দৃষ্টিপাত – ১০

দশ

আরোগ্য সম্ভাবনাহীন রোগীর অত্যাসন্ন মৃত্যু নিশ্চিত জানার পরেও যে প্রফেসন্যাল নির্লিপ্ততা নিয়ে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে যান, ক্রীপস্ আলোচনা সম্পর্কেও বর্তমানে আমাদের সেই মনোভাব উপস্থিত। এর ব্যর্থতা সম্পর্কে নয়াদিল্লীতে সমবেত জার্নালিস্টদের মনে এখন আর সংশয় নেই। প্রশ্ন এখন শেষ মুহূর্তে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবার নয়, প্রশ্ন করে আলোচনার অসাফল্য সরকারীভাবে ঘোষণা করা হবে।

অথচ মাত্র সপ্তাহ দুই পূর্বেও ক্রীস দৌত্যের এই পরিণতি আশঙ্কা করার কারণ ছিল না। বরং এই রাজনৈতিক আলোচনা দ্বারা শীঘ্রই ভারতবর্ষ ও ব্রিটেনের মধ্যে একটা সম্মানজনক মীমাংসার ফলে ভারতে জাতীয় গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হবে, এই আশাই বেশীর ভাগ লোকে পোষণ করেছে।

ঊনিশ শ’ একচল্লিশ সালের ডিসেম্বর মাসে জাপান বৃটেন ও এমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। প্রথম দিনেই পার্ল হারবার বিধ্বস্ত হলো। তিন দিন পরে বৃটিশ নৌবহরের অন্যতম গর্ব ও নির্ভর প্রিন্স-অব-ওয়েলস ও রিপালস্ জাপানী বোমার আঘাতে প্রশান্ত মহাসাগরের গর্ভে সলিল সমাধি লাভ করল। দেখতে দেখতে হংকং ও মালয় জাপানীরা কেড়ে নিল। ষোলই ফেব্রুয়ারী সুদৃঢ় প্রাচ্যে ব্রিটিশের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘাঁটি যা দুর্ভেদ্য বলে সবার ধারণা ছিল—সিঙ্গাপুরের পতন।

দুই শত বৎসরের বৃটিশ শাসনকালে এই প্রথম জল এবং স্থলপথে ভারতবর্ষ শত্রু আক্রমণের সম্মুখীন। কর্তৃপক্ষের মনে উদ্বেগ, সাধারণের মনে ভীতি এবং সহজবিশ্বাসপ্রবণ অজ্ঞজনের অসংবদ্ধ রসনায় নানাবিধ হ্রাসজনক রটনার সৃষ্টি হলো।

এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাউস অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ঘোষণা করলেন—ওয়ার ক্যাবিনেট সর্বসম্মতিক্রমে ভারতবর্ষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যা সম্পর্কে একটি ন্যায়সঙ্গত ও চূড়ান্ত সমাধান—জাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল সলিউশন-স্থির করেছেন এবং লর্ড প্রিভিসীল সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্ নিজে ভারতীয় নেতৃবর্গের সম্মতি সংগ্রহের জন্য মন্ত্রীসভার প্রস্তাবটি নিয়ে ভারতে যাচ্ছেন।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পুনঃ উপেক্ষিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী ভারতের দাবি। বারংবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কংগ্রেসের সহযোগিতার প্রস্তাব। মাসখানেক পূর্বে মার্শাল চিয়াং কাইসেক ও মাদাম এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তাঁরা প্রকাশ্য বিবৃতিতে ব্রিটেনকে ভারতীয়দের হাতে যথাসম্ভব ক্ষিপ্রতায় প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদানের অনুরোধ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তার পরেই সুস্পষ্ট ভাষায় চার্চিলের উক্তির প্রতিবাদ করে বললেন, অ্যাটলান্টিক চার্টার সমগ্র পৃথিবীর জন্য, কেউ তা থেকে বঞ্চিত হবে না এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বৈদেশিক মন্ত্রী এভাট সেখানকার পার্লামেন্টে ভারতের স্বাধীনতা দাবিকে ন্যায্য বলে স্বীকার করে বললেন, সে দাবির প্রতি অস্ট্রেলিয়ানদের পূর্ণ সহানুভূতি আছে।

ভারতবর্ষে জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার প্রতি সম্মিলিত জাতিগুলির ক্রমবর্ধমান অনুকূল মনোভাব ও প্রকাশ্য উক্তি দ্বারা ব্রিটেনের রক্ষণশীল কর্তৃপক্ষ বিব্রত হচ্ছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চাইতেও গুরুতর কারণ ছিল প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায়। সে কারণ সহৃদয়তার নয়, অনুরোধ উপরোধ বা উপদেশজাত নয়। কারণ কঠোর বাস্তব ঘটনা পরম্পরার। আটই মার্চ রেঙ্গুনের পতন হলো, ব্রহ্মে ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি ঘটল। ভারতবর্ষের বিক্ষুব্ধ জনমতকে শান্ত ও ইংরেজের অনুকূল করার প্রয়োজনীয়তা ইতিপূর্বে এমন আর কখনও অনুভূত হয়নি। এগারই মার্চ চার্চিল ক্রীপস্ মিশনের কথা ঘোষণা করলেন।

তবুও একথা মানতেই হবে যে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ভারতবর্ষে অভূতপূর্ব উৎসাহের সঞ্চার করেছিল। এদেশের সংবাদপত্র ও জনসাধারণ ব্রিটিশ ওয়ার ক্যাবিনেটের এই নব প্রচেষ্টাকে অভিনন্দিত করল। বোধ হয় এতদিনে সত্য সত্যই ব্রিটেন ভারতীয় সমস্যার সত্যিকার সমাধানে উৎসুক। ক্ষমতা হস্তান্তরে স্বীকৃত।

ভারতে এই অনুকূল মনোভাবের পশ্চাতে ছিল মন্ত্রিসভার ভারপ্রাপ্ত আলোচনাকারী ব্যক্তিটির প্রতি ভারতবর্ষের আস্থা। সার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপসকে ভারতবর্ষ বর্তমান শতাব্দীর মুষ্টিমেয় ভারতহিতৈষী ইংরেজের মধ্যে অন্যতম জ্ঞান করে থাকে। ক্রীপস্ ইতিপূর্বে দু’বার ভারতবর্ষে এসেছেন। কংগ্রেস নীতি ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় আছে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর তিনি একজন অন্তরঙ্গ সুহৃদ। একাধিকবার ভারতে ইংরেজ শাসনের ত্বরিত সমাপ্তি কামনা করে তিনি লেখনী চালনা করেছেন। বেশী দিনের কথা নয়, ইউরোপে যুদ্ধ ঘোষণার সাত সপ্তাহ পরে হাউস অব কমন্সে দাঁড়িয়ে গভীর প্রত্যয়ব্যঞ্জক স্বরে ক্রীপস্ বলেছেন, ‘কংগ্রেসের নয় ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের অনমনীয় মনোভাবের জন্যই ভারতীয়দের ন্যায়সঙ্গত দাবি আজও অপূর্ণ রয়েছে। সাম্প্রদায়িক কলহের কথাটা একটা ছুতা মাত্র!’

সেই ক্রীপেেসর আপোষ আলোচনা নিরর্থক হতে চলল! মতভেদের বর্তমান কারণ দেশরক্ষার প্রশ্ন! ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রস্তাবানুসারে দেশরক্ষার ভার থাকবে একান্তভাবে প্রধান সেনাপতির হাতে। কংগ্রেসের দাবি, দেশরক্ষার দায়িত্ব পালনের জন্য জনসাধারণের মধ্যে যে অনুপ্রেরণা সঞ্চার প্রয়োজন তা একমাত্র ভারতীয় দেশরক্ষা সচিবের পক্ষেই সম্ভব, বিদেশী কমান্ডার-ইন-চীফের নয়।

যুদ্ধ পরিচালনার প্রত্যক্ষ ভার কংগ্রেস প্রধান সেনাপতির উপর ন্যস্ত করতে রাজী ছিলেন। সে ব্যাপারে তাঁকে সর্বাধিক স্বাধীনতা দানে কংগ্রেসের আপত্তি ছিল না। কিন্তু দেশরক্ষার মূল দায়িত্ব ভারতীয় দেশরক্ষা সচিবের হাতে না থাকলে স্বাধিকার লাভের অর্থ থাকে না। বিশেষত যুদ্ধের সময়ে দেশের অন্যান্য সমস্যা ও ব্যবস্থা দেশরক্ষার বৃহত্তর প্রশ্নের দ্বারাই বহুলাংশে প্রভাবান্বিত। সত্যিকার দায়িত্ব ও স্বাধীনতা লাভের পরিমাপ দেশরক্ষার নিরবচ্ছিন্ন অধিকারের দ্বারাই নিরূপিত হয়।

এই যুক্তির সারবত্তা অস্বীকার করা ক্রীপসের সাধ্য ছিল না। তাই তিনি বিকল্প প্রস্তাব করলেন, প্রধান সেনাপতি যুদ্ধ সচিবরূপে সমর পরিচালনা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করবেন এবং দেশরক্ষা সচিব আখ্যা নিয়ে একজন জনপ্রতিনিধি দেশরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন।

ভালো কথা। কিন্তু এ দু’জনের কর্মবিভাগ হবে কী ভাবে? ক্রীপস্ প্রস্তাবিত নব দেশরক্ষা সচিবের করণীয় কর্মের একটি তালিকা দিলেন। সে তালিকায় আছে, (১) পেট্রোল সরবরাহ; (২) স্টেশনারী অর্থাৎ কাগজ, পেন্সিল, নিব, কালী, কলম কেনা, রাখার ভার, ফর্ম ছাপান; (৩) ক্যান্টিন পরিচালনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

গাম্ভীর্য রক্ষা করে এই তালিকাটি পাঠ করা কঠিন। এদেশের অন্তঃপুরে পানের ভিতরে লঙ্কার কুচি, লুচির মধ্যে ন্যাকড়া ও সরবতে চিনির বদলে নুন মেশানো প্রভৃতি কতকগুলি জামাই-ঠকানো প্রাচীন মেয়েলী কৌতুকের কথা শোনা কিন্তু চল্লিশ কোটি নরনারীর ভাগ্য নিয়ে দুই দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যেখানে চরম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলেছে, সেখানে এই পিড়ির নীচে সুপুরি রেখে আছাড় খাওয়ানো রসিকতা নিশ্চয়ই কেউ প্রত্যাশা করে না।

অপরাহে ইম্পিরিয়্যাল হোটেলে এক সাংবাদিক বন্ধুর চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল। বন্ধুটি কংগ্রেসের সমর্থক নন, গান্ধীজিকে তিনি সাংসারিক বুদ্ধিহীন স্বপ্নবিলাসী আপ্রাকটিক্যাল আইডিয়েলিস্ট মনে করেন। ভারতীয় নন। এমেরিকানও নন,—ইংরেজ। অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে তিনি বললেন, ‘ব্রিটেনের কোন শত্রু এই তালিকাটি রচনা করে ক্রীপসের হাতে দিয়েছে? জাপানীদের টাকা খাচ্ছে এমন কোনো ফিফথ কলামিস্ট নয় তো?’

অসম্ভব নয়।

বন্ধুটি রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। বললেন, ‘পেট্রোল, স্টেশনারী, ক্যান্টিন! খ্যাংরা কাঠি ও দাঁতের খড়কে নয় কেন হোয়াই নট ব্রমস্টিকস্ অ্যান্ড টুথপিকস্?’

ভারতবর্ষের প্রথম দেশরক্ষা সচিব হবেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, এই কথা গত এক সপ্তাহ ধরে নানাভাবে আমরা আলোচনা করেছি। একবার কল্পনা করে দেখা যাক জাপানী আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সমগ্র দেশব্যাপী জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে পণ্ডিত নেহরু তাঁর অনবদ্য ভাষায় বেতারে আবেদন করেছেন, তার সঙ্গে পড়ে শোনাচ্ছেন কর্মের তালিকা-’পেট্রোল, পেন্সিল, নিব, আলপিন।’ পৃথিবীতে সব জিনিসেরই নাকি মাত্রা আছে। নেই কি শুধু নির্বুদ্ধিতার? পরিহাসের?

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য এই, যুদ্ধের সময় দেশরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটেনের। সে দায়িত্ব শুধু ভারতের অগণিত জনসাধারণের প্রতি নয়, সে দায়িত্ব মিত্র জাতিসঙ্ঘের প্রতি, যাঁদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ব্রিটেন যুদ্ধ করছে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে। সে দায়িত্ব তাঁরা পরিত্যাগ করতে পারেন না।

দেশরক্ষার প্রশ্নটি ভারতবর্ষের পক্ষে নানা দিক দিয়ে জটিল। ইংরেজিতে ন্যাশনাল আর্মি বলতে যা বুঝায় ভারতবর্ষের তেমন কোনো সেনাবাহিনী নেই। ভারতে সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছে পেশাদার সিপাহীদল থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে এই সিপাহীদের সংগ্রহ করা হতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। একের পর এক করে কোম্পানী নগর, প্রদেশ ও রাজ্য দখল করেছে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করেছে সিপাহীদল, বেতনের আকর্ষণে।

সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে কোম্পানীর হাত থেকে রাজ্য শাসনের ভার নিলেন। মহারাণী ভিক্টোরিয়া। সেনাবাহিনীও সম্রাজ্ঞীর অধীন হলো। শুরু হলো পরিবর্তন। সিপাহী বিদ্রোহের ফলে দেশীয় সৈন্যদের সম্পর্কে কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন বোধ করলেন ইংরেজ সামরিক কর্তৃপক্ষ। প্রতি দুটি ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করলেন এক ব্রিটিশ বাহিনী, যাতে কোনোদিন কোনো কারণে ভারতীয় বাহিনী বিরুদ্ধভাবাপন্ন হলে অবিলম্বে দমন করা চলে তাদের। সিপাহী বিদ্রোহের আগে ছয়টি ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে একটি মাত্র ব্রিটিশ বাহিনী থাকতো। গোলন্দাজ বাহিনীতে একটিও ভারতীয় নেওয়া হয়নি ঊনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধের আগে পর্যন্ত অফিসার র‍্যাঙ্কে ভারতীয় যাঁরা ছিলেন তাঁদের আঙুলে গোনা যায় এবং যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যেও কেউ মেজরের উপরে ওঠেনি। সামরিক বিচারে বোধ করি তখন পর্যন্ত ভারতীয়দের মেজরিটি প্রাপ্তি ঘটেনি।

সবচেয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হলো সৈন্যদলের লোক নির্বাচনে। ‘সামরিক’ ও ‘অসামরিক’ জাতি, এই কৃত্রিম শ্রেণী বিভাগের দ্বারা ভারতীয় বাহিনী থেকে পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসী ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রায় সব দেশের লোককে সযত্নে দূরে রাখা হয়েছে। অথচ ইতিহাসে যাঁদের কিছুমাত্র দখল আছে তাঁরাই জানেন ভারতে ইংরেজের রাজ্য বিস্তারের এক প্রধান অংশ সম্ভব হয়েছিল বর্তমানে ‘অসামরিক’ জাতি বলে উপেক্ষিত বাংলা ও মাদ্রাজের সিপাহী সান্ত্রীদেরই বাহুবলে। বর্তমানে অত্যন্ত সহজবোধ্য কারণে যে সকল ইংরেজ রাজনীতিক মুসলমানদের সামরিক কৃতিত্ব সম্পর্কে সশ্রদ্ধ প্রশংসায় গদগদ এবং ইংরেজের অবর্তমানে ভারতে গৃহ-যুদ্ধ ঘটলে হিন্দুদের অসহায়ত্ব নিয়ে যাঁরা প্রায় অশ্রু-বর্ষণ করেন, সেই ভারতবন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, ইংরেজের রাজ্য বিস্তারের কালে যারা শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি বলে স্বীকৃত ছিল এবং যাদের কাছে ইংরেজ সর্বাধিক প্রতিরোধ পেয়েছে, তারা মারাঠা ও শিখ। এদের প্রথমটির ধর্মমত অবিমিশ্রিত হিন্দু, দ্বিতীয়টিও হিন্দু ধর্মেরই সংস্কারোত্তর রূপ। একটিও ইসলাম নয়।

পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের প্রতি সেনা বিভাগের এই পক্ষপাতিত্বের কারণ কী? কেউ বলেন, উত্তর ভারতের লোকেরা সাধারণত দৈর্ঘ্যে ও দৈহিক গঠনে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের চাইতে উন্নত। কিন্তু সেটাই সামরিক জাতি বলে চিহ্নিত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। গুর্খাদের তাহলে কোনকালেই খাকী পরতে হত না। বিশেষ করে সৈন্যদের কৃতিত্ব যে-যুগে তাদের দৈহিক সামর্থ্যের উপরেই নির্ভর করতো, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গেই তার সমাপ্তি ঘটেছে।

কোনো বিশেষ অঞ্চল থেকে সৈন্য সংগ্রহের সুবিধা এই যে, তার ফলে একটা নতুন জাতিপ্রথা সৃষ্টি করা চলে। সামরিক বৃত্তি অনেকাংশে পারিবারিক হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষানুক্রমে পিতামহ থেকে পিতা এবং পিতা থেকে পুত্রে সেই বৃত্তি প্রসারিত হয় এবং একই বাহিনীতে বংশপরম্পরা চাকরির দ্বারা বাহিনীর প্রতি একটা কায়েমি স্বার্থবোধ জাগে। নিজেকে তারা সে বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত অংশবিশেষ বলে জ্ঞান করে। ঠিক যেমন করে কলকাতার বড় বড় বিলাতী কোম্পানীগুলির ক্যাশিয়ার, বড়বাবু, বা বেনিয়ানরা। বিদেশী শাসকের পক্ষে শাসনযন্ত্রের প্রতি শাসিতের এই মমত্ববোধ সৃষ্টির সার্থকতা সামান্য নয়।

তার চাইতেও বড় কারণ আছে। সে কারণ রাজনৈতিক। স্বীকার করতেই হবে যে, কিছুকাল পূর্বেও ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রান্ত ছিল রাজনৈতিক চেতনাহীন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় পাঞ্জাব ছিল একমাত্র প্রদেশ যেখানে ইংরেজের বিরুদ্ধে দেশীয় জনগণ অস্ত্র ধরেনি। আধুনিক কালেও ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পাঞ্জাবে জাতীয় জাগরণের চিহ্ন অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ। গদর দল ও কোমাগাটামারুকে নিয়ে যাঁরা পাঞ্জাবের দেশপ্রাণতার প্রশস্তি রচনা করেন তাঁদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, সে পাঞ্জাবীরা বিদেশে গিয়েই দেশাত্মবোধের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, দেশে থাকতে নয়। সাধারণ পাঞ্জাবী সচ্ছল জীবনযাত্রা, মোটা মাইনে, অজস্র আহার ও দামী পোশাক পেলেই খুশি থাকে, দেশ নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামায় না। ভগৎ সিং-এরা নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম মাত্র।

ভারতীয় সেনা বিভাগে বাঙালীরাই সব চেয়ে বেশী অবাঞ্ছিত। আর্মির মনুসংহিতায় তারা হরিজন। আশ্চর্য নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ থেকে শুরু করে তারাই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদ করছে অবিরত, সংগ্রাম করে আসছে অমিত তেজে। ভারতের আধুনিক জাতীয় জাগরণের প্রথম উন্মেষ ঘটেছে এইখানে। জাতীয় যজ্ঞে এখানে মায়েরা আহুতি দিয়েছে পুত্র, মেয়েরা দিয়েছে প্রেরণা, ছেলেরা দিয়েছে প্রাণ। এদের প্রভাব ক্ষুন্ন করতে কার্জন করেছে বঙ্গ-ভঙ্গ, হার্ডিঞ্জ স্থানান্তরিত করেছে রাজধানী, ম্যাকডোনাল্ড কায়েম করেছে কমিউন্যাল এওয়ার্ড। সর্বনাশ! এদের সেনাদলে নিলে রক্ষা আছে? এইখানে স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম লক্ষণও প্রকাশ পেয়েছিল বাংলাদেশরই এক ছাউনিতে। ব্যারাকপুরে।

‘সামরিক জাতির’ প্রতি এই পক্ষপাত ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে সহায়ক হয়েছে সন্দেহ নেই। অভাব অভিযোগের ফলে পাছে তাদের ব্রিটিশ-অনুরক্তি হ্রাস পায় সেজন্য ব্রিটিশ শাসকেরা এই ‘সামরিক জাতির’ পার্থিব কল্যাণ সাধনে অনেকটা তৎপর হয়েছেন, সে কথাও সত্য। সেনা বিভাগের বেতনের হার ও পেন্সন সাধারণ দরিদ্র গ্রামবাসীর পক্ষে যথেষ্ট লোভনীয়। তা ছাড়া বার্ধক্যে অবসর গ্রহণকালে অনেকে জায়গীরও পেয়েছে।

পাঞ্জাব সেনাবিভাগের সৈন্য ও অশ্ব যোগায়, তাই পাঞ্জাব সর্বদাই কর্তৃপক্ষের অধিকতর সস্নেহ মনোযোগ লাভ করে এসেছে। কৃষির উন্নতি, স্বাস্থ্যোন্নয়ন-পরিকল্পনা পাঞ্জাবে হয়েছে বেশী। সমবায় আন্দোলন ও কৃষিবিদ্যার গবেষণা শুরু হয়েছে সেখানে এবং ভারতে ব্রিটিশ যুগের সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর ও ব্যয়বহুল কৃত্রিম সেচকার্যের নিদর্শন আছে পাঞ্জাবে ও সিন্ধুপ্রদেশে। সেখানে বেশীর ভাগ চাষীরই ক্ষেতে ধান, গোয়ালে গরু এবং ঘরে আর্মির মেডেল আছে। সেখানে সাহেবকে বলে হুজুর, দারোগাকে বলে ধর্মাবতার, গভর্নমেন্টকে বলে সরকার বাহাদুর। সেখানে স্বরাজের গরজ থাকবে কার?

কিন্তু বন্যা যখন আসে, তখন তাকে বালির বাঁধ দিয়ে ঠেকানো যায় ক’দিন? সমুদ্র যদি ক্যানুটের আদেশ মেনেই চলতো তবে আর ভাবনা ছিল কী? সমস্ত প্রতিষেধক ও সাবধানতা ব্যর্থ করে দেশাত্মবোধের ধারা এগিয়ে এসেছে ধীরে ধীরে। ভারতবর্ষের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ—কোথাও কোনো প্রান্তে তার আর বাধা রইল না। পশ্চিম সীমান্তে খান আব্দুল গফুর খান এই ভাবগঙ্গার ভগীরথ।

এই বহু অনুগৃহীত অঞ্চলের রাজনীতির সম্পর্কবর্জিত সরল অধিবাসীদেরও তাদের স্বদেশ ও স্বজাতির বিরুদ্ধে পুনঃ পুনঃ ব্যবহার এখন আর আগের মতো নিরাপদ নয়। বোধ হয় অনেকেই জানেন না যে, উনিশ শ’ ত্রিশ সালে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কালে একদল হিন্দু গাড়োয়াল সৈন্য পেশোয়ারে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের উপর গুলীবর্ষণে অস্বীকৃত হয়ে অস্ত্র পরিত্যাগ করেছিল। সে সংবাদ এদেশের খবরের কাগজে প্রকাশ পায়নি, অর্থাৎ প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি।

সম্প্রদায়ের দিক দিয়ে উনিশ শ একচল্লিশ সাল পর্যন্ত এই সেনাদলের শতকরা পঁয়ত্রিশ ভাগ ছিল মুসলমান, তেইশ ভাগ শিখ ও বিয়াল্লিশ ভাগ হিন্দু। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, এ হিসাব থেকেও হিন্দুদের বিরুদ্ধে বহুপ্রচারিত সামরিক অযোগ্যতার অপবাদ মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

খুব সামান্য হলেও ভারতবর্ষের সামরিক নীতির প্রথম পরিবর্তন ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধ অবসানের পর। একান্তভাবে ইউরোপীয় অফিসার পরিচালিত বাহিনীর সামান্য অংশ ভারতীয়করণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারতীয়েরা সেনাবিভাগে কিংস কমিশন প্রাপ্তির যোগ্য বিবেচিত হয় এবং ভারতীয় সেনানায়কদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে দেরাদুনে? ভারতীয় স্যান্ডহার্স্ট-এর প্রতিষ্ঠা ঘটে।

বর্তমান যুদ্ধে এই ভারতীয়করণ দ্রুত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ভারতীয়দের প্রতি মমত্ববোধে নয়। ইংরেজের নিজ প্রয়োজনের তাগিদে। অসামরিক জাতি বলে সেনাবিভাগে ইতিপূর্বে যাদের প্রবেশের সম্ভাবনা মাত্র ছিল না, তারাও এখন অফিসার হতে পারে। অবশ্য এই বাধা অপসারণের ফলে সেনাবিভাগে বাঙালীর সংখ্যা এখনও খুব উল্লেখযোগ্য বলে আমার বিশ্বাস নেই, যদিও বিমানবহরে তাদের সংখ্যা তেমন হতাশাজনক নয়। সুদক্ষ বৈমানিকরূপে কয়েকজন বাঙালী তরুণ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছেন।

এতকাল ভারতবর্ষে দেশরক্ষার ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে। কমান্ডার-ইন-চীফের সবগুলি কামানের মুখ ছিল আফ্রিদিদের দিকে। একচক্ষু হরিণের মতো পার্ল হারবার বিধ্বস্ত হওয়ার পরে সেনাপতিরা প্রথম হৃদয়ঙ্গম করলেন, বিপদ ঠিক সে দিক থেকেই উপস্থিত যে দিক তার সম্ভাবনা তাঁরা কল্পনাও করেননি।

যুদ্ধ শাস্ত্র মতে জাপানের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম প্রতিরোধ-ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন নৌবহর। তা নেই। জলপথ সবটাই শত্রুর দখলে। ব্রিটিশ ও ভারতীয় যে পেশাদার সেনাবাহিনী ভারতে বর্তমান, তা আধুনিক যুদ্ধযন্ত্রে পুরোপুরি সজ্জিত নয় এবং তাদের ঘাঁটিগুলি সম্ভাবিত রণক্ষেত্র থেকে বহু শত যোজন দূরে দেশের অপর প্রান্তে।

এই আসন্ন আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের আত্মরক্ষার উপায় কী, এ প্রশ্ন সামরিক কর্তৃপক্ষের মনে উদিত হয়েছে কিনা জানার উপায় নেই। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রহীন যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞতাশূন্য জনসাধারণের মনে এ জিজ্ঞাসা জেগেছে। অবশেষে একজন এই প্রশ্নের উত্তর নির্দেশ করলেন। তাঁর নাম পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।

পঞ্চাশ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য সংগ্রহের এক পরিকল্পনা করলেন জওহরলাল। কাশ্মীরী পণ্ডিতের বংশধর তিনি। তাঁর ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ রাজকাউল ছিলেন প্রখ্যাতনামা পার্শি ও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, প্রপিতামহ লক্ষ্মীনারায়ণ নেহরু ছিলেন মুঘল দরবারে নামকরা ব্যবহারজীবী। এডভোকেট জনকের সন্তান জওহরলাল নিজেও মসিজীবীরূপেই কর্মজীবন শুরু করেছিলন। দেশরক্ষার আয়োজনে তিনিই সর্বপ্রথম পরিকল্পনা করলেন সর্বসাধারণের অসিচালনার। জনগণের কথা যিনি ভাবেন তাঁকেই তো আমরা বলি জনগণ-মন-অধিনায়ক।

অস্ত্র? চাই বৈকি। অবশ্যই চাই। পঞ্চাশ লক্ষ সৈন্যের অস্ত্র যোগাতে দেশে নতুন কলকারখানা স্থাপন ও পুরাতন কলকারখানার বিস্তার প্রয়োজন। সেটা সময়সাপেক্ষ। শত্ৰু তো তার জন্য অপেক্ষা করবে না। পণ্ডিতজী অত্যন্ত নিকটে থেকে গভীরভাবে অনুধাবনের সুযোগ পেয়েছিলেন স্পেন ও চীনের গণবাহিনীর যুদ্ধসজ্জা ও যুদ্ধরীতি। স্পেনে চাষীমজুরদের সমিতি থেকেই গড়ে উঠেছিল সেনাবাহিনী। তার মধ্যে থেকেই উদ্ভব হয়েছে একাধিক সেনাপতির যারা প্রথম জীবনে কেউ চালিয়েছে লাঙ্গল, কেউ বুনেছে তাঁত। চীন থেকে যুদ্ধবিদ্যা শেখাবার লোক আনার পরিকল্পনা করলেন জওহরলাল।

গতিশীলতা ইংরেজিতে যাকে বলে মোবিলিটি, সেই হলো এই বাহিনীর সর্বাপেক্ষা সুবিধা। রাইফেলের অভাবে হাত বোমা দিয়ে এর কাজ চলে। সর্বত্র এদের সহযোগিতার জন্য গ্রামবাসীরা হতো ব্যগ্র। ক্ষুধায় অন্ন এবং বিপদে আশ্রয় জোগাতো তারা। দেশেপ্রাণতার প্রেরণায় এই বাহিনীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকতো। ইউরোপীয় পরিচালনায় বেতনভুক সৈন্যদলের মতো তারা আদেশ পালনের যন্ত্রমাত্র হতো না!

জনশ্রুতি এই যে, কোনো কোনো ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষও এই পরিকল্পনা শ্রদ্ধার সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন এবং বিলাত থেকে মেজর টম উইনটিংহ্যাম ভারতবর্ষে এসে এই সৈন্যবাহিনীর শিক্ষার ভার গ্রহণ করবেন এমন প্রস্তাবও শোনা গেছে। উইনটিংহ্যাম স্পেনে ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় গণতান্ত্রিক দলের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত নেহেরুর পরিকল্পনা ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট প্রীতির চোখে দেখবেন এ আশা যাঁরা করেছিলেন তাঁরা যাই হোন মানবচরিত্র সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞ নন। তাঁদের জানা উচিত ছিল, ব্রিটিশ প্রস্তাবে সৈন্যসামন্ত বা অস্ত্রশস্ত্রের কথা থাকে না। থাকে পেট্রোল, স্টেশনারী ও ক্যান্টিন। রুল্ ব্রিটেনিয়া, ব্রিটেনিয়া রুল্স দি শ্লেভস্।

ইম্পিরিয়্যাল হোটেল থেকে ফিরছি স্বস্থানে। গেটের বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখি হঠাৎ ব্রেক কষে সশব্দে একটি গাড়ি দাঁড়াল একেবারে ঠিক সামনে। গাড়ির ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে আরোহীটি বললেন, ‘তাইতো, আমাদের বোঁচকা যে! এখানে কী করছিস? আয় উঠে আয়।’

বোঁচকা আমার পিতৃ বা মাতৃদত্ত নাম নয়। পারিবারিক সম্বোধনও নয়। কিশোর বয়সে সহপাঠীদের দ্বারা আবিষ্কৃত উত্যক্ত করার একটি অভিধা মাত্র। লাটিমের অধিকার, আমসত্ত্বের অংশ ও বিস্কুটের বন্টন নিয়ে মতভেদজনিত কলহের পরিণামে বিক্ষুব্ধ পক্ষ ঐ শব্দটি পুনঃ পুনঃ আবৃত্তিদ্বারা আমার উপরে প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করত এবং বহুল পরিমাণে সফলকাম হতো। মনে আছে, অনেকদিন খেলার মাঠে বা ক্লাশে ঐ নামটা শুনে ক্রোধে ও অপমানে প্রচুর অশ্রুপাত করেছি।

নামটা একেবারে আকস্মিক নয়। তার পশ্চাতে কিঞ্চিৎ ইতিহাস আছে।

প্রথমে যেদিন বৃন্দাবন পণ্ডিতের পাঠশালায় বিদ্যারম্ভ, সে দিন দিদিমা একখানা শান্তিপুরী জড়িপাড় ধুতি ও সিল্কের জামা পরিয়ে দিয়েছিলেন। পোশাকটা গুরুগৃহগামী ব্রহ্মচারী বিদ্যার্থীর চাইতে সদ্য বিবাহান্তে শ্বশুরালয়ে আগত জামাতা বাবাজীর পক্ষেই অধিকতর উপযোগী ছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু বিপদ দেখা দিল বস্ত্রটি নিয়েই। প্রথমত, তার অবস্থান যথাস্থানে রাখা রীতিমতো আয়াসসাধ্য ব্যাপার, তার উপরে সযত্নে কুঞ্চিত লম্বমান কোচার প্রান্তভাগ মাধ্যাকর্ষণের ফল কেবলই নিম্নাভিমুখি হয়ে ভূমিতে লুণ্ঠিত হয়। এক হাতে শেট ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণ-পরিচয়, অপরহাতে ধৃত শিথিলবন্ধন বসনের প্রান্তভাগ। কোনোরকমে তালপাকানো অঞ্চলভাগ, দেখতে পোঁটলা আকৃতি।

গোঁসাইদের বাড়ির সিধু ছিল পাঠশালার সর্বাপেক্ষা রখা ছেলে। বয়সে অন্য ছাত্রদের চাইতে অনেক বড়। লেখাপড়ায় বৃহস্পতি। বার দুই ধরে এক ক্লাশেই আছে। এরই মধ্যে বিড়ি ধরেছে। কাছে এসে অত্যন্ত নিরীহের মতো প্রশ্ন করল, হাতে বোঁচকাটি কিসের বাপু, মুড়কির না বাতাসার?’

ক্লাসসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। সেই থেকে শুরু হলো বোচকা। খাতা নিয়ে, পেন্সিল নিয়ে ঝগড়া হলেই বলে, বোঁচকা। সিধুকে কত সাধ্য সাধনা করেছি। এন্তার মার্বেল, রাশি রাশি জলছবি ঘুষ দিয়েছি। আর যেন কোনদিন না বলে। পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে জিনিসগুলি পকেটে পুরে’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষেপেছিস? আর বলি কখনো বোঁচকা? তোর ঐ লাল পেন্সিলটা কিন্তু আমায় দিতে হবে।’

কিশোর বালকের পক্ষে সেদিন ঐ লাল পেন্সিলটা দান করা কর্ণের কবচকুণ্ডল দানের চাইতে কোনো অংশে কম কঠিন ছিল না। কিন্তু তাতেও স্বীকৃত হয়েছি। অত্যন্ত অনুনয় করে বলেছি, ‘দেখ ভাই। অন্য ছেলেরা যেন আর না বলে, বারণ করে দিয়ো।’

সিধু পেন্সিলটার ডগায় জিভের লালা লাগিয়ে কাগজে মোটা অক্ষরে নিজের নাম লিখতে লিখতে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মন্তব্য করল, ‘হুঁ, বলুক দেখি সাহস আছে কোন শা—’

সিধুর বিবাহের নিকট বা সুদূর কোনো সম্ভাবনাই তখন ছিল না। কিন্তু তার সম্ভবপর পত্নীর কাল্পনিক সহোদরের উল্লেখ না করে কোনো একটা বাক্য সমাপ্ত এবং আরম্ভ করা তার পক্ষে কঠিন। ঐ বয়সেই ভাষায় তার এমন শব্দ সম্ভার যা এ বয়সেও উচ্চারণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়।

কিন্তু প্রতিশ্রুতি দান ও তা পালনের মধ্যে সামঞ্জস্যসাধন নিয়ে সিধুর কোনো চিন্তা ছিল না। এ বিষয়ে তার রেকর্ড প্রায় ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সমতুল্য। পরের দিনই ক্লাশে পণ্ডিত মহাশয়ের উপস্থিতি সত্ত্বেও পিছনের বেঞ্চি থেকে পরিচিত কন্ঠের চাপা স্বরে আওয়াজ এল, বোঁচ— অমনি চারিদিক থেকে অন্য ছাত্রেরা শ্লেটের আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসি চাপতে চেষ্টা করলো হিঃ হিঃ হুঃ হুঃ, ফিক।

কাছে এসে দেখি সিধুই বটে। যদিও চেনা খুব সহজ নয়। পরনে লাইট গ্রে রঙের শার্কস্কিনের মহার্ঘ সুট, পায়ে দামী বিলাতী জুতা যার চকমক করা পালিশে প্রায় মুখ দেখা যায়। দুই হাতে গোটা চারেক আংটি, পকেটে পার্কার ফিফটি ওয়ান কলম ও পেন্সিলের সেট, যা একমাত্র এমেরিকান সেনানায়কদের কাছে ছাড়া এদেশে এখনও আর কেউ দেখেনি বললেই হয়। এই কি সেই সিধু যে পাঁচ বছর আগে পটলডাঙার পাইস হোটেলের নীচের তলায় এক টাকা বারো আনা ভাড়ায় আর দু’জন লোকের সঙ্গে একটা অন্ধকার কুঠুরিতে থাকতো? কোন তেলের কলের বিল কালেক্টর ছিল, মাইনে আঠারো টাকা। চিবুকের নীচে কালো বড় আঁচিলটা না থাকলে সিধু বলে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো।

‘তুই এখানে কেন? বিলাত থেকে ফিরলি কবে? বিয়ে থা করেছিস তো?’ এক সঙ্গে তিনটা প্রশ্ন করল সিধু।

সে-সব পরে হবে, তোমার খবর কি বল দেখি?’,

‘আমার খবর ভালো। মিলিটারি কন্ট্রাক্ট করছি। হাতে দু’পয়সা আসছে রে।’ সেকথা বিশেষ করে বলার প্রয়োজন ছিল না।

তার কাহিনী যা শোনা গেল সংক্ষেপে তা এই : তেলের কলের সেই চাকরি ছেড়ে সে অনেক কিছু করেছে। সাবানের ক্যানভাসারি, এক টাকার ইনসিওরেন্সের দালালী, মায় কাগজের প্যাকেটে চানাচুর বিক্রি পর্যন্ত। কোনোটাতেই কিছু হয় না। মাসের মধ্যে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটে না অনেকদিন, এমন অবস্থা। হঠাৎ বাধলো যুদ্ধ। এরোড্রাম তৈরি করে এমন এক কন্ট্রাক্টরের অধীনে কুলি-তদারকের কাজ নিয়ে চলে গেল আসামের কোন জঙ্গলে। সেখানেই কপাল ফিরল। কিছু হাতে নিয়ে এসে বসল কলকাতায়। প্রথমে ছোট-খাটো জিনিস সাপ্লাই, পরে বড় বড় কনট্রাক্ট। এখন দিল্লীতে এসেছে ডিপার্টমেন্টের কোন এক বড় সাহেবকে ধরতে।

পুরানো দিল্লীর সুইস হোটেলে তার আস্তানা। সেখানে এসে গাড়ি থেকে নেমে নিয়ে গেল তার ঘরে। জিজ্ঞাসা করল, ‘থাকিস কোথায়? কুইনসওয়ে? আচ্ছা গাড়ি তোকে নামিয়ে দেবে সেখানে। এই দেখো ড্রাইভার, আভি ঠাহরো। এ সাবকো কুইনস ওয়ে ছোড়নে পড়েগি।’ কুলির তদারক করে হিন্দীটা রপ্ত করেছে সিধু মন্দ নয়।

বাধা দিয়ে বললেম, ‘না, না, আমার জন্য ভাবনা নেই। আমি বাস নেবো এখান থেকে।’

‘ক্ষ্যাপা নাকি? বাসে যা ঝাঁকুনি আর যা ভিড়! ভদ্রলোকের ওঠা দায়। গাড়ি থাকতে সে দুর্ভোগ কেন? ভাড়া তো তাকে পুরো দিনের জন্যই দিচ্ছি।’

এতক্ষণে বুঝলেম, গাড়িটা ট্যাক্সি এবং সমস্ত দিনের জন্যই ভাড়া করা হয়েছে। নয়াদিল্লীর ট্যাক্সিতে মিটার নেই, তার নম্বরও ‘টি’ দিয়ে আরম্ভ নয়। না জানলে বুঝবার সাধ্য নেই যে, ভাড়াটে গাড়ি। কিন্তু বিস্ময়ের অন্ত পাইনে। ঝাঁকুনি আর ভিড়ের জন্য সিধুর ন্যায় ভদ্রব্যক্তির বাসে ওঠা দায়। মনে আছে, পটলডাঙ্গা থেকে দুপুর রোদে পায়ে হেঁটে একদিন টালিগঞ্জে দেখা করতে এসছিল এই সিধু। সে খুব বেশী দিনের কথা নয়।

বয়কে হুইস্কি হুকুম করল সিধু। নিষেধ করলেম। হেসে বলল, ‘ভাবছিস বুঝি ‘সোলান’ কিংবা ‘মারি’? ওসব দেশী মাল ছেঁবে এমন শর্মা নয় সিধুচন্দ্র। চেখেই দেখ না। খাস স্কচ। খাসা। বাবা খাবো তো খাঁটি জিনিস খাবো, নয়তো নয়।’

‘সে জন্য নয়। কিন্তু স্কচ পাও কোথায়? বাজারে তো শুনেছি—।’

‘হ্যাঁ, সাদা বাজারে নেই, কিন্তু কালো বাজারে অভাব কী? ভাইরে, সবই টাকার মামলা। ঝনঝনে ফেলো, জিনিস দেবে না কোন শা-’

স্বচক্ষে দেখলাম কথায় এবং কাজে তফাত করে না সিধু। তিন বোতল সোডা কিনে এনে একটা পাঁচ টাকার নোটের অবশিষ্ট ফেরত দিচ্ছিল বেয়ারা। ‘ঠিক হ্যায়, লে যাও’ বলে’ অত্যন্ত নির্লিপ্ত ঔদাসীন্যে সমস্তটাই বকশিস করল তাকে। লোকটা আভূমিপ্রণত সেলাম করে প্রস্থান করল।

সিধু তার বর্তমান দিল্লী আগমনের কারণ ব্যক্ত করল। কলকাতায় ছোট সাহেব নাকি তার নামে লাগিয়েছে অনেক কিছু। এখান থেকে তাই তার ফ্যাক্টরী দেখতে যাবে কোনো একজন অফিসার। সুতরাং একটু ভাবনায় ফেলেছে।

ভাবনাটা কিসের ঠিক বুঝতে পারলেম না। দেখে আসুক না ফ্যাক্টরী, ক্ষতিটা কিসের? সিধু বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আরে ফ্যাক্টরী থাকলে তো দেখবে? ফ্যাক্টরীই নেই যে।’

‘ফ্যাক্টরী নেই, তবে মাল যোগাচ্ছ কেমন করে?’

‘তুই এখনও সেই বোঁচকাই আছিস। বিলাত ঘুরেও বুদ্ধি খুলল না এতটুকু। আরে মাল যোগাবার জন্য ফ্যাক্টরী থাকার দরকার কী? অন্য লোকের ফ্যাক্টরী নেই? সেখান থেকে তৈরি করিয়ে নিজের লেবেলে চালাতে আটকাবে কোন শা? ছাপাখানার কিছুটা খরচ আছে! খানকয়েক চালান ফরম, লেটার হেড, রাবার স্ট্যাম্প, ব্যস। অর্ডার কি ফ্যাক্টরী দেখে হয়? অর্ডার তো হয়’ বলে’ মুখে চোখে এমন একটা ইঙ্গিত করল যে, তার অর্থ কিছুটা স্পষ্ট ও কিছুটা ঝাপসা হয়ে আমার কাছে একটা প্রহেলিকা সৃষ্টি হলো!

জিঙ্গাসা করলেম, ‘মাল যোগাচ্ছ এত দিন, এর মধ্যে তোমার ফ্যাক্টরী আছে কি নেই সে—খোঁজ হয়নি?’

‘হবে না কেন? তিন চার বার ইন্সপেকসন হয়ে ভালো রিপোর্ট চলে গেছে। এবারেও কি যেত না? শা-ছোট সায়েব ব্যাটার খাই বেড়েছে এত যে, আর মিটাতে পারছি নে। তাই না এ-ঝামেলা। যাক, পরোয়া করি নে। জানতে পারব সবই।’

‘কেমন করে?’

‘কেন, আপিসের কেরানীরাই খবর দেবে। দেবে না? আরে ভাই দেবে কি আর অমনি? সংসারে বিনিপয়সায় পরহিতার্থে আর কাজ করে কোন শা-? আশী টাকার কেরানী, একসঙ্গে পাঁচ শ’ টাকা দেখেছে এর আগে? খবর তো খবর, দরকার হলে ফাইলকে ফাইল গাপ করিয়ে দেওয়ার দাওয়াই পর্যন্ত জানি। এই যে মধুবাবু, আসুন আসুন। কী খবর? আচ্ছা এক মিনিট বোস ভাই, এঁর সঙ্গে একটু প্রাইভেট,—চলুন মধুবাবু বারান্দায়।’ সদ্য আগত আগন্তুককে নিয়ে বাইরে গেল সিধু।

প্রায় মিনিট কুড়ি পরে ফিরে এসে বলল,—’মোটা হাতে কিছু ঢালতে হবে দেখছি। যাক পরে পুষিয়ে নেবো।’

বিস্মিত হওয়ার পালা শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। শুধু জিজ্ঞাসা করলেম, ‘আচ্ছা এসব কি শেষ পর্যন্ত চাপা থাকে? ডিপার্টমেন্টের অন্য লোকেরা কি জানতে পারে না?’

‘কেমন করে জানবে? এই যে এসেছিলেন ভদ্রলোক, খবর দিয়ে গেলেন কোন সায়েব যাচ্ছে এখান থেকে তদন্ত করতে, কবে যাচ্ছে ইত্যাদি। আপিসে যখন যাবো তখন উনি কি আমার সঙ্গে কথা কইবেন, না কিছু? এমন ভাব দেখাবেন যে, জীবনে এর আগে কখনও আমাকে চোখেও দেখেননি। ব্যাস, তা হলেই হলো। সব কাজেরই সিস্টেম আছে তো?’

একজন বেয়ারা গোটা দুই বিরাট প্যাকেট নিয়ে এসে বলল, ‘ফেল্পস কোম্পানি পাঠিয়েছে।’ সিধু বললে, ‘ঠিক হ্যায়। কাল দোকানে সওদা করেছি কিছু। তাই পাঠিয়েছে। দেখ তো জিনিসগুলি। তোরা মডার্ন স্টেটের লোক, আপ-টু-ডেট ফ্যাশানের খবর রাখিস। হ্যাঁ, সার্ট। এক ডজন। ছাব্বিশ টাকা পনেরো আনা করে একটা। ওদের সেই পনেরো আনার কায়দা জানিস তো? পুরা সাতাশ টাকা লিখবে না কিছুতেই। রুমাল! হ্যাঁ, পিরামিড। ডজন সত্তর টাকা। পাওয়া যে যাচ্ছে এই ঢের, সত্তর হলেই কী, আশী হলেই কী? এটাকে কী বলে রে? দেখছি আজকাল এমেরিকান সাহেবরা পরে খুব। ডার্কিন? ডার্কিন নয়? তবে কী? জার্কিন? বর্গীয় জ-য়ে আকার তো? দোকানে তো আর জিনিসের নাম জিজ্ঞাসা করতে পারি নে। ভাববে কী? কিনলেম তো, কখন পরবো সে পরে দেখা যাবে। দাম বেশী নয়। দু’শ আশী টাকা। চামড়াটা ভালো কোয়ালিটির।’ বিল দেখলাম আরও খুঁটি-নাটি অনেক কিছু মিলিয়ে সাত শ’ টাকার উপরে। সায়েব তার ওয়ালেট খুলে দু’খানা পাঁচ শ’ টাকার নোট বেয়ারার হাতে দিল দাম চুকিয়ে দিতে।

চুপ করে স্মরণ করতে চেষ্টা করলেম, এর আগে ঠিক কখন সিধুর গায়ে তালিহীন জামা দেখেছি।

প্রচুর আদর আপ্যায়ন করল সিধু। বাল্যবন্ধুর প্রতি তার এই সহৃদয়তা দেখে মুগ্ধ হওয়া উচিত। তার চালচলন দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আমাকে দশ বছর মাইনে-করা কর্মচারী করে রাখার মতো অর্থ আছে তার ব্যাঙ্কে। কিন্তু কর্মচারীর বদলে অংশীদার করতে চাইল। বললে, ‘আরে ব্যারিস্টার হবি যখন হবি। এখন খবরের কাগজে রিপোর্ট লিখে আর ক’টাকা আসবে? তার চেয়ে আমার সঙ্গে জুটে যা, নেহাত মন্দ হবে না। আমারও সুবিধে হবে, চিঠিপত্র লেখা, সায়েব-সুবোর সঙ্গে কথাবার্তা বলা তো আমার আসে না।’

হেসে বললেম, ‘তার দরকার কী? তুমি যা বলছ তাতে কন্ট্রাক্ট পেতে ওসবের যে কিছু দরকার আছে তা তো মনে হয় না। তোমার হয়ে তোমার টাকাই কথাবার্তা কইবে।’

‘নেহাত মিথ্যে বলিসনি। যে পূজার যে বিধি তা না হলে কিছুই হয় না। তবে হ্যাঁ, ইংরেজি বলতে কইতে পারে, লিখতে পারে এমন লোক থাকলে আরও সুবিধে। তোকে পেলে আমি এখন যা পাচ্ছি তার ডবল আয় করতে পারি। বলেছিলাম নিত্যানন্দকে। মনে নেই তাকে? সেই যে পুরুত ঠাকুরের ছেলে নিতাই রে। পাঠশালায় একদিন তার পৈতে ছিঁড়ে দিয়েছিলাম। আর কথা কইতে পারে না। কেবলই হাত দিয়ে ইশারা করে জবাব দেয়। শেষে পণ্ডিতমশায়ের কাছ থেকে পৈতে ধার করে কথা বলল। নালিশের ফলে শাস্তি পেলেম দু’ঘন্টা দুই কানে ধরে বেঞ্চির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা। সেই নিত্যানন্দ এখন ডেপুটি হয়েছে। মাঝে ক’দিন সাপ্লাইর কাছে ছিল। রাস্তা বাতলে দিলেম, কী করলে দু’পয়সা হবে। বলে কিনা, সিধু, ছেলেবেলায় ইস্কুলে অনেক অকাজ কুকাজ করেছিস, বড় হয়ে এখন আর করিস নে। শোন কথা একবার! টাকা উপায় করতে আমি করছি ঠিকাদারী, তুই করছিস চাকরি। যাতে দু’পয়সা উপরি আসে তার চেষ্টা করব, তাতে কুকাজটা কোনখানে? হরিনাম জপতে তুইও আসিসনি, আমিও বসিনি।’

যাক্, তবু ভালো। সংসারে তাহলে দু’একটা লোক এখনও আছে যারা ব্যাঙ্কের পাশ বইর উপরে দৃষ্টি রাখাটাই জীবনের চরম মোক্ষ মনে করে না।

সিধু বলল, ‘হ্যাঁ লাভটা কি হচ্ছে? ওর সঙ্গে কাজ করতো আর এক অফিসার, সে লেক রোডে বাড়ি কিনেছে দু’খানা, গাড়ি কিনেছে। তার বউ-এর গায়ে হীরার গয়না। আর আমাদের নিত্যানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংস হয়ে বসে আছেন। বাদুড়-ঝোলা হয়ে ট্রামে চেপে আপিসে যায়, ওয়াছেল মোল্লার সুট পরে। আহাম্মক এক নম্বরের।’

তাতে আর সন্দেহ কি!

জিজ্ঞাসা করলেম, ‘আচ্ছা ভাই, যুদ্ধের বাজারে কি অনেস্টি বলতে কোথাও কিছু আর অবশিষ্ট নেই?’

‘অনেস্টি? তার মানে সততা? ভায়া হে, ওসব ভালো ভালো কথা যা আমরা ছেলেবেলায় কপিবুকে লিখেছি না, লিখেছি বলা ঠিক নয়: আমি তো লেখাপড়ার ধার ধারতেম না, কেবল মাস্টারের বেতই খেয়েছি—তোরা লিখেছিস, ওসব ছাপার বইতে থাকে, —ছেলেবেলায় মুখস্থ করতে মন্দ লাগে না। কিন্তু সংসারে ওসব ফালতু। এই বুকে হাত দিয়ে বলছি বোঁচকা, জানবি, এমন লোকই নেই যাকে কেনা যায় না। দামের কম বেশী নিয়ে কথা। কেরানীবাবুকে দিতে হয় দশ বড়বাবুকে পঁচিশ, সুপারিন্টেন্ডেন্টকে পঞ্চাশ, ইন্সপেক্টরকে এক শ’। যত বেশী মাইনের অফিসার, তত বেশী তাঁর দক্ষিণা। টাকায় না হয় এমন কাজ নেই। তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ হয়তো সোজাসুজি টাকাটা নিতে ভয় পায়। তাদের বেলায় বিলাতী হলে পাঠাবে এক কেস্ ‘হোয়াইট লেবেল,’ দেশী হলে মেয়ের বিয়েতে দেবে বেনারসী শাড়ি।’

সিধুচন্দ্রের ওখানে ডিনার খেয়ে তারই ভাড়া করা ট্যাক্সি চেপে বাড়ি ফিরলেম অনেক রাত্রে। অনেকগুলি সিগারেট ভরে দিয়েছিল আমার সিগারেট কেসে। ‘ব্ল্যাক অ্যাও হোয়াইট।’ শাদা আর কালো। শাদা বাজারে তার দুর্শন এখন দর্লভ! কিন্তু কালো বাজারে অভাব কী? দেশে অভাব কী সিধুচন্দ্রের?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *