দৈবাস্ত্ৰ

দৈবাস্ত্ৰ

প্রাককথন

মগধ রাজ্যের ছোট্ট একটি নামহীন গ্রাম। সূর্যাস্ত হতে বেশি দেরি নেই। একটি বটগাছের ছায়ায় শুয়ে আছেন বিষ্ণুগুপ্ত। একদল ছেলে খেলা করছে সামনের খোলা প্রান্তরে। সেদিকে তাকিয়ে আছেন বটে বিষ্ণুগুপ্ত, কিন্তু সেদিকে তাঁর মনোযোগ নেই। তিনি দীর্ঘ পথযাত্রায় ক্লান্ত, মন তার চেয়েও বেশি বিষণ্ণ।

নিজের অপমানের প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে তিনি ভুল করে ফেলেছেন। তাঁর মন অস্থির। শ্বাস—প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে যোগ দ্বারা মন শান্ত করার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন বিষ্ণুগুপ্ত। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছেন গাছের ছায়ায়।

‘যার ওপর নির্ভর করে আছে গোটা দেশের ভবিষ্যৎ, সেই মানুষটাকে বেছে নিতে যদি আমার ভুল হয়, তবে ইতিহাস আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না!” নিজের মনেই কথাগুলো ভাবলেন বিষ্ণুগুপ্ত। তাঁর অবস্থা এই মুহূর্তে এমন এক যোদ্ধার মতো, যে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু কিছুতেই যথাযথ অস্ত্রটা খুঁজে পাচ্ছে না। রাস্তায় প্রচুর তরবারি পড়ে আছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে কয়েক বার অভ্যাস করতে গিয়েই বুঝতে পারছে যে, এই তরবারিগুলো তার জন্যে নয়। এগুলো হয় ভঙ্গুর বা, ধার কম বা, অত্যধিক ভারী বা, অত্যন্ত হালকা। সঠিক অসিটি যোদ্ধা খুঁজে পাচ্ছে না বহু সন্ধান করেও।

নিজের মনেই বিড়বিড় করে বিষ্ণুগুপ্ত বললেন,

—হে ঈশ্বর! ইঙ্গিত দাও। কোথায় খুঁজে পাব আমি তাকে? যে হবে ভবিষ্যতের সম্রাট! যার অধীনে এক হবে গোটা আর্যাবর্ত! কোথায় খুঁজে পাব আমি আমার রাজগুণ সম্পন্ন ভাবী সম্রাটকে?

—মহারাজের জয় হোক।

—নিবেদন করো, সৈনিক।

—মহারাজ, এই যে, চোরকে ধরে এনেছি।

একদল ছেলে ‘রাজা—রাজা’ খেলছে। তাদের চিৎকারে চিন্তাসূত্রে বাধা পড়ায় কিছুটা বিরক্ত হলেন বিষ্ণুগুপ্ত। নিতান্ত নিরুৎসাহীভাবে তাদের দিকে আবার মুখ ফেরালেন তিনি। নয় থেকে বারো বছর বয়সি একদল বালক। প্রত্যেকের একপায়ে শেকল পরানোর বেড়ি রয়েছে দেখে বিষ্ণুগুপ্তর বুঝতে অসুবিধা হল না যে, এরা সকলেই দাস। সম্ভবত, অভাবের তাড়নায় এদের মাতা—পিতাই এদের বিক্রি করে দিয়েছে। অপশাসনের নোংরা পাঁকে আকণ্ঠ ডুবে থাকা এই মগধ রাজ্যে সবই সম্ভব।

পাঁচ—ছয়টা ছেলে মাটিতে বসে আছে। দু—জন সৈনিক সেজেছে, তাদের হাতে লাঠি। তাদের মধ্যে আর একজন একটি ছেলেকে ধরে রয়েছে। সে—ই চোর। এই বালকটির মুখ দেখেই অনুমান করা যায় যে, খেলায় চোর সাজার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার ছিল না। সম্ভবত, আগের কোনো খেলায় সে পরাজিত হয়েছে বলে তাকে এইবার চোরের ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। একটি ছেলে একটু উঁচু পাথরের ওপর বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে। ছেলেটার মাথায় পাতা দিয়ে গাঁথা যে জিনিসটা দেখা যাচ্ছে, এই খেলায় সম্ভবত সেটা রাজমুকুট। বালকটির বসার ভঙ্গি বেশ রাজকীয় বটে।

প্রতিটা বালকের স্বাস্থ্য দুর্বল। তাদের প্রভু সম্ভবত তাদের উদরপূর্তির জন্যে বেশি অন্ন ব্যয় করেন না।

—নিয়ে এসো চোরকে আমার সামনে।

দু—জন টেনে নিয়ে গেল চোরকে মহারাজের সামনে। পাথরের ওপর বসা বালকটি বলল,

—তুমি রুটি চুরি করেছ?

—হ্যাঁ, মহারাজ।

—কেন করেছ চুরি?

—আমার খিদে পেয়েছিল, তাই। ,

—বেশ। তোমার সাজা পাঁচ ঘা লাঠি। আর, আমার নিজের পাঁচ ঘা।

একজন সভাসদ বেশ অবাক হয়ে বলে উঠল,

—চোরকে লাঠিপেটা করা হবে। রাজাকে কেন একই সাজা দেওয়া হবে?

—কারণ, যে দেশের মানুষকে সামান্য একটি রুটিও চুরি করে খেতে হয়, সেই দেশের রাজা একটি অপদার্থ! রাজ্যের মানুষের পেটে ক্ষুধা থাকলে, তার দায় রাজা এড়াতে পারে না! তাই আমিও চোরের সমান দোষী।

.

কান খাড়া হয়ে গিয়েছে বিষ্ণুগুপ্তর। তিনি উঠে বসেছেন। তাঁর ললাটে তীব্র ভ্রূকুটি। উঠে দাঁড়িয়ে এক পা, এক পা করে তিনি এগোলেন বালকদের দলটার দিকে। তাঁকে আসতে দেখে কয়েক জন দ্রুত সরে পড়ল। কয়েক জন দাঁড়িয়ে থাকলেও, কয়েক পা পিছিয়ে গেল। শুধু মাথায় পাতার মুকুট আর পাথরের সিংহাসনে বসে থাকা রাজাটি নিশ্চল কিন্তু সতর্কভাবে বসে রইল।

বিষ্ণুগুপ্ত কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

—তুমি রাজা? মাথায় ওটা কী? মুকুট?

—হ্যাঁ।

—কিন্তু, রাজার পায়ে দাসের বেড়ি কেন? কে বিক্রি করেছে তোমায়? পিতা—মাতা?

—না, আমি নিজেই নিজেকে বিক্রি করেছি।

বিস্মিত হয়ে বিষ্ণুগুপ্ত প্রশ্ন করলেন,

—সেকী! কেন?

—রাজা ধনানন্দর সেনা আমার গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি তখন গ্রামে ছিলাম না। ফিরে এসে শুনলাম গ্রামের লোকজনের অনেককে বন্দি করেছে। তাই রাজার কাছে গেলাম পিতা—মাতার খোঁজ করতে।

—হুম। তারপর?

—রাজার এক সৈনিক বলল, বাবা—মায়ের খোঁজ দেবে, যদি একটি কার্ষাপণ* তাকে দিই। আমার কাছে তো সেটা ছিল না। তাই বাজারে এসে এক প্রভুর কাছে আমি নিজেকে বিক্রি করে দিই এক কার্ষাপণে।

যতই শুনছেন ততই বিস্মিত হয়ে যাচ্ছেন বিষ্ণুগুপ্ত। জানতে চাইলেন,

—তারপর? সৈনিক তোমার মাতা—পিতার খোঁজ দিল?

মাথা নীচু করল বালক। বলল,

—মুদ্রা নিয়ে সৈনিক জানাল যে, আমার পিতা—মাতা মৃত। গ্রামের সবাইকেই হত্যা করেছে সৈনিকরা।

চোখের জল লুকোতে চোখ তুলল না বালক। বিষ্ণুগুপ্ত লক্ষ করছিলেন বালককে। আয়ু নয় অথবা দশের অধিক নয়। পরনে নোংরা একটুকরো কাপড়। বিষ্ণুগুপ্ত প্রশ্ন করলেন,

—তোমার বংশ কী?

—আমি ক্ষত্রিয়।

বিষ্ণুগুপ্ত আরও কিছু প্রশ্ন করতেই যাচ্ছিলেন এমন সময় হঠাৎই কেউ চেঁচিয়ে উঠল,

—এই যে অলসের দল! বিকেলের কাজগুলো কে করবে? শিগগির এইদিকে আয় তোরা। নাহলে চাবকে পিঠের…

লোকটি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণকে দেখে কথা মাঝপথে থামিয়ে দিল। তারপর বলল,

—প্রণাম, ব্রাহ্মণদেব।

বিষ্ণুগুপ্ত প্রশ্ন করলেন,

—এরা সবাই তোমার দাস?

—আজ্ঞে, হ্যাঁ।

বিষ্ণুগুপ্ত রাজা সেজে থাকা ছেলেটির দিকে তর্জনীর ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করলেন, —হুম। তোমার থেকে যদি আমি এই বালকটিকে ক্রয় করতে চাই, তবে কত দাম লাগবে?

লোকটি একবার ব্রাহ্মণের দিকে আর একবার তার দাস বালকটির দিকে তাকাল। ছেলেটা দুর্বল, শরীরে বল কম। তাকে সস্তায় ছেড়ে দিতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু ভাবল, সুযোগ যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন একটু বেশি দাম চেয়ে দেখা যেতেই পারে। যদিও এই কুরূপ ব্রাহ্মণের কাছে বেশি অর্থ থাকার কথা নয়।

—আজ্ঞে, এই দাসটি বড়োই কর্মঠ। তাই এক কাহাপণের** কমে তো…. কথা শেষ করার আগেই ব্রাহ্মণ তাঁর কাপড়ের ছোটো থলে থেকে দুটি স্বর্ণমুদ্রা বের করে ছুড়ে দিলেন দাসের প্রভুর দিকে। বললেন,

—একটি মুদ্রা দাম। আর, দ্বিতীয়টা ওর পায়ের লোহার বেড়ি কাটার জন্যে দিলাম। সেইসঙ্গে কিছু খাদ্যের দাম দিলাম। আজ থেকে এই বালকটি আমার হল।

দুটি স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে চোখ চকচক করে উঠল লোকটির। মনে মনে আফশোস করল যে, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে। আগে জানলে আরও বেশি দাম চাওয়া যেত। যাকগে, দুটি স্বর্ণমুদ্রা কম নয়।

মনে মনে হাসলেন বিষ্ণুগুপ্ত। দুটি কেন, দুশোটি স্বর্ণমুদ্রা দিতে হলেও তাঁর কোনো সমস্যা নেই। কারণ, সবক—টি স্বর্ণমুদ্রাই নকল! এক বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা নকল মুদ্রা যার সঙ্গে আসল স্বর্ণমুদ্রার পার্থক্য করা অসম্ভব। এমনকী এর ওজনও স্বর্ণের সমান। ***

চন্দ্রগুপ্ত হঠাৎ বলে উঠল,

—না!

বিষ্ণুগুপ্ত কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

—না? তুমি কি মুক্তি পেতে চাও না, বালক?

—চাই ব্রাহ্মণদেব, কিন্তু আমার মিত্রদের বন্দিদশায় ফেলে আমি একা কীভাবে মুক্তি পাই? আপনি যদি তাদেরও মুক্তি দেন, তবে আমি কথা দিচ্ছি, আমি তাদের সবার মুক্তির মূল্য আপনার দাসত্ব করে শোধ দেব।

বিষ্ণুগুপ্তর চোখে বিস্ময় ফুটল, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল একমুহূর্তের জন্যে। নাহ্, এইবার তাঁর নির্বাচন ভুল হয়নি।

এই বুঝি দুটি স্বর্ণমুদ্রা হাতছাড়া হয়ে যায়, সেই আশঙ্কায় রেগে গিয়ে ছেলেটিকে আঘাত করতে হাত ওঠাচ্ছিল তার মনিব লোকটি। তাকে কড়া গলায় নিষেধ করলেন ব্রাহ্মণ। একমুঠো স্বর্ণমুদ্রা বের করে তা সামনে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির হাতে দিলেন বিষ্ণুগুপ্ত।

—এই নাও। মুক্তি দাও সবাইকে।

যদিও মনে মনে বিষ্ণুগুপ্ত জানেন যে, সবাইকে মুক্তি দিয়েও লাভ নেই। এই বালকরা বাড়ি ফিরে গেলে আবারও এদের বিক্রি করা হবে। আর, বাড়ি না ফিরলে অনাথ ছেলেদের কেউ—না—কেউ আবারও ধরে দাস বানাবে। মুখে সেকথা বলে এই সরল বালকটির মন ভাঙলেন না তিনি।

বিষ্ণুগুপ্ত এইবার এগিয়ে গিয়ে বালকটির মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, ——আমি চণক পুত্র, বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। সুদূর গান্ধার দেশে অবস্থিত তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। আজ থেকে তুমি আমার শিষ্য হলে। তোমার নাম কী? বালক বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিল ব্রাহ্মণের দিকে। উত্তর দিল,

চন্দ্রগুপ্ত। আমার পিতার নাম সরবর্থসিদ্ধি এবং আমার মায়ের নাম মুরা। আমি মুরাপুত্র চন্দ্রগুপ্ত।

  • কার্যাপণ — রৌপ্যমুদ্রা।

** কাহাপণ — স্বর্ণমুদ্রা।

*** এই কাহিনি বিস্তারিত পাবেন ‘হত্যা—শাস্ত্ৰ’ বইয়ে।

১.

কয়েক বছর পরের কথা। স্থান—— তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট ও আচার্য চাণক্য পাশাপাশি ধীর পদক্ষেপে হাঁটছেন খোলা প্রাঙ্গণে। তাঁরা নিজেদের মধ্যে নীচুস্বরে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। পাশ দিয়ে কোনো ছাত্র যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে সমীহর সঙ্গে নতমস্তকে নিঃশব্দ প্রণাম জানিয়ে যাচ্ছে। গভীর আলোচনার মধ্যেই কিন্তু তাঁরা দু—জন প্রতিটি ছাত্রর অভিবাদনের প্রতি—উত্তর সামান্য মাথা নাড়িয়ে দিচ্ছেন। এটাই শিক্ষকদের আচার। প্রতিটি মানুষকে, ছোটো—বড়ো নির্বিশেষে সম্মান জানানো। প্রধানাচার্য বলেন যে, ছাত্ররা যতটা না শিক্ষকের থেকে শেখে, তার চেয়ে অধিক তারা শিক্ষককে দেখে শেখে। অতএব, যদি কোনো আচার্য তাঁর ছাত্রকে কোনো নিয়ম অনুরূপ চালনা করতে চায়, তবে সর্বপ্রথম সেই নিয়ম শিক্ষককে নিজেকে মেনে চলতে হবে।

প্রধানাচার্য নিজেই একসময় চাণক্যর গুরু ছিলেন। অতএব, তাঁরা সুযোগ পেলেই দেশ, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন। আজও তাই হচ্ছিল।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন তাঁরা যুদ্ধকলা বিভাগের সামনে চলে এসেছেন। সময়টা বিকেল। এই সময়ে সাধারণত যুদ্ধকলা বিভাগ বন্ধ থাকে। কারণ, এই বিদ্যা সাধারণত শুধু রাজকুমারদের জন্যে ধার্য হয়। তারা সকালে যুদ্ধকলা, অশ্বারোহণ অভ্যাস করে। কিন্তু, এখন প্রধানাচার্যর অনুমতিতে আলাদাভাবে ছয় ছাত্রকে এই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এরা ছয়জনই চাণক্যর আশ্রমের ছাত্র, তাঁরই শিষ্য। তাদের এই অতিরিক্ত শিক্ষার অনুরোধ চাণক্যই করেছিলেন কয়েক মাস পূর্বে

এই বিদ্যালয়ে অস্ত্র—শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা শিক্ষক যিনি, সেই আর্যসেন এখন ছয়জনকে অসিচালনা শেখাচ্ছেন। ইনি পূর্বে ছিলেন বৈশালীর সেনাপতি। প্রায় কিংবদন্তি পর্যায়ের মহাযোদ্ধা। যে কারণে মগধও বৈশালীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে ভয় পেত। সেই আর্যসেন এখন এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর কাছে অস্ত্রচালনা শিখতে রাজকুমাররা অত্যধিক অনুদান দিতেও প্রস্তুত থাকে। এবং, আর্যসেন রাজকুমার ব্যতীত কাউকে শিক্ষা প্রদান করেন না সাধারণত। কিন্তু, এই মুহূর্তে তাঁর ছয় ছাত্রদের মধ্যে কেউই রাজপুত্র নয়।

চাণক্য ও প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট আলোচনা থামিয়ে তাদের অভ্যাস দেখলেন কয়েক মুহূর্ত। ছাত্র বা আচার্য এতটাই মগ্ন কেউই তাঁদের উপস্থিতি টের পায়নি। প্রধানাচার্য হেসে বললেন,

—বিষ্ণু, দেখেছ আর্যসেনকে? কী উৎসাহ নিয়ে অসিচালনা শেখাচ্ছে তোমার ছাত্রদের?

—হুমম।

—বর্তমানে তাকে এরূপ দেখে কে অনুমান করতে পারবে যে, কয়েক মাস পূর্বেই তার প্রবল আপত্তি ছিল রাজকুমার ব্যতীত এই ছয়জনকে শিক্ষাদান করা নিয়ে। এ অসম্ভব কীভাবে সম্ভব করলে, বিষ্ণু?

চাণক্য মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন তাঁর শিষ্যদের। তাদের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলেন,

—বিশ্বের বেশিরভাগ “অসম্ভব” কাজই আসলে সম্ভব। শুধুমাত্র কার্যটা সম্পন্ন করাটা এতটাই কঠিন হয়ে থাকে যে, কারণে কার্যটাকে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলে ভ্রম হয়।

আবারও হেসে প্রধানাচার্য প্রশ্ন করলেন,

—সেই কঠিন কাজটাই—বা করলে কীভাবে?

—আমি করিনি। আমার শিষ্যরা করেছে। আমি শুধু ওদের উপায় বলেছিলাম মাত্র। বাকিটা ওদের অধ্যবসায় দ্বারা সম্ভব হয়েছে। আর্যসেন আমার শিষ্যদের শিক্ষাদানের প্রস্তাবে আপত্তি করায় আমি তাকে বলেছিলাম যে, সে যেন মাত্র একমাস সময় দেয় আমার ছাত্রদের। এই একমাসে যদি তারা আর্যসেনের আশানুরূপ ফল করতে না পারে, তবে যেন তাদের বহিষ্কার করা হয়। এও বলেছিলাম যে, আমার ছাত্ররা যেকোনো উচ্চকুলের রাজকুমারদের চেয়ে উন্নতি করবে এই অল্প সময়ে। আমার ছয় শিষ্যই তাই করতে সক্ষম হয়েছে।

প্রধানাচার্য বললেন,

—হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মাত্র কয়েক মাসেই এই কিশোররা কুশল যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। ছাত্রদের উন্নতি দেখে শিক্ষক হিসেবে আর্যসেনও প্রবল উৎসাহী হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু, তোমার ছাত্ররা কীভাবে এত কুশল হল এত কম সময়ে?

—অভ্যাস! অভ্যাস—এর কোনো বিকল্প নেই, তা তো আপনার থেকেই শিখেছি, গুরুদেব। গত কয়েক মাস ধরে, সূর্যোদয়ের পূর্বে আমি আমার শিষ্যদের অভ্যাস করিয়েছি প্রতিদিন। যে অস্ত্রচালনা আর্যসেন তাদের শেখাত, পরের দিন প্রভাতে আমি সেটাই তাদের অভ্যাস করতে বলতাম। শুধু সেইসময়ে তাদের শরীরে আমি বেঁধে দিতাম কিছু ভারী পাথর।

বিস্মিত হয়ে প্রধানাচার্য চাণক্যর দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন,

— পাথর বেঁধে দিতে? সেকী?

—হুমম। শরীরে ওজন নিয়ে অস্ত্রচালনা প্রায় দশ গুণ বেশি কঠিন হয়ে যায়। প্রতিদিন এই ছয়জন এই প্রতিকূলতা নিয়ে অভ্যাস করেছে। যার ফলে পরের দিন আর্যসেনের কাছে, বিনা ওজনে অস্ত্রশিক্ষা তাদের কাছে প্রভাতের অভ্যাসের চেয়ে অনেক সহজ মনে হয়েছে। এই কঠিন অভ্যাসের ফলে খুব দ্রুত তারা সবাই উন্নতি করেছে।

ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে চাণক্যর দিকে তাকিয়ে প্রধানাচার্য জিজ্ঞেস করলেন,

—আর চন্দ্রগুপ্ত?

চাণক্য এই প্রশ্নের ইঙ্গিত বুঝতে পেরেই উত্তর দিল,

—দৈহিক বল ও আয়ুর দিক থেকে চন্দ্রগুপ্ত অন্যদের চেয়ে সবচেয়ে ছোটো হলেও, সে সবার চেয়ে বেশি জেদি। এই কার্য সর্বাপেক্ষা কঠিন ছিল তার পক্ষে। কিন্তু, দেখতেই পাচ্ছেন, সে উত্তমভাবে কৃতকার্য হয়েছে।

প্রধানাচার্য কিছুক্ষণ কিছুই বললেন না। শুধু ছয় কিশোরের তরবারি চালানো দক্ষতা দেখলেন দাঁড়িয়ে। খুব লঘু কণ্ঠে বললেন,

—মগধের ভবিষ্যৎ সম্রাট হিসেবে তুমি এই ছয়জনের মধ্যে কাকে নির্বাচন করেছ তা আমি অনুমান করতে পারি। কিন্তু বিষ্ণুগুপ্ত, বাকি পাঁচজনও সমান দক্ষ ও সম্রাট হওয়ার দাবিদার। ভবিষ্যতে কে সম্রাট হবে, তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?

কয়েক মুহূর্ত কোনো উত্তর দিলেন না চাণক্য। তারপর বললেন,

—রাজা সে—ই হবে যার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সব গুণের চেয়েও একজন রাজার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ হল নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। আমার নির্বাচন যদি ঠিক হয়ে থাকে, তবে আমাকে কিছু করতে হবে না, আমার শিষ্যরাই নিজেদের মধ্যে থেকে সেই নেতাকে বেছে নেবে। যার মধ্যে সহজাত নেতা হওয়ার গুণ আছে, সে—ই হবে আগামীর সম্রাট।

—কিন্তু কীভাবে, বিষ্ণুগুপ্ত? কীভাবে এই প্রায় সমবয়সি কিশোররা নির্বাচন করবে তাদের নেতাকে?

অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চাণক্য উত্তর দিলেন,

—আমার একটি পরিকল্পনা আছে।

২.

—গুরুদেব! আজ আমরা সবাই সফলভাবে সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার শিখে উঠতে পেরেছি।

চাণক্যর সামনে মাটিতে হাঁটুর ওপর ভর করে বসে নতমস্তকে প্রণাম করল তাঁর ছয় শিষ্য। এই ছয়জনকে চাণক্য নিজে বেছে নিয়েছেন তাঁর শিষ্য হিসেবে। আসন্ন ভবিষ্যতে মগধের রাজসিংহাসন থেকে অপদার্থ সম্রাট ধনানন্দকে উৎখাত করে, মগধের অধীনে গোটা আর্যাবর্তকে এক করার স্বপ্ন আচার্য চাণক্য দেখেছিলেন কয়েক বছর পূর্বে। চাণক্য জানেন যে, ভারতকে এক করার চেয়েও কঠিন কাজ হবে তাকে শাসন করা। কারণ, যে দেশে মানুষের ভাষা পর্যন্ত প্রতি সাত যোজন’ অন্তর পালটে যায়, সেই দেশে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা গড়তে গেলে তা একা একজন রাজার পক্ষে পরিচালনা করা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাঁর প্রয়োজন হবে বিশ্বস্ত কয়েক জন সঙ্গীর যারা প্রয়োজনে সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে দূরের রাজ্য শাসন করবে। যারা প্রয়োজনে একাধারে হবে রাজার বিশ্বস্ত সেনাপতি, অন্যদিকে হবে রাজার পরামর্শদাতা। একজন রাজা লোকচক্ষুর সামনে থাকবে, কিন্তু তার আড়ালে থাকবে আরও কয়েক জন যারা রাজার মতোই রাজকার্য পরিচালনা করবে সবার আড়ালে থেকে।

চাণক্য হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গি করে বললেন,

—যশস্বী ভবঃ। তোমরা সবাই অনেক পরিশ্রমের ফলে এই বিদ্যা লাভ করেছ। কিন্তু, মনে রেখো, নিয়মিত অনুশীলন ছাড়া এই বিদ্যা তোমরা ভুলে যাবে। অস্ত্র যেমন অব্যবহৃত পড়ে থাকলে তাতে জং ধরে, সেভাবেই যোদ্ধার শরীরেও জং ধরে যায় অনুশীলন না করলে।

চাণক্য কথা থামিয়ে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,

—সব অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার জানলেও, সাধারণত মানুষ মহারথ মাত্র একটি বা বড়োজোর দুইপ্রকার অস্ত্র লাভ করতে সক্ষম হয়। যেমন অর্জুনের ছিল ধনু, ভীমের ছিল গদা। আর্যসেন সেই বিরল যোদ্ধাদের একজন যিনি আমার জানা মতে অন্তত পাঁচটি অস্ত্রে পারদর্শী। কিন্তু, তোমরা? তোমরা কে কোন অস্ত্র বেছে নিয়েছ?

প্রথমে উত্তর দিল পুরুষদত্ত,

—আচার্য, আমি বেছে নিয়েছি ধনুষ—বাণ। আচার্য আর্যসেন আমার লক্ষ্যভেদ ক্ষমতায় হর্ষিত হয়ে এক বিশেষ গুপ্তবিদ্যা শিখিয়েছেন।

পুরুষদত্ত কিশোরসুলভ আগ্রহ নিয়ে আচার্যর দিকে চেয়ে রইল এই অপেক্ষায় যে, এরপরেই আচার্য জানতে চাইবেন যে, কী সেই গুপ্তবিদ্যা। কিন্তু, চাণক্য পুরুষদত্তকে অবাক করে দিয়ে বললেন,

—হুমম। জানি। তুমি ‘শব্দভেদী’ বিদ্যা রপ্ত করেছ।

—কি—কিন্তু, আপনি তা কীভাবে জানলেন, আচার্য? আচার্য আর্যসেন আপনাকে বলেছেন?

চাণক্যর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। বললেন,

—না, তিনি যথাযথ গোপনীয়তা পালন করেছেন। আর্যসেন যে অন্ধকারে লক্ষ্যভেদ করতে জানেন, তা আমার জানা ছিল। গত কয়েক দিন যাবৎ তোমায় আমি হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠতে দেখেছি সামান্য শব্দ হলেও। অর্থাৎ, তুমি তোমার শ্রবণশক্তিকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শব্দ শুনতে অভ্যস্ত করেছ। যুক্তিনির্ভর অনুমান দ্বারা সহজেই বোঝা যায় যে, এটা শব্দভেদী অনুশীলনের ফল। তোমার এই কৃতিত্বে আমি প্রীত হয়েছি।

পুরুষদত্তর বিস্মিত ভাব কাটার আগেই শশাঙ্ক বলল,

—গুরুদেব, আমি অশ্বারোহণ করে যুদ্ধে বিশেষভাবে সক্ষম। ঘোড়ার গতি ব্যবহার করে এই দীর্ঘ তরবারি দিয়ে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে শিখেছি।

—সাধু, শশাঙ্ক! তোমার এই ক্ষমতা তোমায় রণক্ষেত্রে একজন উৎকৃষ্ট সেনাপতি ও যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি দেবে আগামীতে। আদিত্য? তুমি? আদিত্য চাণক্যর ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বিশালদেহী ও শক্তিশালী। সে উত্তর দিল,

—আচার্য আর্যসেন আমার বাহুবল প্রত্যক্ষ করে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন মল্লযুদ্ধ বা গদাযুদ্ধের। কুস্তিতে আমি অনেককে ধরাশায়ী করেছি। অতএব বলতে পারেন, আমিই এক্ষেত্রে গদাধারী ভীম!

চাণক্য মৃদু মাথা নেড়ে বললেন,

—আর্যসেন বিচক্ষণ শিক্ষক। তিনি অত্যন্ত যথাযথ অস্ত্র নির্বাচন করেছেন তোমার জন্যে।

এরপর অক্ষয় বলল,

—আমি ভল্ল ব্যবহারে দক্ষতা লাভ করেছি। এ ছাড়া, তরবারিতেও নেহাতই মন্দ নই।

—হুমম। সাধু, অক্ষয়। তুমি একাধিক অস্ত্রচালনায় দক্ষ হয়েছ জেনে খুশি হলাম। কিন্তু, আরও একটি বিষয়ে যে জ্ঞান তুমি লাভ করেছ সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হবে আগামীতে।

——আপনি কি আমার রসায়ন ও আয়ুর্বেদ চর্চার কথা বলছেন, আচার্য?

—হ্যাঁ, বৎস। ঔষধি—উদ্ভিদ বিষয়ে তোমার জ্ঞানের কথা আচার্য যোগরাজ নিজে বলেছেন আমায়। তিনি তোমার ওপর খুবই প্রসন্ন হয়েছেন। বেশ, বেশ। এবার তুমি বলো, জীবসিদ্ধি?

জীবসিদ্ধি কিছুটা ইতস্তত করে নিজের কোমর থেকে একটি তরবারি বের করল। তরবারিটা দৈর্ঘ্যে সাধারণ তরবারির চেয়ে ছোটো, কিন্তু কৃপাণের চেয়ে বড়ো। জীবসিদ্ধি বলল,

—কেন জানি না, কিন্তু বড়ো অসির চেয়ে আমি এই বিশেষ তরবারিটা ব্যবহারে বেশি স্বচ্ছন্দ। যদিও এটাকে ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করার মতো অস্ত্র বলা যায় না…।

চাণক্যর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে জীবসিদ্ধির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন,

—মানুষ কোন অস্ত্র ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য, তার থেকে সেই ব্যক্তির চরিত্রের সম্বন্ধে অনেক কিছু অনুধাবন করা সম্ভব। সব যুদ্ধ রণক্ষেত্রে লড়া হয় না, জীবসিদ্ধি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ চলে সবার চোখের আড়ালে।

জীবসিদ্ধি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,

—আপনি কীসের কথা বলতে চাইছেন, আচার্য?

চাণক্য উত্তর দিলেন,

—গুপ্তচর। সেটা কী বস্তু তা তোমার এখন না জানলেও চলবে। তবে নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার অস্ত্র নির্বাচন যথাযথ হয়েছে। এবার তুমি বলো, চন্দ্ৰগুপ্ত। তুমি কোন অস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করেছ?

চন্দ্রগুপ্ত সরাসরি উত্তর দিল,

—কোনোটাতেই না, গুরুদেব। আমি সেভাবে আলাদা করে কোনো অস্ত্রই বলতে পারব না। তবে, আমি আমার ভ্রাতাদের থেকে শেখার চেষ্টা করছি।

চাণক্য চিন্তিত ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন

—অর্থাৎ, তুমি কি বলতে চাইছ যে, তুমি কোনো অস্ত্র চালনাই শিখে উঠতে পারোনি?

—না, তা নয়। আমি সব অস্ত্রের ব্যবহারই আয়ত্ত করেছি। কিন্তু, বিশেষভাবে বলার মতো কিছু আমি খুঁজে পাইনি। আমায় ক্ষমা করবেন, আচার্য। আমি চেষ্টা করছি।

শশাঙ্ক চন্দ্রগুপ্তর সহায়তা করতে এগিয়ে এল,

—আচার্য, চন্দ্র কিন্তু তরবারি ভালো চালায়। আমার সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলন করে ও। খুব দ্রুত উন্নতি করছে।

তার কথায় সায় দিল আদিত্য,

—ও আমার সঙ্গে কুস্তির অনুশীলন করে রোজ। যদিও এখনও আমায় হারাতে পারেনি।

হেসে উঠে প্রসন্ন ভঙ্গিতে চন্দ্রগুপ্তর পিঠে মৃদু আঘাত করল আদিত্য। অন্যরাও একবাক্যে জানাল যে, চন্দ্রগুপ্ত সবার সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলন করে এবং উন্নতি করছে। আশা করা যায়, শীঘ্রই সে তার বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করবে।

তাঁর শিষ্যদের মধ্যে এই ভ্রাতৃত্বের ভাব দেখে চাণক্য মনে মনে প্রসন্ন হলেন। যদিও মুখে কিছু বললেন না।

চাণক্য এইবার গম্ভীর হয়ে বললেন,

—তোমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি যে, আমাদের মূল উদ্দেশ্য কি?

সবাই সমবেত কণ্ঠে বলল,

—না, আচার্য!

—মনে রেখো আমাদের দেশ, আমাদের মায়ের আমাদের প্রয়োজন। তাকে ছিন্নভিন্ন করে রেখেছে কিছু স্বার্থপর শাসক। আমাদের অখণ্ড আর্যাবর্ত গড়তে হবে। আর, তা করতে গেলে সর্বপ্রথম কাকে হারাতে হবে?

আবারও সবাই একসঙ্গে উত্তর দিল,

—মগধাধিপতি নন্দ!

—ঠিক। নিজেদের লক্ষ্যে স্থির থেকো তোমরা। দেশের প্রতি, মাতৃভূমির প্রতি নিজের ঋণের কথা সর্বদা স্মরণে রেখো।

চাণক্য চুপ করলেন। কথা বলতে বলতে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। দু—চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শ্বাস—প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করলেন। চোখ খুলে বললেন,

—কিন্তু, মগধকে পরাজিত করা এত সহজ হবে না। সত্যি বলতে, এ প্রায় অসম্ভব কার্য। যদি না…

কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন চাণক্য। শশাঙ্ক জিজ্ঞেস করল, —যদি না? কী আচার্য?

চাণক্য একবার তাঁর ছাত্রদের মুখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে উত্তর দিলেন, —যদি না কোনো দৈবশক্তি আমাদের সাহায্য করে।

ছয় শিষ্য নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। পুরুষদত্ত প্রশ্ন করল,

—দৈবশক্তি? কোন দৈবশক্তি, আচার্য?

চাণক্য এতক্ষণে শিষ্যদের উপবিষ্ট হতে ইঙ্গিত করলেন এবং নিজেও একটি আসনে উপবিষ্ট হলেন। একটি পাত্রে মধুতে নারকেল পাক দেওয়া লাড্ডু ছাত্রদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—তোমরা ক্ষুধার্ত নিশ্চয়ই। খাও।

এই লাড্ডু যে প্রচণ্ড মিষ্টি হয় তা শিষ্যরা সবাই জানে। তাই আদিত্য বাদে কেউই তা গ্রহণ করল না। আদিত্য সর্বভুক। সে যেকোনো ধরনের খাদ্যবস্তু, যেকোনো সময়ে উদরস্থ করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে।

চাণক্য নিজে একটি লাড্ডু ভেঙে মুখে দিলেন। তারপর কিছুটা যেন ভেবে নিয়ে বললেন,

—এই ভারতভূমি হল রহস্যের দেশ, কিংবদন্তির দেশ। সেইরকমই একটা কিংবদন্তির কথা আমি তোমাদের শোনাতে চাই। কথিত আছে একবার রাবণ নিজ ক্ষমতার অন্ধ দর্পে শিবসহ কৈলাস পর্বত লঙ্কায় তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে ছিল প্রচণ্ড শিব ভক্ত। অন্ধ—ভক্তি সর্বদাই বুদ্ধিনাশ করে। রাবণের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সে নিজের সমস্ত বল লাগিয়ে কৈলাস পর্বত তুলতে গেল। মহাদেব সব সহ্য করতে পারেন, কিন্তু ঔদ্ধত্য নয়। তাই তিনি শুধুমাত্র তাঁর পায়ের একটি আঙুলের চাপ দিতেই গোটা পর্বতের নীচে চাপা পড়ে রাবণ। রাবণের দর্পচূর্ণ হয়। সে ওই অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে, প্রায়শ্চিত্ত করতে শিবের স্তুতিগান শুরু করে। বহুকাল চেষ্টার পর দেবাদিদেব শিব অবশেষে সন্তুষ্ট হন। পর্বত থেকে আঙুল তুলে মুক্তি দেন রাবণকে এবং তাকে প্রদান করেন একটি তরবারি। সেই তরবারির নাম— ‘চন্দ্রহাস’। কথিত আছে যে, এই তরবারি হল অজেয়! যে যোদ্ধার হাতে এই অসি থাকবে, তাকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না।

চাণক্য কথা থামিয়ে দেখলেন তাঁর কথা খুব মন দিয়ে শুনছে সবাই। তিনি আবার গল্প শুরু করলেন,

—কথিত আছে যে রাবণের থেকে এই অবিনাশী তরবারিটি খোয়া গিয়েছিল। যে কারণে শ্রীরাম তাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু, আরও একটি প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী সেই তরবারি আসলে খোয়া যায়নি। ওটা চুরি করা হয়েছিল রাবণের থেকে।

—কে চুরি করেছিল ওটা?

—দেবরাজ ইন্দ্র। ইন্দ্রকে স্বর্গ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল রাবণ। ইন্দ্ৰ জানতেন যে, ওই তরবারি রাবণের হাতে থাকলে স্বয়ং রামচন্দ্রও তাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারবেন না। তাই এক প্রহরীর ছদ্মবেশে, নিজের মায়াবলে ওই তরবারি চুরি করেছিলেন ইন্দ্র। কিন্তু, তিনি সেই তরবারি নিজের সঙ্গে নিয়ে যাননি কারণ তাঁর এই কীর্তির কথা জানতে পারলে মহাদেব অসন্তুষ্ট হতেন। তাই ইন্দ্র এই তরবারি পৃথিবীতে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। শোনা যায়, এই গান্ধার রাজ্যের উত্তরে অবস্থিত দুর্গম গিরি উপত্যকার কোনো এক গোপন স্থানে আজও রক্ষিত রয়েছে সেই চন্দ্রহাস! যে যোদ্ধা সেই তরবারি খুঁজে পাবে, সে হবে অজেয়।

চাণক্যর কথা শেষ হতেই ছয় ছাত্রর মুখে উৎসাহের আলো ফুটে উঠল। সবার মনে যে কথাটা চলছিল, সেটা চন্দ্রগুপ্ত এইবার বলে ফেলল,

—গুরুদেব! ওই অজেয় দৈবাস্ত্র যদি আমরা খুঁজে পাই, তবে কি ধনানন্দকে পরাজিত করা সম্ভব?

চাণক্য নিজের খোলা চুলের শিখায় হাত বুলিয়ে বললেন,

—আমার জানা নেই, চন্দ্রগুপ্ত। এই কাহিনির সত্যতা নিয়েও আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু, তাহলে এই কাহিনি আপনি আমাদের বললেন কেন?

চাণকা কিছুক্ষণ থেমে উত্তর দিলেন,

— কারণ, আজকে প্রভাতে আচার্য প্রমুখর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটি তথ্য জানতে পারলাম। তোমরা তো জানোই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন সুবিশাল পুস্তকালয় নির্মাণ চলছে। সমস্ত ছোটো বড়ো পুস্তকগৃহ থেকে সকল পুস্তক সেখানে আনার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। এর ফলে অনেক প্রাচীন পুস্তক ও ভুজপত্র বেরিয়ে আসছে যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। কয়েক দিবস পূর্বে এরকমই একটি ভূর্জপত্র পাওয়া গিয়েছে, যাতে রয়েছে একটি প্রাচীন মানচিত্র।

——মানচিত্র?

প্রশ্নটা করল জীবসিদ্ধি। চাণক্য ঘাড় নেড়ে উত্তর দিলেন,

—হ্যাঁ। একটি প্রাচীন মানচিত্র। এবং, সেইসঙ্গে একটি প্রাচীন লিপি যাতে লেখা রয়েছে কয়েকটি কথা যার অর্থ দাঁড়ায় এইরূপ— ‘এই মানচিত্রের শেষে যে পৌঁছোবে, সে—ই হবে অজেয়!”

উত্তেজিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়েছে ছয় কিশোর। পুরুষদত্ত বলল,

—আচার্য, আমাদের আদেশ দিন! আমরা উদ্ধার করে আনি চন্দ্রহাস! —হ্যাঁ আচার্য, এই সুবর্ণ সুযোগ আমরা হাতছাড়া করতে পারি না।

চাণক্য সকলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,

—তোমাদের সবারই কি এই অভিমত? তোমরা এই অস্ত্র লাভ করতে ইচ্ছুক? সমবেত কণ্ঠে উত্তর এল,

—হ্যাঁ, আচার্য।

চাণক্য বললেন,

—কিন্তু, এই মানচিত্রর পথ অতি দুর্গম হবে। হয়তো তোমরা কুশল যোদ্ধা হয়েছ। কিন্তু, এই অভিযানের প্রতি পদে তোমাদের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। তাই এখানে যাওয়ার অনুমতি আমি তোমাদের দিতে পারি না।

সবাই হতাশ হল চাণক্যর কথায়। জীবসিদ্ধি বলল,

—আচার্য, আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, এই অস্ত্র উদ্ধার করলে আমরা বাস্তবে মগধকে পরাজিত করার ক্ষমতা লাভ করব?

চাণক্যর চোখ উজ্জ্বল হল। তিনি বললেন,

—হ্যাঁ। আমি বিশ্বাস করি, এই অভিযান সফল হলে তোমরা হবে অপরাজেয়!

চন্দ্রগুপ্ত করজোড়ে নতমস্তকে বলল,

—তবে আমাদের আজ্ঞা দিন, আচার্য।

তার দেখাদেখি অন্যরাও তাই করল। আদিত্য বলল,

—চন্দ্রহাস আমরা উদ্ধার করব। এবং, তা আপনার সমীপে আমরা নিবেদন করব। পুরুষদত্ত বলল,

—আচার্য, ধরে নিন সেটাই হবে আপনাকে আমাদের তরফ থেকে গুরুদক্ষিণা! চাণক্য আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

—ওঠো তোমরা। তোমাদের মতো বীর শিষ্য লাভ করে আমি গর্বিত। বেশ, তবে তাই হোক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমরা রওনা হও দৈবাস্ত্র উদ্ধার অভিযানে। আমি প্রধানাচার্যর সঙ্গে আলোচনা করে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি শুরু করতে বলেছি। বিজয়ী ভবঃ!

১ যোজন ১৪.৬ কিলোমিটার

৩.

—তোমরা সকলে প্রস্তুত? সূর্যোদয়ের কিন্তু আর দেরি নেই।

চাণক্য প্রশ্ন করলেন। ছয়টি দ্রুতগামী ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছয় কিশোর। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে রয়েছে অস্ত্র। প্রতিটা ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুলছে কাপড়ে বাঁধা যাত্রাপথের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, শুকনো খাদ্য, তৈজসপত্রাদি।

জ্যোতিষ গণনা করে এই বিশেষ দিন, ঠিক সূর্যোদয়ের সময়ে তাদের যাত্রা আরম্ভের শুভ সময় বলে নিদান দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী প্রত্যেকে প্রস্তুত হয়েছে। চাণক্য প্রদীপের আলো নিয়ে একে একে প্রত্যেকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাদের প্রস্তুতি দেখে সন্তুষ্ট হলেন। পূর্বের আকাশের অন্ধকার হালকা হয়ে আসছে; তাঁর শিষ্যরা তাঁকে প্রণাম করে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসল। চাণক্য তাদের আবারও মনে করিয়ে দিলেন,

—মনে রেখো, পথ হবে অতি দুর্গম। মানচিত্র বহুযুগ আগের। আমরা কেউই জানি না যে, তাতে নির্দিষ্ট পথ বর্তমানে আদৌ আছে কি না। তা ছাড়া, মানচিত্র পেছনে কিছু কথা লেখা আছে যার মানে দুর্বোধ্য। এর অর্থ আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। কখনো যদি মনে হয় যে, এই অভিযানে সফল হওয়ার আর কোনো সম্ভবনা নেই, তবে নির্দ্বিধায় তোমরা ফিরে এসো। মনে থাকবে তো?

