পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

দ্বিতীয় পর্ব- গৌরবের লক্ষ মুসাফের

দ্বিতীয় পর্ব- গৌরবের লক্ষ মুসাফের

“আমি এখন তোমাকে যা যা বলব, তুমি শুনতে প্রস্তুত তো?”

এত কিছুর মধ্যেও আমার হাসি পেল। গত দু-তিন দিন ধরে আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, ঘটছে, তারপরে আর কিছুতেই অবাক হচ্ছি না। সিরিয়াসলি। অপর্ণা গুহ আমার প্রেমিকা উর্ণার দিদি, দেবাশিস গুহ আসলে ডিব্যাসি, উর্ণার বাবা নিজের প্রাক্তন জামাইকে খুনের দায়ে পুলিশের কাছে বন্দি, বিশ্বজিৎ এমন কিছু জেনে গেছিল যার জন্য ওইভাবে খুন হতে হল তাকে। তাও কীভাবে? না, যেভাবে একশো বছর আগে শৈলচরণ খুন হয়েছিল। কে শৈলচরণ? আমার প্রপিতামহের বন্ধু। সবকিছু ঘুরেফিরে আমার কাছেই চলে আসছে, আর আমি ভ্যাবলার মতো সবকিছু দেখে চলেছি। গোয়েন্দাগিরি অনেকটা ডাক্তারির মতো। অন্যের রোগ হলে সারাতে ভালো লাগে। কিন্তু নিজে তাতে জড়িয়ে গেলে চরম অস্বস্তি হয়। আমি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। উর্ণার বাবাকে গতকাল পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আজকে বেইল পাবার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। ভেবেছিলাম আমিও সঙ্গে থাকব। থাকলে হয়তো উর্ণা মনে একটু জোর পেত। কিন্তু সেটা হল না।

সাতসকালে অধীশ বিশ্বাসের ফোন এল, “খুব জরুরি দরকার। এখুনি চলে এসো আমার বাড়িতে। ব্রেকফাস্ট এখানেই করবে।”

“আসলে অধীশদা, কাল সারারাত তেমন ঘুম হয়নি। ভাবছিলাম…”

“আমিও সারারাত ঘুমাইনি। শৈলচরণের সেই নাটক… ভাবতেও পারছি না কী ভয়ানক…. উফফ……”

“কেন, কী হয়েছে অধীশদা?”

“সব কথা ফোনে বলা যাবে না। তুমি এসো তাড়াতাড়ি।” বলেই ফোন রেখে দিলেন।

আমিও ঊর্ণাকে বলে অধীশদার বাড়ির দিকে বাইক ছোটালাম। আসলে এখানে আমার তেমন কোনও জরুরি কাজ নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল, উর্ণার বাবার প্রেপ্তারের সঙ্গে ওই নাটকের একটা কানেকশান থাকলেও থাকতে পারে। রাস্তায় ভিড় বেশি নেই। সাড়ে আটটার মধ্যে অধীশদার বাড়ি পৌঁছে গেলাম।

দরজা খুললেন অধীশদা নিজেই। দেখেই বুঝলাম রাত জাগার কথাটা মিথ্যে না। চোখ লাল, চুল উশকোখুশকো। তাঁর স্ত্রী বুঝি রান্নাঘরে ছিলেন। গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আমাকে প্রায় হাত ধরে টেনে আগের দিনের সেই বসার ঘরে নিয়ে বসালেন অধীশদা।

“বলুন অধীশদা, কী জন্য ডেকেছেন?”

“সে তো বলবই। কিন্তু তুমি প্লিজ আর-একবার বলো দেখি, এই নাটক ঠিক কীভাবে পেলে তুমি?”

আমি আগাগোড়া সমস্তটা বললাম। কিচ্ছু না লুকিয়ে। এমনকি পো-এর বইয়ের কথাটাও।

“সে বই তুমি এনেছ? কাছে আছে?”

জানতাম এমনটাই হবে। তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। শৈলর বই। পো-র বইয়ের মলাট। অধীশদা খুব মন দিয়ে সেটাকে দেখলেন। পিছনের আঁকিবুকি অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। তবুও দেখা যাচ্ছে। সেটাকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করলেন। বিশেষ করে গোলমতো সিলটাকে। তারপর মাথা উঠিয়ে আমার কাছে জানতে চাইলেন উনি যা বলবেন আমি সেটা শুনতে প্রস্তুত কি না। এইসব প্রশ্নের উত্তর না হয় না। আমি মাথা নাড়তেই অধীশদার মধ্যে আবার সেই মাস্টারিটা ফিরে এল।

“শৈলর লেখা এই নাটকটা আমি বারবার পড়েছি। বুঝতে পারছিলাম কোথাও একটা ব্লু আছে। কিন্তু সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না দেখে ধাঁধার সমাধান হচ্ছিল না। কাল আচমকা বিজ্ঞাপন অংশটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে গোটাটা পরিষ্কার হয়ে গেল।”

“রিভার্স রিড? ওটা পেনসিলে দাগানো আছে।”

অধীশদা দৃশ্যত অবাক হয়ে গেলেন। “তুমি জানো! গ্রেট! এবার বিজ্ঞাপনের প্রতি লাইনের শুরুর অক্ষরটা দ্যাখো। বি-ক-তো-রি-আ। আমার আর কোনও সন্দেহই রইল না। আমি মহারানি ভিক্টোরিয়াকে ক্লু ধরে নাটকের সমাধান করতে বসলাম। কাল সারারাত জেগে সমাধান করেও ফেলেছি।”

“কীরকম?”

সামান্য হেসে একটা সিগারেট ধরালেন অধীশদা। এসব গল্পের গোয়েন্দারা করে। সাসপেন্স বাড়ানোর জন্য। লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন, “রানি ভিক্টোরিয়ার আসল নাম কী জানো? কিংবা ডাকনাম?”

মাথা নাড়লাম। জানি না।

“আলেকজান্দ্রিনা। সংক্ষেপে দ্রিনা। সিংহাসনে আরোহণের সময় তিনি নাম বদলে নেন। তাঁর এ ছাড়াও গোটা দশেক ডাকনাম ছিল। ঠাকুমা তাঁকে ডাকতেন মে-ব্লুম বলে। যার বাংলা ফুলের মতো সুন্দর। পুষ্পসুন্দরী।” এইটুকু বলে অধীশদা খানিক চুপ করলেন। আমি কোনও রি-অ্যাকশান দিই কি না দেখার জন্য। দিলাম না।

“আবার দ্যাখো, রানির অন্য নাম ছিল Duck, মানে হাঁস। আদর করে পরিবারের অনেকে এই নামে ডাকতেন তাঁকে। এবার মলাটের প্রথম লাইন দ্যাখো, ‘হংসকে হত্যা করার কিবা এ কী ছল’। পরিষ্কার বুঝলাম এতদিন গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে যা মিথ বলে মানা হত, সেটা বাস্তবে ঘটেছিল। এবার গোটা নাটক সহজ হয়ে এল। রানির স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট অফ স্যাক্স কোবার্গ অ্যান্ড গোথা। অ্যালবার্ট অর্থ BrIght। এই নাটকের দীপ্তবর্ষ। রানির বড়ো ছেলে রাজকুমার এডওয়ার্ড। মানে ইংরাজিতে Wealth। এখানে ধনবর্মা। নাটকের কম্বুদ্বীপ আসলে জম্বুদ্বীপ। ভারতবর্ষ। যেখানে রানিকে ফ্যামিন কুইন বা দুর্ভিক্ষের রানি বলা হত। এই অবধি নাটক সোজা চলছিল। এবার এল কাপালিক। আমার বিশ্বাস এই কাপালিক কোনও একজন মানুষ না। কোনও গোষ্ঠী। আর কাপালিকের গৃহে যে ধরনের কথাবার্তা চলছে, তাতে আমি যদি খুব ভুল না হই, তবে এই গোষ্ঠী হয় ফ্রিম্যাসন, তা না হলে ম্যাসন ঘনিষ্ঠ কোনও গোষ্ঠী। বড়ো ছেলের সঙ্গে রানির সম্পর্ক ভালো ছিল না। বড়ো নাতি অ্যালবার্ট দ্য ভিক্টর তো পৃথিবীবিখ্যাত এক কেচ্ছায় জড়িয়ে পড়েন। জানো নিশ্চয়ই?” পাশাপাশি মাথা নাড়লাম। জানি না।

“তুমি জ্যাক দ্য রিপারের নাম শোনোনি! রানির নাতি গোপনে এক শপগার্লকে বিয়ে করেন। তাঁদের এক মেয়েও জন্মায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই রানি সেই বিয়ে মেনে নেননি। অ্যালবার্টকে একরকম বন্দি করা হয়। মেয়েটির পাঁচ বান্ধবী এই সন্তানের কথা জানত। সবাইকে একে একে নৃশংসভাবে খুন করা হল। বলা হল, কে এক জ্যাক দ্য রিপার এদের খুন করছেন। পাঁচজন খুন হতেই রিপার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এটা সবাই জানে। যেটা জানে না, তা হল, এর প্রতিশোধ নিতে খোদ রাজপরিবারে রানিকে হত্যার চক্রান্ত হয়।”

“বলেন কী?”

অধীশদা এবার উঠে গিয়ে বইয়ের গাদা হাঁটকে একটা খুব পুরোনো লাল চামড়া বাঁধানো বই নিয়ে হাজির হলেন। “কলেজ স্ট্রিটে সাজেদের সেকেন্ডহ্যান্ড বইয়ের দোকান থেকে বেজায় সস্তায় পেয়েছিলাম। রেয়ার বই। এই দ্যাখো”, বলে বইটা আমার সামনে খুলে দিলেন। বইয়ের নাম “The Secret LIfe of Queen VIctorIa”। লেখকের নামের জায়গায় কোনও নাম নেই। শুধু “A HIstorIan” লেখা।

“বেনামি বই?”

“হ্যাঁ। এবার ছাপার সালটা দ্যাখো। ১৯০১। রানি সেই বছরই জানুয়ারিতে মারা গেছেন। লেখক নিজের নাম জানানোর রিস্ক নেননি। তবে লেখক যিনিই হোন, তিনি হয় ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের কেউ, আর নয়তো এমন কেউ, যাঁর কাছে তখনকার ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের সব খবর ছিল। থ্যাকার অ্যান্ড স্ফিংস থেকে বইটা বেরিয়েছিল। মাত্র একশো কপি। খুব সম্ভব আর এই বই প্রকাশ পায়নি। কোনও ক্যাটালগে এই বইয়ের উল্লেখ নেই। অবশ্য তার কারণও আছে।”

“কী কারণ?”

“এই দ্যাখো। একেবারে শেষ অধ্যায়। The HIdden SpIrIt। এখানে লেখা, ১৮৯৭ সালে রানির জুবিলি অনুষ্ঠানে তিনি স্বয়ং ভারতে আসবেন বলে স্থির হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফ্রিম্যাসনদের এক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে রাজকুমার এডওয়ার্ড নিজে মহারানিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। রানি যতদিন সিংহাসনে থাকবেন, তিনি রাজা হতে পারবেন না। এখন চার্লসের যা দশা। আর ভিক্টোরিয়া তো নিজের সন্তানদেরও রেয়াত করতেন না। সে যাই হোক, ম্যাসনদের হাতে নাকি এমন এক অস্ত্র আসে, যাতে খুনের কোনও প্রমাণ থাকবে না। এখানে সেই অস্ত্রকে বলা হয়েছে spirit, যার একটা মানে মদ বা আরক জাতীয় কিছু। আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু একটু আগে পো-র মলাটটা দেখে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে। স্পিরিট মানে আরক, স্পিরিট মানে সাহস, স্পিরিট মানে নেতা, স্পিরিট মানে উদ্দীপনা, আবার স্পিরিট মানে প্রেতাত্মা, ভূত। এক শব্দের কত মানে! শৈলর ভাষায় ‘হিলি ভূত, বিলি ভূত।”

“তারপর কী হল?”

“ওহ হ্যাঁ। এই আমার এক বদ অভ্যেস। অন্য কথায় চলে যাই। তারপর ঠিক কী হল সেটা এই বইতে নেই। শুধু এটুকু আছে যে এই ষড়যন্ত্র শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ে যায়। কীভাবে, সেটাও বিস্তারিত লেখা নেই। রানির আর এ দেশে আসা হয়নি। আমি গতকাল ন্যাশনাল লাইব্রেরি গেছিলাম। রানি আসার আগের বছরের সব পত্রিকা ঘেঁটেছি। কিচ্ছু নেই। শুধু দু-একটা ছেঁড়াছেঁড়া ব্লু ছাড়া।”

“কেমন?”

“রানি আসার বছরখানেক আগে থেকেই ফ্রিম্যাসনরা আচমকা খুব অ্যাকটিভ হয়ে ওঠে। সেটাই কাল হয়। ১৮৯৬তে ওদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে এক অজ্ঞাত আততায়ী এসে ওদের নতুন গ্র্যান্ডমাস্টারকে গুলি করে। এই আততায়ী বিষয়ে পত্রিকায় একটা কথাও নেই। শুধু আছে আমাদের প্রিয়নাথ দারোগা এই আততায়ীকে এনকাউন্টার করে মারেন।” এতক্ষণ আমি ক্লাস করার মতো শুনে যাচ্ছিলাম। প্রিয়নাথের নামটা কানে আসামাত্র নড়েচড়ে বসলাম। আবার প্রিয়নাথ! এই লোকটা কত কী করে গেছে।

“আমি এতকাল ভাবতাম এই হিস্টোরিয়ান নামের বেনামি লেখক বানিয়ে বানিয়ে একটা কনস্পিরেসি প্লট লিখেছেন। কিন্তু শৈলর নাটক দেখে যা বুঝি এর সবই সত্যি! আর যদি তা হয়, তবে…”

“তবে কী?”

“বইয়ের শেষে লেখক বেশ সজ্ঞানে ভয় দেখিয়েছেন। বলেছেন আততায়ী শেষ হলেও এই স্পিরিট বা ভূতের নাকি বিনাশ হয়নি। ভূতকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যে-কোনো দিন ভূত জেগে উঠবে। তখনকার অনেক লেখক বইয়ের কাটতির জন্য এমন রোমহর্ষক একটা শেষ করতেন। এতে বই শেষ হয়ে গেলেও পাঠকের সাসপেন্স শেষ হত না। আমিও তেমনই ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ তুমি যা দেখালে…… মানে পো-র বইয়ের মলাটের পিছনে যা যা লেখা… আমি এর অর্থ বলতে পারব না হয়তো, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই… তবে আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত।”

“কী ব্যাপারে?”

“এই চিহ্ন, যা বইয়ের উপরে আছে, তা ফ্রিম্যাসনদের গোপনতম চিহ্ন। জাবুলন নামে এক জঙ্গি গোষ্ঠীর। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও এটার কথা কেউ জানত না। সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সেদিন টিভিতে দেখছিলাম। তাই বলছি, একশো বছর পরে ভূত সত্যিই জেগেছে। তুমিই হয়তো জাগিয়েছ। এবার সেই ভূত কীভাবে নৃত্য করবে, সে ব্যাপারে, বিলিভ মি, আই হ্যাভ অ্যাবসোলিউটলি নো আইডিয়া।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *