ত্রিরত্নের নৌবিহার – ৪

চার

খাবার-দাবার সম্পর্কে আলোচনার জন্য আবার মিলিত হলাম আমরা।

জর্জ বলল, ‘প্রথমেই শুরু করা যাক ব্রেকফাস্ট দিয়ে (জর্জ খুবই বাস্তববাদী)। ব্রেকফাস্টের জন্যে লাগবে একটা হাতকড়াই (হ্যারিস টিপ্পনী কেটে বলল—ওটা হজম করা যায় না। আমরা তাকে বলে দিলাম গাধার মত কথা না বলতে), একটা চায়ের পাত্র, কেটলি এবং মেথিলেটেড স্পিরিটের চুলো।’

এরপর আমাদের দিকে একটা অর্থব্যঞ্জক দৃষ্টি হেনে সে বলল, ‘না, না, তেলের চুলো নয়।’

হ্যারিস আর আমি রাজি হলাম তার প্রস্তাবে।

তেলের স্টোভ একবার নিয়েছিলাম আমরা, তবে আর নয়। সেই সপ্তাটা আমরা যেন তেলের দোকানে বাস করেছি। তেল চুঁইয়ে পড়ছিল সারাক্ষণ। প্যারাফিন তেল যে অমন করে চোঁয়ায় আমি কস্মিনকালেও দেখিনি।

স্টোভটাকে আমরা নৌকার একেবারে সামনের গলুইয়ের ওপর সরিয়ে রেখেছিলাম। তারপরও ওখান থেকে চুঁইয়ে তেল গোটা নৌকা আর নৌকার ভেতরকার সব কিছুকে জবজবে করে দিয়ে হাল পর্যন্ত পৌঁছে যায়, নদীতে গড়িয়ে পড়ে, গোটা দৃশ্যপটকে তৈলাক্ত এবং পরিবেশটাকে নষ্ট করে দেয়। একবার তৈলাক্ত পশ্চিমী হাওয়া, আরেকবার তৈলাক্ত পুবালী হাওয়া এবং কখনও তৈলাক্ত উত্তুরে বাতাস, আবার হয়তো বা দখিনে বাতাস বইতে থাকে। মেরু অঞ্চলের তুষার প্রান্তর কিংবা মরুঅঞ্চলের বিরান বালুভূমি—যেখান থেকেই এসে থাকুক না ওই বাতাস—আমাদের কাছে ওটা এসেছে প্যারাফিনের গন্ধ বয়ে।

চোঁয়াতে চোঁয়াতে ওই তেল সূর্যাস্তের দৃশ্যটাকেও মাটি করে দিয়েছিল। আর, চাঁদের আলোর কথা কি বলব, ওটাও ছিল সম্পূর্ণভাবে প্যারাফিনের গন্ধমাখা।

মার্লোতে পৌঁছে আমরা চেষ্টা করি গন্ধটা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার। পুলের কাছে নৌকা রেখে হাঁটতে থাকি শহরের রাস্তায় রাস্তায়। কিন্তু যেখানেই যাই গন্ধটা আমাদের পিছু নেয়। গোটা শহরটা ভরে গেছে প্যারাফিনের গন্ধে। গির্জার লাগোয়া গোরস্থানের ভেতর দিয়ে গেলাম। মনে হলো, মুর্দাগুলোকে যেন তেলের মধ্যে কবর দেয়া হয়েছে। হাইস্ট্রীটটা দেখা গেল তেলের গন্ধে ভরপুর। আমরা অবাক হয়ে ভাবলাম, লোকে ওখানে বাস করে কিভাবে? বার্মিংহামের পথ ধরে হাঁটলাম মাইলের পর মাইল। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। দেশটা তেল জবজবে হয়ে গিয়েছিল এক্কেবারে।

শেষে মাঝরাতে এক নির্জন মাঠে অভিশপ্ত এক ওক গাছের তলে বসে বিশ্রী শপথ নিলাম আমরা (ব্যাপারটা নিয়ে গোটা সপ্তাহ ধরে প্রচলিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকী ভাষায় আমরা গালাগাল দিচ্ছিলাম, কিন্তু এবারেরটা ছিল অত্যন্ত কড়া ধাঁচের)। আমরা শপথ করি যে আর কোন দিন, অবশ্য অসুখ-বিসুখের ব্যাপার ছাড়া, নৌকায় প্যারাফিন তেল নিয়ে যাব না।

কাজেই, বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা নিজেদেরকে মেথিলেটেড স্পিরিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখলাম। এটাও বেশ খারাপ। মাংস-পুরি, কেক ইত্যাদিতে মেথিলেটেড স্পিরিট মিশে যায়। তবে বেশি মাত্রায় মেথিলেটেড স্পিরিট দেহযন্ত্রে ঢোকানো প্যারাফিনের চাইতে উপকারী।

ব্রেকফাস্টের অন্যান্য উপাদান সম্পর্কে জর্জ বলল ডিম আর বেকন নেয়ার কথা। ওগুলো রান্না করা সোজা। আর নিতে বলল কোল্ড মিট, রুটি-মাখন, চা ও জ্যাম। লাঞ্চের জন্য নেয়া যায় বিস্কুট, কোল্ড মিট, রুটি-মাখন আর জ্যাম। তবে পনির নয়। পনির তেলের মতই বড্ড গন্ধ ছড়ায়, গোটা নৌকাটাকে নিজের দখলে নিতে চায়। ঝুড়ি ভেদ করে বেরিয়ে সব কিছুতে একটা পনিরী গন্ধ মাখিয়ে দেয়। আপনি বুঝতে পারবেন না আপেলের পিঠা না জার্মান সসেজ, স্ট্রবেরি না ক্রীম খাচ্ছেন। সব কিছুই লাগবে পনিরের মত। বড্ড বেশি গন্ধ ছড়ায় পনির।

মনে পড়ে আমার এক বন্ধু একবার লিভারপুলে কিছু পনির কিনেছিল। চমৎকার পনির। বেশ পরিপক্ক, নরম এবং দুই শ’ অশ্বশক্তি সম্পন্ন গন্ধযুক্ত। গন্ধটা তিন মাইল পর্যন্ত ছুটে যেতে পারে এবং দুই শ’ গজ দূরের কোন মানুষকে গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারে। আমিও ওই সময় ছিলাম লিভারপুলে। বন্ধুটি আমাকে বলল আমি যদি কিছু মনে না করি তাহলে সে আমাকে দিয়ে ওগুলো লণ্ডনে পাঠাবে, কারণ তার ফিরতে এক বা দু’দিন দেরি হবে এবং পনির বেশি দিন রেখে দেয়া ঠিক নয় বলে তার বিশ্বাস।

আমি জবাব দিলাম—‘আরে দোস্ত, মনে করার কি আছে? খুশির সাথে নিয়ে যাব।’

পনিরগুলো নিয়ে চাপলাম এক ঘোড়ার গাড়িতে। গাড়িটা ছিল একদম ঝুরঝুরে। ওটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক হাঁটু ভাঙা দমহারা ঘুমন্ত প্রাণী। আলাপ প্রসঙ্গে তার মালিক ওটাকে ক্ষণিকের উৎসাহে ‘ঘোড়া’ বলে উল্লেখ করল। পনিরগুলোকে ওপরে রেখে আমরা যাত্রা শুরু করলাম নেঙচাতে নেঙচাতে, এমন এক গতিতে যা এ যাবৎ তৈরি যে কোন দ্রুতগামী স্টীমরোলারের গতিকে হার মানাবে। শবযাত্রার ঘণ্টাধ্বনির মত আনন্দ ছড়িয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম রাস্তার মোড় পর্যন্ত। মোড়টা ঘুরতেই এক ঝলক পনিরের গন্ধমাখা হাওয়া গিয়ে ভক্ করে লাগল আমাদের বাহনের নাকে। ঘুম ভেঙে গেল তার। অমনি আতঙ্কে চিঁহি চিঁহি আওয়াজ তুলে ঘণ্টায় তিন মাইল বেগে ছুটতে লাগল সামনের দিকে। বাতাস তখনও তার দিকেই বইছিল। রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছানোর আগে সে ছুটতে লাগল ঘণ্টায় প্রায় চার মাইল বেগে, ল্যাংড়া-খোঁড়া আর ধুমসো মহিলাদেরকে রাস্তা থেকে সরবার সময় পর্যন্ত না দিয়ে।

স্টেশনে পৌঁছার পর ওটাকে থামাতে কোচোয়ান ছাড়া আরও দু’জন কুলিকে লাগাতে হলো। তারপরও থামান যেত বলে আমার মনে হয় না যদি ওটার নাকে রুমাল চাপা দেয়ার এবং বাদামী রঙের এক টুকরো কাগজে আগুন ধরিয়ে ওটার নাকের সামনে ধরার উপস্থিত বুদ্ধিটা কুলিদের একজনের মগজে না গজাত।

ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে টিকেট কিনে পনির নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে এবার প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করলাম। সসম্ভ্রমে পিছিয়ে দাঁড়াল দু’পাশের লোক। ট্রেনে তিল ধারণের, জায়গা নেই। আমাকে এমন একটা কামরায় উঠতে হলো যেখানে ইতিমধ্যেই সাতজন যাত্রী রয়েছেন। খিট্‌খিটে মেজাজের এক বুড়ো আপত্তি করলেন। কিন্তু সেটা গ্রাহ্য না করেই আমি উঠে পড়লাম। র‍্যাকের ওপর পনির রেখে মুখে মিষ্টি হাসি মেখে চেপে চিপে বসে বললাম, ‘গরমটা আজ বেশ পড়েছে।’

কয়েক মুহূর্ত কাটল নিঃশব্দে। তারপরই বুড়োটি উসখুস করতে আরম্ভ করলেন।

‘বড্ড ঠাসাঠাসি এখানে,’ বললেন তিনি।

‘রীতিমত কষ্টকর,’ মন্তব্য করলেন তাঁর পাশের লোকটি।

তারপর দু’জনেই নাক উঁচিয়ে শুঁকতে লাগলেন। তিনবার শোঁকার পর গন্ধটা তাঁদের কলজে তক পৌঁছে গেল এবং আর একটি কথাও না বলে দু’জনে নেমে গেলেন কামরা থেকে। এবার এক হোঁৎকা মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন যে একজন বিবাহিত সম্মানিত মহিলাকে এভাবে নাকাল করা লজ্জাজনক। এই বলে একটা ব্যাগ আর গোটা আষ্টেক পোঁটলা-পুঁটলি গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। বাকি রইলেন চারজন। অবশেষে কোণে বসা গুরুগম্ভীর গোছের লোকটি, পোশাক আর চেহারা সুরতে মুর্দাফরাসের মত, বলে উঠল যে গন্ধটা মৃত শিশুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে তাকে। এটা শুনেই অন্য তিনজন এক সঙ্গে দরজা দিয়ে বেরুবার চেষ্টায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করল, ব্যথাও পেল তবু একসঙ্গেই নেমে গেল।

আমি ময়লা চেহারার লোকটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, ‘কামরাটা বোধ হয় আমাদের দু’জনের দখলেই থেকে যাবে। খুশির হাসি হেসে লোকটি বলল, ‘কিছু কিছু মানুষ সামান্য জিনিস নিয়ে বড় বেশি হৈ চৈ করে।’ কিন্তু গাড়িটা চলতে শুরু করার পর ওই লোকটাও অদ্ভুত রকম মনমরা হয়ে পড়ল। কাজেই, ক্রিওয়েতে পৌঁছে আমি তাকে বললাম, ‘চলুন, একটুখানিক মদ ঢেলে আসি গলায়।’ রাজি হলো সে। ঠেলেঠুলে আমরা ঢুকে পড়লাম ‘বুফে’র মধ্যে। আধ ঘণ্টা যাবৎ চেঁচিয়ে, মেঝেতে পা ঠুকে, ছাতা নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টার পর এক তরুণী এসে জানতে চাইল আমরা কি চাই।

‘আপনাকে কি দেবে?’ জিজ্ঞেস করলাম সহযাত্রীটিকে।

সে বলল, ‘আমাকে দয়া করে আধা ক্রাউনের ব্র্যাণ্ডি দাও, পানি ছাড়া।’

ব্র্যান্ডিটা গিলে নিঃশব্দে উঠে অন্য কামরায় চলে গেল লোকটা। এটাকে তার নিতান্ত ছোটলোকের আচরণ বলে মনে হলো আমার।

ক্রিওয়ে থেকে গোটা কামরাটায় রইলাম আমি একা, যদিও ট্রেনটা ছিল যাত্রীতে ভর্তি। বিভিন্ন স্টেশনে গাড়ি থামলে আমার কামরাটা খালি দেখে লোকেরা ছুটে আসতে লাগল। ‘ওরে মারিয়া, শিগগির আয়, অনেক জায়গা এখানে,’ ‘ঠিক আছে টম, আমরা এখানেই উঠব,’ বলে চেঁচামেচি জুড়ে দিল তারা। ভারি ভারি ব্যাগ বয়ে নিয়ে ছুটে আসল, পয়লা ওঠার জন্য দরজার সামনে ঠেলাঠেলি ধ্বস্তাধ্বস্তি করল। তারপর দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠেই ঢলে পড়তে লাগল পেছনের লোকের বাহুর মধ্যে। এভাবে সবাই এক একবার উঠল এবং গন্ধ শুঁকে লাফিয়ে পড়ল নিচে, ঠেলেঠুলে কোনক্রমে ঢুকে পড়ল অন্য কামরায় কিংবা বাড়তি পয়সা দিয়ে প্রথম শ্রেণীর কামরায়।

ইয়ুস্টনে নেমে পড়লাম আমি। পনির নিয়ে হাজির হলাম বন্ধুর বাড়িতে। তার বউ এসে চারপাশে নাক বাড়িয়ে শুঁকে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে বলুন তো? আমি যে কোন খারাপ খবরের জন্যে তৈরি আছি।’

জবাব দিলাম, ‘এটা পনির। টম লিভারপুলে কিনেছে এবং আমাকে সঙ্গে করে আনতে বলেছে।’

আমি আরও বললাম, এতে যে আমার কোন হাত নেই সেটা আশা করি তিনি বুঝতে পারছেন। তিনি বললেন যে সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত, তবে টম ফিরলে তার সঙ্গে এ-বিষয়ে তিনি কথা বলবেন।

লিভারপুলে আমার বন্ধুর যতদিন থাকার কথা ছিল তার চাইতে বেশিদিন ওর থাকতে হলো। তিনদিন পরেও যখন সে ফিরল না তখন তার বৌ আমার সঙ্গে দেখা করে প্রশ্ন করলেন, পনিরের ব্যাপারে টম আপনাকে কি বলেছিল?’

জবাব দিলাম, সে বলেছে ওগুলোকে স্যাঁতসেঁতে কোন জায়গায় রাখতে এবং কাউকে ছুঁতে না দিতে।

‘কেউ ওগুলো ছোঁবে না। সে কি পনিরগুলো শুঁকে দেখেছিল?’

বললাম, আমার মনে হয় শুঁকে দেখেছে এবং আমি ওগুলোর প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ লক্ষ করেছি।

‘আমি যদি কাউকে ডেকে একটা সোনার মোহর দিয়ে তার সাহায্যে পনিরগুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলি তাহলে কি আপনার বন্ধুর মন খারাপ হবে?’ জানতে চাইলেন তিনি

জবাবে বললাম যে সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয় তার মুখে আর কোনদিন হাসি দেখা যাবে না।

হঠাৎ একটা বুদ্ধি গজাল বন্ধুপত্নীর মাথায়। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, আপনিই ওগুলো তার জন্য রেখে দিন না। আমি আপনার ওখানে পাঠিয়ে দি, কি বলেন?’

জবাব দিলাম, ‘ম্যাডাম, আমার নিজের কথা হচ্ছে, পনির আমি পছন্দ করি ওগুলো সাথে নিয়ে লিভারপুল থেকে লণ্ডন পর্যন্ত ট্রেন-ভ্রমণটা এক আনন্দময় ছুটিভোগের সুখকর পরিসমাপ্তি হিসেবে চিরকাল আমার মনে থাকবে। তবে কিনা এ দুনিয়াতে বাস করতে গেলে অন্য মানুষদের জন্যও কিছু বিবেচনা থাকা চাই। যে মহিলার ছাদের নিচে আমি থাকি তিনি একজন বিধবা এবং যদ্দূর জানি, একজন এতিম। অপরের অন্যায় সুযোগ গ্রহণের শিকার হতে তাঁর প্রবল ও সরব আপত্তি আছে। আমি সহজেই বুঝতে পারছি যে তাঁর বাড়িতে আপনার স্বামীর পনিরের উপস্থিতিকে তিনি একটা অন্যায় সুযোগ গ্রহণ বলেই গণ্য করবেন এবং আমিও এটা চাইতে পারিনে যে একজন বিধবা ও এতিমের কাছ থেকে অন্যায় সুযোগ নিয়েছি এমন কথা কেউ আমাকে বলুক।’

‘বেশ, বেশ, উঠতে উঠতে বললেন বন্ধুপত্নী। ‘আমার যা বলার সেটা হলো এই যে ওই পনির খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি বাচ্চাদের নিয়ে হোটেলে থাকব। ওগুলোর সাথে এক বাড়িতে আমি থাকব না।’

বন্ধুপত্নীর যে কথা সেই কাজ। ঠিকা-ঝির জিম্মায় বাড়ি ছেড়ে দিয়ে হোটেলে উঠলেন। ঠিকা-ঝিকে যখন প্রশ্ন করা হলো যে গন্ধটা তার সহ্য হচ্ছে কিনা, সে জবাব দিল, “কিসের গন্ধ?’ তাকে পনিরের কাছে নিয়ে গিয়ে জোরে শ্বাস নিতে বলা হলো। এবার সে বলল যে তরমুজের একটা ক্ষীণ-গন্ধ পাচ্ছে বটে। তখন যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হলো যে ওই আবহাওয়ায় মেয়ে মানুষটির কোন ক্ষতি হবে না। কাজেই তাকে ওখানে রেখে যাওয়া হলো।

হোটেলের বিল ওঠে পনেরো গিনি। সব কিছুর হিসেব মিলিয়ে আমার বন্ধু দেখে যে ওই পনিরের প্রতি পাউণ্ডের জন্য তার খরচ পড়েছে ৮ গিনি ৬ পেন্স। সে বলল যে পনির তার খুবই প্রিয় বটে, তবে অত দামী পনির খাওয়ার সাধ্য তার নেই। কাজেই ওগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কৃতসংকল্প হলো সে। পনিরগুলোকে সে ফেলে দিল খালের মধ্যে। কিন্তু বজরাওয়ালারা আপত্তি তোলায় তাকে আবার খাল থেকে ওগুলো তুলে নিতে হয়। বজরাওয়ালাদের আপত্তির কারণ এই যে গন্ধে নাকি ওদের মূর্ছা যাবার মত অবস্থা হয়েছিল

এরপর আমার বন্ধু করল কি, এক অন্ধকার রাতে ওগুলো রেখে এল পাদ্রীর বাড়ির মুর্দা ঘরের মধ্যে। কিন্তু করোনার সাহেব মূর্দা-ঘরে ওগুলো আবিষ্কার করে বিষম হৈ-চৈ বাধিয়ে দিলেন। করোনারের বক্তব্য: ওই পনির মুর্দাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে এবং ফলে তাঁর ভাত মারা যাবে। তাঁকে ভাতে মারার ষড়যন্ত্র করেই ওগুলো ওখানে রাখা হয়েছে।

অগত্যা আমার বন্ধু উপকূলীয় এক শহরে ওগুলো নিয়ে গেল এবং ওখানে সাগরতীরের বালির মধ্যে পুঁতে রাখল। এইভাবে সে মুক্তি পেল ওই পনিরের হাত থেকে।

এদিকে এই ঘটনার ফলে শহরটার খ্যাতি বেড়ে গেল। দর্শনার্থীরা বলতে লাগল যে বাতাস কত ভারি হয়ে উঠতে পারে সেটা এমন করে এর আগে আর কখনও তারা টের পায়নি। এরপর থেকে বহু বছর ধরে সেখানে দুর্বল ফুসফুসের অধিকারী ও ক্ষয়রোগীদের ভীড় লেগে ছিল।

সুতরাং পনির আমার প্রিয় বস্তু হলেও আমি মনে করি যে ওটা নিতে অস্বীকার করে ঠিকই করেছে জর্জ।

জর্জ বলল, ‘চায়ের দরকার হবে না আমাদের’ (হ্যারিসের মুখটা গোমড়া হয়ে গেল এতে), ‘তবে সাতটায় ডিনারের সাথে চা থাকবে এবং নৈশভোজটা হবে বেশ জাঁকাল।

এবার খুশি হয়ে উঠল হ্যারিস। জর্জ মাংস, ফলের পিঠা, কোল্ড মিট, টমেটো, ফল আর শাক-সবজি নেবার কথা বলল। পানীয় হিসাবে যাবে হ্যারিসের উদ্ভাবিত এক চমৎকার আঠাল ধরনের জিনিস—যেটা পানির সাথে মিশিয়ে খেতে হয়। জিনিসটাকে নাকি লেমোনেড বলা হয়। আর থাকছে এক বোতল হুইস্কি। জর্জের ভাষ্যমতে, নৌকা উল্টে গেলে নদীতে ডুব দিয়ে উঠে ওটা ব্যবহার করা যাবে।

আমার মনে হলো, জর্জটা যেন নৌকা উল্টে যাবার ব্যাপারে একটু বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এরকম মনোভাব নিয়ে কোথাও যাত্রা করা ভুল।

হুইস্কি নেয়ায় আমি খুশি হয়েছি। বিয়ার বা ওয়াইন আমরা নিইনি। নদীপথে ওসব নেয়া ঠিক নয়, শরীরকে নিদ্রালু ও ভারি করে তোলে। বিকেলে শহরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়ে মেয়ে দেখে বেড়াতে হলে এক গ্লাস মন্দ নয়। কিন্তু দুপুরের গনগনে রোদ যখন মাথার চাঁদি ফাটিয়ে দিতে চায় তখন কিন্তু ওসব খাবেন না, কারণ তারপরেও আপনাকে পরিশ্রম করতে হবে।

পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে আমরা যা যা নেব তার একটা তালিকা তৈরি করে ফেললাম। বেশ লম্বাই হলো তালিকাটা। পরের দিনটা ছিল শুক্রবার। জিনিসপত্র সব জোগাড় করে বাঁধা-ছাঁদা করার উদ্দেশ্যে শুক্রবার বিকেলে আবার একত্র হলাম সবাই। একটা ইয়াব্বড় ঢাউস-মার্কা গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ আনা হয়েছে। সব কাপড়-চোপড় ভরার জন্য। খাওয়ার জিনিস আর রান্নার সরঞ্জামের জন্য জোগাড় করা হয়েছে কয়েকটা ঝুড়ি। টেবিলটা জানালার কাছে ঠেলে রেখে সব কিছু স্তূপাকারে মেঝের মধ্যখানে জমিয়ে চারদিকে গোল হয়ে বসে আমরা সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমি বললাম বাঁধা-ছাঁদা গোছানো সব আমিই করব।

এই ব্যাপারে নিজের দক্ষতা নিয়ে আমার কিছুটা গর্বই আছে। অনেক বিষয়ের মধ্যে (দুনিয়াতে আর কত অসংখ্য বিষয় আছে তা ভেবে নিজেই একেক সময় আশ্চর্য হয়ে যাই) এটা হচ্ছে অন্যতম যার সম্পর্কে আমি অন্য যে কোন জীবিত মানুষের চেয়ে বেশি জানি বলে মনে করি। জর্জ আর হ্যারিসকে সেকথা বোঝালাম এবং আমার ওপর গোটা ব্যাপারটা ছেড়ে দিতে বললাম। তারা এত সহজে কথাটা মেনে নিল যে ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক বলে মনে হলো না আমার। জর্জ পাইপ ধরিয়ে ইজি-চেয়ারে শুয়ে পড়ল, আর হ্যারিস পা দুটো টেবিলে তুলে দিয়ে সিগারেট ধরাল।

আমি এমনটি চাইনি। আমি যা বোঝাতে চেষ্টা করেছি, অর্থাৎ চেয়েছি, সেটা হলো এই যে কাজটার ওপর আমি মোড়লী করব এবং হ্যারিস আর জর্জ আমার নির্দেশ মত ছোটাছুটি করবে। মাঝে মাঝে তাদেরকে আমি বলব, ‘অ্যাই, কি হচ্ছে!’ ‘এই যে, ওটা আমাকে করতে দাও।’ ‘দেখলে তো, কাজটা কেমন সহজ!’ ইত্যাদি। বলতে পারেন, আসলে আমি তাদেরকে হাতে-কলমে কাজটা শেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা ব্যাপারটাকে যেভাবে নিল তাতে বিরক্ত হলাম। আমি কাজ করছি আর অন্য লোক বসে বসে সময় কাটাচ্ছে এটা দেখার চেয়ে বেশি বিরক্তিকর আমার কাছে আর কিছু নেই।

এক সময় আমি একজনের সাথে থাকতাম। সে এই কায়দায় আমাকে খেপিয়ে তুলত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি কাজকর্ম করতাম, আর সে সোফায় গা এলিয়ে তাই দেখত। ঘরের যেদিকেই যাই তার চোখ আমাকে অনুসরণ করত। লোকটা বলত আমি কেমন করে জিনিসপত্র সব বিশৃঙ্খল করে তুলছি সেটা দেখতে ওর নাকি সত্যি ভাল লাগে। আমার কাজ দেখে সে অনুভব করত যে জীবনটা হা করে বসে থেকে বা হাই তুলে কাটিয়ে দেবার মত অলস স্বপ্ন নয়, জীবন হচ্ছে কর্তব্য ও কঠোর শ্রমে ভরা এক মহৎ কর্মযোগ। সে বলত, আমাকে না দেখলে, কার্যরত অবস্থায় কাউকে লক্ষ না করলে জীবনটা তার কেমন করে কাটত সেটা ভেবে এখন সে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যায়।

আমি ওরকম লোক নই। আমি বসে বসে অন্যকে খেটে মরতে দেখতে পারিনে। আমার ইচ্ছা হয় উঠে গিয়ে দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে কর্মরত মানুষটার চারদিকে হাঁটতে হাঁটতে তার কাজের তত্ত্বাবধান করি, কিভাবে কোন্ কাজটা করতে হবে সেটা বলি। এ হচ্ছে আমার উদ্যমশীল স্বভাব। এরকম না করে আমি পারিনে।

যাই হোক, কিছু না বলে আমি প্যাকিং শুরু করলাম। কাজটা যতটা ভেবেছিলাম তার চাইতেও বেশ দীর্ঘ বলে মনে হলো। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাগটা আমি বোঝাই করলাম এবং ওটার ওপর চেপে বসে ফিতে দিয়ে বেঁধে ফেলতে পারলাম।

‘বুটগুলো ঢোকাবে না?’ আচমকা জিজ্ঞেস করল হ্যারিস।

চোখ তুলে তাকালাম চারদিকে, দেখলাম যে বুটগুলো ভুলে বাইরে রেখে দিয়েছি। এই-ই হলো হ্যারিসের স্বভাবসিদ্ধ কাজ। আমি ব্যাগটার মুখ এঁটে ফিতে দিয়ে বেঁধে ফেলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একটা কথাও সে মুখ থেকে বের করেনি। আর জর্জ? সে হাসছে—তার সেই বিরক্তিকর, অর্থহীন, চাপা, চোয়াল ফাটা হাসি – যা দেখলে আমার মগজে আগুন ধরে যায়। ব্যাগ খুলে বুটগুলো ঢোকালাম। তারপর যে-ই না ওটা বন্ধ করতে যাচ্ছি অমনি এক আতঙ্কজনক চিন্তা আমার মনে এল, টুথ-ব্রাশ নিয়েছি তো? জানিনে এটা কেমন ব্যাপার হলো, তবে ওটা নিয়েছি কিনা তা আমার মনে পড়ল না।

কোথাও ভ্রমণে বেরুলে টুথ-ব্রাশটা আমাকে সব সময় জ্বালায়, জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। আমি স্বপ্নে দেখি—ওটা নিইনি। ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে যায় শরীরটা, জেগে উঠি ধড়মড় করে, বিছানা ছেড়ে খুঁজতে থাকি। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে সকালে দাঁত না মেজেই ওটাকে আমি বেঁধে-ছেঁদে রেখে দিয়েছি। সে কথা মনে না পড়ায় ওটার জন্য পোঁটলা-পুঁটলি আবার খুলি। ঘাঁটতে ঘাঁটতে ওটার হদীস মেলে একেবারে সব জিনিসের নিচে। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে ওটার কথা আবার ভুলে যাই। শেষ মুহূর্তে ওটার খোঁজে ছুটে যাই দোতলায়। অবশেষে রুমালে বেঁধে ওটাকে নিয়ে যাই স্টেশনে।

এখনও দোতলা থেকে টুথব্রাশ আনলাম বটে, তবে হারিয়ে ফেললাম। অবশ্যই জিনিসপত্র সব আবার বের করলাম এবং ওটা খুঁজে পেলাম না। দুনিয়া সৃষ্টির আগে সব কিছু যেমন যত্রযত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ঠিক তেমনিভাবে জিনিসপত্র ওলট-পালট করে ফেললাম। ফলে এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হলো। জর্জ আর হ্যারিসের টুথ-ব্রাশ আমি খুঁজে পেলাম আঠারো বার, কিন্তু নিজেরটা পেলাম না। সব কিছু এক এক করে ঝেড়ে দেখলাম, গুছিয়ে রাখলাম। শেষকালে ওটাকে পাওয়া গেল জুতোর ভেতরে। তখন আরেকবার সব বাঁধা-ছাঁদা করলাম।

কাজটা শেষ করার পর জর্জ জিজ্ঞেস করল, সাবানটা ভেতরে রেখেছি কিনা। ‘সাবান রাখা হয়েছে কি হয়নি ওতে কিস্সু আসে যায় না আমার,’ এ বলে ব্যাগটা বন্ধ করে ফিতে দিয়ে বেঁধে ফেললাম। আর বাঁধার পরেই খেয়াল হলো-আমার তামাকের থলেটি তো রয়ে গেল ভেতরে! আবার খুলতে হলো ব্যাগ।

শেষ বারের মত ব্যাগটি বন্ধ করলাম রাত ১০.৫ মিনিটে। ঝুড়ি বোঝাই-এর কাজ তখনও বাকি। হ্যারিস বলল যে বারো ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আমাদের যাত্রা করা উচিত এবং সে মনে করে যে বাকি কাজটুকু সে আর জর্জ মিলে করলেই ভাল হবে। আমি রাজি হয়ে বসে পড়লাম এবং তারা দু’জন লেগে গেল।

তারা হালকা মেজাজে শুরু করল। স্পষ্টত তাদের উদ্দেশ্য, কাজ কেমন করে করতে হয় সেটা আমাকে দেখিয়ে দেয়া। আমি অপেক্ষা করে রইলাম। কোন মন্তব্য করলাম না। জর্জের ফাঁসি হলে হ্যারিস হবে এই পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ‘প্যাকার।’ স্তূপীকৃত প্লেট, পেয়ালা, কেটলি, বোতল, বোয়েম, মাংসের পিঠা, স্টোভ, কেক, টমেটো ইত্যাদির দিকে তাকিয়ে আমি অনুভব করলাম ফে ব্যাপারটা শিগগিরই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।

হলোও তাই। একটা কাপ ভাঙার মাধ্যমে তারা শুরু করল এবং ওটাই ছিল তাদের পয়লা কাজ। ওরা কি করতে পারে সেটা দেখানোর জন্য এবং তাদের কাজ সম্পর্কে লোকের আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্যই ওটা করল ওরা।

এরপর হ্যারিস একটা টমেটোর ওপর স্ট্রবেরির জ্যাম চাপিয়ে টমেটোটাকে পিষে ফেলল এবং শেষে চামচ দিয়ে টমেটোটাকে তুলে নিতে হলো।

এবার এল জর্জের পালা। সে পায়ের তলায় মাখন মাড়িয়ে ফেলল। কিছুই না বলে আমি এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ধার ঘেঁষে বসলাম, আর তাদের কাণ্ড দেখতে লাগলাম। কোন কিছু বললে ওরা যতটা বিরক্ত হত এতে তার চাইতে বেশি হলো। আমি সেটা টের পেলাম। আমার এ নীরব দর্শকের ভূমিকা তাদের স্নায়ুকে উত্তপ্ত ও উত্তেজিত করে তুলল। তারা জিনিসপত্র পায়ে মাড়াতে, নিজেদের পেছনে রেখে দিয়ে দরকারের সময় খুঁজে না পেতে শুরু করল। মাংসের পিঠাগুলোকে তারা রাখল এক্কেবারে নিচে, ওপরে ভারি ভারি জিনিস চাপিয়ে পিঠাগুলোকে দিল গুঁড়িয়ে। বাটি উল্টে ফেলে সব কিছুর ওপর লবণ ঢেলে দিল মাখনের কথা আর কি বলব। এক শিলিং দুই পেনি দামের মাখন নিয়ে তারা দু’জনে যে কাণ্ডটা করল তার চাইতে বেশি কিছু করতে আমি আর কাউকে দেখিনি.. জীবনে। জর্জ তার চটির তলা থেকে ল্যাপটানো মাখনটুকু ছাড়াবার পর ওরা ওটা কেটলির মধ্যে রাখার চেষ্টা করল। ঢোকানো গেল না। যেটুকু ঢুকল তাও বের হলো না। শেষ পর্যন্ত ওই মাখনটুকু চেঁচে তুলে ওরা চেয়ারের ওপর রাখল। একটু পরেই হ্যারিস গিয়ে বসল ওই চেয়ারে, মাখনটা আটকে গেল তার পাছায়, আর ওরা দু’জন সারা কামরায় তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল ওটা।

খালি চেয়ারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে জর্জ বলল, ‘আমি শপথ করে বলছি ওই চেয়ারের ওপরই মাখনটুকু রেখেছি।’

হ্যারিস বলল, ‘এক মিনিটও হয়নি, আমি দেখেছি তোমাকে মাখন রাখতে।’

এরপর তারা আবার কামরাময় খুঁজতে শুরু করল। আবার দু’জনে মুখোমুখি হলো কামরার মাঝামাঝি জায়গায় এবং একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে।

‘এমন অদ্ভুত কথা কোনকালেও শুনিনি,’ বলল জর্জ।

‘কি রহস্যময় ঘটনা!’ বলল হ্যারিস।

তারপর জর্জ ঘুরে হ্যারিসের পেছনে গিয়ে ওটা দেখতে পেল। দেখেই চৎকার করে উঠল। ‘এইযে, ওটা তো এখানে!’

হ্যারিস চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, ‘কোথায়?’

‘নড়ছ কেন, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারো না?’ গর্জে উঠে ছুটে গেল জর্জ হ্যারিসের দিকে।

হ্যারিসের পেছন থেকে মাখনটা তারা ছাড়াল এবং চায়ের বাটির মধ্যে রেখে দিল।

মণ্টমোরেন্সি অবশ্য এই সব কিছুর সাথেই জড়িত ছিল। ওর জীবনের একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো লোকের পায়ে পায়ে ঘোরা, চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা এবং গালমন্দ খাওয়া। যেখানে তার উপস্থিতি কেউ চায় না বিশেষভাবে সেখানে যদি সে ঘুর ঘুর করে বেড়াতে পারে, এক পুরাদস্তুর উৎপাত হয়ে দাঁড়াতে পারে, রেগেমেগে লোকে যদি তার মাথায় এটা ওটা ছুঁড়ে মারে, তাহলে সে ভাবে যে দিনটা তার বিফলে যায়নি।

তার উচ্চতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো—কেউ তার গায়ে হোঁচট খেয়ে ভূতলশায়ী হোক এবং এক ঘণ্টা ধরে একটানা তাকে গাল দিক। এই কাজে সফল হতে পারলে তার আত্মসন্তুষ্টি রীতিমত অসহ্য রকমের হয়ে দাঁড়ায়।

কোন জিনিস যখন গুছিয়ে রাখার দরকার হয় ঠিক তখনই সে এসে ওটার ওপর বসে পড়ে। হ্যারিস ও জর্জ কোন কিছুর জন্য হাত বাড়ালেই সে মনে করে যে ওরা তার ঠাণ্ডা ভেজা নাকটাই চাচ্ছে। এই স্থির বিশ্বাস নিয়ে সে চলে। জ্যামের মধ্যে পা ঢুকিয়ে দেয়, চা-চামচগুলোকে এলোমেলো করে এবং ভান করতে থাকে যেন লেবুগুলো সব ইঁদুর। হ্যারিস তার পিঠে কড়াইয়ের ঘা মারার আগেই তিনটা লেবু ইঁদুরকে সে হত্যা করল।

হ্যারিস বলল, আমি ওকে আস্কারা দিই। আস্কারা আমি দিইনে। সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আদি পাপ নিয়ে সে জন্মেছে, ওটাই তাকে দিয়ে এসব করায়।

বাঁধা-ছাঁদার কাজ শেষ হলো ১২-১০ মিনিটে। বড় ঝুড়িটার ওপর বসে হ্যারিস বলল, সে আশা করছে কোন কিছু ভাঙবে না। জর্জ বলল, ভাঙলে ভাঙবে। এই মন্তব্যটা তাকে যেন কিছুটা আরাম দিল। বলল, সে ঘুমোতে যাবে। ঘুমের জন্য আমরা সবাই তৈরি ছিলাম। হ্যারিস রাতটা আমাদের সাথেই কাটাবে। আমরা দোতলায় উঠে গেলাম।

কে কোথায় শোবে তা ঠিক হলো টসের মাধ্যমে। হ্যারিস আমার সাথে ঘুমাবে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি বিছানার কোথায়, ভেতরে না বাইরে ঘুমাতে পছন্দ করো?’

আমি বললাম, ‘সাধারণত বিছানার ভেতরে ঘুমানোই আমার পছন্দ।’

হ্যারিস মন্তব্য করল, ‘ওটা সেকেলে রীতি।’

জর্জ জানতে চাইল, ‘তোমাদের কখন জাগাব?’

হ্যারিস বলল, ‘সাতটায়।’

‘না, ছটায়,’ বললাম আমি। কারণ, সকালে কয়েকটা চিঠি লিখতে চাই।

হ্যারিস আর আমার মধ্যে এটা নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হলো, তবে শেষ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধানটাকে আধাআধি ভাগ করে আমরা আপস করলাম এবং দু’জনেই বললাম, ‘সাড়ে ছটায় আমাদেরকে জাগিয়ে দিও, জর্জ।’

জর্জ কোন জবাব দিল না। কাছে গিয়ে দেখলাম এরমধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজেই আমরা স্নানের গামলাটা তুলে এনে রাখলাম তার কাছে, যাতে সকালে উঠেই সে ওটার মধ্যে গড়িয়ে পড়তে পারে। এরপর নিজেরা ঘুমোতে গেলাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *