দাম্পত্য-কলহে চৈব
দুজন দেবতা প্রাচীন দাম্পত্য-জীবনের অধিকর্তারূপে স্বীকৃত—এঁদের মধ্যে একজন অশরীরী অবস্থায় তিন-ভুবনের যুবক-যুবতীকে ক্রমাগত ফুলের ঘায়ে জর্জরিত করে তুলতেন। এই অবস্থায় অপরজনের কর্তব্য ছিল সেই আহত তরুণ-তরুণীর ক্ষতস্থানে নির্মল প্রলেপ দিয়ে পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ করার, কিন্তু তা তিনি প্রায়ই করেননি। প্রসিদ্ধি অনুযায়ী প্রজাপতি—মানে বিবাহের দেবতাটি যেহেতু বৃদ্ধ, তাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মতানুসারেই চলা তাঁর অভ্যাস। বিবাহের মঙ্গল-গ্রন্থিটি সেই দুটি হাতেই তিনি বেঁধে দেন, যেখানে অনুমতি আছে বৃদ্ধদের। এই দুই দেবতার মধ্যে পারস্পরিক কোনো বোঝাপড়া না থাকার ফলে, একের অনুগৃহীত যুগলের প্রতি আরেকজনের অভিশাপ থাকায় নর-নারীর দাম্পত্য-জীবনের পূর্বাভাসটাই নানান সমস্যাকীর্ণ হয়ে ওঠে। প্রাক-বিবাহ পর্বে পূর্বরাগের আশীর্বাদটুকু আর বিবাহ-মুহূর্তে প্রজাপতির আশীর্বাদটুকু—এই দুয়ের একটিকে অবলম্বন করে দাম্পত্য-জীবন শুরু হয়ে যায় বটে। কিন্তু তারপর? তারপর তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যিনি চিহ্নিত হয়েছেন দাম্পত্য কলহ উপশম কিংবা নিবারণের জন্য। অথচ দাম্পত্য কলহ এতই সার্বিক যে, এর জন্য দেবলোকে একজন উপযুক্ত বিভাগীয় আধিকারিকের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হয়নি, কেননা কোনো দেবতাই একা একা এই কঠিন দায়িত্ব নিতে সাহস করেননি। বিশেষত দেবদেবীরা নিজেরাই যেখানে এই আপদ থেকে ততখানি মুক্ত নন সেখানে তাঁদের করুণা-বারি বর্ষণে গৃহস্থের এই রৌদ্ররস নির্বাপিত হয়নি।
সৃষ্টির প্রথমদিন থেকে পিতৃ-পিতামহক্রমে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে দাম্পত্যকলহ জীবনের একটি আঙ্গিকে পরিণত হয়েছে। একেবারেই সৃষ্টির প্রসঙ্গে এসে পড়ায় খটকা লাগতে পারে, তার ওপরে আমাদের সৃষ্টিতত্ত্ব বড়ই জটিল—সেখানে সগুণ ব্রহ্ম, হিরণ্যগর্ভ, সাংখ্যের প্রকৃতি—এরা সবাই একে অন্যের গলা টিপে ধরেছে। তবু বলব দাম্পত্য-জীবনে বিষময় কলহের এই বীজ প্রোথিত করেছেন স্বয়ং ঈশ্বর। সাংখ্য-দর্শন বলে—সৃষ্টির পূর্বাবস্থায় প্রকৃতি নাকি বিকারহীন, শান্ত অবস্থায় থাকে। আর ভাগবত-পুরাণ বলেছে—প্রকৃতির এই নিশ্চল অবস্থায় কারণার্ণবশায়ী পুরুষ নাকি প্রকৃতির দিকে গোল গোল চোখ করে তাকান। ব্যস, প্রকৃতি বিক্ষুব্ধা হয়ে ওঠেন, সমস্ত সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সত্ত্ব, রজঃ তমঃ—সব তেড়েফুঁড়ে ওঠে। ঠিক এই অবস্থায় জীব সৃষ্টি হয়। নারীরূপিণী প্রকৃতির বিক্ষুব্ধ অবস্থায় যে জীবের সৃষ্টি, তাদের দাম্পত্য-জীবনে বিক্ষোভ তো কিছু থাকবেই। প্রাচ্যদর্শনের জটিলতা বাদ দিয়ে কেউ যদি বা সাহেবিমতে বাইবেলের জেনেসিস পর্বটি অনুধাবন করেন, তাহলে দেখা যাবে আদিম জনক-জননীর মধ্যেই দাম্পত্য-কলহের বীজ ছিল। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার সমস্ত দোষ সঙ্গিনীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে, অ্যাডাম ঈশ্বরকে দায়ী করেছে—ওই ইভ, যাকে আপনি আমার জীবনসঙ্গী করে দিয়েছিলেন—The Woman thou gavest to be with me—ওই তো ইনিয়ে বিনিয়ে আমাকে এই ফল খাওয়াল, নইলে…। ভগবানের মনের সৃষ্টি আদিম এই জনক-জননীর মধ্যে প্রথম কলহের এই বীজ জন্ম জন্ম ধরে সন্তানদের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে—আর তারই ফল দাম্পত্য-কলহ।
দাম্পত্য-কলহ হয়েছে দুভাবে—গলার স্বরে এবং ঠান্ডা মাথায়। গলার স্বর যেহেতু স্বভাবতই স্থূল এবং কলহকালে বড়ই কর্কশ, তাই আজকের ঠান্ডা লড়াইয়ের দিনে, ঠান্ডা মাথায় ঝগড়ার কথাই আগে আসবে। এখনকার কালে নানান জটিলতা, রুচির পার্থক্য, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিযোগিতা এবং সর্বোপরি সূক্ষ্ম মানসিক চাপ (চাপ না থাকলেও চাপবোধ)—এ-সবই যেমন দাম্পত্য-কলহের কারণ, তেমনি সেকালেও এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে মহাভারতের কুন্তী বোধহয় সব চেয়ে বড় উদাহরণ।
পাণ্ডুর কুলবধূ হিসেবে কুন্তীর জীবন ছিল প্রায় নিস্তরঙ্গ। কুমারী অবস্থাতেই সন্তান-ধারণের যন্ত্রণাটুকু যেমন ছিল, সেই সঙ্গে অর্ধেক মাতৃত্বের অর্ধেক স্বাদ তাঁর মনে জাগিয়ে রেখেছিল এক বুভুক্ষা—সে বুভুক্ষা পূর্ণ মাতৃত্বের। অথচ এ ব্যাপারে পাণ্ডুর কিছুই করণীয় ছিল না—অক্ষম পুরুষ তিনি। মহাভারতে পাণ্ডুর ওপর কিমিন্দম ঋষির অভিশাপ, পুরুষের অক্ষমতাকে উপায়হীনতার গল্পে পরিণত করেছে। অন্যদিকে দুর্বাসার বরে মাতৃত্বের উপায়টুকু যেহেতু কুন্তীর নিজের অধীনেই ছিল তাই অভিশাপ শুনে একবারও হাহাকার করেননি তিনি, বরঞ্চ জানতেন পাণ্ডুর অক্ষমতাই তাঁকে আরও বলিষ্ঠ মাতৃত্বের সুযোগ এনে দেবে। সুযোগ এলও, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন—তারই পরিণতি। আজকের দিনে ফ্রয়েড সাহেব যদি পাণ্ডুর কীর্তির কথা জানতেন তাহলে তাঁর রুচি এবং লিবিডো নিয়ে মনস্তত্ত্বের নতুন সূত্র বার করতেন। চোখের সামনে বিভিন্ন দেবতাপুরুষের মিলনে পর পর তিনটি পুত্র জন্মানোর পরেও পাণ্ডু বললেন—আরও পুত্র চাই। কুন্তী তেড়ে উঠলেন—মহারাজ আপনি না বিদ্বান, আপনি না ধর্মজ্ঞ, প্রমাদবশত আপনি যে চতুর্থ পুত্রের কথা বলছেন, লোকে যে আমাকে স্বৈরিণী বলবে অর্থাৎ লোকে ভাববে—স্বামীর উপায়হীনতার সুযোগ নিয়ে পুত্রোৎপত্তির অছিলায় আমি আমার কামনা চরিতার্থ করছি। পাণ্ডু থামলেন কিন্তু এবারে খুঁটি ধরলেন মাদ্রীকে। কুন্তীর করুণা হল বটে কিন্তু তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি যে মাদ্রী এক সংকল্পে দুই ছেলের মা হবেন। মনের কথা মনেই রইল; সুযোগ এল, যখন পাণ্ডু আবার লজ্জা ত্যাগ করে মাদ্রীর জন্য মন্ত্র প্রার্থনা করলেন কুন্তীর কাছে। কুন্তী এবার সোজাসুজি স্বামীকে গালাগালি না দিয়ে বললেন—মাদ্রী আমাকে বঞ্চনা করেছে, খারাপ মেয়েদের ব্যাপার স্যাপারই এইরকম—কুস্ত্রীনাং গতিরীদৃশী।
আসলে কুন্তী সারাজীবনই কোনো শান্তি পাননি। তাঁর নিজের পিতা তাঁকে দত্তক দিয়েছিলেন কুন্তিভোজের কাছে; কুমারী অবস্থায় মাতৃত্বের মন্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে পুত্রস্নেহের অধিকার হারাতে হল যেমন, তেমনি একটি সূক্ষ্ম অপরাধবোধ থাকার ফলে পাণ্ডুকে যেখানে ‘পূর্ণপ্রাণে চাবার’ কথা সেখানে তাঁকে ‘রিক্ত হাতে’ চাইতে হয়েছে। অন্যদিকে পাণ্ডুর বিকৃত রুচি, মাদ্রীর ওপরে তাঁর ঈষৎ দুর্বলতা—এ সবকিছুই কুন্তীর ওপরে একেবারে আধুনিক পর্যায়ের মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে। রাগের চোটে কৃষ্ণকে তিনি বলেছেন—আমি আমার পিতার দ্বারা যেমন বঞ্চিত, তেমনি বঞ্চিত হয়েছি শ্বশুরকুলের কাছে—সাহং পিত্রা চ নিকৃতা শ্বশুরৈশ্চ পরন্তপ।
এক একজন আছেন যাঁরা জীবনে একবার মাত্র স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে চিরকালের ঝগড়াটে হিসেবে নাম কিনেছেন। পণ্ডিতেরা বলেন, দশরথ নাকি কৈকেয়ীর বাবাকে কথা দিয়েছিলেন—কৈকেয়ীর ছেলেকেই রাজ্য দেবেন বলে। তার ওপরে জবর জবর দুটি বর জমা হয়েছিল, অথচ দুর্নাম হল কৈকেয়ীর। নিজের প্যাঁচে নিজেই পড়ে ঝগড়া আরম্ভ করলেন দশরথ। মজার কথা হল—অনেক স্বামীর মতো দশরথের ক্রোধাগ্নি থেকেও কৈকেয়ীর পিতৃকুল পর্যন্ত রক্ষা পায়নি সেখানে। দশরথ বললেন—তুমি তীক্ষ্নবিষ সর্পের মত, আমি না বুঝে রাজনন্দিনী-বোধে তোমায় ঘরে এনেছি। অনেকক্ষণ শুনে কৈকেয়ী বললেন—বুদ্ধির মাথা খেয়েছ তুমি, আসল কথা এখন আমার চেয়ে ঐ কৌশল্যাটাকেই মনে ধরেছে বেশি—সহ কৌশল্যায়াঃ নিত্যং রন্তুমিচ্ছসি দুর্মতে। দশরথ বললেন—কৌশল্যা আমার অনেক করেছে, সময় বুঝে মায়ের মতো, বোনের মতো, স্ত্রী, সখী এমনকী দাসীর মতো সেবা করেছে। কিন্তু তোমার মোহে আমি তাকে আমল দিইনি, তুমি নৃশংস, পাপী, ছোটোমন। আমি মরি তারপর বিধবা হয়ে মায়ে-পোয়ে রাজ্যশাসন করো—সেদানীং বিধবা রাজ্যং সপুত্রা কারয়িষ্যসি। কৈকেয়ী বললেন—কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না, আবার ধার্মিক বলে জগতে ঢাক পেটাচ্ছে। দশরথ তখন একেবারে গেঁয়ো মানুষের মতো বলে উঠলেন—আজকে আমার বিপদ বুঝে প্যাঁচে ফেলে মারছো, কিন্তু আশ্চর্য তবু তোমার দাঁতগুলো খসে খসে পড়ছে না—বিশীর্য্যামান্য দশনাঃ সহস্রাধার্য কেকয়রাজার কুলের কালি, চিরকালের মিথ্যেবাদী—তুমি মর।
অযোধ্যাকাণ্ডের দ্বাদশ অধ্যায়টি ছেঁকে নিলে ঝগড়াটা এইরকমই দাঁড়ায়; সংলাপ আছে আরও অনেক, যুক্তি আরও বহুতর, আছে অনুরোধ উপরোধ কিন্তু তার মধ্যে বিশ্রী কথাগুলোও এইভাবে ঢুকে পড়েছে। যেমনটি আজও পড়ে। আবার যেমন ‘তুমি চিরকেলে মিথ্যেবাদী, ভদ্র ভাষায় কথা কইতে জান না,’—একথা কিন্তু ঝগড়ার চরম মুহূর্তেই সত্যি, অন্য সময় সত্যি নয়, কেননা এই দশরথই ঝগড়ার উপক্রমে কৈকেয়ীকে বলেছেন—তুমি তো কোনোদিন আমাকে অপ্রিয় কথা বলনি, অযোগ্য কাজ কোনোদিনও তো করনি—’ন হি কঞ্চিদযুক্তং বা বিপ্রিয়ং বা পুরা মম’। কাজেই ঝগড়ার সময়ের সব কথাই সত্যি নয়, তবু আঁতে ঘা দেবার জন্যই অবধারিতভাবে অন্যায়-অসত্য কথাগুলো এসে পড়েছে।
‘দাম্পত্য-কলহের প্রেক্ষাপটে সীতার কথাও কিন্তু বলা দরকার, কেননা সতী-সাধ্বী হিসেবে তাঁর নাম জগৎজোড়া। আমরা তাঁর সুনামে আঘাত দিতে চাই না, তবে দোষে-গুণে মিলিয়ে মানুষ; ঝগড়া তিনিও কম জানতেন না। বনবাসের আগে পর্যন্ত রাম-সীতার জীবন কেটেছে বেশ আমি-তুমি করেই, কিন্তু বনযাত্রার প্রথম কল্পে রামচন্দ্র যখন সীতাকে বারণ করলেন বনে যেতে, তখন পাতিব্রত্য-রক্ষার জন্য দাম্পত্য-কলহে অবতীর্ণ হলেন সীতা। অতিরিক্ত প্রণয় থাকার জন্যেই যে দাম্পত্য-কলহের সম্ভাবনা, তাও লক্ষ করেছেন বৃদ্ধ বাল্মীকি। তাঁর মতে সীতা নাকি ‘প্রণয়াদেব সংক্রুদ্ধা’। সীতা বললেন, ‘তোমার কথা শুনে আমার হাসি পাচ্ছে, আমাকে ছোট ভেবে এ কি কথা বলছ, বীর রাজপুত্রের মুখে কি এসব কথা মানায়? স্বামীর সঙ্গে কীভাবে চলতে হবে, মা-বাবার কাছে তা অনেক শিখেছি, তোমায় আর উপদেশ দিতে হবে না—মাস্মি সম্প্রতিবক্তব্যা বর্ত্তিতব্যং যথা ময়া। অতঃপর রামচন্দ্র ‘নরব্যাঘ্র’ ইত্যাদি বহু-সম্বোধনেও কাতর না হয়ে সীতাকে প্রচুর ভয় দেখালেন—সিংহ-ব্যাঘ্র থেকে আরম্ভ করে মশা-ডাঁশও বাদ গেল না। সীতা তবু দমলেন না, বরং আরও রেগে গিয়ে বললেন—বাবা জনক যদি জানতেন যে তাঁর জামাই পুরুষের চেহারায় একটি মেয়েছেলে—স্ত্রিয়ং পুরুষবিগ্রহম, তাহলে তিনি তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতেন না। তুমি অভিনেতাদের মতো কুমারী অবস্থায় পরিণীতা এবং চিরকালের সহবাসিনী বধূকে অন্যের কাছে দিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছো। আমাকে না নিয়ে গেলে আমি বিষ খেয়ে মরব।
আমরা জানি, সীতার এই ঝগড়ার ফলেই রামায়ণ সপ্তকাণ্ড হয়েছে, তিনি বনে না গেলে রামায়ণ অযোধ্যাকাণ্ডেই শেষ হয়ে যেত—যা আমাদের পক্ষে হত মর্মান্তিক।
প্রাচীন ইতিহাস-পুরাণের পটভূমিকায় সবচেয়ে ঝাঁঝালো এবং জাহাঁবাজ মহিলা বোধহয় দ্রৌপদী। স্বয়ংবর সভাতে বিবাহের মঙ্গলসূত্র পরিহিত অবস্থায় লজ্জাবস্ত্রের আড়াল থেকে সূতপুত্রের উদ্দেশে যে আদেশগম্ভীর শব্দটুকু ধ্বনিত হয়েছিল তাতে বাপ-ভাইয়ের মান রক্ষা হয়নি মোটেই—কারণ তাঁদের প্রতিজ্ঞার মূল্য থাকেনি একটুও। ঋষি বঙ্কিম থেকে আরম্ভ করে অনেক পণ্ডিত বৃদ্ধ ব্যাসের মনস্তত্ত্ব বিচার করে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর উপযোগিতা খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের কিন্তু মনে হয় দ্রৌপদীর মতো স্ত্রীকে সামাল দেবার জন্যই অন্তত পাঁচ পাঁচটা স্বামীর দরকার। বাৎসল্যরসাভিষিক্ত বালখিল্য নকুল-সহদেবকে না হয় বাদই দিলাম, সর্বজ্যেষ্ঠ ধর্ম-ধুরন্ধর যুধিষ্ঠির যদি দ্রৌপদীর একক স্বামী হতেন তাহলে বিবাহের তৃতীয়বারেই তিনি স্বেচ্ছায় অজ্ঞাতবাস গ্রহণ করতেন। ভীমকে দিয়ে আত্মরক্ষা, অর্জুনকে আড়াল থেকে ভালোবাসা, নকুল-সহদেবকে নিয়ে খেলা করা এবং যুধিষ্ঠিরকে মুখ করা—এই কটিই পঞ্চস্বামীর উপযোগিতা। পণ্ডিতদের মুখে প্রচারিত একটি উদ্ভট শ্লোকে জানা যায়—দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতী নাকি দ্রৌপদীকে পরিহাস করে বলেছিলেন—তোমার তো আবার পাঁচ-পাঁচটা স্বামী ছাড়া পোষায় না। দ্রৌপদী ততোধিক পরিহাসে নিজের সঙ্গে শ্বশুরকুলের মূল ধরে টান দিয়েছিলেন। তিনি বললেন—পতিবৃদ্ধিঃ কুলে মম—এটা আমার শাশুড়িকুলের রেওয়াজ। বাস্তবিকই কুন্তী থেকে আরম্ভ করে সত্যবতী, পর্যন্ত সবারই একাধিক স্বামী ছিল—তাও আবার পুত্রার্থে। শুধু কুন্তীর কথা বললে যদি নিজের গায়ে লাগে তাই দিদিশাশুড়ি এবং তস্য শাশুড়ি প্রসঙ্গে ভানুমতীও জড়িয়ে গেলেন।
শ্লোকটির মধ্যে গভীর কথা নাই বা পেলাম, কিন্তু এটুকু পরিষ্কার যে দ্রৌপদীকে খোঁচা দিলে তার রক্ষা নেই। পঞ্চস্বামীর মধ্যে নিরীহ যুধিষ্ঠিরই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দ্রৌপদীর রোষাগ্নিতে অর্ধদগ্ধ হয়ে পুনর্জীবিত হয়েছেন বারবার। দ্রৌপদীর রূপে-প্রতিরূপে জ্যেষ্ঠ-স্বামীর সঙ্গে মতান্তর এতই সত্য যে মহাভারতের উত্তরসূরিদের মনে প্রধানত ওই ধারণাই দাগ কেটেছে বেশি। মহাকবি ভারবি তো তাঁর কাব্যের প্রথম সর্গটাই উৎসর্গ করেছেন এই দাম্পত্য-কলহের উদ্দেশে। কবির কল্পনাতে দ্রৌপদীর যুক্তি হয়ে উঠেছে অকাট্য, কথার ধার তীক্ষ্নতর। যুধিষ্ঠির তখন বনবাসের ধাক্কায় দ্বৈতবনে এসে পড়েছেন, আবার খবর পেয়েছেন দুর্যোধন বেশ ভালোই রাজ্য চালাচ্ছেন। রাগে, অপমানে দ্রৌপদী জ্যেষ্ঠ স্বামীকে বললেন—মহারাজ স্ত্রীলোক হয়েও তোমায় যে উপদেশ দিচ্ছি—সেটাই তিরস্কারের মতো। বংশের মর্যাদাবোধ যার আছে, এরকম তুমি ছাড়া আর কোন রাজা নিজের স্ত্রীর মতো রাজলক্ষ্মীকে অন্যের কাছে বিকিয়ে দিতে পারে। সময় ছিল—যখন বৈতালিকের মঙ্গলগানে তোমার ঘুম ভাঙত—আর এখন? জাগরণধ্বনি এখনও আছে, তবে তা বন্দির বন্দনা নয়, শেয়ালের ডাক। সময় ছিল—যখন দ্বিজোচ্ছিষ্ট অন্নের দ্বারা ভোজন সমাধা করতে তুমি—এখনও তাই কর, তবে সেটি দ্বিজোচ্ছিষ্ট (পাখিরা ডিমের সূত্রে দুবার জন্মায়, তাই দ্বিজ) বন্য ফল। মণিময় পাদপীঠে শত-সহস্র রাজার মুকুট-মণিতে রঞ্জিত হত তোমার চরণ, এখনও সেই রকমই রঞ্জিত হয়, তবে সেটি ছিন্ন কুশাঙ্কুরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে। মহারাজ, এখনও বলি শত্রুদের হত্যা করার জন্য তোমার তেজ উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠুক, আর শেষ পর্যন্ত মেয়েদের কথাতেও যদি তোমার ক্ষাত্রবীর্য টগবগ করে ফুটে না ওঠে, তবে রাজচিহ্ন ধনুকবাণ ছেড়ে দিয়ে জটাজুট লাগিয়ে বনের মধ্যে হোম কর—’জটাধরঃ সন জহুধীহ পাবকম।’ দ্রৌপদীর সমস্ত কথা অনুমোদন করলেন মধ্যম পাণ্ডব ভীম।
মহাভারতের কবির স্ত্রী ঝগড়াটে ছিলেন কিনা জানি না, তবে ঝগড়াটে মেয়েদের সঙ্গে কবির যোগ ছিল নিশ্চয়। অতিসংবেদনশীল মন নিয়ে কালিদাস তাঁর শকুন্তলার মুখে যে ভাষা বসিয়েছেন, তাতে হৃদয়ের গভীর তন্ত্রী বেজে উঠবে সন্দেহ নেই, কিন্তু এই নাট্যকাহিনির জন্মদাতা ব্যাসদেব কিন্তু শকুন্তলাকে মিলিয়ে দিয়েছেন বাস্তবের সঙ্গে। মহাভারতে দুর্বাসার শাপ নেই, বিলাসী দুষ্মন্ত সমাজের ভয়ে বেমালুম চেপে গেছেন তাঁর গান্ধর্বলীলার কথা। পতিগৃহে যাত্রাকালে শকুন্তলা এখানে গর্ভিণী নয়, তাঁর কোলে তখন ছ’ বছরের ছেলে। শকুন্তলা বললেন—মহারাজ, এই নাও, তোমার ছেলে, পূর্বপ্রতিজ্ঞামতো একে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করো। হঠাৎ করে একেবারে ছ’ বছরের একটি ছেলের সম্বন্ধে এমন প্রস্তাব? রাজা বললেন—দুষ্ট তাপসী, তোমায় কি আমি চিনি, কোনোদিন কি তোমায় দেখেছি? শকুন্তলা চোখ গরম করে বললেন—সব কিছু জেনেশুনে ‘কিছুই জানি না’ বলা—এ তো চোরের মতো কথা। নরমে গরমে অনেক কথা বললেন শকুন্তলা। রাজা বললেন—দ্যাখ, মেয়েরা ভীষণ মিথ্যে কথা বলে—অসত্যবচনাঃ নার্য্যঃ; তার ওপর তুমি নিজেই বলছ—তোমার মা হল মেনকা আর বাবা বিশ্বামিত্র, মানে একজন গণিকা, অন্যজন নীচাশয় কামী। কাজেই তোমার মতো পুংশ্চলীর কথা কে বিশ্বাস করবে? হঠাৎ করে ‘অতিকায়’ একটি ছেলে আমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছ, তুমি মানে মানে সরে পড়। একেবারে বাবা-মা তুলে গালাগাল শুনে শকুন্তলা বললেন—তোমার জন্মের থেকে আমার জন্ম অনেক ভালো। আসলে, কুশ্রী মানুষ যতক্ষণ নিজের আয়নায় মুখ না দেখে ততক্ষণই নিজেকে খুব রূপবান মনে করে। শুভাশুভ অনেক কথা তোমায় বলেছি, কিন্তু শুয়োর যেমন মিষ্টান্ন ত্যাগ করে পুরীষমাত্র গ্রহণ করে, তেমনি তুমিও ভালোটা ছেড়ে খারাপ কথাটা ধরেছ।
এই হল ব্যাসদেবের শকুন্তলা, যার গালাগালির চোটে শেষপর্যন্ত দৈববাণী হয়েছে এবং দুষ্মন্তও নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। দেবকল্প মনুষ্যের এসব কাহিনি বাদ দিয়ে আমরা শিব-দুর্গা-কৃষ্ণ-সত্যভামা—এঁদের অন্তঃকলহ দেখাতে পারতাম। কিন্তু তার থেকে ঋষিদের দাম্পত্য-কলহ আরও উপাদেয়, তাই আমরা ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণের উত্তরভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। বলিপুত্রের সঙ্গে তিলোত্তমার কামক্রীড়া দেখে খ্যাপা-মুনি দুর্বাসার বিয়ে করার সাধ জাগল। পাত্রী জুটে গেল ঔর্ব-মুনির কন্যা কন্দলী, সে নাকি দুর্বাসার রূপ এবং গুণের কথা শুনে মন দিয়েছে তাঁকে। ঔর্ব বললেন—আমার কন্যা বয়সে প্রৌঢ়া বটে তবে যথেষ্ট মনোহারিণী। দোষের মধ্যে একটিই—ঝগড়া পেলে থামতে চায় না। কন্যার অনেক গুণের মধ্যে ওটি নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। হরিষে-বিষাদে চিন্তারত, দুর্বাসা কন্দলীর দিকে তাকাতেই দেখেন—সে মেয়ে ট্যারছা চোখে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। উচাটন মনে দুর্বাসা শ্বশুরকে বললেন—আপনার মেয়ের একশটি কটুকথা আমি ক্ষমা করব। কিন্তু তারপর আর ছাড়ব না। মহর্ষি ঔর্ব অশেষে বিশেষে কন্যাকে ঝগড়া না করার উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন। তৃষিত দুর্বাসা নবসঙ্গমেই গৃহাসক্ত হলেন। কিন্তু এর পরেই লাগল ঝগড়া—কারণে, অকারণে, প্রতিদিন। পুরাণ বলেছে, ”যাঁহার প্রভাবে জগৎ কম্পিত হয় সেই মুনিবর কন্দলীর কটুবাক্যে ক্রোধে কম্পিত হইয়া কেবল তাঁহার কটূক্তির সংখ্যা করিতে লাগিলেন।” এইভাবে শত কটূক্তি সম্পূর্ণ হল, দুর্বাসা আরও দু-একবার সুযোগ দিলেন এবং শেষে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলে স্ত্রী কন্দলীকে ভস্মীভূত করে ফেললেন।
আধুনিকেরা বলবেন—এই পরিণতির থেকে বিবাহ-বিচ্ছেদ ছিল অনেক ভালো। কিন্তু আধুনিকেরা যা আশা করতে পারেন না তা হল—এই কন্দলীর জীবাত্মা ‘আকাশ নিরালম্ব’ অবস্থায় দুর্বাসাকে বলে—”ওগো, এই পৃথিবীতে কে কার শত্রু, কে বা কার মিত্র, তমোগুণ থেকে কোপ, কোপ থেকে কলহ, কলহ থেকে অপ্রিয়তা, কিন্তু তবু স্বামী স্ত্রীলোকের প্রাণাধিক প্রিয়, স্ত্রীও স্বামীর কাছে তাই এবং আমিও ত্রিজগতে তুমি ছাড়া আর কারও স্ত্রী হব না।” শুষ্ক রুক্ষ মুনির মনে আমাদের থেকেও প্রেম ছিল বেশি। এই করুণ বিলাপে তিনি হতচেতন হলেন। অবধারিতভাবে ভগবান দেখা দিলেন এবং আশীর্বাদ করলেন—কন্দলী কল্পান্তরে আবার দুর্বাসার পত্নী হবেন। আপাতত সেই ঝগড়াটে কন্দলী নাকি ভারতবর্ষে কন্দলী-জাতিরূপে বিরাজ করছেন। ভুঁইচাঁপা ফুল, সে ফুল নাকি খায়। রাজশেখর বলেছেন—কলার মোচা, ব্যাঙের ছাতা। দুটিই যেহেতু মানুষের খাদ্য, তাই অনুমান করা যায়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঝগড়ার বীজ সবার মধ্যেই সংক্রামিত—দাম্পত্য কলহও তাই অবশ্যম্ভাবী। শাস্ত্রকার বলেছেন দাম্পত্য-কলহের সুর সব সময়ই চড়া, কিন্তু ফল লঘু—বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। আমরা বলি—চড়া হোক কিংবা লঘু—”কতকটা যে স্বভাব তাদের, কতকটা বা তোমারো ভাই/কতকটা এ ভবের গতিক, সবার তরে নহে সবাই।”