দুই বন্ধু – মহাশ্বেতা দেবী

 দুই বন্ধু – মহাশ্বেতা দেবী

আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। ডিসেম্বর মাস তায় আবার বৃষ্টি। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। সন্ধেবেলার দিকে বৃষ্টিটা অবশেষে থামল। বাবা বাড়িতে নেই। দুদিনের জন্য কোথায় যেন গেছে। আকাশে চাঁদ উঠল সন্ধেবেলায়। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। কিছুক্ষণ পরিস্কার থাকবার পরই আবার বৃষ্টি শুরু হল। তবে এবার আর আগের মতো মুষলধারে নয়, টিপটিপে বৃষ্টি। সে বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকল না। নটা-সাড়ে নটার মধ্যে মেঘ কেটে গিয়ে আবার চাঁদ দেখা দিল। সারাদিন বাড়িতে থাকবার পর আমরা সকলেই বাইরে বেরোবার জন্য ছটফট করছিলাম। ভাই তো বৃষ্টি থামবার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বেস্ট ফ্রেন্ড দারোয়ানজির সঙ্গে কত গল্পই না বাকি! মা আর আমি রাত্রের খাওয়া-দাওয়া সেরে হাঁটতে বেরোলাম। বৃষ্টির জল তখনও পুরোপুরি শুকোয়নি। এদিক ওদিক, ফাটল বা নিচু জায়গায় এখনও জমে রয়েছে। আকাশে ঝুলে থাকা মরা চাঁদের ছায়া পড়ছে সেইসব জমে থাকা জলের ওপর। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বইছে, তাতে গাছের পাতা নড়ার ঝিরঝির শব্দ – সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ।

মা আগে আগে হাঁটছিল। আমি ইচ্ছে করেই আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। কাছে গেটের পাশেই বসেছিল আমার ভাই আর দারোয়ানজি। একটার ওপর আরেকটা চেয়ার সাজিয়ে, একটা সিংহাসন ধরনের বানিয়ে, তার ওপর বসেছিল ভাই। ঠিক যেন কোন দেশের রাজা। তার ঠিক পায়ের পাশে, নিচু একটা টুলে বসে রয়েছে, তার বেস্ট ফ্রেন্ড, মানে আমাদের দারোয়ানজী ( ঠিক যেন ভক্ত হনুমান)। রোজ রাতেই এই একইরকম দৃশ্য দেখা গিয়ে থাকে আমাদের বাড়িতে, দুই অসমবয়সী বন্ধু নিজেদের গল্প শোনায় একে অপরকে। ভাই বাড়িতে সবার চাইতে ভাল হিন্দি বলতে পারে অতএব হিন্দিভাষী দারোয়ানজির সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, তবে ঠিক কী ধরনের গল্প যে হয় সেটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। আজ এই সুযোগে ওদের কিছু কথোপকথন শুনতে পেলাম।

ভাই : দারোয়ানজি, আপনে ওহ্‌ তারা দেখা? (অর্থাৎ আপনি ওই তারাটি দেখেছেন?)

আকাশের দিকে আঙুল বাড়িয়ে কালপুরুষের পায়ের কাছে লুব্ধক তারার দিকে তাক করল।

দারোয়ানজি : ওহ্‌ তারা বাবা? (ওই তারাটা বাবা?)

আসলে কিছুদিন আগে বাবা ছাদে নিয়ে গিয়ে তারা দেখাচ্ছিল সবাইকে। ভাইয়ের হয়তো লুব্ধককে খুব পছন্দ হয়েছিল। তাইজন্য কালপুরুষের পায়ের কাছে অবস্থানটা মোটামুটি ঠিকঠাক দেখিয়ে দিতে পারল। দারোয়ানজি যে ভাইয়ের দেখানো সেই বিশেষ তারাটার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

ভাই : উসকা নাম পতা হ্যাঁয় আপকো? (মানে, ওটার নাম জানা আছে আপনার?)

দারোয়ানজি : নহি বাবা। নহি তো ! (না বাবা। জানি না তো।)

ভাই : উসকা নাম হ্যাঁয় দারোয়ান তারা’ । (ওটার নাম দারোয়ান তারা । )

দারোয়ানজি হাঁ হয়ে গেল।

দারোয়ানজিঃ সচ বাবা? (সত্যি বাবা?)

ভাই মুচকি হেসে ফিজিকসের পণ্ডিতের মতো মাথা নাড়াল।

ভাইঃ আচ্ছা দারোয়ানজি, আপকো ওহ্ চন্দা দিখা?

এবার আর আঙুল দিয়ে দেখাতে হল না, দারোয়ানজি নিজে থেকেই এক ঝলক দেখে নিল চাঁদের দিকে। তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল।

দারোয়ানজি: হা বাবা ! ওহ্‌ রহা চন্দা। (হ্যাঁ বাবা। ওই তো চাঁদ।)

ভাইঃ আপকো পতা হ্যাঁয় দারোয়ানজি ? ওহ্ চন্দা না, মর গিয়া।

(আপনি জানেন দারোয়ানজি ? ওই চাদটা না মরে গেছে) অর্থাৎ মরা চাঁদ আর কি ! মায়ের গল্পে সেই শিলঙের মরা চাঁদের ব্যাপারে বরাবরই কৌতুহল ছিল ভাইয়ের। চাঁদটা মরে গেলে যে ঠিক কীরকম দেখতে হয়, তা নিয়ে সিরিয়াসভাবে চিন্তাও করেছে হয়তো। কে জানে ! আজ যখন মেঘ কেটে ওঠা চাঁদটাকে দেখে মা ডিক্লেয়ার করল যে এটা মরা চাঁদ তখন বেশ আনন্দ পেয়েছিল ভাই।বেশ কয়েকবার মরা চাঁদ, মরা চাঁদ করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু চাঁদের মরে যাওয়াটা দারোয়ানজির কাছে মোটেই শুভ ঠেকল না। প্রথমে কিছুক্ষণ হতভম্ব ভাবে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল দারোয়ানজী, তারপর…………..

দারোয়ানজিঃ নহি নহি বাবা। চন্দা মরেগা কিঁউ? চন্দা তো জিন্দা হ্যাঁয়। ওহ্‌ দেখো, ক্যায়সে মুস্কুরা রহা হ্যাঁয় ? (না, না, বাবা। চাঁদ মরবে কেন? চাঁদ তো বেঁচে রয়েছে। ওই দেখ কি সুন্দর হাসছে?)

ভাইঃ নহি নহি। ওহ্‌ তো মর গিয়া হ্যাঁয়। (না না। ও তো মরেই গেছে।)

তারপর বেশ কিছুক্ষণ এই এক কথা নিয়ে ঝগড়া চলল। চাঁদ বেঁচে আছে না মরে গেছে। আমি আর শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম না। আরেক রাউন্ড হেঁটে নিলাম বাড়ির চারপাশে। ফিরে এসে দেখি নতুন গল্প শুরু হয়েছে দুই বন্ধুর।

ভাই: দারোয়ানজি, আপকে ঘর মে কওন কওন হ্যাঁয়? (আপনার বাড়িতে কে কে আছে?)

দারোয়ানজি লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে মাথা নিচু করল।

দারোয়ানজি: ওহ্‌, এক দিদি হ্যাঁয়, এক ভইয়া হ্যাঁয়। (দিদি অর্থাৎ দারোয়ানজির মেয়ে আর ভইয়া অর্থাৎ দারোয়ানজির ছেলে।)

ভাইঃ অওর কওন হ্যাঁয়? (আর কে আছে?)

দারোয়ানজিঃ অওর ওহ্‌ হ্যাঁয়। (আর উনি রয়েছেন। )

দারোয়ানজির লজ্জায় মাথা নামানো দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেই উনিটি আসলে কে। দারোয়ানজির গৃহিনী ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। কিন্তু আমার পাঁচ বছর বয়সের ভাইয়ের এইসব বোঝার বয়স হয়নি, অতএব সে জিজ্ঞেস করতেই থাকল।

ভাইঃ ওহ্‌ , ‘ওহ্‌’ কওন হ্যাঁয়? (সেই উনিটা কে?)

দারোয়ানজি আরও লাল হয়ে গেল। মাথাটা যতটা সম্ভব নিচু করে নিল ।

দারোয়ানজি: ‘ওহ্‌’ ওহ হ্যাঁয় বাবা। (উনি তো উনি বাবা।)

ভাইঃ সমঝ গিয়া। ওহ্‌ আপকা কম্পিউটার হ্যাঁয়! (বুঝেছি ওটা আপনার কমপিউটার।)

ভাইয়ের মুখে বিজয়ীর তৃপ্ত হাসি, যেন এক্ষুণি যুদ্ধ জয় করে এল। আধবোজা চোখে চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে বসল। কিন্তু দারোয়ানজি বিচলিত হয়ে পড়ল। তার এত সাধের ঘরণীকে কম্পিউটার বানিয়ে দেওয়াটা তেমন পছন্দ হয়নি তার।

দারোয়ানজিঃ নহি বাবা, ওহ্‌ কমপিউটার নহি হ্যাঁয়। (না বাবা, উনি কম্পিউটার নন।)

ভাইঃ সমঝ গিয়া, ওহ্‌ আপকা ওয়াশিং মেশিন হ্যাঁয়।

দারোয়ানজি: নহি বাবা।

তারপর, দুই বন্ধুর তর্ক চলতে লাগল। আমি এগিয়ে গেলাম আরেক রাউন্ড দিতে। চাঁদের নীল আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ঠান্ডা হওয়া গাছের পাতাদের নাড়িয়ে ঝিরঝির শব্দ তুলছে। জমে থকা জলে পড়েছে মরা চাঁদের ছায়া। তার মধ্যে অসমবয়স্ক অথচ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুর গল্প, তর্ক, কথাবার্তা চলতে থাকল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *