দ্বিতীয় অধ্যায় – অভিপ্রয়াণ বা হিযরত
সংঘাতে ভয়ানক পরিবর্তন-মহানবীর সঙ্গে।
আনসারদের পথম বৈঠক-আকাবার ১ম অঙ্গীকার।
মদীনায় মহানবীর দূত।
মহানবী ও আনসারদের মধ্যে সামরিক মৈত্ৰী।
কুরাইশদের ভীতি এবং মৈত্রীর বিরুদ্ধে আপত্তি।
হিযরতের পূর্বে মক্কী মুসলমানদের মদীনায় গমন।
মক্কী সংসদের ঐতিহাসিক বৈঠক।
মহানবীর মদীনা যাত্রা প্রতিহত করতে কুরাইশদের পক্ষ থেকে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত।
ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতা।
সফল হিজরত।
.
মহানবীর প্রচারণার শুরুতে কুরাইশরা মুসলমাদের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচারণা, অত্যাচার, নির্যাতন এবং সামাজিকভাবে বর্জনের প্রচেষ্টা আরো শক্তিশালী করেছিল। তারা ভেবেছিল যে এভাবে ভয় দেখিয়েই তারা নবীজিকে তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদেরকে সহজেই তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে।
কিন্তু ইসলাম ও পৌত্তলিকদের মধ্যেকার সংঘাতের পরবর্তী বছরগুলোতে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে যা মক্কী পৌত্তলিকদের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পাবে এবং পরিস্কার ভাবে নতুন ধর্মমতের অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করে। এটি ছিল ইয়াথ্রিবের জনগণের কাছে মহানবীর সফল অভিগমণ এবং সেখানকার বহু সংখ্যক লোকের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। উপরন্তু ইয়াথ্রিবের জনগণ মহানবীর সঙ্গে একটা সামরিক মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং অঙ্গীকার করেন যে তারা মহানবীকে তাঁর সকল শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন, ঠিক যেমনটি তারা করেছিলেন তাদের নিজেদের জীবন ও স্ত্রী-সন্তানের জন্য।
মহানবী হজ্জ মওসুমে আল্লাহর বাণী প্রচারের সুযোগ হারাননি। এ সময় তিনি মক্কায় আগত বিভিন্ন গোত্রের মানুষের কাছে যান এবং তাদের কাছে তাঁর উদ্দেশ্য ও আদর্শ ব্যাখ্যা করে অবশেষে তাদের কে ইসলাম ধৰ্ম গ্রহণের দাওয়াত দেন। এ ধরণের একটা যোগাযোগের সময় তিনি আকস্মিকভাবে আউস এবং খাজরাজ[১] গোত্রের কিছু লোকের সাক্ষাৎ পান। এই দুই গোত্রের বসবাস ছিল ইয়াথ্রিবে এবং এরা ছিল কাহ্তান বংশীয়। ঐ সময় আরবের গোত্রগুলির মধ্যে এরাই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দুর্দান্ত।
[১. এই গোত্র দুটির ইতিহাসের জন্য এই লেখকের গাজওয়াত ওহুদ (ওহুদের যুদ্ধ) শীর্ষক বইটি দেখুন।]
মহানবী ও আনসারদের মধ্যে প্রধান বৈঠক
মদীনাবাসীদের পক্ষ থেকে মহানবীর (সঃ) সঙ্গে সর্ব প্রথম সাক্ষাৎ করতে আসেন খাজরাজ গোত্রের ছ’জন যুবক। তখন ছিল হজ্জ্বের সময়। মহানবী মিনায় আল-আকাবার কাছে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জিজ্ঞেস করেন : “তোমরা কে?” জবাবে তারা বলেন, “আমরা খাজরাজ গোত্রের মানুষ।” তিনি বললেন, “তোমরা কি ইহুদীদের মিত্র?” তারা জবাব দিলেন, “জ্বি, আমরা ইহুদীদের মিত্র।” একথা শুনে মহানবী তাদের জিজ্ঞেস করলেন তারা কিছুক্ষণ তার কথা শুনবে কিনা। যুবকরা রাজী হলেন। তখন মহানবী তাঁর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন এবং অন্য সব কিছু ছেড়ে তাদেরকে এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস স্থাপন করতে বললেন। তিনি তাদের ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পবিত্র কুরআন থেকে কয়েকটি আয়াত আবৃত্তি করলেন। এতেই ইন্সিত ফল হলো এবং যুবকগুলো প্রবল উৎসাহে তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন।
এই যুবকদলই মদীনার (যে নগরী খাজরাজ ও আউস গোত্রের মধ্যেকার গৃহযুদ্ধের ফলে অনেক কষ্ট সহ্য করেছিল) লোকদের মধ্যে বিজ্ঞতার পরিচয় দেন। মহানবীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তাদের অন্তরে একটা নতুন আশার আলো জ্বলে উঠে। তারা নতুন আহ্বানকে একটা ঐশ্বরিক বাণী বলে মনে করেন এবং এই বাণীই তাদের মারাত্মক বৈরিতা অবসানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ লক্ষ্যেই তারা মহানবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদীনায় ফিরে তাদের লোকদের মধ্যে তা প্রচারের প্রতিশ্রুতি দেন। তারা মহানবীকে বলেন : “আমরা এটা তাদের সামনে তুলে ধরবো এবং আপনাকে সাহায্য করতে এবং আমাদের গৃহীত বিশ্বাস তাদেরকে গ্রহণ করার আহ্বান জানাবো। অতএব আল্লাহ্ যদি তাদেরকে এ ধর্ম গ্রহণ করায় তাহলে আপনার চেয়ে অধিক সন্মানিত আর কেউ হবে না।” এরাই ছিলেন সাহায্যকারীদের (আল-আনসার) মধ্যে থেকে ইসলাম গ্রহণের অগ্রদূত।
মহানবীর (সঃ) সঙ্গে মদীনাবাসীদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সম্ভবতঃ তাঁর মদীনায় হিযরতের তিন বছর আগে। নিজেরা ধর্মান্তরিত হওয়ার পর এই যুবকেরাই সর্বপ্রথম ইসলামের বাণী মদীনায় নিয়ে যান এবং প্রবল উৎসাহ ও আন্তরিকতায় তা ইয়াথ্রিবের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচার করেন। তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল এবং এক বছর যেতে না যেতেই ঐ নগরীর প্রত্যেকটা পরিবার মহানবী ও তাঁর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে পরিচিত হয়েছিল। ইয়াথ্রিবের অধিবাসীদের মধ্যে যারা প্রথম ইসলামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন তাদের নামগুলি ছিল :
১. আসাদ বিন যারারা (বনি নাজ্জার);[১]
২. আউফ বিন আল-হারিথ বিন রাফায়া (বনি নাজ্জার);[২]
৩. রাফি মালিক বিন আল-আজলান (বনি যুরাইক);[৩]
৪. কুবা বিন আমির বিন হাদিদা (বনি সালমা);[৪]
৫. উকাবা বিন আমির বিন নবী (বনি হারাম বিন কা’ব);[৫]
৬. জাবির বিন আব্দুল্লাহ্ বিন রিযাব (বনি উবায়িদ বিন গানাম)[৬]
[১. এর পুরা নাম ছিল আসাদ বিন যারারা বিন আস বিন উরায়িদ আল-আনসারী আল-নজ্জারি আলখাযরাজি। ইয়াথ্রিবের মধ্যে ইনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। ইনি আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় বৈঠকে যোগদেন এবং দ্বিতীয় বৈঠকে (মহানবী ও আনসারদের মধ্যে প্রথম সামরিক মৈত্রী) তার গোত্রের নেতা (আনসার নেতৃবৃন্দের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ) নির্বাচিত হন। আকাবার বৈঠকের রাতে ইনিই সর্বাগ্রে মহানবীর আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। হিজরতের আগে তিনিই সর্বপ্রথম মদীনায় জুমুআর নামায উদ্বোধন করেছিলেন। মুসলমানরা যখন নবীজির মসজিদ নির্মাণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন তখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এবং যাকওয়ান বিন কায়েস-এ দুজনই মদীনায় ইসলাম প্রচারের অগ্রদূত হিসেবে সুনাম ভোগ করেন। ইতিহাসবেত্তা আল-ওয়াকদির বর্ণনা অনুসারে, তারা উভয়ই উতবা বিন রাবিয়ার সঙ্গে একটা কাজ উপলক্ষ্যে মক্কায় গিয়েছিলেন। সেখানেই তারা মহানবী সম্পর্কে শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। মহানবীর আহ্বানে তাঁরা উভয়ই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পরে উতবা বিন রাবিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেই মদীনায় ফিরে যান। এটি ঘটেছিল আল-আকাবার প্রথম বৈঠকের আগেই।
২. পৌত্তলিকদের বড় নেতা আবু জেহেলকে যৌথভাবে হত্যা করার পর তিনি এবং তার ভাই মাউধ বদরের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।
৩. ইবনে ইসহাকের ভাষ্য অনুসারে, যারা বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন রাফি বিন মালিক বিন আল-আজলান বিন আম বিন আমির বিন যুরাইক আল-খাযরাজী ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। ইবনে ইসহাক বলেছেন, রাফিই কুরআনের বিখ্যাত সূরা ইউসুফ’ কে মদীনায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আল-যুবাইর বিন বিকার বলেছেন, মহানবী যখন তার সঙ্গে আল-আকাবায় সাক্ষাৎ করেন তখন বিগত দশ বছরে নাযেলকৃত সমস্ত কুরআনের অংশগুলিই তিনি তাকে দিয়েছিলেন। মদীনায় পৌঁছে তিনি তার লোকদের সমবেত করেন এবং বনি যুরাইকের মসজিদে কুরআন তিলাওয়াত করেন। এই মসজিদে সর্ব প্রথম কুরআন তিলাওয়াত হয়। আমি তার সঠিক মৃত্যু তারিখ সংগ্রহ করতে পারিনি।
৪. মুসলমানরা যখন বিজয়ের বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন তখন কুৎবা ছিলেন বনি সালমার পতাকা বহনকারী। তিনি বদর সহ মহানবীর জীবদ্দশায় অনুষ্ঠিত সব যুদ্ধেই অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মৃত্যু বরণ করেন খলীফা ওমরের রাজত্বকালে। অবশ্য ইবনে হাবানের ভাষ্য অনুসারে তার মৃত্যু হয়েছিল ওসমানের সময়ে।
৫. উকাবার জীবন-ইতিহাসের জন্য এই লেখকের গাজওয়াত ওহুদ (ওহুদের যুদ্ধ) বই দ্রষ্টব্য।
৬. এর জীবন-ইতিহাসের জন্য গাজওয়াত ওহুদ দ্রষ্টব্য]
আল-আকাবার প্রথম বৈঠক
মহানবীর সঙ্গে ছ’জন মদীনাবাসীর প্রথম বৈঠকের পরের বছর মদীনার বারজন লোকের আরেকটি দল (যাদের মধ্যে ছিলেন প্রথম দলের চারজন) আবার আকাবার কাছে মহানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা মহানবীকে প্রতিশ্রুতি দেন যে তারা ইসলাম অনুমোদিত সমস্ত কর্তব্য পালন করবেন এবং ইসলামে নিষিদ্ধ সমস্ত কাজ পরিহার করবেন। প্রথম প্রতিশ্রুতিতে তারা কোন সশস্ত্র সাহায্যের কথা উল্লেখ করেননি, কারণ তখন পর্যন্ত মহানবী অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেবার ব্যাপারে আল্লাহ্ অনুমতি পাননি।
মদীনায় মহানবীর দূত
মহানবীর বিরুদ্ধে কুরাইশদের নির্যাতনের নীতি পালনের সময় এবং যখন তারা তাঁর দূর্বল অনুসারীদের উপর চরম অত্যাচার চালাচ্ছিল তখন ইয়াথ্রিবের অধিবাসীদের সঙ্গে মহানবীর সম্পর্কের দ্রুত উন্নতি হয়।
আকাবার প্রথম বৈঠকের পর হজ্জ্ব মওসম শেষে মহানবী মদীনায় তাঁর প্রথম দূত পাঠান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নতুন ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদেরকে ইসলাম ও তাঁর আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষিত করে তোলা এবং তখনো যারা-মূর্তি-পূজা করে যাচ্ছিল তাদেরকে ইসলামের পথে নিয়ে আসা। এই উদ্দেশ্যে মহানবী মুসাব বিন উমাইর আল-আবদিকে মনোনীত করেন, যিনি ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে একজন ধার্মিক ও সাহসী যুবক এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন বিখ্যাত মুসলমান।
পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে প্রতীয়মান হয় যে ইয়াথ্রিবে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দূত ছিলেন মুসাব। মহানবী তার উপর যে আস্থা স্থাপন করেন তিনি তার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করেন। তিনি অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে তার দায়িত্ব পালন করেন এবং তার শিষ্টাচার ও আন্তরিকতা দিয়ে বহু সংখ্যক ইয়াথ্রিববাসীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। ইয়াথ্রিবের গোত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও বৃহত্তম গোত্রটিও (সা’দ বিন মুয়াদ-এর নেতৃত্বে বনি আব্দ্ আল আশাল) তারই হাতে ইসলাম গ্রহণ করে।
দূতের মক্কা প্রত্যাবর্তন
ইসলামের প্রথম দূত প্রায় নয় মাস মদীনায় অবস্থান করেন এবং তারপর কাহ্তানী (আউস এবং খাজরাজের) গোত্রগুলির মধ্যে ইসলাম প্রচারের সাফল্য নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। এই গোত্রগুলির লোকেরাই পরবর্তীতে ইসলামের প্রথম সেনাবাহিনী গঠন করে ইসলামকে শক্তিশালী করার প্রয়াস পান। তিনি মহানবীকে তার সফলতার সংবাদ জানান এবং নতুন ধর্মান্তরিত লোকদের ক্ষমতা ও শক্তির কথা তাকে অবহিত করেন। সত্যনিষ্ঠ তরুণ দূত মুসাব বিন উমাইরের এই উল্লেখযোগ্য সাফল্যের সংবাদ পেয়ে মহানবী খুব খুশী হন।
আল-আকাবার দ্বিতীয় প্ৰতিশ্ৰুতি
আকাবার প্রথম অঙ্গীকারের পরের বছর (হিযরতের আগে দ্বিতীয় বছর) মক্কায় দু’জন মহিলা সহ মোট ৭৫ জন মুসলমান তীর্থযাত্রী আসেন। মদীনার কিছু প্রতিমা-পূজারীও এই তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে এসেছিল।
মক্কায় পৌঁছে তারা মহানবীর সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এরকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল যে তারা সবাই জিলহজ্ব মাসের ১২ তারিখ দিবাগত রাতে গোপনে মহানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সাক্ষাতের স্থান নিদ্ধারিত হয় আল-আকাবার কাছে মীনা উপত্যকা যেখানে প্রথম পাথর নিক্ষেপের অনুষ্ঠান হয় কিংবা শয়তানকে পাথর মারা হয়।
নির্দিষ্ট রাতের নির্দিষ্ট সময়ে মহানৱী আল-আকাবার কাছে সেই স্থানে পৌঁছলেন যেখানে আনসাররা (পরবর্তী ইসলামের ইতিহাসে ইয়াথ্রিবের লোকেরা এ নামেই পরিচিতি পান) অন্ধকারে এক এক করে সবাই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কারণ তারা চাননি যে মক্কার মূর্তি-পূজারীরা কিংবা তাদেরই পৌত্তলিক সঙ্গীরা মহানবীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ সম্পর্কে কিছু জানতে পারুক। এসলাম ও পৌত্তলিকতার সংঘাতের ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ কিভাবে যে একটা মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তা দেখানোর জন্য আমরা এখানে ঐ সময় উপস্থিত আনসারদের একজন নেতা কা’ব বিন মালিকের বক্তব্য হুবহু উদ্ধৃত করছি।
কা’ব বলেছেন, “অতঃপর আমরা তীর্থযাত্রার জন্য বেরিয়ে পড়লাম এবং মহানবী আমাদেরকে হজ্জের দ্বিতীয় দিন আকাবায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আল্লাহর নবীর সঙ্গে দেখা করার ঐ রাতে আমরা আমাদের অন্যতম নেতা আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন হারামকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। আমরা মহানবীর ব্যাপারে পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা তাকে বললাম, “হে আবু জাবির, আপনি আমাদের অন্যতম নেতা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। আমরা আন্তরিকভাবে চাই এই পৃথিবীতে আপনি যা অনুশীলন করেন এবং বিশ্বাস করেন তার জন্য পরকালে আপনি দোজখের আগুনের জ্বালানী হবেন না।” আমরা তাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলাম এবং মহানবীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের কথা বললাম। তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আকাবায় আমাদের সঙ্গে আমাদের অন্যতম নেতা হিসেবে কাজ করলেন।”
কা’ব আরো বলেছেন, “ঐ রাতে আমরা আমাদের সাথীদের সাথে নিজ নিজ জিনে ঘুমিয়েছিলাম এবং মহানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। আমরা সবাই বিড়ালের মত চুপিসারে হেঁটে হেঁটে অবশেষে আকাবার কাছে একটা গিরিপথে একত্রিত হলাম। আমরা ছিলাম ৭৩ জন পুরুষ এবং দু’জন মহিলা। মহিলারা ছিলেন বনি মা’যান বিন আল-নাজ্জার গোত্রের কা’ব উন্মে আমারার কন্যা নাসিবা এবং আমরের কন্যা আসমা।
তিনি আরো বলেছেন, “আমরা গিরিপথে সমবেত হয়ে মহানবীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই তিনি আসলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব যিনি তখনো বহু ঈশ্বরবাদী হলেও এই মিটিংয়ে যোগদান করেছিলেন, কারণ তিনি ব্যক্তিগত ভাবে তার ভাতিজার (মহানবীর) কার্যকলাপ তদারক করতেন এবং আনসারদের হেফাযতে তাঁকে সমর্পণ করার আগে নিজেকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনিই সর্বপ্রথম এই সভায় বক্তব্য রেখেছিলেন।
বক্তব্য ও বক্তাবৃন্দ
সবাই একত্রিত হওয়ার পর মহানবী এবং আউস ও খাযরাজ গোত্রদুটির গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে সামরিক মৈত্রী বিষয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু হলো। প্রথম বক্তব্য রাখলেন আল-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব। তিনি তার শ্রোতাদের কাছে এহেন সামরিক মৈত্রীর ক্ষেত্রে তাদের দায়-দায়িত্ব ব্যাখ্যা করেন। ইবনে ইসহাকের ভাষায় তিনি তাদেরকে বলেছিলেন :
“হে আল-খাযরাজের লোকসকল (আরবরা ইয়াথ্রিবের লোকদিগকে আল-খাযরাজ বলতো), আপনারা তো জানেন মুহাম্মদ (সঃ) আমাদেরই একজন মানুষ এবং ধর্মীয় কারণে আমাদের মধ্যেই যারা তাঁর বিরোধিতা করেছে তাদের আক্রমণ থেকে আমরা তাঁকে রক্ষা করেছি। তাঁর নিজের লোকদের মধ্যে তিনি সন্মান এবং নিরাপত্তা পেয়ে এসেছেন। তাঁর নিজের শহরে তাঁর কোন ভয় নেই। কিন্তু এখন তিনি আপনাদেরকে মিত্র হিসেবে পেয়েছেন এবং তাঁর ভাগ্যকে আপনাদের ভাগ্যের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন। অতএব আপনারা যদি মনে করেন আপনারা তাঁকে দেওয়া অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারবেন এবং তাঁর সব শত্রুদের আক্রমণ থেকে তাঁকে সুরক্ষা করতে পারবেন তাহলেই কেবল প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সম্পর্কিত যাবতীয় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিন। কিন্তু তিনি আপনাদের দলে যাবার পর আপনারা যদি তাঁকে পরিত্যাগ করেন তাহলে বরং এখানে এক্ষুণি তাকে পরিত্যাগ করুন, কারণ তাঁর নিজের শহরে নিজের লোকদের কাছ থেকে তিনি যথেষ্ট সম্মান ও নিরাপত্তা ভোগ করেন।”
আব্বাস চুপ করলেন এবং তখন আনসাররা এমন ভাষায় তার কথার জবাব দিলেন যাতে তিনি তাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। তারা বললেন, “আমরা আপনার কথা শুনেছি।” এরপর মহানবীর দিকে ঘুরে (দৃঢ়তা, সাহসিকতা এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে) তারা বললেন, “হে আল্লাহর দূত, আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলুন এবং আপনার নিজের জন্য এবং আপনার প্রভুর জন্য আপনার যা ইচ্ছা নির্বাচন করুন। এরপর মহানবী তাদের সঙ্গে কথা বললেন এবং শেষে আনসারদের সঙ্গে তাঁর সামরিক চুক্তি অনুমোদিত হলো।
প্রতিরক্ষা চুক্তি
সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে এই চুক্তিনামার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দফা ছিল সেইটা যেখানে ইয়াথ্রিবের অধিবাসীরা মহানবীকে সুরক্ষার অঙ্গীকার করেছিলেন ঠিক যেভাবে তারা রক্ষা করতেন তাদের নিজেদের কিংবা তাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদেরকে।
আল্লাহর দূত (সঃ) কুরআন তেলাওয়াত ক’রে তাঁর শ্রোতাদের সম্বোধন করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর পথে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলেন। তিনি তাদের সামনে ইয়াথ্রিবের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পাদিত তাঁর চুক্তির দফাগুলিও ব্যাখ্যা করেন। মহানবী আনসারদের সম্বোধন ক’রে বলেন, “আপনারা আমাকে ঠিক সেভাবেই রক্ষা করবেন যেভাবে রক্ষা করতেন আপনাদের স্ত্রী ও সন্তানদের।”
আল-বারা বিন মারুর মহানবীর হাতে তার হাত রেখে বললেন, “জ্বি, যে মহান সত্ত্বা আপনাকে সত্য বাণী দিয়ে নবী ক’রে পাঠিয়েছেন তাঁর নামে শপথ ক’রে বলছি, আমরা যেভাবে আমাদের নারীদের রক্ষা করি ঠিক সেভাবেই আপনাকেও রক্ষা করবো। হে আল্লাহর দূত, আমরা অঙ্গীকার করেছি এবং আমরা হচ্ছি জন্মগতভাবেই যোদ্ধা ও অস্ত্র-চালনাকারী এবং আমরা এ গুণ পেয়েছি আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে।” আল-বারা যখন এভাবে চুক্তি মোতাবেক আনসারদের দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতির কথা বলছিলেন তখন আবুল হাইথাম বিন আল-তিহান বললেনঃ “হে আল্লাহর দূত, ইহুদিদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে বটে, কিন্তু এখন তারা বিচ্ছিন্ন হবে। কিন্তু আপনি যখন সফল হয়ে আপনার লোকদের মাঝে ফিরে যাবেন তখন কি আমাদের ছেড়ে যাবেন? একথা শুনে মহানবী হেসে বললেন, “না, আমি কখনোই আপনাদেরকে ছেড়ে যাব না। এখন থেকে আপনাদের রক্ত আমার রক্ত। আমি আপনাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো এবং আপনাদের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে মিশে শান্তিতে বসবাস করবো।”
অঙ্গীকারের শর্তাবলী মেনে নিয়ে আনসাররা যখন মহানবীর হাতে হাত মিলাতে প্রস্তুত হচ্ছিল তখন আল-আব্বাস বিন আবাদাহ্ বিন নায়লা আল-আনসারী (তার সাথীদের দুঃখ কষ্ট সহ্যের এবং মহানবীর সঙ্গে অঙ্গীকার পালনে আত্মোৎসর্গের আগ্রহ পরীক্ষার উদ্দেশ্যে) বললেন, “হে আল-খাযরাজের লোকেরা, এই লোকের প্রতি আনুগত্যের যে অঙ্গীকার আপনারা করেছেন তার অর্থ কি আপনারা জানেন?”
তারা বললেন, “জ্বি, আমরা জানি।”
তিনি বললেন, “আপনারা কিন্তু এই মর্মে অঙ্গীকার করছেন যে আপনারা সারা পৃথিবীর লাল কিংবা কালো সব মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। অতএব, আপনারা যদি মনে করেন যে আপনাদের ধন-সম্পদ এবং নেতৃবৃন্দ যখন বিপদাপন্ন হবে তখন আপনারা তাঁকে পরিত্যাগ করবেন তাহলে বরং এখনই তাঁকে পরিত্যাগ করুন। এবং তা করলে আপনারা ইহজগৎ এবং পরজগৎ-উভয় জগতে কলংকিত হবেন। কিন্তু আপনারা যদি মনে করেন যে আপনাদের ধন-সম্পদ এবং নেতৃবৃন্দের ক্ষতি উপেক্ষা করেও আপনারা অঙ্গীকার পালন করবেন তাহলেই কেবল তাঁর কাছে অঙ্গীকার করুন, কারণ এটাই হবে ইহকাল ও পরকালের জন্য সর্বোত্তম কাজ।”
তারা জবাব দিলেন, “আমরা আমাদের ধন-সম্পদ ও নেতাদের ক্ষতি স্বীকার করেই অঙ্গীকার করছি। অতঃপর মহানবীর দিকে তাকিয়ে তারা বললেন, “ আমরা যদি আপনার কাছে এ রকম অঙ্গীকার করি তাহলে আমরা কি ধরণের পুরস্কার পাব।”
মহানবী বললেন, “আপনাদের পুরস্কার হবে বেহেশ্ত্। “ তারা বললেন, “তাহলে আপনার হাতটা আমাদেরকে দিন।” মহানবী তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং তারা তাঁর হাতে হাত রেখে তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করলেন।
অলিখিত অঙ্গীকার
তারা মহানবীর হাতে নিজেদের হাত রেখে অঙ্গীকার করলেন (স্বাক্ষর সহ কোন লিখিত অঙ্গীকারনামার পরিবর্তে), কারণ দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ছিল চূড়ান্ত। মহানবী তাদের দিকে তাঁর হাত বাড়িয়ে দেন এবং তারা এক এক করে তাঁর হাত ছুঁয়ে আনুগত্যের শপথ নেন। কেবলমাত্র মহিলা সদস্য উম্মে আমরা (নাসিবা কা’ব আল-মানিয়া হিসেবে পরিচিত) এবং আমরের কন্যা মহানবীর হাত স্পর্শ করেননি, কারণ মহানবী কখনো কোন মহিলার সঙ্গে করমর্দন করতেন না। ওয়াকদি বলেছেন, অঙ্গীকার গ্রহণের সময় উম্মে আমারার স্বামী (আরাবা বিন আমর) মহানবীকে বলেছিলেনঃ ‘হে আল্লাহর দূত, এখানে দু’জন মহিল (উম্মে আমারা এবং উম্মে সাবি) আছেন যারা আপনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে এসেছেন।’ মহানবী বলেছিলেন, “তারাও আপনাদের মতই শপথ গ্রহণ করবেন, তবে আমি মহিলাদের সাথে করমর্দন করি না।” শুধুমাত্র হাত স্পর্শ করার ব্যাপারটি ছাড়া, তাদের অঙ্গীকার এবং পুরুষদের অঙ্গীকারের মধ্যে অন্য কোন পার্থক্য ছিল না।
বার জন শিষ্য
শপথ অনুষ্ঠান শেষে মহানবী শপথ গ্রহণকারীদেরকে তাদের মধ্য থেকে বার জন নেতা নির্বাচন করতে বললেন যাতে তারা অঙ্গীকারের শর্তগুলি বাস্তবায়ন করতে পারেন। তিনি বললেনঃ “আপনাদের মধ্য থেকে বারজন লোক ঠিক করুন যারা তাদের লোকজনের তদারককারী হিসেবে কাজ করবেন। “ ঐ স্থানেই তক্ষুণি নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন হলো এবং নির্বাচিত নেতারা তাদের নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর দায়িত্ববান লোক হিসেবে মহানবীর কাছে নতুন করে আনুগত্যের অঙ্গীকার করলেন। মহানবী তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে যীশু খ্রীষ্টের শিষ্যরা যেমন তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য দায়ী ছিলেন ঠিক তেমনি তারাও তাঁর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি বাস্তবায়নের জন্য দায়ী থাকবেন এবং তিনি (মহানবী স্বয়ং)দায়িত্ব পালন করবেন সমগ্র মুসলমান জাতির।
অঙ্গীকার ফাঁসকারী গুপ্তচর
এই সামরিক মৈত্রী বলবৎ করার কাজটি ভালভাবেই অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু মুসলমানরা এই চুক্তি বলবৎ করতে না করতেই একজন মক্কী গুপ্তচর (যাকে কুরাইশরা মহানবীর কার্যকলাপের উপর নজর রাখতে পাঠিয়েছিল) এই চুক্তির কথা ফাঁস করে দেয়।
তবে সামরিক মৈত্রীর কার্যকলাপের সংবাদ মক্কাবাসীদের কাছে এত দেরীতে পৌঁছে যে তারা আর এগুলোকে রোধ করতে পারে না। গুপ্তচরটি মিনা উপত্যকার একটা উঁচু জায়গা থেকে চুক্তির কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেছিল কিন্তু তার সতর্কবাণী-“হে মক্কাবাসী, মুহাম্মদ এবং সাবিয়ানরা আপনাদের বিরুদ্ধে[১] লড়াই করার জন্য একত্রিত হয়েছে” যখন মক্কাবাসীর কাছে পৌঁছে ততক্ষণে সভার কাজ শেষ করে আনসাররা তাদের তাবুতে ফিরে গিয়েছিলেন।
[১. মহানবীর জীবদ্দশায় কোন ব্যক্তি মুসলমান হলে মক্কার লোকেরা তাকে সাবি বলতো। (অনুবাদক)]
মিনার কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য আনসারদের প্রস্তুতি
আনসাররা যখন শুনতে পেলেন গুপ্তচরটি তার প্রভুদের কাছে চীৎকার করে কিছু বলছে ততক্ষণে তাদের সভা শেষ হয়ে গেছে। তথাপি তাদের একজন নেতা (আল-আব্বাস বিন উবাদা বিন নায়লা) এবং নির্বাচিত বারজন শিষ্য মহানবীকে বললেন : “যিনি আপনাকে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন তাঁর নামে শপথ করে আমরা বলছি, আপনি চাইলে মিনার জনগণের সাথে লড়াইয়ের জন্য আমরা তরবারি নিয়ে প্রস্তুত আছি।”
কিন্তু মহানবী এ ধরনের কাজ সমর্থন না করে বললেন যে এগুলি তাঁর আদেশ নয়।
এরপর মহানবী এই বিশ্বাসী আনসার দলকে তাদের তাবুতে ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন।
যে সব নেতৃবৃন্দ আকাবায় মহানবীর কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন তারা মিনায় তাদের বাসস্থানে চলে গেলেন এবং ইসলামের সমর্থনে কুরাইশদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষের এবং যে কোন আক্রমণের মুখে তাদের আত্ম-রক্ষার নিয়ম-কানুন লিপিবদ্ধ করলেন। এভাবেই তারা ইসলামের সঙ্গে পৌত্তলিকতার সংঘাতের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় রচনা করেন।
অঙ্গীকারের বিরুদ্ধে কুরাইশদের প্রতিবাদ
আকাবায় অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার অনুষ্ঠানের পরদিন সকালে কুরাইশ নেতৃবন্দের একটা বিশাল প্রতিনিধি দল মিনায় এসে ইয়াথ্রিবাসীদের সঙ্গে মহানবীর সামরিক মৈত্রীর বিরুদ্ধে একটা কঠোর প্রতিবাদ পেশ করেন। প্রতিবাদে তারা বলেন : “হে আল-খাযরাজের লোকেরা, আমরা জানতে পেরেছি যে আপনারা আমাদের একজন লোকের (অর্থাৎ মহানবী সঙ্গে দেখা করেছেন এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অঙ্গীকার করে তাকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে চাচ্ছেন; পক্ষান্তরে সমস্ত আরব গোত্রগুলির মধ্যে আপনাদের এবং আমাদের মধ্যে একটা যুদ্ধ লাগবে এ রকম ধারণার চেয়ে ঘৃণ্যতর কিছু আমাদের কাছে নেই।”
আনসারদের পৌত্তলিক ভাইয়েরা মহানবীর প্রতি তাদের আনুগত্য সম্পর্কে কিছুই জানতো না। সম্পূর্ণ গোপনে তারা কুরাইশ নেতাদের এই বলে আশ্বস্ত করেছিল যে এধরণের কোন চুক্তি মহানবীর সঙ্গে হয়নি। এমন কি আল-খাযরাজের নেতা আব্দুল্লাহ বিন উব্বায়ী বিন সালুল[১] খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন : “এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব যে আমার লোকেরা এ ধরণের একটা কাজ করবে আর আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানবো না।[২]
[১. এর জীবন বৃত্তান্তের জন্য এই লেখকের গাযওয়াত ওহুদ বই দেখুন।
২. সিরাত ইবনু হিশাম, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৯।]
মক্কার নেতারা যখন ইয়াথ্রিবের লোকদের কাছে তাদের প্রতিবাদ পেশ করেন তখন আনসাররাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু তারা কোন কথা বলেননি। বিশেষ করে তারা যখন দেখলেন যে কুরাইশ নেতারা তাদের পৌত্তলিক নেতাদের কথা বিশ্বাস করছেন তখন তাদের মধ্যে কেউই আর কোন কথা বললেন না।
কুরাইশদের কাছে অঙ্গীকারের সংবাদ নিশ্চিত হয়
মক্কার নেতারা সাময়িকভাবে এই ভেবে খুশী হয়ে ফিরে এসেছিলেন যে সংবাদটা ছিল সম্ভবতঃ একটা গুজব। তথাপি তাদের মনে একটা সন্দেহ ছিল এবং বিষয়টি অনুসন্ধান করে তারা যখন জানতে পারেন যে সত্যি সত্যি মহানবী ও ইয়াথ্রিবাসীদের মধ্যে একটা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তখন তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা যতজন মদীনাবাসীকে সম্ভব ধরে আনার জন্য তাদের অশ্বারোহীদের পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তাদের এ অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ততদিনে সব তীর্থযাত্রীই (এদের মধ্যে মদীনার লোকও ছিলেন) তাদের বাড়ী চলে গিয়েছিলেন। তবে মক্কী অশ্বারোহীরা শুধুমাত্র একজন ইয়াথ্রিববাসী মুসলমান নেতাকে ধরতে সমর্থ হয় যিনি আকাবার অঙ্গীকারে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আল-খাযরাজের প্রধান সা’দ বিন আবাদাহ্। তাঁকে গ্রেপ্তার করে মক্কায় আনা হয় তবে জুবাইর বিন মু’তিম এবং আল-হারিথ বিন উমাইয়ার হস্তক্ষেপে পরে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।
আকাবার অঙ্গীকারে অংশগ্রহণ কারী আনসারবৃন্দ
আউস এবং খাযরাজদের মধ্য থেকে যে সব আনসার মহানবীর সঙ্গে সামরিক মৈত্রী সম্পন্ন করে ইসলাম ও ইসলামের নবীর সশস্ত্র প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের নাম উল্লেখ করা এই মূহুর্ত খুবই যুক্তি সঙ্গত। তাঁরা (আল্লাহ তাঁদের সবার উপর তাঁর আশির্বাদ বর্ষণ করুন) ছিলেন ইসলামের সেনাবাহিনীর অগ্রদূত। এরাই সমস্ত প্রতিকূল শক্তিকে পরাস্ত ক’রে পরবর্তীকালে সবরকম অত্যাচার ও জুলুম বন্ধ করার কাজে ইসলামকে সাহায্য করেছিলেন।
অঙ্গীকার কারীদের সংখ্যা
এই মহান সামরিক চুক্তিতে অঙ্গীকারকারীদের মধ্যে ছিলেন তেয়াত্তরজন পুরুষ এবং দু’জন মহিলা। এদের মধ্যে এগারজন পুরুষ ছিলেন আল-আউসের এবং বাষট্টিজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা ছিলেন আল-খাযরাজের। তাদের নামের তালিকা নিম্নরূপ :
আকবায় আউসের অঙ্গীকারকারীবৃন্দ
(ক) বনি আবদাল আশালের তিনজন :
১. উসাইদ বিন হুদাইর[১]
[১. এর জীবনীর জন্য গাযওয়াত ওচ্ছদ বইটি দেখুন।]
২. আবুল হাইথাম বিন আল-তেহান[২] (বালি থেকে তাদের আমেলবদ্ধ);
[২. ঐ]
৩. সালমা বিন সালামা বিন ওয়াকশ বিন যাছাবা[১]
(খ) বনি হারিদার তিনজন :
১. যাহির বিন রাফি বিন আদি[২]
২. আবু বারদা বিন নাইয়ার[৩] (কুয়া থেকে তাদের আমেলবদ্ধ)
৩. নুহায়ের বিন আল-হায়দাম[৪]
(গ) বনি আমর বিন আউফ বিন মালিক থেকে পাঁচজন :
১. সা’দ বিন খাইদমা
২. রাফা বিন আবদাল মুনধির[৫]
৩. আব্দুল্লাহ্ বিন যুবাইর[৬]
৪. মান বিন আদি বিন আল-জাদ (বালি থেকে তাদের আমেলবদ্ধ)
৫. ওয়াইম বিন সায়েদা।[৭]
[১. ইনি বদরে উপস্থিত ছিলেন এবং মহানবীর সঙ্গে থেকে পরবর্তী সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আসাদ বিন যুরারার সঙ্গে আকাবার প্রথম অঙ্গীকারেও যোগ দিয়েছিলেন; সাথীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম শিক্ষিত পন্ডিত। ওমর বিন আল-খাত্তাব তাঁকে আল-ইয়ামার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। ভন্ড আব্দুল্লাহ বিন উবায়ি যখন বলেছিল, “আমরা মদীনায় ফিরে গেলে সম্মানিত ব্যক্তিরা দূর্বল ও দূর্বৃত্তদের তাড়িয়ে দেবেন” তখন ওমর বিন আল-খাত্তাব তার শিরঃচ্ছেদের জন্য সালমা বিন সালমা বিন ওয়াকশ-কে পাঠতে মহানবীকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি ৪৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
২. ইনি বদরে মহানবীর (সঃ) সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন।
৩. ইনি বদরে উপস্থিত ছিলেন এবং মহানবীর (সঃ) সঙ্গে থেকে পরবর্তী সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি মুয়াইইয়ার শাসনামলে (৪৫ হিজরী) মৃত্যুবরণ করেন। আলি বিন আবি তালিবের প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধগুলিতে তিনি তাঁর পক্ষ অবলম্বন করেন।
৪. ইনি বদরে উপস্থিত ছিলেন না।
৫. ইনি বদরের যুদ্ধে অংশ নেন এবং খায়বারের যুদ্ধে শহীদ হন। ইনি ছিলেন সুবিখ্যাত সাহাবী আবু লুবাবার ভ্রাতা।
৬. ইনি ওহুদের যুদ্ধে মুসলমান তীরন্দাজদের সেনাপতি ছিলেন।
৭. এর বিস্তারিত জীবন-ইতিহাসের জন্য আল-ইসাবা দ্রষ্টব্য।]
আকাবায় খাযরাজের অঙ্গীকারকারীবৃন্দ
ক) বনি আন-নাজ্জারের এগারজন :
১. আবু আইয়ুব আল-আনসারী-খালিদ বিন যায়িদ বিন খুলাইব।[১]
২. মুয়াদ বিন আল-হারিদ বিন রাফা (ইবনে আফরা নামেও পরিচিত)।
৩. আউফ বিন আল-হারিছ, মুয়াদ বিন আল-হারিছের ভাই।
৪. মাউদ বিন আল-হারিছ, আল হারিছের আরেক ভাই।[২]
৫. আমারা বিন হাযম বিন যাইদ।
৬. আসাদ বিন যুরারা।
৭. সাহল বিন উতায়িক।
৮. আউস বিন থাবিত বিন আল মুনধির।
৯. আবু তালহা, যাইদ বিন সাহল।[৩]
১০. কায়েস বিন আবি সাসায়া।[৪]
১১. আমর বিন গাযিয়া বিন আমর।
(খ) বনি আল-হারিছ বিন আল-খাযরাজের সাতজন :
১. সা’দ বিন আর-রাবি।
২. খারজা বিন যাইদ বিন আবি যুহাইর।
৩. আব্দুল্লাহ্ বিন রাওয়াহা।
৪. বশির বিন সা’দ বিন হা’লাবাহ্।
৫. আব্দুল্লাহ্ বিন যাইদ বিন থা’লাবাহ্।
৬. খালাদ বিন সুয়াইদ বিন থা’লাবাহ্।
৭. উকাবা বিন আমর বিন থা’লাবাহ্।
(গ) বনি বায়জা বিন আমির থেকে ৩ জন :
১. যিয়াদ বিন লাবিদ বিন থালাবাহ্।
২. ফারওয়া বিন আমর বিন ওয়াদফা।
৩. খালিদ বিন কায়েস বিন মালিক।
(ঘ) বনি জুরাইক বিন আমির থেকে নিন্মোক্ত ৪ জন :
১. রাফি বিন মালিক বিন আল-আজলান।
২. যাকওয়ান বিন আকায়েস বিন খালদা।[৫]
৩.আবাদ বিন কায়েস বিন সামির।
৪. আল-হারিস বিন কায়েস বিন খালিদ।
(ঙ) বনি সালমা বিন সাদ থেকে নিন্মোক্ত ১১ জন :
১. আল-বারা বিন মারুর।[৬]
২. সানান বিন সাইফি বিন আখর।
৩. মাসুদ বিন ইয়াজিদ বিন সাবি।
৪. ইয়াজিদ বিন হারাম বিন সাবি।
৫. জাব্বার বিন সাখর বিন ওমাইয়া।
৬. আফাইল বিন আন-নুমান বিন খুনসা।
৭. মাকাল বিন আল-মুন্দির বিন সার্হ্।
৮. ইয়াজিদ বিন আল-মুন্দির বিন সার্হ্।
৯. আয-যাহাক বিন হারিসা বিন যায়িদ।
১০. বিশর বিন আল-বারা বিন মারুর।
১১. আত-তুফাইল বিন মালিক বিন খুনসা।
(চ) বনি সাওয়াদ বিন গানাম বিন কাব থেকে মাত্র ১ জন :
কা’ব বিন মালিক বিন আবি কা’ব।
(ছ) বনি গানাম বিন সাওয়াদ থেকে ৫ জন :
১. সুলাইম বিন আমর বিন হাদিদা।
২. কুতবা বিন আমির বিন হাদিদা।
৩. ইয়াজিদ বিন আমির বিন হাদিদা।
৪. আবুল ইয়াসর কা’ব বিন আমর।
৫. সাইফি বিন সাওয়াদ বিন উব্বাদ।
জ) ৫জন ছিলেন বনি নবী-বিন আমর বিন সাওয়াদ থেকেঃ
১. থালাবাহ্ বিন গানামা বিন আদি।
২. আমর বিন গানামা বিন আদি।
৩. আশ্ বিন আমির বিন আদি।
৪. আব্দুলুল্লাহ্ বিন আনিস (কযা গোত্র থেকে তাদের আমেলবদ্ধ)
৫. খালিদ বিন আমর বিন আদি।
(ঝ) নিন্মোক্ত ৭ জন ছিলেন বনি হারাম বিন কা’ব বিন গানাম থেকে
১. আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন হারাম।[৭]
২. জাবির বিন আবদুল্লাহ্।[৮]
৩. মু’য়াদ বিন আমর বিনআল-জামুহ্।
৪. সাবিত আল-জিদা।
৫. উমাইর বিন-আল-হারিস বিন আলাবাহ্।
৬. খুদাইজ বিন সালমা বিন আউস বিন আমর (বালি গোত্র থেকে তাদের আমেলবদ্ধ)।
৭. মুয়াদ বিন জাবাল বিন আমর বিন আউস।[৯]
(ঞ) বনি আউফ বিন আল-খাযরাজ থেকে নিন্মোক্ত ৪ জন আকাবার
অঙ্গীকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন :
১. উবাদা বিন আস-সামিত।[১০]
২. আল-আব্বাস বিন উবাদাহ্ বিন নাদলা।
৩. ইয়াজিদ বিন থালাবাহ্ বিন খাজমা (আবু আব্দুর রহমান)।
৪. আমর বিন আল-হারিস বিন লুবদা বিন আমর
(ট) বনি সলিমের বিন গানাম বিন আউফ থেকে দু’জন :
১. রাফা বিন আমর বিন জাইদ, এবং
২. আকাবা বিন ওয়াহব বিন খালদা (গাতফান থেকে তাদের মিত্র)।
(ঠ) বনু সাইদা বিন কা’ব বিন আল-খাযরাজ থেকে দু’জন :
১. সা’দ বিন উবাদাহ্, এবং
২. আল-মুন্দির বিন আমর বিন খুনাইস।
আউস এবং খাযরাজ গোত্রের এই ৭৩ জন লোকই আল্লাহর দূতের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আকবার অঙ্গীকারকে বলবৎ করেছিলেন।
[————-
১. ইনি একজন সুপরিচিত সাহাবী যার পদবী ছিল আবু আইয়ুব আল-আনসারী। তিনি মহানবীর জীবদ্দশায় বদরের যুদ্ধ সহ অন্যান্য সব অভিযানে অংশ নেন। মদীনায় এসে মহানবী (সঃ) তাঁর বাড়ীতেই আশ্রয় নেন এবং মসজিদ এবং তাঁর নিজের জন্য বাড়ী নির্মাণের আগ পর্যন্ত এখানেই থাকেন। মহানবী তাঁকে মুসাব বিন উমাইর আল আবদারীর ভাই বানিয়ে দেন। ন্যায়নিষ্ঠ খলিফাদের আমলে তিনি ইসলামের সব যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। খলিফা ওমরকে যখন ইরাকে যেতে হয় তখন তিনি এই ব্যক্তিকেই মদীনায় তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। তিনি আলীর পক্ষে খারীজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং ইসলামের স্বার্থে কখনই যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে যাননি। তাঁর দেখা সর্বশেষ যুদ্ধ ছিল মুয়াইইয়ার আমলের কন্সটান্টিনোপলের যুদ্ধ (৪৯ হিজরী/৬৬৯ খ্রীস্টাব্দে)। এই যুদ্ধে মুয়াইইয়া তার পুত্র ইয়াজিদের নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী সংগ্রহ করেন এবং তারা জল ও স্থল উভয় দিক থেকে কন্সটান্টিনোপল আক্রমণ করেন। মুসলমানদের সেনাপতি ইয়াজিদ বিন মুয়াইইয়া আবু আইয়ুবকে দেখতে যান, কারণ তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন। ইয়াজিদ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার ইচ্ছা কি? ‘তখন তিনি জবাব দেন, ‘আমার ইচ্ছা আপনি আমার মৃতদেহকে শত্রুদের এলাকায় নিয়ে গিয়ে সেখানে কবর দেবেন।’ তাঁর কথামত ইয়াজিদ ৫০ হিজরীতে কন্সটান্টিনোপলের কাছে রোমান ভূমিতে তাঁকে কবর দিয়েছিলেন।
২. আল-হারিছের পুত্র মুয়াদ, মায়ুদ এবং আউফ -এই তিনজন বীর তাদের পদবী ‘আবনা-আফরা’ নামে বিখ্যাত ছিলেন। মায়ুদ এবং আউফের জীবন বৃত্তান্ত ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। মুয়াদ সম্পর্কে কারো কারো অভিমত হচ্ছে এই যে তিনি বদরের যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন তবে ইসহাক তার নাম নিহতদের মধ্যেও অন্তর্ভূক্ত করেননি। আউফ এবং মায়ুদ অবশ্য আবু জেহেলকে নিহত করার পর ঐ বদরের যুদ্ধেই নিহত হয়েছিলেন।
৩. এর জীবন বৃত্তান্তের জন্য আমাদের ওহুদের যুদ্ধ বই দেখুন।
৫. এর জীবন বৃত্তান্তের জন্য আমাদের বই ওহুদের যুদ্ধ দ্রষ্টব্য।
৬. পুরা নাম আল-বারা বিন মারুর বিন সাখর বিন সাবিক বিন সানান আল-খাযরাজি। এই সুপরিচিত সাহাবী আনসারদের একজন নেতা এবং বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। তিনিই প্রথম মুসলমান যিনি কাবাকে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ধারণা করেছিলেন তিনিই মহানবীর মদীনায় আসার এক মাস আগে মৃত্যুবরণ করেন এবং মহানবী নতুন শহরে এসে প্রথমেরই তাঁর কবর যিয়ারত করেন।
৭. এর জীবন বৃত্তান্তের জন্য এই লেখকের ওহুদের যুদ্ধ দ্রষ্টব্য।
৮. ঐ
৯. পুরা নাম মুয়াদ বিন জাবাল বিন আমর বিন আউস বিন আবিদ বিন আদি বিন কা’ব আল-আনসারী আল-খাবরাজি। তিনি ছিলেন ইসলামিক আইনের একজন বড় পণ্ডিত, বিশেষ করে নিষিদ্ধ কাজ কিংবা বিষয়ে। আৰু ইদ্রিস আল-খাওলানির ভাষ্য অনুসারে, তিনি ছিলেন খুব ফর্সা, সুদর্শন এবং সহৃদয় ব্যক্তি। তিনি ২১ বছর বয়সে বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা ছাড়াও মহানবীর সঙ্গে থেকে অন্যান্য সব যুদ্ধেই অংশ নেন। মহানবী তাঁকে ইয়েমেনের গভর্ণর নিযুক্ত করেন এবং নিযুক্তির সময় ইয়েমেনবাসীকে লিখেছিলেন, ‘আমি আপনাদের কাছে আমার একজন সর্বোত্তম মানুষকে পাঠালাম।’ মহানবীর মৃত্যুর সময় মুয়াদ ইয়েমেনে ছিলেন। তিনি আবু বকরের শাসনামলে মদীনায় ফিরে আসেন এবং ১৪ হিজরিতে সিরিয়ায় মৃতু বরণ করেন। তিনি মহানবীর ১৫৭ টি ধর্ম-বিশ্বাসকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
১০. উবাদা বিন আস-সামিত বিন কায়েস বিন আসরাম বিন ফির বিন কায়েস-আনসারি আল-কাযরাজি একজন বিখ্যাত সাহাবী ছিলেন। তিনি মুসলমান সেনাবাহিনীর অন্যতম কমান্ডার হিসেবে আমর বিন আল-আস-এর অধীনে মিশর জয় করেছিলেন। আমর বিন আল-আস মিশরের রোমান গভর্ণর মাকাকাসের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবেও তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। আবু উবাদা বিন আল-জাররাহ তাঁকে সিরিয়ার হিমসের গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি সুদর্শন, লম্বা এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়াতে মিশরের গভর্ণর মাকাকাস ভয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি প্যালেষ্টাইনের রামলায় ৩৪ কিংবা ৪৫ হিজরিতে মৃত্যু বরণ করেন।]
মহিলা অঙ্গীকার কারিনীদ্বয়
এরা দু’জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের এবং এদের নাম ছিল :
১. নাসিবা, কা’ব বিন আমরের কন্যা, এবং
২. উম্মে মনি (তার নামঃ আসমা বিনতে আমর বিন আদি)।
বার জন শিষ্য
অঙ্গীকারের শর্তাবলীর বাস্তবায়ন তদারকির জন্য মহানবীর নির্দেশে খাযরাজের জনগণ যে ১২ জন শিষ্য নির্বাচন করেছিলেন তাদের মধ্যে ৯ জন ছিলেন আল-খাযরাজের এবং ৩ জন ছিলেন আউসের।
(ক) খাযরাজ থেকে তারা ছিলেন :
১. আসাদ বিন জুরারাহ্
২. সা’দ বিন আর-রাবি।
৩. আব্দুল্লাহ্ বিন রাওয়াহা।
৪. রাফা বিন মালিক আল-আজলান।
৫. আল-বারা বিন মারুর।
৬. আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন হারাম
৭. উবাদাহ্ বিন আস-সামিত।
৮. সা’দ বিন উবাদাহ্।
৯. আল-মুনদির বিন আমর।[১]
[১. আল-মুন্দির বিন আমর বিন খাযরাজ বিন হারিসা বিন লাওধান আল-খাযরাজি আল-আনসারি একজন প্রখ্যাত সাহাবী। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সেই সব মুসলমানদের একজন যাদেরকে নাজদের আমির গোত্রের লোকেরা মায়ুনা কূপের কাছে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নিহত করেছিল। তিনি আল্লাহর দূত মুহাম্মদের (সঃ) মাত্র একটি বিশ্বাসকে হস্তান্তর করেছিলেন।]
(খ) আউস থেকে :
১. উসাইদ বিন হুদাইর।
২. সা’দ বিন খায়থামা, এবং
৩. রাফা বিন আব্দুল মুন্দির বিন যুবাইর।[১]
[১. রাফা বিন আল-মুন্দির বিন রাফা বিন যুবাইর ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী-আবু লুবাবা ভাই। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নেন এবং খাইবারের যুদ্ধে শহীদ হন।]
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি
মহানবী এবং মদীনার লোকদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই মহান অঙ্গীকার মক্কার প্রতিমা-পুজারীদেরকে ভীষণ বিচলিত করে তুলেছিল। তারা দেখতে পেল যে ইসলামের শক্তিগুলোর সঙ্গে মদীনার অধিবাসীদের মৈত্রির ফলে তাদের পৌত্তলিক জীবন-ধারা নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে।
আউস ও খাযরাজ গোত্রদু’টির সামরিক শক্তি সম্পর্কে মক্কাবাসীরা ভালভাবেই অবগত ছিলেন। তারা জানতো যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্তরিক ইচ্ছাতেই যুদ্ধরত গোত্রগুলির লোকেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই মানসিকতাই তৎকালীন মদীনায় ইসলামের জন্য সহায়ক হয়েছিল, কারণ ইসলাম ছিল যুদ্ধের বিপক্ষে এবং ভাতৃত্ব, শান্তি ও ভালবাসার পক্ষে। এর শিক্ষা ছিল মানুষে মানুষে ভালবাসার সম্পর্ক বজায় রেখে মিলে মিশে বাস করার। কিন্তু মক্কাবাসীদের জন্য এর সূচনা শুভ ছিল না। কারণ, ইসলাম মদীনার দু’টি প্রতিপক্ষ গোত্রকে একীভূত করে দিলে তাদের সম্মিলিত শক্তিতে পৌত্তলিকদের আদর্শ, ধর্ম এবং রাজনৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ভীষণভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।
সুতরাং ইসলামের এই অগ্রগতির ফলে উদ্ভূত বিপদ এড়ানোর জন্য কুরাইশরা উঠে পড়ে লাগলো। কিন্তু সমাধান কিভাবে সম্ভব সেটাই ছিল তাদের সামনে বড় সমস্যা।
মহানবী এবং মদীনার আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে সামরিক মৈত্রির ফলে সৃষ্ট ঘটনাপ্রবাহ আলোচনার জন্য মক্কী সংসদে কয়েক দফা আলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
মুসলমানদের মদীয়নায় হিজরত
মক্কাবাসীরা যখন শলা-পরামর্শে ব্যস্ত, তখন মহানবী তাদের চিন্তা ভাবনা সম্পর্কে নিজেকে অবহিত রাখলেন এবং তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবলেন।
মদীনায় যখন ইসলামের একটা কেন্দ্র এবং শক্তিশালী সমর্থক পাওয়া গেল তখন মহানবী আর কালক্ষেপণ না করে তাঁর মক্কী সঙ্গী-সাথীদের মক্কা ছেড়ে ইয়াথ্রিবে চলে যেতে পরামর্শ দিলেন। এই ইয়াবিই হয়েছিল পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে পরবর্তী সকল যুদ্ধের জন্য ইসলামের শক্তিসমূহের একটা দূর্ভেদ্য সামরিক ঘাঁটি।
মহানবীর পরামর্শে মক্কী মুসলমানরা মদীনায় চলে যেতে শুরু করলেন। প্রতিপক্ষের দৃষ্টি এড়ানোর লক্ষ্যে তারা একাকী কিংবা ছোট ছোট দলে চলে যেতেন। এটাই ছিল তাদের জন্য বিচক্ষণ একটা ব্যবস্থা, কারণ কুরাইশরা সন্দেহ পরায়ন হলে তাদের হিজরত বন্ধ করতে সর্বোতভাবে চেষ্টা চালাত।
তথাপি যে সমস্ত কুরাইশ সারাক্ষণ প্রহরারত ছিল তারা মুসলমানদের মদীনায় হিজরতের বিষয়টা জানতে পেরেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে মুসলমানদের অব্যাহত মদীনা যাত্রার পেছনে একটা সুনির্দিষ্ট সামরিক উদ্দেশ্য ছিল এবং তা হচ্ছে তাদের পৌত্তলিক জীবনধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা।
তারা মুসলমানদের মদীনা যাত্রা প্রতিহত করতে কয়েকবারই চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হতে পারেনি। অবশ্য সামান্য কয়েকজন দূর্বল এবং দরিদ্র মুসলমান মক্কা ত্যাগ করতে পেরেছিল না। কুরাইশরা এই দরিদ্র ও অসহায় মুসলমানদের উপর তাদের রাগ ঝেড়েছিল এবং তাদের উপর নানা রকম জুলুম ও অত্যাচার চালিয়েছিল তবে এই সব কতিপয় মুসলমান ছাড়া ওমর বিন আল-খাত্তাব, যুবাইর বিন আল-আওয়াম, মুসাব বিন উমাইর আল-আবদারি এবং ওসমান বিন আফান প্রমুখ সহ অধিকাংশ মুসলমানই মদীনায় হিজরত করেন। কুরাইশদের মধ্যে কেউই তাঁদের এই হিজরত প্রতিহত করার মত শক্তিশালী ছিল না।
গুরুতর পর্যায়
কুরাইশরা বিগত তেরো বছর ধরে ইসলামের প্রচার রোধের ব্যর্থ চেষ্টা করে আসছিল। তারা ভীতি-প্রদর্শন, জুলুম, নির্যাতন সহ সব রকম কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল এবং মহানবী ও তাঁর ধর্মমতের বিরুদ্ধে নানা রকম বিরূপ প্রচারনা চালিয়েছিল। মহানবী এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীর বিরুদ্ধে সামাজিক বর্জন এবং না খাইয়ে মেরে ফেলার নীতি গৃহীত হয়েছিল। দূর্বল মুসলমানদেরকে মেরে ফেলা হত এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হত। কুরাইশরা যে এত বছর ধরে ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে ভয়াবহ মনস্তাত্বিক সংগ্রামে লিপ্ত ছিল এগুলো ছিল তারই একটা অংশ।
কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ইসলাম ও পৌত্তলিকতার মধ্যেকার এই সংঘাত এতদিন মুক্ত ও সশস্ত্র সংঘর্ষের রূপ লাভ করেনি। মহানবী এবং তাঁর অনুসারীবৃন্দ এই সময় অবিচলভাবে এবং চরম ধৈর্য্য সহকারে তাঁদের প্রতিপক্ষের যাবতীয় জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। তবে এই সংকটকালে মহানরী-কখনোই ইসলামের প্রচারনার প্রচেষ্টাকে স্তিমিত করেননি। এই সংঘাতের শেষ বছরের দিকে অবশ্য মক্কার পৌত্তলিকরা এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে যা ইসলাম ও পৌত্তলিকতার মধ্যেকার সংঘর্ষে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।
অন্যায় সিদ্ধান্ত
ইসলামের প্রচার রোধে ব্যর্থ হলে মক্কী পৌত্তলিকরা খুব ঘাবড়ে যায়। একমাত্র যুদ্ধ ছাড়া এ পর্যন্ত তারা কোন প্রচেষ্টাই বাদ রাখেনি। মহানবীর সঙ্গে ইয়াথ্রিবের জনগণ যোগ দেওয়ার পর তারা পরিস্কার বুঝতে পারে যে তাদের জন্য ক্রমবর্ধমান বিপদ ঘনিয়ে আসছে এবং তাদের পৌত্তলিক আদর্শের মৃত্যু অবধারিত। ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে তারা নতুন অস্ত্র খুঁজতে লাগলো। মহানবীর অধিকারিকত্বের এয়োদশ বছরের প্রথম দিনে রবি মাসের শুরুর দিকে মক্কী সংসদের বৈঠক আহবান করা হয়। দার-উন-নাদওয়া বলে পরিচিত মক্কী সংসদের এটাই ছিল সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক
মক্কী সংসদের ঐতিহাসিক অধিবেশন
এই ঐতিহাসিক দিনে সমস্ত কুরাইশ গোত্র থেকে প্রতিনিধিরা মক্কার সংসদে এসে মহানবী এবং তাঁর ধর্মমতের বিরুদ্ধে তাদের বিভিন্ন করণীয় বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তারা বুঝেছিলেন যে তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে তাদের পুরনো বিশ্বাসগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই গুরুত্বপূর্ণ সংসদের সদস্যরা ছিলেন :
১. আবু জেল বিন হিশাম (বানু মাখযুম গোত্রের)।
২. যুবাইর বিন মুতিম, আল-হারিস বিন আমির বিন নাওফল, এবং তুয়াইমাহ্ বিন আদি (বানু নাওফল বিন আব্দ্ মানাফ্ গোত্র থেকে)।
৩. উতবাহ্ বিন রাবিয়া, তার ভাই শায়বাহ্ এবং আবু সফিয়ান বিন হারব (বানু আব্দ্ শামস্ বিন আব্দ মানাফ গোত্র থেকে)।
৪. আন-নাদর বিন আল-হারিস বিন কালদা (বদরের যুদ্ধের পর মহানবীর আদেশে সাফরা উপত্যাকায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল) বনু আব্দ্ আদ-দার গোত্রের প্রতিনিধি হিসেবে এই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন।
৫. আবুল বখতারী বিন হিশাম, যামামা বিন আল-আসওয়াদ বিন আল-মুক্তালিব, এবং হাকিম বিন হিযাম (বানু আসাদ বিন আব্দুল উজ্জা গোত্র থেকে)।
৬. আল-হাজ্জাজের দুই পুত্র নাবিয়াহ্ এবং মুন্নাবাহ (বানু সাহাম গোত্র থেকে)।
৭. ওমাইয়া বিন খালাফ[১]
[১. ইনি অন্যান্য মক্কী নেতার সঙ্গে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।]
(বানু আল-জুমহা গোত্র থেকে)। এছাড়াও আরো অনেক কুরাইশ
গোত্রের প্রতিনিধিবৃন্দ এই বৈঠকে যোগদান করেছিলেন।
তেহামাহ্রর লোকদের ডাকা হয়নি
কুরাইশরা ভাবতো তেহামাহ্ লোকেরা মহানবীর প্রতি সহানুভূতিশীল। সেজন্য তাদেরকে তারা মক্কী সংসদের এই অধিবেশনে ঢুকতে দেয়নি। অন্য সবাইকে বিশেষ করে নাজদের লোকদের এই আলোচনায় অংশ গ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, কারণ এ ধরণের জটিল ও বিতর্কিত বিষয়াবলী আলোচনার সময় তাদের সংসদের সদস্য নয় এমন লোকদেরও তারা ডাকতো।
বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। বিভিন্ন প্রতিনিধি বিভিন্ন রকম পরামর্শ ও প্রস্তাব উত্থাপন করলেও তাদের অধিকাংশই সংসদের ভোটে নাকচ হয়ে যায়। আবুল আসওয়াদ রাবিয়ে বিন আমর (বানু আমির বিন লুয়াই গোত্রের) প্রতিনিধির পরামর্শ ছিল মহানবীকে মক্কা থেকে বহিস্কার করে দেয়া। কিন্তু তার এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে যায়, যখন আরেকজন প্রতিনিধি এ ধরণের কাজের বিপদগুলি বর্ণনা করে বলেন : “আমি এই প্রস্তাব সমর্থন করি না, কারণ আপনারা নিশ্চয়ই তাঁর মিষ্টি কথাবার্তা, তাঁর বাগ্মিতা এবং মানুষের অন্তর জয় করার অসাধারণ ক্ষমতার কথা জানেন। তাঁকে তাড়িয়ে দিয়ে আপনারা কখনোই শান্তি পাবেনা না, কারণ তিনি তখন অন্য কোন আরব গোত্রে চলে যাবে এবং তাঁর বাগ্মিতায় এভাবে তিনি শক্তি সঞ্চয় করবেন এবং আপনাদের জীবন তখন তাঁর দয়ার উপর নির্ভলশীল হবে। “ বক্তব্যের শেষে তিনি বললেন, “তার চেয়ে বরং আপনারা অন্য কোন উপায়ের কথা ভাবুন।”
তখন আরেকজন প্রতিনিধি আবুল বখতারি বিন হিশাম (বনি আসাদ বিন আব্দুল উজ্জা গোত্রের) পরামর্শ দিলেন যে মহানবীকে শিকল দিয়ে বেঁধে নিপারদ প্রহরায় রাখা হোক। তিনি বললেন, “তাঁকে লোহার শিকলে বেঁধে একটি কারাগরে নিক্ষেপ করুন এবং যুহাইরা এবং নাবিগার মত অন্যান্য কবিদের মত তাঁরও মৃত্যুর জন্য ধৈর্য্যসহকারে অপেক্ষা করুন।”
কিন্তু এই প্রস্তাবটিও নাকচ হয়ে যায় তখন আরেকজন প্রতিনিধি এর বিচক্ষণতা চ্যালেঞ্জ করে বললেন : “ না, আমি এই মত সমর্থন করি না। আপনারা তাঁকে বন্দী করে রাখলে বন্ধুরা সবাই সংবাদ পেয়েই আপনারদের উপর এসে চড়াও হবে এবং তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। তাদের সংখ্যা বেড়ে আপনাদের চেয়ে শক্তিশালী হবে। অতএব, আমি এ পরামার্শ মানি না। আপনারা বরং অন্য কিছু ভাবুন।”
মহানবীকে হত্যার ব্যাপারে ঐক্যমত
অবশেষে মক্কী সংসদ মক্কার প্রধান অপরাধী বনী মখযুমের আবু জেহল বিন হিশামের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। তার প্রস্তাব ছিল মহানবীকে এমনভাবে হত্যা করা হবে যাতে কুরাইশদের সব গোত্রই হত্যাকান্ডে অংশ নিবে এবং এতে করে কেউই তাঁর মৃত্যুর জন্য তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে সাহস পাবে না। সংসদকে সম্বোধন করে এই নারকীয় নেতা বললেন : “আমি যে প্রস্তাবটি দিতে চাই সেটাই হবে সর্বোত্তম প্রস্তাব। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “ও আবুল হাকাম, আপনার প্রস্তাবটা কি?”
তিনি বললেন, “আমার প্রস্তাব হচ্ছে এই যে আমরা আমাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে ভদ্র পরিবারের শক্ত সমর্থ যুবকদের নির্বাচিত করে তাদের হাতে ধারালো তরবারি তুলে দেব এবং তারা গিয়ে এক সঙ্গে তাঁকে মেরে ফেলবে। এক সঙ্গে আঘাত করলে তাঁকে হত্যার দায়-দায়িত্ব সবার মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে এবং এতে করে বনু আব্দ মানাফ সবাইকে যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পাবে না। তারা যদি এই হত্যার জন্য টাকা-পয়সা দাবী করে তাহলে আমরা তা যৌথভাবে প্রতিরোধ করবো।”
মক্কী সংসদ তক্ষুণি এই ঘৃণ্য প্রস্তাবটি গ্রহণের ব্যাপারে একমত হয়েছিল। তারা এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য তক্ষুণি পদক্ষেপ নিল।
মহানবীর বাড়ী অবরোধ
মক্কী সংসদের যখন এই মারাত্মক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন মহান আল্লাহ তায়ালা মহানবীকে এ সম্পর্কে অবহিত করেন এবং তাঁকে মদীনায় চলে যাওয়ার আদেশ দেন। ইবনে ইসহাক বলেন : “জিব্রাঈল ফেরেস্তা এসে মহানবীকে (সঃ) বললেন, “আপনি যে বিছানায় প্রতিদিন ঘুমান, আজ রাতে সে বিছানায় ঘুমাবেন না।”
পরবর্তী রাতে মহানবী-বাড়ীতেই ছিলেন। এ সময় কুরাইশদের সকল গোত্র থেকে লোকজন এসে তাঁকে হত্যা করার জঘন্য যড়যন্ত্র চরিতার্থ করার জন্য তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে।
ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতা এবং হিজরত
পৌত্তলিকরা মহানবীকে হত্যা করার জন্য তাঁর বাড়ীর বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। মহানবী অবিশ্বাস ও অত্যাচারের অন্ধকার দূর করতে দুনিয়াতে যে আলো নিয়ে এসেছিলেন পৌত্তলিকদের উদ্দেশ্য ছিল সেই আলো নিভেয়ে দেওয়া।
ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করার জন্য পৌত্তলিকদের নেতারাও মহানবীর বাড়ীর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
অন্যান্যদের মধ্যে সেখানে আবু জেহেলও গর্বভরে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরিকল্পনার সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তিনি মহানবীকে ব্যঙ্গ করে অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন :’মুহাম্মদ ভাবছে যে তাকে অনুসরণ করলে তোমরা সমগ্র আরব এবং অবশিষ্ট বিশ্বের নেতা হবে এবং মৃত্যুর পর তোমাদেরকে জীবিত করে তোমাদের জন্য বাগান (জর্ডানের বাগানগুলির মত) সরবরাহ করা হবে। আর তোমরা যদি তার কথামত কাজ না কর তাহলে তোমাদের কপালে দুঃখ আছে, কারণ মৃত্যুর পর তোমাদেরকে জীবিত করে এমন আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে যেখানে তোমরা অনন্তকাল জ্বলতে থাকবে।”
পরিকল্পনা ছিল মহানবীকে মধ্যরাতের পর হত্যা করা হবে। এ জন্য মক্কী নেতৃবৃন্দ এবং তাদের লোকেরা পাহারারত অবস্থায় সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। কিন্তু সবরকম প্রস্তুতি এবং পাহারা সত্ত্বেও তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়, কারণ আল্লাহ হচ্ছে সর্ব-শক্তিমান এবং তিনি যেমনটা উপযুক্ত মনে করেন তেমনটাই করে থাকেন। কুরাইশদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে আল্লাহ্ তাঁর নবীকে ষড়যন্ত্রকারীদের দুষ্কর্ম থেকে রক্ষা করেছিলেন। মহানবী তাদের পাশ দিয়েই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যান কিন্তু পাহারাদাররা জাগ্রত অবস্থায় থেকেও তাঁকে দেখতে পায়নি।
তিনি বাড়ী থেকে বেরিয়ে এক হাতে এক মুঠ ধুলা তুলে নিয়ে দুষ্ট প্রতিমা-পুজারীদের দিকে ছিটিয়ে দেন এবং এই ঐশ্বরিক কথাগুলো বলতে বলতে সেখান থেকে তিরোহিত হন : “এবং আমরা তাদের সামনে এবং পেছনে একটা করে প্রতিবন্ধক স্থাপন করেছি এবং এভাবে তাদের চোখ বন্ধ করে দিয়েছি যাতে তারা দেখতে না পায়।”
নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগে মক্কাবাসীরা বুঝতে পারে যে তাদের শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে। একটু পরে যখন একটা লোক এসে তাদের জানালো যে তাদের পাহারা অর্থহীন তখন মহানবীর ঘরের দরজায় অপেক্ষমান ষড়যন্ত্রকারীরা আপসোস করতে লাগলো। লোকটি বললো : “আপনারা কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন?”
তারা বললো, “মুহাম্মদের জন্য।”
লোকটি বললো, তাহলে আর অপেক্ষা করে কাজ নেই। মুহাম্মদ আপনাদের মাথায় ধুলো ছিটিয়ে আপনাদের পাশ দিয়েই চলে গেছেন। আপনাদের মাথায় ধুলো দেখতে পাচ্ছেন না? এ কথা শুনে সবাই মাথায় হাত দিয়ে ধুলা দেখতে পেল।
তবু তারা ভাবলো মুহাম্মদ ঘরের ভিতরেই আছেন। তারা দ্রুত দরজায় গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখনো মুহাম্মদের বিছানায় তাঁরই কাপড় গায়ে জড়িয়ে আলী শুয়ে আছেন। আলীকে মুহাম্মদ ভেবে তারা বললো : “নিশ্চয়ই মুহাম্মদই ঘুমিয়ে আছে।” তথাপি সন্দেহ ও সিদ্ধান্তহীনতায় বিভ্রান্ত হয়ে তারা তাদের কার্যক্রম সকাল পর্যন্ত স্থগিত রাখলো।[১] এবং সকালে নবীজির বিছানা থেকে আলী বিন আবি তালিবকে উঠতে দেখলো। এতে করে নবীজির প্রস্থান সম্পর্কে রাত্রে লোকটি যা বলেছিল তার সত্যতা প্রমাণিত হলো। মহানবীর জীবনের বিরুদ্ধে তাদের জঘন্য চক্রান্ত এভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো এবং তারা সবাই রাগে দুঃখে আর্তনাদ করতে লাগলো।
[১. আল-রায়ুজ উল-আনফ্ লিল- সুহাইলির লেখকের মতে অবরোধকারীরা রাতে নবীজির বাড়ীর দেয়াল টপকাতে চেষ্টা করতে গিয়ে একজন মহিলার কান্না শুনে থেতে গিয়েছিল। পাছে লোকে যাতে বলতে না পারে যে তারা স্ত্রীলোকের সম্মানহানির জন্য এ কাজ করেছিল এ ভয়েই তারা হত্যার কাজটি সকাল পর্যন্ত স্থগিত রেখেছিল, কারণ জাহিলিয়ার যুগে মেয়েলোকের সম্মান হানিকে খুব ঘৃণ্য কাজ মনে করা হতো। তারা মুহাম্মদের জন্য অপেক্ষা করছিল কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার সময় কেউ তাঁকে দেখতে পায়নি।]
সফল হিজরত
মহানবী কুরাইশদের জঘন্য সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে তাঁর প্রধান সাহাবীকে (আবু বকর আস সিদ্দিক) মদীনায় সম্ভাব্য হিজরতের ব্যাপারে তৎপর করে দিয়েছিলেন। তিনি বাড়ী থেকে বেরিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধুর বাড়ীর দিকে পা বাড়ালেন।
মহানবীর হিযরত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ছিল বিধায় এ ব্যাপারে কড়া গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। আবু বকরের বাড়ীতে পৌঁছে মহানবী (সঃ) তাঁর সঙ্গে গোপনে কথা বলার জন্য বাড়ীর লোকদের সরিয়ে দিতে বললেন। আয়েশার বর্ণনা থেকে ইবনে ইসহাক বলেন, “হিযরতের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত মহানবী (সঃ) প্রতি দিনই সকালে কিংবা বিকেলে একবার করে আবু বকরের বাড়ীতে যেতেন। এই দিন নবীজি আমাদের বাড়ীতে দুপুরে আসেন, যে সময় তিনি আগে কখনো আসেননি।” আয়েশা অরো বলেন : “নবীজিকে আসতে দেখে আবু বকর বললেন, নিশ্চয়ই বড় কোন কারণে নবী (সঃ) এই অসময়ে আমাদের বাড়ীতে আসছেন।” তিনি ভিতরে ঢুকলে আবু বকর তাঁর বিছানায় তাঁকে বসতে বলেন। সেই সময় আবু বকরের সঙ্গে শুধুমাত্র আমি এবং আমার বোন আসমা বাড়ীতে ছিলাম কিন্তু নবীজি আৰু বকরকে বললেন, “ওদেরকে চলে যেতে বলুন।” এতে আবু বকর বললেন, “হে আল্লাহর নবী, ওরা দু’জনই তো আমারই মেয়ে। কি ব্যাপার?’ মহানবী বললেন, ‘দেখুন, এই মাত্র আমি আল্লাহর কছে থেকে হিযরতের অনুমতি পেয়েছি।’ একথা শুনে আবু বকর বলেন, “হে আল্লাহর নবী, আমাকে কি আপনার সঙ্গে যেতে হবে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, যেতে হবে।’ আয়েশা আরো বলেন : “প্রকৃতপক্ষেই তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না যে মানুষ আনন্দেও কাঁদতে পারেন। আমি দেখলাম আবু বকর আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে ফেললেন এবং তারপর বললেন, “হে আল্লাহর নবী, আমি হিযরতের জন্য দু’টি উট প্রস্তুত ক’রে রেখেছি।’ এই উট দু’টিকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দেখাশুনার জন্য বি-দাইলের একজন লোককে দেয়া হয়েছিল। উট দু’টির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আব্দুল্লাহ্ বিন আরকাত নামক একজন বহু-ঈশ্বরবাদী লোককে।
মক্কা থেকে বিদায়
শুধুমাত্র ইসলামের ইতিহাসে নয়, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসেই একটা সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল এই চরম রাতটিতে। কুরাইশরা তাদের অসার দম্ভে নবীজির বাড়ী ঘেরাও করে তাঁকে হত্যা করার জন্য প্রত্যুষের অপেক্ষা করেছিল। এর মধ্যেই মহানবী (সঃ) তাঁর বন্ধু আস-সিদ্দিক প্রত্যুষের আগেই মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন।
গুহায় আত্মগোপন
নবীজি ভালভাবেই জানতেন যে মক্কা থেকে তাঁর তিরোধানের পরেই কুরাইশরা তাঁকে খুঁজে বের করার জন্য কঠোর চেষ্টা করবে। তিনি এটাও জানতেন যে উত্তরে মদীনার পথে ভ্রমণ করা নিরাপদ নয়, কারণ পথে অনুসরণকারীরা তাঁকে অবশ্যই ধরে ফেলবে। এজন্য তাঁরা দক্ষিণের ইয়েমেনের পথ ধরেন। এ পথে অনুসরণকারীদের হাতে ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না।
এভাবে মক্কার পৌত্তলিক শত্রুদের দৃষ্টি এড়িয়ে তাঁরা অনেক পথ ভ্রমণ করলেন। এতদসত্বেও নবীজি অনুমান করলেন কোন পথে শত্রুরা অগ্রসর হতে পারে। একই পথে অগ্রসর হলে তাঁরা ধরা পড়তে পারেন। এজন্য ঐ ঐতিহাসিক রাত শেষে সকালে নবীজি সিদ্ধান্ত নিলেন যে মক্কার লোকদের বিক্ষুব্ধ ভাব এবং তাদের নেতাদের রোষ না কমা পর্যন্ত তিনি তাঁর ভ্রমণ স্থগিত রাখবেন। এজন্য তাঁরা মক্কার দক্ষিণে থায়ুব নামক একটি পর্বত গুহায় আত্মগোপন করলেন।
অনুসরণ
মহানবীর চলে যাওয়ার সংবাদ যখন মক্কায় ছড়িয়ে পড়লো তখন কুরাইশরা খুব বিচলিত এবং রাগে উন্মত্ত হয়ে পড়লো।
কুরাইশ প্রধানরা স্পষ্টতঃই দেখতে পেলেন যে তাদের পৌত্তলিক জীবনধারার বিলুপ্তি আসন্ন। তারা বুঝলেন যে মক্কা থেকে মুহাম্মদের মদীনায় হিজরতের অর্থ হচ্ছে তাদের জন্য একটা শক্তিশালী সুশৃঙ্খল এবং সশস্ত্র প্রতিপক্ষ এবং তাদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ ধরণের একটা অবস্থা মদীনার পথ পার হয়ে তাদের সিরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্যও একটা বড় হুমকিস্বরূপ। তারা বুঝলেন যে মক্কা নগরী এবং তাদের পৌত্তলিক সংগঠন এখন মদীনার সশস্ত্র হুমকির সম্মুখীন। এজন্য মক্কী প্রধানগণ মহানবী যাতে মদীনায় না পৌঁছতে পারেন তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ কল্পে তাদের সংসদের একটা জরুরী বৈঠক আহব্বান করলেন। মক্কা থেকে যে সব পথ বাইরে গেছে সে সব পথে বিশেষ করে মদীনার পথে তারা সশস্ত্র পাহারাদার মোতায়েন করে মহানবী এবং তাঁর সঙ্গীকে প্রেফতার করে মক্কায় ফিরিয়ে আনার জন্য তারা তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন।
মহানবীকে গ্রেফতারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা
মক্কার সংসদ এটাও ঘোষণা দিল যে, যে ব্যক্তি নবীজিকে ধরে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় কুরাইশদের হাতে এনে দিতে পারবে তাকে একশত উট পুরস্কার দেওয়া হবে।
এই ঘোষণায় মহানবী ও তাঁর সফরসঙ্গীকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা আরো জোরদার হলো। নবীজি ও তাঁর বন্ধুর কোন রকম হদিস বের করার জন্য পাহাড়, গিরিখাত, উপত্যকা ইত্যাদি স্থানে বহু লোক-কেউ ঘোড়ার পিঠে, কেউ উটের পিঠে আবার কেউবা পদব্রজে বেরিয়ে পড়লো। এটা ছিল একটা ব্যাপক অনুসন্ধান কার্যক্রম
আবু বকরের বাড়ীতে অনুসন্ধান
নবীজির প্রস্থানে মক্কার নেতাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশী ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন আবু জেহেল। আরো কয়েকজন নেতাকে সঙ্গে নিয়ে এই জঘন্য লোকটি নবীজিকে খুঁজতে আবু বকরের বাড়ীতে গেলেন। দরজায় তাদের অভিবাদন জানালেন আসমা বিনতে আবুবকর আস-সিদ্দিক। তারা আসমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার বাবা কোথায়?” কিন্তু তিনি জবাব দিলেন, “আমি জানি না।”
এ কথা শুনে আবু জেহেল (যাকে ইবনি ইসহাক মক্কার নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন) আসমার গালে এমন জোরে চড় মারলো যে, তাঁর কানের দুল মাটিতে পড়ে গেল।
থাউর পর্বতে সন্ধানকারীরা
নবীজি এবং তার সফর সঙ্গীকে সন্ধানের কাজ তিন দিন একটানা চললো কিন্তু কোন কাজ হলো না। অনুসন্ধানকারীরা তাঁদের কোন হদিসই কোথাও পেল না। নবীজি তাঁর সঙ্গীকে নিয়ে তিন দিন এক পর্বত গুহায় লুকিয়ে থাকলেন। অনুসন্ধানকারীরা একবার প্রকৃত পক্ষেই ঐ গুহার মুখে এসে পৌঁছে ছিল কিন্তু নবীজি ও তাঁর সঙ্গীকে মহান আল্লাহ্তায়ালা বিশেষভাবে রক্ষা করেছিলেন।
মানব ইতিহাসের সংকটময় মূহুর্ত : নবীজির গুহার পাশ দিয়ে যাবার সময় একদল মক্কাবাসী একজন রাখালকে জিজ্ঞেস করলো সে মুহাম্মদকে দেখেছে কিনা। রাখাল জবাব দিল সে কাউকে দেখেনি তবে মহানবীর গুহার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে সে বলল যে ওখানে তাঁরা লুকিয়ে থাকতে পারেন।
শুধুমাত্র ঐ দু’জন মহাত্মার জন্য নয় বরং গোটা মানবজাতির জন্যই এটি ছিল একটা উদ্বিগ্নতার মূহুর্ত। ঐ মূহূর্তের প্রশ্ন ছিল মানবজাতি কি অন্যায়, অত্যাচার এবং ধ্বংসের পথে ফিরে যাবে নাকি গুহার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মানুষটির নেতৃত্বে মুক্তি ও আলোর পথে ধাবিত হবে।
আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে আছেন
পৃথিবীর ভাগ্য নির্দ্ধারণকারী-ঐ উদ্বিগ্নতার মূহুর্তগুলিতে মক্কার অনুসন্ধানকারীরা পাহাড়ের উপর উঠে রাখালের নির্দেশিত গুহার কাছে গিয়ে নবীজি ও তাঁর সঙ্গীকে খুঁজার জন্য উঁকি মারতে যাচ্ছিল। আবু বকর তাদের পায়ের শব্দ শুনে ভীত হয়ে পড়লেন এবং মহানবীর কানে কানে বললেন : “আমরা মাত্র দু’জন। ওদের কেউ নীচে তাকালেই আমাদেরকে দেখতে পারে। “ কিন্তু নবীজি তাঁর প্রভুর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে এবং সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন মনে জবাব দিলেন : “হে আবু বকর, দু’জনের সঙ্গে যে তৃতীয় সঙ্গী হিসেবে আল্লাহ্ আছেন তাঁর সম্পর্কে আপনি কি ভাবছেন?”
আল্লাহ্ তাঁর অসীম দয়ায় অলৌকিকভাবে তাঁদেরকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করলেন। অনুসন্ধানকারীরা গুহার মুখের দিকে তাকিয়েই চলে গেল। তারা আর গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো না, যদিও তাদের শিকার তাদের কাছে থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে ছিলেন।
অন্যান্য অনুসন্ধানকারীদের কাছে ফিরে গেলে তারা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো কেন তারা গুহার অভ্যন্তরে তাকিয়ে দেখেনি। তারা জবাব দিল গুহার ভিতরে তাকানোর দরকার ছিল না এই কারণে যে, ঐ গুহার মুখে এমন একটা মাকড়সার জাল এবং দুটি পাহাড়ী কবুতর ছিল যা দেখে মনে হলো ওগুলো মুহাম্মদের (সঃ) জন্মের পূর্ব থেকেই ওখানে আছে। সুতরাং ঐ গুহার ভিতরে কেউ থাকতেই পারে না। একথা শুনে অন্য অনুসন্ধান কারীরা আর নুতন করে সেখানে খুঁজে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। পলাতকদের কোন হদিস পেতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে তারা তাদের অনুসন্ধানের কাজ ছেড়ে দিল এবং উদ্বিগ্ন মানবতার জন্য সেটি ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত। অবশ্যই আল্লাহ্ তাঁর নবীর (সঃ) মাধ্যমে মানব জাতির কল্যাণ চেয়েছিলেন।
গুহায় তিন দিন
গুহার ভিতর তাঁদের তিন দিন লুকানো অবস্থায় একমাত্র আব্দুল্লাহ্ বিন আবু বকর এবং আবু বকরের মুক্তি প্রাপ্ত ক্রীতদাস আমির বিন ফাহিরা ছাড়া আর কেউ তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানতো না।
মহানবী আব্দুল্লাহ বিন আবু বকরকে (পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে) দায়িত্ব দিয়েছিলেন কুরাইশরা তাঁদের সম্পর্কে কি ভাবে তা তিনি তাঁদেরকে অবহিত করবেন। এজন্য তিনি সারাদিন মক্কায় থাকতেন, লোকজনের সঙ্গে মিশতেন এবং তারা কি বলতো বা করতো তা গভীরভাবে খেয়াল করতেন। তারপর রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের গুহায় গিয়ে সারাদিনের সঞ্চিত তথ্য মহানবী এবং তাঁর সঙ্গীর কাছে পৌঁছাতেন।
আমির বিন ফাহিরার দায়িত্ব ছিল গুহায় তাঁদেরকে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা এবং গুহার আশপাশ থেকে আব্দুল্লাহ্ বিন আবু বকরের পদাঙ্ক মুছে ফেলা। সে দিনের বেলা মক্কার অন্যান্য রাখালদের সঙ্গে তার পশু চরাত এবং রাতে মহানবী ও তাঁর সঙ্গীর কাছে গিয়ে তাঁদেরকে দুধ এবং মাংস দিয়ে আসত। সেখান থেকে ফেরার সময় সে আব্দুল্লাহ বিন আবু বকরের পায়ের দাগগুলি মুছে ফেলতো যাতে কুরাইশরা ঐ দাগগুলির সাহায্যে মহানবীকে খুঁজে বের করতে না পারে। রাখাল এবং পশুদের পায়ের দাগ সন্দেহের কোন ব্যাপার ছিল না।
ইয়াথ্রিবের পথে পুনরায় যাত্রা শুরু
তিন দিন ব্যর্থ খোজাখুঁজির পর কুরাইশরা মহানবী এবং তাঁর সঙ্গীকে পাওয়ার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়লো। তাদের উত্তেজনা প্রশমিত হলো এবং অবশেষে তাদের প্রচেষ্ট দূর্বল হয়ে পড়লো।
এই মুহূর্তে মহানবী এবং তাঁর সঙ্গী গুহার অবস্থান ছেড়ে তাঁদের জন্য রক্ষিত উটের পিঠে চড়ে পুনরায় তাঁদের যাত্রা শুরু করলেন। আব্দুল্লাহ্ বিন আরকাত[১] নামক একজন প্রতিমা-পূজারী ছিল তাঁদের পথ প্রদর্শক। এসময় আমির বিন ফাহিরাও সেখানে উপস্থিত ছিল।
গুহা ত্যাগের পূর্বে তাঁদের লম্বা ও বিপদসংকুল ভ্রমণের জন্য আসমা[২] বিনতে আবু বকর আস সিদ্দিক খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে এসেছিলেন।
[১. ইবনে হাজার তার আল-ইসাবায় আব্দুল্লাহ্ বিন আরকাতের (আল-আরকাও বলা হয়) কথা উল্লেখ করেছেন। আমি যতদূর জানি একমাত্র আধ-ধাহাবী (তার আত-তাজরিদে) ছাড়া আর কেউ তাকে মহানবীর অন্যতম সঙ্গী হিসেবে বর্ণনা করেননি। আব্দুল গনি আল মাকদিসি তার মহানবীর জীবন ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন যে আল-আরকাত কখনো ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিনা তা জানা যায়নি। আন-নাওয়ায়ী ও এই মত সমর্থন করেছেন।
২. আসমা বিনতে আবু বকর ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম জ্ঞানী ও মহীয়সী মহিলা হিসেবে খ্যাত। অনেকের মধ্যে তিনিও প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ ব্যক্তি। হিযরতের আগে মক্কায় আয-যুবাইর বিন আল-আওয়ামের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মদীনায় যান এবং সেখানেই তাঁর যোদ্ধা পুত্র আব্দুল্লাহ জন্মায়। আব্দুল্লাহ্ নিহত হওয়ার কয়েক দিন পর আসমা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অত্যন্ত সাহসী মহিলা ছিলেন। তিনি কখনো দুঃখ বা হতাশার কাছে আত্মসমৰ্পণ করেননি। একদিন আল-হাজ্জুনে (মক্কা) তাঁর ছেলের হত্যাকারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছেলের মৃতদেরহের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন : “এই অশ্বারোহীর কি অশ্ব থেকে নামার সময় হয়নি?” হাজ্জাজ তাঁকে বলেছিলেন, “সে ছিল (আসমার ছেলে) একটা ভণ্ড।” এ কথা শুনে আসমা জবাব দিয়েছিলেন, “না, সে কখনোই ভণ্ড ছিল না। সে ছিল একজন প্রকৃত বিশ্বাসী সে রাতে প্রার্থণা করতো এবং দিনের বেলা রোযা রাখতো।” হাজ্জাজ বললো, “বুড়ো ভীমরতিগ্রস্ত মহিলা, দূরহও এখান থেকে।” আসমা বললেন, “আমি ভীমরতিগ্রস্ত নই। আমি মহানবীর কাছে শুনে ছিলাম থাকিফ থেকে দু’জন লোকের-একজন ভণ্ড এবং আরেকজন অত্যাচারী-আবির্ভাব হবে। ভণ্ড জনকে আমরা দেখেছি (আল-মুখতার বিন আবু ওরাইদ); দুষ্ট অত্যাচারী হচ্ছেন আপনি।” আসমা একশ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্তও তাঁর দাঁতগুলি ছিল দৃঢ় এবং জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল বরাবরের মতই অম্লান।]
দুই কোমরবন্ধের আসমা
আসমা বিনতে আবু বকরের কাছে দড়ি না থাকায় তিনি খাদ্য-সামগ্রীগুলি উটের টাই-বীমের সঙ্গে বাঁধতে পারলেন না। তখন তিনি তাঁর কোমরবন্ধ (যে যুগে আরবের মহিলারা কোমরে দল পরতেন) ছিঁড়ে দু’ভাগ করলেন একভাগ তিনি কোমরে লাগালেন এবং আরেক ভাগ দিয়ে খাদ্যসামগ্রীগুলি বাঁধলেন। এরপর থেকে তিনি “দুই কোমরবন্ধের আসমা” নামে পরিচিত ছিলেন।
ইবনে ইসহাকের ভাষ্য অনুসারে আসমা বিনতে আবু বকরকে এ কারণেই “দুই কোমরবন্ধের তিনি” (দাত-উল-নিতাকোয়েন) বলা হয় এবং ইবনে হিশাম বলেন : আমি অনেক পণ্ডিতকে বলতে শুনেছি যে আসমাকে দাত-উল-নিতাকোয়েন”-”দুই কোমরবন্ধের তিনি” বলা হতো এবং এর ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে তিনি টাই-বীমের সঙ্গে জিনিসপত্র বাঁধার জন্য তার কোমরবন্ধকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন; একভাগ দিয়ে জিনিসপত্র বেঁধে ছিলেন এবং অন্যভাগ কোমরে বেঁধে ছিলেন।
মদীনা পর্যন্ত ভ্রমণ
অতিরিক্তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এবং কুরাইশদের নজরে না পড়ার জন্য মহানবী এবং তাঁর সঙ্গী দক্ষিণে ইয়েমেনের পথ ধরেছিলেন। এটি ছিল একটা পরিত্যক্ত পথ। মক্কা থেকে অনেক দূরে গিয়ে তাঁরা পশ্চিম দিকে সমুদ্র-উপকুলের দিকে অগ্রসর হন এবং সমুদ্র-উপকূল ধরে উত্তর দিকে একটা পরিত্যক্ত পথে চলতে থাকেন। এ পথ পর্যটকরা খুব কমই ব্যবহার করতেন। এভাবে চলতে চলতে তাঁরা অবশেষে মদীনার সীমান্তের কুবাতে পৌঁছেন।
পশ্চাদ্ধাবনকারী অশ্বারোহী : সুরাকাহ্ বিন মালিক
ধরা পড়ার ভয়ে এতসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও তাঁরা জানতেন যে তাঁদের অবস্থান বেশীদিন গোপন থাকবে না, কারণ কুরাইশরা মহানবীর জীবনের জন্য অনেক বড় মূল্য নির্ধারণ করেছিল। মহানবী এবং তাঁর সঙ্গী যখন পুনরায় যাত্রা শুরু করেন তখন অনুসন্ধানকারীদের উৎসাহে অনেকটাই ভাটা পড়েছিল। কিন্তু একদিন মক্কায় তার কিছু লোকের সঙ্গে বসে থাকার সময় সুরাকাহ্ বিন[১] মালিক ইবনে জা’শাম একজন লোককে বলতে শুনেছিলেন, “আমি ধৰ্মত : বলছি, আমি তিনজন লোকের একটা দলকে দেখেছি। আমার ধারণা তাঁরা মুহাম্মদ এবং তাঁর দু’জন সঙ্গী।”
[১. সুরাকাহ্ বিন মালিক ইবনে জা’শাম মক্কার পতনের বছর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন কানানাহ্ গোত্রের একজন নেতা। তিনি ২৪ হিজরীতে ওসমানের শাসনামলে মৃত্যুবরণ করেন।]
একথা শুনে সুরাকাহ্ লোকটিকে চুপ করতে বললেন, কারণ তিনি তক্ষুণি বুঝলেন যে লোকটি যাদেরকে দেখেছে তাঁরা প্রকৃত পক্ষেই মহানবী এবং তাঁর সঙ্গী কিন্তু তাঁদেরকে ধরার বড় পুরষ্কারটি তিনি অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চাইলেন না। এজন্য তিনি বললেন, “না, না, ওরা মুহাম্মদ এবং তার সঙ্গীরা নন। এরা অমুক অমুক লোক যারা তদের ছুটা উট খুঁজছে।” কিছুক্ষণ পর লোক জন যখন অন্য আলাপ জুড়ে দিল তখন সুরাকাহ্ বিন মালিক সেখান থেকে চুপচাপ উঠে তার বাড়ীতে চলে গেলেন এবং তার একজন লোককে তার ঘোড়া সাজিয়ে একটা উপত্যকার নির্দিষ্ট একটা জায়গায় সেটিকে তার জন্য বেঁধে আসতে বললেন। এরপর নিজে তৈরী হয়ে বাড়ীর পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে তার ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে লোকটির বর্ণিত স্থানের দিকে রওনা হলেন। কুরাইশদের ঘোষিত বিশাল পুরস্কারের আশায় তিনি নবীজিকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে আনতে চেয়েছিলেন।
ঘাতকের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন
সুরাকার অনুমান ঠিক ছিল। লোকটির বর্ণিত জায়গার কাছেই তিনি নবীজি এবং তাঁর সঙ্গীকে দেখতে পেলেন। তাঁদেরকে দেখে তিনি পুরস্কারের ভাবনায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁদের দিকে দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটালেন। কিন্তু কাছাকাছি যেতেই তার ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। এতে সুরাকার অন্তরে ভয় ঢুকে গেল এবং তিনি বুঝতে পারলেন তিনি কখনোই নবীজিকে কাবু করতে পারবেন না। এই ভেবে তিনি তার সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ফেললেন।
সুরাকার অদ্ভুৎ গল্প বর্ণনার জন্য আমরা তাকেই এখানে উদ্ধৃত করতে চাই। ইবনু ইসহাক বলেছেন যে সুরাকা ঘোড়াটি দু’বার হোঁচট খেয়েছিল এবং তৃতীয় হোঁচটে প্রবল ধাক্কায় তাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। এজন্যই অবশেষে তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিল।
এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে সুরাকাহ্ বলেন : “আমি তাঁর খোজে (নবীজির) ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছিলাম। তাঁদেরকে দেখতেই আমার ঘোড়া হোঁচট খেল এবং আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। ঘোড়াটি সামনের পা দুটি তুলতেই মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত ঘূর্ণিবায়ুর মত ধুলা উড়ে উঠলো। এটা থেকেই আমি বুঝলাম যে তাঁদের কাছ থেকে আমার দূরে থাকা উচিত এবং আল্লাহর নবীর উদ্দেশ্যই সফল হবে। “ আমি তখন তাঁদের দিকে চীৎকার করে বললাম, “আমি সুরাকাহ্ বিন জা’শাম। আপনারা একটু থামুন, আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলবো। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।” একথা শুনে নবীজি আবু বকরকে আমার সঙ্গে কথা বলে আমি কি চাই জানতে বললেন। আবু বকর কথা বললে সুরাকাহ্ বললেন : “আমার জন্য এমন একটা নিরাপত্তার পরওয়ানা লিখে দিন যা আমার এবং আপনাদের মধ্যে একটা চুক্তি হয়ে থাকবে।” আল্লাহ্ নবী আবু বকরকে চুক্তি নামাটি লিখে তাকে দিতে বললেন। সুরাকাহ্ আরো বলেন, “এক টুকরো চামড়ায় নিরাপত্তার চুক্তি নামাটি লিখে আমরা হাতে দেওয়া হলো। আমি সেটা আমার তূণীর ভিতর ঢুকিয়ে মক্কায় ফিরে গেলাম। এ ব্যাপারে আমি কাউকেই কিছু বললাম না।”
নবীজির মদীনায় প্রবেশ
অবশেষে এভাবে মহানবী এবং তাঁর সঙ্গী বিপদের এলাকা পার হলেন। সুরাকার সঙ্গে সাক্ষাতের পর অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলো না – আর কোন অশ্বারোহী তাঁদের পিছু নেয়নি কিংবা কোন শিকারী চোখ তাঁদের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়নি।
দীর্ঘ এগারদিন এই ক্লান্তিকর ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ শেষে তাঁরা মদীনায় পৌঁছলেন। নবীজির আগমনের সংবাদে অপেক্ষমান মুসলিমদের আনন্দের সীমা রইল না।
মদীনার মুসলমানরা আগেই নবীজির হিযরতের সংবাদ পেয়েছিলেন এবং তাঁরা জানতেন যে নবীজি মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেছেন। তাঁর আগমনের সংবাদে মুসলমানরা, বিশেষ করে তাদের মধ্যে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা (যারা আগে কখনো তাঁকে দেখেননি) অধৈর্য্য হয়ে পড়লেন কারণ তাঁকে একনজর দেখার জন্য তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। সেজন্য নবীজিকে একটা উষ্ণ অভিনন্দন জানানোর লক্ষ্যে মদীনার উপকণ্ঠে গিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করা তাদের একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সূর্য্যের তেজ অসহ্য হয়ে তাদেরকে বাড়ী ফিরতে বাধ্য না করা পর্যন্ত তারা সেখানে অপেক্ষা করতেন।
এই উদ্বিগ্ন ও উৎগ্ন ও উৎসাহী মুসলমানগণ- একদিন এক ইহুদিকে (এই ইহুদি লোকটাই সর্বপ্রথম নবীজি এবং তাঁর সঙ্গীকে দেখতে পেয়েছিল) বলতে শুনলেন : “হে কিলার লোকেরা (অর্থাৎ আনসার), ঐ দেখুন আপনাদের মহান নেতা আসছেন।”
মদীনায় ঐতিহাসিক সেই দিন
এই আহবান শুনামাত্রই মদীনার লোকেরা আল্লাহর দূত, মানবজাতির ত্রাণকর্তা মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ্ কে (সঃ) বরণ করার জন্য ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়েছিলেন। মদীনার ইতিহাসে এটি ছিল একটা অভূতপূর্ব স্মরণীয় দিন।
মদীনার উপকণ্ঠে কুবা ছিল প্রথম স্থান যেখানে মহানবী মদীনায় প্রবেশের আগে চারদিন অবস্থান করেছিলেন। ঐ সময় কুবাতে বি. আমর বিন আউফ নামে আনসারদের একটি শাখা স্থাপন করা হয়েছিল।
মদীনার প্রথম মসজিদ
চারদিন অবস্থানকালে মহানবী কুবার বিখ্যাত মসজিদ স্থাপন করেন। এই মসজিদকে কুরআন শরীফে “ভক্তিতে স্থাপিত মসজিদ” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মদীনায় মহানবী
চারদিন কুবায় থেকে মহানবী মদীনা নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। মহানবীর আগমনে এই নগরী ইসলামের রাজধানী ও কেন্দ্র হয়ে উঠে।
ইসলামের নতুন রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে পৌঁছলে ইয়াথ্রিবের গোত্র-প্রধানগণ রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে মহানবী এবং তাঁর সঙ্গীদেরকে আতিথ্য গ্রহণের আহবান জানান কিন্তু মহানবী বিনীতভাবে তাদের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেন। তাঁর উট আস্তে আস্তে উৎসাহী মুসলমানদের ভীড় অতিক্রম করতে থাকে। এ সময় ইহুদি এবং প্রতিমা-পূজারীরা ও তাদের নিজ শহরের নতুন প্রাণ-স্পন্দন দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যে আউস এবং খাযরাজ গোত্রদু’টি এতদিন পরস্পরের বিরূদ্ধাচরণ করতো তারাও একসঙ্গে মহান নেতার চারপাশে এসে ভীড় জমালো। এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে কে ভাবতে পারতো এই নগরীর জন্য কি মহিমা ও চিরন্তন সম্মান বরাদ্দ ছিল!
এভাবে চলতে চলতে মহানবী এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলেন যার মালিক ছিল বনু নাজ্জার গোত্রের দু’জন এতিম বালক। এখানেই তাঁর উট থেমে যায়। নবীজি উটের পিঠ থেকে নেমে পাশে দন্ডায়মান লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, “এই জমিটা কার?” মুয়াদ বিন আফরা বললেন, “এই জমিটা আমরের এতিম পুত্র সুহায়েল এবং সালের।” এতিম বালক দু’টির পক্ষ থেকে মুয়াদ “এই জমিটা মহানবীকে একটা মসজিদের জন্য উপহার দিলেন। মহানবী উপহারটা গ্রহণ করলেন এবং সেখানে একটা মসজিদ এবং তাঁর বাসস্থান নির্মাণের আদেশ দিলেন।[১]
[১. হায়াত মুহাম্মদ, পৃষ্ঠা ২১৮।]