দুর্গাপূজা : মার্কণ্ডেয় চণ্ডী এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণ
মার্কণ্ডেয় পুরাণের গল্পে আছে—
সেকালের দিনে ভারতবর্ষে সুরথ বলে এক রাজা ছিলেন। যতখানি জায়গা জুড়ে তাঁর রাজ্য ছিল, তার এক প্রান্তে ছিল কাশ্মীর। এখনকার দিনে কাশ্মীর নিয়ে যে সব গণ্ডগোল চলছে, তার চরিত্র এবং প্রকৃতি যাই হোক, সেকালের দিনে কাশ্মীর ছিল বহিরাক্রমণের দ্বার। যে সময়ের কথা আমরা এখানে উল্লেখ করছি, সে অনেক কাল আগের কথা। কাশ্মীরে তখনও এমন কিছু ছোট ছোট সমস্ত রাজাদের বাস ছিল, যাঁরা ভারতবর্ষের আচার এবং রীতিনীতির বাইরে ছিলেন। সেকালের ভারতবর্ষীয় সমাজ এঁদের যবন অথবা ম্লেচ্ছ বলে ডাকত।
এই যবন এবং ম্লেচ্ছ রাজারাই সুরথ রাজার রাজ্য আক্রমণ করে তাঁর রাজ্যের খানিকটা কেড়ে নিল। সুখের বিষয়, তখনও সুরথ রাজার রাজধানীটা বাকি ছিল। রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি হাতছাড়া হয়ে গেলেও সুরথ রাজা নিজের নগরে ফিরে রাজ্য চালাতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু সেখানেও আরেক রকমের গণ্ডগোল বেধে গেল। রাজা দুর্বল হয়ে গেলে যা হয়। রাজদরবারের সুযোগ-সন্ধানী মন্ত্রী, অমাত্য, সেনাপতিরা চক্রান্ত করে রাজার অর্থভাণ্ডার আত্মসাৎ করল আর রাজার বশংবদ সৈন্যদের টাকাপয়সা খাইয়ে ভাগিয়ে নিল নিজেদের পক্ষে।
নিজের আধিপত্য এইভাবে চলে যাওয়ার ফলে সুরথরাজা মৃগয়া করতে যাবার নাম করে একা একা ঘোড়ায় চড়ে চলে গেলেন বনে—’একাকী হয়মারুহ্য জগাম গহনং বনম।’ বনের মধ্যে মেধস মুনির আশ্রম। মুনি বসে আছেন শিষ্যদের নিয়ে। প্রশান্ত পরিবেশ, হিংস্র পশুরাও এখানে হিংসা ভুলে আছে। রাজা প্রথমেই মুনির সঙ্গে দেখা করলেন না। বনের মধ্যেই এদিক ঘোরেন, ওদিক ঘোরেন আর ভাবেন—বাপ-ঠাকুরদার আমলের এত বড় রাজ্যটা! অসভ্য মন্ত্রী আর রাজকর্মচারীরা নিশ্চয় রাজ্যটা লুটেপুটে খাচ্ছে। আমি রাজ্যে নেই, প্রজাদের সুখ-দুঃখ নিশ্চয়ই কিছুই খেয়াল করছে না ওরা।
রাজার মনে পড়ল তাঁর হাতিশালের বিশাল হাতিটার কথা। সেই হাতিটাকে হয়তো ওরা খেতেই দিচ্ছে না। যে লোকগুলো রাজার ব্যক্তিগত সেবা করত, সেই লোকগুলো হয়তো এখন অন্য এক রাজার খিদমতগারি করছে। রাজকোষে এতকাল ধরে জমানো টাকাপয়সা—সব হয়তো ওই হাভাতে মন্ত্রীগুলো নিজেদের বিলাস-ব্যসনে উড়িয়ে দিচ্ছে—’সঞ্চিতঃ সো’ তিদুঃখেন ক্ষয়ং কোষো গমিষ্যতি। রাজা এই সব কথা চিন্তা করতে করতে অত্যন্ত মনমরা হয়ে গেলেন। মুনির আশ্রমের প্রান্তদেশে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে রাজার নজরে পড়ল আরও একটা লোক যেন তাঁরই মতো মনমরা হয়ে আশ্রমভাগের একান্তে বসে আছে। মাথায় হাত, মনে গভীর চিন্তা।
ব্যথার ব্যথী একই গোত্রের আরও একটা লোককে দেখে রাজার কৌতূহল হল। তিনি বললেন—’কে গা তুমি? এখানে এসেছ কি করতে? দেখে মনে হচ্ছে—মনটা তোমার একদম ভাল নেই? কী হয়েছে?’ রাজার মিষ্টি কথা শুনে লোকটা বলল, ‘আমি ব্যবসায়ী মানুষ, জাতিতে বৈশ্য। আমার নাম সমাধি। টাকাপয়সা আমার কম ছিল না, বড়লোকের ঘরেই আমার জন্ম। কিন্তু মুশকিলটা কী জানেন,—আমার বউ-ছেলেরা সব এমন যে, আমার সব টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করে তারা আমাকে ঝাঁটা মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমারই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ষড় করে আমার টাকাপয়সা মেরে দিলে, আর আমাকেও দিলে তাড়িয়ে। মনের দুঃখে আমি বনে চলে এসেছি।’
সমাধি বৈশ্যের ছোট পরিবারের মধ্যে যে লোভ আর প্রতারণার ছবি আমরা ছোট আকারে দেখলাম, ওই একই ছবি রাজকীয় কায়দায় ব্যক্ত হয়েছে সুরথ রাজার রাজ্যের অধিকারে। কিন্তু এই অত্যাচার প্রতারণার পরেও রাজার মুখ দিয়ে যে সত্যি কথাটা বেরুনো উচিত ছিল—সেটা কিন্তু তাঁর মুখ দিয়ে বেরোল না। হয়তো রাজোচিত মর্যাদা অথবা গাম্ভীর্যের কারণে সুরথ কিছু বললেন না, কিন্তু সংসারে এমনটি হলে কী মানসিকতা তৈরি হয় সেই অন্তরের দুঃখটা বেরিয়ে এল সমাধি বৈশ্যের মুখ দিয়ে। সে বলল—’আমার টাকাপয়সা হাতিয়ে আমাকেই তাড়িয়ে দিয়েছে এই তিক্ত ঘটনা জেনেও আমার কেবলই মনে হচ্ছে—আমার ছেলেগুলি ভাল আছে তো, আমার বউটা কষ্টে নেই তো? আমাকে বাদ দিয়ে কীভাবে তারা দিন কাটাচ্ছে, কারও অসুখ-বিসুখ করল কিনা, ছেলেগুলো সৎপথে চলছে কিনা—এইসব চিন্তায় আমি বড় ভাবনায় আছি।’
রাজা বললেন—বেশ রাজকীয় কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করেই বললেন—’সে কি কথা? যে ছেলে-বউরা আপনারই টাকাপয়সা আত্মসাৎ করে আপনাকেই ঝাঁটা মেরে ঘরছাড়া করল, তাদের জন্যই আবার আপনার এত ভাবনা হচ্ছে? ভারী আশ্চর্য!’ বৈশ্য বলল—’যা বলেছেন আপনি! এক্কেবারে হক কথাটা বলেছেন—এবমেতদ যথা প্রাহ। সত্যি আমি মনটাকে অত নিষ্ঠুর করে তুলতে পারছি না। যারা টাকার লোভে বাপের স্নেহ ভুলে গেল, স্বামীর ভালবাসা ভুলে গেল, আমাকে বার করে দিল—আশ্চর্য! তাদের আমি এখনও ভালবাসি। এটা হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু হয়েছে। আমি সব বুঝেও এটা বুঝতে পারছি না—কিমেতান্নাভিজানামি জানন্নপি মহামতে। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না—যে প্রিয়জনেরা আমার সঙ্গে এত শত্রুতা করল, তাদেরই জন্য কেন আমার এই দুশ্চিন্তা, কেন এই দীর্ঘশ্বাস?’
বস্তুত রাজার মনেও তো এই বিক্রিয়াই চলছিল। ‘কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।’ তিনি রাজা, তাই হয়তো সামান্য এক পরিবারের দুঃখ তাঁর কাছে বড় নয়। তিনি তাঁর মতো করে মন্ত্রী-অমাত্যের দুর্নীতির কথা, হাতিশালের হাতির কথা, রাজকোষের অপব্যয়ের কথা—এইসবই তো ভেবে যাচ্ছেন এতক্ষণ। এখন বৈশ্য যে কথাটা বলল, তাতে রাজা দেখলেন তাঁর মানসিকতা তো একই রকম। বৈশ্য তার পারিবারিক রাজ্যের কথা ভাবছে, রাজা তাঁর বিশাল প্রশাসনিক রাজ্যপাটের কথা ভাবছেন। ব্যাপারটা একই—এত শত্রুতা, এত কষ্ট যে কারণে বা যাদের জন্য—সেই পরিবার, সেই রাজ্যপাটের কথাই এঁরা ভেবে যাচ্ছেন। একই ব্যথার ব্যথী, একই কারণে ক্লিষ্ট দুই ভিন্ন গোষ্ঠীর লোক এবার উপস্থিত হলেন মেধস মুনির আশ্রমে। যথাবিহিত সম্ভাষণ করে দুজনেই মুনির কাছে বসলেন। এখানে কথা আরম্ভ করলেন রাজাই। তিনি বললেন—’একটা কথা জিজ্ঞাসা করি মুনিবর! আমার যে রাজ্যপাট, মন্ত্রী অমাত্য, সেনাপতি—ইত্যাদি যে প্রশাসনিক উপকরণ—এই বনে এসেও সেগুলিকে আমি ভুলতে পারছিনা। এই সব রাজোচিত বিষয়ের প্রতি আমার এই যে মমতা, সেই মমতার জন্যই যে আমার কষ্ট হচ্ছে—তা আমি বেশ জানি, কিন্তু জেনেও বোকার মতো কেন দুঃখ পাচ্ছি আমি—তার কারণটা বলতে পারেন?’
রাজা এবার বৈশ্যের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন—’আর এই যে সমাধি বৈশ্য, এর বউ-ছেলে এর টাকাপয়সা হাতিয়ে দুর-দুর করে একে তাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু তবুও দেখুন ও ওদেরই ভালবাসে, ওদের কথাই ও তখন থেকে ভেবে যাচ্ছে। আমার জিজ্ঞাসা, তাহলে ব্যাপারটা কি? যে বিষয়-সুখের কারণে দুজন আমরা কষ্ট পাচ্ছি বা পেয়েছি, অথচ সেগুলির প্রতিই আমাদের এত মমতা—এটা কী হল? অথচ দেখুন, আমরা বেশ জ্ঞানী লোক, দুঃখের কারণটা আমরা বেশ বুঝতে পারছি, তাহলে আমাদের এই অকারণ মোহটা হচ্ছে কেন, কেনই বা বারবার সেই কথা চর্চা করছি, যা আমাদের কষ্ট দিয়েছে। কেনই বা আমাদের মতো বিবেচক জ্ঞানী মানুষের এই মূঢ়তা?’
‘জ্ঞানী’, ‘বিবেচক’—কথাগুলি শুনে মেধস মুনি বুঝি হেসেই ফেললেন। বেড়ে বলেছেন রাজা—তিনি জানেন কী তাঁকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু কেন কষ্ট দিচ্ছে, তা তিনি জানেন না। মুনি বললেন—’আপনার যেরকম জ্ঞান, ওরকম জ্ঞান পশুপক্ষীরও আছে—যতো হি জ্ঞানিনঃ সর্বে পশুপক্ষিমৃগাদয়ঃ। নিষাদের বাঁশি শুনে মুগ্ধ হরিণ যখন অস্ত্রাঘাত লাভ করে, তখন হরিণও বোঝে যে গান শুনেই এমন হল, কিন্তু কেন এমন হল সেটা বোঝে না। হরিণ আবারও গান শোনে। আবারও মরে। খাবারের লোভে পাখি যখন জালে ধরা পড়ে, তখন পাখিরাও বোঝে যে, লোভের কারণেই এমন দুর্গতি হয়, কিন্তু কেন হল সেটা বোঝে না। আবারও খাবার দেখে লুব্ধ হয়। আবার জালে ধরা পড়ে। কাজেই আপনাদের যে রকম জ্ঞান, ওরকমটি পশুপক্ষীরও আছে। পুনশ্চ ওই গাছের পাখিদেরই খেয়াল করুন। খিদেয় কষ্ট পাচ্ছে এই অবস্থাতেও তারা ছোট্ট ছোট্ট ছানাগুলির মুখে খাদ্যকণা তুলে দিচ্ছে। ওদের কি খিদের কষ্ট নেই? আছে। ছোট্ট ছোট্ট ছানাগুলিকে বড় করে তোলার ব্যাপারে যে কষ্টটা হয়, সে কষ্ট সম্বন্ধেও এদের যথেষ্ট বোধ আছে। আর এই কষ্টের বোধ আছে মানেই বিষয়ের দোষটা এরাও দেখতে পাচ্ছে, তার মানে এরাও একভাবে জ্ঞানী। অর্থাৎ যে যে কারণে আপনারা নিজেদের জ্ঞানী মনে করছেন, সেই সেই জ্ঞান এই পশুপক্ষীরও আছে।’
মেধস মুনি এবার আরও পরিষ্কার করে কঠিন বাস্তবে আঘাত করলেন। বললেন,—’ছেলেপিলে, সংসারের ওপর আপনাদের যে এত মমতা দেখা যাচ্ছে তার কারণ কী জানেন? আপনারা আসলে ছেলেপিলেদের কাছে থেকে বিরাট একটা ‘রিটার্ন’ আশা করছেন। অর্থাৎ ছোটো বয়স থেকে গু-মুত ঘেঁটে তোদের এত বড়টা করলাম, বুড়ো বয়সে তোরা আমাদের দেখবি বলেই তো! এই লোভেই এই আশাতেই আপনাদের সন্তানের ওপর এত ভালবাসা—লোভাৎ প্রত্যুপকারায় নন্বেতে কিং ন পশ্যসি। কিন্তু সন্তানের জন্ম থেকে আরম্ভ করে তাকে মানুষ করা, লেখাপড়া শেখানো, জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা—এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটার মধ্যেই যে কষ্ট আছে, সে কষ্টটার সম্বন্ধে আপনাদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, আপনারা যে তাদের এত ভালবাসেন, তার কারণ হলেন মহামায়া—মহামায়া প্রভাবেণ… মোহগর্তে নিপাতিতাঃ।’
মেধস মুনি এতক্ষণে আসল কথায় এলেন। ‘মহামায়া—যাঁর প্রভাবে অখিল চরাচর মোহে অন্ধ হয়ে কলুর বলদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই তিনিই হলেন মহামায়া—জগৎপতি ভগবান শ্রীহরির ‘যোগনিদ্রা’ হলেন এই মহামায়া ‘যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ’। যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরাও এই মায়ার ফেরে সংসারের মোহে কাল কাটান। কিন্তু সত্যি করে যদি তাঁকে বোঝা যায় তবেই মানুষের মুক্তি।
সুরথ রাজা আর সমাধি বৈশ্য এবার বুঝলেন যে মহামায়ার স্বভাব এবং ক্রিয়াকলাপ—দুই-ই বড় গভীর। অতএব এই মহামায়াকেই একটু চিনে নেওয়া দরকার। মেধস মুনির ইঙ্গিতে এইটুকু তাঁরা বুঝলেন যে, রাজ্যপাট ছেলেপিলে সব ছেড়ে এসে তবুও তাদের জন্যই যে কষ্ট হচ্ছে—এর মূলে আছেন এই দেবী। অতএব এই দেবীর জন্ম-কর্ম, স্বভাব-স্বরূপ সবটা যদি মেধস মুনির কাছে বুঝে নেওয়া যায়, তবেই আত্মার শান্তি, মনের আরাম।
মুনি বলতে আরম্ভ করলেন। বলতে আরম্ভ করলেন—কেমন করে ব্রহ্মার স্তুতিতে তুষ্ট হয়ে ভগবান শ্রীহরির মায়াশক্তি এই মহামায়া প্রবুদ্ধ হলেন। একে একে এল মহিষাসুর বধের গল্প, শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের গল্প, রক্তবীজ-বধের কাহিনী। একেবারে শেষ কল্পে এসেছে সুরথ এবং সমাধির তপস্যার কথা। বস্তুত সুরথ আর সমাধির মহামায়া তথা চণ্ডীর আরাধনার ব্যাপারটা—অনেকটাই চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গলের আরম্ভের মতোই। ঠিক এই কারণেই সুরথ আর সমাধির কাহিনিটা এখানে শোনালাম। আমার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু অন্য। এই প্রবন্ধের মধ্য এবং শেষ পরিসরে আমি দুটি সমস্যার কথা বলব। এক, দেবীর উৎপত্তি যেভাবে মার্কণ্ডেয় পুরাণের চণ্ডীতে বর্ণিত আছে, তাতে ভোলানাথ শংকর তাঁর স্বামী হলেন কীভাবে, সেটা চিন্তার বিষয়। দুই, শরৎকালে আমাদের যে দুর্গোৎসব হয়, সেটাকে অকালবোধন বলার কোনো অর্থ আছে কিনা।
(২)
পুজোর সময় বড় বড় প্যান্ডেল থেকে আরম্ভ করে ছোট-মাঝারি এক-চালাতেও আমরা যে সপরিবারে সিংহবাহিনী দুর্গাপ্রতিমা দেখতে পাই, সেই চালচিত্রের চূড়ায় এককোণায়, কোথাও বা পাশে অবহেলিত অবস্থায় একখানি শিবের ছবি আমরা দেখতে পাই। যত অবহেলাতেই হোক তিনি থাকেন। স্বামীসোহাগিনী উমা বাপের বাড়ি এসেও স্বামীর কথা ভুলতে পারেন না—সেই সংস্কারে আমরা পার্বতীর জন্য এই ছবিটুকুর ব্যবস্থা করি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী—শরৎকালের দেবীপক্ষে পনের দিন ধরে আমরা যে দুলে দুলে চণ্ডীপাঠ করি, সেই চণ্ডীর সঙ্গে মহাদেবের কিন্তু কোনো সম্পর্ক নেই। দক্ষযজ্ঞ বিনাশের পর দুর্গা-চণ্ডী হিমালয়ের মেয়ে হয়ে জন্মালেন—এমনটি কিছু কিছু পুরাণে পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায় যে, এই পার্বতীর সঙ্গে কীভাবে মহাদেবের বিয়ের ঘটনাটা ঘটল। এইরকম পুরাণ-কথার আশ্রয়েই মহাকবি কালিদাসের বিখ্যাত কাব্য কুমারসম্ভব রচিত হয়েছে। কিন্তু মার্কণ্ডেয় চণ্ডী—যেটাকে আমরা দুর্গামায়ের আধারভূমি বলে মনে করি, সেখানে চণ্ডী বা দুর্গার উৎপত্তি অন্যভাবে হয়েছে, শিবের সঙ্গেও সেখানে তাঁর কোনো বৈবাহিক সম্বন্ধ নেই। বরঞ্চ নানাভাবে বিষ্ণু বা নারায়ণের সঙ্গেই তাঁর সম্বন্ধ বেশি।
মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে পদ্মযোনি ব্রহ্মা দেখলেন—মধু-কৈটভ নামের দুই অসুর, যারা নাকি ভগবান বিষ্ণুর কানের নোংরা থেকে জন্মেছিল—তারা ব্রহ্মাকেই মারতে উদ্যত হল। ওদিকে বিষ্ণু তখনও ঘুমিয়েই আছেন, তিনি যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন। যোগনিদ্রা এমনই এক মোহজাল যা বিষ্ণুকেও কর্তব্যবিমূঢ় করে রেখেছে। তিনি নির্বিকার চক্ষু মুদে শুয়ে আছেন। এই অবস্থায় ব্রহ্মা—ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা… ত্বং দেবি জননী পরা—ইত্যাদি মন্ত্রে সেই যোগনিদ্রা মহামায়ার অনেক স্তুতি-নতি করে শেষে তাঁকে অনুরোধ করলেন, বিষ্ণুকে ঘুম থেকে জাগাতে। বিষ্ণুর ঘুম মানেই তো সেই যোগনিদ্রা, মহামায়া। ব্রহ্মা সেই যোগনিদ্রাকে মন্ত্রের শক্তিতে নিজের অনুকূলে নিয়ে এলেন। তিনি শ্রীহরির নেত্র-নাসিকা এবং হৃদয়ের অবস্থান ছেড়ে ব্রহ্মার দৃষ্টিপথে এসে দেখা দিলেন। বিষ্ণুর মায়া-ঘুম ভাঙল, তিনি এবার মধুকৈটভকে শায়েস্তা করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলেন। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে দেবী মহামায়ার প্রথম উৎপত্তি এইভাবেই—’এবমেষা সমুৎপন্না ব্রহ্মণা সংস্তুতা স্বয়ম।’
আমাদের ধারণা—হরির এই যে যোগনিদ্রা, যাকে ব্রহ্মা স্তুতি করে হরির ঘুম ভাঙালেন—ইনি যে ঠিক চণ্ডী বা দুর্গা—এমন কোনো সন্ধান আমরা এই উপাখ্যানে পেতাম না। তবে হ্যাঁ, যোগনিদ্রাস্বরূপিণী মহামায়ার কথাটা কেন এখানে বলা হল সেটা বুঝি। সুরথ রাজা আর সমাধি বৈশ্য রাজ্যপাট আর সংসার ছেড়ে এসে সেই বিষয়চিন্তাতেই মগ্ন ছিলেন এবং ঠিক বুঝতে পারছিলেন না—কেন এমন হল। এই ‘কেন এমন হল’—সেটা বোঝানোর জন্যই এই মহামায়ার কথা বলা। আরও বলা এই কারণে যে, ওঁরা বলেছিলেন—আমাদের তো বেশ জ্ঞান আছে, বুদ্ধি আছে, তবু এমনটি হচ্ছে কেন? মুনি দেখালেন—তোমরা কোন ছার, মহামায়া বিষ্ণুকেই ঘুম পাড়িয়ে রাখছেন, তো তোমরা তো সামান্য মানুষ। সংসারের সমস্ত কাজকর্মে এবং চৈতন্যে যে এই মহামায়ারই কর্তৃত্ব—এটা বোঝানোর জন্য এই—মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতির কথা জানানো। অর্থাৎ জ্ঞানী বলব তাকেই, যার এই মহামায়ার জ্ঞানটি আছে। এখন এই মহামায়ার উৎপত্তির সঙ্গে দেবী চণ্ডী বা দুর্গাকে মিলিয়ে দেবার জন্য দ্বিতীয় কাহিনির অবতারণা। বস্তুত মহামায়ার উৎপত্তির কথা বলে দেবীর স্বরূপ নির্ণয় করা হল, এবার তাঁর স্বভাবটা বলা হচ্ছে।
এবারে দেখা যাচ্ছে—দেবতা আর অসুরদের নাকি একশো বছর তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে দেবতারা শেষপর্যন্ত হেরে গেলেন এবং অসুরদের রাজা মহিষাসুর ইন্দ্র হয়ে বসলেন স্বর্গরাজ্যে। পরাজিত দেবতারা মনের দুঃখে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন এবং ব্রহ্মা তাঁদের নিয়ে গেলেন—শিব আর বিষ্ণুর কাছে। দেবতারা মহিষাসুরের স্পর্দ্ধা এবং ঔদ্ধত্যের পূর্বাপর ইতিবৃত্ত জানালেন এই দুই দেবতাকে। মহিষাসুরের এত বাড় বেড়েছে শুনে ভগবান বিষ্ণু রাগে ফেটে পড়লেন, শান্ত শিবের চক্ষু দুটি রাঙা হয়ে উঠল। এই দুই দেবতার রাগ দেখে ব্রহ্মারও বড় রাগ হল। এই তিন মূর্তি দেবতার ক্রোধারুণ মুখমণ্ডল থেকে নিঃসৃত হল এক পরম তেজ। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকেও তাঁদের তেজ-স্বরূপটি আলাদা করে বেরিয়ে এল। এইভবে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের তেজ আর দেবতাদের তেজ মিলেমিশে এক তেজোময়ী নারীশরীর তৈরি হল।
এই যে দেবতেজের তিল তিল তেজের সমাহার জগদম্বা চণ্ডীর নারী বিগ্রহ তৈরি হল, সেই তেজকে পৃথক করে দেখলে দেখা যাবে যে শংকরের তেজে তাঁর মুখমণ্ডল, বিষ্ণুর তেজে তাঁর হাত দুটি এবং ব্রহ্মার তেজে তাঁর পা দুটি মাত্র তৈরি হয়েছিল। দেবীর অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ—স্তন, কেশ, নাক, চোখ—এই সবই সাধারণ অন্য দেবতার তেজে সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি এখানে হিমালয়ের কন্যা পার্বতীও নন, দক্ষকন্যা সতীও নন—তিনি সমস্ত দেবতার তেজসম্ভবা, স্বয়ম্ভূ। তিনি মহিষাসুর থেকে আরম্ভ করে আরও অনেক অসুর বধ করেছেন বটে, কিন্তু শিবের সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথাটি এখানে কুত্রাপি বলা নেই। তবুও অন্যান্য পুরাণ কবিদের আমরা ধন্যবাদ দিই, কেননা নিজের রুদ্রতেজে অসামান্য দেবী-রমণীর যে মুখমণ্ডলটি তৈরি করেছিলেন শংকর, পুরাণ-কবিরা সেই মুখখানির অধিকার দিয়েছেন তাঁকেই। শিবের ঘরণী হয়ে তিনি শিবানী হলেন। কিন্তু মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে এই পরমা দেবী ধূর্জটির মুখের পানে চেয়ে হিমালয়ের তুষার-ধবল হাসিটি হাসতে পারেননি। সেখানে তিনি সমস্ত দেবতার তেজের ভাগ নিয়েই জন্মেছেন। হিমালয় বা শিব, কেউ তাঁর জন্মদাতাও নন, স্বামীও নন। বরঞ্চ মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে এই কাত্যায়নী দুর্গার বিভিন্ন রূপান্তর—কালী, চামুণ্ডা, কৌশিকী, বিন্ধ্যবাসিনী অথবা ভীমা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী অথবা রক্তদন্তিকার পরিচয় অনেক বেশি, শিব-শিবানীর অমর প্রেমকথা সত্যিই এখানে অনুপস্থিত। সেটি চাইলে চণ্ডীপাঠ বাদ দিতে হবে।
(৩)
এবারে আসি অকাল-বোধনের কথায়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর শেষপর্যায়ে আমরা সুরথ রাজা আর সমাধি বৈশ্যকে দেখেছি—দেবীর এই পূজা-তপস্যার ফল কী—তা দেবীর মুখেই আমরা শুনতে পেয়েছি। কোন কোন তিথিতে দেবীপূজার কত মহাত্ম্য, সেই প্রসঙ্গে শরৎকালের বার্ষিক পূজা-মহোৎসবের কথাও এসেছে। সেখানে চণ্ডীপাঠের ফলের কথা বলতে গিয়ে দেবী এমনভাবে সেটা বর্ণনা করেছেন, যাতে বোঝা যায়—প্রতি বৎসরের শরৎকালেই দুর্গাপূজা হয়ে থাকে—শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।
কিন্তু চিরকালীন এই শারদোৎসবের মধ্যেও যে একটা অকালবোধনের সংবাদ চলে এল—তার জন্য দায়ী আমাদের কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি। কৃত্তিবাস যে বাঙালির হৃদয় কতটা অধিকার করেছেন তা এই ঘটনায় প্রমাণ হয়। কবি ঠিক রাবণ-বধের আগে রামচন্দ্রকে দিয়ে একটা দুর্গাপূজা করিয়ে নিলেন এবং বললেন—এখন দুর্গাপূজার সময় নয়, কিন্তু বিপন্ন হয়ে রাবণবধের জন্য রামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকাল-বোধন করেছেন। অতএব শরৎকালের এই দুর্গাপূজা রামচন্দ্রের স্মৃতি মাখানো। কৃত্তিবাসের কবিত্বশক্তি এমনই, তাঁর ছন্দোবদ্ধ শব্দমন্ত্রে এমনই জাদু আছে যে, বাঙালি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করছে—এ পুজো শরৎকালে হতই না এবং রামচন্দ্রের কৃপায় তাঁরই হাতছোঁয়া পুজো আমরা বছর বছর করে যাচ্ছি।
বাস্তবিক রামচন্দ্র এই পুজো করে থাকুন আর না-ই করে থাকুন, তাতে বাঙালির কিছু আসে যায় না। করে থাকলে খুব ভাল। কারণ, রামচন্দ্রকে আমরা খুবই পছন্দ করি এবং জগদজননী দুর্গাকেও আমরা খুবই ভালবাসি। কিন্তু সত্যিই শরৎকালে রামচন্দ্র দেবীর অকালবোধন করেছিলেন কিনা সেই বাস্তবটা জানতে হলে আমদের কৃত্তিবাসেরও আগে বিভিন্ন পুরাণ এবং বিশেষত বাল্মীকি রামায়ণটি মিলিয়ে দেখে নিতে হবে।
কৃত্তিবাসে দেখা যাচ্ছে—লঙ্কাকাণ্ডের শেষ পর্যায়ে রাবণ যুদ্ধে এসেছেন, কিন্তু অসংখ্য পুত্র-মিত্র হারিয়ে হীনবল রাবণ আর যুদ্ধে পেরে উঠছেন না রামচন্দ্রের সঙ্গে। এই অবস্থায় রাবণ জগদজননী কালী-ভবানীকে স্মরণ করলেন। রাবণের স্তবে তুষ্ট হয়ে মা ভবানী একেবারে রাবণকে কোলে করে রাবণের রথে বসলেন—অসিতবরণা কালী কোলে দশানন। এটা কিছুই আশ্চর্য নয়—কৃত্তিবাসের লেখনীতে ডাকাত কিংবা অন্যান্য দস্যুজাতিরা যে কালীপুজো করত, তারই প্রতিরূপ ধরা পড়েছে। রাবণ প্রধানত শিবের উপাসক ছিলেন, কিন্তু এই অসীম বিপন্নতার মধ্যে শিবানীও তাঁর কাছে রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। যাই হোক, রাবণের রথে ‘জলদবরণী’ শ্যামাকে দেখে রামচন্দ্র ধনুক-বাণ ফেলে বসে পড়লেন।
রামচন্দ্রের অবস্থা দেখে স্বর্গের দেবতারা মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ, রাবণবধে তাঁদেরও স্বার্থ আছে। দেবতাদের রাজা ইন্দ্র স্বয়ং ব্রহ্মাকে অনুরোধ করলেন—কোনো উপায় চিন্তা করার জন্য। ব্রহ্মা বললেন—দুর্গাপূজা করতে হবে, কিন্তু দুর্গাপূজার এখন সময় নয়, তাঁকে অকালে বোধন করতে হবে—
বিধি কন বিধি আছে চণ্ডী আরাধনে।
হইবে রাবণ-বধ অকালবোধনে।।
রামচন্দ্রের সুবিধের জন্য ব্রহ্মা তখন স্বর্গরাজ্যেই—অকালে শরতে কৈল চণ্ডীর বোধন। এখানে দুটি কথা আছে।
কৃত্তিবাস যে বলেছিলেন—
রাবণ-বধের জন্য বিধাতা তখন।
আর শ্রীরামেরে অনুগ্রহের কারণ।।
ব্রহ্মার এই দুটি কাজের জন্যই যে অকালবোধন—এই কথাটা কৃত্তিবাস সরাসরি প্রায় অনুবাদ করে দিয়েছেন কালিকাপুরাণ থেকে। এই পুরাণে বলা হয়েছে—রামের প্রতি অনুগ্রহ এবং রাবণ-বধের জন্য ব্রহ্মা রাত্রিতেই দেবীর বোধন করেছিলেন—
রামস্যানুগ্রহার্থায় রাবণস্য বধায় চ।
রাত্রাবেব মহাদেবী ব্রহ্মণা বোধিতা পুরা।
আসলে এই রাতের বেলায় দেবীর বোধনই কৃত্তিবাসকে মহা ফাঁপরে ফেলে দিয়েছে। কেননা, রাত্রির এই আকালিক বোধনই কৃত্তিবাসে শরৎকালের আকালিকতায় পরিণত। এমনিতে শরৎকালের দুর্গাপূজা যে মোটেই আকালিক নয়, সেকথা ওই কালিকাপুরাণ থেকে আরম্ভ করে সব পুরাণেই খুব স্পষ্ট। কিন্তু ব্রহ্মার এই রাত্রিপূজা যেহেতু স্বাভাবিক নয়, অতএব কৃত্তিবাসে শরৎকালের সম্পূর্ণ দুর্গাপূজাটাই অকালবোধন হয়ে গেল।
ব্রহ্মার এই রাত্রিকালীন অকালবোধনের সূত্র ধরেই যে একটা ভুল বোঝবার সম্ভাবনা রয়ে গেছে, সেকথা বিধানদাতা স্মার্ত পণ্ডিতরাও বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন বলেই রঘুনন্দনের মতো স্মার্ত ধুরন্ধর তাঁর দুর্গাপূজার তিথি-তত্ত্বে এই রাত্রির আকালিকতার প্রশ্ন তুলে বলেছেন—বাপু! ওটা দেবতাদের রাত্রি বটে, কিন্তু মানুষের গড়া জগতে ওটা রাত্রি নয়, দিনই। রঘুনন্দনের মতে, সূর্যের সমস্ত দক্ষিণায়নের সময়-কালটাই দেবতাদের রাত্রি। কাজেই মানুষের পূজায় শারদোৎসব কোনো অকালবোধন নয়। বরঞ্চ ব্রহ্মা যে দেবলোকের রাত্রিতে দেবীকে পূজার মন্ত্রে প্রবুদ্ধ করলেন, সেটা অকাল বটে—অকাল ইতি তু রাত্রিত্বেন দক্ষিণায়নস্য অথৈতদ দক্ষিণায়নং দেবানাং রাত্রিঃ ইতি। অতএব মানুষের বেলায় কন্যারাশির শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে দিনের বেলাতেই দেবীর বোধন চলবে—এই হল রঘুনন্দনের মত।
স্মৃতিশাস্ত্রের এই ব্যাপারগুলো, দুর্গাপূজার তিথিতত্ত্ব কৃত্তিবাস যে কিছুই জানতেন না—তা নয়। কারণ, ব্রহ্মা যখন রামচন্দ্রকে নিজ পূজার অনুকরণে অকালবোধন করতে বললেন, তখন রামচন্দ্র তিথির প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন—দুর্গাপূজার পক্ষে বসন্তকালই ‘শুদ্ধ সময়।’ অর্থাৎ বঙ্গদেশে যে বাসন্তী পূজা চালু আছে সেটাই যে দুর্গাপূজার পক্ষে প্রশস্ত সময়—সেটা রামচন্দ্র কৃত্তিবাসের কল্যাণে জানেন। তিনি আরও জানেন যে,
বিধি আছে নিরূপণ নিদ্রা ভাঙ্গিতে বোধন
কৃষ্ণা নবমীর দিনে তার!
কিন্তু কৃষ্ণা নবমী পার হয়ে গেছে। দুর্গাপূজার আরও বিকল্প তারিখ ছিল। কারণ মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে সুরথ রাজা শুক্লা প্রতিপদে দেবীপূজার কল্পারম্ভ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রামচন্দ্র এমন একটা সময়ে দেবীপূজার কথা ভাবছেন—যখন আগামী কাল হল শুক্লা ষষ্ঠী—
শুক্লা ষষ্ঠী মিলিবে প্রভাতে।
কন্যারাশি মাস বটে কিন্তু পূজা নাহি ঘটে
অত্র যোগ, সব হৈল যাতে।
অর্থাৎ সবগুলি তিথিযোগই যখন চলে গেছে, তখন ব্রহ্মার মতে শুক্লা ষষ্ঠীতেই রামচন্দ্রের পক্ষে বোধন করা ভাল। কারণ, সুরথ রাজা যদি নিয়ম ভেঙে প্রতিপদে কল্পারম্ভ করে থাকেন, তাহলে রামচন্দ্রের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বই বা তা পারবেন না কেন—
কর ষষ্ঠী-কল্পেতে বোধন।
ব্যাঘাত না হবে তায় বিধি খণ্ডি পুনরায়—
কল্প খণ্ডে সুরথ রাজন।
লক্ষণীয় বিষয় হল, ব্রহ্মা অকালে বোধন করা জন্য যে সময় নির্দেশ করলেন, সেই দুর্গাপূজা বাঙালির ঘরে ঘরে আপনিই হয়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে এই পূজারই বিধান—শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী। এই শ্লোকের টীকায় নাগোজীভট্ট পরিষ্কার জানিয়েছেন—’শরৎকালে’ মানে হল, আশ্বিনমাসের শুক্ল প্রতিপদ থেকে দুর্গাপূজার যে কল্পারম্ভ হয়। সেই পূজা শরৎকাল আশ্বিন প্রতিপদমারভ্য দুর্গোৎসবরূপা। অন্যদিকে, স্মার্তরঘুনন্দনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। তিনি বলেছেন কন্যারাশি মানে, ওই আশ্বিন মাসের নবমী তিথিতেই দেবী প্রবুদ্ধা হবেন।
আসলে কালিকাপুরাণে দেখা যাবে—নবমীর বোধনের পরেই দেবী প্রবোধিতা হয়ে নিজের মায়ায় রামচন্দ্র এবং রাবণকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করেন। কিন্তু এখানে বোধন ছিল ব্রহ্মার এবং কাল ছিল রাত্রি, স্থান দেবলোক। দেবী ব্রহ্মার বোধনে তুষ্ট হয়ে নিজের ঘুম নষ্ট করে, সাত দিন লঙ্কায় বাঁদর আর রাক্ষসদের রক্তমাংস খেয়ে দিন কাটালেন—রক্ষসাং বানরানাঞ্চ জগধ্বা সা মাংসশোণিতে। তারপর কৃপা করে রামের মাধ্যমে যেন দেবীই মারলেন রাবণকে—রামেণ ঘাতয়ামাস। সংস্কৃতটা এমন আছে, যাতে দেবীই এখানে প্রধান এবং Rama was only instrumental in killing Ravana. এখানে এই খবর ছাড়া আরও একটা খবর জরুরি। সেটা হল রাবণ-হত্যার দিনটি ছিল নবমী তিথি—নবম্যাং রাবণং ততঃ।
কৃত্তিবাস কালিকাপুরাণের সংকেত প্রায় মানলেও ঈশ্বররূপে চিহ্নিত রামচন্দ্রকে তিনি করণ-কারক বানিয়ে রাখেননি। অন্যদিকে, রামচন্দ্রের মনুষ্যায়নের তাগিদে তাঁকে দিয়ে দুর্গাপূজা করালেও রাবণবধের ব্যাপারে কর্তৃত্ব দিয়েছেন। আর তিথির ব্যাপারে কৃত্তিবাস কালিকাপুরাণের মত মেনেওছেন, আবার মানেনওনি। কালিকাপুরাণে নবমীতে রাবণবধ, দশমীতে বিজয়োৎসব এবং দেবীর বিসর্জন। কিন্তু কৃত্তিবাসে নবমীতে দেবী রাতের স্তুতিতেই প্রবুদ্ধা হয়েছেন এবং তাঁকে আর লঙ্কায় বাঁদর-রাক্ষস খেয়ে সময় নষ্ট করতে হয়নি। নবমীতে প্রবুদ্ধা হয়েই তিনি রামকে কৃপা করেন এবং দশমীতেই রাবণবধ। অপিচ সেই রাবণ-বধ রামই করেছেন।
আসল কথা হল—কৃত্তিবাস বাঙালির দুর্গাপূজা পদ্ধতি এড়াতে পারেননি। কৃত্তিবাসে ঠিক বাঙালি-মতে রামচন্দ্র চণ্ডীপাঠ শুরু করেন, তারপর ষষ্ঠীতে বেলগাছের তলায় দেবীর বোধন-অধিবাস করেন। সপ্তমীতে যেমন পুজো হয় তেমনি পুজো হল। অষ্টমী পুজোর পর—নিশাকালে সন্ধিপূজা কৈল রঘুনাথ। তারপর নবমীতে সেই একশো-আট নীলপদ্ম জোগাড়ের কাহিনি। রাম পদ্মের বদলে নিজের চোখ উপড়ে দিতে যাবেন—
হেনকালে কাত্যায়নী ধরিলেন হাতে।।
কি কর কি কর প্রভু জগৎ-গোঁসাই।
সংকল্প তোমার পূর্ণ চক্ষু নাহি চাই।।
দেবী নবমীতেই প্রবোধিতা হলেন এবং এখানে রামচন্দ্রের ব্যাপারে দেবীর ‘জগৎ-গোঁসাই’ বোধটিও আছে। রামচন্দ্র দেবীর বরাভয় নিয়ে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন দশমীতে—
দশমীতে পূজা করি বিসর্জিয়া মহেশ্বরী
সংগ্রামে চলিলা রঘুপতি।
দশমী তিথিতে রাবণবধের ফলে রামচন্দ্রের যে মহাবিজয় সূচনা হল, সেইটাই আমাদের বিজয়া দশমী। কৃত্তিবাসের প্রভাব বাঙালির ওপর এতই বেশি যে, শুধুমাত্র রাবণের মতো এক বিশাল ব্যক্তির মৃত্যু বিজয়া দশমীর দিনে হয়েছিল বলে চৈতন্যচরিতকার কৃষ্ণদাস কবিরাজের মতো পণ্ডিত-কবিও স্বীকার করেছেন—বিজয়া দশমী লঙ্কা বিজয়ের দিনে। শুধু তাই নয়, চৈতন্যচরিতামৃতে বিশাল ব্যক্তিত্বের তিরোধান মহোৎসবও চিহ্নিত হয়েছে ‘বিজয়’ শব্দটির মাধ্যমে। যবন হরিদাসের তিরোধান উৎসব—যে উৎসবে মহাপ্রভু সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন, সেই উৎসবও কিন্তু কৃত্তিবাসের প্রভাবে ‘হরিদাসের বিজয়োৎসব।’
কৃত্তিবাসী রামায়ণে কালিকাপুরাণের অবদানের কথাটা আমরা এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছি। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, বাল্মীকি যে মূল রামায়ণ রচনা করেছিলেন, যাঁর নায়ককে কৃত্তিবাস ঈশ্বরপদবীতে উঠিয়ে তাঁর অমর কাব্য রচনা করেছেন, যে বাল্মীকিকে পদে পদে অনুসরণ করে কৃত্তিবাস পয়ার-ত্রিপদী গেঁথেছেন, সেই কৃত্তিবাস রামায়ণ-রচনার এই চরম মুহূর্তে—যখন রাবণ বধ হবে—তখন বাল্মীকিকে মনেই রাখলেন না—এ কেমন কথা! স্বীকার করি, বাংলাদেশে শক্তিপূজার প্রভাব যথেষ্ট ছিল, এও স্বীকার করি গদ্য-পদ্য রচনায় কবির সেই স্বাতন্ত্র্য আছে, যাতে তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর আকর-গ্রন্থ ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু তাই বলে রাবণ-বধের আগে মূল রামায়ণে যে দেবীপূজার নাম-গন্ধ নেই, সেই দেবীপূজা নির্দ্বিধায় কৃত্তিবাস আমদানি করেছেন রাবণ-বধের মতো বিপন্ন সময়ে। বেশ বুঝতে পারি—বাঙালির শারদোৎসব এবং তার আড়ম্বর কবির কাছে এতই প্রিয় ছিল যে, একজন সমাজ-সচেতন কবি হিসেবে কৃত্তিবাস সেই উৎসব-চিত্র নিরুচ্চারে ছেড়ে দিতে পারেননি।
বস্তুত মূল বাল্মীকি রামায়ণে রাবণবধের আগে রামচন্দ্র কোনো দুর্গাপূজা বা দেবীপূজা করেননি। সেখানে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে রাবণের সঙ্গে লড়াই করতে করতে রামচন্দ্র যখন আর পেরে উঠছেন না, তখন চিন্তাকুল পরিশ্রান্ত—ততো যুদ্ধপরিশ্রান্তং সমরে চিন্তয়া স্থিতম—রামচন্দ্রকে অগস্ত্য মুনি ‘আদিত্য-হৃদয়’ নামে এক মন্ত্র-স্তবক জপ করতে বলেছিলেন। এই মন্ত্রজপে শত্রুবিনাশ হয়। সংগ্রামে বিজয়লাভ হয়। যখন রামায়ণ রচনা হচ্ছে তখন বৈদিক যুগের কল্পান্তর ঘটে থাকলেও সূর্য-মন্ত্র জপের বিধানই বিশেষ সঙ্গত। মহামতি কৃত্তিবাস বাঙালির হৃদয় মন্থন করে আদিত্য-হৃদয়ের পরিবর্তে বাঙালির দুর্গোৎসবের বিধান দিয়েছেন রামচন্দ্রকে। বাঙালি কবির কল্পনা যাই হোক, মহাকবির কল্পনাতেও ছিল না সেই ছবি।