দৃষ্টিপাত – ১১

এগারো

শাস্ত্রকারেরা বলেছেন, রাজদর্শনে পুণ্যলাভ। অমাত্যদর্শনেও পুণ্য আছে কিনা জানিনে। বোধ হয় আছে। নইলে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরদের বাড়িতে প্রত্যহ ভিড় জমে কেন। ভিড় জনতার নয়, আই.সি.এস.-এর।

এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরদের সুদৃশ্য বাংলোর সম্মুখে তৃণাচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ অঙ্গনে অপরাহ্ণ গৃহস্বামী বসেন বিশ্রম্ভালাপে। হাতের কাছে ছোট টিপাইর উপরে টেলিফোন, সুদীর্ঘ তারের সাহায্যে প্রাইভেট সেক্রেটারীর কক্ষে প্লাগ পয়েন্টের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে সুইচ আছে। কে কথা বলেন এবং কি কথা বলেন তার গুরুত্ব বিচার করে সেক্রেটারী সুইচের দ্বারা মনিবের টেলিফোনের সঙ্গে যোগাযোগ সাধন করেন। খান দশ বারো চেয়ার। বেতের। সবুজ রঙের ভালম্পার এনামেলে স্প্রে-পেইন্ট করা। বাগানে কাঠের চেয়ার ব্যবহার আভিজাত্যের চিহ্ন নয়। সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহ-উপগ্রহ সমন্বিত সৌরমণ্ডলের ন্যায় আই.সি.এস.-পরিবৃত এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরের সান্ধ্য সভাতল। অমাত্যের প্রাত্যহিক আসর। সে আসর গুণিজনের নয়, ধনীজনের।

পরিধানে শাদা শাটিন জিনের ট্রাউজার্স ও হাতকাটা হাফসার্ট। টাই নেই, কোটও না।

নয়াদিল্লীতে গ্রীষ্মকালে ঐটেই রীতি। আপিস থেকে ডিনার পর্যন্ত ঐ পোশাকই সর্বজনগ্রাহ্য। যারা বয়সে তরুণ, তাঁরা সার্টের বদলে পরেন স্পোর্ট সার্ট। সেটা আরও বেশী স্মার্ট। মোজাহীন চরণে শাদা কাবুলী চপ্পল। আর্মিতে খাকীর মতো সিভিলিয়নদেরও য়ুনিফর্ম আছে। সে য়ুনিফর্ম লিখিত অনুশাসনের নয়, অলিখিত ফ্যাশনের। ঠিক যেমন বিয়ের বরযাত্রীদের গিলে-কোঁচানো ধুতি আর সোনার বোতামওয়ালা পাঞ্জাবি। মাদ্রাজী, পাঞ্জাবী, বাঙালী, সিন্ধী,—সব আই.সি.এস-এরই এক বেশ, এক ভাষা। বলা বাহুল্য, দু’টোর একটাও তাদের স্বজাতীয় নয়।

যে-বন্ধুকে কাণ্ডারী করে এই সভার্ণবে প্রবেশ করা গেল তিনি গভর্নমেন্টের একজন পদস্থ অফিসার। প্রৌঢ়, অপত্নীক এবং অত্যন্ত সদাশয়। বহুপরিচিত ব্যক্তি। এমন গৃহ অল্প যেখানে তাঁর গতি নেই, এমন গৃহিণী অল্পতর যার ডিনার পার্টিতে তাঁর নিমন্ত্রণ নেই।

পুরুষ মাত্রেরই বউ না থাকলে বাতিক থাকে। কারো তাস, কারো থিয়েটার, কারো দেশোদ্ধার, আর কারো বা সাহিত্য কিংবা স্বামীজি। এ-ভদ্রলোকের বাতিক পোশাকের। সবচেয়ে ভালো পোশাকের সাহেব-বেস্ট ড্রেসড ম্যান বলে নয়াদিল্লীতে তাঁর পরিচিতি গল্প আছে যে চার দিনের জন্য একবার হঠাৎ তাঁকে ট্যুরে যেতে হয়। তাড়াতাড়িতে জামাকাপড় বেশী সঙ্গে নেওয়ার অবকাশ না পাওয়াতে মাত্র দুটো ওয়ার্ডোর ট্রাঙ্ক ও একটা সুটকেশ নিয়েই নাকি তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হয়। সেগুলির গর্ভে শুধু গোটা পনেরো সুট, দেড় ডজন সার্ট, দশটা টাই ও কুড়িখানা রুমাল ছিল। ভাজভাঙা সার্ট বা ক্রীজহীন প্যান্ট পরতে দেখেনি তাঁকে কেউ কোনোদিন। সকালবেলা গয়লা, খবরের কাগজওয়ালার মতই তাঁর বাড়িতে প্রত্যহ নিয়মিত ধোবা আসে বালিশের ওয়াড়, বিছানার চাদর, স্লিপিং সুট ও জামা কাপড় প্রেস করে দিতে বন্ধুরা ঠাট্টা করে পরামর্শ দেন, আপিসে একটা ইলেকট্রিক আয়রন রাখতে—বড় সাহেবের ঘরে ঢুকবার আগে একবার তাড়াতাড়ি গায়ের জামাটা ইস্তিরি করে নিতে পারবেন।

জামাকাপড়ের প্রতি ভদ্রলোকের মনোযোগ আছে, কিন্তু আসক্তি নেই। সুদৃশ্য টাই, মনোরম মাফলার অকাতরে দান করেন আপন বন্ধুদের। গৃহে সর্বদা আতিথ্যের অকৃপণ আয়োজন। এমন অমায়িক প্রকৃতির লোক বেশী চোখে পড়ে না।

ইনি হচ্ছেন সেই স্বল্প সংখ্যক ভারতীয়দের অন্যতম যাদের সাহেব সম্পর্কে কোন দুর্বলতা নেই। একবার বম্বের পথে মাঝ রাত্রিতে এক স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠছিলেন। প্রথম শ্রেণীর কামরায় এক সাহেব দরজা-জানালা বন্ধ করে নিদ্রা দিচ্ছিলেন। হাঁকাহাঁকিতে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে দ্বার খুলে দেখলেন কালা আদমী। ‘ভাগো’ বলে সশব্দে দ্বার রুদ্ধ করলেন। কিন্তু এ কালা আদমীটি অন্য জাতের। সাহেব দেখেই পশ্চাদপসরণের পাত্র নন। স্টেশন মাস্টার এসে অন্য গাড়িতে তাঁর জায়গা করে দিতে চাইলেন। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। সাহেব তো গোটা কামরাটা রিজার্ভ করেনি সুতরাং ঐ কামরাতেই তাঁর যাওয়া চাই।

এতে সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। একটা নেটিভের স্পর্ধা দেখ একবার। না হয় টাকা আছে, ফার্স্ট ক্লাসের টিকিটই কিনেছে। কিন্তু তা বলে একেবারে একজন খাস বিলাতী সাহেবের সঙ্গে এক কামরায়! মাই গড়, ইন্ডিয়ার হলো কী? সেই আধ ন্যাংটো নেংটি ইঁদুরু গ্যান্ডীটা কি দিল্লীতে ভাইসরয় হয়েছে? উইলিংডন কি নেই? সাহেব তাঁর চাবুক হাতে নিয়ে গাড়ির দরজা রুখে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেখছ চাবুক?’

ভদ্রলোক তাঁর পকেট থেকে রিভলবার বের করে বললেন, ‘দেখছ পিস্তল?’

সাহেব মিনিটখানেক হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন তাঁর পানে, তার পরে আস্তে আস্তে দোর খুলে দিয়ে নিজের বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

এ জাতের লোকদেরই সাহেবরা পুলিশের কর্তা হয়ে লাঠিপেটা করেন, হাকিম হয়ে পাঠান জেলে, কিন্তু মনে মনে করেন গভীর শ্রদ্ধা। এঁদেরই জন্য বিদেশে নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দিতে পারা যায় অকুণ্ঠিত চিত্তে।

আর্মির এক কর্নেল কিছুকাল এই ভদ্রলোকের উপরওয়ালা ছিলেন। পাঞ্জাবী হাবিলদার ও সিপাহীদের ধমকিয়ে তিনি চুল পাকিয়েছেন। জানেন ভারতীয়দের দিয়ে কাজ করাবার ঐ একমাত্র উপায়। সে-উপায় প্রয়োগ করলেন একদিন এর উপরে। ভদ্রলোক অত্যন্ত ধীর ও শান্ত স্বরে বললেন, ‘কর্নেল, একজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলার রীতি এটা নয়। মনে রেখো তুমি চোখ রাঙালে আমিও পাল্টে চোখ রাঙাতে পারি-ইফ ইউ সাউট লাইক দ্যাট আই ক্যান সাউট ব্যাক টু।’

শুনেছি এই কর্নেলই পরে এঁকে নিজের বাড়িতে ডিনার খাইয়েছেন বহুদিন। অসুখ হলে নিজে বাড়ি এসে আরোগ্য কামনা জানিয়েছেন এবং রিটায়ার করার কালে প্রমোশন সুপারিশ করেছেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসায়!

এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সান্ধ্য সভায় আলোচনার মধ্যপথে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করলেম আমরা দু’জনে। বন্ধুর সহায়তায় যথারীতি পরিচিত হলেম গৃহস্বামী ও উপস্থিত পারিষদবর্গের সঙ্গে। সুদৃশ্য গ্লাসে সুস্বাদু পানীয় পরিবেশন করল উর্দি পরিহিত বেয়ারা। রূপার সিগারেট বাক্স থেকে সিগারেট। গৃহস্বামী নিজে বিরামহীন ধূমপায়ী, ইংরেজিতে যাকে বলে চেইন স্মোকার। একটা নিঃশেষ হতেই বাক্স থেকে আর একটা তুলে নিয়ে ঠোঁটে চাপেন। কে আগে তাতে দেশলাই জ্বেলে অগ্নি সংযোগ করতে পারেন, তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি।

বিলাতপ্রত্যাগতদের একটা বিশেষ মর্যাদা আছে এ দেশে। তার উপর বিলাতী সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে তো কথাই নেই। মহামান্য বড়লাট বাহাদুরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের মাননীয় সদস্য মহোদয় অমায়িক আচরণ ও অজস্র ধন্যবাদের দ্বারা প্রচুর আপ্যায়ন করলেন।

খণ্ডিত আলোচনার সূত্র অনুসরণ করে বোঝা গেল, বিষয়টি নয়াদিল্লীর গ্রীষ্মাধিক্য ঘটিত। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ন্যায় ভারত গভর্নমেন্টেরও বার্ষিক শৈলযাত্রা আছে। এপ্রিলের গোড়াতে দপ্তর স্থানান্তরিত হয় সিমলা পাহাড়ে। শরৎকালে উল্টোরথে প্রত্যাবৃত্ত হয় দিল্লীতে। বছরে দু’বার করে সিমলার কার্ট রোড আর নয়াদিল্লীর পাহাড়গঞ্জের পথে গরুর গাড়ি বোঝাই বাক্স পেটরা লটবহরের মিছিল দেখা যায়। এই প্রথম শৈলবিহার স্থগিত হয়েছে সরকারী হুকুমে।

নবনিযুক্ত অস্থায়ী সেনাপতি জেনারেল মোলস্ওয়ার্থ দাবি করেছেন, এবার সিমলা যাওয়া চলবে না। গরমে জাপানীদের সঙ্গে সৈন্যরা বর্মার বনে জঙ্গলে লড়তে পারে, আর সেক্রেটারিয়েটের সিভিলিয়ন সাহেবরা একটু গরমও সইতে পারবেন না? এত বাবুয়ানায় যুদ্ধ জেতা যায় না।

আর্মির প্রয়োজনের উপরে কথা নেই। সুতরাং সেইটেই শিরোধার্য করতে হয়েছে নিতান্ত অনিচ্ছুক চিত্তে। সেক্রেটারী সায়েবেরা বিচলিত—উঃ বাবা মার্চের শেষে যা গরম, মে-জুনে না জানি কতই বেশী হবে!

ডেপুটী সেক্রেটারীরা বেশীর ভাগই ভারতীয়। কাজেই তারা এক ধাপ উপরে উঠে বলেন ‘বেশী? মে-জুন মাসে মেডিক্যাল লীভ নিয়ে পালাতে হবে।’

তাঁদের স্ত্রীরা আরও সাংঘাতিক। স্বামীরা আপিসে চলে গেলে দুপুর বেলা পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করলেন, ‘শুনেছ ভাই, নতুন কমান্ডার-ইন-চীফের কীর্তি? গরমে নাকি এবার দিল্লী থাকতে হবে। মাই গুডনেস্। তার চেয়ে চল আমরা মেয়েরাই না হয় সিমলাতে গিয়ে মেস করে থাকি, ওরা থাকুন দিল্লীতে গরমে সেদ্ধ হয়ে মরতে!’

এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গরম কি এখানে খুব বেশী হয়?’ একজন অমনি বললেন, ‘ভয়ানক? থাকতেই পারবেন না এখানে।’

আর একজন বললেন, ‘গরমে গায়ে ফোস্কার মতো হয় অনেকের।’

তৃতীয় ব্যক্তি বললেন, ‘এপ্রিল থেকেই তো লু চলবে।’ ‘লু’ মানে গরম হাওয়ার ঝড়।’

এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলর বললেন, ‘তা দেখুন, সেক্রেটারিয়েটের ঘরগুলি সবই এয়ার কন্ডিসন্ড। দুপুরবেলা সেখানেই থাকব। এক রকম করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে বোধ হয়।’

চতুর্থ জন যিনি এতক্ষণ কিছু বলার সুবিধা না পেয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন, ত ৎক্ষণাৎ সায় দিয়ে বললেন, ‘তা নিশ্চয়ই যাবে। গরমে কি আর দিল্লীতে লোক থাকে না?’

এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলর তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর রাত্রিতে তো লু বইবে না।’

তিনি উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘যা বলেছেন সার, রাত্রিগুলি সব সময়েই ঠাণ্ডা থাকে। তা ছাড়া এইচ. এমদের বাংলোতে একটা করে ঘর এয়ার কন্ডিসন্ড করে দেওয়া হবে এমন কিছু কষ্ট হবে না।’

‘এইচ. এম’ মানে—অনারেবল মেম্বর বা মিনিস্টার। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরদের ঐ সংক্ষিপ্ত নামেই উল্লেখ করা হয় সরকারী মহলে।

প্রথম বক্তা, যিনি গরমের আতিশয্য নিয়ে এতক্ষণ বাগবিস্তার করছিলেন, অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হলেন। চতুর্থ ব্যক্তির কথাগুলি তাঁরই বলা উচিত ছিল। না বলতে পারায় মনে তীব্র অনুশোচনা ঘটল। চতুর্থ ব্যক্তি বলেছেন বলে, তাঁর উপর রীতিমতো ক্রুদ্ধ হলেন। মনে মনে বললেন, কেবল খোশামুদি! এইচ. এম. যেই বলেছেন, গরম এক রকম করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে, অমনি একেবারে প্রমাণ করার চেষ্টা যেন গরমটা কিছুই নয়! হামবাগ কোথাকার! নিশ্চয় জানি এইচ. এম. দিল্লী থাকা অপছন্দ করলে উনি তখন উল্টো সুর গাইতেন! লোকটা যে একেবারে মোসাহেব প্রকৃতির এবং তিনি নিজে যে কোনো কালেই এমন নির্লজ্জ চাটুকারিতা করতে পারতেন না, এ বিষয়ে মনে মনে নিজেকে আশ্বাস দিয়ে অনেকটা আরাম বোধ করলেন।

গরম থেকে প্রসঙ্গ পরিবর্তন কর এইচ.এম. শুরু করলেন সরকারী কাজকর্মের কথা। কাউন্সিলের কাহিনী। কী ভাবে ইংরেজ সহকর্মীদের ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষার প্রয়াস তাঁর প্রচেষ্টায় প্রতিহত হয়, তাঁর প্রখর দুরদৃষ্টির ফল কোথায় কখন গভর্নমেন্টে দেশের স্বার্থ সপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তারই সালঙ্কার বর্ণনা।

দেখা গেল, এবিষয়ে শ্রোতাদের কাছে অধিক বলার প্রয়োজন ছিল না। তিনি না বলতেই তাঁরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। এইচ.এম. না থাকলে অভাগিনী ভারতমাতার যে কী দারুণ দুর্গতি ঘটতো সে কথা কল্পনা করে দু’একজন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। প্রায় অশ্রু-বরিষণের উদ্যোগ।

কান টানলেই মাথা আসে। দেশের কথা তুলতেই কংগ্রেস। এইচ. এম. কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের নিষ্ফলা নীতির তীব্র নিন্দা করে বললেন, ‘শুধু জেলে গেলেই দেশ স্বাধীন হয় না।’ কী করে হয় তা স্পষ্টত না বললেও সংশয়ের অবকাশ রইল না যে, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরদের প্রচেষ্টা দ্বারাই তা হয়। এবিষয়েও পারিষদ দলের মধ্যে বিন্দুমাত্র মতদ্বৈধ নেই।

এইচ.এম. বললেন তিনি এত ভাবনা চিন্তার ধার ধারেন না, মুহূর্তে মন স্থির করেন। অমনি অনুমোদন শুনলেন, ‘সার, ভাবনা চিন্তা দেশে অনেক হয়েছে, এখন ঝাঁপিয়ে পড়াই দরকার।’

এইচ. এম. সংশোধন করলেন, ‘অবশ্য আগে ভাগে না ভেবেচিন্তে হঠাৎ একটা কিছু করে বসাও আবার ঠিক নয়!’

‘তাতে আর সন্দেহ কী সার, না ভেবে কাজ করার নাম তো হঠকারিতা,’ একই ব্যক্তি বলেন অম্লান বদনে।

পরবর্তী সপ্তাহে এক ডিনারের নিমন্ত্রণ স্বীকারান্তে এইচ.এমকে বিদায়-সম্ভাষণ পূর্বক নিষ্ক্রান্ত হলেম পথে। সঙ্গী ভদ্রেলোক জানালেন তাঁর এক বন্ধু নাকি চমৎকার চাটুচাতুর্যপরায়ণ এই পারিষদদলের নর নামকরণ করেছেন ‘হে হে সংঘ’। নামটা সার্থক সন্দেহ নেই।

আসল কথাটা বোঝা কঠিন নয়। এরা আই.সি.এস.। দেশীয় সংবাদপত্রের ভাষায় যাকে বলে স্বর্গোদ্ভূত চাকরে-হেভেনবর্ন সার্ভিস। সিজার পত্নীর সতীত্বের মতো এদের যোগ্যতা প্রশ্নের অতীত। ভবিষ্যৎ অবারিত এবং ক্ষমতা সীমাহীন। এরা সর্ববিদ্যাবিশারদ। তাই আজ যিনি বিহারের অখ্যাত মহকুমার এ্যাসিস্টেন্ট কালেক্টর, কাল তিনি করাচী পোর্টট্রাস্টের চেয়ারম্যান, পরশু তিনি কনট্রোলার অব ব্রডকাস্টিং, পরদিন ডিরেক্টার-জেনারেল অব আর্কিওলজি এবং তার পরের পরদিন গভর্নমেন্টের এ্যাগ্রিকালচারেল কমিশনার। তাঁরা জানেন, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরকে খুশি রাখতে পারলে পদোন্নতি দ্রুত হয়। তাই কেউ সস্ত্রীক এসে এইচ. এমকে নিয়ে যান সিনেমায়, কেউ নিমন্ত্রণ করেন ডিনারে, কেউ সকালে বিকালে হাজিরা দিয়ে প্রত্যেক কথায় করেন হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। হে হেঁ সংঘের সদস্য হতে চাঁদা দিতে হয় না, শুধু যথাস্থানে হাজিরা দিতে হয়।

ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অপূর্ব সৃষ্টি। এর মোট সংখ্যা এগারো শ’র কাছাকাছি, তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ভারতীয়। পরাধীন জাতির মধ্যে থেকেই সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক সংগ্রহ করার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত এই সার্ভিস। স্ফীত বেতন এবং লোভনীয় পেন্সনের আকর্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আকৃষ্ট করেন ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট। তরুণ সম্প্রদায়ের সর্বোত্তম নিদর্শন বেছে নিয়ে নিয়োজিত করেন শাসনকার্যে, যে-শাসন দেশের দাসত্বকে করে দৃঢ়মূল; দারিদ্র্যকে করে ক্রমবর্ধমান এবং জাতীয় আন্দলনকে করে বিঘ্নশঙ্কুল।

অসাধারণ মোহ আছে ইংরেজি বর্ণমালার তিনটি অক্ষরে।।.C. S. নামের পিছনে তাদের অবস্থিতি দ্বারা সাহেব হলে বোঝায় যে, লোকটা পাবলিক স্কুলের ছাত্র, অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজের পাশ এবং কঠিন কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। একটি ভরতীয় ভাষা শিখেছে, ওভারসিজ এলাউয়েন্স পায়, চাকরি শুরু করেছে এ্যাসিস্টেন্ট কালেক্টর রূপে এবং শেষ করবে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলর বা প্রাদেশিক গভর্নর হয়ে। পাঁচ শ’ টাকায় আরম্ভ, ছয় কিংবা আট হাজারে শেষ। ষাট বছর বয়সে এক হাজার পাউন্ড পেন্সন নিয়ে ইংলন্ড বা রিভেয়ারাতে বাড়ি, নিশ্চিন্ত অবসর এবং ভারতবর্ষের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা।

ভারতীয় হলে বোঝাবে,—উচ্চ বংশ, কলেজে ভালো ফল, পুলিশের সন্দেহাতীত, স্বদেশীর স্পর্শলেশশূন্য নিষ্কলঙ্ক ছাত্রজীবন, বিলাভের প্রতি ভক্তি এবং চাকরিতে বিচার বিভাগের বদলে এক্সিকিউটিভ বিভাগে কায়েমীর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা। এদের জন্যই বারোয়ারি পূজার মণ্ডপে চেয়ারের ব্যবস্থা, বিদ্যালয়ে পুরস্কার বিতরণী সভার সভাপতিত্ব, মাসিক পত্রিকায় অপাঠ্য গল্প রচনার সুযোগ এবং অনূঢ়া বয়স্থা কন্যার উদ্বিগ্না জননীর আকুলি বিকুলি।

চলতি কথায় এঁদের বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কাঠামো। স্টীলফ্রেম। এঁদের মধ্যে এমন দু’ চার জন লোক ছিলেন এবং এখনও আছেন যাঁরা পাণ্ডিত্যে, প্রতিভায় ও কর্মশক্তিতে যে কোনো ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান গ্রহণের অধিকারী। তাঁরা ঋগ্বেদের অনুবাদ করছেন, ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতি আলোচনা করছেন, ভারতবর্ষের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করেছেন, সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সমবায় আন্দোলন প্রবর্তন করেছেন এবং সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় ঘটনা—ভারতীয় জাতীয় মহাসভা কংগ্রেসের গোড়াপত্তন করেছেন। জাতীয়তাবাদের গুরু সুরেন্দ্রনাথ, ঋষি অরবিন্দ এবং বিদ্রোহী সুভাষচন্দ্র এই সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বা হতে হতে ছিটকে পড়েছিলেন।

কিন্তু ব্যতিক্রমের দ্বারাই তো নিয়মের প্রমাণ হয়। বেশীর ভাগ আই.সি.এস. ই নিতান্ত সাধারণ, ইংরেজিতে যাকে বলে মিডিওকর। তাঁরা লেখার মধ্যে লেখেন ফাইল,পড়ার মধ্যে পড়েন গেজেট এবং আলোচনা করেন ফার্লো, প্রমোশন বা রিটায়ারমেন্ট। অন্তিমে নিজের জন্য নাইটহুড, স্ত্রীর জন্য বুইক গাড়ি ও ছেলের জন্য ইম্পিরিয়াল সার্ভিস তাঁদের চরম উচ্চাভিলাষ।

ইংরেজিতে বলে, কামানের চাইতে সোনার দাম কম। বৈদেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষতদের অসন্তোষ ঠেকিয়ে রাখবার অমোঘ অস্ত্র, তাঁদের শাসনযন্ত্রের অঙ্গীভূত করা। সে তথ্য জানা আছে ইংরেজের। এগারো শ’ আই.সি. এসেরে জন্য ভারতের রাজস্ব থেকে খরচ হয় বছরে আড়াই কোটি টাকা। প্রতি আড়াই লক্ষ ভারতীয়ের মাথার উপরে আছে একজন আই. সি.এস. প্রতি ৮৬৮ বর্গ মাইল এলাকার আধিপত্যে। প্রচুর অর্থ, প্রভূত প্রতিষ্ঠা এবং বৈদেশিক পরিবেশের ফলে একটি বিশেষ শ্রেণীতে পরিণত হন তাঁরা। দেশের দায় বিমুক্ত, দশের থেকে বিযুক্ত। আই.সি.এস. একটা পেশা নয়, আই.সি.এস. একটা জাত। হোলি রোম্যান এম্পায়ার যেমন না ছিল হোলি, না ছিল রোম্যান এবং বলা না যায় এম্পায়ার; ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস তেমনি ইন্ডিয়ান নয়, সিভিল তো নয়ই এবং সার্ভিসের বাষ্প মাত্র নেই তাতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *