নয়
জর্জকে আমরা বাধ্য করলাম কাজ করতে। এখন আমরা তাকে বাগে পেয়েছি। সে যে কাজ করতে চায়নি – এটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না। সে অজুহাত দেখায় যে শহরে তার ওপর দিয়ে খুব ধকল গেছে। হ্যারিসটা হলো সহানুভূতিহীন ও নির্দয় লোক। সে বলল, ‘ওহো, এখন পরিবর্তন হিসাবে তোমার ওপর দিয়ে ধকলটা যাবে নদীপথে। আর, পরিবর্তন জিনিসটা সবার জন্যই ভাল। বের হও নৌকা থেকে।
বিবেকবুদ্ধি—এমনকি জর্জের বিবেকবুদ্ধি মতেও, আপত্তি করার উপায় ছিল না—যদিও সে প্রস্তাব দিল যে নৌকায় থেকে সে চা তৈরি করলে এবং আমি আর হ্যারিস দাঁড় বাইলেই বোধ হয় ভাল হত, কারণ চা তৈরি করাটা বড্ড ঝামেলার কাজ এবং হ্যারিস আর আমাকে বেশ কাহিল দেখাচ্ছে। জবাবে আমরা শুধু গুণটা বাড়িয়ে ধরলাম তার দিকে। সে ওটা নিয়ে নেমে গেল নৌকা থেকে।
গুণের দড়ির মধ্যে কিছু একটা আছে যা বড় অদ্ভুত ও দুজ্ঞেয়। একজোড়া নতুন পায়জামা যে রকম যত্নের সঙ্গে ভাঁজ করা হয় ঠিক সে রকম যত্নে দড়িটা গুটিয়ে রাখলেও মিনিট পাঁচেক পরেই দেখা যায় যে ওটা ভয়ানক বিশ্রীভাবে জট পাকিয়ে আছে।
এই গুণের দড়িটা আমি তুলে নিয়েছিলাম লকে পৌঁছার ঠিক আগে— হ্যারিসকে ওটা ছুঁতে দিইনি, কারণ সে অসাবধান। আমি ওটাকে ধীরে ধীরে এবং সতর্কভাবে গোল করে পেঁচিয়ে দু’ভাঁজ করে আলতোভাবে নৌকার তলায় রেখে দিই। হ্যারিস বিজ্ঞানসম্মতভাবে ওটাকে তুলে জর্জের হাতে দেয়। জর্জ শক্ত করে ধরে নিজের শরীরে না ছুঁইয়ে নবজাত শিশুর কাঁথাকাপড় খোলার মত যত্নসহকারে খুলতে থাকে দড়ির কুণ্ডলীটা। কয়েক গজ খুলতে না খুলতেই জিনিসটা হয়ে যায় আনাড়ী হাতে তৈরি পাপোশের মত।
এই একই ধরনের কাণ্ড ঘটে প্রায় সব সময়। নদীতীরে বসে বসে যে লোকটা জট ছাড়াবার চেষ্টা করছে সে ভাবে, সব দোষ যে লোকটা দড়িটি গুটিয়েছিল তার। আর, নদীপথে মানুষ যা ভাবে সেটাই বলে ফেলে, ‘কি করতে গিয়েছিলে তুমি এটা দিয়ে? মাঝ ধরার জাল বানাতে? কি বিদঘুটে গোলমালই না বাধিয়ে বসেছ, দেখো তো? বুদ্ধু কোথাকার, ঠিকমত গুটিয়ে রাখতে পারোনি?’ দড়িটা পাগলের মত টানাটানি করতে করতে এসব বলে গজরাতে থাকে মাঝে মাঝে, ছড়িয়ে রাখে দড়িটা গুণ টানার পথের ওপর, ওটার শেষ প্রান্তটা কোথায় তা খুঁজে বের করার জন্য ঘুরতে থাকে চক্রাকারে।
ওদিকে, দড়িটা গুটিয়ে রেখেছিল যে লোক সে ভাবে, ওই জগাখিচুড়ি কাণ্ডটার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী হচ্ছে এখন দড়িটা যে খুলতে চেষ্টা করছে সেই লোকটা। কাজেই রেগেমেগে সে জবাব দেয়, তুমি যখন নিলে তখন তো ওটা ঠিকই ছিল। কি করতে যাচ্ছ সেটা তুমি আগেই ভেবে দেখলে না কেন? তোমার কাজকর্মের ঢংটাই হলো বেপরোয়া বেখেয়াল। তোমার হাতে পড়লে ফাঁসিকাঠের খুঁটি পর্যন্ত জট পাকিয়ে যাবে। হ্যাঁ, ঠিকই জট পাকিয়ে যাবে।’
এভাবে কথা কাটাকাটি করতে করতে একে অন্যের ওপর তারা এমন রেগে যায় যে তাদের ইচ্ছা হয় পরস্পরকে ওই দড়িতে ঝুলিয়ে দিতে। প্রথম লোকটা, অর্থাৎ দড়ির জট খুলতে ব্যস্ত লোকটা, মিনিট দশেক পর এক চিৎকার দিয়ে খেপে ওঠে, নাচতে থাকে দড়ির ওপর, যেখানেই হাত পড়ে দড়ির সেই অংশটা ধরে সোজা টেনে খুলতে চেষ্টা করে। এতে অবশ্য জটটা আরও শক্ত হয়ে এঁটে বসে। এমন সময় দ্বিতীয় লোকটা নৌকা থেকে নেমে আসে তাকে সাহায্য করতে এবং একে অন্যের পথ আটকে তারা কাজে বিঘ্ন ঘটাতে থাকে। দড়ির একটা অংশ ধরে দু’জনে দু’দিকে টানে এবং আশ্চর্য হয়ে ভাবে—কোথায় আটকে গেল। শেষ পর্যন্ত জটটা তারা ছাড়ায়। তারপর পেছন ফিরে দু’জনে দেখে যে নৌকাটা যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে নেই, স্রোতের টানে সোজা ছুটে চলেছে বাঁধের দিকে
এ রকম ঘটনা সত্যি আমার জানামতে একবার ঘটেছিল। এক ঝড়ো সকালে, বোভেনির কাছে। আমরা যাচ্ছিলাম ভাঁটির দিকে। নদীর বাঁকটা ঘুরে আসতেই আমাদের নজরে পড়ল তীরে দাঁড়িয়ে দু’জন লোক পরস্পর মুখ চাওয়া—চাওয়ি করছে। যে বিভ্রান্তি আর হতাশার করুণ অভিব্যক্তি আমি লক্ষ করলাম তাদের চোখেমুখে তেমনটি এর আগে বা পরে আর কোন মানুষের মুখে দেখিনি। দু’জনের হাতে ধরা ছিল একটা লম্বা গুণের দড়ি। বুঝলাম যে অঘটন কিছু একটা ঘটেছে। তাই নৌকার গতি কমিয়ে জানতে চাইলাম ব্যাপার কি।
ক্রুদ্ধভাবে তারা জবাব দিল, ‘ব্যাপার আর কি, আমাদের নৌকা ভেসে গেছে! গুণের দড়ির জট ছাড়াতে নিচে নেমেছিলাম আমরা। জট খুলে ফিরে দেখি নৌকা নেই!’
মনে হলো, নৌকার এই ভেসে যাওয়াটাকে একটা ঘৃণ্য ও অকৃতজ্ঞতার কাজ বলে গণ্য করে তারা আহত।
আধ মাইল ভাঁটিতে গিয়ে আমরা খুঁজে পেলাম ওদের পলাতককে, আটকে আছে নল-খাগড়ার ভেতর। নৌকাটাকে এনে আমরা ফেরত দিই ওদের কাছে। অন্তত সপ্তাখানেকের মধ্যে ওই নৌকাটাকে পালাবার আরেকটা সুযোগ যে তারা দেয়নি এটা আমি বাজি রেখে বলতে পারি।
গুণের দড়ি হাতে নিয়ে নদীতীরে লোক দুটোর একবার এদিকে, একবার ওদিকে ঘুরে ঘুরে নৌকা খোঁজার দৃশ্যটা আমি কোনদিন ভুলব না।
গুণ টানার সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক মজার ঘটনাই চোখে পড়ে নদীপথে। একটা খুব সাধারণ ঘটনা হলো: দু’জনে মিলে গুণ টানছে, জোর কদমে হেঁটে যাচ্ছে কোন একটা বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করতে করতে, আর তাদের থেকে মাত্র শ’খানেক গজ পেছনে যে লোকটা বসে রয়েছে নৌকায় সে বৃথাই চেঁচাচ্ছে তাদেরকে থামাবার জন্য, বৈঠা ঘুরিয়ে পাগলের মত বিপদ সঙ্কেত দেখাচ্ছে। কিছু একটা বিঘ্ন নিশ্চয়ই ঘটেছে। হাল ভেঙেছে, কিংবা নৌকার আঁকড়া খুলে নিচে পড়ে গেছে, অথবা তার হ্যাটটি পানিতে পড়ে গিয়ে স্রোতের টানে দ্রুত ভেসে যাচ্ছে। সে তাদেরকে বলছে থামতে। প্রথমটায় বেশ ভদ্র মোলায়েমভাবে, ‘এ্যাই, থামো তো একটু, আমার হ্যাট পড়ে গেছে পানিতে।’
তারপরে, ‘এ্যাই—টম, ডিক! শুনতে পাচ্ছ না?’ এবার তেমন ভদ্রভাবে নয়।
শেষে, ‘এ্যাই গবেট বুদ্ধুরা, গোল্লায় যা তোরা! এ্যাই—থাম বলছি! আহ্ কি এরপর লাফিয়ে উঠে চারদিকে নাচানাচি জুড়ে দেয় সে, চেঁচিয়ে মুখচোখ লাল করে ফেলে, পাইকারীভাবে পরিচিত সব কিছুকে গালিগালাজ দিতে থাকে। তখন নদীর তীরে জমায়েত বাচ্চা ছেলেরা দলবেঁধে টিটকারি দেয় তাকে, ঘণ্টায় চার মাইল বেগে টানের চোটে নৌকাটা কাছে আসতেই বাচ্চারা ঢিল মারে তাকে লক্ষ্য করে, সে নামতে পারে না নৌকা থেকে।
যারা গুণ টানছে তারা যদি গুণ টানছে এ কথাটা মনে রাখে এবং মাঝেমধ্যে পেছন ফিরে নৌকায় বসা তাদের লোকটির হাল-অবস্থা লক্ষ করে, তাহলে এধরনের ঝামেলার অনেকটাই এড়ানো যায়। গুণ টানতে একজনকেই দেয়া সবচেয়ে ভাল। দু’জনে গুণ টানতে গেলেই শুরু হয় গালগল্প। তারা ভুলে যায় যে গুণ টানছে। নৌকা এতে কোন বাধাই দিতে পারে না, কোন বাস্তব ভূমিকাই পালন করতে পারে না গুণ টানার কথাটা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে।
দু’জনে গুণ টানতে গিয়ে লোকে কেমন সম্পূর্ণভাবে গুণ টানার কথাটা ভুলে যায় তার দৃষ্টান্ত হিসাবে অতি অদ্ভুত একটা ঘটনার কথা জর্জ আমাদেরকে বলল সন্ধ্যার পরে। আমরা তখন রাতের খাওয়া শেষ করে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
জর্জ বলল, একদিন সন্ধ্যায় সে আর অন্য তিনজন লোক মেইডেনহেড থেকে একটা ভারি বোঝাই করা নৌকা দাঁড় বেয়ে নিয়ে যাচ্ছিল উজানের দিকে। কুকল্যাণ্ড লক পেরিয়ে কিছুদূর যাবার পর তারা লক্ষ করল এক তরুণ আর এক তরুণী গুণ টানার পথে হেঁটে যাচ্ছে। দু’জনে গভীর ও মজার আলাপে মত্ত। নৌকার একটা আঁকড়া বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দু’জনে মিলে। আঁকড়াটার সঙ্গে লাগানো রয়েছে গুণটা। গুণটা যাচ্ছে তাদের পিছু পিছু। ওটার শেষ অংশটা রয়েছে পানির মধ্যে। ধারে কাছে কোন নৌকা নেই, দেখা যাচ্ছে না। কোন না কোন সময় ওই গুণটার সঙ্গে একটা নৌকা নিশ্চয়ই বাঁধা ছিল। কিন্তু নৌকাটার কি হয়েছে, ওটার মধ্যে যারা ছিল তাদের কি ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে গেছে, সেটা রহস্যে ঢাকা। তবে যে দুর্ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন তা ওই তরুণ-তরুণীর কোন অসুবিধাই ঘটায়নি। তাদের হাতে ছিল আঁকড়া আর গুণের দড়ি। তারা হয়তো ভেবেছে যে তাদের কাজের জন্য এ দুটো জিনিস থাকলেই চলে।
তাদেরকে কল্পনার রাজ্য থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য জর্জ ডাক দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার মাথায় একটা চমৎকার মতলব খেলে গেল। তাই ডাক আর সে দিল না। সে করল কি, তাদের গুণের শেষ প্রান্তটা পানির ভেতর থেকে আঁকশি দিয়ে তুলে নিয়ে নিজেদের নৌকার মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে ঘরত্নের নৌবিহার দিল এবং তারপর চারজনে বৈঠাগুলো সামলে রেখে নৌকার পেছন দিকে গিয়ে আরামে বসে পাইপ টানতে লাগল। আর, ওই তরুণ-তরুণী চারজন ধুমসো জোয়ানসুদ্ধ ভারি নৌকাটাকে টানতে টানতে মার্লো পর্যন্ত নিয়ে গেল।
জর্জ বলল, লকে পৌঁছে ওরা বুঝতে পারে যে শেষ দুই মাইল পথ অন্য নৌকা টেনে এনেছে। তখন যে গভীর জমাট বিষাদভরা দৃষ্টিতে ওরা জর্জেদের দিকে তাকায় তেমন দৃষ্টি সে আর কোনদিন দেখেনি। জর্জ মনে করে, পাশের ওই মিষ্টি মেয়েটির সংযতকারী প্রভাব না থাকলে তরুণটি হয়তো ভীষণ গালিগালাজ শুরু করত।
প্রথম বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠার পর তরুণীটি এক হাতে অন্য হাত আঁকড়ে ধরে পাগলের মত চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ও হেনরি, খালাম্মা কোথায় গেল?’
‘বুড়িটাকে কি উদ্ধার করতে পেরেছিল ওরা?’ জানতে চায় হ্যারিস।
জবাবে জর্জ বলল যে সে জানে না।
যারা গুণ টানে, আর যারা নৌকায় থাকে এ উভয়ের মধ্যে সহানুভূতির বিপজ্জনক অভাবের আরেকটি নজির জর্জ আর আমি একবার দেখেছিলাম ওয়াল্টনের কাছে। গুণ টানার পথটি যেখানে পানির একেবারে ধার ঘেঁষে চলে গেছে সেখানেই ঘটেছিল কাণ্ডটা। আমরা তখন নদীর ওপারে বসে চারদিককার দৃশ্য দেখছিলাম। সহসা আমাদের চোখে পড়ল একটা ছোট্ট নৌকা। নৌকাটাকে প্রচণ্ড গতিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক তাগড়া বজরা-টানা ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে এক ছোট্ট ছেলে। নৌকার মধ্যে এখানে-ওখানে হাত-পা ছড়িয়ে স্বপ্নিল আরামে শুয়ে আছে পাঁচজন লোক। হালটা যার হাতে তার চেহারাতেও দেখা গেল নিশ্চিন্ত প্রশান্তির ভাব।
নৌকাটা আমাদের সামনে দিয়ে যাবার সময় জর্জ বিড়বিড় করে বলল, ‘ভুল করুক মাঝিটা, আমি চাই সে ভুল করুক।’ আর ঠিক সেই মুহূর্তে তা-ই করে বসল লোকটা। ফলে, চল্লিশ হাজার লিনেনের চাদর ছেঁড়ার মত আওয়াজ তুলে নৌকাটা ছুটে গিয়ে ধাক্কা খেলো তীরে। দু’জন আরোহী, একটা বড় ঝুড়ি, তিনটা বৈঠা তক্ষুণি উৎক্ষিপ্ত ও কাত-চিৎ হয়ে পড়ল ডাঙায়। আর দু’জন নৌকার ডান পাশ দিয়ে নেমে ধপাস করে বসে পড়ল আঁকড়া, পাল, কার্পেটের ব্যাগ আর শিশি-বোতলের মধ্যে। সর্বশেষ লোকটি নামল গিয়ে বিশ গজ দূরে মাথায় ভর দিয়ে।
এতে নৌকাটা বোধ হয় হালকা হলো একটুখানি এবং তরতর করে ছুটে চলল। বাচ্চাছেলেটি গলা চড়িয়ে তাগিদ দিতে লাগল তার ঘোড়াকে আরও জোরে ছোটার জন্য। লোকগুলোর কয়েক সেকেণ্ড লাগল কি ঘটে গেছে সেটা বুঝে উঠতে। তবে বুঝতে পারার পর ওরা তারস্বরে চেঁচাতে লাগল বাচ্চাটাকে থামাবার জন্য। কিন্তু ছেলেটা তখন তার ঘোড়া নিয়ে এতই মত্ত যে ওদের চেঁচামেচি তার কানে গেল না। যতদূর দৃষ্টি যায় আমরা দেখলাম চিৎকার করতে করতে লোকগুলো ছুটে যাচ্ছে বাচ্চাটার পিছু পিছু।
ওদের দুর্দশা দেখে দুঃখিত হয়েছিলাম এমন কথা আমি বলতে পারি না। সত্যি আমি চাই, যেসব বোকারা এভাবে নৌকার গুণ টানায় ওদের কপালে অনুরূপ দুর্ভোগই ঘটুক। ওরা নিজেরা যে ঝুঁকি নেয় সেটা ছাড়াও ওদের পথে অন্য যেসব নৌকা পড়ে তাদের প্রত্যেকটির জন্য ওরা বিপদ ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে গতিতে ওরা যায় তাতে ওদের পক্ষে অন্যের পথ থেকে সরে যাওয়া বা ওদের পথ থেকে অন্য কারও পক্ষে সরে যাওয়া সম্ভব নয়। ওদের গুণ আটকে যায় অন্যের মাস্তুলে, উল্টে দেয় অন্যের নৌকা, কিংবা অন্য নৌকার কারও দেহে বেধে গিয়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পানিতে, অথবা কারও মুখটা কেটে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল পন্থা হচ্ছে হুঁশিয়ার থাকা এবং লগি বা মাস্তুলের গোড়া দিয়ে গুঁতো মেরে ওদেরকে সরিয়ে দেয়া।
গুণ টানার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাকর হচ্ছে মেয়েদের দিয়ে গুণ টানিয়ে নেয়া। এ হলো এমন এক অনুভূতি যা কারও পক্ষেই হারানো উচিত নয়। গুণ টানতে সব সময় তিনজন মেয়ে লাগে দু’জন গুণ টানে, অন্যজন ওদের চারদিকে ঘুরে ঘুরে খিক খিক্ করে হাসতে থাকে। সাধারণত প্রথমেই ওরা নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে গুণের দড়িতে। দড়ি ওদের পায়ে জড়িয়ে যায়। তখন পথের ওপর বসে ওরা পরস্পরকে দড়ি থেকে ছাড়ায়। তারপর দড়িটাকে নিজেদের ঘাড়ে পেঁচিয়ে নেয় ওরা এবং দম আটকে প্রায় মরতে বসে। তবে শেষ পর্যন্ত গুণটাকে সোজা করে নিয়ে ওরা ছুটতে শুরু করে। শ’খানেক গজ গিয়েই স্বাভাবিকভাবে দম হারিয়ে হঠাৎ থেমে যায় এবং সবাই ধপাস করে ঘাসের ওপর বসে পড়ে হাসতে থাকে হি হি করে। ওদিকে, নৌকাটি তখন স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলে যায় মাঝ-দরিয়ায় এবং নৌকার আরোহীরা কি ঘটেছে সেটা বুঝে ওঠা কিংবা বৈঠা ধরার আগেই নৌকা ঘুরে যায় উল্টো দিকে। তখন উঠে দাঁড়িয়ে কাণ্ডটা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় ওরা, বলে, ‘আরে দেখ দেখ! মাঝখানে চলে গেছে।’
এরপর কিছুক্ষণ ধীরস্থিরভাবে টানে ওরা। তারপর হঠাৎ একজনের ইচ্ছা হয় ফ্রকে পিন আঁটার। ফলে, থেমে যায় ওরা এবং নৌকা বেধে যায় তীরে।
তখন লাফিয়ে উঠে লগি দিয়ে ঠেলে তীর থেকে নৌকা থামাও তুমি, চেঁচিয়ে ওদেরকে বলো থামতে।
পাল্টা চিৎকার করে ওরা জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে, এ্যাঁ?’
‘থেমো না,’ গর্জন করে বলো তুমি।
‘কি করব না?’
‘থেমো না—এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও!’
‘এমিলি, গিয়ে দেখে এসো তো কি চায় ওরা,’ বলে একজন।
এমিলি এসে প্রশ্ন করে, ‘কি চাও তোমরা? কি হয়েছে?’
‘হয়নি কিছু, ঠিক আছে সব, শুধু এগিয়ে যাও—থেমো না, বুঝলে?’
‘থামব না কেন?’
‘কেন? আরে তোমরা বার বার থামলে হাল ধরে নৌকার দিক ঠিক রাখা যায় না। নৌকার চলার জন্যে কিছুটা জায়গা রাখতেই হবে তোমাদেরকে।’
‘কি রাখতে হবে?’
“কিছু জায়গা, পথ—নৌকাকে চালু রাখতে হবে।’
‘ও, ঠিক আছে, আমি বলব ওদেরকে। আমরা ঠিকভাবে টানছি তো?’
‘হ্যাঁ, খুব চমত্কার টানছ, সত্যি, কেবল থেমে যেয়ো না।’
“কাজটা মোটেই কঠিন মনে হচ্ছে না। আমি ভেবেছিলাম কত কঠিন।’
‘আরে না, খুব সহজ কাজ। কেবল ধীরস্থিরভাবে টেনে নেয়া— এই যা।’
‘তাই দেখছি। আচ্ছা, আমার লাল শালটা বের করে দাও তো, গদির নিচে আছে ওটা।’
শাল বের করে দিলে তুমি। ততক্ষণে আরেকজন এসে বলে যে তারটাও চাই। মেরীর শালটাও নিয়ে যায় ওরা দরকার হতে পারে ভেবে। কিন্তু মেরীর শালের দরকার নাই, কাজেই ওটা ফিরিয়ে এনে একটা পকেট চিরুণী নিয়ে যায় ওরা। এভাবে প্রায় বিশ মিনিট কাটিয়ে দেয়ার পর আবার যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী মোড়ে পৌঁছেই ওরা দেখে যে পথের ওপর একটা গরু দাঁড়িয়ে আছে। তখন তোমাকে নৌকা থেকে নেমে গিয়ে গরু তাড়িয়ে দিয়ে আসতে হয়।
মেয়েরা গুণ টানলে একটা মুহূর্তও বিরস লাগে না।
জর্জ গুণ টেনে কিছুক্ষণ পরে আমাদেরকে পৌঁছে দিল পেণ্টন হুক পর্যন্ত সেখানে গিয়ে আমরা রাত কাটানোর প্রশ্ন আলোচনা করলাম। আমরা ওই রাতটা নৌকায় কাটাব বলে ঠিক করেছিলাম। সুতরাং আমাদের সামনে তখন দুটো পন্থাগু ওখানেই যাত্রা-বিরতি করা, কিংবা স্টেইনেস পার হয়ে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়া। তবে সূর্য তখনও ছিল আকাশে। এতে আমাদের মনে হয় যে যাত্রাবিরতির সময় হয়নি। কাজেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে সাড়ে তিন মাইল সামনে রুনিমিড পর্যন্ত এগিয়ে যাব। ওখানে নদীর দু’পারে স্নিগ্ধ শান্ত বনভূমি রাত কাটাবার চমৎকার আশ্রয়।
পরে অবশ্য আমাদের সবারই মনে হয়েছে যে পেণ্টনে থেকে গেলেই পারতাম। খুব ভোরে নদীর উজানে তিন চার মাইল পথ কিছুই না, কিন্তু দীর্ঘদিনের শেষে গুণ টেনে এপথ পার হওয়া বড্ড ক্লান্তিকর। এ শেষ ক’মাইল যেতে প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রতি নজর দেয়ার কোন আগ্রহই জাগে না, গালগল্প হাসি—ঠাট্টা মুখে আসে না। প্রতি আধ মাইল পথকে মনে হয় এক মাইল। বিশ্বাস হতে চায় না যেখানে আছি ঠিক সেখানটাতেই রয়েছি। দৃঢ় বিশ্বাস জাগে যে ম্যাপটা ভুল। তারপর শ্রান্ত পায়ে চলতে চলতে যখন মনে হয় যে অন্তত দশ মাইল চলে গেছি—অথচ লকটি চোখে পড়ছে না—তখন সত্যি ভয় হতে থাকে যে লকটাকে কেউ হয়তো চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।
মনে পড়ে, আমি একবার নদীতে ভীষণ বিপাকে পড়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল এক তরুণী—মায়ের দিক থেকে সম্পর্কিত বোন। যাচ্ছিলাম গোরিংএ। দেরি হয়ে গেছিল বেশ। আমরা, মানে আমার সেই সম্পর্কিত বোনটি, গন্তব্যে পৌঁছার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। সাড়ে ছয়টায় যখন আমরা বেনসন লকে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এ সময় সে উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগল। বলল যে রাতের খাওয়ার সময় তাকে উপস্থিত থাকতে হবে। আমি বললাম, ও সময় আমিও উপস্থিত থাকতে চাই। আমার কাছে একটা ম্যাপ ছিল। গন্তব্য কত দূরে রয়েছে তা দেখার জন্য ম্যাপটা বের করলাম। দেখলাম, পরের লকটা—ওয়ালিংফোর্ড—মাত্র দেড় মাইল দূরে এবং সেখান থেকে পাঁচ মাইল গেলে ক্লীভ।
‘আরে, ঠিকই আছে সব। সাতটার আগেই পৌঁছে যাব সামনের লকে। তারপর থাকবে আর একটা মাত্র লক,’ বলে নড়েচড়ে বসে আমি শক্ত হাতে দাঁড় টেনে চললাম।
পুলটা পার হয়ে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম লকটা নজরে পড়ছে কিনা। সে বলল -না, কোন লক দেখছে না।
‘দেখা যাচ্ছে না?’ বলে দাঁড় টানতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক পর আবার ওকে বললাম দেখতে।
না, লকের কোন চিহ্নই দেখছি না,’ বলল সে।
সে যাতে মনঃক্ষুণ্ণ না হয় তার জন্য একটু দ্বিধার সুরে প্রশ্ন করলাম, ‘লক কি জিনিস তা ঠিক জানো তো? লক দেখলে চিনতে পারো তো যে ওটা লক?’
প্রশ্নটা অবশ্য মনঃক্ষুণ্ণ করেনি ওকে। ও বলল, আমার নিজেরই দেখে নেয়া উচিত। তাই দাঁড় তুলে রেখে দেখলাম ভাল করে। গোধূলির অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল সামনে সোজা মাইলখানেক পর্যন্ত বিস্তীর্ণ নদী, লকের চিহ্নও নাই।.
পথ হারিয়েছ বলে মনে হচ্ছে না তো? কি বলো, পথ হারিয়ে ফেলেছ?’ প্রশ্ন করল আমার সঙ্গী
সেটা কেমন করে সম্ভব তা “আমার বোধগম্য হলো না। তবু বললাম যে আমরা হয়তো কোনরকমে বাঁধের স্রোতের মধ্যে—যেখানটায় পানি প্রপাতের মত খাড়া নিচে গড়িয়ে পড়ছে—সেদিকে ছুটে চলেছি।
এ কথাটা মোটেই আশ্বস্ত করতে পারল না ওকে। কাঁদতে লাগল সে। বলল, আমরা দু’জনেই ডুবে মরব, আমার সঙ্গে বেড়াতে আসার দরুনই ওর এ শাস্তি হচ্ছে।
আমার মনে হলো শাস্তিটা একটু যেন বেশি মাত্রায় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমার বোনটির তা মনে হলো না। সে চায় যা হবার হয়ে যাক তাড়াতাড়ি।
চেষ্টা করলাম ওকে আশ্বস্ত করতে এবং গোটা ব্যাপারটাকে হালকা করে তুলতে। বললাম, এটা পরিষ্কার যে আমি যত জোরে দাঁড় টানছিলাম বলে ভেবেছি আসলে তত জোরে টানিনি। তবে এখন শিগগিরই লকে পৌঁছে যাব আমরা।
আরও এক মাইল বেয়ে গেলাম। তারপর নিজেই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলাম। ম্যাপটা খুলে আবার দেখলাম। বেনসন লকের দেড় মাইল দূরে ওই তো লেখা রয়েছে ওয়ালিংফোর্ড লক, পরিষ্কার চিহ্ন দেয়া। ম্যাপটা ভাল এবং নির্ভরযোগ্য। তাছাড়া আমার নিজেরই মনে আছে লকটার কথা। দু’বার আমি পার হয়েছি ওটার ভেতর দিয়ে। কিন্তু কোথায় আছি আমরা এখন? কি হয়েছে আমাদের? ভাবতে লাগলাম, এটা নিশ্চয়ই একটা স্বপ্ন, বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছি আমি। এখনই জেগে উঠে শুনব যে দশটা বেজে গেছে।
বোনটিকে জিজ্ঞেস করলাম এটা স্বপ্ন হতে পারে বলে ওর মনে হয় কিনা। জবাবে সে বলল যে এই মাত্র একই প্রশ্ন সে-ও করতে যাচ্ছিল আমাকে। এরপর আমরা উৎসুক হয়ে উঠলাম একথা জানতে যে আমরা দু’জনেই ঘুমিয়ে আছি কিনা এবং যদি তা-ই থাকি তবে দু’জনের মধ্যে কে আসল, আর কে শুধু স্বপ্ন। খুবই আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়াল ব্যাপারটা।
অবশ্য তখনও আমি দাঁড় টেনে যাচ্ছি এবং তখনও কোন লক নজরে আসছে না। রাতের ঘনায়মান ছায়ার তলে ক্রমেই বেশি বেশি করে আঁধার ও রহস্যময় হয়ে উঠছে নদীটা। সব কিছু যেন অলৌকিক ও ভৌতিক রূপ নিচ্ছে। ভাবতে লাগলাম ভূত-পেত্নী আলেয়ার কথা, সেই দুষ্ট ডাইনী মেয়েদের কথা—যারা রাতভর পাথরের চাঁইয়ের ওপর বসে থেকে মানুষকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যায় ঘূর্ণিস্রোতের মধ্যে এবং আরও নানা রকম বিপদে। ভাবলাম, আহা যদি আরেকটু ভাল লোক হতাম এবং কিছু দোয়া-দরূদ জানতাম! এসব চিন্তার মাঝখানে হঠাৎ কানে এল একটা গানের সুর। আনাড়ী হাতে কেউ কনসার্টিনা বাজাচ্ছে। শুনেই বুঝলাম বেঁচে গেছি আমরা এ যাত্রায়।
কনসার্টিনার আওয়াজ এমনিতে ভাল লাগে না আমার। কিন্তু, আহ! সে মুহূর্তে বাজনাটি কি মধুরই না লাগল আমাদের দু’জনের কানে। অর্ফিউসের কণ্ঠ, অ্যাপোলোর বীণা, কিংবা অন্য যে কোন বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনির চেয়েও মধুর। মনের তখনকার অবস্থায় কোন স্বর্গীয় সুর বেজে উঠলে আমাদের মানসিক যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেত। নিপুণ হাতের প্রাণ মাতানো সুর-মূর্ছনা শুনলে ওটাকে ভূত-প্রেতের আগমনী সংকেত ভেবে বাঁচার সব আশা-ভরসা আমরা ছেড়ে দিতাম। কিন্তু সেই ফ্যাসফেসে একর্ডিয়নের ঝাঁকুনি দেয়া এবং অনিচ্ছাকৃত কাঁপা কাঁপা সুরলহরীর মধ্যে এমন কিছু ছিল যা একান্তভাবে মানবিক ও ভরসাদায়ক।
মিষ্টি সুরটা ঘনিয়ে আসতে লাগল কাছে। যে নৌকায় একর্ডিয়ান বাজছিল সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এল আমাদের পাশে।
নৌকাটিতে রয়েছে এক দঙ্গল গেঁয়ো ছেলেমেয়ে। চাঁদনী রাতে নৌ-ভ্রমণে বেরিয়েছে ওরা (আকাশে যে চাঁদ নেই সেটা ওদের দোষে নয়)। কত আপনজন বলে মনে হলো ওদেরকে। এমনটি আর কোনদিন মনে হয়নি। সম্ভাষণ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা আমাকে ওয়ালিংফোর্ড লকে যাবার পথটা বলে দিতে পারে কিনা। আমি বুঝিয়ে বললাম যে দু’ঘণ্টা ধরে পথটা খুঁজছি।
‘ওয়ালিংফোর্ড লক! খোদার রহমত হোক আপনার ওপর। ওই লকটা তো তুলে দেয়া হয়েছে বছরখানেক আগে। এখন ওয়ালিংফোর্ড লক নাই, স্যার। আপনারা এখন ক্লীভের কাছে এসে পড়েছেন।’ বলল ওরা।