দ্বাদশ পর্ব- কোথাও পাখির শব্দ শুনি
“এবারে কী করবে?”
“কী আর করব? প্রাইভেটে চাকরিবাকরির চেষ্টা করব।”
“আর গোয়েন্দাগিরি?”
“নাহ। অনেক শিক্ষা হয়েছে। আর না।”
“তা বটে। দ্যাখো, মাত্র তিন মাস। সবকিছু কেমন বদলে গেল, তাই না? আমাদের সবার জীবন। আমরা কেউ আর আগের মতো রইলাম না। তুমি না, আমি না, বাবা মা না, অপর্ণা না…”
“অপর্ণার কোনও খোঁজ পাওয়া গেল?”
“না। তবে ও যেরকম মেয়ে, আমি জানি যেখানে আছে, নিজের মতো, নিজের শর্তে বেঁচে আছে। মেয়েকে আর এসবে জড়াতে দেবে না।”
“এইসব আর কোথায়? নীবার তো একরকম শেষই হয়ে গেল।”
“গেল? তুমি শিওর?”
“দ্যাখো, আসল পান্ডা প্রশান্ত মজুমদার মারা গেছে, দেবাশিস গুহ খুন হয়েছে, বিশ্বজিৎ শেষ, অমিতাভও আর নেই। সুকল্যাণবাবু হাতে জিপিএস টাকার ধরিয়ে দিয়েছিলেন প্রথম দিনই। নিশ্চয়ই কিছু সন্দেহ হয়েছিল। পুলিশসময় মতো না এলে হয়তো আমিও…”
“অ্যাই বলেছি না, এসব বলবে না আমার সামনে! বাদ দাও। বলছি, বাসু তাহলে কে? অমিতাভ মুখার্জি, তাই তো?”
“সবাই তাই বলছে। কিন্তু আমার গাটফিলিং আলাদা। মুখার্জি আর বাসু এক লোক না। অবশ্য হতেও পারে। এক দেহ। আলাদা মানুষ। যদি ভূত সবকিছু ভুলিয়ে দিতে পারে, তবে মুখার্জিকেও ভোলাতে পারে যে সেই আসলে বাসু। জেকিল আর হাইড কেস। স্প্লিট পারসোনালিটি। নিজেই জানে না, নিজের শরীর কী করছে। মুখার্জি দেবাশিসকে পাগলের মতো ভালোবাসত আর বাসু ঠিক উলটো। ঘৃণা করত চরমভাবে। অনেকসময় এমন এক্সট্রিম কেস হয়, অনুপমাদি বলছিলেন।”
“অনুপমা, মানে তোমার থেরাপিস্ট? ভালো কথা, তোমার কেসটা নিয়ে কী বললেন?”
“বললেন ট্রমা কাটতে সময় লাগবে। অন্তত বছরখানেক গোয়েন্দাগিরি থেকে দূরে থাকতে। টেনশন-ফ্রি থাকতে। একটা নামও বলেছেন এই রোগের। ডিসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া। এতে রোগীর কোনও ট্রমা হলে সে সেই ট্রমার কারণ যে ঘটনাগুলো সেগুলো ভুলে যায়। আমি যেমন দেবাশিসদার সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কিছু ভুলে গেছি, যাচ্ছি… মজার ব্যাপার, গতকাল আমি অনেক চেষ্টা করেও দেবাশিসদার মুখটাই মনে করতে পারলাম না।”
“সে না পারো গে। আমার মুখটা না ভুললেই হল।”
“ও বাবা! তোমার মুখটা ভুলতে পারি? তুমি তো স্বয়ং রাজকুমারী। মহারানি ভিক্টোরিয়ার বংশধর। আমি ছাপোষা প্রজা, তোমার দাসানুদাস।”
“গুড। সারাজীবন এমন দাস হয়েই থাকবে।”
“সারাজীবন!”
“আজ্ঞে।”
“সারাজীবনের চুক্তিতে দাস হতে গেলে বরং জীবনানন্দ দাশ হয়ে যাব। বেটার।”
“বাজে কথা রাখো। বলছি, এই কেসটার কোনও সমাধান হল না তবে?”
“সব কেসের কি সমাধান হয়? দেবাশিসদার খুনের রাতে ঠিক কী ঘটেছিল কেউ জানে না। জানবেও না। জ্যাক দ্য রিপারের কেসের সমাধান হয়েছে আজ অবধি? তবে আমার চিন্তা একটাই…”
“কী?”
“ভূতের কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। বাসুকে নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু ভূতের স্বভাবই হচ্ছে আর একবার জেগে ওঠা। সে আবার জেগে উঠলে মুশকিল। কোথায় কীভাবে আবার সে মাথাচাড়া দেবে কেউ জানে না।”
“আর তারিণীর ডায়রি? ফর্মুলা?”
“সেসব সুকল্যাণ মিত্র নিয়ে নিয়েছেন। আমার চেয়ে পুলিসের কাস্টডিতে ওসব থাকা নিরাপদ। অবশ্য বাই চান্স যদি ওখান থেকে লিক হয়ে যায় তবে…”
“তোমায় সেসব ভাবতে হবে না। একটা কথা বলব, শুনবে?”
“কী?’
“আমি পত্রিকা অফিসে একটা চাকরি পেয়েছি। যা মাইনে দেয়, তাতে তোমাকেও চালিয়ে নিতে পারব। তোমার আর কষ্ট করে এক্ষুনি চাকরি খুঁজতে হবে না।”
“তাই? তোমার ঘাড়ে বসে খাব? কিন্তু কী দাবিতে?”
“দাবি তুমি বাবার কাছে জানালেই হয়ে গেল। বাবাও তো আগের মতো নেই। অনেক নরম হয়ে গেছেন। এখন আমি বুঝি সেই ছোটোবেলায় টুলবক্সের কম্পাস ভাঙায় কেন মেরেছিলেন। ম্যাসনিক কম্পাস ভাঙার চেয়ে অশুভ কিছু হয় না। সেই অশুভ তো হলই, বলো। যাই হোক, তুমি বাবার সঙ্গে কথা বলবে কি?”
“সে তো বলা যাবে। আগে তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা সেরে রাখি।”
“কী কথা?”
“বাড়িটি থাকবে নদীর কিনারে, চৌকো,
থাকবে শ্যাওলা রাঙানো একটি নৌকো,
ফিরে এসে খুব আলতো ডাকবো, বউ কই….
রাজি?”
-সমাপ্ত-
.