দেওয়ানগঞ্জের রাস্তাটা

দেওয়ানগঞ্জের রাস্তাটা

ক্লাবের নড়বড়ে তক্তাটার ওপর বসে চাটুজ্জেমশাই বলল, ‘বিশু গেল কোথায়? দেখছি না যে অনেকদিন৷’

বিশু ওরফে বিশ্বনাথ সদ্য একটা চাকরি পেয়েছে সেলসের৷ নতুন চাকরি, কম্পানি উদয়াস্ত খাটাচ্ছে৷ প্রায়ই ট্যুরে থাকে, ফেরে এক-দুদিন পর৷ আজ আসার কথা৷

শুনে চাটুজ্জেমশাই চুপ রইলেন৷ আমরা শীতের সন্ধেটা দিব্যি ক্যারম খেলে আর গজল্লা করে কাটাচ্ছিলাম৷

ভবতারণ চাটুজ্জে হচ্ছেন আমাদের ক্লাবের প্রবীণতম সদস্য৷ চাকরি করতেন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে৷ ছেলেমেয়ে নেই, স্ত্রী মারা গেছেন বছর দুয়েক হল৷ কাজ থেকে ভি আর এস নিয়ে এ পাড়ায় মুখুজ্জেদের পোড়ো বাড়িটা কিনে সংস্কার করে বসবাস করছেন৷

চাটুজ্জেমশাই এককথায় চমৎকার মানুষ, বিশু’র ভাষায়, গ্রেট ম্যান৷ শান্ত, ধীর স্থির মানুষ৷ চট করে বাজে বা হালকা কথা বলতে শুনিনি৷ কথার মধ্যে ওজস্বী ভাব আছে৷ আর কথা বলেনও চমৎকার৷ এসেই আমাদের একজন ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন৷ এখন তো ক্লাবের সমস্ত কাজকর্ম, পিকনিক, কুইজ, লাইব্রেরি, বৃক্ষরোপণ, স্বাধীনতা দিবস পালন, সরস্বতীপুজো এসব চাটুজ্জেমশাইকে ছাড়া ভাবাই যায় না৷৷

এহেন চাটুজ্জেবাবুর সবচাইতে বড় গুণ হচ্ছে যে ভদ্রলোক খুব ভালো গল্প বলতে পারেন৷ উনি বলেন সবই ওঁর জীবনের সত্যি ঘটনা৷ সে হোক না হোক, চাটুজ্জেমশাইয়ের গল্প মানেই গা শিউরে ওঠা, হাড় হিম করা সব ঘটনা৷

বিশু সেলসে জয়েন করেছে শুনে চাটুজ্জেমশাই সামান্য হাসলেন৷ তারপর বললেন, ‘তাহলে তো আড্ডার পরের গল্পটা বিশুই বলবে৷’

ভজা বলল, ‘কেন খুড়ো, সেলসে চাকরি পেলেই কি গল্পের প্লট আসে নাকি মাথায়?’

‘প্লট নয়, সত্যি ঘটনা৷ আসলে সেলসের চাকুরেদের এত লোকের সঙ্গে মিশতে হয়, এত জায়গায় যেতে হয় আর এত বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয় যে সেসব গুছিয়ে লিখলেই একটা চমৎকার চিত্তাকর্ষক উপন্যাস হয়ে যায়৷’

বংশী বলল, ‘সে আমাদের বিশু বলিয়ে কইয়ে ছেলে, লিখলে খারাপ লিখবে না বলেই বিশ্বাস৷ তা আপনি কখনও এই লাইনে কাজ করেছেন নাকি?’

মাথা নাড়লেন চাটুজ্জেমশাই, ‘ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে ঢোকার আগে বছর দুয়েক একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধ কম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে কাজ করেছিলাম বই কি৷ তখনই এরকম এক শীতের রাতে আমার সঙ্গে যা ঘটেছিল আজ অবধি বুদ্ধিতে তার ব্যাখ্যা পাইনি৷’

আড্ডা আর ক্যারম ছেড়ে সবাই ঝট করে চাটুজ্জেমশাইকে ঘিরে বসলাম৷ বোঝাই যাচ্ছে যে ভদ্রলোক আজ গল্প বলার মুডে আছেন৷ শিবু ঝট করে ক্লাবের বাইরে মুখ বাড়িয়ে চা ওয়ালাকে এক কেটলি চা বলে দিল৷

‘অনেক বছর আগেকার কথা৷ তখন আমি চাকরি করি মৃত সঞ্জীবনী আয়ুর্বেদ কম্পানিতে৷ টেরিটোরি হচ্ছে গিয়ে সাউথ সেন্ট্রাল বেঙ্গল, মানে বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ইত্যাদি৷ খাই দাই আর টো টো করি৷ গাড়ি আমার, আর হোটেল ভাড়া, খাওয়াদাওয়া, তেলের খচ্চা সব কম্পানির৷ আমিও সুখেই আছি৷ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াই আর কাজের ফাঁকে সব দ্রষ্টব্যস্থান দেখে বেড়াই৷

এই করে করে বছর দুয়েক কেটেছে৷ এমন সময় ঘটল একটা ঘটনা৷

তখন জুন মাস, বর্ষা সবে শুরু হয়েছে৷ আমাদের একটা প্রোডাক্ট ছিল, নোকাফ৷ মানে কাশির অব্যর্থ ওষুধ৷ বর্ষা আর শীতের সময় তার মারকাটারি সেল ছিল৷ ডিস্ট্রিবিউটরদের স্টক সাপ্লাই করে কুলিয়ে উঠতে পারতাম না৷ এমনও হয়েছে আমাদের কলকাতার গোডাউন খোলার আগেই দেখি ডিস্ট্রিবিউটররা এক-একটা করে টাটা চারশো সাত নিয়ে দাঁড়িয়ে৷

আমাদের বর্ধমানের ডিস্ট্রিবিউটের নাম ছিল হরগোপাল তরফদার, ওরফে হাবুলদা৷ সদাহাস্য অমায়িক লোক৷ বয়েস গোটা পঞ্চাশের কাছাকাছি, দেখতে ফর্সা মোষের মতো, মাথা বিলকুল ন্যাড়া৷ হাবুলদা কম্পানির অনেকদিনের পুরনো দিনের ডিস্ট্রিবিউটর৷ উপরমহল অবধি জানাশোনা আছে৷

এহেন হাবুলদাকে নিয়ে বাধল বিশাল ঝামেলা৷ বেঙ্গল ডিপো’তে নোকাফ-এর স্টক এসেছে কম৷ এদিকে ডিপো ম্যানেজারের ভুলে সেই স্টক অন্য কাউকে না দিয়ে পুরোটাই বিল করা হয়ে গেছে কলকাতার ডিস্ট্রিবিউটরকে৷

সে নিয়ে চারিদিকে অসন্তাোষ৷ ওপর মহলে ফোন যেতে লাগল৷ ডিস্ট্রিবিউটরদের কেউ কেউ কড়া চিঠিও লিখলেন৷ আর তার নেতৃত্বে আর কেউ নয়, আমাদের হাবুলদা৷

অবস্থা বেগতিক দেখে আমাকেই মাঠে নামতে হল৷

বেরিয়েছিলাম দুপুর নাগাদ৷ তখন নতুন হাইওয়ে সবে তৈরি হচ্ছে৷ দুপাশে ধানের খেত আর গাছপালা৷ চারিদিকে মনোরম বাতাস৷ হাইওয়ে প্রায় ফাঁকা৷ দূর থেকে দেখা যায় তার ওপর ঝুঁকে আছে জলভরা মেঘ৷ সে দৃশ্য দেখেও শান্তি৷

হু হু করে গাড়ি ছোটালাম একশো কিলোমিটার স্পিডে৷

বর্ধমান পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল চারটে হল৷ আগেই পৌঁছতে পারতাম যদি এয়ারপোর্টের জ্যামে আর শক্তিগড়ের ল্যাংচায় না আটকাতাম৷ তবে ওই রাস্তায় গেলে শক্তিগড়ের ল্যাংচা একটিবার টেস্ট না করাটা পাপ৷

হাবুলদা’র কাছে পৌঁছে দেখি ব্যাপার খুব গুরুতর৷ যে লোকটা আমাকে ভাই ভবতারণ ছাড়া অন্য কোনও নামে কোনওদিন সম্বোধন করেনি, সে মিস্টার চ্যাটার্জি ছাড়া কথাই বলছে না৷ গলা গম্ভীর, মুখ হাঁড়ির মতো, চোখ ছলোছলো৷ মনে মনে প্রমাদ গনলাম৷ টার্গেট ফার্গেট পরের কথা, অমন বিশ্বাসী ডিস্ট্রিবিউটর বিগড়ে গেলে তো মুশকিল৷ তবে আমিও তখন এই লাইনের ঘাঁতঘোঁত জেনে গেছি৷ বিগড়ে যাওয়া ডিস্ট্রিবিউটরকে কীভাবে লাইনে আনতে হয় সেটা যাকে বলে সেলসের অ আ ক খ’র মধ্যেই পড়ে৷

সময় লাগল অনেক৷ অসীম ধৈর্যের সঙ্গে বরফ টরফ গলিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সময় লাগল ঠিক ঘণ্টা চারেক৷ তার মধ্যে অনেক রাগারাগি, অভিমান, দুঃখ সব একবার করে হয়ে গেল৷

শেষে যখন উঠলাম তখন প্রায় আটটা বাজে৷ আমার আবার সেদিনই বর্ধমান থেকে ঘাটাল যাওয়ার কথা, পরেরদিন সকালে মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে মিটিং আছে৷ এখান থেকে ঘাটাল পৌঁছতে কম করে হলেও ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা৷ রাস্তা ফাঁকা থাকলেও রাত এগারোটা- সাড়ে এগারো’টার আগে পৌঁছতে পারব না৷ তার ওপর বর্ষার রাত৷ মাঝরাতে রাস্তায় গাড়ি খারাপ হলে দেখবে কে? ফলে হাবুলদা’কে বিদায় জানিয়ে সেই যে গাড়িতে উঠে থার্ড গিয়ারে স্টিয়ারিং ধরলাম, নেক্সট বিশ কিলোমিটারের আগে গিয়ার চেঞ্জ করিনি!

* * *

 বর্ধমান থেকে ঘাটালের রাস্তাটা যায় আরামবাগ হয়ে৷ বর্ধমান থেকে আরামবাগ প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা৷ দিনের বেলা সময় লাগে দেড় ঘণ্টা৷ রাতের বেলা সামান্য বেশি৷ আরামবাগ থেকে ঘাটাল আরও চল্লিশ কিলোমিটার৷ সে পেরোতে ঘণ্টা দুয়েকের একটু বেশি লাগে৷ কারণ রাস্তার অবস্থা কহতব্য নয়৷

দামোদর নদীর ব্রিজ পেরিয়েই গাড়ি ছোটালাম জোরে৷ ঘাটালে একটা বাঁধা গেস্ট হাউস আছে, গেলে ওখানেই উঠি৷ এতদিন গিয়ে গিয়ে প্রায় পরিবারের মতো হয়ে গেছে৷ কিন্তু সেখানেও রাত এগারোটার পর গেলে পেটে কিল মেরে ঘুমোতে হবে৷

বর্ষার রাত৷ ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে৷ প্রথম অনেকটা রাস্তা হুড়মুড়িয়ে চলে এলে কী হবে, এখন গাড়ি চালাচ্ছি খুব সাবধানে, ষাটের ওপর কাঁটা উঠতেই দিচ্ছি না৷ এমনিতে খানাখন্দভরা রাস্তা, তার ওপর ড্রাইভ করছি গ্রামগঞ্জের রাস্তায়৷ ব্রেকডাউন হলে আর দেখতে হবে না৷ এদিকে এমনিতেই রাত আটটার পর লোকজন বিশেষ থাকে না৷ আর এখন বর্ষার রাতে তো রাস্তাঘাট আরও নিঝুম৷ নেড়ি কুত্তা অবধি দেখা যাচ্ছে না৷

আরামবাগ পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দশটা৷ চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ কেবল উল্টোদিক থেকে আসা লরি আর প্রাইভেট গাড়ির ঝাঁটার মতো আলো ছাড়া আর কোথাও কোনও সাড়া শব্দ নেই৷ তারই মধ্যে আরামবাগের বাজার চত্বরে গাড়িটা দাঁড় করালাম৷ সেখানে দেখি একটা চায়ের গুমটি এত রাতেও খোলা৷ মালিক উদাস মুখে নিভু নিভু উনুনের পাশে বসে আছে৷

একটা বড় ভাঁড়ের চা অর্ডার করলুম৷ সঙ্গে একটা বাপুজি কেক আর দুটো লেড়ো বিস্কুট৷ দুপুরে লাঞ্চ হজম হয়ে এখন পেটে ছুঁচোরা রীতিমতো ডনবৈঠক দিচ্ছে৷

আমার গোগ্রাসে খাওয়া দেখে লোকটার বোধহয় মায়া হল৷ ঘরঘরে গলায় বলল, ‘একটু ঘুগনি আছে বাবু, খাবেন? দুটো পাউরুটি সেঁকে দিই?’

এরকম উত্তম প্রস্তাবে না বলে এমন আহাম্মক আমি নই৷ একটু পরেই ঠান্ডা ঘুগনি আর দুটো সদ্য সেঁকা টোস্ট এল৷ সেসব খেয়ে পেটটা ঠান্ডা হতে বার করে যেই লোকটাকে ধন্যবাদ দিতে যাব, লোকটা দেখি আমার দিকেই ঘোলাটে চোখে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে৷

আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম, বললাম, ‘কিছু বলবে কাকা?’

লোকটা সেই ঘরঘরে গলায় বলল, ‘কোথায় যাবেন?’

ঘাটাল যাব শুনে লোকটা আরও খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল৷ তারপর বলল, ‘কামারপুকুর হয়ে যাবেন তো?’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘ওটাই তো একমাত্র রাস্তা৷ অন্য রাস্তা আছে নাকি?’

‘আছে বই কি৷ দেওয়ানগঞ্জ, বালিহাটপাড়া, দামোদরপুর হয়ে একটা রাস্তা আছে বটে৷ আপনি কিন্তু বাবু ভুলেও ওই রাস্তাটা ধরবেন না৷’

কৌতূহলী হলাম, ‘কেন বলো তো?’

লোকটা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আজ শনিবার, তায় অমাবস্যা৷ রাস্তাটা ভালো নয় বাবু, যাবেন না৷’

শুনে খটকা লাগল৷ রাস্তা খারাপ হলে বারণ করার কারণ বুঝি৷ কিন্তু শনিবার অমাবস্যার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?

লোকটা একটু দোনোমোনো করল, তারপর বলল, ‘রাস্তাটা পুরোটাই গ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছে বাবু৷ অনেক পুরনো মন্দির, বটগাছ এসব পাবেন৷ ওই রাস্তাটা নিয়ে অনেক গল্পকাহিনী আছে৷ অনেকেই বলেছে নিশুতি রাতে ওখানে নাকি কিছু অনেক দেখা যায়, অনেক কিছু শোনা যায়৷’

আমি কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিলাম৷ একে আমি ভূত-ভগবানে ঘোর অবিশ্বাসী, তার ওপর শরীরে তখন জোয়ান রক্ত৷ চা আর খাবারের দাম মিটিয়ে বললাম, ‘চিন্তা কোরো না কাকা, এই শর্মাকে ভয় দেখাবে এমন ভূত এখনও জন্মায়নি, থুড়ি, মরেনি৷’

তখন যদি জানতাম, পরের কয়েক ঘণ্টায় আমার সঙ্গে কী হতে চলেছে!

* * *

আরামবাগ ছাড়ার একটু পরেই বেজায় ঘুম পেতে লাগল৷ তোমরা তো জানো, ড্রাইভারের পক্ষে ঘুম জিনিসটা কত মারাত্মক৷ তবে ঘুমেরও দোষ নেই৷ সারাদিন ধকল তো কম যায়নি৷ তবে রক্ষে এই যে রাস্তা ফাঁকা৷ অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে৷ মোটামুটি স্টিয়ারিং ধরে চল্লিশ-পঞ্চাশ স্পিডে গাড়ি চালাতে লাগলাম৷ বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে৷

একটু পর একটা কালভার্ট পার হওয়ার সময় একটা স্পিড ব্রেকারে আটকে গাড়িটা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল৷ সঙ্গে সঙ্গে চটকা ভেঙে সজাগ হয়ে উঠলাম৷

এই রাস্তায় তো বহুবার যাতায়াত করেছি৷ কালভার্ট আসার তো কথা নয়৷ রাস্তা ভুল হল নাকি?

রাস্তার একপাশে সাবধানে গাড়িটা পার্ক করলাম৷ সামনেই একটা সিমেন্টের ফলক৷ ফলকের ওপরের লেখাটা রোদে জলে আবছা হয়ে এলেও দিব্যি পড়া যাচ্ছে এখনও, ‘দেওয়ানগঞ্জ পঞ্চায়েত এলাকায় আপনাকে স্বাগত৷’

এটা কীরকম হল? আমার তো রাস্তা ভুল হয় না৷ কামারপুকুরের রাস্তা আমার মুখস্থ৷ তার বদলে এই রাস্তাটা ধরলাম কী করে?

ভাবলাম কী করব? এই রাস্তাটাই নেব নাকি গাড়ি ফিরিয়ে কামারপুকুরের রাস্তাটা ধরব?

খানিক দোনোমোনো করে সামনে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম৷ হাজার হোক, একটা নতুন রাস্তা তো চেনা হবে৷

ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে৷ রাস্তায় জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে৷ গ্রামের রাস্তা হলে কী হবে, কাঁচা নয়, পিচের রাস্তা৷ যদিও জায়গায় জায়গায় রাস্তা ভেঙে এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে৷ তার মধ্যেই ধীরে ধীরে গর্ত বাঁচিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলাম৷

এতক্ষণ গাড়ির কাচ বন্ধ ছিল, এসি চলছিল বলে৷ এবার এসি বন্ধ করে কাচ নামিয়ে দিলাম৷ আর সঙ্গে সঙ্গে জোলো বাতাস আর ভ্যাপসা সোঁদা গন্ধ ঢুকে পড়ল গাড়ির ভেতর৷ সঙ্গে ব্যাঙেদের সমবেত গ্যাঙর গ্যাং আর উদ্দাম ঝিল্লীরব৷ ছোটবেলায় ঝিল্লি টিল্লি নিয়ে কত্ত ভালো ভালো কবিতা পড়েছি৷ সেসব নির্ঘাত শহুরে কবিদের লেখা৷ এই দেড়শো ডেসিবেলের আর্তনাদ শুনলে কবিরা কানে হাত চাপা দিয়ে দৌড় দিতেন সন্দেহ নেই৷

ভাঙাচোরা রাস্তায় গাড়ি চলছে আস্তে আস্তে আর হেডলাইটের আলোটা সামনের জমাট অন্ধকারের গায়ে আঁচড় কাটার চেষ্টা করছে৷ দুপাশে ঘন গাছপালা৷ গাড়িতে একটা টর্চ ছিল৷ সেটা জ্বালিয়ে একবার ডানদিকে ফেললাম৷ মনে হল আলোটা যেন ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল, জঙ্গল এতই ঘন আর অন্ধকার জঙ্গল৷

একটু পর জঙ্গল একটু পাতলা হয়ে এল৷ আর ঠিক তার পরেই একটা বিশাল বটগাছ৷

বলতে নেই, বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁত করে উঠল৷ এত বড় বটগাছ জন্মে দেখিনি৷ যেমন উঁচু, তেমনই গুঁড়ির বেড়৷ কত পুরনো কে জানে৷ চারিদিকে গোল করে শান দিয়ে বাঁধানো৷

তবে চমকানোর আরও একটু বাকি ছিল৷

বড় বটগাছটা সরে যেতেই একটা মস্ত বড় পুরনো, পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ তিনতলা জমিদারবাড়ি, সামনেটা বিশাল লম্বা৷ তার প্রায় শেষের দশা৷ একটা দিক হেলে পড়েছে, ইট খসে পড়েছে, দরজা-জানলা বলে আর কিছু নেই৷ ভাঙা জানলা থেকে বেরিয়ে আছে অশ্বত্থ পাকুড়ের চারা৷ হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় কঙ্কালের করোটি থেকে যেন সাপের ফণা উঁচিয়ে আছে৷

ভীতু মানুষ বলে আমার কোনওদিনই কোনও দুর্নাম ছিল না৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, বুকটা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে এল৷ চারিদিকে জনমনিষ্যি তো দূরের কথা, একটা কুকুর অবধি নেই৷ হু হু করে বইছে ঠান্ডা জোলো হাওয়া৷ আকাশ ঢেকে আছে মেঘে৷ সেই পরিবেশে চোখের সামনে এই প্রাচীন বটগাছ আর পোড়ো জমিদারবাড়ি দেখে বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠল৷

তবে জনমনিষ্যি যে একদম নেই সে কথাটা ভুল বলে তক্ষুনি তক্ষুনি প্রমাণ পেয়ে গেলাম৷ ভয়টাও ঝুপ করে কমে গেল৷

গাড়ি জমিদারবাড়ি ছাড়িয়ে একটু এগিয়েছে কি এগোয়নি, দেখি এক বয়স্ক বিধবা মহিলা সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছেন৷ পরনে সাদা শাড়ি, মাথা ঘোমটায় ঢাকা, আর হাতে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে মোড়া কিছু একটা৷ দেখে প্রাণে জল এল৷ যাক, একেবারে নির্জন জায়গা নয় তাহলে৷ ভাবলাম একবার ডাকি৷ তারপর ভাবলাম থাক, গ্রামগঞ্জের মানুষ, কোন কথাটা কীভাবে নেবেন কে জানে৷

এরপর গাড়ির স্পিড একটু বাড়ালাম৷ দুপাশে ফের ঘন জঙ্গল শুরু হয়েছে৷ মাঝে মাঝে জঙ্গল একটু পাতলা হয়ে এলে দেখতে পাচ্ছি যে রাস্তার পাশে নয়ানজুলি৷ নয়ানজুলির ওপাশে চাষের খেত৷

গাড়ি চালাতে চালাতে বুঝতে পারছিলাম কী যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে৷ কিন্তু সেটা কী বুঝতে পারছিলাম না৷

গাড়িটা চালাতে চালাতে আবার ওরকম একটা মস্ত বড় বটগাছ দেখতে পেয়েছি, অমনি একটা কথা বিদ্যুতের মতো মাথায় খেলে গেল৷

সোজা রাস্তা৷ দুপাশে কোথাও গলি গলতা নেই, মহিলা হঠাৎ করে উদয় হলেন কোথা থেকে?

বুকের মধ্যে সেই ভয়টা এবার জমে বসল৷ কপালে অল্প অল্প ঘাম জমতে লাগল৷ প্রশ্নটা ক্রমান্বয়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে৷ সোজা রাস্তা, আমি গাড়ি চালিয়ে আসছি, মহিলাকে আগে কোথাও দেখতে পেলাম না, হঠাৎ করে রাস্তায় এলেন কোথা থেকে৷

ভাবতে ভাবতেই একটা বাঁক নিয়েছি, দেখি সেই মহিলা! আবার! সেই সাদা শাড়ি, কপাল অবধি টানা ঘোমটা, আর হাতে সেই প্লাস্টিকের মোড়ানো ক্যারি ব্যাগ৷

দেখে স্টিয়ারিং ধরা হাত কেন, অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে গেল৷ কোন অলৌকিক মন্ত্রে সেই একই মহিলা এতটা পথ উজিয়ে আবার আমার সামনে চলে এলেন?

পরের কয়েকটা মুহূর্তের কথা তোমাদের কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না৷ হঠাৎ মনে হল পেটের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে৷ নিমেষে গলা শুকিয়ে কাঠ৷ কোনও শব্দ কানে আসছে না৷ হাত দুটো থর থর করে কাঁপছে৷ পায়ে জোর নেই৷

ওই অবস্থাতেও কী করে জানি না গাড়ির অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিলাম৷ বোধহয় ওখান থেকে পালাবার ইচ্ছেটা জোরদার হয়ে উঠেছিল বলেই, যাকে বলে সারভাইভাল ইনস্টিংক্ট৷

পরের দশটা মিনিট কীভাবে ওই খানাখন্দভরা বর্ষার রাস্তায় আশির ওপর স্পিডে গাড়ি চালিয়েছি সে আমিই জানি৷ মাথার মধ্যে আর কিছু নেই, শুধু কে যেন বলছে, পালাও, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাও এখান থেকে৷

একটু পর একটা বড় বাঁক৷ রাস্তাটা প্রায় অর্ধবৃত্তাকারে ডানদিকে বেঁকে গেছে৷ স্পিড কমাতে হল৷ বাঁকের জায়গাটা পেরোবার সময় দেখলাম রাস্তার বাঁদিকে দিগন্তবিস্তৃত দীঘি৷ দূরে পাহাড়ের মতো অন্ধকার মেঘ সেই দিঘির জলের ওপর ঝুঁকে আছে৷

এর পর আরও একটা পুরনো ভাঙা মন্দির পেরোলাম৷ এবার আর রাস্তার পাশে জঙ্গল নেই৷ দূরে গ্রামের টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছে৷

এবার একটু একটু করে সাহস ফিরে আসছে৷ গাড়ির গতি ধীর করলাম৷ বুক ধড়ফড়টা একটু কমেছে৷ মাথাটাও মোটামুটি কাজ করছে৷ খেয়াল করলাম যে গেঞ্জি জামা ঘামে একেবারে সপসপে ভিজে৷

একটু একটু করে এগোচ্ছি৷ একটু পরেই আবার একটা বাঁক৷ এবার বাঁদিকে৷ আস্তে আস্তে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছি৷ হেডলাইটটাও আস্তে আস্তে ঘুরছে৷ বাঁকটা শেষ হবে, এমন সময় হলদেটে আলোর মধ্যে ধীরে ধীরে একটা অতি প্রাচীন টেরাকোটা শিবমন্দির জেগে উঠল৷ তার ইট পাথর খসে পড়েছে, মন্দিরের চাতাল অর্ধেক নেই৷ মন্দিরের মাথা জুড়ে সাপের মতো জড়িয়ে আছে একটা বুড়ো বটগাছ৷ মন্দিরের দরজাটা অন্ধকারে হা হা করছে৷

বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ ভাবটা আবার ফিরে এল৷ কিন্তু আর একটু এগোতেই পরের যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল তাতে হৃৎপিণ্ডটা একলাফে আলজিভের কাছে এসে আটকে গেল৷

মন্দিরের ঠিক ওপাশে ভেসে উঠেছে একটা অবয়ব৷ আর তাকে চিনে নিতে আমার এক মুহূর্ত সময় লাগল না৷

সেই বুড়িটা! সেই সাদা শাড়ি, সেই কপাল অবধি টানা ঘোমটা আর হাতে মোড়ানো প্লাস্টিক ব্যাগ৷

ঠিক তক্ষুনি যে আমার হার্টফেল হয়নি সে আমার পূর্বপুরুষদের অনেক পুণ্যফল৷ মরেই যেতাম যদি না ঠিক তক্ষুনি একটা অন্য ঘটনা ঘটত৷

বুড়িকে দেখতে দেখতেই গাড়িটা চলে এল মন্দিরের সামনে আর বাঁদিকের চাকাটা একটা গর্তে পড়ে একরাশ নোংরা জল বুড়িটার গায়ে ছিটিয়ে দিল৷

গাড়িটার স্পিড কমানোর প্রশ্নই ওঠে না, কারণ আমার পা ইতিমধ্যেই অবশ৷ হাতও তাই৷ স্টিয়ারিং চলছে নিজের মতো৷ শুধু যেতে যেতে দেখলাম বুড়ি তার ঘোমটা পড়া মাথাটা আমার দিকে ঘোরাল৷ আর এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে আমি বুড়ির মুখে একটা বীভৎস ভ্যাচকানো হাসি দেখতে পেলাম৷

আগেও অনেকবার লক্ষ্য করেছি যে চূড়ান্ত বিপদের মুহূর্তে মাথা সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে গেলেও, কোনও এক দৈবী আদেশে হাত পায়ের পেশিগুলো একদম সচল সজাগ হয়ে ওঠে, তাদের কোনও নির্দেশ প্রয়োজন হয় না৷ এবারেও তাই হল৷ মগজের সক্রিয় নির্দেশ ছাড়াই গাড়ির অ্যাক্সিলরেটরে পা চলে গেল৷ আর আমার দশ বছরের পুরনো গাড়িটা যেন উড়েই চলল সামনের দিকে৷

কতক্ষণ ড্রাইভ করেছিলাম জানি না৷ এক-একটা মুহূর্ত অনন্তকাল মনে হচ্ছিল৷ ততক্ষণে গ্রামের রাস্তা শেষ করে একটা হাইওয়েতে উঠেছি৷ হাতে পায়ে সাড় ফিরে পেয়েছি৷ মগজও কাজ করছিল একটু আধটু৷ একটু এগোতেই দেখি একটা চায়ের গুমটি৷ তার সামনে কোনওমতে গাড়িটা দাঁড়করিয়ে কোনওমতে টলতে টলতে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম, গাড়ির দরজাটা খুলে রেখেই৷

দোকানি বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা ঘটেছে৷ সে শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘কী হয়েছে বাবু, শরীর খারাপ লাগছে?’

তখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হইনি৷ মুখে কোনও কথা ফুটল না৷ লোকটা চট করে এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এসে বলল, ‘আস্তে আস্তে খেয়ে নিন৷’

গরম দুধটা খেয়ে হাতে পায়ে বল এল৷ তখন মোটামুটি লোকজন দেখতে পাচ্ছি৷ হাইওয়ে দিয়ে সাঁই সাঁই করে ভিন রাজ্যের লরি চলে যাচ্ছে৷ একটু আগের অবশ করে দেওয়া ভয়টা আর নেই৷ ক্ষীণকণ্ঠে বললাম, ‘কোনওমতে বেঁচে ফিরে এসেছি দাদা৷’

লোকটা বলল, ‘সে কী? কী হয়েছে?’

বললাম, ‘আপনাদের এই পাশের গ্রামের রাস্তাটা খুব খারাপ দাদা৷ আপনারা জানেন না?’

লোকটা আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সে গ্রামের রাস্তা একটু ভাঙাচোরা হবেই৷ কিন্তু তাতে বাঁচা-মরার কথা উঠছে কেন?’

আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ভাঙা রাস্তার কথা বলছি না৷’

‘তাহলে?’

একটু চুপ করে থেকে বললাম, ‘একটু আগে ওই রাস্তায় একটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হল দাদা৷ ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে৷’

‘সে কী? কী হয়েছে?’

‘আপনাদের গ্রামের রাস্তায় রাতের বেলায় কাদের কাদের দেখা যায় জানেন না?’

লোকটা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কাদের আর দেখা যাবে৷ মানুষজনই হবে৷’

লোকটার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলাম৷ তারপর বললাম, ‘না দাদা, যাদের দেখা যায় তারা সবাই মানুষ নয়৷’

লোকটা এবার বোধহয় বুঝতে পারল৷ সন্দিগ্ধস্বরে বলল, ‘কী হয়েছে খুলে বলুন তো৷’

পুরো গল্পটা খুলে বললাম৷ শেষে বললাম, ‘দাদা, সেই বীভৎস হাসিটা জীবনেও ভুলতে পারব না৷’

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আমি দেওয়ানগঞ্জ থেকে ঢুকেছিলেন?’

বললাম ‘হ্যাঁ৷’

কোথাও কিছু নেই, লোকটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল৷ সে হাসি আর থামতেই চায় না৷ আমি তো অবাক৷ এতে হাসির কী হল?

হাসি থামলে লোকটা বলল, ‘ধুর, ওসব ভূতটুত কিছু নয় বাবু৷ দেওয়ানগঞ্জে আজ বয়স্ক বিধবাভাতা দেওয়ার ক্যাম্প বসেছিল৷ আশপাশের সব ক’টা গ্রামের বয়স্ক বিধবারা গেছিল ভাতা নিতে৷ সন্ধে অবধি ভাতা দিয়েছে৷ তারপর সবাই গ্রামে ফিরে আসছিল৷ আপনি তাদেরই দেখেছেন নিশ্চয়ই৷ সবাই বুড়ি, সবারই সাদা শাড়ি, আর সবার হাতেই ভাতা’র কাগজপত্র৷ আর আপনার মনে হয়েছে আপনি একই লোক দেখেছেন৷’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘কিন্তু একটাই রাস্তা, কাউকে আসতে দেখলাম না, হঠাৎ করে আমার সামনে উদয় হচ্ছিলেন কী করে?’

‘বাবু, মোটর গাড়ি চলার রাস্তা একটা হতে পারে৷ গ্রামের ভেতর ভেতর দিয়ে কত পায়ে হাঁটার রাস্তা আছে জানেন? ওসব শর্টকাট গাঁয়ের লোকেরাই জানে৷ বুড়িরা ওই রাস্তা দিয়েই এসে আপনার সামনে উপস্থিত হচ্ছিল আর আপনার মনে হয়েছে একই বুড়িকে বারবার দেখছেন৷ সত্যি বাবু, আপনাদের শহরের লোকদের দেখছি ভূত দেখার বাই আছে৷ এই দেখুন না, আমার মা নিজেই গেছিল ভাতা আনতে৷ এই তো একটু আগে ফিরে এসে দোকানে বসে আছে৷ এই দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরব৷

এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এখন দেখি দোকানের ভেতরে এক কোণে এক বয়স্কা বিধবা মহিলা বসে৷ সাদা শাড়ি, কপাল অবধি ঘোমটা৷ কোলে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে কাগজপত্র নিয়ে বসে আছেন৷

এর পর আর কথা চলে না৷ অনেক ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম৷

গল্পটা এখানেই শেষ হত৷ হল না অন্য কারণে৷

এর মাস খানেক বাদে ফের হাবুলদা’র কাছে গেছি কাজে৷ কথায় কথায় সেই রাতের কথাটা উঠল৷ আমি নিজের বেকুবির কথাটা ফলাও করে বলে নিজেই একচোট হাসলাম৷ কিন্তু হাবুলদা হাসল না৷

আমি বললাম ‘কী হল?’

হাবুলদা গম্ভীরমুখে বলল, ‘কিছু একটা গড়বড় আছে ভব৷ আমার মাসতুতো ভাই রাইটার্সে চাকরি করে৷ আগে তার কাছ থেকে একটা জিনিস জেনে নিই৷ তারপর বাকিটা বলছি৷’

পাশের ঘরে গিয়ে কাকে যেন ফোন করল হাবুল৷ ফোন শেষ করে যখন ফিরে এল তখন তার মুখ গম্ভীর৷ বলল, ‘বয়স্ক বিধবা ভাতা বলে গভর্নমেন্টের কোনও ভাতা বা স্কিম নেই ভব৷ আর তুমি যে গল্পটা বললে সে কাহিনী আমি হুবহু শুনেছি আরও দু’একজনের মুখে৷ সেদিন যা দেখেছিলে, তার মধ্যে মস্ত কিছু গন্ডগোল আছে৷ তুমি ভুল কিছু দেখোনি৷’

উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘গাড়ি তো আছেই৷ চলো, একবার স্বচক্ষে দেখেই আসি জায়গাটা, আর সেই চায়ের দোকানির সঙ্গে কথা বলে আসি৷’

ফের গেলাম সেই রাস্তায়৷ সেই একই রাস্তা, সেই বটগাছ, পোড়ো জমিদারবাড়ি, ভাঙা শিবমন্দির পেরিয়ে হাইওয়েতে উঠলাম৷

কই সেই চায়ের দোকান? সব ভোঁ ভাঁ৷ এমন নয় যে দোকান ছিল, উঠে গেছে৷ তাহলে তার চিহ্ন থাকত৷

একটা লোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল৷ তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, এখানে একটা চায়ের দোকান ছিল না?’

সে অবাক হয়ে বলল, ‘চায়ের দোকান? কই না তো?’

আমি দোকান আর দোকানদারের বর্ণনা দিলাম৷ লোকটা বলল, ‘ও, এবার বুঝলাম৷ এখানে চায়ের দোকান একটা ছিল বটে, বিধবা মা আর ছেলে মিলে চালাত৷ একবার এক বর্ষার রাতে একটা লরি ব্রেক ফেল করে দোকানে ঢুকে পড়ে৷ দুজনেই স্পট ডেড৷ কিন্তু সে তো অনেকদিন আগেকার কথা৷ এখন খুঁজছেন কেন?’

আমি আর হাবুলদা চুপচাপ ফিরে এলাম৷ তারপর থেকে আমি আর কোনওদিন রাতের বেলা অজানা গ্রামের রাস্তা ধরিনি৷’

চাটুজ্জেমশাই চুপ করলেন৷ আমরাও৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *