উনিশ
আমরা দু’টি আনন্দময় দিন কাটালাম অক্সফোর্ডে। অক্সফোর্ড শহরে অনেক কুকুর আছে। মণ্টমোরেন্সি প্রথম দিন এগারোবার লড়াই করেছে, দ্বিতীয় দিন করেছে চোদ্দবার। মণ্টমোরেন্সি স্পষ্টত ভাবছে সে স্বর্গে পৌঁছে গেছে।
দৈহিক গঠনের দিক থেকে দুর্বল, কিংবা বেশি আসে লোকের মধ্যে একটা সাধারণ রীতি হচ্ছে উজানে নৌকা বেয়ে আনন্দ পেতে হলে অক্সফোর্ড থেকে নৌকা নিয়ে ভাঁটির দিকে দাঁড় বেয়ে চলে যাওয়া। তবে যাদের উৎসাহ উদ্যম আছে তাদের উজানে নৌকা বেয়ে যাওয়াই উচিত। পিঠ সোজা এবং টানটান করে, স্রোতের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে বেশি সন্তুষ্টি রয়েছে—আমার অন্তত এরকমই মনে হয়, যখন হ্যারিস আর জর্জ দাঁড় টানে এবং আমি হাল ধরি।
যারা অক্সফোর্ড থেকে যাত্রা করার কথা ভাবে তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলব, তোমরা নিজেদের নৌকা নিয়ে যাও—যদি না, অবশ্য, ধরা পড়ার সম্ভাব্য বিপদ ছাড়া অন্যের নৌকা নিয়ে যেতে পারো। মার্লোর পরে টেম্স নদীতে যেসব নৌকা ভাড়া দেয়া হয় সেগুলো সাধারণত খুবই ভাল নৌকা। ওগুলোতে মোটামুটি পানি না ওঠার ব্যবস্থা আছে এবং যত্নের সঙ্গে চালালে ওগুলো খুব কমই ভেঙে টুকরা টুকরা হয় বা ডুবে যায়। ওগুলোতে বসার জায়গা এবং দাঁড়টানা ও হাল ধরার ব্যবস্থাদিসহ প্রয়োজনীয় সব বন্দোবস্তই আছে।
কিন্তু সৌন্দর্য নাই ওই নৌকাগুলোর। মার্লোর উজানে যেসব নৌকা ভাড়া দেয়া হয় সেগুলোতে চড়ে জাঁক দেখিয়ে বেড়ানো বা বাহাদুরি করা যায় না। ভাড়া দেয়া নৌকা আরোহীদের ওরকম যে কোন পাগলামিকে সঙ্গে সঙ্গেই থামিয়ে দেয়। এটাই এ-নৌকার প্রধান এবং বলা যায়, একমাত্র গুণ।
ভাড়া দেয়া নৌকার আরোহী নম্র এবং লাজুক ধরনের হয়। সে তীর ঘেঁষে গাছের ছায়ায় ছায়ায় এবং বেশিরভাগ সময় খুব ভোরবেলায় কিংবা গভীর রাতে নৌকা চালাতে চায়। সেই সময় নদীতে বেশি লোক থাকে না তার দিকে তাকাবার জন্য।
চেনাজানা কাউকে দেখলে ভাড়া দেয়া নৌকার আরোহী তীরে উঠে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে।
আমি একবার এক দলে ছিলাম যারা কয়েকদিনের জন্য একটা নৌকা ভাড়া করে। ভাড়া দেয়া নৌকা আমরা কেউই আগে দেখিনি এবং যখন দেখলাম, বুঝতে পারলাম না ওটা কি।
আমরা চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম যে একটা নৌকা—একটা ডবল দাঁড়ের ডিঙ্গি আমাদের দরকার। পোটলা-পুটলি নিয়ে নৌকা-ঘাটায় গিয়ে নাম-ধাম বলার পর লোকটা বলে উঠল, ‘ওহ্ হ্যাঁ, আপনারাই চিঠি লিখেছিলেন ডবল দাঁড়ের ডিঙ্গি চেয়ে। ঠিক আছে। জিম, যাও তো, টেম্স-এর গৌরবকে নিয়ে এসো।
ছেলেটি গেল এবং পাঁচ মিনিট পরে মহাপ্লাবনের যুগের একখণ্ড কাঠ টানতে টানতে ফিরে এল। কাঠটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে সম্প্রতি ওটাকে কোন জায়গা থেকে মাটি খুঁড়ে তোলা হয়েছে এবং কাজটা করা হয়েছে অযত্নে, যার ফলে জিনিসটা অযথা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।
বস্তুটা প্রথম দেখে আমার নিজের ধারণা হলো যে ওটা কোন এক ধরনের রোমান জিনিসের ধ্বংসাবশেষ, কিসের ধ্বংসাবশেষ জানি না, হয়তো বা কফিনের।
টেম্স নদীর ওপর দিকের আশেপাশে রোমান যুগের প্রচুর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। কাজেই মনে হলো যে আমার অনুমানটা সঠিক হওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু আমাদের বেরসিক তরুণ সাথীটি—যে ছিল কিছুটা ভূতত্ত্ববিদ —সে ফুৎকারে উড়িয়ে দিল আমার রোমান ধ্বংসাবশেষের তত্ত্বটি। সে বলল যে ন্যূনতম বুদ্ধির অধিকারী (আমাকে ওই শ্রেণীতে ফেলতে পারছে না বলে তাকে মনে হলো দুঃখিত) লোকের কাছেও এটা পরিষ্কার যে ছেলেটি যে বস্তুটা নিয়ে এসেছে ওটা একটা তিমির ফসিল। এবং সে আমাদেরকে নানা চিহ্ন ও লক্ষণ দেখাল যা প্ৰমাণ করে যে ফসিলটা প্রাক-তুষার যুগের।
তর্কের নিষ্পত্তির জন্য আমরা ছেলেটির শরণাপন্ন হলাম। তাকে বললাম—ভয় না করে সোজা সরল সত্য কথাটি বলে দিতে: ওটা কি কোন প্রাক-আদম যুগের তিমির ফসিল, নাকি আদি যুগের রোমান কফিন?
ছেলেটি বলল ওটা ‘টেম্স-এর গৌরব।’
ছেলেটির উক্তিকে আমরা প্রথমে রসিকতা বলে মনে করলাম। কেউ হয়তো এরকম রসিকতা করার জন্য তাকে দুই পেনি পুরস্কার দিয়েছে। কিন্তু ওই ঠাট্টাটি সে বারে বারে এবং আমাদের বিবেচনায় অনেকক্ষণ ধরে আওড়াতে থাকায় আমরা তার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠলাম
আমাদের ক্যাপ্টেন ধমকের সুরে বলল, ‘হয়েছে বাবা, হয়েছে। আমাদেরকে ওসব গাঁজাখুরী গল্প শুনিয়ো না। তোমার মায়ের কাপড় কাচার গামলাটা আবার বাড়ি নিয়ে যাও এবং আমাদের জন্য একটা নৌকা নিয়ে এসো।
তখন নৌকা-নির্মাতা মিস্ত্রী নিজেই এসে আমাদেরকে নিশ্চয়তা দিল। একজন কাজের লোক হিসাবে মুখের জবান দিয়ে সে বলল যে জিনিসটা সত্যিই নৌকা এবং আমাদেরকে নদীপথে নিয়ে যাবার জন্য ‘ডবল দাঁড়ের ডিঙ্গি’ হিসাবে কার্যত ওটাকেই বেছে রাখা হয়েছে।
আমরা অনেক গাঁইগুঁই করলাম। ভাবলাম ওটা যে কোন ভাঙাচোরা জঞ্জাল নয় তা বোঝাবার জন্য সে তো অন্তত একটুখানি চুনকাম করতে বা আলকাতরা লাগিয়েও দিতে পারত। কিন্তু সে ওটার মধ্যে কোন ত্রুটিই দেখতে পেল না।
আমাদের মন্তব্যে তাকে বরং অসন্তুষ্ট হতে দেখা গেল। সে বলল যে আমাদের জন্য সে তার স্টকের সেরা নৌকাটাই বেছে রেখেছে এবং সে মনে করে যে আমাদের আরও কৃতজ্ঞতাবোধের পরিচয় দেয়া উচিত ছিল।
সে বলল ‘টেম্স-এর গৌরব’ এখন যেভাবে আছে ঠিক সেই অবস্থায় তার জানামতে গত চল্লিশ বছর ধরে চালু আছে এবং এর আগে কেউ ওটার ব্যাপারে কোন নালিশ করেনি। সুতরাং সে বুঝতে পারছে না আমরা কেন অভিযোগ করছি।
আমরা আর তর্ক করলাম না।
কয়েক টুকরা দড়ি দিয়ে তথাকথিত নৌকাটাকে কষে বেঁধে দিলাম আমরা। কিছু ওয়ালপেপার নিয়ে বিশ্রী জায়গাগুলোর ওপর সেঁটে দিলাম। তারপর মনে মনে প্রার্থনা সেরে চড়ে বসলাম ওটাতে।
ওই ধ্বংসাবশেষের ছয় দিনের ভাড়া হিসাবে তারা আমাদের কাছে পঁয়ত্রিশ পাউণ্ড দাবি করল। উপকূলে ভেসে আসা কাঠের যে কোন নিলামে গোটা জিনিসটাই আমরা কিনে ফেলতে পারতাম চার শিলিং ছয় পেন্স দিয়ে।
তৃতীয় দিন আবহাওয়া বদলে গেল—ওহো! আমি এখন আমাদের বর্তমান ট্রিপের কথা বলছি। আমরা অক্সফোর্ড থেকে একটানা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির পথে যাত্রা করেছিলাম।
সূর্যালোক হচ্ছে প্রকৃতির জীবন-শোণিত। সূর্যালোক নিবে গেলে মা ধরিত্রী কি নির্জীব প্রাণহীন চোখে তাকায় আমাদের দিকে। তখন তার বুকে থাকতে আমাদের দুঃখ লাগে। মনে হয় সে আমাদের চেনে না, আমাদের নিয়ে ভাবে না। তাকে দেখায় এক বিধবার মত—যে তার প্রিয় স্বামীকে হারিয়েছে। সন্তানেরা তার হাত ছুঁয়ে চোখে দৃষ্টি রাখে, কিন্তু হাসে না সেই বিধবা।
গোটা দিন দাঁড় বাইলাম আমরা। কাজটা ছিল বড় বিষাদময়। আমরা প্রথমে ভান করলাম যেন উপভোগ করছি কাজটা। আমরা বললাম যে ওটা একটা সুযোগ, নদীকে তার সকল অবস্থার মধ্যে দেখতে চাই আমরা। বললাম, সব সময় যে রোদ থাকবে তা আমরা আশা করতে বা চাইতে পারি না। পরস্পরকে আমরা বুঝালাম যে প্রকৃতি সুন্দর, এমনকি ক্রন্দনরত অবস্থাতেও।
‘সত্যি, হ্যারিস আর আমি পয়লা কয়েক ঘণ্টা কাজটার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী ছিলাম। এক জিপসীর জীবন নিয়ে রচিত গান গাইতে থাকি আমরা। জিপসীর জীবন কি আনন্দের! ঝড়, রোদ, বাতাস থেকে মুক্ত! কি আমোদই না সে পায় বৃষ্টিতে, কি হাসিই না সে হাসে সেই লোকদের নিয়ে যারা বৃষ্টিকে ভালবাসে না।
জর্জ আমাদের আমোদে যোগ না দিয়ে ছাতা আঁকড়ে থাকে।
লাঞ্চের আগে আমরা ক্যানভাসের ঢাকনাটা লাগিয়ে ফেলি। গোটা বিকেল থাকে ওটা মাথার ওপর। শুধু সামনের দিকে একটুখানি জায়গা খোলা রাখি যাতে আমাদের একজন দাঁড় টানতে এবং নদীর দিকে দৃষ্টি রাখতে পারে। এইভাবে নয় মাইল গিয়ে ডে-র লকের একটু আগে রাতের জন্য নৌকা থামাই।
আমি সততার সঙ্গে বলতে পারি না যে সন্ধেটা আমাদের আনন্দে কেটেছে। বৃষ্টি ঝরছিল অবিরাম। নৌকায় সবকিছু ভিজে চটচটে হয়ে গিয়েছিল। রাতের খাওয়াটা মোটেও জমেনি। হ্যারিস তার পাতের অভুক্ত খাবারটা মন্টমোরেন্সিকে বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু মন্টমোরেন্সি সেটা গ্রহণ করে না। হ্যারিসের বদান্যতায় স্পষ্টত অপমান বোধ করে সে নৌকার অপর পাশে সরে গিয়ে একা বসে থাকে।
এরপর আর কিছু করার না থাকায় আমরা শুয়ে পড়ি—অর্থাৎ কাপড়-জামা ছেড়ে ঘণ্টা তিন চার নৌকার তলদেশে শুয়ে আছাড় খাই। সকাল পাঁচটায় জেগে আমরা ব্রেকফাস্ট করি।
দ্বিতীয় দিনটা ছিল ঠিক প্রথম দিনের মত। বৃষ্টি হচ্ছিল অঝোরধারায়। আপাদমস্তক বর্ষাতি জড়িয়ে আমরা বসে থাকি ক্যানভাসের নিচে। নৌকা ধীরে ধীরে ভেসে যেতে থাকে ভাঁটির দিকে।
আমাদের একজন—এখন মনে পড়ছে না কে, তবে মনে হয় যে আমি নিজেই, ওই দিন সকালে সেই পুরানো জিপসী বোকামিটা— তাদের প্রকৃতির সন্ত ান হওয়া এবং বৃষ্টিবাদল উপভোগ করার কাহিনী নিয়ে তৈরি গানটা গাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু ওটা তেমন জমেনি। সেই—
‘আমি পরোয়া করি না বৃষ্টির,
পরোয়া করি না!”
আমাদের প্রত্যেকের অনুভূতির এমন বেদনাকর অভিব্যক্তি যে ওটা গাওয়ার আর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না আমাদের।
একটি বিষয়ে আমরা একমত ছিলাম। তা হচ্ছে এই যে যাই ঘটুক না কেন, আমরা এর শেষ পর্যন্ত দেখব। আমরা পক্ষকালের জন্য ফূর্তি করতে নদীতে এসেছি এবং পক্ষকাল আমরা-আমোদ ফূর্তি করব নদীতে। এতে যদি আমাদের জীবনও যায়—হ্যাঁ, আমাদের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনের জন্য ওটা দুঃখের ব্যাপারই হবে বটে, তবে কিছুই করার নেই এতে। আমরা অনুভব করি, যে আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে গেছি তার কাছে হার মানলে একটা খুব খারাপ নজীর সৃষ্টি হবে।
হ্যারিস বলে, ‘আর মাত্র দুই দিন বাকি, আমরাও তরুণ এবং শক্তিমান। আমরা শেষ পর্যন্ত উৎরে যেতে পারি।’
বিকাল চারটার দিকে আমরা সন্ধ্যার ব্যবস্থাদি নিয়ে আলোচনা শুরু করি। আমরা গোরিং ছেড়ে একটুখানি এগিয়েছি। ঠিক করি যে প্যাংবোর্ন পর্যন্ত দাঁড় বেয়ে গিয়ে ওখানেই রাত কাটাব।
আরেকটি আনন্দময় সন্ধ্যা!’ বিড়বিড় করে বলে জর্জ।
‘রাতের খাওয়াটা সেরে নেয়া যায়,’ বললাম আমি অর্ধসচেতনভাবে।
‘হ্যাঁ, পরিতাপের বিষয় আমরা এই নৌকায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,’ জবাব দেয় হ্যারিস। তারপর সবাই চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
‘এই জঘন্য জীর্ণ কফিনটার ভেতর নিশ্চিত মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্ত যদি আমরা না নিয়ে থাকি তাহলে উল্লেখ করা যায় যে পাঁচটার একটু পরেই প্যাংবোর্ন থেকে একটা ট্রেন ছাড়ে বলে আমি জানি। ওই ট্রেন আমাদেরকে রাতের খাওয়ার সময়ের আগেই বেশ আরামে শহরে পৌঁছে দেবে তারপর তুমি যে জায়গার কথা বললে ওখানে যাওয়া যাবে।’ মন্তব্য করল জর্জ নৌকাটার দিকে গভীর হিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
কেউ কিছু বলে না। ‘ আমরা তাকাই একে অন্যের দিকে। প্রত্যেকেই অন্যদের চোখেমুখে নিজের নীচ ও দোষী ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই। নীরবে আমরা গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগটা টেনে নিয়ে জিনিসপত্র ভরে ফেলি। নদীর সামনে পেছনে তাকিয়ে দেখি, কোথাও কোন জনপ্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নাই!
বিশ মিনিট পরে হয়তো লোকে দেখে থাকবে যে তিনটি মানুষ, পেছনে একটি লজ্জিত চেহারার কুকুর নিয়ে সোয়ানের বোট-হাউস থেকে চুপচাপ বেরিয়ে চোরের মত চলে যাচ্ছে রেল-স্টেশনের দিকে। তাদের পোশাক ছিল এরকম।
কালো চামড়ার জুতো—নোংরা, নৌকায় ব্যবহারযোগ্য ফ্লানেলের সুট—অত্যন্ত নোংরা, খাকি রঙের ফেল্ট হ্যাট—অনেক দুমড়ানো, বর্ষাতি—-খুবই ভিজা এবং ছাতা।
প্যাংবোর্নে আমরা নৌকাওয়ালাকে ধোঁকা দিয়েছিলাম। আমরা যে বৃষ্টি থেকে রেহাই পাবার জন্য পালিয়ে যাচ্ছি সেকথা তাকে বলার মত মুখ ছিল না আমাদের। আমরা নৌকাটা সব মালামালসুদ্ধ তার জিম্মায় রেখে চলে আসি নির্দেশ দিয়ে আসি, সে যেন পরদিন সকাল ন’টায় আমাদের জন্য তৈরি থাকে। যদি, আমরা বলি, যদি কোন কারণে ফিরতে না পারি তাহলে তাকে চিঠি লিখে জানাব।
সাতটায় আমরা পৌঁছে যাই পেডিংটনে। সেখানে গিয়ে সোজা চলে যাই আমার পূর্ব-বর্ণিত রেস্তোরাঁয়। ওখানে হালকামত খাওয়া-দাওয়া করে মণ্টমোরেন্সিকে রেখে বলে দিই যে সাড়ে দশটায় যেন আমাদের খাবার তৈরি থাকে। তারপর চলে যাই লেস্টার স্কোয়ারে।
আলহামরাতে আমাদের প্রতি সবারই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। পে-বক্সে গিয়ে নাম—ধাম জানাতেই আমাদেরকে বলা হয় ক্যাল স্ট্রীটে যেতে, আমাদেরকে জানানো হয় যে আমরা আধঘণ্টা দেরিতে পৌঁছেছি।
অনেক কষ্টে লোকটাকে বুঝাই যে আমরা হিমালয় থেকে আগত বিশ্ববিখ্যাত শারীরিক কসরৎ প্রদর্শনকারী নই।’ তখন সে টাকা পয়সা নিয়ে আমাদেরকে ঢুকতে দেয়।
ভেতরে গিয়ে আমরা আরও বড় রকমের সাফল্য লাভ করি। সবাই প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখতে থাকে আমাদের রোদে পোড়া চমৎকার তামাটে মুখ ও ছবির মত বিচিত্র পোশাক। আমরা প্রত্যেকের চোখের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হই।
আমাদের সবার জন্য এটা ছিল এক গৌরবের মুহূর্ত।
প্রথম ব্যালের পর আমরা বেরিয়ে গিয়ে রেস্তোরাঁয় ফিরে যাই। সেখানে আমাদের জন্য খাবার তৈরি।
ওই খাওয়াটা যে আমি উপভোগ করেছিলাম সেকথা স্বীকার করতেই হবে। প্রায় দশদিন আমরা কোল্ড মিট, কেক, রুটি, জ্যাম ছাড়া যেন আর কিছুই না খেয়ে কাটিয়েছি। যা খেয়েছি তা ছিল সাদাসিধে পুষ্টিকর খাদ্য। কিন্তু তার মধ্যে উত্তেজনাকর কিছু, বার্গাণ্ডির সুগন্ধ, ফরাসী সসের ঘ্রাণ, পরিষ্কার ন্যাপকিনের দৃশ্য, লম্বা পাউরুটি—এসব ছিল না।
কিছুক্ষণ নীরবে গোগ্রাসে গিলে যাই। তারপর একটা সময় এল যখন সোজা হয়ে বসার পরিবর্তে আমরা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছুরিকাঁটা শক্ত হাতে ধরে ধীরে ধীরে অবহেলাভরে খেতে থাকি। পা মেলে দিই টেবিলের নিচে, ন্যাপকিনকে পড়ে যেতে দিই মেঝের ওপর। মাঝে মাঝে সিলিং-এর দিকে সমালোচকের দৃষ্টিতে তাকাই। অনেকদিন এরকম করার সুযোগ-সময় পাইনি আমরা। তারপর গ্লাসগুলো নামিয়ে রাখি টেবিলে। বেশ ভাল লাগতে থাকে আমাদের কাছে। আমরা ভাবুক ও চিন্তাশীল হয়ে উঠি। তখন হ্যারিস জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়।
বৃষ্টিস্নাত রাস্তা যেন ঝিকমিক করছিল। ক্ষীণ দীপশিখাগুলো কাঁপছিল বাতাসের ঝাপটায়। বৃষ্টির পানি জমে যাচ্ছিল এবং গড়িয়ে নামছিল ড্রেনের ভেতর। কিছু বৃষ্টিতে ভেজা লোক ছাতা মাথায় জড়োসড়ো হয়ে চলে যাচ্ছিল দ্রুত পায়ে। মেয়েরা হাঁটছিল স্কার্ট উঁচিয়ে।
গ্লাসের জন্য হাত বাড়িয়ে হ্যারিস বলে, ‘আমরা একটা চমৎকার ট্রিপ দিয়ে এসেছি এবং এর জন্য বাবা টেম্সকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তবে আমি মনে করি যে যখন আমরা কেটে পড়েছি ওই সময় কেটে পড়াটা ঠিকই হয়েছে। এসো আমরা নৌকা প্রত্যাগত ত্রিরত্নের উদ্দেশ্যে পান করি!’
মণ্টমোরেন্সি জানালার সামনে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে একটা সংক্ষিপ্ত ঘেউ শব্দ করে আমাদের টোস্টকে সমর্থন করল।
***