দেশের চিঠি – নবনীতা দেবসেন

দেশের চিঠি

মামনি সোনামণি

নববর্ষের অনেক আশীর্বাদ, তোমাকে আর তোমার রবার্টবাবুকে। ঠাণ্ডা একটু কমেছে? ফুলটুসি টুসটুসি কী আছে—”ও বাবাগো মার এত বড় চিঠি? কখন পড়ব? কিন্তু মা এত কথা ফোনে বলতে হলে কত খরচা হত সেটা ভাব? যদিও হবুজামাই পড়তে পারবে না, কিন্তু চিঠি কি ইংরিজিতে লিখতে ইচ্ছে করে? দূর। আর আমাদের সব ব্যাপারে তো তার উৎসাহ থাকার কথাও নয়। পরিবারটি তো ছোট নয় আমাদের, ভগবানের ইচ্ছেয়? সমস্যাও বিচিত্র।

তোমার বাবার শরীর ভালই আছে এখন। মার্কিনী জামাই প্রাপ্তির দুষ্পাচ্য সংবাদটি এতদিনে হজম হয়েছে বলেই মনে হয়। তোমরা তো জুন মাসেই আসছ। সামনাসামনি দেখা হলেই অনেক অকারণ দুর্ভাবনা ঘুচে যায়। তুমি তোমার বাবামাকে যে কত ভালবাস তা আমি জানি। মার্কিনী ছেলেই হোক, আর বাঙালি ছেলেই হোক জামাই হল জামাই, সে এসে ঘর থেকে মেয়েকে কেড়ে নিয়ে চলে যাবেই অন্য এক ঘরে। এটাই নিয়ম। জগতে চিরটাকাল এইই চলছে। বাঙালি পাত্র, পালটি ঘর, অনেক দেখেশুনে বাড়ির কাছাকাছি বিয়ে দিলে, সে জামাই যদি তারপরে মেয়েকে বগলদাবা করে টিম্বাকটু কিংবা দক্ষিণ মেরুতে বিপুল মাইনের চাকরি নিয়ে চিরদিনের মতন চলে যায়, পাঁচ বছরের একবার দেশে আসে, তার বেলায় বাবারা মনের দুঃখে ভয়ে ভাবনায় উদ্বেগে শয্যাশায়ী হল বলে কদাচ শুনিনি। অথচ এই যে ছেলেটি ভারতীয় ইতিহাস নিয়েই গবেষণা করে, কয়েক বছর কর্মসূত্রেই ভারতবর্ষে আসবে যাবে, সে মার্কিনী বলেই তোমার বাবার কেন যে এত উদ্বেগ তা আমার মাথায় ঢুকছে না। হ্যাঁ, যদি তোমার দাদু কি দিদিমা, কি ঠাকুমা এমন ছটফট করতেন আমি বুঝতাম। কিন্তু তোমার ঠাকুমা তো দেখি দিব্যি সাহেব নাত—জামাইয়ের পাঞ্জাবী পাজামা পরা চটি পায়ে ঝোলা কাঁধে ফোটো সবাইকে ফোকলা হাসি সহ গর্বভরে দেখাচ্ছেন এবং তোমরা এলে কীভাবে কী কী অনুষ্ঠান হবে তারই জল্পনা—কল্পনা করছেন পুরুতমশাই আর তোমার পিসিদের সঙ্গে। আমি অবশ্যই আউট। বলা বাহুল্য। আর আমার মা—বাবা? সে—বছর তোমার মেজমামার কাছে ওঁরা যখন গিয়েছিলেন তুমি তো ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে রবার্টের—শিকাগোয় বঙ্গ সম্মেলনে যখন দেখা হয়েছিল। গর্ব করায় তাঁরা সবার ওপরে এককাঠি বাড়া, যেহেতু হবু নাতজামাই স্বচক্ষে অ্যাডভান্স দেখে এসেছেন, চেনেন। যদিও জানতেন না সে জামাই হবে, শুধু জানতেন তোমার মাস্টারমশাই। তোমার ”সায়েন্টিস্ট” বাবাটি কিছুতেই ”বিধর্মী”, ”বিদেশী”, ”বিভাষী” এবং যে তোমাকে চিরদিন প্রবাসে ধরে রেখে দেবে এমন জামাতাকে দিল খুলে পছন্দ করতে পারছেন না যা বুঝছি। আমি অনেক বোঝাচ্ছি যে ছেলেটি ব্রিলিয়ান্ট, ভাল ইউনিভার্সিটিতে পাকা কাজ করছে, দিব্যি সুদর্শন, অল্প বয়স, এই প্রথমবার বিয়ে করছে (সাহেবরা সব্বাই ডিভোর্সী, বহুবিবাহিত এবং/অথবা দুশ্চরিত্র হয় বলেই আমাদের দেশে অনেকের ধারণা?) হিন্দুধর্ম ও ভারতবর্ষ বিষয়ে তার জ্ঞান যে আমাদের চেয়ে বেশি, সংস্কৃত জানে, ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে (আমাদের খাঁটি বাঙালি সুপাত্ররাও আজকাল ভাঙা ভাঙা বাংলাই বলে, কিন্তু তারা সংস্কৃতটা শেখেনি) ভাল রান্নাবান্না জানে (বাঙালি জামাইরা সাধারণত রান্না জানে না, একটু জানলেও বিয়ের পর ভুলে যায়), সিগারেট খায় না মাংস খায় না, কড়া মদ্যপান করে না (এটা তোর মেজমামা আমায় ফোনে বলেছেন বাবা তো শুনে অবাক। কী আশ্চর্য সাহেব, অথচ স্কচ খায় না?’ তোর দাদু মুগ্ধ এমন সৎপাত্রটিকে তাঁর নাতনি সংগ্রহ করেছে বল। এখানে তরুণ সৎ পাত্ররা সবাই মদের পিপে হয়ে যায় চল্লিশে পৌঁছোবার আগে)। তাও তো কেউই জানেন না যে রবার্ট তোকে কত যত্ন—আত্তি করে। বাসন ধুয়ে দেয়, ঘর পরিষ্কার করে দেয়। কাপড় কেচে আনে। আমি তো বাপু হাজার সম্বন্ধ করেও এমন জামাই যোগাড় করতে পারতুম না।

তার ওপর তোমাকে শ্বশুর শাশুড়ি ননদভাজ নিয়ে ঘর করতে হবে না। আমার সংসার তো কানে শুনতেই ”স্বামী—স্ত্রী একটি সন্তান”—কিন্তু কার্যত? বাড়িতে প্রথমত শাশুড়ি আছেন, তবুও বলতে নেই তোমার ঠাকুমা আমায় যতই অগ্রাহ্য করুন, যতই চার মেয়ের দ্বারা মন্ত্রী—পরিবৃতা হয়ে থাকুন, তেমন জব্দ করতে পারেননি। বোবার শত্রুতা করবে কে? তোমার চার পিসি, পিসেমশাই বৃদ্ধ এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা, তোমার কাকু কাকীমা এবং আমার গুণবান দেওরপোদ্বয়কে (বড় জ্বালাচ্ছেন বাপু তাঁরা! পল্টনকে তো ড্রাগের কারণে হস্টেল থেকে রাস্টিকেট করেছে। তবুও পাটনা ছেড়ে তোমার কাকিমা এখনও কাকার সঙ্গে জামসেদপুরে আসবে না।) নিয়েই তো আমার শ্বশুরবাড়ি? তোমার বাপের বাড়ির সংসারের extended family—টি কি ছোট হল? তোমার এ ধরনের অতিরিক্ত অথচ জরুরী সমস্যা আশা করি থাকবে না, বাড়ির বড় বউ হলে এদেশে যেসব ঝঞ্ঝাট ঝেড়ে ফেলা তোমার—আমার পক্ষে শক্ত।

সত্যি কথা বলতে কী, তোমার সিদ্ধান্তে আমি বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছি। সম্বন্ধ করে তোমার বিয়ে দিলে কেরিয়ার—এর ক্ষতি হবে বলে ভয় ছিল, এক্ষেত্রে তোমাদের দু’জনের যেহেতু joint research, সেই হেতু তোমার কাজ বন্ধ হয়ে যাবার ভয় নেই (তাহলে জামাইবাবাজীরও কাজ বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকতে পারে) এবং তোমার কাজের যথার্থ সমঝদারিও ঘরেই তুমি পাবে। যেটা অমূল্য।

তোমার মন শক্ত রেখো—”বাবা শুয়ে পড়েছেন বিয়ের খবর শুনে”—এই কথা ভেবে মুষড়ে পোড়ো না। এখানে বাবার শুয়ে পড়াটা তাঁরই ভুল চিন্তার ফল। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে এই শোকেই হোক, সাহেবজামাই হবে ভেবেই হোক, অথবা জামাইকে তুমি স্বয়ং পছন্দ করেছ শুনেই হোক, হয়তো নানা কারণেই তোমার বাবার এই প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাছাড়া উনি নিজেই এ বাড়ির সর্বময় কর্তা। যাবতীয় সিদ্ধান্তেই সব একা একা নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। হঠাৎ তুমি তাতে বাগড়া দিলে। নিজের জীবন নিয়ে দিব্যি নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে। তাঁর সঙ্গে একটা পরামর্শও করলে না,—অনুমতি চাইলে না, কেবল শুভ সংবাদটি পরিবেশন করলে, এজন্যও তাঁর মনমেজাজ বিগড়ে থাকতে পারে। তুমি বা রবার্ট এ নিয়ে মন খারাপ কোরো না। এটা ওঁর অহং—এর প্রশ্নে ঘটেছে। তোমাদের কোনও ত্রুটির কারণে নয়। ওঁর শুয়ে পড়াটা শারীরিক কোনও দুর্যোগের ফলে হয়নি, হয়েছে মানসিক দুর্যোগে।

সামলে উঠবেন, তোমাকে বলেছিলাম। এবং এখন উনি দিব্যি সুস্থ। তোমার ঠাকুমা, আমার বাবা—মা আর বড়দা তো বোঝাচ্ছেনই, বলতে নেই, তোমার পিসিরাও। প্রথমে তাঁরা দু’ভাগে বিভক্ত ছিলেন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের মতো। বড় এবং সেজ তোমার বাবার দলে, মেজ এবং ছোট তোমার (অর্থাৎ আমারও) পক্ষে। আপাতত দেখছি তোমার বুদ্ধিমতী ঠাকুমার কল্যাণে সম্ভবত চার ভগ্নীতে একজোট হয়ে ভাইকে বোঝাচ্ছেন কেন ফুলটুসির ওপর তাঁর রাগ করা উচিত নয়। তোমরা আষাঢ় মাসেই তো আসছ—শ্রাবণে বিয়ের লগ্ন, তারিখ, ও বিবাহ বাসরের ব্যবস্থা পাঁজিটাজি নিয়ে তোমার ঠাকুমা—পিসিমারাই স্থির করছেন। যথাকালে অবশ্যই আমিও জানতে পারব। ক্যাটারার স্থির হয়ে গেছে শুনেছি। চৌত্রিশ বছর পূর্ণ হল বাড়ির বড় বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছি এখনও আমি সেই ”পরের মেয়ে”। তোমার কাকী তো বটেই। চার পিসি যে যাঁর নিজের বাড়িতে বসবাস করেন, কিন্তু তাঁরাই এখনও ”এ বাড়ির” প্রধান সদস্য। মেনুটা স্থির করার সময়ও ডাকবেন কি না, জানি না।

তোমার সংসারে এই ঝামেলা হবে না অন্তত। আর মিল—অমিল? তোমার ছোট পিসির বিয়ে কি সাহেবের সঙ্গে হয়েছিল? না প্রেম করে? সে বিয়ে কেন ভেঙে গেল? অথচ অনেক দেখে শুনেই তোমার বাবা ছোট বোনের সম্বন্ধটি করেছিলেন। চোখে দেখেও যদি কেউ জীবন বিষয় শিক্ষা না গ্রহণ করেন তো তাঁর শোক দুঃখু তো অন্যের চেয়ে বেশি হবেই। বাবা বড্ড বাঁধাধরা কতগুলো সোজা লাইনে জোর করে জীবনকে চালাতে চান। কিন্তু জীবন তো জ্যান্ত, তার গতিপ্রকৃতি তার নিজস্ব,আমাদের ভবিষ্যদ্বাণীর বাইরে সে কেন রেলগাড়ী হবে? ছোট পিসির বেলায় তোমার বাবার অমন সেকেলেপনা না থাকলে এতদিনে ডিভোর্স হয়ে কবেই সব চুকে বুকে যেত, এমন বিশ্রীভাবে ঝুলে থাকত না পুরো পরিবারটা। আর তোমার কাকা—কাকীমার বিয়ের ব্যাপারেও তোমার বাবাকে তো দেখেছ? আমি যে হাসিখুশি থাকি সবাই ভাবে ”আহা, স্বামী—স্ত্রীতে কী মিল!” কিন্তু মা—মণি, তুমি তো জানো, আমরা দু’জনে দুটো ভিন্ন জগতের প্রাণী। তোমার বাবা অবিশ্যি সেটা না—ও জানতে পারেন। তোমার আর রবার্টের প্রসঙ্গে আমরা দ্বিমত হয়েছি বটে, কিন্তু সাধারণ নিয়মে আমি ওঁর প্রায় সব মতামতই সারা জীবন মেনে চলেছি, ”সংসারে শান্তি”র মুখ চেয়ে। তার চেয়ে বড় লক্ষ্য আমার চেষ্টাকৃত আয়ত্তের মধ্যে আর ছিল না। কিন্তু ফুলটুসি, ধন আমার, তোমার জীবনের কাছে প্রাপ্য আরও অনেক অনেক কিছু থাকবে—আছে। তোমার ক্ষমতা, মেধা, কৃতিত্ব শুধু ঘরেই নয়, বহির্জগতেও তোমাকে প্রমাণ করতে হবে। আমার নিজেকে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে ছিল শুধুই সংসার। শুধু অন্দরমহল। আর ছিলে তুমি। যতদূর মনে হয় সেখানে আমি সফল হয়েছি। আজ তুমি যে Ph.D. শেষ করেই post-doctoral fellow হতে পেরেছে, পড়ানোর কাজ পেয়েছ এবং এক পণ্ডিত ব্যক্তিকে স্বামিত্বে বরণ করার স্বাধীন সিদ্ধান্তে, আমাদের সাহায্য ছাড়াই পৌঁছতে পেরেছে, এতেই প্রমাণ হচ্ছে যে সংসার ক্ষেত্রে অন্তত আমি সফল হয়েছি। তোমার আত্মবিশ্বাসের এবং মূল্যবোধের কোটায় ফাঁক নেই। এবং আমাদের ওপরেও যথেষ্ট বিশ্বাস রাখো, আশা রাখো, যে তোমার পছন্দকে আমরা নিশ্চয়ই সম্মান করব।

এত কথা জামাইয়ের জানার দরকার নেই। তাই বাংলাতেই লিখছি। তোমার সঙ্গে ওখানে কি চামেলির ফোনে কথা হয়েছে? চামেলিরা শীতে দেশে এসেছিল মেয়ের জন্য পাত্রের খোঁজে। ওদেশেই জন্মেছে, বড় হয়েছে মেয়েটা, অথচ আমেরিকায় চামেলি ওর জন্য ছেলে পেল না। ওদেশের বাঙালি ছেলেরা এসে দেশের মেয়েদের বউ করে নিয়ে যাচ্ছে। তারা ওদেশের বাঙালি মেয়েদের বিয়ে করা পছন্দ করে না নাকি, কেননা তারা সব dating করে, নাচতে যায়, তাদের বড্ড মেমসায়েবিআনা। আর তোরা ছেলেরা বুঝি dating করিস না? তোরা বুঝি নাচতে যাস না? সায়েবিয়ানার ‘স’ করিস না—কিন্তু চামেলি বলল, ওদেশের দিশি ছেলেরা (এবং তাদের মা—বাবারাও, কি আশ্চর্য!) ওভাবে ভাবে না। আমি ভাবছি ওই সব NRI ছেলেদের কি ঘরে বোন নেই? তাদেরও তো বিয়ে থা দিতে পাত্র খুঁজতে দেশে আসতে হবে। দেশের ভাল ছেলেরা অবশ্য গ্রিন কার্ডের লোভে NRI বিয়ে করতে সর্বদাই এক পায়ে খাড়া। আর এখানে বাঙালি ছেলেমেয়েরা এদেশে নেচেকুঁদে date—এর বাবা করছে। সেটা কি ওরা ওদেশে অত হিন্দি সিনেমা দেখেও টের পায় না? তারপর যা হোক—তা হোক চামেলীর মেয়ের সঙ্গে একজনদের পাকা কথা হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য ড্রাই কমার্শিয়াল অ্যাটিচ্যুড জীবনের প্রতি! ভেবে অবাক লাগে। ওদেশে জন্মানো বাঙালি মেয়েদের অবস্থা এদেশের মেয়েদের চেয়ে খারাপ বলেই মনে হয় ব্যাপারস্যাপার দেখে।

একটা কথা।

ফুলটুসি, আমি একটা মিথ্যে বলেছি। তোরা যে বিয়ে না—করে কেবল Engaged অবস্থাতেই এক সঙ্গে ঘর সংসার করছিস, বিয়েটা পরে হবে, দেশে এসে, আর ঘর সংসারটা শুরু হয়ে গেল আগেই, এটা তোর পিসিরা, ঠাকুমা কিম্বা দাদু দিদিমা কেউই মেনে নিতে পারবেন না। (বাবার শুয়ে পড়ার প্রকৃত কারণ সেটাও হতে পারে)। ওদের চোখে এটাই দুশ্চরিত্র স্ত্রী—পুরুষের লক্ষণ। (যদি ওই ছেলেটি তোমায় বিয়ে না—করে ল্যাজ গুটিয়ে ছুট দেয়?) আমি আর তোর বাবা তাই কাউকে জানাইনি যে তোর ফ্ল্যাটের কনট্রাক্ট রিনিউ না করে তুই এখনই রবার্টের অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেছিস। দুটো ফ্ল্যাটের ভাড়া গুণে যে লাভ নেই, কৃত্রিম সতীত্বের ছবি সাজিয়ে রেখে লাভ নেই, যার সঙ্গে সারা জীবন কাটাবি, তাকে ছ’মাস আগে বিশ্বাস না করে লাভ নেই, এসব কথা অন্যকে বোঝানো খুব মুশকিল।

আমাদের কান মন প্রাণ, তিনটেকেই যে আমরা সংস্কারের গামছা জড়িয়ে ”কানামাছি ভোঁ ভোঁ” করে বেঁধে রেখেছি। তুই যেন ”সততার খাতিরে” এই খবরটা কাউকে লিখে ফেলিস না বাছা, কিম্বা বাঙালি বন্ধুদের ফোন করে জানিয়ে দিস না। ওখান থেকে ফোনে টোনেও সবাই কিন্তু সব কথাই কলকাতায় সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয়, পরনিন্দা পরচর্চা বিলেতে গিয়েও ছাড়ে না কেউ, খেয়াল রাখবি। জীবন এমনিতেই এদেশে আর একটুও সহজ নেই। আনন্দের মুহূর্তে, সম্মানের মুহূর্তে মানুষের শুভেচ্ছা পাওয়া কঠিন। কিন্তু দুঃখে, অপমানে সহানুভূতি করার লোক অনেক। অযথা ঘোঁট পাকাতে মুখরোচক সংবাদ যুগিয়ে লাভ নেই। মাগো, আমাকে তোরা ভুল বুঝিস না। এটা ”কপটতা” নয়। আমরা আসলে এখনও অতটা ”সত্যনিষ্ঠ’ হবার সাহস পাই না। সমাজে বাস করতে হয় তো? শুনেছি নাকি বম্বে দিল্লিতে এরকম ”লিভ—টুগেদার” আকছার হচ্ছে। খবরের কাগজে, মেয়েদের ম্যাগাজিনে তো বাঙালি মেয়েদেরও সাক্ষাৎকার পড়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কলকাতাতে ব্যাপারটা এখনও বলতে গেলে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির পর‍্যায়েই আছে। তবে আশা করছি দিনে দিনে জীবন আরেকটু যুক্তিযুক্ত, আরেকটু সরল হবে। সংস্কার মুক্তি, আর উচ্ছৃঙ্খলতা এক নয়। আশা করি সেটাও খেয়াল করে চলতে পারবে তোমরা। তোমরা তো জানো মা, সংস্কার মাত্রেই ‘কু’ নয়। কিছু কিছু সংস্কার মানুষকে মাটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। জল বাদ দিয়ে, দুধটুকু খেতে শিখতে হবে তোমাদের। কিছু সংস্কারকে আমাদের জীবনে ধরে রাখা জরুরী। আর কিছু সংস্কার ফেলে দিতে হয়। তোমাকে আর কী বলব ফুলটুসি তুমি আমার বুঝদার মেয়ে। বলবার কথা তো আরও কত আছে কিন্তু তাহলে এত টাকার স্ট্যাম্প লাগবে, যে ফোনেরই সমান হয়ে যাবে! তাছাড়া তোর বাবারও ফেরার সময় হল, আজ ভেবেছি ওঁর জন্যে আলুর পরোটা করব। এখন না উঠলেই নয়। আদর নিও।—

—আং— তোদের মা।

পুনশ্চ : ফেরবার সময়ে গুষ্টিশুদ্ধু সব্বার জন্যে অত প্রেজেন্ট কিনে সময় আর ডলার নষ্ট করতে হবে না। কেবল তত্ত্বে দেবার জন্যে কিছু ভাল কসমেটিকস তোর জন্যে আর জামাইয়ের জন্যে আনবি। তোকে টাকায় দাম শোধ করে দোব; নিতেই হবে। এটা তত্ত্বের ব্যাপার। জামাইয়ের জন্যে যথারীতি আংটি বোতাম গড়ানো হয়েছে, ঘড়িটা কিনিনি। তোর জন্যে আমিই নোয়া গড়িয়ে রেখেছি, (তোর মেম শাশুড়ি তো জানবে না।) তবে দামটা বলিস রবার্ট যেন দিয়ে দেয় স্যাকরাকে। (ওটা বাপের বাড়ি থেকে যাবার কথা নয়)। মহানন্দে বিয়ের বাজার করছি। মাঝে তো মাত্র একটা মাস। কার্ড ছাপতে গেছে, বুধবার আসবে। শরীরের যত্ন নিবি দু’জনে। বাবার জন্যে ভাবিস না, আজ তো অফিস যাবার সময়ে খাওয়া—দাওয়াটা ঠিকমতোই করলেন। ওঁর জন্যে বরং একটা কালো সাদা স্ট্রাইপ শার্ট আনিস। আমার জন্যে খবদ্দার কিছু আনবে না। দয়া করে শুধু নিজেদের শরীর—স্বাস্থ্য ভাল রেখো। এখানে গরম। ঠাকুরের কাছে এটুকুই প্রার্থনা, শুভ কাজটা ভালয় ভালয় হয়ে যাক। ভগবান তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলুন।

 —মা।

 বর্তমান, দশম শারদ সংখ্যা ১৯৯৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *