দৃষ্টিপাত – ৪

চার

নিজামুদ্দিনের দরগায় প্রবেশ করে আজও প্রথমেই চোখে পড়ে আউলিয়া খনিত পুকুর। তার পাশ দিয়ে আসা গেল এক প্রশস্ত চতুরে যার মাঝখানে সমাধিস্থ হয়েছে ফকিরের দেহ। সমাধির উপরে ও আশেপাশে হয়েছে সুদৃশ্য ভবন ও অলিন্দ। উত্তরকালে সম্রাট শাজাহান সমাধির চারদিকে ঘিরে তৈরি করেছেন শ্বেত পাথরের খিলান; প্রাঙ্গণ বেষ্টিত করেছেন সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত জালিকাটা পাথরের দেয়ালে। দ্বিতীয় আকবর রচনা করেছেন সমাধির উপরিস্থ গম্বুজ। ফকিরের পুণ্য নামের সঙ্গে আপনাকে যুক্ত করে নিজেকে তাঁরা ধন্য জ্ঞান করেছেন।

গিয়াসুদ্দিনের রাজধানী তোগ্‌লকাবাদ আজ বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বিবিসিআই রেলওয়ে লাইন গেছে তার উপর দিয়ে। একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণায় এবং টুরিস্টদের দ্রষ্টব্য হিসাবে আজ তার গুরুত্ব। নিজামুদ্দিনের দরগায় আজও মেলা বসে প্রতি বছর। দূর-দূরান্ত থেকে পুণ্যকামীরা আসে দর্শনাকাঙ্ক্ষায়। সেদিনের রাজধানী তার অভ্রভেদী অহংকার নিয়ে বহুদিন আগে মিশেছে ধূলায়; দীন সন্ন্যাসীর মহিমা পুরুষানুক্রমে ভক্তজনের সশ্রদ্ধ অন্তরের মধ্য দিয়ে রয়েছে অম্লান। তার আকর্ষণ দূরকালে প্রসারিত।

হিন্দুর অন্তিম অভিলাষ গঙ্গাতীরে দেহরক্ষার ন্যায় শত শত বর্ষ ধরে দিল্লির বিত্তশালীরা কামনা করেছেন আউলিয়ার কবরের নিকটে সমাধিস্থ হতে চেয়েছেন জীবনান্তে ‘মীর মজলীসে’র সান্নিধ্য। তাই তার আশেপাশে আছে সংখ্যাতীত আমীর ওমরাহের সমাধি। তারই মধ্যে একটি গর্ভে আছে কবি আমার খসরুর দেহাবশেষ।

খসরুর প্রতিভা ছিল বিস্ময়কর; খ্যাতি ছিল বহুবিস্তৃত। দিল্লি কবিগোষ্ঠীতে তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ। আলাউদ্দিন খিলজীর কাব্যরসিক পুত্র খিজির খানের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল গভীর। আপন অনুপম ছন্দে গ্রন্থিত করে খিজির খানের বীরত্ব-কাহিনীকে তিনি কালজয়ী অমরত্ব দান করে গেছেন।

নিজামুদ্দিনের সংলগ্ন সমাধিক্ষেত্রে আর একজন কবি রয়েছে চিরনিদ্রিত, যাঁর রচনা আজও উর্দু সাহিত্যে অজাতশত্রু। কবি গালিবের সমাধিটি আড়ম্বরহীন, সাধারণ প্রস্তর বেদিকায় মাত্র আবৃত। ঊনবিংশ শতাব্দীর উর্দু সাহিত্য অম্লান রেখেছে তাঁর স্মৃতি, কাব্যে ও গাথায়। জগতে বহু ঐশ্বর্যময় সৌধ রচিত হয় অক্ষম ব্যক্তিদের সমাধির উপরে। কিন্তু কবি পরে ভার থাকে নিজ মেমোরিয়্যালের।

হিন্দু যুগে রেওয়াজ ছিল না স্মৃতিসৌধের। তার কারণ মরলোকের চাইতে পরলোকের দিকে হিন্দুদের দৃষ্টি ছিল বেশি। তাই শ্মশানে দালান খাড়া করে প্রিয়জনের স্মৃতি অক্ষয় করার কথা কখনও তাদের মনে হয়নি। মৌর্যরাজদের আমল থেকে পৃথ্বীরাজ পর্যন্ত কোনো হিন্দু রাজা রাখেননি কোন স্মৃতি সৌধ। রাজপুত রাজন্যেরা গড়েননি কোনো এতমদ্দৌলা, সফদারজঙ্গ বা হুমায়ুন’স টুম্ব। তাঁরা জলাশয় খনন করেছেন, মন্দির স্থাপন করেছেন, ভূমিদান, গোদান করেছেন ব্রাহ্মণকে। সমস্তই জগৎ-হিতায় অশোক যে স্তম্ভ রচনা করেছিলেন, তা নিজ কীর্তি ঘোষণার জন্য নয়, জনশিক্ষার উদ্দেশ্যে। বুদ্ধ গড়েছিলেন চৈত্য ও বিহার সঙ্ঘের জন্য, শঙ্করাচার্য স্থাপন করেছেন মঠ বেদান্তচর্চার মানসে।

সে যুগে হিন্দুর জীবনে শেষ কথা ছিল ভক্তি। সূর্যমুখী ফুলের মতো তার সমস্ত কর্ম, চিন্তা, ধ্যান, ধারণা, সাক্ষাৎ বা পরোক্ষভাবে ভগবানের নামে ঊর্ধ্বমুখীন। ঐহিক সম্পর্ককে তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। যখন কা তব কান্তা কস্তে পুত্র, তখন প্রেম দিয়ে আর হবে কী? ময়াময়মিদম অখিলং বিশ্বম। কাজেই পিতাকে হতে হয়েছে পরমং তপঃ, স্বামীকে হতে হয়েছে পতিদেবতা, স্ত্রীকে হতে হয়েছে সহধর্মিণী। নারী যে সহমৃতা হয়েছে তার কতটা প্রেমের আকর্ষণে আর কতটা পুণ্যলোভবশে তা বলা শক্ত। স্বয়ংবরা যাঁরা হয়েছেন, তাঁরা প্রেমে পড়ে নয়। সংযুক্তা পৃথ্বীরাজের গলায় মালা দিয়েছিলেন তাঁর খ্যাতি ও বৈভবের জন্য যেমন একালের তরুণীরা আংটি পরিয়ে দেন আই.সি. এসের অঙ্গুলিতে।

মুসলমানেরাই আনল ভিন্ন জীবনাদর্শ। বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে তাদের নয়। তারা পরকালকে থোড়াই পরোয়া করল, ইহকালকে করল সর্বস্ব। তারা জীবনকে করল ভোগ, কাঁদল, কাঁদালো এবং ভালোবাসল। তাই নারীর জন্য করল লুণ্ঠন, প্রেমের জন্য করল অপহরণ এবং প্রিয়জনের জন্য হনন ও বহু অপকর্ম সাধন। বলা বাহুল্য, এর সবগুলি সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু প্রেম কি কারও সমর্থনের অপেক্ষা রাখে? মেনে চলে নীতির অনুশাসন? অহল্যা করেছে সমাজের বা শাস্ত্রের সমর্থনের অপেক্ষা? মহাভারতের অর্জুন করেছে? বৃন্দাবনের কানু করেছে? করেছে রিজিয়া বেগম, মেরী ওয়ালেউস্কা বা লেডি হ্যামিল্টন?

মুসলমানেরা প্রিয়তম প্রিয়তমার স্মৃতিকে করতে চেয়েছে কালজয়ী। রাখতে চেয়েছে স্মারকচিহ্ন। তাই সৌধ গড়েছে পিতার, পতির, পত্নীর এমন কি উপপত্নীর সমাধিতে। হিন্দু তপস্বী, তারা দিয়েছে বেদ ও উপনিষদ। মুসলমানেরা শিল্পী, তারা দিয়েছে তাজ ও রঙমহল। হিন্দুরা সাধক, তারা দিয়েছে দর্শন। মুসলমানেরা গুণী, তারা দিয়েছে সঙ্গীত। হিন্দুর গর্ব মেধার, মুসলমানের গৌরব হৃদয়ের। এই দুই নিয়েই ছিল ভারতবর্ষের অতীত: এই দুই নিয়েই হবে তার ভবিষ্যৎ। একটিকে বাদ দিলেই পাকিস্তান, মিস্টার মহম্মদ আলি জিন্না না চাইলেও।

যাত্রাসহচরী দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন একটি ক্ষুদ্র মর্মর সমাধির প্রতি। সেই সম্রাটদুহিতা জাহানারার।

ইতিহাসে সম্রাট আলমগীরের শাসন বিধর্মী নির্যাতনের দূরপনেয় কলঙ্কে মলিন; সে-তথ্য স্কুলপাঠ্য পুস্তকে আছে। কিন্তু এই হৃদয়হীন অথচ অমিত বিক্রম যোদ্ধা নৃপতির জীবন যে দুটি বিশিষ্ট উপদ্রুতা বন্দিনীর উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসে অভিশপ্ত ছিল, সে-কথা যথোচিত বিদত নয় জগতে।

জাহানারা ও জেবুন্নেসা দু’জনেই ছিল আওরঙ্গজেবের অতি নিকটতম আত্মীয়া। একজন অনুজা, অপর জন আত্মজা, দু’জনেই ছিলেন রূপসী, দু’জনেই ছিলেন অসাধারণ নির্ভীক ও তেজস্বিনী। দু’জনেই চিরকুমারী এবং দু’জনেরই জীবনের সুদীর্ঘকাল কেটেছে আওরঙ্গজেবের কারাগৃহে।

কিন্তু আরও এক জায়গায় এই দুই দুর্ভাগিনীর মিল ছিল গভীরতর। তারা দু’জনেই ছিলেন কবি। মুঘল যুগের মহিলা কবি।

জাহানারার সমগ্র রচনা সযত্নে রক্ষিত হয়নি। গহন অরণ্যে প্রস্ফুটিত পুষ্পের মতো প্রায় সবই লোকচক্ষুর অন্তরালে ধূলিতে হয়েছে বিলীন। দু’একটি মাত্র নিদর্শন আছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত।

জেবুন্নেসার কাব্যখ্যাতি অধিকতর বিস্তৃত। ‘জেব উ-মুনশোয়াতে’ সত্যিকার কাব্যপ্রতিভার চিহ্ন আছে। বিখ্যাত পার্শী কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ানে মীর’ রচয়িত্রীরূপেও জেবুন্নেসার উল্লেখ আছে অনেক গ্রন্থে, যদিও পণ্ডিতেরা সম্প্রতি সে-বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

জাহানারা আমাকে আকৃষ্ট করেছেন শৈশব থেকে। ইতিহাস পরীক্ষার পূর্বক্ষণে সন তারিখে কণ্টাকাকীর্ণ মুঘল কাহিনী কণ্ঠস্থ করার দুরূহ প্রয়াস করতেম প্রাণপণে দীর্ঘরাত্রিব্যাপী। ঘুমে চোখের পাতা আসতো জড়িয়ে, দেহ হত অলস, মাথা ঝিমিয়ে পড়তো ঢুলুনিতে। এরই মধ্যে জাহানারার উপাখ্যান পড়ে কল্পনায় আঁচ করার চেষ্টা করতেম তাঁর চেহারা।

প্রথম যৌবনে জাহানারা বাদশাহ বেগমের মর্যাদা ভোগ করেছেন বিপুল মহিমায়। হারেমে করেছেন একাধিপত্য। অপ্রতিহত অনুগ্রহ ও শাসন বিতরণ করেছেন দুই হস্তে। কন্যাদের মধ্যে তিনি ছিলেন শাজাহানের প্রিয়তরা। তাঁর জন্য সম্রাট তৈরি করেছিলেন দিল্লির জুম্মা মসজিদ, ভারতের বৃহত্তম মুসলিম ভজনালয়।

জাহানারার স্নেহভাজন ছিলেন এক বাঁদী। অতর্কিতে একদিন আগুন লাগল তার বসনে। সে আগুন নেভাতে গিয়ে শাহজাদী নিজে দগ্ধ হলেন সাংঘাতিকরূপে। রাজ্যের নানা জায়গা থেকে এল হাকিম, হলো নানারকম এলাজ। কিন্তু ফল হলো না কিছুই। সম্রাটনন্দিনীর জীবন সংশয় দেখা দিল।

বিচলিত শাজাহান এত্তালা দিলেন এক সাহেব চিকিৎসককে। গ্যাব্রিয়েল বাউটন। সুরাটে ইংরেজ কুঠির ডাক্তার। বাউটন বললেন, ওষুধ দিতে হলে রোগিনীকে চোখে দেখা চাই। শুনে সভাসদরা হতবাক হলেন। বলে কি বেয়াদব! শাহানশাহ বাদশাহের জেনানা মানে না কমবক্ত?

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিতৃস্নেহ জয়লাভ করল সামাজিক প্রথার উপরে। শাজাহান সম্মত হলেন বাউটনের প্রস্তাবে। অল্পকাল মধ্যে আরোগ্যলাভ করলেন জাহানারা। তাঁর অনুরোধে শাজাহান বাউটনকে দিতে চাইলেন পুরস্কার, যা চাইবে তাই পাবে।

আভূমিনত কুর্নিশ করে বাউটন বললেন, নিজের জন্য কিছুই চাইনে। কলকাতার একশ’ চল্লিশ মাইল দক্ষিণে বালাশোরে ইংরেজের কুঠি নির্মাণের জন্য প্রার্থনা করি একটুকরো ভূমিখণ্ড। ইংরেজকে দান করুন এদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার।

বাউটনের প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। স্বজাতিহিতৈষণার এত বড় দৃষ্টান্ত আর একটি মাত্র আছে আধুনিক কালে। সেটি ইহুদী বৈজ্ঞানিক ডক্টর কাইম ভাইজমানের।

উনিশ শ’ ষোল সালে প্রথম মহাযুদ্ধের সঙ্কটজনক কাল, ইংলন্ডে বিস্ফোরক উ ৎপাদনের অপরিহার্য উপাদান অ্যাসিটোনের অভাব, তখন কৃত্রিম অ্যাসিটোন তৈরির ভার নিলেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক। প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ বললেন, প্রফেসর, সমগ্র ব্রিটেনের ভাগ্য নির্ভর করছে তোমার সফলতা বিফলতার উপরে। আমি চাই তাড়াতাড়ি কাজ, তাড়াতাড়ি ফললাভ।

অধ্যাপক বললেন, তথাস্তু।

দিবারাত্রি অবিশ্রান্ত পরিশ্রমে সপ্তাহ কয়েকের মধ্যে আবিষ্কার করলেন কৃত্রিম অ্যাসিটোন। পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করলেন ব্রিটেনকে এই বৈজ্ঞানিক অধ্যাপক ভাইজমান।

কৃতজ্ঞ লয়েড জর্জ তাঁকে ডেকে দিতে চাইলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

ভাইজমান প্রত্যাখ্যান করলেন সবিনয়ে।

লয়েড জর্জ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, পিয়ারেজ? অর্থ?

‘কিছু নয়। একটি মাত্র যাঞ্চা আছে আমার। আমার স্বজাতির জন্য চাই নির্দিষ্ট একটি দেশ, ইহুদীদের ন্যাশনাল হোম।’

কিছুকাল পরে বালফোর ঘোষণায় ইহুদীদের জন্য প্যালেস্টাইনে নির্দিষ্ট হলো জাতীয় বাসস্থান। অবশ্য কাগজেপত্রে। আজও প্রকৃত অধিকার স্থাপিত হলো না ইহুদীদের। বরং ইদানীং কনসার্ভেটিভরা প্যালেস্টাইনে আরবদেরই করতে চাইছে সুয়োরানী, মধ্য প্রাচ্যে ইংরেজ প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখবার প্রয়োজনে। কৃতজ্ঞতা কথাটা আছে ইংরেজের ভাষায়, নেই ইংরেজের চরিত্রে।

জাহানারার অনুগ্রহে ইংরেজেরা বাণিজ্য নিরঙ্কুশ করলেন ভারতবর্ষে, সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনা করলেন সকলের অলক্ষ্যে। সেই জাহানারার চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করে ইতিহাস রচনা করেছে ইংরেজ। এতো বিস্মিত হইনে। যে সিভিলিয়ান ভারতবর্ষের পেন্সনে স্ট্যাফোর্ডশায়ারে বাড়ি হাঁকিয়ে আছেন, তিনিই ভারতের নিন্দা করেন সবচেয়ে জোর গলায়। লিওপোল্ড এমারীই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় শত্রু, কারণ তার জন্ম গোরখপুরে।

জাহানারার জীবননাট্যের শেষ দৃশ্যগুলি বেদনাবিধুর।

শাজাহানের পুত্রদের মধ্যে দারাশিকো ছিলেন পিতার সর্বাপেক্ষা প্রীতিভাজন। কিন্তু তাঁর অনুরক্তি ছিল খ্রীস্ট ধর্মে। সেটা মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তার কারণ নয়। পিতার অসুস্থতার সংবাদে সুজা সৈন্যসামন্ত নিয়ে রওনা হলেন দিল্লি অভিমুখে। বারাণসীর যুদ্ধে দারা তাঁকে করলেন পরাজিত। আওরঙ্গজেব তখন মোরাদকে বললেন, এ ছলনা চাতুরীময় পৃথিবীর কোনো কিছুতেই লোভ নেই তাঁর। তাঁরা দু’জনে মিলে দারাকে পরাজিত করলে শাজাহান যদি পরলোকগত হন—আল্লাহর দোয়ায় তিনি যেন সেরে ওঠেন—তবে দিল্লির সিংহাসন হবে তাঁর অর্থাৎ মোরাদের। মদ্যপ মোরাদের প্রতীতি হলো এই আশ্বাসে। দারা পরাজিত হয়ে পলায়ন করলেন পাঞ্জাবে এক উৎসব রজনীর অবসানে সুরামত্ত মোরাদ হলো বন্দী, আওরঙ্গজেব নিজেকে ঘোষণা করলেন সম্রাটরূপে। পিতা শাজাহানকে কয়েদ করে আবদ্ধ করলেন আগ্রা দুর্গের এক ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে।

আওরঙ্গজের জাহানারাকে দিতে চেয়েছিলেন বাদশাহ্-বেগমের পদ। কিন্তু জাহানারা প্রত্যাখ্যান করলেন সে অনুরোধ। স্বেচ্ছায় বরণ করলেন শাজাহানের সহ-বন্দীত্ব। পিতার পরিচর্যার জন্য। চতুর্দিকে ক্রুর প্রবঞ্চনা, সীমাহীন বিশ্বাসঘাতকতার ঘন অন্ধকারের মধ্যে সেদিন একমাত্র জাহানারা রইলেন অচল, অটল, অকম্পিত দীপশিখার মতো দীপ্তিময় শাজাহানের দ্বিতীয় কন্যা রোশেনারা আওরঙ্গজেবের পক্ষ নিলেন, হলেন তাঁর প্রিয়পাত্রী। দিল্লির সিভিল লাইনসে আছে তাঁর উদ্যান। সেখানে এ আমলে স্থাপিত হয়েছে রোশেনারা ক্লাব, দিল্লির মন্টিকার্লো। দশ টাকা পয়েন্টে স্টেকে ব্রিজ খেলার খ্যাতি আছে তার উত্তর ভারতে।

দিনের পর দিন গত হয়, মাসের পর মাস। চক্রাকারে আবর্তিত হয় ষড় ঋতু। গ্রীষ্ম গত হয় তার উত্তাপ ও প্রভঞ্জন আহুতি নিয়ে। বর্ষার মেঘকজ্জল দিবসের দীর্ঘ ছায়া নামে যমুনার কালো জলে। বর্ষণমুখর রাত্রির বিদ্যুৎ চমকে উৎফুল্ল ভবনশিখীরা নৃত্য করে প্রসাদের মর্মর অলিন্দে। শরতের আলো-ছায়া বিজড়িত প্রভাতে নদীতীরে কাশের বনের লাগে দোলা। হেমন্ত আনে কুহেল; শীত দেয় হতাশ্বাস। বসন্তে ফুলের মঞ্জরী আন্দোলিত হয় শিরীষের শাখা প্রশাখায়। আগ্রার প্রাসাদ প্রাচীরের অন্তরালে জাহানারার বন্দী জীবনে একটি করে বৎসর হয় বৃদ্ধি, আয়ু থেকে খসে পড়ে একটি বছর। কর্মহীন অবসরে শাহজাদী কবিতা রচনা করেন আপন মনে।

একদা নিশীথকালে আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে শাজাহানের কাছে এসে পৌঁছল একটি সুদৃশ্য মোড়ক। পুত্র পাঠিয়েছে পিতাকে উপহার। তবে কি অনুতপ্ত পুত্রের ক্ষমা প্রার্থনার প্রথম নিদর্শন? আগ্রহকম্পিত হস্তে বৃদ্ধ শাজাহান খুললেন মোড়ক। পরতের পর পরত। খুলতে খুলতে শেষকালে হাত থেকে গড়িয়ে পড়ল শাজাহানের প্রিয়তম পুত্র দারাশিকোর খণ্ডিত মুণ্ড। সম্রাট মূর্ছিত হয়ে পড়লেন জাহানারার অঙ্কে।

শাজাহানের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জাহানারা রইলেন তাঁর পাশে। স্থবির পিতার পরিচর্যা করলেন অমিত নিষ্ঠা ও অবিচলিত ধৈর্যে। তাঁর মৃত্যুর পর প্রত্যাবর্তন করলেন দিল্লিতে।

অবশেষে রমজানের এক পুণ্য তিথিতে মৃত্যুর শান্তশীতল ক্রোড়ে মুক্তি লাভ করলেন বন্দিনী। তাঁরই ইচ্ছায় তাঁর দেহ সমাধিস্থ হলো ফকির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সমাধির পার্শ্বে। সে সমাধির উপরে না রইল মণ্ডপ, না রইল আচ্ছাদন, না রইল ঐহিক ঐশ্বর্যের লেশমাত্র আভাস। শুধু তাঁরই স্বরচিত একটি কবিতা উৎকীর্ণ হলো তার গায়ে,—

‘বেগায়র সবজা না পোশাদ কসে মাজারে মারা

কে কবর পোষে গড়িবান হামিন গিয়াহ বসন্ত।’

‘একমাত্র ঘাস ছাড়া আর যেন কিছু না থাকে আমার সমাধির উপরে। আমার মতো দীন অভাজনের সেই তো শ্রেষ্ঠ আচ্ছাদন।’

পুণ্যশ্লোক নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অনুগামিনী শাজাহান দুহিতা নশ্বর জাহানারার এই তো যোগ্য সমাধি।

আসন্ন সন্ধ্যায়ান্ত নিস্তব্ধতায় শ্রদ্ধানম্র চিত্তে, সামনে এসে দাঁড়ালেম আমরা তিন দর্শনার্থী। কারো মুখে ছিল না কথা, কিন্তু মনে ছিল ভার।

নব শ্যাম দুর্বাদল ছেয়ে আছে ক্ষুদ্র নিরলঙ্কার সমাধি। নির্মল নীল আকাশ থেকে প্রত্যহ নিশীথে সঞ্চিত হয় বিন্দু বিন্দু শিশির, প্রভাতে স্পর্শ করে তরুণ অরুণের প্রথম কিরণ রেখা, সন্ধ্যায় ছড়িয়ে পড়ে গোধূলি আলোকের সোনালী আভা। তারা কি পায় শতাধিক বর্ষ পূর্বে সমাধিস্থ সেই অঙ্গের ললিত সুবাস? পায় তাঁর সুকুমার বক্ষের নীচে ভক্তিনত হৃদয়ের মৃদু স্পন্দন ধ্বনি?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *