দৃষ্টিপাত – ৩

তিন

গৃহকর্ত্রীর সাত বছরের মেয়ে রেবা এসে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘মিনি সাহেব, ইংরেজ জিতবে কি জাপান জিতবে?’

মিনি সাহেব নামের পিছনে আছে ইতিহাস। শুধু ইতিহাস নয়, ভাষাতত্ত্বও।

বিলাতে গেলে আমাদের প্রথম রূপান্তর ঘটে বেশে, দ্বিতীয় নামে। দেশে থাকতে যারা পল্টু, গদাই, সুরেন কিংবা সুবোধ বিদেশে তারাই সেন, রয়, মিটার অথবা ব্যানার্জী। নয়াদিল্লিটা খাঁটি বিলাত নয়, —এরসাৎস। এখানেও ব্যক্তির পরিচয় নামের আদিতে নয়, অন্তে। পি.এল. আস্থানায় আদ্য অক্ষর দুটি কিসের সংক্ষেপ তা নিয়ে কারও ঔৎসুক্য নেই, শেষের টুকু জানলেই হলো। পদমর্যাদার উপরে নির্ভর করে সম্বোধনের বিশেষণ। কেরানী হলে আস্থানার সাফিক্স বসে বাবু, অফিসার হলে প্রেফিক্স লাগে মিস্টার।

কিন্তু মুখে মুখে কথার ধারা বদল হয়, নামেরও পরিবর্তন ঘটে। বিশেষ করে চাকর, বেয়ারা আর্দালী, পিওনের অশিক্ষিত উচ্চারণে অনেক সময় চলতি বিকৃতি থেকে আসল আকৃতি আঁচ করাই কঠিন হয়। ব্যানার্জী বেনারসী হন, মিঃ ম্যাকার্টিস হন মারকুট্টি সাহেব। সেনগৃহের পরিচারিকা বিলাসিয়ার আদি বাস রামগিরি পর্বতের সানুদেশে। ভাষা কিছুটা দ্রাবিড় এবং কিছুটা আর্য, শব্দের উচ্চারণ মারাত্মক। সুতরাং কবে কেমন করে কোন শব্দের অপভ্রংশ ও কোন শব্দের অর্ধাংশ মিলিয়ে তার মুখে মিনি সাহেবে দাঁড়িয়ে গেছি সে গবেষণায় সুনীতি চাটুয্যের শরণ নিতে হবে।

‘বল না, মিনি সাহেব, কে জিতবে। ইংরেজ না জাপান?’ প্রশ্নকর্ত্রী তাড়া দিলেন।

প্রশ্নটা নতুন নয়। ইতিপূর্বে আরও অনেকের কাছে শুনতে হয়েছে এ জিজ্ঞাসা। জবাব অবশ্য দিতে হয়নি। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশ্নকারী নিজেই দিয়েছেন উত্তর, চেয়েছেন শুধু সমর্থন। যাঁরা তা দেননি, তাঁরাও কী শুনলে খুশি হবেন সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ মাত্র রাখেননি কখন, ঠিক যেমন স্ত্রী স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেন, নতুন শাড়িটায় তাঁকে কেমন দেখাচ্ছে। সুতরাং পাল্টা প্রশ্ন করলেম, ‘তুমি বল, কে জিতবে।’

‘ইংরেজ!’ স্বর গম্ভীর, প্রত্যয়ব্যঞ্জক। স্বয়ং চার্চিলের পক্ষেও বোধহয় এতটা নিশ্চিত উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না।

কিন্তু প্রতিপক্ষ কাছেই ছিল। বোনের উত্তর কানে যেতেই ভাই ছুটে এল! ‘কী বললি? ইংরেজ জিতবে? জিতবে না হাতি। জাপানীদের সঙ্গে পারবে ইংরেজ? ফু!’ বাক্যের সঙ্গে যোগ করল ভঙ্গি! ঠোঁট বাঁকিয়ে মুখে চোখে এমন একটা গম্ভীর তাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ করল যাতে শ্রোতাদের পক্ষে ইংরেজের জয় সম্পর্কে ক্ষীণতম আশা পোষণ করাও হাস্যকর নির্বুদ্ধিতা বলে গণ্য হবে।

বুড়ঢু রেবার চাইতে মাত্র দু’বছরের বড়। কিন্তু অভিভাবকত্বের ধারা প্রায়ই বয়সের অনুপাত মেনে চলে না। বিশেষত বুড়ঢ় স্কুলে ভর্তি হয়েছে, রেবার এখনও বাকী। সুতরাং তর্ক-বিতর্কের মাঝপথে বুডঢু যখন মাস্টার বা অন্য ছাত্রদের নজির উল্লেখ করে, রেবাকে তখন বাধ্য হয়ে বোবা হতে হয়। ‘বিশু আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়, সে বলেছে। তার চাইতে তুমি বেশী জান কিনা?’ এ যুক্তির উপরে আর তর্ক চলে না।

কিন্তু আজ তো ফার্স্ট বয়ের মতামত নয়। এ যে তার নিজের বিশ্বাস। তাই রেবা দমল না।

‘কেন জিতবে না, ঠিক জিতবে।’ কিন্তু কণ্ঠে যেন সে দৃঢ়তার আভাস পাওয়া গেল না। বুডঢু অপরিসীম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘ইংরেজ জার্মানের সঙ্গেই পারে না, আর পারবে জাপানের সঙ্গে! হুঃ, হেরে ভূত হয়ে যাবে।’

‘কেন হারবে? ইংরেজের কত কামান বন্দুক কত এরোপ্লেন। আছে জাপানীদের এরোপ্লেন?’

‘জাপানীদের এরোপ্লেন নেই? হা হা হা! এরোপ্লেন থেকে বোমা ফেলে ইংরেজের রিপালস্ আর প্রিন্স অব ওয়েলস্ ডুবিয়ে দিল কে শুনি? পারল ইংরেজ জাপানীদের কিছু করতে? ইংরেজের এরোপ্লেন তো সব ভাঙা, কী হয় তা দিয়ে?’

‘ইংরেজের এরোপ্লেন ভাঙা, মিনি সাহেব? ভাঙা যদি তবে আকাশে ওঠে কেমন করে?’ করুণ কণ্ঠে আপীল জানালেন ইংরেজ হিতাকাঙ্ক্ষিণী।

কিন্তু আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই বুড়ঢ় বলল, ‘ ওঠে আর পড়ে যায়। কাল পত্রিকায় লেখেনি ‘বিমান দুর্ঘটনা? কলকাতায় এরোপ্লেন আকাশে উড়তে গিয়ে পড়ে গেছে। তাতে মানুষ মরেছে।

অকাট্য প্রমাণ। শুধু ঘটনা নয়, একেবারে দিন তারিখ পর্যন্ত উল্লেখ। এর পরে তর্ক করা কঠিন। তবুও শেষ চেষ্টা হিসাবে ক্ষীণ প্রতিবাদ করল রেবা। ‘দেখো, ইংরেজ হারবে না।’

‘তুমি কত জানো! হারবে হারবে, হারবে। জাপানীরা চার্চিলকে হাতে পায়ে বেড়ি দিয়ে বেঁধে এনে তারপর ক্ষুর দিয়ে গলা কাটবে।’ বলে, এমন বীরদর্পে প্রস্থান করল বুড়ঢু যেন জাপানী নয়, সে নিজেই চার্চিলের বন্ধনের উদ্যোগ করতে গেল।

রেবা প্রায় কাঁদ-কাঁদ হয়ে বলল, ‘কখনও নয়, জাপানীরা পারবে না। পারবে মিনি সাহেব?’

তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেম, ‘না পারবে না। আর পারলেই বা কী? বাঁধুক না চার্চিলকে: আমাদের রেবা দিদিমণিকে তো আর বাঁধতে পারছে না।’

‘ইংরেজ হেরে গেলে বিলদের কি হবে? বিলের বাবাকে ধরে নিয়ে যাবে, মাকে নিয়ে যাবে, জন, লুসী ও এ্যানী সবাইকে তো বেঁধে নেবে?’ বিল মানে প্রতিবেশী উইলিয়ম। রেবাদের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সিস দম্পতির বারো বছরের ছেলে জন। লুসী ও এ্যানী তারই দুই বোন।

‘তা নিক না ধরে বিল্‌দের। ওদের ট্যাবী কুকুরটা আমাদের বিলাসিয়াকে সেদিন কামড়ে দিচ্ছিল যে।’

মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তি প্রকাশ করল রেবা। বলল, ‘না ধরে নেবে না ওদের। বিল আমাকে চকোলেট, টফী দেয়। বলেছে একদিন তার সাইকেল চড়তে দেবে।’

ও হরি! এতক্ষণে বৃটেনবান্ধবীর প্রবল ইংরেজ-হিতৈষণার আসল কারণটা বোঝা গেল। চকোলেট, টফী, তার উপরে আবার সাইকেল চড়তে দেওয়ার আশ্বাস। এর পরেও ইংরেজের পরাজয় কল্পনা করা অত্যন্ত কৃতয়তার পরিচয় হবে। বিস্ময়ের কিছুই নেই। ভারতবর্ষে ইংরেজ অনুরাগী যে ক’জন আছেন তাঁদের সবারই ঐ এক অবস্থা। চকোলেট, টফী না হোক, কারো চাকরি, কারো প্রমোশন, কারো বা রায়সাহেব, খানবাহাদুর বা সি.আই.ই. নাইটহুড খেতাব।

কিন্তু সুদূর প্রাচ্যের যুদ্ধ প্রসঙ্গে বাধা পড়ল। সস্ত্রীক ঘোষ সাহেব হানা দিলেন। এই দম্পতিটির সঙ্গে আলাপ হয়েছে মাত্র দিন কয়েক কিন্তু তাঁদের আন্তরিকতা অল্পকালের মধ্যেই অন্তরঙ্গতার সৃষ্টি করেছে। মিসেস বললেন, ‘চলুন ওখলায়।’

‘সে কোথায়? পেরু না কামস্কাটকায়?’

‘তার চাইতে কিছুটা কাছে। মথুরার পথে, এখান থেকে মাইল আটেক। ফিরতি পথে নিজামুদ্দিন দেখিয়ে আনব।’

ওখলা জায়গাটা একটা দ্বীপের মতো। যমুনার ধারাকে একটি কৃত্রিম খালের মধ্যে দিয়ে ভিন্নমুখী করা হয়েছে সেখানে। সে-খাল বেষ্টন করেছে এক টুকরো ভূমিখণ্ড। বৃক্ষবহুল, ছায়াচ্ছন্ন। একপাশে সরকারী সেচ বিভাগের দপ্তর, বাকীটা প্রমোদ-উদ্যান। খালের মুখ খোলা ও বন্ধ করার জন্য আছে লকগেট, তার উপরে প্রশস্ত সেতু। টাঙ্গা ও মোটর অনায়াসে যেতে পারে। ছুটির দিন দলে দলে লোক আসে পিকনিক করতে। ওখলা নয়াদিল্লির বটানিকস।

স্থানটি মনোরম। চারিদিকের ধূসর রুক্ষ ও ধূলিকীর্ণ দেশে একটুখানি স্নিগ্ধ, শ্যামলতার আমেজ মেলে। যমুনার অগভীর প্রবাহ খালের দিকে প্রসারিত করার জন্য দীর্ঘ বাঁধ। তার উপর দিয়ে উপচীয়মান শুভ্র জলধারা গড়িয়ে পড়ছে ওপাশে। বেদীর মতো পাথর দিয়ে বাঁধানো সেখানটা। চাষীদের ছেলেরা কাপড় দিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত। খালের মুখে ছিপ ফেলে বসে আছেন দু-একজন সাহেব ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাঁদের ধৈর্য বিপুল এবং আশা সীমাহীন। গাছের নীচে ফরাস বিছিয়ে বসেছেন কোন শেঠ, প্রসাদ বা গুপ্তজী। চৌরী বাজারে বিরাট লোহার আড়ত। সারা সপ্তাহ হন্দর হিসাবে লোহা বেচে অর্থ উপায় করেছেন প্রচুর। রবিবার এসেছেন প্রমোদ ভ্রমণে। সঙ্গে এসেছে বিপুলকায়া গৃহিণী, আধডজন পুত্রকন্যা, গোটা চারেক বৃহদাকার টিফিন-কেরিয়ার, জলের সোরাই, আলবোলা ও ভৃত্য।

এসেছে কাঁধের উপরে পিতলের চাকৃতি বসানো খাকী গায়ে ইংরেজ, ক্যানাডিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন। বাহুসংলগ্না ফিরিঙ্গী বান্ধবী। স্কন্ধে চামড়ার ফিতে দিয়ে লম্বমান ফটোগ্রাফের ক্যামেরা। প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের প্রণয়কাণ্ডের উৎকট আতিশয্য দেখে মাঝে মাঝে লজ্জিত হতে হয় দর্শকদেরই।

স্বদেশে ইংরেজকে কখনও দেখিনি এমন মাত্রাজ্ঞানহীন। শনিবার বিকেলে পিকাডিলীতে দেখেছি প্রণয়ীযুগলের দল। কপোত-কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ চূড়ে। তাদের আনন্দোচ্ছ্বাস ঠিক ভট্টপল্লীর বিধানানুযায়ী নয় বটে, কিন্তু তবুও অদৃশ্য, অলিখিত একটা রেখা টানা আছে যা লঙ্ঘন করে না কেউ। সে রেখা সুনীতির নয়, সুরুচির। ডিসেন্সীকে ইংরেজ ভালবাসে মনে প্রাণে। ইণ্ডিসেন্ট বলার বাড়া গাল নেই ইংলণ্ডে। ছাব্বিশ মাইল জল পার হলেই কন্টিনেন্টে দেখা যায় না এ রুচিবোধ। শালীনতার অঙ্গুলি-নির্দেশকে সেখানে তরুণ-তরুণীরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় অকুণ্ঠিত চিত্তে।

সাত সমুদ্র তের নদীপার হয়ে এদেশে এসেছে যে-ইংরেজ, সে ঐ সুরুচির রেখাটির কথা ভুলে গিয়েছে নিঃশেষে। ব্রিটেনের বাইরে ব্রিটিশ কলঙ্কের কদর্য কাহিনী আছে Somerset Maugham এর গল্পে ভূরি ভূরি। পালামৌ ভ্রমণে সঞ্জবচন্দ্র এক জায়গায় লিখেছেন, বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। ব্রিটেন-অরণ্যের বাইরে ইংরেজকে দেখলে সংশয়ের অবকাশ থাকে না ডারুইন-তত্ত্বে।

ভারতবর্ষে ইংরেজের এই নির্লজ্জ উচ্ছৃঙ্খলতার প্রধান কারণ এই যে, চার পাশের দর্শকদের ওরা মানুষ বলেই গণ্য করে না। আমরা ওদের সম্বন্ধে কী ভাবি না ভাবি তা নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই। নেই আমাদের সামনে ভদ্র আচরণের দায়িত্ব। আরও একটা কারণ আছে, সেটা গভীরতর। এদেশে ইংরেজ তার পরিবার ও সমাজ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। এখানে সে বল্গাহীন অশ্ব। সে যেন কলকাতার মেসে থাকা মফঃস্বলের ধনী জমিদারনন্দন। পিছনে অভিভাবকের এতটুকু নেই রাশ, হাতে টাকা আছে রাশি রাশি।

দুটি ইংরেজ দম্পতি এসেছেন নয়াদিল্লি থেকে সাইকেল চেপে এই দারুণ গ্রীষ্মে। স্নানার্থে। নদীতে জল কোথাও বুকের উপর নয় কিন্তু স্বচ্ছ। ভারই মধ্যে ঘণ্টা কয়েক ধরে তাঁদের সন্তরণ অর্থাৎ সন্তরণের চেষ্টা চলল সোৎসাহে। ওপারে বালুচরে যে মৎস্যার্থী বকের দল ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর ন্যায় নিশ্চল নিথর, জলের উপর নিবদ্ধদৃষ্টি দাঁড়িয়ে শিকারের প্রতীক্ষা করছিল, স্নানার্থীদের সশব্দ জলক্রীড়া ও কলহাস্যে তাদের স্থৈর্য ক্ষুণ্ণ হলো। সচকিত হয়ে বারংবার তারা স্থান পরিবর্তন করতে লাগল।

স্ত্রী-পুরুষে এই মিলিত স্নানপর্বটা তেমন রুচিকর নয় আমাদের দেশে। প্রাচীনপন্থীদের কথা ছেড়েই দিলেন। আহারে বিহারে শয়নে যারা ইংরেজের অনুগামী তাঁদের মধ্যেও মেয়েরা এটা খুব স্বচ্ছন্দ চিত্তে গ্রহণ করতে পারেন না। ক্লাবে জিন বা ভারমুথ পান করে পরপুরুষের সঙ্গে ওয়লজ নাচতে যাঁদের বাধে না, তাঁরাও সহস্রানটা খুব প্রীতির চোখে দেখেন না।

স্থির চিত্তে বিচার করলে বোঝা যাবে, এর মূলে আছে আমাদের সংস্কার। কিন্তু সংস্কারের মুক্তি তো যুক্তি দিয়ে হয় না, যেমন বুদ্ধি দিয়ে জয় হয় না ভূতের ভয়। সংস্কার রাতারাতি পরিহার করতে হলে চাই বিপ্লব রয়ে-সয়ে করতে হলে চাই অভ্যাস।

আমাদের প্রাচীন সমাজে নরনারীর একটা সম্মিলিত সত্তা খুব স্পষ্টরূপে স্বীকৃতি নয়। উভয়ের ক্ষেত্রে পৃথক, পরিবেশ বিভিন্ন এবং কর্তব্য আলাদা। একমাত্র ধর্মাচরণ ব্যতীত স্ত্রী-পুরুষের একত্র করণীয় কিছুর উল্লেখ আমাদের শাস্ত্রে নেই। অর্জুনের রথে সুভদ্রার সারথিত্যকে বাদ দিলে সমগ্র পুরাণ, কাব্য ও সাহিত্যে স্বামী-স্ত্রীর মিলিত কর্মের দ্বিতীয় উপাখ্যান মিলে না। সাবিত্রী সত্যবানের সঙ্গ নিয়েছিলেন কাঠ কুড়োতে নয়, স্বপ্নে দেখা অমঙ্গলের ভয়ে। সেকালে পুরুষেরা করত যজন, যাজন, অধ্যাপনা, হলকর্ষণ ও বাণিজ্য। মেয়েরা করত গো-ব্রাহ্মণের সেবা, রন্ধন ও গৃহমার্জনা। উভয়ের মধ্যে সাক্ষাতের সময় ও সুযোগ ছিল সঙ্কীর্ণ ও অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র নিশীথে শয্যাগৃহের স্বল্পপরিসর অবকাশের মধ্যেই তা নিবদ্ধ ছিল।

আমাদের একান্নবর্তী পরিবার-প্রথাও স্বামী-স্ত্রীর সর্বব্যাপী যোগাযোগকে বাধাগ্রস্ত করেছে পদে পদে। সেখানে স্বামী এবং স্ত্রী একটা বৃহৎ সংসারযন্ত্রের স্ক্রু বা বল্টু মাত্র, উভয় মিলে আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ একটা সৃষ্টি নয়। সরগমের তারা আলাদা দুটি সুর; দুয়ে মিলে একটি অখণ্ড সঙ্গীত নয়। চৌধুরী বাড়ির মেজগিন্নী পারেন না বাড়ির আর তিনটি জা ও পাঁচটি ননদকে রেখে একা স্বামীর সঙ্গে সিনেমায়, কিংবা গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যেতে। বঠাকুরের মনেও আসবে না একা বড়গিন্নীকে দার্জিলিং কি সিমলা পাহাড়ে বেড়িয়ে আনার কথা।

নরনারীর মিলিত অস্তিত্বের ধারণাটি আমাদের সমাজে অধুনাজাত। স্ত্রী পুরুষের পৃথক সত্তা পুরোপুরি মেনে নিয়েও উভয়ের মিলিত জীবনের একটি সমগ্ররূপ সম্প্রতি আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছি এবং স্বীকার করতে দোষ নেই যে এ জ্ঞান আমরা য়ুরোপের কাছ থেকে পেয়েছি। এখনও পুরুষ দশটা-পাঁচটা আপিস করে, আদালতে যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য চালায় এবং মেয়েরা ঘরকন্নার তত্ত্বাবধান করে, সন্দেহ নেই। কিন্তু দু’পক্ষের রেস্পনসিবিলিটি আলাদা হলেও পলিসির যোগ থাকে। এ যুগের স্ত্রীরা আদার ব্যাপারী হলেও স্বামীদের জাহাজের খবর রাখেন।

গৃহ এখন কেবলমাত্র স্ত্রীর প্রয়োজন ও স্বাচ্ছন্দ্যের বিচারেই গঠিত নয়। বাইরে পুরুষের বন্ধুত্ব, সামাজিকতা ও অবসর বিনোদনও শুধু স্বামীর নিজস্ব অভিরুচির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় জীবজন্তুর মতো বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার লুপ্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। স্বামী, স্ত্রী ও দু’চারটি ছেলেমেয়ে নিয়ে যে নাতিবৃহৎ সংসার, তাতে স্বামীর স্থান গৃহকর্তার। সে স্বনামে পুরুষোধন্য। সে গৃহে স্ত্রীর পরিচয়ও মেজ, সেজ বা ছোট বউ রূপে নয়, আপন সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞীরূপে।

অনেকেই ভুলে যান যে, স্বামী-স্ত্রীর মিলিত জীবনের পরিপূর্ণতাও প্রয়াসের অপেক্ষা রাখে, সেটা আকস্মিক নয়। বিবাহ সে পরিপূর্ণতার লাইফ ইনসিওরেন্স নয়, গ্যারান্টি তো নয়ই। সে শুধু মীন্‌স, সে য়েও নয়। সামাজিক স্বীকৃতি ও আইনগত অধিকার দিয়ে বিবাহ স্ত্রী-পুরুষের মিলনের ক্ষেত্রটিকে সুপরিসর ও নির্বিঘ্ন করে মাত্র। তাকে সফল করতে হয় উভয় পক্ষের সযত্ন চেষ্টায়, নিরলস সাধনায়। আগে প্রেম ও পরে বিবাহকে যারা সমস্ত দাম্পত্য সমস্যার সমাধান জ্ঞান করতেন, তাঁরা এখন ঠেকে শিখেছেন যে কোর্টশিপ করে বিয়েও ফুল-প্রুফ নয়, যেমন নয় ইন্টারভিউ দিয়ে কর্মচারী নিয়োগ।

স্বামী এবং স্ত্রী দিনে দিনে একে অন্যকে প্রভাবান্বিত করে আপন রুচির দ্বারা, অভ্যাসের দ্বারা এবং মতবাদের দ্বারা। পরস্পরকে গঠন করে নিজ অভিলাষানুযায়ী, সৃষ্টি করে পলে পলে। এই দেওয়া নেওয়া, ভাঙা গড়া চলে অলক্ষ্যে অজ্ঞাতে এবং অনেকটা অবিসংবাদে। সেটা সুগম হয় নিকটতম সান্নিধ্যের দ্বারা। সান্নিধ্য শুধু গৃহে নয়, বাইরেও।

মানুষের মন বহু বিচিত্র, তার পরিচয়ের নাই শেষ। তার সত্তা ধ্রুব নয়, পরিবেশের পরিবর্তনে তার প্রকাশ হবে বিভিন্ন। স্ত্রী স্বামীকে চিনবে নানা পরীক্ষায়, উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে। স্বামী স্ত্রীকে আবিষ্কার করবে তিল তিল করে নিত্য নব আবেষ্টনে, যেমন মণিকার হীরা, পান্না, মুক্তাকে করে নতুন ডিজাইনের বালাতে, চুড়িতে, চন্দ্রহারে। সুতরাং স্ত্রী যদি জলকেলির সঙ্গিনী হন, তবে তাঁকে এমন একটি বিশিষ্টরূপে পাই, যা সকাল বেলার সধূম চায়ের পেয়ালা-হস্তে প্রতীক্ষমানা গৃহিণীর মধ্যে নেই। স্ত্রীকে নাচঘরে অপরের বাহুলগ্না দেখে যারা রাগ না করেন, তাঁরা তাঁকে স্নানের সহচরী পেলে দুঃখিত হবেন কেন? নারীদেহ সইমিং কস্টিউমে দেখলেই শকড হবেন এ যুগে মার্কিন সিনেমা দেখে যাঁরা চোখ পাকিয়েছেন তাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কেউ নেই। ঘোষজায়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। ফিরবার পথে মোটর থামালেন নিজামুদ্দিনের দরজায়। দরজা খুলে গেল ইতিহাসের এক অনধীত অধ্যায়ের।

পাঠান সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজী তৈরি করেছিলেন একটি মসজিদ সেদিনকার দিল্লির এক প্রান্তে। তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরে একদা এক ফকির এলেন সেই মসজিদে। ফকির নিজামুদ্দিন আউলিয়া। স্থানটি তাঁর পছন্দ হলো। সেখানেই রয়ে গেলেন এই মহাপুরুষ। ক্রমে প্রচারিত হলো তাঁর পুণ্যখ্যাতি। অনুরাগী ভক্তসংখ্যা বেড়ে উঠল দ্রুত বেগে।

স্থানীয় গ্রামের জলাভাবের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো তাঁর। মনস্থ করলেন খনন করবেন একটি দীঘি যেখানে তৃষ্ণার্ত পাবে জল, গ্রামের বধূরা ভরবে ঘট এবং নামাজের পূর্বে প্রক্ষালন দ্বারা পবিত্র হবে মসজিদে প্রার্থনাকারীর দল। কিন্তু সংকল্পে বাধা পড়ল অপ্রত্যাশিতরূপে। উদ্দীপ্ত হলো রাজরোষ। প্রবল পরাক্রান্ত সুলতান গিয়াসুদ্দিন তোগলকের বিরক্তিভাজন হলেন এক সামান্য ফকির দেওয়ানা নিজামুদ্দিন আউলিয়া।

তোগলক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসুদ্দিনের পিতৃপরিচয় কৌলিন্য-যুক্ত নয় ক্রীতদাসরূপে তাঁর জীবন আরম্ভ। কিন্তু বীর্য এবং বুদ্ধির দ্বারা আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালেই গিয়াসুদ্দিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন বিশিষ্ট ওমরাহরূপে। সম্রাটের ‘মালিক’দের মধ্যে তিনি হয়েছিলেন অন্যতম।

আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে ছয় বৎসর পর পর রাজত্ব করল দুজন অপদার্থ, সুলতান, যারা আপন অক্ষম শাসনের দ্বারা দেশকে পৌঁছে দিল অরাজকতার প্রায় প্রান্ত সীমানায় গিয়াসুদ্দিন তখন পাঞ্জাবের শাসনকর্তা। এমন সময় খসরু খান নামক এক ধর্মত্যাগী অন্ত্যজ হিন্দু দখল করল দিল্লির সিংহাসন। গিয়াসুদ্দিন তাঁর সৈন্যদল নিয়ে অভিযান করলেন পাঞ্জাব থেকে দিল্লি, পরাজিত ও নিহত করলেন খসরু খানকে, সগৌরবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন বাদশাহী তক্তে।

গিয়াসুদ্দিনের দৃঢ়তা ছিল শক্তি ছিল, রাজ্যশাসনের দক্ষতা ছিল। কিন্তু ঠিক সে অনুপাতেই তাঁর নিষ্ঠুরতাও ছিল ভয়াবহ। একদা দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকের অসাবধানী রসনায় রটনা শোনা গেল গিয়াসুদ্দিনের মৃত্যুর। সুলতানের কানেও পৌঁছল সে ভিত্তিহীন জনরব। কিছুমাত্র উত্তেজনা প্রকাশ না করে সুলতান আদেশ করলেন তাঁর সিপাহসালারকে, ‘লোকে আমাকে মিথ্যা কবরস্থ করেছে, কাজেই আমি তাদের সত্যি কবরে পাঠাতে চাই।’ অগণিত হতভাগ্যের জীবনান্ত ঘটল নিমেষে। গোরস্থানে শবভুক পশু-পক্ষীর হলো মহোৎসব।

কিন্তু গিয়াসুদ্দিনের বিচক্ষণতা ছিল। সেকালে মুঘলদের আক্রমণ এবং তার আনুষঙ্গিক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন ছিল উত্তর ভারতের এক নিরন্তর বিভীষিকা। গিয়াসুদ্দিন তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করতে পত্তন করলেন নতুন নগর তৈরি করলেন নগর, ঘিরে দুর্ভেদ্য প্রাচীর এবং প্রাচীরদ্বারে দুর্জয় দুর্গ। একদিকে ক্ষুদ্র পর্বত আর একদিকে প্রাচীর বেষ্টিত নগরী, মাঝখানে খনিত হলো বিশাল জলাশয়। বর্ষার দিনে শৈলশিখর থেকে ধারাস্রোতে জল সঞ্চিত হতো এই জলাশয়ে; সংবৎসরের পানীয় সম্পর্কে নিশ্চিত আশ্বাস থাকতো প্রজাপুঞ্জের।

ফকির এবং সুলতানে সংঘর্ষ ঘটলো এই নগর-নির্মাণ, কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে বলতে হয় নগরপ্রাচীর নির্মাণ উপলক্ষ করেই।

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দীঘি কাটাতে মজুর চাই প্রচুর। গিয়াসুদ্দিনের নগর তৈরি করতেও মজুর আবশ্যক সহস্ৰ সহস্ৰ। অথচ দিল্লিতে মজুরের সংখ্যা অত্যন্ত পরিমিত; দু’জায়গায় প্রয়োজন মিটানো অসম্ভব। অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, বাদশাহ চাইবেন মজুরেরা আগে শেষ করবে তাঁর কাজ, ততক্ষণ অপেক্ষা করুক ফকিরের খয়রাতী খনন। কিন্তু রাজার জোর অর্থের, সেটা পরিমাপ করা যায়। ফকিরের জোর হৃদয়ের, তার সীমা শেষ নেই। মজুরেরা বিনা মজুরিতে দলে দলে কাটতে লাগলো নিজামুদ্দিনের তালাও। সুলতান হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,—’তবে রে—’

কিন্তু তাঁর ধ্বনি আকাশে মিলাবার আগেই এত্তালা এল আশু কর্তব্যের। বাংলাদেশে বিদ্রোহ দমন করতে ছুটতে হলো সৈন্য সামন্ত নিয়ে।

শাহজাদা মহম্মদ তোগলক রইলেন রাজধানীতে রাজ-প্রতিভূরূপে। তিনি নিজামুদ্দিনের অনুরাগীদের অন্যতম। তাঁর আনুকূল্যে দিবারাত্রি খননের ফলে পরহিতব্রতী সন্ন্যাসীর জলাশয় জলে পূর্ণ হলো অনতিবিলম্বে। তোগ্‌লকাবাদের নগর-প্রাচীর রইল অসমাপ্ত।

অবশেষে সুলতানের ফিরবার সময় হলো নিকটবর্তী। প্রমাদ গণনা করল নিজামুদ্দিনের অনুরাগীরা। তারা ফকিরকে অবিলম্বে নগর ত্যাগ করে পলায়নের পরামর্শ দিল। ফকির মৃদু হাস্যে তাদের নিরস্ত করলেন,— ‘দিল্লি দূর অস্ত।’ দিল্লি অনেক দূর।

প্রত্যহ যোজন পথ অতিক্রম করছেন সুলতান। নিকট হতে নিকটতর হচ্ছেন রাজধানীর পথে। প্রত্যহ ভক্তরা অনুনয় করে ফকিরকে। প্রত্যহ একই উত্তর দেন নিজামুদ্দিন—দিল্লি দূর অস্ত।

সুলতানের নগর প্রবেশ হলো আসন্ন আর মাত্র একদিনের পথ অতিক্রমণের অপেক্ষা। ব্যাকুল হয়ে শিষ্য প্রশিষ্যেরা অনুনয় করল সন্ন্যাসীকে, এখনও সময় আছে এই বেলা পালান। গিয়াসুদ্দিনের ক্রোধ এবং নিষ্ঠুরতা অবিদিত ছিল না কারো কাছে, ফকিরকে হাতে পেলে কী দশা হবে তাঁর সে কথা কল্পনা করে তারা ভয়ে শিউরে উঠল বারংবার। স্মিত হাস্যে সেদিনও উত্তর করলেন বিগতভয় সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী,—’দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’। দিল্লি এখনও অনেক দূর। হাতে জপের মালা ঘোরাতে লাগলেন নিশ্চিন্ত ঔদাসীন্যে।

নগরপ্রান্তে পিতার অভ্যর্থনার জন্য মহম্মদ তৈরি করেছেন মহার্ঘ মণ্ডপ। কিংখাবের সামিয়ানা। জরীতে, জহরতে, ঝলমল। বাদ্যভাণ্ড, লোকলশকর, আমীর ওমরাহ মিলে সমারোহের চরতমত আয়োজন। বিশাল ভোজের ব্যবস্থা, ভোজের পরে হস্তিযূথের প্রদর্শন-প্যারেড।

মণ্ডপের কেন্দ্রস্থলে ঈষৎ উন্নত ভূমিতে বাদশাহের আসন, তার পাশেই তাঁর উত্তরাধিকারীর। পরদিন গোধূলি বেলায় সুলতান প্রবেশ করলেন অভ্যর্থনা মণ্ডপে। প্রবল আন্দোচ্ছ্বাসের মধ্যে আসন গ্রহণ করলেন। সিংহাসনের পাশে বসালেন নিজ প্রিয়তম পুত্রকে। কিন্তু সে মহম্মদ নয়, তার অনুজ।

ভোজনান্তে অতি বিনয়াবনত কণ্ঠে মহম্মদ অনুমতি প্রার্থনা করলেন সম্রাটের। জাঁহাপনার হুকুম হলে এবার হাতির কুচকাওয়াজ শুরু হয়, হস্তিযূথ নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনি নিজে। গিয়াসুদ্দিন অনুমোদন করলেন স্মিতহাস্যে।

মহম্মদ মণ্ডপ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন ধীর শান্ত পদক্ষেপে।

কড্ কড্ কড়ড কড়াৎ।

একটি হাতির শিরসঞ্চালনে স্থানচ্যুত হলো একটি স্তম্ভ। মুহূর্ত মধ্যে সশব্দে ভূপতিত হলো সমগ্র মণ্ডপ।

চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল অসংখ্য কাঠের থাম। চাপাপড়া মানুষের আর্ত কণ্ঠে বিদীর্ণ হলো অন্ধকার রাত্রির আকাশ। ধূলায় আচ্ছন্ন হলো দৃষ্টি। ভীত সচকিত ইতস্তত ধাবমান হস্তিযূথের গুরুভার পদতলে নিষ্পিষ্ট হলো অগণিত হতভাগ্যের দল। এবং বিভ্রান্তকারী বিশৃঙ্খলার মধ্যে উদ্ধারকর্মীরা ব্যর্থ অনুসন্ধান করল বাদশাহের।

পরদিন প্রাতে মণ্ডপের ভগ্নস্তূপ সরিয়ে আবিষ্কৃত হলো বৃদ্ধ সুলতানের মৃতদেহ। যে প্রিয়তম পুত্রকে তিনি মনোনীত করেছিলেন মনে মনে, তার প্রাণহীন দেহের উপরে সুলতানের দুই বাহু প্রসারিত। বোধ করি আপন দেহের বর্মে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তাঁর স্নেহাস্পদকে।

সমস্ত ঐহিক ঐশ্বর্য প্রতাপ ও মহিমা নিয়ে সপুত্র গিয়াসুদ্দিনের শোচনীয় জীবনান্ত ঘটল নগরপ্রান্তে। দিল্লি রইল চিরকালের জন্য তাঁর জীবিত পদক্ষেপের অতীত।

দিল্লি দূর অস্ত। দিল্লি অনেক দূর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *