দৃষ্টিপাত – ৬

ছয়

দু’জন ইংরেজ একত্র হ’লে গড়ে একটা ক্লাব, দু’জন স্কচ একত্র হ’লে খোলে একটা ব্যাঙ্ক, দু’জন জাপানী করে একটা সিক্রেট সোসাইটি। দু’জন বাঙালী একত্র হ’লে করে কী? দলাদলি? তা করে এবং বোধ হয় একটু বেশি মাত্রায়ই করে। কিন্তু তাছাড়া আরও একটা জিনিস করে। স্থাপন করে একটি কালীবাড়ি। উত্তর ভারতের এমন শহর দুর্ঘট যেখানে বাঙালী আছে কিছু সংখ্যক অথচ কালীবাড়ি নেই একটি।

হিন্দু দেবদেবীর মধ্যে কালীমূর্তিটি সুখদৃশ্য নয়। বীণাবাদিনী সরস্বতীর সুষমা বা কমলাসনা লক্ষ্মীর শ্রী নেই তাঁর মসীকৃষ্ণ দেহে। ভগবতী দুর্গার হাত দশটি, প্রহরণ সমপরিমাণ। কিন্তু কালীমূর্তির কাছে তাঁকে অনেক শান্ত ও সুকুমার মনে হয়। কণ্ঠে তাঁর নরমুণ্ডের মালা, কটিতে তাঁর ছিন্নবাহুর গুচ্ছ, এক হাতে ধৃত মুক্ত কৃপাণ, আর হাতে দোলে খণ্ডিত শির। অতি বিস্তৃত আননের কোনোখানে নেই কমনীয়তার লেশমাত্র আভাস, নয়নে নেই স্নিগ্ধনত দৃষ্টি। নিরাবরণ বক্ষ, নিরাভরণ দেহ। লোলায়িত রসনা। স্বদেশীয় ভক্তরা বলেন, মা ভয়ঙ্করা; ক্যাথারিন মেয়ো বই লিখে বলেন, বীভৎস।

এই রুদ্র ভয়াল মূর্তিকে ভালোবাসে বাঙালী। শ্রীচৈতন্য যে ভক্তিস্রোত আনলেন তার চিহ্ন রইল একটি মাত্র বিশেষ শ্রেণীতে। কালীর ভক্তরা আছেন দেশব্যাপী। শুধু শাক্তদের মধ্যেই তাঁর পূজারীরা নিবদ্ধ নয়। তাঁর পূজা নিরক্ষর গ্রাম্য কৃষকের কুটীর থেকে ধনীর প্রাসাদ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। পুরাকালে কাপালিকেরা শবাসনে সাধনা করেছে দেবী কালিকার, তান্ত্রিকেরা আরাধনা করেছে শ্যামামায়ের, দস্যুদল লুণ্ঠন মানসে নির্গত হয়েছে নমুণ্ডমালিনী কালীর অর্চনা করে। আধুনিক যুগেও অসুস্থ আত্মীয়ের আরোগ্য কামনায় বাঙালী মেয়েরা মানৎ করেন মা কালীর কাছে, পল্লীতে মহামারী দেখা দিলে সরলচিত্ত অধিবাসীরা পূজা করে ভক্তিভরে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁর ধ্যান করেছেন দক্ষিণেশ্বরে, তাঁরই ভজনা করেছেন সাধক রামপ্রসাদ; রচনা করেছেন অপূর্ব শ্যামা-সঙ্গীত।

বাঙালীর পক্ষে এই কালীপ্রীতি আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা বিস্ময়কর মনে হবে। তার শারীরিক সামর্থ্য এবং মানসিক গঠন বাঙালীকে আকৃষ্ট করবে কোমলতার প্রতি, স্নিগ্ধতার প্রতি, মাধুর্যের প্রতি, এইটেই আশা করা স্বাভাবিক। কিন্তু বাঙালীকে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে জানেন, তার প্রকৃতিকে যারা যথার্থরূপে অনুশীলন করেছেন তাঁরা জানেন, এই আপাতবিরোধিতাই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। কুসুমের মৃদুতা এবং বজের কাঠিন্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তার প্রকৃতিতে। তাই ভীরুতার অপবাদ যেমন তার বহুপ্রচারিত, চরম দুঃসাহসিকতার জয়তিলকও তারই ললাটে।

ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনেরও সংঘাত সংঘর্ষ আজ বহুব্যাপ্ত, আসমুদ্রহিমাচল তার বিস্তার ও বেগ। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার এই সুদীর্ঘ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে জাতিধর্মনির্বিশেষে সর্ব প্রদেশের সর্বসাধারণ। মারাঠী এসেছে, মাদ্রাজী এসেছে, এসেছে গুজরাতী, পার্শী ও বেহারী। ভরেছে জেল, সয়েছে নির্যাতন। কিন্তু স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহায় বাঙালীই সাধন করেছে অগ্নিমন্ত্রের, দিয়েছে দক্ষিণা, জীবন দিয়ে পরিশোধ করেছে দেশমাতৃকার ঋণ। একমাত্র বাঙলা ছাড়া ভারতবর্ষের কোথায় স্কুলের ছেলে বরণ করেছে ফাঁসি, মেয়েরা ছুঁড়েছে পিস্তল, পলিতকেশ অন্তঃপুরিকা বুক এগিয়ে নিয়েছে গুলীর আঘাত?

রিডিং রোডের উপর যে কালীমন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে মিলিত উদ্যোগ ও আর্থিক প্রচেষ্টায়, তার জন্য নয়াদিল্লীর বাঙালী সমাজের গর্ব করার অধিকার আছে। আত্মঘাতী বুদ্ধির কর্মনাশা হঠকারিতায় সে কেবলই করে কলহ, ঘটায় ভেদ, ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠান, —এ অপবাদ বাঙালীর। বোধ হয় একেবারে অমূলকও নয়। একক প্রচেষ্টায় বাঙালীর কৃতিত্ব তুলনাহীন। তার মেধা তার ঋদ্ধি, তার নৈপুণ্য সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু বহুজনের সম্মিলিত কর্ম দ্বারা একটা বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যথেষ্ট শক্তি দেখায়নি বাঙালী —–কথাটা গভীর পরিতাপের সঙ্গে স্বীকার করতে হয়। তাই এই কালীবাড়িটি দেখে মন খুশী হয়। কোনো রাজন্যব্যক্তির অনুগ্রহে নয়, নয় কোনো বিত্তশালীর একক অর্থানুকূল্যে, প্রবাসী বাঙালীদের প্রদত্ত ও সংগৃহীত চাঁদায় গড়ে উঠেছে এই মন্দির, স্থাপিত হয়েছে বিগ্রহ।

সরকারী দপ্তরখানায় জীবিকার্জনের তাগিদে উত্তর ভারতের এই মহানগরীতে এসেছে বাঙালী। তাদের কেউ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যরূপে আয় করেছেন প্রচুর অর্থ, কেউ সাধারণ কেরানীর কাজে পেয়েছেন পরিমিত বেতন। তাঁরা সবাই দিয়েছেন দান, স্বেচ্ছায় ও শ্রদ্ধায়। অল্প অল্প করে জমেছে অর্থ, ভরেছে দেবীর ভাণ্ডার। সাধুবাদ দিই তাঁদের। তাঁরা ধন্য।

মন্দিরটি পরিকল্পনা করেছেন যে স্থপতি তাঁর নাম জানি নে, কিন্তু প্রশংসা করি। আড়ম্বরহীন, বাহুল্য-বর্জিত, সহজ, সরল গঠন। বড়বাজারের গন্ধ নেই, নেই মার্কিনী ঢং-এর অতি আধুনিক স্ত্রীমলাইন। দূর থেকে দেখে চোখ তৃপ্ত হয়, কাছে গেলে মন শুচিতায় ভরে ওঠে।

গুটি কয়েক সোপান অতিক্রম করে উপরে উঠলে বিস্তৃত অলিন্দ, ঈষৎ উচ্চ জালিকাটা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে মন্দির, চারিদিক ঘিরে পথ। সে পথে দর্শনার্থীরা প্রদক্ষিণ করে বিগ্রহ, দ্বারে লম্বমান ঘন্টা-ধ্বনি করে মন্দিরের ধূলি নেয় মাথায়। আপন অন্তরের কামনা নিবেদন করে ভক্ত নরনারীর দল। আকাশের আলো এবং বাইরের বাতাস আসতে বাধা নেই এতটুকুও। মন্দিরের অভ্যন্তরে নেই অন্ধকার, নেই পুষ্পপত্র ও গঙ্গোদকের দ্বারা আর্দ্র অপরিচ্ছন্ন আবহাওয়া।

মন্দিরের প্রাঙ্গণটি সুপরিসর। একদিকে আরাবল্লী পর্বতের ‘রীজ’। পাথরের খাড়া দেয়াল, সিমেন্ট দিয়ে জোড়া। অন্যদিকে রাস্তা এবং রেলিং। পিছনে এক কোণে পুরোহিতের বাসস্থান। ছোট্ট একটি কোয়ার্টার মন্দির কর্তৃপক্ষের তৈরি।

দূরদেশে দেবীর নিয়মিত পূজার আয়োজনে পুরোহিত সংগ্রহ খুব সহজ নয়। বাঙলা থেকে কাউকে এনে রাখতে হলে চাই তাঁর জন্য নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা। তাঁর পরিজন প্রতিপালনের নিশ্চিত আশ্বাস। তাই মন্দিরের কর্তৃপক্ষ পুরোহিতের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন মাসিক মাসোহারা। তার গ্রেড আছে, ইনক্রিমেন্ট আছে, ছুটির ব্যবস্থা আছে। আছে প্রণামী, দর্শনীর প্রাপ্য অংশ নির্ধারিত। এ যুগে দেবসেবককেও চাকরির ফাণ্ডামেন্ট্যাল রুলস মেনে চলতে হয়।

মানুষের জীবন যখন জটিল হয়নি, তখন তার অভাব ছিল সামান্য, প্রয়োজন ছিল পরিমিত। সেদিনে ব্রাহ্মণের পক্ষে আবশ্যক ছিল না বিত্তের। সে বিদ্যা দান করতো ছাত্রকে, জ্ঞান বিতরণ করতো শিষ্যকে, ভজন পূজন করতো নিশ্চিন্ত নির্বিঘ্নে। সে নির্লোভ, নিরাসক্ত, শুদ্ধাচারী, সাত্ত্বিক। সে-দিন বিগত, তার সঙ্গে সে ব্রাহ্মণও তিরোহিত। একালে পুরোহিতেরও সংসারযাত্রার উপকরণ হয়েছে বৃদ্ধি। তার স্ত্রীর জন্য চাই সায়া, সেমিজ ও ব্লাউজ, ছেলের জন্য মেলিনস ফুড, মেয়ের জন্য হেলীন স্নো। ইহকালের সমাজ, সংসার ও পারিপার্শ্বিকের প্রতি উদাসীন হয়ে শুধু যজমানের পরকালীন মঙ্গল চিন্তা করলে তার নিজের পরকাল ঘনিয়ে আসে। তাই মন্দিরের পূজারীর জন্য রাখতে হয়েছে বিনাভাড়ায় বাসস্থান, তাতে বিজলী আলো আছে, কলের জল আছে, আছে ভদ্র স্বল্পবিত্ত বাঙালী পরিবারের উপযোগী সাধারণ স্বাচ্ছন্দ্যের আয়োজন।

সিঁড়ির পাশে জুতা খুলে রেখে উঠলেম মন্দিরে। অকৃপণভাবে পুরোহিত দিলেন দেবীর পাদোদক, দিলেন নির্মাল্য ও প্রসাদকণিকা।

কলকাতার মতো মন্দিরপ্রাঙ্গণে স্যুটপরা বাঙালীর উপস্থিতি এখানকার সমাজে পরিহাসের উদ্রেক করে না। কারণ বসনকে এখানে ব্যক্তির পরিধেয় বলেই গণ্য করে, মনোভাবের পরিচয়রূপে নয়। এটি সম্ভব হয়েছে শুধু শহরে বিভিন্ন পরিচ্ছদের মানুষের অবস্থিতির ফলে। এখানে মাদ্রাজী ব্রাহ্মণ, পাঞ্জাবী সিং, মহারাষ্ট্রীয় বাঈ, বাঙালী বিধবা আসে প্রণাম নিবেদনে। তাদের বেশ ভূষা, এমন কি বস্ত্র পরিধানের রীতিনীতি সমস্তই বিভিন্ন। তারা ভক্ত, এইটেই তাদের একমাত্র পরিচয়, পরিচ্ছদটা তাদের শীত, আতপ ও নগ্নতা নিবারণের উপকরণ মাত্র।

মন্দিরের সামনে উন্মুক্ত প্রান্তর। সেখানে শরৎকালে ত্রিপলঢাকা মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয় মহা আড়ম্বরে। বাঙালী ছেলে-মেয়েদের হাতেগড়া কারুশিল্পের প্রদর্শনী বসে। দিনের বেলায় বালকবালিকারা পায় প্রসাদ, নিশাযোগে থিয়েটারে গোঁপ কামিয়ে মিহি স্বরে মেয়ের পার্ট করে সখের দলের তরুণ সম্প্রদায়।

কালীমন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় কালীকীর্তন হয়। শ্যামাবিষয়ক গান, কীর্তনের পদ্ধতিতে মূল গায়েন ও দোহার মিলে গাওয়া হয়। রচনা ভক্তিমূলক, সুর বৈচিত্র্যহীন। তাতে মহাজন পদাবলীর লালিত্য নেই, নেই সাধকের একক ভক্তিনিবেদনের গাম্ভীর্য ও আবেগ। জিনিসটা সঙ্গীতশাস্ত্রে প্রক্ষিপ্ত এবং ভক্তিতন্ত্রের দিক থেকে অনাবশ্যক অনু-করণ। সব দিক দিয়েই অসার্থক। কালীর অঙ্গনে রামপ্রসাদী সুরে ভক্তের কণ্ঠে—শ্মশান ভালো বাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি’, জাতীয় গানই হচ্ছে শেষ কথা।

গানের আসরে যে প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সঙ্গে গভীর পরিচয় ঘটল তাঁর নাম মোহিতকুমার সেনগুপ্ত, বয়স পঞ্চাশের ওপরে, শরীর অকৃশ, দৈর্ঘ্য সাধারণ বাঙালীজনোচিত, অডিট একাউন্টস সার্ভিসের লোক। সুদক্ষ অফিসার বলে খ্যাতি আছে সরকারী মহলে। বর্তমানে যানবাহন বিভাগের আর্থিক উপদেষ্টা। বেতন এবং পদমর্যাদা দুই-ই গুরুত্বপূর্ণ। এঁর আর দু’ভাইয়ের নাম বাংলাদেশে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সুপরিচিত। পরীক্ষার আগে এম. সেনের ইকনমিক্স ও মিহির সেনের সিভিক্স পড়েনি এ-দশকে এমন বিদ্যার্থীর সংখ্যা বেশি নেই। ছাত্রজীবনে সেনগুপ্ত নিজেও প্রথিতযশা ছিলেন। প্রেসিডেন্সী কলেজ ম্যাগাজীনের তিনি দ্বিতীয় ছাত্র-সম্পাদক।

ভদ্রলোক মৃতদার, অমায়িক এবং নয়াদিল্লীর বাঙালী সমাজে যথেষ্ট সম্মানিত। বাঙালীদের সমুদয় ক্রিয়াকর্মে যোগ আছে ঘনিষ্ঠ। কীর্তনের আসরে তাঁর উপস্থিতি দেখা যায় অবধারিত।

ফ্লীট স্ট্রীটে আছে খবরের কাগজ, সেভিল রো’তে দরজী। নয়াদিল্লীর রিডিং রোডেও তেমনি মন্দির। একটি নয়, দুটি নয় পর পর তিনটি। রাস্তাটার নাম টেম্পল স্ট্রীট হলে ক্ষতি ছিল না।

শ্রীযুগলকিশোর বিড়লার লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরটি বোধ করি ভারতবর্ষে বর্তমান শতাব্দীতে নির্মিত সর্বশ্রেষ্ঠ দেবনিবাস। শুধু আকারে নয়, গঠন পরিপাট্যে ও অর্থব্যয়ের বিপুলতায় এর জুড়ি আছে বলে জানা নেই। দূর দূরান্ত থেকে আসে লোক। শুধু ভক্ত নয়, নিছক দর্শনাভিলাষীরাও। আসে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, পারসিক, খ্রিস্টান। আসে য়ুরোপীয় ও এমেরিকান টুরিস্ট। সকালে সন্ধ্যায়, মধ্যাহ্নে নানাভাবে, নানা দিক থেকে ফটো তুলে খালি করে ক্যামেরার স্পুল।

প্রায় বারো বছর আগের কথা। পিতৃনাম চিহ্নিত করে যুগলকিশোর স্থাপন করতে চাইলেন একটি মন্দির যেখানে হিন্দুমাত্রেরই থাকবে অবাধ প্রবেশাধিকার। বিড়লাদের আদিবাস জয়পুরে, সেখানে এ-মন্দিরের সার্থকতা সীমাবদ্ধ। বছরে ক’জন লোক যায় সেখানে, ক’জন খবর রাখে সেখানকার? স্থান নির্বাচিত হলো দিল্লী, ভারতবর্ষের রাজধানী, শুধু আজকের ভারতবর্ষের নয়, শত সমস্র বৎসর থেকে। এখানে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্ব করেছে মহাভারতের কুরুপাণ্ডব বাস করেছে সংযুক্তা পৃথ্বীরাজ। শিরিতে ছিল সম্রাট কুতবুদ্দিন, লাল কেল্লায় রাজদণ্ড ধরেছে বাদশাহ শাজাহান। যমুনার দুই তীরের বিস্তীর্ণ প্রান্তর, আরাবল্লীর বনভূমি, অধুনা বিলুপ্ত জনপদের পথধূলিতে কত শক হুনদল, পাঠান, মোগল একদেহে হলো লীন। ভাবীকালের ভারতবর্ষেরও দিল্লী হবে নগরমালিকার মধ্যমণি। আর যাই হোক, স্বাধীন ভারতের রাজধানী হবে না ওয়ার্ধা।

উনিশ শ’ বত্রিশ সালে শুরু হলো মন্দিরের নির্মাণ কার্য। বহু এঞ্জিনিয়র, বহু কর্মী, শত শত রাজমিস্ত্রী, মুটে মজুর খাটতে লাগলো ছ’বছর ধরে অবিশ্রাম। উনিশ শ’ আটত্রিশ সালে সম্পূর্ণ হলো মন্দির। লক্ষ্মীনারায়ণের আরাধনার স্থান, ধনকুবের বিড়লা ভ্রাতৃবর্গের জনক রাজা বলদেও দাস বিড়লার নামে উৎসর্গীকৃত।

মন্দিরের গঠনভঙ্গিটি ভারতীয় স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন। লাল পাথরের চূড়া, ধারগুলিতে আছে গৈরিক। মনে হয় যেন লাল জমিতে গেরুয়া পাড়। রাজপথ থেকে শ্বেত পাথরের অতি বিস্তীর্ণ সিঁড়ি ওঠে গেছে উপরে। সেখান থেকে উঠেছে মন্দির। মেঝে ও দেয়ালে বিভিন্ন বর্ণের প্রস্তরখণ্ডের সমাবেশে রচিত বর্ণাঢ্য আলিম্পন ও পুষ্পসম্ভার। প্রাচীর গাত্রে আছে অজস্র ফ্রেস্কো পেইন্টিং। জয়পুর শিল্পবিদ্যালয়ের শিল্পীরা অঙ্কন করেছে সে-সব চিত্র। তাদের বিষয়বস্তু ও অঙ্কনচাতুর্য প্রশংসনীয়। জয়পুর শিল্পবিদ্যালয়ের যিনি অধ্যক্ষ—কোশল মুখার্জি—তিনি বাঙালী; নব্য বঙ্গীয় চিত্রকলার উদ্ভাবক নন্দলাল, অসিতকুমার, সমর গুপ্ত প্রমুখের সতীর্থ। বিড়লা মন্দিরটির পরিকল্পনায়ও আর একজন বাঙালী স্থপতির যথেষ্ট অংশ আছে, এ কথা জেনে আনন্দিত হওয়ার কারণ আছে আমাদের।

মন্দিরের মধ্যে বিগ্রহ আছে শ্বেতপাথরের। প্রত্যহ অগণিত নরনারীর কুসুমার্ধে প্রায় আচ্ছন্ন তাঁর চরণ ও পাদপীঠ। দ্বারে লৌহ-পেটিকা, উপরের ছিদ্রপথে ভক্তেরা রাখে প্রণামী। মন্দিরের বাম পার্শ্বে বিরাট ধর্মশালা, সেটি বিড়লা ননীদের স্মৃতিরক্ষার্থে। ধর্মশালার সংলগ্ন নাট মণ্ডপ। তাতে প্রত্যহ সন্ধ্যায় ভজন সংগীত করেন সুকণ্ঠ গায়ক। সহস্রাধিক শ্রোতা অনায়াসে বসতে পারে সে সভায়। মাইক্রোফোনের সাহায্যে বাইরে সর্বসাধারণের শ্রবণায়ত্ত করার ব্যবস্থাও নিখুত। মন্দির-প্রবেশের বহু দূরে থাকতেই কানে এল সে গান—শ্রীরামচন্দ্র কৃপালু ভজ মন হরণ ভব ভয় দারুণম।

মন্দিরের পিছনে একটি বৃহদাকার পার্ক। এটি পরবর্তী রচনা। সাধারণ লোকের চমক লাগার মতো অনেক আয়োজন আছে এই পার্কে। পাথরের বিরাটকায় হস্তী, তার শুঁড় দিয়ে ফোয়ারার জল ঝরছে ঝর ঝর ধারায়। আছে পাথরের কুমীর, তারও মুখ দিয়ে নির্গত হচ্ছে জল। ফোয়ারা, পুষ্পবীথিকা, কৃত্রিম স্রোতস্বতী ও গিরিগহ্বর প্রভৃতি একাধিক আকর্ষণ আছে বালক, বালিকা ও দেহাতীদের। প্রতিদিন অপরাহ্ বেলায় ভিড় জমে তাদের। কেউ বসে বিশ্রামবেদীতে, কেউ দোলে দোলনায়, কেউ বা পরিক্রমণ করে এদিক থেকে ওদিক। অর্থব্যয়ে কার্পণ্য করেননি শেঠ যুগলকিশোর। যুদ্ধপূর্বকালের অর্থমূল্যে মন্দির ও পার্কের নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় কুড়ি লাখ টাকা।

বিড়লা পরিবারের তিনজন, পাঞ্জাবের আর্য প্রতিনিধি সভার প্রতিনিধি তিনজন এবং স্থানীয় সনাতন ধর্মসভা থেকে তিনজন মিলে এক ট্রাস্ট। তাঁরাই রক্ষণাবেক্ষণ করেন মন্দির এবং তার সংলগ্ন উদ্যান, ধর্মশালা প্রভৃতি। আধুনিক মনোভাবের পরিচয় আছে পরিচালন ব্যবস্থায়। প্রতিনিধিরা প্রতি তিন বৎসরান্তে নির্বাচিত হন। ছোটখাটো ব্যাপারেও আধুনিকতার ছাপ আছে।

মন্দির প্রবেশের পূর্বে জুতা খুলে রাখবার ব্যবস্থাটি চমৎকার। সিঁড়ির ঠিক গোড়াতেই একটি ক্ষুদ্র কক্ষ। দেয়ালে জুতা রাখার র‍্যাক। সেখানে জুতা জমা দিতে হয়। মালিককে দেওয়া হয় সংখ্যাযুক্ত কার্ডবোর্ডের একটি চাকতি। অনুরূপ আর একটি চাকৃতি এঁটে রাখা হয় জুতার গায়ে, যাতে একজনের হাইহিল লেডিস সু’র সঙ্গে অন্যনের কাবুলী চপ্পল বদল না হয়ে যায়। চাকৃতি ফেরত দিলেই ঠিক নিজের জুতাজোড়া এনে হাজির করে জুতাঘরের কর্মচারী যেমন স্যাভয়, গ্রভনর বা কলকাতার গ্রেট ইস্টার্নে টুপী, ছাতা কিংবা লাঠি।

মহাত্মা গান্ধী দ্বার উদ্ঘাটন করেন এ মন্দিরের তাঁর চাইতে যোগ্যতর পুরোধা ছিল না এ অনুষ্ঠানের। ব্রাহ্মণ, শূদ্র ও হরিজনের সমান প্রবেশাধিকার যে মন্দিরে, তার দরজা তিনি খুলবেন না তো খুলবে কে? বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত রইল এ-যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবাত্মার নাম।

বিড়লা মন্দিরের সংলগ্ন ভূমিখণ্ডে তৃতীয় মন্দিরটি মূলত বিড়লাদেরই অর্থানুকূল্যে নির্মিত। সেটি বৌদ্ধদের। বাঙালী কালীমন্দির ও লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দিরের মাঝখানে এই ক্ষুদ্র মন্দিরটির অবস্থিতি ও গঠন কারুর দৃষ্টি এড়াবার নয়। মন্দিরাভ্যন্তরে ভগবান তথাগতের ধ্যান-গম্ভীর মূর্তি। পীতবসন ভিক্ষু আছেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে একজন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। কবির স্মৃতিচিহ্নরূপে একটি বকুল বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন মন্দিরাঙ্গনে। রবি-বকুল বৃক্ষ রোপণানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেছিলেন একজন বাঙালী ঐতিহাসিক। ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন। ভারত সরকারের দলিল দস্তাবেজ সংরক্ষক, কিপার অব ইম্পিরিয়েল রেকর্ডস।

সেন মহাশয় এককালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ অধ্যাপক ছিলেন। মহারাষ্ট্র ইতিহাসে তাঁর গবেষণার মূল্য ঐতিহাসিক মণ্ডলীতে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃত। স্ফীত বেতনের সরকারী চাকরিতে অনায়াস জীবন যাপন করেও যে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি সাহিত্যচর্চা করেন এবং অক্সফোর্ডের সেবকদের মধ্যে শ্রীযুক্ত সেন বিশিষ্ট। এঁর পৈতৃকবাস বরিশাল জেলায়। বাচন ভঙ্গীতে তার আভাস পাওয়া যায়।

রিডিং রোডের একপাশে মন্দির, অন্যদিকে কোয়ার্টার। গভর্নমেন্টের কেরানী ও অনুরূপ কর্মচারীদের বাসস্থান। লম্বা একটানা ব্যারাক, কোনটার ইংরেজী L অক্ষরের মতো একপ্রান্ত প্রসারিত, কোনটার বা E ‘র মতো আকৃতি, শুধু মাঝখানের বাড়তিটুকু বাদ। সামনে খানিকটা মাঠ। মন্দির ও কোয়ার্টার,—সুন্দর এবং কুৎসিতের এত নিকট অবস্থিতি সচরাচর দৃষ্টিগোচর নয় কোনোখানে। এক একটা ব্যারাকে ত্রিশ, চল্লিশটি পরিবারের বাসব্যবস্থা। অল্প বেতনের কর্মচারীদের জন্য সুলভ সরকারী আয়োজন। এ-পাড়াটা নয়াদিল্লীর ইস্ট য়েণ্ড।

দেখতে ভালো না হলেও থাকতে মন্দ নয় এই কোয়ার্টারগুলি। বিশেষ করে সুলভতা বিচার করলে অভিযোগ করার উপায় থাকে না। বেতনের এক দশমাংশ ভাড়া। মাসের শেষে আপিস থেকেই কেটে নেয় নিয়মিত। সেক্রেটারিয়েটের কেরানীদের সর্বনিম্ন বেতন ষাট টাকা। সুতরাং ছ’টাকা ভাড়ায় বাড়ি। দু’খানা শোবার ঘর, একখানা রান্নার, একটি ভাঁড়ার। ভিতরে একটু উঠান, বাইরে ছোট বারান্দা। জলের কল আছে, বাথরুম আছে, আছে ইলেকট্রিক আলো এবং চমকে উঠো না যেন, আছে বড় একটি সিলিং ফ্যান। বাড়িতে রোদ আসে, বাতাস আসে এবং ধূলিরও বাধা নেই। কলকাতা শহরে এমন ভাড়ায় এমন বাড়ি কোটিকে গুটিক মিলে না।

শুধু বাড়ি নয়। ফার্নিচারও। বিবাহ সভায় সালঙ্কারা কন্যার মতো গভর্নমেন্টের বাড়িও আসবাবপত্রসহ পাওয়া যায়। সেন্ট্রাল পি. ডব্লিউ. ডি’র ফার্নিচার। দু’টাকা মাসিক ভাড়ায় পাওয়া যায় দু’খানা তক্তাপোশ, একটি আলমারি, একটি টেবিল ও তিনখানা চেয়ার।

এক একটা ব্যারাক ও তার সামনে খোলা মাঠটুকু নিয়ে এক একটা ‘স্কোয়ার’। অধিকাংশই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতাদের নামের দ্বারা গৌরবান্বিত। ক্লাইভ স্কোয়ার আছে সেই ইংরেজ ভদ্রলোকের নামে যিনি পলাশীর আম্রকাননে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন। যিনি আশী টাকা বাৎসরিক বেতনে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সামান্য কেরানীরূপে ভারতবর্ষে এসে দেশে ফিরেছিলেন ইংলণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনশালীরূপে। ১৭৪৪ সালে মাদ্রাজে আগত খ্যাতিহীন, বিত্তহীন রবার্ট ক্লাইভ ১৭৬০ সালে ৯ই মে যখন সেনানায়েকে ক্লাইভ রূপে প্রত্যাবর্তন করলেন ইংলণ্ডে, জাহাজ থেকে অবতরণ করলেন পোর্টসমাউথ বন্দরে, তখন ইংলণ্ডের এ্যানুয়েল রেজিস্টারে তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য ছিল,—’এই কর্নেলের কাছে নগদ টাকা আছে প্রায় দু’ কোটি, তাঁর স্ত্রী গহনার বাক্সে মণিমুক্তা আছে দু’ লাখ টাকার। ইংলণ্ড, স্কটল্যাণ্ড ও আয়লাণ্ডে তাঁর চাইতে অধিকতর অর্থ নেই আর কারো কাছে।’

স্কোয়ার আছে লর্ড ডালহৌসীর নামে, যিনি একে একে পাঞ্জাব ও ব্রহ্মদেশ যোগ করলেন ভারত সাম্রাজ্যে, জোর করে দখল করলেন পেশোয়াদের সাতারা, কেড়ে নিলেন ঝাঁসী, নাগপুর, নিজামের বেরার, নবাব ওয়াজেদ আলী শা’র কাছ থেকে অযোধ্যা।

স্কোয়ার আছে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর নামে, যিনি কাশীনরেশ চেৎসিংহের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন বহু লক্ষ মুদ্রা, অযোধ্যায় বেগমদের পীড়ন করে অর্থ ও মণিমুক্তা সংগ্রহ করেছিলেন ন্যূনাধিক দেড় কোটি টাকার। যার কুশাসন ও কুকার্যের সুদীর্ঘ তালিকা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিচারসভায় অভূতপূর্ব বাগ্মিতায় উদ্ঘাটিত করেছিলেন এডমণ্ড বার্ক। সে অপকীর্তির রোমহর্ষক বর্ণনা শুনে পার্লামেন্টকক্ষে দর্শকের গ্যালারীতে মূর্ছিত হয়ে পড়েছিলেন একাধিক ইংরেজ রমণী আর আছে সিপাহী যুদ্ধের ছোট বড় মাঝারি ইংরেজ সেনাপতিদের নাম। হেভলক স্কোয়ার, আউটরাম স্কোয়ার, উইলসন স্কোয়ার, নিকসন স্কোয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি। স্কোয়ার নেই শুধু মেজর জেনারেল হিউয়েটের নামে যিনি ১৮৫৭ সালের ৯ই মে মীরাট সেনানিবাসে ৮৫ জন ভারতীয় সিপাহীকে হাতে পায়ে লোহার শখ বেড়ী পরিয়ে সমস্ত সৈন্যদলের সামনে লাঞ্ছিত করেছিলেন। সেদিন নিরুপায় ভারতীয় সিপাহীরা দাঁড়িয়ে দেখেছিল তাদের সঙ্গীদের এই অবমাননা। তাদের মুখে ছিল না প্রতিবাদ, কিন্তু চোখে ছিল আগুন। সে আগুন সহজে নেভেনি।

পরদিন রবিবার। সন্ধ্যার প্রাক্কালে আসন্ন রজনীর ঈষৎ অন্ধকার নামল মীরাটের ছাউনিতে। ব্রিটিশ সৈন্যরা তৈরি হয়েছে চার্চ-প্যারেডের জন্য। ভারতীয় সৈন্যরা করছে কী? বোধ হয় বিশ্রাম। এমন সময় অকস্মাৎ আওয়াজ এল,—গুড়ুম!

পদাতিক বাহিনীর সিপাহীরা অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরেছে বৃটিশ সেনানায়কদের ঠিক ললাটে। বন্দুকের ঘোড়া টিপছে ক্লিক্, ক্লিক্, ক্লিক্। আকাশ, বাতাস, প্রাচীর ও প্রান্তর কাঁপিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে গুড়ুম! গুড়ুম!! গুড়ুম!!!

উত্তর ভারতে সিপাহী যুদ্ধের সেই হলো প্রারম্ভ।

নেতৃত্ববিহীন অসঙ্ঘবদ্ধ পরিচালনা, পরিকল্পনাবিহীন পদ্ধতি, বিভিন্ন অংশে যোগাযোগশূন্যতা এবং কেন্দ্রীয় নির্দেশের অভাবে ব্যর্থ হলেও একথা আজ স্বীকার করতে হয় যে, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাবার ও স্বরাষ্ট্র গঠনে ভারতীয়দের সেই প্রথম উদ্যোগ।

মীরাটের সিপাহীরা ঘোড়া ছুটিয়ে পরদিন প্রভাতে এসে পৌঁছল দিল্লীতে। বাদশাহ বাহাদুর শাহ তখন দিল্লীর মসনদে। বাবরের বিক্রম, আকবরের ব্যক্তিত্ব বা আওরঙ্গজেবের রণকুশলতার লেশ ছিল না এই বৃদ্ধ মুঘল সম্রাটের চরিত্রে। সিপাহীদের শৌর্য, শক্তি ও যুদ্ধোপকরণ কাজে লাগাবার ক্ষমতা ছিল না তাঁর। জনসাধারণের সংগ্রামোন্মুখ ব্রিটিশ-বিদ্বেষকে সফল পরিণতি দান করতে পারলেন না তিনি।

দিল্লীর পরিধি সাত মাইল। অধিবাসীরা উত্তেজিত। ইংরেজের শিবিরে শিক্ষিত ও ইংরেজেরই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চল্লিশ হাজার রণনিপুণ সিপাহী তার পাহারা। নগর প্রাচীরের উপরে চৌদ্দটি বৃহদাকার কামান। দুর্গাভ্যন্তরে বৃহত্তম বারুদখানা। তা ছাড়া আছে আরও ষাটটি ছোট ছোট কামান। আছে বহু সুদক্ষ গোলন্দাজ;—বেশির ভাগই দু’দিন পূর্বে ছিল ব্রিটিশ সৈন্যদলভুক্ত। তারা য়ুরোপীয় যুদ্ধরীতিতে সুশিক্ষিত, সুনিপুণ এবং সুশৃঙ্খলাবদ্ধ। দিল্লী দুর্গকে সুরক্ষিত করেছে ভারতীয় এঞ্জিনিয়রেরা যারা আধুনিকতম এঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান লাভ করেছে ইংরেজের সেনাবাহিনীতে। দিল্লী অধিকারের ক্ষীণতম আশার কারণ ছিল না। ‘রীজে’ সমবেত ব্রিটিশবাহিনীর মনে। লেশমাত্র যুক্তিযুক্ত সম্ভাবনা ছিল না দুর্গপতনের।

কিন্তু তবুও সিপাহীরা হারল। দিল্লী দখল করল ইংরেজ। ভারতে মুসলিম রাজত্বের ঘটল সমাপ্তি। দ্বিশতাধিকবর্ষ পূর্বে নির্মিত সম্রাট শাজাহানের লাল কেল্লার শীর্ষে উত্তোলিত হলো ব্রিটিশ পতাকা।

নগরপ্রান্তে ‘রীজের’ ইংরেজ-শিবিরে সৈন্য সংখ্যা ছিল চৌদ্দ হাজারের সামান্য কিছু বেশি। এরা সবই য়ুরোপীয় নয়। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ছিল ভারতীয় সেপাই। আড়াই হাজার সৈন্য—বলা বাহুল্য, তারাও ভারতীয়—পাঠিয়েছিলেন ইংরেজানুরাগী দেশীয় রাজন্যবর্গ। তাঁদের জন্য আজ একুশ, এগারো বা পাঁচ সাত করে তোপধ্বনির বিধি আছে।

কর্নাল থেকে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে ব্রিটিশবাহিনী এসে শিবির স্থাপন করল ‘রীজে’, যেখানে এখন দিল্লী যুনিভার্সিটি। বর্তমান সবজীমণ্ডীতে ঘটেছে দীর্ঘকালব্যাপী অনেক খণ্ড যুদ্ধ। ইংরেজ সৈন্যদের সেই অস্থায়ী আবাস ভূমিতে পরে রচিত হয়েছে পুরাতন ভাইসরিগ্যাল লজ। সেখানে বসে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থীরা, ফিজিক্স, কেমেস্ট্রির বা ইকনমিক্সের নোট টোকে। তারই অনতিদূরবর্তী একটি ভবনে উনিশ শ’ চব্বিশ সালে তিন সপ্তাহের অনশন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী,—দিল্লীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদকল্পে। প্রথম সর্বদল মিলনের প্রচেষ্টায় সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন পণ্ডিত মালবীয়জি।

ইংরেজ জানতো, অনতিবিলম্বে দিল্লী অধিকার করতে না পারলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ হবে চিরতরে। তাই সর্বস্ব পণ করল তারা। জিতি তো বাদশাহ, হারি তো ফকির। ব্রিগেডিয়ার আর্কডেল উইলসন তখন ব্রিটিশ শিবিরের অধিনায়ক। তিনি জয় সম্পর্কে আশান্বিত ছিলেন না।

গ্রীষ্ম গেল, বর্ষা অতীত, শরতের প্রথমার্ধও বিগতপ্রায়। অর্ধেকের উপর ইংরেজ সৈন্য জ্বর, উদরাময় ও অন্যান্য ব্যাধিতে রুগ্ন। পাঞ্জাব থেকে সেনাপতি লরেন্স ক্রমাগত উৎকণ্ঠিত পত্র পাঠাচ্ছেন, আর কতদিন? দিল্লী বিজয়ের আর বিলম্ব কত? সমগ্র ভারতবর্ষে একমাত্র পাঞ্জাবেই সিপাহীরা তখনও আছে অনুগত, আম্বালার সেনানিবাসে দেখা যায়নি বিক্ষোভ। কিন্তু আর বেশি দিন শান্তি রক্ষা কঠিন হবে। দিল্লী, দিল্লী, দিল্লীর উপরেই নির্ভর করছে ভারতবর্ষে জন কোম্পানীর ভাগ্য।

অবশেষে সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে ফিরোজপুর থেকে হস্তিপৃষ্ঠে বাহিত প্রচুর গোলা বারুদ ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র এসে পৌঁছল ‘রীজে’র ছাউনীতে। ব্রিটিশ-সেনানায়কদের প্রাণে ফিরে এল ভরসা, মনে এল সাহস। সেনাপতি উইল্সনকে অতিক্রম করে যুদ্ধ পরিচালনার ভার গ্রহণ করল জন নিকলসন।

চৌদ্দই সেপ্টেম্বর। রাত্রি প্রায় নিঃশেষিত, যদিও আলোর রেখা দেখা দেয়নি আকাশে। ইংরেজবাহিনী আক্রমণ করল দিল্লী দুর্গ। পূর্ববর্তী ছয় দিন দিবারাত্রি ব্যাপী গোলাবর্ষণের দ্বারা নগর প্রাচীর বিধ্বস্ত করা হয়েছে ধীরে ধীরে মূল আক্রমণের মুখবন্ধরূপে। কাশ্মীরী গেটের দিকে খণ্ড খণ্ড দলে হানা দিল ইংরেজের সৈন্য। দুই পক্ষের কামান গর্জনে দুরু দুরু কম্পিত হলো দূর দূরান্তের গৃহগবাক্ষ, তাদের অগ্নিবর্ষণের রক্তিম আভায় সীমন্তিনীর সিঁথির মতো রঞ্জিত হলো প্রভাতের বিস্তীর্ণ আকাশ।

এই মরণপণ যুদ্ধ চলল প্রহরের পর প্রহর। অবশেষে বিকট শব্দে কাশ্মীরী গেটের রুদ্ধদ্বার বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল ধূলায়।

এঞ্জিনিয়র বিভাগের ক্ষুদ্র একটি দল সরীসৃপের মতো বেয়ে উঠেছে প্রাচীরে বিস্ফোরকে অগ্নি সংযোগের দ্বারা বিচূর্ণ করেছে সুদৃঢ় কাশ্মীরী গেট। তাদের অমানুষিক সাহসের ফলেই জয়লাভ সম্ভব হলো ইংরেজের। ইংরেজের ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেছেন, এই দলের মধ্যে আটজন ছিল ভারতীয়।

সেই ভগ্নদ্বার পথে জয়দৃপ্ত ব্রিটিশবাহিনী প্রবেশ করল ভীমবেগে। বিপক্ষকে আক্রমণ করল দ্বিগুণ তেজে। উন্মুক্ত তরবারি হস্তে সেনাপতি নিকলসন পরিচালনা করছিলেন সেই সৈন্যদল। জনৈক সিপাহী নিশানা করল তাঁকে। মুহূর্তে আর্তনাদ করে ধূলায় লুটিয়ে পড়ল নিকলসন। গুলি লেগেছিল তাঁর কপালে।

পরাজিত বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ পলায়ন করলেন দুর্গ থেকে। আত্মগোপন করলেন দিল্লী প্রাসাদের চার মাইল দক্ষিণে হুমায়ুনের সমাধি সৌধে। সেখানে এক মুসলমান ফকিরের নিলেন আশ্রয়। জনশ্রুতি এই যে, সেই ফকিরই তাঁকে ধরিয়ে দিলেন ইংরেজের গুপ্তচর বিভাগের এক তরুণ কর্মচারী হডসনের হাতে।

হামা আজ দস্তে

গঁয়ের নালা কুনান্দ,

শাদী, আজ দস্তে

খেতান ফরিয়াদ।

নিজের হাতই যখন নিজের গালে চড় বসিয়ে দেয়, তখন, হে শাদী, অপরের হাতে মার খাওয়া নিয়ে আর খেদ করে লাভ কী!

বন্দী সম্রাটকে হডসন পালকী করে নিয়ে এল দিল্লীতে। সেখানে বিচার হলো তাঁর। দণ্ড হলো নির্বাসন। ব্রহ্মদেশে। সেখানে পাঁচ বছর পরে বন্দীদশায় জীবনান্ত ঘটল তাঁর। হতভাগ্য বাহাদুর শাহ্ ভারতের শেষ মুসলিম সম্রাট!

ঠিক যেখানে বাহাদুর শাহ ধৃত হন, হুমায়ুন’স টুম্বেই পরদিন হডসন গ্রেপ্তার করল আর তিনটি পলাতক। বাহাদুর শাহের দুই পুত্র ও এক পৌত্র। তাঁরা স্বেচ্ছায়ই ধরা দিয়েছিলেন। তাঁদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, তাঁদেরও বিচার হবে বাহাদুর শাহের মতো।

হডসন তাঁদের একটি ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে এল দিল্লীতে। দিল্লী গেটের কাছে এসে হডসন থামাল সে গাড়ি। বন্দুক নিয়ে নিজ হাতে পর পর গুলি করল বন্দীদের ঠিক বুকের মাঝখানে। রাজরক্ত ঝর ঝর ধারায় গড়িয়ে পড়ল দিল্লীর ধূলিধূসর পথে। মৃতদেহ নিয়ে চাঁদনী চকের উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রকাশ্য প্রদর্শনী রূপে রাখা হলো তিন দিন। সম্রাট বংশধরদের বিকৃত মৃতদেহ দেখে শিউরে উঠল, পথচারীর দল, বারংবার অশ্রুসিক্ত চক্ষু মার্জনা করল নিঃশব্দে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *