দৃষ্টিপাত – ৮

আট

সকালবেলা ঘুম ভাঙলো একটি মেয়ের চেঁচানিতে। শুধু আজ নয়, প্রত্যহই ভাঙে। অবশ্য আমি বলি চেঁচানি। মেয়ের মা বলেন গান। মেয়েটি গান শিখছে।

পৃথিবীতে সঙ্গীত কে কখন সৃষ্টি করেছেন জানিনে। কিন্তু এতকাল এইটুকু বিশ্বাস ছিল, যিনিই করুন, তাঁর মনে কোনো নিষ্ঠুর অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু সে ধারণা বজায় রাখা ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছে।

মেয়েটির গলায় সুরের লেশ মাত্র নেই, অথচ জোর আছে অসুরের। সেটা আরও সাংঘাতিক। ভোর পাঁচটা থেকে সাতটা, এই পাকা দু’টি ঘন্টা সে প্রত্যহ সঙ্গীতাভ্যাস করে। সপ্ত সুরের সঙ্গে কুস্তি করে বললেই ঠিক হয়। আশেপাশের প্রতিবেশীরা যে এখনও ননভায়োলেন্ট আছে সেটা গান্ধীজির শিক্ষায় নয়, একান্ত নিরুপায় হয়েই। সভ্যতার অনেক দণ্ড আছে। তার মধ্যে এও একটা।

ইউরোপ আমাদের অনেকগুলি মন্দ জিনিস দিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক কোনটা সে বিষয়ে মতভেদ আছে। ডাক্তারেরা বলেন সিফিলিস, গুরুজনেরা বলেন ফ্রি-লভ এবং গান্ধীজি বলেন কলকারখানা। আমার মনে হয় ভারতবর্ষে ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিকর আমদানি হারমোনিয়ম। মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নিদারুণ অত্যাচারের এমন দ্বিতীয় যন্ত্র নেই। আশ্চর্য নয় যে, পণ্ডিত জওহরলাল বলেছেন, জনসভায় অভিনন্দনপত্র পাঠ করার আগে কেউ যখন হারমোনিয়ম বাজিয়ে উদ্বোধন সঙ্গীত শুরু করে তখনই তাঁর অদম্য অভিলাষ হয়, জনতার মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বাদ্যযন্ত্রটাকে পদাঘাতের দ্বারা চূর্ণ বিচূর্ণ করেন।

জড় পদার্থের একটা সুবিধা আছে। তার সহনশীলতা অপরিসীম। সে বিদ্রোহ করে না। দিনের পর দিন দু’ঘন্টা বেসুরো চিৎকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আওয়াজ বের করা একমাত্র হারমোনিয়মের পক্ষেই সম্ভব। গত দশদিন ধরে সেই এক সুরে ‘বঁধু, তুমি যে চলে গেলে, ফিরে তো নাহি এলো। বঁধু লোকটা যে কে, ঠিক জানিনে। যেই হোক, বেচারীর অবস্থা কল্পনা করতে পারি। মেয়েটির সঙ্গে আলাপ থাকলে হাতজোড় করে বলতেম বাছা, চলে যে গেছে, সে নেহাত প্রাণের দায়েই গেছে এবং তোমার ঐ গান না থামলে সে আর ফিরছে না এও নিশ্চয়। প্রেম যত গভীরই হোক প্রাণের মায়া, অর্থাৎ কানের মায়ার চাইতে সে বড় নয়।

মেয়েটির অপরাধ নেই। তার মাকে দোষ দেওয়া বৃথা। তিনি জানেন মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। পাত্রপক্ষ কনে দেখতে এলে গানের পরীক্ষা আছেই। সুতরাং তার জন্য মেয়েকে তৈয়ার করা আবশ্যক। তাই কিনতে হয় হারমোনিয়ম, রাখতে হয় গানের মাস্টার, মেয়েকে প্রাণান্তকর কসরৎ করতে হয় কণ্ঠস্থলীর।

এদেশে সর্বগুণান্বিতা হবার দাবী মেয়েদের উপরে। বিবাহযোগ্যা কন্যাকে হতে হবে বিদূষী, কলাবতী, সুধীরা ও গৃহকর্মনিপুণা। যে মেয়ে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বি.এস.সি. পাশ করেছে তাকেও কার্পেটে ফুল তোলা শিখতে হয়, বড়ির ফোড়ন দিয়ে মোচার ঘন্ট রাধতে জানতে হয় এবং সম্ভবপর বরের বন্ধুদের সামনে কনে বাছনির সময় মহাত্মা গান্ধীর একটি অতি পরিচিত ফটোর ভঙ্গিতে মাদুরে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরতে হয়— ‘যে ছিল আমার স্বপনচারিণী তারে’ ইত্যাদি।

বিবাহের দরবারে পুরুষের কাছে প্রত্যাশা সামান্য। ডাক্তার বরের মাসিক আয়ের খোঁজ নিয়েই মেয়ের মায়েরা খুশি থাকেন, তার ক্রীড়া-দক্ষতা, অভিনয় পারদর্শিতা কিংবা বক্তৃতা শক্তি নিয়ে মাথা ঘামান না। ছেলেরা করবে শুধু একটা। হয় লেখাপড়া, নয়-ফুটবল, নয়তো ইন্‌কেলাব জিন্দাবাদ। মেয়েদের বিচার কোনো একটা মাত্র কৃতিত্বে নয়, সবকিছু মিলিয়ে। তাদের দাম প্রথমত, রূপে, তারপর তাদের বিদ্যায়, তাদের সঙ্গীতে, তাদের নৃত্যে, তাদের সূচীশিল্পে এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাদের পিতৃকুলের ব্যাঙ্কব্যালেন্সের পরিমাপে।

পুরাকালে রাজকন্যারা নিজেরা পতি নির্বাচন করতেন। পুরুষের হতো পরীক্ষা। বীর্যবত্তার পরীক্ষা। পুরুষকে তখন স্বয়ম্বর সভায় নারীর বরমাল্যের যোগ্য হওয়ার সাধনা করতে হতো। একালে মেয়েরা সহজলভ্যা। তাদের জন্য হরধনু ভাঙতে হয় না, প্রতিবিম্ব দেখে মৎস্যচক্র বিদ্ধ করতে হয় না। তাদের লাভ করতে বাধা মাইনের একটা চাকরি হলেই যথেষ্ট। একালে রাজপুত্র, কোটালপুত্রদের কুঁচবরণ কন্যার খোঁজে ঘর ছেড়ে বিদেশে বেরোতে হয় না। দুধসাগরের জলের নীচে যে রূপার কৌটায় কালো ভোমরার মধ্যে আছে রাক্ষসের প্রাণ তার সন্ধান করতে হয় না। সোনার কাঠি ছুঁইয়ে পাতালপুরীর রাজকন্যার ঘুম ভাঙাতে হয় না। সরকারী দপ্তরখানার অফিসারের তকমা এঁটে তারা বীরদর্পে প্রজাপতি ঋষিকে দুয়ারে হাঁক দিয়ে বলেন –লে আও নিপুণিকা, চতুরিকা মালবিকার দল। তোমার রেণুকা সেন, মাধুরী রায়, ডলি দত্ত বা অরুন্ধতী চ্যাটার্জীদের। একালের কেশবতী রাজকন্যারা নব্বই ভরি সোনা আর তিনপ্রস্থ ফার্নিচারের খেয়া নৌকা চেপে আপনি এসে উত্তীর্ণ হন বাসরঘরের ঘাটে। পণের টাকায় কারেন্সী নোটের মালা বরের গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেন, যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম।

আমার কর্ণপটহ-বিদীর্ণকারিণী সঙ্গীত-অভিলাষিণীকে চোখে দেখিনি। শুনেছি একেবারে রূপহীনা নন। লেখাপড়ায়ও ভালো। তা হোক। কিন্তু গান তাকে শিখতেই হবে। আমরা হতভাগ্য প্রতিবেশী—আমাদের ললাটে দুঃখ আছে; খণ্ডাবে কে?

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে আর একবার নিদ্রার উদ্যোগ করলেম। বৃথা এবার গান নয়, কার্ড। দর্শনপ্রার্থী এক ভদ্রলোক। কার্ডের উপরে ছাপা-পি. সি. সমাদ্দার, বি. এ. ডেপুটি এ্যাসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার। ভদ্রলোক আজ সকালে আসবেন কথা ছিল বটে। কিন্তু সকালে মানে যে সাড়ে ছটা তা ভাবতে পারিনি।

এই যে, নমস্কার। ঘুমুচ্ছিলেন না কি? বড় অন্যায় হয়ে গেছে তা হলে। আমি? আমি মশাই ঠিক পাঁচটায় উঠে খানিকটা হেঁটে আসি। বারখাম্বা ধরে’ ফিরোজ শা রোড, উইন্ডসর প্লেস, কুইনসওয়ে হয়ে বাড়ি মাইল দুই হবে। আছি ভালো মশাই! ডিসপেপসিয়াটা অনেকটা চাপা আছে। চা? আচ্ছা দিন এক কাপ, একবার অবশ্য হয়ে গেছে। আপনার বুঝি এখনও হয়নি। সাতটার আগে বিছানা ছাড়েন না? খাসা আছেন মশাই। দশটা-ছ’টা আপিস করতে হয় না, কারো তোয়াক্কা নেই। হাই সার্কেলে মুভ করেন। হ্যাঁ, ভালো কথা, জিজ্ঞাসা করেছিলেন নাকি নেহরুকে ঐ ডিয়ারনেস এলাউন্সের কথাটা।

নেহরু মানে, বি. কে. নেহেরু। ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারী। পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর সঙ্গে আত্মীয়তা আছে। ভদ্রলোক নিজে আই.সি.এস. এবং স্ত্রী বিদেশিনী, কিন্তু ভারতবর্ষের প্রতি দু’জনারই সত্যিকার টান আছে।

ত্রুটি স্বীকার করতে হলো। স্মরণ ছিল না। কিন্তু তিনি নিরাশ হয়ে হাল ছাড়বার পাত্র নন। বললেন, আজ একটু মনে রাখবেন। শুনেছি তো সাড়ে সতেরো পারসেন্ট করার কথা হয়েছে। কিন্তু কত মাইনে অবধি এলাউন্সটা দেবে সেইটেই আসল কথা। পাঁচ শ’ টাকার উপরে মাইনে হলে দেবে না বলে কেউ কেউ বলছে। দেখুন তো একবার অন্যায়টা। কেন, আমাদের অপরাধটা কী? জিনিসপত্রের দাম তো আর শুধু পাঁচ শ’র নীচেওয়ালাদের জন্যে বাড়েনি। দুধের দাম টাকায় ছ’ সেরের জায়গায় এক সের নিতে হচ্ছে তাকেও আমাকেও। বলুন সত্যি কি না? তবে কেন ডিয়ারনেস এলাউন্সের বেলায় আমরা বাদ পড়ব? এসব ইনজাস্টিসের জন্যই তো মশাই গভর্ণমেন্টের কাজে ঘেন্না ধরে যায়। গান্ধী মহারাজ কি আর অমনি শয়তানী গভর্নমেন্ট বলেন?

গান্ধী ভক্তকে সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে হলো যে, গান্ধীজী পাঁচ শ’ টাকার বেশী কারোর মাইনেই রাখতে রাজী নন।

না, না, সেটা ঠিক নয় মশাই। তিনি মহাত্মা, তাঁর কথা আলাদা। ঋষিতুল্য লোক। একটু ছাগলের দুধ পেলেই হলো। আর পাঁচজনের তো তা নয়। এই ধরুন না আমারই কথা। আপনি তো ঘরের লোকের মতো, আপনাকে বলতে আর কী? আট শ’ টাকা পাই। ইনকাম ট্যাক্স, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড কেটে নিয়ে হাতে আসে সাত শ’ তেরো টাকা পাঁচ আনা। ফি মাসেই শেষের দিকে টানাটানি হয়। কোনটা না করলে হয়? গাড়ি আছে, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, ছেলেকে বিলেতে পাঠাতে হবে। পাঁচ শ’ টাকার সীমা কিছু কাজের কথা নয়। স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং বাড়াতে হবে, তা না হলে ভারতবর্ষের উন্নতি নেই। দেখুন না বিলেতে, এমেরিকায়। হ্যাঁ, সাহেবগুলিকে তাড়িয়ে দিন না। ওরা করে কী? শুধু দস্তখত। যা কিছু তো আমরাই লিখে পড়ে দিই। কিন্তু পাঁচশ’র উপরে যদি মাইনে না থাকে, তবে চাপরাশীর মাইনে যে মাসে আট আনায় দাঁড়াবে! দাঁড়াবে না? বরং এখনকার চাইতে আরও বাড়বে? অবাক করলেন মশাই? কি জানি; আপনাদের কংগ্রেসীদের কী বিচার-বুদ্ধি আপনারাই জানেন।

কংগ্রেসীদের বিচার-বুদ্ধি ব্যাখ্যা করার মতো ধৈর্য বা সময় কোনোটাই ছিল না। প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য ক্রীপস্ আলোচনার কথা তুললেম। দেখা গেল তাতেও আগ্রহের একেবারে অভাব নেই। জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু হবে মনে হচ্ছে কি? হলে বাঁচা যায় মশাই। ইংরেজ ব্যাটাদের আচ্ছা শিক্ষা হয়। ছিল বটে আগের দিনে সব দিলদরিয়া সাহেব। যথার্থ মা-বাপের মতো। আমি তখন সবে সেক্রেটারিয়েটে ঢুকেছি। আমাদের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন মহাতপ বাবু। মহাতপ ঘোষ, খড়দায় বাড়ি। বুড়ো হয়েছেন, বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সার্ভিস বুকে লেখা আটচল্লিশ। পেন্সনের আরও সাত বছর বাকী। চোখে একেবারেই দেখতে পান না, লিখতে হাত কাঁপে। একদিন ফাইলে টাইপকরা লেখার উপরেই দস্তখত করে বসে আছেন। আমরা ভয়ে সারা। আজ আর রক্ষে নেই। মারে,—সার অ্যালেকজান্ডার মারে—সাহেব ছিলেন আমাদের সেক্রেটারী। ডেকে নিয়ে বললেন, মহাটপ, ছেলে ম্যাট্রিক পাশ করেছে? না করে থাকে তো ক্ষতি নেই। কাল নিয়ে এসো ভর্তি করে দেবো। তুমি এবার রিটায়র কর। অনেক খেটেছ এখন ডিসার্ভ ওয়েলআর্নড রেস্ট। আর এখন মশাই আমার মেজ শ্যালক কলকাতা ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট। দু’বছরের চেষ্টায় ঢোকাতে পারছি নে।

শুধু মেজ শ্যালকের চাকরি প্রাপ্তিতে ব্যর্থ নয়। নিজের প্রমোশন সম্পর্কেও অভিযোগ ছিল। স্বরাজ না হলে আর চাকরি করে সুখ নেই মশাই। ইংরেজ ব্যাটাদের কাছে এখন মুসলমানেরা হচ্ছে বড় পিয়ারের। তাদেরই পোয়া বারো। কাজ জানুক আর নাই জানুক, মাথায় ফেজ থাকলেই হলো। পেটে বোমা মারলে এক কথা শুদ্ধ ইংরেজি বেরোয় না এমন সব লোক অফিসার হয়ে এসে বসেছে। খান বলে’ আমাদের এক নতুন কন্ট্রোলার এসেছে। আকাট মূর্খ। সেদিন এক ফাইলে রেফারেন্স লিখতে দুটো r দিয়ে বসে আছে। গত মাসে দু’বছরের জুনিয়র একজন মুসলমান আমাদের চার জনকে ডিঙিয়ে ডেপুটি চীফ হয়ে গেল। এসব অবিচার কি আর চিরকাল সইবে? ইংরেজদের দিন ঘনিয়ে এসেছে। তবে হ্যাঁ, এও বলি, হবে নাই বা কেন? মুসলমানদের ফেলো-ফিলিং আছে। চাকরি নিয়ে, প্রমোশন নিয়ে তাদের লীডারেরা সব সময় লড়ছে। পান থেকে চুন খসেছে কি, অমনি এসেম্বলীতে পাঁচজন মুসলমান মেম্বার পাঁচটা প্রশ্ন করবে, উইল দি অনারেবল মেম্বার বি প্লিজড টু স্টেট। একটা মুসলমান চাপরাশীকে কিছু বলেছেন তো মিনিস্টারেরা কৈফিয়ত তলব করবে। আর আমাদের হিন্দুরা? সব কংগ্রেসী। তারা কেবল উচ্চাঙ্গের কথা বলে বলেই গেলেন। স্বরাজ, স্বাধীনতা; কমপ্লিট ইন্ডিপেন্ডেন্স। আরে চাকরি-বাকরিগুলি সবই যদি অন্যের হাতে গেল তবে স্বরাজ নিয়ে কি ধুয়ে খাবো? আমি পষ্ট কথা বলবো মশাই, আমাদের কংগ্রেসের কর্তারা প্রাকটিক্যাল পলিটিক্স একেবারেই বোঝেন না তাই জীবন কাটাচ্ছেন শুধু জেলখানায়।

ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে লাভ নেই, তর্ক করা নিরর্থক। মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের অতি পরিচিত আবহাওয়ায় মানুষ। চাকরিকে জানেন জীবনের অনিবার্য অবলম্বন, গভর্নমেন্ট পোস্টকে আকাঙ্ক্ষিত সৌভাগ্য। তাঁর ধ্যান, ধারণা, চিন্তা ও স্বপ্ন সমস্তই এই চাকরিকে কেন্দ্র করে। ক্যারেক্টার রোল নিয়ে তার আরম্ভ, পেন্সন নিয়ে তার শেষ! এবং এই আদি অন্তের মাঝখানে প্রমোশন দিয়ে তার বিস্তার।

আপিসের বেলা হচ্ছিল। সমাদ্দারবাবু গাত্রোত্থান করলেন। আচ্ছা এখন তাহলে উঠি। আপিস আছে। আজ আবার এ মাসের এরিয়ার স্টেটমেন্টটা পাঠাতে হবে। বিকেলের দিকে আর একদিন আসব। বিকেলে বাড়ি থাকেন না? তাহলে সকালেই আসব। আচ্ছা, চলি এখন। ঐ ডিয়ারনেস এলাউয়েন্সের কথাটা কিন্তু আজ একবার কাইন্ডলি।

বিকালের দিকে চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল। নয়াদিল্লীর প্রেস ক্লাব টি পার্টি দিচ্ছেন সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপকে। ক্রীপ চা, লাঞ্চ ও ডিনারের বহু নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু একমাত্র প্রেস ক্লাব ছাড়া আর কোনো আমন্ত্রণই তিনি গ্রহণ করেননি। বললেন, তাঁর প্রতি ভারতীয় সাংবাদিকদের সহৃদয় ব্যবহারে তিনি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এবং সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যেই এই চা চক্রে তিনি যোগ দিতে স্বীকৃত হয়েছেন।

সেক্রেটারিয়েটের সাউথ ব্লকের প্রাঙ্গণে চা পার্টির আয়োজন। স্বদেশী ও বিদেশীয় সাংবাদিকদের নিয়ে নিমন্ত্রিত প্রায় শ’দেড়েক। কয়েকজন মহিলাও আছেন। অবশ্য তাঁরা সবাই বিদেশিনী।

প্রেস ক্লাবের সভাপতি বাঙালী। ঊষানাথ সেন। ভারতে সাংবাদিকদের গুরুস্থানীয় ও এসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় কে.সি. রায়ের সহকর্মী ছিলেন। বর্তমানে এসোসিয়েটেড প্রেসের অন্যতম কর্ণধার, দিল্লী আপিসের কর্ম-সচিব। বয়স ষাটের উপরে, শরীর সুগঠিত। বিরলকেশ তীক্ষ্ণনাসা, উজ্জ্বল দৃষ্টি। কথাবার্তা, চালচলন ও বেশভূষায় প্রখর ব্যক্তিত্বের চিহ্ন আছে। ভদ্রলোক অবিবাহিত। নয়াদিল্লীতে কোনো দিন চিরকুমার সভা বসলে তিনিই হবেন সর্বজনসম্মত পার্মানেন্ট প্রেসিডেন্ট।

টি-পার্টির পরে সাংবাদিক সম্মেলন। নয়াদিল্লীর সরকারী ও বেসরকারী ইতিহাসে এইটিই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ প্রেস কনফারেন্স। সাউথ ব্লকের কমিটি রুমে তিল ধারণের স্থান ছিল না। এই কনফারেন্সে ক্রীপস তাঁর পরিকল্পনা সর্বপ্রথম সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করলেন। প্রায় দেড় ঘন্টা ব্যাপী বিভিন্ন সাংবাদিকের শতাধিক প্রশ্নের উত্তর তিনি দিলেন। তাঁর বাচনভঙ্গী, তাঁর ক্ষিপ্রতা, তাঁর অক্লান্ত উদ্যম উপস্থিত সমুদয় সাংবাদিকদের প্রশংসা অর্জন করল। তার রসবোধও আছে। মাঝখানে একবার হঠাৎ বললেন, সবুর। তারপর গায়ের কোটটা খুলে রেখে আস্তিন গুটিয়ে বললেন, এবার আসুন! বিপুল হাস্যরোলে ধ্বনিত হয়ে উঠল কনফারেন্স।

সার স্ট্যাফোর্ড বিলাতের খ্যাতনামা ব্যবহারজীবীদের অন্যতম। আইনব্যবসায়ী মহলে তাঁর বার্ষিক উপার্জনের পরিমাণ বহু লোকেরই ঈর্ষাজড়িত বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। এই সাংবাদিক বৈঠকে যুক্তিতর্কে ব্যারিস্টার ক্রীপসের অসামান্য দক্ষতা নতুন করে প্রমাণিত হলো।

কিন্তু মানুষ মাত্রেরই ধৈর্যের সীমা আছে। সেকথাটা অত্যন্ত অপরিহার্যভাবেই ক্রীপসও সাংবাদিকদের স্মরণ করিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। জনৈক সাংবাদিকের এক অভদ্র প্রশ্নে অবশেষে কঠিন স্বরে বললেন,—ভদ্রমহোদয়গণ, আমার ধৈর্য অসাধারণ, কিন্তু তারও শেষ আছে। ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা সম্পর্কে কোন অভদ্র ইঙ্গিত আমি বরদাস্ত করতে রাজী নই।

ভারতীয় সাংবাদিকদের, বিশেষ করে রিপোর্টারদের বুদ্ধি আছে, শক্তি আছে, কৃতিত্বও কম নয়। কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রবোধ নেই। তাঁরা যে রাজনীতিক নন একথাটা তাঁরা কদাচিৎ স্মরণে রাখেন। প্রেস না হলে পলিটিক্স চলে না, কিন্তু পলিটিক্স না হলেও প্রেস চলে। যথা—হরিজন এদেশের সাংবাদিকেরা শুধু প্রথম শ্রেণীর রিপোর্টার হয়েই খুশি থাকতে চান না, প্রথম শ্রেণীর পলিটিসিয়ানও হতে চান। তাই অনেক সময়েই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। তাঁদের অপরাধ নেই। স্পেশিয়েলাইজেশনে এদেশে বিশ্বাস নেই। এখানে যে ডাক্তার জ্বরের চিকিৎসা করেন, তিনি ফোঁড়াও কাটেন এবং দরকার হলে দাঁতও তোলেন।

ক্রীপস্ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য কিনা সে সম্পর্কে সাংবাদিকদের মধ্যে মতদ্বৈত দেখা গেল। প্রস্তাবটির সমস্ত গুরুত্বই ভবিষ্যতে। জনশ্রুতি এই যে, গান্ধীজি ক্রীপসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিন এই প্রস্তাবটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন a post-dated cheque. অতি উৎসাহী কোনো কোনো সাংবাদিক তাঁর সঙ্গে নিজেদের ভাষা যোগ করলেন, on a crashing bank. মুখে মুখে এই প্রক্ষিপ্ত অংশটিও গান্ধীজির মূল উক্তি বলেই চলতে লাগল। ইচ্ছাকৃত কিংবা অনবধানতায় সত্যবিকৃতির এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে।

সেদিন সন্ধ্যায় দুই বন্ধু নিয়ে গেলেন এক ক্লাবে।

নয়াদিল্লীর সবচেয়ে নামকরা ক্লাব আই.ডি.জি.। ইম্পিরিয়েল দিল্লী জিমখানা। ক্লাব বর্ণাশ্রমে দ্বিজোত্তম। প্রবেশাধিকার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। শুধু ব্যয়বাহুল্যের দ্বারা নয়, লিখিত অনুশাসনের দ্বারা। এ্যাডমিশন ফি ও মাসিক চাঁদা দুই-ই গুরুভার। তাছাড়া আই.সি. এস. আই. পি., অডিট একাউন্টস ইত্যাদি প্রথম শ্রেণীর চাকরে ছাড়া সরকারী লোক আর কারও পক্ষেই আই.ডি.জি-র সদস্য হওয়ার উপায় নেই। বে-সরকারী ডাক্তার, জার্নেলিস্ট, ব্যারিস্টরদের পক্ষে ঠিক এরকম বাধা না থাকলেও নতুন সদস্য গ্রহণের সময় ক্লাব কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন যাতে একমাত্র তাঁরাই মেম্বার হন আর্থিক সঙ্গতি এবং সামাজিক মর্যাদা যাঁদের শীর্ষস্থানীয়, ইংরেজিতে যাকে বলে এ-ওয়ান। ক্লাবের কৌলিন্য যাতে কলুষিত না হয় সেজন্য সজাগ দৃষ্টি আছে কর্তৃপক্ষের।

ক্লাবের টেনিস লন আছে, সুইমিং পুল আছে, ব্যান্ড আছে। মায় নিজস্ব ধোবা পর্যন্ত। নয়াদিল্লীতে এইটি একমাত্র ক্লাব যেখানে শুধু পান, ভোজন ও অবসর বিনোদনের নয়, স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থাও আছে। আই. ডি. জি. কেবলমাত্র খেলা বা আড্ডা দেওয়ার জায়গা নয়, পুরোপুরি ক্লাবই বটে।

দু’ নম্বর ক্লাব,—চেমসফোর্ড। সেক্রেটারিয়েটের কাছাকাছি ও কুইন ভিক্টোরিয়া রোডের সঙ্গমস্থলে এই ক্লাবটি সব চেয়ে সরগরম। প্রথমত, এর দক্ষিণা তেমন সাঙ্ঘাতিক নয়, দ্বিতীয়ত, এর অবস্থিতি অনেকটা সুবিধাজনক এবং তৃতীয়ত, এখানে অভারতীয় অল্প। সদস্য গ্রহণেও অতটা কড়াকড়ি নেই। চেমসফোর্ডের সুইমিং পুলে ফি বছর এখানকার সন্তরণ প্রতিযোগিতা হয়। প্রতি মঙ্গলবার রাত্রিতে হয় নাচ। শীতের দিনে ঘরের ভিতরে, গ্রীষ্মকালে বাইরে। বাইরে অবশ্য কাঠের ফ্লোর নয়, শান বাঁধানো। বাগবাজারের রসগোল্লার মতো চেমসফোর্ড ক্লাবের পকৌড়া-অর্থাৎ ফুলুরিরও নাম আছে।

মহিলাদের এখানে পৃথক চাঁদা দিতে হয় না। স্বামীর গরবে গরবিনীরা স্বচ্ছন্দে এসে বসেন পুরুষ বন্ধুদের তাসের টেবিলে। সুদক্ষ পার্টনার পেলে কেবলই ডামি হন। না পেলে তিন রঙের তিনখানা অনার্স কার্ড সম্বল করে মিহি সুরে ডাকেন, টু নো-ট্রাম্পস। দেনার সুদের মতো হারের হার বাড়ে হু হু করে। খেলার শেষে খাতায় সই করে আসেন নিঃশঙ্কে। মাসের শেষে স্বামী বেচারা কম্পিত হৃদয়ে মুখ বুজে চেক লিখে দেন আর বোধ করি মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করেন।

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বেশীর ভাগ ভারতীয় অফিসারই চেমসফোর্ডের সদস্য। পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মারাঠা, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গ-কোনো দেশীয়ই বাদ নেই। কিন্তু উপস্থিতির দিক দিয়ে পাঞ্জাবীরাই প্রধান। বিশেষ করে শিখ। তাঁরা বিকালে এসে তিন সেট টেনিস খেলেন, সন্ধ্যায় পাঁচ রাবার ব্রিজ। তিন পেগ হুইস্কি ও চার কোর্সের ডিনার খেয়ে তাঁরা যখন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন, তার আগেই ইংরেজি ক্যালেন্ডারে তারিখের পরিবর্তন ঘটে। তাদের গৃহিণীরাও পিছনে পড়ে থাকবার পাত্রী নন। ক্লাবে পাঞ্জাবী দম্পতিদের দেখলে সহধর্মিণী কথাটার মানে বুঝতে কষ্ট হয় না।

বন্ধুদের ক্লাবটি শহরের অপর প্রান্তে। এর চাঁদা সামান্য, সভ্য সংখ্যাও বেশী নয়। বাঙালী আছে, মাদ্রাজী আছে, আসামী আছে এবং আছে আরও অন্যান্য প্রদেশের লোক। এটিও ছেলে এবং মেয়েদের সম্মিলিত ক্লাব। মেয়েদের মধ্যে অনেকে খ্রীষ্টিয় সমাজের।

ক্লাবের রেজিস্টারে যাই থাক, ঘরে মেয়েদের সংখ্যাই বেশী। প্রায় পনেরো আনাই কুমারী। গায়ের রং কালো, নখের রং লাল এবং গালের রং ছাই-ছাই। বলা বাহুল্য শেষের দুটো ভগবান প্রদত্ত নয়। তার পেছনে বিলাতী প্রসাধন কোম্পানীর অনেকখানি হাত আছে। বিচিত্র বসন, বিচিত্রতর ভূষণ। একটি মহিলা পরেছেন গোলাপী রঙের একটি সায়ার উপরে একখানা মশারীর নেট, তাতে সাটিনের পাড় বসানো। আর একজনের লেস বসানো ব্লাউজের সূতার ব্যবহারে এত কঠোর মিতব্যয়িতা যে, তার দিকে চোখ তুলে তাকালে কান আপনিই লাল হয়ে ওঠে।

বয়স বেশীর ভাগই ত্রিশের ঊর্ধ্বে। দেহে কারো বা ইউক্লিডের সরল রেখা, কেউ বা অঙ্ক শাস্ত্রের ইলিপস। আমাদের মেয়েদের ভূগোলে নাতিশীতোষ্ণর স্থান নেই, হয় উত্তর মেরু, নয়তো দক্ষিণ। কেউ করেন মাস্টারী, কেউ নার্স, কেউ বা স্টেনোগ্রাফার।

ক্লাবে ব্যাডমিন্টন আছে, ক্যারম আছে, পিং পং আছে। কিন্তু খেলার চাইতে ঢং এবং কথার চাইতে ন্যাকামির পরিমাণ বেশী। একটি পঁয়ত্রিশ বছরের বিপুলা মহিলা কোনো এক সাহায্য অভিনয়ের টিকিট বিক্রয়ের চেষ্টা করছিলেন। তাঁর কথা বলার ভঙ্গী ও আচরণ দেখে বারংবার ইচ্ছা হচ্ছিল, আলাপ করে বলি, ভদ্রে আপনার নিশ্চয়ই ধারণা যে, আপনার ষোলো বছর এখনও পার হয়নি। কিন্তু সেটা যে কুড়ি বছর আগেই কেটে গেছে সে কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার।

জানি, এদের উপরে রাগ করে লাভ নেই। ভগবান এদের রূপ দেননি, ভাগ্য দেয়নি বিত্ত। এদের পিতৃকুল আভিজাত্যের খ্যাতিতে গৌরবান্বিত নয়। বয়স ঊর্ধ্বগামী, যৌবন অপগত প্রায়। এদিকে ঠিকুজি মিলিয়ে অভিভাবকদের পাত্র স্থির করার দিন প্রায় কেটে গেছে। স্কুলে ছাত্রীকে জিরান্ডিয়েল ইনফিনিটিভ মুখস্থ করিয়ে দেহে ও মনে নেমেছে ক্লান্তি, রাত জেগে অনাত্মীয় অপরিচিত রোগীকে থার্মোমিটার আর আইসব্যাগ দেওয়ার কাজে ধরেছে বিরক্তি, আপিসে ‘উইথ রেফারেন্স টু ইওর লেটার নম্বর’ টাইপ করে করে জীবনে এসেছে বিতৃষ্ণা।

প্রিয় ও পরিজন নিয়ে নীড় রচনার মোহ আছে নারীর রক্তে। একখানি ছোট গৃহ একজন প্রেমাসক্ত স্বামী ও একটি দুটি সুস্থ সবল শিশু—এই কল্পনা সে যুগযুগান্ত ধরে পেয়ে আসছে মায়ের কাছ থেকে, মাতামহির কাছ থেকে, জগতের আদি মানবী আদমপত্নী ইভের কাছ থেকে। সে কল্পনা সত্য হতে পারল না, সে কামনা সার্থক হলো না। অতৃপ্ত বাসনার সহস্র নাগিনী জাগায়ে জর্জর বক্ষে সে বৃথাই প্রতীক্ষা করেছে এই দীর্ঘকাল। তার দেহে একদিন রূপ না থাকলেও স্বাস্থ্য ছিল। কিন্তু আজ তার শ্রী গিয়েছে ঘুচে, স্বাভাবিক কমনীয়তা হয়ছে দূর এবং নারীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভূষণ যে লজ্জা তা’ হয়েছে লুপ্ত। অবশেষে বঞ্চিত হৃদয়ের অপরিসীম বেদনাকে ঢাকতে সে প্রাণপণে প্রয়াস করছে নানাভাবে। কেউ করছে মহিলা সমিতি, কেউ করছে রেডিওতে বক্তৃতা, আর কেউ বা রুজ, পাউডার ও লিপস্টিক মেখে পুরুষের সঙ্গে করছে নির্জলা ফ্লার্ট।

ক্লাবের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে কলেজের ছাত্র আছে, সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারী আছে, বীমার দালাল আছে, ডাক্তার আছে। প্রায় সবাই তরুণ। বিবাহিত সদস্যেরা বেশীর ভাগ খ্রীস্টান এবং কুমার সভ্যেরা বেশীর ভাগ হিন্দু। কারণ সুস্পষ্ট।

পশ্চিমের শিক্ষা, সভ্যতা ও ভাবধারা আমাদের দেশে এনেছে নতুন আবেষ্টন। তার ফলে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের কর্মে এবং চিন্তায়। আমাদের আহার, বিহার, বসন, ভূষণ বদল হয়েছে। বদল হয়েছে রীতি, নীতি ও ধ্যান-ধারণা। এতকাল নারীকে আমরা শুধু পুরুষের আত্মীয় রূপেই দেখেছি। সে আমাদের ঠাকুমা, দিদিমা, মাসি, পিসি, দিদি বৌদি কিম্বা শ্যালিকা। কিন্তু জননী, জায়া এবং অনুজা ছাড়াও নারীর যে আরও একটি অভিনব পরিচয় আছে, সে সম্পর্কে আমরা বর্তমানে সচেতন হয়েছি। তার নাম।

প্রাণী জগতের মতো মনোজগতেরও বিবর্তন আছে। তার ফলে বিভিন্ন বস্তু ব্যক্তি বা নীতির মূল্য সম্পর্কে আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। নারীর মূল্যেরও যুগে যুগে তারতম্য ঘটেছে।

একদা সমাজে মায়ের স্থান ছিল সর্বপ্রধান। সেদিন পরিবার পরিচালনা থেকে বংশ-পরিচয় এবং উত্তরাধিকার নির্ণীত হতো মাতার নির্দেশে, সংজ্ঞা এবং সম্পর্ক দিয়ে। ক্রমে এই ম্যাট্রিয়ার্কল ফেমিলী বিলুপ্ত হলো। রাজমাতার চাইতে রাজরাণীর মর্যাদা হলো অধিক। সাধারণ পরিবারেরও পরিধি পরিমিত হলো। সংসারে কর্ত্রী হলেন জননী নয় গৃহিণী। ছেলেরা মায়ের কোল ছেড়ে বউ-এর আঁচলে আত্মসমর্পণ করল।

বলা বাহুল্য, এই হস্তান্তরের ফলে মায়েরা খুশি হলেন না। কেউ কেউ অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ফল হলো না। হার হলো তাঁদেরই। শুধু বউকাটকী শাশুড়ী আখ্যা পেয়ে নাটক, নভেলে তাঁরা নিন্দিত হলেন। যাঁরা বুদ্ধিমতী, তাঁরা কালের লিখন পাঠ করলেন দেয়ালে, মেনে নিলেন অবধারিত বিধি। নিঃশব্দে, কিন্তু স্বচ্ছন্দ চিত্তে নয়। জগতের সমস্ত বিক্ষুব্ধ মাতৃকুলের অনুক্ত অভিযোগ আজও জেগে আছে বধূশাসিত আধুনিক গৃহের বিরুদ্ধে। ইউরোপ ও আমেরিকার সমাজে পত্নীকর্তৃত্ব পুরোপুরি স্বীকৃত। বিবাহের পর ছেলের সংসারে তার মায়ের স্থান নেই, কিংবা থাকলেও সে স্থান উল্লেখযোগ্য নয়। সংস্কৃত ব্যাকরণের লুপ্ত অকার চিহ্নের মতো তাঁর অস্তিত্ব আছে, গুরুত্ব নেই।

কিন্তু স্ত্রী বলতে যেদিন ভাবী সন্তানের গর্ভধারিণী বা গৃহকর্ত্রী মাত্র বুঝতেম, সেদিনও বিগত। স্ত্রীর মধ্যে চাই সচিব সখীমিথ প্রিয় শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ। কিন্তু একজনের কাছে এতখানি প্রত্যাশা করা শুধু কালিদাসের কাব্যেই শোভা পায়, বাস্তবক্ষেত্রে নয়।

এ যুগের পুরুষের কাছে ঘরের চাইতে বাইরের ডাক বেশী। সে দশটা পাঁচটায় আপিসে যায়, কারখানায় খাটে শেয়ার মার্কেটে ঘোরে। সেখান থেকে টেনিস, রেস কিংবা মিটিং। রাত্রিতে ক্লাব অথবা সিনেমা। এর মধ্যে গৃহের স্থান নেই, গৃহিণীরও আবশ্যকতা নেই। আগে সস্ত্রীক ধর্মাচরণ করতে হতো। যাগ-যজ্ঞ, ব্রত-পার্বণে প্রয়োজন ছিল ভার্যার। কিন্তু ধর্ম এখন শুধু ইলেকশনে ভোটসংগ্রহ ছাড়া ভারতবর্ষেও বড় একটা কাজে লাগে না। তাই এ-যুগে সহধর্মিণীর চাইতে সহকর্মিণীকে নিয়ে বেশী রোমান্স লেখা হয়।

পুরুষের জীবনে গৃহ ও গৃহিণীর প্রয়োজন সামান্যই। তার খাওয়ার জন্য আছে রেস্তোঁরা, শোয়ার জন্য হোটেল, রোগে পরিচর্যার জন্য হাসপাতাল ও নার্স। সন্তান সন্ততিদের লালন পালন ও শিক্ষার জন্য স্ত্রীর যে অপরিহার্যতা ছিল, বোর্ডিং-স্কুল ও চিলড্রেনস হোমের উদ্ভব হয়ে তারও সমাধা হয়েছে। তাই স্ত্রীর প্রভাব ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে ঠেকেছে এসে সাহচর্যে। সে পত্নীর চাইতে বেশীটা বান্ধবী। সে কর্ত্রীও নয়, ধাত্রীও নয়, —সে সহচরী।

নারীর পক্ষেও স্বামীর সম্পর্ক এখন পূর্বের ন্যায় ব্যাপক নয়। একদিন স্বামীর প্রয়োজন মুখ্যত ছিল ভরণ পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের। কিন্তু এ-যুগের স্ত্রীরা একান্তভাবে স্বামী-উপজীবিনী নয়। দরকার হলে তারা আপিসে খেটে টাকা আনতে পারে।

তাই স্বামীর গুরুত্ব এখন প্রধানত কর্তারূপে নয়, বন্ধুরূপে।

ভারতবর্ষও এই নব ভাবধরার বন্যাকে এড়িয়ে থাকতে পারেনি। ঢেউ এসে লেগেছে তার সমাজের উপকূলে। আমাদেরও পরিবার ক্রমশ ক্ষুদ্রকায় হচ্ছে, আত্মীয় পরিজনের সম্বন্ধ সঙ্কীর্ণ হচ্ছে। গ্রাম্য সভ্যতার ভিত বিধ্বস্ত, কলকারখনাকে কেন্দ্র করে নগর-নগরীর বিস্তৃতি ঘটেছে ধীরে ধীরে। তার সঙ্গে নতুন সভ্যতা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন জীবন-ধর্মের উদ্ভব অপরিহার্য।

এদেশেও পুরুষের জীবনে এবার আবির্ভূত হয়েছে সখী; নারীর জীবনে সখা। সেটা ভালো কি মন্দ তা নিয়ে তর্ক করতে পারো, মনু পরাশর উদ্ধৃত করে মাসিক পত্রে প্রবন্ধ লিখতে পারো। কিন্তু তাকে ঠেকাতে পারবে না।

স্ত্রী-পুরুষের জীবনে সখাসখীর যে উপলব্ধি, তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের সমাজকর্তারা একেবারে উদাসীন ছিলেন না। কিন্তু পতিকে পরম গুরু এবং পত্নীকে সেবিকা বানিয়ে দাম্পত্যে তাঁরা সখীত্বের অবকাশ রাখতে পারেননি। ট্রান্সফারড এপিথেটের মতো সেটা পুরুষের পক্ষে বৌদি এবং স্ত্রীর পক্ষে দেবরের উপর ন্যস্ত করেছিলেন। সংসারে এর চাইতে মধুরতর সম্পর্ক আমার জানা নেই।

সীতার সাথী ছিলেন লক্ষ্মণ, তাঁর অপর আর কোনো বন্ধুর প্রয়োজন ছিল না। বুড়ো হ’লেও ঋষি বাল্মীকি সে কথা জানতেন। পাঞ্চালীর পাঁচ পাঁচটা স্বামী থাকতেও একটি দেবরের অভাব ঘোচেনি। তাই বেদব্যাসকে আনতে হলো, শ্রীকৃষ্ণ। তিনি দ্রৌপদীর সখা, —সংকটে শরণ্য, সম্পদে স্মরণীয়।

এযুগে জীবনযাত্রার উপচার বহুবিধ এবং ব্যয়সাধ্য। যে লোক দু’শ’ টাকা পায় তার পক্ষে বউ কাছে রাখাই কঠিন, বৌদি দূরে থাক। মেয়েরাও জানেন, পণের টাকা ও সোনার হার না হলে বরই জুটবে না অনেকের, দেবর তো পরের কথা। তাই আধুনিকার ঘা খেয়ে মন দিয়ে মেনেছেন যে, বেশী আশা করে ফল নেই। একটি নির্ভরযোগ্য সহৃদয় বন্ধু পেলেই ভাগ্য। আধুনিকেরা বুদ্ধি দিয়ে বুঝেছেন যে, অনেক লোভে লাভ নেই, তার চেয়ে বরং চাই শুধু একটি বান্ধবী। প্রিয়বান্ধবী।

কিন্তু সাধারণ হিন্দু পরিবারে অনাত্মীয় স্ত্রী-পুরুষের বন্ধুত্বের পথ উন্মুক্ত নয়। সাধারণ মুসলমান পরিবারেও নয়। সেখানে বান্ধবীর স্বীকৃতি মাত্র নেই। সেখানে পুরুষের জীবনে প্রথমে যে অনাত্মীয়া নারীর সান্নিধ্য ঘটে, তিনি নিজের স্ত্রী। তাই ক্লাবে পার্টিতে বিলাতফেরত ও বড় চাকুরেদের ড্রইংরুমে তরুণের দল আসে। কাউকে ডাকে ললিতাদি, আর কাউকে বলে বীণারউদি কাউকে বা শুধু পদবীর আগে ‘মিসেস’ জুড়ে দিয়ে সম্বোধন করে মিস গুপ্ত, মিস আয়েঙ্গার বা মিসেস সোনেরা জাহীর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *