দেবেনবাবুর দাঁত
পাহাড়ী পথে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল দেবেনবাবুর৷ বেশ কিছুটা নীচে ছবির মতো গ্যাংটক শহরটা দেখা যাচ্ছে৷ চারপাশে সবুজ পাহাড় আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷ সূর্য অস্ত গেছে একটু আগে৷ তার লাল আভাটুকু এখনও জেগে আছে পাহাড়ের মাথায়৷ মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে৷ নির্জন পথে শুধু বাতাসের কানাকানি৷ দেবেনবাবু আগে কোনোদিন পাহাড়ে আসেননি৷ সত্যি কথা বলতে কি, ছেলেবেলায় একবার বাবা-মা’র সাথে পুরী বেড়াতে যাওয়া ছাড়া এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে কোথাও বেড়াতে যাননি তিনি৷ আসলে দেবেনবাবু একটু বেশি হিসাবী মানুষ৷ বেড়ানো মানেই টাকা-পয়সা খরচ৷ আর এ খরচটাকে বাজে খরচটাই মনে করেন তিনি৷
দেবেনবাবুর এই গ্যাংটকে বেড়াতে আসা নেহাতই ভাগ্যের ব্যাপার বলা যেতে পারে৷ কলকাতার একটা ইলেকট্রিনিক্স কোম্পানিতে দেবেনবাবু সেলস ম্যানেজারের চাকরী করেন৷ কিছুদিন আগে তিনি বেশ বড়ো একটা কাজের অর্ডার পাইয়ে দিয়েচিলেন কোম্পানিকে৷ তাতে কয়েক লক্ষ টাকা মুনাফা হয়েছে কোম্পানির৷ বড়ো সাহেব তাঁকে ডেকে বললেন, ‘অর্ডারটা পাবার জন্য কোম্পানী আপনাকে পুরস্কৃত করতে চায়৷ তবে ঠিক সরাসরি নগদে নয়, কোথাও থেকে দিন তিনেকের জন্য ঘুরে আসুন, তার জন্য যা খরচ হবে কোম্পানি দেবে৷ আপনি তো কোথাও যান না, কোথাও গেলে মন ভালো হবে৷ নতুন উদ্যমে আবার কাজ শুরু করতে পারবেন৷’
প্রস্তাবটা শুনে প্রথমে ইতস্তত করছিলেন তিনি৷ তারপর হিসাব করে দেখলেন কোম্পানির পয়সা ছেড়ে কী লাভ? তাছাড়া, যানবাহন ভাড়া, হোটেল ভাড়া, খাইখরচা একটু আধটু বাড়িয়ে যদি দেখানো যায় তবে হাতে দু-পয়সাও আসবে৷ কাজেই সবকিছু ভেবে শেষ পর্যন্ত এই গ্যাংটকে উপস্থিত হয়েছেন তিনি৷ গ্যাংটক শহরে দেবেনবাবুর ভায়রা পরিতোষের একটা হোটেলও আছে৷ পার্টনারশিপে আর একজনের সাথে হোটেলটা সে লিজে চালায়৷ দেবেনবাবু কিন্তু সে হোটেলে ওঠেননি৷ শহরের বাইরের দিকে গ্রামের গরীব মানুষরা টুরিস্টদের ঘর ভাড়া দেয় সস্তা দামে৷ তেমনই একটা ঘর খুঁজেপেতে সেখানেই তিনি উঠেছেন৷ দু-তিনদিনের তো মামলা, ভালো হোটেলের দরকার কী? রাত কাটাতে পারলেই হল৷ তিনি অবশ্য ঠিক করেছেন যে ফেরার আগে একবার অবশ্যই যাবেন পরিতোষের কাছে৷ তার থেকে তিনি হোটেলের একটা বিল নেবেন৷ যেটা তিনি জমা দেবেন তাঁর অফিসে৷
হাঁটতে হাঁটতে তার সেই আস্তানা ছেড়ে বেশ অনেকটাই দূরে চলে এসেছেন দেবেনবাবু৷ এক সময় নীচে গ্যংটক শহরে একটা, একটা করে বাতি জ্বলতে শুরু করল৷ দেবেনবাবু ভাবলেন, ‘এবার তবে ফেরা যাক৷’
ফিরতে যাচ্ছিলেনও৷ কিন্তু হঠাৎই নির্জন পথে রাস্তার পাশে একটা বাড়ি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি৷ কাঁচের-দরজা জানলা, ঢালু ছাঁদ-অলা একটা ছোটো কাঠের বাড়ি৷ রাস্তা আর খাদের মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে৷ পাহাড়ী পথে এ ধরনের বাড়ি মাঝে মাঝেই দেখা যায়৷ বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ৷ মাথায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে৷ তাতে চীনা হরফে কী লেখা আছে তা পড়তে না পাড়লেও আড়াআড়ি লাল ক্রশচিহ্ন আর বাঁধানো দাঁতের ছবি দেখে তিনি বুঝতে পারলেন সম্ভবত ওটা দাঁতের ডাক্তারখানা৷ এই নির্জন পথে দাঁতের ডাক্তারখানা! অবশ্য পাহাড়ী অঞ্চলে সব কিছু একটু ফাঁকা ফাঁকা জায়গাতেই থাকে৷ দেবেনবাবুর ওপরের চোয়ালে দু-পাশের দুটো দাঁত কিছুদিন হল পড়ে গেছে৷ ওই যে, যে দাঁত দুটোকে ‘ক্যানাইন’ বা মাংস খাবার দাঁত বলে৷ আজকাল ও দাঁত দুটোর অভাবে মাঝে মাঝে তাঁর খেতে বেশ অসুবিধা হয়৷ দেবেনবাবু ও দুটো দাঁত বসাবার জন্য একবার কলকাতায় এক ডেন্টিস্টের চেম্বারে গেছিলেনও৷ কিন্তু দুটো দাঁতের জন্য তিনি যা টাকা চেয়েছিলেন তা শুনে দেবেনবাবুর অন্য দাঁতগুলো খসে পড়ার যোগাড় হয়েছিল৷ ডাক্তার নাকি রক্তচোষা? দেবেনবাবুর কোলিগরা অবশ্য বলেছিল দুটো দাঁতের জন্য দু’হাজার টাকা চেয়ে নাকি এমন কিছু অন্যায় করেন নি তিনি৷ কিন্তু কোলিগদের কথা শুনে ঠকলে চলবে না তাঁর৷ কাজেই আর সে যাত্রায় দাঁত বসানো হয়নি দেবেনবাবুর৷ দু-তিনশো টাকা হলে না হয় একটা কথা ছিল, তা বলে দু-হাজার টাকা!
এই নির্জন পথে ডেনটিস্টের চেম্বারে দেখে দেবেনবাবুর হঠাৎই মনে এল, তাঁকে একবার কে যেন বলেছিল চীনা দাঁতের ডাক্তারদের কাছে নাকি বেশ সস্তায় দাঁত পাওয়া যায়৷ দাঁত তোলা, দাঁত বেঁচা এ সব কারবার তারা সস্তায় করে৷ কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথে দেবেনবাবুর মনে হল, এখানে তো একবার খোঁজ নেওয়া যেতে পারে৷ যদি সস্তায় দাঁত পাওয়া যায়? লোকে শীতের দেশে বেড়াতে এসে গাঁদাগাঁদা পয়সা নষ্ট করে গুচ্ছের সোয়েটার, চাদর ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়৷ তিনি নয় দাঁতই নিয়ে যাবেন৷ শীতবস্ত্র চেয়ে দাঁত অনেক কাজের জিনিস৷ সব সময় সব ঋতুতে ব্যবহার করা যায়৷ একটু ভেবে নিয়ে গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দেবেনবাবু এগোলেন বাড়িটার দিকে৷
দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷ কোনো শব্দ আসছে না বাড়ির ভিতর থাকে৷ ঘষা কাঁচের জানলা দিয়ে বাড়ির ভিতর কিছু দেখাও যাচ্ছে না৷ দেবেনবাবু ডোরবেল বাজালেন৷
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা৷ তারপর খুট করে একটা শব্দ হল৷ দরজাটা একটু ফাঁক হল৷ তার ভিতর থেকে উঁকি দিল মাঝবয়সী এক চীনাম্যানের মুখ৷ দেবেনবাবুকে একবার দেখে নিয়ে লোকটা ইংরাজীতে জানতে চাইলেন ‘টুরিস্ট’? দাঁতের ডাক্তারের কাছে এসেছেন?’
দেবেনবাবু জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, দাঁতের ব্যাপারে এসেছি৷’
লোকটা দরজার পাল্লাটা আরও একটু ফাঁকা করে বলল, ‘ভিতরে আসুন৷’
বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন দেবেনবাবু৷ ঠিক তখনই বাইরে ঝূপ করে সন্ধ্যা নামল৷
২
করিডোর পার হয়ে ছোটো একটা ঘরে উপস্থিত হলেন তিনি৷ সে ঘরে চেয়ার দেখিয়ে দেবেনবাবুকে সেখানে বসতে বলে অন্য একটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা৷
মাথার ওপর লাল কাগজ মোড়া একটা চীনা লণ্ঠন ঝুলছে সে ঘরে৷ তার হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা টেবিলের দু-পাশে দুটো চেয়ার৷ তারই একটাতে বসেছেন দেবেনবাবু৷ ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেলেন তিনি৷ এটা কী ডাক্তারের চেম্বার নাকি কিউরিও শপ! দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারে দাঁতের ছবি থাকে ঠিকই, কিন্তু তা এমন বিচিত্র ভাবে উপস্থাপিত হয় জানা ছিল না দেবেনবাবুর৷ দেওয়ালের একটা দিকে জুড়ে কাঠের প্যানেলে চীনা ড্রাগনের মূর্তি আঁকা৷ তার ভাঁটার মতো চোখ, লাল চেরা জিভ৷ আর তার পাশ থেকে উঁকি মারছে করাতের মতো সারসার ভয়ঙ্কর দাঁত৷ অন্য দিকের দেওয়ালে গুলোতে ঝুলছে নানা ধরনের তিববতী মুখোশ৷ কিউরিওশপে যেমন তিববতী অপদেবতার মুখোশ ঝোলে তেমনই সব৷ত ভয়ঙ্কর সব দাঁতবার করা মুখোশ৷ আর একদিকে র্যাকের ওপর রাখা আছে বিভিন্ন আকারের ‘লাফিং বুদ্ধ’ মূর্তি ৷ তারাও দাঁত বার করে আছে৷ চীনা লণ্ঠনের লাল আলোর আলো-আঁধারীতে সেই ড্রাগন মূর্তি, মুখোশগুলো, লাফিং বুদ্ধর পেটমোটা মূর্তিগুলো সবাই যেন দাঁত বাড় করে দেবেনবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে৷ অদ্ভুত আশ্চর্য পরিবেশ৷ দেবেনবাবুর কেমন যেন অস্বস্তি লাগল চারপাশে তাকিয়ে৷
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তারের সাদা অ্যাপ্রন পড়ে ঘরে ঢুকল একজন৷ তাকে দেখে দেবেনবাবুর একবার মনে হল, আরে এ লোকটাইতো তাঁকে একটু আগে দরজা খুলে এখানে বসিয়ে রেখে গেল; মুখটা যেন একই রকম লাগছে তার! লোকটা দেবেনবাবুর মুখোমুখি উলটো দিকে টেবিলের ওপাশে বসল৷ তারপর ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘আমি ডক্টর লুই সেঙ৷ ডেনটিস্ট৷ আপনার দাঁতে কী সমস্যা? ব্যথা? যাদের দাঁতে গন্ডগোল আছে পাহাড়ী দেশে বেড়াতে এলে কনকনে ঠান্ডা বাতাসে দাঁত ব্যাথা অনেক সময় বাড়ে৷ নতুন কিছু নয়৷ কোথা থেকে আসছেন আপনি?’
তার কথা শুনে দেবেনবাবু ইংরাজীতেই জবাব দিলেন, ‘আমি কলকাতা থেকে আসছি৷ আজই এসেছি৷ নীচের ওই পাহাড়ী বস্তির একটা বাড়িতে উঠেছি৷’
তারপর তিনি বলেন, ‘দাঁতের ব্যাপারে এসেছি ঠিকই তবে ব্যাপারটা দাঁত ব্যাথার নয়, আমার দুটো দাঁত পড়ে গেছে৷ খেতে অসুবিধা হয়৷ দাঁত বসানোর ইচ্ছা৷ এখানে কী দাঁত পাওয়া যায়?’
লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দেবেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো দুটো দাঁত দেখি? মুখটা ফাঁক করুন৷’
দেবেনবাবু হাঁ করলেন, পকেট থেকে একটা ছোটো টর্চ বার করে তা দিয়ে দাঁতের ফাঁকা জায়গা দুটো দেখল ডেনটিস্ট৷ তারপর আবার নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই পাওয়া যাবে৷ দাঁড়ান আপনাকে দেখাই৷’
টেবিল সংলগ্ন দেরাজ থেকে বেশ কিছু ছোটো ছোটো বাক্স বার করে তার ঢাকনা খুলে দেবেনবাবুকে দেখাবার জন্য টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখল লোকটা৷ বাক্সগুলোর মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে নানা ধরনের দাঁত৷ এই লাল ভুতুড়ে আলোতেও তাদের মধ্যে কয়েকটা দাঁত ঝিলিক দিচ্ছে৷ বাক্সগুলো মেলে ধরে লোকটা বলল, ‘কোন দাঁত আপনার পছন্দ বলুন? সোনার দাঁত থেকে শুরু করে সেরামিক, পলিমার, সব ধরনের দাঁতই আমার কাছে আছে৷ যেটা আপনার পছন্দ হবে৷’
দেবেনবাবু মৃদু আঁতকে উঠে বললেন, ‘না, না, সোনাটোনা অত দামী কিছু নয়, সস্তা দামের কিছু জিনিস৷ যাতে কাজ চলে, আবার টেকসইও হয়, তেমন কিছু আছে?’
লোকটা তার কথা শুনে একটা বাক্স খুলে দুটো দাঁত দেখিয়ে তাঁকে বলল, ‘এ দাঁতগুলো আপনি নিতে পারেন৷ পলিমারের ক্যানাইন, খুব মজবুত ও টেকসই৷ আপনার মাড়িতে খুব ভালো সেটাও হবে৷’
দেবেনবাবু জানতে চাইলেন, ‘কেমন খরচ পড়বে?’
লোকটা জবাব দিল, ‘খুব বেশি নয়৷ দুটো দাঁতের জন্য সব মিলিয়ে হাজার টাকা৷ আমি এখনই বসিয়ে দেব দাঁত দুটো৷ আমার ফিজও ধরা আছে ওর মধ্যে৷’
‘হাজার টাকা!’ যদিও কলকাতার ডাক্তারদের তুলনায় অর্ধেক দাবী করেছেন তিনি, তবুও দেবেনবাবু স্বগোতক্তির সুরে বলে উঠলেন, ‘আরে এও তো যে দেখছি ‘রক্তচোষা৷’
লোকটার সাথে এতক্ষণ ইংরাজিতে কথা বললেও এ কথাটা তিনি বাংলাতেই বললেন৷ কিন্তু দেবেনবাবুর মনে হল এ কথাটা বলার সাথে সাথেই লোকটার দু-চোখ দপ করে জ্বলে উঠল৷ চোয়াল শক্ত করে লোকটা বলল, ‘আপনি কী বললেন?’
লোকটা বাংলা বোঝে নাকি? দেবেনবাবু সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি বলছিলাম, এত দামী জিনিস কেনার ক্ষমতা আমার নেই৷ দু-তিনশো টাকায় যদি কিছু পাওয়া যায়?’
লোকটা প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে৷ তার চোখের দৃষ্টি এবার যেন বদলে গেল কৌতুকে৷ সে বলল, ‘হ্যাঁ, আছে৷ আপনি যখন চাইছেন সেটাই দেব৷ নিয়ে আসছি সেটা৷’ এই বলে লোকটা চেয়ার ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল৷ দেবেনবাবু আবার তাকিয়ে দেখতে লাগলেন ঘরটা৷ সেই ছবি, মূর্তিগুলো যেন দন্তবিকশিত করে তাকেই লক্ষ্য করছে৷ একলা ঘরে সবার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল তাঁর৷ মনে হতে লাগল ওই সব দাঁত বার করা অদ্ভুত মূর্তিগুলো যেন এখনই তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে, এমন কী টেবিলের ওপর রাখা দাঁতগুলোও যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে; অদ্ভুত, বিচিত্র এক পরিবেশ! কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য আবার ঘরে ফিরে এল ডেনটিস্ট লুই সেঙ৷ তার হাতে ছোটো একটা বাক্স৷ তাকে দেখে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন দেবেনবাবু৷ একলা এই ঘরে যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল তাঁর৷ তিনি লোকটার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনার এ ঘরের ছবি, মুখোশ মূর্তিগুলো বড়ো অদ্ভুত!’
লুই সেঙ তার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘ওদের দাঁতগুলো দেখে বলছেন? হ্যাঁ, ওদের সবারই দাঁত খুব শক্ত৷ তাই এই ছবি-মূর্তিগুলো রেখেছি৷ সবাইতো শক্তপোক্ত দাঁত চায়৷’ কথাটা বলে লোকটা প্রথমে তার ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে হাসল৷ দেবেনবাবুর মনে হল, এই হাসিটাও একটা বিজ্ঞাপন৷ লোকটার নিজের দাঁতও বেশ শক্তপোক্ত৷
লোকটা এবার তার হাতের বাক্সটা খুলল৷ ছোট্ট পাথরের বাক্সের মধ্যে লাল ভেলভেটের চাদরে রাখা রয়েছে এক জোড়া ঝকঝকে দাঁত৷ দাঁত দুটো দেখিয়ে সে বলল, ‘এ ক্যানাইন জোড়া পছন্দ আপনার?’
দেবেনবাবু দাঁত দুটো দেখে বললেন, ‘দেখতে তো ভালোই লাগছে, কিন্তু দাম কত?’
সেই চীনা ডেনটিস্ট জবাব দিল, ‘আপনি যা দেবেন তাই৷ এমন কী আপনি কিছু না দিলেও চলবে৷ অনেক দিন ধরে দাঁত জোড়া পড়ে আছে৷ আপনার যদি কাজে লাগে লাগুক৷’
তার কথা শুনে এবার বেশ খুশি হলেন দেবেনবাবু৷ ঈষৎ লজ্জিত ভাবে তিনি বললেন, ‘না, না, বিনে পয়শায় কী জিনিস নেওয়া যায়? আমি না হয় দুশো টাকা দেব৷’
লোকটা যেন তাঁর এ কথাতেই খুশি হল৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে সে কী সব যন্ত্রপাতি দিয়ে দেবেনবাবুর দাঁতের মাপ নিল৷ তারপর সেই দাঁত দুটো নিয়ে কী সব যেন করল খুটখাট করল৷ সে কাজ শেষ হলে দেবেনবাবুর মুখ ফাঁক করে সম্ভব ক্লিপের সাহায্যে বসিয়ে দিল দাঁত দুটো৷ আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটে উঠল তার চোখে৷ কাজ শেষ৷
ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে কোনো একটা প্রাণীর ডাক ভেসে এল৷ ডাক না বলে তাকে অবশ্য যেন গর্জন বলাই ভালো৷ একপাল প্রাণী যেন কোথাও ডেকে উঠল৷
দেবেনবাবু সেই ডাক শুনে মৃদু চমকে উঠে বললেন, ‘ও কিসের শব্দ?’
লুই সেঙ নামের লোকটা হেসে বলল, ‘বাড়িটার সামনে যে পাহাড়টা আছে, ওর ঢালের জঙ্গলে কিছু নেকড়ে আছে৷ ও তাদেরই ডাক৷ অন্ধকার নামলে তারা একবার ডাকে৷ রাতকে আমন্ত্রণ জানায় ওরা৷ ওদের দাঁতও কিন্তু শক্ত৷ ঠিক আপনাকে যে দাঁত দিলাম তার মতোই শক্ত ক্যানাইন ওদের৷ সহজে মাংস ছিঁড়তে পারে৷’
কথাটা শুনে দেবেনবাবু একটু ভয় পেয়ে বললেন, ‘বাইরে নিশ্চই অন্ধকার নেমেছে৷ আমাকে এবার ফিরতে হবে৷ ওরা আমাকে আক্রমণ করবে নাতো?’
লোকটা শুনে হেসে বলল, ‘নির্জন পথে একলা মানুষ পেলে দলবদ্ধ ভাবে ওরা যে মানুষের ওপর হামলা চালায় না, এ কথা বলব না৷ তবে এটুকু বলব আপনাকে ওরা কিছু করবে না৷ নিশ্চিন্তে থাকুন৷’
লোকটার কথায় একটা নিরাপত্তার আশ্বাস থাকলেও কেমন যেন অদ্ভুত লাগল তার কথাগুলো৷ কেন? তাঁকে আক্রমণ করবেনা কেন? যাই হোক এ প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে টাকা বার করার জন্য পকেটে হাত দিলেন তিনি৷
লোকটা তাই দেখে বলে উঠল, ‘থাক, টাকা দিতে হবে না৷ যদি সম্ভব হয় আমার একটা উপকার করবেন? আমি নীচে বিশেষ যাই না৷ যদি সম্ভব হয় ওই টাকাতে দুটো মুরগী কিনে এখানে দিয়ে যাবেন?’
বেশ অদ্ভুত প্রস্তাব৷ দেবেনবাবু যে বাড়িতে আছেন, সে বাড়িতেই একপাল মুরগী দেখেছেন তিনি৷ টাকা পেলে তারা নিশ্চই বিক্রি করবে সেগুলো৷ দেবেনবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে, কাল সকালেই অপনার বাড়িতে পৌছে যাবে দুটো মুরগী৷’ দুটো মুরগী বদলে দুটো দাঁত; কতো সস্তা ব্যাপার! কলকাতার ডাক্তারদের এবার মনে মনে ‘রক্তচোষা’ বলে মন মনে গালাগালি দিলেন তিনি৷
লুই সেঙ তার কথা শুনে বলল, ‘না, আমার বাড়িতে নয়, সামনের পাহাড়ের ঢালে মুরগী দুটোকে ছেড়ে দিয়ে গেলেই হবে৷ আমি দিনের বেলা বাড়ি থাকব না৷’
তার একথা শুনে দেবেনবাবু আবারও একটু আশ্চর্য হলেও মুখে বললেন, ‘ঠিক আছে৷ তাই হবে৷’
কাজ শেষ৷ এবার উঠে দাঁড়ালেন দুজনেই৷ সদর দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়ে দরজা খুলে লোকটা বলল, ‘গুডবাই, আবার নিশ্চই দেখা হবে আমাদের৷’
দেবেনবাবু মুখে বললেন, ‘হ্যাঁ, নিশ্চই’৷ মনে মনে বললেন, ‘তোমার সাথে আর দেখা হবার সম্ভাবনা নেই আমার৷’ বাইরে পা রাখলেন তিনি৷ অন্ধকার নেমেছে অনেক্ষণ৷ অনেক নীচে দেখা যাচ্ছে আলো ঝলমল গ্যাংটক শহর৷ তিনি অবশ্য অত নীচে যাবেন না৷ রাস্তার গায়ই মাথার ওপর উঠে যাওয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের ঢালটা দেখেই তার মনে পড়ে গেল সেই নেকড়ের ডাকের কথা৷ যদি লোকটা বেশ জোড় দিয়েই বলল যে তার বিপদের কোনো সম্ভবনা নেই, তবুও বেশ ভয়ে ভয়েই অন্ধকার পাকদন্ডি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করলেন তিনি৷
শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলেন নীচের পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট গ্রামটাতে৷ গ্রামে ঢোকার মুখেই আস্তানা গেড়েছেন তিনি৷ সে বাড়ির লোকটা একটা লণ্ঠন হাতে বাড়ির বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল৷ দেবেনবাবুকে দেখে সিকিমিজ লোকটা উৎকণ্ঠিত ভাবে বলল, ‘আপনি ওদিকে গেছিলেন; ফিরছেন না দেখে খুব চিন্তা হচ্ছিল৷ ওপরের পাহাড়ের জঙ্গলে নেকড়ে আছে৷ মাঝে মাঝে তারা হানা দেয়৷ বাগে পেলে মানুষকেও ছাড়ে না৷ অন্ধকার নামলে ওদিকে আমরা কেউ যাই না৷’
দেবেনবাবু বেশি কথায় না গিয়ে তাকে শুধু বললেন, ‘কাল সকালে আমাকে তোমার দুটো মুরগী দিও তো৷ আমি কিনব৷’ লোকটা বলল, ‘আচ্ছাবাবু৷ বেশ তাজা মোরগ আছে৷’
৩
যে বাড়িতে দেবেনবাবু উঠেছিলেন সে বাড়িতেই তাঁর খাবার ব্যবস্থা৷ হোটেলে খেতে গেলে বেশি পয়শা লাগবে৷ তাছাড়া নীচে গ্যাংটক শহরে নামতে হবে তাঁকে৷ সিকিমিজ লোকটা তার ঘরে করা রাতের খাবার নিয়ে এল৷ রুটি-ডাল-সবজি৷ রুটি দেখেই ঘাবড়ে গেলেন তিনি৷ এত মোটা আর শক্ত রুটি তিনি খাবেন কী ভাবে? হাত দিয়েই তো রুটি ছেঁড়া যাচ্ছে না! কোনোরকমে একটা রুটি ছিঁড়ে মুখে তুলতেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি৷ রুটি চিবুচ্ছেন, নাকি নরম লুচি৷ তাঁর নতুন দাঁত দুটো যেন মাখনের মতো রুটি ছিড়ছে৷ সত্যি খুব পোক্ত দুটো দাঁত দিয়েছে লোকটা৷
পাহাড়ীদেশে খাওয়া সেরে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে লোকজন৷ দেবেনবাবুর সারাদিন খুব ধকল গেছে৷ খাওয়া সেরে তিনিও শুয়ে পড়লেন৷ সারা রাত ধরে তিনি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন৷ একপাল নেকড়ের মাঝে, তাদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি৷ কখনও পাহাড়ের ঢালের গভীর জঙ্গলে, কখনও বা কনকনে ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বরফের চাদরে মোড়া প্রান্তরে৷ আর তার সাথে সারা রাত ধরে তাঁর কানে বাজতে লাগল অবিশ্রান্ত নেকড়ের গর্জন৷ কখনও সেই গর্জন শিকার ধরার উল্লাসধ্বনি, কখনও বা সম্মিলিত করুন বিলাপের মতো৷ নানা ঢঙে, নানা সুরে বেজে চলল সেই জান্তব সঙ্গীত৷
ভোরবেলা মৃদু চিৎকার চেঁচামচি শব্দে ঘুম ভেঙে গেল দেবেনবাবুর৷ বাড়ির পিছন থেকে শব্দটা আসছে৷ সেদিকে একটা দরজাও আছে৷ সেটা খুলে তিনি বাইরে বেরোতেই দেখতে পেলেন কিছুটা তফাতে বাঁশের বাখরি দিয়ে ঘেরা মুরগী রাখার আস্তানটার সামনে বাড়ির সিকিসিজ মালিক তার বৌ-বাচচাকাচচা সমেত দাঁড়িয়ে আছে৷ দেবেনবাবু তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেলেন চারপাশের মাটিতে মুরগীর পালক আর গোটা কতক মুন্ডুহীন মুরগী পড়ে আছে৷ বাঁশের বাখারির তৈরি সেই খাঁচার দরজা খোলা৷ ভিতরে একটাও মুরগী নেই! বিস্মিত দেবেনবাবু জানতে চাইলেন কী হয়েছে?
লোকটা বলল, ‘নেকড়ে হানা দিয়েছিল৷ সব মুরগী কটাকে মেরে গেল; আপনার ঘরেও ঢোকার চেষ্টা করেছে৷ ওই দেখুন আপনার চৌকাঠ থেকে নেকড়ের পায়ের ছাপ এদিকে এসেছে৷’ এই বলে সে আঙুল দিয়ে মাটির ওপর আর পায়ের ছাপগুলো দেখাল৷
দেবেনবাবু বললেন, ‘নেকড়ে এখানেও হানা দেয় নাকি? ওই জন্যই হয়তো আমি যেন রাতে ঘুমের মধ্যে নেকড়ের ডাক শুনছিলাম৷ তাহলে সেটাও সত্যি!’
সিকিসিজ লোকটা বলল, ‘না, সাধারণত তারা এত নীচে নেমে গ্রামে হানা দেয় না৷ কখনও হঠাৎ নীচে চলে এলেও গ্রামের কুকুর গুলো ডেকে আমাদের সজাগ করে দেয়৷ আমরা মশাল জ্বেলে, ক্যানেস্তারা পিটিয়ে তাদের হটিয়ে দেই৷ আপনি ডাক শুনেছেন বটে, কিন্তু আমরা কিছু শুনিনি৷ কুকুরগুলোও ডাকেনি৷ বেশ অদ্ভুত ব্যাপার! আপনাকেও আর মোরগ দেওয়া হল না আমার৷’ বেশ বিমর্ষ ভাবে লোকটা কথা গুলো বলল৷
দেবেনবাবুর চোখে হঠাৎ ভেসে উঠল গতকালের সেই চীনা ডেনটিস্টের মুখটা৷ দেবেনবাবু তাকে কথা দিয়েছিলে দুটো মুরগী দেবেন৷ কিন্তু এখন আর মুরগী না পাওয়া গেলে কী হবে? সত্যিই তিনি দুটো মুরগী সকালে উঠে পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলে ছেড়ে আসবেন ভেবেছিলেন৷ দেবেনবাবুর টাকা বাঁচল ঠিকই, কিন্তু তিনি বেশ দুঃখিত হলেন ব্যাপারটাতে৷ তিনি একটু হিসাবী লোক ঠিকই, কিন্তু কথা খেলাপী নন৷ তিনি খোঁজ নিয়ে জানলেন এ লোকটা ছাড়া গ্রামে আর কেউ মুরগী পোষে না৷
ঘরে ফিরে এলেন তিনি৷ তাঁকে বেরতে হবে৷ নীচে নেমে গ্যাংটকে শহরটা একবার পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখবেন ভেবেছেন৷ টুরিস্টরা গ্যাংটক বেড়াতে এলে গাড়ি নিয়ে ছাংগুলেক, নাথুলাপাস এসব দেখতে যায়৷ কিন্তু তাতে বেশ খরচা৷ ও পথ মাড়াবেন না তিনি৷ বাড়ি থেকে বেরোবার আগে মুখ ধোয়ার সময় তিনি একবার ভাবলেন, দাঁত দুটো খুলে একবার ভালো করে ধুয়ে নেওয়া যাক৷ কিন্তু ক্লিপ দুটো দাঁতের সাথে এমনভাবে এঁটে গেছে যে কিছুতেই দাঁত দুটোকে তিনি খুলতে পারলেন না৷ একটু পর সেই বাড়ি, গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি৷ নীচে নেমে উপস্থিত হলেন গ্যাংটক শহরে৷
ছোট্ট শহর, কিন্তু ছবির মতো সাজানো৷ দিনের প্রথম আলোয় ঝলমল করছে শহরটা৷ রাস্তার পাশে কিউরিওশপ, পোশাক, মোমো, খাবারের দোকান৷ স্থানীয় সিকিমিজ লোকজন, মুন্ডিত মস্তক তিববতী লামা, রঙবেরঙের পোশাক গায়ে টুরিস্টরা ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ চারপাশে বেশ খুশির পরিবেশ৷ রাস্তার একটা সস্তার দোকানে দাঁড়িয়ে এক প্লেট মোমো খেলেন দেবেনবাবু৷ তারপর দোকানীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পায়ে হেঁটে, বিনা পয়সায় কী কী দেখা যায়?’
সে লোকটা জানাল, সব জায়গাতে ঢুকতেই পয়সা লাগে৷ আপনি বরং ওই যে ওই পাহাড়ের মাথায় এনচে মনাস্ট্রিতে চলে যান৷’ তার কথা শুনে সে পাহাড়ের দিকে দেবেনবাবু এগোলেন৷
শহরের প্রধান রাস্তা থেকে পাকদণ্ডী উঠে গেচে এনচে মনাস্ট্রির দিকে৷ পথের দুপাশে ঘন দেবদারু বনে হীমেল বাতাসের কানাকানি৷ পাতা থেকে জল খসে পড়ার টুপটাপ শব্দ৷ এ পথে টুরিস্ট আছে কিন্তু সংখ্যায় অল্প৷ এক সময় পাহাড়ের মাথায় মনষ্ট্রি চত্বরে উঠে এলেন তিনি৷ পাহাড়ের মাথায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মনাস্ট্রি৷ দেবেনবাবু একটা সাইনবোর্ড দেখে জানতে পারলেন এই বৌদ্ধ গুম্ফার বয়স তিনশো বছর৷ এ মনাস্ট্রিতে বৌদ্ধ লামারা তন্ত্রসাধনা ও অতিপ্রাকৃত বিদ্যার র্চ্চা করেন৷ জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে ওপাশে দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাস যেন দেহে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে৷ দেবেনবাবু এসে দাঁড়ালেন মনাস্ট্রির সামনে৷ কাঠের তৈরি৷ ঢালু ছাদঅলা প্রাচীন মনাস্ট্রি৷ তার বাইরের দেওয়ালে, থামের গায়ে বসানো আছে দাঁত বার করা ভয়ঙ্কর দেখতে সব তিববতী অপদেবতাদের মূর্তি! মনাস্ট্রির সামনে জঙ্গল কিছুটা হালকা৷ তার ফাঁক দিয়ে ওপাশের পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে৷ দেবেনবাবু বুঝতে পারলেন ওই পাহাড়টারই নীচের দিকে কোনো একটা ঢালের গ্রামে তিনি আস্তানা গেড়েছেন৷ পাহাড়ের মাথার ঢালে ঘন জঙ্গল এখনও কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে৷ দিনের বেলাও খুব একটা আলো ঢোকে না সেখানে৷ ও জায়গাতেই সম্ভবত নেকড়েগুলো থাকে৷
মনাস্ট্রির গায়ে বসানো দাঁত বার করা মূর্তিগুলো দেখে মুহূর্তের জন্য দেবেনবাবুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল গতকাল সন্ধ্যার সেই অদ্ভুত ঘরটার কথা৷ ঠিক এমনই সব ভয়ঙ্কর মুখ ঝোলানো ছিল সেখানে৷
গুটি গুটি পায়ে দেবেনবাবু এগোলেন মনাস্ট্রির ভিতরে ঢোকার জন্য৷ তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে মনাস্ট্রির ভিতর ঢুকতে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় ভিতরের অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে তাঁর পথ আটকে দাঁড়ালেন মুন্ডিত মস্তক, গায়ে লাল চাদর জড়ানো, হাতে একটা জপযন্ত্র ধরা একজন বৃদ্ধ লামা৷ দেবেনবাবুর মনে হল তিনি যেন দুর্বোদ্ধ ভাষায় তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন, তারপর জপযন্ত্র ধরা হাতটা উঠিয়ে ও পাশের সেই কুয়াশচ্ছন্ন, ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়টা দেখালেন৷ সেদিকে দেবেনবাবু আবার তাকালেন৷ লামা কী বলছেন? তাঁকে ও জায়গাতে যেতে? ওই পাহাড়ে ফিরে যেতে? ব্যাপারটা ঠিক তার বোধগম্য হল না৷ তিনি সামনে তাকলেন৷ সেই বৃদ্ধলামা অদৃশ্য হয়ে গেছেন মনাস্ট্রির ভিতর অন্ধকারে৷ যদিও তিনি একটু আগেই মনাস্ট্রির ভিতর থেকে দুজন টুরিস্টকে বেরোতে দেখেছেন, তবুও তিনি এরপর আর ভিতরে ঢোকার সাহস করলেন না৷ আশেপাশে একটু ঘুরে বাইরে থেকে মনস্ট্রিটা দেখে দেবেনবাবু নীচে নামার পথ ধরলেন৷
৪
নীচে নেমে রাস্তার পাশে একটা পার্কে বসে দেবেনবাবু কিছুটা সময় জিরিয়ে নিলেন৷ তারপর কিছুটা উদ্দেশ্যহীন ভাবেই রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন চারপাশ দেখতে দেখতে৷ একটা সোয়েটারের দোকানে ঢুকে মেয়ের জন্য একটা সোয়েটার দরদাম করেও শেষ পর্যন্ত নিলেন না৷ কারণ, তাঁর মনে হল কলকাতায় এ জিনিস এর চেয়ে অনেক কমদামে পাওয়া যায়৷ হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তিনি দেখলেন চিড়িয়াখানার সামনে উপস্থিত হয়েছেন৷ লোক ঢুকছে, বেরোচ্ছে গেট দিয়ে, কিন্তু রাস্তার সামনে টিকিট কাউন্টারটা বন্ধ৷ প্রবেশ তোরণটা বেলুন ফুলটুল দিয়ে সাজানো হয়েছে৷ ব্যাপারটা কী? তিনি একটা লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন এ দিন নাকি চিড়িয়াখানার জন্মদিন, ভিতরে ঢুকতে তাই কোনো টিকিট লাগছে না৷ কথাটা শোনার সাথে সাথে দেবেনবাবু চিড়িয়াখানার ভিতরে ঢুকে পড়লেন৷ যাক, এবার তাঁর আরও একটা দ্রষ্টব্য দেখা হয়ে যাবে! তবে এ সময় মেয়ে টেঁপির কথা মনে পড়ল তাঁর৷ মেয়েকে বড় ভালোবাসেন দেবেনবাবু৷ সে সঙ্গে থাকলে ভালো লাগত৷ চিড়িয়াখানাটা কলকাতা চিড়িয়াখানার মতো বড় নয় ঠিকই, কিন্তু এখানে এমন কিছু দুষ্প্রাপ্য পাহাড়ী জীবজন্তু আছে যা কলকাতার চিড়িয়াখানাতে নেই৷ গরমের জায়গাতে তারা বাঁচে না৷ সব চিড়িয়াখানার মতোই টুরিস্টের বেশ ভিড় এখানেও৷ তার মধ্যে একটা বড়ো অংশই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে৷
দেবেনবাবুর হাতে অফুরন্ত সময়৷ তিনি ধীরে সুস্থে ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলেন খাঁচাগুলো৷ নানা ধরনের বাহারী ফেজেন্ট, স্নো-আউল, স্নো লেপার্ড, নানা ধরণের পাহাড়ী জীবজন্তু৷
দেবেনবাবু তখন একটা পাহাড়ী বনবিড়ালের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে৷ হঠাৎ চারপাশে প্রচণ্ড চিৎকার চ্যাচামেচি শুরু হল৷ সবাই প্রাণভয়ে গেটের দিকে দৌড়াচ্ছে৷ বাচচারা আতঙ্কে কাঁদছে৷
দেবেনবাবু দেখলেন কিছু দূর থেকে কয়েকজন যেন প্রাণভয়ে তার দিকেই দৌড়ে আসছে, আর তাদের পিছনে ধাওয়া করে আসছে সাদা কী একটা যেন! কিন্তু দেবেনবাবু ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার আগেই পলায়মান লোকগুলো তাঁর ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল৷ দেবেনবাবুকে এক ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে ফেলে তারা ছুটল গেটের দিকে৷
দেবেনবাবু আবার উঠে দাঁড়ালেন৷ সোয়েটারের গা থেকে ধুলো ঝাড়তে যাচ্ছিলেন তিনি৷ কিন্তু সামনে তাকিয়ে তাঁর হাতটা ওপরে উঠতে গিয়েও নেমে গেল৷ তাঁর সাত আট ফুট তফাতে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা প্রকাণ্ড এক কুকুর জাতীয় প্রাণী! নেকড়ে!! তার সাদা শরীরে সৌন্দর্যর চেয়ে হিংস্রতাই যেন অনেক বেশি প্রকট হয়ে আছে৷ দাঁত বার করে গজরাচ্ছে প্রাণীটা৷ ছুরির ফলার মতো শ্বাপদের দাঁত! লাল জিভ থেকে লালা ঝড়ছে ফোটা ফোটা৷ চোখের দৃষ্টিতে জেগে আছে আদিম ক্রুরতা! হিংস্র পাণীটার পিঠ ধীরে ধীরে ধনুকের মতো ওপর দিকে বেঁকে যাচ্ছে, পিঠের লোমগুলো ঝাঁটার কাঠির মতো খাঁড়া হয়ে উঠছে, দেবেনবাবুর গলা লক্ষ করে ঝাপ দেবার আগে তাঁকে শেষ মুহূর্তের জন্য যেন জরিপ করে নিচ্ছে প্রাণীটা৷
ভয় অথবা বিস্ময়ে সে দিকে তাকিয়ে দেবেনবাবুর মুখটা আপনা থেকেই হাঁ হয়ে গেল৷ পাথরের মূর্তির মতো সেই ভয়ঙ্কর পাণীটার চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি৷
না, প্রাণীটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝাঁপাল না৷ হঠাৎই একটা পরিবর্তন দেখা দিল তার মধ্যে৷ লোমগুলো বসে গেল, পিঠটা আবার স্বাভাবিক হয়ে এল তার৷ চোখের দৃষ্টিতেও একটা পরিবর্তন হল যেন৷ আর সেই চাপা হিংস্র গর্জন বদলে গেল ঘড়ঘড় শব্দে৷ ধীর পায়ে দেবেনবাবুর কাছে এগিয়ে এসে অত বড়ো হিংস্র প্রাণীটা পোষা কুকুরের মতো দেবেনবাবুর পায়ে গা ঘসতে লাগল৷ নিজের অজান্তেই দেবেনবাবুর হাতটা যেন নেমে এল প্রাণীটার মাথায়৷ নেকড়েটার মাথায় পিঠে হাত বোলাতে লাগলেন তিনি৷ যে কজন লোক তখনও চিড়িয়াখানা থেকে পালাতে পারেনি তারা আর চিড়িয়াখানার কর্মীরা নিরাপদে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সেই ভয়ঙ্কর অদ্ভুত দৃশ্য৷
দেবেনবাবু কিছুক্ষণ তার গায়ে হাত বোলানোর পর প্রাণীটা একটু সরে গিয়ে সে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে কিছুটা এগিয়ে মুখ ফিরিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল৷ যেন সে দেবেনবাবুকে অনুসরণ করতে বলছে তাকে৷ দেবেনবাবু সম্মোহিতর মতো অনুসরণ করলেন তাকে৷ প্রাণীটা কিছুটা এগোচ্ছে, তারপর থমকে দাড়িয়ে দেখে নিচ্ছে দেবেনবাবু ঠিক তার পেছন পেছন আসছেন কিনা? প্রাণীটা শেষ পর্যন্ত একটা খাঁচার সামনে এসে দাঁড়াল৷ তারপর সেই খাঁচায় ঢুকে মুখ ফিরিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করে দেবেনবাবুকেও যেন খাঁচার ভিতর ঢুকতে বলল৷ খাঁচার দরজার সামনে একটু ঝুঁকলেন দেবেনবাবু৷ তিনিও কী ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন? কে জানে? কিন্তু ঠিক তখনই চিড়িয়াখানার একটা লোক ছুটে এসে খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিল৷ এবার অন্য লোকরাও ছুটে এল৷ দেবেনবাবুকে নিয়ে শুরু হল হইচই৷ তাঁকে চিড়িয়াখানার ডিরেক্টরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল৷ মালা পড়ানো হল৷ ডিরেক্টর সাহেব বললেন, ‘আপনি আমাদের খুব বাঁচিয়ে দিয়েছেন একটা বড়ো দুর্ঘটনার হাত থেকে, কী ভাবে যে খাঁচার দরজা খুলে গেছিল কে জানে? হিমালয়ান নেকড়ে খুব হিংস্র প্রাণী! ওদের তুষার চিতারাও ভয় পায়৷ এক কামড়ে ওরা মানুষের ধর মুণ্ডু আলাদা করে দিতে পারে, এমনই ওদের চোয়াল আর দাঁতের জোর৷’
আর এক ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি তিরিশ বছর দেশের নানা চিড়িয়াখানায় কাজ করেছি৷ যে সব কর্মী বহু বছর ধরে নির্দিষ্ট কোনো বাঘকে খাবার দেয় তাদের আমি দু-একবার খাঁচার ফাঁক দিয়ে বাঘের গায়ে মুহূর্তের জন্য হাত দিতে দেখেছি৷ কিন্তু খাঁচার ফাঁক দিয়েও কোনোদিন ওই হিমালয়ান নেকড়ের গায়ে কাউকে হাত দিতে দেখিনি৷ এমনই হিংস্র, ধূর্ত, ভয়ঙ্কর প্রাণী ওরা! ধন্য আপনার সাহস মশাই! আপনি কী কোনো সময় সার্কাস, চিড়িয়াখানা বা বনদপ্তরে কাজ করতেন বা করেন?’
দেবেনবাবু বললেন, ‘না, না, এসব কাজ আমি কোনোদিন করিনি৷’
আর একজন বললেন, ‘তাহলে নিশ্চই আপনি কুকুর পোষেন তাই না? হাউন্ড অথবা অ্যালসেশিয়ান, বড়ো জাতের কোনো কুকুর? অ্যালশেসিয়ানতো নেকড়েরই বংশধর৷ নইলে ও ভাবে প্রাণীটার মাথায় কিছুতেই আপনি হাত বোলতে পারতেন না৷ যাই হোক অমন নেকড়ের মাথায় হাত বোলান খুবই সাহসের ব্যাপার!’
দেবেনবাবু সত্যিই বাড়ির সামনে একটা কুকুর পোষেন৷ কুকুর মানে নেড়ি৷ কালু তার নাম৷ দেবেনবাবু তাকে এটোকাঁটা খেতে দেন৷ তিনি রাস্তায় বেরোলে সে কিছুটা পথ পায়ে পায়ে আসে৷ দেবেনবাবুর মেয়ে টেঁপি তাকে খুব ভালোবাসে৷ কাজেই দেবেনবাবু ‘অশ্বথামা ইতি গজ’র মতো বললেন, ‘হ্যাঁ, কুকুর একটা আছে বটে আমার৷’
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের গর্বিত ভাবে বললেন, ‘দেখলেন ঠিক ধরেছি!’ ভাগ্য ভালো তিনি সেটা কী কুকুর আর জিজ্ঞেস করলেন না দেবেনবাবুকে৷
আর একজন চিড়িয়াখানার কর্মী বললেন, ‘আপনি যখন নেকড়েটার মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন তখন আমি ছবি তুলেছি৷ প্লিজ ঠিকানাটা দেবেন৷ আমি ছবিটা পাঠিয়ে দেব৷’
দেবেনবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই নেকড়েগুলো কোথায় পাওয়া যায়?’
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, ‘হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের জঙ্গলে, পাহাড়ের ঢালের অরণ্যে, আরও ওপারে তুষারাচ্ছদিত অঞ্চলেও ওরা থাকে৷ এক সময় এ তল্লাটেও অনেক পাওয়া যেত৷ এখন হাতে গোনা কিছু টিকে আছে৷ ওই যে ওপাশে পাহাড়টা আছে, সেখানে কিছু আছে৷ এবারের সেনসাস বা গননায় ন’টা নেকড়ের পায়ের ছাপ মিলেছে৷ আমরা ওদের সংরক্ষণের জন্য প্রচার চালাচ্ছি৷ ওরা খাবারের সন্ধানে কোনো সময় নীচে নামলেই গ্রামবাসীরা ওদের পিটিয়ে বা অন্য কোনোভাবে মারার চেষ্টা করে৷ যে নেকড়েটাকে আপনি দেখলেন সেটা ওই পাহাড়েরই৷ গ্রামের লোকের হাত থেকে বছরখানেক আগে আমরা ওকে উদ্ধার করেছি৷
দেবেনবাবু জানতে চাইলেন, ‘গ্রামের লোকরা ওদের মারে কেন?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘নেকড়ে সম্বন্ধে ওদের একটা অন্ধ কুসংস্কার আছে৷ এই নেকড়েগুলো আসলে নাকি ‘ওয়ারউলফ!’ ‘ওয়ারউলফ’ বোঝেন তো? যুদ্ধে যারা নাকি মারা যায় তারা নেকড়ের রূপ ধরে ঘোরে! তাদের বলে ‘ওয়ারউলফ৷’ ইওরোপীয়দের মতো এ ধারণাটা এখানকার মানুষদের মধ্যেও আছে৷ পাহাড়ের ওপাশে চীনসীমান্ত৷ কিছু যুদ্ধ এখানে হয়েছে৷ গ্রামবাসীরা অনেকে মনে করে নেকড়েগুলো আসলে রক্তচোষা প্রেতাত্মা৷’
দেবেনবাবুকে আর ছাড়ল না কেউ৷ চিড়িয়াখানার জন্মদিন উপলক্ষে কর্মীদের ভুরিভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল৷ মাংস সহ বিভিন্ন পদ৷ দেবেনবাবুকেও খেতে হল তাদের সাথে৷ ইদানিং দাঁতের জন্য মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েচিলেন তিনি৷ এদিন তিনি বেশ আরাম করেই মাংস খেলেন তার নতুন দাঁতের দৌলতে৷ সত্যি কথা বলতে কী মাংস খেতে খেতে তাঁর মনে হচ্ছিল, ‘মাংস না খেলে লোকে কী ভাবে বেঁচে থাকে কে জানে?’
খাওয়া পর্ব মিটতে বিকাল হয়ে গেল৷ দেবেনবাবু দেখলেন সূর্য ডুবতে চলেছে সেই জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের মাথায়৷ চিড়িয়াখানা থেকে সবে বাইরে বেড়িয়েছেন দেবেনবাবু, ঠিক সেই সময় তাঁর সামনে এসে একটা জিপগাড়ি খ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল৷ তার থেকে লাফিয়ে নামল একটা লোক৷ আরে এ যে দেবেনবাবুর ভায়রা পরিতোষ! দেবেনবাবুকে দেখে বিস্মিত ভাবে সে বলে উঠল, ‘আরে দাদা আপনি এখানে! গতকাল আপনি এখানে আছেন জানিয়ে আপনার বাড়ি থেকে আমাকে ফোন করেছিল, শহরের সব হোটেলগুলোতে আপনার খোঁজ করেছি আমি৷ কিন্তু পাইনি৷ আপনি এখানে আসবেন, অথচ আর কাছে থাকবেন না তাকি হয়? আপনার জন্য একটু করার ক্ষমতা কী আমার নেই?’
দেবেনবাবু ভায়রার কথা শুনে প্রথমে একটু লজ্জিত ভাবে বললেন, ‘তুমি ব্যস্ত মানুষ, তাই তোমাকে আর বিব্রত করতে চাইনি৷’ তারপর তিনি বললেন, ‘তুমি এখন এখানে কী ভাবে উপস্থিত হলে?’
পরিতোষ জবাব দিল, ‘চিড়িয়াখানায় শুনলাম এক বাঙালি ভদ্রলোক হিংস্র হিমালয়ান নেকড়েকে বশ মানিয়ে খাঁচায় ঢুকিয়েছে৷ সারা শহরে আলোচনা হচ্ছে তাই নিয়ে৷ খবরটা শুনে লোকটা বাঙালি বলে দেখতে এলাম৷ আপনি দেখেছেন লোকটাকে? ভাবছি তাঁকে আমার হোটেলে নিয়ে গিয়ে একটা সম্বর্ধনা দেব৷ বাঙালিকে সবাই ভিতু ভাবে৷৷ এখানকার বাঙালিদের গর্বও হবে, আর আমার হোটেলের পাবলিসিটিও হবে৷ তবে আপনাকে কিন্তু ছাড়ছি না৷ আপনার মালপত্র যেখানে আছে, সেগুলো সেখান থেকে নিয়ে আমার হোটেলে ফিরব৷’
দেবেনবাবু এবার হেসে বললেন, ‘তুমি যে লোকটাকে খুঁজছো, সে লোক কিন্তু আমিই৷ নেকড়েটাকে আমিই… কথাটা তিনি শেষ করতে না করতেই পরিতোষ উল্লাসে জড়িয়ে ধরল তাঁকে৷ তারপর বলল, ‘আমার হোটেলে যাবার আগে আর কোনো কথা হবে না৷ আপনার মালপত্রগুলো কোথায় আছে এবার সেখানে চলুন৷’
পরিতোষের গাড়িতে এরপর বাধ্য হয়ে উঠে বসতে হল তাঁকে৷ দেবেনবাবু তাকে নিয়ে প্রথমে উপস্থিত হলেন তাঁর আস্তানায়৷ সেখানে তাঁর মালপত্র গাড়িতে ওঠাতে ওঠাতে পরিতোষ পাহাড়ের মাথার ঢালটা দেখিয়ে দেবেনবাবুকে বলল, ‘জানেন ও পাহাড়ের মাথায় নেকড়ে থাকে!’
দেবেনবাবু হেসে বললেন, ‘জানি’৷ পরিতোষের গাড়ি যখন সে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল, তখন পাহাড়ের মাথার জঙ্গল অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে৷ কেন জানি দেবেনবাবুর মনে হল ওই পাহাড়চুড়োর অন্ধকার জঙ্গল একবার দেখে আসতে পারলে ভালো হত৷
মোবাইলে পরিতোষ যে দেবেনবাবুকে নিয়ে ফিরছেন তা হোটেলের লোকজনকে আগাম জানি রাখা হয়েছিল৷ সবাই অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য৷ হোটেলের রিসেপশনরুমে পা রাখতেই সবাই ঘিরে ধরল তাঁকে আর পরিতোষকে৷ তার মধ্যে এই হোটেল, আশেপাশের হোটেলের বোর্ডাররা যেমন আছে তেমনই স্থানীয় কিছু লোকজনও আছে৷ আবার একপ্রস্থ মালাটালা পরানো হল তাঁকে৷ দেবেনবাবু কোনো কথা বললেন না, তাঁর হয়ে যা বলবার বলল পরিতোষই৷ এবং একটুরঙ চড়িয়ে সে ব্যাপারটা বলল৷ দেবেনবাবু যে নেকড়েটাকে কব্জা করেছেন, সেটা নাকি নরখাদক, এর আগে তিন তিনটে মানুষকে খুন করেছে সে! ইত্যাদি ইত্যাদি৷ হাত তালির ঝড় উঠল৷ লোকে দেবেনবাবুর সাথে দাঁড়িযে ফটো তুলতে লাগল৷ সবাই যখন দেবেনবাবুকে নিয়ে মাতামাতি করছেন ঠিক তখনই হঠাৎ তার চোখ গেল জানলার দিকে৷ দেবেনবাবু যেন স্পষ্ট দেখলেন সেই জানলার ফাঁক দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে প্রকান্ড মাথা৷ তার চোখ জ্বলছে৷ চোয়ালের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি৷ তুষার নেকড়ে! দেবেনবাবু বলতে যাছিলেন, ‘ওই ওই!’ কিন্তু তার আগেই বাইরের অন্ধকারে হারিয়ে গেল সেই মাথা! হয়তো ব্যাপারটা নিছকই দৃষ্টিবিভ্রম৷ নেকড়ে নিয়ে এত কান্ড হওয়াতে ব্যাপারটা ছাপ ফেলেছে তাঁর মনে৷
অবশেষে অনুষ্ঠান এক সময় শেষ হল৷ লোকজন সব রিসেপশনরুম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর পরিতোষ দেবেনবাবুকে বলল, এবার আপনার ঘরে চলুন, অনেক ধকল গেল আপনার ওপর দিয়ে৷ হোটেলের সেরা ঘরটা আপনার৷ ঠিক এই সময় হোটেলের এক কর্মী এসে একটা ছোটো প্যাকেট দেবেনবাবুকে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটু আগে এক ভদ্রলোক এসে আপনার নাম করে জিনিসটা দিয়ে গেল৷’
দেবেনবাবু প্যাকেটটা খুললেন৷ তার মধ্যে একটা দেওয়ালে ঝোলাবার ছবি৷ খুব সুন্দর ছবি৷ চাঁদের অলোতে বরফাচ্ছদিত এক প্রান্তরে চড়ে বেড়াচ্ছে একপাল নেকড়ে! আদীম প্রকৃতির এক আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য৷ দেবেনবাবুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল গতকাল রাতের স্বপ্নের কথা৷ স্বপ্নের সাথে এ ছবির কী অদ্ভুত মিল! তিনিও স্বপ্ন দেখেছিলেন এমনই নির্জন প্রান্তরে একপাল নেকড়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি!
দেবেনবাবু জানতে চাইলেন, ‘লোকটা কে? ছবিটা যে উপহার দিয়ে গেল আগে তাকে দেখেছেন?’
হোটেলের কর্মচারী বলল, ‘না, আগে দেখিনি৷ সাদা ওভারকোট, সাদা দস্তানা, সাদা টুপি পরা ছিল৷ মুখটাও সাদা মাফলারে ঢাকা৷ তবে তার অবয়ব আর কথা বলার ঢং দেখে মনে হল ভদ্রলোক চীনা বা সিকিমিজ হবে৷’ দেবেনবাবুর আর এ প্রসঙ্গে কথা বাড়ালেন না৷
এদিনও তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লেন দেবেনবাবু৷ হোটেলের সেরা ঘরটাই তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছে৷ দুধ সাদা নরম বিছানা৷ কাঁচের জানলা খুললেই পাহাড়৷ কিন্তু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেও প্রথমে ঘুম আসছিল না দেবেনবাবুর৷ এক সময় তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ কাঁচের পাল্লাটা খুললেন তিনি৷ সারা শহর ঘুমিয়ে পড়েছে৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই৷ দেবেনবাবুর চোখ গেল সেই পাহাড়টার দিকে৷ চাঁদের আলোতে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথার ঢালের জঙ্গলটা৷ মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে তার গায়ে৷ এক অপার্থিব রহস্যময় সৌন্দর্য যেন বিরাজ করছে সেখানে৷ ও জায়গাটা যেন দেবেনবাবুর অনেকদিনের চেনা৷ চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মায়াবী পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাঁকে৷ দেবেনবাবু মন্ত্রমুগ্ধর মতো তাকিয়ে রইলেন সেই পাহাড়ের দিকে৷
কতক্ষণ দেবেনবাবু ও ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন তা তার খেয়াল নেই৷ এক সময় তিনি বিছানায় এসে শুয়ে পড়েলেন৷ কিন্তু সারা রাত ধরে তিনি শুনলেন নেকড়ের ঐকতান৷ স্বপ্নে দেখতে লাগলেন একপাল নেকড়ের সাথে কখন পাহাড়ের ঢালের বনভূমিতে, কথনওবা তূষাররাবৃত প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি৷ বেশ ভালোই লাগছে তাঁর ঘুরতে৷ সেখানে কোনো অফিসের চাপ নেই, সংসারের চাপ নেই, শুধু রয়েছে উন্মুক্ত প্রান্তর, বনভূমিতে অনাবিল মুক্তির আনন্দ৷ স্বপ্নটাকে বেশ যেন উপভোগ করলেন তিনি৷
ভোর হল এক সময়৷ ঘুম ভাঙল দেবেনবাবুর৷ বাথরুমে মুখ দুয়ে দাঁত মাজার সময় এদিনও দাঁত দুটোকে খোলার চেষ্টা করলেন তিনি৷ কিন্তু পারলেন না৷ দাঁত দুটো শক্ত ভাবে এঁটে গেছে তাঁর চোয়ালে৷
ফ্রেশ হয়ে হোটেলের রিসেপশনে নেমে এসে তিনি দেখতে পেলেন পরিতোষ একটা লোককে ধমকে বলছে, ‘দ্বিতীয়বার এমন ঘটনা ঘটলে তোমাকে চাকরী থেকে ছুটি করে দেব৷ এখানে নেশাভাঙ চলবে না৷’
ধমক খেয়ে লোকটা মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে৷
দেবেনবাবু বললেন, ‘কী হয়েছে? সাত সকালে রাগারাগি করছ কেন?
পরিতোষ বলল, ‘আর বলবেন না দাদা! এ লোকটা হল নাইট গার্ড৷ কাল রাতে নেশার ঘোরে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখে ম্যানেজার বাবুর ঘুম ভাঙিয়ে ছিল লোকটা৷ ওর কথা শুনেই ম্যানেজারবাবু বুঝতে পেরেছিলেন লোকটা নির্ঘাত নেশা করে আছে৷ ভোরবেলা তিনি ব্যাপারটা আমাকে রিপোর্ট করেছেন৷’
দেবেনবাবু জানতে চাইলেন, ‘কী দেখেছিল লোকটা?’
পরিতোষ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আর বলবেন না! কাল রাতে ডিউটি ছিল লোকটার৷ হোটেলের আসেপাশে ঘুরে সে পাহাড়া দিচ্ছিল৷ হঠাৎ সে নাকি দেখতে পায় দোতলাতে আপনার ঘরের জানলাটা খোলা৷ আর চাঁদের আলো বিরাট একটা নেকড়ে নাকি আপনার ঘরের জানলাতে দাঁড়িয়ে দূরের ওই পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ নেশার ঘোড়ে সে ব্যাপারটা দেখে ম্যানেজারবাবুকে মাঝরাতে ডাকতে যায়৷ তিনি অবশ্য ব্যাপারটাতে পাত্তা দেননি৷’
দেবেনবাবু বললেন, ‘আরে নেকড়ে কোথায়? ঘুম আসছিল না বলে আমিই তো মাঝরাতে জানলা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷’
পরিতোষ বলল, ‘তাহলেই বুঝুন ব্যাপারটা৷ ম্যানেজারবাবু লোকটার কথা শুনে মাঝরাতে আপনার দরজাতে কড়া নাড়লেই লজ্জার এক শেষ হত!’
ঘরে ফিরে এলেন দেবেনবাবু৷ মুখে তিনি যাই বলুন নাইটগার্ডের কথাটা শুনে বেশ অস্বস্তি হতে লাগল তাঁর৷ এখানে আমার পর থেকে ঘটনাগুলোকে ভাবতে লাগলেন তিনি৷ পরপর দু-রাত একই অদ্ভুত স্বপ্ন! তাঁর আস্তানায় গ্রামের বাড়িতে মুরগীর খাঁচায় নেকড়ের হানা! চিড়িয়াখানাতে নেকড়ের সেই অদ্ভুত ঘটনা, তার আগে এনচে মনাস্ট্রিতে লামার অদ্ভুত ব্যবহার, গতকাল সন্ধ্যায় রিসেপশন রুমের জানলাতে নেকড়ের মুখ দেখা, নাইটগার্ডের ঘঠনা! দেবেনবাবুর মনে হল তাঁর অজান্তেই তাঁকে নিয়ে যেন কোনো অদ্ভুত ঘটনা যেন ঘটে চলেছে৷ প্রবল এক অস্বস্তি ধীরে ধীরে ঘিরে ধরল দেবেনবাবুকে৷ খোলা জনলা দিয়ে দেখা যচ্ছে সেই পাহাড়টা৷ এখনও সেখানে কুয়াশা জমাট বেঁধে আছে৷ সেদিকে তাকিয়ে দেবেনবাবুর অস্বস্তি আরও বাড়ল৷ তাঁর কেন জানি মনে হল ওই পাহাড়টা অদ্ভুত ভাবে আকর্ষণ করছে তাঁকে৷ অশুভ এক আকর্ষণ৷ ওই পাহাড় থেকে দূরে চলে যেতে হবে তাঁকে৷ শেষ পর্যন্ত দেবেনবাবু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন৷ এ জায়গাতে থাকা তাঁর সমিচিন নয়৷ ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে তিনি পরিতোষকে বললেন, ‘অফিসে ফোন করেছিলাম, জরুরী কাজ এসেছে, আজ রাতের ট্রেনেই কলকাতা ফিরে যাচ্ছি আমি৷’
৬
সকাল বেলাতে দার্জিলিং মেল থেকে কলকাতায় পা রাখলেন দেবেনবাবু৷ তিনি এখন অনেক দূরে ফেলে এসেছেন কুয়াশা ঢাকা সেই পাহাড়টা৷ রোদ ঝলমলে কলকাতার সকাল৷ ইতিমধ্যে শহরের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে৷ স্টেশন থেকে দেবেনবাবুর বাড়ি আধঘণ্টার হাঁটা পথ৷ দেবেনবাবু স্টেশনের বাইরে বেড়িয়ে হাঁটা লাগালেন তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে৷ চলতে চলতে হঠাৎ তাঁর মনে হল আট বছরের বাচচা মেয়ে টেঁপি নিশ্চই অপেক্ষা করছে তাঁর বাবা কিছু নিয়ে আসবে বলে৷ গোলেমালে তার জন্য গ্যাংটক থেকে কিছুই কেনা হয়নি৷ আর তারপরই রাস্তার পাশে একটা দোকান তাঁর চোখে পড়ল৷ সকাল বেলায় সদ্য খোলা হযেছে দোকানটা৷ রঙিন মাছ, পাখি ইত্যাদির দোকান৷ দোকানের বাইরে একটা খাঁচায় নাদুস নুদুস একটা খরগোশ রাখা আছে৷ গতবছর মৌলালির রথের মেলাতে খরগোশ কেনার বায়না ধরেছিল টেঁপি৷ দামে পোষায়নি বলে দেবেনবাবু কিনে দেননি৷ খরগোশটা দেখে তিনি এগোলেন দোকানটার দিকে৷ সকালের খদ্দেরকে ফেরাতে চাইল না দোকানদার৷ বেশ কিছুক্ষণ দামদরের পর শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ টাকায় রফা হল৷ খাঁচা সমেত খরগোশ কিনে বাড়ি ফিরলেন দেবেনবাবু৷ দরজা খুলতেই টেঁপি ‘বাবা কী এনেছে? কী এনেছ?’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর কোলে৷ দেবেনবাবু তাঁর হাতে খাঁচাটা তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই যে তোমার জন্য একটা জ্যান্ত খরগোশ!’
খরগোশ পেয়ে টেঁপির খুশি আর ধরে না!
হাতে সময় আছে, দেবেনবাবু ঠিক করলেন অফিস যাবেন৷ বিশ্রাম করে প্রথমে স্নান সেরে খেতে বসলেন তিনি৷ খাওয়ার পর ভাতের থালায় কিছু ভাত আর এঁটোকাটা নিয়ে বাইরে এসে হাঁক দিলেন— ‘কালু? আই কালু?’ তাঁর গলার শব্দ পেয়ে রাস্তা থেকে দৌড়ে এল কুকুরটা৷ কিন্তু কয়েক পা তফাতে দাঁড়িয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ তারপর অদ্ভুত ভাবে গজরাতে লাগল দেবেনবাবুর দিকে তাকিয়ে! হয়তো কদিন সে দেবেনবাবুকে দেখেনি তাই অমন করছে৷ বার কযেক ডাকার পরও যখন সে এল না তখন দেবেনবাবু রোয়াকের পাশে ভাত ঢেলে ঘরে ঢুকে গেলেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিস যাবার জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি৷ কালু কিন্তু এদিনে মতো তার পিছন পিছন মোড় পর্যন্ত এলো না৷ একটা প্রাচীরের ওপর বসে তাঁকে লক্ষ করে গর্জরাতে থাকল৷
অপিসে এদিন বেশ ভালোই কাটালেন দেবেনবাবু৷ সবাই তাঁর কাছে বেড়ানোর গল্প শুনতে চাইল৷ দেবেনবাবু তাদের মোটামুটি সব গল্পই করলেন৷ শুধুমাত্র চিড়িয়াখানার নেকড়ের গল্প ছাড়া৷ একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন কী মার্কেটিং করলেন? তিনি মুখ ফাঁক করে বললেন, ‘এই যে এক জোড়া দাঁত’৷ কেউ শুনে বেশ আশ্চর্য হল, আবার কেউ ভাবলেন তিনি মজা করছেন৷
বেড়িয়ে এসে কলকাতায় ফিরে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে দেবেনবাবুর৷ অফিস ফেরতা বহুদিন পর একটু মুরগীর মাংস কিনে ফিরলেন৷ বেড়াতে যাবার আগে টেঁপি মাংস খাব, মাংস খাব করছিল৷
বাড়ি ফরে স্ত্রীর কাছে শুনলেন টেঁপি সারাদিন খরগোশটা নিয়ে আনন্দে খেলেছে৷ তার কোলেই তখনও প্রাণীটা৷ দেবেনবাবুও খরগোশটা নিয়ে মেয়ের সাথে খেলতে বসে গেলেন৷
তাঁর স্ত্রী একসময় কাঁচা মাংসর বাটিটা দেবেনবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, ‘তুমি কলতলা থেকে মাংসটা ভালো করে ধুয়ে আনো৷ আমি মশলা বাটছি৷’
বাটিটা নিয়ে কলতলায় ধুতে গেলেন দেবেনবাবু৷ হঠাৎ কী হল নিজের অজান্তেই এক টুকরো কাঁচা মাংস মুখে ফেলে চিবাতে লাগলেন তিনি৷ বেশ লাগছে খেতে৷ রান্না করা মাংসর তুলনায় যেন শতগুণ ভালো৷
‘কী গো, এত দেরী করছো কেন?’ স্ত্রীর ডাকে সম্বিত ফিরল তাঁর৷ তিনি কাঁচা মাংস চিবচিচলেন! দেবেনবাবু হতভম্ব হয়ে গেলেন নিজের ব্যবহারে৷ মুখটা ভালো করে ধুয়ে ফেললেন তিনি৷
রাতের রান্না করা মাংস ঠিক যেন দেবেনবাবুর মুখে রুচল না৷ খাওয়া ছেড়ে দেবেনবাবু বিছানায় চলে গেলেন৷ দেনেববাবু কিন্তু সেদিনও সেই এক স্বপ্ন দেখলেন৷ চন্দ্রালোকিত প্রান্তরে একপাল নেকড়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি৷ সারারাত ধরে অবিশ্রান্ত ভাবে শুনে গেলেন নেকড়ের ঐকতান! স্বপ্নের ভিতরও যেন সেই পাহাড়টা হাতছানি দিয়ে তাঁকে ডাকছে! ভোর বেলা স্ত্রীর ডাকে ঘুম ভাঙল৷ টেঁপির তখনও ঘুম ভাঙনি৷ স্ত্রী বললেন, ‘বারান্দায় এসো৷ সাংঘাতিক একটা কান্ড হয়েছে৷ টেঁপির ঘুম ভাঙার আগে সড়িয়ে ফেলতে হবে ওটা৷’ কথাটা শুনে দেবেনবাবুর বুকটা ধক করে উঠল৷
বাইরের ঘেরা বারান্দায় এলেন দেবেনবাবু৷ এক কোণে রাখাছিল খরগোশের খাঁচাটা৷ তার মুখ খোলা৷ সামনে পড়ে আছে খরগোশের মৃতদেহটা৷ তার গলাটাকে কেউ যেন কামড়ে ছিড়ে নিয়েছে! বারান্দার গ্রিল তো বন্ধ ছিল তবে কীভাবে কুকুর বেড়াল ঢুকল ভিতরে? যাই হোক মৃতদেহটাকে একটা থলেতে ভরে ফেলে আমার জন্য বাইরে বেড়োলেন তিনি৷ কিছুটা এগোতেই প্রতিবেশী বনমালীবাবুর সাথে দেখা৷ বৃদ্ধ মানুষ, দেবেনবাবুর বাড়ির উলটো দিকে থাকেন, অনিদ্রার রুগী৷ মর্নিং ওয়াকে বেড়িয়েছেন৷ তিনি দেবেনবাবুকে দেখে বললেন, ‘দেবেন কুকুর পুষেছো, ডাক শুনি না তো? কাল মাঝরাতে তোমার বারন্দায় দেখলাম তাকে৷ বিরাট সাদা রঙের কুকুর৷ নিশ্চই খুব দামী কুকুর হবে?’
তাঁর কথায় এমন চমকে উঠলেন দেবেনবাবু যে উত্তরও দিতে পারলেন না৷ তাহলে কী সত্যি কোনো নেকড়ে তাঁকে অনুসরণ করছে? এতজন এভাবে ভুল দেখবে? কে সে? কেনো অতৃপ্ত প্রেতাত্মা? দেবেনবাবু নিজে তাকে দেখতে না পেল্যে সে সাক্ষ রেখে যাচ্ছে৷ সিকিমের যে বাড়িতে তিনি গিয়ে উঠেছিলেন সে বাড়ির ছিন্নভিন্ন মুরগিগুলো, এই গলা ছেড়া খরগোশটা, এ সবই তার প্রমাণ৷ সে দিন ওই চীনা ডেনটিস্টের কাছে যাবার পর থেকেই এ সব ব্যাপার শুরু হয়েছে৷ ওই দাঁত দুটোই কী এ সব গন্ডগোলের মূলে? দেবেনবাবুর হাত কাঁপতে লাগল৷ খরগোশটাকে কোনোরকমে বাইরে ফেলে বাড়ি ঢুকে দেবেনবাবু সোজা ঢুকে গেলেন কলঘরে৷ বহু কষ্টে করেও তিনি দাঁত দুটো খুলতে পারলেন না৷
দেবেনবাবু এদিন বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন৷ তাঁর অফিসের কাছেই একটা দাঁতের ডাক্তারের চেম্বার আছে৷ অফিসে ঢোকার আগে একবার সেখানে ঘুরে যাবেন তিনি৷
চেম্বার খোলাই ছিল৷ ডেনটিস্ট ভদ্রলোকও মুখ চেনা তাঁর৷ অফিসে ঢোকা বেরোনের পথে মাঝে মাঝে দেখা হয় তাঁর সাথে৷
দেবেনবাবু তাঁর চেম্বারে ঢুকে ভদ্রলোককে বললেন, একটা সমস্যায় পড়ে আপনার কাছে এলাম৷ কদিন আগে একজন চীনা ডেনটিস্টের কাছে দুটো দাঁত বসিয়েছিলাম৷ কিন্তু ক্লিপ দুটো এমন এঁটে গেছে যে খুলতে পারছি না৷’
ভদ্রলোক বললেন, ‘কই দেখি? এমন হয় মাঝেমাঝে৷ খুলে দিচ্ছি৷’
দেবেনবাবু আশস্ত হয়ে মুখ ফাঁক করে দাঁত দুটো দেখালেন৷
কিন্তু দাঁত দুটো পরীক্ষা করেই ডেনটিস্ট গম্ভীর হয়ে গেলেন৷ তিনি বললেন, ‘ফলস দাঁত কোথায়? এ দুটো আপনার নিজেরই দাঁত! ক্লিপের কেনো ব্যাপারই নেই৷ অন্য কোনো ভাবেও বাইরে থেকে মাড়িতে বসানো হয়নি৷ আপনার অফিসে মনে হয় কাজের চাপ বেড়েছে৷ ক’দিন বিশ্রাম নিন৷ পারলে একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷’
দাঁতের ডাক্তারের চেম্বার থেকে দেবেনবাবু যখন বাইরে বেরোলেন তখন সত্যিই নিজেকে তাঁর পাগল মনে হতে লাগল৷
অফিসে নিজের টেবিলে বসে দেবেনবাবু ভাবতে লাগলেন সত্যি তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন? ডেনটিস্ট বললেন দাঁত দুটো তাঁর নিজের৷ তাহলে কী ওই চীনা ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া তাঁর কল্পনা ছিল৷ তাঁকে সব থেকে বেশি ভাবাতে লাগল সেই নেকড়ের ব্যাপারটা৷ সে কী দেবেনবাবুকে অনুসরণ করে তাঁর বাড়িতেও চলে এসেছ? নাকি সে নেকড়ে রূপী অন্য কেউ? তাঁকে দেবেনবাবু দেখতে পাননি এখনও৷ তাঁকে কী দেখা যাবে? ধরা যাবে?
হঠাৎ দেবেনবাবুর মনে হল, ‘হ্যাঁ, একটা পথ হয়তো আছে দেখার!’
কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেবেনবাবু ছুটলেন স্টোরকীপারের কাছে৷ তাকে তিনি বললেন, ‘একটা সিসিটিভি ক্যামেরা সেট দিন তো৷ একটা পার্টিকে ডেমনস্ট্রেট করতে হবে৷’ দেবেনবাবুর ইলেকট্রনিক্স কোম্পানী এ সবেরও কারবার করে৷
শনিবার৷ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলেন দেবেনবাবু৷ খরগোশটা খুঁজে পাচ্ছে না বলে খুব কান্নাকাটি করছে টেঁপি৷
দেবেনবাবু বাড়ি ফিরে তাঁর ঘরে ক্যামেরা, মনিটর এ সব বসাতে লাগলেন৷ তাঁর স্ত্রী বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘ঘরে ক্যামেরা বসাচ্ছ কেন?’
দেবেনবাবু বললেন, ‘অফিসের জিনিস, একজনকে দিতে হবে৷ তার আগে টেস্ট করছি৷’
রাতে নির্দিষ্ট সময় খাওয়া সেরে দেবেনবাবু শুয়ে পড়লেন৷ তিনি একটা খাটে, অন্য খাটে তাঁর স্ত্রী আর টেঁপি৷
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি৷ দেবেনবাবু আবার দেখতে লাগলেন সেই স্বপ্ন৷ সেই পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল, চন্দ্রালোকিত বরফাচ্ছাদিত প্রান্তরে নেকড়েদের সাথে তাঁর পদচারণা, বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ, নেকড়ের সম্মিলিত সঙ্গীত, নানা স্বরে নানা ভাবে! নেকড়েদের ধ্বনির মাঝে হঠাৎই অন্যরকম একটা চিৎকার কানে এল তাঁর৷ নেকড়েদের ডাকের কাছাকাছি হলেও সেটা নেকড়ের নয়, কুকুরের ডাক৷ প্রচণ্ড চিৎকার! আর সেই চিৎকারেই ঘুম ভেঙে গেল দেবেনবাবুর৷ তিনি দেখলেন তিনি কখন যেন উঠে টেপির বিছানার সামনে দাঁড়িয়েছেন৷ আর বাইরে থেকে জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে কালু৷ ভিতরে ঢুকতে পারলে সে যেন ছিঁড়ে খাবে দেবেনবাবুকে৷
তার চিৎকারে দেবেনবাবুর স্ত্রীও উঠে পড়লেন৷ অনেক কষ্টে তিনি শান্ত করলেন কুকুরটাকে৷
বাকি রাতটা আর ঘুম হল না দেবেনবাবুর৷ খাটে শুয়ে শুয়ে তিনি খেয়াল করলেন কুকুরটা চিৎকার থামালেও সে জানলার বাইরে থেকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে৷
অবশেষে এক সময় সেই জানলা দিয়েই ভোরের প্রথম আলো ঢুকল ঘরে৷ এদিন দেবেনবাবুর স্ত্রী আর মেয়ের একটা নিমন্ত্রণ আছে৷ একটু দূর যেতে হবে৷ ঘুম থেকে উঠে সেজেগুজে তারা দুজন কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে বেড়িয়ে গেল৷
তারা চলে যাবার পর সিসি টিভির মনিটারটা নিয়ে দেবেনবাবু বসলেন৷ গতরাতে এ ঘরের দৃশ্য ধরা আছে এতে৷ কিন্তু দেবেনবাবু যা দেখলেন তাতে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন৷ কেঁপে উঠলেন তিনি৷ বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর তৈরি হয়ে দেবেনবাবু বাড়ি ছাড়লেন৷ তাঁকে যেতে হবে অনেক দূরে৷ সেই পাহাড়টার পাদদেশে সেই চীনা ডেনটিস্টের খোঁজে৷ এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তাঁর৷
৭
সন্ধ্যা নামছে৷ ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে মাথার ওপর পাহাড়ের ঢালটা৷ ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে৷ আজ ঠান্ডার প্রকোপ আরও তীব্র৷ অনেক নীচে গ্যাংটক শহরের আলো একটা একটা করে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে৷ দেবেনবাবু এসে দাঁড়ালেন সেই বাড়িটার সামনে৷ কাঠের ঢালু ছাঁদঅলা সেই বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ঝুলন্ত অবস্থায় খাদের কিনারে৷ তার মাথায় রংচটা চীনা ভাষায় লেখা দাঁতের ছবি অলা সাইনবোর্ড৷ কাঁচের জানলা গুলো আজও বন্ধ৷ আজ দেবেনবাবু ঘুরতে ঘুরতে এখানে উপস্থিত হননি, এ বাড়িটাতে আসার জন্যই কলকাতা থেকে তিনি ছুটে এসেছেন৷
বাড়ির ভিতর থেকে কোনো শব্দ আসছে না৷ দেবেনবাবু আগের দিনের মতোই বেল বাজালেন৷ আগের দিনের মতোই খুট করে একটা শব্দ করে দরজা খুলে গেল৷ একজন লোক মুখ বাড়ালো৷ সে কিন্তু আজ জানতে চাইল না যে তিনি দাঁতের ডাক্তারের কাছে এসেছেন কিনা? সে যেন জানতই যে দেবেনবাবু আসবেন৷ ইশরায় দেনেবাবুকে ভিতরে ঢুকতে বলল লোকটা৷ ভিতরে ঢুকলেন তিনি৷ আগের দিনের মতোই সেদিনও বাইরে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল৷
লোকটা আগের দিনের ঘরটাতে দেবেনবাবুকে বসিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল৷ সেই ঘর! মাথার ওপর চীনা লণ্ঠন থেকে অদ্ভুত একটা লাল আলো ছড়াচ্ছে ঘরে৷ দেওয়াল জুড়ে সেই দাঁত বার করা ড্রাগনের ছবি, ঝুলন্ত তিববতী অপদেবতার মুখোশ! র্যাকে সাজানো দাঁত বার করা লাফিং বুদ্ধর মূর্তি! সেই টেবিলটা, সেই দুটো চেয়ার! কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে ঢুকল সেই চীনা ডেনটিস্ট৷ তার পরনে সাদা অ্যাপ্রন, সাদা দস্তানা৷ দেবেনবাবুর উলটোদিকের চেয়ারে বসলেন তিনি৷ ঠোঁঠের কোণে হাসি৷ যেন তিনিও জানতেন দেবেনবাবু আবার আসবেন৷
দেবেনবাবু তাকে বললেন, ‘দাঁত দুটো আমি ফেরত দিতে এসেছি৷ ওগুলো আপনি খুলে নিন৷ কেন আপনি এমন করলেন আমার সাথে?’
লুই সেঙ জবাব দিল, ‘ও দাঁত একবার বসালে তো আর খোলা যাবে না৷’
তারপর একটু বিষণ্ণ ভাবে বলল, ‘আপনার ওই ‘রক্তচোষা’ কথাটাই আমার মাথা গন্ডগোল করে দিল সেদিন৷ কথাটা আমি সহ্য করতে পারি না৷ আমাকে ক্ষমা করবেন৷’
দেবেনবাবু জানতে চাইলেন, ‘ও কথার সঙ্গে কী সম্পর্ক আপনার?’
লোকটা জবাব দিল, ‘ওই অজুহাতেই তো গ্রামের লোকেরা খুন করে গেছিল আমাদের৷ ছোটো বাচচা দুটোকেও রেহাই দেয়নি৷’ অন্য সময় হলে দেবেনবাবু চমকে উঠতেন তার কথায়৷ কিন্তু এখন চমকালেন না৷ তিনি জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছিল ব্যাপারটা?’
লুই সেঙ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘এই পাহাড়ের ওপাশে চীন জানেন তো? বৌদ্ধ শরণার্থী হিসাবে এ পাড়ে পরিবার নিয়ে এসেছিলাম৷ দাঁতের ডাক্তারীর ব্যবসা খুলেছিলাম৷ তার সাথে একটু আধটু ডাক্তারীও করতাম৷ এ নিয়ে সংঘাত বাঁধল নীচের গ্রামের ওঝার সাথে৷ তার কারবারের ক্ষতি হচ্ছিল৷ একবার গ্রামের একটা ছেলে ‘অ্যানিমিয়া’ বা ‘রক্তাল্পতায় মারা গেল৷ ওঝা গ্রামবাসীদের বোঝাল যে আমরা নাকি ওর রক্ত শুষে নিয়েছি! আমরা রক্তচোষা! বিশ্বাস করুন, তখন আমরা এমন ছিলাম না৷ এক সকালে গ্রামবাসীরা এসে শেষ করে দিল আমাদের৷ আর তারপর থেকে আমাদের আশ্রয় পাহাড়ের মাথায় ওপরের ওই জঙ্গল৷ কিছু সঙ্গী সাথীও অবশ্য জুটেছে৷ ওই যারা যুদ্ধে মারা গেছে৷ সব মিলিয়ে নজন৷ আপনি এলেন, দশ হবে৷ তবে এখন বেশ আছি জানেন৷ কোনো ঝামেলা নেই৷ উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেড়াই৷ আমরা এখন প্রকৃতির সন্তান৷ দেবেনবাবু বলতে যাচ্ছিলেন, ‘না আমি ফিরে যাব৷’ কিন্তু ঠিক সেই মূহূর্তেই দেবেনবাবুর চোখে ভেসে উঠল ক্যামেরাতে ধরা পড়া সইে দৃশ্য৷ খোলা জানলা দিয়ে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের অলো এসে পড়েছে দেবেনবাবুর ঘরে৷ বিছানায় প্রথমে উঠে বসলেন তিনি৷ একবার হাই তুলেন৷ আধো অন্ধকারেও যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল তার দাঁত দুটো৷ মানুষ নয়, নেকড়ের দাঁত! এরপরই তাঁর চেহারাটা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে লাগল৷ দেবেনবাবুর বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে নিঃশব্দে মেঝেতে নামল একটা বিরাট বড়ো নেকড়ে! লম্বা জিভ দিয়ে লালা ঝড়ছে তার৷ মুখের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সার সার ভয়ঙ্কর দাঁত৷ অন্য খাটের যে পাশে টেঁপি ঘুমাচ্ছে, নিঃশব্দে তাকে লক্ষে করে এগোল প্রাণীটা৷ সে পৌঁছে গেল টেঁপির কাছে৷ তাঁর পর ধীরে ধীরে প্রাণীটার তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো নেমে আসতে লাগল ঘুমন্ত টেঁপির ঘাড়ের ওপর! ঠিক সেই মূহর্তে প্রচণ্ড চিৎকার করে বাইরে থেকে জানলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কালু৷ নেকড়ের শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে রপান্তরিত হল দেবেনবাবুর চেহারায়! দৃশ্যটা কল্পনা করে চেয়ারে বসে কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করলেন দেবেনবাবু৷
তিনি যখন চোখ খুললেন তখন বাইরে কোথা থেকে যেন নেকড়ের ডাক শুরু হল৷ চেয়ারের ওপাশে বসা লুই সেঙ তার উদ্দেশ্য বলল ‘চলুন এবার৷ শুনতে পাচ্ছেন, ওরা আমাদের ডাকছে?’
দেবেনবাবু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ চলুন৷’ টেঁপিকে যে বড়ো ভালোবাসেন তিনি৷ কালুতো সব সময় এসে বাঁধা দেবে না তাঁকে৷ দিতে পারবেও না৷ কাজেই…
লুই সেঙ-এর পিছন পিছন বাড়ি থেকে বেরলেন দেবেনবাবু৷ লোকটাকে অনুসরণ করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন৷ লোক কোথায়? তাঁর আগে আগে এগোচ্ছে বিরাট বড় সাদা একটা নেকড়ে৷ ওপর থেকে ভেসে আসছে সঙ্গীদের আহ্বান৷ পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেলেন দেবেনবাবু৷ বরফাচ্ছদিত সমতল জমি৷ একপাল নেকড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে৷ কখন জানি দেবেনবাবুর সব পোশাক খসে গেছে৷ হীমেল বাতাসে মুক্তির আনন্দ৷ এখানে কোনো দুঃখ কষ্ট নেই৷ শুধু প্রকৃতির সাথে মিশে যাবার আনন্দ৷ তবু শেষ একবারের জন্য দেবেনবাবুর চোখে ভেসে উঠল টেঁপির মুখটা৷ একখণ্ড মেঘ কোথা থেকে এসে যেন চাঁদটাকে ঢেকে দিল৷ সব অন্ধকার হয়ে গেল কিছু সময়ের জন্য৷ আর তার সাথে সাথেই হারিয়ে গেল দেবেনবাবুর পিছনের সব কিছু৷ মেঘ সরে গেল তারপর৷ পাহাড়ের শীর্ষে চন্দ্রালোকিত বরফ প্রান্তরে একপাল নেকড়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন দেবেনবাবু৷ ঠিক তাঁর দেখা সেই স্বপ্নের মতো! চাঁদ মুখ তুলতেই নেকড়ের দল চাঁদের দিকে মুখ তুলে ডেকে উঠল৷ হাজার হাজার বছর ধরে রাত্রির সন্তানরা যেমন অভ্যর্থনা জানিয়ে আসছে চাঁদকে৷ দেবেনবাবু আকাশের দিকে মুখ তুলে সেই আদীম সঙ্গীত ধ্বনিতে গলা মেলালেন৷