পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ— হিন্দুস্থানের যাত্রী

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ— হিন্দুস্থানের যাত্রী

২৭ নভেম্বর, ১৮৯৫, কলকাতা সাদাম্পটন থেকে এক ঝকঝকে ভোরে ছেড়েছিল ছোট্ট যাত্রীবাহী জাহাজ ‘হিন্দুস্থান’। পথে ভয়ানক ঝড়। জাহাজ প্রায় ডোবেডোবে। স্বয়ং ক্যাপ্টেন অবধি ভয় পেয়ে গেছিলেন। আর তখনই তিনি দেখেছিলেন লোকটাকে। বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা। এই চরম ঝড়ের মধ্যেও ডেকে দাঁড়িয়ে ঝড়ের তাণ্ডব উপভোগ করছে। নেহাত পাগল না হলে কেউ করে না। ক্যাপ্টেন প্রথমে এক খালাসিকে পাঠালেন, লোকটাকে ভিতরে নিয়ে আসতে। সে বেচারা হতোদ্যম হয়ে ফিরে এল। এবার ক্যাপ্টেন নিজে গেলেন। এসব পাগলামোর অর্থ হয় নাকি! লোকটাকে বলতে লোকটা অদ্ভুত ঠান্ডাগলায় উত্তর দিল, “আমি এখানেই থাকব। আমার কিছু হবে না।” লোকটার চোখে, হাবভাবে আর গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে ক্যাপ্টেন ভয় পেয়ে ফিরে এলেন। সত্যিই ধীরে ধীরে ঝড় কমে এল। লোকটাও ঢুকে পড়ল নিজের কেবিনে। যেন এই ঝড় থামাতেই ওকে ডেকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল।

চাঁদপাল ঘাটে জাহাজ ভিড়তেই একদল ফড়ে ঘিরে ধরল সাহেবদের। এদের কাজই খদ্দের পাকড়াও করা। পুঁজি বলতে ভাঙা ভাঙা ইংরাজি। তাতেই তারা নবাগত সাহেবদের জুগিয়ে দিত প্রাথমিক মাথা গোঁজার ঠাঁই, নিয়ে যেত কাছের পাঞ্চ হাউস আর ট্যাভার্নে। লালবাজার আর বউবাজার এলাকায় ডেরা বাঁধত তারা। ফড়েরা ঘরে এনে উপস্থিত করত “বিউটিফুল ইন্ডিয়ান গার্ল”। মাথায় বুদ্ধি না থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই কপর্দকশূন্য হয়ে ভিখারির দশা হত সাহেবদের। কিন্তু এদের মধ্যেই টপ হ্যাট পরা এক সাহেবকে দেখে একেবারে আনকোরা মনে হলেও তার চোখেমুখে অন্যদের মতো বিস্ময় নেই। সে যেন আগে থেকেই জানে, সে কী করতে এসেছে, কোথায় যাবে। দুই-একজন ফড়ে তার কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছিল। লোকটা কাউকে পাত্তা না দিয়ে সোজা হেঁটে চলল স্ট্যান্ড রোডের দিকে, যেন এই পথ কতদিনের চেনা। ঠিক এই সময় এক ফড়ে একটা ভুল করল। উত্তেজনার বশে “ও সাহেব” বলে তাঁর কোর্টের কোনা ধরে দিল টান। সাহেবের হাতের লোহা বাঁধানো লাঠির প্রথম ঘা পড়ল তার পেট বরাবর। সে পেট ধরে নিচু হতেই একের পর এক ঘা। মাথা, পিঠ, থুতনি, কোমরে। লোকটা ব্যথায় শুয়ে পড়ল কাদায়। কেঁদে বলতে লাগল, “রক্কে করো, রক্কে করো সায়েব। আমার ভুল হয়েছে। আর করব না, আর জীবনে এই ভুল করব না।” চারিদিকে ভিড় জমে গেছে। সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। আরও দু-চার ঘা মেরে সাহেবের শাস্তি হল। লোকটার মুখে একদলা থুতু ফেলে “ব্লাডি নেটিভ” বলে সোজা একটা ব্রুহাম গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সাহেব। তারপর, যেন নিজের গাড়ি, এমনভাবে দরজা খুলে ঢুকে বসে পড়ল। মাথার টপ হ্যাটটা রেখে দিল পাশের গদিতে। কোচোয়ান এতক্ষণ সব দেখছিল। সেও কিছু বলার সাহস করল না। খানিক বাদে ভিতর থেকে নির্দেশ এল “গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল।”

“ওহ!! উইলসন সাহেবের হোটেল?” মনে মনে বলে ঘোড়াছুটিয়ে দিল কোচয়ান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *