সাত
সাধ্বী স্ত্রী, পিতৃভক্ত পুত্র, ভ্রাতৃবৎসল অনুজ এবং প্রভুপ্রাণ সেবকের দৃষ্টান্ত আছে আমাদের পুরাণ ইতিহাসে একাধিক। জনকতনয়া সীতা, দশরথাত্মজ রামচন্দ্র, সুমিত্রানন্দন লক্ষ্মণ এবং রামানুচর হনুমানের কাহিনী জানে এদেশের আপামর সাধারণ। কিন্তু পত্নী-অনুগত স্বামীর উদাহরণ জানতে চাও তো সর্বাগ্রে দেখে আসা প্রয়োজন ন’মাসিমার বান্ধবী ইন্দুমতী রায়ের বর প্রিয়নাথবাবুকে। ইন্দুমতীচরণ-চারণ চক্রবর্তী শ্রী প্রিয়নাথ রায়।
প্রাকবৈবাহিক জীবনের পরিচয়লিপিতে ইন্দুমতী ছিলেন দাসগুপ্তা। গোখলেতে পড়েছেন ইংরাজী, সঙ্গীত সম্মিলনীতে শিখেছেন সেতার। ফুল শ্লিভসের ব্লাউজ গায়ে দিয়ে মাঘোৎসবের দিনে ব্রাহ্মসমাজে উপাসনায় করেছেন গান–প্রভু, তুমি আমাদের পিতা। তাঁর এক দাদা রেলের অফিসার, অন্য ভাই ব্যারিস্টর।
ইন্দুমতীর বাবার সিন্দুকে রূপা ছিল প্রচুর, কিন্তু নিজের দেহে রূপ ছিল না একটুকুও। ফলে কয়েক বছর আই.সি.এস., বিলাত ফেরত, ডেপুটি প্রভৃতির জন্য অযথা অপেক্ষার পর অবশেষে যৌবনের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে এক শুভ মাঘ মাসি শুক্লপক্ষে পঞ্চম্যাং তিথৌ কণ্ঠলগ্না হলেন প্রিয়নাথবাবুর। বিয়ের পরে কনের বদল হলো পদবী, বরের বৃদ্ধি হলো পদ। এ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে সুপারিন্টেন্ডেন্ট। পয় আছে বটে আমাদের ইন্দুমতীর।
প্রিয়নাথবাবু তাঁর স্ত্রীর নাথ তো নিশ্চয়ই, বোধ করি প্রিয়ও হবেন। হওয়াই উচিত। কিন্তু আমার পক্ষে। থাক সে কথা। আমি তো আর তাঁকে জামাই করছি নে।
মহাদেও রোডে প্রিয়নাথবাবুর বাড়িটি ‘বি’ টাইপ কোয়ার্টার। নয়া দিল্লীতে বাজারে ডিম থেকে শুরু করে বসত বাড়ি পর্যন্ত সবই গ্রেড করা। এ, বি, সি, ডি, ইত্যাদি। হীরার বিচার ঔজ্জ্বল্যে, মসলিনের বিচার সূক্ষ্মতায়। সরকারী কর্মচারীর মূল্য নিরূপিত হয় বেতনে। পি. ডব্লিউ. ডি’র খাতায় বেতন অনুযায়ী ভাগ করা আছে বাড়ি। পাঁচ শ’ থেকে ছ’ শ’ টাকা মাহিনার কর্মচারীর জন্য ‘এ’ টাইপ কোয়ার্টার, চার শ’ থেকে পাঁচ শ’ ওয়ালারা পায় ‘বি’। ছ’ শ’র উপরে মাইনে যাদের তারা পায় বাংলো। তারও শ্রেণীবিভাগ আছে। শুধু গঠন বা ব্যবস্থায় নয়, অবস্থানেও। ঠিকানা শুনেই বলে দেওয়া যায় লোকটার বেতনের পরিমাণ। হেস্টিংস রোডের বাসিন্দা পায় তিন থেকে চার হাজার, তোগলক রোডে তার নীচে। এক হাজারের বেশি না পেলে বাংলো মেলে না রাইসিনা রোডে।
নম্বর মিলিয়ে সন্ধান করলেম বাড়ির বারান্দার পাশের ঘরে আধময়লা গেঞ্জি গায়ে একটি ভৃত্য ইলেকট্রিক ইস্ত্রি দিয়ে একখানা চকোলেট রং-এর বেনারসী শাড়ির পরিচর্যায় ব্যস্ত। জিজ্ঞাসা করলেম, ‘এইটে প্রিয়নাথবাবুর বাড়ি?’
‘হ্যাঁ, মিস্টার রায়ের বাড়ি।’
গলার স্বরে বিরক্তি এবং কপালে কুঞ্চিত রেখার দ্বারা স্পষ্ট বোঝা গেল বাবু সম্বোধনটা শ্রোতার পক্ষে শ্রবণসুখকর নয়। সুতরাং ভ্রম সংশোধন করতে হলো।
‘মিস্টার রায়কে একটু খবর দিতে পার?’
‘আমিই মিস্টার রায়।’
গড সেভ দি কিং! মিসেস ইন্দুমতী রায়ের স্বামী যে সকাল আটটার সময় শাড়ি ইস্ত্রি করবেন তা’ কল্পনা করব কেমন করে? কিন্তু এখন তো আর ফিরবার উপায় নেই। ন’ মাসিমার সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্ক ব্যক্ত করতে হলো, দিতে হলো সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয়। মিস্টার রায় অন্দর থেকে যথারীতি নির্দেশ লাভ করে ড্রয়িং-রুমে নিয়ে বসালেন। ‘উনি’ চান করছেন, আসতে বিলম্ব হবে না আশ্বাস দিলেন।
ড্রয়িং-রুমটির মেঝেতে শতরঞ্জি পাতা, তার উপরে ছোট মির্জাপুরী কার্পেট। টিপাই-এর উপরে পুষ্পহীন জাপানী কাঁচের ফুলদানী। এক কোণে একখানা ভাঁজ করা কেম্বিসের ইজিচেয়ার। মাথার কাছটা উপবেশনকারীদের তৈলসিক্ত শিরের অজস্র চিহ্নের দ্বারা মলিন। দেয়ালে কাঁচ দিয়ে বাঁধানো খান দুই সূচীশিল্পের নমুনা। এই সিবন কারুকর্মের শিল্পীর পরিচয় সম্পর্কে দর্শকের মনে পাছে কিছুমাত্র সংশয় ঘটে সেজন্য বড় বড় হরফে এক কোণে লেখা আছে ‘ইন্দু’। একটাতে একটা ঝুড়ি তাতে কয়েকটি গোলাপ ফুল। আর একটাতে একটা বিচিত্র বর্ণের কুকুর। লাল, নীল, সবুজ, হলদে রং-এর যদৃচ্ছ এবং অকুণ্ঠ ব্যবহার; ‘ভিবজিওর’ বললেই হয়। কুকুরটির মাথার উপরে ইংরেজী অক্ষরে লেখা—গড ইজ গুড! বোঝা গেল গৃহস্বামিনী ধর্মশীলা কিন্তু সেটা প্রমাণের জন্য তো সারমেয়র প্রয়োজন ছিল না। বোধ করি, লেখার ভুল ডগ ইজ গুড হবে।
প্রিয়নাথবাবুর সঙ্গে খানিক আলাপ করা গেল। আলাপ অর্থে তিনি বক্তা, আমি শ্রোতা প্রায় সবটাই ‘উনি’ প্রসঙ্গ। উনি আবার বিছানায় এক পেয়ালা গরম চা না পেলে উঠতে পারেন না। উনি রোজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঠাকুরকে চাল ডাল মেপে দেন। বাজারের খাবার উনি বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে দেন না। নয়াদিল্লী বঙ্গ মহিলা সমিতির যা কিছু তা তো সব উনিই করেন। লেডী মিত্র তো উনি ছাড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
ইন্দুমতী রায়ের প্রবেশ। মিঃ রায়ের উত্থান। এটা ইংরেজী রীতি।
গৃহস্বামিনী রায় আসন পরিগ্রহণ করলেন। প্রথমে গৃহে স্থানাভাবের বিস্তৃত বর্ণনা দিলেন। তবে ছ’মাস পরেই গুরুদ্বোয়ারা রোডে বাংলো পাওয়ার আশা আছে। এ-বাড়িতে ঘরদোর ইচ্ছেমতো সাজাতে পারেননি। তবুও তো সিমলা থেকে যে আসবাবপত্র এনেছেন তার সব এখনও প্যাকিং খোলা হয়নি (সিমলা থেকে এসেছেন এই পাঁচমাস হলো)। ফি বছর দিল্লী-সিমলা করেন। গ্রীষ্মকালে দিল্লীতে এই প্রথম। এবার গভর্নমেন্ট অব ইণ্ডিয়ার শৈল-বিহার বন্ধ। নতুন কমাণ্ডার-ইন-চীফ নাকি বলেছেন, সিমলা গেলে যুদ্ধ জয়ে বিঘ্ন ঘটবে। শোন একবার যত অনাসৃষ্টির কথা! আরও বেশি গরম পড়লে কিন্তু তিনি সিমলা না গিয়ে পারবেন না, তা বাপু, তোমরা যাই বল না কেন।
বেবী—অর্থাৎ ন’ মাসিমা এখন আছে কোথায়? তার মেয়ের বিয়ে কত দূর? ছেলে পড়ে কোন ক্লাশে? তাঁর নিজের চিঠিপত্র লেখার অভ্যাস কম। অবসরও পান না। কত ঝামেলা! এই তো আজ চারটায় আছে এক পার্টি। হ্যাঁগা শাড়িটা ইস্তিরি করে রেখেছো তো? প্রিয়নাথবাবুর প্রতি।
হাতের ঘড়ির পানে তাকিয়ে বিদায় প্রার্থনা করলেম।
এখনই উঠবে? হ্যাঁ, বেলা হয়েছে বটে। আছ ক’দিন? দিল্লী থেকে যাবে কোথায়? বিলেতে কী হলো? যুদ্ধ না থামলে তো আর যেতে পারছ না। বমিং-এর সময় লণ্ডনে ছিলে বুঝি? সেখানকার অবস্থা কি রকম? বাজারে ড্রিন স্যাম্পু পাওয়া যায়? ট্যাঙ্গি লিপস্টিক? এখানে তো ছাই কিচ্ছু মিলে না! আচ্ছা, একটু চা টাও তো খেলে না। ওর আবার আপিসের বেলা হচ্ছে, আচ্ছা আর একদিন এসে খেয়ে যেও কিন্তু।
আরও একটি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করবার ফরমাশ ছিল। ঠিকানা জানা ছিল না। প্রিয়নাথবাবু, থুড়ি, মিস্টার রায়কে জিজ্ঞাসা করলেম, ‘ভি. আর. ভেঙ্কটশরণের বাড়িটা কোথায় জানেন? কোন ডিপার্টমেন্টের যেন এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী?’
প্রচণ্ড ‘বিস্ফোরণ’ বলে একটা কথা বাংলা পত্রিকায় আজকাল প্রায়ই দেখা যায়। সেটা ঠিক কি রকম জানা ছিল না। প্রিয়নাথ রায়ের অবস্থা দেখে কিছুটা অনুমান করতে পারলেম।
‘এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী। ভেঙ্কটশরণ বলেছে বুঝি? চাল, কেবল চাল। চাল দিতে দিতেই গেল মাদ্রাজীটা। জানে, আপনি নতুন লোক, ধরতে পারবেন না। এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী, হুঃ। রিটায়ার করার দু’-এক বছর আগে যে হতে পারে সে তো ভাগ্যবান। এখন যুদ্ধের বাজার। তাই সেকেও ডিভিশন ক্লার্কেরা পর্যন্ত সুপারিন্টেন্ডেন্ট হচ্ছে। নইলে মশাই, এ্যাসিস্ট্যান্ট হতেই যে চুলে পাক ধরে। আমি যেবার সুপারিটেন্ডেন্ট হলেম, উডহেড সাহেব, সার জন উডহেড, পরে বাংলাদেশের গভর্ণর অবধি উঠল,—ডেপুটি সেক্রেটারী। ডেকে বললেন, ‘রয়, তোমার মতো এমন কাজের লোক—’।
অত্যন্ত অনুতপ্ত হলেম। অনিচ্ছাক্রমে এবং নিজের অজ্ঞাতেও যে অপর লোকের মনস্তাপের কারণ হতে হয়, তারই দৃষ্টান্ত।
ভেঙ্কটশরণের গৃহ আছে, গৃহিণী নেই। থাকলে বিপদ ছিল। তিনি প্রাচীন-পন্থী হলে তাঁকে গলায় দড়ি দিতে হতো, আধুনিকা হলে প্রথমে স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে পলায়ন ও পরে বাংলা সিনেমায় নায়িকা। মাতাল বর নিয়ে ঘর করা যায়, কলহ করা যায় অন্যানুরাগী স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু উদাসীন ব্যক্তির স্ত্রী হওয়ার মতো দুর্ভাগ্য নেই জগতে। প্রেম ভালো, বিদ্বেষ দুঃখের, কিন্তু সব চেয়ে মারাত্মক ইণ্ডিফারেন্সে যে কাছেও টানে না– দূরেও ঠেলে না—শুধু ভলে থাকে।
ভক্তেরা বলেন, ধ্যান, জ্ঞান নিদিধ্যাসন সমস্তই ভগবানে উদ্দিষ্ট না হলে ঈশ্বর লাভ ঘটে না। বরদারাজলু ভেঙ্কটশরণ ভগবান প্রাপ্তির জন্য উদ্গ্রীব নন। কিন্তু ভক্তের ঐকান্তিকতা নিয়েই আরাধনা করছেন সেক্রেটারিয়েটের। আপিস, আপিস, আর আপিস। কাজ, কাজ আর কাজ।
সকালে সাড়ে ন’টায় সবে মাত্র ফরাস যখন ঘর ঝাঁট দিয়ে গেছে তখন এসে বসেন টেবিলে। অপরাহ্ণ গড়িয়ে যায় সন্ধ্যার আঁধারে, ঊর্ধ্ব ও অধস্তন কর্মচারীরা চলে যায় নিজ নিজ বাসায়, সহকর্মীরা একে একে করে প্রস্থান। একা ভেঙ্কটশরণ কাজ করে যান অনন্যমনা। বাড়ি ফেরেন কখন রাত আটটায়, কখনও বা তারও পরে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত ঐ একই ধারা। ছুটি নেই, ক্যাসুয়েল লীভ নেই। রবিবারে দুপুরে অনেক দিন চলে আসেন আপিসে। ফাইল নিয়ে লেখেন নোট, ফ্লাগ দিয়ে দাগ দেন ‘ফ্রেশ রিসিট’ অথবা ‘পি. ইউ. সি.–পেপার আণ্ডার কনসিডারেশন।’ বন্ধু বান্ধবেরা ঠাট্টা করে বলে, ভেঙ্কট, কেবল খেটেই গেলে, জীবনটা ভোগ করবে কখন?
ভেঙ্কটশরণ হাসেন আর ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়েন। বোধ হয় মনে মনে বলেন, কী আহাম্মক! হোয়াট্টে ফুল-অ! ভোগ? হুঃ, থার্ড ডিভিশন ক্লার্ক থেকে সেকেণ্ড, সেকেও থেকে এ্যাসিস্ট্যান্ট, এ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে সুপারিন্টেন্ডেন্ট, সুপারিন্টেওন্ট থেকে এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রোটারী। অনেকটা পাল্লা। ভোগের জন্য জীবন তো আছেই পড়ে। চাই প্রমোশন, চাই উন্নতি। চাকরি রে তুঁহু মম শ্যাম সমান।
ভেঙ্কটশরণের এক অনুজ ছিলেন বিলাতে। আই. সি. এস. মানসে। সেখানেই পরিচয়। ভাই-এর অধ্যবসায় লক্ষ্য করেছি তাঁরও চরিত্রে। আশা করি, একদা সিভিল লিস্টের পাতায় নাম ছাপা হবে সগৌরবে।
ভেঙ্কটশরণের স্বজাতিয়েরা নয়াদিল্লীতে সুপ্রতিষ্ঠিত। ভারত সরকারের দপ্তর গোড়াতে ছিল কলকাতায়। লালদীঘির কাছে যে বাড়িতে এখন বাংলার লাট থাকেন, সেখানে বসতি ছিল ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে লর্ড হার্ডিঞ্জের। তখন সেক্রেটারিয়েটে বাঙালী ছিল বহু। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হলো দিল্লীতে। তখন থেকে তাদের সংখ্যা হয়েছে হ্রাস, অতঃপর পাঞ্জাবী, মারাঠী, গুজরাটি নানা জাতি এসেছে ধীরে ধীরে। দখল করেছে চাকরির মসনদ। সে অভিযানে মাদ্রাজীরা সর্বাগ্রে। তারা খাটে বেশি কথা কয় কম, ফাঁকি দেয় কদাচিৎ।
নয়াদিল্লীতে মাদ্রাজীদের ক্লাব আছে, সঙ্ঘ আছে, স্কুল আছে। বোর্ডিং হাউসও আছে একাধিক। সেখানে স্কুলের ডেস্কের মতো ছোট ছোট টেবিল। তার উপরে কদলীপত্রে আহার। চার আনায় মিলে স্বাথম, কুটু, সম্বর ও আপ্পালম। একজন তামিল বা অন্ধ দেশীয়ের নিয়মিত খাদ্য। কোনোদিন ওর সঙ্গে পাওয়া যায় তৈয়রপতচত্তি অর্থাৎ নারকেলের কুঁচি সহযোগে দৈ। সেদিন তো রীতিমতো ভূরিভোজন।
শুধু অশনে নয়, বসনেও যথেষ্ট মিতাচারী দাক্ষিণাত্যের লোক। একখানা চাদর দ্বিখণ্ডিত করে হয় পরিধেয়, একটি সাধারণ ফতুয়া গাত্রাবরণ। কাঁধে একটি তোয়ালে, পায়ে একজোড়া স্যাণ্ডেল। ব্যস্। আপসি ছাড়া সর্বত্র স্বচ্ছন্দচিত্তে চলাফেরা করে এই বেশে। আর যাই হোক, পোশাক নিয়ে শোক করে না মাদ্রাজী কোনদিন।
তাদের মেয়েদেরও সজ্জা বাহুল্যবর্জিত। ভূষণ পরিমিত। অবশ্য সংখ্যায়। মূল্যে নয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত মাদ্রাজী গৃহিণীরও কানে আছে হীরার ফুল। তার দাম শুনে অনেক বাঙালী স্বামী চোখে সর্ষে ফুল দেখবেন। বেশির ভাগ মাদ্রাজী তরুণীদের রূপ নেই, কিন্তু রুচি আছে। তাদের গৃহদ্বার সকালে সন্ধ্যায় আলিম্পনের দ্বারা সুদৃশ্য, তাদের কবরীবন্ধন পুষ্পস্তবকে সজ্জিত। সঙ্গীতে দক্ষতা আছে প্রায় সবারই।
সদ্য পরিচিত একজন পদস্থ মাদ্রাজীর গৃহে আমন্ত্রণ ছিল ডিনারের। ভদ্রলোক দু’হাজার টাকা মাইনে পান। অথচ আহারের আয়োজন দেখে রসনার বদলে চক্ষু জলসিক্ত হওয়ার উপক্রম। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর পারদর্শিতা আছে বীণা বাদনে। অপূর্ব সুর সৃষ্টি করলেন তারযন্ত্রে। জঠর যদিবা রইল অভুক্ত শ্রবণ হলো মধু-তৃপ্ত। স্বচ্ছন্দ চিত্তে ক্ষমা করা গেল তাঁর ভোজন-সভার ব্যয়কুণ্ঠ আয়োজন।
মাদ্রাজীদের সঙ্গে পাঞ্জাবীদের তফাৎ এইখানে। আচার এবং আচরণে পাঞ্জাবীরা শুধু মডার্ন নয়, আল্ট্রা মডার্ন। যুবক, বৃদ্ধ সবাই মিলে করছে ঊর্ধ্বশ্বাসে বিলাতীর নকল। শুধু ছেলেরা হলে ক্ষতি ছিল না। মেয়েরাও।
রেস, ক্লাব ও কার্নিভাল অতি আধুনিকতার এই তিন তীর্থক্ষেত্রে পাঞ্জাবী মহিলারাই প্রধান পাণ্ডা! তাঁরা চার রাউন্ড শেরী সাবাড় করতে পারেন হাসতে হাসতে। রজনীর শেষ প্রহর পর্যন্ত ফক্সট্রট নাচতে পারেন অক্লান্ত চরণে। তাঁদের দেহে শোভার চাইতে সম্ভার অধিক। তাঁরা বিয়ের আদিতে তন্বী, অন্তে বিপুলা। তাঁদের বর্ণ গৌর, কিন্তু আনন লালিত্যহীন। চাকর-চাকরাণীদের শাসনকার্যে স্বহস্তে উত্তম-মধ্যম প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেন না এতটুকুও। দেহে কিংবা মনে পাঞ্জাবিনীর নাইকো কোমলতা।
ভারতবর্ষে ইউরোপীয় ভাবধারার প্রথম উন্মেষ ঘটল বাংলাদেশে। ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতাকে প্রথম বরণ করল বাঙালী। সে-যুগের বাঙালীর প্রাণশক্তি ছিল প্রচুর, প্রতিভা ছিল প্রখর। ইংরেজের সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে সে গলাধঃকরণ করল না, করল গ্রহণ। আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জারক রসে পরিপাক করে তাকে সে আত্মসাৎ করল। পশ্চিমের চিন্তাধারাকে সে ধার করল না, ধারণ করল। তাই বাঙালীর মধ্যে সম্ভব হলো মাইকেল মধুসূদন, বিবেকানন্দ ও চিত্তরঞ্জন দাশ। সাহিত্যে শিল্পে ও ললিতকলায় বাংলাদেশ সূচনা করল সমৃদ্ধিযুক্ত নবযুগের, আনল দেশাত্মবোধের অভূতপূর্ব প্রেরণা। যৌবনকে দিল অভয়মন্ত্র, নারীকে দিল আত্মচেতনা। সেদিন সর্বভারতীয় অধিনায়িকার আসনে অধিষ্ঠিতা হলেন বঙ্গজননী।
ইউরোপের সংস্পর্শে সর্বশেষে এসেছে পাঞ্জাব। বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় শত বৎসর পরে লর্ড ডালহৌসী দখল করেছিলেন পাঞ্জাব। কিন্তু ইউরোপকে পাঞ্জাব অন্তরের মধ্যে পায়নি, শুধু বাইরে থেকে করেছে অনুবর্তন। ইউরোপের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সে অনুসরণ করেনি, অনুকরণ করেছে। সে ভারতবর্ষকে দেয়নি কাব্য, দেয়নি সঙ্গীত, দেয়নি বিজ্ঞান। দিতে পারেনি দেশসেবার আদর্শ। আধুনিক ভারতবর্ষে তার দান একদল পি.ডব্লিউ.ডি.’র এঞ্জিনীয়র, সৈন্যদলের সুবেদার এবং আই.এম. এসের ডাক্তার। একমাত্র লাজপৎ রায় ছাড়া পাঞ্জাবের আর কেউ হয়নি আজ পর্যন্ত কংগ্রেসের সভাপতি।
কলকাতার লালদিঘির জল সাদা এবং গোলদিঘির আকার চতুষ্কোণ। কিন্তু এখানকার গোলমার্কেট সার্থকনামা। সেটা গোলই বটে। চারটি রাস্তার সঙ্গম স্থলে বৃত্তাকার দ্বীপের মতো এ বাজারটি। দোতলা বাড়ি। উপরে দরজীর দোকান, নীচে শাকসব্জী, মাছ, মাংস, ফল ইত্যাদি। পৃথক পৃথক কক্ষ। ইংরেজিতে লেখা আছে বিজ্ঞপ্তি-কোন্টাতে মাছ, কোনটাতে বা মাংস। প্রবেশপথগুলিতে সূক্ষ্ম তারের জাল-আটা দরজা। শ্রীং দেওয়া আছে, যাতে আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। মাছের ঘরটিতে উঁচু সিমেন্টের বেদীতে রাখা হয় মাছ, তার উপর দিয়ে গেছে জলের কলের সছিদ্র পাইপ। ছিদ্রপথে অবিরাম বিন্দু বিন্দু করে ঝরছে জল। আপনি ধুইয়ে নিচ্ছে বেদীটি। আইসচেস্টের ভিতরে থাকে মাছ। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। মাছির উপদ্রব নেই, কর্দমাক্ত জল সিঞ্চনে পঙ্কিল হওয়ার আশঙ্কা নেই ক্রেতাদের বসন। মার্কেটের দু’ধারে মনোহারী দোকান, মুদী ও ময়রা ইত্যাদি। বাঙালীর দোকান আছে কয়েকটি, তার মধ্যে একটিতে মিলে দৈ, সন্দেশ ও অন্যান্য বাঙালীর খাবার।
গোল মার্কেটের পথে আছে লেডি হার্ডিঞ্জ কলেজ, ভারতবর্ষে পুরুষের সম্পর্কশূন্য একমাত্র মহিলা মেডিকেল কলেজ। বিদ্যার্থিনীদের মধ্যে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান আছে, মাদ্রাজী আছে, মারাঠী আছে, আসামী আছে। বাঙালী নেই একটিও। পাঞ্জাবী এক অধ্যাপক বন্ধুর শ্যালিকা পড়ে ফোর্থ ইয়ারে। সুদর্শনা। বাংলার বাইরে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সুন্দরীর সাক্ষাৎ মিলে। রূপের অভাবটাই সেখানকার মেয়েদের উচ্চশিক্ষার কারণ নয়। পড়াশুনাটা নয় বিয়ের আগের স্টপ্ গ্যাপ্।
মেয়েটি মেধাবী, ক্লাশে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন পরীক্ষায়। বললেন, মেডিসিনের চাইতে সার্জারীতে আগ্রহ বেশী। পাশ করে হবেন সার্জেন। সর্বনাশ!
প্রাচীনরা হাতে ধরতেন সম্মার্জনী। ঘরের মেঝে থেকে অবাধ্য স্বামীর পৃষ্ঠ পর্যন্ত সর্বত্র তার অপক্ষপাত ব্যবহারের দ্বারা সংসার যাত্রাকে তাঁরা নিরঙ্কুশ রাখতেন। আধুনিকাদের হস্তে শোভে ভ্যানিটি ব্যাগ। তার গর্ভে নিহিত প্রসাধন সামগ্রী নিজের স্বামীর হৃদয়ে ত্রাস এবং পরের স্বামীর হৃদয়ে চাঞ্চল্যের সঞ্চার করে। অতি আধুনিকারা যদি ধরেন ফরসেপস তবে বেচারী পুরুষ জাতিকে আত্মরক্ষা সমিতি স্থাপন করতে হবে অচিরে।
রসবোধ আছে তরুণীর। কলহাস্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
লেডী হার্ডিঞ্জে বাঙালী ছাত্রী না থাকলেও অধ্যাপিকা আছেন একজন। মহিলার এক ভাই আই.সি.এস. এক ভাই এম.এস. দু’ভাই একাউন্টস সার্ভিসে উচ্চপদস্থ অফিসার। এক বোন শিল্পী। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়ার শিল্প ও বিজ্ঞান বিষয়ক মাসিক পত্রিকা জার্নেল অব সাইন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’-এর চিত্রসম্পাদিকা। অন্য ভাই বোনেরা সকলেই কৃতী। তিনি নিজে ডব্লিউ.এম.এস. অর্থাৎ আই. এম. এসেরই মহিলা সংস্করণের অন্তর্ভুক্তা। মাইনে পান অনেক, ডাক্তারী করে আয় করেন যথেষ্ট, ভদ্র ব্যবহার, অমায়িক ভাষণ, সহৃদয় আচরণ। লেডী ডাক্তারী গন্ধ নেই কোনখানে। কলেজের সংলগ্ন সরকারী কোয়ার্টার। সেখানে গৃহসজ্জায় গৃহকর্ত্রীর সুরুচির পরিচয় পরিস্ফুট।
নয়াদিল্লীতে মহিলা ডাক্তার আছেন একাধিক। যুক্তপ্রদেশের আছেন জন দুই। লেডী হার্ডিঞ্জের যিনি প্রিন্সিপাল তিনি দক্ষিণ দেশীয়। একটি আছেন পাঞ্জাবী। এর জনক ধরমবীর পাঞ্জাবে সুপরিচিত, জননী ইউরোপীয়। তাঁরা উভয়েই জননায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সুহৃদ। মহিলা বিয়ে করেছেন একটি বাঙালী। এরা দুজনেই ডাক্তার। স্বামী স্ত্রী দুজনেই রাজনীতিক বা স্কুল মাস্টার হওয়ার চাইতে ভালো। পলিটিক্যাল ইকনমির মতো দাম্পত্যেও ডিভিশন অব লেবার আছে। সেখানে স্ত্রীর অংশ কথা বলার, স্বামীর অংশ কথা শোনার। দুজনেই বক্তা হলে গার্হস্থ স্বাস্থ্য রক্ষায় নিদারুণ বিঘ্ন ঘটে।
কনট প্লেসকে বলা যায় দিল্লীর চৌরঙ্গী। সাহেবী এবং সাহেবী ধরনের দোকান পসার সেখানে। স্যুট বানাবার দর্জী, ফটো তোলার স্টুডিও, প্রভিসনসের স্টোর, চুলে ঢেউ খেলাবার বিউটিপার্লার, লাঞ্চ খাওয়ার হোটেল, সিনেমা দেখবার ছবিঘর—সবই এই কনট প্লেসে। শুধু চৌরঙ্গী নয়, ক্লাইভ স্ট্রীটও। ব্যাঙ্ক ও আপিস পাড়াও এইটেই। বার্ড কোম্পানীর পেটেন্ট স্টোন, মার্টিনের টাইলস, ডালমিয়ার সিমেন্ট কিনতে হলে আসতে হবে কনট প্লেসেরই আশেপাশে।
কনট প্লেসের নামকরণ হয়েছে রাজা পঞ্চম জর্জের পিতৃব্য পরলোকগত ডিউক অব কনটের নামে। মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিফর্মসের ফলে বর্তমানে কেন্দ্রীয় পরিষদ সৃষ্টি হলে তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে ভারতে আসেন তিনি। জালীয়ানওয়ালাবাগের নরঘাতক নিষ্ঠুরতার স্মৃতি তখনও স্পষ্ট জাগ্রত ভারতীয়দের মনে। বৃদ্ধ ডিউকের উদ্বোধন বক্তৃতায় তার প্রতি ইঙ্গিত ছিল, ছিল আন্তরিকতার সুর,—’দু’পক্ষেই ভুল ত্রুটি ঘটেছে বিস্তর। আজ তার পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই। আসুন আমরা সবাই অতীতের কথা বিস্মৃত হই, পরস্পরকে ক্ষমা করি। ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট।’
কিন্তু ফরগেটনেস তো চলে শুধু সমানে সমানে। শাসক-শাসিতের মধ্যে তার স্থিতি পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মতোই ক্ষণিকের। মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন করে স্মরণের কারণ ঘটে এক পক্ষের ক্ষমতাগর্বিত আস্ফালন ও অপর পক্ষের নিরুপায় নিষ্ফল আর্তনাদ। জালিয়ানওয়ালাবাগ ভুলতে না ভুলতে আসে হিজলী, তার স্মৃতি শূন্যে মিলাবার আগে ঘটে কাঁথি বা তমলুক।
কনট প্লেসের আকৃতি গোলাকার। বৃত্তের ভিতরের দিকে মুখ করে এক সারি দালান। তার পিছনে আছে অনুরূপ আর এক সারি। তাদের মুখ বাইরের দিকে। সেটার নাম কনট সার্কাস। রোমান পদ্ধতির বিরাটাকার থামের উপরে প্রসারিত বারান্দা। সেখানে অপরাহ্ বেলায় ভিড় জমে সুবেশ নরনারীর, সওদা করে সৌখিন ক্রেতারা, আলোকোজ্জ্বল শো-কেসে বিচিত্র দ্রব্যের দর্শন পায় কৌতূহলী জনতা।
দালানের পরেই প্রশস্ত রাজপথ। তার ঠিক মাঝখানে সাদা দাগ দিয়ে পার্কিং-এর নির্দেশ, সেখানে থাকবে অপেক্ষমান মোটরকার ও টাঙ্গা। দু’পাশ দিয়ে চলে যানবাহন। রাস্তার ওপারে বিস্তীর্ণ পার্ক। লৌহশৃঙ্খলের দ্বারা ফুটপাথ থেকে বিচ্ছিন্ন। সেখানে বিশ্রামার্থীদের জন্য আছে বেঞ্চি, ক্রীড়াচঞ্চল শিশুদের জন্য আছে তৃণাচ্ছাদিত অঙ্গন এবং পুষ্পবিলাসীদের জন্য আছে অজস্র ফুলের আয়োজন।
ঘাস জিনিসটার মূল্য যে কত তা জানা নেই বাংলাদেশে, যেখানে দু’দিন না হাঁটলে পায়ের তলায় গজায় ঘন ঘাসের বন। অপদার্থ ব্যক্তিকে ঘাস খেতে বলে গাল দেওয়ার উপায় নেই উত্তর ভারতে। ভাতের চাইতে সেটা অনেক বেশী দুর্ঘট। গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপ যেখানে একশ’ তেরো ডিগ্রিতে ওঠে এবং সারা বছরে যে দেশে মাত্র কুড়ি ইঞ্চি বৃষ্টি হয়, সে দেশে ঘাস জন্মাতে প্রয়াসের প্রয়োজন। নাদিল্লীর কনট প্লেসের প্রত্যেকটি ঘাস হাতে করে বোনা এবং হাতে ধরে বাঁচানো। তার জন্য সরকারী হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট থেকে যে পরিমাণ যত্ন, জল ও অর্থ ব্যয় করা হয়, সে হিসাবটা যে কোনো দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকদের জ্বালাময়ী প্রবন্ধ রচনার উপাদান হতে পারে।
ফুল সম্পর্কে আমরা ভারতীয়েরা, বিশেষ করে বাঙালীরা যথেষ্ট সচেতন নই। ফুল এবং চাঁদের আলো একমাত্র কলেজ ম্যাগাজিনে কিশোর বয়স্কদের প্রথম পদ্য রচনা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে বলে তো জানা নেই। আর্টিস্টিক জাতি বলে বাঙালীর মনে যে আত্মাভিমান আছে সে নিয়ে তর্ক চলে কিন্তু তথ্য মিলে না। সাধারণ স্বল্পবিত্ত ইংরেজ পরিবারেও খাওয়ার টেবিলে বা বসার ঘরে সামান্য কিছু ফুলের সন্ধান মিলে নিশ্চিত। অতি সচ্ছল বাঙালীর গৃহে পুষ্পগুচ্ছের চিহ্ন দেখা যায় কদাচিৎ। অর্থের প্রশ্ন নয় রুচির প্রশ্ন। বেশীর ভাগ বাঙালী পরিবারে ফুলের প্রয়োজন হয় জীবনে মাত্র দু’বার,—ফুলশয্যার রাত্রিতে এবং শবাধার সজ্জায়।
পুরাকালে পরিবারে গৃহদেবতার পূজার রীতি ছিল। সেজন্য প্রয়োজন ছিল গন্ধপুষ্পের। বাড়িতে থাকতো দু’-একটি ফুলের গাছ। আধুনিকতায় গৃহদেবতার স্থান নেই। পূজা যদি করতেই হয়, তবে পাথরের ঠাকুর অপেক্ষা রক্তমাংসের দেবতাদের তুষ্ট করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ফল মিলে হাতে হাতে। তাই এ-যুগে আমাদের ভজন-পূজন হয় আপিসের বড় সাহেব, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এবং রাষ্ট্রনৈতিক নেতাদের। আমাদের ঠাকুর ঘরের জায়গা দখল করেছে ড্রয়িং রুম। কিন্তু জবা, দোপাটি ও নাগকেশরের স্থান কার্নেশন, ডালিয়া বা গ্ল্যাডিওলাস এসে পূর্ণ করেনি। সখীপরিবৃতা আধুনিকা শকুন্তলাকে পুষ্পবীথিকায় তরু আলবালে জল সিঞ্চনরত দেখার সম্ভাবনা মাত্র নেই। তার দর্শনাভিলাষে এ যুগের দুষ্মন্তকে যেতে হবে লাইট হাউস সিনেমায় নয় তো লেকে। কলকাতায় যে লোক ফুল ঘরে রাখে সে নেহাতই ফুলবাবু।
এ শহরে ফুলের অভাব নেই। পথের দু’পাশে সরকারী বাংলোগুলির বিস্তৃত অঙ্গন পুষ্পসম্ভারে সমৃদ্ধ। পথচারণে দৃষ্টি মুগ্ধ হয়। রাস্তার চৌমাথায় বৃত্তাকৃতি পার্কগুলিতে আছে ফুলের কেয়ারী। ডাকঘরের গায়ে, হাসপাতালের মাঠে, ফুটে রয়েছে প্রচুর মরসুমী ফুল। কনট প্লেসে আছে ক্যানা’ ফুলের ঝাড়। শীতের দিনে পুষ্পাভরণের অজস্রতা কল্পনা করা যায় গ্রীষ্মের ভগ্নাবশেষ দেখেই।
নয়াদিল্লীর আকাশে আছে বৈরাগীর দৃষ্টি, বাতাসে আছে নিঃস্বের হতাশ্বাস, মাটিতে আছে তপস্বিনীর কাঠিন্য। কিন্তু তার পথপার্শ্বে সযত্নরোপিত ভরুশ্রেণী পথচারীর জন্য প্রসারিত করেছে ছত্রছায়া, তার শ্যামল তৃণাবৃত পার্ক বিছিয়ে দিয়েছে হরিৎ অঞ্চল, তার বহু বিচিত্র কুসুমের দল রচনা করেছে বর্ণাঢ্য ইন্দ্রজাল। প্রণয়ীযুগলের পক্ষে সর্বাপেক্ষা অনুকূল আবেষ্টন আছে নয়াদিল্লীতে। সন্ধ্যার ঈষৎ অন্ধকারে তার জনবিরল, ধ্বনিবিরহিত গন্ধ-আমোদিত পথে পাশাপাশি চলতে গিয়ে সদ্যবিবাহিত তরুণ-তরুণীর হৃদয় হয় উদ্বেল, কণ্ঠ হয় ক্ষীণ, চুপি চুপি বলতে অভিলাষ হয় অত্যন্ত তুচ্ছ কোনো কথা, যার না আছে অর্থ, না আছে সঙ্গতি, না আছে প্রয়োজন এবং সেই স্তব্ধ সায়াহ্নে একজনের ঝুমকা-দোলানো কানের অত নিকটে একজনের মুখ আনতে গেলে তা’ দু’-একবার লক্ষ্যচ্যূত হয়ে পড়াও একেবারে বিচিত্র নয়।