পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ— মৃত্যু প্রহেলিকা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ— মৃত্যু প্রহেলিকা

অনেকদিন পরে কলকাতায় এমন সাংঘাতিক গরম পড়েছে। এরকম প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম গত দশ বছরে কেউ দেখেনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছের একটা পাতাও নড়ে না। দুপুরে রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। সেদিন চোখের সামনে আকাশের এক পাখিকে ছটফট করতে করতে মাটিতে পড়ে যেতে দেখেছে প্রিয়নাথ। সারাদিন ঘাম হয়। পুলিশি উর্দিতে সেই ঘাম জমে পচা দুর্গন্ধ ছড়ায়। চারদিকে শুধু শুকনো ধুলো। সবুজের লেশমাত্র মুছে গেছে শহরের বুক থেকে। চামড়া ফেটে যায়, চোখের পাতাও যেন কাগজের তৈরি বলে বোধ হচ্ছে। ব্ল্যাক টাউনে অস্বাস্থ্যকর বদ্ধ জলে মলমূত্রের দুর্গন্ধে রাস্তায় চলা দায়। সেখান থেকে জন্ম নিচ্ছে মশা আর মাছির দল। সাহেবপাড়ায় প্রতিবারের মতো এবারও মড়ক লেগেছে। গরম এলেই সাহেবরা ভয়ে সিঁটিয়ে যান। কেউ পালান সিমলায়। আর যাঁরা তা পারেন না, তাঁরা প্রহর গোনেন। কে জানে এবার কার পালা আসে। এবারের সংখ্যাটা ভয়াবহ। কলেরা, টাইফয়েডের সঙ্গে বম্বে শহর থেকে আসা প্লেগ নামে নতুন এক রোগে মানুষজন গণহারে ফৌত হচ্ছে। সবে মে মাসের শুরু। বৃষ্টি নামতে এখনও একমাসের বেশি। রোজ স্টেটসমম্যানের কলাম ভরে থাকে এইসব খবরে। এর মধ্যেই একুশজন রাইটারের মরার খবর এসেছে।

লালবাজারে নিজের রুমে বসে প্রিয়নাথ সংবাদপত্রের পাতা ওলটাচ্ছিল। মোটা ইঁটের দেওয়াল, উঁচু সিলিং, তা বলে গরম একটুও কমছে না। আজকাল খুব সকালে অফিস খুলে যায়। দুপুর হতে না হতে জানলা দরজা সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে জানলায় মোটা খসখসের পর্দা টাঙানো। ভৃত্যেরা নিয়মিত তাতে পিচকিরি দিয়ে গোলাপজলের ছিটা দেয়। ফলে একটা বাইরের আগুনের হলকা খসখসের মধ্যে দিয়ে ঘরে ঢুকে সুন্দর মৃদু গন্ধ ছড়াচ্ছে। কিন্তু এই গন্ধে বেশিক্ষণ থাকলে আবার মাথা ধরে যায়। সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়ের পাতায় কিছুদিন আগেও শুধু কাজের খবর ছাড় কিছু থাকত না। এখন পত্রিকার আয়তন বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে অদ্ভুত সব “জিলা বিজ্ঞাপন আর কেচ্ছা। “দৈবযোগে নরবলি” শীর্ষক এক খবরে লেখা— হুগলীর সোনাই মহম্মদপুরে কিছুকাল পূর্বে এক ব্রাহ্মণ আপনি ছাগ বলিদান করিতেছিলেন এবং তাঁহার ভ্রাতা ওই জন্তুদিগকে ধরিয়াছিল, তাহাতে দৈবযোগে এক কোপ ছাগের গলে না পড়িয়া ভ্রাতার গলে পড়িয়া তাঁহার মুণ্ডচ্ছেদ হইয়া মহা বিপদ ঘটে…..” তারপর পুলিশ নাকি “ভ্রাতাবলিদানকারীকে ফৌজদারিতে উপস্থিত করিয়া দিয়াছে।” একই কলামে হুগলী জেলার আরও একটি খবর। “কুলকন্যার কুলত্যাগ”। তাতে জানা যাচ্ছে চুঁচুড়ার কালীপ্রসাদ দত্তের কন্যা যাদুমণি দেবী নাকি এক কুলীন পাত্রের সঙ্গে বিয়ের পরেই বিধবা হন। এরপরেই “তাঁহার ইন্দ্রিয়বিকার ঘটে।” তিনি কুলত্যাগ করে পালিয়ে যান। বহুদিন তাঁর কোনও খবর ছিল না। এদানি চন্দননগরের পতিতাপল্লিতে সেই “পঞ্চদশীকে সুখে লীলা করিতে দেখা গিয়াছে।” প্রিয়নাথের মুখে একটা হালকা হাসি দেখা দিল। সেই লীলা, কে যে দেখল আর কীভাবেই বা দেখল সে বিষয়ে একটা কথাও নেই। পরের খবরটা দেখেই প্রিয়নাথ প্রায় শোয়া অবস্থা থেকে একটু উঠে বসল। শিরোনামটি চোখ টানার মতোই। খবরটা এইরকম—

গার্ডেনরিচে মৃত্যু প্রহেলিকা।
১২.০৫.১৮৯৬

পাঠকগণ অবশ্যই অবগত আছেন যে গত তিন বৎসর যাবৎ কলিকাতা ও তাহার পার্শ্ববর্তী চটকলগুলাতে বিভিন্ন কারণে ইংরাজ মালিকগণ শ্রমিকদের অসন্তোষের কারণ হইতেছেন। বিগত তিন বৎসর পূর্বে ভারতীয় চটকল সংঘের সদস্যগণ শ্রমিকদের কর্মের সময় বাড়াইয়া দেন, পরন্তু মজুরি বাড়ান নাই। গত বৎসর টিটাগড় এবং কামারহাটি চটকলের শ্রমিকদের ধর্মঘটের কথা পাঠকদের স্মরণে থাকিবে। মহামান্য ইংরাজ বাহাদুরকে এই বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনিতে পুলিশ বাহিনীর সাহায্য লইতে হইয়াছিল। গত বৎসর জুনে বকরি ইদের দিবসে কাঁকিনাড়া চটকলের বিক্ষুব্ধ নেতাগণকে পুলিশ কারারুদ্ধ করেন। বিক্ষোভ স্তব্ধ হয় নাই। দুই মাস যাইতে না যাইতেই বজবজ চটকলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা উগ্র হইয়া উঠে। তাহারা চটকল নিকটবর্তী সকল ইউরোপীয় গৃহ জ্বালাইয়া দেয়। পুলিশ ২১ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করিলেও কে বা কাহারা ইহাদের ইন্ধন দিতেছে তাহা লইয়া ইহারা একটি শব্দও উচ্চারণ করে নাই। আপাতনিরীহ এই শ্রমিকগণের এইরূপ আচরণ সকলকেই বিস্মিত করিয়াছে। এই সকল ঘটনার ঊর্ধ্বে রহিয়াছে গত তিনদিন পূর্বে গার্ডেনরিচ চটকলের ভয়াবহ কাণ্ড। একেবারে প্রত্যুষে নিত্যকার মতই শ্রমিকরা সকলে আপনাপন কর্মে নিরত ছিল। দ্বিপ্রাহরিক ভোজনবিরতির কিয়ৎক্ষণ বাদেই কারখানার মুসলমান শ্রমিকরা মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করিতে থাকে। শুধু তাই নয়, হস্তে লাঠি সড়কি ইত্যাদি লইয়া কারখানার অধিকাংশ দ্রব্য ধ্বংসে উদ্যত হয়। প্রসঙ্গত জানানো প্রয়োজন এই কারখানায় সকল শ্রমিকদের সহিত মালিকপক্ষের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। তাই এমনবিধ আচরণে হতচকিত হইয়া মালিক স্টুয়ার্ট সাহেব কারখানার গেট বন্ধ করিয়া দেন।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকগণের মধ্যে আবুল হাসান নামক এক প্রৌঢ় মুসলমান ছিল। সে আচমকা কারখানার দরোয়ানকে আক্রমণ করিয়া তাহার টুটি টিপিয়া ধরে। সকলে নিজ নিজ কার্যে ব্যস্ত থাকায় মাত্র কয়েকজনই আবুলকে ঠেকাইতে চেষ্টা করিয়া বিফল হয়। দরোয়ানটির তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে। মৃত দরোয়নের নাম কানাইয়ালাল দুবে। বেহার প্রদেশের হিন্দু। এই ঘটনায় অঞ্চলের মুসলমানদিগের মধ্যে এক চাপা উত্তেজনার সঞ্চার হইয়াছে। আবুলকে ফৌজদারিতে করা গেছে।  

প্রিয়নাথের ভুরু কুঁচকে উঠল। তলায় তলায় বিপ্লবীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাচ্ছে, সে খবর তার কাছে আছে। সিপাই বিদ্রোহের পরে মহারানি ভিক্টোরিয়া যখন শাসনভার নিজের হাতে নিলেন, তখন সবাই ভেবেছিল সব বিদ্রোহের আগুনকে এবার ধামাচাপা দেওয়া যাবে। মহারানি একা হাতে গোটা দেশ সামলাবেন। সমাজের তথাকথিত ইন্টালেকচুয়ালরা মহারানির জয়গান গাইলেন। কিন্তু লালবাজারের কোনায় কোনায় খবর ছিল, বিদ্রোহের আগুন তো নেভেইনি, বরং ধিকিধিকি জ্বলছে সারা দেশ জুড়ে। কোনদিন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে বেরোবে, কেউ জানে না। এই চটকলের শ্রমিকদের বিদ্রোহ তাতে নতুন সংযোজন। অন্য বিদ্রোহের মতো এটাও তারা দমন পীড়ন করে থামাতে চাইছে। এভাবে কি আর মানুষের ক্ষোভ চাপা দেওয়া যায়!  

তবে প্রিয়নাথকে ভাবাচ্ছিল অন্য একটা ব্যাপার। এই প্রথম কোনও নেটিভ শ্রমিক আর- এক নেটিভকে আক্রমণ করল। শুধু তাই না, একেবারে খুন করে ফেলল। সমস্যা হল, যে খুন করল, আর যাকে খুন করল দুজনে আলাদা আলাদা সম্প্রদায়ের। সুচতুর ইংরেজরা যদি বুঝতে পারে, তবে এই এক অস্ত্রে নিজেদের মধ্যেই বিভেদ বাধিয়ে এদের আন্দোলন একেবারে শেষ করে দেবে।

দরজায় খুব আস্তে দুইবার টোকা পড়ল। পিয়ন এসেছে। কিন্তু এই সময়! এমন গরমে ভরদুপুরে কে আবার এত্তালা পাঠাল! পিয়নটি একেবারে ছোকরা। এসে জানাল টমসন সাহেব প্রিয়নাথকে নিজের রুমে ডেকে পাঠিয়েছেন। জরুরি তলব। মাথায় শোলার হ্যাট চাপিয়ে “চলো তবে” বলে পা বাড়াল প্রিয়নাথ। বড়ে বড়ো বড়ো অলিন্দগুলো পুরোটাই খসখসের পর্দায় ঢাকা। এদের বলে টাটি। টাটিতে গরম কিছুটা কমলেও এই আঁধারপুরীতে যেন নিজেকে প্রেতের মতো মনে হয়। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে একেবারে অকারণেই প্রিয়নাথের মনে পড়ে গেল বছর চার আগের এক শীতের রাতের কথা। টমসন সাহেব মাঝে কয়েক বছর বদলি হয়ে মুঙ্গের চলে গেছিলেন। এখন অবসরের সময় চলে এসেছে। শেষ পোস্টিং ফের লালবাজারেই।  

দোতলায় টমসন সাহেবের ঘরের সামনে এক বিচিত্র যন্ত্র চলছে। সদ্য বিলেত থেকে আসা এই যন্ত্রের নাম থার্মান্টিডোট। কাঠের তৈরি, গোলমতন, প্রায় ৭ ফুট উঁচু, ফাঁপা এই যন্ত্রের পেটে চারটে পাখা লোহার রডে ফিট করা। বাইরে থেকে হ্যান্ডেল ঘোরালে চারটে পাখাই একসঙ্গে ঘুরে ঘরের গরম হাওয়া টেনে নেয়। আর দুধারের গোল করে কাটা ফুটো দিয়ে খসখসের মধ্যে থেকে হাওয়া ঢুকে ঘরে ঠান্ডা সুগন্ধী হাওয়ায় ভরে দেয়। বাইরে এক নেটিভ পিয়ন গলদঘর্ম হয়ে হ্যান্ডেল ঘুরিয়েই যাচ্ছে। প্রিয়নাথকে প্রথমে সে দেখতে পায়নি। পেয়েই চমকে উঠে সিধা দাঁড়িয়ে লম্বা একটা সেলাম ঠুকল। প্রিয়নাথ হাত নেড়ে তাকে বসতে বলল। এই ছেলেটি নতুন। আগে দেখেনি। টমসন সাহেবের ঘরের বাইরে চেয়ার পাতা। সামনে আর্দালি দাঁড়িয়ে। প্রিয়নাথকে

চেয়ারে বসতে বলেই সে ঘরে ঢুকে গেল। বেরিয়ে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। বলল, “সাহেবরা যেতে বললেন”।

“সাহেবরা?” আর কে আছে টমসন সাহেবের সঙ্গে? তবে কি সত্যিই জরুরি কিছু ঘটল? ভাবতে ভাবতেই আর্দালি ভারী ডবল পাল্লার দরজা খুলে দিল।  

“মে আই কাম ইন স্যার?” বলতেই “প্লিজ কাম” বলে যে ভারী গলা ভেসে এল তা প্রিয়নাথের চেনা না। এ গলা টমসন সায়েবের না, এ গলা…  

ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পড়েছে প্রিয়নাথ। টমসন সায়েবের চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাঁকে প্রিয়নাথ চেনে। নিজের চোখে দেখেছে মাত্র দুই-তিনবার। শেষবার দেখেছিল এক অভিশপ্ত রাতে যেদিন ম্যাজিকের মঞ্চে পরপর খুন হয়েছিল দুইজন। ইনি লালবাজারে আসেন না। দরকার পড়লে রাইটার্স বিল্ডিং-এ তলব করে পাঠান। প্রিয়নাথ সবিস্ময়ে দেখল তার দিকে সোজা তাকিয়ে আছেন বাংলা পুলিশের সর্বেসর্বা ইন্সপেক্টর জেনারেল এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি। মুখ গম্ভীর কপালে চিন্তার ভাঁজ। হেনরি সাহেব ১৮৯১ সালের শুরুতে বাংলা পুলিশের দায়িত্ব পান। পেয়েই নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে আসেন পুলিশ ফোর্সে। ফ্রান্সের বাতিলঁর মাপজোক, আঙুলের ছাপ ইত্যাদি নিয়ে অপরাধী শনাক্তকরণের কাজ ভারতে তিনিই প্রথম শুরু করেন। এই বছরই জানুয়ারি মাসে একটা অর্ডার জারি করছেন তিনি। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে প্রত্যেক অপরাধীর দশ আঙুলের ছাপ নিয়ে একটা অঙ্গুলাঙ্ক পত্র তৈরি করতে হবে। সেগুলো রাখা থাকবে পুলিশের রেকর্ডরুমে। কিন্তু ইংরাজ সরকারের চোখের মণি এই হেনরি সাহেব আজ পথ ভুলে লালবাজারে কী করছেন?

অন্ধকারে চোখ একটু সয়ে যেতেই ঘরের বাকিদেরও দেখতে পেল প্রিয়নাথ। সাহেবের একটু দূরে অন্য একটা চেয়ারে বসে আছেন প্রৌঢ় টমসন সাহেব। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। উলটো দিকে দুই অচেনা নেটিভ, তাঁদের একজন যে মুসলমান, তা তাঁর গুল্ফহীন দাড়ি, মাথার টুপি আর পোশাক দেখেই আন্দাজ করা যায়। অন্যজন সাহেবি পোশাক পরা। রোগা, কঙ্কালসার চেহারা। মুখে দাড়িগোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। এরা কারা? কেনই বা প্রিয়নাথকে তলব করা হল? এসব ভাবতে ভাবতেই একটা স্যালুট ঠুকে সিধে হয়ে দাঁড়াল প্রিয়নাথ।  

প্রথম কথা টমসন-ই বললেন, “স্যার, এই যে অফিসার প্রিয়নাথ মুখার্জি। এঁর কথাই আপনাকে বলছিলাম।”

হেনরি কোনও উত্তর দিলেন না। শুধু গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। তারপর সোজা প্রিয়নাথকেই প্রশ্ন করলেন, “তোমাকে কার্টারের ম্যাজিক শো-র দেখেছিলাম তাই না?”

সাহেবে এখনও তাঁকে মনে রেখেছেন! চমকে যায় প্রিয়নাথ। কিন্তু সেসব ভাবার আগেই ধেয়ে আসে পরের প্রশ্ন, “চটকলের শ্রমিক অসন্তোষ বিষয়ে কিছু জানো?”

আশ্চর্য! একেই বোধহয় কাকতালীয় বলে। এক ঘণ্টা আগেও যদি সাহেব ডেকে পাঠাতেন, তবে প্রিয়নাথের বোকার মতো চেয়ে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। মনে মনে সে সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়কে ধন্যবাদ দিল। তারপর একটু আগেই সংবাদপত্রে যা পড়েছিল, হুবহু বলে গেল সাহেব বিশেষ খুশি হলেন না, “এসব তো সংবাদপত্রের কথা। সবাই জানে। ডিটেকটিভ

গড়গড় করে।

হিসেবে এর বেশি কী জানো তা বলো।”

প্রিয়নাথ মাথা নাড়ল। সে জানে না।

হেনরি সাহেব মাথা নিচু করে কী যেন ভাবলেন। মোটা গোঁফে তা দিলেন দুই-একবার। তারপর বলা শুরু করলেন, “আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যখন বাংলা পুলিশের দায়িত্ব পেলাম, তখন থেকেই হাতের ছাপের উপরে আমার নেশা ধরে যায়। আমি এখনও বিশ্বাস করি কোনও দুটো মানুষের হাতের ছাপ একরকম হয় না, হতে পারে না। তারা দুই যমজ ভাই হলেও না। আমার আগে নদিয়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার উইলিয়াম হার্সেল দশ-বারো বছরের ব্যবধানে একই মানুষের হাতের ছাপ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। সেসব ছাপের ভিত্তিতে ফ্রান্সিস গ্যালটন তাঁর ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ বইতে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, যে-কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতের ছাপ অপরিবর্তনীয়। মৃত্যু অবধি মানুষের চেহারা বদলালেও হাতের ছাপ একই থাকবে। এ কোনও বাজে ধারণা বৈজ্ঞানিক সত্য। সূর্য পুব দিকে ওঠে যেমন সত্য, তেমন সত্য।”  

প্রিয়নাথ ভাবছিল সাহেব এমন জরুরি তলব করে এসব থিয়োরি কপচাচ্ছেন কেন? সাহেবও বুঝি তা বুঝতে পারলেন। সামনের দুই নেটিভকে দেখিয়ে বললেন, “এঁদের চিনে রাখো। ইনি খুলনা থেকে এসেছেন। নাম আজিজুল হক। ইনিই প্রথম হাতের ছাপের সূত্রটি আবিষ্কার করেন। আর তাঁর পাশের জন রায়বাহাদুর হেমচন্দ্র বসু। তিনি সূত্রটা ছোটো ছোটো অংশে ভাগ করেন বোঝার সুবিধের জন্য। যদিও সবাই আমার নামে এই পদ্ধতিকে হেনরি পদ্ধতি বলে, তবু এই দুজন ছাড়া এই কাজ সম্ভব হত না। যাই হোক, কাজের কথায় আসি”, বলে সাহেব একটা চুরুট ধরালেন।

“চটকলের শ্রমিকদের অসন্তোষকে প্রথমে আমরা অন্য অসন্তোষের মতোই দেখছিলাম। কিন্তু গার্ডেনরিচের কাণ্ড আমাদের অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। প্রতি ক্ষেত্রেই দাঙ্গা বেঁধেছে আচমকা। সকাল থেকে কোনও আভাস কারও কাছে ছিল না। পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে তাদের কারও কোনও পুলিশি রেকর্ড নেই। তাদের আত্মীয় বা পাড়াপ্রতিবেশীরাও জানিয়েছে প্রত্যেকেই একেবারে ছাপোষা শান্তিপ্রিয় মানুষ। কেন আচমকা তারা এমন ব্যবহার করল, তা কেউ বলতে পারছে না।”

“কিন্তু স্যার যারা অমন করেছে তারা তো বলতে পারবে নিশ্চয়ই।”

“আসল চমক এখানেই। তারা সবাই অস্বীকার করছে যে তারা কিছু করেছে। এমনকি তাদের কারও নাকি কিচ্ছু মনে নেই।”

“স্যার। তার মানে ওরা মিথ্যে বলছে।”  

“আমরাও তাই মনে করি। কিন্তু টিটাগড় আর কামারহাটির দাঙ্গার মধ্যে মাত্র দুইদিনের তফাতে কামারহাটির অপরাধীদের যখন ধরা হল, তখন টিটাগড়ের শ্রমিকরা জেলে বন্দি। একইরকম মিথ্যে কথা, একইভাবে দুই জায়গার শ্রমিকরা বলে কীভাবে, যদি না…”  

“যদি না দুটোর পিছনেই একই মানুষ বা দল থাকে।”

“ঠিক তাই। আমরাও সেইভাবেই তদন্ত করছিলাম। কিন্তু গার্ডেনরিচের ঘটনা আবার সব হিসেব উলটে দিল”।

“কীভাবে স্যার?”

“আগে আমরা ভাবছিলাম এই দাঙ্গা একমাত্র ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে। কিন্তু গার্ডেনরিচে এই প্রথম একজন নেটিভ অন্য এক নেটিভকে আক্রমণ করল। শুধু আক্রমণই করল না। একেবারে খুন করে ফেলল।”

“পুরোনো শত্রুতাও হতে পারে। পত্রিকায় অবশ্য একটা হিন্দু-দিক তুলেছে স্যার।”

“ওদের তো তাই কাজ। আমি নিজে খোঁজ নিয়েছি। দারোয়ান ছেলেটি একেবারে নতুন। ছোকরা। সবে এক সপ্তাহ হল এসেছিল। আর যে খুন করেছে সে মাঝবয়সি। দুজনের এর আগে কোনও দিন কথাই হয়নি, শত্রুতা তো পরের কথা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে আবুল হাসান নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলছিল। আচমকা সে হাসিমুখেই তার গলা টিপে ধরে। ব্যাপারটা এতটাই আকস্মিক যে কেউ বুঝতেই পারেনি। ছেলেটির চোখ উলটে যায়, জিভ বেরিয়ে যায়, মুখ দিয়ে রক্ত উঠে যায়, আবুল তবু হাসি হাসি গলা চেপেই ধরে থাকে। সবাই দৌড়ে এসে ছাড়ানোর আগেই সব শেষ।”

“আবুল কী বলছে?”

“সেই আগের মতো। অস্বীকার করছে। বলছে তার মনে নেই। সে এইসব কিচ্ছু করেনি।”

“মিথ্যে কথা বলছে। আমি নিশ্চিত। ভালো করে জেরা করলেই সব বেরোবে। আমি নিজে ওকে জেরা করব। এখন ও কোথায় আছে স্যার?”

বেশ খানিক্ষণ চুপ থেকে হেনরি বললেন, “নিজের বাড়িতে। আমিই ওকে ছেড়ে দিতে বলেছি।”

“সে কী! কেন স্যার?”

“সেইজন্যেই তোমাকে ডাকা। চার বছর আগে যখন আমি এদেশীয় মানুষদের আঙুলের ছাপ জোগাড় করতে শুরু করি, তাতে অপরাধী সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষও ছিল। আজিজুল হক নিজে এমন কিছু মানুষের হাতের ছাপ নিয়ে সংগ্রহ করে রাখে। এদের মধ্যে আমাদের ছিল এই আবুল হাসান। তার হাতের ছাপ আমাদের আর্কাইভে পাঁচ বছর হল জমা আছে।”

“তবে তো হয়েই গেল স্যার।”

“না, হল না। মুশকিলটা সেখানেই। গ্রেপ্তার করার পর আবুলের হাতের ছাপ নেওয়া হয়েছে, যা হুবহু সেই পাঁচ বছর আগের ছাপের সঙ্গে মেলে। কিন্তু খুন হওয়া দারোয়ানের গলায় বা শরীরের হাতের ছাপের সঙ্গে এই ছাপের বিন্দুমাত্র মিল নেই। প্রায় পঞ্চাশজন প্রত্যক্ষদর্শী আছে। তবুও আবুলকে ছেড়ে দিতে হল। আমি যে বিজ্ঞানকে সত্য বলে জানি, তা এই প্রেপ্তার সমর্থন করে না।”

“সেকী! এ তো গণপতির ভোজবাজির চেয়েও অদ্ভুত! একেবারে ভুতুড়ে কান্ড!”

“ভুতুড়ে কান্ডই শোনো মিস্টার মুখার্জি, মহারানি এই দেশের শাসন হাতে নেওয়ায় সবাই যে খুব খুশি তা না। কোম্পানির আমলে অনেকের অনেক দুষ্কর্ম ধরা পড়ছে। বড়ো বড়ো রাঘব বোয়ালরা শাস্তিও পাচ্ছে। ফলে শুধু নেটিভরা না, অনেক ইংরেজরাও চাইছে কোনওমতে গোলমাল পাকিয়ে তাঁকে বিব্রত করতে। আমরা তো সেটা হতে দিতে পারি না, তাই না? আমি জানি আবুল খুনি। কিন্তু কীভাবে এক নিরক্ষর শ্রমিক অপরাধের সময় নিজের হাতের ছাপ বদলে ফেলল সেটা জানা খুব জরুরি। এভাবে চললে তো কিছুদিন বাদে কোনও অপরাধীকেই আর ধরা যাবে না! যে সামান্য একটা আলোর রেখা দেখা গেছে, সেটাও মুছে যাবে। তোমাকে দাঙ্গার তদন্ত করতে হবে না। তুমি শুধু এই ব্যাপারটা দ্যাখো। আর হ্যাঁ, আমাদের দপ্তরে আমি আর টমসন ছাড়া কাউকে এই বিষয়ে কিছু জানাবে না।”

“কিন্তু স্যার, এই আঙুলের ছাপ ইত্যাদি নিয়ে তো আমার কোনও ধারণাই নেই।”

“সেক্ষেত্রে দপ্তরের বাইরের একজন কনসালটিং ডিটেকটিভ থাকবেন তোমার সঙ্গে। আমার পরেই এ বিষয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি দক্ষ, এমন একজন। হয়তো আমার থেকেও তিনি কিছু বেশিই জানেন।”

“কে তিনি?”

“তোমার পূর্বপরিচিত। এই মুহূর্তে কলকাতায় নেই। বিশেষ কাজে অন্যত্র আছেন। তাঁর বিশেষ অনুরোধেই তোমাকে এই দায়িত্ব দেওয়া।”

হেনরি সাহেব গালা দিয়ে সিল করা একটা খাম প্রিয়নাথের দিকে এগিয়ে দিলেন। উপরে টানা হস্তাক্ষরে লেখা “To Mr Priyonath Mukkerjea”। খাম ছিঁড়তেই কার্ডের মতো মোটা দামি কাগজের ছোটো একটা চিঠি। এক পিঠে একটা ঠিকানা দেওয়া। অন্য পিঠে কালো কালিতে লেখা-

“বিশেষ কাজে চুঁচুড়ায় এসেছি। ঠিকানা দিলাম। অতি সত্বর দেখা করুন। ট্রেনযোগে আসবেন। বজরা বা পালকিযোগে না। সঙ্গে অবশ্যই তারিণীকে নিয়ে আসবেন। সময় বেশি নেই। খেলা শুরু হয়ে গেছে।

পুনঃ এখানে ভালো তামাক পাওয়া যায় না। কলকাতার গভর্নমেন্ট প্লেসের কাছে স্টানলি ওকসের দোকান থেকে দুই পাউন্ড কড়া তামাক আনলে বাধিত হই। প্রতিদান হিসেবে একদিন অবসরে আপনাকে স্টাডিভেরিয়াস বেহালায় উচ্চাঙ্গ সংগীত শোনাবার প্রতিজ্ঞা করলাম।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *