ত্রিশঙ্কু অবস্থা
অনিশ্চিত অবস্থায় পড়া ব্যক্তির দশাকে সাধারণভাবে বাংলা প্রবাদে ত্রিশঙ্কু অবস্থা বলা হয়।
অযোধ্যার সূর্যবংশীয় রাজা ছিলেন ত্রিশঙ্কু। দাতা হরিশ্চন্দ্র এই ত্রিশঙ্কুর ছেলে। বশিষ্ঠমুনি ছিলেন ত্রিশঙ্কুর কুলগুরু। সশরীরে স্বর্গগমনের বাসনায় রাজা ত্রিশঙ্কু একদিন কুলগুরু বশিষ্ঠকে যজ্ঞ করতে অনুরোধ করেন। বশিষ্ঠ সে যজ্ঞ করতে অসম্মত হন। অতঃপর বশিষ্ঠের তপস্যারত পুত্রদের কাছে গিয়ে ত্রিশঙ্কু একই অনুরোধ জানান। তারা বশিষ্ঠের মতোই রাজাকে জানিয়ে দেন যে, এ যজ্ঞ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তখন ত্রিশঙ্কু বলেন যে, বশিষ্ঠ ও তার পুত্রদের অসম্মতির কারণে তিনি অন্য ঋষির শরণাপন্ন হয়ে ঐ যজ্ঞ করাবেন। বশিষ্ঠের পুত্রগণ এতে রেগেমেগে ত্রিশঙ্কুকে চণ্ডাল হবার অভিশাপ দেন।
অভিশপ্ত রাজা ত্রিশঙ্কু চণ্ডাল হয়ে এখানে সেখানে ভ্রমণ করতে থাকেন। একদিন বশিষ্ঠের প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে তিনি তার প্রার্থনা জানান। বিশ্বামিত্র তাকে আশ্বাস দিয়ে স্বয়ং যাজক (পুরোহিত) হয়ে যজ্ঞের আয়োজন করলেন। বশিষ্ঠ, বশিষ্ঠের পুত্রগণ এবং মহোদয় নামে এক ঋষি ছাড়া অন্য ঋষিরা সবাই যজ্ঞে উপস্থিত হন।
বহুকাল ধরে যজ্ঞ করার পরও যখন কোনো দেবতা যজ্ঞভাগ গ্রহণ করতে এলেন না তখন বিশ্বামিত্র ক্ষিপ্ত হয়ে ত্রিশঙ্কুকে নিজ তপস্যার বলে সশরীরে স্বর্গে উঠাতে লাগলেন। দেবরাজ ইন্দ্রসহ দেবতারা তাকে স্বর্গে স্থান দিতে অসম্মত হন। যেহেতু ত্রিশঙ্কু গুরুর অভিশাপে শাপগ্রস্ত সেহেতু স্বর্গে তিনি বাস করতে পারেন না—এই যুক্তিতে ইন্দ্র স্বর্গগমনরত ত্রিশঙ্কুকে উল্টোমুখে (মাটির দিকে মাথা দিয়ে) পৃথিবীতে অবতরণ করতে বলেন।
ত্রিশঙ্কু অধোমুখে মর্ত্যে অবতরণ করতে থাকেন। বিশ্বামিত্র তার জেদ পূরণ হচ্ছে না দেখে পতনোন্মুখ রাজাকে “তিষ্ঠ, তিষ্ঠ”, বলে ঊর্ধ্বাকাশে স্থান করে দেন এবং দক্ষিণ আকাশে অন্য এক সপ্তর্ষি-মণ্ডল ও নক্ষত্রলোক সৃষ্টি করেন তপোবলে। বিশ্বামিত্র তার সৃষ্ট জগতে নতুন দেবতা ও নতুন ইন্দ্রের সৃষ্টিতে তৎপর হলেন। বিশ্বামিত্রের এই কাজে ভীত হয়ে দেবতারা নতি স্বীকার করে মেনে নিলেন যে, তার সৃষ্ট আকাশে নক্ষত্রমণ্ডল থাকবে এবং সেখানে ত্রিশঙ্কুও দেবতুল্য হয়ে অবস্থান করবেন।
মহাভারতের খিল বা পরিশিষ্ট বলে গণ্য হরিবংশ-গ্রন্থে ত্রিশঙ্কুর আসল নাম সত্যব্রত। অন্যের স্ত্রীকে হরণ করে পিতা এষ্যরুণের অসন্তোষভাজন হন তিনি। কুলগুরু বশিষ্ঠের কামধেনুকে হত্যা করে আহার করেছিলেন ত্রিশঙ্কু। কিছু ভাগ দিয়েছিলেন বিশ্বামিত্রের পুত্রদের। ক্রুদ্ধ বশিষ্ঠ এজন্য সত্যব্রতকে ত্রিশঙ্কু (ত্রি = তিন, শঙ্ক = শলাকা শেল) নামে অভিহিত করেন। ত্রিশঙ্কুর তিন শেল বা পাপ হলো— পরস্ত্রী অপহরণ করে পিতার অসন্তোষ উৎপাদন, গুরুর গাভী হত্যা এবং অন্যায়ভাবে গো-মাংস ভক্ষণ :
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, সে যুগেই ঋষি-পণ্ডিতদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রেষারেষি ছিল; তাছাড়া কোনো কোনো মুনি ছিলেন অভিজাত দেবতাদের পছন্দের আবার কেউ কেউ ছিলেন অপছন্দের। মুনি = ঋষি বা জ্ঞানী বুদ্ধিজীবীদের ভয়ে দেবতারাও ভীত হয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। কোনো কোনো জ্ঞানীর ক্ষমতা দেবতার শক্তিকেও চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম ছিল।
যাহোক, ত্রিশঙ্কু স্বর্গে বা মর্ত্যে কোথাও অবস্থিত না হয়ে মাঝ আকাশে অবস্থিত হয়েছেন দেবতা এবং ঋষিদের দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে। আমাদের সমাজে উভয় সঙ্কটে পড়ে অনিশ্চিত অবস্থায় থাকার বিষয়টি এভাবেই ত্রিশঙ্কুর অবস্থার সাথে তুলনীয় হয়ে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।