সাত
হ্যারিস আমাকে তার গোলকধাঁধার অভিজ্ঞতার কাহিনীটা বলল মৌসলে ‘লক’ পার হবার সময়। এটা পার হতে আমাদের সময় লাগল অনেকক্ষণ। কারণ, আমাদেরটাই একমাত্র নৌকা এবং ‘লক’টাও বেশ বড়। মৌসলে ‘লকের’ ভেতর দিয়ে একটা মাত্র নৌকা যাচ্ছে এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। আমার অনুমান, এটাই নদীর ব্যস্ততম ‘লক’—এমনকি বৌটলার ‘লকের’ চেয়েও।
আমি কোন কোন সময় এখানে দাঁড়িয়ে ‘লক’টার দৃশ্য দেখেছি। তখন পানি একেবারে চোখেই পড়ে না, শুধু দেখা যায় উজ্জ্বল ব্লেজার, রঙচঙা টুপি, হ্যাট, বহুবর্ণা ছাতা, রেশমী চাদর, আলখেল্লা, উড়ন্ত রিবন আর রুচিসম্মত সাদা পোশাকের চোখধাঁধানো জট। জেটির ওপর থেকে ‘লকের’ মধ্যে তাকালে মনে হতে পারে ওটা একটা মস্তবড় বাক্স যার মধ্যে নানা বর্ণের, নানা রঙের ফুল ফেলে রাখা হয়েছে বিশৃঙ্খলভাবে, স্তূপীকৃত রঙধনুর আকারে ওগুলো পড়ে আছে সকল আনাচ কানাচ জুড়ে।
সুন্দর পোশাকে সাজলে নৌকায় মেয়েদেরকেও তেমন বেশি খারাপ দেখায় না। আমার বিবেচনায় রুচিসম্মত নৌ-পোশাকের চেয়ে আকর্ষণীয় আর কিছু নেই। কিন্তু নৌ-পোশাক বলতে সকল মহিলারই বোঝা উচিত ওটা শুধু কাচের খাঁচার মধ্যে নয়, নৌকায় পরার মত হওয়া চাই। নৌকায় যদি এমন কেউ থাকে যে সারাক্ষণ কেবল পোশাকের চিন্তায় আচ্ছন্ন তাহলে ভ্রমণটাই মাটি হয়ে যায়। এই ধরনের দু’জন মহিলাকে নিয়ে নৌকায় পিকনিক করতে যাওয়ার দুর্ভাগ্য একবার হয়েছিল। আহা, কি আমোদেই না কেটেছিল আমাদের সময়টা
ওরা দু’জনেই এসেছিল বেশ সুন্দর সাজগোজ করে-সব জরি আর রেশমী কাপড়, ফুল, রিবন, মানানসই জুতো, হাল্কা দস্তানায় মুড়ে। কিন্তু ওদের পোশাকটা ছিল স্টুডিওতে ছবি তোলার, নদীতে পিকনিকে যাবার উপযোগী নয়। ওগুলো ছিল ফরাসী ফ্যাশন ছবির ‘নৌকার পোশাক।’ ওসব পরে আসল মাটি, পানি আর বাতাসের ধারেকাছেও যাওয়া যায় না।
প্রথম কথাটা হচ্ছে এই যে ওরা ভাবল নৌকাটা যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। আমরা আসনগুলো ঝেড়েমুছে ওদেরকে আশ্বাস দিলাম যে ময়লা নেই। কিন্তু ওরা বিশ্বাস করল না আমাদের কথা। একজন তার দস্তানার তর্জনী দিয়ে গদি ঘষে ফলাফলটা দেখাল অন্যজনকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়ল দু’জনেই। ভাবসাব দেখে মন হলো ওরা যেন সেই আদি যুগের খ্রিস্টান শহীদ—পুড়ে মরার আগে—চিতার খুঁটিতে হেলান দিয়ে একটুখানি আরাম করে বসার চেষ্টা করছে। দাঁড় বাইতে গেলে মাঝে মধ্যে এক আধটুকু পানি ছিটকাবেই। দেখা গেল যে এক ফোঁটা পানি পড়লেই ওদের পোশাকগুলো বরবাদ হয়ে যায়। দাগটা ওঠে না, চিরকালের জন্য থেকে যায়।
দাঁড় বাইছিলাম আমি। প্রায় দুই ফুট উঁচিয়ে ধরে পানি ঝরার জন্য একটু থেমে থেমে বাইতে লাগলাম। প্রতিবারেই কিছু পানি দাঁড়ের সঙ্গে উঠতে ও ঝরে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পরে বাউ বলল, সে নিজেকে আমার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মত পাক্কা মাঝি ভাবতে পারছে না, তবে আমার অনুমতি পেলে সে স্থির বসে থেকে আমার দাঁড় টানা দেখবে (আমার দাঁড় টানা নাকি খুবই আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল তার কাছে)। এত সাবধানতা এবং আমার এত চেষ্টা সত্ত্বেও পানির ছিটা মাঝেমধ্যে গিয়ে পড়তে লাগল ওই পোশাকগুলোর ওপর
অভিযোগ করল না মেয়ে দুটো, তবে শক্ত করে ঠোঁট চেপে দু’জনে আরও ঘন হয়ে বসল। এক এক ফোঁটা পানি গায়ে পড়তেই ওরা দৃশ্যত কুঁকড়ে যেতে এবং কেঁপে উঠতে লাগল। ওদের এই ভোগান্তির দৃশ্যটা তৃপ্তিকর বটে, তবে ওটা আমাকে একদম বেসামাল করে দিল। আমি একটু বেশিমাত্রায় সংবেদনশীল ফলে আমার দাঁড় টানা হয়ে উঠল খেপার মত, অনিয়মিত। যত চেষ্টা করলাম পানি না ছিটকাতে ততই বেশি করে পানি ছিটকে পড়তে লাগল ওদের গায়ে।
শেষে বৈঠা ছেড়ে দিলাম। বাউকে ডাকলাম বৈঠা ধরার জন্য। বাউ মনে করল বন্দোবস্তটা ভালই হলো। আমরা জায়গা বদল করলাম। আমাকে দাঁড় ফেলে চলে যেতে দেখে মেয়েরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এবং মুহূর্তেকের জন্য বেশ খুশিও হয়ে উঠল। আহা বেচারীরা! আমার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াই ভাল হত ওদের জন্য। এখন ওরা যে লোকটাকে পেলো সে হচ্ছে আমুদে, হাল্কা-মনা, মাথা মোটা ধরনের। তার মধ্যে যে পরিমাণ সংবেদনশীলতা আছে ততটা কোন নিউফাউল্যাণ্ড কুকুরছানার মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে। এমন ঝপাঝপ করে জোরে জোরে সে দাঁড় বাইতে লাগল যে পানির ছিটা ঝর্নাধারার মত বর্ষিত হতে লাগল এবং নৌকার সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসতে বাধ্য করল। মেয়ে দুটোর একজনের পোশাকে পাঁইট খানেকের বেশি পানি ছিটিয়ে দিয়ে সে হেসে বলল, ‘মাফ করবেন, সত্যি মাফ চাচ্ছি আমি।’ এই বলে সে পানিটা মুছে ফেলার জন্য ওদেরকে নিজের রুমালটা দিতে চাইল।
জবাবে ওরা মিনমিন করে বলল, ‘না, না কিচ্ছু হয়নি,’ তারপর অন্যদের নজর এড়িয়ে কম্বল আর কোট টেনে নিয়ে গা ঢাকল, লেস-এর ছাতা দিয়ে পানির ছিটা থেকে বাঁচার চেষ্টা করল।
লাঞ্চের সময় ওরা পড়ে গেল বেশ মুশকিলে। সবাই চায় ওরা ঘাসের ওপর বসুক, আর ঘাস ছিল ধুলোয় ভরা। ওদেরকে বলা হলো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসতে, কিন্তু দেখে মনে হলো অনেকদিন ধরে ওগুলোর ধুলোময়লা ঝাড়ামোছা হয়নি। কাজেই মাটিতে নিজ নিজ রুমাল বিছিয়ে ওরা বসল সম্পূর্ণ সোজা হয়ে। প্লেট ভর্তি বীফ-স্টেকের পুরি নিয়ে যাওয়ার সময় গাছের শেকড়ের সঙ্গে হোঁচট লেগে পড়ে গেল একজন। পুরিগুলো ছিটিয়ে পড়ল চারদিকে। ভাগ্য ভাল, একটাও যায়নি ওদের ওপর দিয়ে। কিন্তু এই দুর্ঘটনাটা এক নয়া বিপদের সঙ্কেত দিল ওদেরকে, শঙ্কিত করে তুলল। এরপর থেকে পড়ে গিয়ে বিতিকিচ্ছি কাণ্ড ঘটাতে পারে এমন কোন জিনিস হাতে কাউকে হাঁটাচলা করতে দেখলেই ওরা লোকটাকে ক্রমবর্ধমান শঙ্কার দৃষ্টিতে লক্ষ করতে থাকল, যতক্ষণ না সে আবার বসে পড়ে।
কাটা লাঞ্চের পাট চুকে যাবার পর আমাদের বন্ধু বাউ উল্লাসের সাথে ওদেরকে বলল, ‘এই যে মহিলারা, আসুন তো এখন, ধোয়ামোছার কাজটা করে ফেলুন। ওটা আপনাদেরকেই করতে হবে।’
প্রথমটায় ওরা বুঝতেই পারল না বাউ এর কথা। বিষয়টা মাথায় ঢোকার পর ওরা বলল, ধোয়ামোছার কাজটা কিভাবে করতে হয় সেটা ওরা জানে না।
বাউ চেঁচিয়ে বলল: ‘ওহ্-হো, এই কথা? চিন্তার কিচ্ছু নেই, আমিই দেখিয়ে দিচ্ছি এক্ষুণি। এমন মজার কাজ আর হয় না। আপনারা আপনাদের ‘ইয়ের ওপর’—মানে, পাড়ের ওপর শুয়ে পড়বেন, বুঝলেন তো? তারপর জিনিসগুলোকে পানিতে ডুবিয়ে এদিকে ওদিকে নাড়াচাড়া করবেন।’
বড় বোনটি বলল যে ওদের পোশাক ওই কাজের উপযোগী নয়।
বাউ হাল্কা মেজাজে জবাব দিল, ‘আরে পোশাকের কোন ক্ষতিই হবে না। গুটিয়ে ওপর দিকে তুলে ফেলুন।’
এবং তাই সে করাল মেয়ে দু’টিকে দিয়ে। ওদেরকে সে আরও বলল যে ওই রকম করার মধ্যেই তো পিকনিকের অর্ধেক মজা। ওরা সায় দিয়ে বলল যে কাজটা বেশ আকর্ষণীয়।
জয়া এখন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গেলে মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা যেমন ভাবতাম আসলে কি সেরকমই মাথা মোটা ছিল ওই ছেলেটা? কিংবা সেনা, না, অসম্ভব! অমন সরলতা, অমন শিশুসুলভ অভিব্যক্তি ছিল তাকে ঘিরে। গান
হ্যারিস চাইল হ্যাম্পটন গির্জায় নেমে গিয়ে মিসেস টমাসের কবর দেখতে।
‘মিসেস টমাসটা কে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমি কেমন করে বলব? তবে এটুকু জানি যে তিনি একজন ভদ্রমহিলা, তাঁর একটা অদ্ভুত রকমের কবর আছে এবং আমি ওটা দেখতে চাই—ব্যস্।’
আপত্তি করলাম আমি। আমাকে বানানোর সময়কার ভুলের দরুন কিনা জানি না, তবে সমাধিফলক দেখার জন্য আমি কখনও লালায়িত হই না। জানি, কোন গ্রাম বা শহরে গেলে প্রথম করণীয় হয় গির্জার কবরস্থানে ছুটে গিয়ে সমাধিগুলোর দৃশ্য উপভোগ করা। কিন্তু এটা হচ্ছে সেই বিনোদন যা থেকে আমি সবসময় নিজেকে বঞ্চিত রাখি। হাঁফ-ধরা বুড়োদের পেছনে ঝাপসা ও ঠাণ্ডা গির্জাগুলোতে ঘুরে ঘুরে সমাধিফলকের লেখা পড়তে আমার কোন আগ্রহই নেই। পাথরের মধ্যে ঢোকানো পেতলের ফাটল-ধরা টুকরা দেখেও আমি যাকে বলে আসল সুখ, সেটা পাই না।
উত্তেজক শোকলিপির সামনে দাঁড়িয়ে আমার অবিচল ভাব এবং পারিবারিক ইতিহাস শোনার প্রতি আমার উৎসাহের অভাব মাননীয় সেক্সটনদের আহত করে। বেরিয়ে যাবার জন্য আমার অগোপন উৎকণ্ঠা তাঁদের মনে আঘাত দেয়।
একবার এক রৌদ্রোজ্জ্বল সোনালী সকালে আমি ছোট্ট এক গ্রাম্য গির্জার বাইরের নিচু পাথুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে ধূমপান করতে করতে প্রশান্ত সুখে প্রাণভরে উপভোগ করছিলাম সেখানকার আরামদায়ক মিষ্টি প্রকৃতি শোভা—আইভি লতায় জড়ানো গির্জাটি, উঁচু উঁচু এম্ গাছের সারির ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসা সাদা চলার পথ, ছিমছাম লতাকুঞ্জের বেড়ার ওপর দিয়ে উঁকি-মারা কুঁড়েঘরের খড়ের ছাউনি, খাদের গভীরে বহমান রূপালী নদী, তার পেছনকার বনাকীর্ণ পাহাড়ের মালা!
দৃশ্যটা ছিল মনোরম। রাখালিয়া গানের মত কবিত্বময়। ওটা আমাকে অনুপ্রাণিত করল। চমৎকার ও মহৎ অনুভূতি জাগাল আমার মধ্যে। ভাবলাম, পাপ আর দুষ্কর্মের মধ্যে আর যাব না। ওখানে গিয়ে বাস করব, কোন খারাপ কাজ করব না। নির্দোষ সুন্দর জীবন যাপন করব। তারপর একদিন বুড়ো হব, চুলে পাক ধরবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই মুহূর্তে বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনের সকল নষ্টামি আর গোয়ার্তুমি ক্ষমা করে আমি তাদেরকে আশীর্বাদ করলাম। ওরা জানল না যে আমি ওদেরকে আশীর্বাদ করেছি। ওই শান্তিময় দূর গাঁয়ে দাঁড়িয়ে ওদের জন্য আমি কি করছি সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিত অবস্থায় ওরা ওদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ অব্যাহত রাখল। কিন্তু আশীর্বাদ আমি ঠিকই করলাম এবং যেহেতু আমি চাই যে ওরা খুশি হউক, তাই আমার ইচ্ছা হলো কথাটা ওরা জানুক। এইসব মহান কোমল চিন্তার স্রোতে আমি ভেসে যাচ্ছি—এমন সময় আমার ধ্যানভঙ্গ হলো এক তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কর্কশ চিৎকারে, ‘আইতাছি, ছার, আমি আইতাছি। ঠিক আছে ছার, তাড়াহুড়ার কাম নাই।’
তাকালাম চোখ তুলে। টেকো মাথা এক বুড়ো গির্জার উঠান থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে আসছে আমার দিকে। হাতে তার চাবির এক বিরাট গোছা। প্রতি পদক্ষেপে সেগুলো নড়ে উঠে আওয়াজ করছে ঝনঝন করে।
নীরব মর্যাদার সাথে হাত নেড়ে তাকে চলে যেতে ইশারা করলাম, কিন্তু সে আসতেই লাগল চেঁচাতে চেঁচাতে, ‘আইতাছি, ছার, আইতাছি। আমি এটুখানি ল্যাংড়া, ছার, আগের মতন চইলবার পারি না। এই দিগে আহেন, ছার!’
‘ভাগ, হতচ্ছাড়া বুড়ো কোথাকার।’ বললাম আমি।
‘যত্ত জলদি পাইরছি আইছি, ছার। আমার বৌ এইমাত্র দেইখছে আপনারে। আহেন আমার লগে।
‘ভাগ এখান থেকে, নইলে আমি দেয়াল টপকে গিয়ে তোমার ঘাড় মটকাব।’
আশ্চর্য হয়ে গেছে বলে মনে হলো লোকটাকে আমার কথা শুনে।
‘আপনি কবরগুলা দেইখবেন না, ছার?’ বলল সে।
জবাব দিলাম, ‘না, দেখতে চাই না। আমি চাই এখানে এই পলেস্তারা খসা পুরানো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। চলে যাও তুমি, আমাকে বিরক্ত কোরো না। আমার মন এখন সুন্দর ও মহৎ সব ভাবনায় পরিপূর্ণ। আমি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব, কারণ এতে আমার ভাল লাগছে। তোমার ওইসব সমাধি-ফলকের হাস্যকর গাঁজাখুরি গালগল্প ফেঁদে আমার এই চমৎকার অনুভূতিগুলোকে বিঘ্নিত কোরো না তুমি। ভাগ এখান থেকে। কাউকে ধরে তোমাকে সস্তায় কবর দেয়ার ব্যবস্থা করো গে। অর্ধেক খরচ আমি দেব, যাও।’
মুহূর্তখানেক হতভম্ভ হয়ে রইল লোকটা। চোখ দুটো রগড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখল। বাহ্যিক চেহারা অবয়বে আমাকে তো অনেকটা মানুষ বলেই মনে হচ্ছে তার। কাজেই সে বুঝে উঠতে পারছে না কেন আমি ওরকম ব্যবহার করছি।
সে বলল, ‘আপনে কি, ছার, অন্য জায়গার লোক? এইহানে থাহেন না?’
‘না, থাকি না, আমি থাকলে তুমি থাকতে না।’
‘বেশ, ভালা কতা। আপনে সমাধি—মানে, কবর দেইখবার চান—এইহানে মাইনষেরে গোর দেয়া অইছে, জানেন—কফিনের ভিতরে…’
রেগে উঠে বললাম, ‘তুমি একটা আস্ত মিথ্যুক। সমাধি—তোমার ওই সমাধি আমি দেখতে চাই না। কেন দেখব? আমাদের নিজেদের, আমাদের পরিবারের সমাধি আছে। আমার পোজার চাচারই তো কেনসাল গ্রীন গোরস্থানে একটা সমাধি আছে। ওই এলাকার গর্বের বস্তু ওটা। বাউ-তে আমার দাদুর যে খিলানওয়ালা সমাধিটি আছে ওটাতে আটজন দর্শনার্থীর জায়গা হয়। ফিঞ্চলে গির্জার প্রাঙ্গণে আমার দাদুর বোনের ইটের তৈরি সমাধিটার পাথরের ফলকে মাথায় খোদাই কাজ করা কফির পাত্রের মত একটা জিনিস রয়েছে। ওটার চারদিক ঘিরে আছে সেরা শ্বেত পাথরে তৈরি ছয় ইঞ্চি দেয়াল। অনেক পয়সা খরচ হয়েছে এটা বানাতে। সমাধি বা কবর দেখার ইচ্ছা হলে আমি ওইসব জায়গায় গিয়ে ফূর্তি-আমোদ করি। অন্য লোকের কবর আমি দেখতে চাই না। তুমি নিজে যখন কবরস্থ হবে তখন এসে আমি তোমারটা দেখে যাব। তোমার জন্য এটুকুই শুধু আমি করতে পারি।’
কেঁদে ফেলল লোকটা। বলল যে একটা কবরের ওপর এক টুকরা পাথর আছে। কোন কোন লোক বলেছে যে ওটা নাকি কোন মনুষ্যমূর্তির ধ্বংসাবশেষ আরেকটি সমাধির ওপর খোদাই করা কিছু একটা লেখা আছে, যার পাঠোদ্ধার আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারেনি।
তবু আমি অনড়। তখন ভগ্ন হৃদয়ে সে বলল, ‘আইচ্ছা, আমাগো স্মারক জানালাহানও কি এট্টু দেইখ্যা যাইবেন না?’
সেটা দেখতেও রাজী হলাম না আমি। কাজেই এবার শেষ তীরটি ছুঁড়ল সে। তা কাছে ঘেঁষে এল আমার, ফিসফিস করে বলল, ‘গির্জার তলের গুহার মইধ্যে কয়টা মাথার খুলি রাইখ্যা দিছি, আইস্যা দেইখা যান ওইগুলা। আহা আসেন না, খুলিগুলা দেহেন। আপনে একজন যোয়ান মানুষ, ছুটি কাটাইবার আইছেন, আপনে আনন্দ পাইবার চান। আহেন, দেইখা যান খুলিগুলা…’
এবার আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে দিলাম ছুট। ছুটতে ছুটতে শুনলাম তার আহ্বান, ‘আহা দেইখা যান খুলিগুলা, দেইখা যান!’
জাতীয় হ্যারিস অবশ্য সমাধি, কবর, স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে উৎকীর্ণলিপি ইত্যাদিতে আমোদ পায়। মিসেস টমাসের কবর দেখতে পারে না ভেবে খেপে উঠল সে। বলল, যে-মুহূর্তে এই নৌকা ভ্রমণের প্রস্তাবটি করা হয় তখন থেকেই সে মিসেস টমাসের কবর দেখবে বলে আশা করছিল। মিসেস টমাসের কবর দেখার ইচ্ছা মনে না জাগলে এই যাত্রায় সে যোগই দিত না।
আমি ওকে জর্জের কথা, জর্জের সঙ্গে একত্র হবার জন্য বেলা পাঁচটার মধ্যে কী শেপার্টনে নৌকা নিয়ে যাবার কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। তখন সে পড়ল জর্জকে নিয়ে। জর্জ কেন সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং আমাদেরকেই বা, কেন এই বাজে বেঢপ মাথাভারি বজরাটা গোটা নদীপথে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে তার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য? জর্জ কেন আসতে পারেনি? কেন কাজকর্মে হাত লাগায়নি? কেন সে ছুটি নিয়ে আমাদের সঙ্গে আসতে পারেনি। গোল্লায় যাক ব্যাঙ্ক! ব্যাঙ্কে কোন্ কম্মটি হয় তাকে দিয়ে?
যখনি যাই ওখানে, কোন কাজ করতে দেখি না তাকে। এক টুকরা কাঁচের আড়ালে বসে থাকে সে সারাদিন। কিছু একটা করছে এরকম ভাব দেখাতে চেষ্টা করে। কি লাভ হয় এক টুকরা কাঁচের আড়ালে একটা মানুষকে বসিয়ে রেখে? আমাকে কাজ করতে হয় জীবিকার জন্য। সে পারে না কেন কাজ করতে? তাকে দিয়ে কোন্ কাজটা হয় ওখানে? ওদের ব্যাঙ্কগুলোই বা কোন্ কম্মের? তোমার টাকা নেয় তারা, তারপরে যে-ই তুমি একটা চেক ভাঙাতে যাবে অমনি তারা চেকটার আগাগোড়া “নো ইফেক্টস”, “রেফার টু ড্রয়ার” ইত্যাদি ছাপ মেরে ফেরত দেবে। এতে কি লাভ হয়? গত হপ্তায় দু’বার তারা আমার সঙ্গে এরকম চালাকী করেছে। আমি আর বেশিদিন এসব সহ্য করব না। আমার একাউন্ট তুলে নেব। সে থাকলে আমরা গিয়ে ওই কবরটা দেখতে পারতাম। সে ব্যাঙ্কে গেছে বলেই বিশ্বাস হয় না। অন্য কোথাও ভাঁড়ামি করে বেড়াচ্ছে। হ্যাঁ, তাই করছে সে আমাদের ঘাড়ে সব কাজের বোঝা চাপিয়ে। এখন আমি নেমে যাব, মদ খাব গিয়ে।’
হ্যারিসকে আমি বুঝালাম যে আমরা নদীর যেখানটায় আছি তার কয়েক মাইলের মধ্যে কোন পানশালা নাই। সে তখন নদীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করল, নদীর দ্বারা কি উপকারটা হয়? এবং তৃষ্ণায় মরার জন্য যারা নদীতে আসে তারাই বা কোন ভাল কামটি করে?’
হ্যারিস যখন এরকম শুরু করে তখন তাকে না ঘাঁটানোই ভাল। ভেতরকার গ্যাসটুকু বের করে দিয়ে সে পরে আপনা আপনিই চুপচাপ হয়ে যায়।
আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে ঝুড়ির মধ্যে ঘনীভূত লেমোনেড আছে, নৌকার সামনের দিকে পাত্রের মধ্যে পানি আছে, আর ওই দুটো জিনিস একত্র মিশালেই একটা শীতল ও বলকারক পানীয় তৈরি হয়ে যাবে
এবার সে লেমোনেডের ওপর কটুবাক্য বর্ষণ শুরু করল। লেমোনেডকে সে জিঞ্জার বিয়ার, রাস্পবেরির সিরাপ ইত্যাদির মত ‘স্কুলের বাচ্চাদের পানীয়’ বলে গাল দিল। তার মতে, ওগুলো খেলে হজম শক্তি নষ্ট হয়, দেহ-আত্মা দুই-ই ধ্বংস হয় এবং ওগুলোই হচ্ছে ইংল্যাণ্ডের অর্ধেক ক্রাইমের মূল কারণ। সে যাই হোক, কিছু একটা তাকে পান করতেই হবে। এই বলে সীটের ওপর উঠে সামনের দিকে ঝুঁকে সে বোতলটার দিকে হাত বাড়াল। ওটা ছিল ঝুড়ির একেবারে তলায়। ওটাকে খুঁজে পাওয়া সহজ মনে হলো না। ফলে বোতল খোঁজার জন্য তাকে আরও বেশি বেশি ঝুঁকতে হলো সামনের দিকে। সে সময় নৌকার হালটিও ছিল তারই হাতে। ওরকম উল্টো অবস্থানে থেকে হাল ঘুরাতে গিয়ে ভুল করে বসল সে। পলকে নৌকা ছুটে গিয়ে লাগল তীরে, আর ধাক্কার চোটে বেসামাল হয়ে ডাইভ দিয়ে সে পড়ল গিয়ে সরাসরি ঝুড়ির ভেতর এবং পড়ে ওখানেই সে দাঁড়িয়ে রইল মাথায় ভর দিয়ে। দুই হাতে সাঁড়াসির মত সে আঁকড়ে রইল নৌকার দুই পাশ, পা দু’টি তার রইল ওপর দিকে খাড়া হয়ে। উল্টে গিয়ে নদীতে পড়ে যাবার ভয়ে নড়াচড়ার সাহসও তার হলো না। ওই ভাবেই সে রইল যতক্ষণে না আমি গিয়ে ঠ্যাং ধরে টেনে তাকে বের করলাম ঝুড়ির ভেতর থেকে। এই ঘটনাটা আরও বেশি খেপিয়ে দিল তাকে।