পাঁচ
পরদিন সকালে মিসেস পোপেট্স এসে আমাদের জাগালেন। বললেন, ‘এখন যে প্রায় নয়টা বাজে তা কি জানেন আপনারা?’
‘নয়টা কি?’ চেঁচিয়ে লাফিয়ে উঠলাম।
চাবির ফুটোয় মুখ রেখে তিনি জবাব দিলেন, ‘নয়টা কি আবার? বেলা নয়টা। আমি ভাবলাম আপনারা একটু বেশি ঘুমাচ্ছেন।’
হ্যারিসকে জাগিয়ে জানালাম কথাটা। সে বলল, ‘আমার মনে হয়েছিল তুমি ছ’টায় উঠতে চেয়েছিলে?’
‘তাই তো চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে জাগালে না কেন?’
‘তুমি আমাকে জাগাওনি, তোমাকে আমি কেমন করে জাগাব? এখন বারোটার পরে ছাড়া নৌকায় উঠতে পারব না। ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি, কষ্ট করে তুমি আদৌ উঠতে গেলে কেন। পাল্টা জবাব দিল সে।
‘হুঁম, তোমার কপাল ভাল যে কষ্টটা আমি করেছি। নইলে গোটা পক্ষকাল ধরে বিছানায় পড়ে থাকতে চিৎ হয়ে।
এইভাবে কয়েক মিনিট আমরা দু’জন খেঁকাখেঁকি করে চললাম। এমন সময় তাতে বাধা দিল জর্জের উদ্ধত নাসিকা গর্জন। এ গর্জন মিসেস পোপেট্স-এর ডাকে জেগে ওঠার পর এই প্রথমবার আমাদেরকে তার অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। ওই তো পড়ে আছে সেই লোকটা, যে কিনা জানতে চেয়েছিল কখন আমাদেরকে জাগিয়ে দেবে। ওই তো শুয়ে আছে চিৎ হয়ে, মুখটা হা করে, দুই হাঁটু গুটিয়ে।
কেন এমন হয় জানিনে, তবে আমি নিশ্চিত যে নিজে জেগে ওঠার পর অন্য কাউকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলে মেজাজটা আমার বিগড়ে যায়। মানব জীবনের মহামূল্য সময়-অমূল্য মুহূর্তগুলো—পশুর মত ঘুমিয়ে নষ্ট করে দিতে দেখলে আমার দারুণ খারাপ লাগে।
এই যে জর্জটা, বিকট আলস্যে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে সময়ের অপরিমেয় উপহার। তার মূল্যবান জীবন—যার প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব তাকে একদিন করতে হবে—হারিয়ে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে, কোন কাজে না লেগে। ওখানে হাত-পা ছড়িয়ে মরার মত পড়ে না থেকে সে তো উঠে অন্তত ডিম-বেকন গিলতে পারত, কুকুরটাকে খেপাতে, কিংবা পরিচারিকাটির সাথে ফষ্টিনষ্টি করতেও পারত।
এ এক ভয়ঙ্কর ভাবনা। মনে হলো একই মুহূর্তে এটা উদিত হয়েছে হ্যারিস আর আমার মাথায়। আমরা কৃতসংকল্প হলাম তাকে উদ্ধার করতে এবং ওই মহৎ সংকল্পের বশে ভুলে গেলাম নিজেদের ঝগড়ার কথা। ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ওপর এবং তার জামা-কাপড় খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললাম। হ্যারিস তাকে কষে লাগাল স্যাণ্ডেলের এক ঘা। আমি চেঁচালাম তার কানের মধ্যে। তার ঘুম ভাঙল।
উঠে বসতে বসতে সে বলল, ‘কি হয়েছে?’
‘ওঠ ব্যাটা মাথামোটা মাংসপিণ্ড কাঁহাকার। পৌনে দশটা বেজে গেছে।’ হুঙ্কার ছাড়ল হ্যারিস!
‘কি?’ বলে চিল-চিৎকার দিয়ে লাফ মেরে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে সে পড়ে গেল বাথ টাবের মধ্যে।
‘এটা আবার এখানে আনল কোন্ বদমাশ?’
আমরা বললাম যে ওটা দেখতে না পাওয়া নিশ্চয়ই তার বোকামি।
পোশাক-আশাক পরে টুকিটাকি জিনিস-পত্র খুঁজতে গিয়ে আমাদের মনে পড়ল যে দাঁতের ব্রাশ, চিরুনি (আমি জানি ওই দাঁতের ব্রাশটা আমাকে ভোগাবে) সবই আমরা ব্যাগের ভেতর গুছিয়ে রেখেছি। অগত্যা সবাইকে নিচে নেমে ব্যাগ থেকে ওগুলো খুঁজে বের করতে হলো। কাজটা হয়ে যাবার পর জর্জের দরকার পড়ল দাড়ি কামানো সরঞ্জামের। আমরা বলে দিলাম যে ওই সকালটা দাড়ি না কামিয়েই চালিয়ে নিতে হবে তাকে, কারণ তার জন্যে বা তার মত কোন লোকের জন্যে ব্যাগের জিনিসপত্র আমরা আবার বের করতে রাজি নই।
‘বোকার মত কথা বলো না, এ অবস্থায় আমি কিভাবে শহরে হেঁটে বেড়াব?’
শহরের জন্য ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কিছুটা নির্মম হবে বৈ কি, কিন্তু মানুষের দুঃখ কষ্টে আমাদের কি আসে যায়? হ্যারিস তার ইতর অশ্লীল ভঙ্গিতে বলে দিল যে শহরকে ওটা হজম করে নিতে হবে।
ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে নামলাম আমরা। মণ্টমোরেন্সি অন্য দুটো কুকুরকে নিমন্ত্রণ করে এনেছিল ওকে বিদায় জানাবার জন্যে। তারা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কামড়াকামড়ি করে সময় কাটাচ্ছিল। ছাতিপেটা করে কুকুরগুলোকে শান্ত করে আমরা বসে গেলাম চপ আর ঠাণ্ডা গোমাংস নিয়ে।
হ্যারিস বলল, ‘সকালের নাস্তাটা পেট পুরে খেয়ে নেয়াই উত্তম কাজ।’ কয়েকটা চপ নিয়ে শুরু করল সে। বলল যে ওগুলো গরম গরম খাওয়াই ভাল। মাংস পরে খেলেও চলে।
জর্জ খবরের কাগজটা কব্জা করে নৌকাডুবির খবর আর আবহাওয়ার পূর্বাভাস পড়ে শোনাতে লাগল। আবহাওয়ার খবরের শেষাংশে ‘বৃষ্টি, ঠাণ্ডা, আর্দ্র অবস্থা থেকে সুন্দর আবহাওয়া, মাঝে মাঝে স্থানীয়ভাবে বজ্রসহ ঝড়, পুবালী হাওয়া, মিড্ল্যাণ্ড, কাউন্টিগুলোর ওপর সাধারণ নিম্নচাপ’ ইত্যাদির উল্লেখ ছিল।
আমি মনে করি, যে সব অসম্ভব বিরক্তিকর বোকামি আমাদেরকে সইতে হয় তার মধ্যে নিকৃষ্টতম হচ্ছে এই ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’ নামক ছলনাটা। গতকাল বা পরশু যা ঘটে গেছে ঠিক সেটা এবং আজ যা ঘটতে যাচ্ছে তার ঠিক উল্টোটাই ঘটবে বলে এই পূর্বাভাস ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করে।
মনে পড়ে একবার হেমন্তের শেষে স্থানীয় এক খবরের কাগজের আবহাওয়া রিপোর্টের প্রতি মনোযোগ দেয়ার ফলে আমার ছুটিটা পুরাপুরি বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। কাগজটাতে সোমবারের রিপোর্টে থাকত ‘আজ বজ্রসহ প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।’ ফলে বনভোজনে না গিয়ে আমরা সারাদিন ঘরে বসে থাকতাম কখন ঝড়বৃষ্টি শুরু হবে তার অপেক্ষায়। ওদিকে লোকেরা মহা ফূর্তিতে ছোটছোট ওয়াগন আর ঘোড়ার গাড়িতে চেপে পিকনিকে চলে যেত আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। নির্মেঘ আকাশ ঝলমল করত প্রচুর সূর্য কিরণে।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা বলতাম, ‘আহা! ভিজে জবজবে হয়ে ফিরে আসবে বাছাধনেরা!’
কেমন কাকভেজা ভিজবে লোকগুলো সেকথা ভেবে মনে মনে হাসতে হাসতে আমরা সরে আসতাম জানালার কাছ থেকে। চুল্লীর আগুনটাকে উস্কে দিয়ে বসতাম বই নিয়ে। সাজিয়ে রাখতাম আমাদের কুড়ানো সাগর গুল্ম আর রঙিন ঝিনুকের খোলগুলো। বারোটা বাজতেই রোদ এসে হানা দিত আমাদের ঘরে। গরমটা হয়ে উঠত অসহ্য। বিস্ময়ের সাথে আমরা ভাবতাম — কখন শুরু হবে ওই সব ‘প্রবল বর্ষণ ও মাঝেমধ্যে বজ্রসহ ঝড়ের’ মাতন।
‘আহা হবে হবে, বিকেলের দিকে, দেখে নিও তুমি। ওহ্, কি ভিজাই না ভিজবে ওই ব্যাটারা! আহা কি মজা!’ বলে পরস্পরকে প্রবোধ দিতাম আমরা।
বেলা একটার দিকে আমাদের বাড়িঅলি এসে জিজ্ঞেস করতেন আমরা বাইরে যাব কিনা—যেহেতু দিনটা তো বেশ চমৎকার।
মনে মনে বিজ্ঞের হাসি হেসে জবাব দিতাম, ‘না-না, আমরা বেরুচ্ছি না। বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা আমাদের নেই।’
বিকেলও যখন শেষ হয়ে আসে এবং তবু বৃষ্টির কোন লক্ষণই দেখা যায় না তখন আমরা এই ভেবে নিজেদেরকে চাঙ্গা করে তুলতে চাইতাম যে বনভোজনে যাওয়া লোকগুলো যে সময় ফিরে আসতে শুরু করবে এবং তাদের কাছাকাছি আশ্রয় নেয়ার মত কোন জায়গা থাকবে না ঠিক তখনি ঝড়-বৃষ্টি-বজ্র সব একসাথে হুড়মুড় করে এসে পড়বে, আর এর ফলে ওরা অনেক অনেক বেশি ভিজবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক ফোঁটা বৃষ্টিও হত না। দিনটা চমৎকারভাবেই কাটত এবং দিনের শেষে নেমে আসত বৃষ্টিহীন সুন্দর রাত।
পরদিন কাগজ খুলে দেখতাম যে লেখা রয়েছে দিনটা হবে ‘উষ্ণ, আবহাওয়া চমৎকার থেকে মোটামুটি ভাল, গরমটা পড়বে একটু বেশি। কাজেই, হালকা পোশাকে বেরিয়ে পড়তাম আমরা। বেরুনোর ঘণ্টা আধেকের মধ্যেই শুরু হত মুষলধারায় বৃষ্টি এবং তার সঙ্গে তীব্র কনকনে হাওয়া। দুটোই চলত সারাদিন একনাগাড়ে। ঠাণ্ডা আর বাতে কাবু হয়ে আমরা কোন মতে ঘরে ফিরে এসে বিছানায় আশ্রয় নিতাম।
আবহাওয়া জিনিসটা আমার জ্ঞান-বুদ্ধির একদম বাইরে। কোন দিন আমি এই জিনিসটাকে বুঝলাম না। ব্যারোমিটার কোন কাজেই আসে না। আবহাওয়ার ‘পূর্বাভাসের’ মত ওটাও প্রতারক।
আজকের সকালটি বেশ উজ্জ্বল, রোদে ঝলমল। কাজেই জর্জের পড়ে শোনানো রক্ত-জমাট করা দুর্যোগময় আবহাওয়ার রিপোর্ট আমাদেরকে তেমন বেশি দমাতে পারল না। জর্জ যখন দেখল যে সে আমাদের মন খারাপ করে দিতে পারল না এবং বৃথাই গলাবাজি করে সময় নষ্ট করেছে, তখন করল কি, আমি যত্নের সঙ্গে নিজের জন্য যে সিগারেটটা বানিয়ে রেখেছিলাম ওটা আলগোছে তুলে নিয়ে চম্পট দিল।
আমি আর হ্যারিস টেবিলে অবশিষ্ট খাবার যা কিছু ছিল সেগুলো সব গলায় ঠেসে মালপত্র ঠেলায় চাপিয়ে দোরগোড়ায় নিয়ে গেলাম এবং অপেক্ষা করতে লাগলাম ঘোড়ার গাড়ির জন্য।
সব জিনিস একত্র করার পর দেখা গেল যে আমাদের মালপত্রের বহর অনেক। গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ, ছোট ছোট হাত-ব্যাগ, দুটো ঢাকনাঅলা বড় ঝুড়ি, কতগুলো কম্বলের একটা বড় বাণ্ডিল, চার-পাঁচটা ওভারকোট আর বর্ষাতি, গুটি কয়েক ছাতা এবং তারপর একটা থলের ভেতর আস্ত একটি তরমুজ। তরমুজটি এত বড় যে ওটাকে আর কোথাও ঢোকানো যায়নি। আরেকটা ব্যাগের মধ্যে কয়েক পাউণ্ড ওজনের আঙুর, একটা জাপানী ছাতা এবং হাত-কড়াই। হাত—কড়াইয়ের হাতলটা অতিরিক্ত লম্বা বলে ওটাকে কিছুর মধ্যে ঢোকানো সম্ভব ছিল না। আমরা তাই বাদামী রঙের কাগজে মুড়ে নিয়েছিলাম ওটাকে।
মালের বহরটি বেশ বড়ই দেখা যাচ্ছিল এবং সেজন্য হ্যারিস আর আমি কিছুটা লজ্জা পেতে শুরু করেছিলাম, যদিও ওতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে তা আমরা বুঝতে পারছিলাম না। কোন ঘোড়াগাড়ি এল না, এসে জুটল রাস্তার বখাটে ছেলেরা। স্পষ্টত তামাশাটা দেখে কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ওরা।
পয়লা এসে জুটল বিগস-এর ফুট-ফরমাশের ছোঁড়াটা। বিগ্স হচ্ছে আমাদের পাড়ার সব্জিঅলা। তার মূল প্রতিভা নিহিত রয়েছে মানব সভ্যতার দ্বারা এ যাবৎ সৃষ্ট চরম হতচ্ছাড়া আর নীতিজ্ঞানবর্জিত ছোঁড়াদের কাজে লাগানোর মধ্যে। আমাদের এলাকায় ছেলে-ছোকরাদের মহলে একটুখানি বাড়াবাড়ি রকমের দুর্ধর্ষ কিছু ঘটলেই আমরা ধরে নিই যে ওটা বিগ্সের নতুন ছোঁড়াটার কর্ম। শুনেছি, কোরাম স্ট্রীটের বড় খুনের সময় আমাদের রাস্তার বাসিন্দারা সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়েছিল যে ওই খুনের মূল নায়ক বিগ্স-এর ছোঁড়া (ওই সময়ে যে ছিল)। খুনের পরদিন সব্জির অর্ডার আনতে গেলে ১৯ নম্বর (১৯ নম্বর বাড়ির কর্তা) তাকে কড়া জেরা করেন (তখন ২১ নম্বর সিঁড়িতে উপস্থিত ছিলেন এবং ১৯ নম্বরকে জেরায় সাহায্য করেন)। জেরার জবাবে সে অকুস্থলে উপস্থিত না থাকার যে ওজর দেখায় সেটা সম্পূর্ণ সত্য প্রমাণিত না হলে তার মুশকিল হত। আমি ওই সময় বিগ্স-এর ছোঁড়াকে চিনতাম না। কিন্তু ওর পরেরগুলোকে যেমন দেখেছি তাতে আমি নিজে হলে সেই ওজরকে বেশি গুরুত্ব দিতাম না।
বিস-এর ছোঁড়াটা বেরিয়ে এসেছে কোণের দিক থেকে। প্রথম নজরে পড়ার সময় বোঝা যাচ্ছিল যে তার খুব তাড়া আছে। কিন্তু মালপত্র সহ আমাকে, হ্যারিসকে, আর মন্টমোরেন্সিকে দেখেই গতি কমিয়ে দিল সে এবং অপলক দৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখতে লাগল। হ্যারিস আর আমি কটমট করে তাকালাম তার দিকে। আরেকটু লাজুক গোছের কেউ হলে এতে আহত বোধ করত, কিন্তু বিগ্স-এর ছোঁড়ারা যথারীতি সংবেদনশীল হয় না। আমাদের দোরগোড়ার গজ খানেকের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। রেলিং-এ ঠেস দিয়ে একটুকরা খড় কুড়িয়ে নিয়ে চিবোতে চিবোতে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। স্পষ্ট বোঝা গেল, ব্যাপারটার শেষ অবধি দেখে যেতে চায়।
পর মুহূর্তে রাস্তার অন্য পাশে মুদীর ছোকরাটিকে যেতে দেখে ডাক দিল বিস-এর ছোকরা— ‘হেই, ০.৪২-এর নিচতলা কেটে পড়ছে র্যা।’
মুদীর ছোঁড়া রাস্তা পার হয়ে এসে সিঁড়ির আরেক পাশে দাঁড়াল। তারপরে জুতোর দোকানের ছোকরাটি এসে বিগ্স-এর ছোঁড়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল। খালি টিন কুড়ানো ছেলেটি এসে স্বাধীনভাবে অবস্থান নিল রাস্তার বাঁকে। জুতোর দোকানের ছোঁড়াটি মন্তব্য করল, “ওরা না খেয়ে থাকবে না, কি বলিস?’
‘আহা, ছোট্ট নৌকায় চেপে আটলান্টিক পাড়ি দিতে হলে দুয়েকটা জিনিস সঙ্গে নিতে হয় বৈ কি।’ বলল আরেকজন। এমন করে চলল আমাদের উদ্দেশ্যে বিদ্রূপ বর্ষণ।
ইতিমধ্যে সেখানে জনতার একটা ছোটখাট ভিড় জমে গেছে এবং লোকেরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছে ব্যাপার কি। এক দলের (জনতার মধ্যেকার কম বয়সী ও তরলমতি অংশের) মতে, ব্যাপার হলো বিয়ে। ওরা হ্যারিসকে দেখিয়ে দিল বর হিসাবে। জনতার মধ্যে যারা বয়স্ক ও একটু চিন্তাশীল তাদের ধারণা হলো যে কেউ একজন মারা গেছে এবং আমিই সম্ভবত সেই মৃত ব্যক্তির ভাই।
এরকম জল্পনার মধ্যে একটা গাড়ি এল (এ হচ্ছে এমন এক রাস্তা যেখানে দরকার না থাকলে মিনিটে তিনখানা করে খালি গাড়ি আসে, দাঁড়িয়ে থাকে, লোকের চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়)। মালপত্র সহ আমরা উঠে পড়লাম ওটায় গাদাগাদি করে। মন্টমোরেন্সির বন্ধুরা দেখা গেল ওকে ছাড়তে চায় না। ওদেরকে পেছনে ফেলে জনতার হর্ষধ্বনির মধ্যে আমরা ছুটে চললাম গাড়ি হাঁকিয়ে। বিগ্স এর ছোঁড়া আমাদের ভাগ্য কামনা করে একটা গাজর ছুঁড়ে মারল আমাদের দিকে।
ওয়াটারলু স্টেশনে পৌঁছলাম বেলা এগারোটায়। খোঁজ নিলাম এগারোটা পাঁচের গাড়ি কোনখান থেকে ছাড়ে। কেউ বলতে পারল না। ট্রেন কোন্ জায়গা থেকে ছাড়ে, ছাড়লে কোথায় যায়, এ সংক্রান্ত কোন তথ্য ওয়াটারলুতে কারও কখনও জানা থাকে না। আমাদের মাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে কুলিটি তার ধারণা ট্রেনটা ছাড়বে দুই নম্বর প্লাটফরম থেকে। সে আরেকজন কুলির সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করল। ওই লোকটা গুজব শুনেছে যে ট্রেনটা ছাড়বে এক নম্বর থেকে। এদিকে স্টেশন মাস্টারের ধারণা, ওটা লোকাল প্লাটফরম থেকে ছাড়বে
ব্যাপারটার নিষ্পত্তির জন্য দোতলায় গিয়ে ট্রাফিক সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে ধরলাম আমরা। তিনি বললেন, এইমাত্র একজন লোকের সাথে তাঁর দেখা হয়েছে। সেই লোকটা তাঁকে বলেছে যে ট্রেনটাকে সে তিন নম্বর প্লাটফরমে দেখে এসেছে। গেলাম আমরা তিন নম্বরে। সেখানকার কর্তারা বললেন তাঁদের ধারণা, যে ট্রেনটা ছেড়ে গেছে ওটা সাউদাম্পটন এক্সপ্রেস কিংবা উইণ্ডসর লুপ। তবে তাঁরা এ বিষয়ে নিশ্চিত যে ওটা কিংস্টনের ট্রেন নয়—যদিও কেন তাঁরা নিশ্চিত যে ওটা কিংস্টনের ট্রেন নয় সেকথা বলতে পারলেন না।
আমাদের কুলি বলল, তার মনে হচ্ছে ট্রেনটা রয়েছে হাই-লেভেল প্লাটফর্মে এবং ট্রেনটা সে চেনে। কাজেই আমরা হাই-লেভেল প্লাটফর্মে গিয়ে এঞ্জিন-চালকের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করলাম সে কিংস্টনে যাচ্ছে কিনা। লোকটা বলল, নিশ্চয় করে বলতে পারছে না, তবে তার মনে হয় সে যাবে। যাক, তার কথাবার্তা থেকে জানা গেল যে ১১.৫-এর কিংস্টনের ট্রেন নিয়ে যদি সে না যায় তাহলে ১-৩২-এর ভার্জিনিয়া ওয়াটার, সকাল ১০টার ওয়াইট দ্বীপের এক্সপ্রেস কিংবা ওদিকের কোন জায়গার ট্রেন নিয়ে যাবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। তার ট্রেন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেই আমরা জানতে পারব কোন্ ট্রেন নিয়ে সে গেল। তার হাতে আধা-ক্রাউন গুঁজে দিয়ে আমরা অনুনয় করলাম সে যেন ১১-৫-এর কিংস্টনের ট্রেনটাই নিয়ে যায়।
আমরা বললাম, ‘এই লাইনে কেউ কোনদিন জানবে না তোমারটা কোন্ ট্রেন এবং কোথায় যাচ্ছে। তুমি তো রাস্তা চেনো। চুপচাপ বেরিয়ে কিংস্টনে চলে যাও।’
‘ভদ্দরলোকরা, বুইজবার পারছি না কি করমু। তবে আমার মনে লয় কুন একখান টেরেইনের কিংস্টনে যাওন লাগব। ঠিক আছে, আমিই যামু। আধা—ক্রাউনডা দেন আমারে।’
এমনি করে লণ্ডন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম রেলওয়ে যোগে আমরা কিংস্টনে পৌঁছলাম।
পরে শুনেছি, যে ট্রেনটাতে কিংস্টনে পৌঁচেছি ওটা ছিল আসলে এক্সেটার মেইল। ওয়াটারলুতে লোকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খোঁজাখুঁজি করেও জানতে পারেনি ট্রেনটা কোথায় উধাও হয়েছে।
কিংস্টনে ঠিক পুলের নিচেই অপেক্ষা করছিল আমাদের নৌকা। মালপত্র বোঝাই করে আমরা উঠে পড়লাম তাতে।
‘আপনাগো হগল জিনিস ঠিক আছে ছার?’ প্রশ্ন করল নৌকার লোকটি।
‘সব ঠিক আছে,’ জবাব দিলাম আমরা। হ্যারিস তুলে নিল বৈঠা, আমি বসলাম হাল ধরে। বিষণ্ণ ভাব আর গভীর সন্দেহ নিয়ে মন্টমোরেন্সি বসল নৌকার আগার দিকে। তীরের মত নৌকা ছুটে গেল মাঝ নদীতে। একপক্ষকালের জন্য এটাই হবে আমাদের ঘরবাড়ি।