দোলনকুমার

দোলনকুমার

ঝাঁকড়া বটগাছটার নীচে তাঁবুর সামনে বসেছিলেন শীতলবাবু৷ তাঁবুর ভিতরটা অন্ধকার৷ বাইরেও তেমন কোনো আলো নেই৷ শুধু চাঁদের আলো৷ গ্রামাঞ্চলে রাত আটটা মানে বেশ রাত৷ বিশেষত এই শীতকালে৷ মেলা অনেকক্ষণ ভেঙে গেছে৷ অস্থায়ী দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে৷ সারা দিন অবিশ্রান্ত কথা বলার পর মেলার মাইকগুলোও একদম নিশ্চুপ৷ কোথাও কোনো লোকজন নেই৷ শুধু বেদেদের তাঁবু থেকে অস্পষ্ট হুল্লোড়ের একটা আওয়াজ ভেসে আসছে৷ বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটা হ্যাজাক জ্বলছে তাদের তাঁবুর সামনে৷ বেশ আয় হচ্ছে ওদের৷

শীতলবাবু দূর থেকে দেখেছেন, সারা দিন ধরে লোক ঢুকছে-বেরোচ্ছে তাদের তাঁবুতে৷ ঠিক যেমন শীতলবাবুর তাঁবুতে এক সময় লোক উপচে পড়ত৷

গত কুড়ি বছর ধরে এই হেতেমপুরের মাঘিপূর্ণিমার মেলায় তাঁবু ফেলেন শীতলবাবু৷ শীতল বাজিকরের তাঁবু মেলার মাঠে পড়ছে শুনলেই আশপাশের গ্রামের লোক ছুটে আসত তাঁর জীবন্ত সমাধি বা টানা সাতদিন তাঁবুকে ঘিরে তাঁর সাইকেল চালানো দেখতে৷ শীতলবাবুর তাঁবুই সে সময় ছিল এ মেলার মুখ্য আকর্ষণ৷ মেলার উদ্যোক্তারা সে সময় কত খাতির করত তাঁকে৷ তাঁবু বেঁধে দিত, সমাধির জন্য গর্ত খুঁড়ে দিত, তাঁর সাইকেলের পাশে ছুটতে ছুটতে মুখে খাবার গুঁজে দিত৷ গলায় ঝুলিয়ে দিত পাঁচ-দশ টাকার নোট দিয়ে গাঁথা মালা, রুপোর মডেল৷

সে দিন অবশ্য এখন আর নেই৷ ঘরে ঘরে টেলিভিশন-কেবল চ্যানেল-মোবাইল ফোন৷ মনোরঞ্জনের কত উপকরণ! কিন্তু তা সত্ত্বেও এ সবের মাঝেই টিকে আছেন শীতল বাজিকরের মতো লোকেরা৷ আগের মতো আকর্ষণ তাঁদের খেলায় মানুষ হয়তো আর পায় না৷ তবে যতটুকু পায় তাতে শীতলবাবুদের পেট চলে যায়৷ অন্তত এতদিন শীতলবাবুর তাই যাচ্ছিল৷ কিন্তু আর হয়তো যাবে না…

তাঁবুর বাইরে অন্ধকারে অস্পষ্ট তাঁর সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শীতলবাবু৷ খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে রাখা শীতলবাবুর অনেক মেডেল পাওয়া, দীর্ঘ দিনের সঙ্গী সাইকেলটা হিমে ভিজছে৷

আসলে এই যাযাবরদের তাঁবুটাই শীতলবাবুর কারবারটা একেবারে মাটি করে দিল৷ কোত্থেকে এই বেদেগুলো মেলায় এসে উপস্থিত হল কে জানে৷ স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে জনা পনেরোর একটা দল৷ এদের সঙ্গে কিছু পশুপাখি আছে৷ কুকুর-বাঁদর-বেজি-সাপ-বাজপাখি— এ সব! সকালের দিকটাতে তাদের পুরুষরা এদিক-সেদিক বেরিয়ে পড়ে পাখি ধরার জন্য মাথায় আঠা লাগানো লম্বা কঞ্চি নিয়ে অথবা ছুরি-কাঁচি ধার করার পাথুরে চাকতি নিয়ে৷ আর মেয়েরা যায় জড়ি-বুটি, পাথরের মালা এসব বেচতে৷ কিন্তু বিকেলের অগেই তারা সব তাঁবুতে ফিরে আসে৷ মেলা জমে বিকাল নাগাদ৷ তখন তারা তাঁবুতে পশুপাখিদের নিয়ে খেলা দেখায়, ঢোল-জিপসি বাজিয়ে নাচ দেখায়, তাই দেখতে লোকে ভিড় জমাচ্ছে৷ মনোরঞ্জনের বিকল্প ব্যবস্থা পেয়ে লোকজন আর শীতল বাজিকরের একঘেয়ে সাইকেল চালানো দেখতে রাজি নয়৷

মেলায় আজই শেষ রাত শীতলবাবুর৷ গাছের তলা থেকে তাঁবু গুটিয়ে ফেলতে হবে তাঁকে৷ দুপুরের দিকে মেলাকমিটির লোকজন শীতলবাবুর তাঁবুতে এসেছিল৷ তারা বলল, ‘আপনার তাঁবু তো ফাঁকাই থাকছে৷ তাঁবুটা বরং মেলার অন্য কোথাও সরিয়ে দিন৷ বেদেরা এ জায়গাটা চাচ্ছে৷ ছোটো জায়গাতে ওদের আর কুলোচ্ছে না৷ যা ভিড় হচ্ছে! মেলা কমিটিতে ওরা রোজ পঞ্চাশ টাকা দেবে বলছে৷ কাজেই বুঝতেই পারছেন…৷

এ জায়গাটা যে বেদেদের পছন্দ, তা আগেই আঁচ করছিলেন শীতলবাবু৷ কদিন ধরেই সর্দার বেদেটা মাঝে মাঝেই ঘুরঘুর করছে শীতল বাজিকরের তাঁবুর আশেপাশে৷ নোংরা পোশাক, হাতে পাখি ধরার কাঠি, কোমরে বেশ কয়েকটা লম্বা ছুরি৷ শীতলবাবু শুনেছেন এ লোকটা নাকি ছুরির ফলার খেলা দেখায় তাঁবুতে৷ আজ সকালে তিনি তাকে, ‘এখানে কী চাই?’ জিজ্ঞেস করতেই লোকটা প্রথমে গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খাবার জন্য গাছ থেকে পাখি ধরতে এসেছি;তারপর বলল, ‘এখানে তাঁবু ফেলতে তুমি কত ভাড়া দিচ্ছ কমিটিকে?’

খাবারের জন্য গাছ থেকে পাখি ধরতে আসতেই পারে লোকটা৷ শুধু পাখি কেন, ইদুর-বাদুড়-সাপ-ব্যাং সবই খায় ওরা! কিন্তু তাহলে আবার ভাড়ার ব্যাপারে জিগ্যেস করা কেন? এ প্রশ্নের নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে৷ বেদেদের তাঁবু ফাঁকা মাঠের মধ্যে৷ ছায়া ঘেরা এ জায়গাটা যে লোকটার পছন্দ, তা তার প্রশ্ন শুনে, আর লোলুপ দৃষ্টিতে চারপাশে তাকানো দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন শীতলবাবু৷ তিনি অবশ্য সর্দার বেদেটার প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি৷ ‘এখন এখানে গাছ থেকে পাখিটাখি ধরা হবে না৷ অন্য জায়গায় যাও৷’ কথাগুলো গম্ভীরভাবে বলে হটিয়ে দিয়েছিল লোকটাকে৷ সে আর কথা বাড়ায়নি ঠিকই, কিন্তু শীতলবাবু দেখতে পেয়েছিলেন লোকটা গিয়ে ঢুকল মেলা কমিটির অফিস ঘরে৷

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেলা কমিটির সেক্রেটারি বলাইবাবু তাঁর লোকজন নিয়ে হাজির হলেন তাঁবু সরাবার কথা বলতে৷ অথচ এই বলাইবাবুই তার গলায় কতবার মেডেল ঝুলিয়ে দিয়েছেন৷ মেলার শেষ দিনে প্রতি বছর মেলা কমিটির তরফ থেকে সেরা তাঁবুকে, অর্থাৎ যেখানে ভিড় সবচেয়ে বেশি হয়, তার মালিককে মেডেল দেওয়া হয়৷ কয়েকবার জাদুঘর বা নাগরদোলার তাঁবু মেডেল পেলেও এ যাবৎকাল সবচেয়ে বেশি মেডেল পেয়েছে শীতল বাজিকরের ‘অবিরাম সাইকেল’-এ তাঁবু৷

‘এবার নিশ্চয়ই সবাইকে হটিয়ে বেদেদের তাঁবুটাই মেডেলটা নেবে,’— কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই পিছনে একটা শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালেন তিনি৷ বটগাছের গুঁড়ির গা-ঘেঁষে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক! ছায়াময় একটা অবয়ব!

কে লোকটা? ওখানে এল কীভাবে? বটগাছ আর তাঁবুকে কেন্দ্র করে চারপাশে বৃত্তাকার জায়গা খুঁটি আর বাখারি দিয়ে ঘেরা৷ গাছ আর তাঁবুকে বেড় দিয়ে বাঁশের বেড়ার গা-ঘেঁষে অবিরাম সাইকেলের খেলা দেখান শীতলবাবু৷ বেড়ার বাইরে থাকে দর্শকরা৷ বেড়া টপকে গাছের নীচে লোকটা হাজির হল কীভাবে? লোকটার কোনো বদ মতলব নেই তো? শীতলবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন৷

গাছের নীচ থেকে শীতলবাবুর সামনে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল লোকটা৷ মাঝবয়সি রোগাটে চেহারা৷ গায়ে একটা কালো র‌্যাপার, খালি পা৷ স্থানীয় কোনো লোক বলেই মনে হয়৷ শীতলবাবু তাকে কিছু জিগ্যেস করার আগেই লোকটা তাঁকে বলল, ‘তা হলে খেলাটা আপনি বন্ধ করে দিলেন?’

শীতলবাবু তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আধো অন্ধকারে জরিপ করার চেষ্টা করতে লাগলেন৷

লোকটা মনে হল এবার তার মনের ভাব বুঝতে পেরে তাঁকে আশ্বস্ত করার জন্য প্রথমে বলল, ‘ভয় পাবেন না৷ আমি চোর-ডাকাত নই, এখানেই থাকি৷’

তারপর একটু আপশোশের সুরে বলল, ‘জানেন, কাল বিকালে যখন আপনি অবিরাম সাইকেল থেকে নেমে পড়লেন, তখন দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার৷ কত বছর ধরে আপনার অবিরাম সাইকেল খেলা দেখে এসেছি৷ কী অদ্ভুত খেলা দেখান আপনি! ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সাইকেলে বসে থাকা কী সামান্য ব্যাপার! কত ধৈর্য্য লাগে!

গতকাল সাইকেল থেকে নামার পর থেকে, বিশেষত আজ দুপুরে মেলার কর্মকর্তাদের কথা শোনার পর থেকে মনটা খারাপ শীতলবাবুর৷ এ লোকটার প্রশংসা শুনে দুঃখের মধ্যেও একটু ভালো লাগল তাঁর৷ না এ লোকটাকে ঠিক খারাপ লোক বলে মনে হচ্ছে না৷ তা হলে এখনও এমন লোক আছে যারা আমার খেলা পছন্দ করে৷— এই ভেবে শীতলবাবু একটু বিষণ্ণ হেসে বললেন, ‘কী আর করব? আজকাল এ খেলা আর কেউ দেখতে চায় না৷ লোক হল না বলেই তো সাইকেল থেকে নেমে গেলাম৷ দিনকাল আগের মতো নেই৷’

লোকটা বলল, ‘তা বটে! অথচ এক সময় কী ভিড় হত আপনার খেলায়৷ আপনার বুক ঢেকে যেত টাকায়৷ এত খুচরো পয়সা মাটিতে পড়ত যে ঘেরা জায়গার ভিতর মাটি দেখা যেত না! আমি তো এ সব নিজের চোখে দেখেছি৷’

লোকটা যা বলছে তা সবই সত্যি৷ সে সব দিনের কথা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শীতলবাবু৷

লোকটা এর পর প্রশ্ন করল, ‘মেলার তো আরও চারদিন বাকি৷ এ চারদিন কী খেলা দেখাবেন আপনি?’

শীতলবাবু হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে জবাব দিলেন, ‘আর কিছু নয়৷ কাল সকালেই তাঁবু তুলে ফিরে যাব আমি৷ এ মেলায় আর আসব না৷’

‘কেন?’

লোক হচ্ছে না বলে মেলা কমিটি সরে যেতে বলেছে৷ বেদেরা তাঁবু ফেলবে এখানে৷ আমি দৈনিক কুড়ি টাকা দিই৷ ওরা পঞ্চাশ টাকা দেবে৷’

লোকটা যেন মৃদু চমকে উঠে বলল, ‘আপনি চলে যাবেন? বেদেদের তাঁবু পড়বে৷’

শীতলবাবু বললে, ‘হ্যাঁ, তাই৷ ওদের তাঁবুতে ছুরির খেলা দেখতে খুব ভিড় হচ্ছে৷ ওদের বেশি জায়গা চাই৷ ওদের সর্দারটা আজ এখানে পাখি ধরতে এসেছিল৷ আমি ওকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরই ও মনে হয় আমাকে জব্দ করতেই জায়গাটা চেয়ে বসল৷

লোকটা প্রথমে মন্তব্য করল, ‘হ্যাঁ, লোকটা খুব শয়তান৷’ তারপর বলল, ‘আচ্ছা আপনি মেলার কটাদিন থেকে যেতে পারেন না?’

তিনি বললেন, ‘কীভাবে থাকব? আমার খেলা কেউ দেখছে না৷ কমিটিকে ওদের মতো পঞ্চাশ টাকা দেবার সামর্থ আমার নেই৷’

লোকটা এবার কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘ধরুন, আমি যদি তার ব্যবস্থা করে দিই?’

‘তার মানে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন শীতলবাবু৷

সে বলল, ‘আপনার কত খেলা দেখেছি৷ এ ভাবে আপনি চলে যাবেন, খারাপ লাগছে৷ আমি একটা খেলা জানি৷ যদি আপনার তাঁবুতে খেলাটা দেখতে দেন তবে দেখাতে পারি৷ আমাকে টাকার ভাগ দিতে হবে না৷ দেখবেন কেমন লোক ভেঙে পড়বে তাঁবুতে৷ এ খেলা আগে কেউ দেখেনি৷’

‘কী খেলা?’

লোকটা এবার হেসে বলল, ‘আপনি যেমন ‘‘অবিরাম সাইকেল’’ দেখান তেমনি এ খেলার নাম, ‘‘অবিরাম দোলক’’৷’

‘অবিরাম দোলক?’ এ খেলার নাম শোনেননি শীতলবাবু৷

‘হ্যাঁ, অবিরাম দোলক? তাঁবুর ভিতর দু-পাশে খুঁটি পুঁতে তাদের মাথায় মাটির সমান্তরাল একটা বাঁশ বাঁধা থাকবে৷ সেই বাঁশে পা বেঁধে মাথা নীচের দিকে দিয়ে সারাদিন ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলব আমি৷ শুধু মাঝরাতে একবার খাবার জন্য বেরব৷’

শীতলবাবু অবাক হয়ে গেলেন তার কথা শুনে৷ তিনি বহুদিন এ লাইনে আছেন৷ অনেক বাজিকারের খেলা দেখেছেন, কিন্তু এ খেলা কোথাও দেখেননি৷ এ খেলা যে ভিড় টানবে সন্দেহ নেই৷ বিস্মিত শীতলবাবু বললেন, ‘অদ্ভুত খেলা তো! তা আপনার এ খেলা দেখাবার জন্য অন্য কী শর্ত আছে?’

লোকটা হেসে জবাব দিল, ‘আমার অন্য কোনো শর্ত নেই৷ তবে হ্যাঁ, একটা ব্যাপার বলার আছে৷ এই বেদেগুলোকে আমি একদম পছন্দ করি না৷ কেমন নিষ্ঠুর ভাবে পশুপাখি ধরে ওরা পুড়িয়ে খায়৷ ওদের এই তাঁবুর কাছে ঘেঁষতে দেবেন না৷ কি আপনি রাজি তো?

রাজি না হলে এবার খালি হাতে ফিরে যেতে হবে৷ বাড়িতে অনেকগুলো পেট শীতলবাবুর জন্য প্রতীক্ষা করে আছে৷ হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা ঠিক হবে না৷ শীতলবাবু একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে আমি রাজি৷ তা ভাইয়ের নামটাই তো এখনও জানা হল না? ঘরে কে কে আছেন?’

লোকটা সাদা দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘আজ্ঞে আমাকে আপনি ‘‘দোলনকুমার’’ নামে ডাকবেন৷ আমার স্ত্রী আমাকে এই নামে ডাকে৷ ঘরে শুধু সেই আছে৷’

এ কথা বলার পর সে বলল, ‘তা কথা যখন হয়েই গেল, তখন রাতেই সব ব্যবস্থা করে ফেলা যাক৷ আপনি কমিটির অপিসে সব জানিয়ে দিয়ে আসুন৷ তবে আমার সম্পর্কে খুব বেশি বলার দরকার নেই৷ আমি এখানে থাকলেও ঘর থেকে দিনের বেলা বেশি বেরোই না৷ লোকজন খুব একটা চেনে না আমাকে৷ আপনি শুধু বলবেন, আপনার এক শাকরেদ খেলা দেখাবে৷’

লোকটার সঙ্গে আরও কিছু কথা বলার পর শীতল সর্দার এগোলেন মেলা কমিটির তাঁবুর দিকে৷ সেখানকার লোকদের দৈনিক পঞ্চাশ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেই, আর নতুন খেলার কথা শুনে শেষ পর্যন্ত তারা তাঁবু রাখতে দিতে আর আপত্তি করল না৷ আবার তাঁবুর কাছে ফিরে আসার পর কাজ শুরু হল দুজনে মিলে৷ ঘেরার বাঁশ খুলে তাঁবুর ভিতর দোলনকুমারের কথা মতো ব্যবস্থা হল৷ দোলনকুমার বলল, ‘তাঁবুতে কোনো আলোর দরকার নেই৷ দরজাতে একটা কালো পরদা লাগাতে হবে৷ আলো চোখে পড়লে এ খেলায় অসুবিধা হয়৷ তাঁবুর ফাঁকফোঁকর গলে যেটুকু আলো ঢুকবে সেটুকুই যথেষ্ট৷’

তার কথামতো দরজায় কালো কাপড়ের আচ্ছাদনও টাঙানো হল৷ এ সব কাজ মিটলে অবশেষে শেষ রাতে টাঙানো বাঁশে কাঁচির মতো পায়ের দু-গোড়ালি দিয়ে ঝুলে পড়ল দোলনকুমার৷ তারপর দু-হাত বুকের কাছে আড়াআড়ি ভাঁজ করে অবিকল পেন্ডুলামের মতো দুলতে শুরু করল সে! তাকে দেখে শীতলবাবু অবাক হয়ে গেলেন৷

পরদিন সকাল না হতেই শীতলবাবুর তাঁবুতে মাইক বেজে উঠল— ‘আসুন, আসুন শীতল সর্দারের তাঁবুতে৷ মাত্র দু-টাকার বিনিময় দেখে যান জ্যান্ত দোলকের খেলা! মানুষ দুলছে পেন্ডুলামের মতো৷ অবিশ্বাস্য! অদ্ভুত এক খেলা! যে খেলা কোনো সার্কাসে, কোনো তাঁবুতে দেখেননি আপনি, আসুন…৷’

প্রথমে একজন, তারপর একজন, এভাবে লোক আসতে শুরু করল তাঁবুতে৷ দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় তারা, আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়৷ সত্যি এ দৃশ্য তারা কোনোদিন দেখেনি৷ আধো-অন্ধকার তাঁবুর ভিতর মাটির দিকে মাথা দিয়ে সত্যিই দুলছে একটা মানুষ! না এটা কোনো বুজরুকি নয়, সত্যিই এভাবে দুলছে একটা লোক৷ তাঁবু ফেরতা লোকেদের মুখে মুখে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল খবরটা৷ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই লোকজন দলে দলে আসতে শুরু করল শীতল সর্দারের তাঁবুর দিকে৷ দুপুরের পর তো লম্বা লাইন পড়ে গেল তাঁবুর সামনে৷ বেদেদের তাঁবুতেও লোক যাচ্ছে ঠিকই৷ কিন্তু শীতলবাবুর তাঁবুর তুলনায় কিছুই না৷

ভিড় সামলাতে শীতলবাবুর হিমসিম অবস্থা৷ বাধ্য হয়ে শীতলবাবু টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দিলেন এক সময়৷ অনেকে হতাশ হয়ে ফিরে গেল৷ যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের সঙ্গে দেখা শেষ হতেই সন্ধ্যা নেমে গেল৷ তাঁবুর চারপাশ থেকে সবাইকে হাটিয়ে দিয়ে শীতলবাবু একটা বাতি নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন৷ সারাদিন বার কয়েক শীতলবাবু ভিতরে ঢুকেছিলেন লোকটার কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা জানার জন্য৷ দোলনকুমার সারাদিন কোনো কথা বলেনি৷ শুধু মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই৷ এবার শীতলবাবু তাঁবুতে ঢুকতেই সে বলল, ‘বাইরে অন্ধকার নেমেছে তো? লোকজন সব গেছে তো? তা হলে আমি নামবো৷’

শীতলবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, এবার তুমি নামো৷’ এই বলে তিনি তাকে ধরে নামাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দোলনকুমার নিজেই পা খসিয়ে মাটিতে নেমে আবার উঠে দাঁড়াল শীতলবাবুর সামনে৷ তার মুখে ঝকঝকে হাসি৷ সে বলল, ‘কী আপনার তাঁবুতে ভিড় হয়েছে তো?’

শীতলবাবু বললেন, ‘সত্যি আশ্চর্য তোমার খেলা! অবিশ্বাস্য! ভিড় হয়নি আবার! অন্তত হাজার টাকা আয় হয়েছে৷ একদিনে কোনোদিন এতটাকা আয় হয়নি আমার!’

দোলনকুমার বলল, ‘ভালো৷ আপনার উপকার করতে পেরে, লোককে আনন্দ দিতে পেরে ভালো লাগছে৷ আপনার খেলা দেখেও তো কত লোক আনন্দ পেয়েছে৷ কতবড়ো খেলোয়াড় আপনি৷’

শীতলবাবু এবার ব্যস্তভাবে বললেন, ‘ও সব কথা থাক৷ সারা দিন তোমার ওপর কত ধকল গেছে৷ এভাবে ঝুলে দুলতে থাকা, তা ওপর এক দানা খাবারও পেটে পড়েনি৷ তোমার খাবারের কি বন্দোবস্ত করব বলো? মেলার মাঠের ও পাশে একটা হোটেল কষা মাংস আর রুটি পাওয়া যায়৷ তুমি যদি অন্যকোনো খাবার খেতে চাও, তারও আমি ব্যবস্থা করছি…৷’

দোলনকুমার তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি ব্যস্ত হবেন না৷ ও সব খাবার আমি খাই না৷ আমি বরং বাড়ি যাব৷ তবে আপনার চিন্তার কিছু নেই৷ রাত শেষ হওয়ার আগেই আমি ফিরে এসে ঝুলে পড়ব৷’

শীতলবাবু বললেন, ‘তা হলে কিছু টাকা ঘরের জন্য নিয়ে যাও৷’

দোলনকুমার বলল, ‘আপনাকে তো বলেছি টাকার বখরা চাই না৷’ এই বলে সে দরজার সামনে গিয়ে বাইরেটা একবার দেখল, তারপর শীতলবাবুর উদ্দেশ্যে ‘আসছি’ বলে গায়ে কালো চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বাইরে অন্ধকারে মিশে গেল৷

সারাদিন অনেক ধকল গেছে৷ শীতলবাবু, দোলনকুমার চলে যাওয়ার পর শুকনো কিছু খাবার খেয়ে তাঁবুর ভিতর এক কোণে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ শেষ রাতে দোলনকুমার ফিরে এসে তাঁকে জাগিয়ে দিল৷ তারপর বাইরে আলো ফোটার আাগে আবার গিয়ে ঝুলে পড়ল নির্দিষ্ট জায়গাতে৷

এদিনও একই অবস্থা, বরং ভিড় আরও বাড়ল৷ দূরদূরান্ত থেকে লোক এসে লাইন দিল এই অদ্ভুত খেলা দেখার জন্য৷ এই ভিড় দেখে মেলা কমিটির লোকজনও অবাক৷

বিকালের আগেই টিকিট, মানে কুপন সব শেষ হয়ে গেল৷ শীতলবাবু বাধ্য হয়ে অপেক্ষমান দর্শকদের উদ্দেশ্যে জানিয়ে দিলেন পরদিন দুপুরের আগে তারা খেলা দেখা সুযোগ পাবেন না৷ কুপন আনতে হবে৷

এদিনও লোকজন বিদায় হওয়ার পর অন্ধকার নামলে নীচে নামল দোলনকুমার৷ শীতলবাবুকে বলল, ‘কী, আজও সব ঠিকঠাক হল তো?’

শীতলবাবু বললেন, ‘হল মানে৷ সব টিকিট শেষ! আমি তো অনেক মেলায় যাই৷ তুমি যাবে আমার সঙ্গে? আধা আধা বন্দোবস্ত হবে৷ বছরের কয়েকটা মেলায় গেলেই হাল ফিরে যাবে দুজনের৷’

দোলনকুমার হেসে জবাব দিল, ‘আমি তো টাকার জন্য খেলা দেখাচ্ছি না৷ আপনার সঙ্গে অন্য মেলায় যাওয়াটা মনে হয় হবে না৷ কারণ, আমার স্ত্রীকে ছেড়ে আমি দূরে কোথাও যাই না৷ তাকে নিয়ে তো মেলায় ঘোরা যায় না৷’ এই বলে সে বেরিয়ে গেল তাঁবু ছেড়ে৷

মেলার মাঠ থেকে কিছুদূরে একটা মনোহারি দোকানে ছাপানো টিকিট-কুপন পাওয়া যায়৷ গ্রামের অনেক জায়গাতে এই কুপন দিয়েই সরস্বতী পুজো থেকে বিচিত্রানুষ্ঠানের চাঁদা তোলে আয়োজকরা৷ একটা রিকশা নিয়ে শীতলবাবু কুপন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন বাজারে৷ সেখান থেকে কুপন কিনে মেলার মাঠে ফিরে আসতে তাঁর এক ঘণ্টার বেশি লাগল না৷ রিকশা থেকে নেমে তিনি তাঁর তাঁবুর দিকে কিছুটা এগিয়েছেন, হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন সেই বেদেদের সর্দারটা তার কয়েকজন অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিক থেকে আসছে৷ তাদের সঙ্গে পাখি ধরার বাঁশকাঠি, জাল, খাঁচা ইত্যাদি৷ শীতলবাবুর একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা৷ সর্দার বেদে শীতলবাবুর দিকে তাকিয়ে হলদেটে দাঁত বার করে হাসল৷

‘কেমন জব্দ হয়েছ!’ এই ভেবে শীতলবাবুও তার দিকে তাকিয়ে হাসতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে তাঁর নজর পড়ল সর্দার বেদের হাতে ঝোলানো একটা খাঁচার দিকে৷ তার মধ্যে ছটফট করছে দুটো ঘুঘুপাখি, আর একটা বেশ বড়ো বাদুড়! নিশ্চই ওরা খাবার জন্য ধরেছে এদের৷ কিন্তু কোথা থেকে ধরল? তারা তো শীতলবাবুর তাঁবুর দিক থেকেই আসছে! বটগাছ থেকে ধরেনি তো?’

শীতলবাবু সঙ্গে সঙ্গে সর্দারকে উৎকণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘পাখি ধরলে কেন? কোথা থেকে ধরলে?’ বেশ একটু ঝাঁঝও মেশানো তাঁর কণ্ঠস্বরে৷

সঙ্গে সঙ্গে সর্দার বেদেটা দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘কোথা থেকে ধরেছি জেনে তুমি কী করবে? ধরেছি বেশ করেছি৷ গাছ কি তোমার কেনা?’

শীতলবাবু উত্তেজিত ভাবে সর্দারটার কথায় কিছু উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সর্দার বেদেটা তার কোমর থেকে একটা লম্বা ছোরা বার করে সেটা শীতলবাবুর সমানে নাচাতে নাচাতে বলল, ‘তোমার জন্য অনেক ক্ষতি হচ্ছে আমাদের৷ এবার আর পিছনে লাগলে ছাড়ব না৷’ দানবের মতো দেখতে সর্দার বেদেটার চোখ দুটো জ্বলে উঠল৷ তার সঙ্গীদের মুখের ভাবও হিংস্র৷ শীতলবাবুর জন্যই তো তাদের তাঁবুতে ভিড় কমে গেছে৷

তাদের এই মূর্তি দেখে গুটিয়ে গেলেন শীতলবাবু৷ তিনি মারদাঙ্গা করার লোক নন৷ ছাপোষা মানুষ, পেটের জন্য মেলায় খেলা দেখান৷ বলা যায় না, এরা হয়তো সত্যিই ছুরি বসিয়ে দিতে পারে! শীতলবাবু তাদের আর কিছু না বলায় সর্দারটা তার প্রতি একবার আগুন দৃষ্টি হেনে দলবল নিয়ে নিজের তাঁবুর দিকে চলে গেল৷ শীতলবাবু মনে মনে ভেবে নিলেন মেলা যেদিন শেষ হবে সেদিন ব্যাপারটা নিয়ে নালিশ জানাবেন৷ যাতে পরের বার বেদেরা মেলায় তাঁবু ফেলতে না পারে৷ শীতলবাবু এগোলেন বটগাছ তলায় তাঁবুর দিকে৷

যদিও দুপুর থেকে খেলা দেখানো হবে ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু শীতলবাবু তাঁবুতে ফিরে দেখলেন অন্যদিনের মতো দর্শকরা সকালবেলাই উপস্থিত হয়েছে তাঁবুর কাছে৷ টিকিট হাতে এসে গেছে, কাজেই লোক সমাগম দেখে শীতলবাবু টিকিট বিক্রি শুরু করে দিলেন৷ লোকে দেখতে লাগল তাঁবুর ভিতর পেন্ডুলামের মতো ঝুলছে একটা মানুষ! মাথা নীচে, পা ওপরে!

আগের দু-দিনের মতো এদিনও ব্যাপক ভিড় হল শীতলবাবুর তাঁবুতে৷ এবং যথারীতি খেলা শেষ হতে সন্ধ্যা নেমে গেল৷ দোলনকুমার এদিন নামবার পর শীতলবাবু তাকে বললেন, ‘মেলার তো মাত্র একটা দিন বাকি৷ কাল পারলে তোমার স্ত্রীকে সঙ্গে এনো৷ তুমি তো কিছু নেবে না, তার হাতে আমি কিছু টাকাপয়সা দিতে চাই৷’

দোলনকুমার তার কথায় একবার শুধু হেসে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷

অদ্ভুত লোকতো! টাকাপয়সায় কোনো মোহ নেই৷ এ কথা ভেবে রোজকার মতো খেয়েদেয়ে তাঁবুতে শুয়ে পড়লেন শীতলবাবু৷

শেষ রাতে দোলনকুমারের ডাকে ঘুম ভাঙল তাঁর৷ শীতলবাবু উঠে বসতেই দোলনকুমার বেশ উত্তেজিতভাবে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই বেদেগুলো কাল এই গাছের দিকে এসেছিল নাকি?’

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শীতলবাবুর মনে পড়ে গেল বেদেদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা৷ তিনি আমতা আমতা করে বললেন, ‘এই গাছের দিকে এসেছিল কিনা জানি না৷ কাল সকালে কুপন কিনতে কিছু সময়ের জন্য আমি বাজার গিয়েছিলাম৷ ফেরার সময়ে মাঠের মাঝে ওদের সঙ্গে দেখা হল৷ পাখি ধরে ওরা ফিরছিল৷ আমি প্রতিবাদ করায় সর্দারটা ছুরি দেখিয়ে আমাকে হুমকি দিল৷’

তার কথা শেষ হতে না হতেই দোলনকুমার ব্যাগ্রভাবে জানতে চাইল, ‘কী পাখি? কী পাখি ধরেছিল ওরা?’

‘গোটা দুই ঘুঘু আর একটা বাদুড়৷’ জবাব দিলেন শীতলবাবু৷

তাঁর জবাব শুনে অস্পষ্ট একটা আর্তনাদ করে উঠল দোলনকুমার৷ তারপর দু-হাতে মাথা চেপে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল৷

শীতলবাবু উৎকণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘কী হল তোমার?’

দোলনকুমার শুধু যেন একবার অস্পষ্ট বলল, ‘কী পাষণ্ড আমি! নিজের বাঁচার কথাই শুধু ভাবলাম…৷’

শীতলবাবু তার কথা ধরতে না পেরে বললেন, ‘কী হয়েছে খুলে বলো আমাকে৷ আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না!’

দোলনকুমার কিন্তু তার কথার জবাব দিল না৷ বাইরের আকাশে রং ধরতে শুরু করেছে৷ কিছুক্ষণ পর দোলনকুমার ধীরে ধীরে উঠে আবার নিজের জায়গাতে গিয়ে মাথা নীচু করে দুলতে শুরু করল৷

মেলার শেষ দিন৷ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড় উপচে পড়তে শুরু করল শীতলবাবুর তাঁবুতে৷ জীবন্ত দোলকের খেলা দেখার আজই শেষ সুযোগ৷ তাঁবু ঘিরে লোকজন থিকথিক করতে লাগল বটগাছের তলায়৷ দম ফেলার ফুরসত নেই শীতলবাবুর৷ তবু তারই মাঝে বারকয়েক দোলনকুমারের অবস্থা দেখার জন্য তাঁবুতে ঢুকলেন তিনি৷ দোলনকুমার দুলতে থাকার সময় অন্যদিন কোনো কথা বলে না৷ এদিনও বলল না৷ তবে আজ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন শীতলবাবু৷ অন্যদিন দোলার সময় চোখ বন্ধ করে রাখে দোলনকুমার৷ কিন্তু আজ তার চোখ খোলা৷ চোখ দুটো টকটকে লাল৷ চোয়াল আর মুখভঙ্গি কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠেছে৷ তাঁবুর আলো ছায়াতে যতবারই শীতলবাবু সে মুখ দেখলেন, ততবারই কেমন যেন অস্বস্তি হল তাঁর৷

দিন শেষ হল এক সময়৷ তখনও শীতলবাবুর তাঁবুর বাইরে বটগাছ তলায় প্রচুর লোক৷ কিন্তু অনেক হয়েছে, আর নয়, সকলের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে পরের বছর তাঁবু ফেলার প্রতিশ্রুতি জানিয়ে শো শেষ জানিয়ে দিলেন শীতলবাবু৷ ব্যর্থ মনোরথে ফিরে গেল অনেকেই৷ বাইরে অন্ধকার নামল, মাঠে আলো জ্বলে উঠল৷ লোকজন সব হটে যাওয়ার পর তাঁবুতে ঢুকে লণ্ঠন জ্বালালেন তিনি৷ দোলনকুমার নেমে এল৷ তার মুখে আজ হাসি নেই৷ চোখ দুটো সেই টকটকে লাল, কঠিন চোয়াল৷ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই সে যেন মৃদুমৃদু দুলছে৷ হয়তো দুলুনির রেশ তার কাটেনি৷ শীতলবাবু একটু ইতস্তত করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?’

দোলনকুমার জবাব দিল, ‘আমার শরীর খারাপ নয়, তবে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে!’

‘কী? দুর্ঘটনা?’ ব্যাগ্রভাবে জানতে চাইলেন শীতলবাবু৷

মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে দোলনকুমার বলল, ‘আমার স্ত্রী…৷’ টপটপ করে জল ঝরতে লাগল তার চোখ থেকে৷

শীতলবাবু কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, ‘কী হয়েছে তার?’

দোলনকুমার জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাঁবুর বাইরে কয়েকজন লোকের গলার শব্দ শোনা গেল৷ তার যেন এদিকেই আসছে! দোলনকুমার সে শব্দ পেয়ে কথা থামিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে দাঁড়াল৷

মেলা কমিটির সেক্রেটারি ও কয়েকজন লোক তাঁবুর ভিতর ঢুকল৷ সেক্রেটারি শীতলবাবুকে হেসে বলল, ‘কমিটির বিচারে এবারও রূপোর মেডেলটা আপনার তাঁবুই পেল৷ সেটাই দিতে এসেছি৷ সত্যিই আপনার তাঁবু চমকে দিল সবাইকে৷ কী অসাধারণ খেলা! মেডেলটা নিন৷’— এই বলে তিনি মেডেলটা শীতলবাবুকে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে থামিয়ে শীতলবাবু দোলনকুমারকে দেখিয়ে বললেন, ‘খেলাটা তো ওই দেখিয়েছে, মেডেলটা আপনারা ওকেই দিন৷’

সকলে বলল, ‘সেই ভালো, সেই ভালো৷’ মেলা কমিটি মেডেল পরিয়ে দিল দোলনকুমারের গলায়, এরপর তারা শীতলবাবুর সঙ্গে কিছু কথা বলে তাঁবু থেকে চলে গেল৷

তাঁবুর আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে দোলনকুমার৷ শীতলবাবু আবার তার কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমার স্ত্রী-র কী হয়েছে বলো?’

দোলনকুমার অস্পষ্ট ভাষায় জবাব দিল, ‘সে মারা গেছে৷’ তারপর একই ভাবে বলে উঠল, ‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ…৷’

‘অ্যাঁ, মারা গেছে! কীভাবে?’ চমকে উঠে শীতলবাবু তাকালেন দোলনকুমারের মুখের দিকে৷ দোলনকুমার জবাব দিল না৷ হঠাৎই শীতলবাবুর মনে হল কারও প্রতি প্রচণ্ড আক্রোশে দোলনকুমারের চোখ দুটো যে জ্বলছে৷ গায়ের কালো চাদরটা একবার দু-হাত দিয়ে পিঠের দুপাশে ডানার মতো মেলে ধরল দোলনকুমার, তারপর শীতলবাবুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরের অন্ধকারে হারিয়ে গেল৷ তাঁবুতে বসে হতবাক শীতলবাবু ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন৷

দোলনকুমারের কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন শীতলবাবু৷ হঠাৎ বাইরে একটা গোলযোগের শব্দে ঘুম ভেঙে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি৷ বেশি রাত অবশ্য হয়নি৷ তিনি দেখতে পেলেন কিছু দূরে বেদেদের তাঁবুর কাছটাতে বেশ ভিড়৷ চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছে সে দিক থেকে৷ কয়েকজন ছোটাছুটিও করছে৷ সেদিক থেকে একজন আসছিল৷ লোকটা শীতলবাবুর তাঁবুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শীতলবাবু তাকে ব্যাপারটা জিগ্যেস করায় সে বলল বেদেদের তাঁবুতে ত্রিফলা ছুরির খেলা দেখাতে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছে বেদেদের সর্দার৷ প্রাণে বাঁচলেও তার হাতদুটো বাঁচবে না৷ ছুরির ছুটো ফলা এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলেছে দুটো বাহু৷ তৃতীয় ফলাটা একটুর জন্য মাথা ছোঁয়নি৷ তাহলে তখনই খতম হয়ে যেত লোকটা৷ সর্দারটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷’ কথাটা জানিয়ে লোকটা চলে গেল৷

ত্রিফলা ছুরির খেলা অন্যত্র দেখেছেন শীতলবাবু৷ ক্ষিপ্রতা আর মনোসংযোগের খেলা৷ লাঠির মাথার ওপর আলগা ভাবে বসানো থাকে তিনটে বড়ো ছুরির ফলা৷ লাঠিটা মাথার ওপর বা চিবুকে বসিয়ে হঠাৎই লাঠি সরিয়ে নেন খেলোয়াড়৷ তারপর ক্ষিপ্রগতিতে শুয়ে পড়েন মাটিতে৷ ঝমাঝম শব্দে একসঙ্গে বাঁধা তিনটে ফলা ওপর থেকে নেমে এসে খেলোয়াড়ের দেহকে স্পর্শ না করে গেঁথে যায় মাথা আর হাতের দুপাশের মাটিতে৷ সময়ের সামান্য ভুলচুকে এ খেলায় মৃত্যু অবধারিত৷ কিন্তু সচরাচর তা ঘটেনা৷ যারা এ খেলা দেখায় তারা সবাই ওস্তাদ খেলোয়াড় হয়৷ কী ভাবে ব্যাপারটা ঘটল তা জানার ইচ্ছা থাকলেও ক্লান্ত শরীরে তিনি আর বেদেদের তাঁবুর দিকে গেলেন না৷ তা ছাড়া দোলনকুমার হয়তো আবার দেখা করতে আসতে পারে৷ তাই তাঁবুতে গিয়ে বসলেন তিনি৷ সারা রাত কেটে গেল কিন্তু দোলনকুমার আর এল না৷

সকালে উঠে তাঁবু গুটিয়ে ফেললেন শীতলবাবু৷ মেলা ভেঙে গেছে, সবাই এবার তল্পি-তল্পা গুটিয়ে ঘরে ফিরতে চলেছে৷ শীতলবাবুও যাবেন৷ একটা ভাড়া গাড়ি আসবে লটবহর সমেত নিয়ে যেতে তারই প্রতীক্ষায় বটগাছের নীচে বাঁধানো চাতালে বসে ছিলেন শীতলবাবু৷ শীতের সুন্দর সকাল৷ চারপাশে মেলার মাঠে ঝলমল করছে রোদ, বট গাছের মাথায় পাখি ডাকছে৷ মৃদু বাতাসে গাছের পাতা কাঁপছে৷ অনেক পয়সা একবার মেলা থেকে নিয়ে ফিরছেন তিনি, কিন্তু তবুও সুন্দর সকালে শীতলবাবুর মন একটু বিষণ্ণ৷ দোলনকুমারের সঙ্গে আর দেখা হল না তাঁর৷

গাছতলায় বসে দোলনকুমারের কথা ভাবছিলেন তিনি, এমন সময় তাঁর চেখে পড়ল সমানে দিয়ে মেলা কমিটির সেক্রেটারি যাচ্ছে৷ শীতলবাবুকে দেখতে পেয়ে সে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাচ্ছেন তাহলে? সামনের বছর আবার আসবেন কিন্তু৷ আমি যাচ্ছি হাসপাতালে এই সর্দার বেদেটার খোঁজ নিতে৷ দুর্ঘটনাটা মেলায় ঘটেছে বলে একটা দায়িত্ব থেকে যাচ্ছে৷ কালকের ঘটনাটা শুনেছেন নিশ্চয়ই?’

শীতলবাবু বললেন, ‘শুনেছি৷ তা ব্যাপারটা ঘটল কী ভাবে?’

সে বলল, ‘কাল আপনার খেলা বন্ধ হওয়ার পর কিছু লোক জুটে ছিল বেদেদের তাঁবুতে৷ ওদের তাঁবুতে একটা ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছিল৷ তাঁবুর মাঝে খেলা দেখাচ্ছিল৷ তাঁবুর মাঝে খেলা দেখাচ্ছিল সর্দারটা৷ আর কিছুটা তফাতে তাকে ঘিরে খেলা দেখছিল লোকজন৷ জানেন তো, এ খেলায় সূক্ষ্ম সময়ের হিসাবই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে৷ বেদেটা যখন ত্রি-ফলার নীচ থেকে লাঠিটা সরিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়তে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় কোথা থেকে যেন তাঁবুতে একটা বাদুড় ঢুকে তার ডানা দিয়ে ঢেকে দিল আলোটা৷ কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার হয়তো, কিন্তু তাতেই যা ঘটার ঘটে গেল৷ সময়ের গরমিলে দুটো ফলা মাটির সঙ্গে গেঁথে ফেলল সর্দার বেদেটার দু-হাত৷’

এর পর যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বটগাছটার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘এ গাছে দুটো বড়ো বাদুড় থাকে, কে জানে তারাই কাণ্ডটা ঘটল কিনা!’

লোকটা এগোতেই শীতলবাবু তাকালেন গাছের ওপর দিকে৷ একটু ভালো করে তাকাতেই বেশ উঁচুতে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলেন তিনি৷ একটা বিরাট বড়ো বাদুড় ঝুলছে গাছে৷ আর তার গা থেকে ঝুলছে লাল ফিতে বাঁধা একটা চাকতি৷ পাতার ফাঁক দিয়ে পড়া আলোতে সেটা ঝলমল করছে৷ কী ওটা?

শীতলবাবু তার দিকে তাকাতেই প্রাণীটা বেশ কয়েকবার পেন্ডুলামের মতো দুলে উঠল৷ চাকতিটা ওপর থেকে খসে পড়ল শীতলবাবুর কোলে৷ সেটা দোলনকুমারের গলায় পরিয়ে দেওয়া মেলা কমিটির সেই রূপোর মেডেল!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *