দৃষ্টিপাত – ১৪

চৌদ্দ

ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আধারকারকে যেতে হলো বিলাতে। লাহোর থেকে সপত্নীক ব্যানার্জী সাহেব এসে জাহাজে তুলে দিয়ে গেলেন ব্যালার্ড পিয়ারে।

দিন গেল, মাস বিগত, বৎসরও অতীত প্রায়। বিরহ বেদনায় পীড়িত যে-দিনগুলি অন্তহীন মনে হয় প্রথমে, তারও শেষ আছে। আধারকার প্রত্যাবৃত্ত হলেন স্বদেশে। অবিলম্বে গেলেন লাহোরে।

অঘ্রাণের প্রভাত। ট্রেনের কামরায় ঘুম ভেঙে গিয়ে আধারকার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, নির্মেঘ আকাশে সূর্যোদয়ের স্বর্ণচ্ছটা বিচ্ছুরিত। শাল তরুর কোমল শ্যামল পল্লবদল শিশিরার্দ্র বাতাসে মৃদু কম্পিত। টেলিগ্রাফের তারের উপরে উপবিষ্ট একজোড়া খঞ্জনী পক্ষিশাবক ঘন ঘন পুচ্ছ-আন্দোলনরত। অকারণ খুশিতে ভরে উঠল তাঁর মন।

অপরাহে লাহোরে স্টেশনে পৌঁছে দেখলেন একা ব্যানার্জী সাহেব এসেছেন অভ্যর্থনায়। বাড়ি পৌঁছে বেয়ারার হাতে পেলেন চিঠি। অতি পরিচিত অক্ষরে অনুপস্থিতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা। এক বিশেষ জরুরী কাজে একটি মহিলাকে নিয়ে যেতে হলো এক জায়গায়, চায়ের ব্যবস্থা রইল বেয়ারার কাছে, আধারকার যেন চা খেয়ে নেন। সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরবেন তিনি।

শুধু চায়ের ব্যবস্থা নয়, স্নানের ঘরে বাথ টবে ধরা আছে জল, টাওয়েলরাকে ধবধবে তোয়ালে, সোপ-কেসে আছে আনকোরা সুগন্ধি সাবান। শয়নকক্ষে পরিপাটি বিছানা, খাটের পাশে ছোট টিপাইর উপরে সুদৃশ্য টেবিলল্যাম্প ও খানকয়েক সদ্য প্রকাশিত ইংরেজি উপন্যাস, মায় জয়পুরী ফুলদানীতে সযত্নে বিন্যস্ত আধারকারের প্রিয় শ্বেত করবীগুচ্ছ।

অতিথির পরিচর্যায়, আদরে, আপ্যায়নে লেশমাত্র ত্রুটি নেই কোনোখানে। তবুও কেন যে অকারণ বেদনার ছায়া ঘনায় মনের দিগন্তে আধারকার নিজেই তা জানেন না। প্রবাসে কতদিন নিদ্রাহীন রজনীতে কল্পনা করেছেন আজকের এই মুহূর্তটি। কী বলবেন, তা নিয়ে মনে মনে পর্যালোচনা করেছেন, কত বার। দীর্ঘ বারোমাসের পুঞ্জীভূত কথার মধ্যে কোনটি বলবেন সর্বাগ্রে কোন প্রশ্ন, কোন সংবাদ দেবেন ও নেবেন, তাই নিয়ে অবসরক্ষণে ভেবেছেন কতদিন। দেখা হলে যে কথা ভেবে রেখেছিলেন, তা হয়তো যেতো তলিয়ে, অতি প্রয়োজনীয় জ্ঞাতব্য রইত চাপা, হয়তো শুধু উচ্চারণ করতেন ছোট্ট একটি সাধারণ প্রশ্ন ‘কেমন আছ:’ তার কিছুই হলো না। খচ খচ করতে লাগল আধারকারের মন। হেমন্তের দিনটি যে অপরিসীম আনন্দের অর্ঘ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল, সে আনন্দ নিয়ে যেন শেষ হলো না।

আধারকার সাতদিন রইলেন লাহোরে। সুনন্দার সেবা, যত্নে ও আতিথেয়তায় রন্ধ্র মাত্র রইলো না কোথাও, কিন্তু তবুও যেন আগেকার সে সুর বাজল না আধারকারের মর্মে, রস সঞ্চারিত হলো না অতিথির মনে। কোথায় রইল ফাঁক, কোনখানে ঘটল ব্যত্যয়, তার নিশানা পাওয়া গেল না। শুধু ব্যথা জেগে রইল হৃদয়ের নিভৃততম গহ্বরে। যে অভাব চোখে দেখা যায় না অথচ বুকে বোঝা যায়, তার বেদনা দূর করার উপায় কী?

সুনন্দা কি বদলেছে? কই বোঝা তো যায় না। কিন্তু মন বলে, কী যেন নেই। অতি সামান্য বিষয় কাঁটার মতো বিধে আধারকারের মনে, কুশের অঙ্কুর সম ক্ষুদ্র, দৃষ্টিঅগোচর, তবু তীক্ষ্ণতম। কিন্তু সেগুলি এমনই অকিঞ্চিৎকর যে, তা নিয়ে নালিশ করতে গেলে হাস্যকর ঠেকে। আধারকারের কোটের যে একটা বোতাম ছিঁড়েছে তা যদি একদিন সুনন্দার চোখে না পড়ে থাকে তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। একটা মস্ত সংসারের সমস্ত পরিচালনভার যে গৃহিণীর মাথায়, তার পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক নয়। এটা যুক্তির কথা। কিন্তু মানুষের মন তো ইণ্ডাকটিভ লজিকের পাঠ্য কেতাব নয়। সে ফস্ করে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, কই আগে তো এমন চোখে না পড়তে দেখিনি কখনও।

লাহোর ত্যাগের দিন আধারকার বিদায় সম্ভাষণ জানাতে গেলেন ব্যানার্জীদের এক বন্ধু-পরিবারে। সে-গৃহে আধারকারের সম্প্রীতি জন্মেছিল সুনন্দাদেরই বন্ধুতাসূত্রে। গৃহস্বামীর কন্যা বললেন, ‘আজই যাচ্ছেন কী রকম? এলেন তো এই সে দিন!’

‘সে দিন আর কোথায়, দিন দশেক তো প্রায় হলে!’

‘দশ দিন? কক্ষণো নয়, আমি বলছি অনেক কম। সাত দিন। আচ্ছা বাজী রাখুন? আপনি এসেছেন গেল শনিবারে, সেই যেদিন সুনন্দাদি, রাণু মাসিমা, আমরা সব সিনেমায় গেলাম।’

‘সিনেমায় গেলে?’

‘হ্যাঁ, রাণু মাসিমা এসেছিলেন, এখানে বেড়াতে! তিনি সেন্ট এনড্রজে সুনন্দাদির সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তেন তো? তিনি ধরলেন সিনেমায় যেতে হবে। টিকিট কেনা হয়ে গেছে পর খবর এল আপনি আসছেন ঐ দিনই বিকালে। সুনন্দাদি তাই যেতে চাইছিলেন না, কিন্তু রাণু মাসিমা চলে যাবেন পরদিন সকালে। কাজেই শেষটায় অনেক বলাতে রাজী হলেন। কই আপনি শুনছেন না তো, কী ভাবছেন? বাজী হেরেছেন কিন্তু।’

আধারকারের মুখে চোখে যে বেদনার ছাপ সুস্পষ্ট হলো, তাকে বাজীতে হেরে যাওয়ার শোক মাত্র বলে গণ্য করা কঠিন। কিন্তু বাড়ি ফিরে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন না একটুকুও।

আধারকারকে ট্রেনে তুলে দিতে সে দিন সন্ধ্যায় যথারীতি স্টেশনে এসেছিলেন স্বামী স্ত্রী। ওয়েটিং রুমের একান্তে সুনন্দা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাকে আজ সারাদিন এত আনমানা দেখাচ্ছে কেন? কী এত ভাবছো বলো তো?’

আধারকার চমকে উঠে তৎক্ষণাৎ আত্মসংবরণ করে বললেন, ‘কই, না, তো!’

ট্রেন ছাড়ল। প্ল্যাটফরমের উপর রুমাল সঞ্চালনরত বান্ধব-বান্ধবীদের মূর্তি দূর হতে দূরতর, ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের লাল আলোটা ধীরে ধীরে চলে গেল দৃষ্টির অন্তরালে।

বার্থে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিয়ে আধারকার ভাবতে লাগলেন সেই একই কথা যা আজ সকাল বেলা থেকে কিছুতে তাড়াতে পারছেন না মন থেকে। কেমন করে সম্ভব হলো তার আগমন দিনে সুনন্দার পক্ষে বান্ধবীসঙ্গ? প্রিয়সান্নিধ্যের চাইতে বড় হলো সিনেমা? টিকিট কেনা ছিল? কত লক্ষ টাকা দাম সে টিকিটের? কথা দেওয়া হয়েছিল বান্ধবীকে? কথা নাকি ভাঙা যায় না কিছুর জন্যই? কই আধারকার তো কল্পনা করতে পারে না এমন কোনো এনগেজমেন্ট যা সুনন্দার অভ্যর্থনার জন্য সে অগ্রাহ্য না করতে পারে অবহেলে। এক বছর পর সুনন্দা যদি আসত লণ্ডন থেকে পুণায়, কিংবা ধরো লাহোর থেকে বম্বেতে, আধারকার কি তার নিকটতম বন্ধুর অনুরোধ এড়াত না, মাথাধরা বা শরীর খারাপের কল্পিত অজুহাত দেখিয়ে? প্রিয়জনের জন্যে মিথ্যাভাষণেও কি নেই সুখ?

বেশ তো, না হয় ধরে নেওয়া গেল, বাল্যবন্ধুর কাছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা সম্ভব ছিল না। আগেভাগে টিকিট কেনা ছিল, যেতে হয়েছে সিনেমায়। এতে দোষ কিছুই নেই। কিন্তু তার জন্য গোপনীয়তার আবশ্যক ছিল না, ছিল না জরুরী কাজের দোহাই দিয়ে এই মিথ্যা ছলনার!

বম্বেতে মন বসল না কাজে, তিষ্ঠিতে পারলেন না দীর্ঘকাল। আবার গেলেন লাহোরে। কিন্তু খণ্ডিত লয় খেয়াল গানের মতো কিছুতে পৌঁছতে পারলেন না আর সমে, বেতালা বেসুরো বাজতে লাগল জীবনের রাগিণী। ভারকেন্দ্র থেকে যেন চ্যুত হয়ে পড়ল এই দুটি অনাত্মীয় নরনারীর তিন বছর ধরে দিনে দিনে গড়া হৃদয়সৌধ। ফিরে গেলেন বম্বেতে। এমনি করে বারংবার যাওয়া আসা করলেন বম্বে থেকে লাহোরে, লাহোর থেকে বম্বে।

অবশেষে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতরূপে এই অস্থির ব্যাকুলতার একদিন ঘটল অবসান।

আধারকার আবার লাহোরে। সংশয় বেদনায় বিচলিত। অথচ প্রকাশ্য অভিযোগের নেই উপলক্ষ। কারণ সুনন্দার প্রতি আধারকারের দাবি তো অধিকারের নয়, অনুভূতির। দাবি হৃদয়ের। সে হৃদয় যুক্তি-জ্ঞানহীন শিশুর মতো বারংবার কেবলই অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দুপুরে আপিসের কাজে বের হওয়ার কালে সে-দিন সুনন্দা কাছে এসে দাঁড়ালেন না, আগের মতো এগিয়ে দিলেন না রুমাল, ফাউন্টেন পেন, হাতের ঘড়ি ও পকেটের পার্স। ঝি বললে, ‘মেমসাব রসুইমে আলু বনাতী হৈঁ।’ পরদিন সন্ধ্যাবেলা আপিস প্রত্যাগত আধারকার কাউকে প্রতীক্ষমানা দেখলেন না দোতলার বারান্দায়। শুনলেন ধোবার কাপড় মিলিয়ে নিতে ব্যস্ত আছেন মেমসাব।

রাগ করার কিছুই নেই এতে। কিন্তু অভিমানাহত মন বলে, কই ইতিপূর্বে কখনও তো ঘটেনি এমন দুর্ঘটনা। আধারকারের নির্গমন-আগমনক্ষণে কোনো দিন দেখা যায়নি রন্ধনশালায় আলু কর্তনের প্রতি গৃহিণীর এই অপ্রতিরোধনীয় অনুরাগ এবং রজকের অপহরণপ্রবণতার বিরুদ্ধে মেম সাহবের এই সতর্ক পাহারা।

ব্যানার্জীর আপিসে কাজের চাপ ছিল বেশী, প্রত্যাগমনে ঘটবে বিলম্ব। সন্ধ্যার প্রাক্কালে আধারকার প্রস্তাব করলেন, ‘চল বেরিয়ে আসি সাহাদারা গার্ডেনস।’

সুনন্দা বললেন ‘না’

তবু পীড়াপিড়ি করলেন আধারকার। ‘কেন চল না।’

‘না একা তোমার সঙ্গে দেখলে লোকে কী বলবে?’

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলেন আধারকার। সুদূর অতীতের কথা নয়, স্মৃতিকে করতে হবে না মন্থন। এই তো বিলেত যাওয়ার আগেও কতদিন দুজনে গেছেন সালিমার বাগে, সিনেমায়, জুহুর সমুদ্রতীরে, বম্বের রেস্তোরাঁয়। সনন্দা নিজে উদ্যোগ করে নিয়ে গেছেন অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির দর্শনে, ব্যানার্জী রয়েছেন লাহোরে। সে-দিন কোথায় ছিল লোকেরা, কোথায় ছিল তাদের মন্তব্যের প্রতি সহচারিণীর এই অসাধারণ শ্রদ্ধা?

লোকে দেখলে কী বলবে? হায়রে এ প্রশ্ন যে আধারকারই আগে তুলেছিলেন একদিন অতীতে।

বম্বেতে সেবার শীতের শেষে বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব হলো মহামারীরূপে। আধারকারর গায়ে বেরুল গুটিকা। কী জানি কেমন করে খবর পৌঁছল লাহোরে। পরদিন সন্ধ্যাবেলায় সুনন্দা এসে হাজির হলেন আধারকারের ফ্ল্যাটে। আধারকার বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুমি?’

শঙ্কা, স্নেহ ও অভিমান জড়িত কণ্ঠের উত্তর শুনলেন, ‘তা ছাড়া আর দুর্ভোগ আছে কার? ক’দিন হয়েছে?’

‘দিন চারেক, কিন্তু আমি তো খবর দেব না বলেই ঠিক করেছিলাম।’

‘তা করবে না? তা না হলে আর আমাকে ভাবিয়ে মারবে কেমন করে?’

আধারকার উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন, ‘এই ছোঁয়াচে রোগ, এর মধ্যে আসবার মন্ত্রণা দিল কে তোমাকে?’

ক্রুদ্ধ হয়ে সুনন্দা বললেন, ‘দেখ, আমাকে রাগিও না বলছি। মন্ত্রণা দিয়েছে কে? মন্ত্রণা দিয়েছে আমার অদৃষ্ট।’ খানিক থেমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চাকর বাকর হতভাগাগুলো গেছে কোন চুলোয়?’

‘বাবুর্চি আর বেয়ারাটা পালিয়েছে ভয়ে। মাদ্রাজী ড্রাইভারটা আছে। সে-ই ওষুধপত্র আনে।’

‘খাসা ব্যবস্থা, শুধু খবরের কাগজে ‘শোক সংবাদ’ ছাপাটুকুই যা বাকী’, বলে সুনন্দা গেলেন ড্রাইভারের সন্ধানে। তাকে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে মাল পত্র আনলেন উপরে। ঘরদোর করলেন আবর্জনামুক্ত, ধূলিহীন। বিছানা ঝেড়ে মুছে নতুন করে রচনা করলেন, স্বহস্তে রোগীর পথ্য তৈরি করলেন পরম নৈপুণ্যে।

আধারকার জিজ্ঞাসা করলেন ‘ব্যানার্জীকে দেখছি না যে?’

‘তিনি তো আসেননি।’

‘আসেননি? তুমি এসেছ কার সঙ্গে?

‘কারো সঙ্গে নয়, একা।’

‘মানে?’

‘মানে আবার কী? উনি গেছেন ট্যুরে; ফিরতে দেরী হবে দিন পাঁচেক। তোমার লাহোরের এজেন্টের সঙ্গে পরশু সকালে দেখা হয়েছিল এক দোকানে। তার কাছে খবর পেলেম অসুখের। বাড়িতে তালা এঁটে দুপুর সাড়ে এগারোটার ট্রেন ধরেছি ছুটতে ছুটতে। ওঁকে টেলিগ্রাম করে দিয়ে এসেছি এখানে রওনা হতে।’

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আধারকার বললেন, ‘ব্যানার্জী রাগ করবেন না?’

‘হয় তো করবেন।’

কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে আধারকার বললেন, ‘লোকেই বা বলবে কী? ব্যানার্জী ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে না কেন? একা চলে এলে কেন?’

বিরক্ত কণ্ঠে বললেন ‘এসেছি আমার ইচ্ছে। লোকের ভাবনা ভেবে তোমার মাথা গরম করতে হবে না। তুমি চুপ করে ঘুমোও তো এখন।’ বলে শয্যাপার্শ্বের চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

ঘরের মধ্যে আলো বেশী ছিল না, রোগীর দৃষ্টি থেকে আড়াল করার জন্য টেবিলল্যাম্পের একটা দিক খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা। পশ্চাৎ থেকে সুনন্দার মুখের অংশমাত্র দেখা যায়। কিছুক্ষণ পূর্বে সুনন্দা স্নান করেছেন। আর্দ্র কুন্তলদল পিঠের উপর অযত্নবিস্রস্ত। পরিধানে দেশী তাঁতের একটি শাড়ি। বামস্কন্ধের উপর তার অবিন্যস্ত বঙ্কিম? অঞ্চল প্রান্তের অন্তরাল থেকে নিটোল সুকুমার বাহুটি অনবদ্য ভঙ্গিতে লম্বিত। উন্নত গ্রীবার নিকটে সূক্ষ্ম একটি স্বর্ণহারের একটুখানিমাত্র আভাস। মৃদু দীপালোকিত কক্ষে বাতায়নবর্তিনীর এই মৌন মূর্তিটি রোগশয্যাশায়িত আধারকারের কাছে এটি পরম নিশ্চিত আশ্বাসের মতো প্রতীয় মান হলো। দুজনের কেউ আর কোনো কথা বললেন না। শুধু উভয়ের উদ্বেল হৃদয়ের গভীর ভাবাবেগ সমাজ-সংসারের সমস্ত ক্ষুদ্রতা ও কলঙ্কের ঊর্ধ্বে দেব মন্দিরের পবিত্র হোমাগ্নির মতো যেন জ্বলতে লাগল একটি অনির্বাণ অদৃশ্য শিখায়।

পরের দিন ব্যানার্জীও এসে পৌঁছলেন। আধারকারের বসন্ত আসল নয়, চিকেন। কিন্তু রোগমুক্ত হতেই সুনন্দা জোর করে নিয়ে গেলেন লাহোরে এবং পক্ষাধিককাল পূর্বে আবারকার ছাড়া পেলেন না বম্বেতে ফিরতে।

সে-দিনের সুনন্দার দৃষ্টি ছিলনা বাইরে, গ্রাহ্য ছিল না লোকাপবাদের, মন ছিল ইতর জনের নিন্দা-প্রশংসার অতীত। সংসারে ছিল না আসক্তি, গৃহকর্মে ছিল না আকর্ষণ, স্বামীতে ছিল না মনোযোগ। কতদিন আধারকার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সুনন্দাকে, ‘এই, ব্যানার্জী এসেছে আপিস থেকে। যাও, দেখগে তার কী চাই।’

সুনন্দা বলেছেন, ‘আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে। তোমাকে আর গিন্নিপনা শেখাতে হবে না। তুমি ব্যানার্জীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কি না?’

সেদিনের সুনন্দা নহে মাতা, নহে কন্যা, নহে বধূ। সে শুধু প্রণয়িনী। সে তো সুনন্দা ব্যানার্জী নয়, সে সুনন্দা প্রিয়দর্শিনী।

সুনন্দারা হিন্দু নয়, খ্রীস্টান। বহু বর্ষ পূর্বে তাঁর পিতামহ এসে স্থায়ী আবাস গড়েছিলেন লাহোরে। সুনন্দা মানুষ হয়েছেন ইউরোপীয় আবেস্টনে, বিদ্যাভ্যাস করেছেন শ্বেতাঙ্গদের কনভেন্টে, পরিণীতা হয়েছেন খ্রীস্টীয় প্রথায়। তাঁদের সমাজে তরুণীরা অবগুণ্ঠনবতী নয়, স্ত্রীরা নন অন্তঃপুরিকা। পুরুষের অবাধ সাহচর্য সেখানে নিন্দনীয় নয়, বাইরে বন্ধুসঙ্গ নয় নিষিদ্ধ। এমন কি বিবাহ বিচ্ছেদ এবং পুনর্বিবাহেও সামাজিক অন্তরায় ছিল না সুনন্দার।

কঠোর তিক্ত সত্য হৃদয়ঙ্গম করলেন আধারকার। মোহভঙ্গ হয়েছে সুনন্দার। সুধার পাত্র হয়েছে রিক্ত। মন্থন করলে আর উঠবে না মধু, উঠবে হলাহল।

সে-দিন অপরাহ বাড়ি ফিরবার উৎসাহ ছিল না আধারকারের। টেলিফোন করে জানিয়ে দিলেন ফিরতে বিলম্ব হবে তাঁর। বহুক্ষণ লক্ষ্যহীনভাবে ইতস্তত পরিভ্রমণ করে অবশেষে উপস্থিত হলেন ম্যালের পাশে সিনেমা হলের সম্মুখে। কী যেন কী খেয়াল হলো, টিকিট কিনে প্রবেশ করলেন ভিতরে। ছবি তখন শুরু হয়ে গেছে। অন্ধকার ঘরে টিকিট চেকার বসিয়ে দিয়ে গেল একটা আসনে। নির্বাক চিত্র। কিড়ড়ড় শব্দে প্রজেক্টারের আওয়াজ শোনা যায় স্পষ্ট। দর্শকদের আলাপ, আলোচনা, মন্তব্যেরও বাধা থাকে না।

হঠাৎ নিজের নাম কানে আসতে চমকে উঠলেন আধারকার। সামনের সারিতে কারা বসেছেন অন্ধকারে তা দৃষ্টিগোচর নয়, কিন্তু তাঁরা যে পুরুষ নন সে বিষয়েও সন্দেহ থাকে না। আধারকার উৎকর্ণ হয়ে শুনলেন।

‘যাই বলিস ভাই, এডমায়ারার-এর সংখ্যা আর বাড়াসনে। আধারকার বেচারা তো মরেছে তোর হাতে, আর কেন? ‘ চাপা কণ্ঠে বললেন একটি মহিলা।

উত্তর হলো, ‘হ্যাঁ, বলেছে এসে তোর কানে কানে!’

আধারকার আসন থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন মাটিতে। ভুল করার সাধ্য কি ও কণ্ঠ? এ কণ্ঠ যে তাঁর জীবন ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে অচ্ছেদ্য বন্ধনে। প্রথম শুনেছিলেন তিন বছর পূর্বে দাদর স্টেশনে।

সখীদ্বয়ের পরিহাস পরিবাদ চলতে লাগল মৃদুকণ্ঠে, কিন্তু আধারকারের শ্রুতির অগোচর রইল না এক বর্ণও।

প্রশ্নকর্ত্রী বললেন, ‘কানে কানে বলতে হবে কেন? আমাদের কী চোখ নেই? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আর কোনো আশা নেই লোকটার।’

‘ইস, বড় যে দরদ দেখছি। ওগো করুণাময়ি, তবে তুমিই ত্রাণ কর না কেন তাকে!’

‘বলিস কি! সইতে পারবি? তা হলে যে তোর মুখচন্দ্রমা অমাবস্যার অন্ধকারে ছেয়ে যাবে, বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটবে আমার!’

‘একটুও না। দিব্যি করে বলছি, আমার তাতে কি আসে যায়? বরং ছাড়া পেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।’ কণ্ঠ পরিহাসতরল নয় এবার!

প্রশ্ন কর্ত্রী নিজেও বোধহয় কিছুটা বিস্মিত হলেন। কৌতুক পরিহার করে বললেন, ‘কেন ভাই, আধারকারকে তো বেশ ভালো লোক মনে হয়। ভদ্র, শিক্ষত, বিত্তশালী অথচ স্নব নয়, বেশ সিম্পল।’

‘সিম্পল নয়, সিম্পল্টন। কাওজান নেই এতটুকু। সব জিনিসই অত্যন্ত সীরিয়াসলি নেবে। কবে কখন Fun করে কী বলেছি কী করেছি, সেটাকেই মনে করে বসেছে, আমি ওর প্রেমে পড়েছি। ইডিয়ট। সত্যি বলছি তোকে, আমি ক্রমশ যেন টায়ার্ট হয়ে উঠছি।’

হঠাৎ ছবির স্কুল ছিড়ে গিয়ে ছবি হলো বন্ধ, আলো জ্বলে উঠল প্রেক্ষাগৃহের। সে আলোতে দেখা গেল আলাপ আলোচনারত বান্ধবীদ্বয়কে অদূরবর্তী আসনে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে জোড়া দেওয়া ফিল্ম শুরু হলো। আবার অডিটরিয়মের বাতি দেওয়া হলো নিভিয়ে।

ছবির আখ্যান-ভাগ এক তরুণী শ্রেষ্ঠিকন্যার প্রণয়কাহিনী। দরিদ্র প্রেমাস্পদ চলে যাচ্ছেন দূরদেশে জীবিকার প্রয়োজনে। সন্ধ্যাবেলায় পরিজনের অলক্ষিতে উদ্যান-বাটিকায় তরুণী সাক্ষাৎ করলেন তাঁর সঙ্গে। পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করে সঙ্গিনী হতে চাইলেন দয়িতের। কিন্তু তরুণ চায় না ধনীকন্যাকে দারিদ্র্যের মধ্যে টেনে আনতে। বলে আমাকে ভুলে যেও। মনে করো—এক সন্ধ্যায় অপ্রত্যাশিত রূপে দু’জনে দেখা হয়েছিল এক পান্থশালায়, রাত্রি প্রভাতে যাত্রীরা চলে গেছে নিজ নিজ বিভিন্ন পথে। আর দেখা হবে না কোন দিন।

শ্রেষ্ঠিকন্যার প্রেম গভীর। ঐহিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্ন তাঁর কাছে তুচ্ছ, দৃষ্টি নেই মণি মুক্তা বিলাসোপকরণ বা ঐশ্বর্যসম্ভারে। যাঁকে প্রাণ সমর্পণ করেছেন, তাঁর বিহনে প্রাণ ধারণ করবেন কেমন করে? হে নিষ্ঠুর যদি ফেলে যাও এ অভাগিনীকে, পায়ে দলে যাও কোমল হৃদয় তবে জেনো মৃত্যু তার অবধারিত।

দর্শকগণ রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় সম্মুখের পর্দায় নিবদ্ধদৃষ্টি।

প্রণয়ব্যাকুলা রমণীর এই আত্মসমর্পণে কী করবে তরুণ নায়ক? প্রচুর পাউডার প্রলিপ্ত নায়িকার গণ্ডদেশে ঠাস করে একটি সবল চপেটাঘাত করলে আধারকার সব চেয়ে খুশি হতেন। কিন্তু তা কেমন করে হবে? ছবিতে দেখা গেল, আকাশে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ, মাধবীলতায় ফুটেছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল, পরস্পরের চঞ্চুতাড়না দ্বারা প্রণয় নিবেদন করছে তরুশাখে উপবিষ্ট ক্রৌঞ্চমিথুন এবং উদ্যানের সরোবরে দুটি প্রস্ফুটিত পদ্ম হঠাৎ দু’দিক থেকে ভাসতে ভাসতে এসে মিলল একসঙ্গে। ভারতীয় সিনেমার এই চির পরিচিত পারিপার্শ্বিকে ছায়াচিত্রের নায়কেরা চিরকাল যা করে থাকে তাই করল তরুণ। বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল নায়িকাকে। দু’জনে হাত ধরাধরি করে রওনা হলো। কোথায় তা অবশ্য একমাত্র চিত্র পরিচালকই জানেন। বিমুগ্ধ দর্শকবৃন্দের সঘন করতালি ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল প্রেক্ষাগার। শেষ হলো নাটিকার।

সকলের অলক্ষিতে আধারকার নিষ্ক্রান্ত হলেন প্রেক্ষাগৃহ থেকে। মনে মনে বললেন, একমাত্র নাটকের মধ্যেই সম্ভব এই অবাস্তব কাহিনীর অবতারণা। সেখানে তো সত্যিকারের জীবন্ত মানুষের মুখোমুখি হওয়ার দায় নেই। তাই তার কল্পিত নায়িকার পক্ষে কোনো অসম্ভব আচরণ বা কোনো অস্বাভাবিক উক্তি করতেই বাধা নেই শুনে আমরা বিমুগ্ধ দর্শকরাও এঙ্কোর’, ‘এঙ্কোর’ বলে চেঁচিয়ে উঠি। আমরা তো জানিনে শ্রেষ্ঠিকন্যার যে-প্রণয়নিবেদন দৃশ্য দেখে আমাদের চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে ওঠে তার ষোল আনাই স্টেজ-ম্যানেজড, ষোল আনাই ফান। সমস্তটাই ফাঁকি। হতভাগ্য নায়ক সে তথ্য জানতে পারে দু’দিন পরে। কিন্তু সে তো দর্শকের দেখার উপায় নেই। রচিত কাব্যের বর্হিদেশে, অভিনীত নাটকের নেপথ্যে সে থাকে চিরকাল লোকলোচনের অন্তরালে। নাটকের যেখানে শেষ, জীবনের সেখানেই তো শুরু।

সেই রাত্রেই লাহোর পরিত্যাগ করলেন আধারকার।

রাত বারোটায় ট্রেন। খোয়া-বাঁধানো পথের উপর দিয়ে মন্থর গতিতে চলেছে টাঙ্গা। এপথে কতবার আসা-যাওয়া করেছেন আধারকার। কিন্তু আজকের এই যাত্রা তো অন্য আর বারের মত নয়। তখন যাওয়ার মধ্যে থাকতো অদূরবর্তী পুনরাগমনের আশ্বাস, থাকতো পুনর্মিলনের সতৃষ্ণ প্রতীক্ষা। আজ সে-আশা রইল না এতটুকুও। যে গৃহদ্বার এইমাত্র অতিক্রম করলেন, যে পথ রাখলেন পশ্চাতে, কদাচ তা পুনশ্চারণের আর সম্ভাবনা রইল না।

যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায়, বোমার আঘাতে আহতের একটি বাহু দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে অদূরে, অথচ তার সংজ্ঞা হয়নি বিলুপ্ত। এ্যাম্বুল্যান্স-বাহিত সে আহত স্পষ্ট দেখতে পায়, ফেলে রেখে যাচ্ছে সে আপন খণ্ডিত বাহু। আধারকার অনুভব করলেন সেই অনুভূতি। আপন চোখে দেখতে পেলেন পশ্চাতে ফেলে রেখে যাচ্ছেন বাহু নয়, শতধাবিদীর্ণ হৃদয়।

ফানই বটে! স্নেহ নয়, প্রীতি নয়, শোভা-গন্ধ বিমণ্ডিত হৃদয়াবেগের বাষ্প মাত্র নয়, শুধু কৌতুক। নিষ্কল প্রণয়ের উপশম আছে করুণায়, কিন্তু উপহসিতের নেই সান্ত্বনা। তার লজ্জা দুঃসহ।

এই হৃদয়হীন নারীর ছলনাকেই সত্য কল্পনা করে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন আধারকার, একথা ভেবে নিজের উপরেই গভীর বিতৃষ্ণা জন্মাল তার। কতদিন প্রমত্ত প্রগল্ভতায় হৃদয়ে কত দুর্বলতা ব্যক্ত করেছেন তাঁর কাছে, কত স্বপ্ন গড়েছেন তাঁকে কেন্দ্র করে, সেসব স্মরণ করে বারংবার নিজেকে ধিক্কার দিলেন আধারকার।

গভীর বেদন ও অপরিসীম লজ্জা নিয়ে আধারকার ফিরে চললেন স্বস্থানে। অনন্ত আকাশে লক্ষ কোটি যোজন দূরের যে তারকা শ্রেণী অনিমেষ নয়নে এই বিপুলা ধরিত্রীর পানে তাকিয়ে আছে, তারা সাক্ষী রইল আর একটি সকরুণ কাহিনীর। যুগযুগান্ত ধরে এমন কতশত অশ্রুসজল বেদনাবিধুর নাট্য অভিনীত হয়েছে তাদের পলকহীন নয়নের অকম্পিত দৃষ্টির সম্মুখে। কত খেলা গেছে ভেঙে, কত ফুল ঝরেছে ধূলায়, কত বাঁশরী হয়েছে নীরব!

এই স্বল্পপরিসর জীবনের প্রায় সমুদয় অংশ আধারকার কাটিয়েছেন একা। এই তো সে-দিন পর্যন্ত চাকর বেয়ারা মাত্র সম্বল ফ্ল্যাটে আপনাকে নিয়ে আপনি ছিলেন মগ্ন। আজও আবার সেই নিঃসঙ্গ একাকিত্বের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন করলেন। অথচ এ দুয়ের মধ্যে কি অপরিসীম প্রভেদ। আকাশ আজ নিঃশেষে শূন্য, বাতাস আজ নিরর্থক, এই জনাকীর্ণ পৃথিবীর সমাজ ও সংসারের যাবতীয় কর্ম বিস্বাদ ও ক্লান্তিকর।

নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে দেখলেন আধারকার। একটা বিরাট মরুভূমির মতো সর্বত্র ঊষর। কোনোখানে নেই একটু ছায়া, একটু শ্যামলিমা, একটু আলোক আঁধার বিজড়িত স্নিগ্ধতার চিহ্ন লেশ।

আধারকার মূর্খই বটে। কাঁচকে ভেবেছিলেন হীরা, সদ্য টাকশাল থেকে নির্গত উজ্জ্বল তাম্রখণ্ডকে ভ্রম করেছিলেন গিনি বলে। গান্ধীজির একটা লেখা চোখে পড়ল, আধুনিকাদের সম্পর্কে। তারা নাকি প্রত্যেকেই নিজেকে ভাবে একটি জুলিয়েট, এক সঙ্গে আধ ডজন রোমিওর প্রণয়িনী। আধারকারের মনে হয়, এতদিনে যেন অর্থ পেলেন।

কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারেন না একেবারে। আবার সংশয় জাগে চিত্তে। একাধিক রোমিওর জন্য কি দুর্যোগের রাত্রিতে উৎকণ্ঠায় বিনিদ্র রজনী যাপন করা যায়? সম্ভব হয় তাদের অসুখের সংবাদে স্বামী সংসার ফেলে একাকী একহাজার মাইল ছুটে যাওয়া!

বম্বেতে ফিরে মাস কয়েক বিপুল উদ্যমে চেষ্টা করলেন আপনাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে কর্মের মধ্যে। মিলের কাজে খাটতে লাগলেন সকাল থেকে সন্ধ্যা। ভুলতে প্রয়াস করলেন বিগত তিন বৎসরের স্বল্পায় স্বপ্নলোক। করতে চাইলেন নতুন করে জীবনারম্ভ। কিন্তু মন তো শিশুদের আঁক কষার শ্লেট নয় যে, ইচ্ছা মতো পেন্সিলের আঁচড় মুছে নতুন করে সংখ্যাপাত করা যাবে। নিজের সঙ্গে দিনের পর দিন অবিরাম যুদ্ধ করে ক্ষতবিক্ষত হলেন আধারকার। তারপর জলের দামে একদিন হঠাৎ মিল দিলেন বিক্রি করে। অন্তর্হিত হলেন বম্বে থেকে।

গেলেন মালয়া, রবারের বাগানে হলেন ম্যানেজার। ভালো লাগল না বেশী দিন গেলেন সিলোনে এক কফি কোম্পানীর কর্তারূপে, টিকতে পারলেন না দু’বছর। বুয়েনস্ এয়ার্সে কাজ করলেন মদের কারখানায়; সেখানেও বিরক্তি ধরল। পরিব্রাজক হয়ে দীর্ঘকাল পরিভ্রমণ করলেন, দেশ দেশান্তর। নানকিং, ক্যানবারা, টরোন্টো, ওয়াশিংটন, লাইপৎসিগ, ব্রাসেলস। তবু ভুলিল না চিত্ত।

নিউ ক্যাসেলের এক ইংরেজ কোম্পানী থেকে এককালে নিজের মিলের জন্য আধারকার কিনেছিলেন কিছু সাজ-সরঞ্জাম। তাদের ভারতীয় শাখার ম্যানেজাররূপে অবশেষে আধারকার এলেন দিল্লীতে। এখানে আছেন আজ প্রায় এগারো বছর। যে মিল তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন কুড়ি বছর আগে, তার ম্যানেজিং ডিরেক্টর আজ কোটিপতি। সেখানে এক ডজন কর্মচারী আছে যারা আধারকারের চেয়ে বেশী মাইনে পায়।

বছরের পর বছর হয়েছে গত। জীবনের আজ অপরাহ্ বেলায় এসে পৌঁছেছেন আধারকার। দেহে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে বার্ধক্যের আক্রমণ-আভাস। হৃদয়াবেগের যে তীব্রতা যৌবনের লক্ষণ, আজ তা স্তিমিততেজ।

যে সুনন্দাকে আধারকার ভালোবেসেছিলেন, সে তো শুধু ঐ রক্ত মাংসের মানুষটি নয়। প্রেম আপন গভীরতায় নিজের মধ্যে একটি মোহাবেশ রচনা করে। সেই মোহের দ্বারা যাঁকে ভালোবাসি তাঁকে আমরা নিজের মনে মনে মনোমত করে গঠন করি। যে সৌন্দর্য তাঁর নেই, সে সৌন্দর্য তাতে আরোপ করি। যে গুণ তাঁর অভাব, সে গুণ তাঁর কল্পনা করি। সে তো বিধাতার সৃষ্ট কোনো ব্যক্তি নয়, সে আমাদের নিজ মানসোদ্ভূত এক নতুন সৃষ্টি। তাই কুরূপা নারীর জন্য রূপবান, বিত্তবান তরুণেরা যখন সর্বস্ব ত্যাগ করে, অপর লোকেরা অবাক হয়ে ভাবে, ‘আছে কী ঐ মেয়েতে, কী দেখে ভুলল?’ যা আছে সে তো ঐ মেয়েতে নয়, যে ভুলেছে তার বিমুগ্ধ মনের সৃজনধর্মী কল্পনায়। আছে তার প্রণয়াঞ্জনলিপ্ত নয়নের দৃষ্টিতে। সে যে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে করেছে তাহারে রচনা।

আধারকারের দৃষ্টি থেকে সে অঞ্জন আজ বিলুপ্ত, মন থেকে সে মোহাবেশ অপসৃত। একদিন জগতের সমস্ত কবিকুলের কল্পলোক থেকে আহৃত যে সৌন্দর্য, যে-সুষমা, যে বর্ণসম্ভার দ্বারা সুনন্দাকে তিনি রচনা করেছিলেন তিলে তিলে, আজ তার লেশমাত্র নেই। প্রবঞ্চিত আধারকারের কাছে সুনন্দা আজ একজন অতি সামান্য রমণী মাত্র। কোনোখানে তার এতটুকু অনির্বচনীয়তা, এতটুকু বিশেষত্ব অবশিষ্ট নেই।

কিন্তু কী আশ্চর্য মানুষের মন! আজও ক্ষতের মূল রয়েছে গভীরে যদিও চিহ্ন গেছে মিলিয়ে। অসাবধান মুহূর্তে ছোঁয়া লাগলে আজও কেন টন টন করে ব্যথায়? কেন নিঃশেষ হয় না স্মৃতি?

আধারকারের কাহিনী শেষ হলো।

বাক্যহীন নিস্তব্ধতায় বসে রইলেম খানিকক্ষণ।

‘হুজুর, ট্যাঙ্গা ল্যানে পড়েগা?’

চমকে চেয়ে দেখি আধারকারের ভৃত্য। কখন আধারকার উঠে চলে গেছেন, নিঃশব্দে, টের পাইনি একটুও। আপন জীবনের নিগূঢ় গোপন কাহিনী ব্যক্ত করেছেন আজ এক অতি অল্প দিনের পরিচিত অসমবয়সী বন্ধুর কাছে। যখন বলে গেছেন, তখন অবগাহন করেছেন স্মৃতির ধারায়। কাহিনী সাঙ্গ হতেই সে মোহজাল ছিন্ন হয়েছে, নেমে এসেছেন বাস্তবের প্রত্যক্ষ ভূমিতে। সঙ্কোচ দেখা দিয়েছে সেই মুহূর্তে, যেই হয়েছে চোখাচোখি। তাই অদৃশ্য হয়েছেন নিঃশব্দে। সুতরাং বিদায় নেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত হলেম। ভৃত্যকে টাঙ্গা আনতে করলেম বারণ। পদব্রজে নিষ্ক্রান্ত হলেম পথে।

শুক্লপক্ষের অষ্টমী চাঁদ উঠেছে মেঘশূন্য আকাশে, তার জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে দু’পাশের বাংলোগুলির বিস্তীর্ণ অঙ্গনে। পথ জনশূন্য, ধ্বনিবিরল। কাছাকাছি কোথায় যেন হাসনুহানার ঝাড়ে ফুটছে ফুল। তার তীব্র মদির সুবাসে বাতাস হয়েছে উতলা আকুল, রজনী হয়েছে গন্ধবিহ্বল।

চলতে চলতে ভাবছিলেম আধারকারের কথা। কানে বাজতে লাগল সকরুণ স্বীকারোক্তি, ‘মিনি সাহেব, আমি ইডিয়টই বটে! পরিহাসকে মনে করেছি প্রেম; খেলাকে ভেবেছি সত্য। কিন্তু আমি তো একা নই। জগতে আমার মতো মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত। যুগে যুগে এই নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে, ভালোবেসেছে, তারপর সারা জীবনভোর কেঁদেছে। হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে রসঘন, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গান, শিল্পী অঙ্কন করেছেন চিত্র, ভাস্কর পাষাণ-খণ্ডে উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা। জগতে বুদ্ধিমানেরা করবে চাকরি, বিবাহ, ব্যাঙ্কে জমাবে টাকা, স্যাকরার দোকানে গড়াবে গহনা; স্ত্রী, পুত্র, স্বামী, কন্যা নিয়ে নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করবে স্বচ্ছন্দ সচ্ছলতায়। তবু আমরা মেধাহীনের দল একথা কোনো দিন মানবো না যে, সংসারে যে বঞ্চনা করল, হৃদয় নিয়ে করল ব্যঙ্গ, দুধ বলে দিল পিটুলী, তারই হলো জিত, আর ঠকল কেবল সে, যে উপহাসের পরিবর্তে দিল প্রেম।’

অতি দুর্বল সান্ত্বনা। বুদ্ধি দিয়ে, রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে বলা সহজ-জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা, ধূলায় তাদের যত হোক অবহেলা।’ কিন্তু জীবন তো মানুষের সম্পর্ক বিবর্জিত একটা নিছক তর্ক মাত্র নয়। শুধু কথা গেঁথে গেঁথে ছন্দ রচনা করা যায়, জীবন ধারণ করা যায় না।

আধারকার হচ্ছেন সেই শ্রেণীর পুরুষ, যারা কিছুই হাতে রাখতে জানেন না। এঁদের কপালে দুঃখ অনিবার্য। পলিটিক্সের মতো মানুষের জীবনও হচ্ছে এ্যাডজাস্টমেন্ট আর কম্প্রমাইজ। এ দারুণ ইনফ্রেশনের বাজারেও সংসারে শুধু হৃদয়ের দাম খুব বেশী নয়।

সুনন্দার পক্ষে সম্ভব ছিল না আধারকারের গতিতে তাল রেখে চলা। সে নারী। প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতঃই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌয়ে শাড়ির মতো নিতান্তই সাধারণ; তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিস্ময়, না আছে উচ্ছলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে বেনারসী শাড়ীর মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন।

আধারকার নিজেই একদিন বলেছিলেন, ‘মিনি সাহেব, জগতে যুগে যুগে কিং এডওয়ার্ডেরাই করেছে মিসেস সিম্পসনের জন্য রাজ্য বর্জন, প্রিন্সেস এলিজাবেথেরা করেনি কোনো জন, স্মিথ বা ম্যাকেঞ্জির জন্য সামান্যতম ত্যাগ। বিবাহিতা নারীকে ভালোবেসে সর্বদেশে সর্বকালে আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে একাধিক পুরুষ; পরের স্বামীর প্রেমে পড়ে কোনোদিন কোনো নারী রয়নি চিরকুমারী।’

কোমলহৃদয় বলে আমার খ্যাতি নেই। কিন্তু অধারকারের জন্য সত্যিকার বেদনা বোধ করলেম হৃদয়ে। সুনন্দা ব্যানার্জী আজ কোথায় আছেন জানি নে। অনুমান করছি, এতদিনে তাঁর যৌবন হয়েছে গত, দেহ বিগতশ্রী, দৃষ্টি বিদ্যুৎহীন এবং কপোলের রেখাগুলি প্রচুর প্রসাধনপ্রলেপের দ্বারাও আজ আর কোনো মতেই গোপনসাধ্য নয়। কোনো দিন কোনো অবকাশ মুহূর্তে বহু বর্ষ আগেকার এক মারাঠি ব্রাহ্মণের চরম নির্বুদ্ধিতার কথা স্মরণ করে ক্ষণেকের জন্যও তার মন উন্মনা হয় কিনা, সে কথা আজ জানার উপায় নেই। অথচ তাঁরই জন্য আধারকার দিলেন চরম মূল্য। নিজেকে বঞ্চিত করলেন সাফল্য থেকে, খ্যাতি থেকে, ঐহিকের সর্ববিধ সুখ স্বাচ্ছন্দ্য থেকে! সব চেয়ে বড় কথা, নিজেকে বঞ্চিত করলেন সম্ভবপর উত্তরপুরুষ থেকে, বংশের ধারাকে করলেন বিলুপ্ত।

কোনো দিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁর কুশল কামনা করে তুলসীমঞ্চে কেউ জ্বালাবে না দীপ, কোনো নারী সীমন্তে ধরবে না তাঁর কল্যাণ কামনায় সিন্দুরচিহ্ন, প্রবাসে অদর্শনবেদনায় কোনো চিত্ত হবে না উদাস উতল। রোগশয্যায় ললাটে ঘটবে না কারও উদ্বেগকাতর হস্তের সুখস্পর্শ, কোনো কপোল থেকে গড়িয়ে পড়বে না নয়নের উদ্বেল অশ্রুবিন্দু। সংসার থেকে যেদিন হবেন অপসৃত, কোনো পীড়িত হৃদয়ে বাজবে না এতটুকু ব্যথা, কোনো মনে রইবে না ক্ষীণতম স্মৃতি।

প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয়না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *