দৃষ্টিপাত – ১৩

তেরো

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধ হয় এমন কতকগুলি দুর্বল মুহূর্ত আসে যখন সে মস্তিষ্ক অপেক্ষা হৃদয় দ্বারা বেশী চালিত হয়। সে মুহূর্তগুলি অতর্কিতে দমকা হাওয়ার মতো এসে অতিসাবধানী লোকদের স্থৈর্যের বন্ধন ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তখন সংযমী যোগী পুরুষেরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হন, হিসেবী মহাজনেরা গরমিল করেন জমাখরচের খাতায় এবং স্বভাবত চাপা প্রকৃতির স্থিতধী ব্যক্তিরা বিচলিতচিত্তে মনের কথা ব্যক্ত করন অন্য লোকের কাছে। এমনি এক দুর্বল মুহূর্তে আধারকারের পূর্ব ইতিহাস উদ্ঘাটিত হলো একান্ত অপ্রত্যাশিতরূপে। ক্লান্ত সমাহিত নয়ন এবং নিঃসঙ্গ জীবন-যাপনের অন্তরালবর্তী রহস্য শোনা গেল তারই নিজ বর্ণনায়।

অপরাহে বেলায় ঈশান কোণে মেঘ দেখা দিয়েছিল। বৃষ্টি প্রত্যাশা করেছিলেন গ্রীষ্মপীড়িত হতভাগ্যের দল। বৃষ্টি এল না, এল আধি। ধূলির ঝড়। না দেখলে কল্পনা করা শক্ত এর রূপ। বাংলাদেশে কোনোকালে দেখা যায় না এ জিনিস। আকাশ ভুবন আঁধার করে প্রবল বেগে কোথা থেকে আসে এত বিপুল ধূলিরাশি তা ধারণাতীত। মেঘের চাইতে ঘন তার আচ্ছাদন সূর্যকে আবৃত করে। ঘরের মধ্যে আলো জ্বালতে হয় দিনের বেলায়। দোর জানালা নিশ্ছিদ্ররূপে বন্ধ করলেও কিছু ধূলা প্রবেশ করে নাকে, মুখে, চোখে, এমনকি বাক্স পেটরার মধ্যস্থিত জামা-কাপড়ে। বৃষ্টির ফোঁটা মাত্র নেই; শুধু শুষ্ক ধূলির ঝড়। কিন্তু এই আঁধির ফলেই উত্তাপ হ্রাস পায় অভাবনীয়ভাবে, ধরণী হয় শীতল। উত্তর ভারতের এক বিস্ময়কর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এই আঁধি।

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসেছি দুজনে মুখোমুখি। শোঁ-শোঁ শব্দে বাইরে বইছে আঁধির ঝড়ো হাওয়া, আলোড়িত হচ্ছে ধূলির পাহাড়। ধীরে ধীরে অনুচ্চ কণ্ঠে বিবৃত করলেন আধারকার আপন জীবন-ইতিহাস।

আঁধারকারের কুলগত পেশা যুদ্ধ। তাঁর পূর্বপুরুষেরা লড়েছে মুঘলের সঙ্গে, লড়েছে যশোবন্ত সিংহের বিরুদ্ধে। তাঁর প্রপিতামহ বিষ্ণুদত্ত পেশোয়া বাজিরাওয়ের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন। আসাইর যুদ্ধে পেশোয়ার দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে শত্রু নিপাত করেছেন অমিতবিক্রমে। নিহত হয়েছেন বুকে গুলির আঘাতে। আধারকার বালক বয়সে দেখেছেন তাঁর রুধিরাক্ত লৌহবর্ম, পরিবারের সযত্নে রক্ষিত গৌরবময় উত্তরাধিকার। বীরের রক্ত আছে তাঁর ধমনীতে।

পরিবারে বিত্ত ছিল প্রচুর, বীর্য ছিল বিখ্যাত, কিন্তু বিদ্যা ছিল না আধুনিক। আধারকার পিতার একমাত্র সন্তান, শিক্ষা লাভ করেন পুণার এক ইংরেজি স্কুলে। এলফিনস্টোন কলেজ থেকে পাশ করে গেলেন ম্যাঞ্চেস্টারে। বয়ন-বিদ্যা-বিশেষজ্ঞ হয়ে যখন ফিরলেন স্বদেশে, ইউরোপের প্রথম মহাযুদ্ধ তখন ক্ষান্ত হয়েছে। বম্বেতে স্থাপন করলেন এক কাপড়ের কল, অসুরের মতো খাটতে লাগলেন তাকে সাফল্যমণ্ডিত করতে।

বছর পাঁচেক পরের কথা। এক সন্ধ্যায় এক বন্ধুর আগমন সম্ভাবনায় এসেছেন দাদর স্টেশনে। বন্ধু এলেন না। ফিরে আসছেন এমন সময় কানে এল এক নারীকণ্ঠ। সে তো কন্ঠ নয়, সে সুর। ভাষা বুঝলেন না, পিছনে তাকিয়ে দেখলেন, প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে এক তরুণী, সঙ্গে একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। সামনে সুটকেশ, হোল্ডঅল, বেতের ঝুড়ি ইত্যাদি মালপত্র। উভয়ের মুখে উদ্বেগের ছাপ সুস্পষ্ট। বম্বেতে তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তাণ্ডব চলেছে সাঙ্ঘাতিক। স্টেশনের ভিতরে কুলির অভাব, বাইরে যানবাহনের। সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়।

আধারকার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কি বম্বেতে এই প্রথম এলেন?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার এক আত্মীয় থাকেন এখানে। তাঁকে টেলিগ্রাম করেছিলেম স্টেশনে হাজির থাকতে। আসেননি দেখছি। বোধহয় টেলিগ্রাম পাননি।’

‘পেলেও আসা কঠিন। শহরে দাঙ্গা বেধেছে, খুন-খারাপি চলছে বেপরোয়া। আপনারা কোথায় উঠবেন?’

‘তাই তো ভাবছি। কাছাকাছি কোনো হোটেলের সন্ধান দিতে পারেন?’

‘তা পারি। কিন্তু জায়গা পাবেন না সেখানে। বেশীর ভাগ হোটেলের চাকর, বেয়ারা, রাঁধুনি পালিয়েছে প্রাণের ভয়ে; সেখানে বাসিন্দা যারা আছে, তাদের অন্নজলের অভাব, নতুন লোক নেয় না আর।’

‘তবে তো বড়ই মুশকিল’ বলে ভদ্রলোক সঙ্গিনীর দিকে তাকালেন। ভয়ার্ত ভাব সঞ্চারিত হলো তরুণীর মুখমণ্ডলে। স্টেশনে ওয়েটিং রুমে চেষ্টা করে ফল হলো না। সব আগে ভাগেই দখল হয়ে আছে দূরগামী যাত্রীতে। পরম অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন মহিলা তাঁর স্বামীর দিকে। ‘

আধারকার প্রস্তাব করলেন, ‘যদি আপত্তি না থাকে, চলুন আমার ফ্ল্যাটে। কাল প্রাতে খোঁজ করা যাবে আপনাদের আত্মীয়ের। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। ‘

ভদ্রলোক তাকালেন স্ত্রীর পানে। তিনি একটু সঙ্কুচিত হয়ে ইংরজিতে বললেন স্বামীকে, যদিও উক্তির লক্ষ্য যে আধারকার তাতে সন্দেহ রইল না। ‘রাত্রিবেলা হঠাৎ বিনা খবরে আমরা গিয়ে উঠলে ওঁর স্ত্রীকে খুব বিব্রত করা হবে।’

আবার সেই সুর। বোধ করি, এ সুর ছিল ভীমসিংহপত্নী পদ্মিনীর, যা দিয়ে তিনি রাজপুত যুবককে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যুদ্ধে প্রাণ দিতে, হয় তো ছিল হেলেন অব ট্রয়ের; যাঁর জন্য সহস্র রণতরী ভেসেছিল সাগরে!

আধারকার বললেন, ‘এক রাত্রির জন্য নিরুপায় অতিথিদের গৃহে আতিথ্য দিলে স্ত্রীকে বিব্রত করা হয় কিনা জানি নে, হয়তো হয়। কিন্তু আপনারা নিশ্চিন্ত হোন আমার স্ত্রী মোটেই বিব্রত হবেন না, কারণ আমার স্ত্রী নেই।’

‘স্ত্রী নেই? ওঃ, তা হলে ‘ বলতে বলতে থেমে গেলেন ভদ্রমহিলা।

আধারকার বললেন, ‘তা হলে কী?’

‘আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা কোনোরকম করে রাতটা প্ল্যাটফরমেই কাটিয়ে দেবো।’

‘ওঃ, ব্যাচিলরের বাড়িতে অতিথি হওয়াটা সামাজিকতায় বাধে বুঝি? মনে ছিল না। বেশ, প্ল্যাটফরমেই থাকবেন। ভয় নেই। গোয়ানিজ কুলীগুলি দেখছিনে বটে এখন, তবে আছে কাছাকাছিই। জড়োয়া গয়না আছে গায়ে, সুটকেশগুলির ভিতরেই বা না কোন শত কয়েক টাকার জিনিসপত্র হবে। আশা করি, তাদের আসতে বিলম্ব হবে না। কাল মৃতদেহ সনাক্ত করার দরকার হলে খবর দেবেন। আচ্ছা, চলি, গুড নাইট’ বলে দ্রুত পদে নিষ্ক্রান্ত হলেন আধারকার। স্বরে তার অপমানিতের ক্ষোভ এবং উষ্মা।

কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরেই আবার দেখা গেল আধারকারকে ফিরে আসতে। বললেন, ‘দেখুন, একটা উপায় মাথায় এল। আমার ফ্ল্যাটেই চলুন। আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আমি কাছাকাছি আমার কেরানীর বাড়িতে গিয়ে বরং শোব। তা হলে বাড়ির দোষ থাকবে না ব্যাচিলরত্বের। ভিতর থেকে আগল এঁটে দেবেন ভালো করে, আর যাই হোক, প্ল্যাটফরমের চাইতে আশা করি সেটা নিরাপদ হবে!’

গোয়ানিজ কুলীর নামে মহিলাটির মনে যথেষ্ট ভয় ধরেছে। স্বামীটিরও প্ল্যাটফরমে রাত কাটানোর কল্পনাটা খুব প্রীতপ্রদ মনে হচ্ছিল না। সুতরাং আধারকারের প্রস্তাবে সম্মত হলেন। কুলীর সন্ধান পাওয়া গেল না। আধারকার নিজে দু’হাতে অবলীলাক্রমে দুটে বড় সুটকেশ বয়ে নিয়ে গেলেন গাড়িতে।

ছোট ফ্ল্যাট। একটি মাত্র শয়নকক্ষ। আহারাদির পর আধারকার প্রস্থানোদ্যোগ করতেই মহিলাটি পরিষ্কার ইংরেজিতে জিঞ্জাসা করলেন, ‘ওকি, কোথায় যাচ্ছেন? ‘

‘আমার কেরানীর বাড়িতে?’

‘কেরানীর বাড়িতে? সে কতদূর?

‘মাইল পাঁচেক হবে।

‘এত রাত্রিতে সেখানে? কোনো বিশেষ দরকার আছে কি?’

‘দরকার রাত্রিটা কাটানো।’

‘কেন এ-বাড়ি দোষ করল কী? ‘

আধারকার এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বললেন, ‘দোষ নয় মানে আপনাদের অসুবিধে—’

বাধা দিয়ে মহিলাটি অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, ‘আমাদের অসুবিধার কথা আপনাকে কে বলেছে? আর যদি হয়ই অসুবিধা; আপনি দয়া করে আশ্রয় দিয়েছেন, আর আপনাকেই এইদাঙ্গা হাঙ্গামার রাত্রিতে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে নিজেদের সুবিধা করব, আমাদের এতখানি জংলী ঠাওরালেন কেন? তার চেয়ে বলুন, আমরা আবার সেই স্টেশনের প্ল্যাটফরমেই ফিরে যাচ্ছি।’

স্বামী ভদ্রলোকও জোর দিয়ে বললেন, ‘ক্ষেপেছেন মশাই, এই রাত্রিতে যাবেন বাইরে।’

কিন্তু আর একদফা তর্ক দেখা দিল শয়ন-ব্যবস্থা নিয়ে। একটি মাত্র খাট। আধারকার চান সেটি দখল করবেন অতিথিরা, তিনি ড্রয়িং-রুমের মেজেতে ঘুমাবেন। অতিথিদের ইচ্ছা ঠিক তার বিপরীত। কিন্তু এবারেও মহিলাই জয়লাভ করলেন।

নিজের ঘরে শুতে যেতে যেতে আধারকার বললেন, ‘এ ভারি অন্যায় হলো। মনে মনে নিশ্চয় ভাবছেন, লোকটা সুবিধের নয়। নিজে আরাম করে খাটে নিদ্রা দিচ্ছে, আর অতিথিদের ভূমিশয্যা।’

মৃদু হাস্যে মহিলাটি বললেন, ‘লোকটি আপনি সুবিধের নন, তা টের পেয়েছি। অত্যন্ত ঝগড়াটে।’

‘ঝগড়াটে? বাঃ ঝগড়া করলেম কখন?

‘করলেন না? সেই যে প্ল্যাটফরমে কী বলেছি, তা নিয়ে কত কথা শোনালেন, কেরানীর বাড়ি শুতে যেতে চাইলেন। যান, আর কথা নয়। রাত হয়েছে। এখন লক্ষ্মী হয়ে শুয়ে পড়ুন গে।’

পরদিন আধারকারের ঘুম ভাঙালো অনেক বিলম্বে ভূত্যের ডাকাডাকিতে। ঘড়িতে তখন প্রায় আটটা। তাড়াতাড়ি বেশ পরিবর্তন করে এসে দেখেন, টেবিলে প্রাতরাশ প্রস্তুত। সুপ্রভাত জ্ঞাপন করতে মহিলাটি হেসে বললেন, ‘কাল রাত্তিরে শুতে যাবার সময় বললেন, আমাদের ভূমিশয্যার কথা মনে করে খাটে শুয়ে ভালো ঘুম হবেনা আপনার। কনশেন্স খোঁচা মারবে। এই আপনার ঘুম না হওয়ার নমুনা? কনশেন্সের খোঁচা নিয়েই বেলা আটটা?’

আধারকার লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘দেখতে পাচ্ছি, আমি ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হতভাগা কনশেসটাও ঘুমে বেহুঁশ হয়েছিল।’

উচ্চহাস্য উত্থিত হলো টেবিলে। স্বামী ও গৃহস্বামীর অট্টহাস্যের সঙ্গে মিশল নারীকণ্ঠের কলধ্বনি। মহিলা বললেন, ‘তাই নাকের ডাকে পাশের ঘরে চোখের দু’পাতা এক করা দায়।’

‘নাকের ডাক? নাক ডাকে নাকি আমার? কই, আমি তো টের পাইনি কখনও।’

‘ঐতো মজা। যখন টের পাওয়ার অবস্থা হয়, নাক তখন আর ডাকে না।’ আবার সেই পুরুষ ও নারীকণ্ঠের সম্মিলিত হাস্যোচ্ছ্বাস।

সন্ধ্যার কিছু আগে অতিথিরা বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তাঁদের আত্মীয়ের গৃহে। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে গেলেন তাঁদের ওখানে একদিন অবকাশমতো আসবার। আধারকার প্রস্তুত ছিলেন তখনই তাঁদের সঙ্গে গাড়িতে চেপে বসতে, শুধু সেটা নিতান্ত অশোভন হবে বলেই মনকে নিরস্ত করলেন।

তাঁদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আধারকার এসে বসলেন বারান্দায়। পড়তে চেষ্টা করলেন অন্যদিনের মতো এক ইংরেজি প্রেমের উপন্যাস। এগুতে পারলেন না বেশী দূর। মন বারবার উন্মনা হতে লাগলো। প্রত্যহ সন্ধ্যাবেলা বিলিয়র্ড খেলতে যান জিমখানা ক্লাবে। সেদিন কিছু মাত্র উৎসাহ রইল না তাঁর।

সুনন্দা ব্যানার্জীরা দিন দশেক রইলেন বম্বেতে। প্রত্যহ অপরাহ্ণে আপিস থেকে আধারকার সোজা এসে হাজির হতেন ব্যানার্জীর আত্মীয় গৃহে। দল বেঁধে যেতেন কোনোদিন সিনেমায়, কোনোদিন এপোলো বন্দর, কোনোদিন মহালক্ষ্মী মন্দীর, কোনোদিন বা এলিফেন্টার কেভস্।

বম্বে ত্যাগ করে স্বস্থান লাহোরে প্রত্যাবর্তন করলেন ব্যানার্জী দম্পতি। আধারকার রইলেন বম্বেতে। ফিরে গেলেন আপন রূপহীন, রসহীন, বৈচিত্র্যবর্জিত জীবনের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির মধ্যে। প্রভাত আর আনে না কোনো প্রত্যাশা, সন্ধ্যায় ঘটে না কোনো প্রার্থিত সান্নিধ্য, রাত্রিতে থাকে না পরবর্তী দিবসের প্রগাঢ় প্রতীক্ষা। সুনন্দাবিরহিত নগরীর কুত্রাপি নেই কোনো আকর্ষণ, কোনোখানে নেই মধু, নেই স্বাদ।

কিন্তু বিচ্ছেদ মানেই নয় ছেদ, যতির অর্থ নয় ইতি। অদর্শনের সান্ত্বনা থাকে পত্রে, বাচনের বিকল্প লেখনে। লাহোর পৌঁছে সুনন্দা ব্যানার্জী লিখলেন—

‘মিস্টার আধারকার, নিরুপায় নিশীথে অপরিচিত আগন্তুকদের আপনি আশ্রয় দিয়েছিলেন। আতিথ্য দিয়েছিলেন অকৃপণ ঔদার্যে, – সে জন্য ধন্যবাদ। আপনার সৌজন্য স্মরণে রাখব চিরকাল।’

জবাবে আধারকার লিখলেন,

‘এক রাত্রির অবস্থিতির দ্বারা ব্যাচিলরের গুহাকে আপনি দিয়েছেন সম্মান, গৃহস্বামীকে দিয়েছেন দুর্জয় মর্যাদা। কৃতজ্ঞতা তো জানাব আমি। সৌজন্যের প্রকাশ কর্মে, সেটা সহজসাধ্য; প্রীতির প্রবেশ মর্মে, তা দুরূহলভ্য। মিসেস ব্যানার্জী, আপনার অনুগ্রহ বচনাতীত।’

ত্বরিত উত্তর এল পত্রের। ‘দেখছি, আপনার কুশলতা শুধু আতিথেয়তায় নয়, পত্ররচনায়ও বটে। মশাই, আপনি তো চারুদত্ত নন, আপনি চারুবাক।’

এমনি করে চিঠি লেখালেখির খেলা চলে দুই পক্ষে। সে-চিঠিতে উক্তের চাইতে অনুক্তের ভাগ বেশী; শব্দের চাইতে অর্থের।

অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটলো আধারকারের জীবনে। তাঁর জীবনের প্রারম্ভ থেকে এ পর্যন্ত কেটেছে পুঁথিপত্র আর কলকারখানা নিয়ে। পরীক্ষায় পাশ আর অর্থার্জন। সোনার কাঠি ছোঁয়ানো রূপকথার রাজকন্যার মতো অকস্মাৎ জেগে উঠে আজ নিজেকে তিনি প্রথম আবিষ্কার করলেন। অধীত বিদ্যার শুষ্ক পাণ্ডিত্যের মধ্যে নয়, নয় অর্জিত অর্থের বিরাট সঞ্চয়স্থলীতে। আবিষ্কার করলেন আপন উপবাসী হৃদয়ের অন্তহীন শূন্যতার মধ্যে।

কর্মহীন সন্ধ্যায় নির্জন গৃহকোণে ভাবতে ভালো লাগে যে স্মৃতি, সে সুনন্দার! সুষুপ্ত রাত্রির তিমিরস্তব্ধ প্রহরে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়ে যে প্রসঙ্গ, সে সুনন্দার। প্রভাতে প্রথম জাগরণে স্মরণে আসে যে-মুখ, সে সুনন্দার। এ কী বিস্ময়, এ কী রহস্য, আনন্দ-বেদনা-বিজড়িত এ কী অনির্বচনীয় অনুভূতি!

নিজের হৃদয় যতই উদঘাটিত হয় নিজের কাছে, লজ্জিত হন, অনুতপ্ত হন আধারকার। শাসন করেন দুর্বল চিত্ত। পাছে কোনোদিন কোনো অসাবধান মুহূর্তে সুনন্দার কাছে ইঙ্গিতমাত্রে প্রকাশ পায় মনোভাব, সে দুর্ভাবনায় শঙ্কিত হন।

‘তোমাকে আর একটু জিন অ্যাণ্ড লাইম দেবে, মিনি সাহেব?’ হঠাৎ থেমে প্রশ্ন করলেন আধারকার।

গ্লাসে তখনও অর্ধেকের বেশী ছিল। তুলে ধরে বললেম, ‘অলমতি বিস্তরেণ।’

মিনিটখানেক চুপ করে থেকে আধারকার বললেন, ‘আমাকে নিশ্চয়ই একটা ভিলেন মনে হচ্ছে।’

জবাবে বললেম, ‘আপনি আপনার কাহিনী শেষ করুন। আমি রিপোর্টার, রিফর্মার নই। মিনি-সংহিতায় বিধান নেই কোনো প্রায়শ্চিত্তের।’

স্বল্প বিরতির পর খণ্ডিত আখ্যানের অনুবৃত্তি শুরু করলেন আধারকার।

মাস তিনেক পরে মিলসংক্রান্ত প্রয়োজনে আসতে হলো লাহোরে। বলা বাহুল্য অতিথি হলেন ব্যানার্জী-ভবনে।

অতিথিকে ভারতীয়েরা সেবা করেন পুণ্যকামনায়, তাকে যত্ন করেন ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু অতিথিকে আপন করা যায় একমাত্র হৃদ্যতার জোরে। সে হৃদ্যতার প্রাচুর্য ছিল সুনন্দার। লাহোরে আধারকারের কাজ সমাপ্ত হলো তিন দিনে। কিন্তু বিনা কাজের গ্রন্থিমোচন করে একাধিকবার বার্থ রিজার্ভ ও ক্যান্সেলেশনের পরে বম্বেতে প্রত্যাবৃত্ত হলেন তিন-চারে বারো দিন কাটিয়ে। কিন্তু যে আধারকার বম্বে থেকে গিয়েছিলেন এবং যে আধারকার লাহোর থেকে ফিরলেন তাঁরা এক ব্যক্তি নন। ইতিমধ্যে তাঁর জন্মান্তর ঘটেছে।

লাহোরে সেদিন অপরাহে বেলায় গিয়েছিলেন এক পরিচিত বন্ধু সন্দর্শনে, শহর থেকে অনেকটা দূরে। আশা ছিল সন্ধ্যার পূর্বেই প্রত্যাবর্তনের। কিন্তু এড়াতে পারলেন না অনুরোধ, নৈশভোজন সমাধা করতে হলো সেখানে। ফেরার পথে নামল বৃষ্টি। তার উপরে বাহন হলো বিকল। টাঙ্গার অশ্ব ও আসন দুই-ই প্রাচীনত্বে সমান, চলতে চলতে একটি চাকা স্থানচ্যুত হয়ে ভেঙে পড়ল অকস্মাৎ; আরোহী সবলে নিক্ষিপ্ত হলেন কর্দমাক্ত পথে। উত্তর ভারতে শীতকালের বর্ষণ বর্ষার প্রবল বারিপাতকেও হার মানায়। জনহীন পথপ্রান্তে সিক্ত হলেন দীর্ঘকাল, ব্যানার্জীগৃহে যখন এসে পৌছলেন রাত তখন প্রায় চারটা।

মৃদু আঘাত করতেই দ্বার খুলে দিলেন যিনি তিনি স্বয়ং সুনন্দা।

‘কোথায় ছিলে এই ঝড় বাদলার মধ্যে? সারা রাত ধরে উৎকণ্ঠায় মরছি’ বলতে বলতে কণ্ঠ রুদ্ধ হলো বাষ্পে। ঝর ঝর ধারায় অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ল দুই গণ্ডে। আত্মসংবরণ করতে ত্বরিত অন্তর্হিতা হলেন পাশের কক্ষে।

দ্বোর খোলার শব্দে গৃহস্বামীর নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছিল। তিনি দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার! কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আমরা ভেবে ভেবে মরি, বিদেশ বিভুঁই এই দুর্যোগের রাত্রিতে কোথায় কী হয়। সুনন্দা তো এক মিনিটের জন্য বিছানায় যায়নি, কেবল বারান্দায় এদিক ওদিক করেছে। একটু শব্দ হলেই টাঙ্গা এল ভেবে নীচে যায়।’

আধারকার বাহনবিভ্রাট বিবৃত করলেন সবিস্তারে, ক্ষমা প্রার্থনা করলেন নিজ বিলম্বের জন্য। সুনন্দা বেরিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বাধা দিয়ে বললেন, ‘ভিজে জামা-কাপড়গুলি ছাড়া হবে কি? টাঙ্গার চাকা কইঞ্চি ভেঙেছে, ঘোড়া ক’গজ লাফিয়েছে সে সব কাহিনী কাল সকালে ব্যাখ্যান করলে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। মাথা থেকে এখনও জল ঝরছে, নিউমোনিয়া না বাধালে বোধ হয় বাহাদুরিটা পুরা হবে না।’

বোঝা গেল, শাসনকর্ত্রী নেপথ্যেই ছিলেন, টাঙ্গা দুর্ঘটনার বিবরণ শুনেছেন স্বকর্ণে। আপন শয়নকক্ষে এসে নিদ্রার চেষ্টা করলেন আধারকার। ঘুম এল না। মুদ্রিত কমল-করিকার পার্শ্বে গুঞ্জনরত লুব্ধ ভ্রমরের মতো মন বারংবার কেবলই প্রদক্ষিণ করে ফিরতে লাগল একটি কক্ষপথে। অতিথির বিলম্বে গৃহকর্ত্রীর এই ব্যাকুল উৎকণ্ঠা, বিন্দ্রি নয়নে এই সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা, সকোপন অভিমান-জড়িত এই শাসন এবং সর্বোপরি এই অশ্রুধারা প্লাবিত আননের মধ্যে দিয়ে নারীহৃদয়ের কোন গোপন রহস্য আজ অকস্মাৎ উদ্ঘাটিত হলো? শয্যা ত্যাগ করে আধারকার বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

রাত্রি বিগতপ্রায়। তারকাহীন নভস্তল মেঘমালায় আবৃত এবং দিগন্তবর্তী তরুশ্রেণী বিলীয়মান রজনীর ঈষৎ ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আসন্ন প্রভাতের প্রতীক্ষারত ধরণীর এই প্রশান্ত গম্ভীর মূর্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আধারকার যেন আজ তাঁর জীবন-দেবতার প্রসন্ন কল্যাণ করস্পর্শ প্রথম অনুভব করলেন ললাটে। দুই হাত যুক্ত করে প্রণাম করলেন কাকে তা তিনি নিজেই জানেন না। শুধু ‘আমি ধন্য, আমি ধন্য’ এই বাক্য তাঁর উদ্বেল অন্তরের অন্তস্থল থেকে উত্থিত একটি মহান সঙ্গীতের মতো দ্যুলোক, ভূলোক পরিব্যাপ্ত করে বিশ্বলোকের বীণাতন্ত্রীতে অনাহত রাগিণীতে ধ্বনিত হতে লাগল।

আধারকার থাকেন বম্বেতে, সুনন্দা থাকেন লাহোরে। প্রায় এক হাজার মাইলের ব্যবধান। কিন্তু যোজনা গণনা করে নয় দূরত্ব, নৈকট্যের নির্দেশ হৃদয়ে। হৃদয়ের সে অদৃশ্য যোগাযোগের নিবিড় বন্ধনে বহুদূরবর্তী এই দুটি নরনারী পরস্পরের কাছে রইলেন নিকটতম।

সুনন্দা একদিন কথাচ্ছলে বলেছিল, ‘চারু, ইংরেজিতে কথা কয়ে সুখ নেই। আমি যদি মারাঠি বলতে পারতেম তবে বেশ হতো!’

আধারকার বললেন, ‘পর্বত যদি মহম্মদের কাছে না আসতে পারে, মহম্মদ যাবে পর্বতসকাশে।’

অসাধ্য সাধন করলেন আধারকার। ছ’মাসে শিখলেন বাংলা, বৎসরকালে কণ্ঠস্থ করলেন রবীন্দ্রনাথের কাব্য, দু’বছরে সাঙ্গ করলেন পঠনযোগ্য সমুদয় বাংলা সাহিত্য।

আধারকারের পরিজনেরা পরলোকগত। এক বোন স্বামী-পুত্র নিয়ে আছে কঙ্কনে। তার সঙ্গেও যোগাযোগ সুদৃঢ় নয়। এতকাল বৃত্তহীন পুষ্পের মতো আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ ছিলেন আধারকার। কর্মে, চিন্তায়, জীবনযাপনে ছিলেন স্বাধীন। এবার সে স্বনিয়ন্ত্রিত জীবনের ধারা হলো বদল। বম্বে থেকে চিঠি লেখেন লাহোরে, ‘নন্দা, বাড়ির বেয়ারাটা ছুটি চাইছে তিন মাসের আগাম মাইনে সমেত, দেবো কিনা লিখো।’ কিংবা লেখেন, ‘মালবার হিলসে ওয়ালকেশ্বর রোডে একটা বাড়ি বিক্রি হচ্ছে সস্তায়। কিনব কি।’

নিজের ভালো-মন্দের সমস্ত দায়িত্ব, সমস্ত ভাবনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন এক দূরবর্তিনী নিঃসম্পর্কীয়া অভিভাবিকার হস্তে, কিছুদিন মাত্র আগেও যিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিতা। আত্মসমর্পণে যে এত সুখ, নির্ভরতায় যে এত প্রশান্তি, তা কখনও জানেননি এর আগে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *