দৃষ্টিপাত – ১২

বারো

সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস দিল্লী পরিত্যাগ করলেন।

আগের দিন সন্ধ্যায় দিল্লী বেতার কেন্দ্র থেকে ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে এক বেতার-বক্তৃতায় তিনি ক্রীপস-দৌত্যের ব্যর্থতা ও কারণ বর্ণনা করলেন। বেতার-বক্তারূপে একমাত্র লন্ডন টাইমসের ভূতপূর্ব সম্পাদক উইকহ্যাম স্টীড ছাড়া সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বোধহয় ক্রীপসের জুড়ি নেই। অপূর্ব তাঁর বাচনভঙ্গী, অসাধারণ তাঁর কণ্ঠ। পরিতাপের কথা, সে দক্ষতা তিনি প্রয়োগ করলেন ভারতবর্ষের, বিশেষ করে কংগ্রেসের অযথা অপবাদকীর্তনে। ইচ্ছাকৃত সত্যগোপন বা সত্যের বিকৃতি সাধন, ভিত্তিহীন অভিযোগ, পরস্পর-বিরোধী উক্তি এবং কুযুক্তির দিক দিয়ে তাঁর এ বেতার-বক্তৃতাটি রাজনৈতিক অপভাষণের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে ইতিহাসে।

সমগ্র বক্তৃতাটি এক ক্ষমতাগর্বিত ব্যক্তির আহত অভিমান ও দুর্বলের প্রতি অবজ্ঞার অভিব্যক্তি। আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন দরিদ্র ব্যক্তি ধনী আত্মীয়ের কৃপামিশ্রিত মুষ্টিভিক্ষা প্রত্যাখ্যান করলে দাতার মনে যে ক্রোধের সঞ্চার হয়, সার স্ট্যাফোর্ডের কণ্ঠে তারই পরিচয় ছিল।

ক্রীপস্ বললেন, ভারতবর্ষের বিভিন্ন দলের মধ্যে যে প্রবল মতবিরোধ বর্তমান, একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্থ ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তার একটা সমাধান করতে চেয়েছিলেন। শ্রোতারা বিস্ময় চক্ষু মার্জনা করে ভাবল, এডলফ হিটলারের বক্তৃতা শুনছি না তো? তিনিও তো বলেন, তিনি চিরকাল শান্তি চেয়েছিলেন!

চাকরি বন্টন, পৃথক নির্বাচন, রাজনৈতিক সুবিধাদান প্রভৃতি একাধিক উপায়ে এদেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছেন এবং মতবিরোধকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন যাঁরা, তাঁরাই নাকি মধ্যস্থতা করতে চান। পরিহাস আর কাকে বলে?

ক্রীপস বললেন, যুক্তিশীল ব্যক্তিরাই স্বীকার করেবেন যে; যুদ্ধের দুঃসময়ে নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করা নয়। যেন ভারতীয় নেতৃবর্গ এ-কথা স্বীকার করেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন শুধু প্রকৃত ক্ষমতাবিশিষ্ট একটি সাময়িক জাতীয় গভর্নমেন্ট, যুদ্ধের এ দুঃসময়ে যার প্রয়োজন সব চেয়ে বেশী। দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সে গভর্নমেন্ট গঠিত হবে, সে-গভর্নমেন্টকে একটি স্বাধীন দেশের মন্ত্রিসভায় সমমর্যাদা দান করা হবে এবং অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী বড়লাট একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসনকর্তার ন্যায় এ গভর্নমেন্টের সিদ্ধান্ত স্বীকার করতে বাধ্য থাকবেন, নিজ বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের দ্বারা তাকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না—এই ছিল জননেতাদের দাবি। নতুন শাসনতন্ত্র রচনার কোন কথাই ছিল না।

কংগ্রেসের প্রতি ক্রোধটাই সবচেয়ে বেশী। বললেন, জাতীয় গভর্নমেন্ট গঠনের দাবি দ্বারা কংগ্রেস সকল ক্ষমতা আত্মসাতের প্রয়াসী, দেশের ডিক্টেটর হওয়ার বাসনা সংখ্যাগরিষ্ঠদল কংগ্রেসের। অথচ এগারোই এপ্রিল তারিকের লেখা চিঠিতে মৌলানা আজাদ ক্রীপকে লিখেছিলেন, কংগ্রেস দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় জাতীয় গভর্নমেন্ট গঠনে ইচ্ছুক। এ ধারণার উপরে ভিত্তি করেই সমস্ত আলাপ আলোচনা চলছে। জাতীয় গভর্নমেন্টের সদস্য সংখ্যা, বিভিন্ন দলের অংশ ইত্যাদি প্রশ্ন পরে নিশ্চয়ই আলোচিত হতো। কংগ্রেস নিজে ক্ষমতা লাভের জন্য ব্যাকুল নয়, কিন্তু ভারতীয় জনসাধরণের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত হোক, এই তার দাবি।

দেশরক্ষার দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে দেওয়ার আপত্তি সম্পর্কে ক্রীপস্ বললেন, ভারতবর্ষ রক্ষার দায়িত্ব ব্রিটেনের এবং মিত্রশক্তি এমেরিকার প্রতি ব্রিটেনের যে-কর্তব্য তা পরিহার করা সম্ভব নয়। যুদ্ধের সময় প্রধান সেনাপতির কর্তৃত্বে কারও হস্তক্ষেপ যুদ্ধজয়ের অনুকূল নয়। কংগ্রেস সভাপতি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, প্রধান সেনাপতির যুদ্ধ পরিচালন-ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের কোনো অভিপ্রায় ছিল না কংগ্রেসের। বরং সমরমন্ত্রী হিসাবে তাঁর হাতে আরও অধিকতর কর্তৃত্ব অর্পণে তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু দেশরক্ষার চরম দায়িত্ব থাকবে দেশেরই একজন প্রতিনিধির হস্তে। তা না হলে স্বাধীনতার কোনো অর্থ থাকে না।

জাপানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সর্বময় কর্তৃত্ব মার্কিন সেনাপতি জেনারেল ম্যাকআর্থারের হাতে। তা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার দেশরক্ষা সচিব অস্ট্রেলিয়ানই; মার্কিন বা ইংরেজ নয়,—এ দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলেন কেউ কেউ। কিন্তু ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যুক্তিকে শ্রদ্ধা করেন এমন নজীর নেই।

সবচেয়ে হাস্যকর উক্তি করলেন সার স্ট্যাফোর্ড জাতীয় গভর্নমেন্টের দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে। তিনি বললেন, ‘কংগ্রেস এমন একটি জাতীয় গভর্নমেন্ট গঠন করতে চায়, যার উপরে বড়লাটের বা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। একবার ভেবে দেখা যাক তার মানে কী। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ভারতের গভর্নমেন্ট এমন কয়েকজন ব্যক্তির দ্বারা গঠিত হবে, যারা কোনো আইনসভা বা নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে দায়ী নন, যাঁদের কেউ কখনও নাড়াতে পারবে না।’ কী সাংঘাতিক কথা। সত্যি তো এ তো কোনো মতেই হতে দিতে পারা যায় না। আইনসভা, নির্বাচকমণ্ডলী এবং জনসাধারণের কাছে দায়ী ও পরিবর্তনযোগ্য গভর্নমেন্টের একমাত্র আদি ও অকৃত্রিম নমুনা তো আছে আমাদের বর্তমান বেহুল-ম্যাক্সওয়েল-নূন ওসমান-রামস্বামী পরিবৃত পরম করুণাময় লর্ড লিনলিথগোর গভর্নমেন্টে!

বেতার-বক্তৃতার উপসংহারে ক্রীপস্ জাপানের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিরোধ শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে অনেক উদ্দীপনাময়ী উক্তি করলেন—’ঝুঁকি নিতে হবে, নতুন পরীক্ষা করতে হবে, পুরাতন মনোভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে’ এমনি সব ভালো ভালো কথা।

অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যারিস্টার বলে সার স্ট্যাফোর্ডের খ্যাতি আছে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, এ-সকল উক্তির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও অসঙ্গতি তাঁর মতো ব্যবহারজীবীর দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি। ‘ঝুঁকি নিতে হবে।’ ঠিক কথা। তবে সেটা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে নয়, নিতে হবে পদানত নিপীড়িত ভারতীয় জনসাধারণকে। ‘নতুন পরীক্ষা করতে হবে।’ অথচ ভারতবর্ষে বহাল থাকবে সেই সনাতন স্বৈরশাসন। ‘পুরাতন মনোভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।’ শুধু ভারত সম্পর্কে নয়! এই হলো ব্রিটেনের সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক ভারতবন্ধু সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্ কথিত সুসমাচার!!

বিলাতের ন্যাশনাল গভর্নমেন্টের অনুরূপ অস্থায়ী যুদ্ধকালীন গভর্নমেন্ট গঠিত হবে, এই ভিত্তিতেই মৌলানা আজাদ ও পণ্ডিত নেহেরু ক্রীপস্ প্রস্তাবের আলোচনা করেছেন। পরে দেখা গেল, ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলেরই দ্বিতীয় সংস্করণ ছাড়া আর কিছুতেই রাজী নন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। কখনও কোনো আলাচনায় ক্রীপস্ যে ন্যাশনাল গভর্নমেন্টের আভাসমাত্র দিয়েছেন এমন কথাও স্বীকার করলেন না তিনি। অথচ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের পুনর্গঠন বা তাতে যোগ দেওয়া-না-দেওয়া নিয়ে তিন সপ্তাহ আলোচনা করবেন মৌলানা আজাদ বা পণ্ডিত জওহরলাল, একথা একমাত্র উন্মাদ বা বিশেষ অভিসন্ধিপরায়ণ ব্যক্তি ছাড়া নিশ্চয়ই আর কেউ বিশ্বাস করবে না।

কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি জোরের সঙ্গে বললেন, ক্রীপস্ ক্যাবিনেট গভর্নমেন্টের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ক্রীপস্ তা বেমালুম অস্বীকার করলেন। যদিও সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা ২৩শে মার্চের প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সবাই সাক্ষ্য দেবেন যে, সেখানেও ক্রীপস্ এই ন্যাশনাল গভর্নমেন্টের কথাই বলেছিলেন।

কংগ্রেস নেতৃবর্গ একটি অতি মারাত্মক ভুল করেছেন। তাঁরা ক্রীপস্ আলোচনার কোনো লিখিত ও অবিসংবাদিত দলিল রাখেননি। বিলাতে ব্যবসায়ীদের দেখেছি, কোনো বিশেষ লেনদেন বা চুক্তি সম্পর্কে দুই ব্যক্তির মধ্যে আলোচনার একটি পরস্পর অনুমোদিত লিখিত বিবরণ থাকে। আলোচনার পরে একজন আলোচনার সমুদয় বিবরণ একটি পত্রে লিপিবদ্ধ করে অন্যজনের কাছে পাঠিয়ে দেন। তিনি হয় ঐ পত্রে বর্ণিত বিবরণ যথার্থ বলে অনুমোদন করেন, নয় তা ভ্রমনির্দেশ করেন। এ ব্যবস্থায় দুই পক্ষের মৌখিক আলোচনায় কোনো সময় একে অন্যের উক্তি বা মনোভাবকে ভুল বুঝলে অবিলম্বে তার সংশোধন হয়। চল্লিশ কোটি নরনারীর ভাগ্য নিয়ে যেখানে আলোচনা চলছে, সেখানে কংগ্রেস-কর্তৃপক্ষ এরূপ কোনো সাবধানতা অবলম্বন করেননি—এ শুধু আশ্চর্য নয়, বালকোচিত অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় সেদিনকার আলোচনার সারমর্ম একটি পত্রে গ্রথিত করে তাতে ক্রীপসের অনুমোদন-স্বাক্ষর রাখলে পর পরস্পরের প্রতি এই অসত্য ভাষণের দোষারোপ করার অবকাশ ঘটত না।

মৌলানা আজাদ তাঁর শেষ দীর্ঘ চিঠিতে বলেছেন, দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস ও ক্রীপসের মধ্যে আলোচনা যতই এগিয়ে চলেছে, ব্রিটিশ মনোভাবের ততই ক্রমিক অবনতি ঘটেছে। এ মন্তব্য অহেতুক নয়! ব্রিটিশ প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আগমন ও ভারত পরিত্যাগের মধ্যে ক্রীপসের চরিত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে।

ক্রীপসের এই ব্যর্থতার এবং পরিবর্তনের কারণ কী, তা নিয়ে বহু অনুমান, বহু সংশয়, বহু গবেষণার অবকাশ আছে। ব্যর্থতার সমুদয় দায়িত্ব ক্রীপসের নয়।

লর্ড লিনলিথগো ক্রীপস্-দৌত্যের সাফল্য কামনা করেননি, একথা অনুমান করা কঠিন নয়। যুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে একাধিকবার ভারতীয় জনসাধারণের সমর্থন সংগ্রহের তিনি ভার নিয়েছিলেন। ব্যর্থ হয়েছেন। সুতরাং তার দ্বারা যা সম্ভব হয়নি, অন্য কোনো ব্যক্তির প্রচেষ্টায়, বিশেষ করে একজন শ্রমিকদলের সদস্য দ্বারা তা সম্ভব হবে এটা তার পক্ষে রুচিকর নয়। ব্যক্তিগত মতবাদে লর্ড লিলিথগো যে একজন কন্সার্ভেটিভ ডাইহার্ড সে-কথা অবিদিত নয় কারো কাছে।

জঙ্গীলাট আর্চিবল্ড ওয়েভেল একজন ভারতীয় দেশরক্ষা সচিবের অধীনে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন কি না তাও জানার উপায় নেই। ওয়েভেল বর্তমানে ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি, তার সমরনৈপুণ্যের উপরে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের অবিচলিত আস্থা। ভারতবর্ষে, বিশেষ করে তার সামরিক ব্যাপারে ওয়েভেলের অননুমোদিত কোনো ব্যবস্থায় সম্মত হওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।

সাধারণের ধারণা এই যে, লন্ডন থেকে টেলিফোনযোগে সার স্ট্যাফোর্ডকে সতর্ক করে দেওয়া হয়, তিনি যেন ওয়ার ক্যাবিনেটের লিখিত প্রস্তাবের বাইরে আর এক পাও না যান। ভারতবর্ষ সম্পর্কে চার্চিল ও এমারির মনোভাব এতই সুপরিচিত যে, এ অনুমান একেবারে অমূলক মনে হয় না।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোড়াতে ইংলন্ডের রাজনৈতিক গগনে ক্রীপস ছিলেন একান্ত নিষ্প্রভ। শ্রমিকদলের সঙ্গেও সে সময়ে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল। উনিশ শ ঊনচল্লিশ সালের শেষভাগে তিনি ভারতবর্ষে এলেন। বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করলেন, বিভিন্ন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশলেন, পণ্ডিত জওহরলালের অতিথিরূপে পুংখানুপুংখরূপ অনুন্ধান করলেন এ দেশের জাতীয় আন্দোলন ও তার ধারা সম্পর্কে।

ভারতবর্ষ থেকে ক্রীপস গেলেন চীনে। চীন থেকে রাশিয়া হয়ে ইংলন্ডে যখন প্রত্যাবর্তন করলেন, চেম্বারলেন গাভর্নমেন্টের তখন পতন ঘটেছে। প্রধান মন্ত্রীরূপে চার্চিল গঠন করেছেন নতুন কোয়ালিশন গভর্নমেন্ট। রাশিয়া ও বৃটেনের বৈদেশিক সম্পর্ক সে সময় মধুর নয়, অথচ একমাত্র রাশিয়ার সঙ্গে মিতালীর দ্বারাই তখন ইউরোপে হিটলারের প্রতিরোধ সম্ভব। কে ভার নেবে রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে মৈত্রীসাধনের? ক্রীপসের নাম কে প্রস্তাব করেছিলেন তা জানার উপায় নেই। কিন্তু আইন ব্যবসায়ে প্রচুর অর্থোপার্জন পরিত্যাগ করে রাজনীতিক্ষেত্রে বিস্মৃতপ্রায় ক্রীপস্ অকস্মাৎ একদিন প্রবেশ করলেন দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে। প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বোধ হয় বললেন, মস্কো পছন্দ কর তুমি, সেখানে ব্রিটিশ রাজদূত হয়ে যাও। ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে মিত্রতার সম্বন্ধ স্থাপন করা চাই। এখনই রওনা হও। ফর গডস্ সেক।

ক্রীপস্ রাশিয়ায় গেলেন এবং অসাধ্যসাধন করলেন। ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে তিনি হৃদ্যতার সৃষ্টি করলেন, যা ইতিপূর্বে প্রায় অসম্ভব বলে গণ্য হয়েছে মস্কো ও কুইবাইসেভে নিজ কর্তব্য সমাধান করে উনিশ শ, বিয়াল্লিশ সালে যখন ইংলন্ডে ফিরলেন ক্রীপস্ তখন তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা দু-ই অপরিসীম। চার্চিল তাঁকে আপন মন্ত্রিমণ্ডলে গ্রহণ করলেন।

ভারতীয় সমস্যার তিনি একটা সন্তোষজনক মীমাংসা সাধনে সক্ষম হবেন, এ বিশ্বাস ক্রীপসের ছিল। ওয়ার ক্যাবিনেটের প্রস্তাব যে ভারতীয় জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে অক্ষম, একথা কি তিনি বোঝেননি? তা হলে তার বহু-বিজ্ঞাপিত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পর্কেই সন্দেহ জাগে। প্রচলিত জনশ্রুতি এই যে গান্ধীজি প্রথম সাক্ষাতের দিনে ক্রীপসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই প্রস্তাব নিয়ে তুমি ভারতবর্ষে এলে কেন? ‘উপদেশ দিয়েছিলেন, এর বেশী আর কিছু যদি তোমার দেবার ক্ষমা না থাকে, তবে ফিরতি বিমানে দেশে ফিরে যেতে পার।’

ক্রীপস্ নিশ্চয়ই জানতেন ওয়ার ক্যাবিনেটের প্রস্তাবগুলি যথেষ্ট নয়। কিন্তু তাঁর আশা ছিল, ভারতীয় জননেতাদের সঙ্গে তাঁর যে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্য বর্তমান, তারই সহায়তায় তিনি তাঁদের সম্মতিলাভ করবেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবর্গ শিশু নন; ব্যক্তিগত বিরাগ-অনুরাগের প্রশ্নকে তাঁরা জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ-ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার করতে দেননি।

বোধ হয় ক্রীপসের আশা ছিল, অকুস্থলে অবস্থানকারী-ম্যান অন দি স্পট-হিসাবে তিনি প্রস্তাবগুলির কিছু কিছু সম্প্রসারণের ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে পারবেন ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষে। চার্চিল তাকে নিরাশ করলেন। দু’দিক দিয়েই তিনি বিফল মনোরথ হলেন।

নিজের মতবাদে অবিচলিত ও সততায় একনিষ্ঠ ব্যক্তি এমন ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতেন। প্রকাশ্যে ঘোষণা করতেন, ভারতীয়দের দাবী ন্যায়সঙ্গত। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের মনোভাব আপস অনুকূল নয়, তাঁদের আন্তরিকতা সন্দেহজনক। ক্রীপস্ তা করলেন না। তিনি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সমর্থন করে সংগ্রেসের প্রতি কটুক্তি করলেন। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের এই চরম সঙ্কটকালে ক্রীপস্ ন্যায়-নীতি অপেক্ষা মন্ত্রিসভার নিজ সহকর্মী ও প্রধানের প্রতি আনুগত্যকেই শ্রেষ্ঠ আসন দিলেন। ব্রিটিশজাতির প্রয়োজনে তিনি অপভাষণের আশ্রয় নিলেন। সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে সমাজতন্ত্রী সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্ আত্মহত্যা করলেন।

চার্চিল জয়লাভ করলেন। শুধু ভারতবর্ষকে পরাধীন রাখার প্রচেষ্টায় নয়, নিজ সম্ভবপর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ধ্বংস সাধনেও পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করলেন তিনি।

ইংলন্ডের জনসাধারণ চার্চিলের প্রধানমন্ত্রিত্বে সুখী ছিল না। বিভিন্ন রণাঙ্গনে একটির পর একটি করে পরাজয় পার্লামেন্টের সদস্যদের বিচলিত করে তুলেছিল। তাঁরা তীব্র ভাষায় চার্চিল গভর্নমেন্টের অক্ষমতার আলোচনা করেন। কিন্তু চার্চিলকে অপসারিত করেন না। তার কারণ চার্চিলের প্রতি শ্রদ্ধা বা আস্থা নয়। একান্ত নিরুপায় তাঁরা, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই ইংলন্ডে।

রাশিয়ায় অভাবিতপূর্ব সাফল্য ক্রীপকে যে সম্মান ও খ্যাতি দিয়েছিল, তাতে জনসাধারণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো তার প্রতি। কেউ কেউ বলতে শুরু করল, ইংলন্ডের ভাবী প্রধানমন্ত্রী সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্। ভারতীয় সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান করতে পারলে ক্রীপসের যোগ্যতায় ব্রিটিশ সর্বসাধারণের আস্থা গভীর হতো, চার্চিলের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে রাজনীতিতে ক্রীপসের প্রভাব হতো অনন্য সাধারণ। ওয়ার ক্যাবিনেটের এক শূন্যগর্ভ প্রস্তাব দিয়ে চার্চিল ক্রীপকে ভারতে পাঠালেন, কারণ তিনি নিশ্চিত জানতেন গান্ধীজি, আজাদ ও নেহরু কখনও গ্রহণ করবেন না এ প্রস্তাব।

ক্রীপস্ ব্যর্থকাম হলেন। চার্চিলের প্রধান মন্ত্রীত্ব নির্বিঘ্ন হলো। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অপসারাণের একাধিক উপায় আছে। স্ট্যালিন তাদের হত্যা করেন বন্দুকের গুলিতে, চার্চিল তাদের নিঃশেষ করেন কূটনৈতিক চালে। সোস্যালিস্ট ক্রীপ ইম্পিরিয়ালিস্ট টোরিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতে নিজ হাতে নিজ মৃত্যুদণ্ড স্বাক্ষর করলেন নিজেরই অজ্ঞাতসারে।

রাত্রিতে আহারের নিমন্ত্রণ ছিল এক বন্ধুগৃহে। ভদ্রলোক কলকাতার এক নামজাদা সাহেব কোম্পানীর কভেনান্টেড সার্ভিসের লোক, শ্বেতাঙ্গ পরিচালকগোষ্ঠীতে একমাত্র বাঙালী অফিসার। প্রচুর বেতন, প্রভূত প্রতাপ। যুদ্ধের প্রয়োজনে গভর্নমেন্ট সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে নিয়ে এসেছেন আরও বেশী পারিশ্রমিক দিয়ে। নিজের কোম্পানীতে মোতায়েন আছে। যুদ্ধ শেষ হলে সেখানে ফিরে গিয়ে পুনরায় স্বপদে প্রতিষ্ঠিত হবেন পূর্বগৌরবে।

নিমন্ত্রিতের সংখ্যা জন দশেক। একমাত্র আমিই একক। বাকি সবাই যুগলে;— মিস্টার এন্ড মিসেস। ডিনার ন’টায়, কিন্তু নিমন্ত্রিতেরা সাড়ে সাতটার মধ্যে সবাই উপস্থিত! ড্রয়িং রুম তাঁদের হাস্য, পরিহাস ও আনন্দকলরবে মুখরিত হয়ে উঠল।

আমাদের প্রাচীন ভোজসভাগুলির সঙ্গে এই ডিনার পার্টিগুলির প্রভেদটা সুস্পষ্ট। তফাতটা শুধু আসন পেতে আহার ও ছুরি কাঁটায় খাওয়ার মধ্যে নয়। আমাদের ভোজন আয়োজনগুলি মূলত সামাজিক ক্রিয়া কর্ম সম্পর্কিত। মেয়ের বিয়ে, ছেলের উপনয়ন, নাতনীর ভাত কিংবা ব্রত, পার্বণ উপলক্ষ করে আমাদের নিমন্ত্রণ। তাতে লোক ডাকতে হয় আত্মীয়তা ও কুটুম্বিতার সূত্র ধরে, হৃদ্যতার বিচার করে নয়। সুতরাং সংখ্যা হয় অপরিমিত। ছাদের উপর সামিয়ানা টাঙিয়ে তার নীচে এক সঙ্গে আসন পড়ে সত্তর কিংবা আশী। মেয়েদের জন্য শয়নগৃহে খাট-পালঙ্ক বের করে খাবার জায়গা। এতেও একেবারে সমাধা হয় না সমুদয় নিমন্ত্রিতের আহার। বাড়ির সিকি মাইল দূর থেকে টের পাওয়া যায় কলকোলাহল।

ইংরেজি ডিনারের বিশেষ কোনো উপলক্ষের দরকার নেই। নেই কোনো নির্দিষ্ট দিন। কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে ডাকার অলংঘনীয় দায় নেই গৃহকর্তার। গৃহকর্ত্রী বলাই ঠিক, —কারণ নিমন্ত্রণ করেন গৃহিণীরা।

এক টেবিলে বসে খাওয়ার রীতি সভাবতঃই নিমন্ত্রিতের সংখ্যাকে পরিমিত রাখে। বেশীর ভাগই ছ’জন; ঊর্ধ্বে বারো। তাও গৃহকর্তা ও গৃহিণীকে নিয়ে। বাড়ির গৃহিণী এখানে ভাঁড়ারে ময়দা মাখানো নিয়ে ব্যস্ত নন, ড্রইং রুমে আর পাঁচজন নিমন্ত্রিতার ন্যায় আলাপ-আলোচনায় তাঁরও যোগ আছে। তাঁর বসন হলুদের চিহ্নদ্বারা লাঞ্ছিত নয়, আনন উনানের আঁচে বিশীর্ণ নয় এবং দেহ পরিবেশনজনিত ক্লান্তিতে পীড়িত নয়। তিনিও সুবেশা, সুসজ্জিতা। তিনি সমুদয় অভ্যাগতদের আহারান্তে অপরাহ্ণ বেলায় সর্বশেষে আহারে বসেন না, তাঁদের সঙ্গেই আহার্য গ্রহণ করেন। গৃহকর্তা কোমরে গামছা জড়িয়ে জলের জাগ বা নুনের হাঁড়ি হাতে ছুটোছুটি না করেও অতিথিদের আদর আপ্যায়নের প্রতি দৃষ্টি রাখেন, তাঁদের সঙ্গে বসেই আহার করেন।

খাওয়াটাই ইংরেজী ডিনারের মূল কথা নয়। সেটা বন্ধুজনের একত্র মিলনের একটা উপলক্ষ মাত্র। তাই আহারের আয়োজন পরিমিত। সুক্ত থেকে অম্বল পর্যন্ত দশটা তরকারি এবং দরবেশ থেকে রাবড়ি পর্যন্ত পাঁচটা মিষ্টান্নের আয়োজন না হলে সেখানে কেউ ছি ছি করে না। পান্তুয়া গেলার কৃতিত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা নেই ইংরেজি ডিনারে। আমাদের আধুনিক সমাজের ইঙ্গ-বঙ্গের ত্রুটি অন্বেষণে যাদের কখনও ক্লান্তি নেই, এই একটি ব্যাপারে অন্তত তাঁরা যেন আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকেন।

আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা মজলিসী ধরনের লোক। আসর জমাবার দক্ষতা আছে তাঁর। এককালে শিকারে সখ ছিল। বিহারের জঙ্গলে সম্বর শিকারের গল্প করলেন, আসামের অরণে নেকড়ে।

শুধু গল্প নয়, তাসের ম্যাজিক জানেন অনেক রকম। চোখ বুজে প্যাকেটের মধ্য থেকে চিড়িতনের গোলাম বের করে দিয়ে বিস্মিত করলেন সবাইকে, হরতনের নওলাকে হাত ঘুরিয়ে নিমিষের মধ্যে বানিয়ে দিলেন গোলাম এবং এক মহিলার শাড়ির ভাঁজ থেকে ইস্কাবনের সাহেব বের করে তাঁর কাছে কপট তাড়না এবং আর সবার কাছে উচ্ছ্বসিত সাধুবাদ লাভ করলেন। গল্প গুজব ও হাস্য পরিহাসের মাঝে মাঝে শীতল পানীয় এবং ককটেল গ্লাসে টোমাটোর রস পরিবেশন করল বেয়ারা।

আহারের ব্যবস্থা পাশের কক্ষে। বুফে ডিনার। একটা টেবিলের উপরের বিভিন্ন পাত্রে সাজানো সমুদয় আহার্য। রোস্ট, স্যালাড, চপ, আবার তার সঙ্গেই পরোটা বিরিয়ানী, পটলের দোলমা। পুডিং আছে, রসগোল্লাও আছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইঙ্গ-বঙ্গের ছাপ থাকে আমাদের অশনে, বসনে, চিন্তায় ও কর্মে। হাতে দশগাছা জলতরঙ্গ চুড়ির সঙ্গেই আমাদের মেয়েরা পরেন রিস্টওয়াচ, কোঁচানো ধুতির উপরেই ছেলেরা পরেন ডবল কাফের সার্ট।

সাইডবোর্ডে স্তরে স্তরে একদিকে সাজানো আছে প্লেট, অন্যদিকে চামচে, কাঁটা এবং ছুরি। সবাই প্লেট নিয়ে স্বহস্তে নিজ নিজ অভিরুচি মতো আহার্য তুলে নেন। ছেলেরা বেশীর ভাগ টেবিলের চার পাশে দাঁড়িয়ে খান। মেয়েরা কেউ বা বসেন চেয়ারে, কেউ বা ছেলেদের অনুসরণে দাঁড়িয়েই। গৃহকর্ত্রী খেতে খেতেই তদারক করেন অতিথিদের। বলেন, ‘এ কী ভাই; মিলি তুমি কিছু খাচ্ছ না যে? মিস্টার সেন, আর একটা চপ নিন। মিসেস দেশাই রোস্ট নিয়েছেন তো?’

মিসেস সাহার নাম শোনা ছিল ইতিপূর্বে, চাক্ষুষ পরিচয় ঘটল এই ভোজসভায়। অতিশয় ক্ষীণাঙ্গী, সাধারণ বাঙালী মেয়েদের তুলনায় যথেষ্ট ফর্সা কিন্তু পাউডার-আধিক্যের দ্বারা গণ্ডের স্বাভাবিক বর্ণকে এমন ভাবে ঢেকে রেখেছেন যে, কাগজের মতো সাদা মুখ দেখে মনে হয় বুঝি বা কোনো কঠিন অসুখের পর ভাওয়ালী বা মদনপল্লী স্যানিটেরিয়াম থেকে সদ্য উঠে এসেছেন। পরিধানে সাদা ধবধবে শিফনের অতি মহার্ঘ শাড়ি; প্রায় কাঁচের মত স্বচ্ছ। তার মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট দৃষ্টিগোচর ঈষৎ হাল্কা রঙের অন্তর্বাস। শাড়িতে পাড় থাকাটা আজকাল যথেষ্ট মডার্ন নয়। ঘটি হাতা ব্লাউজের মধ্যে থেকে লম্বমান বিশীর্ণ বাহুদ্বয়। ‘ভি’ আকৃতি সম্মুখ ভাগে মর্মান্তিকরূপে উদ্ঘাটিত গ্রীবার দুই পার্শ্ববর্তী উদ্ধত দুটি কণ্ঠা! গলায় মুক্তার একটি মালা। কানে সর্ষপাকৃতি ক্ষুদ্র মুক্তা গেঁথে গেঁথে একজোড়া দুল, প্রায় কাঁধ অবধি ঝোলানো। বাম হাতের দীর্ঘ সরু অনামিকায় তারই সঙ্গে ম্যাচ-করা মুক্তাবসানো মস্ত একটি আংটি। সবুজ, নীল, মেরুন, ভায়োলেট প্রভৃতি বিভিন্ন রঙের শাড়িপরিহিতাদের মধ্যে মহিলা আপন বেশভূষায় সম্পূর্ণ বিশিষ্টা। যেন শীতের দিনে বর্ণাঢ্য মরসুমী ফুলের বাগানে রজনীগন্ধার উন্নত বৃন্তটি।

মহিলা টেবিল-স্পুনের আধ চামচ বিরিয়ানী নিয়েছিলেন, তাই যেন শেষ করতে পারেন না! হোস্টেস একটু রোস্ট তুলে দিতে যাচ্ছিলেন তাঁর প্লেটে। ‘পারবো না ভাই, পারবো না, দিয়ো না, প্লীজ’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। অনেক সাধ্য সাধনার পর একটা চপ নিলেন এবং ম্যনিকিউর করা দুই আঙ্গুল দিয়ে অতি সন্তর্পণে তার সিকি ভাগ ভেঙে খেলেন। কেবলই বলেন, ‘ভয়ানক পেট ভরে গেছে। আর পারছিনে।’

একটা ঝালে চচ্চড়ি ছিল টেবিলে, তাই একটু নিলেন মিসেস সাহা। এটাই চলতি। মিস্টার সাহা বাধা দিয়ে বললেন, ‘খেয়ো না, এত ঝাল খেলে অসুখ করে মরবে। এতেও নতুনত্ব নেই। স্বামীরা লঙ্কা খেতে বারণ করেন এবং স্ত্রীরা তা অগ্রাহ্য করে বেশী করে লঙ্কা খান, এইটে প্রমাণ করাই হলো আধুনিকাদের আহার সম্পর্কিত আধুনিকতম ফ্যাশান।

ভোজনপর্বের শেষে মহিলাদের প্রতি অনুরোধ হলো গানের। কেউ গাইলেন। কেউ ‘অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি’ বলে এড়িয়ে গেলেন। গৃহকর্ত্রী মোটামুটি রকম গাইতে পারেন এবং তাঁকে অনেক সাধ্য সাধনা না করলেও চলে। একটি গুজরাটি মহিলা তাঁর স্বদেশীয় সঙ্গীত শোনালেন। তার মধ্যে একটি ভক্ত কবি নরসিংহ মেহতার রচনা। তাঁর রচিত ‘বৈষ্ণব জনতো তেঁনে কহি’ বলে একটি গান এককালে গান্ধীজির প্রিয়রূপে খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।

মিসেস সাহার সদাশয়তা আছে। অনেক রাত্রিতে ডিনার পার্টি ভাঙলো। নিজ মোটরে পৌঁছে দিতে চাইলেন আমাকে আমার আবাসে। মিষ্টার সাহাকে বললেন, ‘বীরেন, মিনি সাহেবকে নামিয়ে দিতে হবে কুইনসওয়েতে।’

অতি-আধুনিকারা স্বামীকে নাম ধরেই ডাকেন। ওটা ইংরেজির নকল। আমি সনাতনী নই। স্বামীর নাম করতে নেই, এ অনুশাসনের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু ইংরেজি জন, আর্থার, সিরিলের কায়দায় আমাদের স্ত্রীরাও আমাদের সুধীর, বিকাশ বা উপেন বলে ডাকতে শুরু করলে পুলকে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠারও কোনো কারণ দেখি না।

মানুষের নামের যদি কেবল সনাক্তকরণ ছাড়া আর কোনো প্রয়োজন না থাকত, তবে নামের বদলে সংখ্যা ব্যবহারের দ্বারাই তা অনায়াসে চলতে পারত। তা হলে মেয়ের জন্ম মাত্রেই মেয়ের মা তার নামনির্বাচন নিয়ে ভাবনায় পড়তেন না। নিত্য নতুন নামকরণের অনুরোধ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি আসত না।

জড় বস্তুর পক্ষে নাম একটা অভিবা মাত্র। গোলাপকে ঘেঁটু আখ্যা দিলে তার গন্ধের তারতম্য ঘটে না, একথা সেক্সপীয়রের মতো অন্য পাঁচজনেও জানে; যদিও একথা ঠিক যে, কাব্যের সীমানা থেকে শুধু ঐ নামের জন্যেই তার চির নির্বাসনের সম্ভাবনা ঘটে।

কিন্তু মানুষের পরিচয় তো কেবল কোনো বিশেষ একটি সত্তার দ্বারা নয়। বিভিন্ন পরিবেশে, বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তার বিভিন্ন রূপ। তাকে প্রকাশ করার জন্য তার বিভিন্ন নাম। আপিসে কেরানীবাবুর কাছে যিনি মিস্টার মুখার্জী, পাড়ায় বন্ধুদের কাছে তিনি বিনোদবাবু, বাল্যের সহপাঠীদের কাছে বিন্দে, বাড়িতে মায়ের কাছে খোকন এবং কোনো বিশেষ একটি মাত্র লোকের কাছে তিনি ‘ওগো’ কিংবা ‘শুনছো’ নয়তো শুধু মাত্র ‘এই’। সেগুলি তো কেবল নাম নয়, সেগুলি নির্দেশ। সংজ্ঞা নয়, সঙ্কেত। সেই বিশেষ ব্যক্তিটির কাছে সেগুলি বিশেষ অর্থ বহন করে, বিশেষ কানের ভিতরে বিশেষ সুর এবং অভিজ্ঞ লোকেরা জানেন, এই ছোট্ট দুই অক্ষরের সঙ্কেতের দ্বারাই যে পারে সে আপনি পারে, পারে সে ফুল ফোটাতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *