী করবে৷’

শশিশেখরের মুখে পর্যায়ক্রমে, বিস্ময়, ক্রোধ এবং অসহায়তা খেলা করে গেল৷ কিছুক্ষণ ক্ষিপ্ত পদচারণার পর সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রঘু৷’

কুটির থেকে রঘু বেরিয়ে এল৷ প্রথমে মঙ্গলাকে দেখে অবাক হয়ে গেল সে৷ তারপর শশিশেখরকে বলল, ‘ডাকলেন ছোটকত্তা?’

শশিশেখর ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘ওই সর্দারের সাহস দেখেছ৷ একটা আধবুড়ো ভাম, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এই মেয়েটাকে তুলে এনেছে সাধনসঙ্গিনী করবে বলে৷ স্পর্ধাটা ভাবো একবার৷’

রঘুর মেয়ে হরিমতীর বয়েসও সর্বমঙ্গলার মতোই৷ শশিশেখরের কথা শোনামাত্র রাগে রঘুর গায়ের পেশিগুলো ফুলে উঠল৷ সে বলল, ‘আজ ডাকাতি করে ফেরত আসুক শয়তানটা, দেখাব রঘু পাইকের লাঠির জোর কত৷’

শশিশেখর ধমকে উঠল, ‘পাগলের মতো কথা বোলো না রঘু৷ সেদিন দেখনি লোকটা কত বড় গুনিন? আর ওর পিশাচ বাহিনীর কথা ভুলে গেলে? তুমি লাঠি তোলার আগেই তোমার মুন্ডু ছিঁড়ে নেবে৷’

শশিশেখরের শেষ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গলার স্মৃতির মধ্যে কে যেন সেই ভয়ানক দৃশ্যটা চাবুকের মতো আছড়ে দিল, লোকটা একটা একটা করে হাঁসের মাথা ছিঁড়ে নিচ্ছে৷ সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে শিউরে উঠল সে, অস্ফুটে বলে উঠল, ‘উঃ কী ভয়ঙ্কর, কী ভয়ঙ্কর!’

শশিশেখর বলল, ‘কী হয়েছে? অমন আঁতকে উঠলে কেন?’

মঙ্গলা বলল, ‘ও মানুষ নয়, পিশাচ, একটা আস্ত পিশাচ৷ ইচ্ছেমতো মানুষ থেকে নেউল, আবার নেউল থেকে মানুষ হতে পারে৷ আর লোকটা কী নৃশংস, কী ভয়ানক …’ বলতে বলতে থেমে গেল ও৷ না, ওই বীভৎস দৃশ্যটা আর মনে করবে না সে, কিছুতেই মনে করবে না৷

রঘু দৌড়ে গিয়ে শশিশেখরের কুটির থেকে ঘটিতে করে জল নিয়ে এল৷ মঙ্গলার হাতে দিয়ে বলল, ‘জলটা খেয়ে নাও মা, সুস্থ লাগবে৷’

মঙ্গলা জলটা খেয়ে ঘাড়ে মাথাতেও একটু দিল৷ তারপর শশিশেখরকে বলল, ‘আমি এই গাঁয়ের মেয়ে৷ সব পথঘাট আমার চেনা৷ একবার জঙ্গল পেরোতে পারলে আমিই তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারি৷ পালাতে পারব না কেন বললে?’

রঘু বলল, ‘যে তোমাকে আর আমাদের এখানে ধরে এনেছে মা, সে মস্ত বড় কাপালিক৷ তার অসীম ক্ষমতা৷ অনেক লোক বলি দিয়ে সে তাদের পিশাচ বানিয়ে রেখেছে৷ সেই পিশাচদের চোখ এড়িয়ে এই জঙ্গল থেকে কারও বেরোবার উপায় নেই৷’

মঙ্গলা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই জঙ্গলের মধ্যে মশালের আলো দেখা গেল৷ একটু পর পিশাচ-ডাকাতের দল ঘিরে ধরল তাদের৷ একজন কর্কশ স্বরে বলল, ‘ঘরে যাও৷ নইলে বিপদ হবে৷’

শশিশেখর দেখল তাদের মধ্যে সর্দার নেই৷ সে ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘সর্দার এলেন না?’

সেই কর্কশ কণ্ঠে উত্তর এল, ‘সর্দার শিকার করতে বেরিয়েছেন৷’

* * *

বটগাছটার নীচে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন রামনারায়ণ৷ ভয়ে, দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগে তিনি ঠকঠক করে কাঁপছিলেন৷ গৃহিণী যা বলেছেন তার সামান্য অংশও যদি সত্যি হয়, তাহলে হয়তো মেয়েকে উদ্ধারের সামান্য আশা থাকলেও থাকতে পারে৷ আর যদি না হয়, ভাবতে ভাবতেই দাঁতে দাঁত লেগে গেল রামনারায়ণের৷

একটু পর রামনারায়ণ লক্ষ্য করলেন চারিদিকটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে আসছে৷ এমনিতেও এত রাতে বাঘার জঙ্গলের এত কাছে আসার কথা কেউ ভাবতেই পারে না, সে মানুষই হোক বা পশুপ্রাণী৷ কিন্তু তাও এতক্ষণ ধরে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরিঝিরি হাওয়া, দু’একটা রাতচরা পাখিদের ডাক, নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ সেসব শুনতে পাচ্ছিলেন রামনারায়ণ৷ এবার তাও যেন ক্ষীণ হয়ে এল৷ রামনারায়ণ অনুভব করলেন এই গ্রীষ্মরাতের হাওয়ার দল যেন বইতে বইতে হঠাতই এই বাঘার মাঠ পেরোতে ভুলে গেছে৷ রাতচরা পাখিদের টিঁ টিঁ শব্দ আর শোনা যায় না৷ নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও আর শোনা যায় না৷ সব কিছু যেন স্থির হয়ে গেছে৷

একটু পর একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল রামনারায়ণের৷ এই গন্ধটা চেনেন রামনারায়ণ৷ আজই দুপুর বিকেল নাগাদ দুধপুকুরের রাস্তার পাশের ঝোপে এই গন্ধটা পেয়েছিলেন তিনি৷ দাঁতে দাঁত চেপে প্রস্তুত হলেন তিনি৷ আসছে, সে আসছে৷

সে এল বটে, কিন্তু এমন ভাবে এল যে রামনারায়ণ প্রথমে হতচকিত হয়ে গেলেন৷ তিনি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন ঠিক তার সামনে মাঠের ধুলোয় হঠাৎ করেই যেন একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি হল৷ প্রথমে ক্ষীণ, তারপর ক্রমেই সেই ঘূর্ণিটা দ্রুত বড় হতে থাকল৷ আর কয়েক মুহূর্ত পর সেই ঘূর্ণি থেকেই তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল একটা লোক৷

রামনারায়ণ মনে মনে এমনই কিছু আশঙ্কা করছিলেন৷ তাই খুব বেশি চমকালেন না তিনি৷ শুধু মনের সমস্ত আশঙ্কা, উদ্বেগ আর রাগ চেপে রেখে লোকটার দিকে চেয়ে রইলেন তিনি৷

লোকটার হাতে একটা মশাল৷ তার আলোয় বোঝা যাচ্ছিল যে তার বয়েস বেশি না, চল্লিশ-পঞ্চাশ হবে৷ তবে এই জাতীয় অঘোরী কাপালিকরা অলৌকিক উপায়ে আয়ুর্বৃদ্ধি রোধ করে রাখতে পারে বলে তিনি শুনেছেন৷ ফলে এর বয়েস আরও অনেক বেশি হলেও আশ্চর্য হবেন না রামনারায়ণ৷

লোকটার একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, একমুখ দাড়িগোঁফ, একটা কালো ধুতি শাড়ির মতো করে পরা, আর কাঁধে একটা ঝোলা, গিরিসুন্দরী যেমন বলেছিলেন৷ লোকটা আবির্ভূত হয়েই ছদ্মবিনয়ের সঙ্গে সামান্য নীচু হয়ে বলল, ‘পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই, ভালো আছেন?’

রামনারায়ণ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কে?’

লোকটা হেসে বলল, ‘অধমের নাম ধাম না জানলেও হবে৷ তবে গিন্নিমা আমার পরিচয় ঠিক ভাবেই দিয়েছেন আশা করি৷’

‘কী চাও?’

লোকটা এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল৷ তার হাবেভাবে সেই চেষ্টাকৃত বিনয়ের ভাব উধাও৷ সে আপনি থেকে সোজা তুমিতে নেমে এল৷ বলল, ‘একটা কাজ করে দিতে হবে ঠাকুর৷’

‘কী কাজ?’

‘তোমার অন্নদাতার ঘরে গোপনে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷ প্রতাপনারায়ণের ঘরে যে সোনা জমা হয়েছে তা আমার চাই৷’

রামনারায়ণের মাথা ঘুরে গেল৷ তিনি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন লোকটার দিকে৷ এ কি পাগল?

লোকটা গম্ভীর গলায় বলল, ‘অবাক হচ্ছ কেন? ভাবছ এই কাজটা আমি নিজে কেন করতে পারব না? শোনো ঠাকুর, আমি বুঝতে পেরেছি যে প্রতাপনারায়ণ তার বাড়িতে কোনও এক তান্ত্রিক বা অঘোরী সন্ন্যাসীকে নিয়ে এসেছে৷ তাই ওই বাড়িতে আমার দৃষ্টিদর্পণ কাজ করছে না৷ তাই হয়তো সেখানে অনুপ্রবেশের পথেও বাধার সৃষ্টি হবে৷

তোমাকে একটিই কাজ দিচ্ছি৷ আমি তোমাকে একটি মন্ত্রপূত জিনিস দেব৷ তুমি সেটি প্রতাপনারায়ণের কাছারিবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে কোথাও রেখে আসবে৷ এমন জায়গায় রাখবে যাতে কারও চোখে না পড়ে৷ বাকি কাজ আমি বুঝে নেব৷ আর হ্যাঁ, এর যদি অন্যথা হয় তাহলে কিন্তু তোমার মেয়েকে আর ফিরে পাবে না৷ কথাটা মাথায় থাকে যেন৷’

রামনারায়ণ দাঁতে দাঁত ঘষে একটা অশ্রাব্য শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে থেমে গেলেন৷ তারপর বললেন, ‘আমার মেয়ে যে সুস্থ আছে, বেঁচে আছে তার প্রমাণ কী?’

লোকটা হাতটা একবার নিজের ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে একটা শাড়ি বার করে আনল৷ সেটা দেখেই রামনারায়ণ একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন৷ শাড়িটা খপ নিজের হাতে টেনে নিয়ে পাগলের মতো তাতে মুখ ঘষতে ঘষতে অস্ফূটে উচ্চারণ করতে লাগলেন, ‘মঙ্গলা, মা আমার…’

লোকটা ভুরু কুঁচকে গেলেও কিছু বলল না৷ একটু পর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘শাড়িটা দাও ঠাকুর, দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’

রামনারায়ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও শাড়ি ফেরত দিলেন৷ লোকটা শাড়িটা ঝোলায় ঢুকিয়ে অন্য কী যেন একটা বার করে আনল৷ সেটা রামনারায়ণের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই সেই জিনিস৷ আমার নির্দেশ যেন মাথায় থাকে৷ এমন জায়গায় রাখবে যেখানে চট করে কারও চোখ যাবে না৷ আর কাজটা কালই হওয়া চাই৷ মনে থাকে যেন৷’

‘আর আমার মেয়েকে কখন ফেরত পাব?’

‘তুমি কাল মধ্যরাতে ঠিক এই সময় এই খানে দাঁড়াবে৷ তোমার মেয়েকে ফেরত দিয়ে যাব৷ আর মনে রাখবে, ঘুণাক্ষরেও যদি এই কথা কোথাও প্রকাশ পায়, মেয়েকে টুকরো টুকরো করে কেটে তোমার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যাব৷’

রামনারায়ণ একবার কেঁপে উঠলেন৷ তারপর হাতে ধরা জিনিসটা চোখের কাছে এনে বোঝার চেষ্টা করলেন জিনিসটা কী৷ রাতের অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না৷ তার ওপর আজ কৃষ্ণ চতুর্দশী৷ তারার আলোতে যতটুকু দেখা যায় তাতে রামনারায়ণ বুঝলেন ওটি প্রাণীর মূর্তি, খুব সম্ভবত নেউলের৷ জিনিসটা তারার আলোতেও চকচক করছিল৷ রামনারায়ণ অনুমান করলেন মূর্তিটা খুব সম্ভবত সোনার৷

মূর্তিটা হাতে ধরে মাথা তুললেন রামনারায়ণ৷ তাঁর সামনে কেউ নেই৷ লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে৷

বাড়ির ফেরার রাস্তা ধরলেন রামনারায়ণ৷ এই বিপদের মধ্যেও একটা কথা মনে করে স্বস্তি পাচ্ছিলেন তিনি৷ মঙ্গলা ভালো আছে৷ অন্তত এখনও পর্যন্ত নিরাপদে আছে৷

কারণ ওই শাড়িতে তাঁর মেয়ের গায়ের গন্ধ লেগে নেই৷ নিজের স্নেহপুত্তলির গায়ের গন্ধ খুব ভালো চেনেন ঠাকুরমশাই৷ শাড়িটা নকল, মায়াজাদুতে তৈরি৷

* * *

কৃষ্ণানন্দ আর জাটিয়া জাদু জমিদারবাড়ির খিড়কি দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন৷ তখন ভোর হচ্ছে৷ জমিদারবাড়ির কাজকর্ম সব ধীরে ধীরে শুরু হল বলে৷ গ্রীষ্মের প্রভাতখানি বড় কোমল৷ মৃদুমন্দ হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছিল দুজনের দেহ৷

জাটিয়া জাদু আর কৃষ্ণানন্দ, দুজনেই ব্রাহ্মমুহূর্ত শয্যাত্যাগ করেন৷ তারপর প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে স্নান করেন৷ নিজের হাতে বাগান থেকে পুষ্পদল চয়ন করে ইষ্টদেবীর পূজায় বসেন৷ তারপর সামান্য প্রাতরাশ সেরে দৈনন্দিন কাজে মন দেন৷

এখানে আসা অবধি তাঁদের সেই অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটেছে৷ তবে ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ এবং স্নানের অভ্যাসটি তাঁরা ছাড়তে পারেননি৷ তারপর দুজনে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোন৷

আজ তাঁরা প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে খিড়কির কাছে দাঁড়িয়ে সেদিনের সেই বিকট পায়ের ছাপটা দেখছিলেন৷ আজকাল দিনের বেলাতেও ভয়ে কেউ এদিকে আসে না৷ তাই ছাপটা অক্ষত আছে৷ দু’জনেই খুব মনোযোগ সহকারে দেখছিলেন ছাপটাকে৷ কীসের ছাপ এটা?

জাটিয়া বললেন, ‘কোনও অতিকায় বাঘ বা শিয়ালের পায়ের ছাপ নয় তো?’

কৃষ্ণানন্দ মাথা নাড়লেন, ‘না জাটিয়া, এই অঞ্চলে অত বড় বাঘ বা শিয়াল থাকলে এরা নিশ্চয়ই জানতে পারত৷ তাছাড়া বাঘের সামনের পা আর পেছনের পা একই জায়গায় পড়ে, এ কিছুতেই বাঘ নয়৷ আর শিয়ালের পায়ের মাঝের দুটো আঙুলের ছাপ একটু এগিয়ে থাকে, বাকি দুটো আঙুলের ছাপ দু’পাশে, একটু নীচের দিকে৷ এরকম চার আঙুলের ছাপ একমাত্র কোনও অতিকায় চতুষ্পদ ছাড়া আর কারও পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়৷ তার ওপর দেখছ সামনের দুই পা আর পিছনের দুই পায়ের মধ্যে তফাত কত?’

পাঁচিলের ওপর থেকে কে যেন হেসে বলল, ‘দ্যুৎ, তোমরা কিচ্ছু জানো না৷’

দুজনে মাথা তুলে দেখলেন পাঁচিলের ওপর একটা পাঁচ-ছ’বছরের ছেলে বসে জুলজুল করে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ জাটিয়া জাদু কপট রাগে চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কে রে তুই?’

ছেলেটা ফিক করে হেসে বলল, ‘আমার নাম লখাই গো দাদু৷ আমি কালু ডোমের ছেলে৷’

‘নেমে আয়৷’

লখাই বিনা বাক্যব্যয়ে অতি সহজে, প্রায় টিকটিকির মতোই দেওয়াল বেয়ে নেমে এল৷ জাটিয়া ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুই কী করছিলিস ওখানে?’

‘আম পাড়ব বলে উঠেছিলাম গো ঠাকুর৷’

‘বটে? আর পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙলে?’

ছেলেটি অমলিন হাসল, ‘আজ অবধি পড়িনি তো৷’

অতীত সৌভাগ্যের নমুনা যে ভবিষ্যৎ সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা নয় এরকম একটা বক্তব্য রাখতে গিয়েও থেমে গেলেন জাটিয়া জাদু৷ ইত্যবসরে কৃষ্ণানন্দ ছেলেটিকে কোমল স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যাঁ রে, এই যে দস্যিপনা করে বেড়াচ্ছিস, মা কিছু বলে না?’

ছেলেটি একগাল হেসে বলে, ‘আমার মা নেই তো৷ মরে গেছে৷’

কৃষ্ণানন্দ বুকে যেন একটা ধাক্কা খেলেন৷ কিছুক্ষণ স্থির চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর খিদে পেলে খাস কোথায়?’

‘কেন, জমিদারবাড়িতে বলা আছে তো৷ রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই আমাকে খেতে দেয়৷’

কৃষ্ণানন্দ নীচু হয়ে ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন৷ ভারী কোমলস্বরে বললেন, ‘অমন করে ‘আমার মা নেই’ বলতে নেই রে বাপধন৷ যার মা নেই, তার স্বয়ং জগন্মাতা আছেন৷’

জাটিয়া জাদু প্রকাশ্যে ভারী আপাতরুষ্ট, আপাতক্রুদ্ধ রূপ ধারণ করে চলেন৷ তিনি এই দুজনের অলক্ষ্যে উত্তরীয় দিয়ে নিজের চোখের কোণ মুছে চেষ্টাকৃত কর্কশস্বরে বললেন, ‘বটে? তাহলে এমন ন্যাংটোপুঁটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? জমিদারবাড়ি থেকে কোনও কাপড় দেয়নি?’

লখাইয়ের হাসি আরও চওড়া হয়, ‘দিয়েছে তো৷ জমিদারমশাই একটা পুরনো ধুতি আমাকে দিয়েছে৷ আমি সেইটে দিয়ে স্নান করে গা মুছি, গরমকালে বিছানায় দিয়ে শুই, শীতকালে গায়ে জড়িয়ে ঘুমোই৷’

জাটিয়া জাদু এবার হেসে ফেললেন৷ পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘এই ছোঁড়া, সত্যি করে বল তো, তুই জানিস এটা কোন প্রাণীর পায়ের ছাপ?’

লখাই একগাল হেসে বলল, ‘ও মা, জানব না কেন গো ঠাকুর, ওপর থেকে দেখলেই তো বোঝা যায় এটা একটা মওওওস্ত বড় নেউলের পায়ের ছাপ৷’

ভুরু কুঁচকোলেন কৃষ্ণানন্দ, ‘তুই ঠিক বলছিস?’

‘হ্যাঁ গো ঠাকুর৷ আমি তো বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই৷ তাই ইঁদুর, নেউল, সাপ, শিয়াল সববার পায়ের ছাপ চিনি৷’

‘বটে?’

‘হ্যাঁ গো ঠাকুর৷ আমি মেঠো ইঁদুর ধরতে পারি, আমি বাচ্চা নেউল ধরে পুষতে পারি, গর্তে হাত দিয়ে শিয়ালের বাচ্চার ল্যাজ টেনে বার করতে পারি, কচ্ছপের ডিম চুরি করতে পারি৷ আমি পায়ের ছাপ চিনব না?’

‘হুম৷ রাতদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াস নাকি?’

লখাই আবার একগাল হাসে, ‘হ্যাঁ গো ঠাকুর৷ আমার জঙ্গলে ঘুরতে খুব ভালো লাগে৷’

‘বাঘার জঙ্গলে?’

ছেলেটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার মৈত্রমশাইয়ের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল৷ জাটিয়া জাদু মৃদু ধমক দিলেন, ‘এই যে হ্যাঁ গো ঠাকুর, মুখে কুলুপ কেন এখন? বল!’

লখাই মিনমিন করে বলল, ‘বাপ জানতে পারলে আস্ত রাখবে না, হাড় মাস আলাদা করে দেবে৷’

‘আচ্ছা কালুকে কিছু বলব না৷ এবার বল৷’

লখাই ফিসফিস করে বলতে শুরু করল৷ দুজনে উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলেন৷

* * *

রামনারায়ণ সকালবেলা কাছারিবাড়ি পৌঁছে দেখলেন প্রতাপনারায়ণের কাছে একজন সম্ভ্রান্ত চেহারার ভদ্রলোক বসে আছেন৷ তবে ভদ্রলোক যে খুব উদ্বেগের মধ্যে আছেন বোঝা যায়৷ পোশাক অবিন্যস্ত, চুল উসকোখুসকো, চোখেমুখে হতভম্ব ভাব৷ প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘পণ্ডিতমশাই, এদিকে আসুন৷ আলাপ করিয়ে দিই৷ ইনি হরিসাধন বন্দ্যঘটী, নিবাস তালকোঠরি গ্রাম৷’

সঙ্গত কারণেই রামনারায়ণ সচকিত হলেন৷ প্রতাপনারায়ণ রামনারায়ণের পরিচয় দিতেই হরিসাধন দাঁড়িয়ে উঠে প্রতি নমস্কার করলেন৷ ধীরস্বরে বললেন, ‘ওঁর নাম শুনেছি৷ ওঁর কন্যার সঙ্গেই আমার ছোট ছেলে শশিশেখরের একবার বিয়ের কথা হয়েছিল৷ কিন্তু এখন আর সে কথা বলে কী লাভ৷ যে সে কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে কি নেই…’ বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন হরিসাধন৷

রামনারায়ণ উদ্বিগ্নস্বরে বললেন, ‘সে কী? কী হয়েছে বাবাজীবনের?’

প্রতাপনারায়ণ গম্ভীরমুখে বললেন, ‘ শ্রীমান শশিশেখর আমার কাছে আসছিলেন একটা বৈষয়িক কাজে৷ কিন্তু তিনি এসে পৌঁছননি৷’

রামনারায়ণ বললেন, ‘কেন? পৌঁছননি কেন?’

প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘সেটাই তো গভীর চিন্তার বিষয়৷ বাবাজীবনের যেদিন এসে পৌঁছনোর কথা তার একদিন পরেও না পৌঁছতে আমি বন্দ্যঘটী মশাইয়ের বাড়িতে পাইক পাঠানোর বন্দোবস্ত করছিলাম৷ কিন্তু তার আগেই ইনি স্বয়ং এসে উপস্থিত৷ বাকিটা না হয় এঁর মুখ থেকেই শুনে নিন৷’

হরিসাধন ভগ্নস্বরে বললেন, ‘কাল সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে এক ভিক্ষুক এসে উপস্থিত৷ সে প্রথমে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়৷ আমার কাজের লোকজন তাকে হটিয়ে দিতে চাইলেও সে বার বার বলতে থাকে ‘তোমাদের প্রভুকে বলো তাঁর সামনে ভারী বিপদ৷ তাঁর ভালোর জন্যই আমার সঙ্গে তাঁর দেখা করা একান্ত প্রয়োজন৷’ ফলে তাকে আটক করে আমার সামনে নিয়ে আসা হয়৷ আমার সামনে সে বলে তাকে নাকি কোন এক অঘোরী কাপালিক পাঠিয়েছে আমাকে একটি বার্তা দিতে৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম কী সেই বার্তা৷’

রামনারায়ণের বুক কাঁপছিল দুরু দুরু৷ তিনি বুঝতে পারছিলেন এরপর কী কথা বলবেন হরিসাধন৷

‘লোকটা বলল, কোন এক কাপালিক ডাকাত নাকি তার দলবল নিয়ে আমার ছেলে আর তার সঙ্গে থাকা পাইক বরকন্দাজদের বাঘার জঙ্গলে বন্দি করে রেখেছে৷ অন্তত বিশ তোলা সোনা না পেলে তারা সবাইকে বলি দিয়ে পিশাচ বানিয়ে রাখবে৷’

প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘আর আপনি সেটা বিশ্বাসও করলেন?’

হরিসাধন কাতর স্বরে বললেন, ‘এই প্রশ্ন তাকে আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ তখন সে তার ঝোলা থেকে একটি ফতুয়া আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা চিনতে পারেন?’

আমি দেখামাত্র চিনতে পারি যে এই সেই ফতুয়া যা পরে আমার ছেলে মুরুটিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল৷ ফলে তাকে অবিশ্বাস করার আর পথ রইল না৷’

রামনারায়ণ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘লোকটাকে কেমন দেখতে ছিল?’

হরিসাধন বললেন, ‘একজন রুগ্ন দরিদ্র লোক৷ রোগা পাকানো চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল আর সারা মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল৷ খালি গা আর নীচে একটা কালো কাপড় শাড়ির মতো করে পরা কাঁধে একটি ঝোলা৷’

রামনারায়ণ অন্তর থেকে কেঁপে গেলেন, কিন্তু কিছু বললেন না৷

প্রতাপনারায়ণ অসহিষ্ণুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটাকে ধরে রাখলেন না কেন? ওকে চাপ দিলেই তো আরও অনেক কিছু জানা যেত৷’

‘সেই ফতুয়াটা দেখানোর সময় আমার গৃহিণী সামনে উপস্থিত ছিলেন৷ তিনি ওটা দেখে এমন শোরগোল তুললেন যে বাকি সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ সেই সুযোগে লোকটা উধাও হয়ে গেল৷’

প্রতাপনারায়ণ চিন্তার সুরে বললেন, ‘এ তো ভারী চিন্তার বিষয়৷ এতদিন জানতাম এরা শুধু চুরি ডাকাতি করছে৷ এখন তো দেখছি অপহরণ করে টাকা আদায়েরও পথ ধরেছে৷ এ তো ভারী উৎপাত হল দেখছি৷’

হরিসাধন কাতরসুরে বললেন, ‘ওই বাঘার জঙ্গল আপনার জমিদারির মধ্যেই পড়ে৷ আপনি এর একটা বিহিত করুন জমিদার মশাই, যে করে হোক আমার ছেলে আর বাকিদের ছাড়িয়ে আনুন৷’

প্রতাপনারায়ণ চিন্তিতমুখে বললেন, ‘সেটাই তো আমারও শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কী যে করি কিছু মাথায় ঢুকছে না৷’

হরিসাধন তাঁর ঝুলি থেকে বিস্তর সোনার গয়না আর মোহর বার করলেন৷ সেই দেখে রামনারায়ণের চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ হরিসাধন হাত জোড় করে বললেন, ‘আপাতত এইগুলো আপনার কাছে গচ্ছিত রাখুন জমিদারমশাই৷ যদি ছেলেকে ফেরত পাই, তাহলে আপনার কেনা হয়ে থাকব৷’

প্রতাপনারায়ণ হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘আবার যদির কথা উঠছে কেন৷ ওদের চাহিদামতো সোনা তো নিয়েই এসেছেন৷ এবার কীভাবে ওটা ওদের হাতে দিয়ে আপনার ছেলে আর বাকিদের উদ্ধার করে আনা যায় সেইটে দেখতে হবে৷’ এই বলে তিনি নায়েবমশাই আর খাজাঞ্চিকে আসতে বললেন সোনা গুনেগেঁথে তুলে রাখার জন্য৷ রামনারায়ণও মন্দিরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন৷ পুজোর দেরি হয়ে যাচ্ছে৷

* * *

নিজের ঘরে বসে চুপচাপ ধ্যানে বসেছিলেন জাটিয়া জাদু৷ কৃষ্ণানন্দ তাঁর পাশে বসে কী যেন ভাবছিলেন৷ চোখ দুটি মুদ্রিত৷ ভ্রু দুখানি কুঞ্চিত৷ একমনে কী যেন ভেবে চলেছেন তিনি৷

একটু পর জাটিয়ার ধ্যান ভাঙল৷ তিনি ঘটি থেকে সামান্য জল খেলেন৷ তারপর বললেন, ‘কী এত ভাবছ কৃষ্ণানন্দ?’

কৃষ্ণানন্দ আপন মনে বললেন, ‘ভাবছি তো অনেক কিছুই বন্ধু, কিন্তু কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না৷’

‘যেমন?’

‘যেমন ধরো যেখান থেকে সর্বমঙ্গলাকে অপহরণ করা হয়েছিল সেখানে সোনার ধুলো পড়েছিল৷ কেন? পথের মাঝে এত সোনার ধুলো এল কী করে? আবার ডাকাত সর্দারের সোনা চাই, অনেক সোনা৷ শুধু সোনা কেন? এ কেমন ডাকাত যে শুধু সোনা লুট করে? অত বড় দল, অথচ আজ অবধি তাদের চাল ডাল আনাজ মশলা কিছু ডাকাতি করতে দেখা গেল না কেন? তারা খায় কী? শুধু বনের ফলমূল?

এদিকে আবার জমিদারবাড়ির পিছনে এক মস্ত বড় নেউলের পায়ের ছাপ৷ ভৌতিক নেউল৷ যে কি না অকস্মাৎ বিশাল বড় হতে পারে আবার ছোটও হতে পারে৷ আবার দরকার হলে ছায়াশরীরও ধারণ করতে পারে৷’

‘তুমি কি নিশ্চিত যে ওটা নেউলেরই পায়ের ছাপ?’

‘হ্যাঁ জাটিয়া, আমি নিশ্চিত যে লখাই ঠিকই বলেছে৷ আমরা বড়রা অনেক সময় সামনে থাকা একটা সহজ জিনিস সহজে বুঝতে চাই না৷ কারণ আমাদের সেই দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়, আমাদের সংস্কার, আমাদের চেতনা, আমাদের বিশ্বাস অত্যন্ত সাধারণ জিনিসকেও বিচারের দৃষ্টিতে দেখতে শেখায় বিচার মানেই সন্দেহ, অবিশ্বাস৷ শিশুদের সেই সংস্কার জন্মায় না৷ তাই তারা খোলা মনে একটা জিনিসকে দেখতে শেখে, বুঝতে শেখে৷ আজকের ঘটনাটাই ভাবো না কেন৷ আজ যদি তুমি ওই পাঁচিলের ওপর বসে পায়ের ছাপটা দেখতে, তাহলে কি অমন অনায়াসে বলতে পারতে যে ওটা একটা মস্ত বড় নেউলের পায়ের ছাপ? পারতে না৷ কারণ তোমার সংস্কার তোমাকে বাধা দিত, তোমাকে বলত যে ‘অত বড় নেউল হয় না, হওয়া সম্ভব নয়৷’ অথচ লখাই কিন্তু কী অবলীলায় বলে দিল যে ওটা একটা মস্ত নেউলের পা৷ কারণ তার জ্ঞান নির্মল, তার অনুভব নিষ্কলঙ্ক৷ সে সহজ জিনিসকে সহজ কল্পনায় দেখতে পারে৷’

‘বুঝলাম, ছাত্র পড়িয়ে জ্ঞানদানের অভ্যেসটি ভালোই আয়ত্ত করেছ৷ তা বাপু, এবার বলো দেখি এতগুলি সূত্র জুড়ে তুমি কী আবিষ্কার করলে?’

কৃষ্ণানন্দ অন্যমনস্কভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন৷ নিজের মনেই বলতে লাগলেন, ‘ডাকাত সর্দারের দরকার সোনা, শুধু সোনা৷ ওদিকে পথে পড়ে আছে সোনার ধুলো৷ এদিকে জমিদার বাড়ির খিড়কিদুয়ারে হানা দিচ্ছে বিশালদেহী এক ছায়ানেউল৷ সে অলৌকিক, অশরীরী৷ সর্দার এমন এক ডাকাতদল বানিয়েছে যাদের খাবার-দাবারের প্রয়োজন হয় না৷ তারা কারা?’

কৃষ্ণানন্দ ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠতে লাগলেন৷ তাঁর পদবিক্ষেপ বাড়তে লাগল৷ জাটিয়া জাদু ঢুলুঢুলু চোখে বন্ধুকে দেখতে লাগলেন৷ কৃষ্ণানন্দকে দেখে মনে হল কী যেন একটা ধরতে চেয়েও ধরতে পারছেন না৷ তাঁকে ক্রমে আরও বিচলিত এমন ক্ষিপ্ত দেখাতে লাগল৷

একটু পর কাজের মেয়েটি তাঁদের প্রাতরাশের জন্য ডাকতে এল৷ মেয়েটি পূর্ববঙ্গীয়, কথায় ওদেশের টান প্রবল৷ জাটিয়া জাদু তার সঙ্গে কথা বলে ভারী কৌতুক অনুভব করেন৷ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আজ কী আছে রে জলখাবারে?’

মেয়েটি একগাল হেসে বলল, ‘লুসি হইসে, মুহনভোগ হইসে, সন্দেহ হইসে…’

‘আর ফলের মধ্যে?’

‘আম আসে, জাম আসে, জাম্বুরা আসে…’

ত্বরিতে ঘুরে দাঁড়ালেন কৃষ্ণানন্দ, ‘কী আছে বললে?’

জাটিয়া জাদু বোঝাতে প্রবৃত্ত হলেন, ‘আরে বাতাবি লেবুকে ওরা জাম্বুরা বলে৷’

কৃষ্ণানন্দ বিস্ফারিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, ‘অ ঠাউর, হইলডা কী? অমন কইরা খাড়ায়া রইলা ক্যান?’

কৃষ্ণানন্দর কানে যেন কিছুই পৌঁছল না৷ তিনি সদ্য সুপ্তোত্থিতর মতো বলতে লাগলেন, ‘তাই তো, তাই তো৷ সোনার ধুলো… সোনা…নেউল… সোনার নেউল… সোনার নেউল…’

বলতে বলতে তিনি জাটিয়া জাদুর কাছে দৌড়ে গিয়ে তাঁর কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন, ‘বুঝে গেছি জাটিয়া, সব বুঝে গেছি৷ তুমি লখাইকে ডাকো৷ ওকে আমাদের লাগবে৷ আর তুমি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হও৷’

* * *

এখানে খাবার ব্যবস্থা বলতে বনের ফলমূল আর মধু৷ কিন্তু সর্বমঙ্গলার গলা দিয়ে সেসব নামছিল না৷ সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ভয় আর উদ্বেগ৷ আর তার সঙ্গে তার আরও একটা অসুবিধা হচ্ছে৷

যে স্বপ্নটা সে কয়েকরাত ধরেই দেখছিল, সে এখন দিনমানেও হানা দিচ্ছে৷ সর্বমঙ্গলার গুলিয়ে যাচ্ছে কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা সত্যি৷ কখন যে তার চোখের সামনে এই পৃথিবীটা মুছে গিয়ে ওই সাঙ্ঘাতিক স্বপ্নটা জেগে উঠবে সে নিজেও জানে না৷ আর এটা শুরু হয়েছে ওই ছেলেটিকে দেখার পর৷

ছেলেটিকে বেশ দেখতে৷ কেমন ঢলোঢলো চোখ, আর গায়ের রং তো কাঁচা সোনার মতো৷ কিন্তু হলে কী হবে, মঙ্গলা জানে ওর আয়ু আজ রাত পর্যন্ত৷ ভাবতেই মনটা হু হু করে উঠল মঙ্গলার৷ আহা রে, নিজের বাপ-মাকে আর দেখতে পাবে না ছেলেটা৷

ভাবতে ভাবতেই স্বপ্নটা ফের একবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল৷ কী যে হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না সে৷ এমন তো কখনও হয়নি ওর৷

অন্য এক কুটিরে বিষণ্ণ মুখে বসেছিল রঘু আর শশিশেখর৷ তাদের সামনে কিছু ফল আর পাতার ডোঙায় করে রাখা মধু৷ কিন্তু কেউই মুখে তোলেনি সেই খাবার৷

রঘু ছলোছলো কণ্ঠে বলল, ‘ছোটকত্তা, এই তাহলে শেষ?’

মাথা নাড়ল শশিশেখর৷ দুদিন ধরে শুধু তার নিজের বাবা-মায়ের কথা, নিজের বাড়ির কথা, গ্রামের কথা মনে পড়ছে৷ এইভাবে জীবন শেষ হবে জানলে সে হয়তো আরেকটু ভালোবাসত সবাইকে৷ আরেকটু জড়িয়ে থাকত সবার সঙ্গে৷ কত মায়া, কত ভালোবাসা, কত কিছুই না ফেলে চলে যেতে হচ্ছে৷

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শশিশেখর, ‘বাকিরা কোথায়?’

‘সবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে৷ তাদের খাবারে কী মিশিয়ে দিচ্ছে সর্দার কে জানে৷ সারাদিন শুধু ঘুম আর ঘুম৷’

থাক, ওরা ঘুমোক৷ আজকের রাতটাই তো৷ তারপর তো চিরঘুম৷

মেয়েটির কথা মনে পড়ল শশিশেখরের৷ আহা, বড় মিষ্টি দেখতে মেয়েটিকে, যেন সাক্ষাৎ মা সরস্বতী৷ শশিশেখর তো মরে গিয়ে বেঁচে যাবে, কিন্তু ওই মেয়েটা? তাকে তো সারা জীবন দগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে৷

শিরদাঁড়া সোজা করে ধ্যানে বসল শশিশেখর৷ এই তার জীবনের শেষ ধ্যান, শেষ পূজা৷ চোখ বন্ধ করে সে আবৃত্তি করতে লাগল, ‘প্রভুমীশ-মনীশমশেষগুণং, গুণহীন-মহীশ-গণাভরণম৷ রণ-নির্জিত দুর্জয়-দৈত্যপুরং প্রণমামি শিবং শিবকল্পতরুম…’

একটু পর কুটিরের দরজা ঠেলে ঢুকল একজন পিশাচডাকাত৷ তার হাতে একটি শালপাতার ডোঙা৷ তাতে কিছু সবুজ রঙের তরল ভাসছে৷ সে ডোঙাটি শশিশেখরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নাও, সর্দারের আদেশ৷’

* * *

রামনারায়ণ একটু খোঁজাখুঁজি করতেই সোনার নেউলের মূর্তিটা লুকোনোর জায়গা পেয়ে গেলেন৷ মায়ের মূর্তির পায়ের কাছে একটা বড় ঘট স্থাপিত আছে৷ প্রতিদিন তার জল বদলানো হয়৷ আর সে কাজটা রামনারায়ণই করেন৷ একমাত্র তিনি ছাড়া ওই ঘট ছোঁয়ার অধিকার আর কারও নেই৷

রামনারায়ণ অতি সন্তর্পণে সেই ঘটের মধ্যে নেউলের মূর্তিটা ডুবিয়ে রাখলেন৷ তারপর সজল চোখে হাত জোড় করে মা’কে বললেন, ‘সন্তানের অপরাধ নিও না মা৷ যা করছি নিজের মেয়ের প্রাণ বাঁচাবার জন্য৷ যদি মেয়েকে ভালোয় ভালোয় ফিরে পাই, বুকের রক্ত দিয়ে তোমার কাছে প্রায়শ্চিত্ত করে যাব মা৷’

রামনারায়ণ পুজো শেষ করে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরলেন৷ তাঁর ভয় হচ্ছিল যেন কোনওভাবেই মৈত্রমশাই বা জাটিয়াবাবার সঙ্গে দেখা না হয়ে যায়৷ সেই অস্বস্তি এড়াবার জন্যই এত তাড়া৷

বাঘার জঙ্গল পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর৷ ওদিকে একবার তাকিয়েই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল রামনারায়ণের৷ ওর মধ্যেই কোথাও বন্দি হয়ে আছে তাঁদের মেয়ে৷ কে জানে সে কেমন আছে কী খাচ্ছে, সুস্থ আছে কি না৷ ভাবতে ভাবতে তাঁর চোখদুটি জলে ভরে এল৷ আর বোধহয় সেই জন্যই তাঁর সামনে পথের ওপর ক্রমশ গড়ে ওঠা ধুলোর ঝড়টা তিনি দেখতে পেলেন না৷

রামনারায়ণ চোখের জল মুছে দেখলেন তাঁর সামনে ডাকাত সর্দার দাঁড়িয়ে৷ তিনি আশ্চর্য বা অবাক হলেন না৷ শুধু স্তিমিতকণ্ঠে বললেন, ‘আমি আমার কাজ করে এসেছি৷ ওই নেউলের মূর্তিটাকে এমন জায়গায় রেখেছি যে কেউ খুঁজে পাবে না৷’

সর্দার দাড়িগোঁফের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে একটু হাসল৷ প্রসন্নস্বরে বলল, ‘এই তো চাই৷ কোথায় রেখেছ ওটাকে?’

‘মা কিরীটেশ্বরীর সামনে যে ঘট আছে, তার মধ্যে৷’

‘চমৎকার৷ এবার তোমার ছুটি, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো৷ ঠিক মধ্যরাত্রে এখানে আসবে৷ তোমার মেয়েকে তুমি ফেরত পেয়ে যাবে৷’

রামনারায়ণ কিছু বললেন না৷ ডাকাত সর্দারকে এড়িয়ে পথ চলতে শুরু করলেন৷ ডাকাত সর্দার নীচু হয়ে মাটি থেকে কিছু ধুলো কুড়িয়ে নিল৷ তারপর বিড়বিড় করে তাতে কিছু মন্ত্র পড়ে ডাকল, ‘ঠাকুর, শোনো৷’

রামনারায়ণ ঘুরে দাঁড়ালেন৷

* * *

‘সমগ্র হিন্দু এবং বৌদ্ধশাস্ত্রে একমাত্র একজনই দেবতা আছেন, যাঁর বাহন হচ্ছে নেউল৷’

প্রতাপনারায়ণ আর কৃষ্ণানন্দ একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে গোপন বৈঠকে বসেছিলেন৷ ঘরের বাইরে কালু ডোম নিজে পাহারা দিচ্ছে৷ এখন কারও এই ঘরে ঢোকা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ৷ জাটিয়া জাদু এই বৈঠকে নেই৷ তাঁকে কৃষ্ণানন্দ পাঠিয়েছেন অন্য কোনও কাজে৷

‘সেই দেবতা হচ্ছেন জম্ভল৷ ইনি ধনরত্নাদির অধিপতি৷ জম্ভলদেবের উপাসনা করলে এবং আশীর্বাদপ্রাপ্ত হলে অতুল বৈভবের অধিকারী হওয়া যায় এঁর সঙ্গে হিন্দুদেবতা কুবেরের প্রভূত সাদৃশ্য আছে৷

জম্ভলদেবের হাতে একটি নকুল, মানে নেউল থাকে৷ দেব প্রসন্ন হলে সেই নকুলের ওপর চাপ দেন, আর নকুলটি বিভিন্ন ধনরত্ন উদগীরণ করে৷

সহজে ধনবান হতে চাওয়া বৌদ্ধদের মধ্যে একসময় জম্ভলদেবের পূজা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল৷ দলে দলে বৌদ্ধরা ‘ওঁ জম্ভলজলেন্দ্রায় স্বাহা’ বলে জম্ভলদেবের পূজায় আহুতি দিতেন৷

এই জম্ভলদেবের একটি ক্রোধী এবং ক্রুররূপ আছে, যার নাম উচ্ছুষ্মজম্ভল, বা ডিম্ভ৷ অনেকে কৃষ্ণজম্ভলও বলে৷ ইনি অত্যন্ত ক্রুর এবং অশুদ্ধতার প্রতিমূর্তি৷ উচ্ছুষ্মজম্ভলের আকৃতি পঞ্চমবর্ষীয় কুমারের মতো৷ দেবমূর্তি উলঙ্গ, সর্পাবরণে ভূষিত, বদনমণ্ডলটি ক্রোধী এবং দুখানি উগ্র শ্বদন্তে শোভিত৷ ইনি প্রত্যালীঢ় পদে কুবেরকে পদদলিত করেন এবং কুবেরের মুখ হতে ধনরত্নাদি উদগীরণ করান৷ উচ্ছুষ্মজম্ভলের লিঙ্গটি ঊর্ধ্বমুখী, তিনি বুকের কাছে ধরা একটি রক্তপূর্ণ নরকপালের দিকে ত্রিনয়নে দৃষ্টিপাত করে থাকেন৷ অন্য হাতে একটি নকুল বা নেউল৷ তাকে চাপ দিলে সেও ধনরত্নাদি উদগীরণ করে৷

উচ্ছুষ্মজম্ভলের উদ্ভব এই দেশে নয়, সুদূর মহাচিনে৷ আজ থেকে দেড়শো-দুশো বছর আগে ভোটদেশীয় বৌদ্ধরা এই দেবতার পূজা শুরু করেন৷ আগেই বলেছি ইনি অশুদ্ধ বা অবৈধ উপায়ে ধনপ্রাপ্তির দেবতা৷ আর এই অশুদ্ধ উপায়ের মধ্যে একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে নরবলি, আরও ভালো করে বলতে গেলে শিশুবলি৷’

প্রতাপনারায়ণ শিউরে উঠলেন কথাটা শুনে৷

‘আমি নিশ্চিত এই ডাকাতদলের যে নেতা সে এই উচ্ছুষ্মজম্ভলের সেবক৷ সে অবশ্যই মহাচীনে গিয়ে সে উচ্ছুষ্মজম্ভলের সাধনায় প্রচুর সিদ্ধিলাভও করেছে৷ তাই সে তার ইচ্ছেমতো যখন তখন নেউলের রূপ ধারণ করতে পারে, সে নেউল ভৌতিক হোক বা সোনার৷ আর সেই জন্যেই তার এত সোনার প্রয়োজন৷ এত ডাকাতি, অপহরণ সেই জন্যেই৷’

ভ্রুকুটি করলেন প্রতাপনারায়ণ, ‘কথাটা কি খুব যুক্তিসঙ্গত বললেন মৈত্রমশাই? বলি সে যদি সিদ্ধিলাভ করেই থাকবে তাহলে আর এত কিছু করছে কেন? সে তো তার ঠাকুরের কাছে চাইলেই ইচ্ছেমতো ধনরত্ন পেতে পারে৷’

‘না প্রতাপবাবু,’ মাথা নাড়লেন, ‘সাধনার চূড়ান্ত সিদ্ধি তার প্রাপ্ত হয়নি৷ তাই তো সে এত সোনা খুঁজে বেড়াচ্ছে৷ কারণ উচ্ছুষ্মজম্ভলের সাধনায় চূড়ান্ত সিদ্ধির জন্য প্রয়োজন তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের৷ এক, ইষ্টদেবতার একটি সম্পূর্ণ সোনার তৈরি মূর্তি৷ দুই, সেই মূর্তির সামনে নরবলি, নরবলির রক্তে মূর্তিকে স্নানাভিষেক করা এবং তিন, সেই বলিরক্তলিপ্ত মূর্তির সামনে এক অক্ষতযোনি ব্রাহ্মণবালিকার সঙ্গে সাধনসম্ভোগ৷’

এবার সত্যিই চমকে উঠলেন প্রতাপনারায়ণ৷ তিনি রূদ্ধশ্বাসে বলে উঠলেন, ‘কী বলছেন কী মৈত্রমশাই তাহলে কি…’

বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লেন কৃষ্ণানন্দ মৈত্র, ‘হ্যাঁ প্রতাপবাবু৷ সেই উদ্দেশ্যেই হরিসাধনের কনিষ্ঠ পুত্রকে অপহরণ করা হয়েছে৷ এক লপ্তে অনেকটা সোনা পাওয়া যাবে বলে৷ আর বলি দেওয়ার জন্য তো বটেই৷ আর ঠাকুর মশাইয়ের মেয়েকেও সেই উদ্দেশ্যেই অপহরণ করেছে শয়তানটা৷ সেই হতভাগীর সঙ্গেই সাধনসম্ভোগ করতে চায় সে৷’

আবার চমকে উঠলেন প্রতাপনারায়ণ, ‘ঠাকুরমশাইয়ের মেয়েও অপহৃতা হয়েছে? কই, এ ব্যাপারে তো কখনও কিছু শুনিনি৷’

কৃষ্ণানন্দ গম্ভীরমুখে বললেন, ‘পরিস্থিতি যেভাবে ঘোরালো হয়ে উঠেছে তাতে কথাটা এবার আর চেপে রাখা যাচ্ছে না প্রতাপ৷ আমাদের মনে হয় এবার আপনাকে সবটা জানানো উচিত৷’

পরের কয়েক দণ্ড ধরে কৃষ্ণানন্দ বলে গেলেন রামনারায়ণের মেয়ের অপহৃত হওয়ার সমস্ত বৃত্তান্ত৷ প্রতাপনারায়ণ সবকিছু শোনার পর সবিস্ময়ে বললেন, ‘আশ্চর্য, এত বড় একটা ঘটনা, আর ঠাকুরমশাই আমাকে বলার প্রয়োজন অবধি বোধ করলেন না? তিনি কি আমাকে এতটাই অবিশ্বাস করেন?’

‘প্রশ্নটা বিশ্বাসের-অবিশ্বাসের নয় জমিদারমশাই৷ আপনি একবার তাঁর দিকটাও বুঝুন৷ তিনি লোকলজ্জার, সমাজস্থিতির ভয় পাচ্ছেন৷ এই আচরণ কি তাঁর পক্ষে খুব অস্বাভাবিক?’

প্রতাপনারায়ণ সন্তানহীন৷ তিনি নিজের বাড়ির বিভিন্ন উৎসবে সর্বমঙ্গলাকে কয়েকবার দেখেছেন৷ তাঁর পিতৃহৃদয় ক্রমেই ক্রুদ্ধ এবং তপ্ত হয়ে উঠল৷ তিনি প্রস্তরকঠিনমুখে বসে রইলেন৷

একটু পর কালু ডোম উঁকি দিয়ে বলল, ‘ঠাকুরমশাই এসেছেন প্রভু৷ আপনার সঙ্গে এক্ষুনি দেখা করতে চাইছেন৷ নিয়ে আসব?’

দুজনেই চমকিত হলেন৷ প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘সে কী? উনি পুজো করে বাড়ি চলে গেছিলেন না?’

‘সে তো গেছিলেন৷ আবার ফিরে এসেছেন৷ আর খুব কান্নাকাটি করছেন৷ তাঁর নাকি কী একটা ভীষণ বিপদ ঘটেছে, আপনার সঙ্গে এক্ষুনি দেখা করতে চান৷’

দুজনে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন৷ প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘আচ্ছা, আসতে বল৷’

মুহূর্তখানেক পর রামনারায়ণ মিশ্র ঝড়ের মতো ঢুকে এসে সোজা প্রতাপনারায়ণের পায়ে পড়ে গেলেন, ‘বাবা প্রতাপ, তুমিই আমাদের রক্ষক, আমাদের প্রতিপালক৷ এই দরিদ্র ব্রাহ্মণের ধর্ম রক্ষা করো বাবা, যেভাবে হোক আমাকে কন্যাকে উদ্ধার করো৷’

* * *

জাটিয়া জাদু প্রাতরাশ শেষ করেই বেরিয়ে পড়েছিলেন৷ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বনে বাদাড়ে৷ সঙ্গে লখাই৷ সে ভারী কৌতুকের সঙ্গে বুড়ো মানুষটার আদেশ পালন করে যাচ্ছিল৷ আজ অবধি এমন এমন অদ্ভুত জিনিস খুঁজতে আর কাউকে দেখেনি সে৷ যেমন মেঠো ইঁদুরদের গর্তে জমানো ধান, বাজপড়া অশ্বত্থের মূল, যজ্ঞডুমুর গাছের ডাল, এইসব৷ লখাইয়ের অবশ্য তাতে অসুবিধা নেই৷ এমনিতেই সে টই টই করে এই গাঁ, সেই গাঁ, গ্রাম বন জঙ্গল আদাড় বাদাড় ঘুরে বেড়ায়৷ কোথায় গেলে এসব পাওয়া যাবে সে তার নখদর্পণে৷ সে জিজ্ঞেস করল, ‘এসব দিয়ে কী হবে ঠাকুর?’

জাটিয়া বললেন, ‘সবকিছুরই দ্রব্যগুণ বলে একটা জিনিস থাকে রে লখাই৷ মহামায়ার লীলায় সেই দ্রব্যগুণ আচ্ছাদিত হয়ে থাকে, ছাইঢাকা আগুনের মতো৷ শুধু বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে কোনও ঘটনা ঘটলে সেই মায়ার আচ্ছাদন সরিয়ে বস্তুর দ্রব্যগুণ প্রকট হয়ে পড়ে৷ তখন সে আর সাধারণ বস্তু নয় রে লখাই, বড় কাজের জিনিস হয়ে দাঁড়ায় এবার একটা জিনিস বল তো বাপধন আমার, এ অঞ্চলে এমন কোনও নিম গাছ আছে, যার ডালে কাক বাসা বেঁধেছে?’

মাথা নাড়ল লখাই, আছে বই কি এমন নিমগাছ৷ চণ্ডীপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বারূণী নদী৷ যেখানে বারূণী বাঁক নিয়ে পুবমুখী হয়েছে, সেখানে একটি ছোট পরিত্যক্ত শ্মশান আছে৷ আর সেই শ্মশানের একেবারে গা ঘেঁষেই সেই মস্ত বড় নিমগাছ৷ তবে অসুবিধা একটাই৷ ওই শ্মশানের পরেই শুরু হচ্ছে বাঘার জঙ্গল৷ তাই কেউ ওখানে বিশেষ যায় না৷

চোখ চকচক করে উঠল জাটিয়া জাদুর, ‘শ্মশানের নিমগাছ? সে তো আরও ভালো৷ চল চল বাবা, পা চালিয়ে চল৷’

পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল৷ বারূণীর বুক একেবারে শুকনো খটখট করছে৷ বিশাল নিমগাছটির দিকে তাকিয়ে বুক দমে গেল জাটিয়া জাদুর৷ এই গাছে ওঠা কি সহজ ব্যাপার?

লখাই বোধহয় বুঝতে পারল বুড়ো মানুষটার মনের আশঙ্কা৷ সে একগাল হেসে বলল, ‘কী গো ঠাকুর, ভয় পেলে নাকি? ভাবছ লখাই পারবে কি না? আচ্ছা বলো, কী আনতে হবে কাকের বাসা থেকে?’

‘হাড়৷ কাকে তুলে এনেছে এমন যে কোনও প্রাণীর হাড়৷’

জাটিয়া জাদুকে বিস্মিত করে ওই একরত্তি ছেলেটা তরতর করে উঠে গেল গাছে৷ ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘কী গো ঠাকুর, ওপরে আসবে নাকি?’

জাটিয়া উত্তর দিতে যাবেন, এমন সময় একটা হাওয়ার স্রোত জঙ্গলের ভেতর থেকে পাক খেতে খেতে বেরিয়ে বারূণীর বুকে মিলিয়ে গেল৷ আর সঙ্গে সঙ্গে একটা পচা ভ্যাপসা গন্ধ ধাক্কা মারল তাঁর নাকে৷ উত্তরীয়টা দিয়ে নাক ঢাকলেন জাটিয়া জাদু৷ কীসের গন্ধ এটা?

একটু একটু করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন জাটিয়া জাদু৷ বাঘার জঙ্গল বিশাল এবং অত্যন্ত ঘন জঙ্গল৷ মস্ত বড় গাছ আর তাদের গা জড়িয়ে ওঠা ঝাঁকড়া লতাগুল্ম, ঝোপঝাড়, এসবের ভিতরে নজর চলে না৷ তিনি পায়ে পায়ে একটা মস্ত গাছের নীচে এসে দাঁড়ালেন৷

এরই মধ্যে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে ওই পিশাচ সর্দার আর তার দলবল৷ ধরে নিয়ে রেখেছে একটা ফুটফুটে মেয়ে, আর কয়েকজন নির্দোষ মানুষকে৷ কোথায় আছে তারা? জঙ্গলের কোন গহীনে?

আস্তে আস্তে নিজের হাতটা বাড়িয়ে সামনের গাছটা ধরতে গেলেন জাটিয়া৷ আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে হল একটা উত্তপ্ত আগুনের হল্কা তড়িৎগতিতে তাঁর শরীর ছুঁয়ে গেল যেন৷ ঝটিতি হাত সরিয়ে নিলেন জাটিয়া জাদু৷

কীসের বন্ধন করে রেখেছে পিশাচ সর্দার? কত বড় তান্ত্রিক সে যে এত বড় একটা মস্ত জঙ্গলকে বেঁধে রাখতে পারে?

নীচু হয়ে একমুঠো ধুলো হাতে নিলেন জাটিয়া৷ তারপর ছুঁড়ে দিলেন জঙ্গলের দিকে৷ আর তারপরেই তাঁর সামনে এক আশ্চর্য দৃশ্যের অবতারণা হল৷ মনে হল যেন কোনও এক অদৃশ্য আগুনের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে জ্বলে উঠল ধূলিকণাগুলি৷ জ্বলে উঠল তাদের প্রতিটি অণু পরমাণু৷

থমকে গেলেন জাটিয়া৷ তিনি নিজেও তন্ত্রশাস্ত্রে মহারথী৷ কিন্তু এমন অসম্ভব অচ্ছেদ্য ভূমিবন্ধন তাঁরও স্বপ্নেরও অগোচর৷ কে এই পিশাচ সর্দার?

যেন তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতেই জঙ্গলের ভেতর শনশন শব্দে জেগে উঠল ঝোড়ো হাওয়া৷ মনে হল জঙ্গলের মধ্যে যেন মাতম লেগেছে৷ আর সেই সেই বিক্ষুব্ধ ঝড় মুহূর্তের মধ্যেই প্রলয়ের শিঙা বাজিয়ে দিল জঙ্গলের মধ্যে৷ তার সঙ্গেই জেগে উঠল এক অশরীরী হাহাকারের কান্না৷ জাটিয়া জাদুর মনে হল যেন শত সহস্র বন্দি, অবরুদ্ধ, শৃঙ্খলিত আত্মার দল কেঁদে চলেছে উচৈচস্বরে৷ আর তাদের সেই কান্নার স্বর যেন রক্ত আর বেদনার স্রোত হয়ে মিশে যেতে লাগল ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে৷ তাদের সেই আর্তি, হাহাকারের শব্দ যেন জ্বলন্ত লোহার মতো তাঁর কানে ঢেলে দিতে লাগল কেউ৷

পিছিয়ে এলেন জাটিয়া জাদু৷ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন বাঘার জঙ্গলের দিকে৷ কোন পৈশাচী শক্তি অধিকার করে রেখেছে এই অরণ্য?

কোমরে একটা খোঁচা খেলেন জাটিয়া৷ দেখলেন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাঁকে দেখছে লখাই৷ সে জিজ্ঞেস করল, ‘ও ঠাকুর, এখানে অমন করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

‘তুই কিছু শুনতে পাচ্ছিস লখাই?’

‘কই? না তো ঠাকুর৷’

নিজেকে সামলে নিলেন জাটিয়া৷ এই ঝড়, এই কান্নার শব্দ বোধহয় তাঁর মতিভ্রমই হবে৷ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু পেলি কাকের বাসায়?’

লখাই তার হাতের মুঠি মেলে ধরল৷ আর সেই মুঠিতে ধরা জিনিসদুটি দেখে কেঁপে উঠলেন জাটিয়া জাদু৷

লখাইয়ের প্রসারিত হাতের মুঠোয় ধরা আছে দুটি মাথা৷ শ্মশানে মশানে ঘোরা সর্পতান্ত্রিক জাটিয়া জানেন ওদুটি কীসের মাথা৷

রাজগোখরো৷

ওই মাথা দুটি রাজগোখরোর করোটি৷

* * *

মায়ের মন্দিরের সামনে হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন রামনারায়ণ মিশ্র৷ এতক্ষণে সবই বলে ফেলেছেন জমিদারমশাইকে৷ প্রতাপনারায়ণ পাথরের মতো মুখ করে সব শুনছেন৷ তাঁর পাশে বসে আছেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ৷ তাঁর মুখও চিন্তায় চিন্তায় ঘনকৃষ্ণবর্ণ৷

‘আপনি এসব আমাকে আগে জানাতে পারতেন ঠাকুরমশাই’ কঠিনস্বরে বললেন প্রতাপনারায়ণ৷

সঙ্গে সঙ্গে ফের ফোঁপাতে থাকলেন রামনারায়ণ, ‘ভয় পেয়েছিলাম বাবা প্রতাপ৷ ভয় পেয়েছিলাম যে আমার মেয়ের মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে৷ কিন্তু…কিন্তু আজ দুপুরে বাঘার মাঠের সামনে ওই শয়তানটা স্বয়ং আমাকে বলে গেল যে ও আমার মেয়েকে ছাড়বে না৷ তার চূড়ান্ত সর্বনাশ করবেই করবে৷ তুমি আমাকে বাঁচাও বাবা৷ এই ধর্মনাশ থেকে আমাকে রক্ষা করো৷ তোমার দুটি পায়ে পড়ি৷’

প্রতাপনারায়ণ খানিকক্ষণ ক্ষিপ্ত পায়ে পদচারণা করলেন৷ তারপর হুঙ্কার দিলেন, ‘কালু, পাইকদের ডাক৷ আজই আমি বাঘার জঙ্গলে ঢুকব৷ দেখি শয়তানটার কত বড় স্পর্ধা হয়েছে৷’

কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘একটু দাঁড়িয়ে যান জমিদারমশাই৷ আমার গণনা বলছে মা মঙ্গলা এখনও অবধি সুস্থ আছে, ভালো আছে৷ কিন্তু আজকের রাতটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ আমার মন বলছে যা হওয়ার আজ রাতেই হবে৷ আজ সূর্যাস্ত থেকে কাল ভোর অবধি আপনার এই জমিদাবাড়িতে অবস্থান করা অত্যন্ত আবশ্যক৷’

রামনারায়ণ কাতর চোখে চেয়ে রইলেন জমিদারমশাইয়ের দিকে৷ প্রতাপনারায়ণ বললেন, ‘কিন্তু এইভাবে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকব?’

‘না জমিদারমশাই৷ নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা যাবে না৷ আজ আমি মা তারার সাধনায় বসব৷ আপনি ব্যবস্থা করুন৷’

‘ঠিক আছে, ব্যবস্থা করছি৷ ঠাকুরমশাই আপনাকে সাহায্য করবেন৷ আমি পাইকদের একত্রিত করে পাহারা আরও জোরদার করছি৷’

* * *

জাটিয়া জাদু যখন ফিরে এলেন তখন প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে৷ সংগৃহীত জিনিসগুলি ঘরে রেখে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ দেখলেন কৃষ্ণানন্দ মা বজ্রতারার সামনে পুজোয় বসেছেন৷ রামনারায়ণ তাঁর পাশে বসে তাঁকে সাহায্য করছেন৷ জাটিয়া রামনারায়ণকে দেখে ভারী আশ্চর্য হলেন, এই সময় তো ঠাকুরমশাইয়ের এখানে থাকার কথা নয়! তবে কিছু বললেন না তিনি৷ একপাশে চুপচাপ বসে পড়লেন৷

আচমন, করাঙ্গন্যাস ইত্যাদি শেষ করে ধ্যানস্থ হলেন কৃষ্ণানন্দ৷ মা মহামায়ার পাদপদ্ম স্মরণ করে মনকে একাগ্র করতে চেষ্টা করলেন৷ এবার ধ্যানে জাগ্রত করতে হবে মা বজ্রতারার শ্মশানমণিপীঠ৷

 কিন্তু এ কী! কৃষ্ণানন্দ অনুভব করলেন তাঁর চিন্তা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ শ্মশানমণিপীঠ ধ্যানে প্রকটিত হচ্ছে না৷ কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না সাধনায়৷ প্রবল চেষ্টায় তাঁর কপালে, কানের পাশে, ঘাড়ে ঘাম দেখা দিল৷ মনে হল বুকের ভেতরটা যেন ধড়ফড় করছে৷ হাত পা কাঁপতে লাগল প্রখ্যাত তন্ত্রবেত্তা কৃষ্ণানন্দ মৈত্র’র৷ তিনি আরও প্রবল চেষ্টার সঙ্গে ইষ্টধ্যেয়কে ধ্যানের মধ্যে অধিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করতে লাগলেন৷

না হচ্ছে না৷ কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছেন না মা মহামায়ার একনিষ্ঠ সেবক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ৷ সব যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে৷

অবশেষে তিনি চোখ খুললেন৷ তারপর একদৃষ্টিতে দেবীমূর্তির দিকে ভ্রুকুটিকুটিল নয়নে চেয়ে রইলেন৷

রামনারায়ণ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল আগমবাগীশমশাই? পুজো বন্ধ করে দিলেন যে?’

যেন চটকা ভেঙে জেগে উঠলেন কৃষ্ণানন্দ৷ মাতৃমূর্তির দিক থেকে চোখ সরালেন না৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে কঠিনস্বরে বললেন, ‘মন স্থির করতে পারছি না ঠাকুরমশাই, চিত্ত একাগ্র করতে পারছি না৷ আজকের পূজা সম্পন্ন হবে না৷ আমি জানি না মায়ের মনে কী আছে৷’

বলতেই বলতেই আকাশে গুরু গুরু মেঘের গর্জন শোনা গেল৷ তিনজনেই সচকিত হয়ে দেখলেন আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে৷ কোথাও একটা বজ্রপাত হল৷ তারপর শনশন শব্দ তুলে ধুলো আর হাওয়ার ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ল জমিদারবাড়ির ওপর৷ মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গেল কাছারিবাড়ির চাল, মন্দিরের বারান্দার ওপর লাগানো ছাউনি৷ ক্কড়াক্কর বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠল পৃথিবী৷ উল্টে গেল কোষাকুষি, প্রদীপ, ধুনুচিদান৷ ফুলমালা রাখার বেতের ঝুড়িটি নিমেষে উধাও হল ঝড়ের দাপটে৷ কাছারিবাড়ির ভেতর থেকে কে যেন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ওরে ঝড় উঠেছে রে৷ কে কোথায় আছিস, সব সামাল দে৷’

মুহূর্তে মুহূর্তে ঝড়ের প্রকোপ বাড়তে লাগল৷ হাওয়ার দাপটে দাঁড়িয়ে থাকাই দায়৷ ঝড়ের গর্জনে মনে হচ্ছে যেন শত সহস্র হাতির দল মরণযন্ত্রণায় উন্মত্ত চিৎকার করছে৷ এমন প্রলয়ান্তিক ঝড় কৃষ্ণানন্দ বা জাটিয়া জাদু নিজেদের জীবদ্দশায় দেখেননি৷ দুজনে কোনওমতে একটা বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ দেখলেন পাইকরা এদিকওদিক দৌড়োদৌড়ি করছে ঝড়ের দাপটে হাট করে খুলে গেছে কাছারিবাড়ির সদর দরজা কয়েকজন পাইক তাকে বন্ধ করার চেষ্টায় আছে৷

এমন সময় কৃষ্ণনন্দ খপ করে জাটিয়া জাদুর হাত চেপে ধরলেন৷ ভয়ার্তস্বরে বললেন, ‘ওরা কারা জাটিয়া?’

জাটিয়া দেখলেন আকাশ নেমে আসছে ছায়াশরীরীদের দল৷ যেন অন্ধকারের গর্ভ থেকে, পাতালের গহীন থেকে, সর্বনাশের গহ্বর থেকে নেমে আসছে পিশাচের বাহিনী৷ একে একে তারা নেমে এল কাছারিবাড়ির উঠোনে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো জমিদারবাড়ির ওপর একটা কনকনে শীতল চাদর বিছিয়ে দিল কেউ৷ একটা কটু ভ্যাপসা গন্ধে ভরে গেল চারিপাশ৷ কৃষ্ণানন্দ তাকিয়ে দেখলেন যারা নেমে এসেছে তাদের অবয়ব ছেঁড়া ছেঁড়া কালো ছায়া দিয়ে তৈরি, আর চোখের জায়গায় দুটুকরো করে অঙ্গার জ্বলছে যেন৷ সঙ্গে সঙ্গে সহস্র পৈশাচিক অট্টহাসির শব্দে কেঁপে উঠল দিগ্বিদিক৷ এক এক করে সেই ছায়াশরীর ঢুকে যেতে লাগল কাছারিবাড়ির ভেতরে৷

কিছুক্ষণ ঝড়ের শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই৷ তারপর ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে কাছারিবাড়ির ভেতর থেকে পাইকদের চিৎকার আর আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল৷ আর সেই সঙ্গে সেই বধির করে দেওয়া সমবেত পৈশাচী অট্টহাসি৷ এই আর্তনাদের পালা চলল কিছুক্ষণ৷ তারপর একে একে সেই ছায়ার দল বেরিয়ে এল কাছারিবাড়ির ভেতর থেকে৷ তাদের হাতে ছায়ার পোঁটলা৷ তারা সমবেত হয়ে দাঁড়াল৷ তারপর এক এক করে উড়ে যেতে লাগল আকাশপথে৷

সামান্য পরেই চারিদিক শান্ত হয়ে এল৷ মনে হল এতক্ষণ যেন কোথাও কিছু ছিল না৷ কোথায় সেই প্রলঙ্করী ঝড়? কোথায় সেই মত্তমাতঙ্গের চিৎকার? কোথায় সেই মুহুর্মুহু বজ্রপাত?

প্রতাপনারায়ণ আর হরিসাধন আলুথালু বেশে ছুটে এলেন বাইরে৷ সঙ্গে কাতরাতে থাকা কালু ডোম আর দুএকজন বিশ্বস্ত পাইক৷ প্রতাপনারায়ণ হাহাকার করে উঠলেন, ‘নিয়ে গেল, পিশাচের দল সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেল৷ হায় হায়, আমি এখন কী করব? গাঁয়ের লোকেদের কাছে মুখ দেখাব কী করে?’

হরিসাধনকে দেখে মনে হল এখনও প্রকৃতিস্থ হননি তিনি৷ ভয়ে, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছেন৷ শুধু অস্ফুটে একবার বললেন, ‘নিয়ে গেল? আমার সব জমানো সোনা নিয়ে গেল? এবার আমার ছেলেকে ফিরে পাব কী করে?’

লাফিয়ে উঠলেন রামনারায়ণ৷ তাঁর চেহারা বদলে গেছে৷ চোখ দুটি প্রবল ক্রোধে জ্বলছে যেন৷ তিনি বললেন, ‘আমি ওই বাঘার জঙ্গলে চললাম জমিদারমশাই৷ যাই হয়ে যাক, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনবই৷ যে আমার সঙ্গে যেতে চায় চলুক৷’ এই বলে মায়ের পায়ের কাছে থাকা ঘটটি তুলে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন তিনি৷

প্রতাপনারায়ণ আটকাতে যাচ্ছিলেন ঠাকুরমশাইকে৷ কৃষ্ণানন্দ ইশারায় বারণ করলেন৷ রামনারায়ণ বেরিয়ে যেতে বললেন, ‘যেতে দিন জমিদারমশাই৷ ওঁকে আপনি আটকাতে পারবেন না৷’

প্রতাপনারায়ণ বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘মানে? আটকাতে পারব না মানে?’

‘উনিই আজকের কাণ্ডের মূল হোতা৷ উনিই আজ মন্দিরের মধ্যে এমন একটি মন্ত্রপূত শক্তিশালী আধার এনে রেখেছিলেন যে আমার সমস্ত সাধনা ব্যর্থ হয়ে যায়৷ তাই আজ আমি কোনও বন্ধন দিতে পারিনি৷ আর বন্ধন দিতে পারিনি বলেই আজ এই এত বড় দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল৷’

প্রতাপনারায়ণ ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘তাহলে ওঁকে আটকাতে দিলেন না কেন?’

‘কারণ উনি প্রকৃত রামনারায়ণ মিশ্র নন৷ উনি যখনই আমাকে আগমবাগীশ বলে সম্বোধন করলেন, তখনই নিশ্চিত হয়ে গেলাম উনি কে৷ যবে থেকে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, কেউ আমাকে আগমবাগীশ বলে সম্বোধন করেননি৷ তাহলে উনি আমার এই উপাধি জানলেন কী করে?

আপনি আজ চাইলেও ওঁকে আটকাতে পারতেন না জমিদারমশাই৷ আজ ডাকাতসর্দারই রামনারায়ণ মিশ্রর রূপ ধরে এসেছিল আমাদের মধ্যে৷ খুব সম্ভবত ঠাকুরমশাই ওদের হাতে এখন বন্দি৷

নিজের ওই ভৌতিক, অশরীরী ডাকাতদলকে আহ্বান করে আনার জন্য আজ ডাকাতসর্দারের প্রয়োজন ছিল এই জমিদারবাড়ির মধ্যে উপস্থিত থাকা৷ সে তার কর্ম সম্পাদন সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে৷ তার আয়ুধ নিয়ে পালিয়েছে৷ এবার তাকে আটকায় এমন শক্তি ত্রিভুবনে নেই৷’

* * *

জাটিয়া জাদু ছিলেন দলটির একেবারে সামনে৷ পিছনে ছিলেন প্রতাপনারায়ণ, হরিসাধন, কালু ডোম আর জনা কয়েক বিশ্বস্ত পাইক৷ সবার হাতে একটি করে মশাল৷

প্রতাপনারায়ণ বলেছিলেন যাই হয়ে যাক, আজ তিনি বাঘার জঙ্গলে ঢুকবেনই৷ তাঁর আশ্বাসেই গ্রামের সবাই তাদের সঞ্চিত ধন কাছারিবাড়িতে রেখে গেছিল৷ এখন সেই ধনসম্পত্তি খোয়া গেলে সবাই তাঁকেই দুষবে৷ সেই অপমান তিনি মেনে নিতে পারবেন না৷ আটকানো যায়নি হরিসাধনকেও৷ ছেলেকে না নিয়ে বাড়ি ফিরলে নিজের পরিবারের সামনে দাঁড়াবেন কী করে?

কালু ডোমকেও আটকানো যায়নি৷ তার মতো প্রভুভক্ত মানুষ এই পরগনায় দ্বিতীয়টি নেই৷ প্রতাপনারায়ণ যদি নরকেও যান, তাহলেও সে প্রতাপনারায়ণের সঙ্গ ছাড়বে না৷

আসেননি কৃষ্ণানন্দ৷ তিনি জাটিয়া জাদুর এনে দেওয়া সামগ্রীগুলি নিয়ে মহাপূজায় বসেছেন৷ আজ কৌশিকী অমাবস্যা৷ তিনি পণ করেছেন আজ নিজের সমস্ত তান্ত্রিক জ্ঞান, শক্তি, আয়ুধ প্রয়োগ করে দেখবেন কয়েকটি নিরীহ প্রাণ রক্ষা পায় কি না৷ আর সেই পূজার জন্য গ্রামের শ্মশান থেকে আনিয়ে নিয়েছেন কয়েকটি আধপোড়া চিতাকাঠ৷

মাতৃমূর্তিকে সযতনে পাদপীঠ-সহ মন্দিরের বাইরে আনলেন কৃষ্ণানন্দ৷ তারপর তাকে পশ্চিমাস্য করে স্থাপন করলেন৷ চিতাকাঠ দিয়ে প্রস্তুত করলেন যজ্ঞভূমি৷ প্রথমে নিজের শিখাবন্ধন করলেন৷ তারপর পদ্মাসনে বসে সুগম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করলেন, ‘ওঁ সবর্বান বিঘ্নানুৎসারয় হূঁ ফট স্বাহা৷’ তর্জনী, মধ্যমা আর কনিষ্ঠা বজ্রমুদ্রায় ধারণ করে কোষার জলে ডুবিয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘ওঁ বজ্রোদকে হুং ফট স্বাহা৷’ চন্দন দিয়ে যোনিযুক্ত ত্রিকোণ, ত্রিকোণের তিনটি কোণ ছুঁয়ে একটি বৃত্ত, এবং বৃত্তের বাইরে অষ্টদলপদ্ম আঁকলেন৷ তারপর হাতে ফুল নিয়ে ‘ওঁ পুষ্পকেতু রাজার্হতে’ মন্ত্রোচ্চারণ করে পীঠচিন্তায় নিমগ্ন হলেন৷

প্রথমে শ্মশানভূমিচিন্তা৷ শ্মশানের মধ্যে একটি কল্পতরুবৃক্ষ৷ তার পাদপীঠে সুবর্ণ ও রত্ননির্মিত মণিপীঠ৷ শ্মশানের প্রান্তদেশে শিবাদল মাংস ও অস্থিলোভে আনন্দিত হয়ে বিচরণ করছে৷ শবমুণ্ড, চিতাঙ্গার ও অস্থি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত৷ এইবার নারাচমুদ্রায় অক্ষত প্রক্ষেপণ দ্বারা দিব্য, অন্তরীক্ষ ও ভৌম এই ত্রিবিধ বিঘ্ন নিবারণ করতে হবে৷ মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন কৃষ্ণানন্দ, ‘মাতর্নীলসরস্বতী প্রণমতাং সৌভাগ্যসম্পৎপ্রদে প্রত্যালীঢ়-পদস্থিতে শবহৃদি স্মেরাননাম্ভোরুহে, ফুল্লেন্দীবর লোচনত্রয়যুতে কর্ত্রীং…’

বাঘার জঙ্গলের সামনে এসে থমলে দাঁড়াল ছোট দলটি৷ জাটিয়া জাদু জানেন এইবার তাঁদের সামনে প্রথম বাধা৷ তিনি ইতিউতি চেয়ে মৃদুস্বরে ডাকলেন, ‘লখাই৷’

অন্ধকারের মধ্য থেকে একটা ছোট অবয়ব বেরিয়ে এল, ‘এসেছি ঠাকুর৷’

কালু ডোম আঁতকে উঠল, ‘এ কী লখাই৷ তুই এখানে কী করছিস বাপধন?’

জাটিয়া জাদু কালুর কাঁধে হাত রাখলেন, ‘চিন্তা কোরো না কালু৷ এই জঙ্গলে ঢুকতে গেলে আমাদের দরকার লখাইয়ের বয়সী একটি ছেলে বা মেয়ের৷ পিশাচসর্দার এই জঙ্গলকে এক অতি প্রাচীন বন্ধনে বেঁধে রেখেছে তাই কেউ এখানে প্রবেশ করতে পারে না৷ কিন্তু এই বন্ধন শিশুদের ওপর কোনও প্রভাব ফেলে না৷ সেইজন্যই তোমাদের গাঁয়ের ওই জগাই নামের ছেলেটি জঙ্গলে প্রবেশ করতে পেরেছিল৷ একই কারণে লখাইয়ের ওপরেও সেই অভিশাপের কোনও ফল ফলবে না৷ লখাই আমাদের জানিয়েছে তোমাকে না জানিয়ে সে প্রায়ই এখানে আসে৷ তাই আজ সেইই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে পিশাচসর্দারের আস্তানায়৷’

‘কিন্তু ঠাকুর…’

‘চিন্তা কোরো না কালু৷ আমি জাটিয়া জাদু, প্রতিজ্ঞা করছি, যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি, ততক্ষণ তোমার ছেলের কোনও ক্ষতি হতে দেব না৷’

আরও কিছুক্ষণ হাঁটলেন সবাই৷ এমন সময় লখাই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল৷ জাটিয়া জাদু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল লখাই?’

‘আচ্ছা সন্ন্যাসীঠাকুর…’

‘বল৷’

‘তোমরা তো এত তন্তর মন্তর করো৷ আজ যদি এই জঙ্গলে আমার কোনও বিপদ হয়, তাহলে কি আমার মরে যাওয়া মা আমাকে বাঁচাতে আসবে?’

জাটিয়া জাদু কোনও জবাব দিলেন না৷ লখাইকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগলেন৷

স্বর্ণনির্মিত কৃষ্ণজম্ভলের মূর্তির সামনে ধ্যানে বসেছিল সর্দার৷ কয়েক দণ্ডের মধ্যে খণ্ডবিখণ্ড ধাতুকে গলিয়ে তাকে ইচ্ছেমতো আকার দেওয়া তার কাছে অতি সামান্য বিষয়৷ আর এসবই তার আয়ত্তাধীন হয়েছে মহাচীনাচার সাধনায়৷ তাই আজ সাফল্যলাভের চূড়ান্তমুহূর্তে ধ্যানে বসে তার মনে পড়ছিল মহাচিনে অতিবাহিত দিনগুলির কথা৷

মহাচীনদেশ রুক্ষ মরুভূমি আর বরফের দেশ৷ এত শৈত্য, এত রুক্ষতা আগে কখনও দেখেনি সর্দার৷ সে রাঢ়বাংলার গ্রামের ছেলে৷ পথশ্রমে, ক্ষুধায়, শৈত্যে মৃতপ্রায় হয়ে পথের পাশে পড়েছিল সে৷ দেবী দ্রৌলমার মন্দিরে অর্ঘ্য দিতে যাওয়ার পথে তার গুরু তাকে দেখতে পেয়ে তাকে তুলে আনেন৷ গুরুই তাকে কিছু সিদ্ধি প্রদান করেন যাতে এই কঠিন কঠোর দেশে তার বেঁচে থাকা একটু সহনীয় হয়৷

সেই থেকে শুরু৷ আস্তে আস্তে কঠোর পরিশ্রমে সে গুরুর স্নেহ আর বিশ্বাসের পাত্র হয়ে ওঠে৷ আর জন্মগত প্রতিভা তো তার ছিলই৷ অতি অল্প আয়াসে যে কোনও সাধনাক্রম আত্তীকৃত করায়, যে কোনও তন্ত্রপদ্ধতি অধিগত করায় আশ্চর্য ব্যুৎপত্তি ছিল তার৷ রাঢ়দেশের এক সাধারণ গ্রামের ছেলের মধ্যে এই অতিলৌকিক ক্ষমতা কী করে এল সে এক ঈশ্বরই জানেন৷

তন্ত্রসাধনার অন্তিম উদ্দেশ্য হচ্ছে কামাদিকুসুমের নিগড় থেকে নিজেকে মুক্ত করে, ভোগসমুদ্র’র পারে উত্তীর্ণ হয়ে নিজেকে কৈবল্যসাধনায় বিলীন করে দেওয়া৷ সর্দার সব পেরেছে, সব রিপুশত্রু নাশ করেছে, শুধুমাত্র একটি বাদে৷ শুধুমাত্র একটি রিপুই আজ পর্যন্ত সর্দার অতিক্রম করতে পারেনি৷ লোভ৷ সম্পদের প্রতি লোভ, অর্থের প্রতি লোভ, বিলাসের প্রতি লোভ, ব্যসনের প্রতি লোভ৷

গুরুও কি জানতে পেরেছিলেন? নইলে তাকে দেব কৃষ্ণজম্ভলের সাধনপদ্ধতি শেখাতে বারবার অস্বীকার করেছিলেন কেন তিনি? গুরু ছিলেন মহাচীনাচারশাস্ত্রের মহারথী৷ তিনি চাইলে পৃথিবীর সমস্ত সুখ, সমৃদ্ধি, যশ, প্রতাপ, খ্যাতি অনায়াসে আয়ত্ত করতে পারতেন৷ কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন কৃচ্ছ্রসাধনের পথ, বৈরাগ্যের পথ৷ দারিদ্রকে বরণ করেছিলেন স্বভাবজ বিনয় আর ঔদার্যের সঙ্গে৷

তাই সর্দারকে বেছে নিতে হয়েছিল অন্য এক উপায়৷ গুরু একবার কর্মব্যপদেশে বাইরে গেছিলেন৷ তখন সে চুপি চুপি গুরুর পুঁথির ভাণ্ডার থেকে জম্ভলসাধনার পুঁথিটি হস্তগত করে৷ তারপর প্রায়ই চলে যেত পাহাড়ি অরণ্যে৷ সেই প্রাচীন পুঁথির নির্দেশ মেনে ক্রমে ক্রমে ডিম্ভসাধনার এক একটি স্তর অতিক্রম করতে থাকে সে৷

তবে পাপ কখনও গোপন থাকে না৷ একদিন হাতেনাতে গুরুর হাতে ধরা পড়ে গেল সর্দার৷ তদ্দণ্ডেই গুরু তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন৷ আর অভিশাপ দিলেন যে সাধনার লোভে সর্দার তার গুরুর সঙ্গে এতবড় তঞ্চকতা করল, সে সাধনায় তার চূড়ান্ত সাফল্য তার অধরাই থেকে যাবে৷ তবে এতদিনের সাধনার ফলস্বরূপ দেবী দ্রৌলমা স্বয়ং নিজহস্তে তার মোক্ষপথ উন্মুক্ত করবেন৷

চোখ বুজল সর্দার৷ মহাচীন থেকে পালিয়েছিল বটে, তবে চুরি করে এনেছিল আরও একটি জিনিস৷

দেশে ফেরার পর একের পর দুরূহতম তন্ত্রসাধনায় নিজেকে আরও উন্নত করেছে সে৷ জালন্ধর, পূর্ণগিরি, উড্ডীয়ান, কোথায় কোথায় যায়নি সর্দার? স্মৃতিতে নিয়ে এসেছিল কৃষ্ণজম্ভলসাধনার সমস্ত সাধনপদ্ধতি৷ অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি নিয়ে জন্মেছিল সর্দার৷ এক মন্ত্র তাকে কখনও দ্বিতীয়বার বলতে হয়নি৷ শোনামাত্র বা দেখামাত্র যে কোনও মন্ত্র তার স্মৃতিতে নির্ভুলভাবে গেঁথে যায়৷

আজ সেই বহু ঈপ্সিত চূড়ান্ত সময়৷ আজই দেখা যাবে গুরুর ভবিষ্যদ্বাণী না তার অর্জিত সাধনসম্পদ, কার জোর বেশি৷ ইষ্টদেবকে স্মরণ করে চোখ বুজল সর্দার৷

চিতার আগুনে সমিধ অর্পণ করলেন কৃষ্ণানন্দ৷ মন্ত্রোচ্চারণ করলেন, ‘…ললজ্জিহ্বা সদা পাতু নাভৌ মাং ভুবনেশ্বরী৷ করালাস্যা সদা পাতু লিঙ্গে দেবী হরপ্রিয়া৷ পিঙ্গোগ্রৈকজটা পাতু জঙ্ঘায়াং বিঘ্ননাশিনী৷ বলতে বলতে যজ্ঞে আহুতি দিলেন জাটিয়ার এনে দেওয়া ধান৷ এই ধান এসেছে মেঠো ইঁদুরদের গর্ত থেকে৷ তারা একটি একটি ধানের কণা সঞ্চয় করে রাখে তাদের গর্তে৷ তাদের সেই সঞ্চয়ের মধ্যে, সাধারণ সংসারী মানুষের সঞ্চয়ের মধ্যে অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংযম জমে থাকে৷ সেই সঞ্চয় ছিনিয়ে নেওয়া মহাপাপ৷ সেই মহাপাপকে চিতাযজ্ঞে আহুতি দিলেন কৃষ্ণানন্দ৷

প্রথম বাধা বড় সহজেই অতিক্রম করলেন জাটিয়া জাদু এবং অন্যরা৷ জাটিয়া জাদু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন৷ কৃষ্ণানন্দ ঠিকই বলেছিল তবে৷

দেব কৃষ্ণজম্ভলের আকার পঞ্চবর্ষীয় কুমারের মতো৷ তাই কৃষ্ণজম্ভলের উদ্দেশ্যে কৃত কোনও কৃষ্ণাভিচারই পঞ্চমবর্ষীয় বা তার থেকে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে খাটে না৷ আর সেইজন্যই এই জঙ্গলে প্রবেশ করতে তাঁদের প্রয়োজন ছিল একটি পঞ্চমবর্ষীয় শিশুর৷

সাধারণত এত ছোট শিশুরা তাদের শৈশব মায়ের স্নেহাঞ্চলেই কাটায়৷ কিন্তু এই মাতৃহীন অনাথ বালক শৈশব থেকেই স্বাধীন, সে মানুষ হয়েছে প্রকৃতির কোলে, এই অরণ্যানীর মধ্যে৷ সে যখন ইচ্ছা তখন বাঘার জঙ্গলে ঢুকেছে, বেরিয়েছে, তার ওপর কোনও অরণ্যবন্ধন, প্রকৃতিবন্ধন, বা ভূমিবন্ধন ক্রিয়া করেনি৷ তার উপস্থিতি ডাকাতপিশাচদের কাছে অধরাই থেকে গেছে৷ সে তাদের কাছে অদৃশ্য৷

জাটিয়া জাদু একটি কাপড়ের টুকরো বার করলেন৷ প্রতাপনারায়ণ দেখলেন এ তাঁর সেই পুরনো ধুতি যা লখাইকে দেওয়া হয়েছিল৷ জাটিয়া জাদু ধুতিটি ছোট ছোট টুকরো করলেন৷ তারপর মন্ত্র পড়তে পড়তে প্রত্যেকের বাজুতে সেই টুকরোগুলি বেঁধে দিলেন৷প্রতাপনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবার কোনদিকে যাব?’

জাটিয়া জাদু বললেন, ‘শুনেছি এখানে নাকি এককালে বাঘা ডাকাতের মশান ছিল, সেখানে নরবলি হত৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ডাকাতসর্দার সেখানেই ঘাঁটি গেড়েছে৷’

লখাই একটা ক্ষীণ পায়েচলা পথ দেখিয়ে বলল, ‘ও জায়গাটা তো আমি চিনি৷ এইদিক দিক দিয়ে গেলেই ওখানে পৌঁছনো যাবে৷’ জাটিয়া জাদু বললেন, ‘এবার তাহলে এগোনো যাক৷’

সর্বমঙ্গলা ঘুমিয়ে ছিল কুটিরের মাটিতে৷ আবার সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা দেখছিল সে৷ চারিদিকে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, শুধু দাউ দাউ করে জ্বলছে পাহাড়প্রমাণ চিতার সারি৷ আর তার মধ্যে ধীর পায়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে মস্ত একটি চিতার দিকে৷ তার পরনে বাঘছাল৷ সারা দুই হাতে, দুই পায়ে, সারা শরীরে সাপের দল জড়িয়ে আছে গয়নার মতো৷ আর তার মাথার ওপর একটি জটাকুণ্ডলী পাকিয়ে ফণা ধরে আছে একটি কালনাগিনী৷

ধীরে ধীরে সেই চিতার ওপর উঠতে থাকল সে৷ পায়ের কাছে গড়িয়ে যাচ্ছে জ্বলন্ত কাঠ, নরমুণ্ড, অস্থি, অর্ধদগ্ধ মাংস৷ আগুনের লেলিহান শিখা তাথৈ তাথৈ নাচছে তাকে ঘিরে৷ তার মনে হচ্ছে সে যেন এই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের অধিশ্বরী, রাজরাজেশ্বরী৷ এই সংসার তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে৷ জন্ম আর মৃত্যু যেন তার দুই পায়ের দুই মঞ্জীর৷ তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে যেন এক অদ্ভুত অপার্থিব আনন্দের স্রোত৷ সে অসীম, সে অনন্ত, সে এই বিশ্বচরাচরের প্রতিটি কোণে, প্রতিটি ধূলিকণায়, প্রতিটি অণু পরমাণুতে পরিব্যাপ্ত৷

সুচারুভাবে একের পর এক সাধনার স্তর অতিক্রম করে যাচ্ছে সর্দার৷ তার মন, বুদ্ধি এবং অহংকার এখন তার ভ্রুমধ্যস্থ৷ তার চিত্তচৈতন্য এখন বিশুদ্ধচক্রে অধিষ্ঠান করছে৷ সর্দারের অন্তর্দেহের দক্ষিণ অংশটি এখন শ্বেতকল্প শিব, বাম অংশটি স্বর্ণনির্মিত শক্তি৷ একটি রক্তপদ্মের ওপর আসীন সে৷ তার পরনে বাঘছাল, চারটি হাতে ধনু, শর, পাশ এবং গদা ধারণ করে আছে সে৷ শ্বাসবায়ু স্থির করে মন্ত্র উচ্চারণ করল সর্দার, ‘ওঁ জম্ভলা জামলিম জ্বায়ে স্বাহা৷’

এবার যাত্রা পরের চক্রের দিকে৷

জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা গিয়ে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ল লখাই৷ ফিসফিস করে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ?’

একটু কান পাততেই শুনতে পেলেন তাঁরা৷ একটা শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্য থেকে৷ কিন্তু কোন দিক থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না৷ সবাই ইতিউতি চাইতে লাগলেন৷ এমন সময় জাটিয়া জাদু চাপাস্বরে বললেন, ‘ওপরে তাকান৷’

সবাই ওপরে তাকিয়ে দেখলেন গাছপালার মধ্য দিয়ে অল্প একটু আকাশ দেখা যাচ্ছে৷ আর সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটা অশরীরী ছায়া৷ ছেঁড়া অন্ধকার দিয়ে তৈরি শরীর তাদের৷ আর চোখের জায়গায় দুটি জ্বলন্ত অঙ্গার বসানো৷

জাটিয়া জাদু ফিসফিস করে বললেন, ‘ওরা টের পেয়েছে যে কেউ বা কারা বাঘার জঙ্গলে ঢুকেছে৷ কিন্তু বুঝতে পারছে না যে তারা কারা আর কোথায় আছে৷ আমরা এখন ওদের কাছে অদৃশ্য৷ আপনাদের হাতে যে কাপড়ের টুকরোটা বেঁধে দিয়েছি, ওটাই আপনাদের রক্ষাকবচ৷ কোনও শব্দ করবেন না৷ একদম চুপচাপ থাকুন৷’

আস্তে আস্তে জঙ্গলের শব্দ স্তিমিত হয়ে এল৷ মনে হল জঙ্গল যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে৷ একটু পরেই একটা শীতল চাদর কে যেন টেনে দিল জঙ্গলের ওপরে৷ হঠাৎ করেই অকালপৌষের ঠান্ডা নেমে এল জঙ্গলের বুকে৷ সেই অশরীরী শৈত্য নিঃশব্দ ঘাতকের মতো জমে উঠতে থাকল৷

অশরীরী ছায়ার দল ধীরেসুস্থে নেমে এল ওই জায়গাটায়৷ এদিক ওদিক কী যেন খুঁজতে লাগল তারা৷ তীব্র হয়ে উঠল কটু ভ্যাপসা গন্ধ৷ দাঁতে দাঁত চিপে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন প্রত্যেকে৷

যজ্ঞের চিতার আগুন এবার লেলিহান শিখায় জ্বলছে৷ নিজের উত্তরীয়টা মাথায় শিরস্ত্রাণের মতো করে বেঁধে নিলেন কৃষ্ণানন্দ৷ মন্ত্রোচ্চারণে ছেদ পড়েনি এতটুকু, বলে চলেছেন ‘…নাগনূপুরধরাদেবী ভোজনে পাতু সর্বদা, শবকর্ণা মহাদেবী শয়নে পাতু সর্বদা…’ বলতে বলতে বজ্রপাতে মৃত অশ্বত্থগাছের মূল আর যজ্ঞডুমুরের ডাল চিতাগ্নিতে আহুতি দিলেন কৃষ্ণানন্দ৷ একটা নীল শিখা যেন হঠাৎ লাফিয়ে উঠল লেলিহান অগ্নির মধ্যে৷ আর সেই সঙ্গে আকাশ থেকে একটা নীল রঙের তারা বিদ্যুদ্বেগে খসে পড়ল বাঘার জঙ্গলের মধ্যে৷

দরজা খুলে একজন ডাকাত ঢুকে এল ঘরে৷ সর্বমঙ্গলাকে ডেকে তুলল৷ তারপর একটা শাড়ি দিয়ে যান্ত্রিকস্বরে বলল, ‘ঘরের পেছনে কয়েকঘড়া জল এনে রেখেছি৷ স্নান করে এই শাড়িটা পরে নাও৷’

সর্বমঙ্গলা উঠল৷ শাড়ি নিল৷ যন্ত্রের মতো হেঁটে চলল কুটিরের পিছন দিকে৷ কোথায় যাচ্ছে সে? এই কি সেই জঙ্গল যেখানে তাকে ধরে রাখা হয়েছিল৷ কই, না তো, ওই তো সেই পাহাড়প্রমাণ জ্বলন্ত চিতা৷ তার চারিধারে ছড়িয়ে আছে শবমুণ্ড আর অস্থি… সে ক্রমে উঠে যাচ্ছে চিতার ওপর৷ তার হাতে কী ধরা আছে ওটা? ভালো করে দেখা যায় না৷ এত আগুন, তাও এত অন্ধকার?

একটা ক্রোধ, অব্যক্ত ক্রোধ ক্রমে তার শরীর, মন, মস্তিষ্ক ছেয়ে ফেলছে যেন কেন এই ক্রোধ, কার ওপরে এই ক্রোধ সে জানে না৷ কিন্তু তার মনে হচ্ছে যেন সে যেন তার ক্রোধের আগুনে এই পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারে৷

পুজো সাঙ্গ করে উঠে দাঁড়াল সর্দার৷ তারপর হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘নিয়ে আয় ওদের৷’

এক এক করে শশিশেখর আর তার সঙ্গীসাথীদের এনে মাথা হেঁট করে বসানো হল হাড়িকাঠের সামনে৷ তাদের ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু নেই৷ নিম্নাঙ্গে নতুন ধুতি ছোট করে পরা৷ বোঝা যায় যে একটু আগেই স্নান করানো হয়েছে তাদের৷ চুল থেকে জল ঝরছে এখনও৷ শুধু তাদের চাউনি নিষ্প্রাণ, আচরণ জড়বৎ৷ যেন তারা বুঝতে পারছে না তাদের সঙ্গে কী হতে চলেছে৷

‘ঠাকুরমশাইকে ডাক,’ আদেশ দিল সর্দার৷

একটু পর বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে উপস্থিত হলেন রামনারায়ণ৷ তাঁকেও স্নান করানো হয়েছে৷ তিনি এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এসব কী? আমাকে কেন ডাকা হল?’

সর্দার একটা ধীরেসুস্থে একটি বিশালাকৃতি খড়্গ তুলে ধরল৷ তারপর গম্ভীরমুখে বলল, ‘আমার একটা কাজ করে দিতে হবে ঠাকুর৷ আজ আমি নিজের হাতে এদের বলি দেব৷ আর সেই বলির রক্তে আমার ইষ্টদেবকে স্নান করাব৷ সেই পূজায় তোমাকে পৌরোহিত্য করতে হবে, ব্যস৷ তাহলেই তোমার ছুটি৷’

রামনারায়ণ যেন চোখে অন্ধকার দেখলেন৷ তাঁর হাত পা শিথিল হয়ে এল৷ তিনি কম্পিতকণ্ঠে বললেন, ‘দোহাই সর্দার, তোমার পায়ে পড়ি, এমন পাপ কাজ আমাকে দিয়ে করিও না৷’

‘পাপ কাজ?’ হা হা করে হেসে উঠল সর্দার, ‘যে কাজে স্বয়ং ঈশ্বরের রুচি আছে, তাকে পাপ কাজ বল ঠাকুর? আচ্ছা সে যা হোক৷ যদি পাপকাজ বল; তো তাইই৷ কিন্তু যদি মেয়েকে ফিরে পেতে চাও ঠাকুর তো এই কাজ তোমাকে করতেই হবে৷ এবার তুমিই ভেবে বলো, কী চাও৷ এদের প্রাণ বাঁচাতে চাও না নিজের মেয়েকে ফিরে পেতে চাও৷’

রামনারায়ণ মিশ্র’র বুকে যেন একটা ছুরি বিঁধে গেল৷ এতগুলি অসহায় প্রাণের বিনিময়ে নিজের স্নেহপুত্তলিকে উদ্ধার করতে হবে? এ তিনি কী করে পারবেন? এরাও তো কারও সন্তান, কারও পিতা, কারও ভাই৷ আর ওই যে পূর্ণিমার চাঁদের মতো ছেলেটি, তাকেই তো একদিন নিজের জামাতা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন রামনারায়ণ৷ এখনও বোধহয় হরিসাধন আশায় আছেন তাঁর ছেলেকে ফিরে পাবেন৷ বুকের ভেতরটা যেন হাহাকার করে উঠল রামনারায়ণের, চোখ জলে ভরে এল৷ তিনি চোখের জল মুছে বললেন, ‘এদের বদলে আমাকে বলি দিলে হয় না? আমি সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণ, জীবনে কারও ক্ষতি করিনি, কারও খারাপ চাইনি, সারাজীবন একনিষ্ঠ হয়ে মা কিরীটেশ্বরীর সেবা করেছি৷ আমাকে বলি দিলে তোমার উদ্দেশ্য অনেক তাড়াতাড়ি পূরণ হবে সর্দার৷’

সর্দার আবার হাসল৷ তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুমি সত্যিই একজন সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণ, নিজের সম্পর্কে যা যা বলেছ সব সত্যি৷ আর সেই জন্যই এই বলিপূজায় তোমাকেই পুরোহিত হওয়ার জন্য আমি বেছে নিয়েছি৷ এই অঞ্চলে তোমার থেকে থেকে ভালো পুরোহিত আর কাউকে পেতাম না৷’

‘দোহাই সর্দার, দোহাই৷ এই পাপকাজ করে এই গ্রামকে অপবিত্র কোরো না৷’

হা হা করে হেসে উঠল সর্দার৷ ‘নিজের গ্রামকে বড় ভালোবাসো ঠাকুর, তাই না? কিন্তু কী করি বলো, সবই বিধিনির্দিষ্ট৷ শেষ সাধনা সম্পন্ন করার জন্য আমাকে এই গ্রামেই আসতে হত যে৷ কেন জানো?’

রামনারায়ণ তখনও কাঁপছিলেন৷ তাঁর মুখে কথা ফুটল না৷

‘এই বিপুলা পৃথিবীর যে কোনও সুলক্ষণযুক্ত স্থানেই আমি আমার চূড়ান্ত সাধনার আসন বিছাতে পারতাম৷ কিন্তু এখানে এসেছি একটাই কারণে৷ আমার ইষ্টদেব কৃষ্ণজম্ভল যে কুলের দেবতা সেটি হচ্ছে ধ্যানীবুদ্ধ রত্নসম্ভবের কুল৷ আর দেব রত্নসম্ভব কুলের সর্বোত্তমা ঈশ্বরী হলেন দেবী বজ্রতারা৷ আমার এমন একটি সাধনস্থান প্রয়োজন ছিল যেখানে একইসঙ্গে প্রাচীন নরবলির মশান আর দেবী বজ্রতারার মূর্তি অধিষ্ঠিত আছে৷ ভারতে এমন একটিই জায়গা আছে, সে হচ্ছে এই চণ্ডীপুর গ্রাম৷ এবার তুমি প্রস্তুত হয়ে নাও ঠাকুর৷ বলিদানের পর আরও একটু কাজ রয়ে যাবে, সেটি শেষ করলেই, ব্যস তোমার ছুটি৷’

‘আবার কী কাজ? আর কত পাপ আমাকে দিয়ে করাবে সর্দার?’

দাড়ি গোঁফের ফাঁক দিয়ে অল্প হাসল ডাকাতসর্দার৷ ‘তোমার কন্যাটি বড়ই সুলক্ষণা ঠাকুর৷ ওর শরীরে যে যোগিনীচিহ্ন আছে তা কোটিতে মেলে না৷ আমি স্থির করেছি ওকে আমার সাধনসঙ্গিনী করব৷ তোমার মেয়েকে জীবিত ফেরত পাবে বটে, কিন্তু ও থাকবে আমার কাছেই৷ সেই পুজোটাও তোমাকেই দিতে হবে৷’

অন্ধকার ছায়াগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাঁদের ঘিরে৷ মনে হচ্ছিল কারা যেন ধীরে ধীরে শীতল নিঃশ্বাস ফেলছে৷ ছায়াশরীরগুলো ভেঙে যাচ্ছিল, আবার জুড়ে যাচ্ছিল একে অন্যের সঙ্গে৷ যেন সব মিলিয়ে একটিই মস্ত অন্ধকারপিণ্ড, সেটিই ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন হয়েছে৷

পচা কটু গন্ধে বমি উঠে আসছিল তাঁদের৷ ভয়ে আর ঠান্ডায় দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছিল৷

কিন্তু তবুও তাঁরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন৷

একটু পর জটিয়া জাদু দেখলেন তাঁদের পায়ের কাছে যেন কী একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ তিনি ধীরে ধীরে নীচের দিকে তাকালেন৷

নেউল৷ একটি নেউল ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁদের পায়ের কাছে৷ প্রত্যেকের কাছে গিয়ে পায়ে নাক লাগিয়ে কী যেন শুঁকছে৷

নেউল৷ জাটিয়া জাদুর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমের স্রোত নেমে গেল৷ এ নিশ্চয়ই ডাকাতসর্দারের মায়া নেউল৷ তাঁর বন্ধন পিশাচদের কাছে অদৃশ্য, কিন্তু এই মায়া নেউলের কাছে নয়!

নেউলটা পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জাটিয়া জাদুর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ৷ তারপর হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল৷

এতক্ষণের ভয় আর উত্তেজনায় হরিসাধনের স্নায়ু বোধহয় বিকল হওয়ার মুখে এসে পৌঁছেছিল৷ তিনি হঠাৎ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে লখাইয়ের দেখানো পথ ধরে দৌড়তে শুরু করলেন৷ তাঁকে দেখে বাকিরাও৷ আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পিছু নিল সেই ছায়াশরীরীদের দল৷

রামনারায়ণ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়েছিলেন ডাকাতসর্দারের দিকে৷ এই কথা যে কেউ কোনওদিন তাঁর সামনে উচ্চারণ করতে পারে সে তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি কোনওদিন৷ ক্রোধে, কান্নায়, অপমানে, তাঁর মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল৷ তিনি অস্ফুটে বললেন, ‘কী বললে তুমি, আরেকবার বলো৷’

ডাকাতসর্দার বলল, ‘ঠিকই শুনেছ ঠাকুর৷ তবে চিন্তা কোরো না, তোমার মেয়েকে রাজরানী করে রাখব৷ আজ এই সাধনা সিদ্ধ হলে অতুল ঐশ্বর্যের অধিপতি হব আমি৷ আর তোমার মেয়ে হবে তার অধিশ্বরী৷ অবশ্য তোমাকেও একেবারে বঞ্চিত করব না৷ মেয়েকে আমার হাতে তুলে দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে একটা বড় অংশই তুমি পাবে…’

আর সহ্য হল না রামনারায়ণের, তিনি ‘শয়তানের বাচ্চা, এত বড় সাহস তোর’ বলে একটা হুঙ্কার ছেড়ে লাফিয়ে পড়লেন সর্দারের ঘাড়ে৷

জাটিয়া জাদু দেখতে পেলেন একটু দূরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মশালের আলো দেখা যাচ্ছে৷ তাঁরা দ্বিগুণ বেগে দৌড়তে লাগলেন৷

সর্দার এই আকস্মিক আক্রমণ আশা করেনি৷ বুকে একটা প্রবল ধাক্কা খেয়ে দূরে ছিটকে গেল সে, আর পড়ল গিয়ে শশিশেখরের ওপর৷ শশিশেখর একটা শবদেহের মতো গড়িয়ে পড়ে গেল৷

সর্দারকে আক্রান্ত হতে দেখে উঠে দাঁড়াল বাকি ডাকাতরা৷ তাঁদের পেশি ফুলে উঠেছে অজগরের মতো৷ দু’চোখে ঝিকিয়ে উঠেছে নরকের আগুন৷ তাদের প্রভুর গায়ে হাত তোলে এত সাহস ওই মানুষটার? ওর মাথা ছিঁড়ে নেবে এই অনুগত পিশাচের দল৷

ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল সর্দার৷ গায়ের ধুলো ঝাড়ল যত্ন করে৷ তারপর হিসহিসিয়ে বলল, ‘ভুল করলে ঠাকুর৷ বড় ভুল করলে৷ বিয়ে তো তুমি দেবেই৷ এবার তোমার সামনেই তোমার মেয়েতে আমি উপগত হব, আর সেটাও তোমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে৷’

বলতে বলতেই একটা নেউল দৌড়ে এসে উঠে পড়ল সর্দারের গায়ে৷ গা বেয়ে উঠে এল কাঁধে৷ তারপর সর্দারের কানে কানে কী যেন বলল৷ সর্দার পালটা কিছু আদেশ দিল তাকে৷ নেউলটা সর্দারের গা থেকে নেমে দ্রুত ছুটে গেল জঙ্গলের দিকে৷

সর্দার বিজাতীয় ভাষায় কী একটা উচ্চারণ করতেই বাকি ডাকাতদের নজর ঘুরে গেল জঙ্গলের দিকে৷ এক এক করে ডাকাতদের শরীরে কাঁপন ধরল৷ তারপর তাদের ঘিরে মাটি থেকে জেগে উঠল আঁধার ধুলোর চাদর৷ সেই চাদর ক্রমে ঢেকে ফেলল তাদের পিশাচশরীর৷ তারপর একদল অন্ধকারের পিণ্ড ধেয়ে গেল জঙ্গলের দিকে৷

সর্দার ধীরেধীরে বলিদানের খাঁড়াটা তুলে নিল নিজের হাতে৷ তার গায়ে পরম মমতার সঙ্গে হাত বুলিয়ে বলল, ‘এ খাঁড়া কোথাকার জানো ঠাকুর? মহাচীনদেশের৷ আমার গুরু দেবী দ্রৌলমার উপাসক ছিলেন৷ এই খড়্গ গুরুর আরাধ্য দেবী মন্ত্রপূত দ্রৌলমার খড়্গ৷ আমি এই খড়্গ চুরি করে নিয়ে এসেছিলাম শুধুমাত্র এই দিনটির জন্য৷ আজ মনে হয় মায়ের রক্তপিপাসা জেগেছে৷ জয় দেবী দ্রৌলমা৷ আজ তোমার খড়্গ নররক্তে স্নান করাব না৷’

রামনারায়ণ তখনও ফুঁসছিলেন৷ তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘আমিও মা কিরীটেশ্বরীর সেবক, সারাজীবন কায়মনোবাক্যে দেবীর সেবা করেছি৷ সারাজীবন সত্যকথা বলেছি, সত্যপথে থেকেছি, সত্য আচরণ করেছি, কোনওদিন কারও অনিষ্টচিন্তা করিনি৷ আয় শয়তান, দেখি আজ আমার বিপদে ব্রহ্মময়ী কার কথা শোনেন, তোর মতো এক ভণ্ড পিশাচ তান্ত্রিকের, নাকি এই অধম সন্তানের৷’

সর্দার হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে পড়তে গেল রামনারায়ণের ওপর৷ কিন্তু তার আগেই কে যেন টেনে ধরল তার পা৷ হুড়মুড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল সর্দার৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে সে যা দেখল তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না তার৷

উঠে বসেছে শশিশেখর৷ সর্দার ঘাড়ে পড়ার পর ভেষজ বিষের আবেশ কেটে গেছে তার৷ সে খানিক ব্যোমভোলা হয়ে চারিদিক চেয়ে রইল৷ মুহূর্তখানিক পর যেন আবিষ্ট হয়েই মশানের মাটি থেকে একমুঠো ধুলো কুড়িয়ে তর্জনী, মধ্যমা আর অনামিকা দিয়ে নিজের কপালে তিনটে সমান্তরাল দাগ টানল শশিশেখর৷ তারপর সামান্য টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে শান্তস্বরে বলল, ‘বুড়ো মানুষের ওপর জোর খাটাচ্ছ সর্দার? যদি সত্যিকারের পুরুষ মানুষ হও তো একবার আমার সঙ্গে লড়ো দেখি৷’

দৌড়তে দৌড়তে থেমে গেলেন ওঁরা৷ ওই সুঁড়িপথের শেষ৷ মশালের আলো এখন আরও উজ্জ্বল৷ আর একটু পথ গেলেই….

ঠিক তখনই তাঁদের সামনে যেন শূন্য থেকে ঘনিয়ে উঠল এক ছায়ামূর্তি৷ বিশাল তার আকার, জঙ্গলের সবচাইতে বড় গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে সে৷ আর সে ছায়া কোনও মানুষের অবয়ব নয়৷ জাটিয়া জাদু দেখামাত্র চিনলেন তাকে৷ এই সেই মায়ানেউল, যার কথা কৃষ্ণানন্দ বলেছিলেন তাঁকে৷ সে এবার এসেছে তাদের সংহার করতে৷

ধীরে ধীরে সেই ছায়াশরীরীদের দল ঘিরে ধরল ক্ষুদ্র দলটিকে৷ সঙ্গে যোগ দিল আরও কয়েকটি অন্ধকার অবয়ব৷ তাঁদের ঘিরে এখন পিশাচের দল৷ ধক ধক করে জ্বলছে তাদের চোখ৷ কটু পচা গন্ধে সবার নাসারন্ধ্র বন্ধ হয়ে এল প্রায়৷ আর সেই রক্তকণা শীতল করে দেওয়া অশরীরী শৈত্য৷

জাটিয়া জাদু বুঝলেন এই তাঁদের শেষ৷ যে তান্ত্রিক বন্ধন তিনি বেঁধে দিয়েছিলেন সবার হাতে, এই মায়ানেউল তাকে ছিন্ন করেছে৷ তাঁরা আর এই পিশাচদের কাছে অদৃশ্য নন!

কৃষ্ণানন্দ লক্ষ্য করলেন যজ্ঞের আগুন হঠাৎ করেই যেন নিভু নিভু হয়ে এল৷ অথচ কোথাও কোনও বাতাস নেই, কোনও বিক্ষেপ নেই৷ কিন্তু আগুন যেন জ্বলতেই চাইছে না৷ ওপরে তাকালেন কৃষ্ণানন্দ৷ একটা দুধের সরের মতো মিহি কালো ছায়া নেমে আসছে জমিদারবাড়ির ওপরে৷ হঠাৎ করেই যেন চারিদিকের তাপমাত্রা কমে গেল অনেকটা৷ কৃষ্ণানন্দ বুঝলেন তাঁর আসন ভিজে যাচ্ছে৷ মাটি থেকে উঠে আসছে কনকনে শীতল জল তাঁকে যজ্ঞ করতে দেবে না ওরা৷

মন্ত্রোচ্চারণ আরও জোরালো করলেন কৃষ্ণানন্দ৷ কিছু সমিধ অর্পণ করলেন যজ্ঞাগ্নিতে৷ উচৈচস্বরে আবৃত্তি করতে লাগলেন, ‘রক্তপ্রিয়াশ্চ রক্তাক্ষী রুধিরাস্যবিভূষিতা৷ বলপ্রিয়া বলরতা বলরাম প্রপূজিতা৷ অর্ধকেশেশ্বরী কেশা কেশবেশ বিভূষিতা…’ বলতে বলতে দুটি রাজগোখরোর করোটি আহুতি দিলেন চিতাযজ্ঞে৷

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ৷ সেই মিহি অন্ধকারের চাদর আরও নেমে এসেছে জমিদারবাড়ির ওপরে৷ মাটি এত শীতল যে কৃষ্ণানন্দের মনে হল যেন তুষারস্তূপের ওপর বসে আছেন তিনি৷ যজ্ঞের আগুন একবার ধক করে জ্বলে উঠেই ফের নিভে গেল৷

এবার ভয় পেলেন কৃষ্ণানন্দ৷ তাহলে কি ব্যর্থ হয়ে গেল তাঁর সাধনা? এতগুলো প্রাণ আর রক্ষা করতে পারলেন না তিনি? দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেললেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ৷

আর ঠিক তখনই তিনি শব্দটা শুনতে পেলেন৷ শব্দ, সাপের হিসহিসানি শব্দ৷ প্রথমে মৃদু, তারপর প্রবল৷ যেন দুটি প্রবল পরাক্রমশালী নাগরাজ ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন৷

মাথা তুলে চোখ বুজলেন কৃষ্ণানন্দ৷ এসেছেন, অবশেষে তিনি এসেছেন৷

স্নান করে শাড়ি পরছিল সর্বমঙ্গলা৷ তার হাত-পা চলছে যন্ত্রের মতো৷ কী ভাবছে আর কী দেখছে, কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে, সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে তার৷ এই পৃথিবী যেন তার চোখের সামনে একবার ঝিরিঝিরি করে আসছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে৷ এই তো অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে সেই কুঁড়েঘর৷ পরক্ষণেই তার সামনে সেই দিগন্তবিস্তৃত শ্মশান৷ এই তো সে স্নান করছে, আবার পরমুহূর্তেই সেই পাহাড়ের মতো বড় চিতাস্তূপ৷ কী করছে সে? স্নান করছে না চিতার ওপরে এক পা এক পা করে উঠছে? কোনটা স্বপ্ন, আর কোনটা সত্যি? স্নান করে পুরনো শাড়ি ছেড়ে ও কী পরছে এখন? শাড়ি? কই না তো! এ তো বাঘছাল৷ না না, এ তো শাড়ি ওই তো তার চারিদিকে বাঘার জঙ্গল৷ কুঁড়েঘরের ওদিকে সেই মূর্তি, হাড়িকাঠ৷ কিন্ত… কিন্তু… এ কী! আবার সব দৃশ্য বদলে গেল কী করে? এই তো সে উঠছে ওই বিশাল চিতার ওপরে৷ তার সাপ জড়ানো পায়ে পায়ে গড়িয়ে যাচ্ছে চিতাকাঠ আর নরঅস্থিমুণ্ড৷ প্রায় ওপরে উঠে এসেছে সে৷ তার চারিদিকে দাউদাউ করে জ্বলছে লেলিহান শ্মশানচিতার আগুন৷ তার মাথার মধ্যে ক্রোধ ক্রমে বাড়ছে৷ এক অজানিত, অকারণ, অবোধ্য নৃশংস ক্রোধ৷ সে উঠছে চিতার ওপরে, আর সেই চিতার ওপর শুয়ে আছে কেউ একজন৷ কে ও?

অজগরের সামনে যেন সম্মোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হরিণশিশু, ঠিক সেভাবেই মায়ানেউলের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁরা৷ চারিদিকে আরও ঘনিয়ে এসেছে ছায়াপিশাচের দল৷ তাদের বিশ্রী কটু গন্ধ আর মরণশৈত্যে হাত-পা অসাড় হয়ে এসেছে তাঁদের৷ মাথার মধ্যে সমস্ত বোধবুদ্ধি শূন্য৷ নিশ্চিত মরণের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েকটি অসহায় মানবশিশু৷

ঠিক সেই সময় চোখের কোণ দিয়ে জাটিয়া জাদু দেখলেন আকাশ থেকে একটা নীল রঙের আলো এসে পড়ল একটু দূরে৷ মাটি সামান্য কেঁপে উঠল কি?

তারপর সেখান থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াল এক অবয়ব৷ জাটিয়া জাদু অবাক হয়ে দেখলেন এক উঠে দাঁড়িয়েছে এক নারীমূর্তি৷ তার সমস্ত শরীর নীল৷ পরনে বাঘছাল, ডান হাতে একটি তরবারি আর বাম হাতে একটি খড়্গ৷ তার চুল উড়ছে আগুনের শিখার মতো৷ আর ধক ধক করে জ্বলছে দুটি চোখ৷

এক পা এগোল সেই নারী৷ আর সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কাঁপিয়ে কে যেন ফেটে পড়ল বিপুল অট্টহাস্যে৷ সেই শব্দ যেন বধির করে দিল জাটিয়া জাদু আর তাঁর সঙ্গীদের৷ তারপর সেই নীলবর্ণা নারী মহা হুঙ্কারে ধেয়ে এল ছায়াপিশাচের দলের দিকে৷

ঘুরে দাঁড়াল মায়ানেউল৷ শব্দটা সে একটু আগেই পেয়েছে৷ চিরশত্রুর এই হিসহিসানির শব্দ তার চেনা, বড় চেনা৷

মায়ানেউলের ঠিক সামনে মস্ত ফণা তুলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারই আকারের দুটি বিশাল রাজগোখরো৷

শাড়িটা পরে স্থির পায়ে এগোতে লাগল সর্বমঙ্গলা৷ ওই তো সেই মূর্তি৷ তার সামনে তিনটে লোক৷ একজনকে তার চেনা লাগল৷ আবার সেই দৃশ্য মিলিয়ে গেল তার চোখের সামনে৷ চিতার ওপরে উঠে এসেছে সে৷ যতদূর চোখ যায় শুধু আগুন আর আগুন৷ আর সর্বগ্রাসী হাহাকারের কান্না৷ তার মাথার ওপর কালনাগিনী জেগে আছে একটি জটার মতো৷ তার মাথার মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছে ক্রোধ, অবর্ণনীয়, অসহনীয় ক্রোধ৷ যেন তার এই উগ্র ক্রোধই চিতার আগুন হয়ে বিশ্বচরাচরকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে৷

আবার তার সামনে দৃশ্য পালটে গেল৷ দুটো মানুষ মারামারি করছে আর একজন বয়স্ক মানুষ তাদের সামনে বসে আছে হতবুদ্ধি হয়ে৷ কে ওরা? এত চেনা লাগে কেন?

শশিশেখরের শরীর থেকে ভেষজ বিষের প্রভাব এখনও যায়নি৷ কিন্তু হিংস্র রাগও অনেক সময় অসম্ভবকে সম্ভব করায়৷ সে ঝাঁপিয়ে পড়ল সর্দারের ওপর৷

সর্দার খুব সহজেই প্রতিহত করল তার আক্রমণ৷ তারপর সেও ঝাঁপিয়ে পড়ল শশিশেখরের ওপর৷

সেই দুরন্ত নীলঘূর্ণির আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগল ছায়াপিশাচের দল৷ জাটিয়া জাদু লখাইকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়লেন৷ বাকিরাও দেখাদেখি তাই করল৷ নীলবর্ণা সেই যোদ্ধৃনারীকে দেখে মনে হল যেন মহাপ্রলয় জেগে উঠেছে জঙ্গলের মধ্যে৷ জাটিয়া জাদু দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করতে লাগলেন, ‘খড়্গহস্তা মহাদেবী পাতু মাং বিজয়প্রদা৷ নীলাম্বরধরাদেবী পাতু মাং বিঘ্ননাশিনী…’

ছায়াপিশাচের দলকে ছিন্নবিধ্বস্ত করে স্থির হয়ে দাঁড়াল সেই নারীমূর্তি৷ তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এল জাটিয়া জাদুর দিকে৷ জাটিয়া জাদু হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসলেন৷ দুহাত বুকের কাছে৷ দুচোখে জল৷ ধরা গলায় মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন, ‘ভীমরূপা সদা পাতু শ্মশানে ভয়নাশিনী৷ ভূতপ্রেতালয়ে ঘোরে দুর্গে মাং ভীষণাবতু…’

নারীটি এসে লখাইয়ের মাথার কাছে দাঁড়ালেন একবার৷ তাঁকে আসতে দেখে লখাই উঠে বসেছিল৷ সে নারীমূর্তির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে শুধু একবার বলল, ‘মা?’

নীলবর্ণা নারীমূর্তিটি নীচু হয়ে লখাইয়ের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন৷ তারপর একটি নীল বিদ্যুৎশিখা জঙ্গল ফুঁড়ে ফের ফিরে গেল আকাশে৷

মায়ানেউলের গলা জড়িয়ে ধরেছে দুটি রাজগোখরো৷ জঙ্গলের মধ্যে, খোলা আকাশের নীচে ঘটে যাচ্ছে এক আশ্চর্য অলৌকিক লড়াই৷ নেউল যে কোনও সাপের আক্রমণ রোধ করতে পারে অতি সহজে৷ কেবল একটি মাত্র সাপ ছাড়া, সর্পকুলের রাজা, রাজগোখরো৷

ক্রমেই সেই মায়ানেউলের পরাক্রম স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল৷ তার শরীর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল জঙ্গলের বাতাসে৷

সর্দার অতি সহজেই মাটিতে ফেলে দিল শশিশেখরকে৷ তারপর খড়্গটা তুলে নিয়ে বলল, ‘আয়, তোকে বলি দিয়েই শুরু করি৷’

খড়্গ তুলে ধরতে গিয়ে থেমে গেল সর্দার৷ ও কে? কে হেঁটে আসছে তার দিকে? কে ওই মেয়ে?

সর্দারের দৃষ্টি বিভ্রম হতে লাগল৷ এ তো সেই মেয়ে নয় যাকে সে তুলে এনেছিল গাঁয়ের পুকুরপাড় থেকে৷ কে ও? অমন দৃপ্ত পদক্ষেপ কার? এ কী! দ্রৌলমা? দেবী দ্রৌলমা নেমে এসেছেন এই অরণ্যে? কিন্তু কী করে?

অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেল সর্দারের৷ সে বুঝল এ জন্মে আর সাধনা শেষ হল না তার৷ গুরুর কথাই ফলে গেল৷

সর্দার খড়্গহাতে মোহগ্রস্ত মানুষের মতো এগিয়ে যেতে লাগল সর্বমঙ্গলার দিকে৷

সর্বমঙ্গলা দেখল তার দিকে কে যেন এগিয়ে আসছে৷ তখন অসহনীয় রাগে ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ দাউদাউ করে জ্বলছে৷ পারলে এই মুহূর্তেই এই জগৎসংসার পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চায় সে৷ সে দেখল সেই লোকটা তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে কী একটা যেন দুহাতে তুলে ধরল৷

হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাতে দেবী দ্রৌলমার খড়্গ তুলে ধরল সর্দার৷ সর্বমঙ্গলা অতি অনায়াসে খড়্গটা তুলে নিল৷ তারপর বাঁ হাতে সর্দারের চুলের মুঠি ধরে কেটে ফেলল সর্দারের মাথাটা৷

এই ভয়াল অতিলৌকিক দৃশ্য দেখে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন রামনারায়ণ৷ অসম্ভব, এ অসম্ভব! এ কি তাঁরই মেয়ে? এমন অনায়াসে খড়্গের এক আঘাতে সর্দারের মাথা কেটে নেওয়ার মতো অলৌকিক শক্তি সে পেল কোথায়?

কিন্তু আর কিছু ভাবার সময় পেলেন না রামনারায়ণ৷ সভয়ে দেখলেন একহাতে রক্তস্নাত খড়্গ আর অন্য হাতে সর্দারের কাটামুণ্ড নিয়ে তাঁর মেয়ে এবার তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে৷

ক্রোধ কমেনি সর্বমঙ্গলার৷ চিতার ওপর কে একজন শুয়ে ছিল না? কই সে? তাকে খুঁজে বার করতেই হবে৷ ওই লোকটাকে তার চাই৷ সর্বমঙ্গলার সমস্ত অস্তিত্ব, সত্তা, চৈতন্য আগ্রাসী ক্ষুধার মতো চিৎকার করছে ওই লোকটার জন্য৷ চাই, চাই, চাই৷ কোথায় সে?

শশিশেখর দেখল সর্বমঙ্গলা খড়্গহাতে ধীর কিন্তু দৃপ্তপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রামনারায়ণের দিকে৷ রামনারায়ণ ঠকঠক করে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছেন৷ শশিশেখর দেখেছে একটু আগেই কী অনায়াসে খড়্গের এক আঘাতে সর্দারের মাথা কেটে নিয়েছে ওই একরত্তি মেয়ে৷ সে বুঝেছে এখন তাকে বলপ্রয়োগে আটকানো যাবে না৷ কিন্তু এখন তাকে না আটকালে সমূহ বিপদ৷ কী করবে সে?

অন্য কোনও উপায় মাথায় এল না শশিশেখরের৷ সে একেবারে সটান সর্বমঙ্গলার পায়ের কাছে গিয়ে শবের মতো শুয়ে পড়ল৷ পরক্ষণেই সর্বমঙ্গলা তার বাঁ পা’টা তুলে দিল শশিশেখরের বুকে৷ আর তুলেই স্থির হয়ে গেল৷

হঠাৎ করেই মনে হল পৃথিবীর ঘূর্ণন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ এই বাঘার জঙ্গল, এই গ্রাম, এই আকাশ, এই বিশ্বচরাচর, স্থাবর-জঙ্গম সব চিত্রার্পিতের মতো চেয়ে রইল দৃশ্যটির দিকে৷ যেন এই মরপৃথিবী এর থেকে পবিত্র, এর থেকে রোমাঞ্চকর আর কিছু দেখেনি৷

রামনারায়ণ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকালেন৷ তাঁর বুক ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে৷ মা গো, এত সৌভাগ্যও তাঁর কপালে লেখা ছিল? জগজ্জননী মা রাজরাজেশ্বরী স্বয়ং তাঁর কাছে কন্যারূপে ধরা দিলেন?

যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল সর্বমঙ্গলা৷ এ কী! তার হাতে খড়্গ কেন? নরমুণ্ড কেন? তার শরীর জুড়ে এত রক্ত কেন? এ কার বুকে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে?

সর্বমঙ্গলা পড়েই যেত, যদি না জঙ্গলের আড়াল থেকে জাটিয়া জাদু দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলতেন৷

* * *

প্রতাপনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই অসম্ভব সম্ভব হল কী করে মৈত্রমশাই?’

মৈত্রমশাই রাত্রিভর যজ্ঞশেষে স্নান করেছেন৷ কপালে ধারণ করেছেন যজ্ঞাগ্নির টিকা৷ ভারী শান্ত আর প্রসন্ন দেখাচ্ছিল তাঁকে৷

ভোর হওয়ার আগেই ফিরে এসেছিলেন ওঁরা৷ সঙ্গে অপহৃতদের দল আর চুরি যাওয়া সমস্ত সোনা৷ সর্দারের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছিল তার সমস্ত জাদুকৌশল৷ কৃষ্ণজম্ভলের সোনার মূর্তি ভেঙে গেছিল, সমস্ত সোনা ফিরে পেয়েছিল তাদের আগের রূপ৷

সেই সব সোনার গহনা, মোহর সব আলাদা করে রাখা আছে কাছারিবাড়িতে৷ আজ সবাইকে তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ প্রতাপনারায়ণের লোক বেরিয়ে পড়েছে গ্রামে গ্রামে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিতে৷

অচৈতন্য সর্বমঙ্গলাকে এনে তোলা হয়েছে জমিদারবাড়িতেই৷ স্বয়ং জমিদারগৃহিণী তার শুশ্রূষার ভার নিয়েছেন৷ ছুটে এসেছেন হরসুন্দরীও৷

কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘সর্দার একটি মস্ত ভুল করেছিল৷ সে তন্ত্রজ্ঞ ছিল, কিন্তু শাস্ত্রজ্ঞ ছিল না৷ তন্ত্র শুধু কর্মমার্গ নয়, জ্ঞানমার্গেরও পথ বটে৷

বৌদ্ধশাস্ত্রে বলে দেবী বজ্রতারা অসমা মর্যাদাবতী৷ তাঁকে মা ছাড়া অন্য কোনও দৃষ্টিতে দেখার স্বীকৃতি নেই৷ বৌদ্ধ পণ্ডিত তারনাথের পুঁথিতে আছে, জনৈকা ‘তারা’ নাম্নী রাজকন্যা কোনও বৌদ্ধ সাধককে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন৷ তবে নিজের নাম গোপন করে৷ কারণ রাজকন্যা জানতেন তাঁর নাম ‘তারা’ জানলে তাঁর স্বামী তাঁর কাছে থাকবেন না৷ তাঁর ভয়ই সত্যি হল৷ একদিন সেই সাধক রাজকন্যার আসল নাম জেনে ফেললেন এবং সংসার ত্যাগ করলেন৷ তারার মর্যাদা এতখানিই, তাঁর নামে পত্নীর নাম মানতে পারেননি সেই সাধক৷ যদি ভুলক্রমে দেবীর প্রতি কামচিত্ত উৎপন্ন হয় তো সর্বনাশ৷

সর্দার এই ভুলটিই করেছিল৷ সে দেবী বজ্রতারাকে কামদৃষ্টিতে দেখেছিল৷ তাই দেবী তারা মা সর্বমঙ্গলার মধ্যে আবির্ভূত হয়ে সর্দারের জীবনপাশ ছিন্ন করলেন৷’

রামনারায়ণ উদ্বিগ্ন হলেন, ‘তাহলে কি আমার মেয়ের বিয়ে হবে না মৈত্রমশাই?’

কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘অবশ্যই হবে ঠাকুরমশাই৷ মা তারা তাঁর কর্ম সমাধা করে নিজেকে সংবৃত করেছেন৷ আপনার মেয়ে ঈশ্বরকোটির জাতিকা, তাই মা আপনার মেয়েকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রকটিত হওয়ার জন্য৷ তবে আর ভয় নেই, মা নিজের লীলা সংবরণ করেছেন৷ আপনার মেয়ের এখন সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে আর বাধা নেই৷’

হরিসাধন বন্দ্যঘটী তাঁর আনা সমস্ত সোনা প্রতাপনারায়ণের হাতে সমর্পণ করেছেন৷ এই অভিশপ্ত সোনা তাঁর চাই না৷ নিজের ছেলেকে ফিরে পেয়ে তিনি আনন্দে আত্মহারা৷ তিনি হাতজোড় করে রামনারায়ণকে বললেন, ‘মিশ্রমশাই, আপনার মেয়ের সঙ্গে শশিশেখরের বিয়ের কথা হতে হতেও হয়নি, সে আমারই দোষ৷ অর্থের লোভে আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম৷ মা কাল রাতে আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছেন৷ অনুমতি দিন, মা লক্ষ্মীকে আমি ঘরে নিয়ে যাই৷’

প্রতাপনারায়ণ সহাস্যে বললেন, ‘সে তো বটেই৷ তবে অত সহজে কি আর মা’কে ঘরে নিয়ে যাওয়া যায় বন্দ্যঘটীমশাই৷ আমার কন্যাসন্তান নেই৷ থাকলে তার বিয়েতে যা ধুমধাম হত, মা সর্বমঙ্গলার বিয়েতে তার থেকে কম উৎসব হবে না৷ আর যৌতুকের কথাই যখন উল্লেখ করলেন, তখন বলি আমাকে দান করা আপনার সমস্ত সোনার গহনা আমি মা সর্বমঙ্গলাকে দিলাম তার স্ত্রীধন হিসেবে৷ এ যৌতুক পণ্ডিত রামনারায়ণ মিশ্র নয়, আমি, চণ্ডীপুরের জমিদার প্রতাপনারায়ণ চৌধুরী দিচ্ছি৷’

বারূণী নদীর শুকনো বুক ধরে হাঁটছিল দুটো শরীর৷ এক সন্ন্যাসী এবং আর এক শিশু৷ একদিকে বাঘার জঙ্গল, আরেকদিকে চণ্ডীপুর গ্রাম৷ সকালের শীতল বাতাস জুড়িয়ে দিচ্ছিল তাঁদের শরীর৷

লখাইয়ের আজ ভারী আনন্দ৷ সবাই তাকে ভালো ভালো কথা বলছে৷ তার কত প্রশংসা করছে৷ জমিদারমশাই স্বয়ং বলেছেন এবার থেকে লখাইয়ের খাওয়া-পরা সব কিছুর দায়িত্ব জমিদারবাড়ির৷

লখাই একটা ঢিল কুড়িয়ে দূরে ছুঁড়ে দিল৷ তারপর ডাকল, ‘সন্ন্যাসীঠাকুর৷’

‘বল লখাই৷’

‘একটা কথা বলব?’

‘একটা কেন, হাজারটা বল৷’

‘তুমি আমাকে তন্তর মন্তর শেখাবে৷’

‘কেন লখাই, কী করবি শিখে?’

‘তোমরা তো তন্তর মন্তর জাদু টোনা করে কত্ত বড় বড় কাজ করলে৷ আমি যদি খুব মন দিয়ে শিখি, তাহলে মা’কে ফিরিয়ে আনতে পারব না?’

জাটিয়া জাদু লখাইয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওরে পাগল, স্বয়ং মহামায়া তোর মায়ের রূপ ধরে তোকে আশীর্বাদ করে গেছেন৷ এ কী কম কথা বাপ আমার? আমরা এতদিন ধরে শত তন্ত্রমন্ত্র পূজাপাঠ করে যা পাইনি, তা তুই অনায়াসে পেয়েছিস বাপধন, স্বয়ং জগজ্জনীর অহৈতুকী ভালোবাসা৷ জেনে রাখিস লখাই, এই আমি বলে দিলাম৷ এত তন্ত্রমন্ত্র পূজাপাঠ এসব করে আমি একটা কথাই লিখেছি, একমাত্র ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় জাদু৷’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *