দ্বিতীয় পর্ব– মদির আলোর তাপ
১।
বিনোদিনী ছেড়ে চলে যাবার পরে স্টারের আর সেই বাড়বাড়ন্ত নেই। কিন্তু মরা হাতি লাখ টাকা। এখনও মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন অর্ধেন্দু মুস্তাফি, দানীবাবুরা। গিরিশ ঘোষ নিজে খুব পান-বিড়ির দোকান, গোপন মদের আড্ডা, দেওয়ালে কালি, ঝুল, কিছুই গা করেন না। আগে কম অভিনয় করেন। নাটক লেখা, পরিচালনাতেই আজকাল বেশি ঝুঁকেছেন। স্টারের গা ঘেঁষে দেওয়ালে পোস্টার মারার নিজস্ব স্থান ছিল। এখন একপাশের দেওয়াল জুড়ে অন্নদামঙ্গল-এর পোস্টার সাঁটা। তারিণী থিয়েটারের পাঁচপেঁচি লোকেদের বিশেষ পছন্দ করে না। আগে তাও শখ হলে যেত, আজ কিন্তু শৈলর সঙ্গে যা হয়েছিল, তা দেখার পর আর থিয়েটারে যাবার প্রবৃত্তি হয়নি। বহুদিন পরে নেহাত প্রয়োজনে তাকে এ পাড়ায় আসতে হল।
দুপুরের থেকেই স্টারে কলাকুশলীরা সবাই আসতে শুরু করে। মহলা হয়। ভিতরের আপিসঘরে রোজকার কাজকর্ম চলে। থিয়েটার হোক না হোক সবাইকে রোজ হাজিরা খাতায় সই করতেই হবে, এমনটাই ভুনিবাবুর নির্দেশ। ভুনিবাবু, মানে অমৃতলাল বসুর হাতে পড়ে ইদানীং স্টার আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সব কিছু চলছে ঘড়ির কাঁটার তালে। তারিণী স্টারের পিছনের দরজার সামনে এসে খানিক ইতস্তত করল। আগে কোনও দিন এই পথে ভিতরে ঢোকেনি কিন্তু নিরুপায়। দরজা খুলে খাটো ধুতি পরা একজন বার হতেই তারিণী তাকে জিজ্ঞেস করল, “ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে একটু দরকার। তিনি এয়েচেন?”
“ও বাবা! তিনি না এলে কি আর এস্টার থিয়েটার চলে নাকি?
একেবারে সোজা নাকবরাবর চলে যান। গিরিন রুমের পাশেই ম্যানেজারের ঘর। ভিতরে গুটিগুটি পায়ে ঢুকল তারিণী। চারিদিকে হেলান দেওয়া সেটের অংশ। রাংতা মোড়া তলোয়ার, জারিরর গয়না ছোদা করে রাখা। ম্যানেজারের ঘরের উপরেই বড়ো করে অমৃতলালের নাম খোদাই করা। দরজা হাট করে খোলা। অমৃতলাল আলবোলার নলে মুখ লাগিয়ে তামাক টানতে টানতে চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সি এক অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন।
“কাল তোর মহলা দেখলাম, সবার সামনে বলিনি, কিন্তু ওটা কী করছিস?”
“কেন, ভুল হল কোতায়?”
“আহ! এত বয়স হল, তবু তোর এই ত-এর দোষ কাটল না? কোতায় না রে বেটি, কোথায়, কোথায়!”
“আচ্চা, কোঠায়। এবার বলুন দিকি।”
আলবোলার নল সুদ্ধু মাথায় হাত ঠেকালেন অমৃতলাল, “তোকে শেখানো শিবের অসাধ্য। ভাগ্য ভালো তোর মুখে কোনও ডায়লগ নেই। কিন্তু চারুশীলার “আমার হৃদয়দোলা দোদুল দোলে” গানে তুই ওর পাশে ওটা কী নাচছিস? কিস্যু হচ্ছে না। আর-একবার দেখা দেখি তোর হৃদয়দোলা কেমন করে দোলে।”
মেয়েটা শুরু করতেই এক লাফে চেয়ার থেকে উঠে অমৃতলাল নিজেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে দুলে দুলে নাচতে শুরু করলেন। তারিণী অবাক হয়ে লক্ষ করল সদ্যযুবতিটির চেয়ে প্রৌঢ় অমৃতলালের দেহের লাস্য যেন অনেক বেশি সরস হয়ে ফুটে উঠছে।
“বুঝলি, একেই বলে হৃদয়দোলা, এবেলা শিখে নে, নইলে…কে? কে তুমি?”
শেষ কথাটা তারিণীকে উদ্দেশ্য করেই বলা।
“আজ্ঞে আমার নাম শ্রীযুক্ত তারিণীচরণ রায়। বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে আসা।”
“তা বেশ। ভিতরে এসো। খেদি তুই যা গে। হৃদয়দোলা প্র্যাকটিস কর। আমি এক ঘণ্টা বাদে পরীক্ষা নেব।”
তারিণী ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়েই রইল। অমৃতলালের টেবিলে একগাদা কাগজপত্র ছড়ানো। একপাশে আলবোলার নল, অন্যদিকে একটা চৌকো কাটলার, পামারের হুইস্কির বোতল। আকাশে সন্ধ্যার রং লাগলেই খোলার অপেক্ষায়।
“তুমি বসতে পারো।”
“আজ্ঞে না। বসতে আসিনি। এসেছিলাম আমার এক বন্ধুর খোঁজে। আপনি চেনেন। শৈলচরণ সান্যাল।”
নাম শোনা মাত্র অমৃতলাল প্রায় শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন।
“চুঁচড়োর শৈল? সেই অক্ষয় সরকারদের দলে ছিল। কলকাতায় এসে কিছুদিন ন্যাশনালে কাজ করেছিল। হ্যাঁ, তাকে চিনি বই কি। এই তো গতকালই আমার কাছে এসেছিল। সন্ধেবেলা।”
“গতকাল? আপনি ঠিক জানেন? গত পরশু নয় তো?”
“পরশু? হ্যাঁ হ্যাঁ, তবে তাই হবে। মানে যেদিন সন্ধের পরে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়েই আমার কাছে এসেছিল। হ্যাঁ, এবার আমার স্পষ্ট মনে পড়েছে। আসলে মাতাল মানুষ কিনা, দিনকাল গুলিয়ে যায় আজকাল”,হাসতে হাসতে বলেন অমৃতলাল।
“কেন এসেছিল বলতে পারেন?”
“হ্যাঁ পারি। এসেছিল অদ্ভুত এক দাবি নিয়ে। তুমি ওর বন্ধু। নিশ্চয়ই জানো, স্টারের জন্য ও ইদানীং একটা প্যান্টোমাইম লিখেছিল।”
এই খবরটা তারিণীর কাছে নতুন। সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। তারিণীর মুখ দেখেই অমৃতলাল সেটা বুঝলেন
“জানতে না। তাই তো? তোমাকে বলেনি হয়তো। একবারে চমকে দিতে চাইছিল। এই তো পরশুদিনই কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে”, বলে স্টেটসম্যানের একটা পাতা এগিয়ে দিলেন তারিণীর দিকে। এই বিজ্ঞাপন তারিণীর চেনা। একটু আগেই দেখেছে।
“একাকার প্রহসন তাহলে শৈলর লেখা?”
“হ্যাঁ। আর কী দারুণ লিখেছে ভাবতেই পারবে না। ছোকরার লেখার হাত একেবারে বাঁধিয়ে রাখার মতো। শুধু একটু খামখেয়ালি এই যা। নইলে এত বড়ো সুযোগ পেয়েও কেউ হেলায় হারাতে চায়?”
“কেন? কী হয়েছে?”
“এই দ্যাখো আসল কথাটাই তোমাকে বলা হয়নি। সেদিন বাদলা করেছিল, তাই সবাই আগে আগে ভেগেছে। আমি একা এই ঘরে বসে কারণবারি সেবন করছি। এমন সময় পুরো ভিজে কাক হয়ে তোমার বন্ধুটি এলেন। বললুম, খানিক বসো। তা তার নাকি বসবার সময় নেই। ফতুয়ার পকেট থেকে একটা থিয়েটারের বই বার করে বললে, এখনও দিন পনেরো সময় আছে, আপনি একাকার ছাড়ুন। এই নাটকটা নামান। বললাম, এটা কী নাটক? বলে, এটাও প্রহসন, কিন্তু ঢের ঢের ভালো। আমি রাজি হইনি। স্টারে এভাবে কাজ হয় না। মাসের পর মাস নাটক পড়ে থাকে। গিরিশবাবু নিজে বেছে দেন। এমন উঠল বাই তো কটক যাই করলে নাটক হয় নাকি?”
“তাতে শৈল কী বলল?”
“সে কি আর মানে? খানিক হাতে পায়ে ধরল। তারপর বলল ‘একাকার’ বন্ধ করে দিতে। আমি বললাম, বাপু, সে নাটক তো তুমি নিজেই দশ টাকায় আমাদের বেচে দিয়েছ। এবার আমাদের পাঁঠা, আমরা গোড়ায় কাটি, কি ল্যাজায়, সে তো আমাদের ব্যাপার। তখন সে বারবার বললে আমি নাকি বুঝতে পারছি না। পরে করলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে।”
“কীসের দেরি?”
“আমিও ঠিক সেটাই জিজ্ঞেস করলাম। বললে একদল লোক নাকি খুব খারাপ একটা কাজ করতে যাচ্ছে। এই নাটক দেখানো হলে তারা ভয় পেয়ে যাবে। এই নাটক আগুনের গোলা, জোঁকের মুখে নুন, আরও কীসব বললে। এই নাটক একবার প্রচারিত হলে তারা নাকি সেই খারাপ কাজখানা করার আগে হাজারবার ভাববে।”
“কী কাজ? কিছু বলেছে?”
“সেইটেই তো ভেঙে বলেনি। বলছিল ভয়ানক খারাপ। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। তবে ও নিজেও খুব ভয় পাচ্ছিল। বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল, যেন কেউ ওকে তাড়া করছে।”
“আপনি কী বললেন?”
“আমি শেষে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, তোমার নাটক রেখে যাও। দিন দুই বাদে এসো। ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছিল। সেই বৃষ্টিতেই বেরিয়ে গেল। আজ অবধি তার টিকিটির দেখা পাইনি। তা তোমাকে কি দূত হিসেবে পাঠিয়েছে?”
“আজ্ঞে তা না। ও আমার সঙ্গেই থাকে। আমার আপিসে। পরশু সন্ধেবেলা বেড়িয়েছে। বলেছিল রাতে এসে একসঙ্গে খাবে। আজ অবধি ফেরেনি। কলকাতায় ওর কোনও বন্ধুও নেই। হাসপাতাল আর মর্গেও খোঁজ নিয়েছি। কোথাও কিছু নেই। তাই…”
“তোমার আপিস? কী করা হয়?”
তারিণী নিজের পরিচয় দিল।
“অ। টিকটিকি। তা পসার কিছু হয়?”
তারিণী সে কথার জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি পড়েছিলেন সেই নাটক?”
“হ্যাঁ। সেই রাতেই পড়েছি। বইখানা ভিজে গেছিল বটে, তবে পড়েছি।”
“নাটক নিয়ে আপনার কী ধারণা?”
“অত্যন্ত সাধারণ মানের নাটক। প্রহসন বলা যায় কি না জানি না। যৌনতার ছড়াছড়ি। তাতে আবার রূপকথা ঢুকিয়ে কী যে করতে চেয়েছে ঈশ্বরই জানেন। আমার মতে এটা ওর লেখা সবচেয়ে দুর্বল নাটক। আমি তাও রেখে দিয়েছিলাম, গিরিশবাবুকে দেখাব বলে। কিন্তু কোথায় যে রাখলাম। কাল থেকে আবার খুঁজে পাচ্ছি না। আসলে নেশার ঘোরে… যাই হোক। এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। গিরিশবাবু এই নাটক দেখলে ছুড়ে ফেলে দিতেন।”
“দেখুন তো এই সেই নাটক কি না?” পকেটে করে একটা বই নিয়েএসেছিল তারিণী। সেটাই বার করে দেখাল।
“দেখি? হ্যাঁ, এটাই তো। পুষ্পসুন্দরীর পালা। একেবারে খাজা নাটক ভাই। কিছু মনে কোরো না। আর তোমার বন্ধুর কোনও খোঁজ পেলে জানিয়ো। বলবে, একাকার হবেই। ও যেন আমার সঙ্গে এসে কথা বলে। ওকে দিয়ে অন্য নাটক লেখাব। এইসব পুষ্প-টুষ্প চলবে না।”
“অবশ্যই। আর এই ছবিটা আপনি আগে দেখেছেন?”
“কই দেখি?” মন দিয়ে উলটেপালটে ছবিটা দেখলেন অমৃতলাল। তারপর হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “বাপের জম্মে না। কেন, এ ছবির কী তুক?”
“না এমনিই”, বলে ছবি ফেরত নিয়ে তারিণী বেরোতে যাচ্ছে, এমন সময় অমৃতলাল পিছন থেকে ডাকলেন।
“জিজ্ঞাসা করব করব করেও করতে পারছিলাম না। এখন ভাবছি করেই ফেলি। তুমি ওর এত কাছের বন্ধু যখন নিশ্চয়ই জানবে। ন্যাশনালে শৈলর সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল?”
তারিণী ঘুরে দাঁড়ায়। থিয়েটারপাড়ায় এসেছে আর এই প্রশ্ন আসবে না তা হতেই পারে না। সামান্য কাষ্ঠহাসি হেসে তারিণী বলল, “শৈলকে তো দেখেচেন। শরীর পুরুষের মতো হলেও মনটা একেবারে নারীদের মতো। ভগবান নারী বানাতে গিয়ে শেষ ওকে পুরুষ করে ফেলেছেন। বিধাতার ভুল। কিন্তু সে কথা সবাই মানলে তো! ন্যাশনালে একদিন রাতে তিন-চারজন পুরুষ অ্যাক্টর মিলে ওকে পুরুষ বানাতে গেচিল। তারা কেউই আজ আমাদের মদ্যে নেই। তাই নাম উল্লেখ করেও বিশেষ লাভ নেইকো।”
“বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এ যে ধর্ষণের নামান্তর!”
“নামান্তর কীসের? ধর্ষণই বলুন।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? শৈল ন্যাশনালের মাথাদের জানায়। তাঁরা বিচারসভা বসান। বিচারে সাব্যস্ত হয় শৈলই নাকি থিয়েটারের পরিবেশ নষ্ট করছে। ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর কিছু জানার নেই নিশ্চয়ই। আজ আসি তবে।” তারিণী যখন দরজা দিয়ে বেরোচ্ছে, তখনও অমৃতলাল অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে। হাতের আলবোলাতে টান দিতেও ভুলে গেছেন।
২।
শোভাবাজারের মোড় থেকে সামান্য এগিয়ে বাঁহাতি দক্ষিণ-পূবে গেলেই বটতলা এলাকার শুরু। প্রথমে লোহার সিন্দুক, তস্কর-প্রতিরোধক আলমারির দোকান পেরিয়ে বাঁ হাতেই সোনাগাজির সেই কুখ্যাত গলি। বছর চারেক আগে এই গলিতেই বেশ কয়েকবার আসতে হয়েছিল তারিণীকে। সেই গলির মুখেই ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে জনাকয়েক বেশ্যা। যেন কারও অপেক্ষায় সবে সন্ধ্যা হয়েছে। রাত বাড়লে ধীরে ধীরে এরা ঢুকে যাবে নিজের নিজের খোলায়। বাবুদের সঙ্গে। আপিসফেরতা কিছু বাবু খুব নিবিষ্টমনে এক- একজনকে দেখতে দেখতে চলেছেন। পাকা বাজারু যেভাবে মাছ দ্যাখে। পছন্দ হলে এগিয়ে গিয়ে কানকো তুলে দরদাম করার মতো পাই পয়সার হিসেবটুকু বুঝে নিচ্ছেন। তারিণীর এসবে বেশ অস্বস্তি হয়। সে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। সেখানে আবার আর-এক দৃশ্য। একদিকে ছোটো ছোটো পাইকারি আর খুচরা বই বিক্রির দোকান, পিছনে হাতে চালানো ট্রেডল প্রেস, আর অন্যদিকে যাত্রার দল, অপেরা, হাফ আখড়াই, পাঁচালি পোড়োদের আস্তানা। এই গরমে কেউ আর ঘরে বসে নেই। সবাই রাস্তায় বসে গজল্লা করছে। কেউ বা আড়ঠেকায় রসের গান ধরেছে-
এই দেখাই শেষ দেখা হল আমার ওগো চারুশীলে।
চলিলাম জনমের মতো মনে রেখো অনাথ বলে।।
দুই-তিনজন সমঝদার পাশে বসে আহা আহা করছে। চিৎপুরের এই যাত্রা দলের অফিসগুলোর ডান হাতে নিমাইচরণ গোস্বামীর বিরাট বাড়ি। বলরামের রাস উৎসবে নিম্ন গোস্বামীর বাড়ি প্রসাদ পেতে ফি-বছর আসে তারিণী। এই গলি পেরোলেই গরানহাটা। নিমতলার কাঠ দিয়ে অক্ষরের ডালা, ব্লক, তৈরি করে বাড়ির মেয়ে বউরা। এখানেই কোথাও সেই প্রেস থাকার সম্ভাবনা। তারিণী এগিয়ে গিয়ে এক প্রেসে জিজ্ঞেস করল, “ভাই এখানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রেস কোনটা? ৯১ নম্বর বাড়ি?”
লোকটি ছোকরা এবং কিছুটা তেরিয়া গোছের। গ্যালি সাজানোর কাজ বন্ধ রেখে খ্যাঁক করেই জিজ্ঞেস করল, “কেন? ওই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানই কেন দরকার? আমরা দেশি লোকরা ভালো কাজ পারিনে বুঝি? নাকি ওই আধাফিরিঙ্গি ট্যাঁশদের গায়ের গন্ধ থাকলে বইয়ের মান বাড়ে? কী কাজ করাবেন বলুন। এই গোটা গরানহাটায় আমাদের ক্রাউন লাইব্রেরির ধারেকাছে কেউ নেই।” তারিণী মাথা গরম করল না। বলল, “আজ্ঞে সে তো নিশ্চয়ই। ক্রাউন লাইব্রেরির নাম কে না জানে? তবে আমার দরকার অন্য। আমার এক বন্ধু ওই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে কিছু বই ছাপিয়েছিল। টাকা পুরো নিয়েছে, বই কম দিয়েছে। এসেছিল, ওকে ভাগিয়ে দিয়েছে। তাই আমাকে পাঠাল।”
“তাই বলুন”, এতক্ষণে তারিণী লোকটার মন পেল। “এ তো জানা কথা ওইসব অজাত কুজাতের লোক দিয়ে কি আর ভালো কাজ হয়? আপনার বন্ধুরও বলিহারি। আর প্রেস পায়নি? আমাদের কাছে এলে আমরাই কম দামে ভালো কাজ করে দিতুম।”
“আজ্ঞে প্রেসটা কোথায় যদি বলতেন…’
“একটু এগিয়ে যান। খানিক বাদে রাস্তা বাঁদিকে বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখে হাটখোলার দত্তদের আটচালা শিবমন্দির। ঠিক তার উলটো দিকের রাস্তায় দুটো বাড়ির পরেই ৯১ নম্বর। ভালো করে ধমকে দেবেন। আর আপনার কিছু ছাপানোর থাকলে আমাদের কাছে আসবেন। মনে রাখবেন ক্রাউন লাইব্রেরি।”
কোনওমতে নমস্কার করে দ্রুত এগিয়ে গেল তারিণী। ৯১ নম্বর খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। অন্য প্রেসের চেয়ে আকারে একটু বড়ো। ভিতরে বিদ্যুতের আলোতে ঝলমল করছে। একটু চমকে গেল তারিণী। এত প্রেস থাকতে এখানেই বই ছাপাতে হল? প্রেসের ভিতরে ট্রেডল মেশিনের ঘটাং ঘটাং শব্দ চলছে। সামনে একটা টেবিলে বসে গ্যালি প্রুফ দেখছেন এক ফিরিঙ্গি। তারিণীকে দেখেই মুখ তুলে একগাল হেসে অভ্যর্থনা করলেন।
“ওয়েলকাম বাবু। কাম ইন। আসেন আসেন। বলেন কী দরকার?” সাহেব তাহলে বাংলাটা ভালোই শিখেছেন বোঝা গেল।
“আজ্ঞে সাহেব, আমার নাম শ্রীযুক্ত তারিণীচরণ রায়। আমি এসেছিলাম একটা খোঁজ নিতে।”
“বলেন বলেন। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?”
পকেট থেকে বইটা বার করে সাহেবের হাতে দিল তারিণী। “এই বই আপনাদের প্রেস থেকে ছাপা?”
বই হাতে নিয়েই সাহেবের হাসি হাসি মুখ এক নিমেষে গম্ভীর হয়ে গেল। যেন কোনও আগুনের গোলা ছুঁয়ে ফেলেছেন এমনভাবে দ্রুত বইটা তারিণীর হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, “ইয়েস। নাও হোয়াট হ্যাপেনড এগেইন?”
“কেন সাহেব? কী হয়েছিল?”
“আপনি এই রাইটারকে চিনেন?”
“চিনি।”
“ইয়োর ফ্রেন্ড?”
“না। পরিচিত। কেন?” মিথ্যে বলল তারিণী।
“আপনি তাহলে এখানে এসেছেন কেন?”
“আমার একটা বইয়ের দোকান আছে। চিৎপুরে। যাত্রার বইয়ের। সেদিন ও আমাকে একশো কপি বই বেচে দাম নিয়ে গেছে। এখন দেখছি একটা বই কম। ও বলল আপনারা নাকি এক কপি বই নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছেন। তাই জানতে এলাম।”
“দেন আই মাস্ট সে, বি অ্যাওয়ার অফ হিম।”
“সে কী! কেন?”
“ভেরি ডেঞ্জারাস ম্যান। কিছুদিন আগে আমার কাছে এসে বলল এক রাতের মধ্যে ওর একটা প্লে ছেপে দিতে হবে। আমি বললাম ইমপসিবল। বলল পসিবল করতে হবে। আর্জেন্ট। তাও রাজি হলাম। বললাম তিরিশ টাকা লাগবে। ও বলল এক পয়সা দেবে না। দেন হি থ্রেটেনড
“থ্রেট? কী নিয়ে?”
“লুক বাবু। আপনারও বইয়ের দোকান আছে। আপনি বুঝবেন।এই পাড়ায় বিজনেস করতে গেলে স্ট্রেট ওয়েতে সবসময় হয় না। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের তো আরও মুশকিল। তাই কিছু টুইস্ট অ্যান্ড টার্ন আমিও করেছি। আনফরচুনেটলি হি নোজ দ্যাট।”
“বাট হাউ?”
“দ্যাট আই ক্যান নট টেল ইউ। জাস্ট আউট অফ ফিয়ার আমাকে এক রাতের মধ্যে এই প্লে প্রিন্ট করে দিতে হয়েছে। শুধু এটা বলি হি ইজ নট আ কমন ম্যান। একটা বড়ো গ্যাং আছে ওর পিছনে। দ্যাটস অল। আর কিছু আস্ক করবেন না প্লিজ।”
“আচ্ছা। এই যে বিলটা, এটা আপনাদেরই তো?”
“শিওর। দ্যাট সান অফ আ বিচ একটা পয়সাও না দিয়ে আমাকে দিয়ে এই বিল করিয়েছে। ইফ আই গেট হিম ইন হ্যান্ড…”
“তাহলে এই বইয়ের একটাও কপি আপনাদের কাছে নেই?”
“নো। নেভার।”
“আচ্ছা চলি”, বলে উঠে এল তারিণী। সবকিছু কেমন ধোঁয়াটে লাগছে। এই সাহেব যা বললেন, তা যদি সত্যি হয়, তবে শৈলকে সে আজ অবধি চিনতে পারেনি। কিন্তু এই সামান্য একটা নাটককে নিয়ে এত বাড়াবাড়িই বা সে করছে কেন কে জানে! গোটা রাস্তা ভাবতে ভাবতে চলল সে। এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবের কী এমন গোপন কথা থাকতে পারে, যা শৈল জেনে ফেলেছিল? আর জানলই বা কী করে? এই শৈলকে সে চেনে না। এতদিন একসঙ্গে থাকার পরেও না।
প্রেস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জোড়াসাঁকো, আদি ব্রাহ্মসমাজ পেরিয়ে এল তারিণী। আর-একটু এগিয়ে গেলেই চোরাবাগান আর্ট স্টুডিও। তারিণী যাবে আর-একটু উত্তরপানে। বউবাজারে ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও অন্নদাপ্রসাদ বাগচী মশাই এই স্টুডিও তৈরি করার পরে এখন কলকাতা তো বটেই, ভারতের অন্যতম সেরা ছাপাই ছবি এখানেই বানানো হয়। সেখানে গিয়ে বিশেষ কাজ হল না তারিণীর। অন্নদাবাবু ছিলেন না। তাঁর প্রধান সাগরেদ নবকুমার বিশ্বাস আর ফণীভূষণ সেন এত ব্যস্ত যে কথা বলার সময় নেই। তারিণীর হাতের সেই ছবিটি কে ছাপতে দিয়েছে, কবে দিয়েছে, এই বিষয়ে কেউ একটি কথাও বললে না। নবকুমার শুধু জানালেন, সেখানে কমিশনড কাজ যিনি করাতে দেন, তিনি চাইলে তাঁর নাম গোপন রাখা হয়। এক্ষেত্রেও তাই। ফলে তাঁরা নিরুপায়। বাকিদের জিজ্ঞেস করেও সুবিধে হল না। সবাই যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।
রাত অনেক হল। তারিণী জানে প্রিয়নাথ অনেক রাত অবধি লালবাজারে থাকে। তাকে একবার জানানো প্রয়োজন। যথারীতি প্রিয়নাথ নিজের কামরাতেই ছিল। লালবাজারে ইদানীং বিদ্যুতের সংযোগ হওয়াতে রাতেও কাজ চলে। তারিণী সমস্ত ঘটনা জানাল প্রিয়নাথকে। প্রিয়নাথ মন দিয়ে। শুনল। পাশেই একটা কাগজে প্রেসের ঠিকানাটাও লিখে নিল।
“আচ্ছা, আজ তুমি যাও। আমি দেখছি শৈলর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় কি না।”
তারিণী যাবার আগে প্রিয়নাথের হাতে একটা পাতলা বই ধরিয়ে বলল, “আমি জানি আপনি সাহিত্য পছন্দ করেন। এটা পড়ে দেখবেন। পারলে আজ রাতেই।”
“কী এটা? সেই নাটক? দিয়ে যাও তবে। কিন্তু পড়ার জন্য এত তাড়া কীসের হে?”
“আজ্ঞে তাড়া তো আচেই। শৈলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্চে না। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। যদি এই বইতে কোনও সূত্র খুঁজে পান। আমি চাই আপনি এই বই পড়ুন। বিলম্বে যদি কোনও বিপদ ঘটে।”
“কী বিপদ?”
“আজ্ঞে শৈলর বিপদ।”
“এ নাটক তুমি পড়েছ?”
“পড়েছি বলেই বলচি। সাদা চোকে যা মনে হয় এ বই তেমন বই না। তবে আমি মুখ্যু
মানুষ। ভুল করতে পারি। আপনি একবার পড়ে দেখুন।” তারিণী বইখানা প্রিয়নাথের হাতে দিল। প্রিয়নাথ বই উলটেপালটে দেখে বলল, “যাও তবে। সাবধানে যেয়ো। ভিতরের এই ছবিটাও থাক। আর বইয়ের পিছনে এই লাল পেনসিলের চিহ্নটা কীসের?”
“আজ্ঞে ওটা আমার বদ অভ্যেস। বই পড়া হয়ে গেলে পিছনে একটা চিহ্ন দিয়ে রাখি।”
“তোমার এটা পড়ে কী মনে হয়েছে বলবে না?”
“আজ্ঞে আপনি আগে পড়ে নিন। কাল আমি আবার আসব। আমার ধারণা তখনই আপনাকে বলা যাবেখন।”
নিজের আপিসে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল তারিণীর। শহরের পেটা ঘড়িতে নয়বার ঢং ঢং শব্দ হল। ক্লাইভ স্ট্রিট প্রায় নির্জন। মাঝেমধ্যে দুই-একটা ছ্যাকরা গাড়ি, ব্রহাম ছুটে যাচ্ছে। তারিণীর অফিসের ঠিক সামনের ল্যাম্পপোস্টের বাতিটা খারাপ হয়েছে বেশ কদিন হল। এতদিন সমস্যা হয়নি। সে রাতের আগেই ঘরে ফিরেছে। আজ তালায় চাবি ঢোকাতে সমস্যা হবে। দরজার কড়ায় হাত পড়াতে চমকে তারিণী। তালা নেই। দরজা ভেজানো।
তাহলে কি শৈল ফিরে এল?
“শৈল শৈল” করে বার দুই ডাকল তারিণী। কোনও উত্তর এল না।
খুব ধীরে ধীরে দরজার পাল্লা দুটো খুলে দিল সে। আর দিতেই প্রচণ্ড জোরে একটা ধাতব আঘাত লাগল তারিণীর মাথায়। তারপর তার আর কিছু মনে নেই…..