দুই
বৈষ্ণব কাব্যের শ্রীরাধা কৃষ্ণবিরহে একদা ‘ঘর কৈনু বাহির বাহির কৈনু ঘর’ বলে আক্ষেপ করেছিলেন। দিল্লির কনট প্লেসকে বৃন্দাবনের কুঞ্জগলি বলে কোন মতেই ভুল করবার সম্ভাবনা নেই, তার পুরনারীরা কেউ বৃষভানুনন্দিনী নন। কিন্তু এখানকার শ্রীমতীরাও নিদাঘ রজনীতে ঘরকে বাহির এবং বাহিরকে ঘর করেছেন।
না করে উপায় ছিল না। সমস্ত দিন ধরে মার্তণ্ডদের এখানে যে প্রচণ্ড কিরণ বিকিরণ করেন, তাতে ঘরের ভিতরটা প্রায় টাটা কোম্পানীর অগ্নিগর্ভ বয়লারের মতো তেতে থাকে। মাথা গুঁজতে গেলে মাথা কুটতে ইচ্ছে হয়। পাখা খুলে দিলেও আগুনের হল্কা লাগে। সুতরাং বাইরে ঘুমানো ছাড়া গতি নেই।
শুধু মেয়ের নয়, ছেলে বুড়ো বাচ্চাকাচ্চা সবারই এক অবস্থা। সন্ধ্যাবেলা বাড়ির সামনে জমিতে ঘটি ঘটি জল ঢেলে উত্তপ্ত ধরণীকে করা হয় শীতল। তার উপর খাটিয়া বিছিয়ে পড়ে সারি সারি বিছানা। দেখে মনে হয়, যেন সরকারী হাসপাতালের তিন, পাঁচ বা সাত নম্বর ওয়ার্ড। স্বামী, স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ী, ননদ, ভাজ, পুত্র কন্যা সবাই শুয়েছে উন্মুক্ত আকাশের নীচে। মাথার উপরে নেই আচ্ছাদন, শয্যা ঘিরে নেই কোন আবরণ। অনভ্যস্ত চোখে হঠাৎ যেন একটু দৃষ্টিকটু ঠেকে।
কিন্তু পৃথিবীতে অন্য আর পাঁচটা নীতিবোধের ন্যায় আমাদের শালীনতা জ্ঞানটাও আপেক্ষিক। দেশাচারের দ্বারা তার রকমফের ঘটে, প্রয়োজনের খাতিরে হয় রদবদল। কলকাতার বড়বাজারের রাস্তায় দেখা যায়, খাটো কাঁচুলি আর আঠারো গজি ঘাগরার মধ্যপথে মেদবহুল দেহের অনেকখানি অনাবৃত রেখে অসঙ্কোচে চলেছেন মারোয়াড়ী মহিলা। আমাদের বাঙালী তরুণীদের মধ্যে কারও মতি হবে না সে সজ্জারীতিতে। হাঁটুর উপরে ওঠা স্কার্ট পরে ইংরেজ ও এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মেয়েরা যাচ্ছে যত্রতত্র। কিছু খারাপ লাগছে না তো চোখে। অথচ আমাদের অতি আধুনিকাদের মধ্যেও কোন দুঃসাহসিকা তাঁর ক্রেপ শাড়ির ঝুল পায়ের গোড়ালি থেকে জানু পর্যন্ত উন্নীত করতে পারবেন না। যদি বা পারেন, লজ্জায় চোখ তুলে তাঁর দিকে কেউ তাকাতে পারব না।
একই বস্তু কেমন করে শুধু মাত্র আবেষ্টন ভাষা ও পরিবেশের তফাতে শীল ও অশ্লীল ঠেকে তার আরও সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত আছে সিনেমায়। শ্বশুর-ভাশুর, পুত্রবধূ ও কন্যা-জামাতা একসঙ্গে মেট্রোতে বসে গ্রেটা গার্বো ও চার্লস বোয়ারের দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন আর আলিঙ্গন দেখতে যাঁরা কিছু মাত্র সঙ্কুচিত হন না, বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকার নিরামিষ প্রণয় নিবেদন দৃশ্য তাঁদেরই অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে দেখেছি। শারীরতত্ত্বের আলোচনায় যে কথা বাংলায় বলতে বাধে, ইংরেজিতে তা নিয়ে গুরুজনের সঙ্গে তর্ক করা হয় অনায়াসে।
গরমকালে ঘরে শুলে যে দেশে জ্বরে ধরে; সে দেশে মেয়ে পুরুষকে বাইরে ঘুমোতে হয় এবং তিন চারটে করে আলাদা উঠান যখন শতকরা নিরানব্বুই জনের বাড়িতেই রাখা সম্ভব নয় তখন শ্বশুর, জামাতা, মা ও মেয়ে এক জায়গায় খাট না বিছিয়েই বা করে কী? নয়াদিল্লি সার্বজনীন শহর। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, কাশী, কাঞ্চি, কোশল থেকে এখানে ঘটেছে জনসমাগম। আহারে তারা যদি বা নিজ নিজ রুচিকে রেখেছে বজায়, শয়নে মেনে নিয়েছে একই রীতি। পাঞ্জাবী মেয়েদের বসন এরকম কমিউনিটি স্লিপিং-এর পক্ষে বিশেষ উপযোগী। গোড়ালির কাছে আঁট পায়জামা শিথিলবন্ধন শাড়ির মতো অলক্ষ্যে নিদ্রিত দেহের উপর অবিন্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙতে যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল সে হচ্ছে ফিরিওয়ালার ক্যাভেলকেড। দুধ, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, সবই এখানে ঘরে বসে পাওয়া যায় পসারিণী যদিও বা নেই, পসরা আসে দরজায়। মাথায় চেপে নয় সাইকেলে। ঐ জিনিসটা এখানে অসংখ্য। কলকাতায় সাইকেল চাপতে দেখি খবরের কাগজের হকারকে। কিন্তু নয়াদিল্লিতে গয়লা, ধোপা, নাপিত, জেলে, কসাই, ব্লাউজের ছিট, গায়ের সাবান বিক্রেতা আসে সাইকেলের পিছনে মস্ত ঝুড়ি বা বাক্স চাপিয়ে। মহানগরীর সওদাগরেরাও পদাতিক নয়।
প্রভাতে উঠিয়া যে-মুখ দেখিনু, তার বেসাতি দুধ। ছ্যাকা গাড়ির ঘোড়ার মতো হাড়গোড় বের করা জীর্ণদেহ সাইকেল, তার পিছনের ক্যারিয়ারের দু’পাশে বাঁধা দুধের দুটি টপ। টিনের তৈরী, তলায় জলের কলের মতো ট্যাপ, ঘোরালে দুধ বেরোয়। সামনের হাতলে ঝুলছে অনুরূপ গুটি দুই পাত্র। আশ্চর্য বহন ও চলন ক্ষমতা এই দ্বিচক্ররথের। আশ্চর্যতর তার চাকা, চেন ও দুগ্ধভাণ্ডের সম্মিলিত ঐকতানবাদন টিনের টবগুলির উপরের দিকে ঢাকনি আছে, তাতে তালা আঁটা। বলা বাহুল্য দুগ্ধের বিশুদ্ধতা এবং গয়লার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে ক্রেতাকে আশ্বস্ত করাই তার উদ্দেশ্য। কিন্তু সেটা অসাবধানী লোকের ছাতায় ঘটা করে নাম লেখার মতো। নীরং ত্যত্ত্বা ক্ষীরং গ্রহণ করতে হলে পাঁচ সের দুধকে দু’সেরে দাঁড় করাতে হয়।
গয়লার পরে ‘কলকাত্তাকা হিলশা লো, করাচীকা চিংড়ি’ হাক দিয়ে এল মাছওয়ালা। বলা বাহুল্য সে-ইলিশ বেশীর ভাগই বঙ্গজ নয়, এলাহাবাদের। তবে অনেক মানুষের মতো তারাও সব সময়ে চেহারায় ধরা পড়ে না, পড়ে স্বাদে। মাছওয়ালার সাইকেলের পিছনে ঝুড়ির উপরে মিহি জালের আবরণ, মাছির অত্যাচার নিবারণের জন্য।
সবজিওয়ালা আসে একে একে। কেউ হাঁকে,—লেউকী লো, কেউ হাঁকে পালং অথবা গোবী। কারো বা ঝুড়িতে আছে টিমাটো, ভিত্তি, হরা ধনিয়া এবং সীতা ফল অর্থাৎ কুমড়ো। রজক বাইসিকেলের পশ্চাতে যে পর্বতপ্রমাণ কাপড়ের বোঝা চাপিয়ে আসে তা দেখে ত্রেতাযুগে পবননন্দনেরও বিস্ময়ের উদ্রেক হতে পারত।
মেয়েদের চুল ও ছেলেদের দাড়ি দু-এরই সমান প্রসাধন প্রয়োজন, সমান সময়সাপেক্ষ। তফাত শুধু এই যে, প্রথমটির যত্ন বৃদ্ধিতে, দ্বিতীয়টির বিনাশে। চুল রোজ বাঁধতে হয়, দাড়ি রোজ কামাতে। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে এবং যে আপিস করে সে ক্ষুরও চালায় এ কথা সত্য। তবুও বেণীরচনায় ভ্রাতৃজায়া বা ননদিনীর সহায়তা পেলে মেয়েরা খুশী হন; ক্ষৌরকার্যে নর-সুন্দরের সাহায্য পেলে অনেক ছেলে আয়েশ বোধ করে। তাই সকাল আটটা থেকে দ্বারে দ্বারে হানা দেয় হাজাম। তার সঙ্গে আছে খুব ছোট্ট পিতলের একটি পোর্টেবল চুল্লী, অনেকটা ইকমিক কুকারের মতো আকৃতি। তাতে শীতের দিনে সর্বদা জল গরম হয়। শীতের দেশের বাসিন্দারা জানেন, ডিসেম্বরের সাঁইত্রিশ ডিগ্রির শীতে গালে ঠাণ্ডা জল দেওয়ার চাইতে চড় দেওয়া ভালো।
সাড়ে ন’টা থেকে শুরু হয় আপিস অভিযান। প্রথমে চাপরাশী দল। গায়ে খাকী রঙের উর্দি, মাথায় পাগড়ি ও কটিতে লাল সর্পাকৃতি তিন চার ফেরতা কোমরবন্ধ। দু’-একজনের কোমরবন্ধে সুদৃশ্য খাপের মধ্যে হাতির দাঁতের বাঁটওয়ালা ক্ষুদ্র ছুরিকা। মোগল বাদশাহের আমলে খোজা প্রহরীদের অনুকরণ। তারা অনারেবল মেম্বর বা সেক্রেটারীদের চাপরাশী। আর্দালী বাহিনীতে মেজর জেনারেল। তাদের সাইকেলের পিছনে লাল খেরো কাপড়ে বাঁধা এক গুচ্ছ ফাইল, যা সাহেবরা প্রত্যেক শনিবারই বাড়ি নিয়ে যান কাজ করার জন্য এবং বেশীর ভাগই সোমবারে ফিরিয়ে আনেন একবারও না ছুঁয়ে।
চাপরাশীদের পরে যায় কেরানী, এ্যাসিস্ট্যান্ট ও সুপারিন্টেন্ডেন্টরা।
সাইকেল, সাইকেল, সাইকেলের পর সাইকেল। ঠিক যেন একটা সাইকেলের প্রসেশন। তার সঙ্গে আছে টাঙ্গা। সেও দ্বিচক্রযান। ঘোড়ায় টানে। সামনে পিছনে চারজন বসা যায়,—কিন্তু মুখোমুখি নয়, পিঠোপিঠি। মাথার উপরে সামান্য একটু ক্যাম্বিসের আচ্ছাদন; তাতে রৌদ্রতাপ বা বৃষ্টিধারা কোনটাই পুরোপুরি নিবারিত হয় না। আরোহণ ও অবরোহণের কালে পুরুষদের পক্ষে হয় জিমন্যাস্টিকের পরীক্ষা, শাড়ি পরিহিতাদের পক্ষে ভব্যতার। একটু সতর্কতার অভাবেই পতন ও মূর্ছা অসম্ভব নয়।
টাঙ্গার গতি মন্থর, আসন আরামহীন এবং পরিবেশ নাসারন্ধ্রের পক্ষে ক্লেশকর। সম্প্রতি আমেরিকানদের দাক্ষিণ্যে দক্ষিণার হার হয়েছে বৃদ্ধি। আগে যে রাস্তাটুকুর মাশুল ছিল চার আনা, তার জন্য এখন বারো আনার কমে টাঙ্গাওয়ালারা কথা বলে না; কিংবা এমন কিছু বলে যা না শোনাই ভালো। তবে দশটা পাঁচটায় সেক্রেটারিয়েটের পথে সহযাত্রী মেলে। টাঙ্গাওয়ালা ‘দপ্তরকো, দপ্তর জানেবালা আইয়ে’, বলে চেঁচিয়ে সংগ্রহ করে সওয়ারী। তাতে ভাড়ার অংশ বিভক্ত হয়ে পকেটের পক্ষে সুসহ হয়। ভাগের মা গঙ্গা পায় না, কিন্তু ভাগের টাঙ্গা গন্তব্যস্থল অবধি গিয়ে পৌঁছায়।
সাড়ে দশটার মধ্যে গোটা শহরটার সমস্ত পুরুষ নিষ্ক্রান্ত হলো পথে। সব পথের একই লক্ষ্য-সেক্রেটারিয়েট। বাবু পালাল পাড়া জুড়ালো, গিন্নি এল পাটে।
ইম্পিরিয়াল সেক্রেটারিয়েটটি নবনির্মিত। শুধু সেক্রেটারিয়েট নয় এখানকার বাড়িঘর, পথঘাট, হাটবাজার সবই নতুন। নয়াদিল্লি শহরটা আপস্টার্ট, বারাণসী প্রয়াগ এমনকি কলকাতা মুর্শিদাবাদের মতোও এর পশ্চাতে কোন ট্রাডিশন নেই। সে হঠাৎ টাকা করা ওয়ার কনট্রাক্টর, সাত পুরুষের বনেদি জমিদার নয়। কিন্তু যুগটাই যে ভুঁইফোড়দের। এ যুগে জুড়ি গাড়ির চাইতে বেবী-অস্টিন, সাত লহরীর চাইতে মচেন এবং খেয়াল গান অপেক্ষা গজলের আদর বেশী। বিত্ত হলেই হলো, নাই বা রইল বৈভব।
মাঝখান দিয়ে প্রশস্ত পথ কিংসওয়ে, ভাইসরয় ‘স হাউসের লৌহদ্বার অবধি প্রসারিত। তারই দু’পাশে সেক্রেটারিয়েটের দুই মহল,—নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লক। আকৃতি, রং, রেখা, গঠনভঙ্গি হুবহু এক। যেমন ময়রার দোকানে আবার খাবো’ বা জলতরঙ্গ ছাঁচে গড়া এক জোড়া সন্দেশ। নর্থ ব্লকের সিঁড়ির মাথায় প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ পরিকল্পনার এডুইন লুটীনস এবং তাঁর সহযোগী সার হার্বার্ট বেকারের নাম।
নয়াদিল্লির প্রায় সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী বাড়িগুলিই মুখ্যত ক্লাসিক্যাল অর্থাৎ গ্রীক স্থাপত্যের অনুকরণ, যদিও পুরোপুরি নয়। থাম আর গম্বুজ। আর্চের সংখ্যা কম। যা আছে তাও রোমান ধরনের অর্ধবৃত্তাকার, মুসলিম পদ্ধতির সূক্ষ্মাগ্রভাগের নয়। থামগুলি চতুষ্কোণ নয়। গোলাকার। নয়াদিল্লির পত্তনে গ্রীক স্থাপত্যকে গ্রহণের পশ্চাতে কোন উদ্দেশ্য ছিল কিনা বলা শক্ত। তবে কোন কোন বিশেষজ্ঞের ধারণা এই যে, জলবায়ু ও আবহাওয়ার দিক দিয়ে গ্রীক উত্তর ভারতের সমতুল্য যদিও তার গ্রীষ্ম অপেক্ষাকৃত সহনযোগ্য এবং শীত অপেক্ষাকৃত কঠোরতর। উত্তর ভারতের মতো গ্রীসেরও বাতাস অনার্দ্র, আকাশ নির্মেঘ এবং রৌদ্র নির্মল সুতরাং গ্রীক স্থাপত্য নয়াদিল্লির পক্ষে স্থায়িত্বের দিক দিয়ে অধিকতর উপযোগী হবে, স্থপতিদের মনে এ বিশ্বাস দেখা দেওয়া আশ্চর্য নয়।
কিন্তু নয়াদিল্লির স্থাপত্যকে পুরোপুরি কোনো একটা বিশেষ সংজ্ঞা দেওয়া ঠিক নয়। সেটা ক্ল্যাসিক্যাল বটে কিন্তু একেবারে নির্ভেজাল নয়। সেক্রেটারিয়েট দালানে হিন্দু পদ্ধতিরও চিহ্ন আছে—সারনাথে দৃষ্ট অশোকস্তম্ভের অনুকরণে গঠিত স্তম্ভগুলিতে। আছে প্রবেশ তোরণ ও অন্যান্য অংশে হস্তী, ঘণ্টা প্রভৃতি অলংকরণের! তারই সঙ্গে আছে মুসলিম স্থাপত্যরীতির পাথরের জালি, ফতেপুর সিক্রিতে চিস্তির কবরে যার বহুল নিদর্শন। রাজমিস্ত্রিরা বেশীরভাগই এসেছে জয়পুর, রাজপুতরানার অন্যান্য স্থান এবং আগ্রা থেকে। জনশ্রুতি এই যে, তাদের মধ্যে অনেকে ছিল তাজ নির্মাতাদের উত্তরপুরুষ। নর্থ এবং সাউথ, দু’ব্লকেরই মাথায় বিরাট গম্বুজ, অনেকটা রোমের সেন্ট পল গির্জার অনুরূপ, যদিও এতে কিছুটা মুসলিম স্থাপত্যের ছাপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। চোখে দেখে মনে হয় না যে, গম্বুজ দুটির উচ্চতা কুতুবশীর্ষ থেকে মাত্র একুশ ফুট কম। দুটি ব্লকে মিলিয়ে সেক্রেটারিয়েটে কক্ষ আছে প্রায় এক হাজার, সব ক’টি মিলিয়ে বারান্দার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় আট মাইল। ইলাহী কাণ্ডই বটে!
সাধারণত সরকারী দপ্তরখানার সঙ্গে আর্টের বড় একটা সম্পর্ক থাকে না। তার নামে যে-দৃশ্যটি আমাদের কল্পনায় আসে তা এক রাশি নথি, দলিল, দস্তাবেজ, ও হিসাব নিকাশ। দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত টেবিলের উপর ফাইল ঘাঁটাই যেখানে একমাত্র কাজ, সেখানে গৃহের গঠনভঙ্গি বা পরিবেশ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনে। সে দালানের জানালা কি রং-এর, সিঁড়ি কি ঢং-এর সে প্রশ্ন আমাদের মনেই আসে না। পুলিশকোর্টের দেয়ালে অজন্তার ফ্রেস্কো পেন্টিং আমরা আশা করিনে। কিন্তু দেখলে কি খুশি হতেম না? অন্তত নয়াদিল্লির সেক্রেটারিয়েটকে সুদৃশ্য করার চেষ্টা দেখে আনন্দিত হয়েছি।
লাল পাথরে গড়া বিরাট ভবন। মাঝখান দিয়ে দূরপ্রসারিত পথ। পথের দু’পাশে শ্যামল দুর্বার আস্তরণে ঢাকা বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। মাঝে মাঝে কৃত্রিম ঝিল, তাতে সারিবন্দী ফোয়ারা থেকে অবিরাম উৎসারিত হচ্ছে জলারাশি। পাশে পুষ্পিত মরসুমী ফুলের ডেজী প্যানসী, এ্যাস্টর ও হলি হকের কেয়ারী। নির্বাচিত স্থানে একটি করে কমলালেবু গাছ। বহু যত্নে বৃত্তাকারে ছাঁটা তার ডালপালা, মনে হয় যেন বাঁটের উপর দাঁড়িয়ে আছে এক একটি খোলা ছাতা।
দালানের ভিতরটাকেও কেবলমাত্র কাজের উপযোগী না করে দর্শনযোগ্য করার প্রয়াস আছে। নর্থ ও সাউথ ব্লকে কমিটি রুম নামক যে বৃহৎ কক্ষগুলি আছে তাদের সিলিং এবং দেয়াল চিত্রশোভিত। বম্বে স্কুল অব আর্টের শিল্পীদের আঁকা। চিত্রগুলির বিষয়বস্তু ভাল কিন্তু দুঃখের বিষয় অঙ্কনচাতুর্য প্রশংসনীয় নয়। এই কক্ষগুলিতে নানা রকম কমিটি, কনফারেন্স বসে। সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপসের প্রথম প্রেস কনফারেন্স বসল সাউথ ব্লকের কমিটি রুমে।
ক্রীপসের বিমান নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে এসে পৌঁছল দিল্লিতে। তখন দুটো। সুতরাং বেলা চারটায়—মাত্র দু’ঘণ্টা ব্যবধানে একটা প্রেস কনফারেন্স ডাকার মধ্যে ত ৎপরতার পরিচয় আছে যথেষ্ট। সাউথ ব্লকের সবটাই মিলিটারীর দখলে, বেসামরিক দপ্তরের মধ্যে মাত্র হোম ডিপার্টমেন্ট আছে একটি টেরে। অবস্থান নৈকট্যের কারণ বোধ হয় স্বভাবসাদৃশ্য। ভারতে পুলিশ আর মিলিটারী প্রায় কাছাকাছি। স্বগোত্র না হলেও স্বজাতি বটে।
দরজায় কড়া সামরিক পাহারা। সাংবাদিক ও রিপোর্টারদের জন্য ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ব্যবস্থা হয়েছে প্রবেশপত্রের।
প্রচুর বকশিশ ও প্রচুরতর তাড়না দ্বারা টাঙ্গাওয়ালাকে উৎসাহিত করা সত্ত্বেও সাউথ ব্লকের দরজায় এসে যখন অবতীর্ণ হলেম চারটে বাজতে মিনিটখানেক মাত্র বাকী। বেচারার চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। কিন্তু টাঙ্গার ঘোড়াগুলি ভারতীয় যোগীপুরুষদের মতো নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত ও নির্বিকার; কোন কিছুতেই তাদের উত্তেজিত করা সহজ নয়। বেগবৃদ্ধি প্রায় সাধ্যাতীত।
ঊর্ধ্বশ্বাসে রওনা হলেম কনফারেন্স কক্ষের উদ্দেশে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন সপারিষদ সার ফ্রেডরিক পাকল, ইনফরমেশন বিভাগের কর্ণধার। পরিচিত বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে বললেন, ক্রীপসের অপেক্ষা করছেন। গোটা দুই সিঁড়ি উপরে যাচ্ছিলেন একটি শ্বেতাঙ্গ, মনে হলো সদ্য আগত ইংরেজ বা মার্কিন রিপোর্টারদের অন্যতম। হঠাৎ পিছিয়ে নেমে এসে সার ফ্রেডরিককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘Did you say Cripps? That’s me.’
এর চেয়ে বজ্রপাত হওয়া ভালো ছিল।
আমরা বিস্মিত, পাকল স্তম্ভিত, পারিষদেরা হতবাক।
সার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ওয়ার ক্যাবিনেটের সদস্য। ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ধারণ করতে এসেছেন ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার প্রস্তাব নিয়ে। আছেন ভাইসরয়ের প্রাসাদে। সুতরাং প্রেস কনফারেন্সে আসবেন বড়লাটের ক্রাউন মার্কা গাড়ি চেপে, আগে চলবে লাল মোটর সাইকেলে পাইলট সার্জেন্ট, পাশে থাকবে ভাইসরয়ের প্রাইভেট সেক্রেটারী বা অনুরূপ কোনো হোমরা-চোমরা পথ-প্রদর্শক। জমকে জলুসে চিনতে বিলম্ব হবে না এক মুহূর্ত। এইটেই আশা করছে সবাই। হা হতোস্মি, কোথায় প্রাইভেট সেক্রেটারী আর কোথায় বা আগে পিছনে পিস্তলকোমরে সার্জেন্ট পাহারা। সঙ্গে একটি মাত্র ভাইসরয়’স হাউসের চাপরাশী, বোধ করি সেও শুধু পথ চিনিয়ে দেওয়ার জন্য।
সরকারী কায়দা কানুন, ফর্মালিটি পরিহার করে আড়ম্বরহীন, সহজ ও সরল একটি পরিবেষ্টন সৃষ্টি করলেন ক্রীপস্। তাঁর আন্তরিকতায় ভারতবর্ষের আস্থা গভীরতর হলো, তাঁর চেষ্টার সাফল্য কামনা করল জনসাধারণ, তাঁর সুখ্যাতি অকৃপণ ভাষায় কীর্তিত হলো সর্বপ্রদেশ ও সর্ব ভাষায় বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় স্তম্ভে।
কনফারেন্সে ক্রীপস্ আবেদন জানালেন সাংবাদিকদের, তাঁরা যেন ক্রীপস্ প্রস্তাবের সারমর্ম নিয়ে অযথা গবেষণা না করেন। নেতৃবর্গের সঙ্গে আলোচনার পূর্বে সংবাদপত্রে মীমাংসা—প্রস্তাবের কল্পিত বিবরণ প্রকাশের দ্বারা যেন অবাঞ্ছিত বিরুদ্ধভাবের সৃষ্টি না হয় রাজনীতিক মহলে। বলা বাহুল্য, সে আবেদনের প্রয়োজন ছিল।
সবচেয়ে বিস্ময়কর, প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ক্রীপসের মনে অবিচলিত আস্থা। ওয়ার ক্যাবিনেটের সর্বসম্মত এই মীমাংসা-প্রস্তাব ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষে অনায়াসে গ্রহণীয় হবে ব্রিটেন ও ভারতবর্ষের বিরোধ অপনীত হবে এবং দীর্ঘকাল ধরে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে অদম্য অভিলাষে ভারতের অগণিত নরনারী দুরূহ ত্যাগ ও দুঃসহ নির্যাতন বরণ করেছে তার সার্থক পরিণতি ঘটবে, এ বিষয়ে ক্রীপসের মনে সংশয়ের লেশমাত্র ছিল না।
ভারতবর্ষ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের মনোভাব কারো অজ্ঞাত নয়। জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষের প্রতি ক্রীপসের সহানুভূতি, বিশেষ করে কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর সৌহার্দ্যও তেমনি অতি পরিচিত তথ্য। চার্চিল ইম্পিরিয়ালিস্টদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা রক্ষণশীল। ক্রীপস্ সোশ্যালিস্টগোষ্ঠীতেও সবচেয়ে প্রগতিশীল। জনৈক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, —সর্ববাদিসম্মত প্রস্তাব রচনায় প্রধানমন্ত্রী ও সার স্ট্যাফোর্ডের মতৈক্য হলো কী করে? চার্চিল তাঁর মতবাদ ত্যাগ করেছেন, না কি সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্ বদলেছেন?
প্রবল হাস্যরোলের মধ্যে ক্রীপস্ উত্তর করলেন, কোনোটাই নয়, দুজনারই মতের মিল হওয়ার মতো একটা নতুন পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা এর আগে চোখে পড়েনি।
কনফারেন্স থেকে যখন বাইরে এলেম, ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় ছ’টার কোঠায়। অপরাহ্ণ বেলার শান্তরোষ সূর্যের অ-তপ্ত রশ্মি পড়েছে সেক্রেটারিয়েট ভবনের রক্তাভ প্রাচীরে। সামনের ফোয়ারার উৎসারিত জল কম্পিত ধারায় বিক্ষিপ্ত হচ্ছে বৃত্তাকার প্রস্তর আধারে। ঋজু দীর্ঘ কীংসওয়ের প্রান্তভাগে দেখা যায় ওয়ার মেমোরিয়াল, বিগত মহাযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সৈন্যদের স্মরণলেখা যার গায়ে উৎকীর্ণ। দূরে ইন্দ্রপ্রস্থের পাষাণদুর্গের ভগ্নাবশেষ রূপসী তরুণীর পাশে পলিত কেশ, বিগতযৌবনা বৃদ্ধা পিতামহীর মতো নয়াদিল্লির বর্তমান বৈভবকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কালের অমোঘ বিধান, অপ্রতিরোধনীয় পরিণাম।
পিছনে তাকিয়ে দেখি উন্নতশির ভাইসরয়’স হাউসের বিরাট গম্বুজের শীর্ষে বাতাসে মৃদু আন্দোলিত য়ুনিয়ন জ্যাক,—ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সনাতন গৌরবচিহ্ন। দু’শ’ বছর ধরে ভারতবর্ষে রয়েছে অচল, অটল ও অনপনেয়। এই মাত্র যে কনফারেন্স শেষ হলো, তাতে আশ্বাস ছিল ঐ পতাকার বর্ণ পরিবর্তনের। সে বর্ণ গৈরিক হবে কি সবুজ হবে, তাতে চরকা থাকবে কি অর্ধচন্দ্র থাকবে সে প্রশ্ন পরের। আপাতত এইটিই বড় কথা যে, সে নতুন হবে, ভারতীয় হবে। কিন্তু সে করে গো কবে?