দণ্ডকারণ্যের সেই সন্ন্যাসী

দণ্ডকারণ্যের সেই সন্ন্যাসী

প্রায় ছাপ্পান্ন বছর আগে আমি দণ্ডকারণ্যে যাই। সেই সময় তোমরা যারা এই লেখাটি পড়ছ, তারাই শুধু নও, তোমাদের অনেকেরই বাবা—মায়েরও জন্ম হয়নি।

রামায়ণে দণ্ডকারণ্যের কথা নিশ্চয়ই পড়েছ। এটা সেই দণ্ডকারণ্য। শত সহস্র বছর আগেকার সেই প্রাচীন বনভূমি।

দণ্ডকারণ্য ঠিক কোথায়, সেটা জানিয়ে দিই। আমি যখন গিয়েছিলাম, মধ্যপ্রদেশ তখনও ভাগ হয়নি, যারা ভূগোল পড়েছ রায়পুর শহরটার নাম তাদের জানা। আজকের রায়পুর এক বিশাল নগরী। ছাপ্পান্ন বছর আগে তেমনটি ছিল না। বেশির ভাগ রাস্তাই আঁকাবাঁকা, সরু সরু গলি, ধুলোময়লা এবং খানাখন্দে ভরা। রাস্তার দুধারে আদ্যিকালের সব দালানকোঠা। ছিরিছাঁদহীন। কোথাও বা আবর্জনার ডাঁই। অবশ্য কোনও কোনও মহল্লায় দু—চারটে চওড়া চওড়া তেলতেলে মসৃণ সড়কও ছিল। সেগুলোর দুপাশে চোখধাঁধানো ঝাঁ—চকচকে সব বাড়ি—দোতলা, তেতলাই বেশি। কয়েকটা চারতলা পাঁচতলাও চোখে পড়েছে।

এই রায়পুর শহরটা সেই সময় দক্ষিণ দিকে যেখানে শেষ হয়েছে, তার পর থেকে একটা জাতীয় সড়ক, খুব সম্ভব তেতাল্লিশ নম্বর, কখনও কয়েক মাইল (তখন কিলোমিটার হিসেবে দৈর্ঘ্যপ্রস্থ মাপা হত না) সোজা চলার পর পাহাড়ের চড়াই বেয়ে ওপরে উঠে আবার নীচে নেমেছে, কখনও গভীর জঙ্গল ভেদ করে, ছোট—বড় বহু পাহাড়ি নদীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে গেছে। যেদিকেই তাকানো যাক, শুধু জঙ্গল, পাহাড়, ঝরনা। এখানকার বেশির ভাগ মাটিই কালচে, পাথুরে।

মধ্যপ্রদেশের পর ওড়িষা, তারপর অন্ধ্রপ্রদেশের অনেকটা অংশ জুড়ে এই দণ্ডকারণ্য। তিন রাজ্য মিলিয়ে যে সুবিশাল বনভূমি তার আয়তন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় তিনগুণ। এতবড় একটা অঞ্চলে মানুষজন বলতে বেশির ভাগই আদিম জনজাতি। সাঁওতাল কোল ভিলদের কথা তোমরা শুনেছ। বা নাগা খাসিয়া গারো মিজোদের কথাও অজানা নয়। তেমনি দণ্ডকারণ্যে রয়েছে গোণ্ড মারিয়া মুরিয়া অবুঝমার ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ তো দণ্ডকারণ্যের পটভূমি। হঠাৎ আমার মাথায় জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা এমন একটা সৃষ্টিছাড়া জায়গায় যাবার ইচ্ছাটা চাড়া দিয়ে উঠল কেন? এই কৌতূহলটা তোমাদের হতেই পারে।

আসলে দণ্ডকারণ্যে আসার তিন বছর আগে আমার প্রথম উপন্যাস ‘পূর্বপার্বতী’ লিখেছিলাম উত্তর—পূর্ব ভারতের নাগা উপজাতির জীবনের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে। তোমরা সবাই জানো আমাদের এই বিশাল দেশের নাগাদের মতো অসংখ্য ট্রাইব মানে আদিবাসী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নাগাদের নিয়ে বইটা লেখার পর এই সব আদিবাসীদের সম্বন্ধে আমার ভীষণ আগ্রহ হয়।

এই সময় হঠাৎ একজন বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক, ইংরাজিতে যাকে বলে অ্যানথ্রোপোলজিস্ট, তাঁর লেখা একটা বই পড়ে মুগ্ধ হই। তিনি দণ্ডকারণ্যের গোন্ড জনজাতিদের নিয়ে চমৎকার গবেষণা করেছেন। তাঁর বইটা পড়ে ঠিক করে ফেলি গোন্ডদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। কিন্তু এদের সঙ্গে না মিশলে, তাদের সঙ্গে কম করে বছরখানেক না কাটালে তো উপন্যাস লেখা যায় না।

আমি যখন দণ্ডকারণ্যে আসার তোড়জোড় করছি, সেই সময় একটা ঘটনা ঘটল।

তোমরা সবাই জানো উনিশশো সাতচল্লিশে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষকে দু—টুকরো করে একটা অংশ হয় পাকিস্তান, বাকিটা ভারত বা ইন্ডিয়া। এখন যেটা বাংলাদেশ তখন সেটা হয় পূর্বপাকিস্তান। দেশটা ভাগ হয়ে যাবার পর লক্ষ লক্ষ মানুষ বাড়িঘর, জমিজমা ফেলে এপারে চলে আসে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এত উদ্বাস্তু কোথায় থাকবে? এত জমিজমা তো এখানে নেই। তাই তাদের বসতির জন্য অনেককে প্রথমে পাঠানো হচ্ছিল আন্দামানে, তারপর দণ্ডকারণ্যে।

একটি বিখ্যাত খবরের কাগজের সেই আমলে বার্তা সম্পাদক যিনি ছিলেন, তিনি একজন নামকরা কথাসাহিত্যিকও। তাঁকে আমরা তরুণ লেখকরা খুবই শ্রদ্ধা করতাম। দণ্ডকারণ্যে যাচ্ছি শুনে ডেকে পাঠিয়ে তিনি বললেন, ‘নতুন জায়গায় উদ্বাস্তুরা কীভাবে আছে, তাদের জমিটমি ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি না, সব ইনফরমেশন জোগাড় করে আমাদের কাগজের জন্যে লিখে পাঠাবে। সপ্তাহে অন্তত দুটো করে লেখা চাই।’

মিন মিন করে বললাম, ‘দাদা, আমি গোন্ডদের নিয়ে একটা লেখার জন্যে যাচ্ছি—’

তিনি কষে আমাকে ধমক দিলেন, ‘গোন্ডদের চেয়ে উদ্বাস্তুদের ইমপর্টান্স অনেক বেশি। যা বললাম তাই করবে।’

তাঁকে অমান্য করার মতো বুকের পাটা আমার ছিল না।

তখন রোজই বম্বে মেলের চারখানা বগিতে উদ্বাস্তুদের নিয়ে রায়পুরে ট্রেন যেত। রায়পুরে নামার পর ছিন্নমূল মানুষগুলোকে নিয়ে যাওয়া হত দণ্ডকারণ্যে। একদিন আমিও তাদের সঙ্গে বম্বে মেলে চড়ে বসলাম। ভাবনা—চিন্তা থেকে গোন্ডদের ঝেড়ে ফেলতে হল।

যদিও দণ্ডকারণ্য, গোন্ড, উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে এত কথা বললাম, আসল গল্পটা কিন্তু তাদের নয়—সেটা একজন আশ্চর্য সন্ন্যাসীকে নিয়ে। তার কথায় পরে আসছি।

আগেই জানিয়েছি রায়পুর স্টেশন থেকে দক্ষিণ দিকে লম্বা জাতীয় সড়ক কখনও সোজা হয়ে কখনও এঁকেবেঁকে পাহাড়—জঙ্গল ফুঁড়ে চলে গেছে। এই সড়কের দুপাশে তিরিশ—চল্লিশ মাইল পর পর উদ্বাস্তুদের জন্য ওয়ার্কসাইট ক্যাম্প বসানো হচ্ছিল। ওয়ার্ক সাইট ক্যাম্পগুলো ঘিরেই উদ্বাস্তুদের বাড়িঘর কলোনি তৈরি হবে।

পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তুহারাদের জন্য দণ্ডকারণ্যের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তখন সেটিকে বলা হতো ডি এন কে প্রজেক্ট। এর সর্বেসর্বা ছিলেন ফ্লেচার সাহেব। কেরালার খ্রিস্টান। চমৎকার মানুষ। তিনি দণ্ডকারণ্যে প্রজেক্ট ঘুরে দেখার জন্য আমাকে একটা জিপ আর একজন ড্রাইভারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তেলের খরচ, ড্রাইভারের মজুরি সবই প্রজেক্টের তরফ থেকে মেটানো হবে।

দণ্ডকারণ্য তো একটুখানি জায়গা নয়। বলতে ভুলে গেছি অন্ধ্রপ্রদেশকে বাদ দিয়ে ওড়িষা আর মধ্যপ্রদেশের যে সব অঞ্চল জুড়ে দণ্ডকারণ্যের বিস্তার, শুধু সেই অংশেই পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য তখন নতুন বসতি গড়ে তোলার কাজ চলছে।

বসতি কি একটা—দুটো। অগুনতি। কোনওটাই কাছাকাছি নয়। আগেই জানিয়েছি একটা কলোনি বা ওয়ার্কসাইট ক্যাম্প থেকে আরেকটার দূরত্ব তিরিশ—চল্লিশ কি পঞ্চাশ মাইল। জিপে চক্কর দিয়ে একদিনে দু—তিনটের বেশি ওয়ার্কসাইটে যাওয়া সম্ভব নয়। সে সব জায়গায় উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট তৈরি করে কলকাতায় পাঠিয়ে দিই। রাত্তিরে সুবিধামতো কোনও একটা ওয়ার্কসাইট ক্যাম্পে থেকে যাই।

মাস দুয়েক এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ বম্বে থেকে মহেশ চাপেকারের আবির্ভাব। সে আমার চেয়ে বছর চার—পাঁচেকের বড়। বম্বের একটা নামকরা খবরের কাগজের রোভিং রিপোর্টার। ঘুরে ঘুরে তাঁর পত্রিকার জন্য খবর জোগাড় করাই মহেশের কাজ। দণ্ডকারণ্যে যে বনজঙ্গল সাফ করে উদ্বাস্তুদের কলোনি বসছে সেই তথ্য জোগাড় করে রিপোর্ট পাঠাবার জন্য এসেছে।

মহেশ আমুদে, হাসিখুশি, চমৎকার মানুষ। একই ধরনের কাজে আমাদের দণ্ডকারণ্যে যাওয়া। আমি কলকাতা থেকে গেছি, সে এসেছে বম্বে থেকে। গোড়ার দিকে দণ্ডকারণ্য প্রজেক্টের খুব বেশি গাড়ি—টাড়ি ছিল না। ঘোরাঘুরি করার জন্য প্রজেক্টের কর্তারা আমার সঙ্গেই মহেশকে জুড়ে দিল। অর্থাৎ আমরা এক বাঙালি আর—এক মারাঠি একই জিপে দণ্ডকারণ্যে চক্কর দিয়ে বেড়াব।

মহেশের মধ্যে একটা আপন—করা ব্যাপার আছে। আলাপ—পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

তোমরা যারা এই লেখাটা পড়ছ তারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই অধৈর্য হয়ে উঠেছ। এক সন্ন্যাসীর গল্প শোনাতে গিয়ে কিনা দণ্ডকারণ্য, মহেশ, উদ্বাস্তু, কলোনি—টলোনির মতো হাজার গণ্ডা কচকচানি এসে যাচ্ছে। যাই হোক, যথেষ্ট ভণিতা হয়েছে। এবার সন্ন্যাসীর কথায় আসা যাক। প্রশ্নটা হল তার খোঁজ পেলাম কী করে?

আগেই জানিয়েছি, রায়পুর শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে যে জাতীয় সড়কটা দণ্ডকারণ্যের পাহাড়, জঙ্গল—টঙ্গল ভেদ করে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে, সেটা ধরে ওড়িষার দিকে শ’দেড়েক মাইল গেলে কেশকাল পাহাড়।

পাহাড়ের পরিসর অনেকটা এলাকা জুড়ে। কিন্তু মাঝখানের একটা অংশ মোটামুটি গোলাকার। সেখানকার হাইট খুব বেশি নয়, বড়জোর তিনশো—সাড়ে তিনশো ফিট। জাতীয় সড়ক বা ন্যাশনাল হাইওয়েটা কেশকাল পাহাড়ের এই এলাকাটা বেড় দিয়ে ফের দৌড় শুরু করেছে। এখানকার তলার দিকে একটা গুহা ছিল। এখন আছে কিনা জানি না।

সেই গুহায় সারাদিন ধুনি জ্বালিয়ে, যে সন্ন্যাসীর কথা বলছি, সে থাকত। তার বয়স কত জানি না। ষাটের ওপরেই হবে। বেশ তাগড়াই চেহারা। কোমর থেকে গেরুয়া লুঙ্গির মতো বসন হাঁটুর তলা অবধি নেমে এসেছে। শরীরের ওপর দিকটা একদম খালি। মাথায় জটা। ওড়িষার দিক থেকে যত গাড়ি—টাড়ি সড়ক ধরে রায়পুরের দিকে যায় কিংবা রায়পুর থেকে যে সব ওড়িষায় যায়, প্রতিটি যান সন্ন্যাসীর গুহার সামানে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়।

ড্রাইভার থেকে আরোহী সবাই নেমে এসে সন্ন্যাসীর গুহার সামনে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে টাকাপয়সা, ফলমূল, নানারকম মিঠাই রেখে ফের গাড়িতে উঠে চলে যায়। সন্ন্যাসীর এতটুকু হেলদোল নেই। সে টাকাকড়ি, ফলটল বা মিঠাইয়ের দিকে তাকায়ও না, যারা এসব দিচ্ছে তাদের সঙ্গে একটি কথাও বলে না। শুধু নির্বিকার মুখে বসে থাকে।

দণ্ডকারণ্য প্রজেক্টে উদ্বাস্তুদের ওয়ার্কসাইট ক্যাম্পগুলো চষে বেড়াতে মহেশ আর আমি কতবার যে এই গুহার সামনে দিয়ে গেছি তার লেখাজোখা নেই। কিন্তু সাধুসন্ন্যাসীতে কখনও মহেশ এবং আমার তেমন একটা ভক্তি ছিল না, আবার অশ্রদ্ধাও নয়। আমরা একবারও জিপ থামিয়ে গুহার সামনে নামিনি; মাথা ঝুকিয়ে প্রণাম তো করিইনি, কোনওরকম ভেটও দিইনি।

রিফিউজিদের নিয়ে যে দণ্ডকারণ্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তার প্রধান অফিসটা ছিল ওড়িষার কোরাপুটে, আর এই পরিকল্পনার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের মূল অফিস ছিল মধ্যপ্রদেশের জগদলপুরে।

একদিন ঘুরতে ঘুরতে মহেশ আর আমি কোরাপুটে এসেছি। এখানকার একজন বড় অফিসার ছিলেন গিরিজা গাঙ্গুলি। তাঁদের দেশ ছিল পূর্ববাংলার বরিশালে। দেশভাগের আগেই অবশ্য তাঁরা সীমান্তের এপারে চলে এসেছিলেন। বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক বড়, ‘তুমি’ করে বলতেন। দারুণ আড্ডাবাজ, আমুদে মানুষ। কথায় কথায় সেদিন বললেন, ‘সারা দণ্ডকারণ্য প্রজেক্ট তো ঘুরে ঘুরে দেখছ। ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর কেশকাল পাহাড়ের পাশ দিয়ে নিশ্চয়ই যাতায়াত করেছ?’

বললাম, ‘হ্যাঁ, অনেকবার।’

‘ওই পাহাড়ের গুহার ভেতর একজন সন্ন্যাসী থাকে, লক্ষ করেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘পাহাড়টার মাথায় একটা বাংলো আছে। সেটা কি নজরে পড়েছে?’

‘না। খেয়াল করিনি।’

একটু ভেবে গিরিজা গাঙ্গুলি বললেন, ‘দিন কয়েক বাদে পূর্ণিমা। তখন দুটো দিন ওখানে কাটিয়ে দাও। বাংলোর কেয়ারটেকার রঘুবর সিংকে চিঠি লিখে দিচ্ছি। সে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। পূর্ণিমার সময় ওই বাংলোটায় থাকার আলাদা একটা মজা আছে।’

কৌতূহল হল।—’কীসের মজা?’

‘গিয়ে থাকোই না। তখন নিজের চোখেই সব দেখতে পাবে। এমন দৃশ্য জীবনে কখনও দেখার সুযোগ পাবে না।’

বুঝলাম দৃশ্যটি আমাদের গিয়েই দেখতে হবে। গিরিজা গাঙ্গুলি আগেভাগে কিছুই জানাবেন না। ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। আমরা আর কোনও প্রশ্ন করলাম না।

কৌতূহলটা বেড়েই যাচ্ছিল। গিরিজা গাঙ্গুলির চিঠি নিয়ে মহেশ আর আমি কেশকাল পাহাড়ের মাথায় সেই বাংলোয় গিয়ে হাজির হলাম।

বাংলোটা একটু অদ্ভুত ধরনের। গোলাকার। চারপাশে বুক সমান হাইটের ইটের মজবুত দেওয়াল। মাথার ওপর কংক্রিটের ছাদ। চারদিক ঘিরে দেওয়ালের ওপর ছাদ অবধি লোহার গ্রিল বসানো। গ্রিলের এধারে মাঝে মাঝেই কাচের জানলা। জানলা খুললে বাইরের সব দৃশ্যই চোখে পড়ে। জানি না সেই বাংলোটি এতদিন বাদে আদৌ আর আছে কিনা। এই পাহাড় চূড়ার তলাতেই সেই সন্ন্যাসীর গুহা।

গিরিজা গাঙ্গুলির চিঠিটা পড়ে কেয়ারটেকার রঘুবর সিং আমাদের যথেষ্ট খাতির করে ভেতরে নিয়ে গেল।

বাংলোটা খুব একটা বড় নয়। সবসুদ্ধ তিনখানা শোবার ঘর।

দুটো ঘরে দু—একদিনের টুরিস্ট বা গেস্টরা এসে থাকে। তিন নম্বর ঘরটা কেয়ারটেকারের। সেটা তার বেডরুম এবং অফিসও। বেতের সোফা, সেন্টার টেবিল দিয়ে সাজানো। একটা মাঝারি মাপের ড্রইংরুমও আছে। আর আছে দুটো বাথরুম। কিচেন। রান্না এবং অন্য কাজের জন্য তিনজন লোকও আছে। তারা রাত্তিরে ড্রইংরুমের একধারে শোয়।

আমরা পৌঁছেছিলাম সন্ধের আগে আগে। চারদিকে কেশকাল পাহাড়ের আরও অনেক উঁচু—নীচু চূড়া। যেদিকেই তাকানো যায় শুধুই বনভূমি। বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষ তো আছেই। তা ছাড়া মাঝারি, ছোট গাছও অজস্র। আর আছে প্রচুর ঝোপঝাড়।

সমস্ত এলাকাটা একেবারে নিঝুম। ডাইনে—বাঁয়ে সামনে পেছনে ঘন জঙ্গল থেকে একটানা ঝিঁঝিদের ডাক আর মাঝে মাঝে নীচের হাইওয়ে দিয়ে দণ্ডকারণ্য প্রজেক্টের দু—একটা মোটর বা ট্রাক যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

গাছপালা এবং পাহাড়ের চূড়াগুলোর আড়ালে সূর্য আগেই নেমে গিয়েছিল। আমরা বাংলোয় পৌঁছোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝপ করে সন্ধে নেমে এল।

পাহাড়ের আবহাওয়া বিচিত্র ধরনের। দিনের বেলা যে তাপমাত্রা থাকে, সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে সেটা লহমায় কয়েক ডিগ্রি কমে যায়। অগত্যা মহেশ এবং আমাকে জামাপ্যান্টের ওপর গরম উলের পুল—ওভার চাপিয়ে নিতে হল।

পূর্ণিমা পক্ষ, তাই আকাশে রুপোর থালার মতো গোলাকার চাঁদ। যতদূর চোখ যায়, রুপোলি আলোয় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে।

গিরিজা গাঙ্গুলি আমাদের পাঠিয়েছেন। তাই আমরা পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলোয় তুমুল তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল।

রঘুবর সিংয়ের ইঙ্গিতে একটি কাজের লোক দুজনের সুটকেস, হোল্ড—অলটল দুটো বেড রুমে রেখে এল। রঘুবর বলল, ‘বাবুজি, আপনাদের হোল্ড অল খোলার দরকার নেই। বাংলোয় গেস্টদের জন্যে চমৎকার বিছানার বন্দোবস্ত আছে।’

লক্ষও করলাম দুই ঘরেই পুরু তোশক, বালিশ এবং একজোড়া করে দামি আরামদায়ক কম্বল রয়েছে।

বাথরুম থেকে হাত—মুখটুখ ধুয়ে ড্রইংরুমে এসে বসতেই গরম চা এবং নানারকম ভাজাভুজি চলে এল। সেই কোরাপুট থেকে অনেকটা পথ পাহাড়ি রাস্তার চড়াই—উতরাই ভেঙে এসেছি। গাড়ির ঝাঁকুনিতে হাড়মাংস যেন আলগা হয়ে গেছে। গরম মশলাদার চা শরীরে খানিকটা এনার্জি ফিরিয়ে আনল। নার্ভগুলো বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

রঘুবর একধারে দাঁড়িয়ে আমাদের চা খাওয়ার তদারক করছিল।—’বাবুজি আপনাদের আর কয়েকটা করে আলুর বোন্দা (বড়া) দিতে বলি?’

মহেশ, আমি দুজনেই বললাম, ‘দরকার নেই। অনেক দিয়েছেন। আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।’

আমাদের সামনে কিছুতেই বসবে না রঘুবর। গিরিজা গাঙ্গুলির গেস্টদের তাতে সম্মানহানি হতে পারে বলে তার আশঙ্কা। অনেকবার বলার পর আলগোছে একটা সোফায় বসল সে। বলল, ‘বাবুজিরা, রাত্তিরে খেতে একটু দেরি হবে কিন্তু। লগভগ দশ—সাড়ে দশ বেজে যাবে।’

মহেশ হেসে—হেসে বলল, ‘তা বাজুক। আমরা পত্রকার (সাংবাদিক), রাতে বারোটার আগে খাওয়ার অভ্যাস নেই।’

দণ্ডকারণ্যের ওয়ার্কসাইট ক্যাম্পগুলো ঘুরে ঘুরে উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করে কলকাতার কাগজে রিপোর্ট বা প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি, তাই মহেশের ধারণা আমি একজন পত্রকার বা সাংবাদিক। আমি যে আসলে একজন লেখক সেটা সে পরে জেনেছে।

রঘুবর সিং একটু কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে এবার বলল, ‘বাবুজিরা, আজ কিন্তু এখানে কষ্ট করে আপনাদের শাকাহারী (নিরামিষ) ভোজন করতে হবে। এখানে ডিম,মাংস, মছলি—টছলি পাওয়া বহুত মুশকিল।’

আমি ডিম—মাংস খাই না, তবে মাছটা খাই। রঘুবরের কথার উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই মহেশ বলল, ‘যা হোক খেতে পেলেই হল। শাকাহারী ভোজনে আমাদের আপত্তি নেই।

রঘুবর কৃতার্থভাবে একটু হাসল। বাংলোর অতিথিরা ডিম, মাংস—টাংস না পেয়ে যে অসন্তুষ্ট হবে না, তাতে সে বেশ স্বস্তি বোধ করছে।

রাত সাড়ে দশটার মধ্যেই আমাদের খাবার দেওয়া হল। ঘি—মাখানো গরম গরম চাপাটি, আলুর তরকারি, বেগুনভাজা, ঘন ছোলার ডাল, আচার এবং ক্ষীর (এখানে এক ধরনের পায়েস) দিয়ে বেশ তরিজুত করে খেলাম।

যতক্ষণ খাওয়া চলল, রঘুবর পাশে দাঁড়িয়ে রইল। মহেশ আর আমি তাকে আমাদের সঙ্গেই খেয়ে নিতে বললাম। কিন্তু সে রাজি হল না। বসতে বললেও এবার বসল না।

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বলল, ‘বাবুজিরা এখন শুয়ে পড়বে না। আপনাদের একটা অদ্ভুত জিনিস দেখাতে চাই।’

‘কী জিনিস?’

‘গাঙ্গুলিসাহেব আপনাদের দেখাতে লিখছেন। ইধর আইয়ে—

আন্দাজ করে নিলাম গিরিজা গাঙ্গুলি কেশকাল পাহাড়ে যে রহস্যময় দৃশ্যের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অথচ বারবার জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেননি, খুব সম্ভবত মুখ—আঁটা খামের চিঠিতে রঘুবরকে সেটা দেখানোর জন্য লিখে দিয়েছেন। কৌতূহলটা তীব্র হয়ে উঠেছিল।

রঘুবর সিং দেওয়াল জোড়া, গ্রিল বসানো জানলার একটা কাচের পাল্লা খুলে দিল।

পূর্ণিমা রাতে সন্ধের পর থেকে জ্যোৎস্নার ঢল নেমেছে। যতদূর চোখ যায় সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাংলোর তলা দিয়ে যে হাইওয়েটা চলে গেছে সেটা একেবারে শুনশান। গাড়ি—টাড়ি মানুষজন কিছুই চোখে পড়ছে না। অক্লান্ত ঝিঁঝিদের ডাক আর মাঝে মাঝে রাতজাগা পাখিদের কর্কশ চিৎকার ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

মহেশ বলল, ‘কী ব্যাপার সিংজি, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।’

সিংজি অর্থাৎ রঘুবর বলল, ‘থোড়াসা সবুর করুন বাবুজিরা, যা দেখাতে চাইছি ঠিক দেখতে পাবেন।’

আধঘণ্টা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করার পর সত্যিই দেখা গেল! প্রথম এক ঝাঁক হরিণ জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের জানলার ঠিক নীচে এসে চাঁদের দিকে মুখ তুলে মিহি শব্দ করে নাচের ভঙ্গিতে হুল্লোড় শুরু করল। মনে হল তারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। খানিকক্ষণ নাচানাচির পর হঠাৎ কীসের যেন ডাক শুনে চকিতে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর চোখের পলক পড়তে না পড়তেই বিদ্যুৎগতিতে বাঁ—দিকে ঘুরে দৌড় লাগাল।

এতক্ষণ খেয়াল ছিল না, এবার মনে পড়ল, আরে ওখানেই কেশকাল পাহাড়ের সেই সন্ন্যাসীর গুহা। গুহাটা বাংলো থেকে দেখা যাচ্ছে না। হরিণগুলো কি ওখানেই গেল? ঠিক বুঝতে পারছি না।

হরিণরা চলে যাবার পর হাইওয়ে ফের ফাঁকা। দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। মজা করে রঘুবর সিংকে বললাম, ‘হরিণ দেখাবার জন্যে কি জানালার কাছে টেনে এনেছেন?’

রঘুবর হসাল।—’নেহি বাবুজি, আরও বহুত চমৎকারি আছে। একটু ওয়েট করুন—’

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। নীচের হাইওয়েটা যেন থিয়েটারের মঞ্চ। হরিণের পাল চলে যাবার পর সাত—আটটা বিশাল আকারের পাহাড়ের মতো জংলি মোষ চলে এল। তাদের লম্বা বাঁকানো সিং, চোখের দৃষ্টি হিংস্র। হাইওয়ে থেকে মোষের দঙ্গল আমাদের দেখতে পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমরা এত উঁচুতে যে ভয়ঙ্কর জন্তুগুলোর কিছুই করার নেই। সামনাসামনি পেলে ওরা সিং দিয়ে আমাদের লহমায় ছিন্ন—ভিন্ন করে ফেলত। কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রচণ্ড আক্রোশে ভোঁস ভোঁস আওয়াজ করে, যে আওয়াজ শুনে হরিণেরা বাঁ—দিকে চলে গিয়েছিল, তারাও চলে গেল। জংলি মোষেদের পর এল বুনো দাঁতাল একদল শুয়োর। তারাও আমাদের কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে চলে গেল।

আমরা যেমন চিড়িয়াখানায় ঘেরা জায়গায় জন্তু—জানোয়ার দেখতে পাই, পূর্ণিমার রাতে দণ্ডকারণ্যের হরিণ—মোষ—শুয়োরেরা তেমনি যেন আমাদের দেখে চলে যেতে লাগল।

এবার এল সাত—আটটা বাঘ। আমাদের দেখতে পাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আমরা তো তাদের নাগালের বাইরে। লোভনীয় খাবার এত কাছাকাছি। কিন্তু কিছুই করা যাচ্ছে না। রাগে গরগর করতে করতে তারা মাঝে মাঝে চারপাশের বনভূমি কাঁপিয়ে গর্জন ছাড়ছিল। তারা চলে যাবার পর আর কোনও জংলি প্রাণী এসেছিল কিনা, এতকাল বাদে আমার আর তা মনে পড়ে না।

আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল রঘুবর সিং। ঘণ্টা দুই আমরা কেউ কোনও কথা বলছিলাম না। অবাক—করা আশ্চর্য দৃশ্য দেখছিলাম।

রঘুবর সিং বলল, ‘আজ আর অন্য কোনও জন্তু আসবে বলে মনে হয় না। বাবুজিরা, এবার আপনারা গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’

আমার মনে একটা ধন্দ দেখা দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সব পূর্ণিমা পক্ষে কি বনের জন্তু—জানোয়াররা এখানে আসে?’

‘তার কোনও ঠিক নেই। অন্য সময়েও আসে। তবে পূর্ণিমা পক্ষে বেশি আসে। অবশ্য—’

‘অবশ্য কী?’

‘ডাক পেলেই চলে আসে।’

‘কীসের ডাক?’

একটু চপ করে রইল রঘুবর। তারপর বলল, ‘আমাদের এই বাংলোর তলার গুহার ভেতর এক সাধু—মহারাজ থাকে। সড়ক দিয়ে গাড়িতে যাবার সময় তাকে আপনাদের জরুর নজরে পড়েছে—’

বললাম, ‘হ্যাঁ, পড়েছে।’

‘ওহী মহারাজই শের—ভালুদের ডাকেন।’

বলে কী লোকটা? মহেশ আর আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।

আমরা যে তার কথাগুলো বিশ্বাস করিনি হয়তো রঘুবর তা আঁচ করে নিয়েছিল। বলল, ‘আমি সচ বলছি কি ঝুট, কাল সুবেহ একবার সাধুমহারাজকে পুছিয়েগা। সব বুঝতে পারবেন।’ একটু থেমে ফের বলল, ‘বহুত রাত হুয়া। আজ আর জানোয়াররা আসবে বলে মনে হয় না। আপনারা এবার শুয়ে পড়ুুন।’

বাকি রাতটা ভালো ঘুম হল না। রঘুবর যা বলল তা পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না, আবার উড়িয়েও দিতে পারছি না। মনের সে এক অদ্ভুত অবস্থা। বিছানায় এপাশ—ওপাশ অস্থিরভাবে কাটিয়ে দিলাম।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দু’জনে সোজা বাথরুমে। চটপট মুখ—টুখ ধুয়ে বাসি জামাপ্যান্ট পালটে নীচে নামার তোড়জোড় করছি, রঘুবর সিং সামনে এসে দাঁড়াল। আমরা কোথায় যাচ্ছি সে আন্দাজ করে নিয়েছে। বলল, ‘সাধু—মহারাজের কাছে যাচ্ছেন বাবুজিরা?’

দুজনেই মাথা নাড়লাম।—’হ্যাঁ—’

‘বহুত আচ্ছা। আমি সচ বলেছি কিনা, নিজেদের কানেই শুনে আসুন। তবে চা খেয়ে যান। আমি এখনই ব্যবস্থা করে দিচ্চি।’

‘এখন চা থাক। ফিরে এসে খাব।’

‘ঠিক হ্যায়। আপনাদের যেমন মরজি।’

হাইওয়ে থেকে চড়াই বেয়ে বাংলোয় উঠতে হয়। নামবার সময় উলটো। উতরাই—এর পথ ধরতে হয়। মহেশ আর আমি জিপে নয়, পায়ে হেঁটেই নীচের হাইওয়েতে নেমে এলাম।

রাস্তাটা শুনশান। এখনও কোরাপুট বা রায়পুরের দিক থেকে মোটর কিংবা ট্রাক চলাচল শুরু হয়নি। গাড়ি—টাড়ি বা ক্বচিৎ কখনও দু—চারজন আদিবাসী গোল্ড, মারিয়া বা মুরিয়াদের দেখা পাওয়া যায় বেলা অনেকটা চড়লে।

নীচে নেমে আমরা বাঁয়ে ঘুরে সন্ন্যাসীর আস্তানার কাছে চলে এলাম। এই পথে যাওয়া—আসার সময় যে দৃশ্য দেখেছি, এখনও ঠিক তেমনটাই চোখে পড়ল।

সাধু গুহার একটু ভেতর দিকে পদ্মাসনে বসে আছে। তার সামনে ধুনি জ্বলছে। যতবার সাধুর গুহার পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছি, কখনও জিপ থামিয়ে তার কাছে গিয়ে কথা—টথা বলিনি। তাই সেভাবে লক্ষ করিনি। চলন্ত গাড়ি থেকে তা সম্ভব ছিল না। এবার চোখে পড়ল, সাধু যেখানে বসে আছে তার দু’পাশে প্রচুর ফল—কলা, আপেল, অম্রত (পেয়ারা), শসা ইত্যাদি। প্রায় স্তূপাকার হয়ে আছে। যাতায়াতের সময় অন্য সব গাড়ি—টাড়ির যাত্রী এবং চালকেরা এসব দিয়ে গিয়েছিল, সেটা আমাদের চোখে পড়েছে। ফল ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের মিঠাই—প্যাঁড়া, লাড্ডু, বুন্দিয়া। ফল, মিষ্টি—টিষ্টি বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। বোঝা যায় সাধু এসব কিছুই ছোঁয়নি। শুধু কি ফলটলই, অজস্র রুপোর টাকা, আধুলি সিকি এবং পাঁচ দশ টাকার নোটও এধারে—ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ভক্তদের প্রণামী। কিন্তু সাধু সে সবও স্পর্শ করেনি।

দু—চারজন সাধু—সন্ন্যাসী আগে যে দেখিনি তা নয়। তারা ভয়ঙ্কর রগচটা। অগ্নিশর্মা বলতে যা বোঝায় তা—ই। তাদের ধারেকাছে ঘেঁষার যো নেই। কিন্তু কেশকাল পাহাড়ের এই সন্ন্যাসী একেবারে অন্যরকম। শান্ত, মুখে প্রসন্ন হাসি লেগেই আছে। হিন্দিতে বলল, ‘বোসো—।’

গুহার মুখটা মোটামুটি পরিষ্কার। সেখানে মহেশ আর আমি থেবড়ে বসে পড়লাম।

সন্ন্যাসী জিজ্ঞেস করল, ‘এত সুবেহ সুবেহ তোমরা কোত্থেকে এলে?’

জানিয়ে দিলাম।

সন্ন্যাসী বলল, ‘কাল একটা জিপের আওয়াজ পেয়েছিলাম। সেটা ওপরের বাংলায় উঠেছি। তোমরাই তা হলে ওই জিপে ছিলে? রাতও ওখানে কাটিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘পুনমের রাতে বনের জন্তু—জানোয়ার দেখতে এসেছিলে?’

অস্বীকার করলাম না।—’হ্যাঁ তাই।’

একটু চুপচাপ।

তারপর মহেশ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কত সাল এই গুহায় আছেন?’

সাধু বলল, ‘হোগা বিশ—তিশ সাল। ঠিক মনে নেই।’

‘এখানে এত ফল—মিঠাই পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। আপনি কি এসব খান না?’

‘না, বেটা। মানুষের ইচ্ছা হয়, দিয়ে যায়। ওসব পড়েই থাকে।’

‘আপনি তা হলে কী খান?’

সন্ন্যাসী হাসল। ওপর দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘উনি যখন যা জোটান তাই খাই।—’

উনি বলতে ঈশ্বর বা ভগবান, সেটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু তিনি সন্ন্যাসীর জন্য কী আহারের ব্যবস্থা করেন, সে সম্পর্কে ধন্দ থেকেই গেল। অবশ্য এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করলাম না।

ফের কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর আমি বললাম, ‘আমার একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে।’

‘হাঁ, হাঁ, পুছো না।—’

‘কাল বেশি রাতে নানা ধরনের জানোয়ারের দল একে একে বাংলোর তলায় চলে এসেছিল। হরিণ, বুনো শুয়োর, বুনো মোষ, বাঘ—এমন অনেক। তাদের কেউ যেন ডাকছিল—ওরাও সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আপনার এই গুহার দিকেই এসেছে—’

সন্ন্যাসী হাসল।—’ঠিকই ধরেছ। আমিই ওদের ডেকেছিলাম।’

‘বাঘ, বুনো দাঁতাল শুয়োর, জংলি মোষ—এরা তো ভয়ঙ্কর সব জন্তু। আপনি তাদের মধ্যে থাকেন, নিজের কাছে ডেকেও নেন। ভয় করে না?’

সন্ন্যাসীর হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল।—’কীসের ভয়? ওরাও জীব। আমিও জীব, তোমরাও জীব। আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে এই পরমাত্মা। শের দেখলে, হিরণ (হরিণ) দেখলে, বুনো ভঁইস দেখলে গোলি (গুলি) করে মারব—এটা ঠিক নয়। বহুত বুরা কাম। পেয়ার করো, ভালোবাসতে শেখো। দেখবে ওরা তোমাদের বন্ধু হয়ে যাবে। এই যে এত সাল আমার এখানে কেটে গেল, শের বলো, জংলি বরা বলো—কেউ কি আমার ক্ষতি করেছে? আমি ডাকলেই ওরা চলে আসে, বিশেষ করে পুনমের (পূর্ণিমার) রাতে। দুনিয়ার সবসে আচ্ছা চিজ হল—পেয়ার, ভালোবাসা। এই কথাটা মনে রেখো।’

এরপর অনেক সাধুসন্ন্যাসী দেখেছি কিন্তু, দণ্ডকারণ্যের সেই আশ্চর্য সন্ন্যাসীর মতো এ জীবনে আর একজনও চোখে পড়েনি।

__

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *