দৃষ্টিপাত – ৫

পাঁচ

প্রভাতের সবচেয়ে বড় সেন্সেশন। স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে বেরিয়েছে ক্রীপস প্রস্তাবের সারমর্ম। নিজস্ব সংবাদদাতার বিশ্বস্তসূত্রে পাওয়া বিবরণ। শোনা গেল, গভর্নমেন্ট বিচলিত হয়েছে এ সংবাদ প্রকাশে। ‘গোয়েন্দা বিভাগের বড় কর্তারা তদন্ত শুরু করেছেন সংবাদের সূত্র সম্পর্কে।

সাংবাদিক মহলে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। কারণ প্রস্তাবগুলির কিছুটা আঁচ আমরা সবাই পেয়েছিলেম গত ক’দিন ধরেই। প্রকাশ করা হয়নি, জেন্টলম্যানস এগ্রীমেন্ট স্মরণ করে। ইংরেজ ও আমেরিকান সহ-সংবাদদাতারা অনুমান করলেন, ভাইসরয়’স কাউন্সিলের কোন মহামান্য সদস্যের কাছ থেকে বেরিয়েছে এ খবর।

জনশ্রুতি এই যে, ক্রীপস্ যে-দিন এলেন, বেলা সাড়ে বারোটা থেকে অনাহারে ভাইসরয়’স হাউসে তাঁর অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন এই মাননীয় সদস্যগণ। বেলা দুটোয় এলেন ক্রীপস। লর্ড লিনলিথগো আলাপ করিয়ে দিলেন তাঁর সঙ্গে সারিবন্দী দণ্ডায়মান নিজ সহকর্মীদের। ক্রীপস করমর্দন করলেন সবার সঙ্গে, নিরাসক্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন, ‘হাউ ডু ইউ ডু?’ দ্বিতীয় বাক্য উচ্চারণ না করে মুহূর্তে অন্তর্হিত হলেন আপন নির্দিষ্ট কক্ষে।

তাঁরা আশা করেছিলেন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বে ক্রীপস্ তাঁর প্রস্তাব আলোচনা করবেন তাঁদের সঙ্গে, জানতে চাইবেন তাঁদের অভিমত। সেদিক দিয়েও হতাশ হলেন। ক্রীপস প্রস্তাবের সারমর্ম অনুদঘাটিত রইল তাঁদের কাছে। আশ্চর্য নয় যে, তাঁরা ক্ষুণ্ণ হলেন। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলর হলেও, হাজার হোক, মানুষের শরীর তো! শোনা যায়, অবশেষে ভাইসরয়ের সুপারিশে বিগত রাত্রে লাট প্রসাদে অনুষ্ঠিত এক ভোজ সভায় ক্রীপস্ তাঁর প্রস্তাবের চুম্বক জানিয়েছেন তাঁদের। আজই প্রভাতে সংবাদপত্রের উৎসাহী নিজস্ব রিপোর্টারের জবানীতে ঘটল তার প্রকাশ। ধূম দ্বারা যদি পর্বতের বহ্নি অনুমান করা সম্ভব হয়, তবে বিদেশী সংবাদদাতাদের সন্দেহ একেবারে অগ্রাহ্য করা কঠিন।

সংবাদ ‘স্কুপ’ করার অধিকার সাংবাদিকের আছে। কিন্তু তারও একটা অলিখিত মাত্রা আছে। জাতির বা দেশের বৃহত্তর স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে সাংবাদিকের আপন বিবেক সেন্সর করে তার কপি। এডোয়ার্ড দি এইটথের রাজ্য ত্যাগের ঘটনা মনে পড়ছে সুস্পষ্ট। মে মাস থেকে ব্রিটেনের সকল সংবাদপত্র জানতো সিম্পসন-এডোয়ার্ড প্রণয়-কাহিনী। ফ্লীট স্ট্রীটে কানাঘুষায় শুনেছেন অনেকেই। কেউ প্রকাশ করেনি মুদ্রিতাক্ষরে। সরকারী দপ্তরের কোনো অনুশাসন ছিল না, ছিল না কোনো আইনগত বাধা একদিন জার্মানীর বিরুদ্ধে সেকেণ্ড ফ্রন্ট হবে। কোথায়, কোনখানে করবে মিত্রশক্তি আক্রমণ সে তথ্য জানা হয়ত সম্ভব হতে পারে স্টুয়ার্ট গেল্ডার বা ড্র পিয়ার্সনের। তাঁরা কদাচ প্রকাশ করবেন না সে সংবাদ, যদিও ক্রীপস্ প্রস্তাবের চাইতে সে কম বড় ‘স্কুপ’ নয়।

সকল প্রশ্নের বড় প্রশ্ন সততার। ক্রীপস আন্তরিক আবেদন জানিয়েছিলেন ব্রিটেন এবং ভারতের কল্যাণের নামে। আমরা সবাই সম্মতি দিয়েছিলেম বিনা প্রতিবাদে। পূর্ব প্রকাশের দ্বারা এই ভারতীয় সাংবাদিক ভঙ্গ করলেন সে প্রতিশ্রুতি। তাই লজ্জিত বোধ করছি আমরা সমস্ত ভারতীয়েরা। জেন্টলম্যানরা যদি জার্নলিস্ট হতে পারেন, জার্নলিস্টরা জেন্টলম্যান হতে পারবেন না কেন?

ভাইসরয়’স হাউস থেকে ক্রীপস্ এসেছেন তিন নম্বর কুইন ভিক্টোরিয়া রোডে। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য সার এগুরু ক্লো-র বাংলোয়। ক্লো আসামের আগামী গভর্নর। গদি দখলের আগে দু’মাসের ছুটি নিয়ে গেছেন মুসৌরী না আলমোড়ায়, বিশ্রাম মানসে।

এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলারদের বাড়িগুলি সরকারী। সুদৃশ্য। একতলা দালান। ঈষৎ পীতাভ রং; সামনে অতিবিস্তৃত অঙ্গন। এত বড় যে দু’দিকে গোলপোস্ট খাড়া করে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ খেলা যায়। সবুজ ঘাস, লন-মৌর দিয়ে পরিপাটি ছাঁটা। মাঝখানে বৃত্তাকার ফুলের কেয়ারী। তাকে বেষ্টন করে টকটকে লাল সুরকির রাস্তা; মোটর ঘোরাতে বেগ পেতে হয় না এতটুকুও। ফটকের গায়ে একপাশে কাচের উপরে বড় হরফে লেখা বাড়ির নম্বর। কাচের একদিকে ছোট্ট একটু খুপরি। রাত্রিবেলায় তাতে লণ্ঠন জ্বেলে রাখা হয়, অনেক দূর থেকেও যাতে বাড়ির নম্বরটা চোখে পড়ে। দালানের সম্মুখে পোর্চ, তার নীচে গাড়ি দাঁড়ায়। বারান্দার দু’পাশে দুটি ছোট কুঠুরী। সেখানে অনারেবল মেম্বারের সেক্রেটারী ও স্টেনোগ্রাফারের দপ্তর।

হুবহু একই ধরনের ছ’টি বাড়ি। সেক্রেটারিয়েটের সুমুখ থেকে দুই বাহুর মতো দু’দিকে প্রসারিত দুটি রাস্তা—কিং এডোয়ার্ড ও কুইন ভিক্টোরিয়া রোডের উপরে। যেন ছ’টি যমজ ভাই, ডিয়োনি কুইন্টোপ্লেটসের দোসর।

আতিশয্যের দ্বারা অত্যন্ত ভালো জিনিসকেও যে কতখানি হাস্যকর করে তোলা যায় তার দৃষ্টান্ত আছে নয়াদিল্লীর নগরপরিকল্পনায়। মুনিফর্মিটির বাতিকে পাওয়া স্থপতিরা শহরটাকে শ্রী দিতে গিয়ে ছাঁচ দিয়েছেন, বাড়ি দিতে গিয়ে ব্যারাক। বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে মূলগত ঐক্য প্রকাশ করার নাম সৃষ্টি। গজ, ফুট বা ইঞ্চি মিলিয়ে সামঞ্জস্য বিধানের নাম নকলনবিশি। প্রথমটা যিনি করেন তাঁকে বলি ব্রহ্মা, দ্বিতীয়টা যিনি করেন তাঁর নাম বিশ্বকর্মা। প্রথমটার মধ্যে আছে আর্ট, পরেরটার মধ্যে আছে ক্রাফট।

পুরাকালে নগর-পত্তনের গোড়াতে ছিল নৃপতি। রাজার অবস্থিতি ও অভিরুচি অনুসরণ করে গড়ে উঠতো জনপদ, তাঁর প্রাসাদকে কেন্দ্র করে আমীর ওমরাহেরা তুলতো সৌধ, সাধারণেরা বাঁধতো বাসা, শ্রেষ্ঠরা সাজাতো বিপণি। রাজশক্তির পতন অভ্যুদয়ের সঙ্গে রাজধানীর ভাগ্যে এসেছে বিপর্যয়, নগর নগরীর ঘটেছে বিলুপ্তি বা বৃদ্ধি। আগ্রা, আওরঙ্গাবাদ ও ফতেপুর সিক্রিতে আজও রয়েছে তার নির্ভুল নিদর্শন।

একালে রাজ্যের চাইতে বাণিজ্যের কদর বেশি। লেডী ডাক্তারের স্বামীর মতো রাজার মহিমাও এখন আর আপন বীর্যবত্তায় নয়, প্রজাদের বাণিজ্য-বিস্তারে। শুধু ভারতবর্ষে নয়, অন্য দেশেও এখন বণিকের মানদত্ত পোহালে শর্বরী দেখা দেয় রাজদণ্ডরূপে—কখনও স্বনামে কখনও বা বেনামীতে। তাই এ-যুগের মহানগরীর centre of gravity থাকে ক্লাইভ স্ট্রীটে বা হর্নবি রোডে। তাদের প্রেরণার মূল চেম্বার অব প্রিন্সেস নয়, চেম্বার অব কমার্স। তাই ওয়াশিংটনের চাইতে নিউইয়র্কের গুরুত্ব হয় বেশি; লক্ষ্ণৌকে ছাপিয়ে ওঠে কানপুর, পাটনাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় টাটানগর।

আধুনিক ভারতবর্ষে নয়াদিল্লী হচ্ছে একমাত্র সিটি যেখানে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রভুত্ব নেই। সেখানে বৈশ্য নেই। ব্রাহ্মণও না। আছে শুধু ক্ষত্রিয়। অবশ্য তাদেরও আয়ুধের পরিবর্তন ঘটেছে। মর্ডান ক্ষত্রিয়েরা অসিজীবী নয়, মসিজীবী। প্রাচীন ক্ষত্রিয়েরা ব্যূহ রচনা করে হাত পাকিয়েছিলেন। তার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও ব্যাস সবই রুলমাফিক। আধুনিক ক্ষত্রবীরেরা ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে হাত এবং চুল দুই-ই পাকিয়ে দেন, তারও নির্দেশ হলো precedent। সুতরাং নয়াদিল্লীর পথ, ঘাট, বাড়ি, ঘর সব কিছুরই পিছনে আছে কেবলই এক রকম হওয়ার প্রয়াস। দোকান-পাট থেকে শুরু করে রাস্তা, পার্ক, কোয়ার্টার, মায় পথের পাশে জাম গাছের সারি পর্যন্ত সব কিছুই যেন খাকী কোর্তা-পরা পল্টনের মতো সঙ্গীন উঁচিয়ে এটেনশনের ভঙ্গিতে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে।

নতুন আস্তানায় ক্রীপসের সভা বসল পাত্র-মিত্র নিয়ে। অক্সফোর্ডের অধ্যাপক কুপল্যাণ্ড, এবং ক্যানাডার সমাজতন্ত্রী গ্রেহাম স্প্রাই আছেন তাঁর দপ্তরে।

কুপল্যাণ্ডের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল একবার লন্ডনের এক বিতর্ক-সভায়। ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাঁর ঔৎসুক্য আছে যথেষ্ট, ঔদার্য আছে কিনা জানিনে ক্রীপসের সঙ্গে একে একে সাক্ষাৎ করেছেন মৌলানা আজাদ, গান্ধীজি, পণ্ডিত নেহরু ও মিস্টার জিন্না। আজাদের সঙ্গে দোভাষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আর একজন কংগ্রেসী মুসলমান। ব্যারিস্টার মিস্টার আসফ আলী। আসফ আলীর জন্মস্থান যুক্তপ্রদেশ, কর্মস্থান দিল্লী, শ্বশুরবাড়ি বাংলায়। তাঁর স্ত্রী অরুণা আসফ আলীর পৈতৃক উপাধি ছিল গাঙ্গুলী, অতি নিকট আত্মীয় সম্পর্ক আছে রবীন্দ্রনাথের কন্যা মীরাদেবীর সঙ্গে।

পণ্ডিত জওহরলালের ইংরেজী জ্ঞানের খ্যাতি তাঁর দেশপ্রীতিরই মতো বহুবিদিত। জীবিত ইংরেজ সাহিত্যিকদের মধ্যেও তাঁর তুল্য ইংরেজী রচনাকুশলী বড় বেশি নেই, একথা স্বীকার করেছেন বহু ইংরেজ সমালোচক। গান্ধীজির ইংরেজী জওহরলালের ন্যায় সাহিত্য প্রধান নয় কিন্তু তার স্বচ্ছতা ও অলঙ্কারহীন মাধুর্য বহুক্ষেত্রে বাইবেলের ভাষাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মিস্টার জিন্না ছিলেন প্রথিতযশা ব্যবহারজীবী। ইংরেজীতে সওয়ালে তাঁর দক্ষতা অসাধারণ। ক্রীপসের সঙ্গে একটি মাত্র লোক আলাপ করেছেন—ক্রীপসের ভাষায় নয় নিজের ভাষায়। ইংরেজীতে নয় উর্দুতে। যদিও কাজ চালাবার মত ইংরেজী তিনি জানেন বলে জনশ্রুতি শুনেছি বহু বার। মৌলিকতা আছে মৌলানার। তার জয় হোক।

ইংরেজী আমাদের মাতৃভাষা নয়, কিন্তু ইংরেজী আমাদের শিখতে হয়। তাতে ক্ষোভ নেই। হয়ত লাভই আছে। স্বাজাতিকতার আধুনিক ধারণা, ইংরেজীতে যাকে বলে ন্যাশন্যালইজম, তার বেশিটা আমরা পেয়েছি ইংরেজী শিক্ষার ফলে। কিন্তু এদেশে বিদ্যা, বুদ্ধি এবং কর্মকুশলতার মাপকাঠিও দাঁড়িয়েছে ইংরেজী বলা ও লেখার কৃতিত্বে। এটা হাস্যকর। কলেজে পরীক্ষার খাতায় যে ছেলে ভালো ইংরেজী লেখে, চাকরির বাজার থেকে বিবাহযোগ্য কন্যার উদ্বিগ্না জননী পর্যন্ত সর্বত্র তার আদর আছে। এ-দেশের নেতাদের সম্পর্কেও তাই বিদেশী পর্যটকেরা যখন বলেন যে he speaks faultless English আমরা তখন আনন্দে গদগদ হই। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা সতেজ প্রতিবাদ আছে মৌলানা আজাদের আচরণে। ক্রীপসই হোন, ভাইসরয়ই হোন, কিংবা স্বয়ং জর্জ দি ফিফথই হোন, যদি আমার সঙ্গে আলাপ করতে আমার ভাষা না বলতে চান বা না পারেন তবে আমিই বা তাঁর ভাষা বলতে যাব কেন? সাবাস!

গান্ধীজি ক্রীপসের কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন প্রায় তিন ঘণ্টা পরে। তাঁকে বারান্দার সিঁড়ি অবধি এগিয়ে দিতে সঙ্গে এলেন ক্রীপস্। মুহূর্তমধ্যে সাংবাদিকেরা চক্রব্যূহ রচনা করলেন তাঁকে ঘিরে। চোখে তাঁদের জিজ্ঞাসা, মুখে তাঁদের আগ্রহ, উত্তেজনা ও উদ্বেগের ছাপ। স্মিতহাস্যে উদ্বেল জনতাকে অভ্যর্থনা করলেন তিনি। বিনাবাক্যে নিরস্ত করলেন বহু উদ্যত প্রশ্ন।

ক্রীপসের রসবোধ আছে। রহস্য করে বললেন, গান্ধীজির হাসি দেখে সাংবাদিকরা যেন ক্রীপস্ প্রস্তাবের গুণ বিচার না করেন। ঘর থেকে বেরোবার সময় মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে তিনি গান্ধীজিকে শিখিয়ে দিয়েছেন। প্রবল হাস্যধ্বনি উত্থিত হলো এই কৌতুকালাপে।

কিন্তু কাশীর পাণ্ডা, বিয়ের ঘটক এবং বীমার দালালের চাইতেও নাছোড়বান্দা আছে জগতে। তার নাম রিপোর্টার। গান্ধীজির আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাইলেন তাঁরা। অঙ্গুলিনির্দেশে ক্রীপকে দেখিয়ে উত্তর করলেন মহাত্মা, ‘ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন, আমার কিছু বলার নেই।’

‘প্রস্তাবটি এমনই চীজ যে, দেখেই আপনি হতবাক?’ প্রশ্ন করলেন এক ঝানু সাংবাদিক।

‘You naughty boy’ বলে প্রসন্ন হাস্যে সমাপ্তি ঘটালেন আলোচনার। মোটরে উঠে যুক্ত করে অভিবাদন করলেন উপস্থিত জনমণ্ডলীকে। প্রস্থান করলেন বিড়লা ভবনোদ্দেশে।

ইনফরমেশন বিভাগের ক্যাম্প হয়েছে পাশের একটি ক্ষুদ্র কক্ষে, সাংবাদিকদের সুবিধার্থে। সেখানে হানা দিচ্ছি আমরা রিপোর্টারের দল প্রত্যহ প্রাতে, দুপুরে, বিকালে ও সন্ধ্যায় অমিত উৎসাহে। যদিও করে কখন কোন ভারতীয় নেতা ক্রীপসের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন তার বেশি আর কিছুই জানার উপায় নেই সেখান থেকে।

ক্যাম্প আপিসের কর্তা জগদীশ নটরাজন, ইণ্ডিয়ান সোশ্যাল রিফর্মার এর প্রতিষ্ঠাতা বম্বের বিখ্যাত সাংবাদিক কে. এস. নটরাজনের পুত্র। পাইওনীয়রের সম্পাদকগোষ্ঠী থেকে এসেছেন গভর্নমেন্টে। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের তথ্য জানেন অনেক, ইংরেজী বলেন স্বচ্ছন্দে, উচ্চারণে নেই তামিলজনোচিত ধ্বনিবিকৃতি। একদিন নৈশ ভোজনের নিমন্ত্রণ ছিল তাঁর গৃহে।

নটরাজন গৃহিণী মাদ্রাজী নন, এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান। তাঁর পিতৃকুল বব্ পরিবারের খ্যাতি আছে টেনিস খেলায়, মাতৃকুলের মূল অনুসন্ধান করা যায় বঙ্গদেশে। তাঁর মাতামহী ব্যানার্জী-কন্যা ছিলেন, সে হিসাবে বল্লাল সেনের সৃষ্ট কৌলীন্য দাবী আছে। পিয়ানো বাজাতে পারেন চমৎকার।

আধুনিক অনেক প্রগতিশীল বাঙালী পরিবারেও ভারতীয় রূপটি খুব স্পষ্ট নয়। গৃহের কর্তা হয়তো বিদ্যার্জন করেছেন বিদেশে। অক্সফোর্ডে ইংরেজী, গ্লাসগোতে এঞ্জিনিয়ারিং, এডিনবরায় ডাক্তারী বা লিঙ্কনস ইনে ব্যারিস্টারী পড়ে দেশে এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কর্মজীবনে, অর্থার্জন করেছেন অজস্র ধারে। তাঁদের বসনে স্যুট, অশনে সুপ এবং আসনে কৌচ। তাঁদের গৃহিণীরা পার্টি দেয়, ক্লাবে যায়, ব্রিজ খেলে পুরুষ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে অসঙ্কোচে। সে গৃহে চাকরেরা রয়, মায়েরা মেমসাব, এবং মেয়েরা মিসিবাবা।

বিলাতে না গিয়ে যাঁরা সাহেব, তাঁরা আরও দুর্ধর্ষ। কংগ্রেস থেকে লীগে যোগ দেওয়া মুসলমানের মতো, হিরোডকে করেন আউটহিরোড। শিপিং পায়জামা না পরে ঘুমোনো বা ছুরিকাঁটা দিয়ে না খাওয়াকে তাঁরা প্রায় মধ্যযুগের গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন বা সতীদাহের ন্যায় রোমহর্ষক বর্বরতা জ্ঞান করে থাকেন।

তবুও একথা মানতে হবে যে, ইংরেজ অথবা এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বিয়ে করে আমরা আমাদের সংস্কৃতির মূল থেকে যেমন নিঃশেষে উৎপাটিত হই এমন আর কিছুতেই নয়। বাঙালী গৃহিণীরা যতই চুল খাটো করুক, গিমলেট গিলুক, রং করা ঠোঁটের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ফিরিঙ্গী উচ্চারণে ভুল ইংরেজী বলুক, সংস্কার থাকে Coty বা ম্যাকফ্যাক্টর-ঘ্যা চামড়ার তলায়। রক্তে থাকে ঠাকুরমা দিদিমাদের অন্ধবিশ্বাসের রেড কর্পাসল। তাই মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করতে খোঁজ পড়ে গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার, স্বামীর অসুখে লুকিয়ে মানত করেন সুবচনীর, ছেলের কল্যাণ কামনায় ষষ্ঠীর দিনে থাকেন উপোস। পুরুষেরা হোটেলে যতই খান স্টেক বা ভিল, মা-বাবার শ্রাদ্ধ করেন গুরু পুরোহিত ডাকিয়ে যথারীতি।

সব চেয়ে দুর্ভাগ্য ভারতীয় ও য়ুরোপীয় জনক-জননীর সন্তানেরা। তারা পিতার সমাজ থেকে বিচ্যুত, মাতার সমাজ দ্বারা বর্জিত। তারা না ভারতবর্ষের, না ইংলণ্ডের। কোন দেশের প্রতি তাদের দেশাত্মবোধ জাগবে, কোন জাতির প্রতি মমত্ববোধ? তারা বাবার কাছে পাবে নামের পদবী, মায়ের কাছে থেকে পাবে গায়ের রং, কার কাছ থেকে পাবে মনোভাব? তারা সত্যিকার বর্ণসঙ্কর, শুধু জন্মে নয়, আকৃতিতে ও প্রকৃতিতে। ভারতীয়-য়ুরোপীয় বিবাহজাত সন্তানেরা আজ পর্যন্ত হয়নি কোনো উঁচু দরের শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক বা সঙ্গীতজ্ঞ। তাদের দৌড় বড় জোর রেলের বড় সাহেব নয় তো টেলীগ্রাফের ডিরেক্টর।

য়ুরোপের সমাজ অনেকটা সার্বজনীন। ইংলণ্ড থেকে ইটালী পর্যন্ত মোটামুটি তার একই রূপ। ইংরেজ, ফরাসী, চেক, হাঙ্গেরিয়ানের প্রায় একই বেশ, একই পরিবেশ, একই আচার-আচরণ। সমগ্র য়ুরোপে লোক ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার ও সাপারে বসে ঘড়ি ধরে, খায় ছুরি কাঁটায়। থিয়েটারে যায় শনিবারে রাত্রে, গির্জায় জানুপেতে ভজনা করে রবিবারে। ভাষার বিভেদ ছাড়া য়ুরোপের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে সামাজিক মিল আছে সর্বত্র। লণ্ডনের ইংরেজ স্বামীর অস্ট্রিয়ান স্ত্রীকে দেখেছি অন্য আর পাঁচজন ইংরেজ গৃহিণীর মতো অনায়াসে সমাজে প্রতিষ্ঠিতা। স্বামী, পুত্র, কন্যা, নিয়ে তার গৃহের সঙ্গে আর পাঁচটি ইংরেজ পরিবারের নেই তফাত। ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে ঠিক অন্য আর পাঁচটি ডিক, পল বা হ্যারিংটন পুত্র-কন্যার মতো।

অবশ্য সমস্যা যে একেবারে নেই, তা নয়। সে সমস্যা প্রাত্যহিক জীবনে প্রত্যক্ষগোচর নয় কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষণে দেখা দেয় স্বামী-স্ত্রীর মনে। যেমন লর্ডসে টেস্ট ম্যাচের সময় কোন পক্ষের এ্যাশেজ লাভ কামনা করবে ইংরেজ স্বামী আর অস্ট্রেলিয়ান স্ত্রী? মহাযুদ্ধে কার জয়লাভে উৎফুল্ল হবে জার্মান মিস্টার, কোন পক্ষের পরাজয়ে মুহ্যমান হবেন তাঁর রাশিয়ান মিসেস?

তবুও দূর ভবিষ্যতে কোন দিন য়ুনাইটেড স্টেট্স অব য়ুরোপ যদি গড়ে ওঠে, যদি সম্ভব হয় এক কথা ভাষা, তবে কল্পনা করা কঠিন নয় য়ুরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে অধিকতর বৈবাহিক যোগাযোগ। তখন স্পেনের তরুণ হামেশা বিয়ে করবে নরওয়ের তরুণী ঠিক যেমন এখন করে স্কচেরা ওয়েলসের। যেমন আমাদের কোন্নগরের কনেকে ঘরে নিয়ে আসে বরিশালের বর।

ভারতীয় ও য়ুরোপীয় জীবনের মর্ম আলাদা, সমাজের গঠন বিভিন্ন। একান্নবর্তী পরিবারের কথা বাদ দিলেও আমাদের সমাজ কেবল ব্যক্তি ও তার স্ত্রীপুত্রের মধ্যেই নিবদ্ধ নয়। বহু আত্মীয়-পরিজনগোষ্ঠীর প্রতি নানাবিধ দায়িত্ব এবং সম্পর্কের দ্বারা তার প্রভাব ও ক্ষেত্র দূরপ্রসারিত। তাই পূর্ব পশ্চিমের বৈবাহিক যোগাযোগে ব্যক্তিগত জীবন সুখের হওয়া হয়তো বিচিত্র নয়, কিন্তু তা দ্বারা কোনোকালে ঘটবে না দুই মহাদেশের সামাজিক মিলন। য়ুরোপের স্ত্রীলোক মাত্রই আমাদের পক্ষে পরস্ত্রী।

নটরাজনের ভোজ সভায় পরিচয় ঘটল এক মারাঠি ব্রাহ্মণের সঙ্গে। বয়স চল্লিশের অনেক উপরে, মাথায় কালোর চাইতে সাদার ছোপ বেশি, বলিষ্ঠ দেহ, প্রশস্ত ললাট, উন্নত নাসা। সব চেয়ে আশ্চর্য তাঁর চোখ দুটি। দীর্ঘায়ত নয়ন, অবনী ঠাকুরের আঁকা ভারতীয় চিত্রকলার অর্জুনের মতো। তাতে অপরিসীম ক্লান্তির ছাপ। দৃষ্টিতে বুদ্ধির দীপ্তি আছে বটে, কিন্তু তাকে ছাপিয়ে আছে আষাঢ়ের জলভারনত ঘনমেঘের মতো কালো গম্ভীর ছায়া। সাধারণত চোখে পড়ে না পুরুষের এমন অসাধারণ চোখ।

কিন্তু নয়াদিল্লীর সোসাইটিতে চারুদত্ত আধারকারের খ্যাতি পানীয়ঘটিত। এক বৈঠকে তিনি দশ পেগ হুইস্কি পান করতে পারেন অবলীলাক্রমে। চোখের পাতা কাঁপবে না এতটুকু। সেটা অভূতপূর্ব নয়। আরও দু’চার জন পারেন তা। কিন্তু আধারকারের কৃতিত্ব শুধু পানীয়ের গ্রহণ নয়, উদভাবনেও। সংখ্যাতীত মিক্সিং জানা আছে চারুদত্তের। ককটেল তৈরির বহু পদ্ধতি তাঁর নখাগ্রে। ডিনারে, পার্টিতে নিমন্ত্রণকারিণীরা আগে ভাগে পরামর্শ করেন আধারকারের সঙ্গে। মহানন্দে মন্ত্রণা দেন তিনি। ‘কে কে আসছে, কতজন আসছে? যদি তিন রাউন্ডেই ঘায়েল করতে চাও, তবে প্রথমে দাও রাম অরেঞ্জ, তারপর জিন অ্যাণ্ড লাইম। তারপর হুইস্কি। মেয়েদের জন্য মাঝখানে ব্রাণ্ডি দিতে পার জিঞ্জারেলের সঙ্গে মিশিয়ে। কী বললে, রাম-অরেঞ্জ কেমন করে করবে জানো না! হোয়াট এ পিটি! আচ্ছা শিখিয়ে দিচ্ছি। shaker এর মধ্যে সিকি ভাগ নাও ইটালিয়ান ভারমুথ। ইটালিয়ান নেই? আচ্ছা অভাবে ফ্রেঞ্চই দাও। মেশাও সিকি ভাগ কমলালেবুর রস, অর্ধেক ঢালো রাম। বেশি করে বরফ, আর সামান্য একটু দারুচিনির রস। ব্যস। আচ্ছা করে মিশিয়ে এবার ককটেল গ্লাসে পরিবেশন কর।’

নটরাজন গৃহিণী বললেন, ‘মিনি সাহেব, (আমার মিনি সাহেব নামটা সেন সাহেবের অন্দরমহল থেকে বাহির বিশ্বে ছড়িয়ে পরেছে বন্ধুজনের সকৌতুক সম্বোধনে) যদি নতুন নতুন ককটেল চাখতে চান তো মিস্টার আধারকারের বুদ্ধি নেবেন।’

স্মিত হাস্যে আধারকার বললেন, ‘হ্যাঁ, চাকরি থেকে রিটায়ার করে আমার রেসিপিগুলোর পেটেন্ট নেবো ভাবছি। কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবো-।f it’s a drink. consult আধারকার। ঘরে ঘরে মিসেস বিটনের মতো নতুন গৃহিণীদের আলমারিতে থাকবে আধারকার’স বুক অব ড্রিঙ্কস্।’

কিন্তু আমার জন্যে এ সবের চেয়েও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ভোজন পর্বের শেষে অতিথিদের সনির্বন্ধ অনুরোধে বেহালা বাজিয়ে শোনালেন আধারকার। দরবারী কানেড়ার সুর। গৎ নয়, শুধু আলাপ। প্রায় মিনিট কুড়ি ধরে বাজালেন অপূর্ব দক্ষতায়। বাজনা শেষে আমার পানে তাকিয়ে বললেন, ‘বলতে পারো কী সুর বাজালেম, মিনি সাহেব?’

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলেম খানিকক্ষণ, উত্তর দেওয়ার কথাই মনে রইল না। পরিষ্কার বাংলা।

‘কী একেবারে থ’ হয়ে রইলে যে?’ এবারও বাংলায়।

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেম, ‘আপনি আশ্চর্য। বাংলা শিখলেন কেমন করে?’

‘এটি একটা প্রশ্ন? তুমি ইংরেজী শিখেছ কেমন করে?’

‘আমি শিখেছি পেটের দায়ে।’

‘আমি শিখেছি প্রাণের দায়ে। না, না, আর প্রশ্ন নয়, curiosity is a feminine vice.’

বিদায় দেওয়ার আগে আন্তরিকতার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ‘মিনি সাহেব, ‘তুমি’ বলছি বলে চটোনি তো মনে মনে? তুমি তো বয়সে অনেক ছোটই হবে। আমি থাকি রটেণ্ডাম রোডে, বাইশ নম্বর। এস একদিন সন্ধ্যাবেলা, বাংলা বলবো, বেহালা শোনাবো, আর দেব টপ-হ্যাট। টপ-হ্যাট জানো তো? জানো না? অর্ধেক জিন, সিকিভাগ ফ্রেঞ্চ ভারমুথ, সিকিভাগ ইটালিয়ান। একফোঁটা বিটার্স, তার সঙ্গে খুব খানিকটা বরফ।’

আধারকারের বাড়িতে গেলেম। টপ-হ্যাটের লোভে নয়, লোকটির আশ্চর্য আকর্ষণ। একদিন গেলেম, দু’দিন গেলেম। তারপর প্রত্যহ। কখনও বা সকালে এবং বিকেলে। অনেকদিন ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ডিনার পর্যন্ত সবই সমাধা হয়েছে তাঁর ওখানে। অল্প সময়ে আন্তরিকতা এত ঘনিষ্ঠ হলো যে, আধারকার পুরুষ না হলে নিন্দুকের কু সারটনায় কলঙ্কিত হতে পারতো আমার নাম। তাঁর বিবাহযোগ্যা কন্যা থাকলে নয়াদিল্লীর গৃহিণীরা সম্ভবপর বর কল্পনা করে মুখরোচক আলোচনায় অবসর বিনোদন করতে পারতেন অলস মধ্যাহ্নে।

কিন্তু কন্যা দূরে থাক, কন্যার জননীর চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না অকৃতদার আধারকারের গৃহে। গোটা তিন চার চাকর, বেয়ারা খানসামা নিয়ে আধারকারের হোম গভর্নমেন্ট। তার একমাত্র রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের ভার তাঁর নিজের, বাকি এক্সিকিউটিভ, লেজিস্‌লেটিভ, মায় জুডিশিয়ারী পর্যন্ত সমস্তটাই চাকরদের হাতে। খাঁটি প্রজাতন্ত্র। মজাতন্ত্র বললেও ক্ষতি নেই, ভৃত্যদের পক্ষে।

তর্ক চলে, আলোচনা হয়। রাজনীতি, ধর্ম, ওয়র স্ট্র্যাটেজী, মায় সিনেমা স্টার পর্যন্ত কোন বিষয় বাদ পড়ে না। মাঝে মাঝে হয় কাব্যালোচনা। রবি ঠাকুরের বহু কবিতা ও কবিতাংশ আধারকারের কণ্ঠস্থ। গভীর কণ্ঠে আবৃত্তি করেন—মন দেয়া নেয়া অনেক করেছি মরেছি হাজার মরণে, নূপুরের মতো বেজেছি চরণে চরণে। আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘বল, কোথায় আছে?’ বলতে পারলে বলেন, ‘সাবাস্! Now you have earned a drink, নাও একটা অরেঞ্জ গিমলেট — খানিকটা জিন ও কমলালেবুর রস। এই বয়, সারকোবাস্তে—’ কোনো দিন বলেন, ‘আজ পরীক্ষা। বল, কোথায় আছে— আমারে যে ডাক দেবে তারে বারংবার এ জীবনে ফিরেছি ডাকিয়া; সে নারী বিচিত্র বেশে, মৃদু হেসে, খুলিয়াছে দ্বার থাকিয়া থাকিয়া।’

‘পারলে না? আচ্ছা আর পাঁচ মিনিট সময় দিলুম। তবু পারলে না, হাঃ, হাঃ, বাঙালী হয়ে বাংলা কবিতার বাজিতে অবাঙালীর কাছে হারলে। লোকে শুনলে বলবে কী হে? আচ্ছা আগে মাথা সাফ্ করে নাও। বয়, লাও একঠো ব্রুকলীন। একটা টাম্বলারে অর্ধেকটা বরফের টুকরো, কিছুটা ফ্রেঞ্চস্টাইল ভারমুথ, কিছুটা ড্রাই জিন। আচ্ছা করে নেড়ে দুফোঁটা অরেঞ্জ বিটার্স। ডিল্লিসস।’

একদিন জিজ্ঞাসা করেন, ‘মিনি সাহেব, প্রেমে পড়েছ কখনও?’

‘না।’

‘বল কী হে, ইয়ং ম্যান, বিলেতে ছিলে, প্রেমে পড়নি, একথা বিশ্বাস করবে কে?’

‘বিশ্বাস করা উচিত। There are more things in heaven and earth…’

‘কিন্তু There are more girls in Piccadilly and Leicester Square ওতো বটে।’

‘আসল কথা কী জানেন? প্রেমে পড়লে চেহারাটা বড্ড বোকা বোকা দেখায়, সিনেমায় দেখেছি। সে ভয়ে এগোতে সাহস করিনি।’

উচ্চ হাস্যে ফেটে পড়লেন আধারকার। ‘বোকা বোকা দেখায়, হাঃ, হাঃ, হাঃ, Just imagine প্রেমে না পড়ার কারণ। বার্নার্ড শ’ এর চাইতে ভালো কিছু বলতে পারতেন না। তুমি একটি genius। না, তোমাকে আজ নতুন কিছু না দিতে পারলে মান থাকে না। Try রাম ব্রুইয়ট। চার চামচে রাম, এক চামচে লাইম, এক রত্তি চিনি, আধ পেয়ালা ব্ল্যাক কফির সঙ্গে মিশিয়ে। ওয়াণ্ডারফুল।’

দিনের পর দিন বাড়ে বিস্ময়। ক্রমশ আকৃষ্ট হই এই মারাঠা ব্রাহ্মণের প্রতি। আশ্চর্য এর জীবন। কাব্যে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, শিল্পে গভীর এর অনুরাগ, বেহালা বাদনে অসাধারণ এর দক্ষতা। আয় করেন প্রচুর, ব্যয় করে প্রচুরতর। বেশির ভাগই মদ খাওয়া এবং খাওয়ানোর। অথচ অশোভন আচরণ করতে দেখিনি কখনও। দম্ভ করে বলেন, ‘মিনি সাহেব, তোমাদের শরৎ চাটুয্যে লিখেছেন, যে মদ খায় সে কোনো দিন না কোনো দিন মাতাল হয়েছে নিশ্চয়। যে অস্বীকার করে সে হয় মিছে কথা বলে, নয় তো মদের বদলে জল খায়। শরৎ চাটুয্যে দেখেননি চারুদত্ত আধারকারকে। দেখলে বই থেকে ঐ লাইন দুটি তুলে দিতেন।’

স্ত্রী নেই আধারকারের সে-কথা সবাই জানে। কিন্তু আত্মীয়, পরিজন? কারও জানা নেই কোনো তথ্য। হাসিতে, খুশিতে, গল্পে, গুজবে, সরগরম রাখেন মজলিস, মুখরিত করেন নিজ গৃহের প্রাত্যহিক বন্ধুসমাগম। তবু চোখের দিকে তাকালে মনে হয় এহ বাহ্য। কী এক গভীর দুঃখের ভার পুঞ্জীভূত হয়ে আছে ঐ ভারানত নয়নের অন্তরালে নিঃসঙ্গ জীবনের পশ্চাতে আছে অপরিসীম বেদনার ইতিহাস। কিন্তু কৌশলে প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে আবৃত্তি করেন আধারকার,

আমারে পাছে সহজে বোঝ তাইতো এত লীলার ছল:

বাহিরে যার হাসির ছটা, ভিতরে তার চোখের জল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *