দ্বিতীয় পুরুষ

দ্বিতীয় পুরুষ

“আমার সমুদ্র ভাল লাগে না”।

অদিতি ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল।

তীর্থঙ্কর বলল “আগে বলতে পারতে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম”।

অদিতি তীর্থঙ্করের দিকে তাকিয়ে হাসল “আমি যে বিয়ে করব, আমার যে কোন দিন হানিমুন হবে, আমি সেটাই ঠিক করে ভাবি নি জানো তো। গোটা ব্যাপারটার জন্য আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না”।

তীর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল “চা খাবে?”

অদিতি বলল “কফি খেতে ইচ্ছা করছে, এখানে পাওয়া যাবে?”

তীর্থ চেয়ার থেকে উঠে বলল “আমি দেখছি”।

অদিতি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকল।

কয়েক মিনিট পরে তীর্থ হাতে দুটো কাপ নিয়ে এসে একটা কাপ অদিতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “এই নাও। পেলাম”।

অদিতি কাপটা নিয়ে কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল “আমি তোমাকে বড় বিড়ম্বনায় ফেলছি বল? বিয়ের পরও স্বামী স্ত্রী হয়ে থাকতে পারছি না আমরা। তুমি কি ডিভোর্স ফাইল করবে?”

তীর্থ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল “আমাদের বাড়িতে আসলে কোন দিন এসব হয় নি। বললেও অনেক ঝামেলা হতে পারে। যেভাবে আছো, খুব অসুবিধা না হলে এভাবে থাকো। তারপরে না হয় দেখা যাবে কোন দিন”।

অদিতি বলল “ডিভোর্স আমাদের বাড়ির দিকেও তেমন কারও হয় নি। তবে তোমার মনে হতেই পারে আমি ঠকিয়েছি”।

তীর্থ হেসে বলল “নাহ। ঠকানোর কিছু নেই। সম্পর্ক এরকম হয় তো। বিষহীন। আচ্ছা, একটা শব্দ মনে পড়ল, অসমুদ্র। কেমন শব্দটা?”

অদিতি অবাক হয়ে বলল “আসমুদ্র?”

তীর্থ বলল “না, অসমুদ্র। মানে হল সমুদ্রের মত নয়। ঢেউহীন, নিস্তরঙ্গ”।

অদিতি বলল “ভাল শব্দ তো। এটা তুমি আমাদের রিলেশনকে ডিফাইন করতে ব্যবহার করতে চাও তাই তো?”

তীর্থ বলল “হ্যাঁ। শারীরিক সম্পর্কহীন অথচ আপোষে থাকা একটা জীবন। কেউ কারও পথে আসবে না। মন্দ কি?”

অদিতি বলল “মন্দ না। আচ্ছা তোমার হঠাৎ করে আমায় পছন্দ হয়েছিল কেন? আমি তো সাজিই নি বলতে গেলে”।

তীর্থ বলল “সাজো নি বলেই হয়ত। চিরকাল তো বিয়ে করব না ঠিক করেই চলছিলাম। বাড়ি থেকে এমন চাপ দিতে শুরু করেছিল, তিতিবিরক্ত হয়ে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথম সম্বন্ধটাতেই তোমাকে দেখা। মেক আপ হীন ঠান্ডা মুখ চোখ। আবার বলেও দিলে আমাকে কোন দিন ভালবাসতে পারবে না। কেন জানি না, এসবই টানল। অতি ভালবাসাও কখনও বিরক্তির কারণ হয়ে যায়। আমি তোমার মত কাউকেই চেয়েছিলাম হয়ত যে ভাল বাসবে না। লোকেও জানবে এরা বিবাহিত”।

অদিতি বলল “তোমার ভালবাসার প্রতি আসক্তি নেই বা বিরক্তি কেন এত? কেউ ছিল নাকি?”

তীর্থ বলল “না। কেউ ছিল না। আমি একজন অত্যন্ত সেলফ সেন্টারড সেলফিস প্রকৃতির মানুষ। নিজেকে ভালবাসি। আমার পক্ষে দ্বিতীয় কাউকে ভালবাসা সম্ভব না সেটা বুঝি”।

অদিতি বলল “তাহলে কফিটা আনতে গিয়ে নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছো?”

তীর্থ হাসল, “না। বরং খানিকটা হাঁফ ছেড়েছি। মাঝে মাঝে তোমাকে বড্ড দূরের কেউ বলে মনে হয় আমার। প্রেমে এত ব্যথা মনে হয় দেবদাসও পায় নি”।

অদিতি গম্ভীর হয়ে গেল “মজা করছ?”

তীর্থ বলল “না। মজা করব এত ধৃষ্টতা আমার নেই। তোমাকে আমি সম্মান করি। তুমি তো কিছু লুকিয়ে বিয়েটা কর নি। সাগ্নিক তোমাকে ডিচ করেছিল, তারপর থেকে তুমি কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারবে না, দ্যাটস কুল। আমিও তোমাকে বিয়ে করব কিন্তু ভালবাসতে পারব না এটাও তো ঠিক”।

এক পরিবার তাদের পাশের চেয়ারগুলো দখল করে হৈ হৈ শুরু করল।

অদিতি বলল “হোটেলে চল”।

তীর্থ উঠল “চল। তোমাকে দিয়ে এসে আমি আবার এসে বসব। আমার ভাল লাগছে সমুদ্রের তীরের হাওয়াটা”।

অদিতি বলল “তাহলে তুমি বস। আমি চলে যেতে পারব”।

তীর্থ বলল “নাহ। বীচের এই দিকটা ঠিক সুবিধের না। তুমি এগোও না। আমি একটু দেখেই ফিরে আসব”।

অদিতি একটু ভেবে নিয়ে বলল “বেশ। আচ্ছা, এটা কি বিরক্তি থেকে করবে?”

তীর্থ বলল “না, খুব সেলফিস মানুষেরও কিছু রেসপন্সিবিলিটি থাকে। এটা সেরকম কিছুই ভেবে নাও”।

অদিতি বলল “আচ্ছা”।

দুজনে হাঁটতে শুরু করল।

সন্ধ্যে বেলা। পুরীর সমুদ্রতটের এই অঞ্চলটায় খুব বেশি লোক বসতি নেই। হোটেল থাকলেও মানুষ কম। সিজন না এখন।

তীর্থ বলল “সাগ্নিক ছেলেটাকে আমার বড্ড দেখার ইচ্ছা জানো! একটা ছেলে গোটা পুরুষ সমাজের প্রতি তোমার বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলল, ভারি ইন্টারেস্টিং কিন্তু”।

অদিতি বলল “দয়া করে সেই চ্যাপ্টারটা আমাকে মনে না করালে খুশি হব”।

তীর্থ জিভ কাটল “আন্তরিকভাবে দুঃখিত”।

অদিতি বলল “হানিমুন না কী যেন বলে, এসব আর যাই হোক, বাড়ির ভিড়টা থেকে পালাতে সাহায্য করে। তোমার বাড়ির লোকজন ভারি ইয়ে। বিশেষ করে তোমার বউদিরা। আমাকে কেবল জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে ফুলশয্যায় সব ঠিক ছিল তো? মানুষের মাথা এত সেক্স ওরিয়েন্টেড হবে কেন? সেক্স ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন জিনিস নেই বুঝি?”

তীর্থ বলল “এরা অনেক ভাল। আমার এক বন্ধুর মা কাকীমারা বিছানার চাদর চেক করেছিল”।

অদিতি মুখ বিকৃত করে বলল “সিক পিপল এভ্রিহোয়ার”।

তীর্থ বলল “সিক নাকি জানি না, তবে এসব কৌতূহল খুব অস্বাভাবিক বলে আমার মনে হয় না। মানুষের বরাবরই অপরজনের বেডরুমের কাহিনি জানার আগ্রহটা বেশি”।

অদিতি বলল “কই, আমার তো সে আগ্রহ নেই”!

তীর্থ বলল “ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই থাকে। আমারও আগ্রহ জিনিসটা কম, নইলে অনেক আগেই জিজ্ঞেস করতে পারতাম তোমার সঙ্গে সাগ্নিকের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কিনা”।

অদিতি হাঁটছিল। থেমে গিয়ে বলল “এটা তোমার মনের মধ্যে ছিল। বেশ তো, জানতে চাইছো যখন জেনে নাও। ছিল। বেশ ভাল মতই ছিল”।

তীর্থ বলল “বেশ তো। মিটে গেল। একবারেই যে কৌতূহল ছিল না, তা নয়”।

অদিতি বলল “তো ডোন্ট অ্যাক্ট স্মার্ট না! কৌতূহল সবার থাকে”।

তীর্থ অপরাধীর মত মুখ করে চুপ করে গেল।

অদিতি খানিকটা বিরক্ত হয়েই এগিয়ে গেল।

তীর্থ দাঁড়িয়ে পড়ল।

অদিতিকে হোটেলের ভিতর যেতে দেখে ঘুরে গিয়ে বীচের দিকে রওনা দিল।

রাত ন’টা নাগাদ ফিরল তীর্থ।

অদিতি টিভি দেখছিল। রুমের বেল বাজতে দরজা খুলে বলল “আমি ভেবেছিলাম ডিনার এসেছে। বড় দেরী করছে ডিনার দিতে”।

তীর্থ বলল “সাড়ে ন’টায় দেবে বলল রিসেপশনে। আমি কি বলে দেব এখনই দিয়ে দিতে? তোমার খিদে পেয়েছে?”

অদিতি বলল “নাহ। দিক তখনই। তুমি এতক্ষণ কি সি বীচেই বসে ছিলে?”

তীর্থ বলল “হ্যাঁ। কোথায় আর যাব? একবার ভাবলাম বটে খাজা খেতে স্বর্গোদ্বারের দিকে যাব, শেষমেশ আর গেলাম না। অমলেট খেলাম একটা। ঠিক পরিষ্কারও না দোকানটা। কেমন বালি বালি। তবু গরম অমলেট ভালই লাগল”।

অদিতি টিভির দিকে তাকিয়ে বলল “ও, তুমি খেয়ে এসেছো! এদিকে আমি একবার পকোড়া খাব বলেও খেলাম না”।

তীর্থ অপরাধীর মত মুখ করে বলল “সেটা আগে বলতে পারতে যে খাবে”।

অদিতি বলল “ঠিক আছে। চিন্তা কোর না। তুমি পা ধুয়ে নাও। ঘরময় বালি কিচকিচ করে। এই জন্য সমুদ্র আরও ভাল লাগে না আমার। একটা টাওয়াল পাপোষ হিসেবে ইউজ করতে হবে। তাহলে অতটা সমস্যা হবে না”।

তীর্থ বলল “হ্যাঁ, আমি পা ধুয়ে নি”।

বাথরুমে ঢুকল তীর্থ। অদিতি মিউজিক চ্যানেল দিল।

বলিউডি গান হচ্ছে।

কয়েক মিনিট পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে তীর্থ সোফায় বসল।

অদিতি বলল “ডিনারে চিকেন বলা ছিল না? তার সঙ্গে একটা অমলেট বলে দিও”।

তীর্থ বলল “ঠিক আছে”।

রিসেপশনে ফোন করে তীর্থ অমলেট বলে দিয়ে বলল তাড়াতাড়ি তাদের ডিনার দিয়ে দিতে।

সে ফোন রাখতে অদিতি টিভিটা মিউট করে বলল “তোমার হঠাৎ সাগ্নিকের সঙ্গে আমার ফিজিকাল রিলেশন নিয়ে জানতে ইচ্ছে হল কেন?”

তীর্থ বলল “আমি তো তোমাকে সরি বলেছি। আমি কোন কিছু ভেবে প্রশ্নটা করি নি। এমনি বলে ফেলেছি”।

অদিতি তীর্থর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল “একটা মানুষ সম্পর্কে থাকাকালীন ফিজিকাল রিলেশনশিপে যেতেই পারে। সেটা তাদের মিউচুয়াল ডিসিশনে হয়। এখানে কারও কিছু বলার থাকে না। আমি সাগ্নিকের সঙ্গে বিয়ে করবই ভেবে সব কিছু করি নি। তবু ও আমাকে ছেড়ে যাওয়ায় আমার খারাপ লেগেছে। ক্লিয়ার করতে পারলাম কিছুটা?”

তীর্থ থতমত হয়ে বলল “আচ্ছা, থাক না। এসব বিষয়…”

অদিতি বলল “আমার তোমাকে সব বলার দায় নেই যদিও। তবু বলে দিলাম। শরীর নিয়ে আমার অপরাধবোধ নেই। ভুল মানুষকে ভালবেসেছিলাম বলে আছে। আমি আর কাউকে ভাল বাসতে পারব না। এসব ব্যাপারে আমার মেন্টাল রিজিডিটি আছে খানিকটা”।

তীর্থ বলল “তুমি যে বলছ আর কাউকে ভালবাসতে পারবে না, এটার একটা মানে দাঁড়ায়, সেটা হল সাগ্নিককে তুমি এখনও ভালবাসো”।

অদিতির চোয়াল শক্ত হল “না। সাগ্নিককে আমি ভালবাসি না এখন। ভালবাসা শব্দটাই আমার কাছে একটা তিক্ত শব্দ হয়ে গেছে। এই লেবুটা আমি আর কচলাতে চাই না”।

তীর্থ হেসে বলল “ভাল ব্যাপার। ভালবাসা জিনিসটা আমিও বিশ্বাস করি না। হস্টেলে থাকাকালীন দেখেছি ছেলেপুলে রাত জেগে ফোন করে যেত। একদিন মন দিয়ে শুনতে গেছিলাম তারা কী কথা বলে। কী এমন কথা যার জন্য কেউ রাতের ঘুম অবধি বিসর্জন দিয়ে দেয়। শুনতে গিয়ে দেখা গেল এ প্রান্তের ছেলেটা রাত আড়াইটার সময় গ্যাদা পাতা কেন কাটা জায়গায় দিতে হয়, তা নিয়ে ভাষণ দিচ্ছে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম সিরিয়াসলি? রাত আড়াইটায় গ্যাদা পাতা? এই যে তুমি আমায় জানিয়ে দিয়েছো তুমি আমায় কোন দিন ভালবাসতে পারবে না, এই ব্যাপারটায় আমি বেশ খুশি হয়েছি। নইলে রাত আড়াইটায় জেগে থেকে যদি কোন দিন তোমার সঙ্গে এইসব আলোচনা করতে হত ভালবাসা প্রকাশ করার জন্য, ব্যাপারটা আমার পক্ষে মোটেই সুখকর হত না”।

অদিতি বলল “সবাই গ্যাদা পাতা নিয়ে আলোচনা নাও করতে পারে। ইন ফ্যাক্ট আমি করি নি কোন দিন”।

তীর্থ বলল “কী নিয়ে করতে?”

অদিতি বলল “সাহিত্য নিয়ে। গান নিয়ে। সিনেমা নিয়েও করেছি। সাগ্নিকের পড়াশুনা ভাল। অনেক কিছু জানে। ওর সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলতে ভাল লাগত”।

তীর্থ বলল “এই ব্যাপারে আমি তোমাকে হতাশ করতাম। প্রথাগত পড়াশুনার বাইরে তেমন কিছু পড়ি নি। অবশ্য বাইরের বই একবারে পড়ি নি তাও না। ট্রেনে চাপলে যেমন আমি মেন্ডেটারি হাঁদা ভোদা কিনি। একটা কমিক্স মনে পড়ল, হাঁদা একটা ছিপি বন্দুক আর পিসেমশাই একটা এয়ারগান নিয়ে পাখি শিকারে গেছে। পিসেমশাই এয়ারগান দিয়ে পাখির দিকে গুলি ছোড়ার আগেই হাঁদার ছিপি বন্দুক থেকে বেরনো ছিপি পিসেমশাইয়ের টাকে গিয়ে লাগল। সেটা দেখে টানা দশ মিনিট আমি ট্রেনের মধ্যে হেসেছিলাম। লোক জন আমায় পাগল ভেবেছিল”।

অদিতি বলল “অথবা ভেবেছিল তোমার এখনও অ্যাডোলেসেন্স কাটে নি”।

তীর্থ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল “তা হবে। আমি সাগ্নিকের মত অতটা চৌখশ নই। উল্টোটাই বলতে পারো। এমনকি আমায় চীপ বললেও আমি সেটা খুব একটা অস্বীকার করব না। মিসোজিনিস্ট জোক্সে আমি হাসি। বিলো দ্য বেল্ট ডার্ক জোকসেও। আমার মধ্যে সেনসিটিভ ব্যাপারটাও কম আছে। আমি তো তোমাকে বলেইছি আমি সেলফিস”।

অদিতি বলল “সেটা তোমার অমলেট খাওয়া দেখেই আমি বুঝেছি”।

তীর্থ বলল “তা ঠিক”।

কলিং বেল বেজে উঠল। তীর্থ উঠে বলল “ডিনার এসে গেছে। দরজা খুলি”।

তীর্থ উঠে দরজা খুলল। হোটেলের বয় ডিনার রেখে চলে গেল। রুটি মাংস, একটা অমলেট।

অদিতি তীর্থ খাবার ভাগ করে দিল। অদিতি নিজের প্লেট নিয়ে খেতে খেতে বলল “তুমি চাইলে আমার থেকে অমলেট নিতে পারো”।

তীর্থ বলল “না না, দরকার নেই”।

অদিতি বলল “নেব বললে যেন কত দিতাম!”

তীর্থ বলল “তুমি কি আমার অমলেট খাওয়া নিয়ে ভীষণ রেগে আছো?”

অদিতি বলল “তা আছি। তবে রাগারাগি তো রিয়েল রিলেশনশিপে হয়। আমার জীবনে সেটা আর হবে না বলে আমি ঠিক করে নিয়েছি। তাই আর রাগারাগি করা বোধ হয় ঠিক হবে না। তাই না?”

তীর্থ রুটিতে মাংসের ঝোল মাখিয়ে খেতে খেতে বলল “তা হবে। আমার আবার আবেগ জিনিসটাই নেই। তুমি ভালবাসলেও আমি বুঝতে পারব না”।

অদিতি বলল “কিউট হানিমুন তাই না?”

তীর্থ হেসে বলল “ঢপের হানিমুন। এটাই ভাল। আমাদের দুজনের জন্যই”।

“কোথাও একটা পড়েছিলাম যে সম্পর্কে তুমুক ঝগড়া হয় না, সে দাম্পত্য নাকি টেকেই না”।

খাওয়া হয়ে গেছে। ব্যালকনিতে চেয়ার নিয়ে বসেছে দুজন। তীর্থ কথাটা বলে অদিতির দিকে তাকাল।

অদিতি বলল “কথাটা ভুল কিছু না। আবার যে রিলেশনে এক পক্ষকে অতিরিক্ত কম্প্রোমাইজ করতে হয়, সে সম্পর্কও বেশিদিন টেকে না। বেশিরভাগ মেয়েকেই বিয়ের পরে গান, নাচ, জিন্স পরা সব ছেড়ে দিতে হয় শ্বশুরবাড়ির চাপে পড়ে। ছেলেপক্ষ ভেবে নেয় ভারি জিতলাম। মেয়ে কিন্তু ভোলে না। ধীরে ধীরে সংসারে তার হাত শক্ত হলেই তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করে অন্যভাবে। বরকে বলে নেশা কোর না, এ কোর না, সে কোর না। দিন সবার আসে। কখনও আগে আসে, কখনও পরে”।

তীর্থ বলল “সম্পর্ক নিয়ে তোমার বেশ ভাল জ্ঞান আছে দেখছি। ইম্প্রেসিভ”।

অদিতি বলল “বেশিরভাগ মেয়েরাই এসব ব্যাপারে ছেলেদের থেকে বেশি জানে। অথবা ছেলেরা মেয়েদের এইসব ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় নি বলেই কম জানে হয়ত। তুমি যেমন সম্পর্ক জিনিসটাই চাও নি কোন দিন সেভাবে। বাড়ির চাপে পড়ে আমার সঙ্গে একটা খেলা খেলা টাইপ বিয়ে করেছো। গোটা ব্যাপারটাই ক্যালকুলেটিভ। বেশিরভাগ পুরুষই তাই। নিজের কাজ মিটে গেলে আর কোন কিছু নিয়ে তাদের আগ্রহ থাকে না”।

তীর্থ বলল “আমার মনে হয় তুমি লেসবিয়ান হয়ে যাবে দুদিন পরে। এত পুরুষ বিদ্বেষ আর সরলীকরণ বিরক্তিকর লাগছে”।

অদিতি বলল “হুহ। সে নিজেদের সম্পর্কে সত্যিটা শুনলে হবেই এরকম”।

তীর্থ খানিকটা তেরিয়া হয়ে বলল “মেয়েরাও কত ভাল আমার জানা আছে। ইউনিভার্সিটিতে যেন আমি দেখি নি প্রফেসরকে একটু ঠেকিয়ে কত মেয়ে কত কিছু হাসিল করে নিচ্ছে!”

অদিতি বলল “তা ঐ প্রফেসরও তো পুরুষ! নিজের চরিত্র ঠিক রাখল না কেন?”

তীর্থ বলল “মেয়েগুলোই বা ওরকম যাবে কেন? কোন পক্ষই ধোয়া তুলসীপাতা না বুঝলে? তোমার আর সাগ্নিকের মধ্যে ঝামেলা না? দেখা যাবে তোমারও দোষ ছিল। নিশ্চয়ই ন্যাগিং গার্লফ্রেন্ড ছিলে। পজেসিভও হতে পারো। সন্দেহবাতিক হতে পারো। কে দেখতে যাচ্ছে?”

অদিতি বলল “ন্যাগিং? আমি? ওসব আমার মধ্যে নেই। আর জীবনে ওর মোবাইল ছুইও নি। বুঝলে?”

তীর্থ বলল “কেন ছুঁতে হবে? মোবাইল ছুঁতে হবে কেন? প্রতিটা মানুষের প্রাইভেসী আছে”।

অদিতি বলল “না তুমি বললে না সন্দেহবাতিকের কথা। তাই বললাম। আমার ওসব নেই। একেবারেই ছিল না। বরং এখন মনে হয় খানিকটা সন্দেহবাতিক প্রতিটা মহিলার হওয়া উচিত। বরের মোবাইলও ঘাঁটা উচিত নিয়ম করে। পুরুষ মাত্রেই বহুগামী!”

তীর্থ বলল “ওই যে, ঘুরে ফিরে বন্দেমাতরম। তোমার সব কথার শেষে একটা কানাগলি চলে আসে। পুরুষ বিদ্বেষ। দেখো অদিতি, হতে পারে সাগ্নিক তোমাকে ডিচ করেছে, কিন্তু এরকম অন্ধ হয়ে থাকাটা কোন কাজের কথা না। নিজের মধ্যে থেকে বেরিয়ে বরং চেষ্টা কর সবার পজিটিভ জিনিসটা দেখতে”।

অদিতি বলল “কীভাবে দেখব কারও পজিটিভ জিনিস?”

তীর্থ বলল “কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে। তোমার জন্য বরং একটা ছেলে দেখি চল। ভাল দেখে একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম কর। তারপর পালিয়ে যাও। বেশ একটা থ্রিলিং ব্যাপার হবে”।

অদিতি একটা হাই তুলে বলল “তুমি একটা জিনিস জানো?”

তীর্থ বলল “কী?”

অদিতি বলল “তুমি মানসিক ভারসাম্যহীন?”

তীর্থ বলল “মানে?”

অদিতি বলল “মানে তুমি কী বলছ, কাকে বলছ, সে সম্পর্কে তোমার নিজেরই কোন ধারণা নেই। আচ্ছা, তুমি জীবনেও কন্ডোম কিনেছো?”

তীর্থ অবাক হল “মানে? কেন কন্ডোম কিনতে যাব?”

অদিতি বলল “এই তো। ভাল ছেলে থেকে গেছো সারা জীবন। মাস্টারবেটও কর না বোধ হয় তাই না? নিশ্চয়ই নাইট ফলস হয়ে যায়?”

তীর্থ এবার রাগল “এসব কী কথা? কেন মাস্টারবেট করব না? ওটা না করলে তোমার সঙ্গে এক ঘরে থাকি কী করে?”

অদিতি বলল “আচ্ছা? আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাবার পর বা এক বিছানায় থাকার পর তোমাকে মাস্টারবেট করতে হয় বুঝি?”

তীর্থ বলল “কেন করতে হবে না? আমি স্বাভাবিক পুরুষ মানুষ। আমার সমস্ত অনুভূতিই ন্যাচারাল”।

অদিতি বলল “ওকে। এবার তুমি পরস্পরবিরোধী কথা বলছ। একবার বলেছ তুমি সম্পর্কে জড়াতে চাইছ না, আবার আমাকে দেখে তোমাকে মাস্টারবেটও করতে হচ্ছে”।

তীর্থ বলল “মাস্টারবেটটা তো শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। আমাকে করতেই হবে। এটা করলে আমার মনে হয় বেশিরভাগ পুরুষের চরিত্রই ভাল থাকত। আমার তো মনে হয় প্রতিটা পুরুষকে স্কুলে মাস্টারবেট করা শেখানো উচিত ঠিক করে যাতে দেশে রেপ কমে যায়”।

অদিতি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল “নট এ ব্যাড আইডিয়া, আই মাস্ট সে। চল দেখি, এক প্যাকেট কন্ডোম কিনবে। দেখি কীভাবে কেনো। চল। ওই তো সামনেই ওষুধের দোকান আছে। কিনবে চল”।

তীর্থ বলল “বেশ তো কিনবো। কিনে কী করব? বেলুন ফুলাবো? তোমার সঙ্গে তো কিছু হবে না আমার। আমাদের বিয়ের চুক্তিতে ফিজিকাল রিলেশনশিপ নেই। তাহলে খামোখা কিনতে যাব কেন?”

অদিতি বলল “কারণ কন্ডোম, ন্যাপকিন, কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল এসব হল একজন পুরুষের বড় হবার প্রাথমিক ধাপ। তুমি আজ কন্ডোম দিয়ে শুরু কর”।

তীর্থ বলল “পারলাম না। এবং দয়া করে আমাকে ইন্সট্রাকশন দেওয়া বন্ধ কর। আমাকে কেউ ইন্সট্রাকশন দিক এটা আমি পছন্দ করি না। এজন্যই আমি বিয়ে করতে চাইতাম না”।

অদিতি বলল “ওহ। ভয় পেলে?”

তীর্থ রেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল “ভয় পাবার কী আছে? ওয়েট কর আমি এখনই কিনে আনছি”।

ঝড়ের গতিতে তীর্থ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

কিছুক্ষণ পর এক প্যাকেট কন্ডোম নিয়ে এসে অদিতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “নাও, কী করবে কর”।

অদিতি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মোবাইলের আলো প্যাকেটের ওপর ফেলে বলল “চকোলেট ফ্লেবার এনেছো দেখছি। আচ্ছা বল তো কন্ডোমে ফ্লেবার কী কাজে লাগে?”

তীর্থ বলল “আমি কী করে জানব?”

অদিতি বলল “আমার বিয়ার খেতে ইচ্ছা করছে। দোকান খোলা আছে? আমি দেখব?”

তীর্থ বলল “বন্ধ হয়ে গেছে মনে হয়”।

অদিতি বলল “দেখে আসি”।

তীর্থ বলল “তোমাকে যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি। পুরুষ হয়েছি। কী করে একজন মেয়েকে একা ছাড়ব?”

অদিতি বলল “বাবা! কত পুরুষ এলেন আমার! একা একা অমলেট খায় হানিমুনে এসে। হাহ!”

তীর্থ বলল “হানিমুন কোথায়? সব তো সাজানো ঘটনা”!

অদিতি বলল “তা বটে। ঠিক আছে, তোমাকে একা যেতে হবে না, আমিও যাব চল”।

তীর্থ বলল “কন্ডোমের প্যাকেটটা কী করব?”

অদিতি বলল “বেলুন ফুলাও। বললে তো!”

তীর্থ ব্যালকনি থেকে বাইরের দিকে প্যাকেটটা ফেলে দিল।

অদিতি হা হা করে বলল “ফেলে দিলে কেন? টাকা দিয়ে কেনো নি? কাউকে দিয়ে দিতে?”

তীর্থ বলল “কাকে দেবো? আর দিতে যাবই বা কেন? আজব!”

অদিতি ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল “আচ্ছা চল। বিয়ার কিনে আনা যাক”।

“তোমার আমার কেসটা বেশ ইন্টারেস্টিং কিন্তু। একটা সেলফ সেন্টারড কেরিয়ার ওরিয়েন্টেড ছেলে, আর একটা প্রেমে দাগা খাওয়া সম্পর্কে অবিশ্বাসী মেয়ে”।

বিয়ারের বোতলে চুমুক দিয়ে বলল অদিতি।

তীর্থ টিভি দেখছিল। সেদিকে তাকিয়েই বলল “বার বার আমার চরিত্রে হাত না দিলে চলছে না? আমি সেলফিস সেটা আমি জানি। বার বার বোল না তা বলে। আমারও ভাল লাগে না”।

অদিতি বলল “হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক আছে। বিয়ার পেটে পড়লে আমার একটু ভাট বকা অভ্যাস হয়। তুমি খাচ্ছ না কেন?”

তীর্থ বলল “ও আমি খাব না, খেলেই বমি হয়”।

অদিতি বলল “ছ্যা ছ্যা ছ্যা। লজ্জা। সামান্য বিয়ার নিতে পারো না?”

তীর্থ বলল “না, নিতে পারি না। কী করব?”

অদিতি বলল “তুমি না ভীষণ লালু ভুলু ভাবে মানুষ হয়েছো। এই জন্য এরকম হয়ে গেছো”।

তীর্থ বলল “কী করব?ছোট থেকেই বাবা মা চাকরিতে বেরিয়ে যেত। একা একা মানুষ। প্রথম প্রথম অসহ্য লাগত, তারপর দেখলাম উল্টো ব্যাপার। মানুষ সহ্য হয় না। একা থাকতেই ভাল লাগে। কখনও আমার কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। তোমাকে আগে থেকেই বলে রাখলাম”।

অদিতি কাঁধ ঝাঁকাল “বোল না কথা। আমিও তখন ফেসবুকে ছেলেবাজি করব”।

তীর্থ বলল “ঠিক আছে”।

অদিতি বলল “তোমার হিংসা হবে না?”

তীর্থ বলল “কেন হিংসা হতে যাবে? তোমার লাইফ, তুমি যা খুশি করবে। শুধু অন্য কোন জায়গা থেকে পেট বাধিয়ে চলে এসো না। কাক হতে পারব না আমি”।

অদিতি চোখ ছোট ছোট করে বলল “তুমি কত বড় ডিসরেসপেক্টফুল কথা বললে ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া এবাউট দ্যাট?”

তীর্থ বলল “ও, তাই নাকি? ডিসরেসপেক্টফুল কথা বললাম? আর তুমি সারাক্ষণ সেলফিস বলে যাচ্ছ তাতে কিছু হয় না বুঝি?”

অদিতি ঠোঁট দিয়ে চুক চুক করে শব্দ করে বলল “লেগেছে না? আচ্ছা সরি আর বলব না। আমার কেন জানি না তোমার উপর যা তা রকমের রাগ হচ্ছে”।

তীর্থ বলল “কেন রাগ হচ্ছে?”

অদিতি বলল “জানি না। অমলেট খেয়েছো বলেই বোধ হয়। অ্যাকচুয়ালি ডিমটা আমার বড্ড কাছের জিনিস। সেটা না বলে খেলে রাগ তো হবেই। এমনিতে যদিও রাগ অভিমান রিয়েল রিলেশনশিপে হয় তবু তোমার ওপর আমার রাগ হচ্ছে”।

তীর্থ গম্ভীর গলায় বলল “ঠিক আছে, এর পর থেকে তোমাকে আগে অমলেট খাওয়াব, তারপর নিজে খাব। খুশি?”

অদিতি বলল “খুশি। তুমি লোক খারাপ নও। সেলফিস হওয়াও কিন্তু ভালই। তার থেকেও ভাল সেটা নিজে নোটিস করতে পারা। তুমি সেটা পারছো। ক’টা মানুষ নিজের উইক পয়েন্ট নোটিস করতে পারে?”

তীর্থ বলল “সেলফিস হওয়া উইক পয়েন্ট কেন হতে যাবে? নিজেকে ভালবাসা কখনও উইক পয়েন্ট হতে পারে না। ইনফ্যাক্ট প্রতিটা মানুষের নিজেকে ভালবাসা উচিত। নিজেকে ভালবাসলেই তো বাকি সবার খেয়াল রাখা যায়। আমি নিজে যদি সুস্থ না থাকি তাহলে আমার অসুস্থ বাবা মা কে দেখব কী করে? আমি সেলফিস। এবং তবু আমার বাবা মাকে ভালবাসি। তাদের মিস করি। এই যে ঘুরতে এসেছি, এর আগে যতবার এসেছি, ওদের নিয়েই এসেছি। আমি ওদের মিস করছি। সেলফিস বলেই নিজের বাবা মাকে ভালবাসা যাবে না, এমনও না”।

অদিতি অনেকটা বিয়ার এক চুমুকে গিলে বলল “ইন্টারেস্টিং সব কথা বলছ তুমি। এবং যুক্তিগুলো কোনটাই ফেলে দেওয়ার নয়। আমাদের রিলেশনটা স্বাভাবিক হলে বলতাম বাবা মা কে নিয়েই ঘুরতে যাব এর পর থেকে। কিন্তু সেটা বলা যাবে না। ওরা না না রকম প্রশ্ন করতে পারেন”।

তীর্থ বলল “হ্যাঁ, করতেই পারেন। তবে ওরা আমাকে চেনেন। আমার পার্সোনাল স্পেসে একবারেই আসবেন না এটা তোমাকে বলতে পারি”।

অদিতি খুশি হয়ে বলল “এটা ভাল। এরকম বাবা মা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার”।

তীর্থ বলল “হ্যাঁ ওরা আমাকে ঘাঁটাবেন না বলেছি। তোমাকে ঘাঁটাতেই পারেন। জিজ্ঞেসও করবেন নাতি পুতি কবে আসবে”।

অদিতি চোখ বড় বড় করে বলল “কী সাংঘাতিক। আমাকে কেন?”

তীর্থ রিমোট দিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে বলল “কারণ আমাকে প্রশ্ন করার সাহস নেই কারও”।

অদিতি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল “আমি জানি না। আমি কিছু বলতে পারব না। এরকম চাপ দাও কেন?”

তীর্থ বলল “চাপ দিচ্ছি না। কী কী সিচুয়েশন হতে পারে সেটা আগে থেকে বলে রাখছি। তোমার বাড়ির থেকেও বিয়ে করার চাপ ছিল, আমার বাড়ি থেকেও ছিল। দু পক্ষ একটা মিউচুয়াল এগ্রিমেন্টে বিয়ে করেছি। কিন্তু বাড়ির লোককে কীভাবে সামলাতে হবে সেটা তো কেউই জানি না। তোমার বাড়িতেও তোমার বোনেরা বিয়ের দিন বেশ ভাল মতই জামাই ঠকিয়েছে। আমাকে অনেক জ্বালাতন করেছে, সেই নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই, কারণ আমি জানতাম এসব পার্ট অফ দ্য গেম। তোমাকেও খানিকটা এসবের জন্য মেন্টাল প্রিপারেশন নিতে হবে”।

অদিতি বিমর্ষ মুখে বলল “ঠিক আছে। সামলে নেব। বাচ্চা নেওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল সাগ্নিকের সঙ্গে আমার প্রেমটা ছিল। কত স্বপ্ন দেখতাম, একটা মেয়ে হবে, নাম হবে আঁখি…”

অদিতি চুপ করে গেল।

তীর্থ বলল “মন খারাপ করছে? অমলেট খাবে?”

অদিতি বলল “হ্যাঁ, মাঝরাতে অমলেট খেতে যাব কেন? তুমি তো মহা আতা ক্যালানে লোক!”

তীর্থ বলল “তাহলে কী খাবে?”

অদিতি বলল “কিছু না। আমার মুড ঠিক করতে হবে না। ও এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। তুমিই বেঁচে গেছো। কাউকে ভালবাসো নি, এটাই ভাল। প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কষ্ট ভীষণ। নেওয়া যায় না”।

তীর্থ বলল “ভালবাসা ব্যাপারটাই তো ফিজিকাল। তুমি ওর সঙ্গে শুয়েছো, ওর তোমার ওপর থেকে ইন্টারেস্ট চলে গেছে। ও তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সিম্পল”।

অদিতি চুপ করে বসে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর বলল “হু, ও একটা কুকুর ছিল। বেশিরভাগ পুরুষ…”

তীর্থ হতাশ হয়ে বলল “নাও, ঘুরে ফিরে সেই একই কথা!!! উফ!”

অদিতি সোজা হয়ে বসল “শিট!”

তীর্থ বলল “কী হল?”

অদিতি বলল “বমি”।

 বলেই অদিতি ঘরের মেঝেতে হড়হড় করে বমি করে দিল।

ঘর ধোয়া হয়েছে। হোটেলের লোক এত রাতে এসেও ধুয়ে দিয়ে গেছে।

অদিতি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।

তীর্থ ফিক ফিক করে হাসতে শুরু করল। অদিতি তীর্থর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল “কী হল?”

তীর্থ বলল “এমনভাবে খাচ্ছিলে ভাবছিলাম বিরাট কিছু মাতাল তুমি। ছড়ানোশ্রী মাতাল সেটা বুঝিনি। ভাগ্য ভাল হোটেলের লোক এত রাতেও এল, নইলে বমির গন্ধের মধ্যে শুতে হত”।

অদিতি বলল “এত আনন্দ পাবার মত কিছু হয় নি। মে বি অ্যাসিডিটি হয়েছিল তাই বমি করে দিয়েছি। নিজে তো এক ফোঁটাও গেলো নি, বেশি কথা বলার দরকার নেই”।

তীর্থ বলল “আমি বমি জিনিসটা পছন্দ করি না বলেই খাই না। আমার বডি নিতে পারে না এসব। তবে তুমি এমন ভাব নেবে… ফেকু কোথাকার”।

তীর্থ খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করল।

অদিতি বলল “দেখো, তুমি এভাবে হাসলে কিন্তু ভাল হবে না বলে দিলাম। আমি অন্য ঘর নিয়ে থাকব”।

তীর্থ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল “সরি সরি। আর হবে না”। বলে আবার হাসতে শুরু করল।

অদিতি তীর্থর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রিসেপশনে ফোন করে রুম চাইল। রিসেপশন থেকে জানানো হল কিছুক্ষণ আগে একটা বড় দল এসেছে। সব ঘর বুক হয়ে গেছে। অদিতি ফোন রেখে কট মট করে তীর্থর দিকে তাকিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে চেয়ারে বসে চেঁচিয়ে বলল “আমি সারারাত এখানে কাটাব। অসভ্য লোক কোথাকার”।

তীর্থ ব্যালকনিতে গিয়ে বলল “আচ্ছা আমি আর হাসব না। মাইরি বলছি”।

অদিতি বলল “আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। যে লোক একা একা অমলেট খেতে পারে সে মানুষ খুন করতে পারে”।

তীর্থ মাথায় হাত দিয়ে বলল “আচ্ছা। রাগ কমাও। আমাদের মিউচুয়াল ম্যারেজের চুক্তিতে এত রাগ ছিল না কিন্তু”।

অদিতি বলল “ওরম অসভ্যের মত খ্যাক খ্যাক করে হাসাও ছিল না। তুমি শুধু সেলফিসই নও, একজন অত্যন্ত অসভ্য লোক”।

তীর্থ এবার রাগল “তুমি আবার আমায় সেলফিস বললে?”

অদিতি বলল “বেশ করেছি বলেছি। নিজে খ্যাক খ্যাক করে হাসছিলে তার বেলা?”

তীর্থ কয়েক সেকেন্ড অদিতির দিকে তাকিয়ে বলল “যা পারো কর, আমি ঘুমালাম”।

ঘরে ঢুকে তীর্থ এসি চালিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।

অদিতি কয়েক মিনিট শক্ত মুখ করে ব্যালকনিতে বসে রইল। সমুদ্রের হাওয়া আসছে ঠিকই, কিন্তু কোত্থেকে কয়েকটা মশা এসে কামড়াতে শুরু করেছে।

অদিতি “ধুত্তোর” বলে ঘরে ঢুকে খাটে শুয়ে তীর্থর থেকে পুরো কম্বলটাই নিয়ে নিল।

তীর্থ উঠে “একী একী” বলে বসে বলল “কী করছ?”

অদিতি বলল “তুমি একাই কম্বল নিয়ে শুয়েছো কেন? আমার কম্বল লাগে না?”

তীর্থ বলল “তা বলে তুমি এভাবে কম্বল টেনে নেবে? তুমি তো ডেঞ্জারাস মেয়ে”!

অদিতি বলল “ভদ্রলোকের মত থাকলে ভদ্রলোকের মত ব্যবহার পাবে, নইলে এরকমই হবে। নাও এবার। আমার থেকে এক হাত দূরে শোবে। আর খবরদার রাত্তিরে গায়ে হাত দেবে না”।

তীর্থ বলল “হুহ, আমার বয়ে গেছে ঐ গন্ধ বমিওয়ালা গায়ে হাত দিতে। খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যেন আমার”।

অদিতি চোখ ছোট করে বলল “আমারই ভুল হয়েছে। উচিত ছিল তোমার গায়ে বমিটা করা। তাহলে মজাটা বুঝতে”।

তীর্থ উল্টো মুখ করে শুয়ে বলল “যা পারো কর। আমি ঘুমালাম”।

অদিতি গজগজ করতে করতে শুল। কয়েক সেকেন্ড পরে অদিতি আর্তনাদ করে উঠল “উফ! কী বিচ্ছিরি গন্ধ। এই তোমার পেট পরিস্কার হয় না? বাথরুমে যাও”।

তীর্থ সাড়া দিল না।

অদিতি তীর্থকে ঠেলতে শুরু করল “এই ছেলে, এই অসভ্য ছেলে! বাথরুমে যাও”।

তীর্থ বলল “বিরক্ত কোর না। আমার বড় বাইরে পায় নি”।

অদিতি বলল “না পেলে গিয়ে বসে থাকো। এভাবে পরিবেশ দূষণ ঘটিও না। উফ! এরকম জানলে জীবনেও বিয়ে করতাম না তোমায়। ঈশ কী দুর্গন্ধ মাগো!”

তীর্থ বলল “হ্যাঁ, নিজে তো সুগন্ধে চারদিকে ভরিয়ে রেখেছো”।

অদিতি বলল “এই তিন চার দিন তো বুঝি নি তুমি এমন বিষ মাল! একটা মেয়ে আছে ঘরে, মিনিমাম সভ্যতা ভব্যতা থাকবে না?”

তীর্থ বলল “আমি তো সভ্যভাবেই ছিলাম। হঠাৎ করে একটা অ্যাক্সিডেন্টাল দুর্গন্ধ বেরোতেই পারে। এখানে আমার হাত থাকবে কী করে?”

অদিতি বলল “হাত না, তোমার ইয়ে আছে। প্লিজ আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দাও। বমি করার পর থেকে ভাল লাগছে না। এরকম গন্ধ পেলে আবার বমি হয়ে যাবে খাটের ওপরে তখন বুঝবে”।

তীর্থ ভয় পেয়ে উঠে বাথরুম যেতে যেতে বলল “ওরে বাবা। ঠিক আছে, আমি দেখছি কিছু করা যায় নাকি”।

তীর্থ বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলে অদিতি চোখ বন্ধ করল।

মিনিট দশেক পরে তীর্থ ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠল “একী! তুমিও তো দিয়েছো! এবার কে অসভ্যতা করল?”

অদিতি সাড়া দিল না। তীর্থ কয়েক সেকেন্ড পায়চারি করে বলল “ঐতিহাসিক ভুল করেছি আমি বিয়ে করে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। বিয়ে মানেই ঝামেলার জিনিস! উফ! এরকম জানলে কে বিয়ে করত!”

ঘরের ভেতর সশব্দে একটা শব্দ হল। তীর্থ বলল “বাপরে! যেন বাজ পড়ছে। এই মেয়ে তুমি বাথরুম যাও!”

অদিতি সাড়াশব্দ করল না।

তীর্থ মোবাইল বের করে জোরে গান চালিয়ে দিল।

অদিতি ঘুমের ঘোরে বলল “কী হল? ঘুমাতে দেবে?”

তীর্থ বলল “তুমি বাথরুমে যাবে? ঘরটাকে তো পুরো ধাপার মাঠ বানিয়ে দিয়েছো। আমাকে বাথরুমে যেতে বলে নিজে এখানে পারমাণবিক বিস্ফোরণ করতে শুরু করেছে”।

অদিতি বলল “সকালে সকালে। তুমি ঘুমাও”।

তীর্থ রেগে খাটে শুল। মিনিট খানেক পর অদিতি একটা হাত তীর্থর বুকের উপর দিয়ে তীর্থকে জড়িয়ে ধরল।

তীর্থ সভয়ে বলল “ওরে বাবা। এসব কোর না। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারব না”।

অদিতি তীর্থকে ছাড়ল না।

তীর্থ বলল “সর্বনাশ হল তো! এ মেয়েকে বিয়ার খাওয়ানোটাই ভুল হয়েছে। সাংঘাতিক মাতাল প্রকৃতির মহিলা। এই, শোন না। চুক্তি বহির্ভূত কাজ হচ্ছে।“

অদিতি তীর্থর গালে চুমু খেল।

তীর্থ শিউরে উঠে বলল “এ কী শুরু করল। এবার তো নিম্নচাপ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে উপকূলে আছড়ে পড়বে। শোন না। এসব চুক্তিতে ছিল না”!

অদিতি নেশা ধরা গলায় বলল “চুক্তির গুলি মারি। আর ইউ এ ম্যান? প্রমাণ কর দেখি!”

তীর্থ তেড়ে মেড়ে উঠে বলল “তবে রে!”

ভোর ছ’টা।

তীর্থ ঘুমাচ্ছিল।

অদিতি ঠেলে ওকে ঘুম থেকে তুলল “এই যে, ওঠো, ওঠো”।

তীর্থ ধড়মড় করে উঠে বসে বলল “কী হল? পাকিস্তান বোম মেরেছে?”

অদিতি রাগী গলায় বলল “পাকিস্তান বোম মারে নি। তবে আমি তোমায় বোম মারব। তোমার গায়ে কোন পোশাক নেই কেন? আমার গায়েই বা কিছু ছিল না কেন?”

তীর্থ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজের নিচের দিকে তাকিয়ে জিভ কেটে কম্বল টেনে নিয়ে বলল “তুমিই তো ইনসিস্ট করলে! বললে আমি পুরুষ নাকি দেখতে চাও! আমি কী করব? বার খাইয়ে দিলে কেন?”

অদিতি মাথায় হাত দিয়ে বড় বড় চোখে তীর্থর দিকে তাকিয়ে বলল “করে ফেলেছো?”

তীর্থ অবাক গলায় বলল “কী করব?”

অদিতি বলল “মহা ন্যাকা তো! জানো না কী করার কথা বলছি?”

তীর্থ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বোঝার চেষ্টা করল। বুঝতে পেরে বলল “ও, মানে সেক্সের কথা বলছ?”

অদিতি বলল “না আমি এন আর সি অ্যাপ্লিকেশন করার কথা বলছি। আচ্ছা আপদ তো!”

তীর্থ বলল “অ্যাকচুয়ালি আমি ভার্জিন তো। আমি কী করে কী করতে হয় জানতাম না। তুমিই শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে আর কী!”

অদিতি বলল “আমি শিখিয়ে পড়িয়ে নিলাম! তুমি বোঝ নি নেশার ঘোরে ছিলাম আমি? কী করছিলাম সেটা বোঝার ক্ষমতাই ছিল না আমার?”

তীর্থ বলল “না। বুঝব কী করে? তুমি আমাকে কী যেন বলে, উত্তেজিত করে দিয়েছিলে। আর আমি কী করব?”

অদিতি বলল “আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না সিরিয়াসলি। তুমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলে না?”

তীর্থ বলল “দেখো অদিতি, আমি তো কোন ঋষি মুনি নই যে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারব! তুমি আমাকে সিডিউস করেছো, আমার আর কিছু করার ছিল না। ঢাল ছিল, নদী বয়ে গেছে।“

অদিতি বলল “বাহ, ভাল কথা বল তো তুমি! ঢাল ছিল? এটা কেমন উপমা?”

তীর্থ বলল “দেখো মাঝরাতে ওরকম পিকিউলিয়ার বিহেভ করলে, ভোরবেলা উঠে ভাইভা নেওয়া শুরু করেছো অর্ণব গোস্বামীর মত। আমার টায়ার্ড লাগছে। আমি শুই? পরে উত্তর দেব?”

অদিতি বলল “টায়ার্ড লাগছে মানে? কী পরিশ্রম করেছো তুমি টায়ার্ড লাগার মত?”

তীর্থ বলল “উফ আবার প্রশ্ন! প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দাও”।

অদিতি খিচিয়ে উঠল “ঘুমাও তুমি ঘুমাও! যা ইচ্ছে কর। আমি আর কিছু বলব না তোমাকে”।

তীর্থ কথা না বাড়িয়ে চোখ বুজল। অদিতি পায়চারি শুরু করল বিড়বিড় করতে করতে, “কী করেছে কে জানে! আজব একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে হল আমার! কেন আমি এই বোকামোটা করতে গেলাম! আমার বোঝা উচিত ছিল সব পুরুষ এক রকম। সুযোগ পেলে কেউ ছাড়ে না”!

তীর্থ চোখ বন্ধ করেই বলল “সুযোগের কিছু নেই। সামনে বিরিয়ানি রেখে কেউ খাও না খাও না করলে খাবোই। আমার কী দোষ?”

অদিতি বলল “তোমার কী দোষ? প্রেগন্যান্ট হলে তুমি হবে? এই ঢপের বিয়েতে প্রেগন্যান্ট? সম্ভব?”

তীর্থ বলল “সেটা বিয়ার খেয়ে বাওয়াল করার আগে ভাবা উচিত ছিল”।

অদিতি থতমত খেয়ে বলল “আ… আমি ভেবেছি তুমি কন্ট্রোল করতে পারবে। তোমায় রেসপন্সিবল ভেবেছিলাম। বড় বড় কথা বলছিলে তো!”

তীর্থ বলল “ইউ আর রিয়েলি অ্যামেজিং! আমাকে কন্ট্রোল করতে হবে? কেন বল তো? তাহলে শুরু থেকেই দুটো রুম নেওয়া উচিত ছিল! তুমিই বলেছিলে একটা ঘরেই থাকা যায়। নিজে ইনসিস্ট করলে কাল আর আমায় এখন দোষ দিয়ে যাচ্ছ!”

অদিতি বলল “আমি কিছু জানি না, আমি প্রেগন্যান্ট হতে চাই না। তুমি কী করবে কর”!

তীর্থ বলল “ধুস! একটু ঘুমাতে দেয় যদি! আমি কী করব! মানে আমার কী করার আছে? আমার এসব ব্যাপারে কোন এক্সপেরিয়েন্স নেই বলেছি তো। তুমিই তো শিখিয়ে পড়িয়ে দিলে! আমার বরং এখন কেমন ইয়ে ব্যথা করছে। প্রথম বার তো!”

অদিতি বলল “তোমার ইয়েটা সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে আসো। কন্ট্রোললেস পাবলিক কোথাকার”।

তীর্থ বলল “শোন, আমার কথা শোন, তুমি মাথা ঠান্ডা কর। আজ তো চিল্কা যাবার কথা। ঘুরে আসি। তারপর দুজনে কথা বলে একটা ডিসিশন নেওয়া যাবে”।

অদিতি বলল “চিল্কা যাব? এখনও? সিরিয়াসলি? তুমি এত ইনোসেন্ট কি জন্ম থেকেই নাকি কোন আলাদা কোর্স করেছো?”

তীর্থ অবাক হয়ে বলল “মানে? এতে ইনোসেন্ট হবার কী আছে? কাল তো ট্রাভেল এজেন্টকে গাড়ির জন্য অ্যাডভান্স করে দিয়েছি। সে টাকা নষ্ট হবে না? আর প্রেগনেন্সি এটসেট্রা এত সোজা নাকি? কিছু করে অ্যাভয়েড করা যায় না?”

অদিতি বলল “সব যায়। কিন্তু আমার সমস্যা সেটা না। আমার সমস্যা হল তুমি একটা বহুত ফালতু লোক। বড় বড় কথা বলে আসল জায়গায় এসে ছড়িয়ে লাট করে দিয়েছো। তোমার উচিত ছিল কন্ট্রোল করা”।

তীর্থ বলল “আমি শুনেছিলাম মেয়েরা যুক্তি, টুক্তি না বুঝেই ভাট তর্ক করে যায়, তোমাকে দেখে আমি আজ কনফার্ম হলাম। নিজে বিয়ার খেয়ে বমি করে ঘর ভাসিয়ে আমাকে ওসব করতে ইনসিস্ট করলে আর তখন থেকে একই হ্যাজ দিয়ে যাচ্ছ। আমাকে ফালতু বলার আগে নিজের দিকে তাকাও”।

অদিতি রাগী চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তীর্থ কম্বল সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে বলল “আমার বারমুডা? আমার বারমুডা কোথায়?”

ঘরের এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল মেঝেতে বারমুডা পড়ে আছে। তীর্থ গলা বাড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কেউ আসছে নাকি দেখে লাফ দিয়ে মেঝেতে গিয়ে বারমুডাটা তুলে পরে নিল। গেঞ্জি গায়ে চড়িয়ে আবার বিছানায় শুয়ে নাক ডাকাতে শুরু করল।

মিনিট দশেক পরে অদিতি ঘরে ঢুকে তীর্থর দিকে তাকিয়ে বলল “অদ্ভুত! অদ্ভুত! চুক্তিভঙ্গকারী ফিলিপ মোষ কোথাকার! জেল হওয়া উচিত তোমার! এই ওঠো তো!”

তীর্থকে ঠেলতে শুরু করল অদিতি। তীর্থ বিরক্ত গলায় বলল “কী হল? আবার এখন করতে ইচ্ছা করছে নাকি?”

অদিতি বলল “শোন, কথাটা ভাল করে শোন। যেটা হয়েছে, সেটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। আর যেন না হয়। এরপরে আমি বিয়ার খাই, হুইস্কি খাই, বাংলা খাই যা খুশি খাই, খেয়ে তোমায় যা খুশি করি, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে শিলা কী জওয়ানি নাচি, তুমি নিজেকে কন্ট্রোল করবে? ক্লিয়ার?”

তীর্থ বলল “ক্লিয়ার। এবার শুতে পারি?”

অদিতি বলল “আমার জন্য একটা ওষুধ এনে দিতে হবে”।

তীর্থ বলল “দেব। দোকান খুলতে দাও”।

অদিতি খানিকটা শান্ত হয়ে বলল “ওকে। ঘুমাও। আমার মাথা কাজ করছে না আসলে। আমার বিয়ার খাওয়া উচিত হয় নি”।

তীর্থ বলল “তা মাঝে মাঝে খেও। ভালই লাগল ব্যাপারটা”।

বলেই কম্বল মুড়ি দিল।

অদিতি চ্যাচাতে শুরু করল “কী? কী বললে? বলবেই তো! ম্যান ওয়ান্টস ওনলি ওয়ান থিং। আমিই গাধা যে বিয়ার খেতে গেলাম। শিট, শিট”।

সকাল সাড়ে এগারোটা।

চিল্কায় নৌকায় উঠেছে দুজন।

রোদ ঝলমল করছে আকাশে। তবে অদিতির মুখ ভার। তীর্থ লাইফ জ্যাকেট খুলে বলল “উফ, এসব কেউ পরে? এর জন্য আবার পঞ্চাশ টাকা করে নিল। লোককে মুরগী করার নতুন নতুন টেকনিক যত”!

অদিতি বলল “তুমি ঐ দোকানে লাঞ্চে এত খাবারের অর্ডার দিলে কেন? এত মাছ কে খাবে?”

তীর্থ বলল “আমি খাব। তুমি যতটা পারবে খেও। বাকিটা আমি খাব”।

অদিতি চোখ কপালে তুলে বলল “অত খেতে পারবে?”

তীর্থ বলল “হ্যাঁ, না খাওয়ার কী আছে। এরকম ফ্রেশ মাছ কোথায় পাওয়া যাবে?”

অদিতি চেঁচিয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে “কত দূরে যেতে হবে?”

মাঝি বলল “আগে ডলফিন পয়েন্ট যাচ্ছি। ওখানে ডলফিন দেখে নিন তার পর রেড ক্র্যাব আইল্যান্ডে নিয়ে যাব”।

তীর্থ বলল “ওই দেখো, ডলফিন পয়েন্ট নাকি। ডলফিন দেখাবে”।

অদিতি বলল “যা দেখাবে দেখাবে। আমার ভাল লাগছে না। সকাল থেকে আমার একবারেই মন মেজাজ ভাল নেই। আমার কাল বিয়ার খাওয়া ঠিক হয় নি”।

তীর্থ বলল “ও। শোন, তুমি যেটা ভাবছ সেটা না। আমি আমাদের অ্যাগ্রিমেন্ট ব্রেক করব না। বরং আজ থেকে আমিও প্রি কশান নেব যাতে এই ধরণের ঘটনা আর না ঘটে। এই ব্যাপারটাকে ভুলে যাও বরং। না ভুললে সমস্যা বাড়বে। আমাদের এই বিয়েটার পারপাসই ছিল বাড়ির লোক এবং এদিক সেদিকের লোকের ফিসফিস কমাতে আমরা এই বিয়েটা করব। একটা চুক্তির বিয়ে। সেখানে একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে। সেটা ভেবে মন খারাপ করে লাভ নেই। তুমি অন্য কিছু ভাবো বরং যেটা তোমাকে চিয়ার আপ করতে পারে”।

অদিতি বলল “তুমি জানো না আমার বাড়ি থেকে কতখানি বিয়ের প্রেশার ছিল। অনেক কষ্ট করে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম সব কিছু। আমার মা বাবার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। বাড়ি ফিরতে পারছিলাম না। রাত করে ফিরলেও বাবার অশান্তি, মার ঘ্যান ঘ্যানে পাগল হয়ে গিয়ে শেষ মেশ বিয়ের জন্য রাজি হলাম। এখন যদি আবার কোন কারণে আমি একটা অ্যাটাচমেন্টে জড়িয়ে পড়ি এবং তারপর আবার হার্ট ব্রেক হয় তাহলে আমি জাস্ট শেষ হয়ে যাব। সাগ্নিক আমাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে ইমোশনালি এবং ফিজিক্যালি। তারপর ডিচ করে চলে গেল। আমার মনে হচ্ছিল আমাকে কেউ মাঝ পথে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমার জায়গায় থাকলে হয়ত বুঝতে পারতে”।

তীর্থ বলল “দেখো, একটা পাস্ট রিলেশন বার বার কচলালে তেতো হয়ে যায়। দেখো কী সুন্দর বক বসে আছে। বিভিন্ন পাখী দেখো। এসব দেখে সব ভুলতে চেষ্টা কর। তোমার মত আমারও কোন সিরিয়াস সম্পর্কে যেতে অ্যালার্জি আছে। এই যে তুমি সাগ্নিকের কথা বললে, আমার সেরকম কেউ ছিল না। কিন্তু আমার অফিসে প্রবল চাপ আছে। এই চাপের জন্য দূরে কোথাও যেতেও তো পারলাম না। তিন দিন মাত্র ছুটি ম্যানেজ করে এলাম। সারাক্ষণ অফিস আর কাজের প্রেশার সামলে আমাকে চলতে হয়। এর মাঝে সংসার, বাচ্চা… এসব যদি হয় তাহলে এর দায়িত্ব আমি নিতে গেলে আমার হয়ে গেল। তুমি আমাকে নিয়ে একবারেই ভেবো না, আমি তোমাকে ঠিক আটকে দেবো এর পর থেকে”।

অদিতি হাসল “থ্যাংক্স। কথাগুলো মনে রেখো, তাহলেই হবে”।

পাশের একটা নৌকায় একজোড়া নব দম্পতি যাচ্ছে। স্বামী স্ত্রী একে অপরকে জড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। অদিতি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল “ন্যাকামি যত”।

তীর্থ বলল “ন্যাকামির কিছু নেই। এসব তো করেই থাকে লোকে। তোমার সাগ্নিকের সঙ্গে বিয়ে হলে তুমিও করতে”।

অদিতি বলল “তা করতাম। প্রেম থাকাকালীনও অনেক করেছি। যেদিন ডিচ করেছিল তার আগের দিনও আমাদের সেলফি পোস্ট করেছিলাম। সাগ্নিক আমাকে ব্লক করে দিয়েছিল। আমি অনেকক্ষণ বসে বসে কেঁদেছিলাম। এরকম কেন হবে? এরকম কেন হল? আমাকে ব্লক করবে কেন? ব্লক করার কী আছে? ভেবেছিলাম আজকের দিনটা যাক ঠিক আছে, পরের দিন নিশ্চয়ই ফোন করে ক্ষমা চাইবে। পরের দিনও করল না। তিন দিন পরে ফোন করলাম। একটা মেয়ে ধরে বলল সে নাকি সাগ্নিকের গার্লফ্রেন্ড। ফোনটা কেটে দেবার পর আমার জ্বর এসেছিল। ভীষণ জ্বর”।

তীর্থ বলল “রিলেশনশিপ জিনিসটাই এমন। যারা ব্রেক আপ করে তারা কীভাবে করে আমি জানি না। ব্রেক আপ ব্যাপারটা আছে কী করে পৃথিবীতে? যাকে কেউ ভালবাসে তাকে এত সহজে ভুলে যায় মানুষ? রাস্তায় দেখা হলে চিনতে পর্যন্ত পারে না?”

অদিতি চমকে গিয়ে বলল “কী বললে? রাস্তায় দেখা হলে চিনতে পর্যন্ত পারে না? এই তুমি ঢপ মেরেছো আমাকে। সত্যি করে বল তো কোন মেয়ে তোমাকে ডিচ করেছিল?”

তীর্থ প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল “কেউ না, কেউ না। মাইরি বলছি কেউ না”।

অদিতি মাঝির দিকে তাকাল। মাঝি তাদের দেখছে না। আশে পাশে এখন কোন নৌকাও নেই। অদিতি তীর্থর জ্যাকেট খামচে ধরে বলল “সত্যি করে বল নইলে একদম খিমচে দেব। আমার খিমচানো জগত বিখ্যাত”।

তীর্থ সভয়ে বলল “ওরে বাবা খিমচিও না এখানে টিটেনাস পাব কোত্থেকে?”

অদিতি বলল “কী? টিটেনাস? আমি কুকুর?”

তীর্থ বলল “না না সে বলি নি”।

অদিতি বলল “সে সব ছাড়ো। সত্যি করে বল তোমার কী কেস? শালা বুকে ব্যথা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নিজের সেলফিস ইমেজ ক্রিয়েট করছে। হেবি ডেঞ্জার জিনিস তো তুমি গুরু”।

তীর্থ চারদিকে তাকিয়ে বলল “বলছি বলছি, জ্যাকেটটা ছাড়ো। ঈশ কেউ দেখলে কী ভাববে?”

অদিতি বলল “আগে নাম বল। কেস বল তারপর বলছি”।

তীর্থ ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদতে শুরু করল।

অদিতি বলল “এই মরেছে। কাঁদছ কেন? আচ্ছা আচ্ছা জ্যাকেট ছাড়লাম। বলতে হবে না”।

মাঝি চেঁচিয়ে উঠল “ঐ ঐ ডলফিন”।

দুজনে মাথা ঘুরাল, কিছুই দেখা গেল না। মাঝি একবার এদিকে নৌকা নেয়, ওদিকে নৌকা নেয়। অদিতি চেঁচিয়ে বলল “ঝুট বল কেন? কোথায় ডলফিন?”

মাঝি বলল “ছিল ছিল। দেখুন ভাল করে”।

চারদিকে শুধু জল আর জল কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একগাদা নৌকা এসে গেছে ডলফিন পয়েন্টে। সবাই কৌতূহলী চোখে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তীর্থ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল “সুপর্ণা, ওর নাম ছিল সুপর্ণা”।

অদিতি হৈ হৈ করে উঠল “ঐ তো ডলফিন। ঐ দেখো”।

তীর্থ বলল “ধুত্তোর ডলফিন। তুমি সুপর্ণার কথা শোন। আমাকে সেলফিস বলে চলে গেছিল”।

অদিতি বলল “কেন? তুমি অমলেট খেয়ে ফেলেছিলে নিশ্চয়ই?”

তীর্থ বিরক্ত গলায় বলল “ফিলিপ ঘোষের মাথায় যেমন গরু ঘোরে তোমার মাথায় কি সারাদিন অমলেট ঘোরে? আর কিছু ঘোরে না?”

অদিতি বলল “আচ্ছা সরি সরি। এই তুমি প্রেম করেও ভার্জিন ছিলে এই ওয়ো রুমের যুগেও? কী ভাল মাইরি তুমি?”

তীর্থ কটমট করে অদিতির দিকে তাকাল।

“ওয়ো রুম অ্যাভেলেবল হলেই যে যেতে হবে এটা তোমাকে কে বলল?”

তীর্থ বলল।

নৌকো ক্র্যাব আইল্যান্ডের দিকে রওনা দিয়েছে।

অদিতি বলল “ভালোবাসায় শরীর তো স্বাভাবিক নিয়মেই আসবে। এই যুগে সেটা না হওয়াটাই আমার অস্বাভাবিক লাগে। দুটো ছেলে মেয়ে পাশাপাশি ঘুরলে হাতে হাত লাগলে বিদ্যুৎ খেলবে না?”

তীর্থ জলের দিকে তাকিয়ে বলল “খেলবে। তবে তা সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছিল কোথাও একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। আমরা দেখা করেছি, কথা বলেছি, কিন্তু আমি কখনই ওকে সে প্রস্তাব দিই নি”।

অদিতি মুখ বেঁকিয়ে বলল “সে জন্যই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে মেয়েটা”।

তীর্থ বলল “সব না জেনেই এরকম একটা ডিসিশন নিয়ে নিলে কেন?”

অদিতি বলল “নিলাম কারণ ছেলেদের একটা জেনারেল ধারণা হল মেয়েদের স্বাভাবিক কাম থাকবে না। তাদের সেক্স করতে ইচ্ছা করবে না। তাদেরও যে ছেলেদের মতই ইচ্ছা করে এটাই বেশিরভাগ ছেলে বুঝতে চায় না বা বুঝতে পারে না”।

তীর্থ বলল “ও। না, সেসব কিছু ছিল বলে তো মনে হয় না। বেশিদিন চলেও নি তো ব্যাপারটা। মাস খানেক হবে”।

অদিতি অবাক হয়ে বলল “মাসখানেক? মাত্র? এর বেশি তো আমাদের বাড়ির গ্যাস চলে এত বেশি রান্না হওয়া সত্ত্বেও”।

তীর্থ বলল “হ্যাঁ মাস খানেকই। আর তার কারণ হল ও আমাকে স্টেপনি হিসেবে রেখেছিল। ওর একজন স্টেডি বয়ফ্রেন্ড ছিল। তার সঙ্গে ব্রেক আপ হয়ে গেছিল। আমি সেটা জানতাম না। ক’দিন ঘুরল। তারপর ফোন ধরা, মেসেজ করা বন্ধ করে দিল। আমি কোন কালেই ন্যাগিং ছিলাম না। পরে ফেসবুকে ফেক থেকে দেখে বুঝলাম আগের লোকের সঙ্গে প্যাচ আপ হয়ে গেছে”।

অদিতি হেসে গড়িয়ে পড়ল “ধুস, তুমি পাতি মুরগী হয়েছিলে আর কিছু না”।

তীর্থ অন্যমনস্কভাবে বলল “হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো, মুরগী হয়েছিলাম। একজনের সম্পর্কের মধ্যে না জেনে ঢুকে পড়েছিলাম। জানলে অবশ্যই করতাম না। তবে কী জানো তো, আমার মত মানুষেরা যারা এরকম সম্পর্কে না জেনে ঢুকে যায় আর রিজেক্টেড হয়, মানুষ ভাবে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় না। কষ্ট যে তাদেরও হয় সেটা কেউ বুঝতে চায় না। বরং তাদের এরকম মুরগী ইত্যাদিই ভাবে। সুপর্ণার সঙ্গে আমার নন্দনে দেখা হয়েছিল। ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল ওর সঙ্গে। আমাকে দেখেও দেখল না। আমি আর ডাকি নি”।

অদিতি বলল “তুমি বহুদিন সিঙ্গল ছিলে, তাই তো?”

তীর্থ বলল “হ্যাঁ। আমি সেরকম ভাবে ডেসপারেটও ছিলাম না। সুপর্ণাই আমাকে জোর করে জড়িয়েছিল। তারপরে নিজেই ছেড়ে গেল”।

অদিতি বলল “সিঙ্গল ছেলেদের এটা সমস্যা। হিস্ট্রি দেখে না, মেয়েদের জিওগ্রাফি দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষমেশ দাগা খেয়ে ফেসবুকে দুলাইনের ছন্দ মেলানো কবিতা কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে লিখে বিখ্যাত কবি হয়ে যায়”।

তীর্থ মুখ গোমড়া করে বলল “আমি কবিতা লিখি না”।

অদিতি বলল “লেখো না তবে শেয়ার করতে দেখেছি তোমাকে”।

তীর্থ বলল “আমার যে লেখাগুলোর সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পেরেছি সেগুলো শেয়ার করেছি। দু লাইনের কবিতা হোক না, সমস্যা কোথায়?”

অদিতি বলল “সমস্যা কিছুই না। তবে সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে রিলেট না করে, ফ্রাস্ট্রু না খেয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন”।

তীর্থ বলল “হ্যাঁ সে তো বুঝতেই পারছি। সাগ্নিকের থেকে লেঙ্গি খেয়ে কন্ট্র্যাক্ট ম্যারেজ করার নাম জীবন। থামো,বড় বড় কথা বলে লাভ নেই”।

অদিতি রেগে গিয়ে বলল “তুমি আবার সাগ্নিককে টানলে? তোমার সুপর্ণা আর সাগ্নিক এক হল? আমাদের সম্পর্কটা তোমার মত স্টপ গ্যাপ রিলেশন ছিল না”।

তীর্থ বলল “তাতে কী হয়েছে? তুমিই তো বললে রিলেট না করে এগিয়ে যাবার নাম জীবন। তুমি এগিয়ে যাও নি কেন? আরেকটা ছেলের সঙ্গে না জড়ালেও পারতে”।

অদিতি বলল “তোমার সঙ্গে জড়িয়েছি? জড়াই নি তো! তোমার সঙ্গে বিন্দুমাত্র কিছু হবে না আমার, নিশ্চিন্ত থাকো”।

তীর্থ বলল “আমারও কিছু হবে না। তবে দয়া করে রাত্রিবেলা বিয়ার গিলে আমাকে সিডিউস করতেও আর এসো না। আমিও মানুষ, আমারও সমস্যা হয়”।

অদিতি খানিকটা নিভে গিয়ে বলল “তুমি হোটেলে গিয়ে আলাদা ঘরের কথা বলবে। এই হোটেলে না হলে অন্য হোটেলে যাব। আমি একটা ভুল করেছি, কিন্তু তুমিও যে ভুল করেছো সেটা কিছুতেই তুমি স্বীকার করবে না আমি বুঝছি”।

তীর্থ বলল “মেনকা সিডিউস করেছিলেন বলে স্বয়ং বিশ্বামিত্র মুনিরও ধ্যান ভঙ্গ হয়েছিল, আমি তো কোন ছাড়। এর পর থেকে বরং অন্য ঘরেই শুয়ো। বেটার হয়”।

নৌকো একটা ছোট দ্বীপে পৌঁছল। দুজন লোক নদীর তীরে অপেক্ষা করছিল। নৌকার কাছে এসে কাঁকড়া দেখাতে শুরু করল।

তীর্থ বলল “আমি একটু টয়লেট করে আসছি”।

অদিতি কিছু বলল না। তীর্থ নৌকো থেকে নেমে গেল। তার পা ভিজল খানিকটা। হাঁটতে হাঁটতে সে গাছের আড়ালে চলে গেল।

অদিতিকে লোকগুলো ঝিনুক থেকে কী করে মুক্তো বের করে দেখিয়ে বলল “কিনবেন?”

অদিতি বলল “কত দাম?”

একজন বলল “তিনশোটাকা”।

অদিতি বলল “নাহ কিনব না”।

লোকগুলো মাথা নাড়ল ঠিক আছে। একজন মুনস্টোন দেখাতে শুরু করল।

অদিতি অধৈর্য হয়ে বলল “আমি দেখতে চাইছি না। আপনারা যান”।

লোক দুজন তার দিকে কেমন ভাবে তাকাল।

অদিতির ভয় লাগল হঠাৎ করে। তাদের মাঝিও এগিয়ে এসেছে।

সে চেঁচিয়ে উঠল “তীর্থ, এই তীর্থ”।

তীর্থ কোন সাড়া দিল না।

মাঝি বলল “ম্যাডাম আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? ওরা মুক্তো দেখাচ্ছে, দেখুন না”। হাসল মাঝিটা কেমন করে।

অদিতির মনে হল তার জ্বর আসছে। ভীষণ জ্বর।

সন্ধ্যেবেলা।

তারা সমুদ্রের সামনে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে ফিরে আর হোটেলে যায় নি এখনও।

তীর্থ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল “অনেকদিন পর ভাল চিংড়ি খেলাম। কী অসাধারণ টেস্ট তাই না?”

অদিতি অন্যমনস্কভাবে বলল “হু”।

তীর্থ বলল “কী হল? মুড অফ কেন?”

অদিতি বলল “কিছু না”।

তীর্থ বলল “চা নিয়ে আসব? খাবে?”

অদিতি বলল “নাহ। দুপুরের খাওয়াই হজম হয় নি এখনও”।

তীর্থ বলল “সে কী? আমার তো কখন হজম হয়ে গেছে। সমুদ্রের হাওয়ায় সারাক্ষণ খিদে পেয়ে যাচ্ছে আমার। তুমি জেলুসিল খাবে?”

অদিতি মাথা নাড়ল “না, খাব না”।

তীর্থ কাঁধ ঝাকাল “ওকে। ক্র্যাব আইল্যান্ডের ঘটনাটা নিয়ে তুমি কি খুব আপসেট হয়ে পড়েছো? ওরা কিন্তু ওরকম ছিল না যেমন তুমি ভেবেছিলে”!

অদিতি বলল “জানি”।

তীর্থ বলল “তবে? ওরকম করে চিৎকার জুড়লে কেন?”

অদিতি মাথা নিচু করল “জানি না। আমার ভীষণ ভয় লেগে গেছিল। মনে হচ্ছিল ওরা আমাকে টেনে কোথাও নিয়ে যাবে”।

একজন লোক একগাদা মালা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল বিক্রির জন্য। তীর্থ বলল “লাগবে না বলেছি তো”।

অদিতি লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল “কিছু লাগবে না দাদা। প্লিজ যান”।

লোকটা বিমর্ষ মুখে হাঁটতে শুরু করল।

তীর্থ ডাকল “আচ্ছা শুনুন। একটা হার দিয়ে যান।“

অদিতি বলল “লোকটার জন্য কষ্ট লাগল?”

তীর্থ বলল “হু”।

অদিতি কিছু বলল না। তীর্থ একটা হার কিনে অদিতিকে দিয়ে বলল “এ নাও। পরবে”।

অদিতি বলল “ঠিক আছে”।

তীর্থ বলল “তুমি ওভাবে আতঙ্কিত হয়ে গেছিলে কেন বলবে? অসুবিধা থাকলে বোল না”।

অদিতি মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বলল “সাগ্নিকের ফ্ল্যাটে সেদিন একটা ছোট গ্যাদারিং ছিল। ওর তিন চারজন কলিগ, বস এটসেট্রা। ড্রিংক্সের সঙ্গে কিছু একটা মিলিয়ে দিয়েছিল আমায়। ঘোর ভেঙে দেখি আমার সঙ্গে ওর বস শুয়ে আছে। আমার গায়ে কিচ্ছু নেই। কোনরকমে উঠে ওকে ধরলাম। আমাকে ও বোঝাতে শুরু করল এগুলো খুব ন্যাচারাল। সামনেই একটা প্রোমোশন পাওয়ার চান্স আছে ওর। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যাকে আমি এত ভালবাসি সে আমাকে এরকম… মানে…”

অদিতি চুপ করে বসে কাঁদতে লাগল।

তীর্থ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উঠে চলে গেল।

মিনিট দশেক পরে একটা প্লেট এনে অদিতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “অমলেট। খেয়ে নাও”।

অদিতি হাতে নিল প্লেটটা।

সমুদ্রের হাওয়া এসে তাদের চোখে মুখে ঝাপটা মারছে। তীর্থ চোখ বন্ধ করে বলল “জিভটা বের করে হাওয়া টানার চেষ্টা কর। দেখবে জিভে নুন এসে লাগবে। আমার বেশ মজা লাগে এটা”।

অদিতি জিভ বের করল।

তীর্থ বলল “এবার আকাশের দিকে তাকাও। দেখো সব তারা দেখা যাচ্ছে। ঐ যে সপ্তর্ষিমন্ডল। কালপুরুষ। কালপুরুষের বেল্টটা দেখো। আমাকে ছোটবেলায় বাবা এই তারা দেখা শিখিয়েছিল। কাল তুমি যখন চলে গেলে, আমি অনেকক্ষণ বসে থেকে তারা দেখছিলাম। অন্য কোন দিকে তাকাই নি। শুধু তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করবে না আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন টাইম ট্রাভেল করছি। যেন সেই ছোটবেলায় ফিরে গেলাম। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দেখো”।

অদিতি আকাশের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার কাঁদতে শুরু করল।

তীর্থ বলল “তুমি ছোটবেলায় ফিরতে চেষ্টা কর অদিতি। মাঝের সময়টাকে ডিলিট করে দাও বরং মাথা থেকে। ডিলিট করা কঠিন আমি জানি, তবু চেষ্টা কর। একদিন না একদিন বেরোবেই। পৃথিবীর দু একজন পুরুষের জন্য সব পুরুষ খারাপ হয়ে যায় না জানো তো? সব কিছুর এত সরলীকরণ করলে হবে? এই পুরুষ যেমন ধর্ষণ করে, এই পুরুষই কিন্তু ধর্ষিতাকে রক্ষা করে। যে ছেলেগুলো ওখানে কাঁকড়া বিক্রি করছিল, যাদের তুমি এত ভয় পেলে, ওদের কথা শুনেছো? তিলতিল করে টাকা জমিয়ে ওরা একটা ঘর বানিয়েছিল। একটা ফণী এল, সব হারিয়ে গেল ওদের। কোনমতে প্রাণে বেঁচে আবার শূন্য থেকে শুরু করল। সরকারি ত্রাণ এখনও এসে পৌছয়নি। কাঁকড়া, ঝিনুক ভাগে চাষ করে জীবন কাটায়। আমাদের গোটা নৌকোটা আঠেরোশো টাকা ভাড়া নিয়েছে যারা, তারা মাঝিকে সারাদিনে মাত্র একশো টাকা দেয়। মাঝির মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমরা এদের শুধু পুরুষ হিসেবেই দেখব? এরাও মানুষ। সিজনে ক’টা টাকার জন্য এরকম জীবন কাটাচ্ছে। তোমার ভয়ের কারণটা বুঝেছি, কিন্তু সব সময় গুটিয়ে থাকাই কি জীবন? বেরনোর চেষ্টা কর। আমি জানি তুমি পারবে”।

অদিতি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে বলল “তুমি আমাকে ঘেন্না করছ?”

তীর্থ বলল “ধুস! ঘেন্না করার কী আছে? একটা ফালতু ছেলের জন্য একটা মেয়ে খারাপ হয়ে যাবে? এত সোজা নাকি? হতে পারি আমি সেলফিস ছেলে, কিন্তু এই মিনিমাম বোধটা বোধ হয় আমার আছে। আর ইয়ে, অমলেটটা ঠান্ডা হয়ে গেলে কিন্তু ভাল লাগবে না”।

অদিতি চামচ দিয়ে অমলেটটা কেটে কেটে খেতে শুরু করে বলল “তুমি খাবে না?”

তীর্থ বলল “খাব। তুমি তখন আমাকে দেখে নৌকো থেকে নেমে যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে শুরু করলে আমার পেট ভরে গেছে”।

অদিতি চামচটা ছুরির মত তীর্থর গলায় ধরে বলল “বার বার এবার এই কথাটা তুললে একদম মেরে ফেলে দেব কিন্তু। আমার তখন ভয় লেগেছিল”।

তীর্থ হাসতে হাসতে বলল “হ্যাঁ বুঝেছি তো। কত বীরাঙ্গনা দেখলাম আজ”।

অদিতি গম্ভীর হয়ে বলল “আমায় অমলেট খেতে দাও। অমলেট খাবার সময় ফালতু বকা আমার ভাল লাগে না”।

তীর্থ বলল “বলছিলাম কী, আমার না এই চুক্তির বিয়ে টিয়ে আর পোষাচ্ছে না। একটা এক্সপেরিমেন্ট করাই যায় কী বল?”

অদিতি জিজ্ঞাসু চোখে বলল “কী রকম?”

তীর্থ বলল “এই যে, মানে সংসার করলে কেমন হয়। ধর একজন সেলফিস ছেলে, মানে তোমার কথা অনুযায়ী, আরেকজন দাগা পাওয়া মেয়ে… মন্দ হয়?”

অদিতি একটু ভাবার ভান করে বলল “শর্ত আছে একটা”।

তীর্থ বলল “কী?”

অদিতি বলল “সুপর্ণার ব্যাপারে আমি লেগ পুল করতে পারব, তুমি কিন্তু সাগ্নিককে নিয়ে আমার লেগপুল করতে পারবে না”।

তীর্থ অসহায় ভঙ্গিতে বলল “মাইরি এ কেমন শর্ত? মানে লেগপুল না করলে হবে না?”

অদিতি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল “না হবে না। আমার লেগপুল করতে হেব্বি লাগে। আর হ্যাঁ, হানিমুনে এসে প্রথমবারে অমলেট একা একা মেরে দেওয়াটা নিয়ে তো সারাদিন কথা শোনাব”।

তীর্থ ছদ্ম ক্ষোভে বলল “ঠিক আছে”।

অদিতি একটু চুপ করে থেকে হি হি করে হেসে বলল “মাইরি কত নাটক! চুক্তির বিয়ে, এই বিয়ে, সেই বিয়ে, শেষে ঘুরে ফিরে সেই থোড় বড়ি খাড়া বিয়েই হয়ে গেল”!

তীর্থ অদিতির একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে সিরিয়াস মুখে বলল “আমার একটাই দাবী”।

অদিতি গম্ভীর হয়ে গেল “কী? আবার কী দাবী?”

তীর্থ ফিক করে হেসে বলল “আজ আবার তুমি বিয়ার খেও। ঠিক আছে?”

অদিতি তীর্থর হাতে চাপ দিয়ে বলল “ধ্যাত!”

সমুদ্রের জল বাড়ছে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে।

হোটেলে তারা আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরল।

ডিনার দিতে এসে ছেলেটাও ফিরে গেল।

দরজার ভেতরে কী হল, সেসব আর জেনে কাজ কী?

আমরা বরং আমাদের কাজ করি।

কী বলেন?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *