আট
কেম্পটন পার্কের ধারে উইলো গাছের নিচে নৌকা, বেঁধে আমরা লাঞ্চে বসলাম। ছোট্ট মনোরম জায়গা। নদীর ধার ঘেঁষে বিস্তৃত ঘাসে ছাওয়া উইলো-ঢাকা সমতল ভূমি। সবেমাত্র ‘থার্ড-কোর্স’ রুটি-জ্যামে হাত দিয়েছি অমনি আস্তিনওয়ালা শার্ট পরে ছোট্ট পাইপ টানতে টানতে এক ভদ্রলোক এসে জানতে চাইলেন আমরা যে অনধিকার প্রবেশ করেছি সেটা আমাদের জানা আছে কিনা। বললাম বিষয়টা সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মত যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা আমরা এখনও করিনি, তবে একজন ভদ্রলোক হিসাবে তিনি যদি কথা দেন যে আমরা তা-ই করেছি তাহলে আর বেশি দ্বিধা না করে সেটা বিশ্বাস করব। তিনি আমাদেরকে সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিলেন এবং আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম কিন্তু এর পরেও তিনি ওখানে ঘুরঘুর করতে লাগলেন এবং মনে হলো তিনি বেশ অসন্তুষ্ট। কাজেই, জিজ্ঞেস করলাম তাঁর জন্য আর কিছু করতে পারি কিনা আমরা। হ্যারিস স্বভাবগতভাবেই মিশুক লোক, সে তাঁকে একটুখানি রুটি জ্যাম সাধল।
আমার বোধ হয়, লোকটা নিশ্চয়ই এমন কোন সংঘের সদস্য যারা পণ করেছে রুটি-জ্যাম স্পর্শ করবে না, কারণ অত্যন্ত রূঢ়ভাবে তিনি হ্যারিসের রুটি—জ্যামের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর ভাবসাব দেখে মনে হলো রুটি—জ্যামের প্রলোভন দেখানোয় তিনি যেন বিরক্ত। বললেন, আমাদেরকে ওখান থেকে উঠিয়ে দেয়া তাঁর কর্তব্য
হ্যারিস বলল, কর্তব্য যদি হয় তবে ওটা করে ফেলা উচিত। লোকটাকে সে জিজ্ঞেস করল কাজটা করার সর্বোত্তম উপায় সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণা আছে কিনা এবং থাকলে সেটা কি। হ্যারিস হলো যাকে বলা হয় একজন সুগঠিত এক নম্বর সাইজের মানুষ এবং দেখতেই বেশ শক্তসমর্থ গাট্টাগোট্টা গোছের। লোকটি তার চেহারা আগাগোড়া দেখে পরিমাপ করে বললেন যে তিনি গিয়ে তাঁর মনিবের সঙ্গে আলোচনা করবেন, “তারপর ফিরে এসে আমাদের দু’জনকেই নদীতে ছুঁড়ে ফেলবেন।
আমরা অবশ্য তাঁর টিকিটিও আর দেখিনি এবং অবশ্যই তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের কাছ থেকে একটা শিলিং হাতিয়ে নেয়া। নদীতীরের জায়গাগুলোতে কিছু লোক আছে যারা গরমের দিনে নদীর ধারে গুণ্ডামি করে বেড়ায় এবং দুর্বল আর ভীতু স্বভাবের লোকদের ওপর এভাবে চাপ দিয়ে বেশ কিছু আয় করে নেয়। তারা বলে, মালিক তাদেরকে পাঠিয়েছে। এক্ষেত্রে সঠিক করণীয় হচ্ছে তাদেরকে নিজের নাম ঠিকানা দিয়ে বলে দেয়া যে মালিকের যদি সত্যি কিছু করার ইচ্ছা থাকে তাহলে তিনি আপনাকে আদালতের সমন পাঠাতে এবং তাঁর জমির একটুখানি জায়গায় বসার দরুন কি ক্ষতি হয়েছে তার প্রমাণ দিতে পারেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এত বেশি অলস এবং ভীরু যে তারা সামান্য দৃঢ়তা দেখিয়ে এটা বন্ধ করার চাইতে ওই চাপের কাছে নতি স্বীকার করে এটাকে উৎসাহিতই করতে চান।
মালিকরাই যদি আসল দোষী হয়ে থাকে তবে সেটা ফাঁস করে দেয়া দরকার। নদীতীরের জায়গা-জমির মালিকদের স্বার্থপরতা প্রতি বছরই বেড়ে যাচ্ছে। সুযোগ পেলে এরা টেমস্ নদীটাকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। ছোটখাট খাল-নালা আর জলাগুলোতে এরা কার্যত তাই করছে। নদী-নালার মাঝখানে খুঁটি পেতে এরা এপারে ওপারে শেকল টেনে আটকে দেয়, গাছে গাছে জুলিয়ে দেয় বড় বড় সাইনবোর্ড। ওই বিজ্ঞপ্তিগুলো দেখলেই আমার ভেতরকার সব খারাপ প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। ইচ্ছা হয় একটা একটা করে ওগুলোকে খুলে নিয়ে যারা লাগিয়েছে ওদের মাথায় হাতুড়ি ঠুকি যতক্ষণ না ওরা মারা যায় এবং তারপর ওদেরকে কবর দিয়ে কবরের ওপর সমাধি ফলকের মত সাইনবোর্ডগুলো বসিয়ে দিই।
হ্যারিসকে জানালাম আমার এহেন অনুভূতির কথা। সে বলল তার অনুভূতি আরও খারাপ। তার ইচ্ছা করে ওই বোর্ডগুলো লাগানোর জন্য যারা দায়ী তাদেরকেই শুধু নয়, তাদের পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবাইকে কচুকাটা করে তাদের ঘরবাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে দিতে। এটা একটু বেশি রকম বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে মনে হলো আমার এবং হ্যারিসকে বললাম সেকথা। কিন্তু হ্যারিস জবাব দিল, ‘মোটেই না। তাদের উচিত সাজা হবে এতে। আমি সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে কমিক গান গাইব।’
হ্যারিসের এরকম রক্তপিপাসু ধরনের কথাবার্তা শুনে আমি বিরক্ত হলাম। ন্যায়বিচারের সহজাত প্রবৃত্তিকে নিছক প্রতিহিংসাপরায়ণতায় পর্যবসিত হতে দেয়া আমাদের কখনও উচিত নয়। বিষয়টাকে আরেকটু খ্রিস্টানসুলভ দৃষ্টিতে দেখার জন্য হ্যারিসকে রাজী করাতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগল। তবে শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। সে প্রতিশ্রুতি দিল যে বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনদের রেহাই দেবে এবং বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে কমিক গান সে গাইবে না।
হ্যারিসের কমিক গান আপনারা শোনেননি কোনদিন। শুনলে বুঝতেন মানবজাতির কি উপকারটাই না করেছি আমি ওকে কমিক গান করা থেকে বিরত রেখে। হ্যারিসের একটা বন্ধমূল ধারণা হলো এই যে সে কমিক গান করতে পারে। কিন্তু তার যেসব বন্ধুবান্ধব তাকে সেই চেষ্টা করতে দেখেছে ওদের ধারণা একদম উল্টো। ওদের বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে কমিক গান হ্যারিস গাইতে পারে না, কখনও পারবে না এবং তাকে ওই চেষ্টা করতে দেয়া উচিত নয়।
যাক, বেলা তিনটায় আমরা সানবারি লকে পৌঁছলাম। গেটের আগ পর্যন্ত নদীটা বড় সুন্দর। লকের ভেতরকার আটকানো পানিটাও দেখতে বেশ মনোরম। কিন্তু দাঁড় বেয়ে তার ওপর দিয়ে এগুনোর চেষ্টা করবেন না
আমি একবার করেছিলাম। দাঁড় ছিল আমার হাতে। হাল ধরে ছিল যারা তাদেরকে আমি জিজ্ঞেস করি কাজটা করা যাবে কিনা। তারা বলে, হাঁ হাঁ, করা যাবে যদি আমি জোরে জোরে দাঁড় টানি। তারা যখন একথা বলে তখন আমরা ছিলাম লকের দুই বাঁধের মধ্যেকার ছোট্ট পুলটির নিচে। আমি যুৎ করে বসে নিচু হয়ে কষে ধরলাম দাড়, দিলাম জোর টান।
চমৎকার বাইতে লাগলাম। একটানা ছন্দময় গতিতে, হাত-পা-পিঠের সকল শক্তি নিয়োগ করে। দ্রুত ঝপাঝপ শব্দে সত্যিকারের জমকালো ভঙ্গীতে টেনে চললাম দাঁড়। বন্ধু দু’জন বলল, আমাকে দেখে আনন্দ পাচ্ছে তারা। মিনিট পাঁচেক পর আমার মনে হয় যে এতক্ষণে তো বাঁধের কাছে পৌঁছে যাবার কথা আমাদের। চোখতুলে চেয়ে দেখি, আমরা রয়ে গেছি পুলের নিচে—যেখান থেকে দাঁড় টানতে শুরু করেছিলাম ঠিক সেই জায়গাটিতে, আর ওই দুই আহাম্মক হাসতে হাসতে তাদের ফুসফুস জখম করে ফেলছে। বুঝলাম, নৌকাটাকে পুলের নিচে স্থির অবস্থায় রাখার জন্যই এতক্ষণ আমি পাগলের মত খেটে যাচ্ছিলাম তখন আমি সরে গিয়ে অন্য লোকদের পথ ছেড়ে দি সেই তীব্র স্রোতের মুখে এগিয়ে যাবার জন্য।
আমরা দাঁড় টেনে পৌঁছে গেলাম ওয়াল্টনে। নদীতীরের শহরগুলোর মধ্যে এটা বেশ বড় জায়গা
ওয়াল্টনেও অবশ্য সীজারের একটা আস্তানা –শিবির, ঘাঁটি বা ওই ধরনের কিছু ছিল। সীজার একজন রীতিমত উজান নদীর লোক। তাই ছিলেন রানী এলিজাবেথও। তিনিও গিয়েছিলেন ওখানে। যেখানেই যান না কেন আপনি, এই মহিলাটিকে এড়াতে পারবেন না। ক্রমওয়েল এবং ব্রাড্শও এসেছিলেন এখানে।
ওয়াল্টন গির্জায় একটা লোহার তৈরি ‘কটুভাষীর লাগাম’ আছে। প্রাচীনকালে রমণীদের মুখ বন্ধ করার জন্য এগুলো ব্যবহার করা হত। এখন সেই চেষ্টা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমার মনে হয় লোহা দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠায় এবং লোহা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বানালে যথেষ্ট শক্ত হবে না বলে আজকাল ওরকম লাগামের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে।
গির্জায় উল্লেখযোগ্য কবরও আছে। আমার ভয় হচ্ছিল ওগুলো এড়িয়ে আমি হ্যারিসকে নিয়ে জায়গাটা পার হয়ে যেতে পারব না। কিন্তু দেখা গেল যে হ্যারিস ওগুলোর কথা ভাবলই না। ফলে আমরা এগিয়ে গেলাম। পুলের ওপারে নদীটা দারুণ এঁকেবেঁকে গেছে। এতে নদীকে দেখায় ছবির মত। কিন্তু দাঁড় বেয়ে যাওয়ার পক্ষে এই বাঁকগুলো বড় বিরক্তিকর। এগুলো দাঁড়ী আর মাঝির মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়।
এখানটায় নদীর ডান তীরে রয়েছে ওটল্যাণ্ড পার্ক। প্রসিদ্ধ প্রাচীন জায়গা এটি। অষ্টম হেনরি জায়গাটা কার না কার থেকে চুরি করেছিলেন। কার থেকে, সেটা এখন আমার মনে পড়ছে না। তিনি এখানে বাস করেছিলেন। পার্কের মধ্যে একটা গুহা আছে। দর্শনীর বিনিময়ে ওটা দেখা যায়। খুবই আশ্চর্যজনক বলে মনে করা হয় গুহাটিকে। আমি নিজে ওটার মধ্যে তেমন কিছু দেখতে পাই না। ইয়র্কের প্রয়াত ডাচেস ওটল্যাণ্ডে থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কুকুরপ্রিয়। অনেক কুকুর ছিল তাঁর। কুকুর মরে গেলে গোর দেয়ার জন্য একটা বিশেষ গোরস্থান তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। ওখানেই শুয়ে আছে ওরা, সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশ। প্রত্যেকটি কবরের ওপর রয়েছে পাথরের ফলক এবং তাতে উৎকীর্ণ শোকলিপি।
হ্যাঁ, সাহস করে বলছি যে একজন সাধারণ খৃষ্টান তার কবরের ওপর প্রস্তরফলক ও শোকলিপি যতখানি দাবি করতে পারে ঠিক ততখানি দাবি করতে পারে ওরাও।
ওয়াল্টন পুল ছাড়িয়ে প্রথম বাঁকটি হলো ‘করওয়ে স্টেক্স।’ এখানে সীজার ও কাসিভলাউনাসের মধ্যে একটা যুদ্ধ হয়। নদীর বুক জুড়ে অসংখ্য শূলের মত খুঁটি পুঁতে (এবং নিঃসন্দেহে নোটিশ বোর্ডও ঝুলিয়ে) কাসিভলাউনাস নদীটাকে তৈরি করে রেখেছিলেন সীজারের জন্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও সীজার নদী পার হন ওই নদীতে ডুবিয়ে সীজারকে মারা যায় না। জলাময় এলাকায় আমাদের এখন ওই ধরনের মানুষেরই দরকার।
হ্যালিফোর্ড আর শেপার্টনের নদীর ধারের জায়গাগুলো বেশ সুন্দর, কিন্তু দু’য়ের কোনখানেই উল্লেখযোগ্য কিছু নাই। শেপার্টনের গির্জা প্রাঙ্গণে অবশ্য কবিতা-উৎকীর্ণ একটা সমাধি আছে। হ্যারিস ওটা দেখার জন্য বেরিয়ে গিয়ে পাগলামি করতে চাইবে ভেবে আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়ি। ঘাটের কাছাকাছি এগিয়ে যেতে যেতে তাকে সেদিকে আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে আমি হঠাৎ এক নিপুণ কায়দায় ঝাঁকি দিয়ে তার টুপিটা ফেলে দিলাম নদীতে। পানি থেকে টুপি উদ্ধারের উত্তেজনায় এবং আমার আনাড়ীপনায় ক্রুদ্ধ হয়ে প্রিয় সমাধিগুলোর কথা সে বিলকুল ভুলে গেল।
ওয়েইব্রিজে ওয়েই, বৌর্ন আর বেসিংস্টোক খাল সব একসাথে এসে মিলেছে টেমস নদীর সাথে। এখানে লকটা হচ্ছে শহরের বিপরীত দিকে। কাছাকাছি পৌঁছতেই একটা গেটের ওপর প্রথম যে বস্তুটি চোখে পড়ল তা হচ্ছে জর্জের ব্লেজার। আরও খুঁটিয়ে দেখতে বুঝা গেল যে জর্জ ওই রেজারের ভেতরেই আছে।
প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিল মণ্টমোরেন্সি, আমি চিৎকার দিলাম, হ্যারিস শুরু করল গর্জন। হ্যাট দোলাতে দোলাতে পাল্টা চেঁচাতে লাগল জর্জ। লকের রক্ষী ওপর থেকে কেউ পানিতে পড়ে গেছে ভেবে ছুটে এল মই নিয়ে এবং কেউ পড়েনি দেখে স্পষ্টত বিরক্ত হলো লোকটা
জর্জের হাতে দেখা গেল অয়েল-স্কিনে মোড়া একটা অদ্ভুত ধরনের পোটলা। একদিকে গোল, অন্যদিকে চ্যাপ্টা। একটা সরল লম্বাটে হাতল বেরিয়ে আছে ওটা থেকে।
হ্যারিস জিজ্ঞেস করল, ‘ওটা কি? কড়াই নাকি?’
এক অপরিচিত বুনো দৃষ্টি ঝলকে উঠল জর্জের চোখে। সে বলল, ‘না, কড়াই নয়। চলতি মওসুমে এগুলোরই জয়জয়কার। নদী অঞ্চলে সবার কাছেই আছে। এটা হলো ব্যাঞ্জো।’
একসাথে চেঁচিয়ে উঠলাম হ্যারিস আর আমি, ‘তুমি ব্যাঞ্জো বাজাতে পারো একথা তো জানতাম না?’
‘বাজাই ঠিক না, কিন্তু লোকে বলে, বাজানো খুবই সোজা। বাজনা শেখার বই নিয়ে এসেছি আমি!’