থ্রোশীয় ছোরা
১
পাথুরে ধাপ ভেঙে ক্রাসাস আমাদের এনে দাঁড় করাল গ্যালারির নির্দিষ্ট একটা জায়গাতে৷ বেশ উঁচু জায়গা৷ নীচ থেকে অন্তত ষাট ফুট হবে৷ বিশাল গ্যালারির অন্য জায়গার মতো এ জায়গা উন্মুক্ত নয়৷ সামনে অনুচচ রেলিং আর মাথার ওপর ছাদ আছে৷ প্রাচীন যুগের পাথুরে স্তম্ভ ধরে রেখেছে ছাদকে৷ তার মধ্যে একটা চেয়ার কারুকাজ করা সিংহাসনের মতো বিশাল৷ মহাকাল তাতে এখনও থাবা বসাতে পারেনি৷ আপন গাম্ভীর্যমন্ডিত সৌন্দর্য নিয়ে আজও বিরাজমান শ্বেতপাথরের আসনটি৷ তার দু-পাশের আসনগুলোও মসৃণ মার্বেলের৷ তবে আকারে কিছুটা ছোটো৷
সিংহাসনটি দেখিয়ে ক্রাসাস আমাদের বলল, ‘আপনারা বসুন এখানে৷’
পাথুরে সিংহাসনটাতে আমি বসলাম৷ আমার পাশেই একটা আসনে প্রফেসর জুয়ান৷ বসতেই টের পেলাম পাথরের আসনটা কি ঠান্ডা! যদিও এখন বেলা দুপুর, সূর্য ঠিক মাথার ওপর, কিন্তু সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে না এখানে৷ শীতল ছায়াময় জায়গা৷
আমরা সেখানে বসার পর ক্রাসাস আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি যে আসনে বসে আছেন ঠিক এই আসনে বসে দু-হাজার বছর আগে নিচে ওই এরিনার দিকে তাকিয়ে গ্ল্যাডিয়েটরদের খেলা দেখতেন রোমান সম্রাটরা৷ আর আপনার ডানপাশের আসনগুলোতে বসতেন শুভ্রবসন পরিহিত সুবিশাল রোমান সম্রাজ্যের সর্বোচচ ক্ষমতার প্রতিভূ সেনেটরের দল৷ যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ভাগ্য, আর ক্ষেত্র বিশেষে সম্রাটের ভাগ্যও৷ আপনারা তাকান ওই নীচের দিকে৷ গ্ল্যাডিয়েটরদের তপ্ত শোণিত শুষে নেবার জন্য বালুকা বিছান থাকত ওই ভূমিতে৷ এরিনা সংলগ্ন যে কক্ষগুলো আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, সেখান থেকে কখনও একা, কখনও বা দলবদ্ধভাবে বদ্ধভূমিতে বেরিয়ে আসত অস্ত্রবর্ম সজ্জিত গ্ল্যাডিয়েটরের দল৷ সাধারণত ক্রীতদাস বা যুদ্ধবন্দিদেরই গ্ল্যাডিয়েটরের ভূমিকায় নামান হতো৷ বিভিন্ন জাতীয় মানুষ, স্পেনীয়, গল, জার্মান, আফ্রিকান, থ্রোশিয়ান ওই মৃত্যুকূপে অবতীর্ণ হতো৷ আর ওই যে ময়দানের মাঝখানে মাঝে মাঝে চৌবাচচার মতো জায়গা দেখছেন ওখানে রাখা থাকত হিংস্র পশুর দল৷ ভূগর্ভস্থ ওইসব ঘরের ওপর ঢাকা কাঠের পাটাতন সরিয়ে গ্ল্যাডিয়েটরদের সাথে লড়ানো হত জন্তুদের৷ গ্ল্যাডিয়েটরদের আর্তনাদ, পশুদের ক্রুদ্ধ গর্জন আর রক্তদর্শনে উল্লসিত জনতার হর্ষধ্বনী, এই কলোসিয়াম অতিক্রম করে ছড়িয়ে যেত দূর থেকে দূরে৷ যা ছিল মহাশক্তিধর রোমান সম্রাজ্যের দম্ভ ক্ষমতার বজ্রনির্ঘোষ৷ যা কাঁপন ধরাতো রোমের শত্রুদের বুকে৷ জোড়ের লড়াই শেষে পরাজিত গ্ল্যাডিয়েটর যখন ভূপতিত তখন জয়ী যোদ্ধা সম্রাটের আদেশের প্রতীক্ষায় তাকাত এই বারান্দার দিকে৷ সম্রাট উঠে দাঁড়াতেন৷ তিনি যদি তার বৃদ্ধাঙ্গুল নিচের দিকে দেখাতেন তবে বিজয়ী হত্যা করত ভূপতিতকে৷ আবার উল্লাস উঠত জনতার মধ্যে৷ কোনো কোনো সময় হয়তো সম্রাট খুশি হয়ে বিজয়ীকে মুক্তি দিতেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজয়ীকে আবার পরবর্ত্তী লড়াইয়ে জন্য প্রস্তুত হতে হতো৷ এ জন্য সে সময় রোমে দুটো চালু প্রবাদ ছিল৷ এক, ‘প্রত্যেক হত্যার সাথে সাথে গ্ল্যাডিয়েটর আসলে নিজের মৃত্যুকেই প্রত্যক্ষ করে৷’ দুই, ‘গ্ল্যাডিয়েটরদের মধ্যে কখনও বন্ধুত্ব হয় না৷’ খৃষ্টপূর্ব ৭১ অব্দে অবশ্য একজন এই দ্বিতীয় প্রবাদটা ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন, যাঁর নাম স্পার্টাকাস৷ কিন্তু গ্ল্যাডিয়েটরদের সে বিদ্রোহ নৃশংসভাবে দমন করেন রোমান শাসকরা৷ তারপরও বহু শতাব্দী টিকে ছিল এই ভয়ঙ্কর গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই৷’ একটানা কথাগুলো বলে থামল আমাদের গাইড৷ পাথরের সিংহাসনটাতে বসে ক্রাসাসের কথা শুনে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করলাম৷ আমি যে পাথরের সিংহাসনে বসে আছি, সেখানে পিঠ রেখেছি, যে হাতলে হাত রেখেছি, সেখান একইভাবে একদা বসতেন ইতিহাসের বইতে পড়া মহাপরাক্রমশালী রোমান সম্রাটরা!
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘জুলিয়াস সিজার, আগস্টাস, নিরো— এরাও কি একদিন এখানে বসেছিলেন?’
প্রফেসর জুয়ান বললেন, ‘এই তথ্যটা সম্ভবত সঠিকভাবে জবাব দেওয়া আমাদের গাইড বন্ধুর পক্ষে সম্ভব নয়৷ কারণ, এই কলোসিয়ামের নির্মাণকার্য প্রাক খ্রিস্টীয় যুগে শুরু হলেও এর নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয় ৮০ খ্রিস্টাব্দে৷ সিজার মারা যান ৪৪ খৃষ্টপূবঅব্দে, অগস্টাস ১৪ অব্দে আর নিরো ৬৯ অব্দে৷ অর্থাৎ কলোসিয়ামের নির্মাণ কার্য তখনও সম্পন্ন হয়নি৷ তবে পরবর্তীকালের রোমান সম্রাটরা নিশ্চয়ই বসেছেন এই আসনে৷ জুয়ানের কথা শুনে ক্রাসাস বলল, ‘ আপনার তথ্য ঠিক৷ কলোসিয়োমের আনুষ্ঠানিক নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয় ৮০ অব্দে, কিন্তু উল্লেখিত সম্রাটরা যে গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই দেখতেন এ তথ্যও আছে৷
বেশ কিছুক্ষণ কলোসিয়ামে বসে রইলাম আমরা৷ তারপর নিচে নেমে সেই সৌধর বাইরে এলাম অন্য দ্রষ্টব্য দেখার জন্য৷
গতকালই আমি আর জুয়ান রোমে এসে পৌঁছেছি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে৷ প্রফেসর জুয়ান তাঁর স্বদেশ স্পেনের ক্যানারি ইউনিভার্সিটিতে ‘মেসো আমেরিকান’ সভ্যতার ইতিহাস পড়ান৷ আমি প্রবীন প্রফেসরের অসম বয়সী বন্ধু দীপাঞ্জন সেন৷ খাঁটি বাঙালি, কলকাতার লোক৷ একটা আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত৷ প্রবল ভ্রমণের শখ আমার এবং সেই সূত্রেই প্রফেসরের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব৷ আমার ‘সেন’ পদবি জুয়ানের স্নেহের উচচারণে ‘শেন’৷ গতবছর আমরা গেছিলাম মেক্সিকো ভ্রমণে তেজকাৎলিপোকার পিরামিড দেখতে৷ আর এবার ইটালিতে৷ এ দেশে পা রেখে বুকের মধ্যে তুমুল রোমাঞ্চ অনুভব করছি আমি৷ ইউরোপীয় সভ্যতার ভিত্তিভূমি বলা যেতে পারে গ্রিস আর রোমকে৷ এই মাটি একদিন সূচনা করেছিল বিশাল এক সাম্রাজ্যের৷ যে সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল মিশর থেকে ইংলন্ড পর্যন্ত৷ রোম শহর প্রতিষ্ঠা হয় ৭৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে৷ ভাবা যায়, ৫০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়! কত ঐতিহাসিক নাম, প্রাক খ্রিস্টীয় যুগের জুলিয়াস সিজার থেকে আধুনিক ইতিহাসের মুসোলিনি৷ সবারই ধাত্রী ভূমি এই দেশ৷ রয়েছে প্রাক খ্রিস্টীয় যুগের কলোসিয়াম, পান্থেয়ন, আর্ট অব টিট্টমের মতো সৌধ৷ এখানেই রয়েছে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র ভ্যাটিকান, পোপের প্রাসাদ, ক্যাথলিক সমাজের সর্বোচচ ধর্মগুরুর আবাস স্থল৷ আবার এদেশেরই উপকূলবর্ত্তী শহরে জন্মেছিলেন এক সাহসী বিজ্ঞানী গ্যালিলিও, যিনি যাজকদের প্রচারিত বক্তব্যের বিরুদ্ধাচরণ করে প্রথম বলেছিলেন, ‘সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যর চারপাশে ঘোরে৷’ সত্যিই এখানে প্রতি ধূলিকণার সাথে মিশে আছে ইতিহাস৷ এ দেশে পা রাখলে আমি কেন, যে কোনো মানুষের মনেই রোমাঞ্চ জাগবে৷ প্রফেসর জুয়ানও যে ভিতরে ভিতরে খুব উত্তেজিত তা আমি তাঁর সাদা দাড়িতে ঘনঘন হাত বোলানো দেখেই বুঝেছি৷
ক্রাসাসের সাথে আমাদের পরিচয় গতকালই৷ শক্ত সমর্থ ছিপছিপে বছর তিরিশের যুবক৷ সম্ভবত সে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত৷ চেহারায় তেমনই একটা ছাপ আছে৷ কাপুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের স্নাতক৷ বছর দশেক হল একটা ভ্রমণ সংস্থার হয়ে গাইডের কাজ করে৷ ইটালিতে আমরা দিন পাঁচেক আছি৷ এ কদিন সেই আমাদের গাইড৷ তবে স্বল্প পরিচয়ে যতটুকু বুঝেছি, অন্য গাইডদের মতো সত্যি মিথ্যা গল্প মিশিয়ে সে বকবক করে না৷ যতটুকু জানে ততটুকুই বলে, বাকি সময় চুপ করে থাকে৷
কলোসিয়ামের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে আরও অনেক সৌধ৷ কলোসিয়ামের বাইরে বেরিয়ে জুয়ান জানতে চাইলেন— ‘এরপর আমরা কোথায় যাব?’
ক্রাসাস বলল, ‘ভিয়াডেল ইম্পোরার দিকে৷ ওটা হল প্রাচীন রোমের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তার নাম৷ প্রাচীন রোমের পার্লামেন্ট বা ফোরাম ও জায়গাতেই৷ সেনেটররা থাকত ওখানে৷ ভিয়াডেল ইম্পোরা ছিল পার্লামেন্ট হাউস আর কলোসিয়ামের যোগাযোগের রাস্তা৷ পাথরের ব্লক বসানো এ রাস্তা ধরেই ঘোড়ায় টানা রথে বা ক্রীতদাসদের কাঁধের শিবিকায় চেপে কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই দেখতে আসতেন সেনেটররা৷’
আমরা তিনজন এগোলাম সে দিকে৷ সে পথে যেতে যেতে সাদা মার্বেলের একটা সৌধ দৃষ্টি আকর্ষণ করল৷ তবে সেটা অক্ষতই আছে৷ আশেপাশে ভগ্নপ্রায় সৌধগুলোর চেয়ে অনেক নবীন৷ ক্রাসাস বলল, ‘ওটা হল আধুনিক যুগের রোমের রাজা ভিক্টর এমানুয়েলের স্মৃতিসৌদ্ধ৷ বয়স মাত্র একশো বছর৷ আশেপাশের সৌধ গুলোর বয়সের তুলনায় ওকে শিশুও বলা যায় না৷’
২
ভিয়াডেল ইম্পোরার চারপাশে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন রোমক সাম্রাজ্যের অসংখ্য স্মারক৷ সে সময় রোম নগরীতে ডাকা হত ‘রোমা’ নামে৷ বিরাট বিরাট স্তম্ভঅলা বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, তার সামনে প্রশস্ত চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সব মূর্তি, স্মারক দেখতে দেখতে আমরা উপস্থিত হলাম প্রাচীন রোমের পার্লামেন্টের সামনে৷ দুঃখের বিষয় সেটা আর অক্ষত নেই৷ মহাকাল তাকে গ্রাস করেছে৷ বিশাল কাঠামোর খুব অল্প অংশই আজ শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ টুরিস্টদের বেশ ভিড় এখানে৷ ছবি তুলছে তারা৷ আজ সভ্য পৃথিবীতে যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, আর তার জন্য যেখানে যত পার্লামেন্ট বা সেনেট হাউস আছে তার আদি পুরুষ হল এই পার্লামেন্ট৷ আমিও বেশ কিছু ছবি তুললাম সে জায়গায়৷
বেশ কিছুক্ষণ সে জায়গার ছবি তোলার পর ক্রাসাস আমাদের নিয়ে এল একটা পাথুরে চত্ত্বরে একটা উঁচু বেদীর কাছে৷ তার একপাশে একটা মর্মর মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে৷ চিনতে পারলাম মূর্তিটা,— ‘জুলিয়াস সিজারের’৷ বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে ক্রাসাস বলল, ‘এ জায়গার এক বিশেষ স্থান মাহাত্ম্য আছে৷ এটা একটা চক৷ প্রাচীন রোমে এই চককে ঘিরে বাজার বসত৷ আর এই বেদীতে দাঁড়িয়ে সেনেটরার জনগণের উদ্দেশ্যে সরকারী ঘোষণা পাঠ করতেন৷ আমি যে সময়ের কথা বলছি খ্রীষ্ট তখনও জন্মাননি৷’
এরপর একটু থেমে সে বলতে শুরু করল, ‘ওই যে যিনি চত্ত্বরের কোণায় মর্মর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর সম্বন্ধে কিছু কথা সংক্ষেপে আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই৷ রোমের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন সিজার৷ বলা যেতে পারে রোম আর সিজার ছিল সমার্থক শব্দ৷ দক্ষ রাজনীতিবিদ, সফল সমর নায়ক, দুর্ধর্ষ বক্তা, লেখক, বহুবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি৷ যদিও অনেকে মনে করেন তিনি ছিলেন ঈশ্বর প্রেরিত তবুও রোমান ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১০২-১০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্ত্তী সময়ে তাঁর জন্ম৷ ৮০ খৃষ্টপূর্বাব্দে তিনি সামরিক বিভাগে যোগদান করেন ও প্রথম যুদ্ধেই বীরত্বের জন্য পদক পান৷ ৫৯ খৃষ্টপূর্বাব্দে তিনি কনসাল নির্বাচিত হন ও তার পরের বছরই গল দেশ অধিকার করেন৷ এরপর থেকেই সিজার রোমের সীমানার বিস্তার ঘটাতে থাকেন৷ আর এই সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথেই তিনি হয়ে ওঠেন এক অপ্রতিরোধ্য নায়ক৷ ৪৯ খৃষ্টপূবাব্দে তাঁকে আমৃত্যু রোমের ডিক্টেটর বলে ঘোষণা করা হয়৷’
কথাগুলো বলে মুহূর্তখানক চুপ করে থেকে সে বেদীটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর এই হল সেই জায়গা যেখানে ৪৪ খৃষ্ট পূবাব্দের ১৫ মার্চ, মার্ক অ্যান্টনি, অক্টোভিয়ান ও সেনেটদের চক্রান্তে ছুরিকাঘাতে নিহত তিনি হন৷ এখানেই শোনা গেছিল তাঁর শেষ আর্তনাদ, ‘ব্রুটাস তুমিও…!’ ক্রাসাসের বর্ণিত স্থান মাহাত্ম্য সত্যি হোক বা না হোক বেশ কিছুক্ষণ সে জায়গাতে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে হতভাগ্য মহান সম্রাটের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম আমরা৷ তারপর সেই চত্ত্বর ছেড়ে এগোলাম অন্যত্র যাবার জন্য৷ আমরা যখন সে জায়গা অতিক্রম করে বড়ো রাস্তায় পৌঁছলাম তখন একটা বাড়ির দেওয়ালে লটকানো একটা পোস্টারের সামনে হঠাৎ থমকে দাঁড়লেন প্রফেসর জুয়ান৷ হাতে লেখা পোস্টারে বড়ো বড়ো ইংরাজি হরফে যা লেখা তার বাংলা তর্জমা হল—
‘১৫ মার্চ সিজারের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে ২০০০ বছরের প্রাচীন ক্লডিয়াস অ্যাম্ফিথিয়েটরে বসে উপভোগ করুন নাটক ‘জুলিয়াস সিজার৷’ নৈশালোকে মঞ্চস্থ এই নাটক আপনাকে নিয়ে যাবে রোমের প্রাচীন রোমাঞ্চকর ইতিহাস ভূমিতে৷ বিশেষ আকর্ষণ, মঞ্চে জীবন্ত সিংহ!’ আগ্রহী ব্যক্তিরা যোগাযোগ করুন মিস্টার ব্যাটিয়েটাসের সাথে৷ আসন সংখ্যা সীমিত৷ বিদেশি পর্যটকদের অ্যাম্পিথিয়েটরে রোম থেকে যাতায়াতের জন্য শীততপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ব্যবস্থা আছে৷’ বিজ্ঞাপনের শেষে যোগাযোগের জন্য একটা ফোন নম্বর দেওয়া৷
পোস্টারটা দেখে জুয়ান আমাকে বললেন, ‘কালই তো ১৫ মার্চ৷ ঐতিহাসিক দিন৷ কি যাবে নাকি নাটক দেখতে?’ আমি বললাম, ‘ভালোই হয়৷ সিজারের মৃত্যুর দিনে রোমে বসে জুলিয়াস সিজার নাটক দেখাটা বেশ স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷’
এরপর তিনি ক্রাসাসকে বললেন, ‘ওই অ্যাম্পিথিয়েটরটা কোথায়? তুমি নাটক দেখার ব্যবস্থা করতে পারবে?’ ক্রাসাস জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, পারব৷ তবে জায়গাটা ঠিক এখানে নয়৷ রোম থেকে ফ্লোরেন্সের দিকে গাড়িতে ঘণ্টা আটেকের পথ৷ প্রাচীন যুগে কলোসিয়াম ছাড়াও রোম নগরীর আশেপাশে অনেক ছোটো ছোটো অ্যাম্পিথিয়েটর ছিল৷ ওটা তারই একটা৷ তিনশো মাত্র আসন৷ নাটকের টিকিটের দাম কিন্তু খুব বেশি৷ ২০০ ইউরো৷’ ক্রাসাস এরপর আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ একটা সবুজ রঙের ফিয়াট গাড়ি ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে আমাদের সামনে দাঁড়াল৷ এ গাড়ি এখানে খুব বেশি চলে৷ বিখ্যাত এই গাড়ি কোম্পানি ইটালিতেই৷ পুরো নাম, ‘ফ্যাবরিকা ইতালিয়ানি অটোমোবাইল তেরিনো৷’ অর্থাৎ ‘ফিয়াট৷’
গাড়ি থেকে নামলেন মধ্য পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক৷ তাঁর পরনে দামী ফরাসী স্যুট৷ হাতে সোনার ঘড়ি, ঠোঁটের কোণে জ্বলন্ত সিগার৷ তবে ভদ্রলোক খুবই খর্বকায় আর বেজায় মোটা৷ তিনি এগিয়ে এসে ক্রাসাসকে মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, তোমাকে দেখে দাঁড়ালাম৷ তা কাল তুমি আসছো তো?’ একটু চুপ করে থেকে ক্রাসাস জবাব দিল, ‘কোম্পানি আমাকে এনাদের সঙ্গে দিয়েছেন৷ তাছাড়া কাল হেলেনার মৃত্যুদিন, আর বাচচাটার ব্যাপারতো আপনি জানেন৷’
ভদ্রলোক ক্রাসাসের পিঠে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে বললেন, ‘মানুষের জীবনে দুর্ঘটনাতো আসতেই পারে কিন্তু তার জন্য কি শো থেমে থাকবে? চিকিৎসার জন্য তো অর্থর প্রয়োজন৷ আর সে জন্যই তোমার আসা দরকার৷ গতবারের দ্বিগুণ পয়সা দেব আমি৷’
ক্রাসাস শুনে সামান্য ভেবে নিয়ে আমাদের দেখিয়ে বলল, ‘ওনারা এই মাত্র বলেছিলেন যে নাটক দেখতে যাবেন৷ ওনারা গেলে আমি যাব৷ কিন্তু অভিনয় করব কিনা বলতে পারছি না৷’
ভদ্রলোক এবার আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনারা নাটক দেখার ব্যাপারে আগ্রহী! আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?’
আমরা নিজেদের পরিচয় দিলাম৷ ভদ্রলোক করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘পোস্টারের যে নাম লেখা আছে আমি সেই ব্যাটিয়েটাস৷ আপনারা আসুন না আমার নাটক দেখতে৷ নিজের প্রোডাকশন বলে বলছি না, ক্রাসাস জানে, আমি হলফ করে বলতে পারি জুলিয়াস সিজারকে নিয়ে এত ভালো প্রোডাকশন রোমের কোনো অপেরা হাউসে নেই৷ ক্রাসাসের সঙ্গে এলে টিকিটের দাম লাগবে না৷ আপনারা আমার অতিথি হবেন৷’
জুয়ান করমর্দন করে স্মিত হেসে বললেন, ‘যদি দেখতে যাই তবে টিকিট কেটেই দেখব৷ প্রোডাকশনের তো একটা খরচ আছে৷’
ভদ্রলোক হেসে জবাব দিলেন, ‘তা আছে ঠিকই, তবে টিকিটের টাকায় সে খরচ ওঠে না৷ এটা আমার পক্ষ থেকে একটা চ্যারিটি শো৷ আসলে আমি প্রাচীন রোমাক সংস্কৃতির একজন পূজারি৷ আর সিজার ছিলেন সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম প্রতীক৷ আমি ওর ভীষণ ভক্ত৷ বলতে পারেন ওঁর মৃত্যু দিনের আমার নাটক ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য৷’
এরপর তিনি ক্রাসাসের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তুমি ওনাদের সঙ্গে নিয়ে এসো৷ বেশি চিন্তা করো না৷ আমি যাচ্ছি, কাল দেখা হবে৷’ কথাগুলো বলে, আরও একবার অমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিলেন ভদ্রলোক৷
তিনি চলে যাবার পর জুয়ান ক্রাসাসকে বললেন, ‘বাঃ তুমি অভিনয়ও করো! তা এই ভদ্রলোক কি করবেন?’ ক্রাসাস বলল, ‘ওঁর নাম, ল্যানিস্টা ব্যাটিয়েটাস৷ পয়সাওলা লোক৷ রোমে বেশ কয়েকটা প্রেক্ষাগৃহ আছে ওঁর৷ ক্লডিয়াস অ্যাম্পিথিয়েটর রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়েছে৷ তাছাড়া সার্কাস, চিড়িয়াখানার জন্য পশু বিক্রির ব্যবসা আছে৷ বর্তমান ক্লডিয়াসেই থাকে৷’
জবাব দেবার পর ক্রাসাস বলল, ‘আপনাদের একটা অনুরোধ করব৷ কাজেই আমার বাড়ি৷ যদি অনুমতি দেন তবে মিনিট দশেকের মধ্যে সেখান থেকে একটু ঘুরে আসব৷ আসলে, বাচচাটা অসুস্থ৷ আপনারা যদি এখানে একটু দাঁড়ান…৷’
জুয়ান বলল, ‘ঠিক আছ তুমি যাও৷ তবে তোমার যদি আপত্তি না থাকে আমরা তোমার সাথে যেতে পারি৷ ক্রাসাস একটু বিস্মিত হয়ে বলল, ‘যাবেন আপনারা! চলুন৷’
বড়ো রাস্তা ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা উপস্থিত হলাম বিরাট সৌধগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা ছোটো বস্তি মতো অঞ্চলে৷ সেখান চারপাশে খুপরি খুপরি ঘর৷ কেউ কেউ আবার প্রাচীন কোনো কাঠামোর মাথায় ছাউনি দিয়ে সেখানেই আস্তানা পেতেছে৷ অর্ধ উলঙ্গ শিশুরা খেলা করছে রাস্তায়৷ সেখানকার বাড়ি ঘর, লোকজনের পোশাক আশাক দেখলেই বোঝা যায় জায়গাটাতে নিম্নবিত্ত মানুষদের বাসা৷ ক্রাসাস আমাদের নিয়ে ঢুকল ছোট্ট একটা ঘরে৷ সেখানে বিছানায় শুয়ে আছে বছর দশেকের একটা শীর্ণ মেয়ে৷ তার চেহারা ও গাত্রবর্ণে সুস্পষ্ট আফ্রিকান ছাপ৷ ক্রাসাসকে দেখে তার ডাগর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ মেয়ের মাথায় হাত রেখে তার সাথে বেশ কিছুক্ষণ সস্নেহে ক্রাসাস কথা বলল৷ সে ভাষা আমরা বুঝতে পারলাম না৷ তারপর সে আমাদের বলল, ‘অনেকদিন ধরে ভুগছে ও৷ হার্টের সমস্যা৷ ডাক্তার বলেছে অনেক টাকার দরকার৷ বাড়িতে ও একলা থাকে তো, তাই আমি বাইরে বার হলে চিন্তায় থাকি৷’
আমি বললাম, ‘একলা কেন? ওর মা কোথায়?’
মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে ক্রাসাস জবাব দিল, ‘নেই৷ ঠিক একবছর হল একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে৷’ এরপর সে খাটের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চলুন, আপনাদের আবার সময় নষ্ট হচ্ছে৷’ আমার পকেটে একটা চকোলেট ছিল, সেটা বাচচাটার দিকে এগিয়ে দিলাম৷ কাঁপা কাঁপা হাতে চকোলেটটা নিয়ে বিষণ্ণ একটা হাসি হাসল বাচচাটা৷ তাকে দেখে মনটা বেশ খারাপ লাগল আমার৷ এরপর আমরা যখন বাইরে বেরতে যাব, ঠিক তখন দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো একটা জিনিস চোখে পড়ল আমাদের৷ বেশ বড়ো একটা ছোরা৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা বেশ প্রাচীন৷ সম্ভবত ব্রোঞ্জের তৈরি৷ সেটার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হযেছে দেখে ক্রাসাস বলল, ‘ওটা হল ‘থ্রোশীয় ছোরা’৷ আপনার বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ওর বয়স প্রায় দু-হাজার বছর৷ এই বলে সে দেওয়াল থেকে সেটা খুলে আমাদের দেখার জন্য দিল৷ জুয়ান জিনিসটা দেখতে দেখতে বললেন, ‘এতো অমূল্য ঐতিহাসিক জিনিস! তুমি পেলে কোথায়?’ ক্রাসাস বলল, ‘বংশানুক্রমে প্রাপ্ত৷ আমার পূর্বপুরুষরা গ্লাডিয়েটর ছিলেন৷ এক সময় ক্রীতদাস হিসাবে আফ্রিকা থেকে এ দেশে এসেছিলেন তাঁরা৷ রোমে গ্লাডিয়েটর প্রথা বন্ধ হয়ে গেলেও পাঁচশো বছর আগেও বিভিন্ন প্রাইভেট অ্যাম্পিথিয়েটরে পশুদের সাথে লড়াই হতো গ্ল্যাডিয়েটরদের৷’
ক্রাসাসসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্যত্র এগোলাম আমরা৷ হাঁটতে হাঁটতে প্রফেসর জুয়ান ক্রাসাসকে বললেন, ‘ভাবছি নাটকটা দেখতে যাব৷ তবে বাসে নয়, তুমি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করো৷ ফ্লোরেন্সটা একবারে দেখা হয়ে যাবে তাহলে৷’
ক্রাসাস বলল, ‘তাহলে ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি নেব৷ আমি চালিয়ে নিয়ে যাব৷ খরচ কম হবে আপনাদের৷ রাস্তার দ্রষ্টব্য গুলোও ভালো করে দেখা যাবে৷’
জুয়ান বললেন, ‘সেই ভালো৷ তা এখন আমরা কোথায় যাব?’
ক্রাসাস বলল, ‘ভ্যাটিকান আর ডোরিয়া চিত্রাশালায়৷’
আমরা প্রথমে গেলাম ভ্যাটিকানে৷ অতুল ঐশ্বর্য আর ইতিহাসের ধাত্রীভূমি ক্যাথলিক খৃষ্টানদের সর্বোচচ ধর্মগুরুর প্রাসাদ ও পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র৷ এদের নিজস্ব মুদ্রা, ডাকটিকিট পুলিশ, দূতাবাস সবই আছে৷ তবে বিদেশি মুদ্রা বিনিময় এখানে চলে না৷ পোপের প্রাসাদের সামনে বিরাট চত্ত্বরে নানা দেশের ট্যুরিস্টদের ভিড়৷ চত্ত্বরের বিভিন্ন দিকে রয়েছে নানা মিউজিয়াম৷ আমরা দেখা শুরু করলাম মাইকেল এঞ্জেলো নির্মিত সেন্ট পিটার্স গীর্জা দিয়ে৷ মাইকেল এঞ্জেলোর বহু শিল্পকীর্তি রয়েছে এখানে৷ গীর্জার ছাদ থেকে দেখলাম দূরে টাইবার নদী৷ সেন্ট পিটার্সের পর প্রবেশ করলাম ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে৷ সেখানে রাখা আছে শত শত বছর ধরে পোপ যে সব অমূল জিনিস উপহার পেয়েছেন সেগুলো৷ বিকাল হয়ে গেল৷ শেষে পৌঁছলাম ডোরিয়া মিউসিয়ামে৷ সেখানে বাত্তেচিল্লির ভূবন বিখ্যাত ‘ভেনাসের’ ছবি দেখে জীবন সার্থক করলাম৷ এছাড়া এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে যাওয়া আসার পথে আমরা দেখতে পেলাম অসংখ্য পাথরের ফোয়ারা যা এই প্রাচীন নগরীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য৷
একদিনে যতটুকু দেখা যায় তা দেখার পর আমাদের থাকার জায়গা ‘হেটেল ভেনিসিয়া’য় যখন ফিরলাম তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে৷ পরদিন সকালে গাড়ি নিয়ে আসবে বলে ক্রাসাস বিদায় নিল৷ সারা দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে রাত নটা নাগাদ খাওয়া সেরে বিছানায় গেলাম আমরা৷’
৩
পরদিন সকাল সাতটা নাগাদ ভাড়া করা একটা ফিয়াটে রোম ছেড়ে রওনা হলাম আমরা৷ জুয়ান মেয়ের খবর জিজ্ঞেস করায় ক্রাসাস বিমর্ষভাবে জানাল তার শরীর খারাপ৷ যেহেতু আমাদের ফ্লোরেন্স যাবার কথা তাই দু রাত ফেরা হবে না তার৷ এক প্রতিবেশির জিন্মায় সে বাচচাটাকে রেখে এসেছে৷
মসৃণ পিচ রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি৷ এক সময় আমরা দেখতে পেলাম আমাদের রাস্তার সমান্তরালই মাঝে মাঝে মাটির বুক থেকে জেগে আছে পাথরের ব্লক বসানো রাস্তার অংশ৷ ক্রাসাস বলল, ‘এটা হল দু-হাজার বছরের প্রাচীন রাস্তার অংশ৷ সে যুগেও সাম্রাজ্যের নানা অংশের সাথে রোমের সড়ক যোগাযোগ ছিল৷ ওই রাস্তায় এখনও সে যুগের রথের চাকার ঘর্ষণ সৃষ্ট দাগ দেখা যায়’
আমি শুনে বললাম, ‘প্রবাদই তো আছে, ‘অলরোডস লিড টু রোম৷’ সব পথই রোমের দিকে যায়৷
আমি শুনে ক্রাসাস বলল, ‘আপনার ব্যাখ্যাটা চালু হলেও, আসলে কিন্তু তা নয়৷ এই প্রবাদের উৎপত্তি প্রাকখৃষ্ট যুগে দাস বিদ্রোহের আমলে৷ সে সময় এ সব পথে মানুষের প্রাণের কোনো নিরাপত্তা ছিল না৷ রোমেও চূড়অন্ত অরাজক অবস্থা৷ তখন বলা হতো ‘রাস্তার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় রোমের কি অবস্থা!’ প্রবাদের অর্থটা ইংরাজি অনুবাদগুণে বদলে যায়৷ দাস বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে এই সব রাস্তার দু-পাশে বিদ্রোহীদের ক্রুশবিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল জনসাধারণের প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে৷’
আমি বললাম, ‘কি অদ্ভুত বৈপরীত্য ছিল সে যুগে! একদিকে তাঁরা তৈরি করছে বিস্ময়কর সব স্থাপত্য, জন্ম দিচ্ছে আশ্চর্য সুন্দর সব শিল্পের, সেই সুদূর অতীতে প্রতিষ্ঠা করছে প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তার পাশাপাশি আবার চলছে, গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই, দাসব্যবসা, ক্রুশবিদ্ধ করার মতো ভয়ঙ্কর প্রথা!’
প্রফেসর জুয়ান বললেন, ‘তবে ক্রুশবিদ্ধ করার প্রথা কিন্তু রোমের আদি প্রথা ছিল না৷ ৩২৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দে রোমানরা কার্থেজ বিজয়ের পর সে দেশ থেকে যে দুটো জিনিস নিজেদের দেশে আমদানি করেছিল৷ তার মধ্যে একটা হল বাগিচা প্রথা, আর একটা এই ক্রুশবিদ্ধ করে মানুষকে হত্যা করার পদ্ধতি৷ কেন রোমের জনগণ এই নিষ্ঠুর হত্যা পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছিল তা বলা শক্ত, তবে এ সংস্কৃতি এমনভাবে মিশে গেছিল রোমানদের জীবনযাত্রার সাথে যে পরবর্তী পাঁচশো বছরে যে মাটিতেই তারা পা রেখেছিল সেখানেই তারা বহন করে নিয়ে গেছিল এই বীভৎস পদ্ধতিকে৷ সেনেটররা বলতেন, ‘ক্রুশবিদ্ধ দেহ আসলে রোমের সার্বভৌম রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতীক৷’ স্পার্টাকাস থেকে যীশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করে রোমানরা ওই মতই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ছিল৷ তবে সে সময় ক্রুশবিদ্ধ কার দৃশ্য দেখার জন্য বহু মানুষের ভিড় হতো৷ এমন কি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারাও এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে আসতেন৷ ঠিক যেমন লোকে সিনেমা থিয়েটর দেখতে যান তেমন৷’
জুয়ানের কথা শুনে ক্রাসাস বলল, ‘আপনি তো ইতিহাসের প্রফেসর তাই অনেক কিছু জানেন৷ তবে সব সময় যে জনগন কোনো হতভাগ্য মানুষের হত্যা দৃশ্য উপভোগ করতে আসত তা নয়৷ অদম্য রোমান রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে ক্রুশবিদ্ধ বীরের মৃত্যুও দেখতে আসত অনেকে৷ যে দৃশ্যের মধ্যে লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের বীজ৷’
আমাদের যাত্রাপথের দূরে দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে৷ রোম নগরীর সাতটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা৷ ওরকম দূরের একটা পাহাড় দেখিয়ে ক্রাসাস বলল, ‘আপনাদের যদি ইচ্ছা হয় তবে রোম ভ্রমণে আপনাদের ওই পাহাড়ের মাথায় নিয়ে যাব৷ ওর মুখটা রোমের দিকেই৷ এক সময় ওখানে ছিল সম্রাট নিরোর প্রাসাদ৷ ৬৪ অব্দে রোমে যখন বিধ্বংসী অগ্নিকান্ড হয় তখন ওই প্রাসাদেই বেহালা বাজাতে বাজাতে ওপর থেকে জ্বলন্ত রোম নগরীর দৃশ্য উপভোগ করছিলেন সম্রাট৷ এমন অজস্র ঐতিহাসিক জায়গা আছে রোমে৷
জুয়ান বললেন, ‘সময় পেলেই যাব আমরা৷ সব কিছু ভালো করে দেখার জন্যই তো এসেছি৷
নানা কথা আলোচনা করতে করতে এগিয় চললাম আমরা৷ সময়ও এগিয়ে চলল পাল্লা দিয়ে৷ রাস্তার পাশে আঙুর ক্ষেত, ছোটো ছোটো শহর গ্রাম অতিক্রম করে অবশেষে বেলা তিনটে নাগাদ আমরা পৌঁছলাম গন্তব্যস্থলে৷
জায়গাটা লোকালয় থেকে বেশ দূরে৷ শেষ গ্রামটা আমরা মাইল পাঁচেক পিছনে ফেলে এসেছি৷ ডিম্বাকৃতির অ্যাম্পিথিয়েটরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল আমাদের গাড়ি৷ চারপাশে ছড়িয়ে আছে নানা প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ৷ জায়গাটার প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনো সংশয় নেই৷ তবে পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন টাঙিয়ে জায়গাটাকে অন্যরূপ দানের চেষ্টা হযেছে৷ একটা বড়ো বাস আর বেশ কিচু লোকজন রয়েছে অ্যাম্পিথিয়েটরের বাইরে৷ ক্রাসাস বলল, নাট্যকের অভিনেতারা সব ওই বাসে এসেছে৷ দর্শকরা সন্ধ্যার মধ্যেই সব আসবে৷ সন্ধ্যা সাতটায় শো শুরু হবে৷ দেড় ঘণ্টার প্লে৷ শো শেষ হলে দর্শক আর অভিনেতারা সব রোমে ফিরে যাবে৷ তবে আমাদের এখানে রাত কাটাবার সে ব্যবস্থা করবে৷ কারণ, রাতে গাড়ি নিয়ে নির্জন রাস্তা ধরে ফ্লোরেন্সে যাওয়া যাবে না৷ ইদানিং সে পথে নাকি ডাকাতি-টাকাতি হচ্ছে! কাল ভোরে আমরা ফ্লোরেন্সের পথ ধরব৷
গাড়ি থেকে আমরা নামতেই কিছু লোক ক্রাসাসকে দেখে এগিয়ে এসে তার সাথে কুশল বিনিময় করল৷ তারা তার পূর্বপরিচিত ও অভিনেতা৷ বাইরে থেকে অ্যাম্ফিথিয়েটরের যতটুকু দেখা যাচ্ছে তার তিন দিক ফুট দশেক উঁচু প্রাচীর ঘেরা, আর এক দিকে সার সার ঘর তার মাথার ওপর দিয়ে ওপর দিকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাথুরে গ্যালারি৷ অ্যাম্ফিথিয়েটরে প্রবেশ পথে আর্চ আকৃতির তোরণের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধরত গ্লাডিয়েটরের প্রাচীন মূর্ত্তি৷ সে যেন রোমের সেই ভয়ঙ্কর যুগের সাক্ষী৷ যে যুগে অ্যাম্ফিথিয়েটরে হিংস্র সিংহর মুখে মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে অথবা গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্তাক্ত লড়াই দেখে আমোদ উপভোগ করতে জনতা!
আমরা প্রবেশ তোরণের দিকে এগোতেই সেদিক থেকে বেরিয়ে এলেন মিস্টার ব্যাটিয়েটাস আর একজন লোক৷ তবে তাঁর চেহারা ব্যটিয়েটাসের ঠিক বিপরীত৷ লোকটা বেশ রোগা, আর উচচতায় অন্তত সাড়ে ছ-ফুট হবে৷ তার পরনেও দামি পোশাক, সোনার চশমা, সোনার ঘড়ি৷ গায়ের রং বেশ ফর্সা, টিকালো নাক, কোঁকড়ানো চুল৷ ব্যাটিয়েটাস আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বেশ উৎফুল্লভাবে বললেন, ‘আরে আপনারা এসে গেছেন! আপনাদের কথাই ভাবছিলাম আমি৷ আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না৷ আপনারা আমার অতিথি৷’ আর, এরপর তিনি তার সঙ্গী ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনি, মিস্টার ম্যাসিডো৷ আজ রাতের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি৷ নাটক দেখবেন বলে গ্রিস থেকে এসেছেন৷’
জুয়ান নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর সাথে করমর্দন করে ভদ্রলোকের পেশা জিজ্ঞেস করতেই তিনি নিস্পৃহভাবে জবাব দিলেন, গ্রিসে তাঁর একটা জাহাজ তৈরির কারখানা আছে৷ আর অঅছে গোটা তিনেক ফাইভস্টার হোটেল৷ আমরা শুনে চমকে উঠলাম৷ তার মানে লোকটা একজন ধনকুবের! লোকটা আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করল না৷ লোকটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল ক্রাসাসকে৷
ব্যাটিয়েটাস হেসে ক্রাসাসকে বললেন, ‘তুমি যে আসবে তা আমি জানতাম৷’
ক্রাসাস অস্পষ্ট ভাবে বলল, ‘আমি এসেছি ঠিকই৷ কিন্তু এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি৷’ এরপর সে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ব্যাটিয়েটাস একবার আড়চোখে মিস্টার ম্যাসিডোকে দেখে নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে ও ব্যাপারে পরে কথা হবে৷ তুমি এখন এই ভদ্রলোকদের বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যাও৷ সব ব্যবস্থা করা আছে৷’ এই বলে তিনি মিস্টার ম্যাসিডোকে নিয়ে এগোলেন অন্য দিকে৷
ক্রাসাস আমাদের নিয়ে উপস্থিত হল গ্যালারির নিচে একটা পাথুরে ঘরে৷ সেখানে খাট পেতে বিছানার ব্যবস্থা করা৷ পাশাপাশি সারবদ্ধ ছোটো ছোটো ঘর সেখানে৷ একটা টানা বারান্দা দিয়ে ঘরগুলো সংযুক্ত৷ বারান্দার ওপাশে এরিনা৷ তবে দেওয়াল তুলে তাকে পরবর্তীকালে ঢেকে দেওয়া হয়েছে৷ দেয়ালের মাথার দিকের ঘুলঘুলি থেকে হালকা আলো ঢুকছে বারান্দা সংলগ্ন ঘরে৷ তাছাড়া ঘরে কোনো জানলা নেই৷ সৌন্দর্যহীন নিরেট পাথরের মেঝে আর দেওয়াল৷ লক্ষ করলাম মেঝে থেকে কিছুটা ওপরে দেওয়ালের গায়ে বেশ কয়েকটা ধাতব গজালের অংশবিশেষ যেন উঁকি দিচ্ছে৷ আমরা বসার পর ক্রাসাস বলল, ‘সে যুগে এই ঘরে গ্ল্যাডিয়েটরদের রাখা হত৷ দেওয়ালের গায় পোঁতা ওই গজালের সাথে শিকলে বাঁধা থাকত তারা৷ এখান থেকেই তাদের নিয়ে যাওয়া হত এরিনার মৃত্যু কূপে৷’ সে এরপর বলল, ‘আপনারা তাহলে বিশ্রাম করুন, আমি ঠিক সময় আবার আসব৷’ এই বলে সে দরজার দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল হঠাৎ জুয়ান তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘নাটকে তুমি কোন ভূমিকায় অভিনয় করবে বলো তো?’ জুয়ানের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই পরপর দুবার অদ্ভুত গর্জনে কেঁপে উঠল ঘর আর সংলগ্ন বারান্দা৷ সিংহর ডাক! নাটকের প্রয়োজনে আনা প্রাণীটাকে সম্ভবত আশেপাশেই কোনো ঘরে রাখা হয়েছে! মুহূর্ত্তের জন্য থমকে দাঁড়াল ক্রাসাস৷ জুয়ানের প্রশ্ন জবাবে সে বলল, ‘গ্ল্যাডিয়েটরের৷’ তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷
৪
ক্রাসাসের উত্তর বেশ কিছুটা বিস্মিত করল আমাদের৷ আমরা তার কথা কিছুক্ষণ আলোচনা করার পর জুয়ান বললেন, ‘শো তো সাতটায়, এখনও চারটে বাজেনি৷ একটু বরং ঘুমিয়ে নিই৷’
দুজনেই শুয়ে পড়লাম, প্রফেসর নাক ডাকতে শুরু করলেও আমার কিন্তু ঘুম এল না৷ চুপচাপ শুয়ে রইলাম৷ কিন্তু ঘুম না এলে বেশিক্ষণ আমি শুয়ে থাকতে পারি না৷ বিকাল হবার সাথে সাথে বাইরে নানা লোকের হাঁকডাক, গাড়ির হর্ন শোনা যেতে লাগল৷ হঠাৎ আমার মনে হল, ‘সিংহটা নিশ্চয়ই কাছে আছে, তাকে একবার দেখা যায় কিনা?’ উঠে ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে ধীর পায় হাঁটতে লাগলাম৷ একপাশে সারবব্ধ খুপরি খুপরি ঘর৷ হঠাৎ একটা ঘরের ভিতর থেকে শোনা গেল ক্রাসাস আর ব্যাটিয়েটাসের গলা৷ ব্যাটিয়েটাস বলছেন, ‘তোমাকে আজ নামতেই হবে৷ ম্যাসিডো তিন লাখ ইউরো দিয়েছে৷ তাঁকে দেখাতে হবেই আমাকে৷ তোমাকে পঞ্চাশ হাজার দেবো৷ ভেবে দেখ ওই দিয়ে তোমার মেয়ের চিকিৎসা করাতে পারবে৷’ ক্রাসাস জবাব দিল, ‘আমিই যদি না থাকি তাহলে কে ওর চিকিৎসা করাবে? এই ভাবে ওর মা গেল৷ প্রাণীটাকে আমি দেখে এলোম৷ না, আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়, আপনি অন্য রাস্তা দেখুন৷’ এই বলে সে সম্ভবত রাগ করে ঘর ছেড়ে বাইরে আসতেই আমার মুখোমুখি হয়ে গেল৷ আমাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে খুঁজছেন?’
আমি বললাম, ‘ঠিক তা নয়, আসলে যে সিংহটার ডাক শুনলাম, ভাবছি সেটা দেখা যায় কিনা?’
ক্রাসাস যেন মৃদু চমকে উঠল৷ তারপর বলল, সেটা কাছেই আছে, কিন্তু ঘরবন্দি অবস্থায়, এখন দেখা যাবে না৷ এরপর সে বলল, ‘আমি কিছুক্ষণ পরই, আপনাদের ঘরে যাচ্ছি৷’ এই বলে সে সম্ভবত ব্যাটিয়েটাসের সাথে কথা বলার জন্য আবার ঘরে ঢুকল৷ অগত্যা আমিও ঘরে ফিরে এলাম৷
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঘুম ভাঙল জুয়ানের৷ তিনি উঠে বসার পরই আমাদের ঘরে আগমন হল মিস্টার ব্যাটিয়েটাসের৷ তার সঙ্গে খাবার নিয়ে একজন লোক৷ ব্যাটিয়েটাস বললেন, ‘আপনাদের কেনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? ক্রাসাস শো-এর জন্য তৈরি হচ্ছে৷ ও আসছে৷’
জুয়ান বলল, ‘না, হচ্ছে না৷ আপনার টিকিটের দামটা? আমরা কিন্তু টিকিট কেটেই শো দেখব৷’
তিনি বললেন, ‘সে পরে নেব৷ আপনারা তো থাকছেন রাতে৷’
তার সাথে আমাদের আর কোনো কথা হল না৷ তিনি চলে যাবার পর খাবার খেয়ে পোশাক বদলে নিলাম আমরা৷ তার বেশ কিছুক্ষণ পরে ক্রাসাস ঘরে ঢুকল৷ তার পরনে পুরদস্তুর সে কালের গ্ল্যাডিয়েটরের সাজ৷ ধাতব বর্মে সে আবৃত, পায়ে ফিতে দিয়ে বাঁধা চর্ম পাদুকা, মুখ ঢাকা শিরস্ত্রাণ৷ সে আমাদের দেরি হবার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলল, ‘এবার ওপরে চলুন৷ লোকজনও সব এসে গেছে৷’
ঘর থেকে বেরিয়ে একটা অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে আমাদের গ্যালারিতে পৌঁছে দিল সে৷ সত্যি লোকজনে প্রায় ভরে গেছে গ্যালারি৷ অ্যাম্পিথিয়েটরের বাইরে আরও একটা বাস, আর বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাদের চারপাশে যারা বসে আছে, দেখেই বোঝা যায় তারা বেশ পয়সাওলা লোকজন, কিছু বিদেশিও আছে৷ কিছুটা তফাতে একটা বিশেষ আসনে মিস্টার ম্যাসিডোকেও দেখলাম৷ আমরা সেখানে বসে আছি তার ফুট কুড়ি নীচেই এরিনা৷ দেড়শো ফুট মতো চওড়া৷ একটা দশ ফুট গভীর গর্ত্ত গ্যালারি আর এরিনার মধ্যে ব্যবধান রচনা করেছে৷ জুয়ান সেটা দেখিয়ে বললেন, ‘উত্তেজিত দর্শকরা যাতে এরিনায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ওই পরিকা খনন করা হোত৷’
ক্রাসাস আমাদের বসিয়ে দিয়ে চলে গেল৷ দিন শেষের রক্তিম আলো এসে পড়েছে এরিনাতে৷ কেমন যেন বিষন্নতা ছড়িয়ে আছে তার বুকে৷ আমি সে দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ভাবতে কেমন অবাক লাগছে সত্যিই এই এরিনাতে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতেন গ্ল্যাডিয়েটররা! হাজার হাজার বছর ধরে কত মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছে এই বধ্যভূমি!’
প্রফেসর জুয়ান বললেন, ‘গাড়িতে আসার সময় তুমি রোমান সমাজের যে বৈপরিত্যের কথা বলছিলে তা গ্ল্যাডিয়েটরদের জীবনেও কিন্তু প্রবলভাবে ছিল৷ একদিকে তারা ছিল ক্ষমতা-বাকস্বাধীনতা-কপর্দকহীন ক্রীতদাস, অন্যক্ষেত্রে তারাই আবার লড়াইয়ের ময়দানে মৃত্যুঞ্জয়ী অকুতোভয় বীর নায়ক৷’
আমরা গল্প করতে লাগলাম৷ এক সময় অন্ধকার নেমে এল৷ এরিনায় জ্বলে উঠল উজ্জ্বল আলো৷
ঠিক সাতটায় শো শুরু হল৷ বাজতে লাগল কনসার্ট৷ নাটকের মুখবন্ধে ঘোষক জানিয়ে দিলেন, ‘এ নাটক সম্পূর্ণ সেক্সপীয়র আধারিত নয়৷ তার সাথে মেলানো হয়েছে প্রাচীন রোমের নানা কাহিনি৷ জুলিয়াস সিজারের সাথে সাথে সমকালীন রোমকেও তুলে ধরার চেটা করা হয়েছে এই নাটকে৷ গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই দিয়ে শুরু হচ্ছে এই নাটক৷’ আর এরপরই আমাদের অবাক করে দিয়ে প্রথম দৃশ্যেই মঞ্চে আবির্ভুত হল গ্ল্যাডিয়েটর ক্রাসাস৷ আর তার পিছনে একজনের হাতে শিকলবাঁধা একটি সিংহী৷ লড়াই শুরু হল৷ সিংহীটা বেশ প্রশিক্ষিত৷ গ্ল্যাডিয়েটরের ছদ্ম আক্রমণের সাথে সাথে তার গর্জনে কেঁপে উঠতে লাগল অ্যাম্পিথিয়েটার৷ বিরাট তরবারি নিয়ে তার সাথে লড়াই চালাল ক্রাসাস৷ সিংহর গর্জন শুনে এক এক সময় মনে হতে লাগল যেন সত্যিই লড়াই হচ্ছে! মিনিট পাঁচেক পরে তুমুল করতালির মধ্যে দিয়ে লড়াই শেষ হল৷ প্রথম দৃশ্য মাতিয়ে দিয় মঞ্চ থেকে সিংহীটাকে নিয়ে অপসৃত হল গ্ল্যাডিয়েটর৷ এরপর শুরুর হল সিজারের জীবন আধারিত কাহিনি৷ সামান্য সৈন্য থেকে কিভাবে রোমে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেল তাই দেখানো হতে লাগল৷ আর তার সাথে সে যুগের আনুসঙ্গিক সব ঘটনা, দাস ব্যবস্থা, ক্ষমতা দখলের জন্য সেনটরদের চক্রান্ত ইত্যাদি৷ সিজারের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন, তার অভিনয় তো বটেই, অন্যদের অভিনয়ও চমৎকার৷ মার্ক অ্যান্টনি, অক্টোভিয়ান, সব চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল চোখের সামনে৷ মন্ত্রমুগ্ধর মতো দেখতে লাগলাম৷ সত্যিই অপূর্ব প্রোডাকশন! সময়ের সাথে সাথে নাটক এগিয়ে চলল তার পরিণতির দিকে৷ অবশেষে সেই অন্তিম দৃশ্য৷ যেখানে হত্যা করা হচ্ছে সিজারকে৷ সিজারের শেষ চিৎকার, ‘ব্রুটাস ইউ!’ সেই আর্তনাদ যেন এরিনা থেকে উঠে অন্ধকার অকাশকে বিদীর্ণ করে দিল! সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হল সেই আর্তনাদ! আর তারপরই জ্বলে উঠল গ্যালারির আলো৷ বিমোহিত দর্শকদের একটু সময় লাগল বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে৷ তারপর করতালির ঝড় উঠল গ্যালারি থেকে৷ জুয়ান বললেন, ‘সত্যি নাটকটা না দেখলে খুব মিস করতাম! অসাধারণ প্রোডাকশন!’ লোকজনের সাথে সাথে এরপর আমরাও উঠে পড়লাম৷ গ্যালারির ওপর থেকে দেখলাম অ্যাম্ফিথিয়েটরের বাইরে সেই সিংহীটাকে গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে৷
৫
আমাদের ঘরে ফিরে এলাম৷ ধীরে ধীরে বাইরে লোকজন, গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগল৷ ফিরে যাচ্ছে সবাই৷ সিংহীটাকেও মনে হয় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল৷ ক্রমঅপসৃয়মান ডাক শুনলাম তার৷ নাটক শেষ হয়েছে সাড়ে আটটাতে৷ কিন্তু নটা বেজে গেল ক্রাসাস দেখা করতে এল না৷ তার পাত্তা নেই৷
হঠাৎ ঘরের বাইরে পায়ের শব্দ শুনে আমরা ভাবলাম ক্রাসাস আসছে৷ কিন্তু ঘরে ঢুকলেন ব্যাটিয়েটাস৷ তিনি আমাদের প্রশ্ন করলেন, ‘ক্রাসাস এখানে এসেছিল?’
আমি বলালম, ‘না, আমার তো তার জন্যই অপেক্ষা করছি৷’
ব্যাটিয়েটাস আর কোনো কথা বললেন না৷ তিনি যেমন হঠাৎই এসেছিলেন তেমনই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷
প্রফেসর বললেন, ‘ক্রাসাস কোথায় গেল বলতো? ব্যাটিয়েটাসও তো ওকে খুঁজছেন!’
আমরাও ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হল না৷ প্রথম দৃশ্যের পর ক্রাসাসকে আর মঞ্চেও দেখা যায়নি!
আমরা প্রতীক্ষা করতে লাগলাম৷ ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে লাগল৷ আরও এক ঘণ্টা কেটে যাবার পর বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলাম আমরা৷ জুয়ান আমাকে বললেন, ‘যাও, মিস্টার ব্যাটিয়েটাসের ওখানে দেখে এসো ক্রাসাস ফিরছে নাকি?’
ঘর ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে আমি এগোলাম ব্যাটিয়েটাসের ঘরের দিকে৷ সে ঘরের দরজার কাছাকছি যেতেই আমি শুনতে পেলাম ভিতরে একজন উত্তেজিত ভাবে বলছে, ‘ধাপ্পা দিযে তুমি আমাকে এখানে টেনে এনেছো৷ তোমাকে আমি ছাড়বনা৷ সবটাকা উসুল করব আমি৷’
এরপর শোনা গেল ব্যাটিয়েটাসের গলা, ‘আপনি বিশ্বাস করুন, শেষ পর্যন্ত ওর হাতে পঞ্চাশ হাজার ইউরো দিয়ে রাজি করিয়েছিলাম৷ এখন যদি না পাই…৷’
অপর জন বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘আমি কোনো কথা শুনতে চাই না৷ তাহলে, বিকল্প ব্যবস্থা করো৷’
‘এখন কি বিকল্প ব্যবস্থা করব আমি?’
আড়ি পেতে কথা শোনা ঠিক নয়, ব্যটিয়েটাসের প্রশ্ন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ দেখলাম ঘরের মধ্যে রয়েছেন তিনি আর মিস্টার ম্যাসিডো৷ অর্থাৎ দ্বিতীয় গলাটা তারই৷ আমাকে দেখে দুজনেই থেমে গেলেন৷ তাঁদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে দু-জনেই বেশ উত্তেজিত৷
আমি ব্যাটিয়েটাসকে বললাম, ‘ক্রাসাস ফিরেছে কিনা খোঁজ নিতে এলাম৷ তাছাড়া টিকিটের টাকাটাও…৷’
আমার কথা শেষ হবার আগেই যেন উত্তেজনার মেঘ মুছে গেল ব্যাটিয়েটাসের মুখ থেকে৷ হাসি মুখ করে তিনি বললেন, ‘ও ক্রাসাস? ও ফিরে এসেছে, কিন্তু এরিনায় আছে৷ শো চলার সময় ওর হাত থেকে আংটি পড়ে গেছে৷ সেটা ও খুঁজছে৷ এখনই সম্ভবত ফিরবে ও৷ আপনি যান, ও আপনাদের ঘরে যাচ্ছে৷ টাকাটা ওর হাতে দেবেন৷’ ঘরে ফিরে ব্যাপারটা জুয়ানকে, আমি জানালাম৷
আরও কিছুক্ষণ সময় গেল, ক্রাসাস এলো না৷ কিন্তু তার পরিবর্তে ঘরে ঢুকলেন ব্যাটিয়েটাস তিনি বেশ হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ‘চলুন৷’
জুয়ান বললেন, ‘কোথায়?’
ব্যাটিয়েটাস বললেন, ‘একটু অ্যাম্পিথিয়েটারের ভিতরে যেতে হবে৷ ক্রাসাস আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে৷ ওখানে একটা প্রাচীন জিনিস আপনাদের দেখাবে৷ যা গ্যালারিতে বসে দেখা সম্ভব ছিল না৷’
আমি বললাম, ‘কি জিনিস?’
ব্যাটিয়েটাস হেসে বললেন, ‘সেটা আগে বলে দিলে ব্যাপারটা উপভোগ্য হবে না৷ দেখবেন চলুন চাঁদনীরাতে দু-হাজার বছরের প্রাচীন এরিনাতে দাঁড়াতে কেমন লাগে! এ সুযোগ আর কোনোদিন পাবেন না৷ রোমের কোনো অ্যাম্পিথিয়েটরে রাতে ট্যুরিস্টদের ঢুকতে দেওয়া হয় না৷ চলুন এবার৷’ একটু ইতস্তত করে ব্যাটিয়েটাসের সাথে ঘরের বাইরে এলাম আমরা৷ বারান্দা ধরে একটু এগিয়ে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গতে তিনি আমাদের দাঁড় করালেন৷ তারপর তিনি কি একটা হাতল ঘোরাতেই পাথুরে দ্যেয়ালের গায়ে একটা অংশ ওপরে উঠে গেল৷ বাইরে থেকে এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়ল পায়ের কাছে৷ বাইরে দেখা যাচ্ছে চন্দ্রালোকিত এরিনার একটা অংশ৷
ব্যাটিয়েটাস বললেন, ‘এক সময় এ পথ দিয়েই রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হতো গ্ল্যাডিয়েটররা৷ যান, ওখানে ক্রাসাস আছে৷’
আমি বললাম, ‘আপনি?’
তিনি বললেন, ‘আমি মিস্টার ম্যাসিডোকে নিয়ে আসছি৷’
সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আমরা পা রাখলাম এরিনাতে৷ নাটকের জন্য যে আলো লাগানো হয়েছিল সেগুলো এখন নেই৷ চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে আছে উন্মুক্ত এরিনা৷ তবে গ্যালারির নিচ আর প্রাচীরের গায়ে এরিনার প্রান্ত সীমায় জমাট বাঁধা অন্ধকার৷ আমরা এগোলাম এরিনার কেন্দ্রস্থলের দিকে৷ কিন্তু কোথায় ক্রাসাস? সেই গ্যালারির সংলগ্ন অন্ধকারে নাকি? আমি দু-বার তার নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু কোনো সাড়া মিলল না৷ ব্যাপারটা কি হল? আমি পিছন তাকাতেই দেখতে পেলাম যে দরজা দিয়ে আমরা এরিনায় প্রবেশ করেছি, সেটা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেছে! জুয়ান এবার হাঁক দিলেন, ‘মিস্টার ব্যাটিয়েটাস আপনি কোথায়? ক্রাসাসতো এখানে নেই৷’
তাঁর কথা শেষ বার সঙ্গে সঙ্গেই গ্যালারির ওপর থেকে কয়েকটা জিনিস এসে সশব্দে আছড়ে পড়ল এরিনার পাথুরে মেঝেতে৷ তারপরই ওপর থেকে ভেসে এল, ব্যাটিয়েটাসের কণ্ঠস্বর, ‘আমরা এখানে৷ ঢাল আর সড়কি তুলে নিন, ওগুলো আপনাদের৷’ দেখলাম গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি আর গ্রীক ধনকুবের! আমি বললাম, ‘আপনার কথা আমরা বুঝতে পারছি না৷ কি হবে ওগুলো দিয়ে?’
ব্যাটিয়েটাস জবাব দিলেন, ‘দুজাহার বছর আগে ওজিনিস গুলো যে কাজে লাগত, আজও সেই কাজে লাগবে৷ গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই৷ উঠিয়ে নিন অস্ত্রগুলো৷’
জুয়ান বললেন, ‘আপনি কি আমাদের সাথে মজা করছেন?’
এবার অট্টহাস্য করে উঠলেন ব্যাটিয়েটাস৷ সে হাসিতে যোগ দিলেন মিস্টার মাসিডোও৷ তারপর ব্যাটিয়েটাস বলে উঠলেন, চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন৷
তাকালাম আমরা৷ আর, তারপরই আমাদের হূদপিণ্ড যেন স্তব্ধ হয় গেল৷ গ্যালারির নিচের একটা অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে চন্দ্রালোকিত এরিনায় এসে দাঁড়িয়েছে একটা সিংহ! এটা নাটকের সেই সিংহী নয়, কালো কেশরঅলা বিরাট কলেবরের একটা প্রাণী! চাঁদের আলোতে দৃশ্যমান হল তার হিংস্র দাঁতগুলো৷
ব্যাপারটা মুহূর্তের মধ্যে অনুধাবন করতে পারলাম৷ ব্যাটিয়েটাস আমাদের ছেড়ে দিয়েছেন সিংহের মুখে! অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনাটা সত্যি! আমরা গ্ল্যাডিয়েটর নয়৷ কিন্তু, ঢাল আর সড়কি গুলো সত্যি আমাদের এখন প্রয়োজন, যদি তা দিয়ে কোনোভাবে প্রাণরক্ষা করা যায়৷ আমরা সেগুলো তুলে নিতেই গ্যালারি থেকে ‘সাবাশ! বলে চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটিয়েটাস৷ তালি দিয়ে উঠলেন মাসিডোও৷ চাঁদের আলোতে গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্ত্তি দুটো সিংহটার থেকেও যেন বেশি হিংস্র মনে হল! আমাদের পালাবার পথ নেই৷ গ্যালারির দিকে পরিখা, অন্যদিকে প্রাচীর৷ জুয়ান চাপা স্বরে বললেন, পিছনের প্রাচীরের দিকে পিছু হটতে শুরু কর৷ যদি কোনোভাবে খাঁজ বেয়ে প্রাচীর টপকে পালানো যায়!’ সিংহটা একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের৷ ঢাল আর সড়কি বাগিয়ে প্রাণীটার দিকে চোখ রেখে এক পা এক পা করে পিছু হটতে শুরু করলাম আমরা৷ ব্যাটিয়েটাস মনে হয় আমাদের মতলব ধরতে পারলেন৷ তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘ও ভাবে বাঁচা যাবে না৷ লড়াই করুন৷ একজনের বিরুদ্ধে দু-জন, অনেক বেশি সুযোগ দিয়েছি আপনাদের৷’ এই বলে তিনি ওপর থেকে পাথরের টুকরো ছুড়তে লাগলেন সিংহটাকে উত্তেজিত করার জন্য৷ একটা পাথর সিংহর পিঠের ওপর পড়তেই ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল প্রাণীটা৷ উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন মাসিডো৷ তারপর তিনিও বড়ো একটা পাথরের টুকরো ছুড়ে মারলেন সিংহটাকে লক্ষ করে৷ সেটা সটান এসে পড়ল প্রাণীটার মাথায়৷ লাফিয়ে উঠল প্রাণীটা৷ আগের চেয়েও জোরে গর্জন করে উঠল সে৷ তারপর এগোতে লাগল আমাদের দিকে৷ তাড়াতাড়ি পিছু হটতে গেলাম আমরা৷ কিন্তু পায়ে পা বেঁধে দুজনেই হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেলাম৷ আমার হাত থেকে ছিটকে গেল ঢাল৷ আমরা উঠে দাঁড়াবার আগেই সিংহটা এক লাফে পৌঁছে গেল আমাদের কাছে৷ তারপর কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে গজরাতে লাগল৷ রনংদেহী মূর্তি৷ চোখ দুটো ভাঁটার মতো জ্বলছে৷ চাঁদের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে হিংস্র দাঁত৷ সম্ভবত ওই দাঁতগুলো শত্রুর দেহে বসিয়ে দেবার আগে শেষ বারের মতো জরিপ করে নিতে চাচ্ছে তাদের ক্ষমতা৷ ওদিকে গ্যালারি থেকে ভেসে আসছে নরপশুদের হর্ষধ্বনি৷ প্রাণীটার লেজের ডগা মৃদু মৃদু কাঁপছে৷ লাফ দেবার আগের মুহূর্ত্ত৷ মৃত্যুকে যেন সামনেই প্রত্যক্ষ করতে পারছি৷ হাত কাঁপছে, শক্ত হাতে চেষ্টা করছি সড়কি ধরে রাখার৷ ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কান্ড ঘটল৷ আমরা প্রাচীরের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছিলাম সে সময়৷ হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি ধুপ করে লাফিয়ে নামল আমাদের কাছেই৷ তারপর দ্রুত ছুটে এসে ঢালটা কুড়িয়ে নিয়ে দাঁড়াল সিংহর মুখোমুখি৷ বর্ম-আবৃত লোকটার একহাতে ঢাল অন্য হাতে থ্রোশীয় ছোরা৷ চাঁদের আলোতে চিনতে পারলাম তাকে, ক্রাসাস!!
সিংহটাও মনে হয় মৃদু চমকে গেছিল হঠাৎ আরও একটা দোপেয়ে প্রাণীর আবির্ভাবে৷ কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বিকট গর্জন করে লাফ দিলে ক্রাসাসকে লক্ষ্য করে৷ ক্রাসাস ঢাল দিয়ে প্রতিহত করল তার আক্রমণ৷ কিন্তু তারা দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল৷ তারপর শুরু হল এক ভয়ঙ্কর লড়াই৷ ক্রাসাস আর সিংহটা দু-জন দু-জনকে লক্ষ্য করে চালাতে লাগল থ্রোশীও ছোরা আর তীক্ষ্ণ নখর৷ ক্রাসাসের চিৎকার আর সিংহর গর্জনে কেঁপে উঠতে লাগল এরিনা৷ আর ওপর থেকে ভেসে আসতে লাগল ব্যাটিয়েটাস আর ম্যাসিডোর পৈশাচিক আনন্দধ্বনি৷ ক্রাসাস আর সিংহটা লড়তে লড়তে ক্রমশ এগোতে লাগল গ্যালারির দিকটাতে৷ একসময় ক্রাসাস আর সিংহটা দুজনেই পরস্পরের থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল শেষ অক্রমণ হানার জন্য৷ এই সময় আমি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়ে সড়কিটা ছুড়লাম সিংহটাকে লক্ষ্য করে৷ কিন্তু সেটা লক্ষভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে পড়ল ক্রাসাস আর সিংহটার মাঝখানে৷ সিংহটার আঘাত না লাগলেও ব্যাপারটাতে ক্রাসাসের প্রতি মনঃসংযোগ মুহূর্তের জন্য ছিন্ন হল তার৷ নতুন শত্রুকে দেখার জন্য সে দৃষ্টি ফেরাল আমাদের দিকে৷ আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগল ক্রাসাস৷ বিদ্যুতের মতো সড়কিটা তুলে নিয়ে প্রচন্ড জোড়ে সে আঘাত হানল সিংহটাকে লক্ষ্য করে৷ সড়কিটা এঁফোড়-ওঁফোড় হয়ে বসে গেল প্রাণীটার কাঁধে৷ সিংহর রক্তজল করা আর্তনাদে কেঁপে উঠল অ্যাম্পিথিয়েটরের পাথুরে কাঠামো৷ যেন ব্রজপাত হল! আতঙ্কিত প্রাণীটা এরপর প্রতি আক্রমণে না গিয়ে পালাবার জন্য সড়কি বেঁধা অবস্থাতেই ছুটল গ্যালারির দিকে৷ দশফুট লম্বা পরিখা এক লাফে অতিক্রম করে সে উঠতে শুরু করল গালারি বেয়ে৷ ব্যাটিয়েটাস বা ম্যাসিডো কেউই প্রস্তুত ছিলেন না এ অবস্থার জন্য৷ তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিদ্যুৎ গতিতে প্রাণীটা পৌঁছে গেল সেখানে৷ তার সামনে পড়ে গেলেন ব্যাটিয়েটাস৷ মৃত্যুপথযাত্রী প্রাণীটা প্রচণ্ড জান্তব আক্রোশে মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন করে দিল তাঁকে৷ তারপর গ্যালারির মাথায় উঠে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাইরে মহাশূন্যে ঝাঁপ দিল৷ তার শেষ গর্জন মিলিয়ে গেল৷ আর ম্যাসিডো আতঙ্কে পালাতে গিয়ে গ্যালারি থেকে ছিটকে পড়লেন পরিখার অন্ধকারে৷ আমরা ছুটে গেলাম ক্রাসাসের কাছে৷ সে তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে৷ আমি তার কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে চিৎকার করে ডাকলাম তার নামধরে৷ কিন্তু কোনো উত্তর মিলল না৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার দেহ৷ পাশে পড়ে আছে গ্ল্যাডিয়েটরের থ্রোশীও ছোরা৷ আর এরপরই যেন অ্যাম্পিথিয়েটরের বাইরে থেকে সাইরেনের তীব্র শব্দ ভেসে এল৷ কিছু ধুপধাপ পদশব্দ, বেশ কয়েকটা ছায়ামূর্তি প্রাচীর টপকে প্রবেশ করল ভিতরে৷ অনেকগুলে টর্চের আলোতে ধাঁধিয়ে গেল আমার চোখ৷
৬
পাঁচদিন পর ভিয়াডেল ইম্পোরার সন্নিকটে সেই বস্তিতে ক্রাসাসের আধো অন্ধকার ঘরে উপস্থিত ছিলাম আমরা৷ বেলা দশটা বাজে৷ রোম থেকে দেশে ফেরার জন্য রাতের ফ্লাইট ধরব৷ আমাদের সামনে শুয়ে আছে ক্রাসাস৷ সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ৷ গতকালই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে৷ সিংহের থাবায় মারাত্মক জখম হলেও অদম্য মনের জোর আর ডাক্তারদের চেষ্টায় যমরাজকেও হারিয়ে দিয়েছে গ্ল্যাডিয়েটর৷ ক্রাসাসের মাথার কাছে বসে তার বাচচা মেয়েটা অবাক চোখে দেখছিল আমাদের৷ আমরা ক্রাসাসের বাড়িতে এসেছি দুটো কারণে৷ এক, রোম ছাড়ার আগে তাকে শেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে, দুই, তার মেয়ের চিকিৎসার জন্য যৎসামান্য অর্থ দান করতে চাই জুয়ান আর আমি৷
সেদিন রাতে ওই অঞ্চল দিয়ে একটা পুলিশ প্যাট্রোল যাচ্ছিল৷ দূর থেকে সিংহর গর্জন শুনে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করার জন্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় তারা৷ শেষ পর্যন্ত তারাই আমাদের উদ্ধার করে রোমে ফিরিয়ে আনে৷ ক্রাসাসকে হাসপাতালে পাঠায়৷ তবে মিস্টার ব্যাটিয়েটাসকে বাঁচানো যায়নি৷ মৃত্যুর আগে সিংহটা শেষ কামড় বসিয়েছিল তার ঘাড়ে৷ ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়৷ আর মিস্টার ম্যাসিডোকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ তার বিরুদ্ধে আমদের সিংহের মুখ ফেলে খুনের চেষ্টার মামলা রুজু হয়েছে৷ তবে এই ভয়ঙ্কর ঘটনাতে জড়িয়ে গিয়ে আমাদের রোম ভ্রমণ অনেকটাই বিঘ্নিত হয়েছে৷ ফ্লোরেন্সে আর আমাদের যাওয়া হয় নি৷ আশেপাশের কয়েকটা জায়গা দেখে সময় কাটিয়েছি৷
ক্ষীণ কণ্ঠে ক্রাসাস বলছিল তার কথা,— ‘মিস্টার ব্যাটিয়েটাসের নানা পেশার আড়ালে ছিল আরও একটা গোপন পেশা৷ এখনও কিছু মানুষ আছে যারা সেই প্রাচীন যুগের রোমানদের মতো রক্ত দেখে আনন্দ উপভোগ করে৷ সাধারণ খেলাধূলা বা মনোরঞ্জন সামগ্রী তাদের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা হিংস্র মানুষটাকে তৃপ্ত করতে পারে না৷ শুধু প্রাচীন রোমে নয়, আজও পৃথিবীর নানা জায়গাতে ছড়িয়ে আছে এ সব হিংস্র প্রবৃত্তির মানুষ৷ যেমন ধনকুবের গ্রীক মাসিডো৷ আর এ সব মানুষকে রোমে এনে মোটা অর্থের বিনিময় গ্ল্যাডিয়েটরের খেলা দেখাতো ব্যাটিয়েটাস৷ সে জন্যই ওই প্রাচীন অ্যাম্পিথিয়েটর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিল সে৷ রোমে বেশ কয়েকটা থিয়েটার হল চালাতো সে, তার সঙ্গে পশুবিক্রির ব্যবসা৷ তাঁর কাছে পশুতো থাকবেই৷ ফলে প্রশাসন বা সাধারণ মানুষের পক্ষে তার ওই আসল ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব ছিল না৷ মাত্র কয়েকজন খবরটা জানত৷ আমি ছাড়া তারা কেউই আর বেঁচে নেই৷ কারণ, তারা প্রত্যেকেই গ্লাডিয়েটার৷ তার মধ্যে একজন ছিলেন আমার স্ত্রী৷ গতবছর একই দিনে একই জায়গাতে নেকড়ের কামড়ে মৃত্যু হয় তাঁর৷ সেবার ভেনিস থেকে এক ধনকুবের এসেছিল মহিলা গ্ল্যাডিয়েটারের খেলা দেখবে বলে৷ আমি স্ত্রীকে এরিনায় নামতে বারণ করেছিলাম, কিন্তু মেয়ের চিকিৎসার কথা ভেবে…৷’ ক্রাসাস তার কথা শেষ করতে পারল না৷ বাষ্পরুদ্ধ হয় এল তার কণ্ঠ৷ আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম৷
কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে সে বলতে শুরু করল, ‘গাইডের কাজ করে যে সামান্য টাকা পাই তাতে মেয়ের চিকিৎসা করা যাচ্ছে না৷ সেদিন রাতে এরিনায় নামার জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই আমাকে রাজি করাবার চেষ্টা করছিল ব্যাটিয়েটাস৷ উভয় সংকটে পড়ে গেছিলাম আমি৷ একদিকে ভয় যে আমার কিছু হলে মেয়েটার কি হবে? আর অন্য দিকে বেঁচে ফিরে এলে মেয়েটার চিকিৎসার সুবিধা হবে৷
যাই হোক, ঘটনাচক্রে আপনাদের নিয়ে আমি সেদিন সেখানে উপস্থিত হালম৷ ব্যাটিয়েটাসও আমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে চাপ দিতে লাগল৷ আমি প্রাণীটাকে দেখলাম৷ এ যাবৎ ব্যাটিয়েটাস যে প্রাণীগুলোকে লড়াইয়ে নামিয়েছে সেগুলো সাধারণত হত সার্কাসের বুড়ো অথবা আফিম খাওয়ানো কমজোর প্রাণী৷ যেমন ছিল নাটকের সিংহীটা৷ সাধারণ মানুষ অবশ্য এসব ধরতে পারে না৷ কিন্তু সেই সিংহটা তেমন ছিল না৷ সদ্য তাকে আফ্রিকা থেকে এনেছে ব্যাটিয়েটাস৷ যাকে বলে, একদম সত্যিকারের সিংহ৷ তাকে দেখে আমি ব্যাটিয়েটাসকে না বলে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু ব্যাটিয়েটাস তবুও চাপাচাপি করতে লাগল৷ আমি তাকে নিরস্ত করতে করতে পঞ্চাশ হাজার চাই বলতেও সে রাজি হয়ে গেল! এই সময় আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলল৷ ভাবলাম, এতগুলো টাকা! টাকাগুলো আমি নেব ঠিকই, কিন্তু রিং-এ নামব না৷ টাকা নিয়ে রোমে পালিয়ে এসে মেয়েকে নিয়ে অন্যত্র হাওয়া হয়ে যাব৷ বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই টাকাটা নিয়ে নিলাম৷ তারপর নাটকের প্রথম দৃশ্য শেষ হলে, সবার অলক্ষে ওই পোশাকেই অ্যাম্পিথিয়েটার ছেড়ে রোমের পথ ধরলাম৷ সে জায়গা ছেড়ে অনেকটাই দূরে চলে এসেছিলাম৷ কাজ পরিকল্পনা মাফিকই এগোছিল৷ কিন্তু…৷’ এই বলে থামল সে৷ আমি বললাম, ‘কিন্তু, কি?’
সে বলল, ‘কিন্তু রাস্তায় হঠাৎ আমার মনে হল, আপনারা আমার ভরসায় ও জায়গাতে গেছেন৷ আপনাদের ফেলে আমি পালাচ্ছি৷ এমন হবে না তো যে আমাকে না পেয়ে আপনাদেরই ব্যাটিয়েটাস সিংহের মুখে ছেড়ে দেবে? আর ব্যাপারটাও তাই ঘটেছিল৷ চিন্তাটা মাথায় আসতেই বিবেক আমার গতিরুদ্ধ করল৷ না এগিয়ে আমি পিছনে ফিরলাম৷ আর তার পরের ঘটনাতো আপনাদের দুজনেরই জানা৷’
এরপর সে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন৷ আমার জন্য আপনাদের অনেক ক্ষতি হল৷ ফ্লোরেন্স যাওয়া হল না, দেখাতে পারলাম না নিরোর প্রসাদ, আরও কত কি৷’
প্রফেসর জুয়ান হেসে বললেন, ‘তাতে কি হযেছে, তোমার সাথে তো দেখা হল!’
বাইরে গাড়ির হর্ন শুনলাম৷ ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে এসেছি৷ তার তাড়া আছে৷ হর্ন বাজিয়ে সে ডাকছে আমাদের৷ আমাদের এবার ক্রাসাসের থেকে বিদায় নিতে হবে৷ প্রফেসর জুয়ান পকেট থেকে টাকার খামটা বার করে বিছানাতে রেখে বললেন, ‘এটা তোমার মেয়েকে দিলাম৷’
অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে ক্রাসাসের চোখ৷ কাঁপাকাঁপা হাতে সে লম্বা একটা কাগজের মোড়ক বিছানা থেকে তুলে আমার দিকে এগিয় দিয়ে বলল, ‘এটা আমি আপনাকে উপহার দিলাম৷ সড়কিটা ঠিক সময় ছুঁড়ে ছিলেন৷ ওটা না পেলে…৷’
মোড়কটা খুলেই আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ তার মধ্যে আছে সেই থ্রোশীও ছোরা আর ক্রাসাসের স্বাক্ষরিত তার দানপত্রের হলফনামা৷
আমি অবাক হলে বললাম, ‘এটা দিয়ে আমি কি করব?’
ক্রাসাস জবাব দিল, ‘ড্রইংরুমে টাঙিয়ে রাখলে দেখতে ভালো লাগবে৷ আর কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, এটা যে আমাকে দিয়েছিল সে ছিল রোমের শেষ গ্লাডিয়েটর৷’ বিদায় বেলায় বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল ক্রাসাসের মুখে৷ তবে সে হাসি মুছে দিল মেয়েটার নির্মল হাসি৷ সে যেন বুঝতে পারল ছোরাটা আমাদের দিয়ে দেবার সাথ সাথে তাদের পরিবারে বহু যুগ ধরে চলে আসা এক অভিশপ্ত পেশার পরিসমাপ্তি হল৷ সে জড়িয়ে ধরল ক্রাসাসের গলা, আর ক্রাসাস তাকে৷
তার ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা৷ দূরে সবকিছুর মাথা ছাপিয়ে দেখা যাচ্ছে সূর্য্যালোকিত কলোসিয়ামের শীর্ষদেশ৷ তার মাথার ওপর উজ্জ্বল রৌদ্রে ডানা মেলেছে বিন্দুর মতো এক ঝাঁক পায়রা৷ সেদিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে প্রণাম জানালাম ক্রাসাসের পূর্ব পুরুষ সেই সব মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের প্রতি৷ রোমের ইতিহাসে যাঁদের ডাকা হয় ‘গ্ল্যাডিয়েটার’ নামে৷