দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ— পাপের সোপান
প্ৰায় বৃদ্ধ, টাকমাথা এক গার্ড হেলেদুলে আমার কাছে এসে জানালেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এবার আমায় উঠতে হবে। রাস্তার সব আলো জ্বলে গেছে। খেয়াল করিনি। চুঁচুড়া কবরখানার বিরাট বিরাট সব ওবেলিস্ক আর ভার্নেতের কবর যেন দূরাগত কোন জটিল ধাঁধার সাক্ষী হয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। একা বসে ভাবছিলাম, যদি এরা কথা বলে উঠতে পারত, তবে হয়তো শতাব্দীপ্রাচীন এক রহস্যে কিছু হলেও আলো পড়ার সুযোগ ছিল। একটু আগেই যা দেখলাম, যা আমার হাতে এই মুহূর্তে ধরা আছে, তা যদি সত্যি হয়, তবে এতদিনে, এই প্রথম, ভাগ্য কিছুটা হলেও প্রসন্ন হয়েছে। ইতিহাস কথা বলে উঠেছে। মুশকিল হল, কী বলছে তা বোঝার সাধ্যি আমার নেই। আমার যাদবপুর মেকানিক্যালের বিদ্যায় এই সংকেত পাঠ অসম্ভব। তবু যতটা যা বুঝেছি, তাও কম না। এই যে তদন্তের শুরু থেকেই ভূতের নাম বারবার ফিরে ফিরে আসছে, যে ভূতকে নেহাত অলীক, নেহাত অসম্ভব ভেবে বারবার অবজ্ঞা করেছি, সেই ভূতের এমন পাথুরে প্রমাণ হাতেনাতে পাব, কোনও দিন ভাবতে পারিনি।
মোটা বাদামি কাগজের উপরে জড়ানো প্যাঁচানো হাতের লেখায় B.H.U.T. নামে একটা প্রস্তুতের প্রণালী লেখা। খুব বেশি ভুল না হলে, এই ভূতের প্রতিটা অক্ষরের আলাদা মানে আছে। না হলে মাঝে এই ডট থাকত না। গোটা লেখাটা একজনেরই হাতে, কিন্তু দুটো ব্যাপার অদ্ভুত। একেবারে মাথায় একটা গোল চিহ্ন আছে। অনেকটা সিলের মতো। কিন্তু সিল না। তার ভিতরে খুব ছোটো আকারে নানা অদ্ভুত মূর্তি আঁকা। খালি চোখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। আতশ কাঁচটা দিয়ে দেখতে হবে। শুধু দুটো অক্ষর বোঝা যাচ্ছে সিলের মধ্যে। A আর G। এ বস্তুর রহস্য উদ্ধার আমার একার কম্মো না। দেবাশিসদা বেঁচে থাকলে হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারতেন। কিন্তু এখন উপায় বলতে অমিতাভ মুখার্জি। তিনিও পারবেন কি না সন্দেহ। আর একজন আছেন বটে, ঊর্ণার সেই অধীশদা। কেমিস্ট্রি খুব ভালো না বুঝলেও ভদ্রলোক হিস্ট্রিটা বেজায় ভালো জানেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। গার্ড যখন আমায় ডাকতে এল তখন আমি ঠিক করে নিয়েছি, আগে অধীশদার কাছে যাব। কিছু ব্যাক আপ ইনফরমেশন না নিয়ে এগোনো যাবে না। তারও আগে একজনের সঙ্গে কথা বলা খুব দরকার। জটের অনেকটাই তাঁর হাতে।
নিশীথ দত্ত। ঊর্ণার বাবা। নীবার নামের সেই এনজিও-র সদস্য।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত নটা হয়ে গেল। ফিরেই কেমন একটা অস্বাভাবিক ঠেকছিল গোটা বাড়িটা। পুরো বাড়ি অন্ধকার। পাড়াটা এমনিতেই খালি থাকে এই সময়। পোর্টিকোতে আলো জ্বলছে না। অন্যদিন উর্ণার ঘর থেকে খুব ধীরে গানের আওয়াজ ভেসে আসে। আজ সে ঘর নিস্তব্ধ। সবাই গেল কোথায়? কিন্তু তাহলে তো সদর দরজায় তালা থাকত। তাও নেই। ঠিক সেই সময় একটা জিনিস দেখে আমার বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেল। দরজা ভেজিয়ে রাখা। এত বছরে এই প্রথমবার দেখলাম। উর্ণাদের বাড়ি রাস্তার উপরেই। তাই দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকে সর্বদা। আমি বেল বাজালে কেউ খুলে দেয়। ওরা বাইরে গেলে আমার কাছে স্পেয়ার চাবি থাকে। সেটা খুলেই ঢুকি। বাইকটা একপাশে সিঙ্গল স্ট্যান্ডে রেখে খুব ধীরে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। ভিতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। খুব ধীরে, যাতে আওয়াজ না হয়, এমন করে দরজা সামান্য ফাঁক করে বোঝার চেষ্টা করলাম ভিতরে কী চলছে? লবিতে একটা হলদে আলো জ্বলে। সেটা যথারীতি জ্বলছে। সিঁড়ির তলায় জুতো খুলে পা টিপে টিপে উপরে উঠতে লাগলাম। মেজানাইন ফ্লোরের ঘরটার সামনে আসতেই উপর থেকে খুব চাপা গলায় কথা শোনা গেল। কান পেতে শোনার চেষ্টা চালালাম। বোঝা যাচ্ছে না। একটা গলা কাকুর। মানে ঊর্ণার বাবার। কাকু চলে এসেছেন তবে? অন্যটা পুরুষ কণ্ঠ। মনে হচ্ছে কেউ মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কথা বলছে। উর্ণারা কেউ নেই ঘরে? নাকি আছে? কতজন ভিতরে ঢুকেছে? এক না একাধিক? আমার কি পুলিশে ফোন করা উচিত? ভাবতে ভাবতে উপরে উঠে দেখি কাকুর ঘরের থেকেই আওয়াজ আসছে। দরজা সামান্য খোলা। উঁকি মারলে ভিতরে দেখা যাবে। আগুপিছু না ভেবে উঁকি মেরে যা দেখলাম তাতে আমার বুকের রক্ত জল হয়ে গেল। ঘরের মাঝে একটা চেয়ারে বসে আছেন নিশীথ দত্ত। তাঁর দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। পরনে ছোটো একটা আন্ডারপ্যান্ট বাদে এক টুকরো সুতলি অবধি নেই। ওঁর চোখে মুখে বিস্ময়। উনি মাথা নাড়ছেন বারবার। আর ওঁর সামনে…..
আমার দিকে পিছন ফিরে উলটো দিকের চেয়ারে বসে আছে একটা সা-জোয়ান লোক। দরজার ফাঁক দিয়ে লোকটার পিঠের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে শুধু, আর মাথার কিছুটা। লোকটা কালো রঙের মাথাঢাকা একটা মুখোশ পরে আছে। এবার বুঝলাম কেন গলার আওয়াজ অমন শোনাচ্ছিল। কথা হচ্ছে একেবারে নিচু পর্দায়। প্রায় ফিসফিস করে। লোকটা কিছু জানতে চাইছে। কিছুর খবর। আমি মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা করলাম। সব কথা পরিষ্কার না। তবু তার মধ্যেই “দেবাশিস গুহ” আর “খুন” শব্দ দুটো কানে এল। একবার শুনলাম “লাস্টচান্স”, আর-একবার “আমরা শিওর।”
আমি না। আমরা।
এই আমরা মানে কারা?
হঠাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরেই একটা প্রশ্ন করল লোকটা। আর সেটা শুনেই কেঁপে উঠলাম।
“তুর্বসু জানে?”
জানি না শ্বাস চাপার আওয়াজ হয়েছিল কি না, নাকি দরজায় ভুলে ভর দিয়ে ফেলেছিলাম। চেয়ারে বসা লোকটা চকিতে দরজার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করল, “কে?”
তারপর আমাকে বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে এক ঠেলায় দরজা খুলে ফেলল। লোকটার মুখে মাথাজোড়া একটা কালো স্কিমাস্ক। অনেকটা স্পাইডারম্যানের মতো। ফলে চোখ, নাক, মুখ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। লোকটার হাতে চকচকে যে যন্ত্রটা, সেটা এবার আমার দিকে তাগ করা। অজান্তেই আমার হাত দুটো উপরে উঠে গেল।
আর ঠিক তখনই আমাকে অবাক করে লোকটা স্কিমাস্ক খুলে ফেলল।
“এসে গেছ? ভেবেছিলাম তার আগেই ভয় দেখিয়ে কনফেশন আদায় করব। কিন্তু এ মাল হার্ড নাট টু ক্র্যাক।”
আমার ঘোর তখনও কাটেনি। আমতা আমতা করে বললাম “মানে? কী ব্যাপার?”
“দেবাশিস গুহকে খুনের দায়ে তোমার বাড়ির মালিক নিশীথ দত্তকে আমরা গ্রেপ্তার করছি”, বলে আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন অফিসার অমিতাভ মুখার্জি।