আঠারো
পরদিন সকালে আমরা বিদায় নিলাম স্ট্রীট্লি থেকে। কালহ্যামে পৌঁছে রাত কাটালাম নৌকায় ক্যানভাসের নিচে।
স্ট্রীট্লি থেকে ছ’মাইল এগিয়ে গেলে ওয়েলিংফোর্ড। এটি একটা অত্যন্ত প্রাচীন শহর। ইংরেজদের ইতিহাস গঠনের একটা সক্রিয় কেন্দ্র ছিল শহরটি। ব্রিটনদের আমলে এটি ছিল একটা রুক্ষ মাটির তৈরি শহর। রোমের সৈন্যরা এসে ব্রিটনদের ওখান থেকে উৎখাত করে। ব্রিটনদের শুকনো কাদামাটির দেয়ালগুলো ভেঙে ওরা গড়ে তোলে শক্তিশালী দুর্গ। মহাকাল এখনও পারেনি সেই দুর্গ প্রাকারের চিহ্নগুলো মুছে ফেলতে। প্রাচীন দুনিয়ার রাজমিস্ত্রীরা কি দক্ষ নির্মাতাই না ছিল।
কিন্তু রোমান দুর্গ প্রাকারের সামনে এসে থেমে গেলেও মহাকাল শিগগিরই রোমানদেরকে ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো করে দেয়। পরবর্তী সময়ে সেই মাটির ওপর লড়াইয়ে মত্ত হয় বর্বর স্যাক্সন আর বিশালদেহী ডেনরা। তারপর আসে নরম্যানরা।
পার্লামেন্টের যুদ্ধের সময় পর্যন্ত এটা ছিল একটা দেয়ালঘেরা সুরক্ষিত শহর। এ সময় দীর্ঘদিন ধরে শহরটি অবরুদ্ধ থাকে। শেষ পর্যন্ত এর পতন ঘটে এবং দেয়ালগুলো ধূলিসাৎ করা হয়।
ওয়েলিংফোর্ড থেকে ডরচেস্টার পর্যন্ত নদীর আশপাশটা ক্রমেই বেশি পাহাড়ী, বৈচিত্র্যময় ও ছবির মত হয়ে উঠেছে। নদী থেকে ডরচেস্টারের দূরত্ব আধ মাইল। এটা একটা শান্তিপূর্ণ প্রাচীন জায়গা।
ওয়েলিংফোর্ডের মত ডরচেস্টারও ব্রিটনদের আমলের শহর। তখন এর নাম ছিল কায়ের ডোরেন পানির ওপরকার শহর।’ পরে রোমানরা এখানে এক বিশাল ছাউনি স্থাপন করে এবং তার চারদিকে গড়ে তোলে এক রক্ষা প্রাচীর। ওটাকে এখন দেখায় নিচু সমতল পাহাড়ের মত। স্যাক্সনদের আমলে এটা ছিল ওয়েসেক্স-এর রাজধানী। শহরটা অতি পুরানো, তবে এক সময় এর প্রতাপ ছিল এবং আকারেও এটা ছিল বিশাল। এখন উত্তেজনাময় দুনিয়ার একপাশে সরে বসে শহরটা মাথা নাড়ে আর স্বপ্ন দেখে।
পরদিন খুব ভোরে জেগে উঠলাম, কারণ দুপুরের মধ্যেই আমরা অক্সফোর্ডে পৌঁছে যেতে চাই। বাইরে রাত কাটানোর সময় কত ভোরেই না জেগে ওঠা যায়। নৌকার পাটাতনে কম্বল মুড়ি দিয়ে গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগের ওপর মাথা রেখে শু’লে লোকে আর ‘মাত্র মিনিট পাঁচেক’ চোখ বুজে থাকার জন্য তেমন লোভাতুর হয় না যেমনটা হয়ে ওঠে পালকের বিছানায় শু’লে।
জানি না কেন এরকম হবে, কিন্তু নদীতে এলে সবাই যেন সব সময় অত্যন্ত তিরিক্ষি মেজাজে থাকে। ডাঙায় থাকতে যেসব ছোটখাট অঘটন নজরেই পড়ে না সেগুলো নদীতে ঘটলে লোকে রেগেমেগে একেবারে আগুন হয়ে যায়। হ্যারিস আর জর্জ ডাঙায় চূড়ান্ত আহাম্মকি করলেও আমি প্রশ্রয়ের হাসি হাসতে থাকি কিন্তু নদীতে ওরকম বোকামি করলে আমি এমন ভাষায় ওদেরকে বকি যা শুনলে রক্ত জমে যাবে। অন্য কোন নৌকা আমার পথ আটকালে আমার ইচ্ছা হয় একটা বৈঠা তুলে নিয়ে ওই নৌকার সবাইকে মেরে ফেলি।
ডাঙার ওপর যেসব লোকের মেজাজ অত্যন্ত নরম, নৌকার মধ্যে তারাই হয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর এবং রক্তপিপাসু। আমি একবার এক তরুণীকে নিয়ে নৌকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। মেয়েটির ব্যবহার ছিল অত্যন্ত মিষ্টি এবং যতটা সম্ভব ভদ্র কিন্তু নদীতে যাবার পর তার মুখ থেকে যে ভাষা বেরুল তা শুনে আমি ‘থ’ খেয়ে গেলাম। কোন হতভাগা মাল্লা তার পথে বাধার সৃষ্টি করলেই চেঁচিয়ে উঠত সে, ‘ওহ, কি হারামজাদা লোকটা, কোনদিকে যাচ্ছে দেখতে পায় না কেন ব্যাটা?’
পালটা ঠিকমত না উঠলে ক্রুদ্ধভাবে বলত মেয়েটি, ‘ওহ্, কি ঝামেলা, গোল্লায় যাক ওই বাজে জিনিসটা!’ তারপর ওটাকে ধরে সে ঝাঁকাতে থাকত নিষ্ঠুরভাবে।
অথচ, আমি আগেই বলেছি, ডাঙায় সে ছিল দয়ালু এবং যথেষ্ট ভদ্র।
নদীর বাতাস মানুষের মেজাজের ওপর একটা খারাপ প্রভাব ফেলে। আমার মনে হয়, এর দরুনই এমনকি বজরাওয়ালারাও একেক সময় পরস্পরের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করে এবং এমন খারাপ ভাষা ব্যবহার করে, যার জন্য মেজাজ ঠাণ্ডা হবার পর তারা নিঃসন্দেহে অনুতপ্ত হয়।