দ্বিতীয় অধ্যায় – থানা

দ্বিতীয় অধ্যায়

ট্রেনিং স্কুলে অ্যাংলো-অধিকর্তার কটূক্তি সহ্য করতে না-পেরে চাকুরি ত্যাগ করি। কিন্তু বাইরে এসে দেলাম একজনের বদলে বহুজনের কূটক্তি শুনতে হচ্ছে। আমার চাকুরি-ত্যাগের এত বড়ো বীরত্বের কেউ মর্যাদা দিলো না। সকলেরই অভিমত: চাকুরি পাওয়া সহজ কিন্তু রক্ষা করা কঠিন। সৌভাগ্য এই-যে টেগার্ট সাহেব খবর পেয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন ও পুনর্বহাল করলেন। সেই সঙ্গে ট্রেনিং স্কুলে এদেশীয় লোকেদের উপর দুর্ব্যবহার বন্ধেরও ব্যবস্থা করলেন। আমার দীর্ঘ সুঠাম দেহ টেগার্ট সাহেবের বিশেষ পছন্দ। আমার চেহারা যে ভালো তা বহুলোকের মুখে শুনেছি।

ছেলেবেলায় আমার চেয়ে বয়সে বড়ো বন্ধুকে মহিলারা আদর করে কাছে টেনে বলতেন, ‘এসো বাবা এসো।’ আর আমি বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বলেছেন, ‘একজন ভদ্রলোক এসেছে। ওঁকে বাইরের ঘরে বসতে দে।’ বিবাহ উপলক্ষে কন্যাপক্ষ বলেছে যে পাত্রের বয়সটা বেশি। কিন্তু পুলিশে ওই দোষটাই আমার মহাগুণ হিসাবে পরিগণিত হ’ল।

এইভাবে পুনর্বহাল না-হলে ও পুলিশে না-থাকলে অপরাধ-বিজ্ঞানের গবেষণা কাজে অপারগ হতাম।এই বিজ্ঞান বিষয়ের বহু মূলসূত্র তাহলে অজ্ঞাত থেকে যেতো। এজন্য টেগার্ট-সাহেবের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর হাতে-লেখা একটি শিপ নিয়ে উত্তর-কলকাতার ডিসট্রিকট অফিসে এলাম। এখান হতে ডেপুটি কমিশনার আমাকে থানায় বহাল করেন।

আমার খোঁজে জ্যেষ্ঠতাত রায়বাহাদুর কালীসদয় ঘোষাল আসেন। তিনি বিপ্লবী ভূপতি মজুমদার ও বিপিন গাঙ্গুলির প্রতি সহানুভূতিশীল এই অপবাদে তাঁকে স্পেশাল-ব্রাঞ্চে ডেপুটি কমিশনার করা হয় নি। প্রতিবাদস্বরূপ তিনি তখন লম্বা ছুটি নিয়েছেন। আমার খোঁজ পেয়ে উত্তর কলকাতার ডিসট্রিক্ট-অফিসে বসে তিনি কয়েকটি উপদেশ দিয়েছিলেন। যেমন: ইচ্ছা করে বদলি হয়ো না। মদ ও নারী সর্বদা বর্জন করবে। এক কপদক ও উৎকোচ গ্রহণ কোরো না ইত্যাদি। পরে বলেছিলেন, ওরা আমাকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি-পদ থেকে বঞ্চিত করেছে, আশা করি দ্রুত প্রমোশন পেয়ে ওই পদে একদিন তুমিই বসবে।’

[তাঁর উপদেশ আমি সারা জীবন আক্ষরিক অর্থে পালন করেছি। আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারও হয়েছি। কিন্তু তখন পূর্বের মতো ওই পদের মর্যাদা ও জৌলুস ছিল না।]

বড়বাজার থানা

ভারতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড়ো থানা বড়বাজার থানা। এক-এক ম্যানসনে মহকুমার মতো লোকের বাস। সেখানে থানার ইনচার্জ গরহাজির! এই থানার কাজকর্ম এমনই যে এখানে তালা ভাঙা, হার-চুরি, ছেলে-চুরি, গাড়ির ধাক্কা, কুলি হারানো, বিড-গ্যাম্বলিং, ব্যাংক ফ্রড, বহু অভিযোগ। বড়ো বড়ো থানায় ঘটিবাটি বা ছোটখাটো চুরি গৃহীত হয় না। ওগুলি নথিভুক্ত করে অভিযোগকারীদের বিদায় দেওয়ারই রীতি। পের্টি থেপ্ ট-এনকোয়ারি রিফিউজ করা হয়।দুজন লিখিয়ে-বাবু মামলা লিখে-লিখে হিমসিম।

হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো বড়োসাহেব ডায়েরি ওডেলি-রিপোর্ট দুইই এখনই চান। তিনি রাত্রে কোথায় নিমন্ত্রণে যাবেন। শুক্রল-সাহেবের ডায়েরি লেখা তখনও শেষ হয় নি। কলমের গতি একটু বাড়িয়ে তিনি মুন্সীবাবুকে বললেন, ‘আরে ওঁকে বলে দাও, এখনই ডায়েরি আর ডেলি-রিপোর্ট পাঠাচ্ছি।’

টেলিফোন বেজে ওঠার বিরাম নেই তবু। আগুন লাগার খবর। সেখানে হাল্লাবাহিনী ও অফিসার পাঠাতে হবে। ফের বড়োসাহেবের তাগিদ: ডায়েরি ও রিপোর্ট পাঠাও। টেলিফোনের ওপার হতেই তাঁর চিৎকার শোনা যাচ্ছে: ‘কি হ’ল? এখনও পাঠাচ্ছ না কেন?’ শুক্রল-সাহেব ডায়েরি লেখা থামিয়ে হুকুম দিলেন: ‘ওঁকে বলে দাও ডাক বহুক্ষণ আগে চলে গেছে। এদিকে শিগগির একজন সাইকেল অর্ডারলিকে তৈরি করো।’ আমি বুঝলাম আত্মরক্ষার জন্যে এগুলো এক ধরনের কৌশল।

‘বাবুসাহেব: এক নোকর বিশ হাজার রূপেয়া লেকে ভাগা।’—এক পাগড়িধারী মাড়োয়ারী খানায় ঢুকে বললে, ‘নগীজমে ঘাট-হাজার রূপেয়া থে। লেকেন বুড়বাক কো উহো মালুম নেহি…’

‘তুম ক্যা বোলোত?’—এক অফিসার ডায়েরি লিখতে-লিখতে মুখ তুললেন: ‘এইসেন বাত আছে’? নকোরকো ক্যা নাম? উনকে। গাঁও কাঁহা?’ ‘উনকো নাম হুজুর’, মাড়োয়ারী লোকটি এইবার একটু বিব্রত হন: ‘উনে নাম বোলা থা… মতিহারী ইয়ে রামহরি। এতোয়ারী-ভি হো শেকথা। উসকো গাঁওকো নাম বোলা থা… মতিহারী ইয়ে গাজীপুর। গাজিয়াবাদ-ডি হো শেকথা।’

তারপরই সেখানে একটি কুলি-হারানোর মামলা এসে গেল। চল্লিশ হাজার টাকার জিনিস-সমেত ট্রাঙ্ক নিয়ে কুলি উধাও। তার নাম ঠিকানা ও নম্বর ফরিয়াদীর জানা নেই।

‘মশাই, মশাই, সর্বনাশ হয়েছে।’—এক প্রৌঢ় বাঙালী থানায় ঢুকে বললেন, ‘আমার নাবালিকা স্ত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না।

একদল জুয়াড়ীকে ভেড়ার মতো তাড়াতে তাড়াতে থানায় আনা হ’ল। হাত-গুলো জোড়ে-জোড়ে একসঙ্গে গামছা দিয়ে বাঁধা। দলে পরিচিত কিছু পুরনো পাপীও ছিল। থানার ভিতর ভীড় এবার আরও বাড়লো। গেটের পাহারাদার শাস্ত্রী চিৎকার করে জানান দিলো: ‘বড়োবাবু বড়োবাবু—বড়োবাবু আ গয়া’। এই, সবকোই মু’ সামালকে।’ অর্থাৎ এবার সবাইকে মুখ বন্ধ করতে হবে আর তিনি মুখ খুলবেন এবং গালাগালি দেবেন!

ইনচার্জবাবু ঘরে ঢুকে তাঁর চেয়ারে বসলেন। ঘরে জুয়াড়ীদের দেখে তাঁর মেজাজ গরম। ‘কে? কে এদের ধরে এনেছে? আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি কেন? জানো না যে নরম্যাল ওয়ার্কস সাসপেন্ডে? শুধু কংগ্রেসী ও পিকেটরদের ধরার হুকুম।’—তারপর চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ওদের গালি দিতে শুরু করলেন। অশ্রাব্য গালির পর কিছু শ্রাব্য ভাষা শুরু হ’ল। তাঁর মুখ থেকে সেকেণ্ডে প্রায় কুড়িটি গালি বেরোয়। যেন অটোমেটিক পিস্তলের বুলেট। ফলে সব গালাগালি ফুরিয়ে গেল। তখন একটু দম নিয়ে বিচিত্র-সব শব্দ-নির্গত হতে লাগলো: ‘ম্যাডাগাস্কার, ক্যামাসকাটা, হনুলুলু’ ইত্যাদি। হঠাৎ একজন ইংরেজ মেমসাহেব ঢুকলেন সেই তোড়ের মুখে। তার অভিযোগ এই-যে দোকানী তাঁকে কিছু পচা আঙুর বিক্রি করেছে।

ব্রেক কষলে গাড়ি থামে, কিন্তু গালাগালি ঘামানো সহজ নয়। গালি আপনবেগে পাগল-পারা। অতএব কমপক্ষে দশটি গালি বর্ষিত হ’ল সেই মহিলার উদ্দেশ্যেও। ভাষা সৃঠিক অনুধাবন করতে না-পারলেও ওটা যে গালি তা বুঝতে তাঁর বিলম্ব হ’ল না। মহিলার সাদা মুখ রাগে লাল হয়ে উঠলো। এ যে রীতিমত অপমান! তিনি তৎক্ষণাৎ ফোনে ইংরেজ-ডেপুটিকে কিছু বলতে চাইলেন। ইনচার্জ-বাবু প্রমাদ বুঝে সুর পালটে ফেললেন। তিনি বিনীত ভঙ্গিতে বুঝিয়ে বললেন যে সব কাজ তো একসঙ্গে করা যায় না, তাই শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ রেখে ওঁর কথা তিনি ঠিকই শুনেছেন কিন্তু বাক-সংযম করা যায় নি বলে দুঃখিত। প্রকৃতপক্ষে মেমসাহেব মান্যে বড়ো বলে মুখ ছিল তাঁর দিকে কিন্তু মুখের বাক্যরাশি নির্গত হয়েছে ওই নেটিভগুলোর উদ্দেশ্যে। মাননীয়া মহিলা যেন ক্ষমা করেন।

মহিলা ক্ষমা করেছিলেন এবং ইনচার্জবাবুর দেওয়া লেমনেড পান করে ফিরে গিয়েছিলেন।

আমি সারাক্ষণ দাড়িয়ে তাঁর এই কাণ্ড-কারখানা দেখছিলাম। আমার আর বাক্যস্ফূর্তি হতে চায় না।এখান হতে সরে পড়াও সম্ভব নয়। অতএব নির্বাক বসেছিলাম। এবার তাঁর দৃষ্টি পড়লো আমার ওপর। ঘাড় কাত করে তিনি আমাকে দেখলেন এবং যথারীতি কণ্ঠস্বর চড়িয়ে বিকট গর্জন: ‘কে মশাই আপনি? এখানে কি চান? কি জন্যে এসেছেন?’—নির্দোষ স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা, কিন্তু কণ্ঠস্বর এত চড়া আর উচ্চারণের ভঙ্গি এত কর্কশ যে চমকে যেতে হয়। আমার আগমনের উদ্দেশ্য বলতে না-বলতেই উপরের কোয়ার্টার থেকে একটি বালক নেমে এসে অফিস-ঘরে ঢুকলো। তিনি চেঁচিয়ে এক অফিসারকে বললেন, রিমেশ, এখানে আমরা ‘মুখমিষ্টি” করছি, বাচ্চাদের অফিস ঘরে ঢুকতে দাও কেন? ওরা গোল্লায় যাবে যে! এখনই ওপরে যেতে বলো।‘তিনি সমাদরে নিজের কাছের একটা চেয়ারে আমাকে ডাকলেন: ‘আসুন মশাই, এখানে বসুন।’

‘আজই গেজেটে আপনার নাম দেখেছি।’—তিনি বললেন, ‘ডেপুটি-সাহেব ফোনে আমাকে সব বলেছেন। আমার কোয়ার্টারের পাশেই আপনার কোয়ার্টার। সুইপার দিয়ে পরিষ্কার করানো আছে। একটা কমবাইণ্ড হাও কুক্ বা চাকর রাখবেন। ফ্যামিলি থাকলে না-আনাই ভালো। এই কদিন থানা বড়ো গরম। কংগ্রেসীদের পিকেটিং সম্প্রতি বেড়েছে। ডেপুটিদের মাথা তাতে দারুণ উত্তপ্ত।আপনাকে এই পিকেটিং-করা লোকেদের ধরার ডিউটি দেওয়া হয়েছে। আপনি এবার জেনা রেল ডায়েরিতে লিখুন: ‘জয়েন্ট দিস থানা (পি. এস.)। মে গড়, হেল্‌প মী। আজকের দিনটা বিশ্রাম করুন, কাল সকাল ছটার সময় থানায় নামবেন।’

তাঁর নির্দেশমতো: কোয়ার্টারের উপরে উঠে বারান্দায় দাড়ালাম। হঠাৎ নিচের অফিসে একটা সোরগোল: ‘বড়োসাহেব বড়োসাহেব বড়োসাহেব এসেছেন।’ গরুর পালে যেন বাঘ পড়লো। পরক্ষণেই নিচের অফিসে দারুণ চেঁচামেচি ও টেবিল ঠোকাঠুকি। বড়োসাহেব থানা-ইনস্পেকসনে এসে কিছু ভুল ধরেছেন। একটা ছোট ছেলে উপর থেকে নিচে নেমেছিল। সে একবার থানার অফিসঘরে উকি দিয়েই দৌড়ে উপরে উঠে মা-কে বললে, ‘মা’ একজন সাহেব এসে বাবাকে বকছে।”—আমি কৌতূহলী হয়ে বড়োসাহেব-জীবটিকে দেখতে নিচে নামছিলাম। হঠাৎ দেখি এক অফিসার নিচে হতে দৌড়ে ওপরে উঠছেন। বড়োসাহেব একটি থানা পরিদর্শন সেরে বার হওয়া মাত্র সেখান হতে ফোনে খবর এসেছে যে ওই থানার একজন কর্মীকে কাজে গাফিলতির জন্য সাসপেণ্ড করা হয়েছে এবং তাঁর গাড়ি এইদিকে ঘুরেছে। তার মানে এখানেও ওই রকম কিছু ঘটতে পারে এই আশংকায় অফিসারটি জেনারেল ডায়েরিতে সিক্ রিপোর্ট লিখে উপরে উঠছিলেন। তাঁর কাগজ-পত্র ঠিকমতো তৈরি হয় নি। আমাকে নিচে নামতে দেখে পথরোধ করে বললেন, ‘মশাই, এখন নিচে নামবেন না। ওঁর সামনে পড়লে পানিসমেন্ট অবধারিত।’

[কলিকাতা-পুলিশে অ্যাসিসটেন্ট কমিশনারদের বড়োসাহেব এবং তাঁদের ঊর্ধ্ব তন ডেপুটি-কমিশনারকে ডেপুটি-সাহেব বলার রীতি। ওই যুগেবড়ো সাহেবের চোখ দিয়েই উপরওয়ালারা অধীনস্থ অফিসারদের বিচার করতেন। ইংরাজ-ডেপুটিরা এই দেশীয় অফিসারটির উপর নানা বিষয়ে নির্ভরশীল। নিয়মানুবর্তিতার নামে ওঁদের তদারকি কিছু কড়া ধরনের হ’ত। আত্মরক্ষার জন্যে দিবারাত্র ব্যস্ত থাকতে হ’ত বলে অধীনস্থ কর্মীদের পক্ষে উৎপীড়ক হওয়ার বা উৎকোচ গ্রহণের সময় বা সুযোগ বিশেষ ছিল না। তবে এই পরিদর্শন প্রায়ই গঠনমূলক না হয়ে ধ্বংসাত্মক হ’ত। ক্ষমা নামক শব্দটি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ডেপুটি-সাহেবদের ক্ষমতা তখন বড়োসাহেবরা নির্বিচারে প্রয়োগ করতেন। তবে সেই-সব ক্ষেত্রে ভ্রাস্তি বা গণ-অভিযোগ থাকা চাই।নইলে ঊর্ধ্বতনরা নিম্নপদস্থদের আনীত অভিযোগেরও বিচারে বসবেন।]

[বিঃ দ্রঃ প্রথম জীবনের এই-সব অসুবিধা, পদ্ধতি ও প্রকরণ আমার স্মরণ ছিল। আমরা ক্ষমতায় অসীম হলে এগুলি সম্পর্কে সচেতন হই। অধীনস্থ কর্মীদের ভুল শুধরে দিতে সাহায্য করতাম। তাঁদের সকলের প্রতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৌজন্যবোধ ফিরিয়ে আনি ও আচরণবিধি সৌষ্ঠবপূর্ণ করে তুলি। তাঁদের পারিবারিক বিষয়েও আমরা সাহায্য করেছি। পারিবারিক ক্ষেত্রে অশান্তি ও অসুবিধা থাকলে সরকারী কাজে কিছু ভুল-ভ্রান্তি হওয়া সম্ভব। তাঁরা অসংকোচে অসুবিধার কথা আমাদের জানাতো এবং আমরা তাঁদের পরামর্শ দিতাম। ফলে পুলিশী কাজে সহযোগিতা ও দক্ষতা অনেক বেড়ে যায়।]

সকালবেলা য়ুনিফর্ম পরে অন্যদের মতো নিচে নামলাম। অফিস-ঘরে জনগণের ভিড় আরও বেশি দেখলাম। একই রকম ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি মাত্র। ওদিকে আইন-অমান্য আন্দোলন আরও বেড়েছে। থানার উল্টোদিকে সঘ গড়ে ওঠা একটি নতুন থানা দেখা গেল। কংগ্রেসীরা ঘর ভাড়া করে পাল্টা থানা করেছেন।

পাবলিক প্রসিকিউটর তারক সাধুর মতামত তখনও আসে নি বলে ওটা ভেঙে দেওয়া হয় নি।

এক অ্যাংলো অফিসার চেঁচিয়ে জনৈক অভিযোগকারী ব্যক্তিকে বললেন, ‘যাও, গান্ধী মহারাজকো থানা মে যাও।’—অভিযোগকারী ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে দশ হাজার টাকার গহনা চুরি গেছে। একজন বাঙালী অফিসার বিনয়ের সঙ্গে নতুন স্থাপিত কংগ্রেসী থানা দেখিয়ে দিলেন। (মেদিনীপুর ছাড়া অন্যত্র কংগ্রেসী থানা সফল হয় নি।) পরে ফরিয়াদীর অভাবে সব থানাই আপনা হতে উঠে যায়। অন্য-এক দারোগাবাবু ভদ্রলোককে দরোয়ান রাখার উপদেশ দিলেন। ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আচ্ছা, উনি দরোয়ান রাখার পরও যদি চুরি হয়?’—তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে দরোয়ানের সংখ্যা বাড়াতে বলবো।’

সকলেই তখন ইংরাজ-প্রভুদের সাম্রাজ্য সামলাতে ব্যস্ত। সাধারণ চুরি-ডাকাতি তদন্তের ব্যাপারে তাঁদের সময় কই। কোন্ ফাণ্ড হতে জানি না, বাড়তি কাজের জন্য অফিসারদের ওভার-টাইমও দেওয়া হচ্ছে। পদ-নির্বিশেষে প্রত্যেক কৰ্মী তখন অত্যন্ত ক্লান্ত। ফলে, অতি-পরিশ্রমে অনেকেই অসুস্থ। আন্দোলন আরও বেশিদিন চললে ওদের মনোবল ভাঙতো। এজন্য কর্তৃপক্ষ অফিসারদের রীতিমত আস্কারা দিচ্ছেন। পূর্বে এরূপ গাফিলি ঘটলে তাঁরা বরখাস্ত হতেন। এই সময় অসাধুতা, চুরি, ডাকাতি, জুয়া ও কোকেন ব্যবসা বেড়ে যায়।

সন্ধ্যাকালে বড়োসাহেব যথারীতি থানা পরিদর্শনে এলেন। প্রত্যেক বন্দীকে তাঁর সুমুখে হাজির করা হ’ল। বন্দীদের কারো বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে তিনি তা শুনতেন। অন্য থানাতেও তিনি এই-রকম সান্ধ্য-পরিদর্শন করেন। এক থানার সংবাদ শুনে তিনি অন্য থানাকে ওয়াকিবহাল করেন। এভাবে অপরাধী ধরা পড়লে তিনি তাকে চিনে নিতেন।

‘আমার সঙ্গে তাঁর ব্যবহার খুবই ভালো। কথাপ্রসঙ্গে জানালেন যে তিনি আমার জ্যেষ্ঠতাতের অধীনে কিছুকাল কাজ করেছিলেন। এখন আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বুঝলেন যে জ্যেষ্ঠতাতের মতোই আমি বলবান ও দীর্ঘদেহী। আমাকে পছন্দ হওয়ায় তিনি খুশি হয়ে বললেন, ‘তোমাকে দিয়ে আমি উৎকোচ-গ্রহণ বন্ধ করে এই এলাকার নোংরা-আবহাওয়া দূর করবো। তোমার জ্যেষ্ঠ-ভ্রাতের মতো তুমি সন্দেহাতীত অনেস্ট হবে আশা করি। বড়বাজারে প্রথম ও জোড়াসাঁকোতে দ্বিতীয়বার পোস্টেড হলে জীবনে উন্নতি হয়। তোমাকে এরপর জোড়াসাঁকোতে সত্যেনের কাছে পাঠাবো।এই দুই থানায় টিকে গেলে তোমার উন্নতি অনিবার্য।’ তিনি ইনচার্জবাবুকে সযত্নে কাজ শেখাতে বলে আমাকে পিকেটার ধরার ডিউটি দিলেন।

[নবীশ-অফিসারদের কাজ শেখানো ইনচার্জ অফিসারদের পবিত্র দায়িত্ব। ইনচার্জ-অফিসাররা তদন্তে বেরুবার সময় নবীশদের সঙ্গে নিতেন এবং ডিটেক্‌ট করে ডায়েরি লেখাতেন। খুউব বাছা ও হুঁ দে ব্যক্তিকে থানা-ইনচার্জ করা হ’ত। নবীশদের উপযুক্তরূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হলে ইনচার্জদের কৈফিয়ৎ তলব করা হ’ত।]

পুরানো-যুগ সত্য-বিদায়ের পর নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। তাঁর স্মৃতিস্বরূপ প্রবেশপথে হেড-জমাদারের পুরু তক্তাপোষ ও তার উপরের গর্দী তখনও দেখা যায়। গদীর উপর একটি নিচু ডেকে নথী রেখে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে ওঁরা গড়গড়ায় মুখ রেখে বসতেন। এরকম ব্যবস্থা থানার অফিস-ঘরে অফিসারদের জন্যও ছিল। ছোট জলচৌকির উপর নখী রেখে ভুষি-কালি ও সরের কলমে তক্তাপোষে আসন-পিড়ি হয়ে বসে লেখালেখির কাজ হ’ত। এখন সেখানে কেদারা ও সেজ অর্থাৎ টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা। সম্প্রতিকালেও এই সব লেখালেখি বাংলার বদলে ইংরাজিতে হয়।

তখনও থানার কাজে বহু দেশজ শব্দের ব্যবহার ছিল। যেমন: পেটি অর্থাৎ বেল্‌ট, উর্দি, তদন্ত, দারোগা, কৈফিয়ৎ, গাফিলতি, সরেজমীন তদন্ত, থানা-তল্লাস, দায়রা-আদালত, টুলি অর্থাৎ ট্রুপ, সেরেস্তা, হাজতঘর, মেয়াদ, লালকেতাব অর্থাৎ স্ট্যাটিটিকস্, হাতকড়ি, মুন্সিবাবু, ময়না-তদত্ত অর্থাৎ পোস্টমর্টম, চেরাই ঘর অর্থাৎ মর্গ, হুকুমৎ, সোপার্দকরণ, গ্রেপ্তার, অকুস্থল প্রভৃতি। এমন-কি ইংরাজি শব্দগুলিকেও সিপাহী জমাদাররা নিজস্ব ভাষায় আত্মসাৎ করেছে। যেমন: পিনসিন, রোঁদ অর্থাৎ রাউণ্ড সাসপিন, দলীল অর্থাৎ ড্রিল ইত্যাদি। প্রতিটি থানা-অঙ্গনে ওরা একটি বটগাছ, শিবলিঙ্গ ও কুস্তির আখড়া তুলবেই। এ বিষয়ে ওদের রুখবার ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের কারোরই নেই।

দরবার করে থানায় উৎকোচ বা উপঢৌকন গ্রহণের রীতি আর নেই। শুনলাম, পূর্বে কোকেন ও জুয়ার ডেন্ হতে টাকা তুলে বিচিত্র ভাগে শেয়ার ভাগ হ’ত। যেমন: লায়ন শেয়ার, টাইগার শেয়ার, লেপার্ড শেয়ার, জ্যাকেল শেয়ার ও তারপর ক্রমানুসারে ক্যাট, র্যাট ও ব্যাট শেয়ার। লায়ন অর্থাৎ সিংহ ভাগ নির্দিষ্ট বড়োসাহেবের, টাইগার—ছোটসাহেবের লেপার্ড—বড়োবাবুর এবং তারপর যথাক্রমে মেজ সেজ ছোট ও মুন্সিবাবুর মধ্যে বাকি শেয়ারগুলি ভাগ হ’ত। আমি ছোটবাবু অর্থাৎ মর্যাদার দিক থেকে র‍্যাট, যদিচ কোনোদিনই ওদের তালিকাভুক্ত হই নি। রাত্রে রোঁদে বেরিয়ে কোকেন ডেন। পরিদর্শন করে সকলেই প্রাপ্য গ্রহণ করতেন ছোটো-বড়ো পদমর্যাদা অনুযায়ী; কুড়ি দশ পাঁচ বরাদ্দ হিসাবে। কারো কারো কাছে জুয়াড়ীরা শীল-করা খামে প্রাপ্য পাঠিয়ে দিতো। সিপাহী-জমাদাররা ঠাট্টা করে এঁদের বলতো: ‘খানেওয়ালা বাবু।’

কংগ্রেসী আন্দোলনে ঊর্ধ্বতনরা ব্যস্ত থাকার ফলে তদারকী-ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে নি। এজন্য কিছু কর্মী অধঃপতিত হওয়ায় এরূপ ঘটনা মধ্যে-মধ্যে ঘটতো। রাজনৈতিক আন্দোলনে পুলিশ-কর্মীদের আস্কারা দিলে এরকম অবস্থা হয়ে থাকে। এজন্য বহুদেশে সাধারণ-পুলিশকে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে নিযুক্ত করার রীতি নেই।

কিছু পুলিশ-কর্মী এই সুযোগে প্রলোভন ইত্যাদির শিকার হন বটে কিন্তু অন্যদিকে ওঁরাই আবার বহু প্রশংসীয় গুণের অধিকারী ছিলেন। চোর ও গুণ্ডাদের প্রতি তাঁরা অত্যন্ত কঠোর ও নির্দয়, কিন্তু ভদ্র-গৃহস্থদের সেবায় তাঁরা কখনও কপর্দকও উৎকোচ গ্রহণ করেন নি। বরং দরিদ্র ও অনাহারী ব্যক্তিদের কিছু কিছু দানধ্যান করেছেন। জুয়া ও কোকেন ব্যবসাক্ষেত্র হতে ওঁরা কেউ-কেউ অর্থের ভাগ নিতেন, দুর্ব ত্তদের এই-সব স্থানে আনাগোনা থাকায় তাদের জানতেন ও চিনতেন। এজন্য অপহৃত দ্রব্যাদি দ্রুত উদ্ধার করে অপরাধের কিনারা করতে সক্ষম ছিলেন। অবশ্য কোকেন জুয়া ও সরাবের জন্য অপ্রত্যক্ষ অপরাধ বাড়তো ও গৃহস্থের। ক্ষতিগ্রস্ত হ’ত।

[ওঁদের বৃহৎ গুণ এই-যে ওঁরা নারীদের সম্মান করতেন ও শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। হারানো শিশুরা সপ্তাহ-ভর থানায় থেকেছে, তাদের খেলনা আহার ওঁরা কিনে দিতেন। খোঁজাখুঁজি করে ওদের অভিভাবকদের ডাকা হ’ত।হারানো-শিশুদের সংবাদ তৎক্ষণাৎ প্রতিটি থানায় জানানো হ’ত। প্রতিদিন জমাদার ওই শিশুদের সঙ্গে বেরিয়ে তাদের বাড়ির হদীস নিতো।]

কিন্তু টেগার্ট সাহেবের সরেজমীন দৌরাত্ম্যের ফলে এইভাবে উৎকোচ-গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। আমার জ্যেষ্ঠতাত ও অন্যেরা এবিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। একবার বড়োদিনে আতর-ভিজানো তুলো ধুনে সিল্কের ওয়াড় দিয়ে লেপ তৈরি করে অফিসাররা অন্য দ্রব্যাদি সহ মিছিল করে জনৈক ইংরাজ-ডেপুটিকে উপহার দেন। চার্লস টেগার্ট অল্প সময়ের মধ্যে তা জেনে টেলিফোনে সেই ডেপুটিকে দূর-স্থানে বদলি করেন।—কোনও এক নিম্নপদস্থ কর্মী জুয়াড়ীদের ধমকে ধমকে বলেছিলেন, ‘কাহে নেহি কাম চালাতা? এই লেও রূপোয়া। চালাও।’ ভদ্রলোকের এইভাবে দ্বাদন দিয়ে এলাকার মধ্যে জুয়ার আড্ডা বসানোর সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছুতে বেশি দেরি হয় নি। তিনি মাত্র সন্দেহের বশবর্তী হওয়ায় তাঁকে কর্মচ্যুত করেছিলেন।

[এই পাপ কর্মগুলি শহর হতে উচ্ছেদ করতে প্রভাত মুখার্জি, সত্যেন মুখার্জি সহ আমাকে ও অন্য একজনকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। আমরা সবাই মিলিত প্রচেষ্টায় ওই কর্মগুলি এলাকা হতে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করেছিলাম। তার পরোক্ষ প্রভাবে শহর হতে অপরাধের সংখ্যা অত্যন্ত কমে যায়। আমার বৃহৎ প্রতিবেদনের পর সরকার ডেঞ্জারাস ড্রাগ এ্যাক্ট বিধিবদ্ধ করেন। কোকেনের প্রত্যক্ষ কুফল সম্বন্ধে ওই প্রতিবেদনাটি ছিল আমার একটি উল্লেখযোগ্য থিসিস।]

থানার বড়োবাবু আমাকে অনেক কিছু বললেন ও শোনালেন। তিনি একটি পুলিশী প্রবাদ উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘কাক কখনও কাকের মাংস খায় না। থানার ভিতরের খবর যেন বাইরে না যায়। এখানে দেওয়ালেরও কান আছে। অতএব চোখ আর কান খোলা রাখবে কিন্তু মুখ বন্ধ রাখবে সর্বদা। মুরুব্বীর জোর যতোই থাকুক ফর্জেন্টির আশ্রয় কদাচ নয়। এখানে ক্ষমা নামক কোনো বস্তু নেই। বাগে পেলে কেউ কাউকে ছাড়ে না।’

থিওরিটিক্যাল শিক্ষা আমার শেষ হ’ল। এবার ফিল্ড ওয়ার্ক-এ যেতে হবে। বড়োবাবু আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরুলেন। চিৎপুর রোড ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি। রাস্তার দু‘ধারে ঠোঁটে-রঙ গালে খড়ি পরনে সস্তা জাপানী সিল্কের শাড়ি শীর্ণকায়া হত ভাগিনীরা অপেক্ষারতা। এ অঞ্চলে আমি আগে কখনও আসিনি। বড়োবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরা কারা?’–বড়োবাবু আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন এবং পাল্টা প্রশ্ন করলেন এই-যে, আমার বয়স কতো এবং আমি কতোদিন এই শহরে আছি। আমি উত্তর দেবার আগেই একজায়গায় একটা ভিড় দেখে তিনি ঠেঙাতে শুরু করলেন। শুনলাম, ওরা টপ্‌ কা ঠগীর দল। শিকারের জন্য ওখানে অপেক্ষা করছিল। আমাদের সাথী হাফ-উর্দি সিপাহীর দল ওদের কজনকে ধরে বেঁধে ফেললো।

বড়োবাবু এবার আমাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘ঠেঙাতে মায়া করবেন না। নচেৎ এলাকার ক্রাইমের সংখ্যা বাড়বে। তাতে ঊর্ধ্বতনদের কৈফিয়ত দিতে হয়। তবে লোক চিনে ও বুঝে ও-সব করতে হয়। স্যুট-পরা ঠগীও কিছু-কিছু থানায় আসে। আগন্তুক বড়ো অফিসার নাকি মামুলি ব্যক্তি, ইনসিওরেন্সের এজেন্ট নাকি সে এক প্রতারক তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোঝা চাই। প্রয়োজনে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা বলবে। ওটা হচ্ছে একধরনের ট্যাক্‌ট অর্থাৎ কায়দা। ওর মধ্য হতে এক ঝুড়ি যত্নে সংগ্রহ করে রাখবে কোয়ার্টারে স্ত্রীর নিকট সাপ্লাইয়ের জন্যে। ক্লিয়ার?

আমি বিধিবদ্ধ আইনের প্রশ্ন তুললে তাঁর ব্যাখ্যা: ‘ল’ আর মেনি বাট্‌ ফিউ আর ফলোড। অনেষ্টি বস্তুটা ইন্‌-পারপাস থাকলেই হ’ল। ল’-এর ওয়ার্ডিঙ না-নিয়ে ওর স্পিরিটটা শুধু নেবে। মামলা সত্য বোঝার পর সাক্ষীর অভাবে যেন মুক্তি না পায়। মোড়ে মোড়ে পানওয়ালা, ভুজাওয়ালা ও গরীব বাড়িওয়ালা আছে। প্রয়োজন-মতো ওদের সাহায্য নেবে। উন্নাসিক ভদ্রলোকের কোনও সাহায্যেই আসে না। এক-পা থানায় আর অন্য-পা জেলখানায় রেখে আমরা কাজ করি।’

এ-সব তত্ত্বকথায় আমি মুষড়ে পড়েছিলাম। বড়োবাবু-আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘ডোন্ট ওরি। তুমি ঠিক টিকে যাবে।’

রাস্তার ওপারে রঙমাথা নারীরা পুলিশ দেখে ঘোড়দৌড় শুরু করে দিলো। কেউ আছড়ে ফুটপাতে পড়লো, উঠে আবার সে দৌড়োয়। পুলিশ তাদের জাপটে ধরে একজায়গায় জড়ো করে। একজন ঘরের তক্তাপোষের নিচে লুকিয়েছিল। তাকে পাজাকোলা করে বাইরে আনা হ’ল। চোখের জল ওদের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু মুখে প্রতিবাদের ভাষা নেই। হতভাগিনীরা দরিদ্রতম রূপোপ-জীবিনীর দল। অভিজাত বেশা-রমণীদের মতো এদের বাধা উকীল নেই। এরা খরিদ্দারের অপেক্ষায় রাস্তার ধারে দাড়ায়। তাই রাস্তাবন্দীর অপরাধে অপরাধিনী। মোক্তার ও দালাল এসে ওদের জামিন হবে। কোর্টে গিয়ে পরদিন এৱা জরিমানা দেবে। দৈনিক উপার্জনের দশগুণ গুণাগার। ফলে তাদের উপর্যুপরি কয়েকদিন অনাহার। বাড়িউলির কাছে দেহগুলি শুধু বন্ধক থাকবে। সেই দেনা বহুকাল পরিশোধও হবে না। ওদের হাড় জিরজির দেহ। হাত দিলে ব্যথা লাগে। এই-সব পেটিকেস হতে সরকারের বড়ো-রকম আয়। থানার স্ট্যাটাসটিকস্ ঠিক রাখতে হলে এর প্রয়োজন। মামলার সংখ্যা কমলে কর্তৃপক্ষের নিকট বড়োবাবুকে কৈফিয়ত দিতে হবে।

আমি এই কুলটা নারীদের প্রতি সহাভূতিশীল হয়ে পড়ি। শীতের রাতে ওদের গায়ে পাতলা শাড়ি আর পুলিশ মোটা বনাতের ওভারকোট পরে ওদের ধরেছে, শীতে এবং ভয়ে ওরা কাপছে। রাত দশটা পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু-টাকাও উপার্জন হয় না। পুলিশের হল্লার ভয়ে প্রধান খরিদ্দার মুটে-মজুরেরা ও পথ মাড়ায় না। থানায় পশুক্লেশ নিবারণী অর্থাৎ ঘা-ওয়ালা পুলিশকে (সি এস পি সি এ) দেখেছি। গবাদি পশুদের জন্য এক শ্রেণীর লোক চিন্তা করে। কিন্তু এই পশুদের প্রতি সকলের শুধু ঘৃণা ও অবজ্ঞা। এদের পুনর্বাসনের বা আশ্রয়ের চিন্তা কারোরই নেই। আমার মনোভাব ও বিষণ্ণতা বড়োবাবুর নজর এড়ায় নি। তিনি অল্পক্ষণ কি-যেন ভাবলেন তারপর একটু ইতস্তত করে জমাদারকে বললেন, ‘এই ছোটবাবু বহুৎ ঘাবড়া গয়া। আজ উনলোককে। ছোড় দেনে বোলো।’—ছাড়া পেয়ে চটিজুতোর পটপট শব্দ করে ওরা দৌড়ে যে-যার ঘরে ঢুকলো। ওদের ছেড়ে দিতে পেরে সিপাহীরাও খুশি। (পরে, চেষ্টা করেও আমি এই প্রথা উচ্ছেদ করতে পারি নি।)

প্রতিদিন থানায় দলে-দলে ফুটপাত-অবরোধী সব্জীওয়ালা ফলওয়ালা ফুচকাওয়ালা ভুজাওয়ালা প্রভৃতিকে সিপাহীরা ধরে এনে হপ্তাপুর্তি করে। ঝুড়ি ও চুবড়িতে থানার মেঝেগুলি ভর্তি। পচনশীল দ্রব্য থাকায় ওগুলো থানাতেই নিলাম হবে। উচিত-মূল্যের সিকিভাগও ওঠার সম্ভাবনা নেই। ওগুলি সবই আইনমত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল।

আদালতে ‘হ্যাঁ’ বলবার আগেই ওদের জরিমানা হয়ে যায়।

‘আসামী মাথুরাম বাপকে নাম নাথুরাম রাস্তামে ফল বিক্রি কিয়া?’

‘নেহী হুজুর’

‘দো রূপেয়া’

কোথাও কমা পূর্ণচ্ছেদ নেই। এক বাক্যে ও এক নিশ্বাসে বিচার শেষ। বেশি কথা কইলে জরিমানার বহর বাড়ে। মামলা লড়লে পড়তা পোষায় না। তাই সকলে দোষ কবুল করে ঝঞ্ঝাট এড়ায়। এটা ওদের কাছে ফুটপাত ভাড়ার মতো। আমি বড়োবাবুকে এই বিষয়ে কিছু বলেছিলাম। ফুটে বসার আগেই তো ওদের সরানো যায়। ভোরবেলা লোক পাঠিয়ে তাড়ানো হয় না কেন? এতদিনে তাহলে ওরা বিকল্প জীবিকার সন্ধান করতো এবং পেয়ে যেতো। এখন অযথা পুনর্বাসনের প্রশ্ন উঠবে। পথ-অবরোধ বন্ধ করার এখন একটিমাত্র উপায় ক্রেতাদের ধরে থানায় আনা। তাহলে ক্রেতার অভাবে ওরা এমনি অন্যত্র চলে যাবে।

বড়োবাবু একটু ভেবে আমাকে তত্ত্বকথা ভুলে যাবার জ্ঞান দিলেন।তিনি আরও বললেন যে আমি ওয়েলার্স হর্স। কিন্তু এখনও যথাযথভাবে ব্রেক পাইনি। —আমি অবাক হয়ে ভাৰি যে ফুটপাতে বসতে দেবো অথচ তারপর ধরবো। মদ যথেচ্ছ বিক্রি করবো, অথচ মাতাল হলে তাকে ধরবো, এ কেমন রীতি। বড়োবাবুর মতে ওগুলো সরকারের দ্বিমুখী আর্থিক আয়ের ব্যবস্থা মাত্র।

[ক্ষমতায় আসার পর আমার এলাকায় মুচী ও নাপিত গ্রেপ্তার বন্ধ করি। পরে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয়তা বুঝে ওদের পথ অবরোধের আওতা থেকে মুক্তি দেন।]

হঠাৎ আমার থানার কাজ শেখা বন্ধ হ’ল। আমাকে পিকেটিঙ ডিউটিতে না-দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ রুষ্ট। শুনলাম, ‘আই অ্যাম আনডার ওয়াচ। পরদিন হতে সদাসুখ ও মনোহর দাস কাটরা অঞ্চলদ্বয়ে আমার ডিউটি পড়লো।

বিঃ দ্রঃ-বড়বাজারে মহিলা ও বালক-পিকেটারদের সংখ্যাই বেশি। অ্যাংলো-সার্জেন্টদের বিরুদ্ধে অশালীনতার কিছু অভিযোগ আসে। এজন্য একজন সচ্চরিত্র ও ভদ্রকর্মীকে এই কাজে নিযুক্ত করার হুকুম। কিন্তু এজন্য আমাকে কেন বাছা হ’ল তা বুঝলাম না। আমি নিজে যা-দেখেছি ও করেছি এবং যা শুনেছি তা-ই মাত্র এখানে উল্লেখ করবো। কলকাতা-সহ বাংলার অন্যত্রও এরকম ঘটনাই ঘটে থাকবে। এ হতে আইন অমান্য আন্দোলনের একটি নিখুঁত চিত্র পাওয়া যাবে। বড়বাজার তখন ভারতের সর্বপ্রধান বস্ত্র-ব্যবসায় কেন্দ্র। এখানকার প্রতিটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া সমগ্র ভারতে পড়তে বাধ্য। বোম্বে আমেদাবাদ প্রভৃতি দেশীয় বস্ত্রের মিলগুলি তখনও যথেষ্ট জোরদার নয়। বিলাতী বস্ত্রের প্রতিযোগিতায় তারা টিকে থাকতে চায়। তাই বড়বাজারের আন্দোলনে তারা কেউ-কেউ যথেষ্ট টাকা দিতো।মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দালন দেশপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বড়বাজারে অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। তবু ব্যবসায়ীরা মজুত মাল নষ্ট হতে দেবে না। ওদিকে ম্যাঞ্চেস্টারের স্বার্থে ব্রিটিশ শাসকরা উদগ্রীব। তাই মূল সংঘাত বড়বাজারের বিপণন কেন্দ্রগুলিতে বেশি হয়।

আইন অমান্য

এইদিন থানায় বহু কংগ্রেসী পিকেটার বালকদের ধরে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেরই বয়স দশ-বারো মাত্র। উঁচু লরীতে তারা নিজেরা উঠতে পারে না। দু’হাতে এক-একজনকে তুলে লরীর ভিতর ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছিল। ভিতরের পাটাতনে পড়ে ওরা যন্ত্রণাদায়ক কোঁক কোঁক আওয়াজ করছিল। লরী ভর্তি হলে ওদের কোনও দূরস্থানে ছেড়ে দেওয়া হবে। কারণ জেলখানায় আর তিল-ধারণের জায়গা নেই। গন্তব্য স্থানে নিয়ে গিয়ে এমনি করে আবার পথের ওপর ছুঁড়ে ফেলা হবে। আমি এতটা সহ্য করতে না-পারায় অ্যাংলা-সার্জেন্টদের সঙ্গে কলহ শুরু হ’ল। একজন সার্জেন্ট তো চেঁচিয়েই বললে, ‘দেন জয়েন দি আঙ্গার ক্যাম্প।’ বড়োবাবু আমাদের উভয়কে শান্ত করে আমাকে একান্তে ডেকে বললেন, ‘মাথা গরম কোরো না। সাহেবদের কানে উঠবে। গোপন নথীতে দাগ পড়বে: সিমপ্যাথেটিক।’

থানা-বাড়িতে একদিকে কংগ্রেসী পিকেটার ও অন্যদিকে সাধারণ আসামী। খোয়াড়ের হাসমুর্গির মতো ঠাসাঠাসি সকলে মেঝের উপর বসে। সাধারণ আসামীরা দলে-দলে জামীনে বেরিয়ে গেল। কিন্তু কংগ্রেসী পিকেটারদের কেউ জামীনে মুক্তি চায় না। তাঁরা জেলগুলি ভর্তি করতেই এসেছেন। তাঁদের স্থান সংকুলানের জন্য চোর ও বদমায়েসদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। জেলে পাঠানোর আগে পঞ্চাশ-ষাটজন পিকেটার সকলেরই বিবৃতি লিখতে হবে।

কিন্তু কাজটি অন্যক্ষেত্রে দুরূহ হলেও এঁদের বেলায় খুবই সহজ। এঁরা নিজেদের নামটি শুধু বলবেন, পিতার নাম ও ঠিকানা উহ্য থাকে। অতএব শুধু একটি করে ইংরাজি ছত্র লিখলেই কাজ শেষ। নিচে মন্তব্য: ‘দে রিফিউজড্ টু মেক্‌ স্টেটসমেন্টস।’ অর্থাৎ এঁরা কেউ বিবৃতি দিতে রাজী নন। পঞ্চাশ-ষাটটি নাম লিখে মাত্র দুটি পাতার ডায়েরি লেখা শেষ হ’ল।

সার্জেন্ট সাহেব কিন্তু আমার নামে রিপোর্ট করেছিলেন। ইংরাজ ডেপুটি কমিশনার আমাদের উভয়কে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘ডোন্ট কোয়ার্লস্ অ্যামঙ্গ ইয়োরসেল্ফ।’-সার্জেন্ট সাহেব আমার সঙ্গে সেকহাণ্ড করে বললেন, ‘ফরগিভ অ্যাণ্ড ফরগেট।’—ট্রামে-বাসে আমাদের দুজনের মধ্যে কিছুটা আলাপ হ’ল।উনি তাঁর ইংল্যাণ্ডবাসিনী মায়ের কথা শোনালেন। ভারতে আসার সময় ওঁর মা নাকি দুটি উপদেশ দিয়েছিলেন। উপদেশ দুটি হ’ল এই: ‘কিপ্, ইওর হেড কভার্ড অ্যাণ্ড ইওর বা ওয়েলস্ ক্লিল্ড।’ —মাথা ঢেকে রাখবে এবং কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখবে।

সদাসুখ ও মনোহরদাস কাটরার বিলাতী বস্ত্রের দোকানগুলিতে পিকেটারদের দৌরাত্ম্য বেশি। সমগ্র ভারতে এখান থেকেই বিদেশী বস্ত্র সরবরাহ হয়। দোকানগুলিকে অবরুদ্ধ করে রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। তাহলে অন্য-কোথাও বিলাতী বস্তু-পাঠানো সম্ভব হবে না।

কিন্তু আশ্চর্য এই-যে পিকেটিঙের স্থানে প্রাপ্তবয়স্ক কোনও পুরুষ নেই। কেবল নারী ও শিশু, বালক ও কিশোর। বহু নারীর ক্রোড়ে শিশু। বয়স্করা ইতিমধ্যে জেলখানা ভর্তি করেছে। মেদিনীপুরের বহু নারী ট্রেন-বোঝাই হয়ে শহরে আসে। বাকী গুজরাটী নারী আর বাঙালী মহিলা।

শহরের মধ্যে বহু হল ও ঘর ভাড়া নেওয়া হ’ত। এগুলোকে বলা হ’ত— সিক্রেট ক্যাম্প। এই-সব ক্যাম্পে বালক ও কিশোরদের এনে জমা করা হ’ত আর এখান থেকেই তারা পিকেটিঙে বেরুতো। ধরা না পড়লে ফিরে আসতো এই-সব জায়গাতেই এবং পরদিন আবার পিকেটিং। ওদের আহার কারা যোগাতো কেউ তা জানে না। এই সিক্রেট ক্যাম্প আবিষ্কার করতে পারলে অফিসাররা ক্যাম্প-প্রতি একশ টাকা বকশিস পেতেন।

বিঃ দ্রঃ—আমি খবর পেয়ে অন্যদের সঙ্গে ভোররাত্রে একটি সিক্রেট ক্যাম্পে হানা দিয়েছিলাম। একটি হল-ঘরে কজন কিশোর ধরা পড়ার পর আর কাউকে পাই নি। ওদের কিছু বালক হুজুগে মেতে এসেছিল। গৃহ-পলাতক বালকের সংখ্যাও কম নয়। একজন তার বন্ধুকে ফেলে জেলে যেতে চায় নি। সে আমাকে চুপিচুপি ছাদের অন্য এক কক্ষে যেতে বললে। সেখানে গিয়ে আমরা তার বন্ধু-সমেত আরও আটজন বালককে ধরতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওই হল ঘর কারা ভাড়া করেছে তা বহু চেষ্টা সত্ত্বেও জানতে পারি নি।

মহিলারা কিন্তু এভাবে একস্থানে জমায়েত থাকতো না, অন্য কোথা হতে আসতো। বয়স্ক-পুরুষেরা তাদের লরী-ভর্তি করে ভোররাত্রে আনতো এবং সুবিধাজনক স্থানে নামিয়ে দ্রুতগতিতে সরে পড়তো। তাদের কেউ-কেউ ট্রামে-বাসেও আসতো। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা তারা কখনও কাউকে দেয় নি।

ওঁর সকলেই নিরুপদ্রব অসহযোগী ও আইন অমান্যকারী। এঁদের গ্রেপ্তার করে থানার ঠিকানা বলে দিলেই হ’ল। সঙ্গে করে কাউকে থানায় যাবার প্রয়োজন নেই, ওঁরা নিজেরাই সংশ্লিষ্ট থানায় উপস্থিত হতেন। —একদিন এই প্রথার ব্যতিক্রম ঘটলো। দোকান-মালিকের নিয়োজিত কুলিরা বিলাতীবস্ত্রের গাঁট ঠেলাগাড়িতে তুলছে, একদল হিন্দীভাষী মহিলা তাদের আটকে দিলেন। তাঁরা গ্রেপ্তারও হবেন না। মহিলাদের গায়ে হাত দেবার রীতি নেই। অথচ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে হবেই। দূর হতে অ্যাংলো-সার্জেন্টরা আমাকে ওয়াচ করছে। কাছেই বাঙালী মহিলাদের একটি দল পিকেটং করছিলেন। কিছু নাবালিকা এবং শিশুক্রোড়ে মহিলাও আছেন সেই দলে। তাঁদের নেত্রীদের নিকট আমি সাহায্য চাইলাম। গান্ধীজীর নীতির বিষয়েও আমি তাঁদের বোঝালাম।

নেত্রীদ্বয় মোহিনী দেবী ও প্রতিভা দেবী এসে ওঁদের কিছুটা বকলেন। এঁদের সাহায্যকারিণীদেরও আমি পুলিশ ভ্যানে তুললাম।জনৈকা বৃদ্ধ। উঁচু ভ্যানগাড়িতে উঠতে পারছিলেন না দেখে তাঁর সাহায্যার্থে একটি নিচু টুল এনে দিলাম। একজনের একপাটি শিল্পার ভ্যান হতে নিচে পড়ে গেল। চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে কেউ দেখছে কিনা তারপর চট করে শিপারটি গাড়িতে তুলে দিলাম। এই সময় থানার এক ঊর্ধ্ব তন-অফিসার পরিদর্শনে এলেন। জেলখানা থেকে আপত্তি এসেছে সেখানে ছোট শিশু বা কমবয়সী বালক যেন পাঠানো না হয়। এই সাহেব একজন বাঙালী মহিলাকে বললেন, ‘আপনার থোকার বাবার নাম বলুন। খোকাকে তাঁর কাছে রেখে আসবো।’—কিন্তু ভদ্রমহিলা স্বামীর নাম বা বাড়ির ঠিকানা বলতে অস্বীকার করলেন, তিনি ওই শিশুপুত্র ক্রোড়েই জেলে যেতে বদ্ধপরিকর। অফিসারটি ভীষণ রেগে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই কে আছো, এ-দিকে এসো। বাচ্চাটাকে ট্রামের তলায় ফেলে দাও।’—ভদ্রমহিলা শিউরে উঠেও সামলে নিলেন। অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক আছে। তাই হোক। গোলামের সংখ্যা না-ই বাড়লো।’—একটি বালক তার মাসীর আঁচল কিছুতেই ছাড়বে না। সে কান্না শুরু করে দিলো। মাসীর সঙ্গে সে জেলে যাবে। জনৈক সার্জেন্ট তার সেই আঁচল চেপে ধরা হাতে উপর্য্যুপরি বেত্রাঘাত করলো। তবু সে হাত সরালো না। এদিকে জেলখানায় দারুণ স্থানাভাব। অন্যদিকে বালক ও শিশুর দল জেলে যাবার জন্যে আবদার ও কান্না আরম্ভ করেছে। বলা হ’ল যে পরদিন তাদের জেলে পাঠানো হবে, তবু তারা থানা পরিত্যাগ করতে চাইলো না। তখন তাদের রুলের গুঁতো দিয়ে ঠেলে থানা থেকে বার করে দেওয়া হ’ল।

অ্যাংলো-সার্জেন্টরা ঠেঙাতে ওস্তাদ হলেও ফরিয়াদী হতে নারাজ। পরদিন সারাক্ষণ আদালতে থাকতে হবে। সাক্ষী দিয়ে ফিরতে দেরি হয়ে ধায়। তাতে তাদের বলড্যান্স ও ককটেল পার্টি মাটি। বড়োই অসুবিধা। তবে আদালতে অভিযুক্তদের কেউ বড়ো-একটা আত্মসমর্থন করেন না। সংশ্লিষ্ট পুলিশ-কর্মীর জেরাহীন সাক্ষ্যতেই তাঁদের ছমাস জেল।

থানায় নাবালক সাবালক বাছাও মুশকিল হচ্ছিল। সেজন্য মাপকাঠি হিসাবে একটি কচি বাঁশ আড়াআড়ি টাঙানো হ’ল। কারো মাথা তাতে আটকালে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হ’ত। কিন্তু যাদের মাথা ঠেকে গেল তাদের সাবলিক বুঝে ঠেঙিয়ে হাজতে পুরে দেওয়া হ’ল। গান্ধীজীর মন্ত্রমুগ্ধ সমগ্র দেশটাই তখন জেলে যেতে উৎসুক। ওদিকে জেল-কর্তৃপক্ষ বারে বারে বলে পাঠাচ্ছেন: ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী।’

প্রতি সন্ধ্যায় বহু মহিলাকে থানায় আনা হয়। নিজেদের ব্যয়ে তাঁদের ও তাঁদের বাচ্চাদের চা লস্যি মিষ্টি ও লজেন্স দিই। টেবিলের চতুর্দিকের বিশখানি চেয়ারে লাল নীল ও সবুজ শাড়িতে ভর্তি হয়ে যায়। পরের দিন ওদের কোর্টে পাঠানো হবে। আত্মপক্ষ সমর্থন না করলে ওদের প্রত্যেকের ছমাস জেল বরাদ্দ।

[কোনও পিকপকেটার ধরা পড়লে সে বলতো: ‘হুজুর, হামকে পকেটমারীমে মাত ভেজিয়ে, হাম লোককো পিকেটিংমে দে দিয়ে। ইসমে ভী ছ’ মাহিনা উসমে ভী ছ’ মাহিনা, লেকেন উসমে খানা আচ্ছা মিলতা।’]

ফুটফুটে চৌদ্দ বৎসরের এক বালিকা মহিলাদের মধ্যে ছিল। তার উপর আমার একটু মায়া হ’ল। তাকে এক বাটি দুধ খাওয়ালাম ও বললাম, ‘খুকি, বাড়ি যাও। তোমাকে আমরা চাই না। জেলে গেলে তোমাকে কেউ বিয়ে করবে না।” —আমি ভালো মনে কথাগুলি বললেও বালিকাটি ক্ষেপে উঠে বললে, ‘আমার ওপর এতো দরদ কেন? গভর্নমেন্ট অফিসারকে বিবাহ করতে আমরা তৈরি হই নি। আমাদের বিবাহ করবার জন্যে অন্য বহুলোক আছে।’

পরদিন আদালতে হাকিম ওয়াজেদ আলীকে আমি বলেছিলাম যে ওই নাবালিকাটিকে মুক্তি দিলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তার জেলে যাবার বড়ো ইচ্ছা। সে অদ্ভুতভাবে ক্ষেপে উঠে প্ৰকাশ আদালতে বললে, ‘গ্রেপ্তার করার পর থেকে আমার প্রতি ওঁর বড়ো দরদ। কী মতলব উনি স্পষ্ট করে বলুন।’—আদালতসুদ্ধ লোক হতবাক। কেউ-কেউ হেসে উঠলেন। হাকিম সাহেব মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্টিল ইউ রেকম্যাণ্ড হার রিলিজ?’ পরে কি-ভেবে ওই বালিকাকে তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন। মেয়েটি কবার আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে তাকালো তারপর গজগজ করতে করতে নিচে নেমে গেল।

[বিঃ দ্রঃ উপরোক্ত ঘটনার প্রায় ছ’বছর পর কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ একটি মোটর কিছুদূরে ব্রেক কষে থেমে গেল। একটি সুশ্রী সুবেশ যুবক গাড়ি হতে নেমে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার, আপনার নাম কি মিঃ ঘোষাল? ছ’বছর আগে আপনি কি বড়বাজার থানায় ছিলেন? আমার স্ত্রী ওই গাড়িতে বসে রয়েছেন, তিনি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। আপনার গল্প তিনি প্রায়ই আমাদের বলেন।’ —তাঁর কথা শুনে আমি তো অবাক। গাড়ি হতে নেমে শাড়ি-সিঁদুরে ঝলমলে এক বধূ আমার পায়ের ধুলো নিলো। পরে তার পরিচয় পেয়ে আমি সত্যই বিস্মিত। শুনলাম, ওর স্বামী একজন মুনসেফ। তখন হেসে তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে মুনসেফ কি গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট নন?’

মহিলাটি আমার সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি। লজ্জায় তাঁর মুখ লাল। সময়ের ব্যবধানে তাঁর ব্যক্তিত্বের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ওঁরা আমাকে ওঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু ওঁদের ঠিকানা নেওয়া সত্ত্বেও সেই নিমন্ত্রণ আমি আর রক্ষা করতে পারি নি।]

জনৈকা বিদুষী কুমারী তরুণী একদিন রাস্তার মোড়ে শুয়ে পড়লেন। স্বরাজ না-পাওয়া পর্যন্ত তিনি এইভাবে পথ অবরোধ করে থাকবেন। ভদ্রঘরের সুন্দরী বাঙালী তরুণীকে সিপাহীদের দ্বারা সরাতে বিবেকে বাধলো। আমার ডান হাতে স্টিক ছিল, বাম হাতে তাঁর হাত ধরে ফুটে তুললাম। মেয়েটি ফুটপাতে উঠলো, কিন্তু আমার পিছন ছাড়তে চায় না। আমার সঙ্গে সঙ্গে আসে আর বলতে থাকে: ‘আমার হাত যখন ধরেছেন তখন আমাকে সঙ্গে করে নিতে হবে।’ ব্যাপার দেখে অন্যান্য মেয়েরাও হইচই করে উঠেছে। চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। আমি বেশ জোরেই বললাম, ‘আমি আপনাকে বামহাতে ধরেছি, ডানহাতে নয়। সুতরাং আপনার কোনও ক্লেম্ থাকতে পারে না।—ওদের সকলকে অতঃপর ভ্যানে পিকআপ করে থানায় এনেছিলাম। পরদিন হাকিম অবশ্য সাবধান করে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

কদিন বাদ ওই মেয়েটি একগোছা নিষিদ্ধ প্রচারপত্র-সমেত ধরা পড়লো। সে আমার হাতে কিছু লিফলেট গুঁজে দিয়ে বললে, ‘চলুন। থানায় চলুন।’ এই শ্রেণীর মেয়েরা সাধারণতঃ বাড়ির ঠিকানা বলে না বলে’ আমাদের খুব সুবিধা। বাড়ি তল্লাসীর হাঙ্গামা থেকে রেহাই পেয়ে যাই। কিন্তু এই প্রথম তার ব্যতিক্রম ঘটলো। সে সহজভাবেই ঠিকানা বললে। ওটা নারী-কর্মীদের একটি সিক্রেট ক্যাম্প। ক্যাম্পের সভ্যারা সবাই জেলে, নেত্রীরূপে সে-ই শুধু বাইরে। একটা নড়বড়ে কাঠের সিড়ি ও তার সংলগ্ন কাঠের বারান্দা। সিডিতে ভারী শরীরের ভার সহ্য হয় না। সিপাহী দুজনকে নিচে রেখে বারান্দায় উঠে এলাম। হঠাৎ একটি স্থান মচ মচ করে উঠলো। রেলিঙটা একপাশে কাত হয়ে পড়লো। আমি ভয় পেয়ে বললাম, ‘ভেঙে পড়বে না তো।’—সে কাছে এগিয়ে এসে হাসি-মুখে বললে, ‘এইবার যদি আপনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিই?’ মেয়েটির আগমনে সত্যি সত্যি রেলিঙ কাপতে লাগলো। আত্মরক্ষার জন্যে আমি হাত বাড়িয়ে একে ধরে ফেললাম। সে কাছে এসেছিল আমাকে সাহায্য করবে বলেই, আমি ক্ষমা চাইলাম অহেতুক ভয়ে ওকে জড়িয়ে ধরবার জন্যে। সে একটু হেসে বললে, ‘এবার কিন্তু আপনিই অপরাধী।’

তার কক্ষে কোনও নিষিদ্ধ প্রচারপত্র পাওয়া যায় নি। মেয়েটি বললে যে সে চা তৈরি করবে এবং আমাকে খেতে হবে। আমি অস্বীকৃত হলে মেয়েটি শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বললে, ‘যা বলি শুহন। নইলে চেঁচাবো।’—ক্ষিপ্রহাতে সে স্টোভ জেলে চা তৈরি করলো এবং আমাকে তা গ্রহণ করতে হ’ল অনন্যোপায় হয়ে। ভাঙা-সিঁড়ি বেয়ে সাক্ষীরা ও সিপাহীরা উপরে উঠতে পারে নি। আমি তখন মেয়েটির হেপাজতে অসহায়।

তাকে আর না-ঘাঁটিয়ে আলাপ শুরু করলাম। জানা গেল, সে ধনাঢ্য জমিদার ও ব্যবসায়ীর অতি-আদরের একমাত্র সন্তান। গ্র্যাজুয়েট। ঢাকায় ও কলকাতায় ওদের কয়েকটি বাড়ি আছে। পরিশেষে হেসে যা বললে তার অর্থ এই: এখন সে আমাকে দাদা বলছে বটে কিন্তু পরে এই সম্বোধন থাকবে কিনা নিশ্চয়তা নেই।

—বেশ প্রাণোচ্ছল ও স্পষ্ট-চরিত্রের মেয়ে। দুঃসাহসিকাও বটে।

এই সময়ে জেলে স্থানাভাব হওয়ায় মুচলেখা লিখে বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হ’ত। আমি প্রস্তাব দিলাম। সে বললে, ‘সংগঠনের পক্ষে নিয়ম-বহির্ভূত হলেও আমি এই প্রস্তাবে রাজী। প্রকৃতপক্ষে সে এসব ছেড়ে পড়াশুনায় মন দেবার পক্ষপাতী। তাদের বালিগঞ্জের বাড়ির ঠিকানা দিলে, বললে, ‘আমাদের বাড়িতে অবশ্যই একদিন যাবেন। নইলে এপথে আমি আবার নামবো। —রীতিমত হুমকি। সাংঘাতিক মেয়ে! এই ধরনের মেয়েদের কাছ থেকে দূরে থাকাই উচিত। কিছুদিন পরে যথারীতি ঘটনাটি আমি ভুলে যাই।

[বিঃ দ্রঃ-এর বেশ কিছু পরবর্তীকালের ঘটনা। শহরে ১৪৪ ধারা জারী হয়েছে। পথে মিছিল নিষেধ। আমি অন্যদের সাথে প্রতিরোধার্থে ডিউটিতে আছি। দেখলাম একটি বিরাট মিছিলের সঙ্গে মারমুখী জনতা। সম্মুখে একটি মেয়ে পতাকা হাতে নেত্রীত্ব দিচ্ছে। ওদের রোখা শক্ত বুঝে হেডকোয়ার্টারসে ফোন করলাম: এফেকটিভ ফায়ারিঙ ছাড়া রোখা অসম্ভব। —হুকুম আসার পূর্বেই ইষ্টক বর্ষণ শুরু হয়েছে। জনা-দশেক সশস্ত্র শান্ত্রী আহত। হতাহতের সংখ্যা বেশি হলে বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়বে এবং ওরাও আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। দলনেত্রী মেয়েটি প্রাণপণে জনতাকে শান্ত করতে চাইছে। কিন্তু তারা তখন আর আয়ত্তে নেই।

ওদের ভয় দেখিয়ে পিছু হটানোর উদ্দেশ্যে হুকুম দেওয়া হ’ল: ‘টু স্পেসেস্ স্টেপ ব্যাক। শুনলি টু রাউণ্ড। ওপেন ফায়ার। —পূর্বাপর ঘটনায় আমরা কিঞ্চিৎ নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম, ফলে অসতর্ক মুহূর্তে একটা গুলি ছিটকে বেরিয়ে অঘটন ঘটালো। জনতা তখনই ছুটাছুটি হাওয়া। একমাত্র দলনেত্রী মেয়েটি পথে মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়েছে। তাকে দেখে আমার আর বাকস্ফুরণ হয় না। একটা চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দুহাতে তার রক্তাপ্লুত দেহটা তুলে সেই গাড়ির মধ্যে রাখলাম। সে চোখ মেলে অস্ফুটস্বরে বললে, ‘আপনি? আপনার কোনো ক্ষতি হয় নি তো! আপনি ভালো আছেন?’

রাত্রে হাসপাতালে তার স্টেটমেন্ট নিতে নিজেই গিয়েছিলাম। অপারেশন সাকসেসফুল হলেও সে তখনও অর্ধ-অচৈতন্য। তার কপালে হাত রেখে বুঝলাম ক্ষতের জন্য জ্বর এসেছে। সে একবার চোখ মেলে আমার হাত মুঠি করে চেপে ধরলো। একজন নার্স ছুটে এসে আপত্তি জানিয়ে বললে, ‘ওঁকে এখন বিরক্ত করবেন না। এখন ওঁর বিবৃতি দেবার কোনও ক্ষমতা নেই।’—খাতা-পেনসিল গুটিয়ে নিয়ে আমি থানায় ফিরে এলাম।

দুদিন পরে টেলিফোনে জানলাম যে মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে এবং কথা বলছে। এখন তার বিবৃতি নিতে কোনও অসুবিধা নেই। হাসপাতালে তখন তার বহু আত্মীয়-স্বজন। হাসপাতাল-সংলগ্ন রাস্তায় মোটর গাড়ির সারি। ওদের ম্যানেজার-ভদ্রলোক ছুটাছুটি করছেন। আমাকে দেখে ওর পিতা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ইউইউইউ আর দ্যাট ইনস্পেক্টর।’ মেয়েটি ক্ষীণকণ্ঠে বাধা দিয়ে বললে, ‘ওর দোষ নেই বাবা, উনি গুলি ছোঁড়েন নি।’ কন্যার কাছেই মাতা দাঁড়িয়ে ছিলেন। জগদ্ধাত্রীর মতন চেহারা। তিনি বললেন, ‘ওদের আর দোষ কি। ওরা পেটের দায়ে চাকরি করে। বাবা, তুমি এমন সুন্দর ছেলে, এই নোংরা চাকরি ছেড়ে দাও।’

বহিপ্রাঙ্গণে তখন তরুণ কংগ্রেসী নেতারা চিৎকার করছিল: ‘বন্দে মাতরম।’ আমারই সম্পর্কিত পিতামহ এই মন্ত্র দেশকে দিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু তা উচ্চারণ করার অধিকারও আমার নেই। আমি অধোবদনে ওদের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ডাক্তারদের অভিমত: মেয়েটি বাঁচবে না। (‘এজন্য আমরা কি নারী-হত্যার জন্য দায়ী বলা যায়?’)

ওদিকে বড়বাজারে পিকেটিং এতটুকুও বন্ধ হয় না। কর্তৃপক্ষ শীঘ্রই বুঝলেন যে গ্রেপ্তার করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না, অন্য ব্যবস্থা প্রয়োজন। দলে দলে পিকেটার-বালকদের থানায় আনা হচ্ছিল। অ্যাংলো-সার্জেন্টদের হাতে মোটা খেঁটে। পরক্ষণে মার-মার-মার। ওরা অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল। ‘জল আন, জল আন।’ ফার্স্ট এড-ও দেওয়া হচ্ছে। চকমিলান থানা-বাড়ির উপরের তলগুলির চতুর্দিক ঘিরে অফিসারদের কোয়ার্টারস। সেখানে জানলায় জানলায় পুলিশ-গৃহিণীরা দাঁড়িয়ে নিচের উঠোনে কাণ্ড দেখছেন ও ডুকরে কেঁদে উঠছেন। গৃহিণীদের কারো কারো হাতে সুতা-কাটা তক্‌লি দেখা যায়। পুত্রেরা গোপনে বাড়িতে চরকাও এনেছে। গান্ধীজীর ডাক পুলিশ-পরিবারের অন্তঃপুরেও পৌঁছেছে। রক্তাক্ত কলেবর বালকের দল জ্ঞান ফেরামাত্র চেঁচিয়ে উঠলো, ‘বন্দে মাতরম।’ আবার মার, আবার তারা অজ্ঞান। বারে বারে একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। তাদের মুখের হাসি কিন্তু প্রতিবারেই অটুট থেকেছে। কাউকে কটূক্তি করতে পর্যন্ত শোনা যায় নি।

যারা এমনি করে চুপ করে মার খেতে পারে তারা একবার ঘুরে দাড়ালে নিশ্চয়ই দুর্বার হ’ত। কিন্তু ওদের মধ্যে এতটুকু বিদ্বেষের ভাব দেখি নি।

অধিকাংশ দেশীয় অফিসাররা নীরব দর্শক। (অবশ্য তা বলতে বিবেকে বাধে।)

একটা শুকনো বেতের ছড়ির মাঝখানটি আমি চিরে রেখেছিলাম। কর্তাদের হুকুমে যদি মারতে হয় তাহলে বিশেষ লাগবে না, অথচ ফটাফট শব্দ বের হবে। তাতে সাহেবরা বুঝবেন যে অন্যদের মতো আমিও একজন লয়েল-অফিসার। ক্রমে ক্রমে পুলিশ-কর্মীরাও ওদের প্রতি সিমপ্যাথেটিক হয়ে উঠেছে। (সিমপ্যাথেটিক শব্দটি পুলিশে তখন শোধনবাদী শব্দের মতো ভয়ংকর।) ওদের তাড়া করে ধরতে বললে সিপাহীরা লাঠি ঠুকে কিছুদূর এগোয় ও ফিরে এসে বলে, ‘না মিলি। ক্যা করু।’ মুশ্লিম-সিপাহীরা নির্লিপ্তভাবে মুখ ঘুরিয়ে বলেছে যে এখন তাদের রোজা, মিথ্যে সাক্ষী তারা দেবে না।

[আশ্চর্য!—এই বে-আইনী মারধোরে আদালতে কজন পুলিশ-কর্মী দণ্ডিত হন। জনৈক প্রধান হাকিম আমাকে বলেছিলেন, ‘আস্ক ইওর অফিসার টু বি কেয়ারফুল।’ আমাদের অধিকর্তা ইংরাজ ডেপুটি কমিশনার সম্পর্কেই তিনি একথা বলেছিলেন। এই-সব হাকিমদের দূর চট্টগ্রামে বদলী অনিবার্য ছিল।]

একদিন সন্ধ্যায় বিশজন মহিলা-সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করে থানায় এনেছিলাম। অভিযোগ-বইয়ে ওঁদের নাম লিখতে হবে। কিন্তু ওঁরা অসহযোগী হওয়ায় নাম বলতে নারাজ। পীড়াপীড়ির ফলে একজন বলেন, ‘আমার নাম—শ্রীমতী ব্রিটিশ-শত্রুনী দেবী।’ অন্যজনের উত্তর: ‘আমার নাম—কুমারী সাম্রাজ্য-ধ্বংসী দেবী।’

—কী সাংঘাতিক! এই-সব শব্দ কানে শোনাও মহাপাপ। বাধ্য হয়ে আমরাই ওঁদের একটি করে নাম রাখি। যেমন—ললাটিকা, নলস্তিকা, মহাশ্বেতা, নবনীতা ইত্যাদি। পরিশেষে ভালো নাম ফুরিয়ে গেলে এই-সব নাম রাখি: জগদম্বা, ক্ষেমৎকরী, নৃত্যকালী, মহাকালী ইত্যাদি। কিন্তু আদালতে এই সব নামে ওঁরা সাড়া দিতেন না। ফলে, পরদিন সনাক্ত করাও আমাদের পক্ষে মুশকিল হ’ত।

একদিন বড়বাজারে সোরগোল পড়ে গেল।—চামুণ্ডা দেবী! চামুণ্ডা দেবী! মহাবলী গোরা-সার্জেন্টরাও তাঁর ভয়ে ভীত। এক অ্যাংলো-সার্জেন্টের ঘড়িসুদ্ধ কবজি একবার তিনি চেপে ধরায় হাতটি ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। দুবার বন্দে-মাতরম বলার পর সার্জেন্টটি মুক্তি পান এবং হাসপাতালে ভর্তি হন। ছ’ফুট লম্বা এই দেহাতি মহিলার মধ্যে-মধ্যে আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু কোথা থেকে এসে কোথায় চলে যান কেউ তা জানে না। তাঁর হাতে হান্টার থাকতো বলে তখন তিনি সাধারণভাবে হান্টারওয়ালী নামে পরিচিতা।

হঠাৎ তিনি বড়বাজারে কাটরা অঞ্চলে এসে উপস্থিত। বিলাতী বস্ত্রের গাঁটবাহী কুলিদের পিঠে গুম করে কিল বসিয়ে তাদের পিঠ দুমড়ে দিচ্ছিলেন তিনি। আমরা ব্যাপার দেখে একটা ভারী শতরঞ্জি তাঁর মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে সকলে চেপে ধরলাম। তিনি সব কজনকে শতরঞ্জি-সহ উল্টে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং কুলিদের পিঠে আবার গুম গুম কিল বসাতে লাগলেন। জনৈক কংগ্রেসী নেতা সেই সময় সেখানে এসে পড়েছিলেন। তাঁর বোঝানোর ফলে তিনি গ্রেপ্তার হতে সম্মত হন। আমরা তাঁকে থানায় নিয়ে এলে তিনি পুনরায় নিজমূর্তি ধরে টেবিল-চেয়ার উল্টাতে আরম্ভ করে দিলেন।

আমাদের ইনচার্জবাবু গোলমাল শুনে তাঁর ঘর হতে বেরিয়ে এলেন এবং আসামীকে দেখে বললেন, ‘আরে এঁকে ধরেছো কেন? ওঁকে গ্রেপ্তার করা বারণ। এখনই সব চেয়ার-টেবিল ভেঙে তছনছ করে দেবে।’—বড়োবাবু কংগ্রেসী ফাণ্ডে দশ টাকা চাঁদা তাঁর হাতে দিলেন এবং তিনি থানা হতে বেরিয়ে গেলেন। ওঁর টাকার দরকার পড়লে এইভাবে তিনি আবির্ভূতা হন। শুনলাম যে জেল-কর্তৃপক্ষও ওঁকে জেলে রাখতে চান না। তাই গ্রেপ্তার না-করে কোনোমতে তাড়িয়ে দেওয়াই হুকুম। একবার তো বেয়নেটের খোঁচায় তাড়াতে হয়েছিল।

কোনো স্থানে একজোড়া তরুণ-তরুণী ঘনিষ্ঠভাবে বসে পিকেটিং করছিল। আমি প্রত্যহই তাদের দুজনকে একসঙ্গে একই স্থানে পিকেটিং করতে দেখি। বিচিত্র ভাবের বশবর্তী হয়ে আমি অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করে একদিন বলি, ‘উহু। এটা ঠিক হচ্ছে না। আপনারা একটু দূরে দূরে বসবেন।’ ওরা অপ্রতিভ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। বেশ কিছুকাল ওদের আমি প্রতিটি কাটরায় বৃথাই খুঁজেছি। দিন-পনেরো পর ওদের আবার একসঙ্গে পিকেটিং করতে দেখলাম। সেদিন মেয়েটির সিথিতে সিঁদুর আর ছেলেটির হাতে কাঁচা দুর্বার রাখী দেখে সদ্যোবিবাহিত দম্পতি বুঝে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

এই সময় পুলিশ এবং পিকেটারস ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি অলিখিত ভদ্রলোকের চুক্তি গড়ে ওঠে। সন্ধ্যার পর পিকেটিং হবে না, দোকানীরা দোকান বন্ধ রাখবেন এবং পুলিশও বিশ্রামার্থে নিজ-নিজ থানায় ফিরবেন—এই হ’ল চুক্তি। কিন্তু লোভাতুর কিছু ব্যবসায়ী দোকান সামান্য ফাঁক করে ভিতরে বসে থাকতেন খরিদ্দারের আশায়।

জনৈক প্রৌঢ় রায়বাহাদুর এক দোকানে গোপনে কিছু বিলাতী বস্ত্র সওদা করতে এলেন। পুলিশ এবং পিকেটাররা চুক্তিমতো অনুপস্থিত। চতুর্দিকে বিজলী-বাতিগুলি নিবছে একে-একে। লোকজনের কলরব স্তিমিত।

‘আমার দাদু আপনাকে ডাকছেন। তিনিও কাপড় কিনতে এসেছেন।’ একটি চতুর্দশী বালিকা যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে তাঁর কাছে নিবেদন করলো: ‘দাদুর পায়ে গাউট হয়েছে বলে তিনি দোকান থেকে উঠে আসতে পারলেন না, আমাকে পাঠালেন। আমার সঙ্গে আপনি ওদিকের দোকানে গেলে তিনি খুশি হবেন।’

দাদুর নাম শুনে তিনিও খুশি। ওঁরা উভয়ে বন্ধু এবং উচ্চপদস্থ অবসরভোগী রায়-বাহাদুর। অতএব উৎসাহিত হয়ে তিনি বালিকাটির সঙ্গী হলেন এবং তার নির্দেশমতো একটি গলির মধ্যে প্রবেশ মাত্র অপেক্ষারত ছেলের দল তাঁকে পাকড়াও করলো। একজন নাপিত তাঁর সযত্ন লালিত দীর্ঘ সাদা দাড়িগোঁফ খরখর করে কামিয়ে দিলো। তাতে বাটির জল যতো না ছিল, চোখের জল মিশেছিল তার চেয়ে বেশি। ওদের প্রত্যেকের হাতে ধারালো ছুরি। অন্য-একজন তো চটপট তাঁর কান বিধিয়ে এবং আয়োডিন লাগিয়ে প্রতি-কানে একটি করে পিতলের মাকড়ি এবং দুহাতে কিছু কাচের চুড়ি পরিয়ে দিলো। বাকী ছিল পরনের ধুতি। সাজ সম্পূর্ণ করার জন্যে সেই ধুতি খুলে শাড়ি ও ব্লাউজ পরিয়ে তাঁকে একটা রিকশায় তুলে দিলো এবং চালককে নির্দেশ দিলো তাকে যেন নিকটবর্তী থানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

ভদ্রলোক তো থানায় এসে উপস্থিত। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি হাউমাউ করে বললেন, ‘মশাই, আমি স্ত্রীলোক নই। আমি রায়বাহাদুর অমুক চন্দ্র অমুক।’—থানায় তৎক্ষণাৎ হুলুস্থুল পড়ে গেল। এমনটি এই এলাকায় কখনও ঘটে নি। তাঁর প্রতিবেদনে ডাকাতি মামলা রজু করা হ’ল।’ বড়োসাহেব ছুটে এলেন এবং কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করলেন। সংবাদ পেয়ে ডেপুটি-সাহেব এলেন ওসব দেখে অবাক হলেন। কোয়ার্টারস হতে ওঁর জন্যে ধুতিও চাদর আনা হ’ল, তিনি শাড়ি ও ব্লাউজ পরিবর্তন করলেন। আমি দৌড়ে ঘটনাস্থলে গেলাম এবং সেখান হতে তাঁর ক্ষৌরীক্বত দাড়ি ও গোঁফ সংগ্রহ করে আনলাম। সেগুলি একত্রে একটা তার দিয়ে বেঁধে তাতে লেবেল এঁটে লেখা হ’ল: একস্‌জিবিট নং ১। শাড়ি ব্লাউজ ও চুড়িগুলিকে দুভাগে আলাদা করে যথাক্রমে লেখা হ’ল দুই ও তিন নম্বর একস্‌জিবিট। অন্যগুলিকে চার নম্বরের একস্‌জিবিটের টিকিট সাঁটা হ’ল।—পরে আদালতে কেস উঠলে মামলার প্রদর্শনী দ্রব্যরূপে এগুলো দেখানোর সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা।

একদিন এলাকায় হরতাল ডাকা হয়। অজুহাত-পুলিশী জুলুম। হ্যারিসন রোড হরতালের জন্য ফাঁকা। ফুটপাতে চেয়ার ও বেঞ্চি পেতে বসে আমরা অপেক্ষা করছি। সিপাহীরা এখানে-ওখানে বসে গোঁফে তা দিচ্ছে, খৈনি খাচ্ছে, জমাদাররাও আছে। আমাদের আশংকা, মিছিল যদি আসে তাহলে এলাকা নিরুপদ্রব না-ও থাকতে পারে।

পুলিশ-ঘেঁষা লোক সব সময় কিছু না-কিছু থাকে। সেই রকম এক পরিচিত ভদ্রলোক সেখানে এলেন। পুলিশী ভাষায় এ দের বলা হয়: পুলিশ ফ্রেণ্ড। ইনি ধনীর পুত্র, নিজস্ব গাড়ি ও বাড়ি দুইই আছে। গাড়িটি কেউ চাইলেই ব্যবহার করতে দেন। প্রয়োজনে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী হন। তাঁর রায়বাহাদুর পিতার মতো তিনিও বিশেষভাবে রাজভক্ত। পরনে ফিনফিনে বিলাতী ধুতি ও পাঞ্জাবি। তিনি একজন হেড-কনস্টেবলের কাছে গিয়ে ভাব জমালেন এবং বললেন, ‘ইনে লেড়কা লোককো পিটনে চাহী। ইংরাজলোক হামলোককো কিত নী উপ্‌কার কিয়া। এহী বেইমান লোক উন্‌কো হটানে মাঙতা।’— জমাদার ওসব শুনে গোঁফ মুচড়ে যা উত্তর দিলো তা এই-যে সেকথা তো ঠিকই, কিন্তু আপনিও একজন বাঙালী। কোনও বাঙালীর মুখে এরকম উক্তি জমাদারের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। —একটু দূরে এক অ্যাংলো সার্জেন্ট ওদের কথাবার্তার ধরন লক্ষ্য করছিল। এইবার তিনি কাছে এগিয়ে এসে জমাদারকে জিজ্ঞাসা করলেন যে ওই বাবু তোমাকে কী বলছিল? জমাদার দাঁড়িয়ে উঠে সত্যি কথাই বললে, ‘উনি স্বদেশীদের সম্বন্ধে কিছু কথাবার্তা বলছিলেন।’ আর যায় কোথা! সার্জেন্ট সাহেব তাই শুনে দারুণ ক্ষেপে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলেন এবং তাতেও তৃপ্ত না হয়ে মাটিতে ফেলে ক্রমাগত বুটের ঠোক্কর দিতে লাগলেন। আমি দূর থেকে হাঁ-হাঁ করে ছুটে আসছিলাম, কিন্তু তার আর দরকার হ’ল না। ঘটে গেল একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা।

কংগ্রেসী ষাঁড়

একটি প্রকাণ্ড ষাঁড় বড়বাজারের ফুটপাতে নির্বিবাদে ঘুমুচ্ছিল। এক কংগ্রেসী বালক মজা করবার জন্যে কাগজে করে একমুঠো কড়া নস্যি তার নাকের নিচে ধরলো। ঘুমন্ত ষাঁড় ঘন নিশ্বাসে তার সবটুকু নাকের মধ্যে টেনে নিলে। এবং শুরু হ’ল প্রতিক্রিয়া। যাকে বলে এলাহী কাণ্ড। ষাঁড়টি ক্ষেপে গিয়ে কেবল হাঁচে আর দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োয়। সে প্রথমেই ওই সার্জেন্ট সাহেবকে গুতিয়ে চিৎ করে ফেললো। তারপর পরোয়া না-করে বন্দুকধারী শাস্ত্রীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। পালাও পালাও। বন্দুকধারী শাস্ত্রীদের সকলেই হিন্দু ও গুর্খা—হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের কেউ গো-বধে রাজী নয়। ফলে, ষাঁড়টির লম্ফঝম্ফ একটুও কমলো না। তার লাল-পাগড়ির উপরেই যেন বেশি রাগ। ভয়ে পুলিশও দৌড়োয় জনতাও দৌড়োয়। হ্যারিসন রোড কয়েক মুহূর্তে একেবারে জনমানবশূন্য।

কী বিচিত্র শিক্ষা! সার্জেন্ট সাহেবটি তো ঢিট হলেনই, পরদিন সেই রাজভক্ত ভদ্রলোকটিকে দেখে আমি তো অবাক। পরিবর্তন তাঁর মধ্যেও। ফিনফিনে বিলাতী ধুতি ও পাঞ্জাবির পরিবর্তে আজ তার পরনে মোটা খদ্দরের ধুতি আর মাথায় খাদি গান্ধী টুপি। ষাঁড়ের অযাচিত শিক্ষা তিনি এমনভাবে গ্রহণ করেছেন যে সেদিন থেকেই তাঁকে কংগ্রেসের বিশ্বস্ত কর্মী হতে দেখা গেল। এমনকি মোটা অঙ্কের চাঁদাও তিনি কংগ্রেস ফাণ্ডে দিয়েছিলেন।

বিঃ দ্রঃ—প্রকাশ্যে প্রহার দ্বারা নিয়োগকারীদের যথেষ্ট ক্ষতি করা হয়েছিল। এই প্রহার যারা দেখে বা শোনে তারাও ব্রিটিশ-বিরোধী হয়। প্রহৃত ব্যক্তির মতো তার বন্ধু, আত্মীয় ও পড়শীরাও গভর্নমেন্ট-বিরোধী হয়। এযুগের পুলিশ-কর্মীদেরও তা স্মরণ রাখা উচিত। শৈশবে আমি এক থানায় এক নারীর চুল ধরে এক দারোগাকে প্রহার করতে দেখেছিলাম। তাতে আমার মনে পুলিশ-বিরোধী মনোজটের (কমপ্লেক্স) সৃষ্টি হয়েছিল। পরে বহু উৎপীড়ন ও প্রহারাদি দেখেছি কিন্তু শৈশবে দেখা সেদিনের ঘটনাটাই আমাকে বেশি ব্যথিত করে। এজন্য শিশুদের সম্পর্কে পুলিশদের বেশি সাবধান হওয়া উচিত।

আমাকে একদিন জনৈক ইংরাজ ঊর্ধ্বতন অফিসার বলেছিলেন, ‘তোমাদের মতো ভদ্র ও সদ্ব্যবহারকারী কর্মী যতো বেশি হবে আমাদের জনপ্রিয়তা ততো বাড়বে। আমাদের রাজ্য-শাসনও ততো দীর্ঘায়িত হবে। কিন্তু উৎপীড়ক ও প্রহারকারী অফিসাররা প্রকারান্তরে আমাদের বিদায় ত্বরান্বিত করবে। এদের ব্যবহারের জন্যই তোমাদের দেশ তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে। প্রকৃতপক্ষে ওরাই এই ঘুমন্ত দেশকে পিটিয়ে জাগিয়ে দিচ্ছে।’

থানা-বাড়িতে আচমকা ভূতের উপদ্রব শুরু হ’ল। ‘ঠিক দুক্কুর বেলা ভূতে মারে ঢেলা’ নয় বরং ‘ঠিক দুক্কুর রাতে ভূতে ঢেলা নিয়ে মাতে’-গোছের ব্যাপার। চকমিলান থানা-বাড়ির উঠোন ইটের টুকরোয় ভরে যাচ্ছিল। মাঝরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত ক্রমাগত ইষ্টক বর্ষণ। কিছু কর্মী তাতে জখম হয়। প্রতিবেশীদের ছাদে পাহারা বসানো হ’ল। তীব্র সার্চলাইট জ্বেলে চতুর্দিক খোঁজা হয়েছে। কিন্তু ইট উৎক্ষেপের উৎপত্তির স্থান বুঝতে পারা যায় নি। আমরা থানা-বাড়ির উঠোনটা তারের জাল দিয়ে আবৃত করলাম, তবু প্রতিরোধ করা গেল না। এক জমাদার তো ভূতের ওঝা ডেকে আনলো, মাঝরাতে তার সে কী মন্ত্র আউরানো! আশ্চর্য, তাক করে ঠিক তার মাথাতে ঢিল। মন্ত্র-টন্ত্র সব ভণ্ডুল। প্রাণ বাঁচাতে সবাই অস্থির। অতএব ভূত ধরা সম্ভব হ’ল না।

ডেপুটি-সাহেব সব শুনে আমাকে বললেন, ‘বাট ইউ আর এ সায়ান্স স্টুডেন্ট।” —তার নির্গলিতার্থ ছাড়াও আমি বুঝেছিলাম যে অত্যন্ত চতুর কংগ্রেসী কর্মীদের দ্বারাই এ অ-ভূতকর্ম। পরখ করবার জন্য কজন ধরা পড়া পিকেটার বালককে উঠোনে সারারাত্রি বসিয়ে রাখা হ’ল। ব্যস! সেই রাত থেকেই ইট-বর্ষণ বন্ধ।

এই বুদ্ধি বার করার জন্য আমি কুড়ি টাকা পুরস্কার পেয়েছিলাম।

একবার একটি বে-আইনী কংগ্রেসী মিছিল জোর করে ভেঙে দেওয়া হয়। ক্রুছ একদল জনতা থানার সামনে এসে ইষ্টক বর্ষণ শুরু করলো। তখনও পুলিশের পক্ষ থেকে গুলি বর্ষণের রীতি নেই। থানায় কোনপ্রকার আগ্নেয়াস্ত্র থাকতো না। লাঠিই ভরসা। ওই অস্ত্রে দাঙ্গাকারীদের রুখতে কনস্টেবলরা প্রায়ই আহত হ’ত। পরে উভয়পক্ষ হাসপাতালের পাশাপাশি শয্যায় শুয়ে সুখ-দুঃখের গল্পও করেছে। পুলিশের জনৈক কর্তাব্যক্তি এসে হুকুম দিলেন, ‘চার্জ লাঠি।’ তারপর সাহেব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আরে এ কী-রকম লাঠিচার্জ হচ্ছে। কেউই এখনও ইন্‌জিওর্ড হ’ল না। কারো এতটুকু রক্ত বেরুচ্ছে না। হাসপাতালে পাঠানোর মতো একটা কেসও তো নেই। হুম্। দেখছি, সবাই সিমপ্যাথেটিক।’

সাহেব কোমর থেকে নিজস্ব পিস্তল বার করলেন। এক কিশোর এগিয়ে এসে জামা খুলে বুক পেতে দাঁড়ালো। বললে, ‘মারুন।’ — সাহেব লজ্জা পেলেন এবং পিস্তলটি যথাস্থানে গুঁজে রাখলেন।

খবর পেয়ে কংগ্রেসী-কর্মীরা ছুটে এসে জনতাকে ঠাণ্ডা করলেন। ইট-বর্ষণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। এইটুকু ভায়োলেন্সের জন্য কংগ্রেস-কর্মীরা দুঃখিত ও দারুণ লজ্জিত। ইংরাজ ডেপুটি কমিশনার গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে থানায় ঢুকছিলেন। তাঁকে অপদস্থ না করে সসম্মানে তারা পথ ছেড়ে দিলো।

একবার এক পিকেটার-বালক এগিয়ে এসে একটা লজেন্স ডেপুটি-সাহেবের হাতে গুঁজে দিয়েছিল। ইংরাজ-সাহেব পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলেছিলেন, ‘সে কী! এটা তুমি আমাকে খেতে দিলে? আচ্ছা, আমি গ্রহণ করলাম।’—লজেন্সটি তিনি পকেটে পুরে রাখলেন। পিকেটার-বালকেরা আমাদের মুখে প্রায়ই লজেন্স গুঁজে দিতো ও বলতো, ‘সেদিন বড্ডো মেরেছিলেন। এই নিন। আপনি একটা লজেন্স খান।’

কোনও জেলে তখন আর কয়েদী রাখার জায়গা নেই। স্থান সংকুলানের জন্য পুরানো দাগী কয়েদীদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে এলাকায় চুরির সংখ্যা অসম্ভব বেড়ে যাচ্ছে। আমার উপর একদিন ঊর্ধ্বতন কর্তাদের হুকুম হ’ল, একদল মহিলা ও কিশোরীকে লরী করে দূরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। আমার সঙ্গে সেই রাত্রে একজন মাত্র ড্রাইভার ছিল। শহর থেকে ষোল-সতেরো মাইল দূরে এক জায়গায় ওদের আমি নামালাম। কিন্তু ওরা ওই জঙ্গলের মধ্যে কিছুতেই পড়ে থাকতে চাইলো না, সবাই মিলে আমাকে ধরে একটা সাঁকোর উপর বসিয়ে দিলো। একা আমি ও ড্রাইভার তাদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারলাম না। ওরা আমাদেরই দেশের মা ও ভগিনী। উপরন্তু অতজনের সঙ্গে লড়াই করাও অসম্ভব। সুতরাং ওদের সঙ্গে একটি গোপন-সন্ধি করতে হ’ল। আমরা নিকটের একটি রেল-স্টেশনে ওদের পৌঁছে দিলাম। আমাদের শর্তানুযায়ী দু‘পক্ষের কেউই এ-ঘটনা কাউকে প্রকাশ করি নি।

[এইখানে তরুণ শিক্ষিত পুলিশ-অফিসারদের অসুবিধা বেশি হ’ত। লাঠিচার্জের হুকুম হলে জনতাকে তাড়া করা হ’ত। ওই জনতার মধ্য বহু আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী ও পরিচিত পড়শীদের মুখ দেখা যেতো। উদ্যত ষষ্টি তাদের মাথায় বসানো সম্ভব হ’ত না।]

রাত্রিদিন অবিরাম ডিউটি। শরীর প্রত্যেকের ভেঙে পড়েছে। বহু অফিসার ও সিপাহী পীড়িত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আন্দোলন আরও কিছুদিন চললে শাসন-ব্যবস্থা ভেঙে পড়তো। একদল মহিলা থানায় ঢুকে বন্দে মাতরম ধ্বনি তুললেন। জনৈক রাজভক্ত অফিসার তখন ক্ষেপে উঠে বললেন, ‘মেথরানী! টাট্টিকো ঝাঁটা লে আও।’ থানার মেথরানী ঝাঁটা নিয়ে এলো। কিন্তু তাঁর পরবর্তী আদেশ প্রতিপালন করলো না। এদিকে অন্য কজন অফিসার প্রতিবাদ করায় নিজেদের মধ্য কলহ বেধে গেল। সহানুভূতিতে দেশীয় কর্মীদের মধ্য আনুগত্যও প্রতিদিন কমে আসছিল।

প্রধান হাকিম ছুটিতে ছিলেন। তাঁর স্থলে এক সিনিয়র হাকিম কাজ চালিয়ে খাচ্ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্রটি প্রতি বৎসর পরীক্ষায় প্রথম হয়, কিন্তু পিকেটারদের সঙ্গে সে-ও গ্রেপ্তার হয়েছিল। ওই বিচারপতি তাঁর পুত্র সম্বন্ধে কি-রকম বিচার করেন তা দেখে একটা প্রতিবেদনের জন্য কর্তৃপক্ষ আমাকে আদালতে পাঠান। হাকিম সাহেব একবার মাত্র নিজের পুত্রের পানে তাকালেন তারপর মুখে কলম কামড়ে একমুহূর্ত বোধহয় চিন্তা করলেন যে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে কী বলবেন। তিনি অন্যদের সঙ্গে পুত্রটিকেও ছ’মাসের মেয়াদ দিয়ে টলতে-টলতে এজলাস ছেড়ে খাস কামরায় চলে গেলেন। পর বৎসর দেখা গেল তিনি রায়-বাহাদুর খেতাব লাভ করেছেন।

সুসংবাদ এলো ৮ মার্চ ১৯৩১ গান্ধী-আরউইন প্যাক্ট সমাপ্ত। অ্যাংলো-সার্জেন্টরা তাই শুনে ক্ষেপে উঠে বলেছিল, ‘এরকম অপদার্থ বড়লাট ভারতে আগে আর-একজনও আসে নি।’ আগের দিন বহু তেরঙা ঝাণ্ডা ও কংগ্রেসী ফেসটুন থানায় এনে বিনষ্ট করা হয়েছিল, আজ সেই-সব পতাকা ও ফেসটুন ফেরত দেবার হুকুম এলো। অগত্যা রঙিন কাগজ কিনে তাই দিয়ে পতাকা ও ফেসটুন তৈরি করে ওদের ফেরত দেওয়া হ’ল। কিছু পরে বড়বাজারের শিখাধারী কংগ্রেসী-কর্মীরা ঝুড়ি-ঝুড়ি মিঠাই এনে আমাদের বিতরণ করলো।

আইন অমান্য আন্দোলন তখন সম্পূর্ণ বন্ধ। কিন্তু সিক্রেট ক্যাম্পগুলিতে তখনও বহু বালক মজুত। এদের মধ্যে অনেকেই গৃহ-পলাতক বালক। বাড়িতে ওদের আশ্রয় নেই। তারা খায়-দায় আর জেলখানা ঘুরে আসে। এখন মুশকিলে পড়লো। এখন তাদের কেউ আর খবর নেয় না। পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থাও নেই। নেত। ও উপনেতাদের তারা পাত্তা পায় না। কোনো কাজ নেই। না-লেখাপড়া না-গৃহপ্রত্যাবর্তন। ফলে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে গেল।

এই বে-ওয়ারিশ বালকদের সম্বন্ধে আমি সরকার বরাবর একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলাম। ওদের সে-সময়ে বাড়ি-ফেরার গাড়ি ভাড়াও নেই। আমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে কয়েকজনকে রেলভাড়া দিয়েছিলাম। পরে গভর্নমেন্ট থেকে ওদের সংগ্রহ করার হুকুম আসে। কিন্তু তখন কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।

এই আন্দোলনে পুলিশদেরও যথেষ্ট আস্কারা দেওয়া হয়েছিল। তাদের মারমুখী স্বভাব সংযত করা কঠিন হয়ে ওঠে। পূর্বস্বভাব ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। বহুদিন পর্যন্ত ওদের আইনানুগত করা সম্ভবপর হয় নি। প্রকৃতপক্ষে পুলিশ দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন দমন করতে গেলে এ রকমই হয়ে থাকে।

কার্যোদ্ধার সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পরদিনই দেখা গেল ইংরাজ-উর্ধ্বতনরা ভিন্নমূর্তি ধরেছেন। ৮ মার্চের দিনই রিপোর্ট রুমে একজন অ্যাংলো অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার জনৈক নতুন ভর্তি স্নাতকোত্তর তরুণ কর্মীকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘ইয়া! ইউ আর এম-এ-সা (এম-এস-সি)। ইউ মাস্ট আন লার্ণ হিয়ার হোয়াট ইউ লার্নড দেয়ার।’—সেই সঙ্গে তিনি আরও কয়েকটি আপত্তিকর কটূক্তি করেন। তরুণ-কর্মীটি তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ স্বরূপ কর্মে ইস্তফা লিখে দিয়েছিলেন। উপস্থিত ইনচার্জবাবুরা তাঁকে বুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন। তারা বলেছিলেন:

‘আরে এ কী করছো! আমরা এখানে দশজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী ‘উপরওয়ালা যদি গালি দেয় তাহলে বিশটা পাবলিককে আমরা গালি দেব। তাতে নিদ্রাও ভালো হবে আর মনের জালাও মিটবে।’ অন্য একজন বাঙালী প্রৌঢ় ইনচার্জ সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আরে শব্দ হচ্ছে ব্রহ্ম। তার কোনো আকার নেই, অর্থও নেই, যা-হোক একটা-কিছু মানে করে নিলেই হ’ল। জাপানে ড্যাম মানে গোলাপ ফুল, এখানে তার অর্থ গালাগালি। তাছাড়া গরু ডাকে, ঘোড়া ডাকে, বাঘ ডাকে। ডাকে তো? মনে করো এখানে সেই রকম কেউ-কেউ ডাকছে। তাতে কী রাগ করতে আছে? ছেলেবেলায় বাবা আমাকে বকলে আমি কী ভাবতাম জানো?—ষাঁড় ডাকছে!

[কোনও এক নতুন অফিসার সংস্কৃতে এম-এপাশ বলায় তাঁর প্রৌঢ় ইনচার্জ বলেছিলেন, ‘সে কী! সংস্কৃত শিখে থানায় চাকরি করলে কার-কি উপকারে আসবে। তার চাইতে কোথাও একটা টোল খুলে বসলে না কেন?’]

যাদের আত্মসম্মান জ্ঞান নেই তারা মানুষও খুন করতে পারে। উর্ধ্বতনরা এভাবে ওদের আত্মসম্মান বোধ বিনষ্ট করে অনেককেই তাদের মতো অসদ্বব্যবহারী এবং উৎপীড়ক করে তুলতো।

এতদিন বলা হ’ত নরম্যাল ওয়ার্ক বন্ধ করো। এখন নরম্যাল ওয়ার্ক না করার জন্যে কৈফিয়ৎ। ওদিকে ইংরাজ-ডেপুটিরা ক্লাব-জীবনে ফিরে গেছেন। অফিসাররাও সিনেমা দেখতে ও নিমন্ত্রণ-রক্ষা করতে সক্ষম। কিন্তু শীঘ্রই বোঝা গেল যে পূর্ব-দিনগুলিই ছিল ভালো। বড়োসাহেব এসে থানার মালখান। পরিষ্কারের হুকুম দিলেন। চোখের সামনে এক নিদারুণ ঘটনা ঘটতে দেখলাম। বাংলায় লেখা বহু বাঁধানো কেতাব বাইরে এনে জড়ো করা হ’ল। ওগুলিতে সুন্দর হস্তাক্ষরে সরল পরিভাষা-সমূহ লেখা। কলিকাতা পুলিশের স্থাপনাকাল হতে ১৯১০ খ্রীঃ পর্যন্ত থানার কাজ বাংলা ভাষায় সমাধা করা হ’ত। নিষ্প্রয়োজন মনে করে ওগুলি প্রাঙ্গণে পুড়িয়ে ফেলা হ’ল। দুশো বছরের অমূল্য সম্পদ এভাবে ভস্মীভূত হতে দেখে আমি হতবাক।

[একই কেতাবে পর-পর নম্বর-সহ ভৃত্যচৌর্য, গৃহচৌর্য, প্রবঞ্চনা ইত্যাদি বহু অপরাধের অভিযোগ। সিপাহীদের বেয়াদবী ও গাফিলতির বিষয় ওতাতে রয়েছে। কে কাকে কি গালি দিয়েছে বা কে হুকুম তামিল করে নি-কেতাবগুলির পার্শ্বে বাংলা ভাষায় ঊর্ধ্বতনদের লেখা মন্তব্যও ছিল।]

মা ঠিক সময়ে খেতে ও ঘুমাতে বলেছিলেন। কারো মনে কষ্ট দিতে ওমারামারির মধ্যে যেতেও তাঁর বারণ ছিল। কিন্তু এখানে তাঁর প্রতিটি উপদেশের বিপরীত কাজই করতে হয়। বিপদজনক কাজে ঝাঁপিয়ে কতবার জখম হয়েছি। মা-র নাগাল হতে ছেলে ছিনিয়ে কতবার গ্রেপ্তার করেছি। বাইরে বেরুলে লিখতে হ’ত কোন্ সময়ে বেরুলাম ও কখন ফিরলাম; কিজন্য কোথায় গিয়েছি ও সেখানে কি কাজ করেছি। বেরুবার আগে ও ফিরবার পরে ডায়েরি বইয়ে ও প্রতিবেদনে তা লেখা চাই। দু-রাত্রি রাউণ্ডের পর একরাত্রি বিশ্রাম। ঢুলতে ঢুলতে যাওয়া এবং ঢুলতে ঢুলতে ফেরা। কখনও সারাদিন তদন্তে থাকি। সাক্ষী দিয়ে কোর্ট হতে বিকালে ফিরি। সকালের খাবার বিকালে খেতে হয়।

[পরে সাহেবদের বুঝিয়ে আমিই দু-রাত্রির বদলে একরাত্রি অন্তর রাউণ্ডের ব্যবস্থা করেছিলাম। এর আগে এবিষয়ে প্রতিবাদ করতে কেউ সাহসী হয় নি।]

বড়োসাহেব একবার থানায় এসেছিলেন। উনি দারুণ চেঁচামেচি করে গেলেন। জুনিয়র অফিসার শুক্রল সাহেব বড়োবাবুকে বললেন, ‘আপনি রোঁদে আছেন বললে উনি হয়তো বিশ্বাস করলেন না। চেঁচাতে দাও। ওতে মন শান্ত হবে।’—বড়ো-বাবু একটুও ভীত না-হয়ে বললেন, ‘একসঙ্গে দুজনে আগে কাজ করেছি। এখন উনি উচ্চপদস্থ হলেও পরস্পরের দুর্বলতা জানি। জব্বরকে ডেকে বলো, কিছুদিন বন্ধ রাখুক। আমাকে উনি বেশি ঘাঁটাবেন না। তবে তোমরা একটু সাবধানে থেকো। এখন তিনি বাড়িউলি হয়ে পূর্বজীবন ভুলে গেছেন।’ (এ রকম কথা-বার্তা তখনও আমার কাছে দুর্বোধ্য।)

শীঘ্রই বুঝলাম যে পুলিশ-বিভাগ এক গহন সুন্দরবনের সঙ্গে তুলনীয়। সেখানকার কাকড়া-বিছা মাঝে মাঝে দংশন করবে। ডাঁশ মশার কামড়ে উত্যক্ত হতে হবে। শুধু দেখতে হবে সাপের দংশন বা বাঘের আক্রমণের মতো ফেটাল-কেস যেন না হয়। জরিমানা, ধমকানো ও বরখাস্ত ওখানে সাধারণ ঘটনা। এছাড়া একপ্রকার অদৃশ্য জীবাণু আছে যা অজ্ঞাতে ফুসফুস ফুটো করে শরীরে অকেজো করে। ডাক্তারী শাস্ত্রে তার নাম যা-ই থাক্ পুলিশ-শাস্ত্রে তার নাম, গোপন নথী (C.C. Role), যা আরও সাংঘাতিক। কখনও কখনও বহুকাল পরে তার অস্তিত্ব ক্রিয়াশীল হয়।

পুস্তক-বিক্রেতা ভোলানাথ যেন এক মুশ্লিম তরুণ কর্তৃক কলেজ স্ট্রীটে নিহত হলেন। তাঁর অপরাধ, তিনি ভুল করে একটি পুস্তকে হজরত মহম্মদের প্রতিকৃতি ছেপেছিলেন। শ্রীসত্যেন মুখার্জি ও আমি তাকে চিৎপুরের এক মসজিদ হতে গ্রেপ্তার করলাম। আমি অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে নিরস্ত্র করি। ফাঁসির হুকুম দিতে গিয়ে হাইকোর্টের ইংরাজ জজ লিখেছিলেন: ‘সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক কোনও হত্যাতে রেহাই নেই।’

পর-পর কয়েকটি বড়ো অপরাধের সার্থক কিনারা করতে পারায় জোড়াসাঁকোর ইনচার্জ সত্যেন্দ্র মুখাজি আমাকে তাঁর কাছে টেনে নিলেন। মন্ত্রণীত ‘পকেটমার ও অন্ধকারের দেশে’ রচনায় ওই সকল দুরূহ মামলার উল্লেখ আছে। বড়বাজার থানা হতে আমি জোড়াসাঁকো থানায় বদলি হলাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *