দেবতার বেলা লীলাখেলা
পাপ লিখেছে মানুষের বেলা
এই প্রবচনের মধ্যে গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় রয়েছে। আমাদের সমাজে ক্ষমতাধর কিংবা অভিজাত শ্রেণীর মানুষ অনেক গর্হিত কাজ করলেও অর্থবিত্ত, ক্ষমতার দাপট ও অন্যান্য প্রভাবে তাতে সহজে কেউ মনে কিছু করে না, বরং ঐ কাজকে সমাজ স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয়। কিন্তু কোনো সাধারণ ছাপোষা দুর্বল মানুষ একই রকম গর্হিত কাজ করলে তার বেলা নেমে আসে শাস্তির ফতোয়া। সামাজিক বিধিবিধানের নিষ্ঠুর প্রয়োগ যতটা গরিব ও সাধারণ মানুষের জন্য প্রযোজ্য হয় তার বিপরীতে ধনী, অভিজাত বা ক্ষমতাধর মানুষের জন্য তার সামান্য অংশও হয় না। এ প্রবাদে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের উচ্চারণ লক্ষণীয়। আমাদের গুরুদেবরা বলে থাকেন, ‘আমরা যা বলি তা করবে। যা করি তা করবে না।’ এ থেকে বোঝা যায় সমাজনেতাদের আসল চেহারা।
পর্বতশিখরে সুরম্য অট্টালিকায় আরামে বসবাসকারী স্বর্গের দেবতা বলে কথিত অভিজাত সম্পদশালীদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই অন্যায় ও অবৈধ কাজের উদাহরণ আছে। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা রামায়ণ, মহাভারত তথা পৌরাণিক শাস্ত্রগুলির কাহিনী উপস্থাপন করতে পারি। পরস্ত্রী হরণ, পরস্ত্রী গমন, ব্যভিচার, স্বর্গবেশ্যার সাথে ঢলাঢলি ইত্যাদি প্রচুর অবৈধ এবং গর্হিত কাজের উদাহরণ দেয়া যায়। স্বয়ং ব্রহ্মাও এ অপবাদ থেকে মুক্ত নন। আবার যে পঞ্চকন্যাকে (অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা, মন্দোদরী) আমরা নিত্যস্মরণীয়া বলি তাদের কেউই সতীসাধ্বী ছিলেন না। আসল শাস্ত্র ও অভিজাতের খেয়ালে তৈরি ও প্রতিপালিত শাস্ত্র-বিধান ভিন্নরূপ হয়ে যায় উপরতলার মানুষের কৌশলে।
দেবদেবতার নামের অজুহাতে কেউ গাঁজাভাঙ্গ ইত্যাদি খায়। তা কতোটা শাস্ত্রসমর্থিত তা নিয়ে ভাবার আছে। নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদ আর অভিজাতের খেয়ালে পরিচালিত সমাজে সাধারণ মানুষের মতামত ও কর্মকাণ্ড বিচারের সম্মুখীন হয় পদে পদে। পাপপুণ্য শুধু যেন তাদের জন্য। দেবতার নামে কৃত পাপ তাই দেবতার লীলা খেলা আর আমজনতার ক্ষেত্রে তা হয় পাপ বা অন্যায়। এ বিষয়ে অনেক বলার থাকলেও সংক্ষেপে প্রবাদটির মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা করা হলো এখানে।