তিন
পরদিন সন্ধ্যায় পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাদি আলোচনার জন্যে আবার বসলাম। হ্যারিস বলল, ‘প্রথম কাজ হচ্ছে কি কি নিতে হবে সেটা ঠিক করা। জেরোম, তুমি এক টুকরো কাগজ নিয়ে লেখো তো। জর্জ, মুদীর ক্যাটালগটা এনে দাও। আর কেউ একজন আমাকে একটা পেন্সিল দাও না। তারপর আমি একটা তালিকা বানিয়ে ফেলব।’
এ-ই হচ্ছে হ্যারিস—আমাদের আদি ও অকৃত্রিম হ্যারিস—প্রথমে সব বোঝা নিজের ঘাড়ে নিয়ে পরে অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে অতি প্রস্তুত।
তাকে দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় বেচারা পোজার চাচার কথা। আমার পোজার চাচা কোন কাজে হাত দিলে সারা বাড়িময় এমন তুলকালাম কাণ্ড বেধে যেত যে তেমনটি আপনারা জীবনে কখনও দেখেননি। ধরুন, দোকান থেকে একটা ছবি বাঁধাই হয়ে এসেছে। টাঙানোর অপেক্ষায় ওটাকে ডাইনিং হলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। চাচী জিজ্ঞেস করবেন ওটার কি ব্যবস্থা হবে। চাচা বলবেন ‘ওহ্ ওটা? ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও—যা করবার আমিই করব।’
এর পরেই গায়ের কোটটা খুলে রেখে তিনি লেগে যাবেন। কাজের মেয়েটাকে পাঠাবেন ছ’ পেনি দামের পেরেক কিনে আনতে। পরক্ষণেই, ছেলেদের একজনকে পাঠাবেন কোন সাইজের পেরেক আনতে হবে সেটা ওকে বলে আসতে এবং এইভাবে আস্তে আস্তে তিনি গোটা বাড়িটাকে তাঁর কাজের মধ্যে জড়িয়ে ফেলবেন।
‘এখন উইল, তুমি গিয়ে আমার হাতুড়িটা নিয়ে এসো তো,’ হেঁকে উঠবেন তিনি। ‘আর টম, আমার রুলটা এনে দাও। মইটার দরকার আমার। রান্নাঘরের একটা চেয়ার আনলে ভাল হয়। জিম, এক দৌড়ে মি. গগল্স্কে গিয়ে বলো—বাবা আপনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং আশা করছেন যে আপনার পায়ের অবস্থা উন্নতির দিকে। এরপর, জানতে চাইবে তিনি তাঁর স্পিরিট-লেভেলটা একটু ধার দেবেন কিনা। আরে মারিয়া, তুমি চলে যেও না। বাতিটা উচিয়ে ধরার জন্যে কেউ একজন থাকা দরকার। আর, কাজের মেয়েটা ফিরে এলে ওকে আবার যেতে হবে ছবি বাঁধার রশি আনতে। এই যে টম, তুমি এখানে এসো। তুমি আমাকে ছবিটা তুলে দেবে।’
এবার তিনি ছবিটা তুলবেন, এবং তুলেই দেবেন ফেলে। ফ্রেম থেকে বেরিয়ে আসবে ছবিটা। তিনি চেষ্টা করবেন কাঁচটা বাঁচাতে এবং সেটা করতে গিয়ে কেটে ফেলবেন নিজের হাত। হাত কেটে ঘরময় লাফাতে লাফাতে রুমাল খুঁজতে থাকবেন তিনি। রুমাল পাওয়া যাবে না, কারণ ওটা রয়েছে তাঁর কোটের পকেটে। কোটটি তো তিনি খুলেই রেখেছেন, কিন্তু কোথায়—সেটা তাঁর মনে পড়বে না। বাড়ির সবাইকে যেতে হবে তাঁর যন্ত্রপাতি আর হাতিয়ারের খোঁজে, লাগতে হবে তাঁর কোটের সন্ধানে, আর তিনি লাফালাফি করে বিঘ্ন ঘটাতে থাকবেন সবার কাজে।
‘গোটা বাড়ির মানুষ কি কেউ জানে না আমার কোটটা কোথায় গেল? এরকম অকেজো লোকজন তো আমি কোনদিন দেখিনি। ছয় ছয়টা মানুষ তোমরা! আর কিনা মাত্র মিনিট পাঁচেক আগে যে কোটটা আমি খুলে রেখেছি ওটা খুঁজে পাচ্ছ না। বেশ হয়েছে… যত্তো…’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াবেন তিনি এবং দেখবেন যে কোটের ওপরই তিনি বসেছিলেন। এবার চেঁচিয়ে বলবেন সবাইকে, ‘হয়েছে, হয়েছে, ওটা পেয়ে গেছি। তোমাদেরকে কিছু খুঁজতে বলার চাইতে একটা বেড়ালকে বলাও অনেক ভাল।’
তাঁর কাটা আঙুল বাঁধতে, নতুন কাচ কিনে আনতে, যন্ত্রপাতি, মই, চেয়ার, মোমবাতি সব জোগাড় করতে আধ-ঘণ্টা কেটে যাবার পর তিনি আবার শুরু করবেন। গোটা পরিবারের লোক, কাজের মেয়ে, ঠিকা-ঝি সবাই তাঁকে সাহায্য করার জন্যে অর্ধবৃত্তের আকারে তৈরি হয়ে দাঁড়াবে। দু’জন তাঁর চেয়ার ধরে রাখবে, তৃতীয়জন তাঁকে চেয়ারে উঠিয়ে সেই অবস্থায় ধরে রাখবে, চতুর্থজন একটা পেরেক তুলে দেবে তাঁর হাতে, পঞ্চমজন বাড়িয়ে দেবে হাতুড়িটা। কিন্তু পেরেকটা হাতে নিয়েই ফেলে দিয়ে আহত সুরে বলে উঠবেন তিনি—‘আহা গেল পড়ে, পেরেকটা পড়ে গেল।’
আমরা সবাই তখন হাঁটু গেড়ে বসে হাতড়ে হাতড়ে পেরেক খুঁজতে থাকব মেঝেতে, আর ওই গোটা সময়টা চেয়ারে দাঁড়িয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকবেন তিনি, জানতে চাইবেন গোটা সন্ধেটা তাঁকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে কিনা।
শেষ পর্যন্ত পেরেক খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু এবার তিনি হারিয়ে ফেলবেন হাতুড়িটা।
‘হাতুড়িটা কোথায় গেল? ওটা নিয়ে কি করলাম আমি? হায় খোদা! তোমরা সাতটা মানুষ এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ অথচ জানো না হাতুড়িটা আমি কি করলাম।’
হাতুড়িও আমরা খুঁজে দেব। তখন দেয়ালে পেরেক পোঁতার জন্যে তিনি যে চিহ্নটা দিয়েছিলেন ওটা খুঁজে পাবেন না। আমরা তখন এক এক করে চেয়ারে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দেখব চিহ্নটা পাই কিনা এবং প্রত্যেকে আলাদা আলাদা জায়গায় ওটা দেখতে পাব। তিনি ‘বোকা’ বলে আমাদের সবাইকে নামিয়ে দেবেন এক এক করে। তারপর রুল হাতে নিয়ে নতুন করে মাপজোক শুরু করবেন। যে জায়গাটা তিনি চাচ্ছিলেন ওটার অবস্থান ঠিক করতে এবং কোণার দিক থেকে ওটার দূরত্ব মনে মনে মাপতে গিয়ে মগজটা তাঁর গরম হয়ে উঠবে।
আমরাও মনে মনে মাপতে গিয়ে একেকজন একেক জায়গায় পৌঁছব এবং তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে দেব। তখন সেই সার্বিক হট্টগোলের মধ্যে দূরত্বটা ঠিক কত হবে সেই মূল কথাটাই সকলে ভুলে যাব এবং চাচাকে আবার নতুন করে মাপা শুরু করতে হবে।
এবার তিনি একটা ফিতা নেবেন এবং চরম মুহূর্তে বোকা বুড়োটি চেয়ারে দাঁড়িয়ে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে ঝুঁকে তাঁর পক্ষে যতটা দূরে হাত বাড়ানো সম্ভব তারও ইঞ্চি তিনেক দূরের একটা জায়গা ছুঁতে চেষ্টা করবেন। অমনি ফিতেটা খসে পড়বে হাত থেকে, কাত হয়ে তিনি পড়ে যাবেন পিয়ানোর ওপর এবং তাঁর মাথা আর দেহটা হঠাৎ করে পিয়ানোর সকল ঘাটে একসাথে আঘাত হানার ফলে এক সত্যিকারের সুন্দর সঙ্গীত ধ্বনি বেজে উঠবে।
চাচা গালাগাল দিয়ে উঠবেন পিয়ানোটাকে।
ওই সময়, চাচী মারিয়া বলে উঠবেন যে বাচ্চাদেরকে ওখানে দাঁড়িয়ে ওরকম ভাষা তিনি শুনতে দেবেন না।
যাক, শেষ পর্যন্ত চাচা পেরেক ঠোকার জায়গাটা ঠিক করে বাঁ হাতে পেরেকের আগাটি ওখানে বসিয়ে ডান হাতে তুলে নেবেন হাতুড়ি। পয়লা ঘায়েই তাঁর বুড়ো আঙুলটি যাবে খ্যাতলা হয়ে। চিৎকার করে হাতুড়িটা তিনি ফেলে দেবেন আরেকজনের পায়ের আঙুলের ওপর।
চাচী মারিয়া তখন মৃদুস্বরে বলবেন যে তিনি আশা করেন ভবিষ্যতে দেয়ালে পেরেক ঠুকতে হলে পোজার তাঁকে আগে থেকে জানিয়ে দেবেন। তাহলে ওই সময় চাচী তাঁর মায়ের কাছে কাটিয়ে আসতে পারবেন।
‘আহ্-হা, একেই কিনা বলে মেয়ের জাত। তোমরা সব কিছুতেই বড্ড বাড়াবাড়ি করো,’ জবাব দেবেন চাচা নিজেকে সামলে নিতে নিতে। ‘কেন, হয়েছেটা কি? এধরনের ছোটখাট কাজ আমি একটু ভালবাসি, এই তো?’
তারপর আবার শুরু করবেন তিনি। দ্বিতীয় আঘাতের সাথে সাথে পেরেকটা এবার ভস করে ঢুকে যাবে প্লাস্টার ভেদ করে, পেরেকের পেছনে হাতুড়ির অর্ধেকটাও যাবে ঢুকে, ভীষণ জোরে হুমড়ি খেয়ে চাচা পড়ে যাবেন দেয়ালের ওপর, তাঁর নাকটা যাবে থ্যাবড়া হয়ে।
আবার আমাদের রুল, ফিতা ইত্যাদি যুগিয়ে দিতে হবে, আরেকটি নতুন ছিদ্র করা হবে এবং প্রায় মাঝ-রাতের দিকে ছবিটা টাঙানো হবে। ওটা ঝুলতে থাকবে একেবারে দুমড়ানো ও নড়বড়ে অবস্থায়। ছবির চারপাশের দেয়ালটা কয়েক গজ পর্যন্ত দেখাবে ক্ষতবিক্ষত, আঁচড়ানো। আর, শুধু চাচা ছাড়া অন্য সবাইকে দেখাবে শ্রান্ত, অবসন্ন।
চেয়ার থেকে নামতে গিয়ে তিনি ভারি পায়ে মাড়িয়ে দেবেন ঠিকা ঝির কড়া—পড়া পায়ের আঙুলগুলো। চারপাশের ওলট-পালট অবস্থার ওপর নজর বুলিয়ে স্পষ্ট গর্বের ভঙ্গিতে তিনি বলে উঠবেন, ‘এই বার হয়ে গেল। আরে আমি বুঝতেই পারিনে, এরকম সামান্য কাজের জন্যে লোকে কেন বাইরে থেকে মজুর ডেকে আনে!”
বয়স বাড়লে হ্যারিসও ঠিক এরকমই হবে। আমি জানি, এবং তাকে বললামও সেকথা। আরও বললাম যে তাকে অত কাজের ভার নিজের কাঁধে নিতে আমি দেব না-দিতে পারিনে।
‘নাহে, তুমিই কাগজ পেন্সিল ক্যাটালগ নাও, জর্জ লিখুক, আর আমি কাজগুলো করব,’ বললাম তাকে।
প্রথমে যে তালিকাটা আমরা বানালাম তা বাতিল করতে হলো। এটা পরিষ্কার হয়ে উঠল যে অপরিহার্য বলে যেসব জিনিস আমরা তালিকাভুক্ত করেছিলাম সেগুলো বোঝাই করার মত অত বড় নৌকা নিয়ে টেম্স নদীর উজানে যাওয়া যাবে না। কাজেই প্রথম তালিকাটা ছিঁড়ে ফেলে আমরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম!
জর্জ বলল, ‘বুঝলে দোস্তরা, আমরা একদম ভুলভাবে চিন্তা করছি। কোন কোন্ জিনিস আমাদের কাজে লাগবে সেটা নয়, আমাদের ভাবা উচিত শুধু কি কি না হলে আমাদের চলবে না সেটা।’
আমাদের জর্জ একেক সময় এমন খাঁটি বিবেচকের মত কথা বলে যে শুনে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন। আমি এটাকে প্রজ্ঞা বলব। শুধুমাত্র বর্তমান ক্ষেত্রে নয়, সাধারণভাবে জীবন নদীতে আমাদের যাত্রা সম্পর্কেও। জীবন নদীর সেই যাত্রায় কত লোক আনন্দ আর আরামের জন্যে অপরিহার্য ভেবে কত বাজে জিনিস—সত্যিকারের অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল দিয়ে কানায় কানায় বোঝাই করে তরণী ভাসায়, যাতে যে কোন সময় ভরাডুবি হয়ে যেতে পারে।
ছোট্ট নৌকাটির মাস্তুল পর্যন্ত তারা বোঝাই করে ফেলে রকমারি পোশাক—আশাক, বড় বড় দালান-কোঠা, ফালতু চাকর-বাকর, রংবাজ ইয়ারদোস্তের দঙ্গল (এরা তাদের জন্যে এতুটুকুও ভাবে না এবং তারাও এদের জন্যে থোড়াই চিন্তা করে), কেউ উপভোগ করে না এমন সব আমোদ-প্রমোদ, আনুষ্ঠানিকতা আর জাঁকজমকে। তারা বোঝাই করে আহা, সব চাইতে ভারি আর পাগলামিপূর্ণ জঞ্জালটি—প্রতিবেশী কি ভাববে সেই ভয়টি। তারা নৌকায় তুলে নেয় সৌখিন সব জিনিসপত্র—যা শুধু দেয় অতৃপ্তি, ফূর্তি আনন্দের ব্যবস্থা—যা কেবল এনে দেয় ক্লান্তি, ফাঁকা তামাশা—যা প্রাচীনকালের কয়েদীদের মাথায় পরানো লোহার মুকুটের মত শুধু রক্ত ঝরায় এবং অসহ্য মাথাব্যথায় প্রাণান্ত করে তোলে।
ওরে মানুষ, এই সব কিছুই অপ্রয়োজনীয় এবং বর্জনীয়। ছুঁড়ে ফ্যাল্ তুই এসব নৌকা থেকে। এগুলো নৌকাকে ভারি করে দেয়, ফলে গুণ টানতে কষ্ট হয়। দাঁড় বাইতে বাইতে তুই প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়িস। এগুলো সামলানোও . কষ্টকর এবং বিপজ্জনক। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা থেকে তুই এক লহমার জন্যেও নিষ্কৃতি পাস না। কখনও পাস না মুহূর্তের জন্যে স্বপ্নিল আলস্যের কোলে গা এলিয়ে দেয়ার অবকাশ। তোর সময় নেই বালুবেলায় বাতাসে আন্দোলিত ছায়ার কাঁপন এক পলক চেয়ে দেখার, তীরে দাঁড়িয়ে নদীর জলে আপন প্রতিবিম্ব দেখার, সবুজ আর সোনালী রঙে ছাওয়া বনভূমির দিকে তাকাবার, ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের মাথায় নৃত্যরত সূর্য কিরণের ঝিকমিকি উপভোগ করার। তোর সময় নেই সাদা আর হলদে লিলিফুল, নলখাগড়া, অর্কিড, নীল ‘ফরগেট মি নট’-এর সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করার।
বাজে, অপ্রয়োজনীয় জিনিস সব ছুঁড়ে ফেলে দে ওরে মানুষ! তোর জীবনের নৌকাকে হালকা কর। কেবল দরকারি জিনিস নে–একটা ছোটখাট ছিমছাম বাড়ি, সহজ-সরল আমোদ-প্রমোদ, দু’একজন প্রকৃত বন্ধু, তুই যাকে ভালবাসবি এবং যে তোকে ভালবাসবে এ রকম একটা বেড়াল, একটা কুকুর, একটা কি দুটো পাইপ, যথেষ্ট খাবার আর কাপড়-চোপড় এবং যথেষ্টর চাইতে একটুখানি বেশি পানীয়—যেহেতু তৃষ্ণা একটা বিপজ্জনক বস্তু।
তুই দেখবি যে নৌকা বাওয়া সহজতর হয়ে উঠেছে এবং ওটা সহজে উল্টে যাবে না। আর উল্টে যদি যায়ও দৈবাৎ, ওতে বেশি কিছু আসবে যাবে না। সাদামাঠা জিনিসপত্র পানিতে বিশেষ নষ্ট হয় না। তুই চিন্তা আর কাজের সময় পাবি। সময় পাবি জীবনের সূর্যকিরণে অবগাহনের, ঈশ্বরের বাতাসে ভেসে আসা আমাদের চারপাশের মানুষদের হৃদয়তন্ত্রী হতে উৎসারিত স্বর্গীয় সঙ্গীতের সুমধুর ধ্বনি কান পেতে শোনার।
মাফ করবেন। সত্যি আমি আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। হ্যাঁ, তালিকা তৈরির কাজটা আমরা জর্জের হাতেই ছেড়ে দিলাম এবং সে তা শুরু করল।
‘আমরা তাঁবু নেব না,’ প্রস্তাব করল জর্জ। ‘ছইওয়ালা নৌকা নেব। ওটা অনেক সহজ ও আরামদায়ক হবে।’
ওর চিন্তাটা মনে হলো বেশ ভালই। আমরা তা মেনে নিলাম। আমি যে জিনিসটার কথা বলতে চাচ্ছি সেরকম কিছু আপনারা কখনও দেখেছেন কিনা জানিনে। ছই বা ছাউনি লাগাতে হলে নৌকার ওপরে লোহার পতর বসিয়ে তার ওপর একটা ক্যানভাস বিছিয়ে ওটাকে দু’ধারে এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত শক্ত করে আটকে দিন। ব্যস্ হয়ে গেল একটা ছোটখাট ঘরের মত। একটু গাদাগাদি হলেও বেশ আরামদায়ক। তবে কি জানেন, সব কিছুতেই খুঁত থাকে—যেমন বলেছিল সেই লোকটা যার শাশুড়ী মরার পর পড়শীরা এসে ধরেছিল দাফন—কাফনের খরচ দেয়ার জন্যে।
জর্জ বলল, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককে একটা করে কম্বল, একটা লণ্ঠন, কয়েকটা সাবান, চিরুনি (সকলের ব্যবহারের জন্যে), একটা করে দাঁতের ব্রাশ, পানির গামলা, কিছুটা দাঁত মাজার পাউডার, দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম এবং স্নানের জন্যে কয়েকটা বড় তোয়ালে নিতে হবে। আমি লক্ষ করেছি যে পানির কাছাকাছি কোন জায়গায় যেতে হলেই লোকে স্নানের জন্যে পেল্লায় রকমের বন্দোবস্তে লেগে যায়, কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তেমন বেশি স্নান-টান তারা করে না।
সাগরতীরে যাওয়ার বেলায়ও এমনটিই ঘটে। লণ্ডনে বসে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গেলে আমি সব সময় সিদ্ধান্ত করি যে প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে ব্রেকফাস্টের আগেই সাগরে গিয়ে ডুব মেরে আসব। আমি নিষ্ঠার সঙ্গে একজোড়া ইজের ও একটি তোয়ালে গুছিয়ে নি। লাল রঙের স্নানের তোয়ালেই আমি কিনি সব সময়, আর লাল ইজের পরা অবস্থায় নিজেকে কল্পনা করতে আমার কিছুটা ভালই লাগে। ওগুলো আমার গায়ের রঙের সাথে বেশ খাপ খায়। কিন্তু সাগরতীরে পৌঁছার পর অত সকালের স্নানটা কেন যেন শহরে থাকতে যতটা মনে হয়েছিল ঠিক ততটা আকাঙ্ক্ষিত বস্তু বলে মনে হয় না।
সাগরতীরে গেলে উল্টো অনুভূতি জাগে। ইচ্ছে হয় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পড়ে থাকি বিছানায়, তারপর উঠে ব্রেকফাস্টটা সেরে নি। একবার কি দু’বার অবশ্য পবিত্র চেতনার জয় হয়েছে, ছ’টায় উঠে আধা পোশাক পরে, ইজের-তোয়ালে নিয়ে টলমল পায়ে বিষণ্ন মুখে বেরিয়েও পড়েছি। কিন্তু কোন আনন্দ পাইনি ওতে। খুব ভোরে সমুদ্র-স্নানে গেলেই এক বিশেষ ধরনের হাড়কাঁপানো কনকনে পুবালী হাওয়া যেন আমার জন্যে ওঁৎ পেতে থাকে। তিনকোনা পাথরগুলোকে যেন কুড়িয়ে এনে পেতে রাখা হয়। নুড়িগুলোকে যেন ধারাল করে বালি দিয়ে ঢেকে রাখা হয় যাতে ওগুলো আমি না দেখি। সাগরটাকে যেন সরিয়ে দেয়া হয় মাইল দু’য়েক দূরে যাতে দু’বাহু দিয়ে বুকটা জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে লাফাতে লাফাতে ইঞ্চি ছয়েক গভীর পানি মাড়িয়ে আমাকে এগিয়ে যেতে হয়। আর এমনি করে সাগর তক পৌঁছে দেখি যে ওটা তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ এবং রীতিমত অপমানজনক।
বিশাল একটা ঢেউ এসে ধরে ফেলে আমাকে। আছড়ে ফেলে দেয় একটা শিলার ওপর যথাসম্ভব জোরে। শিলাটিকে যেন রেখে দেয়া হয়েছে ওখানে আমার জন্যেই। আহা-উহু করে দেহের কোন অংশ থেকে কিছু খোয়া গেছে কিনা সেটা পরখ করার আগেই ফিরে আসে ঢেউটা, টেনে নিয়ে যায় আমাকে সাগরের মাঝখানে। পাগলের মত হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরে তীরে আসার চেষ্টা করি আমি। ভাবতে থাকি আর কোনদিন ঘরে ফিরে যেতে, বন্ধু-বান্ধবদের দেখতে পাব কিনা। আফসোস করি, আহা ছেলেবেলায় (অর্থাৎ আমি যখন ছেলে ছিলাম) ছোট বোনটাকে যদি একটুখানি স্নেহ করতাম! বাঁচার সব আশাই যখন ছেড়ে দি ঠিক তখনই আরেকটা ঢেউ এসে আমাকে এনে ফেলে একেবারে তীরে। তারা মাছের মত চিত হয়ে আমি পড়ে থাকি বালুর বিছানায়। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি—এতক্ষণ জীবন রক্ষার চেষ্টায় আমি সাঁতরাচ্ছিলাম মাত্র দুই ফুট পানির মধ্যে। তখন আবার লাফাতে লাফাতে ফিরে চলি, পোশাক পরি, অতিকষ্টে ধীরে ধীরে ঘরে যাই। সেখানে সবার কাছে ভান করি যেন স্নানটা আমি বেশ উপভোগ করেছি।
বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা কথাবার্তা বলছিলাম এমন ধরনে যেন প্রতি ভোরে দীর্ঘ স্নান-যাত্রায় চলেছি। জর্জ বলল, ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় ঘুম থেকে উঠে নির্মল নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া দারুণ আনন্দের ব্যাপার। হ্যারিস বলল, ক্ষুধা বৃদ্ধির জন্যে ব্রেকফাস্টের আগে স্নান করে ফেলার মত উপকারী আর কিছুই নেই। সকালে স্নান করলে ক্ষুধা বাড়বেই। জর্জ বলল, স্নানের ফলে যদি হ্যারিস সাধারণত যে পরিমাণ খায় তার চাইতে বেশি খেতে থাকে তাহলে হ্যারিসের স্নানের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ করা উচিত।
সে আরও বলল যে নদীর উজানে গুণ টেনে নৌকা নিয়ে যাওয়া এমনিতেই কঠোর পরিশ্রমের কাজ। হ্যারিসের জন্যে বাড়তি খাবার নিতে হলে কাজটা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই হ্যারিসের স্নান করাই উচিত হবে না।
যাক, আমি জর্জকে বোঝালাম হ্যারিসকে দিয়ে নৌকাটা ধোয়া মোছা করিয়ে নেয়াটা কেমন মজাদার ব্যাপার হবে। তার জন্যে এমনকি আরও কয়েক হন্দর বাড়তি খাবার নিতে হলেও। আমার মতলব বুঝতে পারল সে এবং হ্যারিসের স্নানকর্মের বিরোধিতা প্রত্যাহার করল।
শেষ পর্যন্ত আমরা একমত হলাম যে তিনটা স্নানের তোয়ালে নেব যাতে তোয়ালের জন্যে কাউকে অপেক্ষায় থাকতে না হয়! পোশাক-আশাকের ব্যাপারে জর্জ বলল যে দুটো করে ফ্লানেলের সুট নিলেই চলবে আমাদের। ময়লা হয়ে গেলে টেমস্ নদীতে ধুয়ে নিতে পারব।
আমরা জানতে চাইলাম সে নিজে কখনও নদীতে ফ্লানেল ধুয়েছে কিনা। সে জবাব দিল, না, ঠিক নিজে নয়, তবে তার জানামতে কিছু লোক ধুয়েছে এবং কাজটা বেশ সহজ।
মনের দুর্বলতার কারণে হ্যারিস আর আমি ধরে নিলাম যে জর্জ যা বলেছে জেনেশুনেই বলেছে এবং প্রভাব-পদবীহীন তিনজন ভদ্র যুবক কাপড় ধোলাইয়ের কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই একটুখানি সাবান দিয়ে নিজ নিজ জামা-কাপড় সত্যিই টেমস নদীতে ধুয়ে নিতে পারবে।
পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা জানতে পারব জর্জ কি জঘন্য প্রতারক এবং স্পষ্টতই ব্যাপারটা সম্পর্কে তার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। কিন্তু ওটা আমরা টের পাব বড় দেরিতে। ধোয়ার পর আমাদের জামা-কাপড়গুলোর চেহারা যদি আপনারা দেখতেন!
জর্জ আমাদেরকে বোঝাল বাড়তি অন্তর্বাস আর প্রচুর মোজা নিতে। নৌকা উলটে গেলে বা বদলানোর দরকার হলে ওগুলো কাজে লাগবে। বেশি করে রুমালও সে নিতে বলল, কারণ জিনিসপত্র মুছতে ওগুলো লাগবে। সে বলল, এক জোড়া করে বুট এবং নৌকায় পরার মত জুতোও আমাদের নেয়া উচিত, কারণ নৌকা উল্টে গেলে ওগুলো কাজে আসবে।