দশম পর্ব- সময়ক্যেতদূর দেখা যায় চোখে
দশ মিনিট লাগল না। ঠিক সাড়ে সাত মিনিটের মাথায় অফিসার মুখার্জির এসইউভি-টা এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। “উঠে এসো”, দরজা নিজের হাতে খুলে বললেন অফিসার। একেবারে প্রথম দিনের মতো আজও ভিতরে কনকনে ঠাণ্ডা এসি চলছে। অফিসার মোবাইলে কিছু একটা দেখছিলেন। বন্ধ করে বললেন, “চন্দননগর যেতে হবে। তবে তার আগে অন্য এক জায়গায় যাব।”
“কোথায়?”
“বড়বাজারে। বিশ্বজিতের দোকানে।”
“কেন? সেখানে কী?”
“দোকানের ভিতরে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। বলেছি যেদিন বিশ্বজিৎ শেষ দোকানে গেছিল, সেদিনের ফুটেজ কালেক্ট করে রাখতে। এইমাত্র মালিক ফোন করে যেতে বলল। আগে ওখানকার কাজ সেরে, তারপর চন্দননগর।”
জোড়াসাঁকো দিয়ে বড়বাজারে ঢুকতে ঢুকতেই অনেকটা সময় জ্যামে নষ্ট হল। বড়বাজার থানার ভিতরে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম। চারিদিকের লোকের ভিড়, রাস্তার আওয়াজে কান পাতা দায়। কোনওমতে ভিড় ঠেলে বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে ঢুকেই পাইকারি শাড়ি, চাদর, পর্দার কাপড়, কাটা কাপড়ের দোকান। ছোটো ছোটো গুমটি মতো। সামনে অনেকে দাঁড়িয়ে দরদাম করছে। তাদের পাশ কাটিয়ে খানিকটা যেতেই তামান্না শাড়ি মিউজিয়াম। এই দোকানটা আমি চিনি। বিশ্বজিৎ আমার হয়ে যে সামান্য দু-একটা কাজ করেছে, তার পেমেন্ট এই দোকানের পাশে ভুজাওয়ালার দোকানে দাঁড়িয়েই নিত। কিন্তু দোকানের ভিতরে ঢুকিনি কোনও দিন। অফিসার আমাকে নিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন ভিতরে। মাথায় ফেজ টুপি, দাড়িওয়ালা সাদা পোশাকের এক ভদ্রলোক আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। ইনিই সম্ভবত মালিক। অফিসারকে চেনেন। ছোট্ট একটা সেলাম করে “আইয়ে স্যার” বলতেই অফিসার “আজ হাতে একদম সময় নেই। ওটা রেডি আছে?” জিজ্ঞেস করাতে ভদ্রলোক আমাদের “জি জি” বলে পাশের একটা ছোট্ট ঘুপচি ঘরে নিয়ে উপস্থিত করলেন। ঘরে ডাঁই করা কাপড়ের গাঁটরি বাঁধা। একপাশে একটা ছোট্ট কম্পিউটার। একটা রোগামতো ছোকরা বসে কী যেন করছে। আমাদের দেখে সে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
“নাসির বেটা, ইনলোগো কো উস ফুটেজ দিখাও। ও বিশোয়াজিত কা লাস্ট ডে-ওয়ালা।”
নাসির ছেলেটি বাংলা ভালোই বলতে পারে। মুখার্জিকে “বসুন স্যার, হামার চেয়ারে বসুন”, বলে চেয়ারছেড়ে দিল। আর-এক কর্মচারী কোথা থেকে আমাকেও একটা চেয়ার এনে বসার ব্যবস্থা করল। আমাকেও পুলিশের লোক ভেবেছে বোধহয়।
“এই যে স্যার। এটা ২০ জুন কা ফুটেজ। আমরা সোব অলগ অলগ ফোল্ডারে ডেট ওয়াইজ রাখি। সোকাল থেকে দেখবেন?”
“না, না”, একটু অধৈর্য হয়েই বললেন মুখার্জি। “বিশ্বজিৎ বাড়ি গেছিল কখন? তার একটু আগে থেকে দেখাও।”
“আচ্ছা, ওই দিন কি সুশোভন মহাপাত্র এসেছিলেন? এমএলএ সুশোভন। তার বান্ধবীকে নিয়ে শাড়ি কিনতে?” আমি না বলে পারলাম না। অফিসার দেখলাম আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালেন। ছেলেটাও
বেশ চমকাল। একটু আমতা আমতা করে বলল, “হাঁ স্যার। উনি তো আমাদের রেগুলার কাস্টমার। প্রায়ই আসেন। ওনেক টাকার চিজ কিনেন।”
“কুড়ি তারিখও এসেছিলেন?”
“জি হাঁ।”
“ওখান থেকেই দেখাও।”
নাসির মিডিয়া প্লেয়ারে ভিডিও খুলে টেনে প্রায় পিছনে নিয়ে অ্যাডজাস্ট করে দিল। একটু আগুপিছু করে বলল, “দেখুন স্যার। এই যে ওরা। ঘুসছেন।”
ভিডিওতে কোনও আওয়াজ নেই। নেতামশাই আর তাঁর বান্ধবী মিডিয়ার দৌলতে সবার পরিচিত। আমি ওদের দেখছিলাম না। দেখছিলাম বিশ্বজিৎকে। ওরা ঢোকা মাত্র ও নিজের জায়গা থেকে সরে গেল একেবারে ধারে। ফ্রেমের এক কোণে ওকে দেখা যাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ও পকেট থেকে ফোন বার করল। ফোন করছে। এবার রেখে দিল।
“কাকে ফোন করল জানো?” অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।
“আমাকে। এই সেই কাজ। যার কথা বলেছিলাম।”
“গুড।”
তারপর মিনিট কুড়ি শুধু শাড়ি নামানো, শাড়ি বাছা চলল। বিশ্বজিৎ নিজে ও দুই একটা শাড়ি খুলে দেখাল। এবার একটা ফোন এল তার কাছে। একটু সরে ফোন ধরে মুখে হাত চাপা দিয়ে কথা বলছে বিশ্বজিৎ। অফিসার আমার দিকে তাকালেন।
“আমি করেছিলাম। করে বলেছিলাম দুজনের ভিডিও তুলতে। গোপনে। আমি পাঁচশো টাকা দেব।”
বিশ্বজিৎ ফোন কাটল। কীসব খুটখাট করে ফোনটা আর জিন্সের প্যান্টের পকেটে ঢোকাল না। ঢোকাল বুকপকেটে। ও আমার কথা শুনেছিল। মোবাইল ক্যামেরা শিওর বাইরের দিকে আছে। বিশ্বজিৎ গোপনে ওদের ছবি তুলছে। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এঁরা চলে গেলেন। বিশ্বজিৎ পকেট থেকে মোবাইল বার করে ক্যামেরা অফ করল। রেখে দিল জিন্সের পকেটে। এবারই আসল। একটু পরেই কিছু একটা ঘটেছিল। বিশ্বজিৎ ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছিল। বলেছিল ওর নাকি শরীর খারাপ লাগছে। কী এমন হল এরপর? রামানুজ বলেছিল বাড়ি ফিরে ও নাকি পাগলের মতো করছিল। “আঁখ লাল। ডরা হুয়া। য্যায়সে কোই ভূত দেখ লিয়া হো।” কী হয়েছিল এরপরে? আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফুটেজ দেখতে লাগলাম। প্রথম আধঘণ্টা প্রায় কিছুই হল না। তারপর এক কাস্টমার দরজা দিয়ে ঢুকলেন। মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বজিৎ তাঁকে দেখেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। তিনি খুব ক্যাজুয়ালি, যেন শাড়ি দেখছেন, এমনভাবে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সোজা বিশ্বজিতের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিশ্বজিৎকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে। কিংবা ভয়ে। এই ঘরটায় এসি চলে। তাও একবার রুমাল বার করে ঘাম মুছল। ভদ্রলোক বিশ্বজিৎকে কিছু একটা দেখাতে বললেন। বিশ্বজিৎ একটা শাড়ি বার করে দেখাল। ভদ্রলোকের পিঠ ক্যামেরার দিকে। মাথা নিচু। কিন্তু তিনি বিশ্বজিতের সঙ্গে কথা বলছেন। বিশ্বজিতের ঠোঁট নড়ছে। সে উত্তেজিতভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছে। ভদ্রলোক হাত তুলে ওকে থামতে বললেন। তারপর স্পষ্ট দেখলাম হিপ পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে সেখান থেকে কিছু একটা তিনি বিশ্বজিতের হাতে গুঁজে দিলেন। একটা কাগজ। সে কাগজে কিছু লেখা। বিশ্বজিৎ তাতে চোখ বুলিয়েই সেটা বুকপকেটে রেখে দিল। ভদ্রলোক আরও কয়েকটা শাড়ি নেড়েচেড়ে বেরিয়ে গেলেন। যাবার ঠিক আগে জাস্ট একবার পিছনে ঘুরে তাকালেন। আর তখনই সিসিটিভি ক্যামেরায় পরিষ্কার দেখা গেল তাঁকে। আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল। এ লোক তো আমাদের চেনা! কিন্তু… অফিসার মুখার্জি খানিক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “চলো, জিজ্ঞাসাবাদ করার আর-একজন বাড়ল।” ভদ্রলোক চলে যাবার পর বেশ খানিক সময় বিশ্বজিৎ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। কী যেন ভাবল খানিক। পাশের ছেলেটি কথা বলতে যেতে মাথা নাড়ল বেশ কয়েকবার। তারপর সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। “বাস! ইতনা হি। ইসকে বাদ উয়ো নিচে গিয়ে আব্বুর থেকে ছুটি নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ি ভেগে গেছিল। ফির অউর নেহি আয়া।”
“ঠিক আছে। এই অংশটা একটা পেন ড্রাইভে নিয়ে দাও। আমি রিসিভ করে নিচ্ছি। আর হ্যাঁ। এই ফুটেজ ডিলিট করবে না। তোমাদের কাছেও কপি রাখো।”
“জি স্যার।”
দোকানের কাজ মিটতে মিটতে আরও মিনিট পনেরো গেল। দুপুর হয়ে গেছে প্রায়। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে চন্দননগরের দিকে চালাতে বলে মুখার্জি বললেন, “সকালে কিছু খাওনি নিশ্চয়ই। আমিও না। রাস্তায় খেয়ে নেব।” আমার খিদে পাচ্ছিল না। একটু আগে সিসিটিভি ফুটেজে যাঁকে দেখলাম,
তাঁকে দেখার পর আমার খিদে তেষ্টা সব উবে গেছে। “আপনি ভেবেছিলেন….” আমি বলা শুরু করতেই অফিসার চোখের ইশারায় আমায় থামিয়ে দিলেন। ইঙ্গিতে দেখালেন ড্রাইভারকে। মানে এর সামনে কথা বলা যাবে না।
বালি হয়ে চন্দননগর যাবার পথে রাস্তার ধারে একটা হোটেলে খেয়ে নিলাম। দুজনে। গোটা রাস্তায় মুখার্জি একটাও কথা বললেন না। প্রশ্ন করলেও উত্তর দিচ্ছেন না। অস্বাভাবিক গম্ভীর। কী ব্যাপার কে জানে! চন্দননগর পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। আমার কেন যেন একেবারে প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছিল। সেই অমিতাভ মুখার্জি, সেই গাড়ি, সেই ড্রাইভার, আবার দেবাশিসদার বাড়ি। সবকিছু চক্রাকারে ফিরে আসছে জুন মাসের কুড়ি তারিখের মতো। বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি সদর দরজা তালা মারা। সামনে একজন কনস্টেবল টুলে বসে খইনি ডলছে। মুখার্জিকে দেখেই সে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকল।
“দরজা খুলতে হবে। কিছু ইনভেস্টিগেশান আছে।”
“কিন্তু স্যার…”
পকেট থেকে একটা ছাপা কাগজ বার করল মুখার্জি। “এই যে অর্ডার আছে। দেখে নাও।” কনস্টেবল কী বুঝল জানি না। খানিক উলটে পালটে কাগজটা দেখল। তারপর “ঠিক আছে স্যার” বলে দরজা খুলে দিল।
“আর-একটা কথা শোনো। আজ থেকে এখানে লালবাজারের পুলিশ পোস্টিং থাকবে। একটু পরেই আসছে। তুমি আমার গাড়িটা নিয়ে চন্দননগর কমিশনারেটে চলে যাও। আমি ফিরে গিয়ে তোমাকে রিলিজ দিয়ে দিচ্ছি।”
“কিন্তু স্যার, মেন দরজায় কেউ থাকবে না?”
“আমি ভিতর থেকে বন্ধ করে দিচ্ছি। লালবাজারের লোক এলে ওদের চার্জ হ্যান্ডওভার করে আমি যাব।”
কনস্টেবল আর কথা বাড়াল না। গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে ছোটো একটা মুগুর টাইপ একটা অস্ত্র বের করে আনলেন মুখার্জি।
“এটা কী?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“হাতিয়ার। কখন কী কাজে লাগে।”
“ভিতরে কাউকে এক্সপেক্ট করছেন নাকি?”
“কিছু বলা যায় না।”
“তাহলে তো ওই কনস্টেবল থাকলে…”
“দরকার নেই। দ্য লেস, দ্য মেরিয়ার। লেটস গো।”
“আচ্ছা ওই সিসিটিভি ফুটেজে…”
“সেসব পরে হবে। আগে ভিতরে তো ঢুকি।”
ভিতরে ঢুকতে যেটা প্রথমেই নাকে এল সেটা অদ্ভুত এক গন্ধ। কাঁচা মাংস, কিংবা রক্ত বাসি পড়ে থাকলে যেমন চিমসে গন্ধ বেরোয় অনেকটা সেইরকম। অফিসার সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে গেলেন উপরে। পিছন পিছন আমিও। উপরের যে ঘরে দেবাশিসদা খুন হয়েছিলেন, দরজায় জাস্ট ছিটকিনি লাগানো। ভিতরের রক্ত কেউ সাফ করে দিয়েছে। কিন্তু জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে আগের মতোই। কে-ই বা গোছাবে! অফিসার সেগুলো প্রায় মাড়িয়েই চললেন বাথরুমের দিকে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এদিকে এসো। ওই গোপন ঘরটা এই বাথরুমের মধ্যে দিয়েই যেতে হয় খুব সম্ভব। দেবাশিসদার মোবাইলটাও তো এখানেই পাওয়া গেছে।”
অফিসারের পিছু পিছু আমিও ভিতরে ঢুকলাম। যে-কোনো সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির বাথরুমের মতো। শাওয়ার, কমোড, হ্যাঙ্গার, দেওয়াল আয়না। অফিসার চারদিকে দেখতে লাগলেন। কোথাও কোনও দরজার চিহ্নমাত্র নেই। আমার অনেকদিন আগে পড়া শার্লক হোমসের একটা গল্প মনে পড়ল। বললাম, “ফিতে আছে? মাপবার?”
“কেন? কী কাজে লাগবে?”
“দরকার ছিল। আছে?”
“উঁহুঁ। আমি কি কাঠের মিস্ত্রি নাকি যে পকেটে ফিতে নিয়ে ঘুরব?”
ততক্ষণে আমি একটা লম্বা নাইলনের দড়ি পেয়ে গেছি। এক প্রাপ্ত অফিসারকে দিয়ে বললাম, “ধরুন দেখি। একটু মাপি।”
অফিসার বিনাবাক্যব্যয়ে ধরে রইলেন। আমি বাথরুমের ভিতরের মাপটা দড়ি ধরে নিয়ে নিলাম। বর্গাকার বাথরুম। চোখের আন্দাজে মনে হচ্ছে দশ ফুট বাই দশ ফুট।
“এবার নিচে চলুন। লাস্ট আর-একটা মাপ লাগবে। বাইরে থেকে।”
মাপতে হল না। চোখের দেখাতেই বোঝা যাচ্ছে একদিকে প্রায় ডবল লম্বা। তাহলে গোপন ঘরটা এই দিকেই আছে। আবার বাথরুমে গেলাম। যেদিকে সন্দেহ করছি, সেদিকে একটা দেওয়াল আয়না। ঠেলাঠেলিতে কাজ হল না তেমন। আমি খুঁজতে লাগলাম। কিচ্ছু নেই। তারপরেই মনে এল গণপতির বাক্সের কথা। দেবাশিসদা সেই বাক্সের কথা জানতেন। যে বাক্স পাশাপাশি খোলে। দেখি না, যদি এটাও…
পাশ থেকে সামান্য ঠেলা দিতেই আয়না স্লাইডিং ডোরের মতো একদিকে খুলে গেল। পিছনে একটা অন্ধকার ঘর। অফিসার মুখার্জি যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না। আসলে পুলিশের গোয়েন্দাদের এই এক সমস্যা। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের মানুষ বলে মনে করেন না।
মুখার্জি অবাক, “তুমি এই ঘরের কথা জানতে?
“মোটেই না। আজ আপনার থেকেই শুনলাম প্রথম।” অপর্ণার কথা ইচ্ছে করেই বললাম না। দরকার কী? “তাই? সত্যি বলছ?”
“একদম। মিথ্যে বলে আমার লাভ?”
“তাহলে খুললে কী করে?”
“যেমন করে আপনি সেই বাক্স খুলেছিলেন লাইব্রেরিতে।”
“ওকে চলো। ভিতরে চলো।”
আমি নিজে আগে ঢুকলাম না। মৃদু হেসে অফিসারকে বললাম, “আপনিই প্রথমে ঢুকুন।”
.
ঘরটা অন্ধকার। কোনও জানলা নেই। ঢোকার জন্য পথ একটাই। এই বাথরুম। পিছন দিক থেকে ঢোকার কোনও উপায় নেই। নিশ্ছিদ্র দেওয়াল। অবশ্য তারপরেও একটা উপায় থাকে। নিচে পিছনের দিকে একটা দরজা আছে। সেটা পিছনের উঠোনে খোলে। ইয়েল লক লাগানো। বাড়ির পিছনে মাঠ। মাঠের উপর দিয়ে রাস্তা। একটা ছোটো খিড়কির দরজা সেদিকে খুলেছে। আমি যতবার ট্রেনে চেপে এসেছি, দেখেছি ওই পথে শর্টকাট হয়।
আমি এসব ভাবছি। এদিকে অফিসার মুখার্জি দেওয়াল হাতড়ে একটা স্যুইচ খুঁজে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। ঘরটা দেখে আমি অবাক হলাম। অনেকটা নার্সিংহোম বা হাসপাতালের রুমের মতো। মাঝে একটা লোহার খাট পাতা। তাতে সাদা চাদর। বালিশ। বিছানা। চেয়ার। একটা টেবিল। পাশে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি রাখা। একটাই বড়ো মেশিন। এতে হার্টবিট, পালস ইত্যাদি মাপে। বাবা যখন শেষের দিকে নার্সিংহোমে ভরতি ছিল, তখন দেখেছিলাম। আরও কিছু যন্ত্র। সুগার, প্রেশার ইত্যাদি মাপার। বেশ কিছু সিরিঞ্জ। খালি। এগুলো দিয়ে কী হত কে জানে! SIck experIment… সুকল্যাণবাবুর কথাগুলো মনে পড়তেই শিউরে উঠলাম। একধারে দেরাজের মধ্যে বেশ কিছু ইংরাজি বই রাখা। মুখার্জি সেগুলো উলটে পালটে দেখছিলেন।
“এদিকে দ্যাখো”, আমায় ডাকলেন, “বেশিরভাগ হিউম্যান অ্যানাটমি আর ফিজিওলজির বই। কিন্তু একটা বই বেশ অড। এইটা”, বলে পাতলা একটা পেঙ্গুইন পেপারব্যাক বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। একঝলক দিয়েই বুঝলাম যা ভেবেছিলাম তাই। এই ঘরেই ডাক্তার জেকিলকে মিস্টার হাইড বানাতেন দেবাশিসদা। কে সেই হাইড? বাসু? বাসুকি? তাহলে জেকিলটা কে?
মুখার্জির সঙ্গে আমিও হাত লাগালাম কাগজপত্রে। নোটস বা ডায়রি জাতীয় কিছু পেলে ভালো হয়। সেসব কিচ্ছু নেই। এক কোণে একটা বুনসেন বার্নার। সঙ্গে গ্যাসের লাইন যোগ করা। বার্নারের ঠিক পাশে একগাদা পোড়া কাগজের স্তূপ। তবে কেউ খুব তাড়াহুড়ো করে সব জ্বালিয়েছে। বেশ কিছু কাগজ আধপোড়া অবস্থায় লুটোচ্ছে এদিক ওদিক। আমি মাটি থেকে একটা হলদেটে কাগজ তুললাম। এটার তলার দিকে বেশ খানিকটা পড়া যাচ্ছে। কালো কালিতে কাঁপা হস্তাক্ষরের লেখা। যেন কোনও বৃদ্ধ লিখেছেন-
হে শান্তিময় পিতঃ! তোমার নিকট এখন এই প্রার্থনা যে, ভবিষ্যতে এইপ্রকার পাপের কুহকে কখনোই যেন আমাকে ভুলাইতে না পারে। আমার আস্তরিক ইচ্ছা জীবনের শেষ সময়ে যেন একাকী বসিয়া জগৎপিতাকে প্রাণভরে স্মরণ করিতে পারি।
আমার জার্নাল এই স্কুলেই সমাপ্ত হইল।
নীবারসপ্তক। প্রিয়নাথের শেষ হাড়। ছিল। নেই। সেই হাড়ের শেষ পাতা এখন আমার হাতে ধরা। প্রথম পাতা দেখেছিলাম সেই কবে। স্টেট আর্কাইভে। আমার কাছে দেবাশিসদার সেই চার লাইনের অর্থ স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রিয়নাথের শেষ হাড়
তৈমুরের কাব্যগাথা
গণপতির ভূতের বাক্স
তারিণীরছেঁড়া খাতা
মাস স্কেলে ভূত বানাতে গেলে এই চারটেই লাগবে। দুটো ওঁর কাছে ছিল। বাকি দুটোর খোঁজে ছিলেন দেবাশিস গুহ। কিন্তু এখন ঠিক উলটো অবস্থা। আমার কাছে সেই দুটো আছে, কিন্তু প্রিয়নাথের হাড় শেষ আর ভূতের বাক্স কোথায় জানা নেই। পাশে আর-একটা পাতা প্রায় অক্ষত অবস্থায়। নতুন চকচকে পৃষ্ঠা। কোনও স্পাইরাল বাউন্ড খাতা থেকে ছেঁড়া। সেখানে জড়ানো অক্ষরে যেন লেখাপড়া জানে না এমন কেউ লিখেছে। আমি বাসু। আমি বাসুকি। আমার পাঁচটি ফণা। আমিই হলাহলের রজ্জু।
আমি বিষ উগরে অমৃত তুলে আনি। আমার মাথার ভিতরে আর কিছু নেই। শুধু নিস্তব্ধতা। চারিদিকে আলো আর আওয়াজ। আমি স্থির। আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। আমি জানি কী অদ্ভুত উপায়ে আমি বাসুকি হয়ে যাই প্রতিবার। আমার আর মাথা ঘোরায় না। আমার শরীরে আর ব্যথা হয় না। আমার শরীরে এখন অমানুষিক শক্তি। কিন্তু আমি কিছু ভাবি না। আমার কাজ মাস্টারের কথা মেনে চলা। মাস্টারকে মেনে চলা। মাস্টারকে। মেনে। চলা। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার। মাস্টার।
এরপর গোটা পাতা জুড়ে শুধু একটাই কথা লেখা, “মাস্টার’। আর কিচ্ছু না। আমি অমিতাভ মুখার্জিকে ডেকে দেখালাম। ওঁর মুখ গম্ভীর, আরও গম্ভীর হয়ে গেল।
“কোথা থেকে পেলে এটা?”
“এই তো এদিকের চেয়ারের নিচে।”
“হুম… মনে হয় পোড়াতে গিয়ে চোখ এড়িয়ে গেছিল। আর কিছু নেই?”
“নাহ। দেখি যদি খাটেরতলায়…..”
খাটের তলা হাতড়ে একটাই কোনাপোড়া ছবি পাওয়া গেল। ধুলোমাখা। ধুলো ঝেড়ে দেখতে যাব, এমন সময় মুখার্জি নিজের হাতের সেই পাতাটা উলটে চমকে উঠলেন।
“সে কী! এই তুর্বসু, এদিকে একবার দেখে যাও তো।”
আমি গিয়ে দেখলাম একই হস্তাক্ষরে পিছনের পাতায় লেখা রয়েছে, “তুর্বসু রায় কে?”
“এই হাতের লেখা চেনো?”
“কস্মিনকালে দেখিনি। তবে দেবাশিসদার না।”
“সে আমিও জানি। কিন্তু…” বলতে না বলতে মুখার্জির কাছে একটা ফোন এল। একঝলকে ডিসপ্লে স্ক্রিনে দেখলাম নাম ভেসে উঠেছে ‘গোলাপ”। ফোন আসা মাত্র মুখার্জি “একটু দাঁড়াও। এক্ষুনি আসছি”, বলে ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুম হয়ে দেবাশিসদার ঘরে চলে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম একা। সেই ছবি হাতে নিয়ে।
.
বেশ অনেকদিন আগের তোলা ছবি। কিন্তু চেনা যাচ্ছে। এই লোকটাকেই কিছুক্ষণ আগে দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে দেখেছি। বিশ্বজিতের হাতে কাগজ গুঁজে দিচ্ছে। এই লোকটাই কিছুদিন আগে আমাদের সঙ্গে কত কথা বলেছে। প্রশান্ত মজুমদার। স্টেট আর্কাইভের ডিরেক্টর। কিন্তু ছবির ঠিক মাঝে তার অন্য পরিচয় লেখা। কেউ একটা লাল মার্কার দিয়ে গোটা গোটা হরফে লিখেছে “MASTER”। পিছন ফিরে অমিতাভ মুখার্জিকে ডাকতে যাব, দেখলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাথায় প্রচণ্ড একটা ব্যথা। সবকিছু দুলে উঠে পৃথিবী আবছা হয়ে এল। জ্ঞান হারাবার আগে যেন বহুদূর থেকে অমিতাভ মুখার্জির গলা শুনতে পেলাম, “শা-আ-লা-হ, বোকাচ্চোদা… অনেক জ্বালিয়েছিস…..’