—হ্যাঁ, আচার্য।

সবাই সমস্বরে উত্তর দিল।

—বেশ। তবে তোমরা এইবার রওনা হও। পথে প্রথমেই পড়বে গভীর বন। মনে রেখো, সন্ধ্যার আগেই তোমাদের বন পেরিয়ে যেতে হবে। ওই দেখো, সূর্যোদয় হচ্ছে। অতএব, আর বিলম্ব নয়। ঈশ্বর তোমাদের রক্ষা করুন।

তক্ষশিলার উত্তরের দ্বার খুলে গেল। ছয়জন তরুণ অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে এল ফটক দিয়ে এবং বায়ুর বেগে ছুটে চলল তাদের অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে।

তাদের ঘোড়ার খুরের আঘাতে মাটি থেকে ওড়া ধুলোর কুণ্ডলী যতক্ষণ দৃশ্যমান রইল, ততক্ষণ চাণক্য দাঁড়িয়ে রইলেন তক্ষশিলার দ্বারে। নিজের ছয় প্রিয় শিষ্যদের তিনি এমন এক পরীক্ষার মুখে ঠেলে দিয়েছেন যার ফলে তাদের প্রাণহানি পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। একবারের জন্যে কিছুটা দুর্বল হলেন বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। ভাবলেন তিনি কি ভুল করলেন কিছু? তাঁর ছাত্ররা কিশোর মাত্র। তাদের এই বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া কি উচিত হল?

কিন্তু, পরমুহূর্তেই মন শক্ত করলেন তিনি। নাহ্, এই পরীক্ষায় এই ছয়জনকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। কারণ, তাদের ওপরেই নির্ভর করছে একটা গোটা দেশের ভবিষ্যৎ। সফল হতেই হবে তাঁর ছাত্রদের। বিশেষ করে চন্দ্রগুপ্তকে।

এই অভিযানে তার ভূমিকা কী হয় তা দেখার অপেক্ষায় থাকবেন চাণক্য। চাণক্য মনে করেন যে, আসল অধিনায়ক সে নয় যে নিজেকে সবার নেতা বলে দাবি করে। আসল অধিনায়ক সে—ই যাকে অন্যরা নিজেদের নেতা বলে নির্বাচন করে।

ছয়জনের এই দলে কেউ চন্দ্রগুপ্তর চেয়ে বলশালী, কেউ আবার তার চেয়ে উৎকৃষ্ট যোদ্ধা। দলে তার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় সদস্য আছে। কিন্তু, যদি চাণক্যর নির্বাচন সঠিক হয়ে থাকে, তবে এই সবার সম্মুখে নিজেকে অধিনায়ক হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হবে চন্দ্রগুপ্ত। আর, এই পরীক্ষায় যদি সে সফল না হয়, তবে চাণক্য জানবেন যে আবারও তাঁর নির্বাচনে ভুল ছিল। আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে সব কিছু!

চাণক্যর মনে পড়ল বহু বছর আগের সেই দিনের কথা, যেদিন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্তকে। সেইদিন ঈশ্বরের কাছে তিনি ইঙ্গিত চেয়েছিলেন। ঈশ্বর তাঁকে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্তর মধ্যে দিয়ে। তাই আজ এত বছর পর তিনি আরও একবার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন,

—হে ঈশ্বর। রক্ষা করো ওদের। সঠিক মার্গ দেখাও ওদের!

৪.

জঙ্গল অবধি খুব দ্রুতগতিতে চললেও, জঙ্গলে প্রবেশ করার পর ঘোড়ার গতি কমাতে হল। কারণ, এত গাছ, লতার মধ্যে ঘোড়া দৌড় করানো সম্ভব নয়।

দলে সবার সম্মুখে চলেছে শশাঙ্ক। কারণ, সে—ই সবথেকে ভালো মানচিত্র দেখে পথনির্দেশ দিতে পারে। অতএব, সে—ই আগে ঘোড়ার পিঠে এগিয়ে চলেছে। তার হাতে ধরা মানচিত্র ও সূর্যের অবস্থান অনুযায়ী দিক্‌নির্ণয় করছে। কিন্তু, বার বার গাছের ডাল ও লতার জন্যে, হাতে মানচিত্র নিয়ে এগোতে তার অসুবিধা হচ্ছে। চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—জীবসিদ্ধি, আমার সঙ্গে এগিয়ে চলো। লতা ও গাছের ডালের জন্যে শশাঙ্কর অসুবিধা হচ্ছে। আমরা সম্মুখে তরবারি দিয়ে ডাল আর লতা কেটে পথ পরিষ্কার করতে করতে এগিয়ে চলি যাতে শশাঙ্ক মানচিত্রে মনোনিবেশ করে এগোতে পারে আমাদের পেছনে।

কথাটা বলেই চন্দ্রগুপ্ত এগিয়ে গেল ঘোড়া নিয়ে। তার পেছনে এগোল জীবসিদ্ধি। দু—জন দু—ধার থেকে পথ পরিষ্কার করতে থাকল তরবারির কোপে। তাদের পেছনে, শশাঙ্কর নির্দেশ মতো এগোল বাকি তিনজন। শশাঙ্ক বলল,

—মানচিত্র অনুযায়ী অদূরে একটি নদী পড়বে। সেটা পেরোতে হবে।

—কীভাবে?

প্রশ্ন করল পুরুষদত্ত। শশাঙ্ক উত্তর দিল,

—যাত্রীদের মুখে শুনেছি এর ওপর একটি সেতু আছে। কাঠ ও দড়ি দিয়ে বানানো হলেও, ঘোড়ার গাড়ি পেরিয়ে যেতে পারে। অতএব, অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

কিছুক্ষণ আরও পথ ধরে এগোতেই শশাঙ্কর কথামতো একটি নদীর সামনে এসে পড়ল তারা। জঙ্গলের ও পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা ক্ষরস্রোতা নদী। শশাঙ্ক একদিকে হাত তুলে বলল,

—যতদূর জানি, ওদিকে সেতু আছে।

সেইদিকে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়েই সবাইকে থমকে দাঁড়াতে হল। কারণ, সেতুটা তারা খুঁজে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সেতু ওপার থেকে ছিঁড়ে গিয়েছে। এপার থেকে আলগা ঝুলে আছে পাহাড়ের গা বেয়ে। অতএব, নদী পারাপারের আপাতত কোনো পথ নেই।

শশাঙ্ক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,

—এ পথে কয়েক দিন আগেই একদল বণিক এসেছিল গান্ধারে। তাদের মুখেই এই পুলটার কথা শুনেছিলাম। তার মানে, গত কয়েক দিনের মধ্যেই এটা ছিঁড়েছে। আদিত্য বলল,

—সে তো বুঝলাম, কিন্তু এখন উপায় কী, ভ্রাতারা?

পুরুষদত্ত উত্তর দিল,

—আমরা জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে ভেলা বানাতে পারি। তারপর একে একে পার হয়ে যাব ঘোড়া সমেত।

চন্দ্রগুপ্ত দুইদিকে ঘাড় নেড়ে বলল,

—তা হয় না, ভ্রাতা। কারণ, এতে প্রচুর সময় লাগবে। আমাদের হাতে সময় নেই। দেখো আকাশের দিকে। দিনের শেষ প্রহর শুরু হয়ে গিয়েছে। এই জঙ্গলে সন্ধ্যা নামলেই বিপদ। বন্য জানোয়ারের শিকার হতে হবে আমাদের।

—আমরা গাছের ওপর বসে রাত কাটিয়ে দিতে পারি।

চন্দ্রগুপ্ত আবারও অসম্মতি জানাল,

—আমরা হয়তো—বা গাছের ওপর রাত্রিযাপন করতে পারি। কিন্তু, আমাদের অশ্ব? রাত্রি হলেই হায়না বা অন্য বন্যজন্তুরা তাদের ছিঁড়ে খাবে। বিনা অশ্বে আমাদের এই অভিযানে সাফল্যের সম্ভাবনা অর্ধেক হয়ে যাবে।

কেউই এরপর আর কিছু বলতে পারল না। চন্দ্রগুপ্তর কথায় যুক্তি আছে বুঝতে পারল তারা।

অক্ষয় বলল,

—তাহলে উপায়?

চন্দ্রগুপ্ত ওপারের দিকে কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে বলল,

—একটি উপায় আছে।

—কী উপায়?

প্রত্যেকেই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল। চন্দ্রগুপ্ত আরও খানিকটা ভেবে বলল, —সেতুর দড়ি ওদিক থেকে ছিঁড়ে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে যদি একজনও ওপারে পৌঁছে যেতে পারি, তবে ওইদিক থেকে সেটা আবার মেরামত করে, বেঁধে দেওয়া সম্ভব হবে সহজেই।

—এ কী অসম্ভব কথা বলছ তুমি, চন্দ্র? ওপারে আমাদের মধ্যে কেউ পৌঁছোবে কীভাবে? সেতুটাই তো নেই! নৌকা বানাতে সময় লাগবে। আর, এই নদী সন্তরণের প্রশ্নই আসে না। দেখো, কী প্রচণ্ড খরস্রোতা এই নদী।

পুরুষদত্তর কথায় চন্দ্রগুপ্ত উত্তর দিল,

—এই অসম্ভব কার্য তুমিই একমাত্র সম্ভব করতে পারো, পুরুষদত্ত।

—আমি?

—হ্যাঁ, তুমি। ওই দেখো, ওপারে একটি বৃক্ষ দেখা যাচ্ছে। একটি বাণের সঙ্গে দড়ি বেঁধে, যদি ওই বৃক্ষের ডালের মাঝখান দিয়ে গলিয়ে দেওয়া যায়, তবে কিন্তু এপার—ওপার দড়ি—পথ তৈরি হবে। আমি তোমায় এই দীর্ঘ সময় ধরে একজন উৎকৃষ্ট ধনুর্ধর হয়ে উঠতে দেখেছি, ভ্রাতা। আমি নিশ্চিত এই কঠিন লক্ষ্যভেদ কেউ পারলে একমাত্র তা তুমিই পারবে।

পুরুষদত্ত কিছুক্ষণ ওপারে গাছের দূরত্ব ও দুটি মজবুত ডালের মাঝের অংশটা দেখে নিয়ে মনে মনে হিসেব করে নিল। তারপর বলল,

—তা হয়তো আমি পারব। একটি দড়ির মাধ্যমে ওপারে যাবে কে? দড়ি ছিঁড়ে যেতে পারে। গাছের ফাঁকে আটকে থাকা বাণটাও ভেঙে যেতে পারে।

—হ্যাঁ, সে—সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর, সেই কারণেই আমিই ওই দড়ি ধরে ওপারে যাব। কারণ, আমাদের সবার মধ্যে, আমারই দেহের ওজন সবচেয়ে কম। শশাঙ্ক বলল,

—কিন্তু চন্দ্র, এ যে বড়ো বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যায়! একবার তোমার হাত ফসকালে যে নিশ্চিত মৃত্যু!

চন্দ্রগুপ্ত দু—হাত তুলে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,

—আর কোনো উপায় নেই, ভ্রাতা। এই ঝুঁকি নিতেই হবে।

আদিত্য বলল,

—কিন্তু, তাতেই—বা লাভ কী? সেতু যে এপার থেকে ঝুলে আছে। ওটার ও মাথা, ওপারে পৌঁছোবে কীভাবে?

চন্দ্রগুপ্ত মৃদু হেসে বলল,

—সেই কাজটা করতে তোমার এবং অক্ষয়ের সাহায্য লাগবে।

—কীভাবে?

—শোনো, বলছি। ভ্রাতা আদিত্য, তুমি গোটা পুলটা টেনে এপারে তোলো। আমি ওপারে পৌঁছে গেলে, তুমি তোমার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সেটাকে ওদিকে ছুড়ে দেবে। ঠিক সেই মুহূর্তে অক্ষয় সজোরে নিজের ভল্ল ছুড়ে দেবে ওটার দিকে। ভল্ল দ্বারা ওটাকে বিদ্ধ করবে আকাশে। তোমার বাহুবল ও তোমার ভল্লর আঘাতের সম্মিলিত জোরে সেতুর ওই অংশ ভল্লবিদ্ধ হয়ে ওপারে ঠিকই পৌঁছোবে।

—এটা অসম্ভব!

—আমার কিন্তু মনে হয়, এতে কাজ হবে।

—ব্যাপারটা অসম্ভব নয়, কিন্তু অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ।

সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ডুবে গেল। চন্দ্রগুপ্ত তাদের থামিয়ে বলল,

—শাস্ত হও, ভ্রাতাগণ। দেখো, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। জল্পনার সময় এটা নয়।

পুরুষদত্ত, তুমি তৈরি হও। জীবসিদ্ধি, তোমার কাছে দড়ি আছে, ওটা নিয়ে এসো। চন্দ্রগুপ্ত নিজের হাতে কাপড় বাঁধতে শুরু করল। জীবসিদ্ধি দড়ি নিয়ে এসে সেটি একটি ভারী, মজবুত বাণের সঙ্গে বেঁধে দিল। সেটা হাতে নিয়ে, ওজন অনুমান করে ধনুতে চড়িয়ে গুণ টানল পুরুষদত্ত। অনেকটা পেছন অবধি গুণ টেনে ধরল পুরুষদত্ত। কয়েক মুহূর্ত পাখির চোখের মতো সে শুধুই দেখতে পেল গাছের, দুটি ডালের মাঝের অংশটা। আঙুল থেকে ধনুর গুণ ছাড়তেই টংকার ধ্বনি উঠল এবং মুহূর্তে দড়ি বাঁধা তির ছুটে গেল লক্ষ্যের দিকে। নির্ভুল নিশানায় তির ঢুকে গেল গাছের দুটো ‘Y’— আকারের ডালের মধ্যে দিয়ে!

এই দৃশ্য দেখে সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল। দড়ির এই মাথাটা শক্ত করে বাঁধা হল এপারের একটি গাছের সঙ্গে। কাপড় বাঁধা হাত দুটোর সাহায্যে এইবার দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল চন্দ্রগুপ্ত। এগোতে লাগল নদীর ওপর দিয়ে। নীচের দিকে একবার চোখ গেল তার। মুহূর্তে বুক ঠান্ডা হয়ে এল নীচে বয়ে চলা, সাক্ষাৎ মৃত্যুরূপী নদীটাকে একনজর দেখে। মনে হল হাতের জোর বুঝি কমে আসছে, ফসকে যাবে এখুনি। এপার থেকে চিৎকার করে উঠল তার পাঁচ ভ্রাতা!

চন্দ্রগুপ্ত চোখ বন্ধ করল। নাহ্, এটা দুর্বলতার সময় নয়। অর্ধেক খাদ পেরিয়ে গিয়েছে সে ইতিমধ্যে। আর মাত্র কিছুটা।

দৃঢ়চিত্তে আবার এগিয়ে চলল চন্দ্রগুপ্ত। ওপারে পা রাখতেই আরও একবার এপার থেকে হর্ষধ্বনি উঠল। চন্দ্রগুপ্ত ইশারা করল পরবর্তী পদক্ষেপের।

ঝুলন্ত কাঠের অংশ আগেই তোলা হয়েছে। এইবার অনেকটা যেভাবে মৎস্যশিকারি নদীর ওপর জাল ছুড়ে দেয়, ঠিক সেই ভঙ্গিতে, নিজের সমস্ত শারীরিক বল প্রয়োগ করে দড়ি বাঁধা কাঠের কাঠামোটাকে ছুড়ে দিল আদিত্য। হাতে ভল্ল নিয়ে তৈরি ছিল অক্ষয়। ভল্ল গিয়ে মাঝ আকাশে বিদ্ধ করল সেতুর কাঠের একটি অংশ এবং সেই দুটি একসঙ্গে এসে বিদ্ধ হল ওপারের মাটিতে!

চন্দ্রগুপ্ত দড়ি দিয়ে পুলটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিল। প্রথমে ওপারে পাঠানো হল একটি একটি করে ঘোড়াকে। কারণ, এ অবস্থায় ঘোড়া সমেত আরোহীর ওজন এই কাঠের সেতুর ওপর না দেওয়াই উচিত। ঘোড়া পেরিয়ে যেতে একে একে সেতু পার করল অন্য পাঁচজন। এপারে এসে পুনরায় তারা অশ্বারোহণ করল।

জীবসিদ্ধি কিছুটা পিছিয়ে পড়ছিল। সে সেতুও পার করেছে সবার শেষে। চন্দ্রগুপ্ত লক্ষ করেছে যে, অন্যরা যখন ঘোড়ায় চড়ছে, তখনও জীবসিদ্ধি সেতুর কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন করছে।

জীবসিদ্ধি পিছিয়ে পড়েছে দেখে চন্দ্রগুপ্তও নিজের ঘোড়ার গতি কমাল।

জীবসিদ্ধির মুখে চিন্তার রেখা সে দেখতে পেয়েছে। অন্যরা সেদিকে খেয়াল না করেই এগিয়ে গিয়েছে। জীবসিদ্ধি পাশাপাশি আসতে চন্দ্রগুপ্ত মৃদু হেসে বলল,

—কী দেখলে, ভ্রাতা?

জীবসিদ্ধি গম্ভীর হল। বলল,

—সেতুর দড়ি ছিঁড়ে যায়নি। দেখেই বোঝা যায় ওটা কাটা হয়েছে। অতএব, আমাদের কয়েক দিন পূর্বেই কেউ পুল পার করে সেতুর রশি কেটে দিয়ে গিয়েছে যাতে অন্য কেউ নদী পার করতে না পারে।

চন্দ্রগুপ্ত সামনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,

—জানি। আমিও দেখেছি। কিন্তু, ব্যাপারটা যে আমাদেরই আটকাতে করা হয়েছে এরকম কোনো প্রমাণ নেই। অতএব, এখনই এই নিয়ে চিন্তিত হোয়ো না, ভ্রাতা জীবসিদ্ধি। অন্যদের আপাতত জানানোর প্রয়োজন নেই।

৫.

বেশ কয়েক দিন পার হয়েছে। জঙ্গল, পাহাড় ঘেরা বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে ছয় কিশোর যোদ্ধা। প্রায় অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে তারা। এক অচেনা উপত্যকায় রাত্রে বিশ্রাম নিচ্ছে পাঁচজন, প্রহরায় জেগে আছে শশাঙ্ক। পেছন থেকে কারুর হেঁটে আসার শব্দে ফিরে তাকাল সে।

চন্দ্রগুপ্ত এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,

—রাত্রির শেষ প্রহর শুরু হয়েছে, ভ্রাতা। তুমি এবার বিশ্রাম নাও। আমি প্রহরায় থাকি।

শশাঙ্কর ঘুম পাচ্ছিল এমনিতেই। তাই সে দ্বিরুক্তি না করে উঠে দাঁড়াল এবং আগুন ঘিরে যেখানে অন্যরা ঘুমিয়ে আছে, সেদিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু, মাত্র কয়েক পা এগোতে পারল সে। তারপরেই হঠাৎ টলে উঠল তার পা। সংজ্ঞাহীন হয়ে ভূপাতিত হল পরমুহূর্তে।

দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠে দাঁড়াল চন্দ্রগুপ্ত। কী হল ব্যাপারটা? শশাঙ্কর দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ অদূরে জঙ্গলের মধ্যে কিছু নড়াচড়ার শব্দ পেয়ে মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল চন্দ্রগুপ্ত। হাতে ততক্ষণে উঠে এসেছে তরবারি। পরক্ষণেই চন্দ্রগুপ্তর বাম কাঁধের কাছে কীট দংশনের মতো হালকা একটা জ্বলনের অনুভূতি হল। সেখানে হাত দিতে চন্দ্রগুপ্ত টের পেল তার কাঁধে গেঁথে আছে একটি ক্ষুদ্র কাঠের শলাকা। সেটা টেনে বের করে আনল।

কী ঘটছে তা সম্পূর্ণ অনুমান করতে পারল চন্দ্রগুপ্ত। বিষযুক্ত শলাকা এটা! কেউ বা কারা যেন জঙ্গলের মধ্যে থেকে বিষাক্ত শলাকা ছুড়েছে বাঁকনল দিয়ে! শশাঙ্ক ও তার সঙ্গীরা হয় অচৈতন্য, অথবা, মৃত!

চন্দ্রগুপ্তর শরীরে বিষ প্রভাব ফেলে না। তাই সে এখনও সজাগ দাঁড়িয়ে আছে। অন্যথায় এতক্ষণে সেও শশাঙ্কর মতোই মাটিতে লুটিয়ে পড়ত। শলাকা কোনদিক থেকে এসেছে তা অনুমান করে, তরবারি তুলে জঙ্গলের সেদিকে এগোল সে। শলাকা বিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও চন্দ্রগুপ্তকে সংজ্ঞাহীন না হতে দেখে শত্রুরাও বিস্মিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু, তাকে তরবারি হাতে আক্রমণে উদ্যত হতে দেখে তারা এইবার জঙ্গলের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।

দূরে জ্বলতে থাকা আগুনের আলোয় চন্দ্রগুপ্ত দেখল তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে একদল উলঙ্গ পুরুষ। তাদের কারুর হাতে কাঠ কেটে বানানো তিরধনুক, অন্যদের হাতে গাছের ডালের মাথায় বড়ো পাথর বেঁধে বানানো গদা। একজন এখনও বাঁকনল ধরে আছে মুখে। ওতে ফুঁ দিতেই আরও একবার একটি ছোট্ট শলাকা ছুটে এল চন্দ্রগুপ্তর দিকে। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেগুলোর পথ থেকে সরে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করল সে।

লোকগুলোর মুখে ও শরীরে ভেষজ রং দিয়ে অদ্ভুত নকশা আঁকা। চন্দ্রগুপ্তর বুঝতে বাকি রইল না এরা অসভ্য জংলির দল। এরা অতি হিংস্র ও ভয়ংকর। ধনুকে তির লাগিয়ে তারা আক্রমণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল চন্দ্রগুপ্ত। অন্তত পঞ্চাশজন বা আরও বেশি জংলি আছে এদের দলে। এতজনের সঙ্গে সে যুদ্ধে কোনোভাবেই পেরে উঠবে না। যদি তার সঙ্গীরা ইতিমধ্যে মারা গিয়ে থাকে, তবে তার কিছুই করার নেই। কিন্তু, যদি তারা সংজ্ঞাহীন হয়ে থাকে, তবে তাদের বন্দি করবে জংলিরা। সেক্ষেত্রেও তাদের বাধা দিতে পারবে না চন্দ্রগুপ্ত। অতএব, এখানে যুদ্ধ বৃথা। এখন সর্বপ্রথমে আত্মরক্ষা করতে হবে।

চন্দ্রগুপ্ত উলটোদিকে জঙ্গলের দিকে দ্রুত ছুটে গিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হল। জংলিরা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত ছিল। তারা প্রত্যাশা করতে পারেনি যে, প্রতিপক্ষ হঠাৎ পলায়ন করবে। অতএব, কয়েক মুহূর্ত তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তাদের দলপতি অজানা ভাষায় আদেশ দিতে তারা ছুটল চন্দ্রগুপ্তর সন্ধানে। কিন্তু, ওই কয়েক মুহূর্তের ব্যবধান জঙ্গলের গভীরে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে চন্দ্রগুপ্তর কাছে যথেষ্ট ছিল।

কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর জংলিরা বুঝতে পারল যে, এই গভীর বনে, অন্ধকারে এক কিশোরকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অতএব, দলপতির নির্দেশে তারা অনুসন্ধান বন্ধ করল। অন্য পাঁচজনের সংজ্ঞাহীন দেহগুলো এক—একটি বাঁশের সঙ্গে বেঁধে, দু—জন করে কাঁধে নিয়ে রওনা দিল। তাদের তৈজসপত্র ও ঘোড়া যেমন ছিল তেমনই পড়ে রইল। এই জংলিরা এইসব বস্তু ব্যবহারে বা অশ্বারোহণে অভ্যস্ত নয়। অতএব, এইসবের প্রয়োজন তাদের নেই।

* * *

প্রথম জ্ঞান ফিরল জীবসিদ্ধির। তার মাথা এখনও ঝিম ঝিম করছে। টের পেল তার দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। প্রথমে বুঝতে পারল না যে, দিন না রাত। কারণ, যে কুটিরে তাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে, তা অন্ধকার। অন্ধকারে দৃষ্টি সয়ে যেতে জীবসিদ্ধি খেয়াল করল যে, কুটিরের মেঝে ও দেওয়ালে ঠেস দিয়ে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে তার সঙ্গীরা। প্রত্যেকেরই হাত মজবুত লতা দিয়ে বাঁধা।

কী ঘটেছে অনুমান করার চেষ্টা করল জীবসিদ্ধি। রাত্রে সে ঘুমোতে গিয়েছিল, এইটুকু তার মনে আছে। তারপর সে কীভাবে এই স্থানে এল, তা তার অজানা। এইবার আশেপাশে লক্ষ করল সে। কুটিরের দেওয়ালে অদ্ভুত কিছু ছবি আঁকা আছে। ভয়ংকর কিছু মূর্তির ছবি দেখা যাচ্ছে। যেমন, একটি ছবিতে, এক নেকড়েমুখো পিশাচরূপী মূর্তি যে গোলাকার বস্তুটা মুখের ওপর ধরে কিছু একটা পান করছে, সেটা সম্ভবত একটি কাটা মুণ্ডু। আর, তা থেকে যে ধারা নেমে এসেছে নেকড়ে মানুষের মুখে, তা বোধ হয় রক্ত।

হঠাৎ একপাশ থেকে মৃদু গোঙানির আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকিয়ে জীবসিদ্ধি দেখল শশাঙ্কর জ্ঞান ফিরছে। সেও চোখ খুলে কিছুক্ষণ আশেপাশের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল। কুটিরে আর একটু আলো থাকলে জীবসিদ্ধি দেখতে পেত যে, দেওয়ালে নেকড়ে মানুষের ছবিটা দেখেই শশাঙ্কর চোখে আতঙ্ক খেলে গেল।

—শশাঙ্ক? তুমি কি জেগেছ?

জীবসিদ্ধি ফিসফিস করে প্রশ্ন করল। উত্তরে অন্ধকার কোণ থেকে ‘হুমম’ জাতীয় শব্দ এল। জীবসিদ্ধি আবার বলল,

—রাত্রে আমাদের কোনোভাবে অচৈতন্য করে কেউ বা কারা বন্দি করেছে বলে মনে হচ্ছে। কুটিরের ছবি আঁকার ধরন দেখে মনে হয় কোনো জংলি উপজাতি। শশাঙ্ক এইবার কথা বলল,

—কোনো সাধারণ উপজাতি এরা নয়, জীবসিদ্ধি। এরা ‘হোরা’ উপজাতি। এদের বিষয়ে আমি কিছু পুথিতে পড়েছি। এই ঘরটি আসলে ওদের আরাধ্য দেবতার প্রতি উদ্দেশ করা মন্দিরের অংশবিশেষ। এই রক্তলোলুপ নেকড়েমুখো দেবতার নাম ‘হোর’। শুনেছিলাম এই উপজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু, এই ভয়ংকর উপজাতি যে রয়ে গিয়েছে, তা জানা ছিল না।

—এরা ভয়ংকর জাতি? তাহলে আমাদের হত্যা না করে বন্দি করল কেন? শশাঙ্ক কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁপা গলায় উত্তর দিল,

—হোর—এর কাছে আমাদের বলি দেবে বলে। হোর নরমাংসভোজী রাক্ষস দেবতা। হোরা উপজাতিরা আদমখোর, অর্থাৎ, নরভোজী! এরা আমাদের বলি দিয়ে, আমাদের মাংস ভক্ষণ করবে বলে জীবিত বন্দি করেছে!

৬.

সকাল গড়িয়ে বিকেল হল। একে অন্যের কাঁধে চড়ে, ওপরের উঁচু একটি ছোট জানলা দিয়ে বাইরে কয়েক বার দেখেছে তারা। যা বুঝেছে, তাতে মনে হয়েছে উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে নরভক্ষকগুলো। সম্ভবত, এতজন বন্দি একসঙ্গে ধরা পড়ার ফলেই আজকে তাদের মহাভোজের আয়োজন করা হচ্ছে। আজ রাত্রেই তাদের কেটে খাবে এই জংলি রাক্ষসরা।

তাদের বন্দিশালার বাইরে সর্বদা ছ—জন জংলি প্রহরারত থেকেছে। তারা সশস্ত্র। প্রত্যেকের হাতে হয় ভারী প্রস্তরনির্মিত মুষল, অথবা, প্রস্তরের ধারালো ফলাযুক্ত ভল্ল। অস্ত্রগুলো অপটু হাতে তৈরি হলেও, সেগুলো নিঃসন্দেহে প্রাণঘাতক।

অতএব, পলায়নের চেষ্টা বৃথা বুঝেই পাঁচজন সে—চেষ্টা করেনি। তা ছাড়া, সকাল থেকে তাদের আহার বা জল দেওয়া হয়নি। এই দুর্বল অবস্থায় কোনোভাবেই একদল বর্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করে জেতা সম্ভব নয়।

সন্ধ্যা হয় হয়। মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে তারা। ঠিক এই সময়ে দূরে কোথাও কোলাহলের শব্দ শুনতে পেল ওরা। শশাঙ্ক প্রথম বলল,

—কীসের যেন কোলাহল, শুনতে পাচ্ছ? কয়েক জন চিৎকার করছে না?

সবাই কান পেতে শুনতে পেল যে, গ্রামের দিক থেকে লোকজনের দ্রুতপদে যাতায়াত ও অনেক পুরুষ ও নারীকণ্ঠের আওয়াজ আসছে।

—জীবসিদ্ধি, দেখো তো কী ব্যাপার।

বলে আদিত্য হাঁটুর ওপর বসে জীবসিদ্ধিকে তার কাঁধে পা রাখার জায়গা করে

দিল। আদিত্যর কাঁধে ভর করে ওপরের ছোটো জানলা দিয়ে উকি দিল জীবসিদ্ধি।

—আগুন লেগেছে। এদের গ্রামের কিছু বাড়িতে আগুন লেগেছে। তাই সবাই ওইদিকে ছুটছে।

জীবসিদ্ধি নেমে এল। ঠিক তখনই তাদের বন্দিশালার দ্বারের ঠিক বাইরে ‘ধুপ’ জাতীয় শব্দ হল। তারপর চিৎকার করে একজন জংলি কিছু একটা বলতে গেল, কিন্তু তার কথা যেন মাঝপথেই থেমে গেল। কিছুক্ষণ বাদেই বাইরে থেকে দ্বার খোলার শব্দ এল। শশাঙ্ক বলল,

—প্রস্তুত থাকো! হতে পারে আমরা নিরস্ত্র, কিন্তু বিনা যুদ্ধে প্রাণ দেব না। যতজন রাক্ষসকে সম্ভব, নিজেদের সঙ্গে পরপারে নিয়ে যাব!

প্রত্যেকেই অসম যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল। দ্বার খুলে গেল একধাক্কায়। কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে দ্বারে, যাকে অন্ধকারে ঠিক দেখা গেল না একমুহূর্তে। কিন্তু, পরক্ষণেই একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর তাদের উদ্দেশে বলে উঠল,

—তোমরা ঠিক আছ তো? এখুনি পালাতে হবে জংলিগুলো ফিরে আসার আগেই!

—চন্দ্ৰগুপ্ত!

সবার মুখ থেকে একসঙ্গে নামটা উচ্চারিত হল।

—আমার পিছু পিছু চলো! শীঘ্র!

বলেই পেছন ফিরে জঙ্গলের দিকে ছুটল চন্দ্রগুপ্ত। দু—জন মৃত বা সংজ্ঞাহীন প্রহরী দ্বারের বাইরেই পড়ে ছিল। বন্দিরা বুঝল তাদেরই ভারী শরীরের পতনের শব্দ হয়েছিল একটু আগে। তাদের টপকে চন্দ্রগুপ্তর পিছু নিল অন্য পাঁচজন।

—এই আগুন কি তবে…

অক্ষয়ের প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই চন্দ্রগুপ্ত উত্তর দিল,

—হ্যাঁ। কাল রাত্রি থেকেই আমি এদের পিছু নিয়ে এখানে এসেছিলাম। জঙ্গলের ভেতরের রাস্তাটা ভালোভাবে চিনে নিয়েছি সেই সুযোগে। সারাদিন শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু, প্রতিমুহূর্তে তোমাদের বন্দিগৃহর বাইরে পাঁচ বা ছ—জন নররাক্ষস প্রহরায় ছিল। তা ছাড়া, আমি অপেক্ষা করছিলাম অন্ধকার হওয়ার। গ্রামের কিছু বাড়িতে আগুন দিলাম যাতে এই জংলিরা বিভ্রান্ত হয়ে গ্রামের দিকে চলে যায়। ঠিক তাই হল। দু—জন প্রহরী রেখে বাকিরা গ্রামের দিকে চলে গেল ছুটে। সেই সুযোগে এই দু—জনকে কাবু করে তোমাদের মুক্তি দিলাম।

—জয় হোক! জয় হোক চন্দ্রগুপ্তর!

আনন্দে চিৎকার করে উঠল আদিত্য। এতগুলো কথার মাঝে কেউ তাদের দৌড়ের গতি কম করেনি। চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—এখনই খুশি হোয়ো না, ভ্রাতা। ওরা এখনই টের পাবে যে, তাদের শিকার পালিয়েছে। ওরা পিছু নেবে। এই জঙ্গল ওদের কাছে হাতের তালুর মতো পরিচিত, অতএব ওরা আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ দ্রুতগামী এই বনপথে। ওরা আমাদের ধরে ফেলবে যদি না আমরা আমাদের অস্ত্র অবধি তার আগে পৌঁছোতে পারি।

কথা শেষ হতেই ফেলে আসা গ্রামের দিক থেকে একটি অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল। যেন কোনো অচেনা জন্তু বা পাখি ডেকে উঠল। যদিও শব্দটা আসলে কোনো জন্তু বা পাখির নয়। একজন জংলি বন্দিশালায় ফিরে এসে দুই নিহত সঙ্গী ও খোলা দ্বার দেখে, নিজের দুই হাত মুখের ওপর ধরে এই বিচিত্র শব্দ সৃষ্টি করল।

জীবসিদ্ধি বলল,

—ওই! ওটাই সম্ভবত ওদের সংকেত শব্দ! এর মাধ্যমে জানাচ্ছে যে, বন্দি পালিয়েছে। এবার ওরা পিছু নেবে।

প্রত্যেকে আরও দ্রুত ছুটতে শুরু করল। কিন্তু বন, লতা, গাছ তাদের বার বার গতিরোধ করছে। কিছুক্ষণ বাদেই তারা টের পেল যে, তাদের পেছনে একদল ভারী পায়ের শব্দ দ্রুত এগিয়ে আসছে! এই অন্ধকার জঙ্গলে তাদের গতি যেন বায়ুর বেগে চলছে। তাদের থেকে পালিয়ে যাওয়া এই দুর্বল শরীরে ছয় কিশোরের পক্ষে অসম্ভব! তবুও তারা প্রাণপণ ছুটতে শুরু করল।

জংলি নরখাদকরা বাস্তবিকই অনেকটা এগিয়ে এসেছিল। খুব শীঘ্রই পালিয়ে যাওয়া শিকার আবার তাদের হাতে ধরা পড়ত। এইবার আর জীবিত ধারার প্রয়োজনও তাদের নেই। এখন হত্যা করে টাটকা মাংস ভক্ষণ করবে তারা। প্রায় হাতের নাগালে ছিল তাদের শিকার।

কিন্তু, তখনই অকস্মাৎ, অন্ধকার ভেদ করে একঝাঁক তির ধেয়ে এল তাদের দিকে। একদল শরবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বাকিরা দাঁড়িয়ে গেল ঘটনার আকস্মিকতায়। কী করবে ভেবে ওঠার আগেই আরও একঝাঁক বাণ উড়ে এল তাদের দিকে। তারপর আরও একঝাঁক। জঙ্গলে গাছের ডালে বসে একদল লোক পর পর তির নিক্ষেপ করে চলেছে জংলিদের দিকে। কারা এরা? এরা কোথা থেকে এল?

এত কিছু ভাবার সুযোগ পেল না জংলিরা। বুঝতে পারল এর বেশি এগোতে গেলে তাদের অর্ধেক দল শেষ হয়ে যাবে এই অদৃশ্য শত্রুর বাণে। তাই তাদের দলপতি অচেনা ভাষায় নির্দেশ দিল পিছু হটার। পলায়নরত শিকারদের ধরার আশা ত্যাগ করে গ্রামের দিকে পিছিয়ে চলল নরখাদকের দল।

যেখানে তাদের ঘোড়া আর অস্ত্রাদি রাখা ছিল সেখানে পৌঁছোল ওরা ছয়জন। দ্রুত জল পান করে ঘোড়ায় চড়ে বসল তারা। এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। জীবসিদ্ধি জঙ্গলের পথের দিকে চেয়ে বলল,

—আশ্চর্য। জংলিরা হঠাৎ মাঝপথে আমাদের ধাওয়া করা বন্ধ করে দিল কেন? আমি তো ভেবেছিলাম এই যাত্রা মৃত্যু নিশ্চিত। চন্দ্রগুপ্ত গম্ভীরভাবে শুধু বলল,

—আশ্চর্যই বটে। ব্যাপারটা আমারও অদ্ভুত লাগছে। কী ঘটল হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর! তবে, আপাতত আমাদের এই স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্তকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

ছয় যোদ্ধা চাঁদের আলো ও স্থির, উজ্জ্বল ধ্রুবতারাকে সঙ্গী করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল উত্তর—পশ্চিম দিকে।

৭.

পরবর্তী দু—দিন চন্দ্রগুপ্তরা সামান্যই পথ চলল। তারা প্রত্যেকেই নৈশ অভিযানের ফলে ক্লান্ত। তাই পরবর্তী দু—দিন তারা কম পথ চলে বিশ্রাম বেশি নিল।

তৃতীয় দিন ভোরে পাহারায় ছিল আদিত্য। পূর্বের আকাশে সবে আলো ধরতে শুরু করেছে। একসময়ে হঠাৎ অদূরে একাধিক ঘোড়ার খুরের ধ্বনি শুনতে পেল। শব্দ তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। সচকিত হয়ে পড়ল আদিত্য। ঘুম থেকে ডেকে তুলল তার সঙ্গীদের। কিন্তু, তারা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার আগেই একদল সশস্ত্র ঘোড়সওয়ার তাদের ঘিরে ধরল। অস্ত্র নেওয়ার আগেই তাদের গলায় তরবারির স্পর্শ অনুভব করল চন্দ্রগুপ্ত ও তার সঙ্গীরা। তাদের বেশ দেখেই বোঝা যায় এরা দস্যু! পথিক ও বণিকদের হত্যা করে তাদের সর্বস্ব লুট করে এরা।

এক দস্যু খুব ধীরে ঘোড়া থেকে নেমে তাদের দিকে এগিয়ে এল। বিশাল, বলিষ্ঠদেহী এক পুরুষ। অনাবৃত বাহুতে বহু ক্ষতচিহ্ন তার যুদ্ধ অভিজ্ঞতার সাক্ষী। সম্ভবত সে—ই এই দলের দলপতি। সে বলল,

—অস্ত্রর দিকে হাত বাড়ালে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেব। আশা করি, এই কচি বয়সে তোমরা মরতে চাও না।

চন্দ্রগুপ্ত শান্ত ভঙ্গিতে বলল,

—আমরা তক্ষশিলার ছাত্র। আমাদের কাছে মূল্যবান কিছুই নেই। আমাদের লুণ্ঠন করে কোনো লাভ নেই। ঘোড়াগুলো আছে, কিন্তু তোমাদের ঘোড়া আমাদের থেকে উত্তম প্রজাতির ও তেজি।

চন্দ্রগুপ্তর কথায় হো—হো করে হেসে উঠল দস্যুনেতা। হাসি থামিয়ে বলল, —আমি সব জানি যে, তোমরা কারা এবং কী উদ্দেশ্যে এতদূর এসেছ। আমার যা প্রয়োজন তা তোমাদের কাছেই আছে। মানচিত্র দাও!

লোকটার কথায় চমকে উঠল ওরা। এই দস্যু জানে ওদের অভিযানের উদ্দেশ্য? মানচিত্রর কথাও তাদের জানা!

জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,

—তোমরাই কি রাস্তায় সেতুর দড়ি কেটে দিয়েছিলে?

দস্যুনেতা কৌতূহলী চোখে জীবসিদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলল,

—বাহ! তুমি বুঝতে পেরেছিলে যে, সেতু নিজে থেকে ছিঁড়ে যায়নি? বেশ বুদ্ধিমান তো তুমি ছোকরা! তা ঠিকই আন্দাজ করেছ। আমরাই তোমাদের দেরি করে দিতে ওটা করেছিলাম। যাতে আমরা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সুবিধামতো জায়গায় তোমাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারি। দু—দিন পূর্বেই তোমাদের ওপর আক্রমণ করতাম। কিন্তু, তোমরা ধরা পড়ে গেলে ওই নরখাদকদের হাতে। যাই হোক, মানচিত্রটা দাও এবার!

—কখনো না!

শশাঙ্ক চিৎকার করে ওঠে। দস্যুপতি এবার তার দিকে তাকিয়ে বলে,

—তোমরা নিজে থেকে না দিলে, তোমাদের মৃতদেহ খুঁজে মানচিত্রটা বের করতে খানিকটা সময় যাবে আর কি। তবে, তোমাদের আমাকে এই মানচিত্র অন্তত কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দিয়ে দেওয়া উচিত।

—কীসের কৃতজ্ঞতা? কীসের কথা বলছ?

—তোমাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে। নরখাদকদের দল তো তোমাদের ধরেই ফেলেছিল আর একটু হলে। আমরা সঠিক সময়ে গাছের আড়াল থেকে তির বর্ষণ করে ওই জংলিগুলোকে তোমাদের পিছু ধাওয়া করা থেকে নিরস্ত করি। নাহলে এতক্ষণে ওই রাক্ষসরা তোমাদের খেয়ে হজম করে ফেলত। ওই মানচিত্রর জন্যেই তোমাদের সেযাত্রা বাঁচিয়েছিলাম।

চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—ওই মানচিত্রর নির্দিষ্ট স্থানে তুমি কি ভেবেছ কোনো গুপ্তধন পাবে? রত্ন পাবে? সেসব কিছুই নেই।

—আমি জানি এই মানচিত্র কীসের। আমায় বেশি শেখাতে এসো না বালক। আমি ওই দৈবাস্ত্র চাই! ওই অস্ত্র হাতে নিয়ে আমি হব অপরাজেয়! এই গোটা রাজ্য আমার বশ্যতা স্বীকার করবে। আমি হব এখানকার অধিপতি!

—কিন্তু, মানচিত্র দিয়ে দিলে যে তুমি আমাদের প্রাণে মারবে না তার নিশ্চয়তা কী?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে দস্যু উত্তর দিল,

—নেই! কিন্তু না দিলে যে তোমাদের প্রাণটা যাবে, সেটা নিশ্চিত বলতে পারি। চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল,

—বেশ, আমরা তোমাকে মানচিত্র দেব। এমনিতেই এই অভিযান আমাদের জন্যে অত্যধিক কঠিন বলে প্রমাণিত হয়েছে ইতিমধ্যে। আমরা ফিরে যাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমাদের ঘোড়া ছেড়ে দাও আমাদের জন্যে।

দস্যু কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

—বেশ। তাই হোক। কিন্তু, যদি তোমাদের আবারও ওই পথে আসতে দেখি, তবে তোমাদের আমি নির্দয়ভাবে হত্যা করব। এবার মানচিত্র আমায় দাও এবং নিজেদের প্রাণ রক্ষা করো।

চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শশাঙ্কর উদ্দেশে বলল,

—মানচিত্র ওকে দিয়ে দাও, ভ্রাতা।

শশাঙ্ক দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

—এ তুমি কী বলছ, চন্দ্র? গোটা দেশের ভবিষ্যৎ আমাদের অভিযানের ওপর নির্ভর করে আছে।

আদিত্য শশাঙ্কর কথার সমর্থন করে বলল,

—হ্যাঁ, প্রাণ থাকতে এই মানচিত্র আমরা দেব না।

চন্দ্রগুপ্ত এইবার দৃঢ়কণ্ঠে বলল,

—মানচিত্র ওকে দিয়ে দাও, শশাঙ্ক!

জীবসিদ্ধি বলল,

—চন্দ্ৰ যা বলছে তাই করো, শশাঙ্ক।

—জীবসিদ্ধি, তুমিও?

অক্ষয় বলল,

—আমি চন্দ্রগুপ্তর ওপর ভরসা রাখি। এমনিতেও ও না থাকলে আমরা এতদূর আসতেই পারতাম না। তাই ওর কথা আমাদের শোনা উচিত, ভ্রাতা।

তার কথার সমর্থন জানাল পুরুষদত্ত।

কিছুক্ষণ সঙ্গীদের মুখের দিকে চেয়ে রইল শশাঙ্ক। চন্দ্রগুপ্তর মুখে দৃঢ়তা ফুটে আছে। তার চোখের দৃষ্টিতে এক আশ্চর্য আশ্বাস যেন দেখতে পেল শশাঙ্ক। দৃষ্টির মাধ্যমে যেন চন্দ্রগুপ্ত তাকে বলছে, ‘আস্থা রাখো! আমার ওপর আস্থা রাখো!’ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কটিবন্ধ থেকে প্রাচীন একখণ্ড ভূর্জপত্র বের করে এনে সেটা বাড়িয়ে দিল দস্যুনেতার দিকে।

দস্যুনেতা মানচিত্র নিয়ে তা খুলে একবার পরীক্ষা করে নিল। একমুহূর্তের জন্যে তার কপালে ভাঁজ পড়ল, কিন্তু পরক্ষণেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। বলল,

—বেশ। এবারের মতো তোমাদের প্রাণভিক্ষা দিলাম। ফিরে যাও নিজেদের বিদ্যালয়ে। এই অভিযান তোমাদের আয়ত্তের বাইরে। কিন্তু মনে থাকে যেন, আমাদের পিছু নিলে, বা, কোনো চালাকির চেষ্টা করলেই নিশ্চিত মৃত্যু! চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—আমরা কথা দিচ্ছি যে, আমরা অন্য পথ ধরব। মানচিত্রর পথে আমরা আর এগোব না।

দস্যুরা যে—যার নিজের ঘোড়ায় চড়ে বসল। দলপতি বলল,

—তোমাদের ঘোড়া রেখে গেলাম। ফিরে যাও।

চন্দ্রগুপ্ত প্রশ্ন করল,

—একটা প্রশ্ন করতে পারি?

—ইচ্ছে তো নেই তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। তবুও শুনি।

—মানচিত্রর কথা তুমি জানলে কীভাবে?

কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও হো—হো করে হেসে উঠল দস্যুনেতা। ঘোড়া ছুটিয়ে দেওয়ার আগে শুধু বলল,

—দেওয়ালেরও কান আছে!

ধুলো উড়িয়ে মানচিত্রর নির্দিষ্ট পথের অভিমুখে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল প্রায় কুড়িজনের দস্যুদল। চন্দ্রগুপ্ত ও তার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে তাদের গমনপথের দিকে অসহায়ভাবে চেয়ে রইল শুধু।

জীবসিদ্ধি প্রথম কথা বলল,

—দস্যুটার শেষ কথাটার মানে কী? কেউ আমাদের কথা শুনেছিল নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

পুরুষদত্ত বলল,

—আমি অনুমান করতে পারি এ কার কাজ! একজনই তো আছে যে সর্বদা আমাদের ওপর নজর রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ে! আমি নিশ্চিত আমাদের অভিযান বিফল করতে, এই দস্যুকে আমাদের খবর আচার্য শঙ্কুমণি দিয়েছে! ওর লোক তক্ষশিলার সর্বত্র আছে! এ ওরই কাজ!

চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—সব কিছু না জেনে এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে না, ভ্রাতা। অক্ষয় প্রশ্ন করল,

—কিন্তু, এবার আমরা কী করব, চন্দ্রগুপ্ত? খালি হাতে ফিরে যাব বিশ্ববিদ্যালয়ে? এই পরাজয় যে বড়ো লজ্জার!

চন্দ্রগুপ্ত একবার জীবসিদ্ধির দিকে চকিতে তাকিয়ে নিয়ে, ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল,

—না অক্ষয়, আমরা ফিরছি না। আমরা আমাদের অভিযান সফল করব। চন্দ্রহাস উদ্ধার করব।

আদিত্য বলল,

—কিন্তু, কীভাবে? মানচিত্র ছাড়া আমরা কীভাবে পথে এগোব?

—মানচিত্র আমাদের কাছে আছে, আদিত্য।

শশাঙ্ক অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল,

—আছে? কী বলছ তুমি, চন্দ্রগুপ্ত? একটু আগে তোমারই নির্দেশে আমি মানচিত্র ওই শয়তানটার হাতে তুলে দিয়েছি! কোথায় আছে আমাদের কাছে মানচিত্র? চন্দ্রগুপ্ত মৃদু হেসে তার সঙ্গীদের দিকে ফিরল। নিজের মাথায় দু—বার তর্জনী ঠুকে উত্তর দিল,

—এইখানে!

৮.

—অর্থাৎ?

বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করল শশাঙ্ক। উত্তরে চন্দ্রগুপ্ত হেসে বলল,

—ওই মানচিত্র আমি নিজের মস্তিষ্কে বসিয়ে নিয়েছি। শুধু আমি নই, জীবসিদ্ধিও তাই করেছে। মানচিত্র না থাকলেও আমরা সহজেই পথ নির্দেশ করতে পারব।

—কিন্তু, এ কাজ তোমরা কখন করলে?

উত্তর জীবসিদ্ধি দিল,

—আমাদের যাত্রা শুরুর পর পরই যে ভাঙা সেতুর সম্মুখে আমরা এসে পড়েছিলাম তার কথা নিশ্চয়ই স্মরণে আছে। আমি ও চন্দ্রগুপ্ত লক্ষ করেছিলাম যে, ওই সেতু কেউ ইচ্ছে করে ছিঁড়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া, রাত্রি প্রহরার সময়ে বা জঙ্গলে খাদ্য জোগাড় করতে গিয়ে আমরা মাঝে মাঝেই অন্য কোনো দলের আগুন জ্বালানোর চিহ্ন দেখতে পেতাম। তার ফলে আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে, কোনো একটি দল আমাদের নজরে রাখছে।

তার কথা শেষ করল চন্দ্রগুপ্ত,

—আমাদের ওপর নজর রাখার, বা, আমাদের গতিরোধ করার একটিই উদ্দেশ্য থাকতে পারে যে, অন্য কেউ আমাদের উদ্দেশ্য জানে। তারা শুধু সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তাই মানচিত্র চুরি হওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে, সতর্কতা হিসেবে আমরা দু—জন গত কয়েক দিনের চেষ্টায় মানচিত্র মনে রাখতে সক্ষম হয়েছি। অতএব, মানচিত্র ছাড়াও আমরা সহজেই আমাদের অভীষ্টের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

—এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। আমি জানতাম, চন্দ্রগুপ্ত কিছু একটা উপায় ঠিকই করবে।

পুরুষদত্ত বলে উঠল। কিন্তু, অক্ষয় চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,

—কিন্তু, তাতেই—বা লাভ কী? এই দস্যুরা আমাদের অনেক আগেই চন্দ্ৰহাস অবধি পৌঁছে যাবে। তাদের ঘোড়া আমাদের থেকে দ্রুতগামী। আর, তারা সংখ্যায় অনেকজন। সম্মুখসমরে আমরা কখনোই পেরে উঠব না।

চন্দ্রগুপ্ত এগিয়ে গিয়ে অক্ষয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,

—এখনই নিরাশ হোয়ো না, ভ্রাতা। মাত্র কুড়িজন দস্যুকে দেখে হার মেনে নিলে চলবে কী করে? নন্দর কুড়ি লক্ষ পদাতিক সৈন্য, কুড়ি হাজার অশ্বারোহী, দুই হাজার রথ, তিন হাজার হস্তীর সৈন্যবাহিনীর সামনে তবে আমরা কী করে জিতব, ভ্রাতা? চিন্তা নেই, আমরাই সেই দৈবাস্ত্র অবধি আগে পৌঁছোব।

—কিন্তু, কীভাবে?

চন্দ্রগুপ্ত আরও একবার হেসে বলল,

—আমি আর জীবসিদ্ধি বাড়তি সতর্কতা হিসেবে আরও একটা কাজ করেছি। আমরা মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন করেছি। ওই মানচিত্র সঠিক নয়। ওতে নির্দিষ্ট পথে চললে দস্যুরা কোনোদিনই সঠিক স্থানে পৌঁছোতে পারবে না। ওরা আর কয়েক যোজন পর থেকেই ভুল পথ ধরবে।

কিছুক্ষণ কেউই কথা বলল না। তারপর উৎফুল্ল ভাবে দুই বাহু আকাশে প্রসারিত করে চিৎকার করে উঠল আদিত্য,

—জয় হোক! জয় মুরাপুত্র চন্দ্রগুপ্তর জয়! আজ থেকে তুমি হলে আমাদের দলপতি! আমাদের নেতা!

তার হর্ষে যোগ দিল অন্যরা। প্রত্যেকেই একসুরে বলে উঠল,

—জয়, চন্দ্রগুপ্তর জয়!

চন্দ্রগুপ্ত হাত তুলে তার সঙ্গীদের শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত করে বলল,

—ভ্রাতাগণ, এখনই বিজয়োল্লাসের সময় আসেনি। মনে আছে, আচার্য সবসময় কী বলেন? বিজয়ের পূর্বেই বিজয়োল্লাস যারা করে, তারা মূর্খ! এই আনন্দ আমরা সবাই একসঙ্গে পালন করব যখন দৈব অসি চন্দ্রহাস আমাদের হাতে থাকবে।

জীবসিদ্ধি তাকে সমর্থন করে বলল,

—হ্যাঁ। আজকে আমরা আর পথ চলব না। কারণ, আমরা সত্যিই অভিযান থেকে বিরত থাকছি কি না, তা নিশ্চিত করতে হয়তো দস্যুদলের কেউ ফিরে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা যদি দেখে যে, আমরা তাদের পিছু পিছু চলছি, তবে আমাদের ওরা হত্যা করবে।

—ঠিক। বরং, অপেক্ষা করা যাক। ওরা একদিনে ওই কয়েক যোজন পথ পেরিয়ে ভুল পথে চালিত হলে, আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করব। ওদের থেকে কিছুটা তফাতে থাকতে হবে আমাদের।

চন্দ্রগুপ্তর প্রস্তাবে সকলেই সম্মতি জানাল।

সেইদিন সন্ধ্যায় জীবসিদ্ধিকে একা আগুনের পাশে বসে থাকতে দেখে চন্দ্রগুপ্ত এসে তার পাশে বসল। জীবসিদ্ধিকে চন্দ্রগুপ্ত বড়োই স্নেহ করে। তার এই গুরুভ্রাতাটি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। কিন্তু, সদাসতর্ক এবং বুদ্ধিমান। তারই মতো আচার্য চাণক্যর প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা। যদিও বাকিরাও এর ব্যতিক্রম নয়। চাণক্য খুব বেছে বেছে এই ছয় ছাত্রকে নিজের শিষ্য করেছিলেন।

৯.

—কী ভাবছ, জীবসিদ্ধি?

জীবসিদ্ধি চন্দ্রগুপ্তর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল,

—দস্যুরা মানচিত্রর খোঁজ কি সত্যিই আচার্য শকুনির থেকে পেয়েছে? কিন্তু, সেই তরবারি দস্যুর হাতে তুলে দিয়ে তার লাভ কী?

—লাভ কিছু নেই। কিন্তু, তিনি যে প্রকৃতির মানুষ, তাতে তিনি আমাদের ও আচার্য চাণক্যর উদ্দেশ্য সফল হতে বাধা দিতে, সব কিছুই করতে পারেন।

—চন্দ্র, আশা রাখি ওই দস্যুদের সঙ্গে আমাদের আর দেখা হবে না। কিন্তু, যদি আগামীতে তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়, তখন? কী উপায়ে আমরা তাদের মতো বিশজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে পরাজিত করব?

চন্দ্রগুপ্ত এর উত্তর দিতে পারল না। কারণ, এর উত্তর তার জানা নেই।

আরও কয়েক দিন চলার পর, বহু দুর্গম পথ পেরিয়ে অবশেষে একটি গুহামুখে এসে থামল চন্দ্রগুপ্তরা। মানচিত্রর নির্দিষ্ট পথ এখানেই শেষ হয়েছে। অর্থাৎ, এই গুহার ভেতরেই বহুযুগ ধরে অপেক্ষায় আছে স্বয়ং দশানন রাবণের তরবারি ‘চন্দ্ৰহাস’!

—এইবার? এর ভেতরেই কি আমরা পাব আমাদের দৈবাস্ত্র?

পুরুষদত্ত প্রশ্ন করল। উত্তর শশাঙ্ক দিল,

—আমার মনে হয় না সেটা এতটা সহজ হবে। মানচিত্র এখানে শেষ হয়েছে। কিন্তু, মানচিত্রর পেছনে লেখা কথাগুলো মনে করো। আমি নিশ্চিত এটা কোনো ধাঁধা, যা আমাদের আগে সমাধান করতে হবে।

—কী যেন লেখা ছিল তাতে?

উত্তর চন্দ্রগুপ্ত দিল,

‘দুই চন্দ্রের নীচে, চন্দ্র আছে শম্ভুর।

না পেলে পথ, উত্তর দেবে কম্বুর।’

—এর মানে কী?

—জানি না। হয়তো ভেতরে গেলে উত্তর খুঁজে পাব।

ঘোড়া বেঁধে গুহার মুখে এসে দাঁড়াল তারা ছয়জন। গুহার মুখে কিছুটা আলো ঢুকলেও, ভেতরে দেখা যাচ্ছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।

আলোর ব্যবস্থা করে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। মশাল বানাতে হবে আগে। শশাঙ্ক বলল। চন্দ্রগুপ্ত তার কথায় সায় দিয়ে বলল,

—শুধু তাই নয়, চিহ্ন রেখে এগোতে হবে, যাতে গুহার মাঝে পথ হারিয়ে ফেললেও সেই চিহ্ন ধরে ধরে আমরা গুহামুখে ফিরে আসতে পারি।

জ্বলন্ত মশাল হাতে গুহায় প্রবেশ করল ওরা ছয়জন। গুহা সংকীর্ণ তাই এক এক করে সারিতে এগোতে হচ্ছিল ওদের। কিন্তু, বেশ কিছুটা এগোনোর পর গুহা চওড়া হতে শুরু করল। সবশেষে তারা এসে পড়ল একটি জলাশয়ের সম্মুখে। গুহার ওপরে একটি অর্ধচন্দ্রাকার ফাঁক। তা থেকে আলো এসে জায়গাটা আলোকিত করে রেখেছে। এখানে আর মশালের দরকার ছিল না। ওই ফাঁক থেকেই বৃষ্টির জল ভেতরে প্রবেশ করে, পাথরের এই গুহার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এই প্রাচীন জলাশয়ের।

চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ ওপরের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। অক্ষয় তাকে প্রশ্ন করল,

—কী দেখছ আকাশের দিকে, মিত্র?

চন্দ্রগুপ্ত আকাশের থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,

—বোধ হয় মানচিত্রর লেখা কথাগুলোর প্রথম পঙ্ক্তির সমাধান পেয়েছি।

—সেকী! কীভাবে?

চন্দ্রগুপ্ত ফাটলটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল,

—আকাশে থাকে চাঁদ। প্রথম চন্দ্র। তার নীচে ওই গুহার অর্ধচন্দ্রাকার ফাটল। ওটা দ্বিতীয় চন্দ্র। অর্থাৎ, এই ফাটলের নীচেই আছে তৃতীয় চন্দ্র। শম্ভু অর্থাৎ শিবের চন্দ্র! চন্দ্রহাস!

জীবসিদ্ধি বলল,

—কিন্তু, নীচে তো এই জলাশয়। তবে কি…?

তার অনুক্ত প্রশ্নের উত্তরে চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত জলের অতলে লুকোনো আছে সেই দৈব তরবারি।

নিজের অঙ্গবস্ত্র খুলতে খুলতে শশাঙ্ক বলল,

—তবে আর বিলম্ব কীসের? চলো, এখুনি জলে ডুব দিয়ে তুলে আনি সেই চমৎকার অসি!

চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—কিন্তু, দ্বিতীয় পক্তির উত্তর যে পাওয়া গেল না।

—সে দেখা যাবে। আগে চলো, জলের নীচটা পরীক্ষা করে আসি। তুমি সঙ্গে আসছ তো, ভ্রাতা চন্দ্ৰগুপ্ত?

—হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।

—আমিও যাব।

বলে অক্ষয়ও অঙ্গবস্ত্র ছুড়ে দিল একদিকে।

চন্দ্রগুপ্ত, শশাঙ্ক ও অক্ষয় ঝাঁপিয়ে পড়ল জলাশয়ের শীতল জলে। বেশ কিছুক্ষণের জন্যে তারা ডুবে রইল জলের নীচে। তারা প্রত্যেকেই সন্তরণে প্রশিক্ষিত। তাই জলাশয়ের ধারে অপেক্ষারত অন্য তিন মিত্র তাদের নিয়ে চিন্তিত ছিল না।

কিছুক্ষণ বাদে সবার আগে ওপরে ভেসে উঠল শশাঙ্ক। তাকে দেখেই আদিত্য চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল,

—পেয়েছ?

দম নিয়ে উত্তর দিল শশাঙ্ক,

—হ্যাঁ! জলের নীচেই তরবারি রয়েছে! আমরা খুঁজে পেয়েছি, ভ্রাতারা! আমরা পেরেছি!

কিছুক্ষণ বাদেই ভেসে উঠল অক্ষয় এবং সবশেষে চন্দ্রগুপ্ত। প্রত্যেকেই খুশি হলেও চন্দ্রগুপ্তকে খুব একটা খুশি মনে হল না। সে চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে এল। তাকে দেখে আদিত্য তার কাঁধে ভারী হাতের একটা আঘাত করে বলল, ,

—কী ব্যপার? আমাদের অধিনায়কের মুখ অন্ধকার কেন?

—হ্যাঁ চন্দ্রগুপ্ত, তুমি কি খুশি হওনি? তোমার নেতৃত্ব ছাড়া যে এই অভিযান কখনোই সফল হত না।

চন্দ্রগুপ্ত নিজের ভেজা কেশ মুখের ওপর থেকে সরিয়ে বলল,

—সফল এখনও হইনি, মিত্র। চন্দ্রহাস আমরা খুঁজে পেয়েছি বটে, কিন্তু তা ওই জলাশয় থেকে তুলে আনা যে অসম্ভব!

জীবসিদ্ধি জিজ্ঞেস করল,

—কেন?

চন্দ্রগুপ্ত উত্তর দিল,

—ওই তরবারি এতটাই গভীরে আছে যে, কেউই একদমে সেটা অবধি পৌঁছে, আবার জলের ওপর উঠে আসতে পারবে না। যে—ই সেটা আনতে যাবে তাকে মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে হবে। যদি—বা পৌঁছোনো যায় তরবারি অবধি, কখনোই সেটা নিয়ে উঠে আসা যাবে না। শ্বাস ফুরিয়ে জলের নীচেই তার সলিলসমাধি হবে।

সমস্যাটা উপলব্ধি করতে পেরে নিমেষে হতাশা নেমে এল সবার মধ্যে। শশাঙ্ক আর অক্ষয় জলের নীচে তরবারির দেখা পেয়ে এতটাই আনন্দিত হয়ে গিয়েছিল যে, এই বাস্তব সমস্যার কথাটা তাদের তখন মাথায় আসেনি। চন্দ্রগুপ্তর কথায় তারা উপলব্ধি করল, সত্যিই একডুবে ওই তরবারি জলের গভীর থেকে তুলে আনা অসম্ভব!

—তাহলে উপায়?

পুরুষদত্তর প্রশ্নে চন্দ্রগুপ্ত বলল, —জানি না।

১০.

কিছুক্ষণ প্রত্যেকেই জলাশয়ের দিকে চেয়ে মনমরা হয়ে বসে রইল। দিনের তৃতীয় প্রহর শুরু হয়েছে। আলো আর বেশিক্ষণ থাকবে না। লক্ষ্যের এত কাছে পৌঁছে এরকম একটা বাধার সম্মুখীন হতে হবে এটা তারা ভাবতেও পারেনি। এ যেন হাতের কাছে থেকেও নেই।

হঠাৎই জীবসিদ্ধি বলল,

—আচ্ছা, ওই মানচিত্রর দ্বিতীয় পক্তিটায় হয়তো এর উপায় লেখা আছে।

—কী যেন ছিল সেটা?

শশাঙ্কর প্রশ্নের উত্তরে জীবসিদ্ধি আরও একবার বলল,

‘না পেলে পথ, উত্তর দেবে কম্বুর।”

—এর মানে কী? কম্বুর মানে তো… ওই একপ্রকার জলজ প্রাণী। পুরুষদত্ত বলল,

—শঙ্খ। কিন্তু, সে তো সমুদ্রে থাকে শুনেছি। এই জলাশয়ে নিশ্চয়ই শঙ্খ পাওয়া যায় না।

হঠাৎ অক্ষয় লাফিয়ে উঠল,

—শঙ্খ? কী বললে? শঙ্খ, তাই না? আরে, এই তো এখানে শঙ্খ আছে।

—কই, কই?

অক্ষয় ছুটে গিয়ে গুহার পাথরের একটি ফাঁক থেকে দু—খানি বড়ো শঙ্খ বের করে আনল। বলল,

—তোমরা তিনজন যখন জলে ডুব দিয়েছিলে, তখন আমি এই গুহার আশপাশ ঘুরে দেখছিলাম। তখনই এই দুটো এখানে রাখা দেখেছিলাম। তখন এই দুটো দেখে কিছু মনে হয়নি। কিন্তু, এখন তোমাদের কথায় মনে হচ্ছে, এই দুটো এখানে লুকিয়ে রাখার বিশেষ কোনো কারণ আছে।

—দেখি শঙ্খ দুটো।

হাত বাড়িয়ে শঙ্খ দুটো অক্ষয়ের হাত থেকে নিল শশাঙ্ক। ওতে ধুলো পড়ে মলিন হয়ে ছিল। জলাশয়ের জলে ধুয়ে, অঙ্গবস্ত্র দিয়ে খানিকটা ঘষতে সেটা পরিষ্কার হল। ভালো করে সেটা পরীক্ষা করে হতাশ ভঙ্গিতে শশাঙ্ক বলল,

—নাহ্। কিছুই নেই। আশা করেছিলাম হয়তো এতে খোদাই করা কোনো লেখা থাকবে। কিন্তু, সেরকম কিছুই এতে নেই। নিতান্ত সাধারণ শঙ্খ দু—খানি। —বাজিয়ে দেখো।

পুরুষদত্তর কথায় সবাই তার দিকে চাইল। সে সবার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

—আহা! আরে বাবা, বাজিয়ে দেখতে আপত্তি কী? হয়তো এটাই রহস্যের সমাধান। শঙ্খ থেকে উত্তর হয়তো ওটা বাজালে আসবে।

—মন্দবুদ্ধির মতো কথা বোলো না, পুরুষদত্ত। শঙ্খ বাজিয়ে কী হবে?

—আরে, চেষ্টা করতে আপত্তি কী?

খানিকটা ইতস্তত করে শঙ্খ মুখের কাছে তুলে শশাঙ্ক তাতে জোরে ফুঁ দিল। তার থেকে সুন্দর শঙ্খধ্বনি নির্গত হল বটে, কিন্তু ওই অবধিই। দ্বিতীয় শঙ্খ বাজিয়েও কোনো ফল হল না। তাতে পুরুষদত্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ায় জীবসিদ্ধি হেসে বলল,

—আরে, ভ্রাতা পুরুষদত্ত, তুমি কি সত্যিই ভেবেছিলে যে, শঙ্খ বাজানো জাদুবলে জলাশয়ের জল দু—ভাগ হয়ে আমাদের পথ করে দেবে?

প্রত্যেকেই হেসে উঠল একথায়। সলজ্জ মুখে পুরুষদত্ত বসে রইল। সে বরাবরই তার মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে কল্পনাপ্রবণ। মুখে স্বীকার না করলেও সে মনে মনে এরকমই কিছু একটা অলৌকিক কাণ্ড ঘটবে বলে আশা করেছিল।

—একবার আমায় দাও দেখি।

আদিত্য নিজের জায়গা থেকে না উঠেই হাত বাড়াল। শশাঙ্ক বিরক্ত হয়ে বলল,

—তুমি আবার আলাদা করে কী দেখবে, ভ্রাতা? আমি তো বললামই যে, এই দুটো কোনো কাজের নয়। কিছুই লেখা—টেখা নেই এতে।

—আহা! তবুও একবার দেখি না। দাও দেখি এদিকে।

শশাঙ্ক নিজের জায়গা থেকে গাত্রোত্থান না করেই, তাচ্ছিল্যভরে একটি শঙ্খ ছুড়ে দিল আদিত্যর দিকে। কিন্তু, আদিত্য সেটা ধরতে পারল না এবং শঙ্খটি গিয়ে পড়ল জলাশয়ের জলে। ‘ছলাৎ’ শব্দ করে সেটা ডুবে গেল জলে।

—আরে, এ কী করলে? দিলে তো ফেলে! তোমার কি বুদ্ধি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, শশাঙ্ক?

—আমায় কেন দোষ দিচ্ছ? মুদ্গার তুলে তুলে তুমি স্থূল হয়ে গিয়েছ। সামান্য একটি বস্তু ছুড়ে দিলেও তা তোমার হাত ফসকায়!

দুই মিত্রর বিবাদ আরও কিছুক্ষণ চলত যদি না মাঝপথে জীবসিদ্ধি তাদের থামিয়ে বলত,

—আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে! এই দুশ্চিন্তার মাঝে এ কেমন বালখিল্যপনা তোমাদের? আর ওই দেখো, শঙ্খটা আবার ভেসে উঠেছে। আর বিবাদ করে কাজ নেই। যাও আদিত্য, ওটা তুলে নাও গিয়ে।

কিন্তু, আদিত্য ওঠার আগেই হঠাৎ ছুটে গিয়ে শঙ্খ তুলে নিল চন্দ্রগুপ্ত। শঙ্খটা নিয়ে হাতে তুলে সে মূর্তিবৎ দাঁড়িয়ে রইল হাঁটু অবধি জলে। শশাঙ্ক জিজ্ঞেস করল,

—কী হল চন্দ্ৰ? কী ভাবছ?

চন্দ্রগুপ্ত তার দিকে ফিরে প্রশ্ন করল,

—শঙ্খ কেন ভেসে ওঠে, বলতে পারো?

—এর অতি সহজ ব্যাখ্যা আছে। তুমি জানো না? শঙ্খর ভেতরে বাতাস ঢুকে থাকে। যেহেতু বাতাস জলের চেয়ে হালকা, তাই তা ভেসে ওঠে।

—ঠিক! ঠিক! ঠিক!

হঠাৎই চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল চন্দ্রগুপ্ত। তাকে এরকম উৎফুল্ল হতে দেখে বিস্মিত হয়ে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল বাকিরা। চন্দ্রগুপ্ত এরপর ছুটে এসে শশাঙ্কর হাত থেকে দ্বিতীয় শঙ্খ নিয়ে, দুটো শঙ্খ নিজের কটিবন্ধর সঙ্গে বেঁধে নিল। তারপর নিজের কোমরে একটি দড়ি বাঁধতে বাঁধতে বলল,

—উত্তর পেয়েছি, ভ্রাতারা! আমাদের সমস্যার সমাধান তো এই দুটো শঙ্খর মধ্যেই আছে!

—চন্দ্র, তোমার কি মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটল শেষে? কী বলছ তার একবর্ণ যে আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।

চন্দ্রগুপ্ত নিজের কোমরে দড়ি বেঁধে, দড়ির অপরপ্রান্ত শশাঙ্কর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

—এতে টান পড়লে বুঝবে আমি সংকেত দিচ্ছি। জোরে টানা শুরু করবে সবাই মিলে।

কথা শেষ করেই, তার সঙ্গীদের আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চন্দ্ৰগুপ্ত আবার জলাশয়ের জলে ঝাঁপ দিল।

জলের নীচে সূর্যের আলো এসে পৌঁছোচ্ছে। খুব স্পষ্ট না হলেও দেখা যাচ্ছে জলের নীচটা। খুব দ্রুত জলাশয়ের গভীরের দিকে সম্ভরণ করতে থাকল চন্দ্রগুপ্ত। নীচে একটি প্রস্তরের গায়ে তরবারি বিদ্ধ করা রয়েছে। আশ্চর্য যে, এত যুগের পরেও তাতে জং ধরেনি।

চন্দ্রগুপ্ত টের পেল তার ফুসফুসের বায়ু শেষ হয়ে গিয়েছে। বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। দ্রুত নিজের কটিবন্ধ থেকে একটি শঙ্খ খুলে তা নিজের মুখের ধরল চন্দ্রগুপ্ত। মুখের একটানে শঙ্খর মধ্যে থেকে বাতাস টেনে নিল নিজের বুকে। এইবার দ্রুত কাজ করতে হবে তাকে।

কোমর থেকে দড়ি খুলে তা শক্ত করে বেঁধে দিল তরবারির হাতলে। তারপর দড়ি টেনে তার সঙ্গীদের ইঙ্গিত দিল। দড়ি ধরে টানা শুরু করল জলাশয়ের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচজন। সেইসঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত নিজেও নিজের সর্বশক্তি দিয়ে টানতে লাগল তরবারির হাতল ধরে। সবার মিলিত জোরে, কিছুক্ষণ বাদেই তরবারি বেরিয়ে এল আলগা হয়ে প্রস্তরশীলা থেকে। দড়ির টানে দ্রুত সেটা উঠে যেতে লাগল ওপরের দিকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে চন্দ্রগুপ্ত টের পেল আবার তার শ্বাস আটকে আসছে। অতএব, এইবার সে দ্বিতীয় শঙ্খটা মুখে লাগিয়ে একইভাবে সেটার ভেতর থেকে বাতাস টেনে নিল নিজের ফুসফুসে। তারপর দ্রুত সাঁতরে ওপরে উঠতে শুরু করল।

প্রথমে দড়িতে বাঁধা অবস্থায় উঠে এল তরবারি। কিন্তু, তখনও চন্দ্রগুপ্ত উঠছে না দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সবাই,

—চন্দ্ৰ কোথায়?

মিত্রর বিপদ হয়েছে এই আশঙ্কায় মুহূর্তে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল শশাঙ্ক ও অক্ষয়। চন্দ্রগুপ্ত যখন প্রায় জলাশয়ের পৃষ্ঠের কাছে তখন সে আবারও তার বুকে আগুনের মতো জ্বালা অনুভব করল। তার ফুসফুসে বাতাস শেষ! বেশি সময় নিয়ে ফেলেছে সে তরবারি টেনে বের করতে। আর মাত্র কিছুটা! ওই তো! কিন্তু, তার আগেই মস্তিষ্কে বায়ুর অভাবে চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল চন্দ্রগুপ্তর। জলের অতলে তলিয়ে যেতে লাগল সে।

কিন্তু, পরক্ষণেই টের পেল দুটি পরিচিত বাহু তাকে দু—দিক থেকে ধরে ফেলল। তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর থেকে টেনে তুলে নিয়ে যেতে শুরু করল ওপরের দিকে।

.

চন্দ্রগুপ্ত চোখ খুলে দেখল, সে জলাশয়ের ধারে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে উদ্‌বিণ্ন পাঁচজোড়া চোখ তারই দিকে চেয়ে আছে। মুখ থেকে খানিকটা জল বেরোল চন্দ্রগুপ্তর। মিত্রদের মুখ দেখে মৃদু হেসে সে বলে উঠল,

—যমরাজ এসেছিলেন একটু আগে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কানে কানে বলে গেলেন, ‘তোমার মিত্ররা এক—একটি পাষণ্ড!”

উদ্‌বেগ কেটে গেল মুহূর্তে তাদের মুখ থেকে। শশাঙ্ক কপট ক্রোধের ভঙ্গিতে বলল,

—বলেছিলাম না, একে মরতেই দেওয়া উচিত ছিল আমাদের। অন্তত এর এই জঘন্য কৌতুকরস থেকে আমরা মুক্তি পেতাম।

আদিত্য হাত বাড়িয়ে দিল চন্দ্রগুপ্তর দিকে। তা ধরে তাকে টেনে উঠে বসাল আদিত্য। জীবসিদ্ধি বলল,

—জীবিতদের জগতে তোমায় পুনরায় স্বাগতম, ভ্রাতা চন্দ্রগুপ্ত।

পুরুষদত্ত এগিয়ে এসে চন্দ্রগুপ্তকে আলিঙ্গন করে বলল,

—আর কোনোদিন এভাবে আমাদের না বলে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়বে না, চন্দ্ৰ।

অক্ষয় বলল,

—হ্যাঁ। আমরা কী করতাম আমাদের অধিনায়ককে ছাড়া?

চন্দ্রগুপ্তর এতক্ষণে খেয়াল পড়ল,

—চন্দ্রহাস?

তরবারির কথাটা কারুরই খেয়াল ছিল না। চন্দ্রগুপ্তর কথায় তারা ফিরে দেখল এখনও দড়ি বাঁধা অবস্থাতেই, নিতান্ত অবহেলায় মাটিতে পড়ে আছে সেটা। জীবসিদ্ধি এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে আনল। চন্দ্রগুপ্ত ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার সামনে হাঁটু গেড়ে হঠাৎই বসে পড়ল জীবসিদ্ধি। দু—হাতে অস্ত্র সমর্পণ করার ভঙ্গিতে চন্দ্রগুপ্তর হাতে তুলে দিল দৈব অসি। বলল,

—চন্দ্র থাক চন্দ্ররই হাতে।

অতি নাটকীয়তা দেখে হেসে উঠল চন্দ্রগুপ্ত। হাতে তুলে নিল অজেয় অসি চন্দ্রহাস। পরক্ষণেই তার পাঁচ গুরুভ্রাতা ঠিক জীবসিদ্ধিরই ভঙ্গিতে এক হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল তার সামনে। নিজেদের অস্ত্র বের করে তা মাটিতে নামিয়ে রাখল। এবং, সামরিক কায়দায় ডান হাত মুঠো করে বাম বুকের কাছে এনে অভিবাদন জানিয়ে বলে উঠল,

—সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর জয় হোক! আমরা আজ থেকে তোমাকে নিজের অধিনায়ক রূপে গ্রহণ করছি। আজ থেকে তোমার আদেশে আমরা প্রাণ নিতে পারি, প্রাণ দিতে পারি।

এই কথাগুলো যোদ্ধাদের সামরিক শপথের বাণী। এর দ্বারা নিজেদের রাজার কাছে সেনাপতিরা নিজেদের আনুগত্য জানায়।

—ওঠো, তোমরা। উন্মাদ হলে নাকি?

উঠে দাঁড়াল প্রত্যেকে। তাদের মুখে বিজয়ীর গর্ব! তারা পেরেছে! তারা পেরেছে দৈবাস্ত্র উদ্ধার করতে। তাদের অভিযান আজ সফল হয়েছে।

এইবার তাদের ফেরার পালা। তাদের আচার্য যে তাদের পথ চেয়ে আছেন বহুদিন ধরে।

১১.

পথের ধারে রেখে আসা চিহ্নগুলো ধরে চন্দ্রগুপ্ত ও তার গুরুভ্রাতারা গুহার প্রবেশ—মুখ অবধি পৌঁছে গেল। কিন্তু, গুহার বাইরে পা রাখতেই তাদের থেমে যেতে হল। কারণ, গুহার প্রবেশপথ ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জনা বিশ সশস্ত্র দস্যু!

—এসো এসো। তোমাদেরই অপেক্ষায় ছিলাম আমি।

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে সেদিকে দৃষ্টি দিতেই তারা দেখল একটি প্রস্তরখণ্ডের ওপর বসে আছে তাদের সেই পরিচিত দস্যুনেতা। ছয় কিশোরের মুখে বিস্ময়ের ভাব দেখে সে সহাস্যে বলল,

—অবাক হচ্ছ আমায় দেখে? ভাবছ যে, আমি এখানে কীভাবে এলাম? খুব সহজ। তোমাদের পিছু নিয়ে এলাম। আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে, মানচিত্রে হয়তো কোনো গণ্ডগোল আছে। তা ছাড়া, ওই পেছনে লেখাগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থও উদ্ধার করতে পারলাম না। তাই ঠিক করলাম তোমাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখি। তোমাদের পিছু নিয়ে ঠিক সময়ে, ঠিক স্থানে পৌঁছে গিয়েছি তা তো দেখতেই পাচ্ছ।

চন্দ্রগুপ্তর হাতে ধরে থাকা তরবারিটির দিকে নজর পড়ল দস্যুনেতার।

—আহা! ওই তো! ওটাই নিশ্চয়ই সেই দৈবাস্ত্র! দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কী জৌলুস! এত যুগ পরেও যেন আকাশের একফালি বিদ্যুতের রেখার মতো চমকাচ্ছে! ওটা দাও, চন্দ্রগুপ্ত! নাহলে তুমি হয়তো ওই তরবারি ব্যবহার করে আমাদের পরাজিত করতে পারবে, কিন্তু তোমার সঙ্গীদের মাথা তাদের ধড় থেকে আগে আলাদা হবে!

চন্দ্রগুপ্তর নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হল। তার হাতে অজেয় তরবারি, কিন্তু তবুও এই দস্যুর সামনে নিজেকে অসহায় মনে হল ওর। শেষ চেষ্টা করতে বলল,

—নিজের দলের মধ্যে থেকে সবাই বীরপুরুষ সাজতে পারে। কিন্তু, আমি জানি তুমি কাপুরুষ! আমি তোমায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি, দস্যু! শুধু আমি আর তুমি, এখানে, এই মুহূর্তে যুদ্ধ করব। দেখা যাক, কত বড়ো যোদ্ধা তুমি!

দস্যুরা হেসে উঠল প্রত্যেকে। দস্যুনেতা বলল,

—কিন্তু, আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাব কেন? আমি যেখানে সহজেই তোমাদের হত্যা করে আমার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি লাভ করতে পারি!

চন্দ্রগুপ্ত জানে, কথাটা সত্যি। তার সঙ্গে এক—এক যুদ্ধ করার কোনো কারণ দস্যুর নেই। তাই দস্যুর অহং—এ আঘাত করতে চন্দ্রগুপ্ত বলল, ,

—কেন? ভয় পেলে নাকি? শেষে এক কিশোরের সঙ্গে যুদ্ধে ভয়? ওহে দস্যুগণ, তোমাদের নেতা কি এতটাই কাপুরুষ?

অন্য একজন দস্যু রেগে চিৎকার করে উঠল,

—মুখ সামলে কথা বল, মূর্খ বালক! তুই জানিস না তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস! হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল দস্যুনেতা। মুহূর্তে খানিকটা ভয় পেয়েই যেন পিছিয়ে গেল দস্যুটি। অনুমতি ছাড়া কথা বলায় দলপতি রেগে গিয়েছে বুঝতে পেরেছে সে।

দস্যুনেতা বলল,

—বেশ। আমি যুদ্ধে প্রস্তুত। কিন্তু, ওই অজেয় তরবারি হাতে নিয়ে যে কেউই বীর বিক্রম হয়। সাহস থাকলে…

কথা শেষ করার আগেই চন্দ্রগুপ্ত চন্দ্রহাস ঘুরিয়ে মাটিতে গেঁথে দিল। বলল, —এই রইল দৈব অসি! আমি তোমার সঙ্গে নিজের এই সাধারণ তরবারি দিয়েই যুদ্ধ করব, বা, যেকোনো অস্ত্র যা তুমি বলবে, তা দিয়েই যুদ্ধ করব! কিন্তু কথা দাও যে, তুমি পরাজিত হলে তুমি আমাদের চন্দ্রহাস সমেত নিরাপদে যেতে দেবে?

ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপাত্মক হাসি হেসে লোকটা বলল,

—তাই হবে।

বলে নিজের কটিবন্ধ থেকে ঝুলতে থাকা তরবারি বের করে আনল। চন্দ্রগুপ্তও নিজের তরবারি বের করল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। দু—জনেরই হাতে খোলা তরবারি। দু—জন একে অন্যের চোখে চোখ রেখে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপরেই দু—জন তরবারি নিয়ে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল একে অন্যের ওপর!

প্রথমে দস্যুনেতা আশা করেছিল যে, এই কিশোরকে সে সহজেই হারিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু, কিছুক্ষণ চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে অসিযুদ্ধ করার পরেই সে বুঝতে পারল যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ কোনো কিশোর মাত্র নয়। দৈহিক বল তার কম, কিন্তু সেটার পরিপূরক হল তার ক্ষিপ্রতা।

দস্যু বুঝতে পারল যে, গুরুত্ব না দিলে তার প্রাণ যাবে এই কিশোরের হাতে। চন্দ্রগুপ্তর পাঁচ সঙ্গী রুদ্ধশ্বাসে এই যুদ্ধ দেখছিল। এবং, অবাক হচ্ছিল। এক অদ্ভুত কৌশলে যুদ্ধ করছে চন্দ্রগুপ্ত। এ তার অস্ত্র গুরুর শেখানো যুদ্ধশৈলী নয়, এমনকী তাদের কারুর মতো নয়। চন্দ্রগুপ্তর যুদ্ধশৈলী আসলে সবার মিলিত এক যুদ্ধশৈলী। চন্দ্রগুপ্ত প্রত্যেকের থেকে শিখেছে। আর সব মিলিয়ে মিশিয়ে সে নিজস্ব এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের যুদ্ধকৌশল আয়ত্ত করছে! তার অস্ত্র চালনা, শরীরের চাল সব কিছু প্রতিপক্ষর কাছে অনির্দেশ্য। তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে, তার প্রায় দ্বিগুণ আকারের দস্যুনেতার ঘাম ছুটছে।

ঠিক যখন মনে হচ্ছিল যে, চন্দ্রগুপ্ত জিতে যাবে, তখনই একটি অঘটন ঘটল। দস্যুর তরবারির একটা আঘাত লাগল চন্দ্রগুপ্তর ডান হাতে! সময়মতো পিছিয়ে গিয়ে গুরুতর আঘাত এড়িয়ে গেল বটে। কিন্তু এই আঘাত নিয়ে, ভারী তরবারি উঠিয়ে যুদ্ধ করা অসম্ভব।

হতাশার একটা চাপা শব্দ বেরিয়ে এল চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গীদের মুখ থেকে। সেইসঙ্গে এতক্ষণ চিন্তিত চিত্তে যুদ্ধ দেখতে থাকা দস্যুদলের দিক থেকে হর্ষধ্বনি উঠল।

দস্যুনেতা তরবারি বাগিয়ে বলল,

—হার স্বীকার করো, চন্দ্রগুপ্ত!

চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ ভাবল এবং তারপর একটা অদ্ভুত কাজ করল। ডান হাত থেকে তরবারি তার বাম হাতে নিল।

আদিত্য বিড়বিড় করে বলে উঠল,

—কী করছে চন্দ্রগুপ্ত?

প্রত্যেকেই ভেবেছিল এটা চন্দ্রগুপ্তর হারের মুখে এক দুর্বল, মরিয়া প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু, সবাইকে বিস্মিত করে চন্দ্রগুপ্ত আগের মতো, ঠিক একই কৌশলে যুদ্ধ শুরু করল বাম হাতে তরবারি নিয়ে!

সবাই বিস্মিত হয়ে দেখতে থাকল প্রায় অলৌকিক এই দৃশ্য। সবচেয়ে হতভম্ব অবস্থা দস্যুনেতার। সে কোনোদিন এরকম দুর্ধর্ষ যোদ্ধা দেখেনি যে, দু—হাতেই সমানে যুদ্ধ করতে সক্ষম।

দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল অক্ষয়,

—এই! এইটাই! আচার্য চাণক্য এর কথাই তো বলেছিলেন যে, প্রত্যেক যোদ্ধার কোনো বিশেষ কৌশল থাকে। চন্দ্রগুপ্ত শেষপর্যন্ত নিজের বিশেষত্ব খুঁজে পেয়েছে! জীবসিদ্ধি বলে উঠল,

—সব্যসাচী!

—হ্যাঁ। চন্দ্রগুপ্ত দুই হাতেই অস্ত্রচালনায় সমান পারদর্শী! চন্দ্রগুপ্ত সব্যসাচী!

—শুধু তাই নয়, ও এতদিন আমাদের থেকে শিখেছে। আমরা সবাই যেখানে এক—একটি অস্ত্র কৌশল রপ্ত করেছি, সেখানে ও প্রতিটি কৌশল আমাদের থেকে গ্রহণ করেছে! আমাদের সবার কৌশল একত্রে ওর মধ্যে রয়েছে!

চিৎকার করে উঠল তার মিত্ররা,

—জয় হোক! জয় হোক চন্দ্রগুপ্তর! পরাস্ত করো ওই দস্যুকে!

সবাই অবাক হয়ে দেখল পিছিয়ে যাচ্ছে দুর্ধর্ষ দস্যুনেতা। চন্দ্রগুপ্তর অদ্ভুত যুদ্ধশৈলী তাকে দ্বিধায় ফেলছে। সে প্রতিপক্ষর পরবর্তী আঘাত অনুমান করতে পারছে না। হাত, পা, কাঁধ, মাথা, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ দিয়ে যুদ্ধ করছে চন্দ্রগুপ্ত! যেন অসিযুদ্ধ ও মল্লযুদ্ধ একসঙ্গে করছে সে।

মুহুর্তের অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে পায়ের এক অদ্ভুত মল্লযুদ্ধের প্যাঁচে, দস্যুনেতার পায়ে আঘাত করে তাকে ধরাশায়ী করল চন্দ্রগুপ্ত। সামলে ওঠার আগেই তার গলায় চন্দ্রগুপ্ত তার তরবারি ছোঁয়াল।

—আমি জয়ী হলাম, দস্যু! মনে রেখো, আমি চাণক্যশিষ্য চন্দ্রগুপ্ত আজকে তোমায় পরাজিত করেছি!

তরবারি ফেলে দুই হাত মাথার ওপর তুলে উঠে দাঁড়াল দস্যু। বলল,

—হ্যাঁ, পরাজয় স্বীকার করলাম।

আনন্দে লাফিয়ে উঠল চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গীরা। চন্দ্রগুপ্ত এগিয়ে গিয়ে চন্দ্ৰহাস তুলে নিল নিজের হাতে। উৎফুল্লতার প্রকাশে তার সঙ্গীরা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরতে গেল চন্দ্রগুপ্তকে। আর, সেখানেই ভুল করে ফেলল অনভিজ্ঞ কিশোরের দল!

চোখে চোখে নির্দেশ দিল দস্যুনেতা। সেই কয়েক মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে চারজন দস্যু ঝাঁপিয়ে পড়ল সবচেয়ে পেছনে থাকা জীবসিদ্ধির ওপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জীবসিদ্ধির গলায় দুটো তরবারি এসে ঠেকল।

চন্দ্রগুপ্ত তরবারি তুলে নিয়ে চিৎকার করে উঠল,

——বিশ্বাসঘাতক! তুমি শপথ করেছিলে!

হেসে দস্যুনেতা উত্তর দিল,

—তোমার বিদ্যালয়ের যুদ্ধক্ষেত্র আর বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্রর একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য এইবেলা শিখে রাখো, চন্দ্রগুপ্ত। বাস্তবের যুদ্ধে কোনো নিয়ম হয় না! দস্যুর থেকে সততা আশা করে যে, সে মূর্খ!

১২.

—চন্দ্রহাস আমাকে দিয়ে দাও, অন্যথায় জেনে রেখো তোমার এই মিত্রর সঙ্গে যা হবে, তার জন্যে তুমি দায়ী থাকবে।

দাঁতে দাঁত চেপে বলল দস্যুনেতা। উত্তরে জীবসিদ্ধি চিৎকার করে উঠল,

—কখনো না! একে ওই অস্ত্র দিলে ধ্বংস ডেকে আনবে সারাদেশে।

চন্দ্রগুপ্ত একবার তার হাতে ধরা অজেয় দৈব অসিটির দিকে দেখল। শত্রুদের হাতে বন্দি গুরুভ্রাতা জীবসিদ্ধির দিকে দেখল। নির্ণয়টা বড়ো সহজ ছিল চন্দ্রগুপ্তর জন্যে।

তরবারি ছুড়ে দিল সে দস্যুর দিকে।

—জীবসিদ্ধিকে ছেড়ে দাও।

কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দস্যুনেতা।

—এত সহজে মেনে নিলে? এই দৈবাস্ত্র, যা তোমাকে অসীম ক্ষমতা দেবে তা এত সহজে ত্যাগ করলে?

চন্দ্রগুপ্ত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,

—তুমি যা চেয়েছ, তা পেয়েছ। তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। এবার আমাদের মুক্তি দাও।

চন্দ্রহাস তুলে নিল দস্যুপতি। ইশারায় তার দলকে ঘোড়ায় উঠতে বলে নিজেরাও ঘোড়ায় চেপে বসল। যদিও প্রত্যেকের হাতের তরবারি হাতেই রইল।

—তোমাদের ছেড়ে দেব? ভাবলে কীভাবে? আমার সঙ্গে ছলনার চেষ্টা করেছ তোমরা!

—কিন্তু, চন্দ্রগুপ্ত তোমায় সম্মুখযুদ্ধে হারিয়েছে, দস্যু! তাতে কোনো ছলনা ছিল না। ছল তুমি আমাদের সঙ্গে করলে!

আদিত্য চেঁচিয়ে বলল। উত্তরে বিশ্রী হেসে উঠল দস্যুরা। দলপতি বলল,

—হ্যাঁ। আর তাই তোমাদের এখুনি প্রাণে মারব না। তোমরা ছ—জন গুহার দিকে এগিয়ে চলো।

কী করতে চাইছ তুমি আমাদের সঙ্গে?

—বৃথা বাক্যব্যয় না করে এগিয়ে যাও।

ঘোড়ায় চড়া দস্যুরা ভল্ল ও তরবারির মাথায় তাদের এগিয়ে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল গুহার মধ্যে। তারপর দুই দস্যু নেমে একটি বড়ো পাথরের চাঁই দড়ি দিয়ে বেঁধে দিল চারটে ঘোড়ার সঙ্গে।

চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—তুমি আমাদের গুহাবন্দি করে যেতে চাইছ? মুক্তি দাও আমাদের, শঠ!

—কখনো না। দেখো, গুহার ওদিকে বেরোনোর অন্য কোনো মুখ খুঁজে পাও কি না। আর না পেলে…।

আবারও বিশ্রী হেসে উঠল দস্যুরা। চারটে ঘোড়ার শক্তি দিয়ে একটি বিশাল প্রস্তর গড়িয়ে এনে গুহামুখ ঢেকে দিল। ভিতরে বন্দি হল চন্দ্রগুপ্ত ও তার ছয় সঙ্গী।

দুটো মশাল তখনও জ্বলছিল। তাই কিছুটা আলো ছিল। পুরুষদত্ত চন্দ্রগুপ্ত দিকে ফিরে বলল,

—এখন উপায়?

চন্দ্রগুপ্ত একটু ভেবে বলল,

—জলাশয়ের কাছেই যাওয়া যাক। এই পাথর সরানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। খাবার কি কিছু আছে তোমার কাছে, অক্ষয়?

—হ্যাঁ। সামান্য আছে। আজকের রাতটুকু চলতে পারে।

—এ কী জীবসিদ্ধি, তুমি এরকম বিমর্ষ হয়ে পড়লে কেন?

জীবসিদ্ধি হতাশায় মাথা নেড়ে বলল,

—কেন? কেন তুমি তরবারি দিয়ে দিলে ওকে? আমার প্রাণের মূল্য কি ওই দৈবাস্ত্রর চেয়ে অধিক?

চন্দ্রগুপ্ত হেসে বলল,

—অবশ্যই, ভ্রাতা! এই বিষয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। আমি জানি যে, একই অবস্থায় তুমি থাকলে তুমিও আমাকে বাঁচাতে এটাই করতে। এখানে উপস্থিত সবাই তাই করত। মনে করো, আচার্য আমাদের কী মূলমন্ত্র শিখিয়েছেন। আমরা একা দুর্বল। আমরা একমাত্র একসঙ্গেই শক্তিশালী! আমরা একসঙ্গে নতুন আর্যাবর্ত গড়ে তুলব। এ যুদ্ধে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা অপরিহার্য।

আদিত্য বলল,

—চন্দ্র ঠিক বলেছে, জীবসিদ্ধি। দোষ আমাদেরই। আমরাই অসতর্ক ছিলাম। —এবার চলো। দিনের আলো শেষ হতে বেশি দেরি নেই। তার আগেই একটা উপায় করতে হবে।

গুহাপথের পাশে পাশে, কিছুটা অন্তর ছোটো ছোটো পাথরের স্তূপ করে চিহ্ন আগেই করা ছিল। মশালের আলোয় সেই পথ ধরে এইবার সহজেই পথ চলতে থাকল ওরা। কিন্তু, জলাশয়ের কাছাকাছি পৌঁছোতেই পায়ে জলের ছোঁয়া পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল সবার আগে চলতে থাকা শশাঙ্ক।

—আরে, এ কী! এখানে জল এল কী করে?

—তাই তো, শুনে দেখো জল ঢোকার শব্দ হচ্ছে কোথাও থেকে। শুনতে পাচ্ছ? একটু খুঁজতেই জলের উৎস খুঁজে পাওয়া গেল। বেশ কিছু পাথরের ফাঁক থেকে জল ঢুকছে। কিন্তু, সেই ফাঁকগুলো এতটাই ছোটো যে, তা দিয়ে মানুষ বেরোতে পারবে না। শশাঙ্ক বলল,

—সামনেই কোনো নদীর জল ঢুকছে গুহায়। জোয়ারের জল।

আলো এমনিতেই কমে এসেছে। পুরুষদত্ত ভালো করে গুহার উঁচু পাথুরে ছাদের সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি ফাটলটা দেখার চেষ্টা করে বলল,

—সম্ভবত রোজই জল ঢোকে এখানে এই সময়ে। তারপর আবার নেমে যায়। দেখো ওই উঁচু ছাদ অবধি শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ গজিয়ে আছে। তার মানে জলে গোটা গুহা ভরে যায়।

—সর্বনাশ! তবে আমরা যে ডুবে মারা যাব।

চন্দ্রগুপ্ত এতক্ষণ কিছু ভাবছিল। এবার বলল,

—আমি কিন্তু মুক্তির পথ দেখতে পাচ্ছি এতে।

জীবসিদ্ধি জিজ্ঞেস করল,

—কীভাবে?

চন্দ্রগুপ্ত ওপরের ফাঁকের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,

—আমাদের সঙ্গে যা দড়ি আছে তা ওই উঁচু অবধি পৌঁছোতে পারবে না। কিন্তু, গুহায় জল ভরতে শুরু করলে, আমরা যদি কিছু সময় ভেসে থাকতে পারি, আমরা কিন্তু ওই ফাটলের কাছে পৌঁছে যাব। তখন দড়ি ছুড়ে আমরা উপরে আটকে দিতে পারব। ওই অর্ধচন্দ্রাকার ফাটলটাই হবে আমাদের মুক্তির পথ!

—সাধু! সাধু! তাহলে এখুনি সবাই শুকনো গাছের ডাল খোঁজো যাতে ভর করে ভেসে থাকা যায়।

দ্রুতহস্তে কাজ করল সবাই। শুকনো ডালপালা জুড়ে একটি ছোটো ভাসমান ভেলা তৈরি করল। তাতে ছয়জন উঠতে না পারলেও, অন্তত ভর দিয়ে ভেসে থাকতে পারবে। তা ছাড়া, প্রত্যেকেই সত্তরণে পটু।

জল ক্রমেই কোমর ছাড়িয়ে উঠল। একসময়ে ওদের পা গুহার পাথুরে মেঝে ছাড়ল। জল ক্রমেই বেড়ে চলল। চন্দ্রগুপ্তরা ভেসে রইল বহু কষ্টে। একসময় প্রায় অর্ধেক গুহা যখন জলে ভরে গিয়েছে তখন শশাঙ্ক বলল,

—গুহার দেওয়ালে জলের দাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, জল তার চরম উচ্চতা ছুঁতে চলেছে। জল আর বাড়বে না। এবার নামা শুরু হবে যেকোনো মুহূর্তে। অতএব, এই সুযোগ!

চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—ঠিক। ভেলায় তুমি চেপে বোসো, পুরুষদত্ত। আরও একবার তোমার অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের ওপর আমরা ভরসা রাখছি।

—কিন্তু… কিন্তু দেখো ওপরে! আজ অমাবস্যা, তার ওপর মেঘলা আকাশ! ওপরে যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না! পুরুষদত্ত লক্ষ্যভেদ করবে কী করে? চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—পুরুষদত্ত, ভ্রাতা, তুমি কি ওপর থেকে ভেসে আসা পেঁচার ডাক শুনতে পাচ্ছ?

পুরুষদত্ত কান করতে শুনতে পেল সত্যিই… ওপর থেকে একটি পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ, ধরে নেওয়া যায় সে একটি গাছের ওপর বসে আছে। এই পরিস্থিতিতেও পুরুষদত্তর ঠোঁটে হাসি ফুটল। বলল,

—তোমার ইঙ্গিত আমি বুঝতে পেরেছি, চন্দ্র!

প্রত্যেকে ভেলা ছেড়ে দিল কিছুক্ষণের জন্যে। টলোমলো ভেলায় উঠে দড়ি বাঁধা একটি বাণ ধনুকে চড়াল পুরুষদত্ত। আজ তার শ্রেষ্ঠ বিদ্যার পরীক্ষা।

যদিও নিকষ অন্ধকার। তবুও চোখ বন্ধ করে একাগ্রভাবে শব্দটা শুনল পুরুষদত্ত। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই লক্ষ্য স্থির করে তিরসহ ধনুকের ছিলা টেনে ধরল। মুক্ত হতেই বাণ ছুটে চলল অন্ধকার ভেদ করে!

১৩.

সূর্যের আলো এসে চন্দ্রগুপ্তর মুখে পড়তে তার ঘুম ভাঙল। কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ওর মনে করতে যে ও কোথায় আছে।

গুহা থেকে উঠে আসার পর, সারারাত্রি পাহাড়ের ওপরেই শুয়ে ছিল ওরা ছ—জন।

চন্দ্রগুপ্ত উঠে বসতেই অক্ষয় তার কাছে এসে তাকে একটি পাতায় করে কিছুটা লতাপাতা থেঁতো করে এনে বলল,

—এটা খেয়ে নাও। এতক্ষণ জলে থাকার জন্যে সারারাত ভেজা কাপড়ে ছিলাম আমরা। শরীর নিশ্চিতভাবেই এই অত্যাচার সইবে না। এই প্রতিষেধক ক্ষমতাবর্ধন ঔষধিটা সেবন করো। শরীর ঠিক থাকবে এতে।

বিনা প্রশ্নে সেটা গিলে নিল চন্দ্ৰগুপ্ত। এত বিস্বাদ ও তিক্ত বস্তু চন্দ্রগুপ্ত খুব কমই খেয়েছে। মনে হল যেন মুখ থেকে গলা অবধি জ্বালিয়ে দিয়ে সেটা নামল। কিন্তু, পরমুহূর্তেই শরীরে একটা উষ্ণতা যেন ছড়িয়ে পড়তে টের পেল চন্দ্ৰগুপ্ত।

—এই ঔষধি বানানোর সামগ্রী পেলে কোথায়?

—কিছু জড়িবুটি আর একটি বিশেষ গাছের মূল এই জঙ্গল থেকেই পেয়ে গেলাম। পাথর দিয়ে থেঁতো করে বানালাম।

—সবাইকে দিয়েছ? তুমি নিজে নিয়েছ?

—সব হয়েছে।

—অন্যরা কই?

—খাদ্যের জন্যে ফল ও মাংস জোগাড় করতে গিয়েছে। আগে শরীরে বল এলে, আমরা পাহাড় থেকে নীচে নামার পথ ধরব। ঘোড়া ও আমাদের তৈজসপত্র দস্যুরা রেখে যাবে এ দুরাশা আমার নেই।

চন্দ্রগুপ্ত কিছু বলল না। চুপচাপ আবার শুয়ে পড়ল। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল। অক্ষয় কাঠ জোগাড় করে তাতে অগ্নি সংযোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ বাদে তার অন্য সঙ্গীরা ফিরে এল। আদিত্য চন্দ্রগুপ্তকে দেখে তার পিঠে আবারও জোরে একটি চপেটাঘাত করে বলল,

—কী হে, ভ্রাতা চন্দ্র? এরকম বিরসবদনে বসে আছ কেন? দৈবাস্ত্র হাতছাড়া হয়েছে বলে শোকাহত বুঝি?

আদিত্য বিষয়টা যতই হালকা করার চেষ্টা করুক, প্রত্যেকেই মর্মাহত। জয়ের এত কাছে এসে হেরে যাওয়ায় সকলেই বিষণ্ন। আদিত্য বলল,

—কী আর করা যাবে, বন্ধু? দেবতারা আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট। অদৃষ্টে আমাদের লেখা ছিল না ওই অস্ত্র।

চন্দ্রগুপ্ত মৃদু হেসে বলল,

—না। তা নয়। আমরা যে এখনও অক্ষত আছি আমি এতেই খুশি। আমরা এই অভিযানে বারংবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। এই—বা কম কী? নেহাতই দৈবের জোরে আমরা এই অবধি পৌঁছেছি।

—শুধুই দৈব নয়, ভ্রাতা। তোমার নেতৃত্বও এর জন্যে দায়ী। চলো, ওঠো এবার। গতকাল থেকে তো উদরে একটি দানা পড়েনি।

পেট ভরে ফল ও মাংস খেয়ে প্রত্যেকেই দেহে বল ফিরে পেল। দিনের দ্বিতীয় প্রহর শুরু হতেই তারা নেমে আসতে শুরু করল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর তারা আবার গুহামুখের সামনে এসে দাঁড়াল এবং চমকে গেল।

—এ কী! গুহামুখ যে খোলা!

—তাই তো! ভারী পাথরটা কেউ সরিয়ে দিয়েছে।

—কিন্তু, ঘোড়ার বল ছাড়া তো এই ভারী পাথর সরানো সম্ভব নয়।

—তবে কি দস্যুরাই? কিন্তু, কেন? হঠাৎ সদয় হবে কেন তারা?

—হতে পারে, মাঝপথে তারা মত পালটায়। আমাদের হত্যা করতে ফিরে আসে। কিন্তু, গুহায় কিছুটা এগোতেই যখন দেখতে পায় যে, গোটা জায়গাটা ডুবে গিয়েছে, অতএব তারা ধরেই নেয় যে, আমাদের জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে।

—হ্যাঁ। সম্ভবত সেটাই হয়েছে। তাই গমনপথে পুনরায় পাথর দিয়ে পথ আটকানোর প্রয়োজন ওরা বোধ করেনি।

নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করছিল ওরা। শুধু চন্দ্রগুপ্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। জীবসিদ্ধি তার কাছে জানতে চাইল,

—তোমার কী মতামত, চন্দ্ৰ? ‘

চন্দ্রগুপ্ত সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল,

—আমাদের ঘোড়াগুলো সম্ভবত জায়গামতো পেয়ে যাব। চলো, আর সময় নষ্ট না করে ফেরা যাক। এই অভিযান শেষ হয়েছে।

চন্দ্রগুপ্তর অনুমান ঠিক ছিল। তারা যেখানে ঘোড়া ও তৈজসপত্রাদি ছেড়ে গিয়েছিল, তা জায়গামতো খুঁজে পেল। ঘোড়ার পিঠে চেপে ফেরার পথ ধরল তারা।

তাদের অভিযান শেষ হয়েছে। কিন্তু, সফল হয়নি। তাই কেউই খুব বেশি উৎফুল্ল ছিল না। সামনে আবার দীর্ঘদিনের পথ।

চন্দ্রগুপ্ত বড়ো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। তাকে উৎসাহ দেওয়ার প্রয়াস করতে তার মিত্ররা কোনো কসুর করল না। কিন্তু, তবুও চন্দ্রগুপ্ত যেন সারাদিনই কিছু একটা ভাবতে থাকে।

একদিন ঘোড়ায় পাশাপাশি চলার সময়ে জীবসিদ্ধি তাকে প্রশ্ন করল,

—তুমি কী নিয়ে এত চিন্তিত, ভ্রাতা? চন্দ্রহাস আমরা পাইনি তার গ্লানিতে নিজেকে দগ্ধ করে তো কোনো লাভ নেই, চন্দ্র। বরং, আমরা সেটা ওই দস্যুদের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে পারি।

চন্দ্রগুপ্ত অসম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বলল,

—না। আমরা আগে তক্ষশিলায় ফিরব। সবার আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন।

—প্রশ্ন? কোন প্রশ্ন?

—দস্যুরা আমাদের অভিযানের বিষয়ে জানল কীভাবে? মানচিত্রতে পরিবর্তন করা হয়েছিল সেটা কীভাবে দস্যুনেতা বুঝতে পারল? আর সবথেকে বড়ো প্ৰশ্ন, গুহাদ্বার থেকে পাথরটা কে ও কেন সরাল?

বিস্মিতভাবে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,

—তুমি মনে করো এইসব প্রশ্নের উত্তর তুমি তক্ষশিলায় পাবে? —আমি নিশ্চিত যে, এর উত্তর আমরা তক্ষশিলাতেই পাব।

১৪.

তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়। সময় রাত্রির প্রথম প্রহরের মাঝামাঝি।

প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর কক্ষে তাঁর সঙ্গে গভীর আলোচনায় ডুবে আছেন চাণক্য। একপাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের কথা শুনছে সুভাষিণী। প্রয়োজনে নিজের মতামত ব্যক্ত করছে।

আজকের আলোচনার বিষয় ‘অলকশেন্দ্র’। সুদূর ম্যাসিডন দেশের যবন সম্রাট অলকশেন্দ্র।

চাণক্য বলছেন,

—অলকশেন্দ্র নিজেকে দেবপুত্র বলে দাবি করে। তার বিশাল সেনাবাহিনী ও তাকে দেবরাজ ইন্দ্রর ন্যায় পুজো করে বলে শুনেছি। তার জন্ম নিয়েও অনেক রোচক কাহিনি প্রচলিত আছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, যবনরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং ধর্মভীরু। শুভ—অশুভ, দৈবলক্ষণ ইত্যাদির ওপর নাকি তাদের অগাধ বিশ্বাস।

ভদ্রভট্ট মৃদু হেসে বললেন,

—মানুষ অলৌকিক ভালোবাসে, বিষ্ণু। তারা ভাবতে ভালোবাসে যে, কোনো ঊর্ধ্বতন শক্তি আমাদের নজর রাখছে। আমাদের ভালো—মন্দ বিচার করছে। সুভাষিণী প্রশ্ন করল,

—আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন, জ্যেষ্ঠ?

—আমি কর্মফলে বিশ্বাসী, সুভাষ। আমি মনে করি মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতেই হয়। হয় তা দৈবের আঘাতে, অথবা, কোনো মনুষ্যকেই উদ্যোগী হতে হয় পাপীকে তার কর্মফল ফিরিয়ে দিতে।

চাণক্য বললেন,

—ঠিক বলেছেন, গুরুদেব। আমিও আপনারই মন্ত্রে দীক্ষিত। অলকশেন্দ্র এইসব কাহিনি প্রচার করে আসলে একধরনের মানসিক যুদ্ধ খেলে তার শত্রুদের সঙ্গে। আগে থেকেই শত্রুদের কাছে এই ধারণা যায় যে, তারা স্বয়ং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে। এতে তারা মানসিকভাবে প্রথমেই কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আর অলকশেন্দ্রর নিজের বাহিনীর ওপর এর প্রভাব পড়ে পুরো উলটো। তারা মনে—প্রাণে বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বর তাদের সঙ্গে রয়েছে। অতএব, তারা প্রচণ্ডভাবে উৎসাহী হয়ে যায় যুদ্ধে। কারণ, তারা অন্ধবিশ্বাসী।

ভদ্রভট্ট আবারও মৃদু হেসে বললেন,

—এই অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মভীরুতাকেই কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যায়। যদি একবার তাদের এই বিশ্বাসে আঘাত করা যায়, তাহলে অর্ধেক যুদ্ধ ওখানেই জিতে যাওয়া হবে।

আলোচনা আরও কিছুক্ষণ চলত কিন্তু তখনই এক কর্মচারী এসে জানাল যে, চন্দ্রগুপ্তরা ফিরে এসেছে। তারা আচার্য চাণক্যর দর্শনপ্রার্থী।

চাণক্য ও প্রধানাচার্য চকিত দৃষ্টি বিনিময় করলেন। প্রধানাচার্য নির্দেশ দিলেন,

—ওদের এই কক্ষে পাঠিয়ে দাও।

চাণক্য সেইসঙ্গে জুড়ে দিলেন,

—সেইসঙ্গে অতিথিশালায় সিংহরণকে গিয়ে কেউ একজন বলো, আমি তাদের ডাকছি।

কিছুক্ষণ বাদেই পথশ্রমে বিধ্বস্ত ছয় কিশোর এসে প্রবেশ করল কক্ষে প্রথমেই তারা প্রণাম জানাল কক্ষে উপস্থিত তিনজনকে।

চন্দ্রগুপ্ত, জীবসিদ্ধি, শশাঙ্ক, আদিত্য, অক্ষয় এবং পুরুষদত্তর মুখের দিকে একে একে দেখে নিয়ে চাণক্য বললেন,

—তোমাদের অক্ষত দেখে আমি খুশি হলাম। বলো? সফল হয়েছ তোমরা? কোথায় সেই দৈবাস্ত্ৰ চন্দ্রহাস?

প্রত্যেকেই উত্তর না দিয়ে চন্দ্রগুপ্তর দিকে তাকিয়ে রইল। অধিনায়ক হিসেবে সে—ই উত্তর দেবে সেটাই সবাই ধরে নিয়েছে। চন্দ্রগুপ্ত এগিয়ে এসে বলল,

—আমাদের ক্ষমা করবেন, গুরুদেব। আমরা চন্দ্রহাস নিয়ে আসতে পারিনি। আমরা তা উদ্ধার করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তা আমাদের থেকে লুন্ঠন করা হয়েছে।

—লুণ্ঠন? কে? কারা করল এই কাজ?

—একদল দস্যু শুরু থেকেই আমাদের গতিবিধির ওপর নজর রেখে চলেছিল। তারাই শেষমুহূর্তে আমাদের থেকে চন্দ্রহাস নিয়ে নেয়।

—নিয়ে নেয় মানে? কীভাবে? তোমরা তো সক্ষম যোদ্ধা! বিনা যুদ্ধে সেই অস্ত্র তোমরা দিয়ে দিলে?

চন্দ্রগুপ্ত মাথা নীচু করে বলল,

—এই অভিযানের নেতৃত্ব দিতে সবাই আমাকে তাদের অধিনায়ক নির্বাচন করেছিল। তাই এই দায় আমি নিচ্ছি।

প্রতিবাদ করে উঠল জীবসিদ্ধি,

—ক্ষমা করবেন, গুরুদেব। কিন্তু, এই বিফলতা চন্দ্রগুপ্তর দায় নয়। আমার প্রাণ বাঁচাতে চন্দ্ৰগুপ্ত এই তরবারি দস্যুদের হাতে তুলে দিয়েছে। অন্যথায় আমার মৃত্যু অনিবার্য ছিল।

তাকে সমর্থনে গলা মেলাল অন্যরা,

—চন্দ্রগুপ্ত না থাকলে আমরা অনেক আগেই মারা যেতাম, গুরুদেব।

—হ্যাঁ, আচার্য। তা ছাড়া, আমরা বিনা যুদ্ধে অস্ত্র তুলে দিইনি। এক বনাম এক যুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত দস্যুনেতাকে পরাজিত করেছিল। তার বীরত্ব ও নেতৃত্ব ক্ষমতা প্রশ্নাতীত।

—আদিত্য ঠিকই বলেছে, আচার্য। দস্যু ছল করে তরবারি নিয়েছে। তারা সশস্ত্র ছিল, সংখ্যায় অনেকে বেশি।

চাণক্য হাত তুলে সকলকে থামতে ইঙ্গিত করতেই প্রত্যেকে কথা থামিয়ে দিল। চাণক্য কয়েক মুহূর্তের জন্যে সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,

—তোমরা নিজেরাই যখন চন্দ্রগুপ্তকে তোমাদের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচন করেছ তখন দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।

— কিন্তু…

জীবসিদ্ধি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে হাত তুলে থামালেন চাণক্য। বললেন, —আসন্ন যুদ্ধের দায়িত্ব আমি তোমার ওপর দিলাম, চন্দ্রগুপ্ত। যে অধিনায়কের কাছে তার সহযোদ্ধার প্রাণের মূল্য সবচেয়ে বেশি, সে—ই যোগ্য নেতা। আগামীতে ‘তুমিই নেতৃত্ব দেবে মগধের বিরুদ্ধে আমাদের এই যুদ্ধে। তোমার ছত্রছায়াতেই নিকট ভবিষ্যতে একত্রিত হোক আর্যাবর্ত। মনে রেখো, এই অসম যুদ্ধে তোমার এই পাঁচ সহযোদ্ধাই তোমার সবচেয়ে বড়ো শক্তি হবে আগামীতে।

প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন,

—তোমরা কি চন্দ্রগুপ্তকে আর্যাবর্তর সম্রাট হিসেবে স্বীকার করো?

আরও একবার সামরিক অভিবাদনের ভঙ্গিতে নত হল পাঁচজন। বুকের ওপর মুষ্টি রেখে বসল তারা।

—আমরা পূর্বেই চন্দ্রগুপ্তকে নিজেদের রাজা বলে স্বীকার করে নিয়েছি, আচার্য।

—আমরা সকলেই তার জন্যে প্রাণ দিতে ও নিতে প্রস্তুত থাকার অঙ্গীকার করেছি।

চাণক্য ও ভদ্রভট্ট আরও একবার নিজেদের মধ্যে দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করলেন। চাণক্যর ঠোঁটের কোণে একটা হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। চাণক্য এইবার চন্দ্রগুপ্তর দিকে ফিরে প্রশ্ন করল,

—আমার মনে হয় তোমার মনে কিছু প্রশ্ন আছে।

——আমায় ক্ষমা করবেন, আচার্য। কিন্তু, আপনার অনুমান সঠিক। এই অভিযানের শেষের কয়েক দিন থেকেই আমার মনে কিছু প্রশ্ন উঠেছে।

—হুমম। বেশ।

—এই অভিযানে আমাদের পাঠানোটা কি আপনার একটা পরীক্ষা নয়? অভিযানের প্রথম দিন থেকে যা যা ঘটেছে, গোটাটাই কি আপনার পরিকল্পনার অংশ নয়?

১৫.

চাণক্য কিছুক্ষণ চন্দ্রগুপ্তর দিকে চেয়ে থেকে বললেন,

—হুমম। বিদ্যালয়ে শেখা বিদ্যা আর বাস্তবে তা প্রয়োগের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আমি চেয়েছিলাম তোমরা বাস্তবে নিজেদের বিদ্যার প্রয়োগ শেখো। নিজ নিজ শস্ত্রের প্রয়োগ যুদ্ধ বাদে কতভাবে করা যায়, তা শেখো। নিজেদের বিদ্যা শুধুই বিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে নয়, বাইরেও তার ব্যবহার শেখো। এবং, তোমরা নিজেদের মধ্যেই বেছে নাও কে হবে আগামীর অধিনায়ক।

—আর, ওই দস্যুদল? তারাও কি আপনারই পরিকল্পনার অংশ নয়?

পুরুষদত্ত বলে উঠল,

—এ তুমি কী বলছ, চন্দ্ৰগুপ্ত?

—ভেবে দেখো, পুরুষদত্ত। দস্যুরা বহুবার আমাদের হত্যা করার সুযোগ পেয়েও আমাদের হত্যা করেনি। সুযোগ পেয়েও আমাদের ঘোড়া নিয়ে যায়নি।

ছেড়ে রেখে গিয়েছে আমাদের ঘোড়া, অস্ত্রাদি। যাতে আমরা এই অভিযান চালিয়ে যেতে পারি। ঘোড়াগুলো না থাকলেই আমরা বিপদে পড়তাম। তারা তা করেনি। বরং, তারা আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছে ধাবমান নরখাদকদের হাত থেকে।

চাণক্য প্রশ্ন করলেন,

—তোমার প্রথম সন্দেহ কবে হল?

—সন্দেহ প্রথম থেকেই ছিল। প্রথমত আপনাকে আমি যতটুকু চিনেছি, তাতে জানি যে, আপনি কিংবদন্তি বা অলৌকিকে বিশ্বাসী নন। তবুও কোনো এক দৈব অস্ত্রের খোঁজে আমাদের পাঠালেন। বিষয়টা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল শুরুতেই। কিন্তু, শেষে যখন গুহা থেকে বেরিয়ে দেখলাম যে, দস্যুরা মানচিত্র অনুযায়ী না গিয়ে আমাদের পিছু নিয়েছে, তখন সেই সন্দেহ বদ্ধমূল হল। দস্যু কীভাবে জানতে পারল যে, মানচিত্রে বদল করা করেছে? এর একটিই মানে দাঁড়ায় যে, দস্যুনেতা আগেও মানচিত্র দেখেছে, বা, তার কাছে আসল মানচিত্রর প্রতিলিপি আছে। তাই সে সহজেই বুঝতে পেরেছে যে, এই মানচিত্র সঠিক নয়। এরপর যখন দেখলাম যে, গুহার মুখ খোলা, তখনই বুঝতে বাকি রইল না যে, তারাই গুহামুখের পাথর সরিয়ে দিয়েছে। যাতে কোনো উপায় যদি নাও করতে পারি, তবুও ঠিকই আমরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই।

চাণক্য বললেন,

—তোমাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত না করে, কখনোই আমি এই দুর্গম অভিযানে তোমাদের যেতে দিতে পারতাম না। ওই দস্যুরা সর্বক্ষণ তোমাদের থেকে সামান্য দূরত্বে থেকে তোমাদের সুরক্ষা দিয়ে গিয়েছে।

—তবে কি সব কিছুই আপনার পরিকল্পনা ছিল?

—পৃথিবীতে কোনো কিছুই যথাযথ পরিকল্পনা অনুযায়ী হয় না, বৎস। তোমাদের নরখাদকদের হাতে বন্দি হওয়া, গুহা থেকে জলপথে বেরিয়ে আসা এগুলো কোনোটাই আমার পরিকল্পনার অংশ ছিল না।

আদিত্য বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল,

—এ কী? আপনি সব কিছু জানেন?

তখনই বাইরে থেকে এক ভৃত্য এসে বলল,

—আচার্য। আর্য সিংহরণ বাইরে অপেক্ষারত।

—তাকে ভেতরে নিয়ে এসো।

নির্দেশ দিলেন ভদ্রভট্ট।

যে ব্যক্তি কক্ষে প্রবেশ করলেন, তাঁকে দেখে চমকে উঠল জীবসিদ্ধিরা। কারণ, কক্ষে প্রবেশ করেছেন সেই দস্যুনেতা! তাঁর বেশবাস এখন সাধারণ আর্যদের মতো হলেও, তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না। তিনি এগিয়ে এসে চন্দ্রগুপ্তর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারও হেসে উঠলেন।

চাণক্য বললেন,

—পরিচয় করিয়ে দিই তোমাদের সঙ্গে। এ আর্য সিংহরণ। পূর্বে এ মগধের এক সেনাপতি ছিল। কিন্তু, মগধরাজ নন্দর বিরোধিতা করায় সিংহরণসহ তার অধীনে থাকা গোটা দু—হাজার সেনাকে মৃত্যুদণ্ডর আদেশ দেয় নন্দ। পাঁচ হাজার সেনার বিরুদ্ধে বীর সিংহরণ ও তার সেনা যুদ্ধ লড়েছিল এবং জিতেছিল। সে—যুদ্ধের কথা এখনও মগধের লোকমুখে ফেরে।

সিংহরণ বলে ওঠেন,

—সেই জয়ের ভয়ংকর মূল্য দিয়েছি আমরা। আমার দু—হাজার সহযোদ্ধার মধ্যে মাত্র তিনশো বাইশজন প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলাম। তাদের মধ্যেই কয়েক জনকে, তোমরা আমার সঙ্গে দেখেছ দস্যুবেশে।

চন্দ্রগুপ্ত বলে উঠল,

—আপনি? আপনি সেনাপতি সিংহরণ? আমি মগধের সন্তান। আমি আপনার নাম শুনেছি বহুবার লোকমুখে। আপনি আমার নায়ক ছিলেন!

সিংহরণ এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রগুপ্তর সম্মুখে দাঁড়াল। নিজের কটিবন্ধ থেকে তরবারি বের করল। দৈবাস্ত্র ‘চন্দ্রহাস’!

—আর আজ থেকে তুমি আমার নায়ক হলে চন্দ্রগুপ্ত। এই জীবনে আমি বহু যোদ্ধার মুখোমুখি হয়েছি, কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, তোমার মতো দুর্ধর্ষ যোদ্ধার সঙ্গে আমার কখনো পূর্বে পরিচয় হয়নি। এই তরবারি তোমার, এই তরবারি নিয়ে আমায় দায় মুক্ত করো, হে তরুণ যোদ্ধা।

চন্দ্রগুপ্ত চন্দ্রহাস হাতে নিতেই আবারও আনন্দে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল সবাই। চন্দ্রগুপ্ত তরবারিটি কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল,

—আচার্য। আমার শেষ প্রশ্নের জবাব দিন। এই তরবারি কি বাস্তবিকই পুরাণে বর্ণিত দৈব অসি চন্দ্ৰহাস?

চাণক্য উত্তর দিলেন,

—হ্যাঁ। অন্তত মানচিত্র ও এই কাহিনির অংশ সত্য।

তাও চন্দ্রগুপ্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে চাণক্য বলল,

—এই অসি হাতে নিয়ে কি তোমার নিজেকে অজেয় মনে হচ্ছে না, চন্দ্রগুপ্ত ধীরে উত্তর দিল, চন্দ্ৰগুপ্ত?

—আমি মিথ্যা বলব না আপনাকে, আচার্য। এই অসি এক প্রাচীন সময়ের দুর্দান্ত নিদর্শন বটে। এত যুগ জলের নীচে থেকেও এতে জং ধরেনি। কিন্তু, সবশেষে এটা আমার কাছে আর পাঁচটা তরবারির থেকে আলাদা কিছুই মনে হচ্ছে না। আমি বিশ্বাস করি না যে, শুধুমাত্র এই অস্ত্রের দ্বারা আমরা কোনো যুদ্ধের পরিণাম নির্ণয় করতে পারি।

সবাই বিস্মিত হয়ে উঠল চন্দ্রগুপ্তর উত্তরে। কিন্তু, প্রসন্ন চিত্তে চাণক্য বলে উঠলেন,

—সাধু, চন্দ্রগুপ্ত! সাধু! তবে, ফেলে দাও, ওই দৈবাস্ত্র চন্দ্রগুপ্ত!

—এ কী বলছেন আপনি, গুরুদেব?

শশাঙ্ক বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল। চাণক্য মৃদু মাথা নেড়ে বললেন,

—যুদ্ধ ‘অস্ত্র’ জেতে না, বৎস। যুদ্ধ জেতে যোদ্ধারা। একটি সাধারণ তরবারিও দক্ষ যোদ্ধার হাতে, পরাজিত করতে পারে অদক্ষ ব্যক্তির হাতে ধরা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ তরবারিটিকে। আমরা যে বিদ্রোহ, যে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে চলেছি, তা জয়ের জন্যে প্রয়োজন বুদ্ধি, শৌর্য, বীরত্ব ও ঐক্যর। সেই কারণেই চন্দ্রগুপ্তর সম্মুখে আমি শেষ পরীক্ষা রেখেছিলাম যখন সিংহরণ তাকে দৈব তরবারি অথবা তার সঙ্গীর প্রাণের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বলে। চন্দ্রগুপ্তর সম্মুখে দুটি বিকল্প দেওয়া হল। একদিকে ছিল “ক্ষমতা”, অন্যদিকে ছিল অধিনায়ক হিসেবে তার “দায়িত্ব”। চন্দ্রগুপ্ত যে মুহূর্তে নির্দ্বিধায় এই তরবারি ত্যাগ করে জীবসিদ্ধির জীবন বেছে নিয়েছিল, সেই মুহূর্তেই ও আমার শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ক্ষমতা তারই হাতে শোভা পায়, যে নির্দ্বিধায় ক্ষমতাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তুমি আমায় গর্বিত করেছ। তোমরা সবাই আমায় গর্বিত করেছ। হাজার বিপত্তিতেও তোমরা একে অপরের সঙ্গ ছাড়োনি। শেষ অবধি তোমরা নিজের অধিনায়ককে ত্যাগ করোনি!

ছ—জন শিষ্য হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করল তাদের গুরুকে। চাণক্য বললেন, —আজ, আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হল। আজ আমি নিশ্চিত হলাম যে, এই দেশের ভবিষ্যৎ আমি যোগ্য উত্তরসূরিদের হস্তেই তুলে দিতে চলেছি আগামীতে। ওঠো তোমরা! মাথা উঁচু করো তোমরা!

উঠে দাঁড়াল চন্দ্রগুপ্ত ও তার গুরুভ্রাতারা। চন্দ্রগুপ্ত তার হাত থেকে দৈব অসি চন্দ্রহাস নামিয়ে রেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেল তার মিত্রদের দিকে।

—দাঁড়াও, চন্দ্রগুপ্ত।

সিংহরণের ডাকে ফিরে দাঁড়াল চন্দ্রগুপ্ত। ফিরতেই দেখল সামনে তরবারি নামিয়ে রেখে সামরিক কায়দায় এক হাঁটুর ওপর ভর করে বসে আছেন বিশালদেহী সিংহরণ। বুকের কাছে হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন,

—আমায় নিজের বাহিনীর প্রথম সেনাপতি হওয়ার অনুমতি দিন। আমি ও আমার ৩২১ জন সৈনিক আজ থেকে আপনার অধিনায়কত্ব স্বীকার করলাম। আজ থেকে আপনার আদেশে আমরা প্রাণ দিতে ও প্রাণ নিতে প্রস্তুত! এগিয়ে গিয়ে সেনাপতিকে ধরে দাঁড় করাল চন্দ্রগুপ্ত।

—উঠুন, সেনাপতি। এ আমার সৌভাগ্য যে, আমার বাল্যকালের নায়ক আমার সহযোদ্ধা হতে চলেছে! আমি সম্মানিত, আর্য! নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা আমার মার্গ দর্শন করুন।

সবাই একসঙ্গে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল,

—জয় হোক! জয় হোক! জয় হোক!

***

Author’s note:

১. এই কাহিনির শুরুতে চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যর প্রথম সাক্ষাতের যে ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে, অনেকটা এরকমই কাহিনি পাওয়া যায় পঞ্চম শতাব্দীতে লেখা শ্রীলঙ্কার ইতিহাস বই ‘মহাবংশ—টীকা’—তে। একই ঘটনার উল্লেখ জৈন পুথি ‘পরিশিষ্টপর্ব—তে।

২. রামায়ণ অনুযায়ী রাবণের তরবারির নাম ছিল ‘চন্দ্রহাস’। এই তরবারি রাবণকে স্বয়ং ভগবান শিব দিয়েছিল তার ভক্তিতে খুশি হয়ে। এই ‘দিব্য অস্ত্র’ মহাদেবের পাশুপত, ত্রিশূল বা পিনাকের মতোই শক্তিশালী বলে কথিত আছে। সীতাহরণের সময়ে এই তরবারির আঘাতেই জটায়ুর শক্তিশালী ডানা কেটেছিল রাবণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *