দুর্ঘটনার পর

দুর্ঘটনার পর

এ জায়গাটা রেবতীবাবুর এখনও চেনা হয়ে ওঠেনি। মাত্র তিনদিন হল পাহাড়ি অঞ্চলের এই হাসপাতালে সুপারের দায়িত্ব নিয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন রেবতীভূষণ। নতুন তৈরি হয়েছে এই ছোট হাসপাতালটা। মাত্র কয়েকজন চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। পেশেন্টদেরও তেমন ভিড় নেই এখানে। সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। থামার কোনো বিরাম নেই। জানলার বাইরে পাহাড়গুলোর মাথা ঢেকে আছে কালো মেঘে। আজ একজনও পেশেন্ট আসেনি হাসপাতালে। বিকাল হয়ে আসছে। নিজের চেম্বারে বসে একটা মেডিকেল জার্নালের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন রেবতীবাবু। ঠিক সেই সময় স্থানীয় পুলিশ স্টেশন থেকে টেলিফোনটা এল। একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে একটা জায়গাতে। অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলছে সেখানে। ফোনটা নামিয়ে রেখেই চেম্বারের বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন রেবতীবাবু। বারান্দায় একটা কাঠের বেঞ্চে বসে গল্প করছিল অ্যাম্বুলেন্সচালক সুব্বা নামের ছেলেটা ও আরও কয়েকজন স্থাস্থ্যকর্মী। রেবতীভূষণকে দেখেই তারা উঠে দাঁড়াল।

রেবতীবাবু তাদের প্রশ্ন করলেন, ‘এখানে ডেভিল রোডটা কোথায়?’

সুব্বা বলল, ‘কাছেই স্যার। কেন কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হল নাকি?’

রেবতীবাবু মৃদু বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি জানলে কিভাবে?’

ছেলেটা বলল, ‘ও জায়গাতে মাঝে মাঝে অ্যাক্সিডেন্ট হয় স্যার। বিশেষত এই বর্ষাকালে। সেজন্যই ও রাস্তার ওই নাম।’

রেবতীবাবু এবার এই অদ্ভুত নামের কারণ বুঝতে পারলেন। ডেভিলস রোড—শয়তানের সরণি।

তিনি বললেন, সেখানে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। থানা থেকে ফোন এসেছে।’

কথাটা শুনে একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলল, ‘তবে কোনো ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনি?’

হাসপাতাল থেকে বেশ কিছুটা তফাতে ডাক্তারদের বাসস্থান। আজ কোনো পেশেন্ট নেই বলে কিছুক্ষণ আগেই রেবতীবাবুর অনুমতি নিয়ে অন্য দুজন ডাক্তার ঘরে ফিরে গেছেন। স্বাস্থ্যকর্মীর কথা শুনে রেবতীবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ তাঁদের গিয়ে হাসপাতালে আসতে বলুন। তবে তাঁরা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে আমিই যাচ্ছি।’

বারান্দার নীচে কিছুটা তফাতে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়েছিল অ্যাম্বুলেন্সটা। রেবতীবাবু সুব্বা, আর একজন সঙ্গীকে নিয়ে উঠে বসলেন তাতে। সর্পিল পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে তাঁরা এগোলেন অকুস্থলের দিকে।

জায়গাটা বেশি দূর নয়। মিনিট চার লাগল সে জায়গাতে পৌঁছতে। তার একপাশে পাহাড়ের ঢাল উঁচু হয়ে উঠে গেছে ওপর দিকে। তার মাথার ওপর বর্ষণসিক্ত পাইন বন। সেখান থেকে একটা ঝোরা বা ঝর্না নেমে এসে সামনের সংকীর্ণ রাস্তাটাকে ভিজিয়ে দিয়ে নেমে যাচ্ছে অন্য দিকের অতলস্পর্শী খাদের দিকে। ঝর্নার জলধারা যেখান দিয়ে রাস্তায় প্রবাহিত হচ্ছে তার পরই রাস্তাটা একটা বাঁক নিয়ে নীচের দিকে নেমেছে। যে রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠে আসে গাড়ি, রেবতীবাবুরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামতেই সেখানে একটা ছোটখাট জটলা দেখতে পেলেন। একটা পুলিশের জিপও সেখানে আছে। রেবতীবাবু সঙ্গীদের নিয়ে সেই জটলার কাছে যেতেই একজন পুলিশ অফিসার তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। রেবতীবাবু তাঁকে বললেন, ‘আমি হাসপাতালের সুপার। তিনদিন হল এখানে এসেছি। ঘটনাটা কী?’

অফিসার বললেন, ‘একজন বাইক আরোহী মোটর সাইকেল নিয়ে খাদে পড়ে গেছে। লোকটা গাছের গায়ে ঝুলছে। বুঝতে পারছি না বেঁচে আছে কিনা? তোলার পর দেখা যাক।’

রেবতীবাবু বললেন, ‘কই, কোথায়?’

অফিসার বললেন, ‘চলুন দেখাচ্ছি। তবে একটু সাবধানে পা ফেলবেন। দেখছেন তো রাস্তাটা কেমন পিছল এজন্যই অ্যাক্সিডেন্ট হয় এখানে। বিশেষত যারা ওয়াকিবহাল নয় এ জায়গার ব্যাপারে। অ্যাক্সিডেন্টটা স্থানীয় একজন লোক দেখেছে। বাইক আরোহী রাস্তা দিয়ে নীচ থেকে ওপরে উঠে আসছিল। বাঁক পেরিয়ে ওপরে উঠে এসেই সে পিছল রাস্তায় উঠে বাইক সমেত ছিটকে পড়ে খাদে।’

একে তো রাস্তাটা জলে ভেজা, তার ওপর আবার রাস্তার ঢালটা খাদের দিকে। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে রেবতীবাবু সাবধানে পা ফেলে এগোলেন খাদের দিকে। ইতিমধ্যে কয়েকজন পুলিশকর্মী জিপের পিছনে দড়ি বাঁধতে শুরু করেছে সেই দড়ি বেয়ে খাদে নামার জন্য। তাদের চেহারা দেখে রেবতীবাবু বুঝতে পারলেন তারাও পাহাড়ি মানুষ। সম্ভবত এ ধরনের কাজে লোকগুলোর পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।

অফিসারের সঙ্গে রেবতীবাবু এসে দাঁড়ালেন খাদের ধারে। খাদটা এত গভীর যে নীচে সবকিছু ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। রেবতীবাবু ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করলেন যে লোকটা কোথায়?

অফিসার রেবতীবাবুকে সতর্ক করে বললেন, ‘বেশি ঝুঁকবেন না। একদম খাদের নীচে নয়, ওই যে খাদের গা থেকে যে গাছটা বেরিয়ে শূন্যে ঝুলছে সেটা দেখুন।’ এই বলে তিনি আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন সে জায়গা।

রেবতীবাবু এবার দেখতে পেলেন জায়গাটা। প্রায় সত্তর ফুট নীচে খাদের দেওয়াল থেকে ঠিক হাতের মতো মোটা ডালসমেত কোনো একটা বুনো গাছ অদ্ভুতভাবে শূন্যে বেরিয়ে আছে। আর তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা লোক। হেলমেটটা এখনও তার মাথায় আছে। তবে লোকটা নড়ছে না।

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘লোকটা বেঁচে আছে কিনা জানি না। তবে একদম নীচে পড়লে বেঁচে থাকলেও এখন লোকটাকে তোলা সম্ভব হত না। খাদটার গভীরতা পাঁচশো ফুট। ওই দেখুন অনেক নীচে ওর মোটরবাইকটা পড়ে আছে। ওই যে যেটাকে একটা লাল বিন্দুর মতো লাগছে। লাল রঙের মোটরবাইক। তবে ওটাকে এখন ওপরে আনা সম্ভব নয়। অন্য পথ দিয়ে নীচে নেমে পরে তুলে আনতে হবে।’

রেবতীবাবু ভালো করে তাকিয়ে এবার খাদের নীচে পড়ে থাকা বাইকটাকেও দেখতে পেলেন।

।।২।।

খাদে নামার কাজ শুরু হয়ে গেল। একপাশে দাঁড়িয়ে রেবতীবাবু দেখতে লাগলেন সেই রেসকিউ অপারেশন। জিপটাকে প্রথমে পিছিয়ে এনে দাঁড় করানো হল খাদের কিনারে। তার পিছনের চাকা দুটোর গায়ে বেশ বড় দুটো পাথরখণ্ড রাখা হল যাতে চাকা হড়কে না যায় সেজন্য। কাছির মতো লম্বা দড়ি বাঁধা হয়েছে জিপের পিছনের অংশে। যার অপর প্রান্ত বাঁধা আছে এক গোর্খা পুলিশকর্মীর কোমরে। তাছাড়া লোকটার কাঁধে অন্য একটা দড়িও আছে আহত বা নিহত বাইক আরোহীকে বেঁধে ওপরে তুলে আনার জন্য।

খাদ বেয়ে ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করল সেই পুলিশকর্মী। ওপর থেকে তাকে নানা নির্দেশ দিতে লাগল অন্য পুলিশকর্মীরা। ব্যাপারটা দেখতে লাগলেন ডাক্তারবাবু।

একসময় ধীরে ধীরে নীচে নেমে সেই পুলিশকর্মী পৌঁছে গেল ঝুলন্ত গাছটার গায়ে লোকটার কাছে। তারপর দড়ি দিয়ে নিজের দেহটার সঙ্গে লোকটাকে বাঁধতে শুরু করল। ওপর থেকে পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন, ‘লোকটা বেঁচে আছে?’ নীচ থেকে জবাব এল, ‘বুঝতে পারছি না।’

কালো হয়ে আসছে আকাশ। বৃষ্টি বাড়তে শুরু করেছে। পুলিশকর্মী লোকটার দেহটাকে নিজের দেহের সঙ্গে বেঁধে ফেলার পর নীচ থেকে বলল, ‘জিপ চালু করো।’

ধীরে ধীরে খাদের ধার থেকে সরতে শুরু করল জিপ। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ধীরে ধীরে দড়ির টানে ওপরে উঠে আসতে লাগল রজ্জুবদ্ধ দেহ দুটো। একসময় লোকটাকে ওপরে তুলে আনল সেই পুলিশকর্মী। বাইক আরোহীকে ওপরে তুলে এনে মাটিতে শুইয়ে প্রথমে তার হেলমেটটা খুলে ফেলা হল। রেবতীবাবু ঝুঁকে পড়লেন তার ওপর। লোকটার বয়স মনে হয় বছর পঁয়তাল্লিশ হবে। সুঠাম চেহারা। পরনে লাল জ্যাকেট, নীল জিপ, পায়ে শু্য। হাতে বাইক চালানোর জন্য আঙুল কাটা গ্লাভসও আছে। তবে লোকটার মুখমণ্ডল দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সে স্থানীয় মানুষ অর্থাৎ ভুটিয়া-গোর্খা বা লেপচা নয়। রেবতীবাবু লোকটার কবজিতে হাত রেখে সেটা তুলে ধরলেন। বরফের মতো ঠান্ডা হাত। কোনো স্পন্দন নেই তাতে। রেবতীবাবু একবার তার আঙুলটা লোকটার নাকের কাছেও ছোঁয়ালেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মারা গেছে লোকটা। বাইরে থেকে তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন না দেখা গেলেও পোস্টমর্টেম করলেই বোঝা যাবে কেন মারা গেল লোকটা। হার্টফেল হতে পারে। ঘাড়টা দেখুন কেমন যেন বাঁকা মনে হচ্ছে। যেখানে পড়ার সময় কোনো মারাত্মক আঘাতও লেগে থাকতে পারে।’ রেবতীবাবুর কথা শুনে পুলিশ অফিসার মাথা থেকে টুপি খুলে বললেন, ‘আপাতত বডিটা আপনার হাসপাতালে নিয়ে রাখুন। কাল সকালে বডিটা সদর হাসপাতালে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠাব। দেখি লোকটার পকেটে কোনো পরিচয়পত্র পাওয়া যায় কিনা? পেলে বাড়িতে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।’

অফিসারের নির্দেশ পেয়ে এরপর একজন পুলিশকর্মী বাইক আরোহীর পকেট হাতড়ানো শুরু করতেই লোকটার হিপ পকেট থেকে একটা পার্স বেরিয়ে এল। অফিসার সেটা খুলতেই তার মধ্যে কিছু টাকা, এ. টি. এম. কার্ড আর একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেল। লাইসেন্স কার্ডটা হাতে নিয়ে সেটা আধো অন্ধকারে চোখের সামনে তুলে ধরে দেখে অফিসার বললেন, ‘যাক, নাম, ঠিকানা পাওয়া গেল। কলকাতায় বাড়ি দেখছি!’

রেবতীবাবু বললেন, ‘তাই নাকি! আমিও তো কলকাতার লোক।’

অফিসার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা রেবতীবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ছবি আঁটা লাইসেন্স কার্ডে লোকটার নাম লেখা আছে—দীনেশ মল্লিক। পিতা অখিল মল্লিক। ঠিকানা—৭২ কলুটোলা লেন, কলকাতা। ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে মৃত ব্যক্তিরই ড্রাইভিং লাইসেন্স এটা। লাইসেন্স কার্ডটা অফিসারের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে রেবতীভূষণ বললেন, ‘কলকাতা থেকে এত দূরে বাইক নিয়ে এসেছিল লোকটা!’

অফিসার বললেন, ‘লং ড্রাইভে আসতে পারে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় লোকটা এত দূরে এসে থাকতে পারে। আবার স্থানীয় কোথাও চাকরি সূত্রে এসে থাকতে পারে। এই যেমন আপনি এসেছেন।’

অফিসার আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই একজন পুলিশকর্মী বলে উঠল, ‘আরে, লোকটা বেঁচে আছে। পা নাড়াচ্ছে!’

কথাটা শুনে চমকে উঠে দেহটার দিকে তাকালেন অফিসার আর রেবতীভূষণ। চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে। তারই মধ্যে রেবতীভূষণ দেখলেন লোকটার একটা পা যেন মৃদু মৃদু নড়ছে! বেঁচে আছে লোকটা!

রেবতীবাবু তাড়াতাড়ি বসে পড়ে লোকটার নাকের কাছে আঙুল রাখলেন। হ্যাঁ, মৃদু হলেও শ্বাস নিচ্ছে লোকটা! সে সত্যিই এখনও বেঁচে আছে। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এখনও তো দেখছি বেঁচে আছে লোকটা!’

পুলিশ অফিসার বিস্মিতভাবে রেবতীভূষণকে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু আপনি যে তবে একটু আগে বললেন…।’

রেবতীভূষণ বললেন, ‘হ্যাঁ, বলেছি। দশ লাখে একজন মানুষের ক্ষেত্রে এ ঘটনা অনেক সময় ঘটে। হৃৎপিণ্ড কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হলেও আবার তা চালু হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও হয়তো তেমন ঘটেছিল। এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হয়তো বেঁচে যেতে পারে লোকটা।’

এরপর আর কথা বাড়াল না কেউ। অ্যাম্বুলেন্স থেকে স্ট্রেচার নামিয়ে লোকটাকে তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ফেলা হল।

অক্সিজেনের মাস্কও লাগিয়ে দেওয়া হল লোকটার মুখে। রেবতীবাবুদের অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিয়ে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘আপনি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি থানায় ফিরে লোকটার বাড়ির ঠিকানাতে খবর পাঠাবার চেষ্টা করছি। কোনো অঘটন হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন। হাসপাতালে পৌঁছে যাব। নইলে কাল ভোরে যাব লোকটা কেমন আছে জানতে।’

সূর্য ডুবতে ঘণ্টাখানেক বাকি থাকলেও হঠাৎই যেন পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাড়ছে বৃষ্টিও। হেডলাইট জ্বালিয়ে জিপ এগোল হাসপাতালের দিকে। চলন্ত অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে লোকটার বুকে হাত ছুঁইয়েই রেবতীবাবু বুঝতে পারলেন যে লোকটার বুকটা ওঠা-নামা করছে। হয়তো বা এ যাত্রায় বেঁচে যেতে পারে লোকটা।

হাসপাতালে ইতিমধ্যে খবর পেয়ে অন্য দুজন ডাক্তারবাবুও উপস্থিত হয়ে গেছিলেন। ছোট একটা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটও আছে হাসপাতালে। লোকটাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে সোজা ঢুকিয়ে দেওয়া হল সেখানে। তিনজন ডাক্তার মিলে লোকটার চিকিৎসা শুরু করলেন। স্যালাইন-অক্সিজেন আর বেশ কয়েকটা ইনজেকশন দেওয়া হল। হৃৎস্পন্দন দেখার জন্য যে মনিটর স্ক্রিন আছে তার সঙ্গে লোকটার শরীরের সংযোগ স্থাপন করতেই সেখানে দেখা গেল যে কিছুটা উত্তেজিত অবস্থায় থাকলেও লোকটার হৃৎস্পন্দন মোটামুটি স্বাভাবিক।

ভালো করে লোকটার পর্যবেক্ষণ করার পর একজন ডাক্তারবাবু মন্তব্য করলেন, ‘খুব বেশি কিছু হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতায় লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তবে ঘাড়ের কাছটায় চোট লেগে থাকলেও থাকতে পারে। কেমন যেন বাঁকা মনে হচ্ছে।’

ডাক্তার রেবতীভূষণ বললেন, ‘হ্যাঁ। সেটা এক্সরে করলে ধরা পড়বে কাল সকালে। আপাতত ওকে বেশি নাড়ানাড়ি করার দরকার নেই। অক্সিজেন, স্যালাইন যেমন চলছে চলুক। দেখা যাক স্বাভাবিকভাবে ওর জ্ঞান ফেরে কিনা?’

অন্য দুজন ডাক্তারবাবুও সহমত প্রকাশ করলেন তাঁর সঙ্গে। একজন ডাক্তারবাবু আর দুজন স্বাস্থ্যকর্মীকে ডিউটিতে রেখে ডাক্তার রেবতীভূষণ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তাঁর কোয়ার্টারের দিকে।

।। ৩।।

পরদিন ভোরবেলায় সূর্যদেব মুখ দেখালেন না। সারা রাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে, সকালেও তার বিরাম নেই। পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টি নামলেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। পথঘাট জনশূন্য হয়ে যায়। ঠান্ডার দেশে আরও ঠান্ডা নামে। কাঠের বাড়িগুলোর মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে লোকজন। কিন্তু রেবতীভূষণকে হাসপাতালে যেতেই হবে। জরুরি পরিষেবার কাজ বলে কথা, তাই তিনি টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন হাসপাতালের দিকে।

তিনি যখন হাসপাতালে এসে গাড়ি থেকে নামলেন, ঠিক তখনই পুলিশের গাড়িটাও এসে থামল সেখানে। বর্ষাতি পরা গতকালের সেই পুলিশ অফিসার ডাক্তার রেবতীভূষণের সঙ্গে সুপ্রভাত বিনিময়ের পর বললেন, ‘লোকটার খবর কী?’

রেবতীভূষণ বললেন, ‘গতকাল রাতে যখন পেশেন্টকে দেখেছি তখন তার জ্ঞান না ফিরলেও হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকই ছিল। তেমন খারাপ কোনো কিছু ঘটলে নিশ্চয়ই রাতে আমাকে হাসপাতাল থেকে জানানো হত, আর আমিও ততক্ষণাৎ আপনাকে জানিয়ে দিতাম ব্যাপারটা। আশা করি তেমন কিছু ঘটেনি। শকের ফলেই লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেছে মনে হয়। তবে লোকটা ঘাড়ে কোনো চোট পেয়ে থাকতে পারে। ঘাড়টা কেমন যেন বাঁকা মনে হচ্ছে। সেটা অবশ্য আজ এক্স-রে করলে বোঝা যাবে। ভিতরে চলুন, দেখি লোকটা কেমন আছে?’

পুলিশ অফিসারকে নিয়ে হাসপাতালের ভিতর প্রবেশ করে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের দিকে এগোতে এগোতে সুপার সাহেব, পুলিশ অফিসারকে প্রশ্ন করলেন, ‘লোকটার বাড়ির লোকজনের খোঁজ পেলেন?’

অফিসার বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটাই আপনাকে বলতে যাচ্ছিলাম। যোগাযোগ করা গেছে স্থানীয় থানার মাধ্যমে। এই দীনেশ মল্লিক নামের লোকটা ও তার পরিবার পয়সাওলা লোক। চালতাবাগান লোহা-পট্টিতে বিশাল কারবার। কলকাতায় বেশ কয়েকটা বাড়ি-গাড়ি আছে। স্ত্রী-সন্তান, পরিবারের অন্য লোকজনও আছে। বাইকে লং-ড্রাইভ-এ লোকটার শখ। কলকাতা থেকে বাইক নিয়ে মাঝে মাঝেই পাহাড়ি অঞ্চলে চলে আসেন। এবারও আসছিলেন দার্জিলিং-এ। পথে এই দুর্ঘটনা। আজ দুপুরেই ওঁর বাড়ির লোক ট্রেনে রওনা হচ্ছেন। আশা করি কাল দুপুরের মধ্যেই তাঁরা নিউ জলপাইগুড়ি হয়ে এখানে পৌঁছে যাবেন। ফ্লাইটেই আসতেন, কিন্তু বাগডোগরাতেও বৃষ্টির কারণে আজকের সব ফ্লাইট বাতিল। অগত্যা ট্রেনেই আসতে হচ্ছে তাঁদের।’

সুপার রেবতীভূষণ আর পুলিশ অফিসার এরপর উপস্থিত হলেন পেশেন্ট যে ঘরে আছে তার দরজার সামনে। সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন গত রাতে দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ও দুজন স্বাস্থ্যকর্মী। রেবতীভূষণকে দেখে সেই ডাক্তারবাবু বললেন, ‘গুড মর্নিং সুপার সাহেব। ভালো খবর আছে। লোকটা চোখ মেলেছে একটু আগে। এ যাত্রা মনে হয় সে বেঁচে গেল। মাথা আর ঘাড়ও নাড়াচ্ছে। ঘাড়ের চোটের যে আশঙ্কা আমরা করছিলাম সেটাও মনে হয় সত্যি নয়। অ্যাক্সিডেন্টের শকের কারণেই মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছিল লোকটা।’

রেবতীভূষণ বললেন, ‘বাঃ, বেশ ভালো খবর। চলুন, দেখি ভদ্রলোককে।’

সদলবলে ঘরটাতে প্রবেশ করলেন রেবতীভূষণ। হ্যাঁ, সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। তাঁরা ঘরে প্রবেশ করতেই তাঁদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাঁদের দিকে তাকাল লোকটা। তার দৃষ্টি সবার মুখের ওপর পড়তে লাগল। কিন্তু পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়েই যেন মৃদু আতঙ্ক ফুটে উঠল তার মুখে। অস্পষ্টভাবে সে হিন্দিতে বলে উঠল, ‘পুলিশ কিঁউ? ম্যায়নে চোরি নেহি কিয়া।’

অর্থাৎ ‘পুলিশ কেন? আমি চুরি করিনি।’

এই বলে উঠে বসল লোকটা।

রেবতীভূষণ তাকে বললেন, ‘শুয়ে পড়ুন, শুয়ে পড়ুন,’ কিন্তু অফিসারের দিকে মৃদু আতঙ্কিত ভাবে চেয়ে রইল সে। তিনি তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ‘আপনার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। গতকাল আপনি বাইক নিয়ে পিছলে খাদে পড়ে গেছিলেন। উনি, অর্থাৎ পুলিশই আপনাকে উদ্ধার করে। আপনি কেমন আছেন তা জানতে এসেছেন উনি।’

অফিসার এবার লোকটার উদ্দেশে বললেন, ‘আপনি দীনেশ মল্লিক তো?’

লোকটা প্রশ্ন শুনে বিড়বিড় করে বলল, ‘দীনেশ মল্লিক! কলকাত্তা! মালুম নেহি…।’

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘আপনি কি নিজের পরিচয় মনে করতে পারছেন না? আপনার নাম দীনেশ মল্লিক, বাবার নাম অখিল মল্লিক। কলকাতার কলুটোলা লেনে থাকেন আপনি।’

লোকটা আবারও হিন্দিতে বলল, ‘কেয়া কাম করত হুঁ? কুছ ইয়াদ নেহি আ রহা…’

অর্থাৎ, ‘আমি কি করি? কিছু মনে পড়ছে না।’

অ্যাক্সিডেন্টের ধকল সামলাতে মাঝে মাঝে এমন স্মৃতিবিভ্রম হয়। প্রাথমিক অবস্থায় কিছু মনে পড়ে না। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। লোকটার কথা শুনে সুপার রেবতীভূষণ বললেন, ‘কলকাতার লোহাপট্টিতে আপনার বিশাল কারবার। অনেক বাড়ি-গাড়ি আছে সেখানে। বাইকে লং-ড্রাইভ আপনার শখ। মনে পড়ছে এবার?’

লোকটা যেন এবার রেবতীভূষণের কথা শুনে চুপ করে ভাবার চেষ্টা করতে লাগল।

অফিসার লোকটার উদ্দেশে এরপর বললেন, ‘কিছু মনে পড়ছে? চেষ্টা করুন। বাইকে লং-রাইড আপনার নেশা। কলকাতা থেকে এসব পাহাড়ি অঞ্চলে বাইক নিয়ে আসেন আপনি।’

সেই বাইক আরোহী এবার ভাঙা ভাঙা বাংলাতে বলল, ‘কলকাতায় আমার বড় কারবার, অনেক ক’টা বাড়ি তাই না?

অফিসার বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে?’

এবার লোকটার ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, ‘এবার যেন মনে পড়ছে।’

রেবতীভূষণ বললেন, ‘আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই। পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। আজ তাঁরা রওনা হচ্ছেন। কাল দুপুরের মধ্যেই আশা করি তাঁরা এখানে পৌঁছে যাবেন।’

কথাটা শুনে স্পষ্টতই হাসি ফুটে উঠল লোকটার মুখে। সে বলল, ‘তারা কি আমাকে নিয়ে যাবে?’ রেবতীভূষণ বললেন, ‘আপনি যদি সুস্থ হয়ে থাকেন তবে তাঁদের হাতে আমরা আপনাকে তুলে দেব। আচ্ছা, আপনার ঘাড়ে কি কোনো চোট লেগেছে? ব্যথা আছে কোনো? অথবা দেহের অন্য কোথাও?’

প্রশ্ন শুনে দীনেশ মল্লিক নামের লোকটা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ডাক্তার রেবতীভূষণের দিকে। তারপর ঘাড়টা স্বাভাবিক ভাবেই দু’পাশে ফিরিয়ে বলল, ‘না, তো, কোনো ব্যথা লাগছে না।’

রেবতীভূষণ বললেন, ‘বাঃ, তবে তো সব ঠিক আছে বলেই মনে হচ্ছে।’

দীনেশ মল্লিক বলল, ‘আপনাদের যে কীভাবে ধন্যবাদ দেব জানি না। কলকাতা থেকে আমার বাড়ির লোক ঠিক নিতে আসবে তো?’

অফিসার বললেন, ‘আমাদের ধন্যবাদ দেবার মতো ব্যাপার নেই। আমরা আমাদের ডিউটি পালন করেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তাঁরা এসে আপনাকে নিয়ে যাবেন।’

রেবতীভূষণ বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি আবার শুয়ে পড়ুন। বিশ্রাম নিন।’

শুয়ে পড়ল লোকটা। সে ঘর থেকে রেবতীভূষণরা বাইরে বেরিয়ে আসার পর পুলিশ অফিসার বললেন, ‘যাক বেঁচে গেল লোকটা। ধন্যবাদ ডাক্তার। আমি এখন যাই। ওর বাড়ির লোকজনকে সঙ্গে করে কাল আসব।’

কথাগুলো বলে এগোতে যাচ্ছিলেন অফিসার, কিন্তু ঠিক সে সময় গতরাতে হাসপাতালে দায়িত্বে থাকা একজন স্বাস্থ্যকর্মী অফিসারের উদ্দেশে বলল, ‘স্যার, আপনাকে একটা কথা জানাবার আছে।’

‘কী কথা?’ ফিরে দাঁড়ালেন অফিসার।

স্বাস্থ্যকর্মী বলল, ‘গতরাতে এখানে চমনলাল এসেছিল। তবে ভিতরে ঢুকতে পারেনি। আমি বাইরে বেরোতেই আমাকে দেখতে পেয়ে মিলিয়ে গেল।’

তার কথা শুনে অফিসার বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘কখন? আপনি ঠিক দেখেছেন? লোকটা চমনলালই তো?’

স্বাস্থ্যকর্মী বললেন, ‘হ্যাঁ, চমনলালই। ওকে এখানে কে না চেনে? কনুই থেকে কাটা ওর বাম হাতটাই তো তাকে চিনিয়ে দেয়। তখন মাঝরাত হবে। এই পেশেন্টের ঘরে ডিউটি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল একটা মাথা যেন ঘষা কাচের শার্সির ওপাশ থেকে ঘরের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করছে। ও কাচ তো আর খোলা যায় না। তাই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম আমি। আমাকে দেখেই সে উধাও হয়ে গেল।’

রেবতীভূষণ, অফিসারকে প্রশ্ন করলেন, ‘চমনলাল কে?’

অফিসার বললেন, ‘চমনলাল একটা দাগী চোর। একটা চুরির ঘটনার পর গত সাতদিন ধরে বেপাত্তা। আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি লোকটাকে। কাল বৃষ্টির রাত ছিল। সেই সুযোগে নিশ্চয়ই চুরি করতে বেরিয়েছিল চমনলাল। তবে কতদিন আর পালিয়ে থাকবে? ঠিক ধরে ফেলব। লোকটা তবে এ তল্লাটেই আছে। কোথাও ওকে দেখতে পেলেই সঙ্গে সঙ্গে বলবেন।’—শেষ কথাটা স্বাস্থ্যকর্মীর উদ্দেশে বলে ডাক্তার রেবতীভূষণের থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

রেবতীভূষণ তাঁর চেম্বারে গিয়ে ঢুকলেন। সুপার হিসাবে প্রশাসনিক কাজের দায়িত্বও সামলাতে হয় তাঁকে। কিছু ফাইল বানাতে হবে তাঁকে। সে কাজ নিয়ে বসে পড়লেন তিনি। এদিনও কোনো পেশেন্টের দেখা মিলল না। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ কেটে যেতে লাগল। বৃষ্টিও কমে আসতে লাগল। ফাইল নিয়ে কাজে ডুবে রইলেন রেবতীভূষণ। সময় এগিয়ে চলল। সকাল গড়িয়ে দুপুরও হয়ে গেল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে আরও পরিষ্কার হতে লাগল আকাশ।

একটানা কাজ করে বেলা তিনটে নাগাদ প্রথমে থামলেন রেবতীভূষণ। সঙ্গে করে খাবার নিয়ে আসেন তিনি। দুপুরের খাবার শেষ করার পর রেবতীভূষণের মনে হল দীনেশ মল্লিক নামের লোকটাকে একবার দেখে আসি। রেবতীভূষণ হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে প্রবেশ করলেন তার ঘরে। লোকটা বেডে শুয়ে আছে। ঘাড়টা যেন মাথার সঙ্গে কোনাকুনি অদ্ভুত ভাবে বাঁকা!

রেবতীভূষণকে দেখতে পেয়েই লোকটা উঠে বসল। ঘাড়টাও স্বাভাবিক হয়ে গেল।

রেবতীভূষণ তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কেমন আছেন?’

লোকটা জবাব দিল, ‘আচ্ছা হ্যায়। উও লোগ লেনে আয়েগা তো কাল?’

অর্থাৎ, ‘ভালো আছি। ওরা আমাকে নিতে আসবে তো কাল?’

রেবতীভূষণ প্রথমে বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনার বাড়ির লোক নিশ্চয়ই এতক্ষণে ট্রেনে চড়ে বসেছেন।’ এ কথা বলার পর রেবতীভূষণ প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা আপনি তো বাঙালি, কিন্তু মাঝে মাঝে হিন্দি বলেন কেন?’ প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল লোকটা। তারপর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আসলে কলকাতার বাইরে বেরোলেই আমার মুখে হিন্দি ফুটে ওঠে। সবাইকেই হিন্দিভাষী মনে হয়। তাছাড়া ব্যবসার কারণে বহু হিন্দীভাষী মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। প্রায় সারাদিনই হিন্দি বলতে হয়। তাই হিন্দি কথা মুখে চলে আসে।’

রেবতীভূষণ হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, এবার বুঝলাম। এমন হয়। আপনি বিশ্রাম নিন। রাতটা দেখতে দেখতে কেটে যাবে। কালই আপনার বাড়ির লোকরা আপনাকে নিতে আসবে।’

দীনেশ মল্লিক বলল, ‘হ্যাঁ, তাদের জন্যই তো অপেক্ষা করছি।’

সে ঘর ছেড়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে এলেন রেবতীভূষণ। খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তিনি দেখলেন বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘও সরে গেছে। দিন শেষে মেঘ-কুয়াশার আবরণ সরিয়ে মাথা তুলছে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারধবল শিখরগুলো। সে দিকে তাকিয়ে মনটা বেশ চনমনে হয়ে উঠল রেবতীভূষণের। দু-দিন ধরে বৃষ্টির জন্য ঘরের বাইরে বেরোতে পারেনি পাহাড়ের মানুষরা। হয়তো কাল পেশেন্টরা হাসপাতালে আসতে পারে। তখন আর অফিসিয়াল কাজে হয়তো বসতে পারবেন না রেবতীভূষণ। ঘরে তাঁর কোনো কাজ নেই। কাগজপত্রের কাজগুলো শেষ করে বাড়ি ফিরতে কোনো অসুবিধা নেই। এ কথাগুলো ভেবে নিয়ে আবার কাজে বসে গেলেন তিনি।

।।৪।।

রেবতীভূষণের কাজ যখন শেষ হল তখন রাত প্রায় আটটা। এবার বাড়ি ফিরবেন তিনি। ফাইলের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে জানলার বাইরে তাকালেন রেবতীভূষণ। দূরে আকাশের বুকে চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। মেঘমুক্ত আকাশে সোনার থালার মতো বিরাট চাঁদ উঠেছে। তার আলো যেন চুঁইয়ে পড়ছে পর্বতশৃঙ্গের গা থেকে। রেবতীভূষণ টেবিল ছেড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন জানলার সামনে। বেশ কিছুক্ষণ তিনি তাকিয়ে রইলেন চন্দ্রালোকিত কাঞ্চনজঙ্ঘার অপার্থিব সৌন্দর্যের দিকে। তারপর তিনি যখন জানলা থেকে সরে আসতে যাচ্ছেন ঠিক তখনই এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল তাঁর। ঘরের এ জানলাটা দিয়ে হাসপাতালে পিছনের অংশটা দেখা যায়। একটা সুঁড়িপথ সেদিক দিয়ে এগিয়ে একটা পাহাড়ি ঢালের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। রেবতীভূষণ ওদিকে যাননি কখনও। তিনি দেখতে পেলেন একটা লোক হাসপাতালের দিক থেকে সে পথে যাচ্ছে। ভালো করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রেবতীভূষণের মনে হল যে লোকটার পরনে যেন হাসপাতালের রোগীদেরই পোশাক। ঢোলা হাফ হাতা জামা আর পা-জামা! কিন্তু এ হাসপাতালে তো একজন মাত্র রোগী ভর্তি আছে। সেই দীনেশ মল্লিক। সেই নাকি? কী হল ব্যাপারটা?

ডাক্তার রেবতীভূষণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চেম্বার থেকে বেরিয়ে উপস্থিত হলেন পেশেন্টের ঘরে। তিনি দেখতে পেলেন দীনেশ মল্লিকের বিছানাটা ফাঁকা। আর ঘরের অন্যপাশের দরজাটা খোলা। ও দরজা দিয়ে হাসপাতালের পিছনের রাস্তায় যাওয়া যায়। খোলা দরজাটা দেখামাত্রই ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হল না রেবতীভূষণের। কিন্তু লোকটা এত রাতে এভাবে বাইরে বেরিয়ে গেল কেন?

রেবতীভূষণও আর দেরি না করে সে দরজা দিয়ে বাইরে, হাসপাতালের পিছনের অংশে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি দেখতে পেলেন লোকটা ঢালের আড়ালে পথের বাঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে।

এ ভাবে কোনো লোক হাসপাতাল ছাড়তে পারে না। হাসপাতালের রেজিস্টারে লোকটার নাম নথিভুক্ত করা আছে। বাইরে বেরিয়ে লোকটার যদি কোনো বিপদ ঘটে তবে কি কৈফিয়ৎ দেবেন তিনি? গন্ডগোলের মুখে পড়ে যাবেন রেবতীভূষণ। মিডিয়া, পেশেন্ট পার্টি, আইন সবাই তাঁকে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে নাজেহাল করে ছেড়ে দেবে। লোকটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই রেবতীভূষণ এগোলেন সেদিকে।

তিনি যখন সেই পাহাড়ের ঢালের বাঁকের কাছে পৌঁছলেন তখন লোকটা মিলিয়ে যাচ্ছে অন্য একটা বাঁকের আড়ালে। আবার এগোতে লাগলেন তিনি। লোকটাকে কখনও দেখা যাচ্ছে আবার পরক্ষণেই সে হারিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে নির্জন পাহাড়ি পথ বেয়ে রেবতীভূষণ অনুসরণ করতে লাগলেন তাকে। ক্রমশই অচেনা পথে হাসপাতাল থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন তিনি। লোকটাকে ধরার জন্য কেমন যেন একটা জেদ চেপে গেল রেবতীভূষণের মনে। এগিয়ে চললেন রেবতীভূষণ। মিনিট আট-দশ চলার পর একটা বাঁক নিতেই থমকে দাঁড়ালেন রেবতীভূষণ।

আরে, তিনি তো গতকালের সেই দুর্ঘটনার জায়গাটাতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ওই তো সেই ঝর্নাটা সামনের পথটা ভিজিয়ে নেমে যাচ্ছে খাদের দিকে। দীনেশ মল্লিককেও এরপর দেখতে পেলেন তিনি। ঠিক যে জায়গা দিয়ে গতকাল তাকে ওপরে ওঠানো হয়েছিল, ঠিক সে জায়গাতেই রাস্তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। চাঁদের আলোতে খাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে লোকটা? রেবতীভূষণ সাবধানে এগোলেন তার দিকে।

দীনেশ মল্লিক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে খাদের ভিতর। রেবতীভূষণ তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তাঁর পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল লোকটা। স্পষ্টতই তার মুখে একটা অপ্রস্তুতের ভাব ফুটে উঠল। রেবতীভূষণ তাকে বললেন, ‘ও ভাবে কী দেখছেন?’

লোকটা প্রথমে জবাব দিল, ‘আপনে কো ঢুন্ড রহা।’ অর্থাৎ ‘নিজেকে খুঁজছি।’

অদ্ভুত কথা। রেবতীভূষণ বললেন, ‘তার মানে।’

লোকটা নিজেকে যেন সামলে নিয়ে বলল, ‘না, কিছু না। আসলে এখান থেকেই তো আপনারা আমাকে ওপরে তুলেছিলেন। এখানেই আমার পুনর্জন্ম হল। তাই শেষ একবার জায়গাটা ঘুরে গেলাম। এখানে তো আর কোনোদিন আসব না।’

কথাটা শুনে রেবতীভূষণ একটু উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, ‘কাজটা মোটেও আপনি ঠিক করেননি। এ ভাবে হাসপাতাল থেকে বেরোনো যায় না। কোনো বিপদ ঘটলে আমি আপনার বাড়ির লোককে কাল কী কৈফিয়ৎ দিতাম? এই ঠান্ডায় আপনার গায়ে কোনো গরম জামা নেই। নিউমোনিয়াও হতে পারে। চলুন, এখনই হাসপাতালে ফিরে চলুন।’

লোকটা এবার হেসে বলল, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে। চলুন যাচ্ছি। আমি তো কাল তাদের আসার জন্যই অপেক্ষা করছি। সেখানে গেলে ভালো থাকতে পারব। কতদিন ভালো খাইনি, ভালো ঘুমোইনি।’

রেবতীভূষণ বললেন, ‘হ্যাঁ, তাঁরা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।’

লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে এরপর হাসপাতালে যাবার জন্য পা বাড়ালেন রেবতীভূষণ। কিন্তু পিছু ফিরে এক পা এগোতেই পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘না, আমি তোমাকে বাড়ির লোকের সঙ্গে যেতে দেব না।’

বাংলায় বলা কণ্ঠস্বরটা শুনে চমকে ফিরে দাঁড়ালেন রেবতীভূষণ আর দীনেশ মল্লিক।

খাদের কিনারাতে ভোজবাজির মতো যেন একটা লোক এসে উপস্থিত হয়েছে। তার পরনে স্থানীয় লোকদের মতো বিবর্ণ পোশাক। লোকটার বাম হাতটা কনুই থেকে কাটা। সেই চমনলাল? প্রচণ্ড আক্রোশে তার চোখ যেন জ্বলছে। লোকটা ক্রোধমিশ্রিত কণ্ঠস্বরে খাঁটি বাংলায় আবারও বলে উঠল, ‘না, এ হয় না, আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না ওদের সঙ্গে।’

এ কথা বলে লোকটা এগিয়ে এসে এক হাতেই চেপে ধরল দীনেশ মল্লিককে। দীনেশ মল্লিক বলে উঠল, ‘মুঝে ছোড় দো।’

কিন্তু লোকটা ছাড়ল না তাকে। এক হাতে জড়িয়ে আসুরিক শক্তিকে তাকে টেনে নিল খাদের ধারে, তারপর তাকে নিয়ে ঝাঁপ দিল খাদে। দীনেশ মল্লিকের আর্তনাদ হারিয়ে গেল অতল খাদের ভিতর।

পুরো ব্যাপারটা ঘটতে খুব বেশি হলে মুহূর্ত পাঁচেক সময় লাগল। হতভম্ব রেবতীভূষণ। ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল তাঁর। তারপর তিনি মোবাইল ফোন থেকে থানায় ফোন করলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই পুলিশ অফিসার হাজির হলেন। ব্যাপারটা শুনে তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘ঘটনাটা আমিও কিছুই বুঝতে পারছি না। ভোর হবার আগে দেহ দুটো উদ্ধার করা যাবে না।’

এরপর তিনি আতঙ্কিত রেবতীভূষণকে বললেন, ‘আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। ব্যাপারটা আমি ম্যানেজ করছি। পেশেন্ট পার্টিকে বলব যে দীনেশ মল্লিককে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর সে মৃত বোঝা যায়। দেহটা তো পোস্টমর্টেমের জন্য সদর হাসপাতালে পাঠাতে হবে। খাদের থেকে দেহ উদ্ধারের ব্যাপারটা চেপে যাব। বলব যে হাসপাতাল থেকেই বডিটা আমরা মর্গে চালান করেছি। সেই মতো হাসপাতালের কর্মীদের শিখিয়ে রাখবেন। চমনলালের দেহটাও পোস্টমর্টেমে পাঠাতে হবে। ওর ব্যাপারে অবশ্য কোনো চিন্তা নেই আপনার।’

এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ অফিসার হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে গেলেন রেবতীভূষণকে। সেখানে ফিরে তিনি জানতে পারলেন যে, দীনেশ মল্লিকের ঘরে যে স্বাস্থ্যকর্মী দায়িত্বে ছিল সে কিছু সময়ের জন্য ল্যাট্রিনে গেছিল। আর সেই ফাঁকেই দীনেশ মল্লিক…

।।৫।।

গতরাতে পুলিশের জিপ ডাক্তার রেবতীভূষণকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার পর আর হাসপাতাল ছাড়েননি তিনি। বাকি রাত আর আজ সারাটা দিন নিজের চেম্বারেই রয়েছেন তিনি। কোনো সময় নিজের চেয়ারে বসে থেকেছেন। আবার কোনো সময় উত্তেজিত ভাবে ঘরময় পায়চারি করেছেন। বাইরের লোক ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজ করতে এলে কী বলতে হবে তা তিনি ডাক্তারবাবু আর স্বাস্থ্যকর্মীদের শিখিয়ে দিয়েছেন। চাকরি যাবার ভয়ে সবাই একই কথা বলবেন। পুলিশ অফিসার যদিও তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন তবুও তাঁর আতঙ্ক কাটছে না। গতরাত পেরিয়ে সারাদিন কেটে বিকাল হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও মনের ছটফটানি কমছে না কিছুতেই। তবে সকালবেলা একজন স্বাস্থ্যকর্মী এসে তাঁকে জানিয়েছেন যে দুটো লাশই নাকি খাদের থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।

শেষ বিকালে হাসপাতালে রেবতীবাবুর ঘরে এসে ঢুকলেন সেই পুলিশ অফিসার। রেবতীবাবুর মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন তিনি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিশ্রান্ত তিনি। চোখেমুখে চাপা উত্তেজনার ভাব। রেবতীবাবু উৎকণ্ঠিত ভাবে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী খবর?’

ভদ্রলোক তাঁর টুপিটা খুলে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, ‘দুটো লাশই উদ্ধার করা গেছে। ভোরবেলা লাশ দুটো উদ্ধারের পর তা নিয়ে সদর হাসপাতালে গেলাম। তারপর পোস্টমর্টেম করিয়ে দীনেশ মল্লিকের লাশটা তার বাড়ির লোকদের দিয়ে, তাদের কলকাতাতে রওনা করিয়ে দিয়ে এই ফিরছি। শেষ পর্যন্ত ওর বাড়ির লোককে বিশ্বাস করাতে পেরেছি কথাটা। হাসপাতালে আনার পরই বোঝা যায় সে মৃত।’

রেবতীভূষণ এবার নিশ্চিন্ত হলেন তাঁর কথা শুনে। তিনি বললেন, ‘যাক, আপনি আমাকে বাঁচালেন। আপনাকে যে কীভাবে ধন্যবাদ দেব জানি না।’

অফিসার বললেন, ‘কুড়ি বছর চাকরি করছি পুলিশে। বহু কেস দেখেছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত কেস দেখিনি। মাথার ভিতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে!’

রেবতীভূষণ জানতে চাইলেন, ‘কী অদ্ভুত ব্যাপার?’

অফিসার বললেন, ‘চমনলালের লাশটা পচাগলা ছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও বলছে দিন সাতেক আগে মারা গেছে লোকটা! হয়তো কোনোভাবে খাদে পড়ে গেছিল সে।’

কথাটা শুনে বিস্মিত রেবতীভূষণ বলে উঠলেন, ‘তা কী করে সম্ভব? আমি তো দেখলাম যে হাতকাটা লোকটা দীনেশ মল্লিককে খাদে টেনে নিয়ে গেল! তবে কী আমি আপনাকে বানিয়ে গল্প বলেছি?’

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘সেটাই আমি ভাবতাম যদি না আরও আশ্চর্য একটা ব্যাপার থাকত।’

রেবতীভূষণ ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলেন, ‘আরও আশ্চর্যের ব্যাপার কী?’

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘দীনেশ মল্লিকের বাড়ির লোক কেন আমার কথা বিশ্বাস করল জানেন? আপনি নিশ্চয়ই ডাক্তার হিসাবে জানেন যে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মৃত্যুর সঠিক মুহূর্তটা লেখা থাকে না। মোটামুটি সময়টা লেখা থাকে। এক-আধঘণ্টা সময়ের হেরফের হতেই পারে। রিপোর্টে লেখা আছে আমরা যখন তাকে পরশু বিকালে খাদ থেকে তুলি সে সময়ের কিছু আগে পড়েই মৃত্যু ঘটেছিল লোকটার। আজ আমি যখন ভোরবেলা দীনেশ মল্লিকের দেহটাকে উদ্ধার করি তখন দেহটাকে এক-দু’দিনের বাসি মড়া বলেই মনে হয়েছিল আমারও। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল তার মৃত্যুর কারণ কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সুনিদিষ্টভাবে লেখা আছে। বাইক নিয়ে খাদে ছিটকে পড়ার সময় কোনো কিছুতে আঘাত লেগে ঘাড়ের হাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর সেজন্যই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে লোকটার!’

পুলিশ অফিসারের কথা শুনে হতভম্ভ হয়ে গেলেন ডাক্তার রেবতীভূষণ। হ্যাঁ, ঘাড়টা তো অদ্ভুতভাবে বাঁকা মনে হচ্ছিল দীনেশ মল্লিকের! তবে কি নতুন জীবনের আশায়, সুখের আশায় মৃত দীনেশ মল্লিকের দেহে প্রবেশ করেছিল চমনলালের আত্মা? সেজন্যই কি সে হিন্দিতে কথা বলছিল? নিজের পুরোনো দেহটাকে শেষ একবার দেখার চেষ্টাতে হাজির হয়েছিল খাদের ধারে? সে তো বলেছিল, ‘নিজেকে খুঁজছি!’ আর দীনেশ মল্লিকের আত্মা কি চমনলালের দেহ ধারণ করে চমনলালকে দীনেশ মল্লিকের পরিবারকে প্রতারিত করতে বাধা দিল? পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ ভাবে এসব প্রশ্নের আর এই অদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলেন সেই পুলিশ অফিসার আর ডাক্তার রেবতীভূষণ। বাইরে পাহাড়ি জনপদে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *