দিবাবসান
(চল্লিশ) সিংহাবলোকন
আপনমনে বলে উঠলাম, ‘মণিমেখলা? আচ্ছা, এই নামেই তো শিলপ্পদিকরম-এর সিকুয়েল লেখা হয়েছিল, তাই না ?’
‘হ্যাঁ। একেবারে গোড়ার দিকে তোমাকে বলেছি সেকথা। সঙ্গমযুগের দ্বিতীয় মহাকাব্য মণিমেখলাই। সেটি এই শিলপ্পদিকরম-এর পরের কাহিনি। লিখেছিলেন কবি শাত্তান । কিন্তু সেসব কথা এখন কেন ?’
বাসবান্নার কণ্ঠস্বরে গল্পের ঘোর ভেঙে গেল। দেখলাম, কথাটা বলে তিনি আমার দিকেই চেয়ে আছেন।
পাশ থেকে বাসবান্নার শেষ কথাটাকে জোরালো সমর্থন করল কাঁকন, ‘হ্যাঁ। তাই তো! সেকথা এখন কেন? এখন তো কোভালন-কন্নকী মাদুরাইতে গিয়ে কী করল, কী ঘটল, সেসব বলার কথা ।
এরা যে এতক্ষণ এ ঘরেই ছিল, গল্পের ঘোরে একেবারেই তা ভুলে গেছিলাম । বললাম, ‘না, কোভালন-মাধবীর ভাবী সন্তানের নাম শুনলাম মণিমেখলা। তার থেকেই প্রশ্নটা চট করে মাথায় চলে এল। তাহলে কি মাধবীর মেয়েকে নিয়েই সিকুয়েল মহাকাব্যটি লেখা?’
বাসবান্না জবাব দিলেন, ‘ঠিকই ধরেছ। মাধবী-কোভালনের মেয়ে মণিমেখলাকে নিয়েই কবি শাত্তান মণিমেখলাই কাব্য রচনা করেন এর পরে। সেখানে কিন্তু ….’
বাসবান্না আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কাঁকন তাঁকে বাধা দিল, ‘না-না, সেই গল্প এখন শুনব না। তাহলে সব গুলিয়ে যাবে। মাদুরাইতে গিয়ে ওদের কী হল, আপনি সেটাই বরং বলুন।’
বাসবান্না নিরস্ত হয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘বলব। কিন্তু রাত হয়ে গেছে। চলো, তোমরা আজ এখানেই খেয়ে নেবে। খাওয়ার পরে বাকি গল্পটা বলব না হয়। আজ রাতে আমার বাড়িতেই তোমরা থেকে যাও। উপরে অনেকগুলো ঘর খালি পড়ে আছে। নীচেও অনেকগুলো ঘর খালি। তোমরা যেখানে খুশি ইচ্ছেমতো হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারো।’
বাসবান্নার ভাষা নকল করে আমি বললাম, “তার মানে ‘আহার্য ও আশ্রয়’? তাই তো ?”
‘বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের সেই পুরোনো অভ্যেস তাহলে যায়নি এখনও ? বাসুদার ভাষা নিয়ে হাসিঠাট্টা করা? তা করো। কিন্তু মনে রেখো, আহার্য যা কিছু পাবে আমার বাড়িতে, সবই কিন্তু খাঁটি দক্ষিণী। মোর স্পেসিফিকালি তামিল।’
বাসবান্নার কথায় অণুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে কাঁকন বলল, ‘তাতে অসুবিধে কী? দক্ষিণী খাবার তো আমাদের খুব ভালো লাগে।’
বাসবান্না তির্যক দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘বটে? তোমাদের বাঙালিদের জিভ কী পরিমাণ সূক্ষ্ম, জানো? কত্তোরকমের টেস্ট-বাড! কত বিচিত্র পদ তোমাদের। টক-ঝাল-মিষ্টি-তেতো-নোনতা। কোনোটাই খুব উগ্র নয়। সাংঘাতিক সন্তুলন ! কিন্তু আমাদের তামিলদের বাপু জিভে একটিই টেস্ট-বাড প্রবল। খাট্টা! টক! সেই কথাটাই তো বলছি।’
আমি বললাম, ‘কীভাবে এটা বলছেন, বাসুদা ? তামিল খাবারেরও তো কতরকম ভেরিয়েশন আছে। মেদুবড়া, ফুলিওকারাই, তৈরসাদম, ইডলি, রসম, সম্বর, দোসা, মৌর, উফমা। এক দোসারই কতরকম ভেরিয়েশন। প্লেন দোসা, মশালা দোসা, রাব্বা দোসা…আরও যে কতরকম!’
বাসবান্না বললেন, ‘হুঁ, ভেরিয়েশন! ভেরিয়েশনই বটে! ওই নামরূপগুলোই খালি আলাদা, আসল উপাদান-কারণ একটিই। টক। একমেবাদ্বিতীয়ং টক। তোমাদের ইলিশমাছের পাতুরি, চিংড়ির মালাইকারি, ঝিঙে পোস্তো, ধোঁকার ডালনা, মাছের মাথা দিয়ে কচুর লতি—বাঙালির অন্তহীন ইনভেনশনের এত বৈচিত্র্য কোত্থাও নেই, বাবা !’
‘আপনি বনেদি তামিল পরিবারের সন্তান হয়ে এসব বলছেন, বাসবান্না ?’ আমি বললাম।
‘তোমরা তামিল থাকতে দিলে কই, অ্যাঁ? আমার জন্মটুকুই খালি এখানে। বড়ো হয়েছি কলকাতায়। পড়াশোনা করেছি সাউথ সিটি কলেজে। তোমাদের আমি চিনি, বাপু। তোমাদের অনেকটাই যে চিনি! তাই তো বলছি, সাবধানে খেও। শেষে শরীর খারাপ করে তামিলনাড়ুর দুর্নাম কোরো না। তোমাদের জিভে তেমন ধারই নেই।’
কাঁকন মারাভারদের সেই গানটা সামান্য এদিক-ওদিক করে গাইতে আরম্ভ করল, ‘মোদের জিভের গোড়ায় ধার হোক, মোদের গাঁয়ে বেবাক লোক, মোরা যেন বীরের মতো যুদ্ধ করে মরি!’
বাসবান্না বললেন, ‘তাতে ধার হবে জিভে, কিন্তু তার হবে কি? না, না, থাক । আমি মনিয়র উইলিয়মসকে বলে দিচ্ছি, তোমাদের জন্য ডিমের ওমলেট করে দিতে।’
আমি বাসুদার কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘মনিয়র উইলিয়মস? হঠাৎ মনিয়র উইলিয়মস… সেই ব্রিটিশ পণ্ডিতমশাই এলেন এখানে কোত্থেকে ?’
বাসুদা হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘আ রে, আমাদের রাঁধুনি। ওর নাম পনিয়র সেলবম । আমি ওকে মজা করে মনিয়র উইলিয়মস বলে ডাকি!’
‘বাপ রে বাপ! একেবারে লেক্সিকোগ্রাফার থেকে শেফ! আপনি পারেনও বটে, বাসুদা ! একেবারে ঝাঁকিয়ে দেন মধ্যে মধ্যে।’
হাসতে হাসতেই আমরা ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। খাবারদাবার প্রথাগত—ভাত, ঘন সম্বর, নারকেলের কুচো মেশানো মটরশুটির তরকারি, রসম। শেষপাতে মৌর, পাপড়, চাটনি। আমাদের জন্যে ডিমভাজাও এল। খাবার পরিবেশন করছিলেন বাসুদার সেই মনিয়র উইলিয়মস। বাসুদা কিন্তু রাতে বেশি কিছু খান না। হাতেগড়া দুটো রুটি আর এক গ্লাস দুধ নিয়ে বসলেন।
খাওয়ার পরে একতলার উঠোনে বাসবান্না জোরে জোরে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন। দক্ষিণী মানুষদের এই এক সদভ্যাস—রাতের খাওয়ার পরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। আমরা ভরপেট খেয়ে একতলার বারান্দায় ফোটোফ্রেমে ঝোলানো রবিবর্মার পেন্টিং-এর অনুকৃতিগুলো দেখছিলাম।
আধঘণ্টা পর বাসুদা আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘চলো, ছাদে যাই। বাকি গল্প ছাদে বসেই বলব।’
বাসবান্নাদের বাড়ির ছাদটা আমাদের পুরোনো কলকাতার সেই সব হারিয়ে যাওয়া পাঁচিল-তোলা বিশাল বিশাল ছাদের মতন, যেখানে চাইলে কোর্ট কেটে টেনিস খেলাও যেত। আমরা একটা বিশাল মাদুর পেতে বসলাম। ছাদ বেশ অন্ধকার, দূরে সিঁড়ির দরজার কাছে হালকা আলোর একটা বাল্ব। তার আবছা আভা এত দূর অবধি এসে পৌঁছোচ্ছিল না। আকাশে কয়েকটা অনুজ্জ্বল তারা। চাঁদ নেই এখন। তারার আলোয় অন্ধকার তেমন ফিকে হয়নি। আমরা তিনজন অনেকটা দূরে দূরে ছড়িয়ে বসেছি। কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছি না এই অন্ধকারে ।
এতক্ষণ পরে আবার সেই ঘোর-ঘোর ভাবটা ফিরে আসছে। একটু আগে যে এত মজার কথা হল, খাওয়াদাওয়া হল—সেসব তখন বেশ স্পষ্টভাবেই সত্যি মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে… ওসব যেন সত্যি সত্যি ঘটেনি। সিনেমা দেখার সময় যেমন সব সত্যি মনে হয়, পর্দার গল্পের মধ্যে কেমন ঢুকে যাই আমরা ! তারপর সিনেমা শেষ হল, হলের আলো জ্বলে উঠল, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে জনাকীর্ণ শহরের ব্যস্ত রাজপথে নেমে গাড়ি ধরলাম, তখন সিনেমার সেই সব দৃশ্য গল্প কথা সমস্তই মিথ্যে মনে হয়, আলোর কারসাজি মনে হয়—এও যেন ঠিক তেমনই।
আবার সেই জ্বরটা ফিরে আসছে আমার। এই বাসবান্না লোকটা কিংবা কাঁকন নামের ওই মেয়েটি—এরা কারা যারা অন্ধকারে বসে আছে দূরে, কে জানে? সত্যিই কি বাসবান্না বলে কেউ ছিল কোনোদিন, কলকাতায় পড়ার সময়ে যার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল ? কাঁকন আমারই কল্পনা নয় তো? নিঃসঙ্গ আত্মীয়স্বজনহীন জীবন আমার, অমিশুক অসামাজিক প্রকৃতির মানুষ আমি… কাঁকন বলে একটি অল্পবয়েসি মেয়েকে মনে মনে কল্পনা করে নিয়ে তার কাছে স্নেহের আশ্রয় পেতে চাইছি জীবনের পড়ন্ত বেলায়? সে বলল, সে নাকি আমার লেখাপত্তর পড়েছে। কিন্তু আমি কি কোনোদিন কিছু লিখেছিলাম ? বইটই ? ওই যেমন কলেজ স্ট্রিটের লেখকরা সব লেখেন? গল্প, উপন্যাস? আমি আবার ওসব লিখলাম কবে? আমি নাকি কোন মঠে বেদপাঠী সাধু হয়েছিলাম ! ধুর! তিনবেলা টিউশন করে খাই পেটের ভাত গায়ের কাপড়ের জন্যে। নিতান্ত আটপৌরে লোক আমি, প্রকৃতির অনবদ্য অপচয়। আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, আমি ঘর ছেড়ে চলে গিয়ে সাধু হয়ে বেদ পড়তে যাব খামোখা? আবার মঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ছাইত্য করব? দুর, দুর, দুর! কীসব ভেবে চলেছি যে! যা যা যথাসময়ে আমার করা উচিত ছিল, কেন করলাম না আমি সেসব সারা জীবনে? আর যা যা করা উচিত হয়নি, সেই সব অনুচিত কাজই কেন করে গেলাম অহরহ? ‘কিমহং সাধু নাকরবম্ ? কিমহং পাপমকরবমিতি ?’
জীবনজিজ্ঞাসার হুল মুখে নিয়ে বিশ্রান্ত মৌমাছিরা অন্ধকারে আমার চারপাশে উড়ছে… ঘুম আসছে ঘুম…. মৃত্যু…অনিবার্য নীল মৃত্যু….
জলধরপুরে আমাদের গাঁয়ের সেই মাঠকোটা ঘরখানা… টিনের চাল, আলকাতরালেপা দেওয়াল, জানালায় জানালায় লোহার রেলিং… সেখানে ফিরে গেলে কী হয়? বিনয় সেনাপতির কৃষিসামগ্রী আর সারের দোকানে খাতা-লেখার কাজ নিয়ে দুটো ডালভাত, দুয়েকটা জামাকাপড়… আমার বেশ চলে যাবে… আমি কীসব করছি এখানে মরতে মাদ্রাজ শহরে ? বাসবান্না নামের আধবুড়ো একটা লোক আমাকে আর আমার হাঁটুর বয়েসি একটা মেয়েকে কোন আঠেরোশো বছর আগেকার ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের গল্প বলছে… কী হাস্যকরভাবে অবাস্তব! বুঝতে পারছি অবাস্তব হ্যালুশিনেশন, তবু একটা ঝাঁকুনি মেরে এর থেকে বেরিয়েও আসতে পারছি না। অনেকদিন একা একা থাকতে থাকতে মাথার ব্যারাম হয়…. সে-ব্যারাম আর সারে না বোধহয় ? নাকি সারে ?
যদি কালতা-পাঁচখুরি চলে যাই, এমন চাঁদহীন রাতে চাষের ক্ষেতের ধারে শ্যালোঘরের পাশে আলের উপর বসে থাকি একা অনেক অন্ধকার আর মাঠভরা জোনাকি-মাখা এলোমেলো বাতাস মাথায় নিয়ে, তাহলে কি এই অসুখ সারবে না? আমি ভুল, আমার পথ ভুল, সব ভুল আমার… আমার কখনও কোনো পথ ছিল ? আমি বলে কেউ ছিলাম ? কারা যেন আমাকে কল্পনা করেছিল…. ভেবেছিল, আমি জন্মালাম বুঝি, বাঁচলাম বুঝি, বেড়ে উঠলাম বুঝি, ভালোবাসলাম বুঝি, মরবার ভয় পেলাম বুঝি… কারা তারা? কোনো এক বর্ষার রাতে পরস্পর আদর করতে করতে তারা আমাকে, আমার জীবনের গল্পকে কল্পনা করে বসল কেন? নিরর্থক এই গল্পের কথা পৃথিবীর নদী, পাহাড়, বাতাস— কেউ জানেও না। কখনও টেরও পায়নি। তারা ভেসে যায়, দাঁড়িয়ে থাকে, বয়ে যায়… আমাকে চিনত না তারা, জানবেও না তারা কোনোদিন। অলীক গল্প কুয়াশার মতো মাঠে রোদ উঠলে মিলিয়ে যায়।
‘একটা ট্রান্সফরমেশন হয়েছে বুঝতে পারছি এই মাদুরাই যাওয়ার পথে, যেন একটা স্থানবিনিময়,’ অন্ধকারের মধ্যে মেয়েটি বলল।
‘হ্যাঁ। কোভালন আর কন্নকীর কথা বলছ তো?’ বাসবান্না নামের লোকটি বললেন।
‘হ্যাঁ। কোভালন ছিল আইডিয়ালিস্ট আর কন্নকী রিয়ালিস্ট। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতার মোকাবিলা করতে গিয়ে কোভালন রিয়ালিস্ট হয়ে গেল আর কন্নকী আইডিয়ালিস্ট হয়ে উঠল। নয় কি?’ মেয়েটির গলা আবার। ওফ্! পাঠকেরা কত কী বোঝে !
‘কিন্তু এ দুয়ের বিরোধ, এ দুয়ের দ্বন্দ্ব রিজলভ করছেও তো এক জায়গায়,’ মাঝবয়েসি লোকটির গলা ।
‘ওই মারাভারদের দেবী ভয়ংকরী আইয়াই-এর মধ্যে এসে সব বৈপরীত্য মিটে যাচ্ছে, নাকি?’ মেয়েটি প্রশ্ন করল। হুম্, পাঠক ঠিকই বোঝে কখনও কখনও।
‘হ্যাঁ, তাই। তবে ওই ভয়ংকরীর আরকেটাইপ কোনো আসন্ন বিপর্যয়ের পূর্বাভাসও তো হতে পারে,’ আবার মেয়েটির ভাবনাটাকে ঘেঁটে দিতে চাইছেন মধ্যবয়স্ক কথক।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ বেশ। কেউ কোনো কথা বলছে না। সামুদ্রিক বাতাস বইছে ছাদের উপর। তারপরে আবার মেয়েটি বলল, ‘তার থেকে আপনি না হয় গল্পটাই বলুন । মাদুরাই পৌঁছোল কন্নকী-কোভালন-কাভুন্দি শেষ অবধি? কী হল সেখানে গিয়ে? কোভালন কি আর ফিরতে পেরেছিল পুষ্পহারে ? সন্তানের মুখ দেখা হয়েছিল তার?’
আবার সব নিশ্চুপ। তারপর অন্ধকারের মধ্যে শুধু কণ্ঠস্বরটাই রইল। গল্পের কথক, শ্রোতা মুছে গেল ধীরে ধীরে চিহ্নহীনভাবে।
‘সেটাই ছিল তাদের যাত্রাপথের শেষ রাত। অম্বনাভর ব্রাহ্মণদের গাঁয়ের এক পরিবারে আশ্রয় জুটেছিল ওদের। ভোর হয়ে আসছে… অনেক দূরের বজ্রধ্বনির মতো নগরীর দূরাগত শব্দ এসে পৌঁছোতে লাগল ওদের শ্রুতিমূলে….’
(একচল্লিশ) পথপ্ৰান্ত
যাত্রাপথের শেষ রাত। অম্বনাভর ব্রাহ্মণদের গাঁয়ের এক পরিবারে আশ্রয় জুটেছিল। রাত ভোর হয়ে আসছে…. অনেক দূরের বজ্রধ্বনির মতো নগরীর দূরাগত শব্দ এসে পৌঁছোতে লাগল ওদের শ্রুতিমূলে। বিচিত্র সব শব্দ। দেবতার মন্দিরে মন্দিরে ডঙ্কা বাজছে যেন বহু দূরে… পাণ্ড্যরাজার গৌরবসূচক ঢক্কা নিনাদিত হচ্ছে বুঝি কোথাও …. সৈনিকদের স্কন্ধাবারে স্কন্ধাবারে মুলাভু-আনদ্ধের তাল মুখর করে তুলছে ভোরের আকাশ… কোথাও যেন সামবেদী ব্রাহ্মণদের বেদপাঠের মেঘগম্ভীরঘোষ, কোথাও আবার যেন সমস্বরে সূত্রপাঠ করে চলেছেন ভিক্ষু শ্রমণের দল… কোথাও নর্তকীদের প্রভাতী চর্চার তালে তালে কিনাই-ঢোলের মৃদঙ্গমধুর গীতশব্দ… কখনও হস্তীযূথের চকিত বৃংহিত, কখনও অশ্বকুলের তীব্র হ্রেষা… দূরাগত শব্দসমুদ্রের গুঞ্জরিত কলতান ভাইগাই নদী পেরিয়ে, ঘাটের সোপান ছুঁয়ে, মাঠের বিশুষ্ক বুক কাঁপিয়ে, বনের হাওয়ায় ঢেউ তুলে ওদের কানে এসে লাগছিল। যেন এক অজ্ঞাত নগরী তার সমস্ত সমৃদ্ধি নিয়ে, ঐশ্বর্য নিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে ওদের এই সদ্যোজাগর প্রভাতবেলায়।
প্রাতরুত্থানের পরে গ্রাম ছেড়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল। খানিক অগ্রসর হতেই নদী পড়ল পথে। ভাইগাই নদী। কোভালন, কন্নকী, কাভুন্দি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সেই নদীটির নিসর্গরূপ। কোভালন ভাবছিল, এই স্রোতস্বিনীর সঙ্গে বোধহয় মাদুরার কবিদের নাড়ির যোগ আছে। আজন্ম এ নদীর জল পান করে কবিদের সুললিত কণ্ঠে জেগে ওঠে সুরচিত শ্লোকের মূর্ছনা, আবার সেসব শ্লোকের মধ্য দিয়েই মাদুরার কবিকুল আমৃত্যু গেয়ে চলেন এ নদীরই বন্দনাগীতি। কেমন পরস্পরনির্ভর এরা–কবি ও নদী, নদী ও নারী, নারী ও কবি। চিরকাল…. বিচ্ছেদবিহীন। কোভালনও তো কবিতা লিখত একদিন। তবু কবিতা হল না কোভালনের। কেমন করে কবিতা লেখে, কী কবিতার রীতিরাত্মা, কে বলে দেবে তাকে? এ এমন জিনিস যে, হলে সবই হল, না-হলে কিছুই হোলো না। তবু একজন এসেছিল কোভালনের জীবনে, যে চিনিয়ে দিতে পারত স্পর্শে স্পর্শে কবিতার সমস্ত অবয়ব, সমস্ত প্রত্যঙ্গ… সত্যিই সে ছিল আশ্চর্য শব্দস্পর্শময়ী… কিন্তু মাধবীর পৃথিবী এখন কোভালনের আকাশের থেকে কত দূরে সরে চলে গেছে !
পাশ থেকে কন্নকী সোচ্ছ্বাসে বলে উঠল, ‘এ তো নদী নয়, এ যে পুষ্পের অবারিত স্রোত!’
কথা সত্যি। ভাইগাইয়ের স্রোতে অজস্র ফুল দুপাশের তীরস্থিত পুষ্পতরু থেকে ঝরে পড়ে। নানা বর্ণের পুষ্পসম্ভারে বর্ণিল তাই এই নদীনারীর বসন। খেজুরের ফুল, বকুলের ফুল, অজস্র শিমুল, ভেঙ্গাই, কদম্ব, শিহরিত নাগকেশর, মৃদুল তিলক, মুরুদম, আলোলিত জুই—কত যে ফুলের পাপড়ি ভেসে যাচ্ছে জলে—যেন এক রূপকথার নদী। এই পুষ্পাবৃতা ভাইগাই স্রোতস্বতী—দুপাশের বালুচর যেন তার সুদৃঢ় কটিবন্ধ, নদীবক্ষে অকস্মাৎ জেগে ওঠা সুশ্যাম সুগোল দ্বীপভূমি যেন তার উত্তুঙ্গ স্তনমণ্ডল, স্রোতোজলে ভেসে যাওয়া আরক্তিম পুষ্পসম্ভার নদীটির কোমল ঠোঁট, বন্য যূথিকাদল তার কুন্দনিভ দশনপক্তি, স্রোতের গভীর থেকে লাফিয়ে উঠে আবার স্রোতের ভিতরেই চকিতে লুকিয়ে পড়া শফরী যেন তার চঞ্চল দৃষ্টিবিদ্যুৎ, কুসুমসুরভিত জলস্রোত নদীর আলুলায়িত কুন্তল। কবির নদী সে, কবির নারী এই ভাইগাই। তবু বড়ো বেশি আবৃত বলে মনে হল তাকে কোভালনের। এত বর্ণের উপচার দিয়ে এ নদী যেন ঢেকে রেখেছে কোন অপ্রকাশিত বেদনা। এত প্রসাধনের নীচে কোন বেদনার অশ্রুবারিচয় লুকিয়ে রাখতে চায় এই বিষাদমেদুর নদী? বুঝতে পারল না কোভালন । এই প্রথম সে কোনো নদীর চোখে চোখ রেখে তার অন্তরের ভাষা পড়তে পারল না।
হয়তো এই ভাইগাই নদী সেদিন সকালে অস্ফুট স্বরে বলছিল কোভালনকে, ‘ফিরে যাও, যুবক, ফিরে যাও ! এখনও সময় আছে, ফিরে যাও!’
নদীর বুকে অনেক বিচিত্র আকারের জলযান; ময়ূরের মতো, অশ্বের মতো, হস্তী বা সিংহের মতো সেসব নৌযানের মুখ । মানুষের বড়ো ভিড় এই সব নদীঘাটে, কোনোমতে পারাপারের নৌকায় চেপে কোভালন-কন্নকী-কাভুন্দি ভাইগাইয়ের দক্ষিণ ঘাটে এসে নামল ।
দক্ষিণ ঘাটের কাছেই ফুলের বড়ো বড়ো বাগান, তারপর নগরপ্রাকার। প্রাকারের চারিপাশে পরিখা; পরিখার জল সবুজ দলঘাসে ঢাকা। সেই ঘাসেদের মাঝে মাঝে একটি দুটি শালুকের ফুল কেমন যেন বিষণ্ণ চোখে চেয়ে আছে কোভালনের দিকে। কেন যে এমন মনে হচ্ছে বারবার, বুঝতে পারছিল না কোভালন। ফুলের চারিদিকে মৌমাছিদের ওড়াউড়ি দেখে কত কবিতার চরণ মনে ভেসে আসে তার অন্য সময়ে। কিন্তু আজ এই সব মধুমক্ষিকার গুঞ্জরন যেন কোনো শোকগাথার সুর হয়ে ভেসে আসছে। প্রাকারের উপর ব্যাঘ্রচিহ্নলাঞ্ছিত পতাকাগুলো নদীর হাওয়ায় পত্ পত্ করে উড়ছে, সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, কেন জানি ওই বিজয়কেতনগুলো হাত নেড়ে কোভালনকে বারবার নিষেধ করছে। যেন বলছে, ‘এ নগরীতে এসো না, এসো না তোমরা, চলে যাও, চলে যাও, এখনই চলে যাও !’
কিন্তু এসব নিয়ে ভেবে কী হবে? কোভালনের মনে হল, মনের অর্থহীন কল্পনা যত মূর্ছিত সব! দীর্ঘ পথশ্রমে শ্রান্ত হয়েছে শরীর, ক্লান্ত হয়েছে মন। তাই এমন অপরূপ নিসর্গশোভার মধ্যেও তার মন যত অমাঙ্গলিক ছবি দেখছে। ওই তো কেমন দূরবিসর্পী মেঠো পথ, সবুজ ধানের ক্ষেত, স্বচ্ছ জলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুষ্করিণী, পুষ্করিণীর পাড়ে বাঁশের তৈরি ক্ষুদ্রাকার কুটির সব। পাখির ডাকে উদাস হয়ে থাকা শস্যক্ষেত্র, এখান থেকে বহু দূরে দেখা যায় ছায়ার মতন নগরীর হর্ম্য, প্রাসাদ, সৌধছবি। আসলে এ একেবারেই মাদুরাই নগরীর বহির্দেশ, যথার্থত নগরীর আরম্ভ আরও কিছুটা পরে। নারিকেল বীথি দিয়ে ঘেরা শীতল এক উদ্যানে এসে বসল ওরা তিনজন, চারিপাশে কলা আর সুপুরি গাছের সারি। এত শান্তি চারিদিকে। বিপদের আশঙ্কা কই? নাহ্, তার মন তাকে ভুল বোঝাতে আরম্ভ করেছে আবার, কোভালন ভাবল ।
খানিক সেই তরুতলে বিশ্রাম নেওয়ার পর কোভালনের মনে হল, এখানে এই নগরীর বহির্দেশে কালক্ষেপ বৃথা। সামনে এখনও সারাটা বেলা পড়ে আছে, গোটা একটা দিন। সময় থাকতে থাকতে নগরে প্রবেশ করে এ জনপদের রীতিনীতি বুঝে নেওয়া দরকার। কোথায় স্কন্ধাবার, কোনদিকে কী কী পথঘাট, রাজকার্যালয় কোথায়, বিপণিবিতান কোনদিকে, বিশেষত বিশ্বস্ত স্বর্ণকার কারা এখানে, সুবর্ণের মূল্য এ নগরীতে কত কালাঞ্জু—এসব না জানা থাকলে পদে পদে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা । কাভুন্দি ও কন্নকী বিশ্রাম করতে হয় করুক, কিন্তু তাকে নগরীতে যেতে হবে।
এই সব সাতপাঁচ ভেবে কোভালন বিনীতভাবে কাভুন্দিকে বলল, ‘মা! আপনারা অতীব পথশ্রান্ত, এই শীতল উদ্যানে বিশ্রাম করুন। কিন্তু আমার একবার মাদুরাইতে প্রবেশ না করলেই নয়। শুনেছি, এ নগরীর বিত্তবান বণিকদের সবার উপর আস্থা রাখা কঠিন। বিশ্বস্ত কারা আছেন, দেখি যদি সংবাদ নিতে পারি। কাল রাতে যে অম্বনাভর ব্রাহ্মণগৃহে আমরা আশ্রয় পেয়েছিলাম, তাঁরা আজ প্রাতে বিদায়কালে কন্নকীর আঁচলে পর্যাপ্ত চিঁড়াগুড় বেঁধে দিয়েছেন। আপনারা আহারাদি করুন, বিশ্রাম নিন, কিন্তু আমাকে নগরীতে যাওয়ার জন্যে অনুমতি দিন। কন্নকী আপনার কাছে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত। । আমি যাব আর আসব। অনুমতি দিন, মা!’
কাভুন্দি বললেন, ‘বেশ। তবে তুমি যাও!’ বলেই কী যেন ভেবে বললেন, ‘দাঁড়াও, তোমাকে আমি দু-পা এগিয়ে দিয়ে আসি ।’এই বলে কন্নকীকে তরুতলে বিশ্রাম করতে বলে কাভুন্দি কিছু দূর অবধি কোভালনের সঙ্গে এলেন।
কোভালনের মনে হল, কাভুন্দি যেন তাকে কন্নকীর আড়ালে কিছু বলতে চাইছেন। কোভালন জিজ্ঞেস করল, ‘মা! আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?’
কাভুন্দি বললেন, ‘হ্যাঁ, বাবা! কথাটা এইবার তোমাকে বলে ফেলাই বিশেষভাবে দরকার। আমাদের প্রত্যেকের জীবনই প্রাক্তন কর্মফলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শুভ কর্মে শুভ ফল, অশুভ কর্মে অশুভ ফল। আমি গণনা করে দেখেছি, তোমার প্রাক্তন শুভ কর্মের ভাণ্ডার নিঃশেষিতপ্রায়। এখন পূর্বজন্মের কিছু অশুভ কর্ম ফলপ্রসবোন্মুখ হয়ে রয়েছে।’
কোভালন পাংশুপ্রায় মুখে বলল, ‘আপনি কি কিছু বিপদের আশঙ্কা করছেন, মা?’
‘তা করছি। কিন্তু কী বিপদ, আমি তা নিশ্চয় করে বলতে পারছি না। যা-ই ঘটুক, অবিকৃত চিত্তে তোমাকে তা গ্রহণ করতেই হবে।’
কাতর হয়ে কোভালন প্রশ্ন করল, ‘এ অবশ্যম্ভাবী কর্মফল রোধ করা কি একান্তই অসম্ভব?’
কাভুন্দি বললেন, ‘দ্যাখো বাবা, এ কলিকাল; পূর্বাহ্ণে আমরা যতই তোমাদের সাবধান করি না কেন, তোমরা কি আমাদের কথা শোনো? আমরা তো কতই বলি, প্রলোভনে পা দিও না, কিন্তু সেকথা কি তোমাদের কানে ঢোকে? একবার অশুভ কর্মের চাকার ভিতর গিয়ে ঢুকলে সে-চাকা তো তোমাকে ঘুরিয়ে অন্ধকারের অতলে নিয়ে গিয়ে ফেলবেই। তবু যদি সজাগ থাকো, কষ্ট কিছুটা হলেও কম হয়।’
কোভালন নিজের পূর্বকৃত কর্মের কথা মনে মনে স্মরণ করে ক্ষিন্ন স্বরে বলল, ‘জানি মা। আমি আমার কর্তব্য থেকে বিচলিত হয়ে ভুল পথে গিয়েছিলাম। নিজের মাথার খেয়ালে চলে কন্নকীকে অনর্থক কষ্ট দিয়েছি…’
কাভুন্দি বললেন, ‘বাসনা বড়ো সাংঘাতিক, বাছা! সুরভিতকেশা নারীর বাঞ্ছায় নিজের মনের উপর দখল হারিয়েছিলে তুমি। আত্মনিয়ন্ত্রণ চলে গেছিল। মদনপীড়া বড়ো ভয়ানক ব্যাধি। নারী, বিত্ত, সুখের আকর্ষণ মানুষকে ঋতপথ থেকে বিচ্যুত করে। আর তোমাকেই-বা কী বলি, বাবা? এ কি আজকের কথা? সৃজনের ঊষালগ্ন থেকে মানুষ এই চাকাতেই তো ঘুরছে। দু-চার জন সংযমী লোক কোনোমতে এর হাত থেকে নিস্তার পেয়ে অর্থৎ হন।’
কোভালন বলল, ‘আমার যা হয় হোক, মা ! আমি চিন্তা করি না। কিন্তু কন্নকী—তার যেন কষ্ট না হয় আমার নিমিত্ত। আমি ইতিমধ্যেই তার বহু কষ্টের কারণ। এমনিতেই তাকে অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়েছি, তার পরেও সে আমারই জন্যে এই দুর্গম পথ অতিবাহন করে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে। এত কিছুর পরেও একথা আপনার কাছে আমি স্বীকার করব মা, কন্নকী আমার প্রাণের কুসুম, আমি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসি। সে যেন আমার কর্মের কারণে কষ্ট না পায় !’
কাভুন্দি উত্তর দিলেন, ‘কর্মের ফল বড়ো বিচিত্র, বাবা! কার জন্যে যে কে কষ্ট পায়, মনুষ্যবুদ্ধি দিয়ে বোঝা দুষ্কর। এই দ্যাখো না, পিতৃসত্যরক্ষার্থে রামচন্দ্র সীতাকে সঙ্গে নিয়ে বনে গেলেন। সেখানে রাক্ষসরাজ রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেল। রাম ও সীতা তো নিষ্কলুষ ছিলেন। দশরথের প্রাক্তন কর্মের ফল নির্দোষ রাম-সীতা ভোগ করতে গেলেন কেন? আবার দ্যাখো, নল-দময়ন্তীর কথা। রাজা নল দ্যুত ক্রীড়ায় আসক্ত হয়ে রাজ্য হারালেন, স্ত্রী দময়ন্তীকে নিয়ে বনে গেলেন, সেখানে ভাগ্যবিপর্যয়ে এক গভীরা রজনীতে প্রিয়তমা দময়ন্তীকে পরিত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হলেন। নল রাজার অশুভ কর্মের জন্য নিষ্কলুষা দময়ন্তীকে দুঃখভোগ করতে হল কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে কে দেবে, বলো !’
সাশ্রুনেত্রে কোভালন বলল, ‘আমি নিজের কর্মফল ভুগতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার কর্মে কন্নকীকে যেন না ভুগতে হয়, এই প্রার্থনা করি। এই তো আপনার কাছে কন্নকীকে আমি রেখে যাচ্ছি। জানি, আপনার কাছে থাকলে তার কোনো ক্ষতি হবে না, আমি ও মাদুরাই নগরীর অন্ধিসন্ধি জেনে স্বল্পক্ষণের মধ্যে শীঘ্রই ফিরে আসব। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের জন্যেও তার আসন্ন অদর্শন আমাকে এখনই পীড়া দিচ্ছে। অথচ, একটা সময় ছিল, যখন দিনের পর দিন আমি কন্নকীকে ছেড়ে থেকেছি। কিন্তু এখন…’
কাভুন্দি স্মিত হেসে বললেন, ‘স্ত্রীকে অত চোখে হারিও না, বাবা ! নিজের উপস্থিত কর্মে মন দাও। আসক্তি যে-রূপেই আসুক, তা অন্তিমে পীড়াদায়ক। কন্নকী আমার কাছে নিরাপদেই থাকবে’, এই পর্যন্ত বলে কোভালনের চোখে জল দেখে করুণাপরবশ হয়ে কাভুন্দি যোগ করলেন, ‘আচ্ছা, আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি, রাম যেমন সীতা-বিচ্ছেদে কষ্ট পেয়েছিলেন কিংবা নল যেমন দময়ন্তী-বিহনে দুঃখ পেয়েছিলেন, তোমাকে যেন সেই পত্নীবিচ্ছেদের যন্ত্রণা না সইতে হয়। যাই ঘটুক, শেষ দিন পর্যন্ত যেন তোমরা দুজন একসঙ্গেই থাকতে পারো। যদি আমি এতটুকুও আন্তরিকভাবে তপস্যা করে থাকি, তবে আমার সেই তপোশক্তির প্রভাবেই তোমরা চিরকাল বশিষ্ঠ-অরুন্ধতীর মতন পাশাপাশি অবস্থান কোরো। যত শীঘ্র সম্ভব মাদুরাই দর্শন করে ফিরে এসে আমাদের আশ্বস্ত করো, বাবা। কেঁদো না, চোখ মোছো !”
এই বলে তিনি নীরব হয়ে রইলেন। কাভুন্দির চরণ দুটিকে অশ্রুজলে সিক্ত করে কোভালন উদ্যান পরিত্যাগকরতঃ নিতান্ত বিষণ্ণ মনে পথে বাহির হয়ে গেল।
(বিয়াল্লিশ) প্রবেশ
কৌতূহল এমন দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি যে, উপস্থিত দুঃখকেও তা কিয়ৎপরিমাণে ভুলিয়ে দেয় । মাদুরাই নগরীর বিরাট প্রবেশদ্বার দিয়ে কোভালন যখন ভিতরে প্রবেশ করল, তখন এ বিচিত্র নগরীর আধান তার চেতনায় এরূপে আহিত হল যে, সে কিছুক্ষণের জন্য স্বল্পপূর্বে কাভুন্দিমুখে শ্রুত বিপর্যয়-সম্ভাবনার কথা এককালে বিস্মৃত হয়ে গেল। কোভালন দেখল, একটা বিশালকায় হাতি শুঁড় দুলিয়ে নগরীর দ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে। দ্বারপালরা সেই হস্তীর প্রবেশ-ব্যাপারে শশব্যস্ত থাকায় ইত্যবসরে দ্বারের এক পাশ দিয়ে কোভালন ভিতরে চলে গেল। এই প্রবেশমার্গ সর্পিলাকারে পরিখার উপর দিয়ে সম্মুখে বিস্তৃত আছে, পরিখার জল সূর্যকিরণে চক্ চক্ করছে, তীরে সবুজ বনানী গাঢ় কজ্জলরেখার মতো নগরীকে বেষ্টন করে আছে। বনভূমির উপর দিয়ে পশ্চিমা বাতাসে উড্ডীন ব্যাঘ্রচিহ্নিত নগরপতাকা দৃষ্টিগোচর হল। পথিপার্শ্বে বুরুজের মতো দেখতে কতগুলি রহস্যময় গম্ভীর গঠন, সেই সব বুরুজ সশস্ত্র গ্রিক সৈন্যের দল গম্ভীর মুখে সতর্কভাবে পাহারা দিচ্ছে। ওই বুরুজগুলি কি কোনো অস্ত্রশালা, নাকি সৈন্যদের স্কন্ধাবার? কোভালনের মনে এতাদৃশ কৌতূহল উদ্রিক্ত হলেও এই মুহূর্তে গ্রিক সৈনিকদের নজর এড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করাই মুখ্য কাজ। সেনানীর নজরে পড়লে ওরা কোভালনকে নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে মারবে; কে তুমি, কোথা থেকে এসেছ, কোথায় যাবে, নগরীতে আগমনের কীই-বা হেতু—ইত্যাকার যাবতীয় প্রশ্ন। সন্তোষজনক উত্তর না দিতে পারলে তৎক্ষণাৎ কারাগারে নিক্ষেপ করবে। এবম্বিধ জ্বালা-ঝামেলায় পড়ার কোনো ইচ্ছা এ মুহূর্তে কোভালনের নেই। সে গ্রিক সৈন্যদের অন্যমনস্কতার সুযোগ খুঁজছিল এবং কিছুক্ষণ পরেই সেই সুযোগ মিলল। কে একজন স্থূলোদর সেনানায়ক অকুস্থলে উপস্থিত হলেন ও হস্তীমূর্খ গ্রিক সৈন্যগুলি তাঁর আপ্যায়নে সবিশেষ ব্যস্ত হয়ে পড়ল; ওদের সেই ব্যস্ততার সুযোগে কোভালন বুরুজ পার হয়ে গেল ।
মনে মনে তার কিঞ্চিৎ পুলক। প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বে সমুদ্রের মতন দিগন্তপ্লাবী সৈন্যদল নিয়ে আলেকজান্ডার ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর বিশ্ববিজয়ের স্বপ্ন কালের মুষলাঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, তিনিও অচিরেই ভারতভূম পরিত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু বন্যার জল সরে গেলেও যেমন অনুচ্চ জমিতে সেই দূষিত জল কিছুটা কিছুটা করে এখানে-ওখানে থেকে যায়, ঠিক তেমনই আলেকজান্ডারের পশ্চাদপসরণের পরেও তাঁর সৈন্যদলের খণ্ডবিখণ্ড কতিপয় অংশ ভারতে এখানে-ওখানে রয়ে যায়। উত্তর থেকে দক্ষিণ–ভারতের নানা অঞ্চলে গ্রিক সৈন্যদলের এই সব টুকরি বসবাস করতে আরম্ভ করে; দক্ষিণ ভারতে অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্যেও হাত লাগায় । যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষেরা একসময় ভারত-আক্রমণ করেছিল, তাই পাঁচশত বৎসর পূর্বের মাংসাহারের স্মৃতি তারা এখনও নিজেদের করতলে শুঁকে বেড়ায়। সবসময় কেমন যেন একটা গদাইলস্করী চাল এদের। এদের এসব চাল কোভালন পুষ্পহারেই দেখেছে। মাদুরার পাণ্ড্যরাজারা যে এই মোটাবুদ্ধি গ্রিকগুলোকে বুরুজ পাহারার শ্রমসাধ্য কাজে লাগিয়েছে, তা দেখে এ মুহূর্তে কোভালন যারপরনাই আহ্লাদিত বোধ করছিল।
বুরুজ পেরিয়েই কিন্তু নগরের প্রকৃত রূপ দেখা দিল। যেন সহস্রলোচন ইন্দ্রের অতুল বৈভবে নগরী ঝলমল করছে। এত বড়ো আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য সত্ত্বেও মাদুরাই নগরী কিন্তু এখন এক ভোগোন্মুখ প্রমোদ-জনস্থলী। সময়ে সময়ে প্রমোদের প্রাচুর্য কিছুটা অতিরিক্ত ও বটে ! অতি বিস্তৃত রাজপথ, সে-পথের পাশে মধ্যে মধ্যে সবুজ বনে ঢাকা সমুচ্চ টিলা, টিলার উপর প্রমোদ-উদ্যান। রাজপথে অলজ্জা নটী, বারাঙ্গনার দল সতত সানন্দে বিহার করছে। পুরললনারাও এ নগরীতে মুক্ত, প্রাণোচ্ছলা। মেয়েদের হাঁটার ভঙ্গীতে নৃত্যের ছন্দ, কালো কেশে যূথিকার মালা, গলায় কোরকাই বন্দরের দুর্মূল্য মুক্তার হার, মুখমণ্ডল হরিদ্রা ও চন্দনে সুচর্চিত। কোনো কোনো প্রমত্ত নাগরিক এই সব সুন্দরী মেয়েদের পিছু নিয়েছে, কেউ কেউ ইতিমধ্যেই ঘনিষ্ঠতা করেছে। অনেকে নারীসঙ্গে সবুজ টিলার উপর প্রমোদ-উদ্যানে শুয়ে বসে অলসভাবে কালহরণ করছে। জনৈক প্রমত্ত যুবক তার প্রিয়তমাকে দুই বলিষ্ঠ বাহুতে বক্ষে তুলে নিয়ে উভয়েই উতরোল হা হা-শব্দে হাসিতে ফেটে পড়তে পড়তে উদ্যানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই টিলাসমূহের পশ্চাতেই ভাইগাই নদীর নির্বারিত স্রোত, নদীর জলের উপর লাফ দিয়ে পড়ে সন্তরণপটু বালকের দল আনন্দে জলবিহার-নিরত।
রাজপথের দুপাশে সমুচ্চ হর্ম্য ও প্রাসাদ। প্রাসাদের ছাদগুলি পুষ্পমালায় অলংকৃত । আজ আকাশে আরক্তিম মেঘ, নদীবক্ষবিহারী বাতাস মন্দ মন্দ বেগে ধেয়ে এসে প্রাসাদসমূহের গবাক্ষনিষ্ঠ বস্ত্রাবরণগুলিকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতি প্রাসাদের সম্মুখেই পুষ্পোদ্যান; মাদুরাই নগরীতে পুষ্পের বৈভব যে ঈর্ষণীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো কোনো গৃহাবাস থেকে বীণার সুর, মৃদঙ্গ, করতাল ও কিনাই-বাদ্যের ধ্বনি উঠছে, কোথাও কণ্ঠসঙ্গীতের তান নিঃসৃত হচ্ছে। কোনো কোনো হর্মের সম্মুখস্থ অলিন্দে বসে পুরললনারা গুনগুন স্বরে গান গাইতে গাইতে পুষ্পমালা গাঁথছেন ।
নাগরিকাদের দ্বারা ব্যবহৃত বেশবাস ও প্রসাধন সম্ভার থেকে কোভালন এ নগরীর প্রধান প্রধান পণ্যবস্তুগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছিল। বণিকের সন্তান কোভালন, কাজেই সে-প্রয়াস তার ব্যর্থ হল না। ক্ষৌম বস্ত্ৰ, জলপাই তৈল, চন্দন, অগুরু, সুগন্ধি, কর্পূর, সুবর্ণ। হঠাৎ রাজপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকেই খুব অদ্ভুত মনে হতে লাগল কোভালনের। একদিন নারীর সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ত সে। সে ছিল সৌন্দর্যপিপাসু কবি। আর আজ সে সুন্দরের বস্তুনিষ্ঠ উপাদানগুলি খুঁজে বের করছে। তার দৃষ্টিভঙ্গীতে সমগ্রতার বোধ নেই আর এখন। এখন সে বিশ্লেষণ-তৎপর বণিক। বিহঙ্গদৃষ্টি চলে গেছে তার, এখন শুধু খুঁটে খুঁটে দেখা, এখন শুধু তার পতঙ্গদৃষ্টি।
রৌদ্র প্রখর হয়ে উঠছে এবার। বনভূমি, উদ্যানসমূহ, টিলাপাথর প্রখর তাপে শুষ্ক দেখাচ্ছে। ভাইগাই নদীর তীরে, নগরীর প্রশস্ত জলাশয়সমূহের পাড়ে জলপানের আশায় হস্তীযূথ হস্তীশাবকসঙ্গে উপস্থিত। হস্তীশিশুরা তাদের তরুণ কর্ণগুলি বিরামহীনভাবে মুহুর্মুহু দোলাচ্ছে—সে দৃশ্য বড়ো সুকুমার, বড়ো মনোরম। পথ দিয়ে সশব্দে অগণিত রথ চলেছে, পালকি-বেহারারা পালকি কাঁধে তুলে নিয়ে সরবে ‘আহোম্মা আহোম্মা’ ধ্বনি দিতে দিতে দুলতে দুলতে চলেছে, জনৈকা রাজনন্দিনী পুষ্করিণীতীরে পালকি থেকে নেমে তরুতলে তৃণভূমির উপর কোমল জাজিম পেতে বসে সখীসঙ্গে বিশ্রাম করছেন, তাঁর রত্নখচিত চিনাংশুক উজ্জ্বল রৌদ্রে ঝলমল করছে। রাজকন্যার বাম করপুটে একটি সুবর্ণনির্মিত তাম্বুলকোশ, জাজিমের উপর গাভীপুচ্ছের ঈষৎ পীতাভ চামর, সোনার পানপাত্র, ভৃঙ্গার সমস্তই মজুত আছে। রাজনন্দিনীর রক্তিম ওষ্ঠাধরে শুভ্র দশনপভুক্তি বিকশিত—তাঁর সে আনন্দোৎফুল্ল হাস্যরেখা যেন উজ্জ্বল প্রবালপেটিকায় সজ্জিত মুক্তারাজির মতন শোভমানা। *
কোভালনের মনে মাদুরাই নগরীর সঙ্গে তার নিজ শৈশবের লীলাভূমি, যৌবনের উপবন পুষ্পহার নগরীর তুলনা, প্রতিতুলনা চলছিল। মাদুরাই নগরী আয়তনে পুষ্পহারের তুলনায় বৃহত্তর, কিন্তু মাদুরাইতে পুষ্পহারের মতন নানা জাতি, নানা পরিধান বহু দিগ্দেশাগত মানুষের বিচিত্র সমাবেশ নেই। ভোগের উপচার এখানেও আছে, সেখানেও আছে, কিন্তু পুষ্পহারে ভোগচিত্র অনেক পরিশীলিত, মাদুরাইতে ভোগের ছবি স্থূল রুচির। পুষ্পহারে নাগরিক-নাগরিকার জীবন কস্তুরীর মতন সূক্ষ্ম, মাদুরাইতে নগরজীবন কষ্টিপাথরের মতন স্থূল। পুষ্পহারে জীবনযাপনে নিশ্চিন্ততা অধিক, মাদুরাইতে জীবনযাত্রা সতত অনিশ্চিত, চঞ্চল। পুষ্পহারে মানুষের মন মোটের উপর সরল—যেকোনো বাস্তব সমস্যার রৈখিক সমাধানেই তারা আগ্রহী। মাদুরাইয়ের মানুষের চোখের সামনে যেন সরলরেখা পড়েই না, যদিও-বা ক্বচিৎ কখনও পড়ে, বুদ্ধি দিয়ে তারা তাকে বক্ররেখা বানিয়ে নেয়। এমনকি বৃত্ত, উপবৃত্তেও মাদুরাই-জনতার রুচি নেই, পরাবৃত্ত বা অধিবৃত্তই বুঝি তাদের কাছে অধিক রুচিকর। পুষ্পহারে রাজা-প্রজার দূরত্ব, সতী আর নটীর সামাজিক দূরত্ব অনেকখানিই। মাদুরাইতে রাজা যেন প্রজার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটে, নটী যেন এক লহমায় গৃহাঙ্গনে প্রবেশ করে দায়িত্বশীলা গৃহবধূ হয়ে ওঠে। পুষ্পহারের লোকগুলো যে যার নিজের মতামত, নিজের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ভিন্নমতাবলম্বীদের গৃহের প্রবেশদ্বার পর্যন্ত অনুমতি দেয়। মাদুরাইয়ের মানুষ ভিন্ন মত পথের লোকদের নিয়ে অন্দরমহলে সভা বসায়। এইভাবে উভয় জনপদেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে উৎকৃষ্টতা আছে আবার উভয় নগরীরই নিজস্ব সীমাবদ্ধতাও আছে।
এসব কথা মনে মনে আলোচনা করতে করতে একসময় কোভালনের মনে হল, আর অধিককাল পথে পথে না ঘুরে বেড়িয়ে যে-কাজে আসা, সেই কাজ সমাধা করা যাক। অন্তরাপণে প্রবেশ করে পণ্যবস্তুর দরদাম ইত্যাদি পরীক্ষা করা যাক। বিশেষত সুবর্ণ রত্নাদির মূল্য কীরূপ, নির্ভরযোগ্য বিপণি কোথায়—এসব অনুসন্ধান করা প্রয়োজন । কন্নকী ও কাভুন্দি নগরবাহিরে সেই নারিকেল-উদ্যানে তারই প্রতীক্ষায় বসে আছেন, সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই সেখানে ফিরে যেতে হবে। নগরপথ ধরে আসতে আসতে কোভালন বহুস্থলে প্রেমিক-প্রেমিকাদের একত্রে অবস্থান, উপবেশন, ঘনিষ্ঠ আচার-আচরণ সমস্তই পুঙ্খানুপুঙ্খ দর্শন করেছে। সেসব দেখে বারবার তার মনে কন্নকীর কাছে যত দ্রুত সম্ভব ফিরে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু সেই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে আপাতত অবদমিত করে কোভালন গদ্যময় কর্তব্যানুরোধে ধীরে ধীরে পণ্যবীথিকায় প্রবেশ করল।
পণ্যবীথির প্রারম্ভে ধাতব সামগ্রীর বিপণি। পাথর ও ধাতু কর্তনের করাত, গজদন্ত খোদাই করার যন্ত্র, তরবারি, ঢাল, ভল্ল, ধনুর্বাণ এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার। অস্ত্রের পরেই কোমল ব্যাপারস্যাপার – ধূপ, গঁদ, রজন ও পুষ্পস্তবকের আপণ। বস্ত্ৰবিপণি— কাপড়ের গাঁট স্তূপাকৃতি; ক্ষৌমবস্ত্র, কার্পাসবস্ত্র, রোমশ পরিধান—সমস্তই থরে থরে সাজানো রয়েছে। তারপর শস্যসম্ভার—চাল, আখ, তুলা ও মশলার কারবার। সেই সব শস্যের গ্রন্থিবদ্ধ বোরা পার হয়ে কোভালন আরও একটি বৃহৎ রাজপথের চৌমাথা অতিক্রম করে অলংকার-বিপণিসমূহে সুসজ্জিত এক অন্তরাপণে প্রবেশ করল।*
চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতনই ব্যাপার! নিখুঁত সমুজ্জ্বল হীরক, সেই হীরক আবার চতুর্বিধ—শ্বেতবর্ণ, রক্তবর্ণ, পীতবর্ণ ও ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। কী তাদের দীপ্তি, কেমন উজ্জ্বল পালিশ! নির্মেঘ সবুজ পান্না, যেমন তার আকার, তেমনই জ্যোতি। রক্তপদ্ম-আকৃতির পদ্মরাগমণি, সুনীল নক্ষত্রের দীপ্তিপ্রদ নীলকান্তমণি, স্বচ্ছ স্ফটিক, সুবর্ণনির্মিত হেমালংকারের উপর বসানো মার্জারচক্ষুনিভ পুষ্পরাগমণি, আরক্তসুন্দর প্রবাল, বিভাবরীর প্রগাঢ় অন্ধকারের মতন গোমেদ, উজ্জ্বল শ্বেত ও গোলাপি মুক্তা—কী নেই এখানে? এর পরেই স্বর্ণাভরণের বিপণি। জাতরূপ, কিড়িচ্চিরাই, আড়কম্, জাম্বুনাদম্—চতুর্বিধ স্বর্ণই উপস্থিত। স্বর্ণালংকারের বৈচিত্র্যও নানাবিধ।*
এই সব অলংকার ও মণিরত্নের নানা প্রকারভেদ এবং তাদের বাণিজ্যিক আদান-প্রদানে পুষ্পহার ও মাদুরাইয়ের তুল্যমূল্য বিচার মনে মনে করে চলছিল কোভালন বিপণির এক পাশে দাঁড়িয়ে। এমন সময় পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স্ক এক পলিতকেশ স্থূলবপু ব্যক্তি তার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। সে-ব্যক্তি কোভালনকে নম্র সুরে জিজ্ঞাসা করল, ‘মহাশয় কি এখানকার ? আগে তো কখনও এখানে দেখিনি?’
কোভালন বলল, ‘না। আমি পুষ্পহারের অধিবাসী। সম্প্রতি মাদুরাই এসেছি।’
‘কিয়ৎক্ষণপূর্বে রত্ন পরীক্ষা করছিলেন। পরীক্ষার ধরন থেকে মনে হল, আপনি বণিকঘরের সন্তান। কী নাম, জানতে পারি ?
‘আমার নাম কোভালন। বণিকসন্তানই বটে! আপনি?’
‘আমি রত্ন-ব্যবসায়ী। স্বর্ণাভরণের একটি বিপণিও আমার এখানে আছে। আমার নাম—আথিয়ামান। উপযাচক হয়ে কথা বলছি বলে কিছু মনে করছেন না তো ?’
‘না, না। মনে করব কেন ?’
হাত কচলে বিমুগ্ধ হাস্যে আথিয়ামান বলল, ‘আপনি সজ্জন ব্যক্তি, উপরন্তু উদারহৃদয় । তা না হলে আজকাল কে আর কাকে বিশ্বাস করে বলুন? চলুন না, আমার বিপণি তো সম্মুখেই। একবার আভরণশিল্পের সম্ভার জহুরীর চোখ দিয়ে বিচার করে দেখবেন। ক্রয়বিক্রয়ের ইচ্ছা আছে নাকি ?’
‘আছে। তবে এখনই নয়। জেনে-বুঝে তবেই বেচব।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। এ সমস্ত বিষয়ে খুব পাকা লোক না হলে ঠকে যাওয়ারই সম্ভাবনা। আমাদের শত বৎসরেরও অধিককাল পূর্বের বিপণি। আমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ সকলেই স্বর্ণকার ছিলেন। এ আপণ তাঁদের দ্বারাই স্থাপিত। ধনলক্ষ্মীর কৃপায় আমরা কেবল বিত্তোপার্জনই করিনি, রাজানুগ্রহও পেয়েছি। বিশ্বাস, আস্থা—এই সবই তো বাণিজ্যের প্রকৃত মূলধন,’ আথিয়ামান উদার হাস্য সহকারে বলল। কোভালন দেখল, আথিয়ামানের নীচের পাটির একটা দিক দন্তশূন্য ।
আথিয়ামানের উদার ব্যবহারে আপ্যায়িত হয়ে কোভালন উত্তর দিল, ‘বেশ তো, চলুন । দেখি আপনার বিপণির স্বর্ণসম্ভার!’
স্বর্ণবণিকদের গলিপথ ধরে কোভালন আথিয়ামানের সঙ্গে তার বিপণির উদ্দেশে সহজ ভঙ্গিতেই চলতে লাগল ।
….কিন্তু আথিয়ামানের সঙ্গে কোভালন সেই দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে নিতান্ত চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে মস্যাধারে লেখনী নামিয়ে রেখে কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন ইলাঙ্গো আডিগল!
(তেতাল্লিশ) মা
আথিয়ামানের সঙ্গে কথা বলে মনে মনে বেশ তৃপ্তি অনুভব করল কোভালন । মনে হল, মানুষটি অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত। হ্যাঁ, আথিয়ামানের উপর নির্ভর করা চলে।
নগরীর হালচাল দেখে নগর-বহিঃস্থ সেই উদ্যানে সে ফিরে এল যখন, তখন অপরাহুছায়া ঘনিয়ে আসছে। কোভালন দেখল, তরুতলে কাভুন্দি ও কন্নকীর সঙ্গে জনৈক বয়স্ক মানুষ বসে আছেন ।
ধীরে ধীরে পরিচয় হল। আগন্তুক বৃদ্ধ মাঠর গোত্রীয় ব্রাহ্মণ, নাম—বিপ্রতীপ। কন্যাকুমারীতে তীর্থে গিয়েছিলেন। এখন তীর্থযাত্রা সাঙ্গ করে কাঞ্চীপুরমে ফিরছেন, সেখানেই তাঁর গৃহ। এ পথ দিয়ে যেতে যেতে নারিকেল-বিপিনে সাধ্বী কাভুন্দিকে দেখে ধর্মালাপে আগ্রহী হয়ে এসে বসেছেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সরল প্রকৃতির, কাভুন্দি ও কন্নকী তাঁর সঙ্গে বেশ সহজভাবে অন্তরঙ্গ কথাবার্তা বলছিল।
কোভালনের উদ্দেশে বিপ্রতীপ বললেন, ‘আপনার কথা সবই আপনার স্ত্রী কন্নকী ও সাধ্বী কাভুন্দির মুখে শুনছিলাম। আপনি মাশাত্ত্ববানপুত্র জেনে খুবই হৃষ্ট হলাম। পুষ্পহারে আপনাদের গৃহে একসময় আমার যাতায়াত ছিল। সে বহুদিন আগের কথা । আপনার পিতা তখন যুবাপুরুষ; তখনও দারপরিগ্রহ করেননি। আপনার পিতা বণিক মাশাত্তুবানের মুখে আপনাদের পিতৃপুরুষবর্গের অনেক কীর্তিকাহিনি আমি শুনেছি। আপনাদের বংশ তো সমুদ্রলক্ষ্মীর কৃপাপ্রাপ্ত! ‘
কথাটা শুনে কোভালন বেশ অবাক হল। বলল, ‘একথা কেন বলছেন ?’
‘সে একটা আছে ব্যাপার, মহাশয়। ঊর্ধ্বতন চারপ্রজন্ম আগে আপনারই এক পূর্বপুরুষ একবার বাণিজ্য-ব্যপদেশে সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন। ফিরবার সময় আপনার সেই পূর্বপুরুষের অর্ণবপোত এক ভয়ানক সমুদ্রঝটিকায় আক্রান্ত হয়। জাহাজ ডুবে যাওয়ার উপক্রম। কারও বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু কী আশ্চর্য! যেখানে এক লহমায় জাহাজডুবি হওয়ার কথা, সেখানে আপনার পিতৃপুরুষের বাণিজ্যতরণী তিনদিন ধরে সমুদ্রবক্ষে কোনোমতে ভাসমান হয়ে রইল। আপনার পূর্বপুরুষ আকুল হয়ে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করছিলেন। তিনদিন পর অপরূপ সৌন্দর্যময়ী এক দেবী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বললেন, “উদ্বিগ্ন হয়ো না, বৎস ! তোমার অর্ণবপোত আমি গ্রাস করব না । পূর্ব পূর্ব জন্মে তোমার বহু পুণ্যকর্ম সঞ্চিত আছে। সেই পুণ্যবলেই এ যাত্রা তুমি বেঁচে ফিরবে। তোমাদের বংশের উপর চিরকাল আমার কৃপাদৃষ্টি বজায় থাকবে, তুমি চিন্তা কোরো না।’ তখন আপনার পূর্বপুরুষ সেই দেবীকে সভক্তি প্রণাম-নিবেদনান্তর প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কে মা?’
তিনি উত্তর দেন, ‘আমি সমুদ্রলক্ষ্মী; আমার নাম মণিমেখলা।’
ব্রাহ্মণের কথায় চমকে উঠল কোভালন। বলল, ‘কী বললেন? আপনি কী নাম বললেন সেই দেবীর?
ব্রাহ্মণ উত্তর দিলেন, ‘দেবী মণিমেখলা। ইনি সাগরবক্ষে মাঝিমাল্লা ও আরোহীদের রক্ষা করেন। আগেকার দিনে বণিকেরা এই দেবীর নাম স্মরণ করেই সমুদ্রযাত্রায় বেরোতেন।’
কোভালন ভিতরে ভিতরে খুবই আলোড়িত বোধ করছিল। তাদের পরিবার-সম্পর্কিত এমন কোনো প্রবাদের কথা সে এর আগে শোনেনি। পিতা মাশাত্তুবান তাকে এই প্রবাদের কথা কখনও কিছু বলেননি। হয়তো সময় সুযোগ পাননি। কতক্ষণই আর সে পিতার কাছে কাছে থাকত? কিন্তু এ প্রবাদটির কথা না জেনেও কোভালন তার ভাবী কন্যাসন্তানের নাম ‘মণিমেখলা’ রেখেছে। সন্তান পুত্র হবে না কন্যা হবে, তার অবশ্য স্থিরতা নেই। তবু যদি কন্যা হয়, তাহলে সেই কন্যার নাম ‘মণিমেখলা’ হোক—তার সেই ইচ্ছার কথা ক-দিন আগেই মাধবীকে পত্রে লিখেছে। সেইখানেই বিস্ময়। একে কী বলবে সে, অলৌকিক যোগাযোগ, নাকি সমাপতন?
বিপ্রতীপ ব্রাহ্মণ বলে যাচ্ছিলেন, ‘এই একটু আগেই সাধ্বী কাভুন্দি বলছিলেন প্রাক্তন কর্মের কথা। কিন্তু পূর্বজন্ম কে দেখেছে? কে জানে? আর পূর্বজন্মের অশুভ কর্মগুলিই কি শুধু সঞ্চিত থাকে, শুভ কর্ম সঞ্চিত থাকে না? তা ছাড়া এই জন্মেরও তো শুভাশুভ কর্মের ফল মানুষের উপর অর্শাবে, নাকি? কিছুক্ষণ আগে আপনার স্ত্রী কন্নকী তো বলছিলেন, এই জীবনেই আপনি কত ভালো কাজ করেছেন। তো সেসব সুকৃতির কি শুভ ফল পাওয়া যাবে না ?’
কোভালন ভাবছিল, কন্নকী আবার তার সম্পর্কে কীসব ভালো ভালো কথা ব্ৰাহ্মণকে বলল? সে সংকুচিতভাবে জানাল, ‘আমি আপনাদের কর্মতত্ত্ব ভালোমতো বুঝতে পারি না। জীবনে ভালো কাজ আর ক-টাই-বা করেছি? তাই হয়তো আমাকে এত ভুগতে হচ্ছে।’
বিপ্রতীপ বললেন, ‘কেন? এই যে আপনার স্ত্রী বললেন, এক সৎ নিলোর্ভ ব্রাহ্মণকে একটা পাগলা হাতি আক্রমণ করেছিল। আপনি সেই অসহায় মানুষটিকে উন্মত্ত হস্তীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। পুষ্পহারের আরেক ব্যক্তি সামান্য কারণে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছিলেন। আপনি তাদের মিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মঙ্গলকামনায় যজ্ঞকর্মের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তারপর এক সতী স্ত্রীলোক; তার স্বামীকে কেউ তার সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছিল। যে-ব্যক্তি স্বামীকে ভুল বুঝিয়ে তাদের সম্পর্ক ভাঙতে চেয়েছিল, সেই কুচক্রী লোকটির উপর পরে ভূতাবেশ হয়। তখন সেই কুচক্রী লোকটির বৃদ্ধা মায়ের কান্না দেখে আপনি করুণাপরবশ হয়ে প্রেতের কাছে প্রার্থনা করেন, লোকটিকে ছেড়ে দিতে । তাতে আপনার প্রার্থনা অবশ্য বিফল হয়, কুচক্রীর মৃত্যু প্রেতের হাতেই হয়েছিল। কিন্তু তখন আপনি সেই পুত্রহীন বৃদ্ধাকে আমৃত্যু ভরণপোষণ করেছিলেন। অন্যদিকে সতী স্ত্রীলোকটির স্বামীকে বুঝিয়ে ছিলেন যে, স্ত্রীর কোনো দোষ নেই। সমস্ত কুৎসাই অমূলক। ওদের দুজনকেও আপনি মিলিয়ে দিয়েছিলেন। তো এই সব সৎ কর্মগুলোর শুভ ফল কোথায় যাবে? এগুলো কি বাতাসে মিলিয়ে যাবে? এসব সৎ কর্মের ফলে আপনার কল্যাণই হবে।’
কোভালন খুবই লজ্জিত বোধ করছিল। এগুলো তার জীবনের সত্য ঘটনাই বটে! জীবনে কত কী ঘটে, সব কি আর মনে রাখা যায়? কোভালনও ভুলে গেছিল এসব। কিন্তু আশ্চর্য, কন্নকী এসব এত যত্ন করে মনে রেখেছে? স্বামীর ভালো কাজগুলি পরম মমতায় মনে রেখেছে কন্নকী, এসব নিয়ে স্বামীর জন্যে তার চাপা গর্ববোধ… এই কন্নকীকে তো কোভালন কখনও চিনতে পারেনি। কত অগভীরভাবে সে কন্নকীর মূল্যায়ন করেছিল, শুধু তার অপার্থিব রূপের কাছে নিজের কল্পনা হতমান হয়ে পড়েছিল বলে অভিমান করে কন্নকীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে। সহসা জীবনকে বড়ো রহস্যময়, বড়ো আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল কোভালনের। কেন যে সময় থাকতে সে জীবনের মূল্য বুঝল না !
মনের সেই হাহাকারকে বাইরে প্রকাশিত হতে না দিয়ে কোভালন বলল, ‘এমন কাজের সুযোগ হয়তো প্রতিটি মানুষের জীবনেই কখনও-না-কখনও আসে। আমি ঠিক জানি না এসবের মানে কী। তবে আজকাল বড়ো আতঙ্কের স্বপ্ন দেখি আমি। কেন যে এমন হচ্ছে… হয়তো পূর্বকৃত কোনো অসমাপ্ত কর্মের ফল !’
বিপ্রতীপ সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন কেমন? কী দেখেন স্বপ্নে?’
‘দেখি… যেন এক অপরিচিত নগরীতে আমি প্রবেশ করছি… কোন এক কুচক্রীর পাল্লায় পড়ে গেছি আমি… কারা যেন আমার পরিধেয় বস্ত্র ছিঁড়ে দিচ্ছে… অপমান করছে…. আমার স্ত্রী কন্নকী খুব কষ্ট পাচ্ছে সে জন্যে… আমাকে কতগুলো লোক একটা ভয়ংকর মহিষের পিঠে চাপিয়ে সারা নগর তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে… তারপরে কোথা থেকে কন্নকী এসে আমাকে খুব সুন্দর এক স্থানে নিয়ে যাচ্ছে… আবার অন্য কে একটি সুন্দরী মেয়ে পিতৃপরিচয়হীনা এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে… সেই কন্যাটিকে বৌদ্ধ বিহারে এক শান্তস্বভাবা ভিক্ষুণীর হাতে সঁপে দিচ্ছে মেয়েটি…. জানি না, এসব স্বপ্নের অর্থ কী!’
কোভালনের কথা শুনতে শুনতে এবার কন্নকীর বিস্মিত হওয়ার পালা। এসব দুঃস্বপ্নের কথা কখনও তাকে বলেনি তো কোভালন ঘুণাক্ষরেও ? মনে এত কষ্ট পুষে রেখেছে স্বামী? এত কল্পনাপ্রবণ মানুষ ! তাহলে কখনও ওর কল্পনার জগৎটাকে বুঝেই তো উঠতে পারল না কন্নকী। এখন খুব খেদ হয় তার। দোষগুণ নিয়েই রক্তমাংসের মানুষের জীবন। শুধু নৈতিকতার নিরিখে সে তার স্বামীকে আজীবন বিচার করে গেল। কোনোদিন বুঝতে পারল না স্বামীর খেয়ালিপনা, তার জেদ, তার কল্পভুবনকে। কোভালনের দুঃস্বপ্নের বিবরণ শুনে ভিতরে ভিতরে শঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল কন্নকীর। কী জানি কোন অশুভ অর্থ এসব স্বপ্নের! কে জানে কোন অমঙ্গল ভবিষ্যতে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে!
বিপ্রতীপ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘সব স্বপ্নের কি আর অর্থ হয়, মহাশয় ? আমার তো মনে হয়, এসব স্বপ্ন আপনার উদ্বিগ্ন মনের ফলাফল। ওসব খুঁটিনাটি নিয়ে মনকে আর দুর্বল করবেন না। দুর্বল মন দুঃস্বপ্নের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওই দুঃস্বপ্নের অনুরূপ কার্যই করে বসে। আশায় বুক বাঁধুন। পূর্বের অশুভ কর্মফলগুলি যদি হিংস্র পশুর মতো আপনার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বার জন্য উদ্যতও হয়ে থাকে, তাহলে আপনার শুভকর্মের ফলগুলিও দেবদূতের মতো আপনাকে রক্ষা করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আর ওসব ভাববেন না। কর্ম, কর্ম, কর্ম ! আমাদের বৈদিক, বৌদ্ধ আর জৈনদের এই এক বুলি । আরে বাবা, কর্মফলই যদি সব কিছুর নিয়ন্তা হয়, তাহলে আর ঈশ্বরকে ডাকার কী দরকার? কর্মফলেই তাহলে যা ঘটার ঘটুক! ওসব ছেড়ে আপনি বরং সেই করুণাময় ঈশ্বরকেই প্রাণভরে ডাকুন, মানুষকে তার অশুভ কর্মফল থেকে তিনি চাইলে বাঁচাতেও তো পারেন, না কি?’
শেষ কথাটা বলে বিপ্রতীপ অপাঙ্গ দৃষ্টিতে কাভুন্দির দিকে একবার তাকালেন। কিন্তু কাভুন্দি বিপ্রতীপের কথার কোনো উত্তর দিলেন না। বিপ্রতীপের বিশ্বাস আর কাভুন্দির বিশ্বাস একপ্রকার নয়। ও নিয়ে কোনো তর্কে প্রবৃত্ত হলেন না কাভুন্দি।
বিপ্রতীপকে বেশ নতুনরকম লাগল কোভালনের। নিষ্ঠাবান তীর্থসেবী ব্রাহ্মণ । কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে সাহসী বিপ্রতীপ। সর্বোপরি কোনো স্থবির বিশ্বাসের কাছে কেউ হার মানবে, এ সহ্য হয় না তাঁর। নতুন একটা আশার আলো কোভালন দেখতে পাচ্ছে এই প্রশ্নশীল ব্রাহ্মণ বিপ্রতীপের কথাবার্তায়।
একটু পরে বিপ্রতীপ বললেন, ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমি এবার যাব। আপনারাও আর দেরি না করে কোথাও রাতের আশ্রয় অন্বেষণ করুন। মঙ্গলমস্তু!’ এই বলে তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
সন্ধে হয়ে আসছে ঠিকই। পশ্চিমাকাশ করুশ রঙিন হয়ে উঠছে ক্রমশ। সন্ধ্যাসবিতা ম্লান রক্তপলাশ সদৃশ। সাম্প্রত-বিধবার সদ্যোধৌত কপালের অন্তিম সিন্দুরাভা ছড়িয়ে পড়ছে আবিশ্ব চরাচরে। পশ্চিম দিগন্তের নীচে জ্বলমান চিতাগ্নি, তারই আগুন থেকে ঠিকরে ওঠা বিস্ফুলিঙ্গ যেন আকুল করে তুলেছে আকাশ, বাতাস। পাটল মেঘমালার প্রান্তে প্রান্তে সে-আগুনের আঁচ, বৃক্ষশীর্ষে তারই উত্তাপ, শূন্য মাঠের নিশিডাক-লালসায়, পথের দিশাহারা নির্মুক্তিতে, পরিখাজলের শান্তস্রোত উপরিতলে, অদূরস্থ মাদুরাই নগরীর সুকঠিন কঙ্করময় প্রাকারের গাত্রে সেই বিলীয়মান আলোরই করুণা। আর এই অপসৃয়মাণ আভার ভিতর দিয়ে নগরীর গোপালকরা ঘরে ফিরছে গবাদিযূথ সঙ্গে। গোখুররেণু মাটি থেকে আকাশে উঠে মিশে যাচ্ছে অস্তাভায়। আকাশ অনন্ত, মাঠঘাট দিকচিহ্নহীন, প্রত্যাবৃত গোধনও অগণন—সর্বত্র এক উদাসীন অন্তহীনতার ইমন বেজে উঠছে অদৃশ্য কোনো রুদ্রবীণায়।
এই ম্লানিমার ভিতর কাভুন্দি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। কোভালন ও কন্নকীও তাঁকে অনুসরণ করে উঠে দাঁড়াল। কাভুন্দি কোভালনকে বললেন, ‘দ্যাখো বাবা, শুনেছি নগরীর বাহিরে জৈন উপাসক-উপাসিকাদের একটি মন্দির আছে, আমি সেখানেই আশ্রয় নেব । কিন্তু তোমাদের সেখানে নিয়ে গিয়ে কী উপকার হবে, কেননা তোমরা তো মাদুরাই নগরীতে জীবিকার সন্ধান করতে চাও, তার জন্য নগরে প্রবেশ প্রয়োজন, কী উপায় করি… সঙ্গে তোমার এই সুন্দরী অল্পবয়স্কা বধূ… কোথায় আশ্রয় পাবে…’
কাভুন্দিকে চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছিল। তাঁর সে-চিন্তার উপশমনার্থে কোভালন কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই নারিকেলবীথির পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক গোপালিকা বৃদ্ধা, সাধ্বী কাভুন্দিকে দেখে, অনুচর বালকদের হাতে গোধনের দায়িত্ব দিয়ে উদ্যানমধ্যে ধীর পায়ে উপস্থিত হলেন। সেই বৃদ্ধা গোপালিকা শ্রদ্ধাভরে কাভুন্দির চরণবন্দনা করে ঋজুরেখ দীপশিখার মতো নম্র ভঙ্গিমায় একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাভুন্দি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কে, বাছা ?’
আগন্তুক বৃদ্ধা বললেন, ‘অধীনার নাম মাদারি। আমি গোপালন করে থাকি । দিনশেষে গোরু চরিয়ে ঘরে ফিরছিলাম, আপনাকে দেখে প্রণাম নিবেদনের ইচ্ছা হল।’
‘কোথায় তোমার ঘর ?’
‘নগরমধ্যে গোপপল্লী আছে। সেই পল্লীতেই আমরা সব থাকি।’
কাভুন্দি চোখ বুজে কী যেন চিন্তা করছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে জৈন মন্দির কোথায় আছে, বলতে পারো ?’
মাদারি বললেন, ‘আমি সেখানে যাই তো, মা ! এই তো বনবীথির পূর্বকোণে পরিখার এপারে। তাঁরাও ময়ূরপালন করেন। আপনার হাতে ও ময়ূরপাখাটি দেখে ভাবলাম, আপনিও বুঝি সেই মন্দিরেরই সাধ্বী।’
‘তুমি কি আমার একটা উপকার করতে পারবে?’ কাভুন্দি জিজ্ঞেস করলেন।
‘আদেশ করুন, মা। আপনার কোনোরূপ সেবা করতে পারলে আমি নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করব,’ মাদারি উত্তর দিলেন।
‘বেশ, তবে আমার একটি কাজ করে দাও। এই যে মেয়েটিকে দেখছ, এর নাম কন্নকী, একে আমার সেবিকা বলতে পারো। আর এ হচ্ছে কোভালন—কন্নকীর স্বামী। এরা খুব বড়ো ঘরের সন্তান। কিন্তু ইদানীং ভাগ্যবিপর্যয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। জীবিকার সন্ধানে এরা মাদুরাই এসেছে। কিন্তু এদের কোনো থাকার জায়গা নেই। তুমি কি এদের জন্য কিছু করতে পারো ?’
মাদারি বললেন, ‘এঁরা যদি চান, তবে আমার ঘরে থাকতে পারেন। তবে আমি অত্যন্ত দরিদ্র। এঁদের উপযুক্ত সেবা করতে পারব কি না, কে জানে !’
কাভুন্দি বললেন, ‘পারবে। তোমার পক্ষে যা সম্ভব, তাতেই হবে। এদের পিতামাতার পরিচয় পেলে নগরের বহু সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ হয়তো এদের আতিথ্যের আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। কিন্তু তাতে এই কথা জানাজানি হবে যে, বিত্তবান বণিক মাশাত্তুবানের পুত্র ও পুত্রবধূ নিঃস্ব হয়ে মাদুরাইতে আশ্রয় নিতে এসেছে। তাতে এদের সম্মানহানি হবে, লোকে করুণার চোখে দেখবে। আমি তা চাই না। আমি চাই, স্বল্পকালের মধ্যে কোভালন উপার্জনের কোনো একটা উপায় খুঁজে বের করুক। তারপরে না হয় সস্ত্রীক অন্য কোথাও উঠে যাবে। কিন্তু ততদিন অবধি তুমি কি এদের তোমার বাড়িতে থাকতে দিতে পারবে? বেশি দিন নয়, হয়তো কয়েকটা মাস ।’
অতি উৎফুল্ল চিত্তে মাদারি বললেন, ‘এ তো আমার পরম সৌভাগ্যের বিষয়, মা ! যদি এঁরা আমার আতিথ্য স্বীকার করেন, আমি যথাসাধ্য সেবা করব।’
কাভুন্দি বললেন, ‘হ্যাঁ, বাছা! তোমার জন্যে এ মহাপুণ্যপ্রদ কর্ম হবে, সন্দেহ নেই । নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দেওয়া, নিরন্নকে অন্ন দান, সর্বোপরি স্বার্থশূন্য ভালোবাসার মতো পবিত্র সাধনা ত্রিজগতে আর কিছুই নেই। তবে আমার এই মেয়েটি….’ এই পর্যন্ত বলেই কাভুন্দি স্নেহভরে কন্নকীর গাল ও চিবুক স্পর্শ করে কম্পিত স্বরে বলতে লাগলেন, ‘এ মেয়েটি আমার বড়ো কষ্ট পেয়েছে। এমন পবিত্র চরিত্রসম্পন্না কন্যার এত কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। দীর্ঘ পথশ্রমে ও বড়ো ক্লান্ত। ওকে তুমি ঘরে নিয়ে গিয়ে ভালো করে স্নান করিও। ওর এই দুটি ডাগর ডাগর চোখে কাজল পরিও। চুল বাঁধেনি কতদিন, মাথায় একটু সুগন্ধি দিয়ে চুল বেঁধে দিও ওর। ভালো কাপড় নেই, যদি থাকে তোমার কাছে পরিষ্কার ধোয়া কাপড়, পরতে দিও ওকে। পা দুটো এই দীর্ঘ পথে চলতে চলতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, ঝামাপাথর দিয়ে ঘষে মসৃণ করে আলতা পরিয়ে দিও। বড়ো ভালো মেয়েটি আমার, শুধু শুধু এত কষ্ট পেল। যত্ন নিও, বাছা, যত্ন নিও অনেক আদরের ধন তোমার হাতে তুলে দিলাম আজ। শাস্ত্রে আছে, যেখানে মেয়েদের আদর, মেয়েদের সম্মান করা হয়, সেখানেই দেবতারা আনন্দে নৃত্য করেন। সেখানেই সব শান্তি, সব সমৃদ্ধি। যাও বাছা, ওদের নিয়ে যাও,’ বলতে বলতে কাভুন্দি তার মুখ একপাশে ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি দরবিগলিত ধারে কাঁদছেন ।
মাদারি বললেন, ‘আপনি কিছু চিন্তা করবেন না, মা! এঁরা আমার কাছে স্বস্তিতেই থাকবেন। আমি এঁদের লক্ষ্মী-জনার্দনের মতো… না, না, আমি এঁদের আমার নিজের পেটের ছেলেমেয়ের মতনই সেবা করব!’
কাভুন্দি অনেকক্ষণ ধরে কন্নকীকে বুকে ধরে রাখলেন। তারপর কন্নকী ও কোভালন ভূমিষ্ঠ হয়ে কাভুন্দিকে প্রণাম জানাল। কাভুন্দির চরণধূলি মাথায় নিয়ে ওরা বলল, ‘তাহলে আসি, মা!’
ইতিমধ্যে কাভুন্দি নিজেকে সংযত করার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। কন্নকী-কোভালনের শিরোপরি আশীর্বচনের হাতখানি রেখে কাভুন্দি বললেন, ‘এসো। জানি না, আমাদের আর দেখা হবে কি না। তবে দেখা হোক আর নাই হোক, মাদুরাইতে যাই ঘটুক, সর্বাবস্থায় সর্বক্ষণে জানবে, আমার আশীর্বাদ, আমার ভালোবাসা তোমাদের ঘিরে রইবে !’
কোভালন ও কন্নকী মাটি থেকে তাদের পুঁটুলি ও যষ্টি তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে মাদারির সঙ্গে নগরাভিমুখে চলতে আরম্ভ করল। যতবার ওরা পেছন ফিরে চাইছিল, ততবারই সেই নারিকেল-বিপিনের প্রান্তে কাভুন্দি স্থির দাঁড়িয়ে আছেন, দেখতে পাচ্ছিল। যেন যতক্ষণ দেখা যায়, ততক্ষণ তিনি ওদের যাত্রাপথ তাঁর স্নেহদৃষ্টি দিয়ে সুরক্ষিত করে দিতে চাইছিলেন।
কন্নকীও কাঁদছিল খুব। যেন বিবাহের এত বছর পর, আবার মা-কে ছেড়ে সে আজ আরেক অজ্ঞাত পৃথিবীর দিকে যাত্রা করেছে। কোভালন ভাবছিল, সংসারবিযুক্তা কঠোর তপস্বিনীর মধ্যেও কত করুণা, কত সন্তানস্নেহ, কত ভালোবাসা !
নগর-প্রাকারের কাছে এসে আবার একবার ফিরে তাকাল কন্নকী। না, এখান থেকে আর কাভুন্দিকে দেখা যাচ্ছে না। মাঠে-ঘাটে সন্ধ্যার সান্দ্র অন্ধকার নেমে এসেছে।
(চুয়াল্লিশ) পরবাস
মাদারির এ গৃহে আশ্রয় নেওয়ার পর প্রায় দেড়মাসের অধিক কাল কেটে গেছে। কোভালন প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যায়, মাঝবেলায় ঘরে এসে আহারাদির পর খুব অল্প সময় বিশ্রাম নেয়, তারপর আবার পথে বেরিয়ে পড়ে। রাত হলে ঘরে ফেরে। কন্নকীর নূপুর বিক্রয় না করে যদি অন্য কোনো উপায়ে ছোটোখাটো কিছু ব্যবসা আরম্ভ করা যায়, সেই চেষ্টাই কোভালন করে চলেছে প্রত্যহ । কিন্তু এখনও অবধি তার প্রয়াস সাফল্যের মুখ দেখেনি। কী করেই বা দেখবে? অন্তরাপণ থেকে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি কিনে পথে পথে ফেরি করেও দেখল কিছুদিন, কিন্তু তা দিয়ে দিন-আনি-দিন-খাইয়ের জীবন চালানো সম্ভব; স্থায়ী ব্যবসার জন্যে যে-মূলধন প্রয়োজন, তা জোটানোর উপায় কীভাবে হবে ? সুবর্ণ, রত্ন বা মশলার আপণে অধস্তন কর্মী হিসেবে সে যোগ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু মাদুরাইতে সে অপরিচিত ব্যক্তি, কেউই তাকে এখানে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। কথাটা সে স্বর্ণকার আথিয়ামানকেও লজ্জার মাথা খেয়ে বলে দেখেছিল, কিন্তু আথিয়ামানও…. ‘আপনি কত বড়ো ঘরের ছেলে, সামান্য কর্মচারীর কাজ কি আপনাকে মানায় ?’ বলে কোভালনের প্রস্তাব এড়িয়ে গেছে। আথিয়ামান আলাপী লোক, এ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু কোভালনকে সে বিপণির কোনো কার্যে নিয়োগ করবে, এতটা বিশ্বাস ও অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক তো গড়ে ওঠেনি। এখনও অবধি তাদের বর্তমান সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি।
উনুনে রান্না চাপিয়ে দুয়ারে বেরিয়ে এল কন্নকী। উনুনের কাছে এর মধ্যেই ফিরে গেছে আইয়াই। সে আর আইয়াই মিলেই রান্নাবান্না করে। গোপালক-গোপালিকাদের সঙ্গে বৃদ্ধা মাদারি গবাদি পশু নিয়ে সকালেই বেরিয়ে পড়েন, তাঁদের খাবার তখনই বেঁধে দিতে হয়। তার এক ঘড়ি পরে গৃহের অবশিষ্ট সদস্যদের জন্যে রান্না করতে বসে আইয়াই আর কন্নকী। অবশিষ্ট সদস্য বলতে সে, কোভালন, আইয়াই আর আইয়াইয়ের খঞ্জ ভ্রাতা। আইয়াই বালবিধবা, তার ভাই চিত্তিরাই জন্ম থেকেই পঙ্গু; এ পরিবারে আপাতত এই ক-জনই মানুষ।
মাদারির ঘরখানি লাল মাটি দিয়ে লেপাপৌঁছা, সামনে মাটির একহারা উঠান। উঠানের চারিপাশে কলমিলতার বেড়া দেওয়া। বেড়ার ফটক পেরিয়ে ধুলামাখা পথ পল্লীর মধ্য দিয়ে নগরের রাজপথে গিয়ে মিশেছে। এ পল্লীর সকলেই গোপালক, প্রত্যেক গেরস্থালির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট গোশালা আছে। গোরু ছাড়াও ছাগ ও মেষপালনও করে এরা। সকাল থেকেই বাতাস গবাদিপশুর রবে পরিপূর্ণ। পল্লীর একদল লোক সূর্য ওঠার একটু পরেই গোচারণে বেরিয়ে যায়, আরেকদল যায় বনে কুড়াল, কর্তরী কাঁধে গোখাদ্য সংগ্রহের জন্যে। আরও একদল বাঁকে করে দুধ, ঘোল, মাখন ইত্যদি ফেরি করতে বেরিয়ে পড়ে নগরের দিকে। দুধ-দই বেচে গোয়ালার মেয়েরা যতটুকু উপার্জন করে, তাই দিয়ে সংসারযাত্রা নির্বাহ হয়। তারও পরে টুকিটাকি যতটুকু বাঁচাতে পরে, সেই উদ্বৃত্ত অর্থে হাটে গিয়ে তারা মাঝেমধ্যে কঙ্কণ কেনে, বলয় কেনে, কর্ণাভরণ কিনে আনে। সেই নিয়ে সরলা গোপবালিকাদের ভারি গর্ব।
কন্নকী আর কোভালনকে নিয়ে মাদারি যেদিন সন্ধ্যায় এ ঘরে ফিরেছিলেন, পল্লীর মেয়েরা সব দল বেঁধে দেখতে এসেছিল। কন্নকীর মতো সুন্দরী মেয়েকে দেখে তারা তো সব হতবাক। নিজেদের মধ্যে ফিশফিশ করছে, এ ওকে ঠেলা মেরে হাসছে, ‘বলছে, ও মা! কী সুন্দর মেয়ে আর তার কী সুন্দর বর দ্যাখ ! আঈ কোত্থেকে এত সুন্দর জুড়ি নিয়ে এল গো ঘরে ? মনে হয়, গোমাতার আশীর্বাদ পেয়েছে গো, আঈ ! কিন্তু মেয়েটার গায়ে গয়না নেই কেন? হাত-গলা-কান সব ফাঁকা ! আহা গো! এত সুন্দর মেয়ের গায়ে গয়না নেই একটাও ?’
ওই সব শুনতে পেয়ে মাদারি রাগ করে গলা তুলে বলেছিলেন, ‘শুধু গায়ে গয়না পরলেই হয় না। যে সত্যিকারের সুন্দরী, সুন্দর যার মন, তাকে আর আলাদা করে গয়না পরতে হয় না গায়ে। ওদের দুজনকে কিছু বলিসনি তোরা ! সাধ্বী মা কাভুন্দি ওদের ভার আমার হাতে দিয়েছেন, বুকে করে রাখতে বলেছেন, বুঝলি লা? ওরা আসতে আমার ঘরের উঠানটা যেন আলো ঝলমলে হয়ে গ্যাছে। এই গাঁয়ের মেয়েরা, তোরা এখন যা দিকি যে যার কাজে ! আইয়াই, তুই কন্নকীকে পুকুরঘাটে নিয়ে যা নাইতে। অনেক পথ হেঁটে এসেছে গো, অনেক পথ হেঁটে এসেছে। আজ ওরা নেয়ে-খেয়ে ঘরে শান্ত হয়ে বিশ্রাম করুক। কালকে না হয় সব মেয়েরা আসবিখন ওদের সঙ্গে কথা কইতে, হ্যাঁ !’
প্রথম প্রথম তাকে কোনো কাজে হাত লাগাতে দিতেন না মাদারি। কিন্তু কতদিন আর কাজ ছেড়ে থাকা যায় ? মাদারি ও আইয়াইয়ের আপত্তি সত্ত্বেও নিজে থেকেই এই রান্নার কাজে ব্যাপৃত হয়েছে কন্নকী ধীরে ধীরে। কাজ নিয়ে তত কিছু সমস্যা নেই, কেননা পুষ্পহারে পিত্রালয়ে কিংবা শ্বশুরালয়েও তো সে সারাদিন কোনো না কোনো কাজ নিয়েই থাকত। কিন্তু এমন পরিবেশে সে কখনও থাকেনি। কত বিত্তবান মানুষের মেয়ে সে, কত বিত্তবান ঘরে তার বিবাহ হয়েছিল। এতটা শারীরিক কষ্টে সে অভ্যস্ত নয় একেবারেই। কিন্তু সেকথা সে কাউকে বুঝতে দেয় না। সে জানে, তার স্বামী এ মুহূর্তে উপার্জনহীন, তারা পুরোপুরি এ গৃহে আশ্রিত, মানিয়ে তো নিতে হবেই। মানিয়ে নিলে তখন আনন্দেই থাকা যাবে। কানে দুল পরলে প্রথম প্রথম তো কষ্টই হয়, কান ব্যথা করে, কিন্তু দিন পনেরো পরে সেও সয়ে যায়। তখন কানে যে কিছু পরে আছে, তা আর মনেই থাকে না । মেয়েদের এমন অনেক নিজস্ব যুক্তি আছে, সেসব যুক্তি খণ্ডন করারও উপায় নেই, কেননা বাস্তব উদাহরণের উপর সেসব যুক্তি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেই যুক্তি দিয়ে মেয়েরা কীভাবে যে নিজেদের মনকে মানিয়ে নেয়, সে-রহস্য মেয়েরা ছাড়া অন্য কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে বলে মনে হয় না। কন্নকী কল্পনা করে, হয়তো পুষ্পহারেই তার পূর্বজন্ম শেষ হয়ে গেছে, তারপর আবার এখানে মাদারির ঘরে তার নতুন জন্ম আরম্ভ হয়েছে। এইভাবে সে মনকে প্রবোধ দেয়; কিন্তু পূর্বজন্মের তো স্মৃতি থাকে না, এক্ষেত্রে তার পুষ্পহারের স্মৃতি মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। কীভাবে সে তার পূর্বজীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে যাবে ? এই ‘কীভাবে ভুলে যাবে’ ব্যাপারটার মীমাংসা একমাত্র নারীমনেই সম্ভব, সে রহস্যের সমাধান পুরুষের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব ।
সকাল গড়িয়ে দ্বিপ্রহর এল। কেমন স্তব্ধ চারিদিক। কোভালন ঘরে ফিরল। তার মুখে হতাশার কালো মেঘ। নিশ্চয়ই আজও কিছু করে উঠতে পারেনি কোভালন কন্নকী তাকে খেতে দিল মাটিতে চাটাই পেতে। কলাপাতায় ভাত বেড়ে দিল। আইয়াই নিয়ে এল মৃৎপাত্রে ডাল, তরকারি আর দুধ । জলপাত্র থেকে দক্ষিণ করপুটকোশে জল নিয়ে কোভালন আচমন করল। মাটির পাত্র থেকে ডাল নিয়ে ভাতে মাখতে লাগল । কাছে বসে কন্নকী তালপাখায় বাতাস করছে। আইয়াই ফিক করে হেসে বলল, “তোমাদের না একসঙ্গে দেখলে মনে হয়, ঠিক যেন শ্রীকৃষ্ণ আর রুক্মিণী !”
কন্নকী তার দিকে ছদ্মকোপে চোখ পাকিয়ে তাকাল । হাসতে হাসতে আইয়াই পালাল অমনি পাকশালা ছেড়ে। *
কোভালন নিঃশব্দে ভাত খেতে লাগল। একবার শুধু মুখ তুলে গম্ভীরভাবে বলল, ‘তুমিও তো খেতে বসে গেলেই পারতে।’ কন্নকী সেকথার কোনো উত্তর দিল না, যেমন পাখা করছিল, তেমনই পাখা করতে লাগল ।
কোভালন খেয়ে উঠে গেলে আইয়াইকে নিয়ে কন্নকী খেতে বসল। কোভালন পাশের ঘরে বিশ্রাম করছিল।
খাওয়ার পর জাঁতিতে সুপুরি কুচিয়ে পান সেজে ও ঘরে গেল কন্নকী। দেখল, কোভালন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছাদের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে।
কোভালনকে পান দিয়ে জিজ্ঞেস করল কন্নকী, ‘আজও কিছু হল না, না ?’
পান মুখে দিয়ে এক দিকে পাশ ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোভালন সংক্ষেপে বলল, ‘নাঃ!’ তারপর একটু থেমে চিন্তামগ্ন মুখে বলল, ‘কেউ কাজ দিতে চায় না। ছুটকোছাটকা জিনিস নিয়ে হট্টে বসেও ক-দিন দেখলাম, যা আয় হচ্ছে, তা দিয়ে ব্যবসা খোলার কথা চিন্তা করাও বাতুলতা। কী করতে যে মাদুরাই এলাম! না এসেও অবশ্য তখন আর অন্য উপায় ছিল না। নিরুপায় হয়েই এখানে আসা ! ‘
কন্নকী মনে মনে অনেক কথা তোলাপাড়া করছিল। কোন ঘরের ছেলে কোভালন ! আর কেমন ভাবুক প্রকৃতির মানুষ সে! কিন্তু ভাগ্যবিপর্যয়ে আজ কী দশা! রোদে রোদে হতাশ মনে ঘুরছে সারাদিন পথে পথে। কোনো উপায় হচ্ছে না। এদিকে দেড়মাস কেটে গেল, কতদিন আর এই পরের ঘরে রোজগারপাতি ছাড়া পড়ে থাকা যায় ?
একটু পরে কন্নকী বলল, ‘একটা কথা বলব?’
কোভালন নিরুৎসাহিত ভঙ্গীতে উত্তর দিল, ‘তুমি কী বলবে, আমি জানি।
কন্নকী বলল, ‘ব্যস, জানো যখন, তখন তাই করো। আর কতদিন এভাবে পথে পথে ঘুরবে? আমার কথা শোনো।’
কোভালন বলল, ‘ওই নূপুরজোড়াই তোমার শেষ সম্বল, কন্নকী। ওতেও থাবা বসাতে আমার মন চায় না।’
কন্নকী বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা কেন বুঝছ না, বলো দেখি? আমার গয়না কি তোমারও নয়? এত আমার-তোমার করছ কেন? দাও না বেচে ওগুলো। ভালো দাম পাবে। তাই দিয়ে নতুন ব্যবসা খুলে চলো এবার এদের ঘর থেকে উঠে যাই।’
কোভালন বলল, ‘আমি যদি নিজেই একটা কিছু করতে পারি, তাহলে…’
কন্নকী বলল, ‘তোমার কি আত্মাভিমানে লাগছে? অভিমানের সময় নয় এখন, কোভালন!’
কোভালন ভাবতে ভাবতে বলল, ‘আত্মাভিমান? না, আত্মাভিমান নয়। আত্মাভিমানের আর বাকি রেখেছি কী ? রোদে রোদে এর-ওর দুয়ারে ঘুরে ঘুরে আত্মাভিমান পুড়িয়ে ছাই করেছি। কিন্তু নূপুর দুটো আমারও যে খুব প্রিয়। আমাদের বিয়ের পরের পরের স্মৃতি । স্মৃতি কি কাউকে ছাড়ে, বলো? তোমার পায়ে পায়ে ওদের নিক্বণধ্বনি চোখ বুজলেই আজও শুনতে পাই যে আমি ।’
কথা বলতে বলতে সে কন্নকীর কানের লতি ছুঁয়ে আদর করছিল। কর্ণপুট থেকে কোভালনের হাত আলগোছে সরিয়ে কন্নকী হঠাৎ চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “আচ্ছা, শোনো না, একটা উপায় তো আছেই। যদি বন্ধক দাও ?”
‘বন্ধক দিয়ে টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করে, পরে আমার ব্যবসা ধরো যদি না সফল হয়… সফল তো না হতেই পারে, ব্যবসা মাত্রেই কিন্তু ঝুঁকির ব্যাপার; তখন সুদসমেত ঋণশোধ করে ওই দুর্মূল্য বস্তু ঘরে ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে যে কন্নকী ! সে কি আর আমি অন্তরাপণের ব্যাপারীদের সঙ্গে বুঝে দেখিনি, ভেবেছ? সে অনেক সমস্যা।’
কন্নকী যেন একটু নিভে গেল। তারপর ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ কী যেন ভাবতে লাগল। অতঃপর বলল, ‘শোনো! তাহলে দুটো নূপুর না হয় নাই বেচলে। একটা অন্তত বেচে দাও । সহস্র কালাঞ্জু পাবে! তার থেকে অনেক বেশিও পেতে পারো। ওতে তো অনেক রত্ন বসানো আছে।’
‘সহস্র কালাঞ্জু’ কথাটা তিরের মতো বুকের মধ্যে গিয়ে বিধল কোভালনের। কন্নকী জানে না, একদিন ওই মূল্যেই মাধবীকে কিনেছিল কোভালন। হায়, গতায়ু অতীত ! একদিন সহস্র কালাঞ্জু দিয়ে কত অনায়াসে সে মনের বিলাস মেটাত অপ্রয়োজনে যখন তখন। আর আজ শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে নিজেদের ভালোবাসার সামগ্রী পর্যন্ত বিক্রয় করে সহস্র কালাঞ্জু পাওয়ার কথা তাকেই ভাবতে হচ্ছে!
চিন্তামগ্ন কোভালনকে ঠেলা দিয়ে কন্নকী বলল, ‘কী গো? কী ভাবছ অত? বেচে দাও একটা নূপুর, বুঝলে?’
কোভালন শয্যা থেকে উঠে বাইরে যাওয়ার তোড়জোড় করতে লাগল। সে চুপ করে আছে দেখে নাছোড় কন্নকী পুনরায় বলল, ‘আর দেরি কোরো না। অন্যের গৃহাবাসে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে কেমন লাগে? চিন্তা ছাড়ো। তুমি আজই অন্তরাপণ থেকে বুঝে এসো, কত দাম পাবে। নিয়ে যাবে নূপুরটা ? বের করে দেবো?’
কোভালন বলল, ‘না। আজ নয়। আজ বৃহস্পতিবার। আজ থাক। কাল না হয় … কোভালন তার প্রস্তাবে শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হয়েছে দেখে কিছুটা খুশি হল কন্নকী ভাবল, যাক, কিছু একটা তো উপায় হবে এবার !
কোভালন প্রস্তুত হয়ে ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল শূন্য মনে। পথে নামল। দূরের আকাশটা তপ্ত কটাহের মতন ঘোলা দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে তার দিকে । কী জানি, দিনান্তে হয়তো আজ বৃষ্টি নামবে। কন্নকীর নূপুর বিক্রয় করার মতন হীন কাজ করতে কিছুতেই মন সরছে না। তবু উপায়ও অন্য কিছু নেই। নিতান্ত অপ্রসন্ন মুখে ধুলামাখা পথ ধরে হাঁটতে লাগল কোভালন ।
(পঁয়তাল্লিশ) প্রাবৃটযামিনী
কোভালন বেরিয়ে যাওয়ার পরে আইয়াইয়ের ঘরে গেল কন্নকী। এই কক্ষেই তার ভাই চিত্তিরাইও থাকে। জন্মপঙ্গু ছেলেটি করুণ মুখে চেয়ে থাকে সারাদিন। দুই ভাইবোন— আইয়াই আর চিত্তিরাই—দুপুরবেলা অপেক্ষা করে বসে থাকে কন্নকীর জন্যে । কন্নকী গল্প বলে ওদের প্রতি দ্বিপ্রহরবেলায়। পুষ্পহার নগরীর কথা, কন্নকীর ছোটোবেলার কথা, বনের মধ্য দিয়ে মাদুরাই আসার কাহিনি, মারাভারদের দেবীর থানে কী হয়েছিল, সেসব বারবার ওরা শুনতে চায় কন্নকীর মুখে। আইয়াই মাদুরাইয়ের বাইরে কখনও যায়নি, তার বিয়েও হয়েছিল এখানেই, বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে সে বিধবা হয়ে এই গোপপল্লীতেই ফিরে আসে। আর চিত্তিরাই তো পঙ্গুত্বের কারণে আবাল্য গৃহবন্দি; গৃহের বাহিরের জগৎ সে দেখতে পায়নি কখনও। কন্নকীর গল্পের জন্যে তাই দুই ভাইবোনেরই এত তীব্র আকর্ষণ; এসব কথার মধ্য দিয়ে তাদের গৃহগত প্ৰাণ যেন কোন অজানা সুদূর দেশের দিকে উড়ে চলে যেতে চায় ।
খানিক গল্পগাছার পরে আইয়াই প্রতিবেশীদের গৃহের উদ্দেশে বেরিয়ে গেল একঘটি দুধ নিয়ে। কন্নকীও চলে এল নিজেদের ঘরে।
রিক্ত প্রকোষ্ঠ। প্রকোষ্ঠের এই রিক্ততা প্রতিদিন মধ্যাহ্নে কোভালন বেরিয়ে যাওয়ার পরে আরও প্রকট হয়ে ওঠে কন্নকীর মনে। এটা-সেটা কাজ করার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই মন লাগে না কোনো কাজে তার। কখন ফিরে আসবে কোভালন, ভাবতে ভাবতে দিন ফুরিয়ে আসে।
হঠাৎ কী জানি ভেবে আজ সে কুলুঙ্গি থেকে কাঠের পেটিকাটি সযতনে নামিয়ে আনল শয্যার উপর। সেই পুরাতন রত্নমঞ্জুষা তো এখন আর নেই। অন্তরাপণ থেকে কোভালনকে দিয়ে এই কাষ্ঠনির্মিত পেটিকা বানিয়ে এনেছে কন্নকী। কুলুঙ্গিতে রেখেছে; এখানেই নিরাপদ।
আঁচলের প্রান্তে বাঁধা কুঞ্জিকা দিয়ে কাষ্ঠপেটিকার তালক খুলল। ভিতরে নানা রত্নে মোড়া সোনার নূপুর দুটি পাশাপাশি শুয়ে শুয়ে ম্লান চোখে কন্নকীর দিকে তাকিয়ে আছে যেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নূপুর দুটো বের করে আনল সে। পরম মমতায় নূপুর দুটোর গায়ে হাত বোলাল একবার। তারপর পায়ে পরল নূপুরজোড়া। হয়তো এই শেষ বার পরছে ওদের কন্নকী। এর পরে নূপুরজোড়া আর কোনোদিন পরা হবে না তার। এক পায়ে একটা নূপুর আর কে কবে পরে ?
নূপুর পরে শয্যা থেকে কন্নকী উঠে দাঁড়াল। নিঝুম ঘুমন্ত দ্বিপ্রহর। এ গৃহে চিত্তিরাই ছাড়া আর কেউ নেই এখন। প্রকোষ্ঠের ভিতর ঘুরে বেড়াতে লাগল কন্নকী আপনমনে কক্ষের বাহিরে, দাওয়াতে, উঠানে, কলমিলতার বেড়া অবধি হেঁটে কক্ষে ফিরে এল। নূপুর দুটো বাজছে; কিন্তু তেমন ঝমঝম করছে না আর আজ । কেমন ম্রিয়মাণ নিক্বশধ্বনি যেন আজ তাদের । প্রকোষ্ঠের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে আজ এতদিন পরে আবার তার মনে হল, নূপুরদুটো কী জানি বলছে পরস্পর। কী বলছে ওরা? জনহীন কক্ষের মেঝেতে লঘু পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কান পেতে নূপুর দুটির বার্তালাপ শুনতে লাগল সে:
ডানপায়ের নূপুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, ‘চিরবিচ্ছেদের দিন এসে গেল আমাদের রে! হয়তো কালই…’
বাঁ-পায়ের নূপুর চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উত্তর দিল, “কে যাবে, কে জানে ! শুনলাম, যেকোনো একজন। বোধহয় আমিই। আমাকেই বিক্রি করে দেবে। তুই থাক সখীর চরণ আলো করে, দক্ষিণ…”
‘অত নিশ্চিত করে কি আর বলা যায়? যেতে পারি আমিও। তবে যেই যাক, অন্যজন ও আর চরণে উঠবে না কোনোদিন!’ দক্ষিণী উত্তর দিল।
বামা নূপুর বলল, ‘হ্যাঁ, এক পায়ের নূপুরের আর কী ব্যবহার? রত্নপেটিকাতেই পড়ে থাকতে হবে আরও দূর ভবিষ্যতে বিক্রয় হওয়ার জন্যে।’
দক্ষিণ চরণে কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই। তারপর আবার রুনুঝুনু করে বলল ডান পায়ের নূপুর, ‘আমাদের মধ্যে যে যাব, সে তো আর বেঁচে থাকব না। মুক্তা, পদ্মরাগ, হীরক খুলে নিয়ে রুপার তার আর সোনার অঙ্গ গলিয়ে নেবে স্বর্ণকার। আকার চলে যাবে, থাকবে শুধু উপাদান। সেই উপাদান দিয়ে তৈরি হবে অন্য কোনো আভরণ। বিক্রি হয়ে গিয়ে আমাদের যেকোনো একজনের মৃত্যু হয়ে যাবে। পুষ্পরাগের শিল্পী মণিকণ্ডনের সৃষ্টির আধখানা ধ্বংস হয়ে যাবে কাল।’
বাঁ-পায়ের নূপুর তার পদ্মরাগমণির চোখ মুছে বলল, ‘হোক, যা হওয়ার । তবু আমাদের সখীর তো প্রাণ বাঁচবে! যে-দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে কন্নকীর জীবনে, আমাদের যেকোনো একজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার অবসান হোক। কন্নকী-কোভালনের এ দুর্দশা আর পেটিকায় শুয়ে শুয়ে দেখতে পারছি না ৷’
ডানপায়ের নূপুর উত্তর দিল ক্ষীণ উদাসীন স্বরে, ‘সত্যিই তাই। এমন রূপসী মেয়ে, এমন তার ভাগ্য! আমাদের একজন যাব, আরেকজন তার স্মৃতি হয়ে পড়ে থাকব পেটিকায় তালকবন্ধ হয়ে। পড়ে-থাকা জনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সখী কন্নকী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে করবে চলে-যাওয়া জনের কথা। এই আমাদের নিয়তি! গড়ে ওঠা, শরীর সাজানো, ভেঙে পড়া—এই এক চক্রাকার গতি। তবু কন্নকী-কোভালন বেঁচে থাকুক বেঁচে থাকুক ওদের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাতেই আমাদের জীবনের সার্থকতা, বামা !’ আবার সব চুপচাপ। তারপর দুপুরের নৈঃশব্দ্য ভেঙে বাঁ-পায়ের নূপুর সহসা বলল,
‘কিন্তু আমার মন কেন কু-গাইছে, বল দেখি?’
ডানপায়ের নূপুর প্রশ্ন করল, ‘কেন, কী মনে হচ্ছে তোর ?’
‘মনে হচ্ছে, শুধু বিক্রয় হয়ে গেলেই যে ওদের শান্তি হবে, এমন নয়। যেন আরও কোনো বড়ো বিপর্যয় অপেক্ষা করে আছে ওদের ভাগ্যে!’
‘এমন মনে হচ্ছে কেন তোর ?’
‘শিল্পী মণিকণ্ডন আমাদের মতনই আরও একজোড়া বানায়নি তো আমাদের বানানোর আগে?’
‘বানাতেই পারে। আমাদের জন্মের আগে কিংবা জন্মের পরেও। শিল্পীরা একই ছাঁচ থেকে কত অলংকার নির্মাণ করেন। কিন্তু তাতে কী হল ?’
‘সেই আমাদেরই মতন দেখতে অন্য কোনো নূপুরের সঙ্গে যদি মানুষ আমাদের কাউকে গুলিয়ে ফেলে? কী বিপর্যয় হবে ভেবেছিস?’
‘খানিকটা ভাবতে পারছি। তবে থাক, তুই আর ওসব অলুক্ষুণে কথা মুখে আনিসনি এখন। চিরজীবনের মতো চলে যাব আমরা একজন আরেকজনাকে ছেড়ে। কত মধুমাসের স্মৃতি হারিয়ে যাবে আমাদেরই সঙ্গে। ওসব অমাঙ্গলিক কথা থাক এখন । এমন বিচ্ছেদ হবে জানলে, কে জন্ম নিতে চাইত ?’ ডানপায়ের নূপুর এই কথা বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল ।
তার সেই কান্নায় আর স্থির থাকতে পারল না বামপায়ের নূপুরটিও। সেও অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে গলা জড়িয়ে ধরল দক্ষিণীর ।
ওদের কথা শুনতে শুনতে দুঃখে, আশঙ্কায়, উদ্বেগে কাঠ হয়ে বসে পড়ল কনকী শয্যার উপর। কোন বিপর্যয়ের কথা বলছে ওরা? আরও বিপর্যয়? কে জানে, কীসের কথা বলছে! কে জানে, কী হবে !
ভাবতে ভাবতে পা থেকে নূপুর দুটো খুলে পেটিকায় ভরে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখল সে। নগ্ন পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, সব আমার উদ্ভট কল্পনা। সব কল্পনা। নূপুর কখনও কথা বলে? নিজের মনের শঙ্কা আমি ওদের নিক্বণের মধ্যে শুনতে পাচ্ছি। কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যাবেই।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদে কোভালন গৃহে ফিরল। মুখ তার আষাঢ়ের আকাশের মতন মেঘাচ্ছন্ন। কাছে এসে দাঁড়াল কন্নকী চোখে প্রত্যাশা নিয়ে। জিজ্ঞেস করল, ‘কী গো, কিছু কি ব্যবস্থা হল?’
কোভালন গম্ভীর মুখে বলল, ‘হ্যাঁ। ব্যবস্থা হয়েছে। স্বর্ণকার আথিয়ামান বলল, ‘যেকোনো একটা নূপুর কাল নিয়ে যেতে। পরীক্ষা করে দাম দেবে।’
‘তুমি কিন্তু এককথায় রাজি হয়ে যেও না, বাপু। খানিক দরদাম করে, তারপর…. ‘
‘হ্যাঁ, সে আর বলতে। আথিয়ামান ছাড়া আরও কয়েকজন স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে দাম যাচাই করা দরকার। যেখানে বেশি দাম পাব…’ এই পর্যন্ত বলেই কোভালন চুপ করে গেল। গম্ভীর হয়েই বসে রইল শয্যায়। কন্নকী পাকশালায় চলে গেল।
উনুনে রাতের আহার প্রস্তুত করছেন মাদারি। তিনি গোচারণ থেকে ফিরেছেন সন্ধ্যার আগেই। কন্নকীকে দেখতে পেয়ে তার চিবুক স্পর্শ করে আদরভরে বললেন, ‘সারাদিন কী খাস, কেমন আছিস, কে জানে মা! আইয়াই তোর যত্ন নেয় তো ঠিকমতো ? ভাব হয়েছে? দুটো কথা বলার লোকও তো তোর আমাদের ঘরে নেইকো কোনো….
কন্নকী বলল, ‘না-না, মা, আপনি চিন্তা করবেন না। আইয়াই আমাদের খুবই যত্ন করে। দুপুরবেলা দুটি ভাইবোনে কত গল্প শোনে আমার কাছে বসে !’
মাদারি বললেন, ‘আর বলিসনি মা, আমার পোড়া কপালের কথা! ওই দুটি ছেলেমেয়ে আমার—একটি জন্ম থেকেই বিছানায় আর অন্যটি তো অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে … আমার কর্তা জ্বরে অসুখে ভুগে অকালেই মারা গেলেন….সব আমার কপাল! তারপর থেকে আমিই টানছি ওদের গোরুবাছুর পালন করে। কে জানে, তোদের কত অসুবিধা হচ্ছে হয়তো… নিজে দেখাশোনা করতে পারছি না। যা করে ওই আইয়াই… জামাই ফিরেছে রে ঘরে ?’…
রাত্রির প্রথম প্রহরে বৃষ্টি নামল। প্রথমে জোরে এক পশলা বৃষ্টি হল খুব। তারপর ঝিরিঝিরি করে ঝরছে তো ঝরছেই। আজ রাতে আর বৃষ্টি থামবে বলে মনে হয় না।
শয্যায় চুপ করে শুয়েছিল ওরা দুজনে। ঘুম আসছে না আজ কিছুতেই। ঘরের এক কোণে মাটির প্রদীপ জ্বলছে নিভুনিভু। প্রকোষ্ঠের ছাদে বৃষ্টি পড়ার ছন্দোময় শব্দ। গোশালার পুকুরপাড়ে ব্যাং ডাকছে। সে-ভেকঘর্ঘর গবাক্ষপথে বৃষ্টিভেজা বাতাসের সঙ্গে মিশে এ কক্ষে ভেসে আসছে অবিরত। গবাক্ষের ওদিকে মাদুরার বর্ষাসজল যামিনী তার যাবতীয় তমিস্রা নিয়ে কার অপেক্ষায় যেন থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কোভালনের দিকে পাশ ফিরল কন্নকী। অন্ধকারে স্বামীর শরীর স্পর্শ করে বলল, রাগ করেছ? কথা বলছ না কেন আমার সঙ্গে সন্ধে থেকে ?
কোভালন বলল, ‘কার ওপর রাগ করব, কন্নকী? রাগ করলে নিজের ওপরেই করতে হয়। তুমি ঘুমোও ।’
‘ঘুম আসছে না তো! তুমিও তো ঠায় জেগে আছ! কী হয়েছে, বলো না! নূপুর বিক্রি করতে হবে বলে মন খারাপ?’
নাহ্, এমনিই ঘুম আসছে না,’বলতে বলতে কন্নকীর উপাধানের উপর বাম বাহুখানি প্রসারিত করল কোভালন। সেই প্রশস্ত ভুজলতার উপর মাথা রেখে স্বামীর কপালে হাত বুলোতে বুলোতে কন্নকী বলল, ‘মন খারাপ কোরো না গো ! তোমার ব্যবসা সফল হলে আমাকে না হয় ওরকম একটা নূপুর গড়িয়ে দিও আবার কোনোদিন।’
‘জানি না, কী হবে! খুব চিন্তা হয়,’এই বলে কন্নকীর মুখখানি কোভালন তার বুকের মধ্যে নিল ।
কোভালনের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কন্নকী সান্ত্বনা দিয়ে বলতে লাগল, ‘চিন্তা কোরো না। দ্যাখো, সুখ-দুঃখ প্রত্যেক মানুষের জীবনে পরপর আসে। আমাদের খারাপ সময়ও কেটে যাবে এরপর । তুমি আশায় বুক বাঁধো দেখি ! সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ভেকঘর্ঘর প্রবল হয়ে উঠছে। ছাদের উপর বৃষ্টি পড়ছে অবিরল ধারায়। কিছুক্ষণ ওরা কোনো কথা বলছে না, চুপ করে আছে। হঠাৎ কোভালন বলে উঠল, ‘তোমার মনে আছে বনের ধারে কাভুন্দি-মার ঘরখানার কথা? সেই যে দুজনে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেই রাত্রে মাটির ওপর ?’
কন্নকী বলল, ‘হ্যাঁ। সে-রাতের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। কত শান্তি সেখানে। জীবনে ওইগুলোই তো সত্যিকারের পাওয়া!’
‘সত্যি, কন্নকী। কত প্রাচুর্যের মধ্যে বড়ো হয়েছি আমরা। বিয়ের পরেও কত দিন দুজনে কত প্রাচুর্যের মধ্যেই থেকেছি। অথচ জীবনের মধুরতম স্মৃতি হয়ে রইল আমাদের ওই দিনগুলো… যখন নিঃস্ব হয়ে গেলাম… দুজনে পথে পথে ঘুরে বেড়ালাম, তখন। তবে যাই বলো, এই দুর্গম পথ ধরে মাদুরাই আসতে তোমার কষ্ট হয়েছে খুব….’
‘সে-কষ্ট কিছুই নয়, কোভালন। যদি আমার মানুষ আমার পাশে থাকে, তাহলে কষ্টগুলোই পরে মধুর মনে হয়…’
‘তোমাকে কত যে দুঃখ দিলাম, কন্নকী, সারাজীবন ! পথ ভুলে বিপথে গেলাম আমি…’
‘বিপথ বলে কিছুই নেই গো! কোনটা সুপথ, কোনটা বিপথ, কে বলে দেবে বলো তো ! আমিও তো তোমাকে বুঝতে চাইনি বহু দিন। ভুল বুঝেছি…. আচ্ছা, মাধবীর আর কোনো সংবাদ পাও তুমি ? কী জানি, কী করছে মেয়েটা পুষ্পহারে একা….’
কোভালন বলল, ‘হ্যাঁ, একজন পত্রবাহকের হাতে পত্র পাঠিয়েছিল মাঝে। ওর খুব কষ্ট, লিখেছে।’
‘দ্যাখো, যদি ব্যবসায় সফল হতে পারো, এদিকটা একবার গুছিয়ে নিয়ে পুষ্পহারে যাবে আমাকে নিয়ে ? এবার না হয় শকটে চেপে বা জলপথে যাব দুজনে। ব্যাপারীরা তো যায়!’
‘আচ্ছা, যাব এখন। আমারও পুষ্পহারেই ফিরতে ইচ্ছা করে। এ মাদুরাইতে মোটেই মন টেকে না।’
মাধবীর সব কথা কন্নকীকে এখনই খুলে বলল না কোভালন। বিশেষত, মাধবীর সন্তান-সম্ভাবনার কথা। বলবে কখনও ওকে পরে। এই গয়না-বিক্রির ব্যাপারটা মিটিয়ে নিয়েই না হয় বলবে। অনেক বড়ো মন কন্নকীর, কোভালন তা জানতে পেরেছে। ওকথায় অপ্রসন্ন হবে না কন্নকী, সে নিশ্চিত।
কোভালন চুপ করে আছে দেখে কন্নকী বলল, ‘এই সব বর্ষার ঘন রাত্রি। এসব নিয়ে তুমি কত কী লিখতে একদিন। আমাকে পড়ে শোনাতে। এখন আর লেখো না তুমি সেসব ?’
‘আর লেখা ! লেখা আমার আর হবে না, কন্নকী। কবিতা আমার হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে চিরতরে। এখন আর মাথায় কিছু আসে না। জীবনে একটু থিতু হয়ে না বসতে পারলে কি ওসব ভাবনা মাথায় আসে?’
‘আচ্ছা, মারাভারদের জীবন কি খুব শান্ত, খুব স্থিতিশীল?’
‘হঠাৎ মারাভারদের কথা কেন এখন?’ বলতে বলতে কন্নকীকে বুকের আরও কাছে নিবিড় করে টেনে নিল কোভালন।
‘মারাভাররা যেসব গান গায়, ওসব কি ওদেরই বানানো ?’কন্নকী জিজ্ঞেস করল। ‘হ্যাঁ, ওদেরই বানানো। ওসব পদ ঠিক আটবিকদের ভাষায় ওদেরই আবেগ থেকে উঠে এসেছে তো!’ কোভালন বলল।
‘তাহলে? ওরা যদি এত অশান্ত দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের মধ্যে বসে অমন গান বানাতে পারে, তাহলে তুমি পারবে না কেন ?’
কোভালন কথাটা নিয়ে ভাবছিল। বেশ চিন্তোদ্দীপক কথাটা। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে সে উত্তর দিল, ‘কেন পারব না আমি, জানো? ওরা জন্মেছেই ওই অশান্তির মধ্যে। বিপদ, অশান্তি ওদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। কিন্তু আমরা তো জন্মেছি নাগরিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের ভিতর। দারিদ্র্য, বিপদ আমাদের স্বাভাবিক নয়। তাই বাঘের থাবার মধ্যে বসে আমরা কবিতা লিখতে পারি না।’
কোভালনের থেকে একটু সরে গিয়ে স্তিমিতান্ধকারে শূন্য দৃষ্টি মেলে কন্নকী বলল, ‘ঠিকই। ওই জন্যেই মারাভারদের গান অত স্বাভাবিক। আর আমাদের নাগরিক জীবনের কাব্য এত সাজানো, এত কৃত্ৰিম।’
‘তাই হবে হয়তো। তবে তুমি যখন বলছ, চেষ্টা করব লেখার। জানি না, পারব কি না। এখন আর আমার মাথায় আসে না কিছুই। মাথায় শুধু অন্নচিন্তা চমৎকারা।’
‘অত চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। সুদিন আসবে আবার। … ওহ্, বর্ষার বাতাস কী কনকনে ঠান্ডা, না? কেমন শীত শীত করছে!’
‘সরে এসো এদিকে। চলো, ঘুমিয়ে পড়ি। অনেক রাত হয়েছে,’ বলে কন্নকীকে আবার কাছে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল কোভালন। যেন ঠান্ডা না লাগে কন্নকীর।
রাত্রির অন্ধকারের ভিতর আরও জোরে অনর্গল বৃষ্টি পড়ছে। কখনও দূর আকাশে বজ্রপাতের গর্জন। সমস্ত মাদুরাই যেন ডুবে যাচ্ছে প্রলয়সলিলের ভিতর আজ রাত্রে। এ বর্ষায়, এ অন্ধকারে কোনটি স্রোতস্বতী ভাইগাই আর কোনটি মাদুরাই নগরী—তার নিষ্পত্তি করার মতো কেউ আর জেগে নেই এখন।
(ছেচল্লিশ) কূটচক্র
উৎপীঠিকার উপর ঝুঁকে পড়ে আতসকাচ দিয়ে বহুক্ষণ ধরে নূপুরটি পরখ করে চলছিল স্বর্ণকার আথিয়ামান। একবার হাতে নিয়ে ওজন অনুমান করার চেষ্টা করছে, একবার তুলাযন্ত্রে ওজন মাপছে, একবার চোখের খুব কাছে এনে নূপুরের গায়ে বসানো রত্নগুলো খাঁটি কি না পরীক্ষা করছে, সোনার ফুলগুলো ঘষে দেখছে একেকবার। আথিয়ামানের মুখে বিস্ময়, বিবেচনা ও লালসার বিচিত্র ভাবসকল ফুটে উঠছে মুহুর্মুহু।
উৎপীঠিকার এধারে বসে আছে কোভালন। ধীরে ধীরে অধৈর্য হয়ে উঠছে সে এই দীর্ঘ খুঁটিনাটি পরীক্ষায় । পূর্বাহ্ণের প্রথম প্রহর গত হওয়ার পর দুই ঘড়ি সময় অতিক্রান্ত হতে চলল, এখনও নূপুরের মূল্য নির্ধারিত হল না। সকালে ঘর থেকে বেরোনোর সময় কন্নকীকে সে বলে এসেছে, নূপুর বিক্রি হয়ে গেলেই অর্থ নিয়ে অবিলম্বে গৃহে ফিরবে। কারণ অর্থ সঙ্গে নিয়ে অন্তরাপণে হেথাহোথা ঘোরা বেশ বিপজ্জনক। এদিকে আথিয়ামানের পরীক্ষা আর শেষ হচ্ছে না। আজ মাদারিগৃহ থেকে গলিপথ দিয়ে বেরিয়ে রাজপথে ওঠার সময় বিশালকায় কালো একটা মহিষ তার সামনে দিয়ে এধার থেকে ওধারে রাস্তা পার হল; এসব কুসংস্কার সে মানে না, কিন্তু মহিষটা ঠিক যেন তার দুঃস্বপ্নদৃষ্ট মহিষেরই মতন দেখতে। কেন জানি সেই থেকে তার মন নানা অমঙ্গল-আশঙ্কা করে চলেছে। মানুষের জীবনে দুঃসময় এলে মনের যাবতীয় দুর্বলতা তাকে পেয়ে বসে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে কোভালন জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন কী বুঝছেন ?’
আথিয়ামান সোজা হয়ে বসল। অপ্রতিভ ভঙ্গীতে সামান্য হেসে বলল, ‘এ এক আশ্চর্য অলংকার, মহাশয়! এত দিন ধরে অলংকার ঘাঁটছি, কিন্তু আজ অবধি এমন আরেকটি দুর্মূল্য আভরণ চোখে পড়েনি। এ নূপুর কি আপনার স্ত্রীর ?’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোভালন উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ। তাঁরই।… কত দাম হতে পারে ?’
‘দাম কত হতে পারে, তা এখনই বলতে পারছি না। সোনা তো শুধু নয়, এর মধ্যে রুপার তার আছে, হীরকের দানা এতগুলো আছে, পদ্মরাগমণি এতগুলো, মুক্তাও অজস্র । আবার হাতে নিয়ে ওজন করে দেখছি, সোনার ফুলগুলোর ওজন মনে মনে যা আন্দাজ করছি মশায়, তুলাযন্ত্রে তার থেকে কেন জানি, অনেক বেশি দেখাচ্ছে! এ বস্তু দাম দিয়ে কেনা আমার সাধ্যাতীত,’আথিয়ামান বলল ।
কথাটা শুনে কোভালন বেশ নিরাশ হয়ে পড়ল। বলল, ‘সেকী! কিনবেন না আপনি ? ‘কিনব না—নয়। কিনতে পারব না। আরে আমি তো আমি, সারা মাদুরাইতে এমন একজনও সোনার ব্যাপারী বা রত্নের কারবারি নেই, যে এ নূপুরের দাম দিতে পারে । তা নূপুর তো একটা হয় না, মশায়, একজোড়া হয়। সেই আরেকটিও আছে নাকি এখনই আপনার কাছে?’ আথিয়ামান অপাঙ্গ দৃষ্টিতে কোভালনের দিকে চট করে একবার তাকাল ।
‘না, কাছে তো এখন নেই, তবে বাড়িতে আমার স্ত্রী-র কাছে অন্য নূপুরটা আছে। কিন্তু সেটা এখনই বিক্রি করব না। আমার অর্থের বিশেষ প্রয়োজন পড়েছে, তাই এই একটা নূপুরই বিক্রি করতে এসেছি। তা না হলে এ বস্তু বিক্রয় করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। আমি বলছিলাম, নূপুরটা ভেঙে যদি রত্নগুলো আর সোনারুপো আলাদা আলাদা করে বিক্রয় করা যায়? ধরুন, আপনি হয়তো সোনারুপো কিনে নিলেন, অবশিষ্ট রত্নগুলো আমি অন্যান্য বিপণিতে বিক্রয় করলাম, তাতে তো আর আপনার দাম দিতে অসুবিধা হবে না?’ কোভালন বোঝানোর চেষ্টা করল আথিয়ামানকে।
আথিয়ামান ত্বরিতে জবাব দিল, ‘আপনি বলছেন কী, মহাশয়? এ নুপুর আপনি ভাঙতে বলছেন? এ নূপুর কি শুধু সোনারুপো আর রত্নপাথর? এর যে নির্মাণশৈলী, তার কি কোনো তুলনা আছে? সেই নির্মাণশৈলীর দাম নেই নাকি? আলাদা আলাদা করে সোনা, রুপো, রত্ন বেচলে আপনি যে-দাম পাবেন, এই গোটা নূপুরটার দাম তার থেকে বহু গুণে বেশি। ভাঙবার কথা মনেও আনবেন না। এ মহল্লায় কোনো স্বর্ণকারই রাজি হবে না আপনার এমন প্রস্তাবে।’
কোভালন এবার সত্যিই একেবারে হতাশ হয়ে পড়ল। নূপুর কি সে সাধ করে ভাঙতে চাইছে? গোটা নূপুরের দামই যদি কেউ না দিতে পারে, তাহলে ভাঙা ছাড়া আর উপায় কী? এদিকে আবার আথিয়ামান বলছে, নূপুর ভাঙতেও নাকি কেউ রাজি হবে না। এ তো আচ্ছা বিপদে পড়া গেল !
মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করল কোভালন, ‘তাহলে কী হবে? কেউ পারবে না নূপুর কিনে আমাকে অর্থ দিতে?’
আথিয়ামান খানিক কী যেন ভাবতে ভাবতে বলল, ‘নাহ্, পারবে না…তবে…’ কোভালন অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তবে কী ? ‘
আথিয়ামান ভেবে ভেবে উত্তর দিল, ‘….আছেন একজনই মাদুরাইতে আপনার এ নূপুর কেনার মতন! একমাত্র তাঁরই সামর্থ্য আছে বটে এ বস্তু ক্রয় করার…’
‘কে?’
‘কোপ্পারুনদেবী!’ কথাটা বলেই আথিয়ামান সসম্ভ্রমে প্রণামের ভঙ্গিতে দুই কানের লতিতে আড়াআড়ি দু-হাত ছোঁয়াল ।
কী বলছে আথিয়ামান, বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল কোভালন, “কার কথা বলছেন ?”
‘রানিমা-র কথা গো, রানিমা-র কথা। মাদুরাইয়ের রাজা পাণ্ড্যবংশের কুলপ্রদীপ সম্রাট নেডুঞ্জেলিয়ণ-এর পট্টমহিষী কোপ্পারুনদেবী। এ নূপুর ক্রয় করতে পারলে, একমাত্র তিনিই পারবেন,’ আথিয়ামান বলল ।
আথিয়ামানের কথা শুনে কোভালন যেন আকাশ থেকে পড়ল। এ লোক বলে কী! কন্নকীর নূপুর কিনতে পারেন কেবলমাত্র মাদুরার রানি, আর কেউ নয় ? নিজের কানকে পর্যন্ত সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে যাই হোক, রাজা-রানি—ওসব কোভালনের পক্ষে অনেক দূরের ব্যাপার। মুষড়ে পড়ল কোভালন। বলল, ‘কিন্তু তাহলে তো আমার সামনে আর কোনো উপায় রইল না, আথিয়ামান। রানি কোপ্পারুনদেবী—তাঁর সঙ্গে আমি আর যোগাযোগ করব কী উপায়ে? আমি নিতান্ত সাধারণ এলেবেলে লোক । তাহলে আর হল না। দিন, ও নূপুরটা দিন, ঘরে চলে যাই !’
আথিয়ামান অদ্ভুত একটা রহস্যজনক হাসি হাসতে হাসতে বলল, ‘এখনই অত নিরাশ হওয়ার কিছু নেই, মশাই! সে উপায় একটা আছে বই-কী! উপায় না থাকলে রাজা-রানিরা দুর্মূল্য সব অলংকার কেনেন কীভাবে? উপায় আছে।’
এই বলেই সে গুরুগম্ভীর স্বরে হাঁক দিল, ‘জীবগ্রীব! অরে জীবগ্রীব!’
আথিয়ামানের হাঁকাহাঁকিতে শীর্ণকায় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এক কর্মচারী নিকটে এসে দাঁড়াল। লোকটার চোখে-মুখে কেমন যেন একটা উদগ্র কৌতূহল। আথিয়ামান সে-লোকটার চোখের সামনে নূপুরটা মেলে ধরে বলল, ‘দেখছিস রে, জীবগ্রীব? কেমন, অ্যাঁ?’
নূপুর দেখে জীবগ্রীবের চক্ষু বিস্ফারিতপ্রায়। সে কোনোমতে বলল, ‘এমনটা আর দেখিনি কখনও, কত্তা !’
আথিয়ামান বলল, ‘হুঁ-উঁ, সেই তো বলছি! ভালো করে দেখে-শুনে যা। এখনই একবার রাজবাড়ি যাবি। রানিমা-কে বিস্তারিত বিবরণ দিবি নূপুরটার। এ নূপুরের লোভ কোপ্পারুনদেবী কোনোমতেই সামলাতে পারবেন না। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রসাধিকা নারুভি-কে এক্ষুনি দরদাম করতে পাঠাবেন। আমরা সামনের মন্দিরের গোপুরমের নীচে অপেক্ষা করছি। সেখানেই নারুভি-কে নিয়ে আয়। বিপণিতে বসে এ বস্তুর দরদাম করা ঠিক হবে না। যা যা, এখনই যা!
আথিয়ামানের তাড়া খেয়ে জীবগ্রীব রাজবাড়ি যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হতে বিপণির ভিতরে গেল। কিন্তু আথিয়ামান তাতেও যেন নিশ্চিন্ত হতে পারল না। সে তাড়াতাড়ি নূপুরটা কোভালনের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি নূপুর নিয়ে একটু বসুন তো এখানে। আমি ভিতরে গিয়ে জীবগ্রীবকে দুটো কথা আরও বলে দিয়ে ফিরে আসছি। এসব কর্মচারী….বেয়াক্কেলে ছোকরা… বোঝেনই তো, কী করতে কী করে বসবে! ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।
এই বলে আথিয়ামান বিপণির ভিতরের দিকে চলে গেল। কোভালন নূপুর হাতে নিয়ে বসে রইল আথিয়ামানের ফেরার অপেক্ষায়।
এদিকে আথিয়ামান বিপণির অনেক ভিতরে একটি সংগুপ্ত প্রকোষ্ঠে এসে উপস্থিত হল। জীবগ্রীব সেখানে তারই জন্যে যেন অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। আথিয়ামান গলা নামিয়ে বলল,
‘ভালো করে দেখলি রে নূপুরটা ?’
জীবগ্রীব বলল, ‘হ্যাঁ, দেখলাম, কত্তা। অবিকল রানিমা-র সেই হারানো নূপুরটার মতোই দেখতে । যেটা আমি মাসখানেক আগে নৃত্যশালা থেকে চুরি করে এনে আপনাকে দিয়েছিলাম, একদম সেইটারই মতন দেখতে এইটাও!’
চাপা স্বরে ধমক দিয়ে উঠল আথিয়ামান, ‘চুপ, চুপ ! আস্তে, আস্তে ! দেওয়ালেরও কান আছে এখানে। নগরপালদের উৎপাত এখন কেমন তোর উপর ?’
‘সে আর বলবেন না, কত্তা! যেদিন থেকে নূপুরটা সরিয়েছি, এক্কেবারে সেই দিন থেকেই নগরপালরা আমার পেছনে যেন ছিনে জোঁকের মতো লেগেছে। ওরা আমাকে সন্দেহ করছে, মনে হয়। আপনি তো চুরির মাল গালিয়ে বেচে দিয়েই খালাস ! আমি মরছি আমার জ্বালায় !
আথিয়ামান ব্যঙ্গভরে বলল, ‘কেন, পারিশ্রমিক দিইনি নাকি রে তোকে?’
‘তা দিয়েছেন। তবে এখন আমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি না হয় ! আর আমাকে ধরতে পারলে আপনাকেও কি আর ছেড়ে দেবে ভেবেছেন? আমি আপনারই বিপণির কর্মী, সন্দেহ স্বভাবতই আপনার উপরেও গিয়ে পড়বে।’
আথিয়ামান উত্তর দিল, ‘ঠিকই বলেছিস রে! এখন দ্যাখ, মহা সৌভাগ্যে এই কোভালন নামের বোকা লোকটা আমাদেরই বিপণিতে ওর গিন্নির নূপুর বিক্রি করতে এসেছে। একদম অবিকল সেই চুরি-যাওয়া নুপুরটার মতই এটারও গড়ন। চুরি-যাওয়া নূপুরের একেবারে হুবহু প্রতিলিপি। তাই যা বলছি, মন দিয়ে শোন। ঠি-ই-ক যেমন বলছি, একদম সেই রকমই করবি। একমাত্র তাহলেই আমরা নূপুরচুরির দায় থেকে চিরতরে বাঁচতে পারব।’
জীবগ্রীব বলল, “তাড়াতাড়ি বলুন কত্তা, কী করতে হবে ?”
কণ্ঠস্বর আরও এক ধাপ খাদে নামিয়ে আথিয়ামান বলল, ‘শোন, তুই রাজবাড়িতে কোপ্পারুনদেবীকে গিয়ে বল যে, তাঁর নূপুরচোর ধরা পড়েছে। চোরের নাম কোভালন নূপুর বেচতে সে আমার কাছে এসেছিল। আমি তাকে বিপণিসমীপে মন্দিরের গোপুরমের নীচে আটকে রেখেছি। এখনই যেন কোপ্পারুনদেবী তাঁর রক্ষীদের পাঠান। রক্ষীদের সঙ্গে নারুভিকেও যেন পাঠিয়ে দেন অলংকার চিনবার জন্য। ওরা এলেই একেবারে বামালসমেত চোরকে আমরা রক্ষীদের হাতে তুলে দেবো।’
জীবগ্রীব খিসখিস করে হাসতে হাসতে বলল, “ভালো ফন্দি এঁটেছেন, কত্তা ৷ ওই কোভালন-নামের লোকটার হাতে নূপুরটা দেখে, ওটা যে সেই চুরি-যাওয়া নূপুরটা নয়, ওটা যে একই গড়নের অন্য আরেকটা নূপুর, সেকথা কোনোমতে বুঝতেই পারবে না নারুভি, সে যতই ও রানির পদসেবা করে থাকুক না ক্যানো, হ্যাঁ !“
হায়, পুষ্পহারের আভরণশিল্পী বাদ্য মণিকণ্ডন ! কোন দুর্গ্রহের প্রেরণায় যে আপনি একই ছাঁচ থেকে দুই জোড়া নূপুর নির্মাণ করেছিলেন বিশ বছরের ব্যবধানে ? তার প্রথম জোড়াটি পাণ্ড্য রাজমহিষীকে আর দ্বিতীয় জোড়াটি কন্নকীর পিতা মানাইক্কনকে বিক্রয় করতে গিয়েছিলেন আপনি কোন দুর্দৈববশে ? তা যদি আপনি না করতেন, তাহলে আজ এমন কূটচক্রান্তজাল রচিত হতে পারত না!
জীবগ্রীব বিপণি থেকে তখনই রাজবাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে গেল। প্রায় এক মাস আগে নৃত্যশালায় নৃত্য উপভোগকালে অন্যমনস্কতাবশত রানি কোপ্পারুনদেবীর পা থেকে একটি নূপুর খসে পড়ে যায়। জীবগ্রীব তখনই সেই নূপুর চুরি করে এনে আথিয়ামানকে দিয়েছিল। এবং আথিয়ামান তৎক্ষণাৎ নূপুরটা গালিয়ে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু রাজকীয় দ্রব্য চুরি করা যত কঠিন, সে-চুরির দায় হজম করা তার থেকেও বহু গুণে কঠিন। রক্ষীদের সন্দেহ থেকে নিজেদের মাথা বাঁচাতে নিরপরাধ হতভাগ্য কোভালনের কাঁধে চুরির দায় চাপানোর ভয়ানক ষড়যন্ত্র সেরে নিয়ে কুচক্রী আথিয়ামান এখন মুখে কান-এঁটো করা হাসি ঝুলিয়ে বিপণি-সম্মুখে উপস্থিত হল। হাসতে হাসতেই বলল সে কোভালনকে, ‘ব্যস, সব ব্যবস্থা পাকা করে এলাম। এখন, চলুন মশাই! মন্দিরের গোপুরমের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। নূপুর আপনার আজই বিক্রি হয়ে যাবে নির্ঘাত!
(সাতচল্লিশ) অবিবেচনা
রাজবাড়িতে প্রবেশ করে জীবগ্রীব দেখল, আজ এখানে বেশ ঝামেলা পেকে উঠেছে। পট্টমহিষী কোপ্পারুনদেবী কী কারণে যেন অভিমান করে গোঁসাঘরে খিল দিয়েছেন। কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারছে না। আথিয়ামানের সঙ্গে এ প্রাসাদে সে প্রায়শই যাতায়াত করে, প্রাসাদের অনেকেই জীবগ্রীবের মুখচেনা মতো হয়ে গেছে। তাই প্রাসাদে ঢুকতে তার কোনো অসুবিধে হল না, কিন্তু পাটরানির মহলের সামনে এসে দেখল দ্বার রুদ্ধ; সশস্ত্র প্রহরীরা দ্বার পাহারা দিচ্ছে। অনন্যোপায় হয়ে প্রহরীদের সঙ্গে একপাশে দাঁড়িয়ে সে উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগল৷
লোকে বলে, রাজাই হোক আর গজাই হোক, স্ত্রীর কাছে সব মহোদয়ই জব্দ। এত যে প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট নেডুঞ্জেলিয়ণ, যাঁর প্রভায় কোরকাই মাদুরাই সব আলোকিত, যাঁর অস্ত্রঝনঝনানির ভয়ে প্রতিবেশী রাজ্য সব নতশির, সেই তিনিও আজ সকাল থেকে মহা বিপদে পড়ে গেছেন। ক-দিন ধরে রাজনর্তকীদের সঙ্গে একটু বেশি সময় কাটাচ্ছিলেন, সারাদিন রাজকার্যের পরে একটু আমোদ, একটু ফুর্তি, কিন্তু তাই নিয়ে পট্টমহিষী কোপ্পারুনের সঙ্গে সকালবেলায় খানিক উত্তপ্ত বাগ্বিনিময় হয়েছে। ব্যস, অমনি অভিমান করে পাটরানি গোঁসাঘরে গিয়ে ঢুকেছেন। এখন রাজকাজ সব নেডুঞ্জেলিয়ণের মাথায় উঠেছে, কী করে গৃহশান্তি করা যায়, ভেবে কূল পাচ্ছেন না। কোপ্পারুন বড়ো আদরের, সেই মাত্রায় অভিমানী। আপাতত পাত্র-মিত্র-অমাত্য-সভাসদদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা অন্য দিনের তুলনায় স্বল্পতর সময়ে সাঙ্গ করে রাজা চিন্তিত মুখে রানির মহলের দিকে যাচ্ছেন। কী করে এখন কোপ্পারুনের মান ভাঙানো যায়, সেই তার একমাত্র চিন্তা ।
রানির মহলের দ্বারপ্রান্তে এসে নেডুঞ্জেলিয়ণ দেখলেন, প্রহরীদের সঙ্গে জীবগ্রীবও দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ লোকটা এখানে কী করছে, নেডুঞ্জেলিয়ণ ভাবলেন। তিনি জীবগ্রীবের দিকে ভ্রূলতা ঈষৎ নর্তিত করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার ?’
জীবগ্রীব দেখল এই সুযোগ। কন্ঠস্বরটিকে বাঁশির মতন ক্ষীণ করে নিয়ে জীবগ্রীব কৃতাঞ্জলিপুটে বলল, ‘একটি বিনীত নিবেদন আছে, মহারাজ!
তার ভঙ্গিমায় রাজার হাসি পেল, কিন্তু অতিভক্তি কীসের লক্ষণ তিনি তৎকালে তা ভুলে গেলেন। বক্র হেসে শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা কী নিবেদন ?’
জীবগ্রীব বলল, ‘মহারাজের মনে আছে বোধহয়, মাসখানেক আগে পট্টমহিষীর একটি নুপুর চুরি গিয়েছিল…’
নেডুঞ্জেলিয়ণ চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘নৃত্যশালায় নাচ দেখতে গিয়ে মহিষী অসাবধানতাবশত একটা নূপুর খুইয়েছিলেন, এই মাত্র । আমার তো মনে হয় না, চুরি হয়েছে বলে। কোথাও পড়ে-টড়ে গিয়েছে হয়তো। সে যাই হোক, আমার নগরপালরা কিন্তু বলছে, সে বস্তু নাকি চুরিই হয়েছে। এখন তা নিয়ে তুমি কী বলতে এসেছ?’
জীবগ্রীব গলাটাকে আরও মধুর করে তুলে উত্তর দিল, ‘সে-চোর আজ সকালে আমাদের হাতে একরকম ধরাই পড়ে গেছে, বলতে পারেন, মহারাজ!’
নেডুঞ্জেলিয়ণ উত্তেজিত হয়ে বিস্ফারিত নয়নে বলে উঠলেন, ‘সে কী হে! তা কোথায় তোমার সেই চোর?’
জীবগ্রীব বলল, ‘আমাদের বিপণিতেই চোর নিজে নূপুর বিক্রি করতে এসেছিল আজ সকালে, মহারাজ। চোর বিদেশী লোক। আমার কত্তা তাকে বিপণির সমীপে মন্দিরের গোপুরমের নীচে নানান কথায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখনও আটকে রেখেছেন । আপনি যদি রক্ষী পাঠান, এখনই বামালসমেত তস্কর ধরা পড়ে যাবে।’
পত্নীর কারণে একেই নেডুঞ্জেলিয়ণের চিত্ত অস্থির ছিল, এখন এই সংবাদ শুনে তাঁর মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠল। এত স্পর্ধা! এত দুঃসাহস! ভিনরাজ্যের একটা লোক তাঁর পট্টমহিষীর নূপুর চুরি করে কিনা তাঁরই রাজ্যের স্বর্ণকারের আপণে বুক ফুলিয়ে সেই অলংকার বিক্রয় করতে এসেছে ?
নেডুঞ্জেলিয়ণ হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘প্রাসাদের ভল্লধারী রক্ষীরা কোথায় ? ডাকো তাদের এক্ষুনি, তারা এসে এখনই এখানেই আমার সঙ্গে দেখা করুক।’
সঙ্গে সঙ্গে সবাই শশব্যস্ত হয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চার-পাঁচ জন সশস্ত্র রক্ষী রাজসমীপে উপস্থিত হল। নেডুঞ্জেলিয়ণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাজমহিষীর প্রসাধন করে যে-মেয়েটি, সেই নারুভিকে ডেকে আনো।
নারুভিও এসে উপস্থিত হল তৎক্ষণাৎ। রাজা বললেন, ‘এখনই এই জীবগ্রীবের সঙ্গে যাও তোমরা। নারুভি! তুমি নূপুরটা দেখে চিনতে পারবে, সেটাই পট্টমহিষীর কি না?’
নারুভি বলল, ‘পারব, মহারাজ!’
রাজা রক্ষীদের উদ্দেশে রোষষায়িত নেত্রে বললেন, ‘সেক্ষেত্রে চোরটাকে সঙ্গে সঙ্গে বেঁধে নিয়ে আসবে তোমরা। যদি সে পালানোর চেষ্টা করে, তাহলে তখনই তাকে হত্যা করবে। এই আমার আদেশ !’
একজন রক্ষী ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই চরম শাস্তি দেওয়া কি ঠিক হবে, স্বামিন?’
রাজা নেডুঞ্জেলিয়ণ গৃহসমস্যার এমন একটা আশু সমাধান পেয়ে মনে মনে পুলকিত ছিলেন। নুপুর উদ্ধার ও নুপুরচোরের চরম শাস্তি দিতে পারলে এখনই অভিমানিনী স্ত্রীর মান ভাঙানো যাবে। আর এর মধ্যে এ অর্বাচীন রক্ষীটা বলছে কি না, শাস্তি দেওয়ার আগে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া প্রয়োজন? রাজা স্থানকাল ভুলে কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ঠিক-বেঠিকের ভার তোমার হাতে নেই হে! তার জন্যে আমি দেশের রাজা কী করতে আছি? যাও, যাও, যা বললাম, তাই করো!
লজ্জিত রক্ষীটি অমনি মাথা হেঁট করে অন্যান্য রক্ষী, নারুভি ও জীবগ্রীব সমেত স্থানত্যাগ করল।
(আটচল্লিশ) নিমজ্জমান
এদিকে স্বর্ণবিপণির নিকটস্থ মন্দিরের গোপুরমের ছায়ায় আথিয়ামানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে কোভালন অস্থির, অধৈর্য হয়ে উঠেছে। মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত, গোপুরমের ছায়া পশ্চিমদিকে ঘুরে গেছে। আথিয়ামানের বকবকানি যেন আর শেষ হচ্ছে না; প্রথমদিকে কোভালন তার কথায় যোগ দিচ্ছিল, কিন্তু এখন ‘হুঁ, হ্যাঁ’ দেওয়া ছাড়া কিছুই আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এত কথা বলতে পারে লোকটা! একবার অধীর হয়ে বলেই ফেলল কোভালন, “কী হল বলুন তো, মশাই? এত দেরি হচ্ছে, জীবগ্রীব এখনও তো ফিরে এল না? কোনো সমস্যা হল না কি?”
আথিয়ামান অমনি ঘাড় দুলিয়ে জবাব দিল, “আরে না, না। এখনই চলে আসবে জীবগ্রীব। রাজবাড়ির ব্যাপারস্যাপার, একটু সময় তো লাগবেই ! অত চিন্তা করবেন না ।“ এই পর্যন্ত বলেই সে আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গেল, ‘তা যেকথা বলছিলাম মশাই! কারুর নগরী থেকে তখনও তো পেটিকাগুলো আসেনি, আমি তো মহা চিন্তায় পড়ে গেছি…’
প্রায় এক ঘড়ি পরে জীবগ্রীবের প্রত্যাবর্তনের ভরসা কোভালন যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, ভাবছে এবার অলংকার বিক্রির আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে আথিয়ামানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ফেরা যাক, ঠিক তখনই পথের একপাশ দিয়ে সে জীবগ্রীবকে এদিকেই দ্রুত পায়ে হেঁটে আসতে দেখল। জীবগ্রীবের সঙ্গে একজন সুবেশা যুবতী, কোভালন অনুমান করল, সে-ই মেয়েটিই নিশ্চয় রানির প্রসাধিকা নারুভি হবে। কিন্তু ওদের সঙ্গে এত শস্ত্রধারী রক্ষী কেন? ব্যাপারটা দেখে ভয়ে কোভালনের বুক কেঁপে উঠল একবার। কিন্তু তারপরেই তার মনে হল, দুর্মূল্য অলংকার ক্রয় করে নিয়ে যাবে নারুভি, তাই হয়তো ওর সঙ্গে রানিমা আরক্ষাকর্মীদের পাঠিয়েছেন।
পন্থা অতিক্রম করে ওরা মন্দিরের গোপুরমের নীচে কোভালন ও আথিয়ামানের নিকটে এসে উপস্থিত হল। উপস্থিত হওয়া মাত্রই জীবগ্রীব কোভালনকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এই যে, এই সেই চোর! ‘
কোভালন জীবগ্রীবের কথা কিছুই বুঝতে পারল না। নিতান্ত বিস্ময়বিমূঢ়ভাবে সে। আথিয়ামানকে বলল, ‘এ কী বলছে, মশাই? রোদে ঘুরে জীবগ্রীব পাগল হয়ে গেল না কি?
কিন্তু আথিয়ামান তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। কেবল কেমন একটা আঁশটে দুর্গন্ধযুক্ত পিচ্ছিল হাসি এখন আথিয়ামানের ঠোঁটে খেলা করছে!
জীবগ্রীব সেই একইভাবে চেঁচাতে লাগল, ‘দেখুন, দেখুন! এখন কেমন সাধু সাজছে ! ওই যে ওই তো ওর হাতের থলিতেই রানিমা-র নুপুরটা আছে।’
সেকথা বলামাত্রই একজন রক্ষী বাজপাখির মতন ছোঁ মেরে কোভালনের হাত থেকে নূপুরের থলিটি কেড়ে নিল। নূপুর কেড়ে নিচ্ছে দেখে অসহায় কোভালন বিষম ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এসব কী হচ্ছে কী? আমার স্ত্রীর নূপুর। আমি বিক্রি করতে এসেছি। আপনারা এ নূপুরে হাত দেবেন না। নূপুরে হাত দেবেন না। আমার স্ত্রীর নূপুর !
কিন্তু তার সেকথা গ্রাহ্যমাত্র না করে রক্ষীটি থলি থেকে নূপুরটা টেনে বের করে এনে নারুভির হাতে দিল। নারুভি নূপুরটা একবার দেখে নিয়েই অমনি উল্লসিত স্বরে বলে উঠল, ‘এই তো, এই তো রানিমা-র চুরি যাওয়া সেই নূপুর !
কোভালন উদ্ভ্রান্তের মতন এলোমেলোভাবে বলতে লাগল, “না, না! রানিমা-র নূপুর নয়, রানিমা-র এ নূপুর নয়। আমার স্ত্রীর নূপুর। আমি বিক্রি করতে এনেছি।’ তারপরে মরিয়া হয়ে আথিয়ামানকে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘ও মশাই! বলুন না ! আপনি তো সব জানেন। আপনার সঙ্গে তো আমার মাসাধিককালের উপর পরিচয়। ও মশাই, কালই আপনাকে বলে রাখলাম… আজ সকালেই আপনার কাছে নূপুর বেচতে এলাম…. না, না, কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। ও আথিয়ামান ভাই, চুপ করে আছেন কেন ? কিছু তো একটা বলুন এদের।’
এতক্ষণ পরে আথিয়ামান মুখ খুলল। কিন্তু আথিয়ামানের কথায় বিস্ময়ে যেন বজ্রাহত হয়ে গেল কোভালন । আথিয়ামান রক্ষীদের উদ্দেশে বলল, ‘আমি প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলাম এ লোকটাকে। মাস দেড়েকের আলাপ। বিদেশী লোক, নাম বলল— কোভালন। কাল এসে শলা করে গেল, নূপুর বেচবে। আজ প্রাতঃকালে বিপণিতে এসে উপস্থিত। তা নূপুর দেখে তো, মশাই, আমার চক্ষুস্থির। এ যে সেই কোপ্পারুনদেবীর নূপুর ! বছরখানেক আগে রুপোর তারটা ঢিলে করবার জন্যে রানিমা আমাকে রাজপ্রাসাদে ডেকেছিলেন। একবার দেখেই চিনতে পেরেছি। বলে কিনা, ওর গিন্নির নূপুর ! আস্পর্ধাটা দেখুন একবার! পরে জীবগ্রীবের কাছে শুনলাম, রানিমা-র নূপুর নাকি খোয়া গেছে। দুয়ে দুয়ে চার করতে আমার আর দেরি হল না। তক্ষুনি পাঠিয়েছি আমি জীবগ্রীবকে রাজপ্রাসাদে রানিমা-র কাছে…’
কোভালনের মাথা ঘুরছে। চোখ দিয়ে, কান দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। থরথর করে কাঁপছে তার সারা শরীর। এসব কী বলছে আথিয়ামান? এত বড়ো শঠতা ! এত বড়ো মিথ্যাচার!
জনৈক রক্ষী তখনই কোভালনকে বাঁধবার জন্যে এগিয়ে এল। কিন্তু সেই যে-রক্ষীটি রাজপ্রাসাদে রাজাকে বলেছিল, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই শাস্তিবিধান কী প্রকারে সম্ভব, সে-ই এখন বাধা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। এ লোকটাকে দেখে মোটেও আমার চোর বলে মনে হচ্ছে না। এর মুখচোখ, হাবভাব—সবই সম্ভ্রান্ত বিত্তবান ঘরের সন্তানের মতো। না-না, চোর এ হতেই পারে না। আমাদেরই ভুল হচ্ছে কোথাও !’
তীরে এসে তরী ডুবে যায় দেখে আথিয়ামান তাড়াতাড়ি সেই রক্ষীর উদ্দেশে বলে উঠল, “মশাই, মুখ দেখে কি আর মানুষ চেনা যায়? চোরের তো ধর্মই ওই। বাইরে থেকে চোরকে চিরকাল নিরীহ, নিপাট ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখবেন, পাক্কা চোর !”
বন্ধনে বাধাদানকারী রক্ষীটি বলল, ‘কিন্তু এর বিরুদ্ধে তো কোনো অভ্রান্ত প্ৰমাণ নেই!
কোভালন হাত জড়ো করে সবাইকে কাতর কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘বিশ্বাস করুন, ও মশাইরা। চুরি আমি কক্ষনো করিনি। আমার চতুর্দশ পুরুষে কেউ কখনও চুরি করেনি। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন, পুষ্পহারে আমাদের বাড়ি। এ আমার স্ত্রীর নূপুর। ছোটোবেলায় তার বাবা তাকে উপহার দিয়েছিলেন। অভাবে পড়ে আমার স্ত্রী আমাকে নূপুরটা আজই বিক্রি করতে পাঠিয়েছে। আপনারা কী বলছেন, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি । কোথাও একটা ভীষণ গোলমাল হচ্ছে আপনাদের। আমাকে ছেড়ে দিন, আমি চোর নই। আমাকে ছেড়ে দিন, ও মশাইরা !
কিন্তু তার কাতর আবেদন কেউ কানেও তুলল না। পরিবর্তে নারুভি ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘চোপ ! চোরের আবার এত চোপা!’ কোভালনের কণ্ঠস্বর নকল করে নারুভি বলল, “চুরি করিনি—কত্তোখানি স্পর্ধা!’ তারপর রক্ষীদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে স্ফারিত নেত্রে গর্জন করে উঠল সে, ‘কী? দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আবার কী অভ্রান্ত প্রমাণের প্রয়োজন আপনাদের? রানিমার নূপুর এর কাছে, বামালসমেত ধরা পড়েছে, তারপরেও আরও প্রমাণ চাইছেন?’
বাধাদানকারী রক্ষী বলল, ‘না-না, তা নয়। কিন্তু রাজপ্রাসাদে এ লোকটাকে তো আমরা কখনও দেখিনি। এ কী করে নৃত্যশালা থেকে নূপুর চুরি করবে ?’
আথিয়ামান বলল, “আরে কতরকম চুরির কায়দা আছে, সেসব জানা আছে আপনার, রক্ষীমশাই? মন্ত্র, দৈব, মাদক, লক্ষণ, ছল, স্থান, কাল, যন্ত্র—চুরিবিদ্যা বড়ো বিদ্যা, বাবা ! যেকোনো কায়দায় চোর আপনার চোখের কাজলটুকু পর্যন্তচুরি করে নিয়ে নিরীহমুখে স্থানত্যাগ করে চলে যেতে পারে, হে হে হে! এ লোক এই সব ক-টা কৌশলই জানে৷*
চারিপাশে এত কথা-চালাচালি হচ্ছে, কে যে কী বলছে, কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কোভালন। তার শুধু মনে হচ্ছে, এই ভয়ানক কূটচক্র থেকে যেকোনোভাবে এখনই নূপুরটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এখানে এক মুহূর্তও আর নয়। কতদূরে যেন অধীর ৩০৪ | মূর্ছিত নূপুর
আগ্রহে কন্নকী তার জন্যে ভাত বেড়ে বসে আছে প্রতীক্ষায়… সে কন্নকীর কাছে ফিরবে…. কন্নকীর কাছে…
যে-রক্ষীটি কোভালনকে বাঁধতে উদ্যত হয়েছিল, সে এখন খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নারুভির হাতে নুপুরটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। তাদের এই অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে কোভালন শেষ চেষ্টা করতে গেল। কী করতে যাচ্ছে না ভেবেই নারুভির হাত থেকে নূপুরটা হ্যাঁচকা টানে ছিনিয়ে নিতে গেল কোভালন তখনই আর এক মুহূর্তও দেরি না করে অন্য একজন রক্ষী তীক্ষ্ণ ভল্লে এফোঁড়-ওফোঁড় গেঁথে ফেলল কোভালনকে। বল্লমের এক আঘাতে বুকের থেকে দরদরধারে রক্তস্রোত বেরিয়ে এল । প্রচণ্ড আর্তনাদ করে কোভালন তৎক্ষণাৎ সশব্দে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে । রক্ষীদের কেউ একজন বলে উঠল, ‘দেখলেন, শেষ মুহূর্তেও নূপুর ছিনিয়ে নিয়ে ভেগে যাওয়ার মতলব করছিল।’
আথিয়ামান মুখে চুক-চুক শব্দ করে বলল, “হায় রে! চোরের শেষ এইভাবেই হয় !” আরেকজন রক্ষী বলল, চলুন, চলুন। এখানে আর বিলম্ব করে লাভ নেই। থাক পড়ে লোকটা এখানেই। আমাদের প্রাসাদে ফিরতে হবে।
ধরিত্রীর ধুলারাশির মধ্যে কোভালনের রক্তস্রোত বয়ে যেতে লাগল অবারিত ধারায় । যেন এক অমোঘ অন্ধকার যবনিকা নেমে আসছে কোভালনের মরণাহত দৃষ্টির সামনে। ওই দূর আকাশের পারে সেই পুষ্পহার নগরী… পুণ্যতোয়া কাবেরী নদী… ওইখানে মাধবীগর্ভে তার অজাত সন্তান… আবার কোথায় যেন দ্বিপ্রহরবেলায় ভাত বেড়ে নিয়ে বসে আছে কন্নকী… কন্নকী, না মাধবী, কে যেন…. সে কন্নকীর কাছে ফিরবে…. কন্নকী বড়ো ভালো মেয়ে… ও কিছু জানে না… রাঙা টুকটুক মুখ… অনেক কষ্ট দিয়েছে ওকে কোভালন… কন্নকীর কাছে ফিরে যাবে কোভালন…. এখনই ফিরে যাবে…. এখনই….
অনিবার্য অবসান-তমিস্রার ভিতর কোভালনের নিঃসাড় চেতনা হালভাঙা নৌকার মতো তলিয়ে যেতে লাগল ।
(উনপঞ্চাশ) শোকবহ্নি
কোভালন এখনও ফিরল না দেখে প্রবল উৎকণ্ঠায় ক্রমাগত ঘর-বাহির করছিল কন্নকী।
বলে গেল, নূপুর বিক্রি হয়ে গেলেই অর্থ নিয়ে কোভালন গৃহে ফিরে আসবে, অথচ মধ্যাহ্ন গড়িয়ে অপরাহ্ণ হতে চলল, এখনও কোভালনের দেখা নেই। অন্য দিন দ্বিপ্রহরবেলায় কোভালন ঘরে ফেরে, ভাত খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে যায়। কিন্তু আজ তো অলংকার বিক্রি করেই মধ্যাহ্নবেলায় তার বাড়ি ফেরার কথা! তাহলে কি কোনো বিপদ হল? অথবা অলংকার ভাঙিয়ে একাধিক বিপণিতে সুবৰ্ণ, রত্নাদি বিক্রয় করছে বলে এত দেরি হচ্ছে? কিংবা অন্য কোনো বিশ্রী সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে কোভালন? নানা সম্ভব-অসম্ভব চিন্তা কন্নকীর উদ্বিগ্ন চেতনায় ওঠাপড়া করছিল। কেমন একটা অমঙ্গলের কালো ছায়া বারবার এসে পড়ছিল তার মনে ।
এদিকে এ বাড়িতে চিত্তিরাই ছাড়া অন্য কেউ নেই আজ। আজ গোপালকদের উৎসব। অন্যদিনের মতো আজ প্রভাতে গোচারণে যাননি মাদারি। তিনি তাঁর মেয়ে আইয়াইকে নিয়ে নদীতে স্নান করতে গেছেন। স্নান সেরে বিষ্ণুপূজা দিয়ে তাঁরা বাড়ি ফিরবেন। ফলত, এ মুহূর্তে কন্নকী একেবারে একা। নিজ মনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ভাগ করে নেওয়ার মতনও কেউ নেই এখন কাছে। প্রতিবেশীরাও সকলেই মাদারিরই মতন ভাইগাই নদীতে স্নানান্তে পূজা দেওয়ার জন্যে বেরিয়ে গেছে। পাড়াটা একেবারে শুনশান নিস্তব্ধ, মাঝেমধ্যে কেবল গবাদির ডাক দ্বিপ্রহরের সেই অনড় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে।
কোভালনের জন্য ভাত নিয়ে আর কতক্ষণ বসে থাকবে কন্নকী? কোভালন আহার করেনি, তাই কন্নকীরও আহার করা হয়নি। অপেক্ষা করতে করতে উৎকণ্ঠায় তার ক্ষুধাও এখন মরে গেছে। এত বিলম্ব তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনো বিপত্তি হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, কেন যে সে জোর করে কোভালনকে নূপুর বিক্রি করতে পাঠাল অন্তরাপণে !
আরও অর্ধঘটিকা প্রায় অপেক্ষা করার পর সে দেখল, কলমিলতার বেড়া-সংলগ্ন ফটকের আগড় ঠেলে আইয়াই ত্বরিতে উঠানে প্রবেশ করছে। দ্রুত পায়ে দাওয়া থেকে নেমে আইয়াইয়ের কাছে ছুটে গেল কন্নকী। দেখল, আইয়াইয়ের মুখ কী যেন বিপুল উদ্বেগে ভারাক্রান্ত। সে হাঁপাচ্ছে, তার আর্দ্র বস্ত্রে পথের ধুলাকাদা লেগে আছে। যেন কোনো আকস্মিক কারণে স্নান সেরেই ছুটতে ছুটতে আইয়াই বাড়ি চলে এসেছে। কিন্তু কী হয়েছে আইয়াইয়ের ? মাদারি কোথায় গেলেন? একা এভাবে ঘরে ফিরে এল কেন আইয়াই?
জিজ্ঞাসা করায় আইয়াই বলল, তার স্নান সারতে দেরি হচ্ছে দেখে তাকে অন্য মেয়েদের দলে রেখে মাদারি পূজা দিতে চলে গেছেন মন্দিরে ।
‘তা বেশ, কিন্তু তুমি কি স্নান করে মন্দিরে পুজো দিতে যাওনি আর, আইয়াই ? পুজো না দিয়েই এভাবে বাড়িতে ফিরে এলে কেন ?’কন্নকী সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল।
উত্তরে আইয়াই কিছু বলল না। শুধু স্তব্ধ নিষ্পলক চোখে সে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে কন্নকীর মুখের দিকে। তার সেই নির্বাক মূক দৃষ্টির সামনে কী জানি কোন অজানিত আশঙ্কায় কেঁপে উঠল কন্নকীর বুক ।
তবে কি আইয়াই কোনো অশুভ সংবাদ নিয়ে এসেছে? এমন কোনো সংবাদ, যা পাওয়ামাত্রই আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে কন্নকীকে বলবার জন্যেই ছুটে এসেছে আইয়াই? তবে কি কোভালনেরই কোনো বিপদসংবাদ ?
ব্যাকুল হয়ে বলে উঠল কন্নকী, ‘বলো বলো আইয়াই, চুপ করে থেকো না । কী হয়েছে? বলো আমাকে। আমি তখন থেকে ঘর-বাইর করছি। আমার বাঁ-চোখের পাতা নাচছে ক্রমাগত । ভয় করছে খুব। কামারের হাঁপরের মতন বুকটা উঠছে-পড়ছে তখন থেকে ধড়ধড় করে, ভালো করে শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছি না। কী হয়েছে, বলো। দোহাই তোমার, চুপ করে থেকো না ৷
কন্নকীর কথায় উদ্বেজিত আইয়াইয়ের চোখ দিয়ে তার বিশুষ্ক গালের উপর অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কোনোমতে সে বলতে পারল, ‘আমি স্নান সেরে উঠেই ভাইগাইয়ের ঘাটে শুনলাম, লোকে বলছে… কিছুই না, হয়তো শুধুই গুজব.. তবু কথাটা শুনে আর স্থির থাকতে না পেরে আমি মন্দিরে পুজো না দিয়ে…
‘কী শুনেছ তুমি? লোকে কী বলছে? বলো! আমার স্বামীর কোনো দুঃসংবাদ ? ‘ বলতে বলতে আইয়াইকে দু-হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল কন্নকী ।
আইয়াই বলল, ‘বলছি। ছাড়ো আমাকে, বলছি। এসব রটনা সত্যি যেন না হয়, হে ভগবান! ঘাটে লোকগুলো বলাবলি করছিল, কোভালন-আন্না নাকি রাজপ্রাসাদ থেকে রানিমা-র নূপুর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে… রাজার সৈন্যরা তাকে অন্তরাপণের কাছে গোপুরমের নীচে নিয়ে গিয়ে খুব মারছে!’ বলতে বলতে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল আইয়াই।
ঘরের মধ্য থেকে চিত্তিরাই বোনের কান্না শুনে ডাক দিল, “কী হয়েছে রে? কাঁদছিস কেন? কী হল? কী হল, ও বোন ?”
স্থির চোখে আইয়াইয়ের দিকে তাকিয়ে কন্নকী বলে উঠল, ‘কী বললে তুমি ? আমার স্বামী চোর ? নূপুর চুরি করেছে? অসম্ভব! সে তো আমার নূপুরই বিক্রি করতে গেছিল অন্তরাপণে। কী বললে? সৈন্যরা তাকে মারধোর করছে? না, না, না! কিছুতেই হতে পারে না। তুমি নিশ্চয়ই ভুল শুনেছ, আইয়াই !’
‘যেন আমার শোনা-কথা ভুলই হয়, কন্নকী। কিন্তু তাহলে তুমি অমন করে কাঁপছ কেন?’ আইয়াই উদ্বিগ্ন স্বরে বলল।
খুব জোরের সঙ্গে আইয়াইয়ের কথাটাকে প্রত্যাখ্যান করলেও কন্নকীর মন এবার একেবারে বিপদ-আশঙ্কায় অশান্ত হয়ে উঠতে লাগল। সে কী করবে, জানে না। থরথর করে কাঁপতে লাগল তার সারা শরীর। কোনোমতে ছুঁয়ের উপর বসে পড়ল সে। তবে কি আইয়াইয়ের আনা সংবাদই ঠিক? কোভালনকে চোর সন্দেহে প্রহার করেছে রাজসৈন্যরা?
কিছুক্ষণের মধ্যেই পল্লীর আরও কয়েকজন যুবতী গৃহপ্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হল। তাদের মুখও মেঘাবৃত মলিন, গম্ভীর। তারাও শুনে এসেছে ওই একই কথা, বলতে লাগল। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে বলল, ‘তুমি একবার চলো, কন্নকী। আমরা সবাই অন্তরাপণের মন্দিরে যাব তোমার সঙ্গে। নিজের চোখে একবার…’
হাহাকার করে উঠল কন্নকী, ‘সেখানে গিয়ে নিজে চোখে কী দেখব আমি? কী দেখার কথা বলছ তুমি আমাকে ?’
চুপ করে রইল মেয়েটি। তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, ‘নদীর ঘাটে একজন লোক বলছিল, সে নাকি স্বচক্ষে মন্দিরের গোপুরমের নীচে… কোভালনের প্রাণহীন নিথর শরীর… ‘
‘কী বললে?’ চিৎকার করে কথাটা বলেই মাথাটা ঝন্ করে ঘুরে উঠল কন্নকীর। মনে হল, সমস্ত পৃথিবীটা তার চোখের সামনে যেন দুলে উঠল। কোনোমতে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল কন্নকী মেয়েটিকে, ‘তুমি ঠিক শুনেছ?’
অন্য আরেকটি মেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, কন্নকী। লোকজন বলছে, কোভালন আর নেই… রাজসৈন্যরা তাকে চোর সন্দেহে… আমিও অনেকের কাছে এই একই কথা….’
তারপরে অন্য মেয়েরা কে কী বলাবলি করছে চারপাশে, আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না কন্নকী। তার চোখের ভিতরটায় কে যেন উষ্ণ রক্ত ছিটিয়ে দিচ্ছে। পায়ের নীচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে তার। চোখের সামনে সেই মেয়েরা, বাড়ির উঠান, কলমিলতার বেড়া অপরাহ্ণের রোদের ভিতর যেন মূক চলচ্ছবির মতন অর্থহীনভাবে নড়ছে। মস্তিষ্কের মধ্যে কতগুলো অনির্দেশ্য আকার গড়ে উঠে ভেঙে পড়ছে। ভয়ে, বিহ্বলতায়, যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠল সারা শরীর। তারপর আর কিছু বুঝবার আগেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কন্নকী অবলম্বনহীন।
অনেক কষ্টে মুখে-মাথায় জল ছিটিয়ে সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনল মেয়েরা। কোনোমতে উঠে বসাল কন্নকীকে। তার চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল। চোখের কাজল ধুয়ে যাচ্ছে কান্নায়। সকালে একটা কুন্দমালা পরেছিল সে চুলে। এখন সে মালা অর্ধস্খলিত হয়ে ঝুলছে আধখোলা খোঁপা থেকে। কপালে করাঘাত করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাহাস্বরে বলতে লাগল কন্নকী, ‘হা রে আমার দুর্ভাগ্য! হা রে কর্মফল! হা রে ঈশ্বর ! আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় চলে গেলে, কোভালন? এ কোন চিতার আগুনের মধ্যে আমাকে ফেলে গেলে তুমি? আমার এই অর্থহীন সতীত্ব নিয়ে আমি এ কীসের মধ্যে বেঁচে থাকব এখন? হে বিধাতা, কোন পাপে আমি এ নষ্ট পৃথিবীতে নারীজন্ম গ্রহণ করেছিলাম!’
কয়েকজন মেয়ে এগিয়ে এসে সান্ত্বনা দিতে চাইল কন্নকীকে। একজন বলল, ‘আমরা তো এখনও নিজেদের চোখে কিছু দেখিনি, কন্নকী আক্কা ! কিছুই জানি না । কিছু না জেনে এমন অপবাদে বিশ্বাস করা….’
দুই হাত দিয়ে সেই সান্ত্বনাপ্রদানকারিণী মেয়েদের সরিয়ে দিয়ে টলতে টলতে এবার উঠে দাঁড়াল কন্নকী। গায়ের আধখানা কাপড় তার মাটিতে লুটোচ্ছে, চুল খোলা। উন্মুক্ত কেশপাশে শুকিয়ে আসা কুন্দমালাখানি বিশুষ্ক অস্থিহারের মতো একপাশে ঝুলছে। আরক্তভীষণ চক্ষু, অক্ষিতারা ঘুরছে উন্মাদিনীর ন্যায়। মুখভাব বিলোল ভয়ংকর, যেন এখনই মুখমণ্ডল বিস্ফারিত হয়ে রক্ত ফুটে বেরিয়ে আসবে। কন্নকীর সে স্বাভাবিক রূপ, তার সমস্ত মনোহারী সৌন্দর্য এখন লুকিয়ে পড়েছে, পরিবর্তে কী যেন একটা ভীষণা শক্তি আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে তার সর্ব অবয়বে। এ যেন আর সেই পরিচিত কন্নকী নয়, এ যেন অন্য কেউ, ভীমা, ভয়ংকরী!
কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল কন্নকী, ‘শোনো তোমরা! আমার স্বামী তস্কর নয়। সে আমারই নূপুর বিক্রয় করতে অন্তরাপণে গিয়েছিল। আমিই তাকে পাঠিয়েছিলাম। তোমাদের রাজা আমার স্বামীর উপর অবিচার করে তাকে হত্যা করেছে। পাণ্ড্যরাজার রাজদণ্ড বেঁকে গেছে। আমি এর প্রতিশোধ নেব। কেউ বাঁচবে না। এ নগরী যে-পাপ করেছে, আমি তাকে আগুন দিয়ে পরিশুদ্ধ করব!’
বলতে বলতে এক মুহূর্তে প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে কুলুঙ্গিতে রক্ষিত সেই কাষ্ঠপেটিকা থেকে অবশিষ্ট নূপুরখানি বের করে নিয়ে পরমুহূর্তেই ঝড়ের মতো দুর্নিবার বেগে মাদারিগৃহ থেকে পথে বেরিয়ে গেল কন্নকী ।
(পঞ্চাশ) দাবানল
গলিপথ দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে অনেক পথ পেরিয়ে ব্যস্ত রাজমার্গের জনাকীর্ণ এক চৌমাথায় এসে দাঁড়াল সে। হাতে তার সেই একখানি অবশিষ্ট নূপুর। জনতার গোলযোগের ঊর্ধ্বে গলা তুলে তারস্বরে সে বলতে লাগল, ‘শুনুন, শুনুন আপনারা যত নগরের সভ্য অধিবাসীবৃন্দ ! শুনুন আপনারাও, এ নগরীর যত সতী রমণীর দল ! আপনারা এক অবিবেচক, অপদার্থ, স্বার্থপর রাজার অধীনে বসবাস করেন। এখানে বিচার নেই, সাধারণ মানুষের ন্যূনতম সম্মান নেই, কোনো মূল্যবোধ আর অবশিষ্ট নেই। এখানে শুধু বিত্তবানের দম্ভ, প্রতিভাহীনের শূন্যগর্ভ আস্ফালন। শুনুন আপনারা !’
কন্নকীর এমন উন্মত্ত উদ্ঘোষণায় তার চারপাশে মাছির মতো লোকের ভিড় জমে গেল। একজন নাগরিক চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘কেন আপনি আমাদের রাজাকে এমন অপবাদ দিচ্ছেন? কী হয়েছে, খুলে বলুন!’
কন্নকী সেই লোকটির চেয়েও বেশি জোরে চেঁচিয়ে উত্তর দিল, ‘ঠিকই বলছি। যা হওয়ার, তাই-ই হয়ে গিয়েছে। যা প্রতিনিয়ত আপনাদের এই মহামূল্যবান নগরীতে ঘটে থাকে, ঠিক তাই-ই হয়েছে। আমার স্বামী আমার একখানা নূপুর আজ অন্তরাপণে বিক্রয় করতে গিয়েছিল। আমরা খুব গরিব, আমাদের খুব অর্থাভাব, তাই একটাই বিক্রি করতে গেছিল সে। এই যে আমার হাতে সেই জোড়ার অবশিষ্ট নূপুরটি! তা আমার স্বামী যে-নূপুরটা নিয়ে গিয়েছিল, সেই নূপুরের দাম ওরা দিতে পারেনি। না দিক, তাতে ক্ষতি ছিল না। কিন্তু দাম না দিয়ে আমার স্বামীর কাছ থেকে নূপুরটা কেড়ে নিয়ে রাজা তাকে চোর অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলেছে। তাহলে বলুন, চোর কে? আমার নিরীহ স্বামী, নাকি আপনাদের পরস্বাপহারক রাজা? শুধু চোরই নয়, আপনাদের রাজা তো একজন ঘাতক ! ঘৃণ্য ঘাতক !’
চারিপাশে সবাই গুঞ্জন করতে লাগল। একজন বলল, ‘সেকী! এই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এ কোন রাজার রাজ্যে আমরা বসবাস করছি, অ্যাঁ?’
আরেকজন বলল, ‘কিন্তু কী হয়েছে, তার সত্যাসত্য কীভাবে আমরা এই পথের উপরে দাঁড়িয়েই বিচার করব ?’
তৃতীয় এক ব্যক্তি আপনমনে বলল, ‘পথের উপরেই যত গোলমাল! প্রতিদিন একটা-না-একটা গোলমাল। এসবে যত জড়িয়ে পড়ব আমরা, ততই নিজেদের বিপদ ডেকে আনব, হ্যাঁ!’
আবার চতুর্থ একজন প্রশ্ন করল, ‘আপনার স্বামীর মৃতদেহ এখন কোথায় ?’
পঞ্চম ব্যক্তি বলল, “আপনি প্রকৃত বিচারের জন্য রাজার কাছে যাচ্ছেন না কেন ? রাজার কাছে যান, রাজার কাছে যান, এখানে বলে কী লাভ? রাজাকে বলুন, রাজাকে গিয়ে সব খুলে বলুন।’
ষষ্ঠ ব্যক্তি বলল, ‘আরে রাজাকে গিয়ে বললেই কি সুবিচার পাওয়া যাবে? আজ এই মহিলার উপর অবিচার হয়েছে, কালকে আমাদের উপর হবে। কেউ আমরা এই পাণ্ড্যরাজ্যে এখন আর নিরাপদ নই, বুঝলে?’
সপ্তম ব্যক্তি বলল, ‘কেন দাদা, আজ আপনি এই কথা বলছেন? বারো বছর আগে যখন নেডুঞ্জেলিয়ণের বাপ রাজত্ব করত, তখন যে সেই শেম্বিয়ান নামে একটা গরিব ব্যবসায়ীকে অন্তরাপণের সামনে ধরে খুন করে দিল বিনা বিচারে, কই তখন তো আপনি মুখ খোলেননি ? ”
একজন রমণী বলে উঠল, ‘সব নির্দোষ মানুষের উপরেই চিরটাকালই এরকম অত্যাচার হয়। মা গো!’
এক বৃদ্ধা কন্নকীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ মেয়েটার উপর মনে হয় যেন সাক্ষাৎ দেবীর ভর হয়েছে গো! মনে হয়, খুব বড়ো ঘরের মেয়ে গো, কপালদোষে দুঃস্থ হয়ে পড়েছে। মেয়েটার চোখ দুটো লাল, চোখের তারা কেমন ভাটার মতন ঘুরছে, চোখের জলে কাজল গলে গেছে, আহা ! এ খুব দুর্লক্ষণ, খুব দুর্লক্ষণ ! ওকে কেউ জিজ্ঞেস করো না, ওর স্বামীর মৃতদেহ কোথায় পড়ে আছে? যদি তোমাদের জানা থাকে, তাহলে যাও না নিয়ে তোমরাই ওকে সেখানে না হয়! মানুষের বিপদে মানুষের মতো একটা কাজ অন্তত করো!’
তখন কিছু লোক সমস্বরে কন্নকীকে বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ, চলুন তো, চলুন তো, আমরা আপনার সঙ্গে যাব। কোথায় আপনার স্বামীর মৃতদেহ পড়ে আছে বলে শুনেছেন ? কী বললেন? অন্তরাপণের মন্দিরের সামনে ?’
কিন্তু মাদুরাইতে অন্তরাপণ তো আর একটি মাত্র নয়। প্রতি অন্তরাপণের সামনেই একটি করে মন্দির। কোথায় পড়ে আছে হতভাগ্য কোভালন? বহু অন্বেষণ করে সমবেত জনতা কন্নকীকে নিয়ে ভাইগাই নদীতটের কাছাকাছি এক অন্তরাপণে এসে উপস্থিত হয়ে স্বর্ণবিপণির পুরোভাগে এক মন্দিরের গোপুরমের নীচে কোভালনের রক্তাপ্লুত শরীর দেখতে পেল।
এতক্ষণ কন্নকী ভিড়ের মধ্যে ছিল, অন্যদের সঙ্গেই পাগলের মতো কোভালনকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু এখন যখন সে মন্দিরের গোপুরমের নীচে কোভালনকে রুধিরাপ্লুত দেহে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল, তখন সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না । চারপাশের মানুষজনের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে ভিড়ের থেকে নিজেকে মুহূর্তে আলাদা করে নিয়ে তিরবেগে ছুটে এল সে কোভালনের কাছে। বিস্ফারিত নয়নে দেখল, কোভালনের সমস্ত দেহ রক্তে ভরে আছে, তার শরীরের চারপাশে ধুলার উপর জমে আছে চাপচাপ রক্ত। সেই রক্তসমুদ্রের মধ্যে যেন একটা ফেনার ফুলের মতো নিঃস্পন্দ কোভালন কেমন অগাধ ঘুমের অতলে তলিয়ে গিয়েছে!
কোভালনের বুকের উপর আছড়ে পড়ল কন্নকী তীব্র হাহাকারে । উন্মাদিনীর মতো মৃত স্বামীর বুকে মাথা কুটতে কুটতে সে বলতে লাগল, ‘এ কেমন হল বলো তো ? কন্নকীর উপর অভিমান করে ঘুমিয়ে পড়লে তুমি? সোনার বরণ তোমার দেহ, এমন ধুলার মধ্যে আবর্জনা মেখে পড়ে আছ? স্নান করবে না ভাইগাই নদীতে ? ভাত খাবে না দুপুরে? আর কোনোদিন খাবে না আমার হাত থেকে? এই যে কুন্দমালাটা… এই মালাটা তুমি সকালে গলায় পরেছিলে গো, ঘর থেকে বেরোনোর সময় আমাকে চুম্বন দিয়ে আমার খোঁপায় জড়িয়ে দিয়ে এসেছিলে গো মালাটা… এই শুকনো মালাটা নিয়ে আমি এখন কী করি বলো তো? আমি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, তুমি কেন আমার এ অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না, কোভালন? আমি… আমি তোমার কন্নকী… তোমার কন্নকী… তোমাকে সবসময় ভালো হতে বলতাম আমি, তাই তুমি অভিমান করে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? ঠিক কাজ করলে, কোভালন? বলো, ঠিক করলে কি ?’
তারপরেই নগরীর অপেক্ষমাণ জনতার দিকে ফিরে সরোষে বলতে লাগল, ‘এখানে কোনো মেয়েমানুষ নেই? কোনো সত্যিকারের মেয়েমানুষ? নাকি এ নগরে শুধু সেই মেয়েরাই থাকে, যারা নিজেদের স্বামীর উপর এমন অবিচার দেখেও মুখ বুজে চুপ করে থাকে? কোনো পুরুষ নেই এ নগরে, কোনো পুরুষের মতন পুরুষ? নাকি এ নগরে শুধু সেই সব পুরুষেরাই থাকে, যারা শুধু নিজের বউ-ছেলে-মেয়ের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত, অন্যের উপরে অত্যাচার অবিচার দেখে যারা হাতের উপর হাত রেখে চুপ করে বসে থাকে? এ নগরীতে মাথার উপর কোনো ঈশ্বর নেই, কোনো সত্যিকারের ঈশ্বর? নাকি এ দেশে শুধু এক অত্যাচারী অনাচারী রাজারই অপশাসন, যে-অপশাসনে দিনদুপুরে অসহায়, নিরন্ন, নির্দোষ মানুষ পথেঘাটে খুন হয়ে যায় ?
আচম্বিতে মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়লেন, যেন এ মর্মন্তুদ দৃশ্য জগৎসাক্ষী দিবাকরও আর সহ্য করতে পারছেন না। অপরাহ্ণের সেই অস্পষ্ট আলোর মধ্যে কোভালনকে ছেড়ে দলিতা ফণিনীর মতো কন্নকী উঠে দাঁড়াল। সে এখনই রাজপ্রাসাদে যাবে। এ অন্যায়ের বিচার চাইবে সে! তার ভীষণ চক্ষু দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়তে লাগল। ক্রোধের আগুন সারা শরীরে প্রজ্জ্বলিত করে সে ছুটতে লাগল রাজপ্রাসাদের দিকে।
সমবেত জনতাও দ্রুতধাবমান দাবানলের মতো তাকে অনুসরণ করতে লাগল।
(একান্ন) অগ্নিবলয়
জনতার বিপুল গর্জন শুনে চমকে উঠলেন রাজা নেডুঞ্জেলিয়ণ। সেই ভীষণ কলরোল যেন রাজপ্রাসাদের দ্বারপথের দিক থেকেই অপ্রতিহতবেগে ধেয়ে আসছে। পাত্র, মিত্র, অমাত্য, সভাসদ, জ্যোতিষী সকলেই চমকিত, রানি কোপ্পারুনদেবী সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চারিপাশে তাকাচ্ছেন। এ কারা রাজপ্রাসাদের দ্বারে এমন ভয়ানকভাবে গর্জন করছে?
এমনিতেই এক প্রবল অস্বস্তির মধ্যে অসময়ে এই সন্ধ্যাবেলায় মন্ত্রণাসভা আহ্বান করতে হয়েছে। অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আজ রাজরানি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এক ভয়প্রদ দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। যেন রাজদণ্ড বেঁকে যাচ্ছে, রাজছত্র খসে পড়ছে। প্রাসাদদ্বারে বিপদসূচক ঘণ্টা নিনাদিত হচ্ছে। ধরিত্রীর দশদিক থরথর করে কাঁপছে। রাত্রির অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে সূর্যকে। তিমিরযামিনী জুড়ে জেগে উঠছে রামধনুর বিলোল বিস্ফার। আকাশের বুক থেকে খসে পড়ছে উজ্জ্বল কোনো নক্ষত্র।
সেই দুঃস্বপ্ন দেখে রাজসকাশে ছুটে এসেছেন কোপ্পারুনদেবী। এ কোন অমঙ্গলের সংকেত! রাজা তখনই সভাসদদের ডেকেছেন বিপদের পূর্বাভাস পেয়ে। রাজজ্যোতিষী গণনা করে বললেন, এই দুঃস্বপ্নের ফল অত্যন্ত অশুভ। কোথাও নিশ্চয়ই অবিচারজনিত কারণে বিপদ হয়েছে। দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছে দুয়ারে।
চিন্তান্বিত সভাস্থ সকলেই, এরই মধ্যে এই প্রাসাদদ্বারে জনকলরোল। অসংখ্য মানুষ যেন প্রাসাদের সামনে সমবেত হয়ে চিৎকার করছে। কারা যেন দ্বারকবাটে ক্রমাগত শালস্তম্ভ দিয়ে আঘাত করে চলেছে। আওয়াজের প্রাবল্যে কান পাতা দায়। এরই মধ্যে কার যেন উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কে এক নারী ভীমনাদে গর্জন করে উঠল, ‘হা দ্বারপাল! হো প্রতিহারী! হে প্রাসাদরক্ষীর দল! তোমরা কাকে রক্ষা করছ? এক দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজাকে, যার বিচারব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে গেছে? যাও, যাও, যাও সেই অত্যাচারীর কাছে যাও। গিয়ে বলো, দ্বারে তার সর্বনাশ দাঁড়িয়ে আছে। যে-নূপুরযুগ নারীর দুপায়ে মধুচ্ছন্দে রণিত হত একদিন, আজ তারই একটি অকালবিধবার হাতে প্রাণসংহারী অস্ত্র হয়ে উঠেছে। যাও, তোমাদের রাজাকে গিয়ে বলো, আমি তার মৃত্যু নিয়ে এসেছি!’
সে-উদ্ঘোষণা শুনতে পেয়ে ভয়ে কেঁপে উঠল রাজার হৃদয়। রানি ও অন্যান্য সভাসদদের মুখ ত্রাসে পাংশুবর্ণ ধারণ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাসাদের দৌবারিকপ্রধান সভার মধ্যে উপস্থিত হল। রাজাকে বিনীত অভিবাদন জানিয়ে দৌবারিক বলল, ‘মহারাজ! প্রাসাদের দুয়ারে অগণ্য মানুষ বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। তাদের কেন্দ্রে এক ভীষণদর্শনা নারী । আমরা তাদের কিছুতেই সামলাতে পারছি না। দ্বারকবাটে এমন আঘাত করছে যে, কবাট এবার ভেঙে পড়বে। আর সেই নারী যে কে, আমরা জানি না। আলুলায়িত কুন্তলা, বিস্রস্তবেশা রমণী দেবী কোরাভাই নন, কেননা তাঁর হাতে ভল্ল নেই বা চরণতলে মহিষমূর্তি নেই। তিনি শিবমোহিনী অনঙ্গু নন, প্রেতপিশাচ মধ্যে নৃত্যপরা বলিপ্রিয়া কালিকা তিনি নন, এমনকি দারুকাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গাও নন। অথচ এঁদের প্রত্যেকেরই ভীষণতা তাঁর অস্তিত্বে। তাঁর সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে, চোখের কাজল মর্দিত, কেশপাশ ঝড়ের মতন উড়ছে, আঁচল ভূমে লুটোচ্ছে। হাতে তাঁর একটা নূপুর। সেই নূপুর হাতে তিনি জনতার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু গর্জন করছেন। আমরা কী করব, আদেশ দিন।’*
রাজা নেডুঞ্জেলিয়ণ ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠলেও বাইরে সে-ভাব প্রকাশিত হতে দিলেন না। তিনি রাজা; বিপদে নিজেকে সামলাতে না পারলে তাঁর চলে না। গম্ভীর স্বরে নেডুঞ্জেলিয়ণ বললেন, ‘ভিড়ের মধ্য থেকে শুধু পাঁচজন প্রতিনিধিস্থানীয় নাগরিক ও ওই নারীকে ভিতরে আসতে দাও। বাকিদের প্রাসাদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলো। আগে সব শুনি, জানি, কী ওদের অভিযোগ। তারপর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে!’
পুনরভিবাদন জানিয়ে দৌবারিকপ্রধান রাজাদেশ-পালনার্থে সভা থেকে বেরিয়ে গেল। তারই কয়েক মুহূর্ত পরে পাঁচ নাগরিকপ্রতিনিধি ও সেই বলধৃষ্টা নারী ঝড়ের বেগে সভামধ্যে এসে দাঁড়াল। তাদের ভীষণ মূর্তি দেখে সভাসদরা প্রমাদ গণলেন, রাজার অন্তরাত্মা পর্যন্ত যেন ত্রাসে শুকিয়ে গেল।
যথাসম্ভব কোমল কণ্ঠে রাজা সেই নারীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘নারী, তোমার মুখ চোখের জলে পরিপ্লুত। তুমি কে, ললনা? এখানে কী অভিযোগ নিয়ে এসেছ?’
তীক্ষ্ণ স্বরে উত্তর দিল কন্নকী, ‘অবিবেচক রাজা ! আমি পুষ্পহার নগরীর অধিবাসিনী, নাম আমার কন্নকী ! আমার পিতার নাম মানাইক্কন, আমার স্বামী মাশাত্ত্ববানপুত্র কোভালন । অনুসন্ধান করে দেখুন, আমার পিত্রালয় বা শ্বশুরালয়ে কোনো অন্যায়কারী অধার্মিক ব্যক্তি খুঁজে পান কি না ! উচ্চ বংশের বিত্তবান পরিবারের সন্তান আমরা। কিন্তু ভাগ্যদোষে আজ আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। তাই জীবিকার সন্ধানে আপনার রাজ্যে এসেছিলাম। আমার একজোড়া নূপুর মাত্র অবশিষ্ট ছিল। দারিদ্র্যপীড়িত হয়ে তার একখানা বিক্রয় করার জন্য আমার স্বামী অন্তরাপণে ব্যাপারী আথিয়ামানের কাছে এসেছিলেন। কিন্তু সেই নূপুরখানা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তাঁকে চোর অপবাদ দিয়ে আপনার আরক্ষাকর্মীরা হত্যা করেছে। আমি এই অন্যায়ের প্রতিবিধান চাইতে এসেছি।’
রাজা উত্তর দিলেন, ‘চোর-অপবাদ যে মিথ্যা, তার কি কোনো প্রমাণ আছে?’
‘সত্য কি মিথ্যা—সে-প্রমাণ তো আপনার সংগ্রহ করার কথা, রাজা ! আপনার রক্ষীরা আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দিল, অথচ আপনিই জানেন না, অপবাদ সত্য নাকি মিথ্যা ? বিনা বিচারে আপনি কাউকে শাস্তি দিতে পারেন কীভাবে ?’
নেডুঞ্জেলিয়ণ বিপন্ন বোধ করতে লাগলেন। তাঁর কপাল ঘেমে উঠল। একথা সত্যি যে, কোভালন দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই তিনি রক্ষীদের বলেছিলেন, প্রয়োজনে চরম দণ্ড দিতে। আসলে তখন রানির কারণে এত বিক্ষিপ্তচিত্ত ছিলেন যে, সবিবেচনা করার সময় পাননি। কিন্তু সেকথা এখন অন্যদের বুঝতে দিলে চলবে না। তিনি অবিকম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘কোভালনের কাছে রানির নূপুর পাওয়া গেছে, এর থেকেই তো প্রমাণ হয় যে, সে চোর !’
কন্নকী বিদ্রুপাক্ত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘তাই নাকি? কী করে বুঝলেন, আমার স্বামীর কাছে যে-নূপুরটা পাওয়া গেছে, সেটাই আপনার রানির খোয়া-যাওয়া নূপুর? গহনানির্মাতারা কি একই ছাঁচ থেকে একাধিক নূপুর তৈরি করে না? আমি যদি বলি, আমার স্বামীর হাতে যে-নূপুরটা ছিল, সেটা আমারই ব্যবহৃত নূপুর? এই তো আমার হাতে সেই জোড়ার আরেকটা!’
রাজা নেডুঞ্জেলিয়ণ আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি খুঁজছিলেন। সত্যিই, এদিকটা তিনি ভেবে দেখেননি। এটা ঠিক, রানিরও একটিই নূপুর চুরি হয়েছিল। সেই জোড়ার অবশিষ্টটি রানির কাছেই এখনও আছে। কন্নকীর হাতের নূপুরটাও সেটারই মতন দেখতে । তাহলে কি মেয়েটি যা বলছে, তা সত্যি ?
স্বামীকে বিপর্যস্ত দেখে রানি কোপ্পারুনদেবী এবার মুখ খুললেন, ‘এই মেয়ে! তুমি বৃথাই অর্থহীন অভিযোগ শানাচ্ছ! তোমার হাতের নূপুরের সঙ্গে তো এর কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার স্বামীর কাছে যে-নূপুরটা পাওয়া গেছে, সেটা যে তোমার, সেটা যে আমার নয়, প্রমাণ করবে কীভাবে?”
যদিও প্রমাণ করার দায়িত্ব রাজার, তবু এই প্রশ্নের মুখে কন্নকী অপ্রতিভ হয়ে পড়ল । এতক্ষণ যে-তেজের সঙ্গে সে তর্ক করছিল, এখন যেন তাতে হঠাৎ ভাটা পড়ল। সত্যিই তো, কীভাবে সে এখন প্রমাণ করবে যে, কোভালনের কাছে পাওয়া নূপুরটা তারই ?
সারাদিন সে খায়নি, এতটা পথ চরম উত্তেজনায় দৌড়ে এসেছে, কোভালনের মৃতদেহ এখনও পড়ে আছে মন্দিরের গোপুরমের নীচে, সারা শরীর হা-ক্লান্ত, তার মন আর এই ঘটনাস্রোতের চাপ নিতে পারছে না। চোখে অন্ধকার দেখছে সে, মনে হচ্ছে আবার অজ্ঞান হয়ে যাবে বুঝি। কোন যুক্তি দিয়ে সে এই সভায় প্রমাণ করবে, তার স্বামী নির্দোষ ?
রাজসভায় অন্য সভাসদরা হইচই করছে। কন্নকীর সঙ্গে আসা পাঁচজন জনপ্রতিনিধি হতমান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে দপ্ করে আলো জ্বলে ওঠার মতো কন্নকীর মনের ভিতর ফুটে উঠল অনেক অনেক বছর আগের একটা স্মৃতি। একটা হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য । বহু বহু বছর আগে, তখন কন্নকীর সবেমাত্র কৈশোরকাল, তার পিতা মানাইক্কন জন্মদিনে নূপুরজোড়া উপহার দিয়ে তাকে বলেছিলেন, ‘একটা কথা মনে রাখিস, মা ! অনেক রত্ন যেমন তোর নূপুরের গায়ে বসানো আছে, তেমনি নূপুরের ভিতরেও কিন্তু মূল্যবান রত্ন আছে। প্রত্যেকটা সোনার ফুলের ভিতরে লুকোনো আছে একটা করে নীলকান্তমণি । একথা তুই আর কাউকে বলিস না এখন।’
মুহূর্তে যেন প্রাণ ফিরে পেল কন্নকী। সভাসদদের চিৎকার চেঁচামেচি ছাপিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘প্রমাণ আছে।
এক লহমায় সকলেই চুপ করে গেল। রাজসভায় সুগভীর নৈঃশব্দ্য। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী প্রমাণ ? ”
কন্নকী উত্তর দিল, ‘আমার নূপুরের প্রত্যেকটা সোনার দানার মধ্যে একটা করে নীলকান্তমণি আছে।’
প্রতিযুক্তি হিসেবে রাজা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই রানি কোপ্পারুনদেবী বলে ফেললেন, ‘আশ্চর্য তো! আমি শুনেছিলাম, আমার নূপুরের সোনার ফুলগুলোর ভিতরে একটা করে শ্বেত মুক্তা আছে। বিবাহে উপহার পেয়েছিলাম। কে উপহার দিয়েছিল, এখন আর মনে নেই। একই অলংকারশিল্পীর দ্বারা নির্মিত না কি দুজোড়া নূপুর ?’
আর বিলম্ব না করে হাতের নূপুরটা মেঝেতে আছড়ে ভেঙে ফেলতে যাচ্ছিল কন্নকী । কিন্তু তার আগেই রাজা বলে উঠলেন, ‘থামো! তোমার হাতের নূপুরটা ভাঙলে এ সমস্যার নিশ্চিত সমাধান হবে না। তোমার স্বামী কোভালনের কাছে যে-নূপুরটা পাওয়া গেছে, সেটাই ভেঙে দেখা দরকার। সেটা ভেঙে যদি দেখা যায়, নূপুরের ভেতরে নীলকান্তমণি আছে, একমাত্র তাহলেই প্রমাণ হবে, নূপুর তোমার, রানির নয় এবং তোমার স্বামী নির্দোষ।
রাজার নির্দেশে জনৈক রক্ষী অন্দর থেকে একটা থালায় করে কোভালনের কাছে যে-নূপুরটা পাওয়া গেছিল, সেটা নিয়ে এল। রাজা থালা থেকে নূপুরটা তুলে নিয়ে কন্নকীর হাতে দিলেন।
কন্নকীর দিকে ভয়ে ভয়ে চেয়ে রইলেন রাজা। এখন যদি এই নূপুরটা ভাঙলে সোনার দানার ভেতর থেকে মুক্তা বেরোয়, তা হলে নূপুর কোপ্পারুনদেবীর। কিন্তু যদি নীলকান্তমণি বেরিয়ে আসে, তাহলে…. ? নিদারুণ উদ্বেগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন নেডুঞ্জেলিয়ণ ।
নূপুরটা হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকাল কন্নকী। চুম্বন করল নূপুরটাকে কত আদরভরে। তারপর সজোরে রাজসভার শান-বাঁধানো মেঝের উপর নূপুরটাকে আছড়ে মারল।
মেঝেতে আছড়ে পড়ে রুপোর তার খুলে গেল। সোনার ফুলগুলো চুরমার হয়ে গেল। সেই বিচূর্ণ সোনার ফুলগুলোর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল অজস্র নীলকান্তমণি । তার মধ্যে একটা ছিটকে গিয়ে লাগল রাজার মুখে রাজা, রানি, পাত্র, মিত্র, সভাসদ, কন্নকী, জনপ্রতিনিধি সকলেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেঝেতে নীলকান্তমণিসমূহের মধ্যে পড়ে থাকা চূর্ণবিচূর্ণ নূপুরটার দিকে। একদিন কন্নকীর পায়ে পায়ে বেজে উঠে সুরের মূর্ছনা তুলত যে-নূপুর, আজ তা শতধাবিভগ্নরূপে মেঝের উপর মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছে।
শ্মশানের মতো নিষ্প্রাণপ্রায় সেই রাজসভার নীরবতা ভেঙে এইবার সেই জনপ্রতিনিধিদের একজন বলতে লাগল, ‘রাজা! আপনার রাজ্যের অধিবাসী আমরা। আপনি আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আপনার সুশাসনের উপরে আমাদের আস্থা ছিল। কিন্তু আজ একজন নিরীহ বিদেশী লোক এ নগরে ভাগ্য ফেরাতে এসে আপনার অবিচারের শিকার হয়ে নিহত হল। এমন অন্যায় আমাদের সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে…’
আরও কীসব বলতে যাচ্ছিল সেই জনপ্রতিনিধি, কিন্তু পরের পর সংঘটনার অভিঘাত সামলাতে পারলেন না আর রাজা নেডুঞ্জেলিয়ণ। জ্ঞান হারিয়ে তিনি সিংহাসনের থেকে নীচে গড়িয়ে পড়লেন।
সঙ্গে সঙ্গে রানি কোপ্পারুনদেবী ছুটে গেলেন স্বামীর কাছে। সভাসদরা স্বস্থান থেকে উঠে এগিয়ে গেলেন। রাজবৈদ্য সংজ্ঞাহীন রাজার নাড়ি চেপে ধরে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুক্ষণে পরেই গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে রাজবৈদ্য বললেন, ‘খুবই দুঃখজনক! রাজার প্রাণ বেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যেই!’
কথাটা শুনে জ্ঞান হারালেন রানি কোপ্পারুনদেবীও। তখন সেই সংজ্ঞাহীনা রানির দিকে তাকিয়ে কন্নকী বলে উঠল, ‘আমি দুঃখিত। আমি চাইনি, আমার মতন স্বামী হারানোর যন্ত্রণা আপনাকে দিতে। আমি শুধু সুবিচার চাইতে এসেছিলাম। আমার স্বামী নির্দোষ প্রমাণ করতে এসেছিলাম। কিন্তু হায় ! আমাকে আপনার স্বামীর মৃত্যুর কারণ হতে হল। এর শাস্তি আমি নিজেই নিজেকে দেবো। এখন আমার এমনিতেও আর বেঁচে থাকার অর্থ নেই।’
এই কথা বলেই কন্নকী সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীর কটিবন্ধন থেকে ছুরিকাখানি ছিনিয়ে নিয়ে নিজেকে উপর্যুপরি আঘাত করতে লাগল। সমস্ত সভাসদ এখন রাজা-রানিকে ছেড়ে কন্নকীকে নিরস্ত করবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টায় ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে লাগল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা! একের পর এক নিজের বক্ষে ছুরিকা দিয়ে আঘাত করতে করতে কন্নকী বলতে লাগল, ‘ধিক আমার যৌবন ! ধিক আমার সুমেরুসদৃশ স্তনযুগ ! ধিক রূপ ! ধিক দেহ! ধিক জীবন!’
বলতে বলতে সে নিজের বক্ষোদেশ একেবারে রুধিরপ্লাবিত করে তুলল। বক্ষোদেশ থেকে রক্তাক্ত মাংসখণ্ড কেটে ফেলে দিল রাজসভায়। উপস্থিত সবাই শিহরিত হয়ে চোখ বুজে ফেলল ভয়ে, ত্রাসে, আতঙ্কে তারপরেই সেই রক্তাক্ত শরীরে মত্ত মাতঙ্গীর মতো রাজসভা ছেড়ে, প্রাসাদদ্বার পেরিয়ে, আতঙ্কিত জনতার সঙ্গ পরিহার করে, রাজপথের পর রাজপথ, প্রাসাদ, দেউল, খিলান, স্তম্ভ অতিক্রম করে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে সে এসে দাঁড়াল সেই মন্দিরের গোপুরমের নীচে, যেখানে পড়ে আছে কোভালনের মৃত শরীর ।
ঊর্ধ্বাকাশে মাথা তুলে কন্নকী, মৃত্তিকার কন্যা, উচ্চারণ করল, ‘যে-পাপে আমার জলের মতো সরল ভালোবাসা, ফুলের মতো সহজ জীবন নষ্ট হয়ে গেল; সেই পাপেই এ মাদুরাই নগরী অশুচি হয়ে গেছে। আজ তা আগুনে পুড়ে খাঁটি হোক, সংশুদ্ধ হোক!’
এ কথা বলেই কন্নকী লুটিয়ে পড়ল কোভালনের তুষারহিম প্রাণহীন শরীরের উপর। প্রভূত রক্তক্ষরণের ফলে কন্নকীর প্রাণবায়ুও নির্বাপিত হতে আর অধিক বিলম্ব হল না ।
সেই রাত্রে সহসাই কোন অভাবিত উৎস হতে আগুন লাগল নগরীতে। অগ্নির লেলিহান জিহ্বা প্রথমে মৃদু, পরে ভয়ংকর রূপ ধরে মাদুরাই নগরীকে গ্রাস করে নিতে লাগল । আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল দ্রুত। ভাইগাই নদীবক্ষোত্থিত বাতাসে আন্দোলিত আগুনের শিখা নৃত্যশীল সর্পশিশুর ফণার মতো এক এক করে গ্রাস করতে লাগল প্রাসাদ, হৰ্ম, সৌধ ও আবসথগুলিকে। আগুন ধেয়ে গেল রাজসভায়, সেখানে প্রাণহীন রাজা নির শরীর, পাত্র, মিত্র, অমাত্য, নটী, সভাসদ, বিদূষক সকলকে গিলে ফেলতে লাগল আগুন । কেউ তারা পালাতে পারল না। আগুন ধেয়ে গেল অন্তরাপণে, পুড়ে মরতে লাগল ব্যাপারীরা। আগুন ধেয়ে গেল পশুশালায়, স্কন্ধাবারে, প্রমোদকাননে, গণিকালয়ে, গৃহাঙ্গনে—সর্বত্র। গবাদি পশু হাম্বারবে, হস্তীযূথ বৃংহিত ধ্বনিতে, অশ্বযূথ হ্রেষারবে, আর্তনাদকারী মনুষ্যকুল—শিশু, বৃদ্ধ, নর, নারী—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র শ্রেণিনির্বিশেষে সকলেই সেই খাণ্ডবদহনসম উত্তপ্ত অগ্নিবলয় থেকে প্রাণ বাঁচাতে রাজপথ, গলিপথ, অবপথ ধরে ছুটতে লাগল নগরীর প্রধান দ্বারপথের দিকে। কেউ দ্বারপথ অতিক্রম করে বাহির হয়ে বাঁচতে পারল এ অগ্নিবলয় থেকে, অনেকেই বিফল হল। রাত্রির প্রথম প্রহরেই সমগ্র মাদুরাই নগরীর বুকে নেমে এল মৃত্যুর অঙ্গারনীল স্তব্ধতা।
(বাহান্ন) দিবাবসান
অনেক দূরে অস্পষ্টপ্রায় দিগন্তের কাছে নাওগুলো ভেসে গেছে আজ। অস্তসূর্যের আভা জলের উপর রেখে যাচ্ছে দিনান্তের আশীর্বাদ। এখান থেকে এ নদীর পরপার দেখা যায় না। আকাশপথ বেয়ে নীড়ে ফিরে আসছে পাখির ঝাঁক। নদীবক্ষ শান্ত আজ; কখনও মধ্যস্রোতে সামান্য কম্পন, ঢেউগুলি গভীর থেকে উপরিতলে উঠে আসছে শান্ত প্রার্থনার ছন্দে, ভেঙে পড়ছে নিবেদনের ভঙ্গিমায়। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার তরল ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে জলে, স্থলে, বনে, গহনে, উপবনে। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা একা জেগে উঠেছে সুগভীর মুগ্ধতায়।
এদিকে তীরের কাছে জলের ভিতর অর্ধনিমজ্জিত একখানি নাও। যতটুকু জলের উপর জেগে আছে তার, সেইখানে নৌকার পাটাতনের উপর নদীর দিকে মুখ করে পাশাপাশি বসে আছে দুজন মানুষ। কোভালন ও কন্নকী। ওরা কথা বলছে না কোনো, শুধু নিশ্চুপে চেয়ে আছে জলের দিকে। শান্ত সন্ধ্যার আলো খেলা করছে ওদের মুখে, বুকে, কালো চুলে। নৌকার পাশে নদীর পাড় ঘেঁসে সবুজ শৈবালদাম জমে আছে।
কোভালনের করতল স্পর্শ করে কন্নকী বলল, ‘এ কোথায় এলাম বলো তো? যেন কত চেনা চেনা লাগে !’
কোভালন উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমারও মনে হচ্ছে, কেমন যেন পরিচিত স্থান। কাবেরীর ঘাট নয় কি?”
একবার জলের দিকে তাকিয়ে, তারপর তীরস্থ গাছগাছালির পানে চেয়ে কন্নকী বলল, “ঠিকই বলেছ, কাবেরীর ঘাটই বটে! আমাদের সেই পুষ্পহার নগরীর প্রান্তসীমা । ওই তো সেই চিরচেনা নদীর ঘাট। কিন্তু আমরা এখানে কী করছি? কোথাও কেউ নেই কেন ?“
‘আমিও সেকথাই ভাবছি,’ ধীরে মৃদুস্বরে বলল কোভালন। তারপর যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু এখানে এলাম কীভাবে?’
স্বগত বিহ্বলতায় কন্নকী বলল, ‘সেই তো! এই তো একটু আগেই মাদুরাইতে সে কী ভয়ংকর ঘটনা ! সেখান থেকে এখানে…ওহ্!…. কিন্তু কীভাবে?’
কোভালন নিজের বক্ষ স্পর্শ করল। ছুঁয়ে দেখল কন্নকীর মুখ, বুক, জানু। বলল, ‘কই, সবই তো ঠিক আছে আমাদের ! সব আগেরই মতন। এতটুকু রক্ত নেই কোথাও । কোথাও এক ছিটে ব্যথাও নেই আমার শরীরে আর। তোমার?’
‘আমারও কোথাও আর কোনো যন্ত্রণা নেই গো! দেখো, এই তো আমার সেই আগের মতই উত্তুঙ্গ স্তন, শঙ্খের মতন শুভ্র, গিরিচূড়ার মতো উত্তল। এতক্ষণ কী দেখছিলাম বলো তো তাহলে ?’ কন্নকী প্রশ্ন করল।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কোভালন বলল, ‘জানি না। তবে এখন যেন কোনো অপমান নেই, কোনো বেদনা নেই, স্নায়ুযুদ্ধ নেই আর। তাহলে এতক্ষণ কী যে হচ্ছিল ! হে নাথ !’ ভাবতে ভাবতে পূর্বকথা মনে করে শিউরে উঠল কোভালন ।
আবার সব চুপ। দুজনে কেউ কোনো কথা না-বলে নদীর উপর মিলিয়ে আসা শেষ আলোর স্পর্শের দিকে চেয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে কন্নকী বলল, ‘চলো, ওঠা যাক। কেমন শিশির পড়ছে যেন !’
দুজনে উঠে দাঁড়াল নৌকার উপর। কোভালন সেই অর্ধনিমজ্জিত পাটাতন থেকে লাফিয়ে তীরে নামল। কন্নকীকে হাত ধরে নামিয়ে আনল। দুজনে হাত ধরাধরি করে নদীতীর দিয়ে হাঁটতে লাগল পাশাপাশি। কোভালন বলল, ‘কাবেরীতীর, অথচ যেন কাবেরীতীর নয় এ। নদীতীরস্থ সেই ব্যস্ত পথ, ব্যাপারীদের ভিড়, দুয়েকটি বিপণি—সেসব কোথায় এখানে?’
‘আমিও বুঝতে পারছি না। এ হয়তো পুষ্পহার নয়। হয়তো আমাদেরই ভুল। কী করে যে… কীভাবে যে এখানে এলাম আমরা… ! কত পথ পার হয়ে মাদুরাই গেছিলাম, মাদুরাইতে মহাবিপর্যয়, তারপর সহসা এখানে…. এসবের অর্থ কী?’ কন্নকী আপনমনে বলল।
অর্থ কী, তা কোভালনও জানে না। নদীতীর ধরে বহুক্ষণ অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে এক তরুতলে একলা একজন মানুষকে অবশেষে দেখতে পেল ওরা। মানুষটির পরনে একখানি বস্ত্র, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। শীর্ণ শরীর, মাথায় কুণ্ডলায়িত কেশ, কপালের উপর শুধু একগাছি অবাধ্য কুন্তল এসে পড়েছে। মুখভাব মঞ্জুল, ওষ্ঠাধর সস্মিত; যেন মানুষটি সর্বদাই তাঁর অন্তর্গত আনন্দে হাসছেন। কেমন যেন একটা অপ্রস্তুত হাসি। গাছের তলায় তিনি নিশ্চুপে বসে আছেন ।
কোভালন-কন্নকীকে দেখে তিনি পূর্বপরিচিতের মতন হাসলেন। ওরা তাঁকে অভিবাদন জানাল। কোভালন সবিশেষ কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল, ‘মহাশয়! আমাদের কি আগে কোথাও কখনও দেখা হয়েছে?”
লোকটি কোভালনের প্রশ্নের উত্তরে শুধু হেসে বলে উঠল, ‘লাগ ভেলকি লাগ ! ভেলকি লাগ !’
চমকে উঠল কোভালন। তৎক্ষণাৎ লোকটিকে চিনতে পারল সে। কী আশ্চর্য ! ইনি তো সুদূর কৈশোরকালে দেখা সেই উন্মাদপ্রায় মানুষটি। যিনি কোভালনকে সংবাদী ভেলকি, বিসংবাদী ভেলকির কথা বলেছিলেন। কী অদ্ভুত! এতদিন চলে গেছে, অথচ লোকটি কি একটুও পালটায়নি? সেই একই চেহারা, একই বেশবাস, একই বয়েস ! এমনকি একই জায়গায় তিনি বসে আছেন !
কোভালন বলল, ‘আপনি যাননি কোথাও এখান থেকে? এখানেই বসে আছেন এত বৎসর?’
‘যাব না কেন গো? কতবার গেলাম, কতবার এলাম। ফিরে ফিরে আসি এখানে। এই স্থানটি আমার খুব ভালো লাগে, তাই…’ তিনি উত্তর দিলেন।
‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?’
‘হ্যাঁ, চিনব না কেন? তুমি তো কোভালন ! আর এ তোমার স্ত্রী কন্নকী !
‘আমাকে আপনি জানলেন কীভাবে? আমার সঙ্গে তো আপনার দেখাই হয়নি কখনও,’ কন্নকী শুধোল।
তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমাদের চিনব না কেন, মা? তোমরা কত কষ্ট পেলে, মাদুরাইতে গেলে, সেখানেও কী ভীষণ বিপর্যয়…. যে কষ্ট পায়, তাকে আমি বেশি করে চিনি,’ বলতে বলতে তিনি থেমে গেলেন।
‘আচ্ছা, এ কি কাবেরীনদীর তীর?” কোভালন প্রশ্ন করল ।
‘হ্যাঁ, চিনতে পারছ না? কাবেরীই তো! তবে কাবেরীরই তীর, তীরের কাবেরী নয়, ‘ তিনি হাসতে হাসতে হেঁয়ালি করে বললেন।
কন্নকী প্রশ্ন করল, ‘এখানে আমরা এলাম কীভাবে, বলতে পারেন?’
‘এখানেই তো ছিলে চিরকাল। মাঝখানে একটু কর্মভোগ হয়ে গেল আর কি!’ তিনি উত্তর দিলেন। তারপর যোগ করলেন, ‘ওসব এখন ভুলে যাও ! ওসব ভেলকি। লাগ, ভেলকি লাগ !’
কোভালন বলল, ‘কী অদ্ভুত কথা যে আপনি বলছেন! সেই মাদুরাই, এত কষ্ট, এত রক্ত, এত আগুন—সব ভেলকি? সব অলীক ?’
মানুষটি অমনি ধড়পড় করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘অলীক কী করে হবে গো ? তোমরা দুজনে এত কষ্ট পেলে, এত রক্ত বেরোল, এত আগুন জ্বলল, অলীক কীভাবে হবে? অলীক নয়। অলীক হল তাই, যা কখনও কোনোকালে কেউ দেখেনি, অনুভবও করেনি। এই যেমন ধরো, খরগোশের শিং। ওই কথাটাই আছে খালি, কেউ কখনও খরগোশের শিং দেখেনি, অনুভবও করেনি।’
এ লোকের কথা সবই হেঁয়ালিভরা। বোঝা যায়, অথচ বোঝা যায় না। তবু কোভালন একে ছেড়ে চলে যেতেও পারছে না। জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে এ সমস্তই স্বপ্ন ?’ তিনি শান্ত হয়ে বসলেন আবার গাছের তলায়। তারপর বললেন, ‘স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন একে তুমি বলতে পারো না। স্বপ্নের মতো বলতে পারো শুধু। তবে এক হিসাবে আবার সবই সত্যি। মাদুরাইয়ের ঘটনা মাদুরাইয়ের দিক দিয়ে সত্যি। আবার এখানকার এই নদী, গাছ, জল, আলো, হাওয়া, চাঁদ—এখানকার দিক দিয়ে এসবই সত্যি। মাদুরাইতে তোমাদের মৃত্যু—মাদুরাইয়ের দিক দিয়ে দেখলে সত্যি। আবার এখানে তোমাদের বেঁচে ওঠা—এখানকার দিক দিয়ে দেখলেও সত্যি। তখনকার কথা তখন, এখনকার কথা এখন। ভেলকি!’
কন্নকী উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, ‘মাদুরাইতে কী হয়েছে তবে আমাদের মরে যাওয়ার পর?’
লোকটি বলল, ‘কী আর হবে? নগরীতে আগুন লাগল। পুড়ে ছাই হল মাদুরাই।’
‘সবাই পুড়ে গেছে?’
‘সবাই নয়। সবাই কি পোড়ে? তবে অনেকেই পুড়ে মরে গেছে। অনেকেই বেঁচে গেছে। আবার নতুন করে গড়ে উঠবে মাদুরাই। এমন কতবার পুড়ল, কতবার গড়ে উঠল!’
‘আচ্ছা, আইয়াইয়ের কী হয়েছে? ওর পঙ্গু ভাই চিত্তিরাই? আগুনের মধ্যে চিত্তিরাই তো কোথাও যেতেও পারবে না!’ কন্নকী সোদ্বেগে প্রশ্ন করল। এখন সে যা করেছে, তার জন্যে তীব্র অনুতাপ হচ্ছে।
‘চিত্তিরাইকে পাড়ার লোকজন কাঁধে তুলে নগরীর বাইরে নিয়ে গেছিল। তাই সে বেঁচে যায়। আইয়াইও বেঁচে গেছে।’
‘আর মাদারি? উনি বাঁচতে পারেননি?”
‘মাদারিও বেঁচেই গেছিল। কিন্তু তোমাদের রক্ষা করতে না-পারার দুঃখে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দিল ।’
‘ওহ্!’ অনেকক্ষণ একেবারে চুপ হয়ে গেল কন্নকী। মনে মনে অতীত ঘটনা সব মনে পড়ছে তার। তারপর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কাভুন্দি-মা? তিনি বেঁচে নেই ?
‘এখনও বেঁচে আছেন। তবে তিনিও প্রায়োপবেশনে বসবেন। সাধ্বী তিনি; পরার্থে জীবনোৎসর্গ তাঁর ব্রত। এর পরে আরও কত কিছু হবে! ধূর্ত ব্যবসায়ী আথিয়ামান ও তার অনুচর জীবগ্রীবের প্রাণদণ্ড হবে নেডুঞ্জেলিয়ণের পুত্রের হাতে। তোমার নামে দেবদেউল দেওয়া হবে। সেখানে তোমার পুজো হবে পট্টিনীদেবী নামে। মাধবীর মেয়ে মণিমেখলা বৌদ্ধ ভিক্ষুণী হবে। ইলাঙ্গো আডিগল নামে এক কবি কাব্য লিখবেন তোমাদের নিয়ে। সে অনেক কিছু। ওসব বাদ দাও। ভুলে যাও ওসব এখন। ভুলে যাওয়াই ঠিক।’
‘আচ্ছা, আপনি এত কিছু জানেন কীভাবে?’ কন্নকী প্রশ্ন করল।
তিনি প্রশ্ন শুনে হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘আমি যে মাদুরাইয়ের দেবীমন্দিরের পূজারী গো ! আমাকে মা এসব দেখিয়ে দিয়েছেন।’
কোভালন বলল, ‘আচ্ছা, এত যন্ত্রণা, এত কষ্ট পেলাম কেন বলুন তো ?
মানুষটি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘সে আছে একটা ব্যাপার । অনেক জন্ম আগে তোমার নাম ছিল ভরত। তখন সিংহপুরের রাজা ছিলেন বসু আর কপিলপুরের রাজা ছিলেন কুমারন। তুমি ছিলে রাজা বসুর প্রধান সেনাপতি । কলিঙ্গদেশ নিয়ে তখন বসু আর কুমারনের মধ্যে রেষারেষি চলছে। এই অবস্থায় সঙ্গমন নামের এক যুবক ব্যবসায়ী, তার স্ত্রী নিলিকে নিয়ে সিংহপুরে এসেছিল জীবিকার সন্ধানে। তুমি কোভালন, সেই জন্মে তোমার নাম তখন ভরত, তুমি মিথ্যা সন্দেহ করেছিলে সঙ্গমনকে। ভেবেছিলে, সঙ্গমন হচ্ছে কপিলপুরের অধিপতি কুমারনের গুপ্তচর। এই মিথ্যা সন্দেহে তুমি সঙ্গমনকে বেঁধে নিয়ে রাজা বসুর কাছে গিয়েছিলে। তোমার মিথ্যা অভিযোগের ফলেই কোনো বিচার ছাড়াই রাজা বসু সঙ্গমনের মুণ্ডচ্ছেদের আদেশ দেন। নিরীহ সঙ্গমনের উপর এমন অবিচারে ব্যথিত হয়ে তার স্ত্রী নিলি আত্মহত্যা করে। এই অশুভ কর্মের ফলেই এই জন্মে কোভালন হয়ে তোমাকে এত ভুগতে হল। এই আর কি! ওসব নিয়ে ভেবো না । ওসব হাঁড়ির মা-কে দিয়ে তাড়ির মা করা—পৃথিবী জুড়ে এই ভেলকিই তো চলছে। ভুলে যাও কোভালন, ওসব ভুলে যাও !’
কোভালনের হঠাৎ মনে হল, কেউ যেন তাদের উপর থেকে দেখছে। মুখ তুলে উপরে তাকাল কোভালন। কিন্তু উপরে কাউকেই দেখতে পেল না। নির্মল আকাশে শুধু রাকাশশী কিরণ বিস্তার করছেন। বিশদ জ্যোৎস্না আকাশ থেকে নেমে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মাটিতে এসে পড়েছে। কেমন একটা শিহরনসঞ্চারী অনুভূতি। কে জানে কী অর্থ এসবের !
জিজ্ঞেস করল কোভালন তরুতলে উপবিষ্ট মানুষটিকে, ‘তাহলে এই কি স্বৰ্গ ? মাদুরাইতে আমাদের মৃত্যু হয়ে গিয়েছে, আবার এই কাবেরীতীরে বেঁচে উঠলাম, তাহলে এই স্থানই নিশ্চয়ই স্বর্গ?’
তিনি উত্তর দিলেন, ‘স্বর্গ বা নরক বলে আসলে তেমন কিছু নেই। মৃত্যুতে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর সেই মহাঘুমের ভিতর যে-স্বপ্ন দেখে, তাকেই লৌকিক ভাষায় স্বর্গ বা নরক বলা হয়। আবার এই জীবন, এও এক দীর্ঘ স্বপ্নযাত্রা। যেন একটি নীল পাখির পালক নিঃসীম মহাশূন্যের ভিতর দিয়ে নির্জনে নেমে আসছে। যখন যেখান দিয়ে নেমে আসছে, তখন সেখানকার দৃশ্যাবলী সত্যি বলে মনে হচ্ছে পালকের। তুমি সেই পালক, কোভালন। তুমি, আমি, কন্নকী, মাধবী, আমরা সবাই একেকটা পালক। আর কিছু নয়।’
চুপ করে রইল কোভালন। নিষুপ্ত রাত্রির প্রথম প্রহর। কন্নকী ভাবছিল, তাহলে এই নদীতীর—একেও এ মুহূর্তে যত সত্যিই মনে হোক না কেন, একটু পরে এও হয়তো থাকবে না। এই নদী, এই বনজ্যোৎস্না, তরুতল, কোভালন, এই অপরিচিত কথক কিংবা সে নিজে—এও কি চলে যাবে? চিরতরে মুছে যাবে?
কী করে যেন তার মনের কথা বুঝতে পারলেন মানুষটি। তিনি কন্নকীর দিকে চেয়ে বললেন, ‘ঠিকই ভেবেছিস, মা! এও শেষ সত্য নয়। সত্যের কোনো শেষ নেই। তবে একটি গুহ্য কথা আছে। তোরা দুজন আমার কাছে এসে বোস। বলব সেই কথাটা তোদের।’
কোভালন আর কন্নকী তরুতলে সেই পথিকের মুখোমুখি বসল। উদাসীন মানুষটি ওদের কী যেন বলতে লাগলেন।
আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন ওদের উপর থেকে দেখছি। গাছের তলায় বসে থাকা তিনজন মানুষ খুবই নিবিষ্ট চিত্তে বার্তালাপ করছে। তিনজন মানুষের মাথা উপর থেকে দেখে ত্রিভুজের তিনটি বিন্দুর মতো মনে হচ্ছে আমার। বিন্দুগুলো পরস্পর কাছে সরে আসছে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে; ত্রিভুজের আয়তন বড়ো হচ্ছে কখনও, কখনও আবার ছোটো হয়ে আসছে। হঠাৎ ওরা তিনজন খুব কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। বিন্দু তিনটি এখন একেবারে গায়ে গায়ে। আর একটুক্ষণ, তার পরেই বিন্দুত্রয় সমাপতিত হয়ে গেল, এখন আর একটুও ফাঁক নেই…
অমনি কী এক মন্ত্রবলে মিলিয়ে যেতে লাগল ওরা… মিলিয়ে যেতে লাগল নদীতীর…. নদী, তীরস্থ তরুবীথি, আকাশের চাঁদ, বাসবান্নাদের বাড়ির সেই ছাদ, বাসবান্নার কণ্ঠস্বর, কাঁকন… সমস্তই ঘুরতে ঘুরতে মিলিয়ে যাচ্ছে…
প্রবল আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম চোখ মেলে। নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই ফিরে এল যেন।
চারিপাশে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কেউ নেই। নির্জন ঘরে খাটের উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছি আমি। কলকাতার সেই ভাড়াটে বাড়ি। বৈশাখের দুপুর শেষ হয়ে বিকেল নেমেছে। সারা শরীর ঘর্মাক্ত !
এতক্ষণ কী হচ্ছিল? স্বপ্ন দেখছিলাম তবে? অথবা, স্বপ্নের মতনই অন্য কিছু ?
খাট থেকে নেমে বিহ্বল পায়ে টয়লেটে গেলাম। মুখচোখ ধুলাম। ক্লান্ত লাগছে। এ ঘরে বসে থাকলে ক্লান্ত লাগবে আরোই। এমনিতেও বেরোতে হবে আমাকে। কিডস্ট্রিটে কাজ আছে একটা ।
বেরিয়ে পড়লাম। সারাটা পথ জুড়ে আজ শুধু দুপুরের স্বপ্নের কথা মনে আসছে । আঠেরোশো বছর আগের সেই পুষ্পহার নগরী, কোভালন, কন্নকী, মাধবী…. কোভালন-কন্নকীর মাদুরাই যাত্রা… কাভুন্দি… মাদুরাই নগরী… সেই কূটচক্র, মৃত্যু, শোকাগ্নি, দাবানল…. আবার সেই কাবেরী তীর…
মনটা খারাপ হয়ে আছে। স্বপ্নই হোক আর যাই হোক, অনেক বছর পরে বাসবান্নার দেখা পেয়েছিলাম, তাঁর গল্প শুনছিলাম। কাঁকন নামের কে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে এসেছিল স্বপ্নে। তার চপলতা, তার বুদ্ধিমত্তা, তার ছেলেমানুষি, তার খেয়ালি স্বভাব মুগ্ধ করেছিল আমাকে। সে নাকি আমার অকিঞ্চিৎকর সব লেখার পাঠিকা। ভবিষ্যতের পাঠিকা! আপনমনে হাসলাম। স্বপ্নে মানুষ কত কী যে দেখে!
তবে শিলপ্পদিকরম-এর কাহিনি আমার মনের কল্পনা নয়। তরুণ বয়সে আমার বন্ধু শ্রীনিবাসন আমাকে বলেছিল শিলপ্পদিকরম-এর কাহিনি। সেই গল্পটাই কি আমার মনের আরও পাঁচরকম কল্পনার সঙ্গে মিশে স্বপ্নকথা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ দুপুরে ? হবেও-বা !
পার্কস্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে নামলাম। এ স্টেশনটার গঠন বেশ জটিল। পাতালের গোলকধাঁধায় অনেক ঘুরে মাটির উপরে উঠে এলাম। চারিপাশে ব্যস্ত কলকাতা শহর ।
জাদুঘরের পাশ দিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দেখলাম, পেপারব্যাক বইয়ের পসরা নিয়ে বসে আছে কতগুলো লোক। জোস্তে গার্ডারের দ্য রিং মাস্টার্স ডটার বইটা দেখে হাতে তুলে নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল, আমার পরিচিত কে একজন আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। বই থেকে মুখ তুলে তাকালাম। আশ্চর্য তো! পেছন থেকে দেখছি তাকে; মেরুন রঙের লেহেঙ্গা পরা, মাথার চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা…আরে, এ তো সেই ! অবিকল!
চেঁচিয়ে ডাকলাম, ‘কাঁকন! কাঁকন!’
বই ফেলে আমি এগিয়ে গেছি তখন দুয়েক পা। একেবারে তার কাছে গিয়ে ডাকলাম, ‘এই কাঁকন! শুনতে পাচ্ছ না?
আমার ডাকাডাকিতে চমকে মেয়েটি ফিরে দাঁড়াল। আমার দিকে অবাক চোখে তাকাল সে। মুখে একটা অপ্রতিভ হাসি।
না আমি ‘দুঃখিত’ বলবার আগেই মেয়েটি বলে উঠল, ‘আপনি বোধহয় আমাকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করেছেন। নমস্কার !’
এ তো কাঁকন নয়, এ অন্য কোনো মেয়ে! ইশ্, কী যে ভুল করলাম !
কথাটা বলেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল কাঁকন। অথবা সে কাঁকন নয়। হয়তো অন্য কোনো কাঁকন। কিংবা সে-ই কন্নকী।