দৃষ্টিপাত – ৯

নয়

তিরিশে মার্চ সন্ধ্যায় ফিরোজশাহ কোটলায় মুনলাইট-পিকনিকের যিনি আয়োজন করেছিলেন, আইডিয়্যাল হোস্টেস বলে নয়াদিল্লীর সোসাইটিতে তাঁর প্রসিদ্ধি আছে। মহিলা সুন্দরী, পরিহাসপটু এবং প্রিয়ভাষিণী। বন্ধুসমাগমে আনন্দ লাভ ও আনন্দ দান করার দুর্লভ ক্ষমতা আছে তাঁর।

ফিরোজশাহ কোটলা দিল্লীর পঞ্চম নগরীর ধ্বংসাবশেষ। ভারতের শেষ হিন্দু সম্রাট পৃথ্বীরাজের সময়ে দিল্লী নগরী ছিল বর্তমান কুতুবের নিকটস্থ মেহরৌলীতে। পুরাতত্ত্ব বিভাগ কিছু কাল পূর্বে এই রাজধানীর নগর প্রাচীর মৃত্তিকাগর্ভ থেকে আংশিক উদ্ধার করেছেন। জনপ্রবাদ এই যে, নিজ প্রিয়তমা কন্যার যমুনা দর্শনাভিলাষ পূরণার্থে পৃথ্বীরাজ তৈরি করেছিলেন কুতুব মিনার। প্রত্যহ অপরাহ্ণ বেলায় প্রসাধন সমাপনান্তে রাজনন্দিনী আরোহণ করতেন তার শীর্ষে, অবলোকন করতেন দূরবর্তী যমুনার জলধারা। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা এ কাহিনী বিশ্বাস করেন না। তাঁদের অভিমত, পাঠান সম্রাট কুতুবুদ্দিন আইবেক নির্মাণ শুরু এবং আলতামাস শেষ করেন জগতের সর্বোচ্চ বিজয়স্তম্ভ এই মিনার।

দ্বিতীয় দিল্লী নগরী প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী। তাঁর রাজত্বকালে দুর্ধর্ষ মুঘল দস্যুদল ভারতবর্ষ আক্রমণ করল, হত্যা ও লুণ্ঠনের দ্বারা বহু নগরনগরী বিধ্বস্ত করে উপনীত হলো দিল্লীতে। দিল্লীর সমতল ভূমিতে তাদের প্রতিরোধ করা সহজ ছিল না। সম্রাট পশ্চাদপসরণ করলেন কুতুবে। মুঘলেরা দিল্লীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখল করে আমীর ওমরাহদের ধনরত্ন লুণ্ঠন করল এবং সাধারণ কৃষকদের শস্যক্ষেত্র বিধ্বস্ত করল। অবশেষে দিল্লীর অসহনীয় গ্রীষ্মের প্রখরতায় ক্লান্ত ও রোগাক্রান্ত হয়ে দস্যুদল দিল্লী পরিত্যাগ করল। আলাউদ্দিন এই দস্যুদলের পুনরাক্রমণ প্রতিরোধের জন্যে নির্মাণ করলেন সুদৃঢ় প্রাচীরবেষ্টিত নব নগরী, নাম দিলেন সিরি। এই নগরীতে সুলতান নির্মাণ করেছিলেন নিজের জন্য এক মহার্ঘ প্রাসাদ, তার স্তম্ভ সংখ্যা ছিল এক সহস্র। আজ সে প্রাসাদের চিহ্ন মাত্র নেই।

আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন অসমসাহসিক যোদ্ধা। রাজ্য জয়ের নেশা ছিল তাঁর রক্তে। তিনি রাজপুতদের পরাজিত করে চিতোর অধিকার করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে প্রথম মুসলিম অধিকারও প্রতিষ্ঠিত করলেন তিনি। সেই বিজয় গৌরবকে চিরস্মরণীয় করতে নির্মাণ শুরু করলেন দ্বিতীয় কুতুব। প্রথম কুতুবের পাশেই। প্রথম কুতুবের চাইতে এর আকার হবে দ্বিগুণ,-এই অভিলাষ ছিল সুলতানের মনে। কিন্তু আরব্ধ কাজ শেষ করার মতো আয়ুর মিয়াদ ছিল না তাঁর। অর্ধসমাপ্ত এই নর পরিকল্পিত কুতুবের চিহ্ন আজও দর্শকজনের কৌতূহল উদ্রেক করে। বর্তমান সিরির স্মারক আছে শুধু প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণায় এবং কিছুটা বিরাট নগর প্রাচীরের ভগ্নাবশেষের মধ্যে।

ফিরোজাবাদের প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান ফিরোজশাহ তোগলক। রাজার নামে রাজধানীর পরিচয় মুসলিম রাজত্বের ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতের মুসলিম নৃপতিদের মধ্যে ফিরোজশাহ তোগলক ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বৎসর তিনি প্রবল প্রতাপে রাজদণ্ড পরিচালনা করেছেন। দিল্লীর মুসলিম বাদশাহদের মধ্যে একমাত্র আওরঙ্গজেব ব্যতীত আর সবার চাইতেই তিনি ছিলেন বয়োবৃদ্ধ। মহম্মদ তোগলকের মৃত্যুর পরে তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখনই তাঁর বয়স ষাটের ঊর্ধ্বে।

ইতিহাসে মুহম্মদ বিন্ তোগলকের নাম অব্যবস্থিতচিত্ত ও অপরিণামদর্শী নৃপতির উদাহরণ রূপে কুখ্যাত। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাঁর চরিত্রে বহু রাজোচিত সদগুণেরও সমাবেশ ঘটেছিল। মহম্মদ বহু ভাষাবিদ, কবি, গণিতজ্ঞ এবং সুদক্ষ লিপিকার ছিলেন। সাহসী যোদ্ধা এবং সহৃদয় দাতা বলেও তাঁর সুনাম আছে। আবার নিষ্ঠুরতার জন্য নিন্দারও অভাব নেই। প্রসিদ্ধ আরবী পর্যটক ইবন বতুতার আত্মচরিতে সম্রাট মহম্মদের একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু যথার্থ বর্ণনা আছে।

‘দান করা এবং হত্যা করা এই দুই ব্যাপারেই রাজা মহম্মদ তুল্য দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। যে পথ দিয়ে তিনি যান সে পথে কোনো না কোনো অতি দরিদ্রকে তিনি ধনী বানিয়ে যান, কোনো না কোনো জীবিত ব্যক্তিকে তিনি পরলোকে পাঠিয়ে দেন। একাধারে তাঁর মহানুভবতার ও নিষ্ঠুরতার শত শত গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরছে।’

ইবন বতুতা নিজে মহম্মদের অধীনে কয়েক বছর দিল্লীর কাজী অর্থাৎ প্রধান বিচারক ছিলেন।

মহম্মদের নানা উদ্ভাবনী বুদ্ধি ছিল, কিন্তু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ছিল না। বহু বিষয়ে পরীক্ষা করায় তাঁর ঝোঁক ছিল। বেশীর ভাগ পরীক্ষারই মারাত্মক পরিণতি ঘটেছে। উত্তর ভারত থেকে দাক্ষিণাত্যে একাধিকবার রাজধানী স্থানান্তরিত করা, দিল্লী এবং দৌলতাবাদের মধ্যে রাজধানীর সমুদয় অধিবাসীর গমন ও প্রত্যাগমন, রৌপ্য মুদ্রার পরিবর্তে তাম্র মুদ্রার প্রচলন, চীন জয়ের প্রয়াস ইত্যাদি মহম্মদের সর্বনাশা উদ্যোগের একাধিক কাহিনী স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে বাল্যকালে আমরা পড়েছি।

জীবনের শেষভাগে মহম্মদ আপন সেনাবাহিনী নিয়ে বর্তমান করাচীর নিকটবর্তী থাট্টায় এক দুর্গ অবরোধ করেছিলেন। একদিন প্রভাতে সেখানে এক ধীবর সিন্ধুনদে হঠাৎ এক অদ্ভুত মৎস্য শিকার করেছিল। সে মৎস্য রাজসমীপে উপস্থিত করা হলো। সম্পূর্ণ অপরিচিত আকৃতির এই মৎস্য মানুষের রসনার পক্ষে সুস্বাদু কিনা সে পরীক্ষার বাসনা জাগল মহম্মদের মনে। পাত্রমিত্রের অনুরোধ উপরোধ অগ্রাহ্য করে সে মৎস্য সম্রাট আহার করলেন। ইহলোকে সেই তাঁর শেষ পরীক্ষা। সেদিনই জীবনান্ত ঘটল তাঁর।

মহম্মদের প্রতিভা ছিল, শক্তি ছিল। সে-সময়ে আলাউদ্দিন খিলজীর রাজধানী সিরি ও প্রাচীন মেহরৌলীর মাঝখানে দিল্লীর বিত্তশালী ব্যক্তিদের বহু প্রাসাদ ও প্রমোদোদ্যান গড়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে। কিন্তু যথোচিত রক্ষাব্যবস্থার অভাবে মুঘল দস্যুদের আক্রমণ সম্ভাবনা থেকে সেগুলি মুক্ত ছিল না। মহম্মদ তাঁর নিজ প্রাসাদ রচনা করলেন সেখানে। দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দিলেন সিরি থেকে মেহরৌলী। নব নগরীর নামকরণ করলেন ‘জাহানপন্না’-বাংলা ভাষায় যার মানে হলো জগতের আশ্রয়। প্রাসাদের সংলগ্ন ভূমিতে বৃহৎ এক হ্রদ খনন করেছিলেন পানীয় জলের সংস্থানে। কুতুবের অদূরবর্তী বর্তমান খিরকী গ্রামে আজও চোখে পড়ে এই প্রাচীরের অবশিষ্টাংশ। তার গায়ে হ্রদে জল প্রবেশ-ব্যবস্থার চিহ্ন আছে পরিস্ফুট।

বর্তমান কুতুব রোডের নিকটে সরকারী প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের খনন কার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে মহম্মদের স্নানাগার, তাঁর জেনানা ও তাঁর বিখ্যাত মঞ্চ, যেখানে বসে প্রত্যহ তিনি তাঁর সৈন্যদলের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করতেন। আলাউদ্দিনের সহস্রস্তম্ভ কক্ষের অনুরূপ মহম্মদও একটি বিরাট কক্ষ নির্মাণ করেছিলেন, যার কিছু কিছু চিহ্ন আজও কৌতূহলী দর্শকদের বিস্মিত করে।

মহম্মদের মৃত্যুর পরে ফিরোজশাহ তোগলক সম্রাট হলেন। মহম্মদের তিনি আত্মীয় এবং সেনানায়ক ছিলেন। সিন্ধু থেকে সৈন্য সামন্ত নিয়ে তিনি ফিরে এলেন দিল্লীতে। রাজ্যের গঠনকার্যে মনোনিবেশ করলেন অবিলম্বে। অনেকেই বোধ হয় জানে না যে, ফিরোজশাহই ভারতের সর্বপ্রথম নরপতি যার ধমনীতে হিন্দু ও মুসলমানের রক্ত এক হয়ে মিশে ছিল। তাঁর জননী ছিলেন রাজপুতানী।

দুই বিভিন্ন ধর্মের সম্মিলিত প্রভাব তাঁর চরিত্রে একটি বৈশিষ্ট্য দান করেছিল। বিদ্বান ও ধর্মপরায়ণ বলে তিনি খ্যাত ছিলেন এবং প্রজাদের কল্যাণ সাধনে তাঁর আন্তরিক স্পৃহা ছিল। মুসলিম যুগের প্রথম কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন ফিরোজশাহ। অধুনা ওয়েস্টার্ন যমুনা ক্যানেল নামে খ্যাত খালটি তিনিই খনন করেন। কর্নালের নিকটস্থ যমুনার মূল ধারা থেকে উৎসারিত হয়ে এর এক শাখা এসেছে দিল্লীতে, অপর শাখা গেছে হিসারে। ফিরোজশাহের আমলে এই খালের পরিধি বিস্তৃততর ছিল। সম্রাট শাজাহানের আদেশে তৎকালীন পূর্তবিভাগের অধ্যক্ষ আলী মর্দান খা এই খালের সংস্কার সাধন করেন। এখানে স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, সম্রাট শাজাহানের রক্তেও হিন্দু প্রভাব ছিল। তাঁর জননী যোধপুরী বেগমও রাজপুতানী ছিলেন। আহম্মদশাহ আব্দালী কর্তৃক দিল্লী অবরোধ কালে এ খালটি দ্বিতীয়বার বিনষ্ট হয় এবং পরবর্তী যুগে ইংরেজ শাসকগণের চেষ্টায় তার পুনঃ সংস্কার ঘটে।

সৌধ নির্মাণে ফিরেজশাহের গভীর অনুরাগ ছিল। এদিক দিয়েও সম্রাট শাজাহানের সঙ্গে তাঁর চরিত্রের মিল ছিল। কুতুব মিনারের ঊর্ধ্বতন যে দুটি তলা শ্বেত পাথরে গড়া তা ফিরোজশাহেরই কীর্তি। ভূমিকম্পে কুতুবের যে ক্ষতি ঘটেছিল তারও সংস্কার তিনিই করেছিলেন। দিল্লীর হিন্দুরাও হাসপাতালের সংলগ্ন, ‘রীজে এখনও তাঁর নির্মিত মৃগয়াগৃহের ভগ্নাবশেষ বর্তমান।

সিরি, বিজয়মণ্ডল ও কুতুবে তিন তিনটি নগরী থাকা সত্ত্বেও ফিরোজশাহ যমুনার ধারে আর একটি নতুন নগরের পত্তন করলেন। একেবারে যমুনার ঠিক গায়ে নির্মাণ করলেন রাজপুরী ফিরোজশাহ কোটলা। আজ তোরণপথে ঢুকলেই বাঁ দিকে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ তৃণাচ্ছাদিত অঙ্গন। একদা সেখানে ছিল ফিরোজশাহের দরবার গৃহ। আজ আমাদের পিকনিক পার্টির আসর বসল সেখানে।

দলটি ক্ষুদ্র নয়। ছেলে মেয়ে নিয়ে প্রায় জন বারো। কিন্তু অধিনায়িকা আহার্য যা এনেছেন, তা দিয়ে অনায়াসে তার ডবল লোকের উদর পূর্তি করা যেতে পারে।

পিকনিকে সব চেয়ে যিনি মনোযোগের যোগ্য, তিনি মিস্টার খোলা। বহুল পরিচিত ব্যক্তি। বিশেষ করে মহিলা মহলে। মেয়েরা এগজিবিশন করেছেন, তার দরজায় ভলান্টিয়ারী করেছেন কে? মিস্টার খোলা। সমিতি দামোদর বন্যার সাহায্য ভাণ্ডারে টাকা তুলেছেন। মেয়েদের সঙ্গে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁদা আদায় করেছেন কে? মিস্টার খোলা। চাঁদনী চক থেকে মিসেস মুখার্জীর উল কিনে আনছেন, মিসেস স্বামীনাথনের জন্য পাঁচ দোকান ঘুরে পন্ডস ক্রীম যোগাড় করছেন। সমস্তই মিস্টার খোশলা। নয়া দিল্লীতে মেয়েরা আছেন অথচ মিস্টার খোলা নেই, এমন কোন সভা, সমিতি, পার্টি, পিকনিক কেউ কল্পনা করতে পারবে না।

সাধারণ পাঞ্জাবীর তুলনায় বেঁটে, দোহারা চেহারা। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। নির্বাক যুগের চিত্রাভিনেতা ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস-এর অনুকরণে দীর্ঘ জুলপি গালের মধ্যপথ পর্যন্ত প্রসারিত। হিটলারের মতো গোঁপের কায়দা। পরিধানে ব্রাউন রঙের কর্ডরয়ের প্যান্ট, পায়ের গোড়ালির কাছটা সরু। প্যান্টের পিছনে হিপ্-পকেট। তাতে মনোগ্রাম করা লম্বা রূপার সিগারেট কেস যার গর্ভে প্রায় পঞ্চাশটা সিগারেট রাখা চলে। গায়ে গ্যাবার্ডিনের কোট। প্রায় আজানুলম্বিত নীচের পকেট দুটি ঈদের চাঁদের আকৃতিতে কাটা। সিল্কের সার্ট। টকটকে লাল রঙের টাই, তাতে নীল রং-এর লতাপাতার ছাপ। মাথায় একটি সবুজ ফেল্টের টুপি, নীচের দিকে নামিয়ে পরেন। পায়ে কখনও কম্বিনেশন সু. কখনও বা বাকলস আঁটা সুয়েডের জুতা। দিনের বেলায় চোখে এক জোড়া মোটা শেলের ফ্রেমযুক্ত সানগ্লাশ। রোদ থাক আর নাই থাক। মেয়েদের হাতে রিস্টওয়াচের মতো মিস্টার খোশলার গগলসও প্রয়োজনের জন্য নয়, শোভার জন্য।

মিস্টার খোলার প্রকৃত পেশা নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলে তিনি কন্ট্রাক্টর, কেউ বলে তিনি দু’ তিনটে বীমা কোম্পানীর এজেন্ট, আর কেউ বা এমন কিছু বলে যার ইংরাজি তর্জমা করলে কথাটা দাঁড়ায়, স্রেফ লোফার। তিনি নিজে কার্ডে নামের পিছনে লেখেন একটি শব্দ যা দিয়ে নলিনীরঞ্জন সরকার থেকে শুরু করে বাবুগঞ্জের হাটে কাটা-কাপড়ের ব্যবসাদার পতিতপাবন সাহাকে পর্যন্ত বুঝানো যায়। মার্চেন্ট। কিন্তু কাজ তাঁর যাই হোক, ব্যস্ততার অভাব নেই। এই দারুণ পেট্রোল রেশনিং-এর দিনেও সারাদিনই দেখা যায় তিনি তাঁর বেবী অস্টিন নিয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটছেন শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। পথে পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে এক মিনিট কথা বলেই বলেন ‘আচ্ছা ভাই, এখন বড্ড ব্যস্ত। আবার দেখা হবে, শ্যাল সি ইউ এগেন।’

পিকনিকে খোলা বিপুল উদ্যমে মেয়েদের আহার্য পরিবেশন করলেন। স্যান্ডউইচের প্লেট নিয়ে ছুটতে গিয়ে প্রায় আছাড় খেতে খেতে বেঁচে গেলেন। সন্দেশের থালা নিয়ে হন্ত দন্ত হলেন, কোনো মহিলাকে ‘প্লিজ’ কোন মহিলাকে বা ‘ফর মাই সেক,’ বলে দুটো বেশী পেস্ট্রী খাওয়ালেন। একটি তরুণী অন্য কার কাছে এক গ্লাশজল চাইছিলেন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মিস্টার খোশলা। তাঁর কানে যেতেই ‘জল, জল, মিস উপাধ্যায়ের জন্য জল’ বলে এমন উতলা হয়ে জলের অন্বেষণে ছুটতে লাগলেন যে, মনে হলো, হাতের কাছে অন্য কোথাও না পেলে তিনি বুঝিবা তৎক্ষণাৎ ভগীরথের ন্যায় গঙ্গা আনয়নের জন্য কৈলাসে ছুটবেন!

শ্রীমতী সুব্বা রাও প্রস্তাব করলেন চারিদিকে ঘুরে দেখবার। দেখার মধ্যে যা আছে তা ফিরোজশাহ নির্মিত একটি মসজিদ। সুলতান পাত্রমিত্র নিয়ে জুম্মার দিনে প্রার্থনা করতে আসতেন। অনুমান করা অন্যায় নয় যে, সেদিন এই মসজিদের গুরুত্ব ছিল অসাধারণ। যদিও আজ ভগ্নদশা দেখে তার বিগত সৌষ্ঠব বুঝবার উপায় নেই। কিন্তু তার গঠন-পারিপাট্য লক্ষ্য করার মতো। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘প্রোপোরশন’-ফিরোজশাহ-কোটলার মসজিদ ও অন্যান্য প্রাসাদ ভগ্নাবশেষে তা বিশেষভাবে বর্তমান।

ফিরোজশাহের আমলে সর্ব প্রথম ভাতীয় স্থপত্যে হিন্দু ও মুসলিম পদ্ধতির সিনথেসিস ঘটেছিল। প্রাক মুসলিম যুগের উত্তর ভরতীয় হিন্দু স্থাপত্য ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। অতি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরে এখনও তার চিহ্ন আছে। বর্তমানে জৈন পদ্ধতি নামে অভিহিত এ স্থাপত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন বোধ হয় রাজপুতনার মাউন্ট আবু পর্বতোপরি বিখ্যাত মন্দিরটি।

সেদিনের হিন্দু স্থাপত্যে আর্চ— অর্ধবৃত্তাকার গঠন—ছিল না। তার বৈশিষ্ট্য ছিল চতুষ্কোণ স্তম্ভে। এই স্তম্ভগুলি কারুকার্যখচিত! কোনোটাতে দেবদেবীর মূর্তি, কোনোটাতে পুষ্পসজ্জা, কোনোটাতে বা ঘন্টা কিংবা গাছ। প্রস্তরে গঠিত এই স্তম্ভগুলির অলঙ্করণের মধ্যে মিলত সেদিনকার স্থপতিদের মণ্ডন-চাতুর্যের পরিচয়। সেকালের স্থাপত্যে গম্বুজেরও অস্তিত্ব ছিল না। চতুষ্কোণ স্তম্ভের উপরে সমান্তরাল প্রস্তরখণ্ড একটির পর একটি সাজিয়ে দু’দিক থেকে ক্রমশ মিলিয়ে আনা হতো মাঝখানে। দ্বার, গবাক্ষ ও প্রবেশপথের উপরাংশে আর্চের পরিবর্তে এই গঠন অনেকটা দাগ কাটা সিঁড়ির মতো দেখায়। আর্চের ভারবহন ক্ষমতা অধিক এবং তার ব্যবহার ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত ছিল।

এই স্থাপত্যের প্রথম পরিবর্তন ঘটল দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। দাস বংশের কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লীতে এসে প্রথম তৈরি করতে চাইলেন একটি মসজিদ যেখানে বসে তিনি আল্লার কাছে পাঠাতে পারবেন প্রচুরতর অর্থ প্রবলতর প্রতাপ এবং প্রভৃততম শান্তি কামনা করে প্রাত্যহিক আবেদন। বলা বাহুল্য তাঁর নিজ জন্মস্থান আফগানিস্থানে যে ধরনের মসজিদের সঙ্গে তিনি আশৈশব পরিচিত তারই অনুরূপ ভজনালয় নির্মাণ করা ছিল তাঁর বাসনা। সে মসজিদ পয়েন্টেড আর্চের, অনেকটা গণিত শাস্ত্রের দ্বিতীয় বন্ধনীচিহ্নের মতো খিলানের উপর তৈরি। রোমানরা ব্যবহার করতো বৃত্তাকার আর্চ। আরবীয়েরা পছন্দ করতো পয়েন্টেড আর্চ। পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, পয়েন্টেড আর্চ সম্বলিত স্থাপত্যের প্রথম নিদর্শন হলো ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত ইরাকের অন্তর্গত সামাররার মসজিদটি। হিন্দু স্থপতিদের জানা ছিল না তার নির্মাণ কৌশল। কাবুল কান্দাহার থেকে মুসলিম কারিগর আনাও সম্ভব ছিল না। সুতরাং দিল্লীর প্রথম মসজিদে স্থাপত্যের যে নিদর্শন রইল সেটা হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যের সম্মেলন নয়, গোঁজামিলন। কুতুব মিনার সংলগ্ন মসজিদে আজও তার প্রমাণ আছে। সে মসজিদের বারান্দায় ও দ্বারপথে অর্ধবৃত্তাকার গঠন সত্যিকার খিলানের উপর নয়। তাতে ‘কী-স্টোন’ নেই।

মুসলিম স্থাপত্যে দেবদেবীর মূর্তি বা পুষ্প ও বৃক্ষলতা উৎকীর্ণ করার রীতি ছিল না। কোরাণের বচন উদ্ধৃত হতো মসজিদের প্রাচীরের গায়ে ও আর্চের উপরে। আরবী লিপি ও কোরাণের রচনা সম্পর্কে কুতুবুদ্দিনের মসজিদ নির্মাণরত ভারতীয় রাজমিস্ত্রীদের জ্ঞান ছিল সামান্যই। তাই কৃত্রিম আর্চের উপরে তারা বৃক্ষ অঙ্কন করে তার আশেপাশে আরবী বচন উৎকীর্ণ করার প্রয়াস করেছে কোনো মতে। হিন্দু স্থাপত্যের চিহ্ন মসজিদের সংলগ্ন মণ্ডপে আরও অধিকতর প্রকট। তার স্তম্ভগুলি নিঃসন্দেহে কোনো হিন্দু মন্দির থেকে আহৃত। সেকালে মুসলিম নরপতিরা লুণ্ঠনকে লজ্জার বিষয় মনে করতেন না। বরং অপহৃত দ্রব্যের প্রকাশ্য ব্যবহারের দ্বারা তাঁরা বিজয়স্তম্ভ রচনা করে আপন অপকীর্তির সাক্ষ্য রাখতেন পরবর্তীকালের জন্য।

সুলতান আলতামাস কুতুবুদ্দিন রচিত মসজিদের বিস্তার সাধনে উদ্যোগী হয়ে গজনী থেকে আনলেন মুসলিম স্থপতি ও কারিগর। তারা জ্যামিতিক পদ্ধতির মুসলিম অলঙ্করণ প্রচলন করল ভারতবর্ষে। খিলজী যুগে অধিক সংখ্যক মুসলিম রাজমিস্ত্রী এল আফগান থেকে। তারা প্রবর্তন করল চতুষ্কোণ স্তম্ভের পরিবর্তে ‘কী-স্টোন’-যুক্ত সত্যিকার আর্চ, সমতল ছাদের বদলে গম্বুজ, চলতি ভাষায় যাকে বলে শিকারা, এবং ঘন্টা, পুষ্প, বৃক্ষ ইত্যাদির বদলে জ্যামিতিক রেখাঙ্কন সজ্জা। ভারতে পুরোপুরি মুসলিম স্থাপত্যের প্রতিষ্ঠা হলো। কুতুব সংলগ্ন আলাই দরওয়াজা ও নিজামুদ্দিনের জামাতখানা মসজিদ সেকালের হিন্দু প্রভাববর্জিত একান্তভাবে মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন।

তোগলক রাজত্বে, বিশেষ করে ফিরোজশাহের নির্মিত প্রাসাদ, দুর্গ ও অন্যান্য অট্টালিকায় হিন্দু স্থাপত্যের পুনর্ব্যবহার দেখা গেল। সে যুগের স্থাপত্যের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো অলঙ্কার ও বাহুল্যবর্জিত গঠন। সাধারণ পাথর ও চুন সুরকির আস্তর দিয়ে তা তৈরি, খিলজী আমলে ও পরবর্তী মুঘল যুগে ব্যবহৃত লাল বা শ্বেত পাথরের চিহ্ন বড় নেই। বোধ হয় মুঘল দস্যুদের আক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ও দাক্ষিণাত্য অভিযান প্রভৃতিতে ফিরোজশাহের পূর্ববর্তী রাজকোষ শূন্য হয়ে এসেছিল, ব্যয়বহুল প্রস্তর ব্যবহার আর সম্ভব ছিল না। মহম্মদ তোগলক কর্তৃক বারংবার দিল্লীর অধিবাসীদের স্থানান্তরিত করার ফলে পাথরের কাজে দক্ষ রাজমিস্ত্রীর অভাব ঘটাও বিচিত্র নয়।

ফিরোজশাহের সৌধাবলীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, চতুষ্কোণ স্তম্ভের ব্যবহার, দ্বারপথে ও বারান্দায় আর্চের বদলে হিন্দু পদ্ধতির গঠন এবং প্রস্ফুটিত পদ্ম উৎকীর্ণ প্রাচীর সজ্জা। ফিরোজশাহ নির্মিত হাউজ খসের পরবর্তী অংশগুলিতে আছে এর প্রকৃষ্ট পরিচয়।

মসজিদের গায়ে যে অট্টালিকার উপর অশোক স্তম্ভটি আছে তার আরোহণপথ খুব কঠিন নয়। সিঁড়ির ধাপগুলি কিছুটা উঁচু সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের সঙ্গী নারীবাহন মিস্টার খোলা থাকতে মেয়েদের চিন্তার কারণ নেই। প্রত্যেকটি মহিলা নিরাপদে উপরে না ওঠা পর্যন্ত তিনি নীচে দাঁড়িয়ে তদারক করলেন। বেশী পরিচিতাদের হাতে ধরে উঠতে সাহায্য করলেন এবং সদ্য পরিচিতাদের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘মে আই— ‘

অশোক স্তম্ভটি প্রাসাদের যে অংশে স্থাপিত সেটা ফিরোজশাহের অন্দরমহলের অন্তর্ভুক্ত বলে কথিত। স্তম্ভটি প্রস্তর নির্মিত। আম্বালার নিকটবর্তী এক গ্রামে সম্রাট অশোক কর্তৃক এই স্তম্ভটি স্থাপিত হয়েছিল খ্রীস্টজন্মের প্রায় আড়াই শত বৎসর পূর্বে। একদা মৃগয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে তা’ ফিরোজশাহের চোখে পড়ল। পুরাকীর্তিতে ফিরোজশাহের গভীর আগ্রহ ও অনুরাগ ছিল সেখান থেকে স্তম্ভটি তুলে নিয়ে এলেন তিনি দিল্লীতে, তাঁর রাজধানী ফিরোজশাহ কোটলায়।

বিয়াল্লিশ চাকার গাড়িতে চাপিয়ে শত শত মজুর টেনে এনেছিল এই স্তম্ভটিকে। স্তম্ভটির শীর্ষে একটি স্বর্ণ নির্মিত আচ্ছাদন ছিল। পরবর্তী যুগে জাঠ দস্যুরা দিল্লী লুণ্ঠনকালে তা’ আত্মসাৎ করেছে। বহুবর্ষ পরে স্তম্ভের গায়ে পালি ভাষায় উৎকীর্ণ লিপির পাঠোদ্ধার হয়েছে। অহিংসা ও সর্বজীবে দয়াপ্রদর্শনের অনুরোধ জানিয়ে ভগবান বুদ্ধের অনুগামী সম্রাট অশোক সমগ্র ভারতবর্ষে যে বহুশত অনুশাসন প্রচার করেছিলেন, এই স্তম্ভে তারই একটি সাক্ষ্য রয়েছে।

অশোক স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যায় অদূরবর্তী যমুনার জলস্রোত। ফিরোজশাহের আমলে যমুনার ধারা কোটলার পাদদেশ স্পর্শ করত সে কথা বুঝতে আজও কিছুমাত্র কষ্ট হয় না।

নীচে নেমে সদলবলে বসা গেল খোলা মাঠের মধ্যে। পাশে একটি ক্ষুদ্র জলাশয়। স্থানীয় লোকেরা বলে, বাউলী। দারুণ গ্রীষ্মের দিনে সুলতান অবগাহন করতেন এর জলে, বিশ্রাম করতেন এর তীরবর্তী পাষাণ-বেদিকায়।

কে একজন বললেন, ‘তাস সাথে থাকলে একহাত খেলা যেত।’

আমাদের অধিনায়িকা অমনি তাঁর তোরঙ্গ থেকে বার করলেন দু’প্যাকেট সুদৃশ্য ঝকঝকে তাস, নম্বর লেখার ছাপানো প্যাড ও পেন্সিল।

সবাই জয়ধ্বনি করে বলল—’একেই বলে দূরদৃষ্টি। সকল কালের সকল রকম দরকারের কথা যিনি আগে থাকতে ভেবে রাখেন, তাঁরই নাম অনাগতবিধাতা।’

ডাক্তার অধিকারী আমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ। আর্মিতে লেফটেনেন্ট কর্নেল। অত্যন্ত রসিক লোক। মাথার পাকা চুল দিয়ে মনের কাঁচা ভাবকে ঢেকে রেখেছেন। মাইল দশেক দূরবর্তী ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসেছেন পিকনিকে যোগ দিতে। কন্ট্রাক্টব্রিজে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। খুশি হয়ে বললেন, ‘ক্রীপস আলোচনা চলছে। স্বরাজ হলে আমরা ওঁকেই প্রেসিডেন্ট করব। স্বাধীন ভারতে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট মিসেস বিজয়া ব্যানার্জী। বিজয়া ব্যানার্জী কী—’

সবাই মিলিত কণ্ঠে উচ্চধ্বনি করলেন, ‘জয়।’

বাধা দিয়ে বললেন, ‘কর্নেল, প্রেসিডেন্ট বললেই মনে হয় পলিতকেশ, বিগতযৌবনা বৃদ্ধা। তার চাইতে বলুন মহারাণী। ‘

কর্নেল তৎক্ষণাৎ স্বীকার করলেন: ‘ঠিক বলেছ ভায়া। মহারাণীই ভালো। দিল্লীর দ্বিতীয় মহিলা সম্রাজ্ঞী। সুলতানা রিজিয়ার পরে সুলতানা বিজয়া। জয় মহারাণী বিজয়া কী জয়। বন্দে মাতরম, আল্লা হো আকবর, হিপ হিপ হুররে।’

ভাবী সুলতানা সহাস্যে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একসঙ্গে তিনটাই বলেন নাকি আপনি?’

‘নিশ্চয়। গান্ধী মহারাজ, জনাব জিন্না ও ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে খুশি রাখতে হয়। যখন যাঁর হাতে ক্ষমতা আমি তাঁরই দলে আছি। অবস্থা অনুযায়ী যার যত তাড়াতাড়ি মত বদলায় ইংরেজিতে তাকেই তো বলে তত প্রগ্রেসিভ।’

মিস্টার জুবেরী সদ্য আই.সি.এ. হয়েছেন। বিলেতে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে কিছুকাল পড়েছিলেন। সোশ্যালিজমে এখনও ভক্তি আছে। বললেন, ‘মহারাণী তো মনার্কিজম ডেমোক্রেসির যুগে তা চলবে না।’

কর্নেল বললেন, ‘খুব চলবে। ঘরে ঘরে মনার্কিজম চলছে, আর ঘরের বাইরে গভর্নমেন্টে চলবে না? ভায়া হে, তোমার বয়স অল্প, শিখতে এখনও ঢের বাকী ডেমোক্রেসি বস্তুটা আছে শুধু হ্যারল্ড ল্যাস্কির বইতে। আমাদের মিস্টার ব্যানার্জীকে জিজ্ঞাসা করে দেখ, তাঁর বাড়িতে তাঁর জানলার পর্দা নীল হবে কি সবুজ হবে, সকালে সুক্তো রান্না হবে কি ছেঁচকি রান্না হবে এসব সিদ্ধান্ত ব্যানার্জীর ভোট নিয়ে ঠিক হয়, না মহারাণীর হুকুমে চলে? বিয়ে করলে নিজেই বুঝতে পারবে যে, হার মেজেস্টিস্ গভর্নমেন্টে আর যাই থাক, লীডার অব দি অপোজিশন নেই।’

প্রবল উচ্চ হাস্য উত্থিত হলো সভায়।

লজ্জাজড়িত আত্মপ্রসাদে মহিলার গৌর গণ্ডদ্বয় রক্তিম হয়ে উঠল। প্রসঙ্গ চাপা দেওয়ার জন্য আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর কথা নয়। আসুন এবার খেলা যাক।’

হাত জোড় করে বললেম, ‘মাপ করবেন ও বিদ্যে আমার একেবারে জানা নেই।’

‘বলেন কী? আচ্ছা তা হলে খেলা থাক। গান করুন।’

‘কী সর্বনাশ! তার চাইতে বরং কুতুব মিনারের উপর থেকে লাফিয়ে পড়তে বলুন। না হয় আপনার খাতিরে তাই চেষ্টা করে দেখব। গান করলে অবশ্য লাফিয়ে পড়ার ইচ্ছাটা হবে আপনাদের।’

ব্যানার্জী বললেন, ‘তবে আবৃত্তি শোনান, রবি ঠাকুরের কবিতা।’

জবাবে বললেম, ‘ছোটবেলায় সংস্কৃত শব্দরূপ আর বড় হয়ে জুরিসপ্রুডেন্সের ধারা মুখস্থ করে করে কবিতা মনে রাখবার আর সময় পেলেম কখন?’

মিসেস বললেন, ‘আচ্ছা, তা হলে গল্প বলুন।

ডাক্তার অধিকারী অ্যামেন্ডমেন্ট যোগ করলেন,-’প্রেমের গল্প?।’ হেসে বললেম, ‘কর্নেল, প্রেমের হলে সেটা যে গল্পই হবে, সত্যি হবে না, সে তো জানা কথা। কিন্তু সে গল্পও আমার জানা নেই। চান তো ভূতের গল্প বলতে পারি। জানেন, এই বাউলীর ধারে ঠিক আপনার ডাইনে মিসেস মিত্র যেখানটায় বসেছেন, সেখানে রাজরক্তের দাগ? সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরকে এখানে হত্যা করা হয়।’

‘ও মাগো!’—বলে ত্রিং করে লাফ দিয়ে সরে একেবারে দলের মাঝখানটিতে এসে বললেন মিসেস মিত্র। বার বার নিজ শাড়ির দিকে পরীক্ষামূলক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন, সত্যিই রক্তের দু’একটি ছিটে ফোঁটা তাঁর বসনে লেগেছে কিনা সেই আশঙ্কায়। সবাই খানিকটা হেসে নিল। কিন্তু অন্যান্য মহিলারাও যে একটু চঞ্চল না হলেন তা নয়।

মিস্টার খোশলা মিসেস মিত্রের জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন। বার বার বলতে লাগলেন এমন ভাবে মেয়েদের ভয় দেখানো মোটেই উচিত হয়নি। হঠাৎ ভয় পেয়ে শক লাগলে সাঙ্ঘাতিক ইত্যাদি ইত্যাদি।

অধিনায়িকা দমবার পাত্রী নন। বললেন, ‘বেশ, বলুন ভূতের গল্প। সত্যি ভূতের হওয়া চাই কিন্তু। বানানো নয়।’

‘মিসেস ব্যানার্জী, ভূত চিরকালই বানানো হয়ে থাকে। ভূতের গল্পের তো কথাই নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তাও আমি জানি নে।’

মহিলা সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না না, আপনি কেবলই ফাঁকি দিচ্ছেন। তাস খেলা নয়, গান নয়, গল্পও নয়। একটা কিছু করুন।’

কর্নেল বললেন, ‘তাই তো হে, তোমার কেস খারাপ হচ্ছে। তুমি যদি কোনো কিছুই না পার তবে মহারাণীর গভর্নমেন্টে তোমার জায়গা হবে না।’

মহিলা বললেন, ‘সত্যি তো। আপনাকে নিয়ে করব কী? গান গাইতে জানেন না যে, বৈতালিক হবেন! পদ্য কইতে পারবেন না যে, সভাপণ্ডিতের চাকরি দেব। গল্প বলতে পারেন না যে, বয়স্য করব। এমন অকর্মা লোক আপনি হবেন কী?’

যুক্তকরে বললেম, ‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকার।’

বিপুল হাস্যরোল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *