দরজার ওপাশে

দরজার ওপাশে

বাড়িটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শমিতের মনে হল, বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে৷

ভালো করে দেখা যাচ্ছে না৷ একটা থামে আড়াল হয়ে আছে৷ গাছের ঝাঁকড়া ডাল-পাতার ছায়া পড়ে কেমন যেন একটা আলো-ছায়ার লুকোচুরি ভাব৷ তাই ওটা কী মানুষ নাকি অন্য কিছুর ছায়া ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ যদিও শমিতের মনে হচ্ছিল ওটা মানুষই৷ কেউ একজন থামের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে কিছু করছে৷ সাদা রঙের জামা-কাপড় পরা বলে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে৷

প্রায় ছয়মাস হতে চলল, শমিত এই গৌরীপুর গ্রামের শিবনাথ বসু উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলার মাস্টারমশাই হয়ে এসেছে৷ স্কুলটা গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে৷ বেশ বড় ইংরোজি এল আকৃতির একখানা দোতলা বাড়ি৷ সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা৷ পিছনে দুটো বড় বড় খেলার মাঠ৷ একটাতে বড় ছেলেরা ফুটবল-ক্রিকেট খেলে৷ অন্যটা থাকে নীচু ক্লাসের বাচ্চাদের দখলে৷ শীতের সময় স্পোর্টস হয়৷ আশপাশের গোটা দু-তিন গ্রামের মধ্যে এই একটাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল, মানে বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়ানো হয়৷ তাই ছাত্রসংখ্যাও নেহাত কম নয়৷ প্রতি ক্লাসে প্রায় জনা পঞ্চাশেক ছাত্র৷ তাদের অনেকেই আবার ভারী বিচ্ছু৷ শমিত এদিকে ভালোমানুষ, গোবেচারা ধরনের লোক৷ তাই ছাত্ররা তাকে মানে না মোটেই৷ সবাইকে সামলে, পড়া বোঝাতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই হিমশিম খেতে হয়৷ ব্যাপারটা তার ভালো লাগে না মোটেই৷ কিন্তু কিছু করার নেই৷ শমিতের বাবা মারা গেছেন অল্পবয়সে৷ মা কষ্টেসৃষ্টে মানুষ করেছে তাকে৷ সে পাশ করে চাকরি পেয়েছে বলে মা ভারী খুশি৷ স্কুলে পড়াতে তার ভালো লাগছে না, অসুবিধা হচ্ছে বললেই মা যেন কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে৷ তাড়াতাড়ি ছেলের গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে, দেখিস বাবা, ভালো লাগছে না বলে যেন আবার দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিস না৷ প্রথম প্রথম ওরকম সবার লাগে৷ আর ছোট ছেলেপুলেরা তো একটু দুষ্টু হবেই৷ স্কুলের মাস্টারমশাই যখন হয়েছিস তখন তো ওটুকু মেনে নিতেই হবে৷ তুই বরং এক কাজ কর৷ ক্লাসে যখন যাবি, তখন মুখখানা একেবারে আষাঢ়ের মেঘের মতো গম্ভীর করে রাখিস আর হাতে একখানা ছড়ি নিস৷ তাহলেই দেখবি ছাত্ররা ভয় পাবে৷

মায়ের টোটকায় অবশ্য লাভ হয়নি কিছুই৷ কারণ শমিতের মুখটা এমন আহ্লাদে, ভালোমানুষ গোছের, যে সে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেও কেউ তাকে ভয় পায় না৷ আর হাতে ছড়ি নিয়েও কোনও লাভ নেই৷ কারণ ছড়ি দিয়ে কোনও ছাত্রকে মারতে হবে ভাবলেই শমিতের কান্না পেয়ে, হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকে যায়৷ অতএব সে কোনওটারই চেষ্টা করেনি৷ তবে মা ভয় পেয়ে গেছে বুঝে মাকেও আর কিছু বলেনি৷

যদিও মা-কে ছাড়া আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ তার নেই৷ কারণ ছোটবেলা থেকেই মুখচোরা হওয়ায় শমিতের বন্ধু-বান্ধব বেশ কম৷ স্কুলে পড়ার সময় ছেলেদের সঙ্গে মারামারি, ঝাঁপাঝাঁপি কোনওটাই সে পারত না৷ ক্লাসরুমের এককোণে এমনভাবে গুটিয়ে বসে থাকত যে অনেকসময় মাস্টারমশাইরা তাকে খেয়ালই করতেন না৷ অথচ পড়াশোনায় সে যে খুব খারাপ ছিল তা কিন্তু নয়৷ কলেজে ওঠার পর দু-একজনের সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব হয়েছিল৷ কিন্তু তারাও এখন চাকরি নিয়ে নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে৷ যোগাযোগ তেমন নেই৷ মনের দুঃখ নিজের মনেই চেপে রাখতে রাখতে শমিত কেমন যেন একটু মনমরা, বিষণ্ণ হয়ে থাকত সবসময়ই৷

কিন্তু মাস খানেক আগে একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটল৷ শমিতের বাড়ি থেকে স্কুলে আসার যে পথটা, সেটাই গ্রামের মূল রাস্তা৷ দু’ধারে হাট-বাজার, বাড়ি-ঘর, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সবই আছে৷ গৌরীপুর এমনিতে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম৷ রাস্তায় সাইকেল, ভ্যানরিকশা এমনকি মোটরসাইকেলেরও অভাব নেই৷ তার বাড়ি থেকে স্কুলটা বেশ দূর৷ হেঁটে যেতে প্রায় কুড়ি মিনিট লাগে৷ আর রাস্তার দু’ধারে গাছপালা তেমন নেই বলে, গরমের দিনে বেশ কষ্টই হয়৷ কিন্তু উপায় তো নেই৷ কারণ গ্রামদেশে পায়ে হেঁটে যাওয়াটাই রেওয়াজ৷ রিকশার চল নেই তেমন৷ তবে হাঁটার কষ্ট ছাড়াও আর একটা অসুবিধাও শমিতের ছিল৷ স্কুলের ছাত্ররাও সবাই একই পথে হেঁটে যায়৷ যাওয়ার সময় সবারই তাড়া৷ ঘণ্টা পড়ে গেলে হেডস্যারের বকা খেতে হবে৷ কিন্তু ছুটির পরে যখন ছেলেরা গল্প করতে করতে ফেরে, তখনই হয় ঝামেলা৷ অপছন্দের স্যার কাউকে রাস্তায় দেখলে প্রায়ই তার উদ্দেশে টুকটাক মন্তব্য ছুড়ে দেয় ছাত্ররা৷ কে বলছে বোঝার উপায় নেই৷ কিন্তু যাকে বলা হচ্ছে তার অস্বস্তি বাড়বেই৷ শমিতকে লক্ষ করে প্রায়ই এরকম মুখরোচক মন্তব্য উড়ে আসত বলে সে চেষ্টা করত, স্কুল ছুটি হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে বেরোতে, যাতে ছাত্রদের মূল দঙ্গলটা এগিয়ে যায়৷

এরকমই একদিন বেরিয়েছে৷ সেদিন আবার ভয়ংকর রোদ আর গরম৷ অতখানি রাস্তা হেঁটে যেতে হবে ভেবেই গায়ে যেন জ্বর আসছে তার৷ এমন সময় স্কুলের বিহারি দারোয়ান হনুমান প্রসাদ বলল, মাস্টারবাবু আপনার বাড়ি তো পিরপাড়ায়৷ তা আপনি অত ঘুরে বড় রাস্তা দিয়ে যান কেন? শর্টকাটে গেলেই তো পারেন৷

শমিত তো অবাক৷ স্কুল থেকে বাড়ি যাওয়ার কোনও শর্টকাট রাস্তা আছে বলেই তার জানা নেই৷ হনুমান প্রসাদকে জিজ্ঞাসা করতে জানা গেল, গেট দিয়ে বেরিয়ে খানিকটা এগোলে লিচুবাগানের পাশ দিয়ে বাঁহাতে যে রাস্তাটা ঢুকেছে, সেটাই একটু এঁকেবেঁকে গিয়ে ওঠে পিরপাড়ার মুখে৷ ওই পথ দিয়ে গেলে সময় অনেক কম লাগে৷ তবে রাস্তাটা ফাঁকা বলে অনেকে যেতে চায় না৷ শমিত মুখচোরা হলেও ভীতু নয়৷ তা ছাড়া চোর-ডাকাতের ভয় তো আর নেই৷ তার পকেটে বড়জোর পঞ্চাশ টাকা আছে৷ সে নিতে আর কে আসবে৷ তাই সে ঠিক করে ফেলল ওই নতুন রাস্তা দিয়েই আজ বাড়ি ফিরবে৷

মস্ত লিচুবাগান৷ বড় বড় লিচুগাছে ভর্তি৷ গরমের দিনে টুকটুকে লাল লিচু, গাছ ভরে পেকে থাকায় চমৎকার দেখাচ্ছে৷ বাগানটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা৷ তার পাশ দিয়েই ঢুকেছে রাস্তাটা৷ কিছুটা এগিয়েই মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল শমিতের৷ রাস্তা ফাঁকা৷ কদাচিৎ দু-একটা লোক দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু চারপাশটা ভারী সুন্দর৷ দু’ধারে বড় বড় মহানিম, অশ্বত্থ আর অর্জুন গাছ৷ গাছের ছায়ায় চারদিকটা ঠান্ডা হয়ে আছে৷ মাঝে-মধ্যে নানারকম পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে৷ শমিত মনে মনে ঠিক করে ফেলে এবার থেকে সে প্রতিদিনই এই রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরবে৷

লিচুবাগান পেরিয়ে খানিকটা যাওয়ার পর রাস্তাটা ডানদিকে বেঁকেছে৷ সেদিকে কিছুটা যাওয়ার পর কিন্তু চমকে উঠল শমিত৷ রাস্তার ধারেই একটা পেল্লায় চক-মেলানো দোতলা বাড়ি৷ সঙ্গে নানারকম গাছ-গাছালিতে ভর্তি বিশাল বাগান৷ বাড়িটা অবশ্য খুবই পুরোনো এবং ভগ্নপ্রায়৷ দরজা-জানলা সব বন্ধ৷ জানলার কাঠের রং জ্বলে গেছে৷ পাল্লায় ফাট ধরেছে৷ সিঁড়ির জাফরিতে মাঝে মাঝেই বুড়োমানুষের ফোকলা মুখের মতো বড় বড় ভেঙে যাওয়া কাচের ফাঁক৷ দেওয়ালের নানা জায়গায় মাথা তুলেছে রকমারি গাছের চারা৷ তাদের অনেকে আবার দিব্যি ডালপালাও মেলে দিয়েছে৷ বাড়িটাতে কোনও মানুষজন থাকে বলে মনে হয় না৷ জংধরা গেটেও তালাবন্ধ৷ কিন্তু তবু শমিত গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে বাড়িটাকে দেখল৷ তার কেমন যেন মনে হচ্ছিল বাড়িটা এতদিন ধরে তার অপেক্ষায় ছিল৷ তাকে দেখে ভারী খুশি হয়েছে৷ সেদিন বাড়ি ফিরে নিজের কাজকর্ম করতে করতেও শমিতের বারবারই বাড়িটার কথা মনে পড়ছিল৷

তারপর থেকে শমিত প্রতিদিনই স্কুল থেকে ফেরার সময় বাড়িটার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়৷ বাড়িটা যেন ক্রমশ তার বন্ধু হয়ে উঠেছে৷ যেদিন স্কুলে ছাত্ররা তাকে খুব বেশি উত্ত্যক্ত করে, কিংবা অন্য মাস্টারমশাইরা অপদস্থ করতে চায়, সেদিন শমিত তার মনের সব দুঃখ বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে উজাড় করে দেয়৷ সারাদিন যা ঘটেছে সব সে মনে মনে বলে, আর তার মনে হয় বাড়ির দেওয়াল-দরজা-জানলা সব যেন স্থির হয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তার প্রতিটি কথা শুনছে, তার দুঃখে দুঃখিত হচ্ছে৷ এমনকী এই সময়টায় একেক দিন এমন একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া বাগানের গাছপালার মধ্যে দিয়ে বয়ে এসে শমিতকে ছুঁয়ে যায় যে শমিতের মনে হয়, আসলে বাড়িটা যেন তার মাথায় সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ অদ্ভুত ব্যাপার হল, এরকম একটা প্রাসাদের মতো ভাঙা বাড়ি যে গ্রামে আছে, সে ব্যাপারে শমিত কিন্তু কোনওদিন কারুর কাছে কিছু শোনেওনি৷ তাই বাড়িটা যে আসলে কার, কারা থাকত এখানে সেসব কিছুই সে জানে না৷ জানার খুব একটা আগ্রহও তার নেই৷

গত প্রায় একমাস, রোজই স্কুল থেকে ফেরার সময় শমিত বেশ কিছুক্ষণ বাড়িটার সামনে কাটায়৷ তবে কোনওদিনই ভিতরে কোনও মানুষজন দেখেনি৷ ভাঙা গেটটা ঠেলাঠেলি করে খুলে ভিতরে কেউ আছে কিনা দেখার চেষ্টাও অবশ্য সে করেনি৷ তাই আজ গোল গোল থাম দেওয়া বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে মনে হওয়ায় সে একটু আশ্চর্যই হল৷ বাড়িটা কি তাহলে পরিত্যক্ত নয়? বাসিন্দারা মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকে? কথাটা ভেবে একটু মনখারাপই হয়ে গেল শমিতের৷ এই ক’দিনের মধ্যেই বাড়িটার ওপর তার কেমন যেন একটা অধিকার জন্মে গেছে৷ তাই বাড়ির অন্য ভাগীদার থাকতে পারে এই ভাবনাটাই তার একটুও পছন্দ হচ্ছিল না৷

পরদিন ওই রাস্তা দিয়ে আসার সময় শমিত একটু আশায় আশায় ছিল যে সে হয়তো ভুল দেখেছে৷ কিন্তু সেদিন আর কোনও সংশয় থাকল না৷ বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শমিত দেখতে পেল বারান্দায় এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন৷ বেশ লম্বা, স্বাস্থ্যবান চেহারা৷ ধুতি পরা৷ খালি গা৷ সাদা ধপধপে পৈতেটা গায়ে ঝুলছে৷ আশ্চর্য ব্যাপার, ভদ্রলোক যেন শমিতের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন৷ তাকে দেখেই সোজা এগিয়ে এসে বললেন, আসুন আসুন ভিতরে আসুন, আজ তো মিটিংয়ের জন্য স্কুল ছুটি হতে অনেকটা দেরি হল…..

হেডস্যার অন্য মাস্টারমশাইদের নিয়ে একটা মিটিং করেছেন৷ স্কুল থেকে বেরোতে তাই সত্যিই বেশ খানিকটা দেরি হয়েছে শমিতের৷ ভদ্রলোক সেটা জানেন দেখে একটু চমক লাগল৷ কিন্তু ততক্ষণে বাড়িটার ভিতরে ঢুকতে পারবে জেনে তার এত আনন্দ হচ্ছিল যে ওই ভাবনাটা বিশেষ গুরুত্ব পেল না৷

বাগানের ভিতর দিয়ে বেশ খানিকটা নুড়ি পাথর ঢালা পথ ৷ তারপর দু’ধাপ সিঁড়ি উঠে গোল বারান্দা৷ সেখানে দুটো ধুলোমাখা পুরোনো কাঠের চেয়ার পাতা রয়েছে৷ তারই একটাতে শমিতকে বসতে বললেন ভদ্রলোক৷ বারান্দা ঘিরে বেশ কয়েকটা দরজা৷ সবগুলোই ভিতর থেকে বন্ধ৷ যদিও ভিতরে কোনও লোক আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না৷ কারুর কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না৷ শমিত খেয়াল করল সারা রাস্তা সে নানারকম পাখির ডাক শুনতে শুনতে এলেও, এই বাগানের ভিতরটা কিন্তু আশ্চর্যরকম নিস্তব্ধ৷ কোথাও কোনও পাখি কিংবা কাঠবিড়ালির ডাক শোনা যাচ্ছে না৷ এমনকী ঝিঁঝিঁ পোকারাও কোনও অজানা কারণে একেবারে চুপ করে আছে৷

আমার নাম যশোনাথ গাঙ্গুলি…….

ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ বেশ ভরাট, গম্ভীর৷ কথা বলার মধ্যে একধররনের রাশভারী ব্যক্তিত্ব আছে৷

কিছুদিন ধরেই লক্ষ করছি যে আমার বাড়িটা আপনার বেশ পছন্দ হয়েছে৷ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি মনের কথা চালাচালি করেন৷ বাড়িটাকে আপনার বেশ নিজের নিজের মনে হয়….সবটাই আমার বেশ ভালো লেগেছে৷ আসলে এই বাড়িটা তো আমার নিজেরও খুব প্রিয়৷ এটাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারি না৷ তাই আপনার বাড়িটা পছন্দ হয়েছে জেনে বেশ ভালো লাগছিল৷

এই বাড়িটার সম্বন্ধে শমিত কোনও দিন কাউকে একটি কথাও বলেনি৷ এমনকি, তার মাও এবিষয়ে কিছু জানে না৷ অথচ ভদ্রলোক কীরকম অনায়াসে তার মনের কথা জেনে বসে আছেন দেখে অবাক লাগছিল শমিতের৷ কিন্তু সেকথা না তুলে সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি বরাবর এখানেই থাকেন? বাড়ির সব দরজা-জানলা বন্ধ থাকে দেখে আমি ভেবেছিলাম….

কী মুশকিল! এখানে থাকব না তো যাব কোথায়? এটা তো আমার পৈতৃক বাড়ি৷ আমার দাদুর বাবা, রাজা দীনেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন৷ রাজা অবশ্য তিনি ছিলেন না৷ তবে বড় জমিদার ছিলেন৷ আশপাশের অন্তত গোটা দশেক গ্রাম নিয়ে তাঁর জমিদারি চলত৷ পরে যদিও সরকার সব জমি-জমা, সম্পত্তি কেড়ে নেয়৷ তবে এই বাড়িটাকে অনেকদিন পর্যন্ত লোকে রাজবাড়িই বলত৷ কিন্তু জমিদারি চলে গেলে কি আর সেই বোলবোলাও থাকে? আমাদের অবস্থাও আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করেছিল৷ জমানো টাকা বসে খেলে তো আর বেশিদিন থাকে না৷ তাই একসময় পয়সা-কড়ি শেষ হয়ে গেল৷ অবস্থা বেগতিক দেখে আশ্রিত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সব পালাল৷ শেষ পর্যন্ত টিঁকে ছিলাম আমার মা-বাবা আর আমি৷ আমি গাঙ্গুলি বংশের শেষ সন্তান৷ আর ছিল এই বাড়িটা৷ যদিও যত্নের অভাবে বাড়ির অবস্থাও গাঙ্গুলি বংশের মতোই৷ নাহলে এমন বাড়ি তখন এই তল্লাটে কারও ছিল না৷ জয়পুর থেকে শ্বেতপাথর এনে বাড়ির মেঝে করা হয়েছিল৷ মেহগিনি কাঠের আসবাবে ঘর ভর্তি ছিল৷ সবই আপনাকে দেখাব একটু একটু করে৷ আমি আসলে সবকিছুই একটু ধীরে-সুস্থে করাটা পছন্দ করি৷ গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাড়াহুড়ো করাটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ৷

সেদিন যশোনাথের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ফিরে এসে নিজেকে কেমন যেন চাঙ্গা লাগছিল শমিতের৷ মনটা যেন হালকা, খুশি-খুশি৷ মা-কে চা বানাতে বলে, ঘরে জামাকাপড় ছাড়তে গিয়ে শমিত হঠাৎ লক্ষ করল, তার নাকের নীচে রোমের রেখা ঘন হয়ে আছে৷ এমনিতে সে ক্লিন-শেভেনড৷ প্রতিদিন সকালে নিখুঁত করে দাড়ি কামায়৷ অনেকসময় রাতেও আর একবার শেভ করে৷ তাহলে এই গোঁফটা গজাল কখন? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখতে দেখতে শমিত ঠিক করল গোঁফটা সে রেখেই দেবে৷ যশোনাথ গাঙ্গুলির বেশ পুরুষ্টু গোঁফ আছে৷ ওরকম গোঁফ তারও যদি গজায় তাহলে মন্দ হবে না৷

যশোনাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে এখন রোজই দেখা হয় শমিতের৷ সত্যি কথা বলতে কী, কতক্ষণে দেখা হবে, তার জন্য সে মনে মনে রীতিমতো ছটফট করে৷ স্কুলের ক্লাস শেষ হলে আর একমুহূর্ত দাঁড়ায় না৷ হেডস্যার কোনও হুকুম করলে রীতিমতো বিরক্ত হয়৷ যশোনাথ গাঙ্গুলিও অবশ্য রোজই শমিতের জন্য অপেক্ষা করেন৷ শমিত গেলে তাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান৷ আশ্চর্যের ব্যাপার বাড়ির বাইরেটা ওরকম ভাঙাচোরা হলেও ভিতরটা একদম অন্যরকম৷ বারান্দার ওই বন্ধ দরজাগুলো পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেই চারপাশটা একদম বদলে যায়৷ তখন পায়ের তলায় ঝকঝক করে হালকা গোলাপি মার্বেলের মেঝে৷ ছাদ থেকে ঝোলানো ঝাড়বাতির আলো ঠিকরে পড়ে বেলজিয়ান গ্লাসের মস্ত আয়নায়৷ ভেলভেটের গদি দেওয়া মেহগিনি কাঠের সোফায় বসে শমিত দেখতে পায় লম্বা টানা বারান্দায় সার সার ঝুলছে রকমারি পাখির খাঁচা৷ হলুদ ঝুঁটি দেওয়া সাদা ধপধপে কাকাতুয়া দাঁড়ে বসে একমনে আখরোটের খোলা ভাঙছে৷

বাড়িটা কিন্তু ফাঁকাও নয় মোটেই৷ যশোনাথ গাঙ্গুলি ছাড়া আর কোনও মানুষকে যদিও শমিত দেখেনি কোনওদিন৷ কিন্তু লোকজন যে আছে বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ অস্পষ্ট কথাবার্তা, মেয়েদের শাড়ির খসখস, গয়নার টুংটাং, খড়মের খটখট, রান্নার ছ্যাঁকছোঁক সবই শোনা যায়৷ যশোনাথ তাকে একেকদিন একেকটা ঘর ঘুরিয়ে দেখান৷ সেইসব ঘরেও যে কিছুক্ষণ আগেই অন্য মানুষ ছিল, তারা আসবে বলে পাশের ঘরে উঠে গেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ তবে অতিথির জন্য সবসময়ই তারা ঘরে কিছু না কিছু উপহার রেখে যায়৷ কোনওদিন মোরাদাবাদি রেকাবিতে গন্ধরাজ ফুল, কোনওদিন আবার রুপোর গ্লাসে ঘোলের সরবত৷ শমিতের মনে হয় এবাড়ির সকলেই যেন তাকে ভারী পছন্দ করে, তার জন্য অপেক্ষায় থাকে৷ তার নিজেরও বাড়িটার প্রতি আকর্ষণ দিনে দিনে বাড়ছে৷ ছেড়ে যেতে যেন ইচ্ছেই করে না৷ কথাটা সে একদিন যশোনাথকে বলেও ফেলেছিল৷ যশোনাথ একটু সময় স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, একটু ধৈর্য ধরুন৷ সেই ব্যবস্থাই তো হচ্ছে৷

কথাটার মানে অবশ্য শমিত বুঝতে পারেনি৷ তবে এটা সে বুঝেছে প্রতিদিন এই রাজবাড়িতে যাওয়ার ফলে তার নিজের মধ্যেও কিছু বদল হয়েছে৷ নাকের ওপর সেই হালকা রোমের রেখাটি এখন বেশ পুরুষ্টু গোঁফের আকার নিয়েছে৷ শমিতের বয়স প্রায় তিরিশ৷ এই বয়সে মানুষ আর বাড়ে না মোটেই৷ কিন্তু শমিতের মনে হচ্ছে হঠাৎ-ই সে বেশ ইঞ্চি দুয়েক লম্বা হয়ে গেছে৷ অভ্যস্ত জামা-কাপড়গুলোও কেমন যেন ছোট-ছোট ঠেকছে৷ আর একটা মজার ব্যাপার হল যে মা আজকাল আর তার গলা চিনতে পারে না৷ সেদিন সে বাজার নিয়ে ফিরে বাইরে থেকে এক হাঁক দিতে মা তো ভয়-টয় পেয়ে একশা৷ শমিতকে সামনে দেখেও কেমন যেন বিশ্বাস করতে পারছে না৷ বারবার বলছে, তোর গলাখানা এমন গেরামভারী মতো হয়ে গেল কী করে রে খোকন! চেহারাটাও কেমন যেন মুশকো মত হয়েছে……

মায়ের কথা শুনে বেশ মজাই লেগেছিল শমিতের৷ কিন্তু সেদিন স্কুলে গিয়েও সে বুঝতে পারল যে কিছু একটা বদল হয়েছে৷ ছেলেরা আজকাল আর তার ক্লাসে তেমন দুষ্টুমি করে না৷ একটু যেন ভয়ই পায় তাকে৷

সেদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় যশোনাথ গাঙ্গুলিকে কথাটা বলতে, তিনি আবারও একইরকম ঠান্ডা হেসে বললেন, পরিবর্তনই তো জগতের নিয়ম৷ আমারও তো বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে৷ আপনি বোধহয় খেয়াল করেননি৷

কথাটা শুনে ভদ্রলোককে ভালো করে দেখে শমিতের মনে হল, সত্যিই তো৷ প্রথমদিন যেমনটি দেখেছিল, তার থেকে অনেকটাই চেহারা বদলে গেছে যশোনাথের৷ মোটা গোঁফজোড়া উধাও৷ লম্বা মানুষটি হঠাৎ-ই যেন একটু খাটো হয়ে গেছেন৷ মুখে জমিদারসুলভ গাম্ভীর্যের বদলে একটা যেন গোবেচারা ভাব৷ ব্যাপারটা কী করে ঘটল ভাবার চেষ্টা করছে শমিত, এমন সময় যশোনাথ বললেন, আপনার তো এই বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না বলেছিলেন, তাই আপনি যাতে এখানেই থাকতে পারেন সে ব্যাপারে আমি আমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলাম৷ তাঁরা দুজনেই রাজি হয়েছেন৷ বাড়ির অন্যান্যদেরও আপত্তি নেই…তাই আমরা ঠিক করেছি যে এবার থেকে আপনি এই বাড়িতেই থাকবেন৷ তবে রাজবাড়িতে তো এরকম হুট করে আসা যায় না৷ তাই আমাদের পুরোহিত মশাই দিন-ক্ষণ দেখে নিয়েছেন৷ আগামী মঙ্গলবার অমাবস্যা পড়েছে৷ সেদিন ঠিক মধ্যরাতে এই বাড়িতে আপনার অভিষেক হবে৷ কিন্তু কাউকে একথা জানানো চলবে না৷ আপনি ঠিক সময়ে একলা, গোপনে এখানে চলে আসবেন৷

কথাটা শুনে, শমিতের মনে হচ্ছিল সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ কিন্তু তবু মনের উচ্ছ্বাস চেপে বলল, কিন্তু আমার মা তো একলা থাকতে পারবেন না৷ তাঁকে নিয়ে আসব তো?

তাঁকে নিয়ে আসতে হবে না৷ চিন্তা করবেন না৷ তাঁর সব দায়িত্ব আমার৷

মঙ্গলবার গভীর রাতে, নিঃশব্দে নিজের বিছানা ছেড়ে উঠল শমিত৷ পাশের ঘরে মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে৷ পাছে ঘুম ভেঙে যায়, তাই চুপিচুপি দরজা টেনে বেরিয়ে এল রাস্তায়৷ অমাবস্যার রাত৷ চারিদির ঘুরঘুট্টি অন্ধকার৷ মাঝে-মধ্যে দূর থেকে দু-একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে৷ শমিতের কিন্তু ভয় লাগছিল না একটুও৷ সে যেন কেমন হাওয়ায় ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে৷ আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে রাজবাড়ির সামনে এসেই চমকে উঠল শমিত৷ গোটা বাড়িটা আলোয় ঝলমল করছে৷ চারিদিক ফুল দিয়ে সাজানো৷ হালকা সানাইয়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে৷ গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল শমিত৷ বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে সে আয়নায় নিজের মুখ দেখেনি৷ নাহলে বুঝতে পারত, তাকে এখন অবিকল প্রথমদিনের যশোনাথ গাঙ্গুলির মতো দেখতে লাগছে৷

যশোনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন৷ শমিতকে দেখে বললেন, আসুন, সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে…….

বারান্দার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল শমিত৷ যশোনাথ কিন্তু ঢুকলেন না৷ দরজা বন্ধ হয়ে গেল৷ বাগানে নেমে এলেন যশোনাথ৷ পুরোনো, ভেঙে পড়া, চারপাশে গাছ গজানো রাজবাড়ির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে, ভাঙা গেটটা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে এসে ফিরতি পথে ধরলেন৷ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার৷ কাল সকালেই তো আবার স্কুলে গিয়ে ছাত্র ঠ্যাঙাতে হবে৷

1 Comment

Excellent !

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *